প্রত্নকেতকী
কুকুরছানাটা বোধকরি অদৃষ্টপ্রেরিত হইয়াই সেদিন রাস্তায় নামিয়াছিল।
সুবীর সন্ধ্যার সময় স্ত্রীকে লইয়া মোটরে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিল। মাথা-খোলা জাগুয়ার গাড়িটা আস্তে চলিতে জানে না, সামনে সাদান অ্যাভিনিউ-এর খোলা রাস্তা পাইয়া উল্কার বেগে ছুটিয়াছিল।
কুকুরছানা সময় বুঝিয়া ফুটপাথ হইতে রাস্তায় অবতরণ করিল। তারপর মন্থরপদে রাস্তা পার হইয়া চলিল। তাহার আকৃতি অতি ক্ষুদ্র, গায়ের রঙ নোংরা হলুদবর্ণ। সুবীর প্রথমে তাহাকে দেখিতে পায় নাই; যখন দেখিতে পাইল তখন কুকুরছানা ও মৃত্যুর মাঝখানে বিশ গজের ব্যবধান। সুবীর সবেগে ব্রেক কষিল।
স্বামীর পাশে বসিয়া অরুণা এই বেগ-সংহতির জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাহার কপাল ড্যাশ্বোর্ডের গায়ে সজোরে ঢুকিয়া গেল। কপাল কাটিল না বটে, কিন্তু অরুণা একটি ক্ষীণ কাকুতি উচ্চারণ করিয়া সুবীরের গায়ে হেলিয়া পড়িল।
কুকুরছানা চাপা পড়ে নাই, অক্ষত ছিল; সে গুটিগুটি ফিরিয়া গিয়া আবার ফুটপাথে উঠিল। সুবীর দেখিল অরুণা মূর্ছা গিয়াছে। সে ব্যগ্রকণ্ঠে ডাকিল— ‘অরুণা! অরুণা!’
অরুণা সাড়া দিল না। সুবীরের বুকের মধ্যে একবার ধ্বক্ করিয়া উঠিল; তারপর সে মোটর ঘুরাইয়া তীরবেগে চলিল। মাইলখানেক দূরে একটা নার্সিং হোম আছে, সেখানকার ডাক্তার তাহার পরিচিত। —
সুবীর অবস্থাপন্ন বনেদী ঘরের ছেলে। শান্ত শিক্ষিত স্বাস্থ্যবান যুবক, তাহার চরিত্রে একটি অচপল দৃঢ়তা আছে। মাত্র ছয় মাস হইল অরুণার সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে। অরুণা উচ্ছল রূপবতী। আধুনিক আদর্শে কৃশাঙ্গী তন্বী নয়। কিন্তু কালিদাস ও জয়দেবের চোখে বোধকরি ভাল লাগিত; তাহাকে দেখিলে গীতগোবিন্দ ও মেঘদূতের কথা মনে পড়িয়া যায়।
ছয় মাসের বিবাহিত জীবনে তাহারা মনের দিক দিয়া খানিকটা কাছাকাছি আসিয়াছে, কিন্তু একেবারে মিশিয়া গলিয়া একাকার হইয়া যায় নাই। সুবীর নিজের মন-প্রাণ অরুণার কোলে ঢালিয়া দিয়াছে, কিন্তু অরুণার মনের আড়াল এখনও পুরাপুরি ঘুচিয়া যায় নাই। বিবাহ এমন একটি অনুষ্ঠান যাহার ফলে দুইটি যুবক-যুবতী অকস্মাৎ পরস্পরের অতি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে নিক্ষিপ্ত হয়; কিন্তু দৈহিক ঘনিষ্ঠতা ঘটিলেই যে মনের ঘনিষ্ঠতা ঘটিবে এমন কোনও কথা নাই। কাহারও কাহারও মনের কবাট আস্তে আস্তে খোলে, খুলিতে বিলম্ব হয়। —
নার্সিং হোমের ডাক্তার অরুণাকে পরীক্ষা করিয়া বলিলেন— ‘ভয়ের কিছু নেই, সামান্য কংকাশন (Concussion) হয়েছে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই জ্ঞান হবে।’
অরুণার যখন জ্ঞান হইল সুবীর তখন তাহার শয্যাপাশে বসিয়া একাগ্র চক্ষে তাহার মুখের পানে চাহিয়া আছে। অরুণার চোখে কিন্তু মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টি, সে ক্ষণকাল শূন্যে চাহিয়া থাকিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল—‘কেয়ার গন্ধ!’
ডাক্তার বলিলেন—‘সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তিন-চার দিন লাগবে।’
অরুণা নার্সিং হোমেই রহিল। তিন দিন পরে সুবীর অরুণাকে গৃহে লইয়া আসিল। অরুণা এখন সারিয়া উঠিয়াছে, সেই আচ্ছন্ন ভাব আর নাই। তবু, তাহার মুখের হাসি চোখের চাহনি দেখিয়া মনে হয় যে যেন অন্তরের কোন্ সুদূর-লোকে প্রবেশ করিয়াছে, বহির্লোকের সহিত তাহার সম্পর্ক কমিয়া গিয়াছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যে সান্নিধ্য নিবিড় হইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেছিল তাহা আবার শিথিল হইয়া গিয়াছে।
কয়েকদিন লক্ষ্য করিয়া সুবীর নার্সিং হোমের ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করিল। ডাক্তার শুনিয়া বলিলেন— ‘ও কিছু নয়, দু’চার দিনে ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ করুন না, ওঁকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসুন। চেঞ্জ্ লাগলে শিগ্গির আরাম হয়ে যাবেন।’
সুবীর বলিল— ‘কোথায় যাব? শীত এসে পড়ল, এখন তো পাহাড়ে যাওয়া চলবে না।’
ডাক্তার বলিলেন— ‘নাই বা গেলেন পাহাড়ে। অত বড় রাজস্থানের মরুভূমি পড়ে রয়েছে, সেখানে যান।’
রাজস্থানের মরুভূমি! সুবীরের মনে পড়িয়া গেল, তাহার এক দূর-সম্পর্কের ভগিনীপতি মস্তবড় প্রত্নতাত্ত্বিক, তিনি বর্তমানে রাজস্থানের পশ্চিম প্রান্তে খননকার্য চালাইতেছেন। ভালই হইয়াছে, সুবীর অরুণাকে লইয়া রাজস্থানের মরুভূমিতেই যাইবে। নূতন দেশ, নূতন পরিবেশ, অরুণা অচিরাৎ সারিয়া উঠিব।
সে বাড়ি ফিরিয়া গিয়া অরুণার কাছে প্রস্তাব করিল। অরুণা বিশেষ ঔৎসুক্য দেখাইল না, কিন্তু রাজী হইয়া গেল।
তারপর দিন দশেকের মধ্যে রাজস্থানে ভগিনীপতিকে চিঠি লিখিয়া সব রকম ব্যবস্থা করিয়া সুবীর অরুণাকে লইয়া রাজস্থানের পথে বাহির হইয়া পড়িল।
কলিকাতা হইতে রাজস্থানের অপরাস্ত সামান্য পথ নয়, দিল্লীতে ট্রেন বদল করিয়া যাইতে তিন দিন লাগে। মেল ট্রেনের একটি কুপে কামরায় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিতে করিতে অরুণার মন উৎফুল্ল হইয়া উঠিতে লাগিল, চোখে মুখে উৎসুক আগ্রহ দেখা দিল। সে এ-জানালা হইতে ও-জানালায় ছুটাছুটি করিয়া, সুবীরকে নানা বিচিত্র প্রশ্ন করিয়া ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল। অরুণার এই পরিবর্তনে সুবীর পরম আহ্লাদিত হইল, তাহাকে কাছে টানিয়া গদ্গদ সুরে বলিল— ‘ভাল লাগছে?’
অরুণা কাকলিকলিত স্বরে বলিল— ‘খুব ভাল লাগছে। আমার কী মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে অনেক দিন বিদেশে থাকার পর নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছি।’
তারপর একদিন বেলা তৃতীয় প্রহরে তাহারা রাজস্থানের একটি ছোট স্টেশনে অবতরণ করিল। তাহার প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই স্টেশনের বাহিরের শুষ্ক প্রান্তর হইতে বালি-মাখা আতপ্ত বাতাসের একটা তরঙ্গ তাহাদের উপর দিয়া বহিয়া গেল। অরুণা চকিত চক্ষে চারিদিকে চাহিয়া বলিল— ‘গন্ধ পাচ্ছ? কেয়া ফুলের গন্ধ?’
অরুণা পূর্বেও একবার অর্ধচেতন অবস্থায় কেয়া ফুলের উল্লেখ করিয়াছিল, সুবীরের মনে পড়িল। সে দীর্ঘ ঘ্রাণ গ্রহণ করিয়া বলিল— ‘কেয়া ফুলের গন্ধ? কই, না। ইঞ্জিনের পোড়া কয়লার গন্ধ পাচ্ছি।’
এই সময় কোট-প্যান্ট সোলা-হ্যাট-পরা প্রত্নবিৎ বিরাজমোহনবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রৌদ্রতাম্র শীর্ণাঙ্গ মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি, বাংলা ইংরেজি হিন্দী সংস্কৃত মিশাইয়া কথা বলেন। সুবীর তাঁহাকে প্রণাম করিল, দেখাদেখি অরুণাও প্রণাম করিল। বিরাজমোহনবাবু ইতিপূর্বে অরুণাকে দেখেন নাই, সপ্রশংস হাসিয়া বলিলেন— ‘বাঃ, খাসা শ্যালবধূ তো!’
সুবীর অবাক হইয়া বলিল— ‘শ্যালবধূ!’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘শ্যালবধূ বুঝলে না? তুমি হলে আমার শ্যাল, মানে শ্যালক; ও হল গিয়ে তোমার বধূ, সুতরাং শ্যালবধূ। — এস, জীপ এনেছি, স্টেশন থেকে পনরো মাইল যেতে হবে।’
জীপে মালপত্র তুলিয়া তিনজনে গাড়িতে উঠিলেন, বিরাজবাবু গাড়ি চালাইলেন। স্টেশন হইতে আধ মাইল যাইবার পর আর লোকালয় দেখা যায় না; চারিদিকে ধূ ধূ বালি; দুই-চারিটা কঙ্কালসার বৃক্ষ ও ঝোপঝাড়, দূরে দূরে ছোট ছোট পাহাড়ের ঢিবি, তাহার মধ্যে দিয়া অস্পষ্ট পাথুরে পথের চিহ্ন চলিয়াছে।
জীপ চালাইতে চালাইতে বিরাজবাবু কথা বলিতে লাগিলেন। —এ দেশটা এখন প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে বটে, কিন্তু দু’হাজার বছর আগে এমন ছিল না, উর্বর দেশ ছিল। তখন এখানে একটি রাজ্য ছিল; মরুভূমির উপান্তে ছোট্ট একটি রাজ্য। তারপর প্রকৃতি এবং মানুষ একসঙ্গে এই রাজ্যের পিছনে লাগিল। ইতিহাসে যাদের Parthian বলা হইয়াছে সেই পারদ জাতি এদেশ আক্রমণ করিয়া অধিকার করিল। কিন্তু বেশী দিন রাজ্য ভোগ করিতে পারিল না। দুই শত বছরের মধ্যে মরুভূমি আসিয়া রাজ্যটিকে গ্রাস করিয়া লইল। এখন এদেশে মানুষের বসতি নাই বলিলেই চলে, পুরাতন ঘরবাড়িও ভূমিসাৎ হইয়াছে কেবল প্রস্তরনির্মিত রাজপ্রাসাদটি এখনও মরুভূমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়া বালুর মধ্যে অর্ধপ্রোথিত অবস্থায় মাথা জাগাইয়া আছে।
‘এইই রাজপ্রাসাদ এখন আমাদের স্কন্ধাবার, মানে হেড কোয়াটার্স। তোমাদের সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি।’
সুবীর বলিল—‘সেখানেই খোঁড়াখুঁড়ি করছেন নাকি?’
বিরাজবাবু হাসিলেন— ‘আরে না না, ও প্রাসাদ তো মাত্র দেড় হাজার কি দু’হাজার বছরের পুরনো। আমাদের দৃষ্টি আরো গভীরে। রাজপ্রাসাদ থেকে মাইল তিনেক দূরে এক জায়গায় সিন্ধু সভ্যতার কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে। অন্তত চার হাজার বছর আগে ওখানে ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতা ছিল, এখন বালি চাপা পড়েছে। আমরা তাই খুঁড়ে বার করছি।’
বিরাজবাবু শুধু প্রত্নপণ্ডিত নন, প্রত্নপাগল; তিনি উৎসাহভরে খননকার্য বিষয়ে আরও অনেক তথ্য বলিয়া চলিলেন। সুবীরের পুরাতত্ত্বের প্রতি বিশেষ অনুরাগ ছিল না, সে নীরবে শুনিয়া গেল।
আধ ঘণ্টা চলিবার পর সম্মুখে মাইল দুয়েক দূরে একটা উঁচু পাথরের ঢিবি দৃশ্যমান হইল; যেন বালু ফুঁড়িয়া একটা ত্রিকোণ পাথরের চাঙড় মাথা তুলিয়াছে। বিরাজবাবু বলিলেন— ‘ওই দেখ রাজপ্রাসাদ, যেখানে তোমরা থাকবে।’
অরুণা উৎসুক চক্ষে সেইদিকে চাহিয়া রহিল। সুবীর বলিল— ‘আপনিও তো ওখানেই থাকেন।’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘ওখানে আমার অফিস আছে বটে, কিন্তু আমি বেশীর ভাগ তাঁবুতেই থাকি। যেখানে এক্স্কাভেশন হচ্ছে সেখানে হরদম না থাকলে অসুবিধা হয়। আমার সহকারীরা এবং কুলিরাও সরজমিনে থাকে। রাজপ্রাসাদটা তোমাদের দুজনের জন্যে রিজাভ থাকবে।’
সুবীর ঈষৎ উদ্বিগ্ন হইয়া বলিল— ‘কেবল আমরা দু’জন একলা থাকব?’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘একেবারে একলা নয়, অফিসের একজন পাহারাদার আছে, সে প্রাসাদেই থাকে। তার বৌকেও আনিয়ে রেখেছি। ওরা স্থানীয় লোক। দু’জনে মিলে তোমাদের খবরদারি করবে!’
জীপ আসিয়া রাজপ্রাসাদের সামনে থামিল। একজোড়া স্ত্রীপুরুষ প্রাসাদের ছায়ায়, বালুর উপর মুখোমুখি বসিয়া ছিল, তাহারা উঠিয়া দাঁড়াইয়া সেলাম করিল। পুরুষের মাথার ধামার মতো প্রকাণ্ড পাগড়ি, পাগড়ির নীচে গোঁফ ও দোপাট্টা দাড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। স্ত্রীলোকটির নাকে নথ, সীমন্তে রূপার ঘুন্টি।
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘গিরধর সিং, এঁরা এসেছেন, তোমার এঁদের দেখভাল্ করবে। রুক্মিণী, রান্নার ব্যবস্থা করেছ তো? বেশ, আমি এখন খাদে যাচ্ছি, ‘চিরাগ-বাত্তি’র সময় ফিরব। তোমরা এঁদের সামান্ ভিতরে নিয়ে যাও।’ সুবীরকে বলিলেন— ‘আজ রাত্তিরটা আমি এখানেই থাকব, তোমাদের ঘরবসত করে দিয়ে নিশ্চিন্ত হব। — আচ্ছা।’
বিরাজবাবু জীপ চালাইয়া প্রস্থান করিলেন।
গিরধর সিং ও রুক্মিণী লটবহর লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল। সুবীর ও অরুণা প্রাসাদের সম্মুখে বালুর উপর পায়চারি করিতে করিতে চারিদিক দেখিতে লাগিল। প্রাসাদের সদর আন্দাজ পঞ্চাশ গজ চওড়া, আগাগোড়া গেরুয়া রঙের পাথর দিয়া তৈয়ারি। নীচের তলা বালুস্তূপের নীচে চাপা পড়িয়াছে বটে, কিন্তু অবশিষ্ট দুইতল মিলিয়া এখনও প্রায় চল্লিশ ফুট উচ্চ। তৃতীয়তল পিরামিডের ন্যায় কোণাকৃতি। স্থানে স্থানে পাথর খসিয়া গিয়া প্রাসাদের গায়ে ক্ষত হইয়াছে, কিন্তু মোটের উপর অটুট আছে।
সুবীর দেখিতে দেখিতে বলিল— ‘এত পুরনো বাড়ি, দেখে কিন্তু মনে হয় না। এই বাড়িতে দেড় হাজার দু’হাজার বছর আগে রাজা-রানী থাকত, লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্ত গম্গম্ করত, কল্পনা করা যায় না। তুমি কল্পনা করতে পার?’
স্বপ্নাতুর চক্ষে চাহিয়া অরুণা বলিল— ‘পারি।’
গিরধর আসিয়া জানাইল, সামান্ যথাস্থানে বিন্যস্ত হইয়াছে, এখন মালিক ও মাল্কিণী গৃহে প্রবেশ করিতে পারেন। সুবীর ও অরুণা ঢালু বালির পাড় আরোহণ করিয়া একেবারে দ্বিতলের বারান্দায় উপস্থিত হইল। বারান্দাটি প্রশস্ত, তাহার প্রান্ত হইতে ঘরের সারি আরম্ভ হইয়াছে; কক্ষের পর কক্ষ, অসংখ্য কক্ষ। কোনোটি আকারে আয়তনে সভাগৃহের ন্যায় বৃহৎ, কোনোটি কোটরাকৃতি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ। সব মিলিয়া একটি বিশাল মধুচক্র বলিয়া ভ্রম হয়।
অট্টালিকার নিম্নতল হইতে পাথরের সিঁড়ি বিবর-নির্গত অজগরের মতো দ্বিতলের বারান্দায় উঠিয়াছে। তারপর পাক খাইয়া ত্রিতলের দিকে চলিয়া গিয়াছে।
গিরধর সিং বলিল, ‘আপনাদের মহল তিনতলায়। আসুন।’
সুবীর জিজ্ঞাসা করিল—‘তোমরা কোথায় থাকো?’
গিরধর সোপান-গহ্বরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল— ‘নীচে দুটো ঘর পরিষ্কার করে নিয়েছি, সেখানে থাকি। রান্নাঘরও সেখানেই। ভারি চমৎকার জায়গা হুজুর। ঠাণ্ডা নেই, গরম নেই; একটু অন্ধকার, এই যা।’
সুবীর বলিল— ‘আর অফিস কোথায়?’
গিরধর বলিল— ‘ঐ যে ওদিকের ঘরগুলো, ওখানে অফিস।’
সুবীর একটা বড় ঘরে উঁকি মারিয়া দেখিল, অনেকগুলো টেবিল রহিয়াছে; টেবিলের উপর নানা আকৃতির পাথরের টুক্রো। অফিসে স্বাভাবিক সরঞ্জাম, কাগজপত্র, টাইপরাইটার, কিছুই নাই।
সুবীর বলিল— ‘চল, এবার আমাদের মহল দেখি।’
ত্রিতলটা চন্দ্রশালা, অর্থাৎ চিলেকোঠা। পাশাপাশি তিনটি ঘর; বাকি ছাদ উন্মুক্ত, মাঠ ময়দানের ন্যায় প্রশস্ত। ছাদ ঘিরিয়া পাথরের কারুকর্মখচিত আলিসা। মেঝের উপর বালুকার পুরু পলি পড়িয়াছে।
ঘর তিনটি কিন্তু পরিষ্কৃত ও পরিচ্ছন্ন, ধূলাবালির চিহ্ন নাই। মাঝের ঘরে একটি বড় খাট, এক পাশের ঘরে একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার দিয়া বৈঠকের আকারে সাজানো হইয়াছে; অন্য পাশের ঘরে স্নানাদির ব্যবস্থা। বিরাজবাবু প্রত্ন-লোকবাসী হইলেও বর্তমানকালের শ্যালক ও শ্যালবধুর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা ভালই করিয়াছেন।
এই ঘরগুলির একটা অসুবিধা, দ্বারের কপাট নাই। পূর্বকালে নিশ্চয় কাঠের কপাট চৌকাঠ সবই ছিল, এখন ঘুণ-চর্বিত হইয়া অদৃশ্য হইয়াছে। যাহোক, বিরাজবাবু দ্বারে পদা টাঙাইয়া দিয়া যথাসম্ভব আব্রু রক্ষা করিয়াছেন।
গিরধর সিং বলিল— ‘হুজুর, আপনারা আরাম করুন, আমি চায় নিয়ে আসি।’
গিরধর সিং চলিয়া গেল। সুবীর ও অরুণা ঘরগুলি ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিতে লাগিল। সুবীরের মুখে চোখে নূতনত্বের ঔৎসুক্য, অরুণার চোখে অবাস্তবের কুহক। সুবীর বলিল— ‘কেমন লাগছে?’
অরুণা অস্ফুট আত্মগত স্বরে বলিল— ‘এসব আসবাব এখানে কেন!’
সুবীর চকিত হইয়া বলিল— ‘সেকালের বাড়িতে একালের আসবাব বেমানান্ ঠেকছে— না! কিন্তু উপায় কি? গজদন্ত পালঙ্ক অস্নেহদীপিকা সুবর্ণভৃঙ্গার, এসব কোথায় পাওয়া যাবে!’
গিরধর সিং একটি বড় থালার উপর চায়ের সরঞ্জাম সাজাইয়া উপস্থিত হইল। দু’টি পাথরের বাটিতে মশলাদার চা; সঙ্গে ডালের ভাজিয়া, ঝাল মটর, পাঁপড় ভাজা ইত্যাদি টুকিটাকি খাবার। দু’জনেরই ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, তাহারা সাগ্রহে খাইতে বসিল।
চায়ের স্বাদ ঠিক স্বাভাবিক চায়ের মতো নয়, তবু মন্দ লাগিল না। ভাজাভুজিতে ঝাল একটু বেশী, কিন্তু অত্যন্ত মুখরোচক। দু’জনে হুস্হাস্ করিতে করিতে সব খাইয়া ফেলিল। তারপর ঘরের বাহিরে ছাদের উপর গিয়া দাঁড়াইল।
প্রাসাদের পিছন দিকে বালুপ্রান্তরের পরপারে সূর্য অস্ত যাইতেছে। আতপ্ত বাতাসের গায়ে একটু শৈত্যের স্পর্শ লাগিয়াছে। দু’জনে আলিসার পাশ দিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে পশ্চিম দিকে গিয়া উপস্থিত হইল। অরুণা আয়ত চক্ষু মেলিয়া দিগন্তের পানে চাহিল। সুবীর নীচের দিকে উঁকি মারিল। শ’ হাত নীচে আল্গা বালির ঢালু বাঁধ প্রাসাদের নিতম্বে আসিয়া ঠেকিয়াছে। সে বলিল— ‘চারিদিকে বালির সমুদ্র, মাঝখানে এই প্রাসাদ যেন একটি পাথরের দ্বীপ।’
অরুণা উত্তর দিল না, একাগ্র চক্ষে অস্তমান সূর্যের পানে চাহিয়া রহিল।
সূর্য অস্ত গেল। নিম্নে বালুর উপর ঈষৎ আলোড়ন তুলিয়া শুষ্ক শীতল বায়ু তাহাদের মুখে আসিয়া লাগিল। অরুণা হঠাৎ শিহরিয়া উঠিল। সুবীর কাছে আসিয়া তাহার স্কন্ধ জড়াইয়া লইল, বলিল—‘ঠাণ্ডা লাগছে। চল, ঘরে যাই। ভারি মজার দেশ রাজস্থান; দিনে গ্রীষ্মকাল, আবার সূর্যাস্ত হতে না হতেই শীতকাল।’
দু’জনে ঘরে ফিরিয়া গেল। সুবীর লক্ষ্য করিল না, অরুণার চোখে শঙ্কা-ছোঁয়া উত্তেজনা । সে যে হঠাৎ শিহরিয়া উঠিয়াছিল তাহা কেবল শীতল বায়ুর স্পর্শ নয়, তাহার মনেও যেন কোন্ অভাবনীয় ভবিতব্যতার স্পর্শ লাগিয়াছে।
ঘরে একটি অর্ধ-গোলাকৃতি গবাক্ষ আছে, বর্তমানে তাহার উপর পর্দা ঢাকা। ছায়াচ্ছন্ন ঘরে সুবীর ও অরুণা দুইটি চেয়ারে পাশাপাশি বসিল; সুবীর অরুণার একটা হাত নিজের হাতে লইয়া বলিল— ‘নতুন জায়গায় এসে তোমার বেশ ভাল লাগছে?’
অরুণা একটু চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল— ‘ভাল লাগছে। আবার একটু ভয়-ভয় করছে।’
সুবীর অনুভব করিল, অরুণার হাতের আঙুলগুলি ঠাণ্ডা, সে আঙুলের সহিত আঙুল জড়াইয়া লইয়া বলিল— ‘ভয়ের কী আছে। বাড়িটা মান্ধাতার আমলের, লোকজনও বেশী নেই, তাই একটু ভুতুড়ে-ভুতুড়ে মনে হচ্ছে। দুদিন থাকলেই ঠিক হয়ে যাবে।’
অরুণা দ্বিধাভরে বলিল— ‘হ্যাঁ।’
দ্বারের কাছে আলো দেখা গেল। রুক্মিণী প্রবেশ করিল, তাহার হাতে একটি রেকাবির উপর কয়েকটি জ্বলন্ত মোমবাতি। এই দীপান্বিতা রমণীকে দেখিয়া সুবীরের চোখে একটা বিভ্রম জন্মিল; রুক্মিণী যেন বর্তমানকালের মেয়ে নয়, তাহার বেশভুষা স্বচ্ছন্দ গতিভঙ্গি সবই যেন সুদূর অতীতের স্পর্শবহ। রুক্মিণী সুন্দরী নয়, যুবতীও নয়। তাহার বয়স ত্রিশের ঊর্ধে, তামাটে গৌরবর্ণ দেহে কঠিন স্বাস্থ্য, নথ-পরা মুখখানিতে আভিজাত্যের দীপ্তি। প্রকৃতির বিচিত্র বিধানে রাজস্থানের উচ্চ নীচ সকল জাতির মেয়ের দেহে রাজকন্যাসুলভ মর্যাদা রহিয়া গিয়াছে।
রুক্মিণীর হাসিটা মিষ্ট, কণ্ঠস্বরও বিনম্র। একটি মোমবাতি টেবিলের উপর রাখিয়া সে অরুণার পানে চোখ তুলিল, ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বলিল— ‘বাঈ, সব ঘরে বাতি দিয়ে আসি?’
অরুণা বলিল— ‘এস।’ অরুণার বাপের বাড়ি বিহার প্রদেশে, সেও অল্পবিস্তর হিন্দী বলিতে পারে।
রুক্মিনী চলিয়া গেল; অন্য ঘর দুটোতে বাতি দিয়া আসিয়া অরুণার পাশে দাঁড়াইল —‘বাঈ, এবার তোমার চুল বেঁধে দিই?’
অরুণা তাহার পানে স্মিত মুখ ফিরাইল, নিজের চুলে একবার আঙুল বুলাইয়া বলিল—‘আজ থাক। আজ শুধু মুখ-হাত ধুয়ে নেব।’
‘আচ্ছা। আমি তাহলে যাই, রসুই করতে হবে।’
‘যাও।’
রুক্মিণী অরুণার প্রতি একটি সুস্মিত দৃষ্টিপাত করিয়া চলিয়া গেল। সুবীর বলিল— ‘রুক্মিণীর দেখছি তোমাকে ভাল লেগেছে।’
অরুণা একটু অন্যমনস্ক হাসিল।
দু’জনে মোমবাতির আলোয় নীরবে বসিয়া রহিল। অরুণার দিকে চাহিয়া সুবীরের মনে হইল, এই অস্পষ্ট আলোতে অরুণা যেন আরও অবাস্তব হইয়া গিয়াছে।
নীচে জীপের শব্দ হইল। বিরাজবাবু ফিরিয়াছেন। অরুণা উঠিয়া পড়িল। স্যুটকেস হইতে কাপড়, জামা, সাবান, তোয়ালে প্রভৃতি লইয়া স্নানঘরের দিকে চলিয়া গেল।
বিরাজবাবু প্রবেশ করিলেন, তাঁহার হাতে এক মুঠি ধূপের কাঠি। উচ্চকণ্ঠে বলিলেন— ‘কি হে, কেমন অট্টালিকা? শ্যালবধূ কোথায়?’
সুবীর বলিল— ‘বাথরুমে গেছে। চমৎকার অট্টালিকা! আপনি কোথায় শোবেন?’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘ভয় নেই, আড়ি পাতব না। আমার শয়নকক্ষ দোতলায়। — স্টেশনে এক আঁটি ধূপকাঠি কিনেছিলাম, জীপেই পড়ে ছিল।’ বলিয়া তিনি কয়েকটা ধূপ জ্বালিয়া দিয়া চেয়ারে বসিলেন—‘এ ঘরগুলোতে ধূপ-ধুনো দেওয়া দরকার, অনেক দিন শুন্য পড়ে আছে।’
ধীরে ধীরে ঘরটি ধূপের গন্ধে ভরিয়া উঠিল।
সুবীর বলিল— ‘চা খাবেন না?’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘তাঁবু থেকে চা খেয়ে এসেছি। এখানে কেবল রাত্রে ভোজন এবং শয়ন। তারপর সুর্যোদয়ের আগেই প্রস্থান।’
সুবীর বলিল—‘এখানকার জল-হাওয়া খুব ভাল—না?’
বিরাজবাবু সোৎসাহে বলিলেন— ‘মরুভূমির মতো জায়গা আছে! রোগের বীজাণু এখানে টিকতে পারে না, জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। তাছাড়া এমন রাত্রি পৃথিবীর আর কোথাও নেই।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। এ দেশটা রাজস্থানের অন্তর্গত হলেও আসলে মালব দেশ। মুসলমানেরা যখন প্রথম ভারতবর্ষে আসে ওরা লক্ষ্য করেছিল, অযোধ্যার সন্ধ্যা, রাজোয়াড়ার সকাল আর মালবের রাত্রি জগতে অতুলনীয়। মুসলমানী ভাষায় বয়েৎ আছে।’
মালবের রাত্রি! বাক্যটির রোমান্টিক স্বাদ সুবীর মনে মনে গ্রহণ করিতেছে এমন সময় অরুণা শয়নকক্ষ হইতে বাহির হইয়া আসিল। তাহার হাতে স্নিগ্ধ-শিখা মোমবাতি। সুবীরের মাথায় কবিতা গুঞ্জরিয়া উঠিল— হেন কালে হাতে দীপশিখা, ধীরে ধীরে নামি এল মোর মালবিকা!
প্রবেশ করিয়াই অরুণা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, চকিত কটাক্ষে এদিক ওদিক চাহিয়া বলিল—‘কেয়া ফুলের গন্ধ!’
বিরাজবাবু হাসিয়া উঠিলেন—‘কেয়া ফুল নয়, অম্বুরী ধূপের গন্ধ। কেয়া ফুল এদেশে কোথায়! তাছাড়া এটা কেয়া ফুলের সময় নয়। —এস শ্যালবধূ।’
দ্বিধামন্থর পদে অরুণা আসিয়া টেবিলের উপর মোমবাতি রাখিল, একটু অপ্রতিভ হাসিয়া বিরাজবাবুর পাশের চেয়ারে বসিল। তাহার মনের মধ্যে যেন বাস্তব ও অবাস্তবের দ্বন্দ্ব চলিতেছে। সুবীরের মনে উদ্বিগ্ন বিস্ময় পাক খাইতে লাগিল— অরুণা বার বার কেয়া ফুলের গন্ধ পাইতেছে! কী ব্যাপার?
বিরাজবাবু কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি একটু বেশী কথা বলেন, কিন্তু কথাগুলি নীরস নয়। নানাপ্রকার পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলাপ-আলোচনার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাসা মিশাইয়া দুই ঘণ্টাকাল কাটাইয়া দিলেন।
গিরধর ও রুক্মিণী রাত্রির আহার লইয়া আসিল। আহার্য দ্রব্যগুলি টেবিলে রাখিয়া গিরধর আরও কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়া দিল। তিনজনে টেবিলের ধারে চেয়ার টানিয়া খাইতে বসিলেন।
খাদ্যবস্তু সংখ্যায় এবং পরিমাণে প্রচুর। শাক-সবজিই বেশী, তার সঙ্গে ঘৃতপক্ক অন্ন ও চাপাতি, অল্প মাংস, মালাই এবং বরফি।
খাইতে খাইতে সুবীর বলিল— ‘এই মরুভূমির মাঝখানে তাজা শাক-সবজি পান কোত্থেকে?’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘মাইল দুই দূরে আভীরদের একটা গ্রাম আছে, তারাই দুধ আর শাক-সবজি যোগায়। মাঝে মাঝে ভেড়ার মাংস পাওয়া যায়। কিন্তু মাছ পাওয়া যায় না। মরুভূমিতে জল কোথায় যে মাছ আসবে!’
সুবীর জলের গেলাসে চুমুক দিয়া বলিল— ‘ভারি সুস্বাদু জল। এ জল কোথায় পান?’
বিরাজবাবু বলিলেন— ‘নীচের তলায় একটা ঘরের মেঝেয় ইঁদারা আছে। সেই দু’-হাজার বছরের পুরনো ইঁদারা! কিন্তু কী জল! বরফের মতো ঠাণ্ডা, শরবতের মতো মিষ্টি।’
অরুণা পুরুষদের বাক্যালাপে যোগ দিল না, একটু নিঝুম ভাবে আহার করিতে লাগিল। আহার শেষ হইলে বিরাজবাবু বলিলেন, ‘শ্যালবৌ, তুমি ক্লান্ত হয়েছ, শুয়ে পড় গিয়ে, আমরা আরো খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি। কাল ভোরেই আমি চলে যাব, হয়তো দু’তিন দিন আসতে পারব না।’
অরুণা একটু ঘাড় হেলাইয়া শয়নকক্ষে চলিয়া গেল। তারপর দু’জনে ঘনিষ্ঠভাবে বসিয়া গল্প করিতে করিতে ভূতের গল্প উঠিয়া পড়িল। বিরাজবাবু গলা খাটো করিয়া বলিলেন— ‘বৌকে কিছু বোলো না, কিন্তু গিরধরের মুখে শুনেছি এ বাড়িতে নাকি আছে।’
‘কী আছে— ভূত-প্রেত! আপনি বিশ্বাস করেন?’
বিরাজবাবু হাসিলেন— ‘আমি বিজ্ঞানী, যার প্রমাণ পেয়েছি তা বিশ্বাস না করে উপায় কি? বিজ্ঞানী আর অ-বিজ্ঞানীর মধ্যে ঐখানেই তফাত, বিজ্ঞানী প্রমাণ পেলে বিশ্বাস করে, অ-বিজ্ঞানী প্রমাণ পেলেও বিশ্বাস করে না, উল্টে নানা রকম কু-ব্যাখ্যা শুরু করে দেয়।’
‘আপনি তাহলে প্রমাণ পেয়েছেন?’
‘দ্যাখো, ভূত-কাল নিয়েই আমার কারবার। ভূত-কালের সন্ধানে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ এমন কিছু পেয়েছি যাকে বাস্তব বলা যায় না। সে গল্প আর-একদিন বলব। তবে এ বাড়িতে আমি নিজে কিছু প্রত্যক্ষ করিনি। যা শুনেছি চাকর বাকরের মুখে।’
‘ওরা কী বলে?’
‘ওরা বলে একটা আত্মা আছে। মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে বীণার ঝঙ্কার শোনা যায়, তাজা ফুলের গন্ধ চারিদিকে ভর্ভর্ করতে থাকে—।
সুবীর চমকিয়া বলিল— ‘কোন্ ফুল! কেয়া?’
বিরাজবাবু কিছুক্ষণ তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন— ‘তা জানি না। আজ তোমার বৌ কেয়ার গন্ধ পেয়েছিল…তাই তো, এটা আমার খেয়াল হয়নি—’
সুবীর বলিল— ‘অরুণার এই দুর্ঘটনা হবার পর থেকে সে তিনবার কেয়া ফুলের গন্ধ পেয়েছে; কোথাও কেয়া ফুল নেই, তবু গন্ধ পেয়েছে। এর মানে আপনি বলতে পারেন?’ বলিয়া সুবীর মোটর দুর্ঘটনার পর হইতে ব্যাপার বিবৃত করিল।
বিরাজবাবু কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘এখানে আসার আগে যদি গন্ধ পেয়ে থাকে তাহলে অলৌকিক কাণ্ড না হতেও পারে। হয়তো মাথায় চোট লাগার ফলে olfactory nerves বিগ্ড়ে গিয়েছে। স্নায়ু বড় বিচিত্র যন্ত্র। যা হোক, ভাবনার কিছু নেই, আস্তে আস্তে normal হয়ে যাবে।’
তারপর, রাত্রি গভীর হইতেছে দেখিয়া তিনি দ্বিতলে শয়ন করিতে চলিয়া গেলেন। সুবীর শয়নকক্ষে যাইবার আগে একবার বহির্দ্বারের পর্দা সরাইয়া ছাদের দিকে উঁকি মারিল। বাহিরে মধুর শীতলতা; চাঁদ আকাশের মাঝখানে উঠিয়া, বালু-ঢাকা প্রকাণ্ড ছাদ চন্দ্রকিরণে কিংখাবের মতো ঝিকমিক করিতেছে। তন্দ্রাজড়িত স্বপ্নসমাকুল দৃশ্য। মালবের রাত্রি। সুবীর একটি নিশ্বাস ফেলিল। অরুণা যদি সুস্থ থাকিত, দু’জনে মিলিয়া তাহারা মালবের এই অপরূপ রাত্রি উপভোগ করিতে পারিত।
সুবীর শয়নকক্ষে গেল। বৃহৎ কক্ষের মাঝখানে বিস্তীর্ণ পালঙ্ক, অরুণা শয্যার এক পাশে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সুবীর পালঙ্কের পাশে ঝুঁকিয়া মৃদুকণ্ঠে ডাকিল— ‘অরুণা!’
অরুণা জাগিল না। তাহার দেহ এমন শিথিলভাবে শয্যায় পড়িয়া আছে যে মনে হয়, শুধু ঘুম নয়, ঘুমের চেয়েও দুরবগাহ অবচেতনার মধ্যে তাহার সংজ্ঞা ডুবিয়া গিয়াছে। হঠাৎ শঙ্কিত হইয়া সুবীর তাহার বুকের উপর করতল রাখিল। না, হৃৎস্পন্দন মন্থর বটে, কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই সচল আছে। সুবীর সযত্নে অরুণার গায়ের উপর চাদর টানিয়া দিল, অপলক চক্ষে তাহার ঘুমন্ত মুখের পানে চাহিয়া রহিল।
মাথার শিয়রে নিঃশেষিত মোমবাতিটা নিব-নিব হইয়া আসিয়াছিল, নিবাপিত হইবার পূর্বে দপ্দপ্ করিয়া উঠিল। সুবীর তখন সন্তর্পণে অরুণার পাশে শয়ন করিল।
পরদিন সকাল হইতে তাহার প্রকৃত প্রবাস-জীবন আরম্ভ হইল। নির্জন প্রবাসে জীবন-যাত্রার সুবিধা অসুবিধা দুই-ই আছে। পরিচিত মানুষের অভাব কখনও সুবিধা কখনও অসুবিধা বলিয়া মনে হয়। কাজকর্ম নাই, খবরের কাগজ নাই, এরূপ অবস্থা কাহারও পক্ষে সুখকর, কাহারও পক্ষে অসুখকর। কিন্তু যেখানে দু’টি স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে প্রণয়ের বন্ধন আছে সেখানে প্রবাসের নির্জনতা মধুময় হইয়া ওঠে।
সুবীরের মন এই নিবিড় রসানুভূতির জন্য উৎসুক হইয়াছিল। কিন্তু অরুণার দিক হইতে তাহার প্রতিফলন আসিল না। বরং মনে হইল অরুণা সুবীরকে এড়াইয়া চলিতেছে। একসঙ্গে ওঠাবসা করিয়াও দু’জন মানুষ মনে মনে পরস্পরকে এড়াইয়া চলিতে পারে। অরুণা স্বভাবত সরল ও সিধা প্রকৃতির মেয়ে; কিন্তু এখন দেখা গেল অরুণার চোখে গোপনতার কটাক্ষ, সে যেন সুবীরের নিকট হইতে নিজের মানসিক অবস্থা প্রচ্ছন্ন রাখিবার চেষ্টা করিতেছে; তাহার মনের মধ্যে এমন কিছু ঘটিতেছে যাহা সে সুবীরকে জানিতে দিতে চায় না।
রুক্মিণী প্রথম দর্শনেই অরুণাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সে নিজের কাজ হইতে ছুটি পাইলেই উপরে আসিয়া অরুণার আশেপাশে ঘুরিয়া বেড়ায়। অযাচিত ভাবে তাহার সেবা করে, চুলে তেল মাখাইয়া চিরুণী দিয়া আঁচড়াইয়া চুল বাঁধিয়া দেয়, আর অনর্গল গল্প করে। অরুণাও তাহার সঙ্গে বেশ স্বচ্ছন্দে মেলামেশা করে। মেয়েদের ঐ একটি গুণ আছে, তাহারা উঁচু-নীচু নির্বিশেষে সকল জাতের মেয়ের সঙ্গে মিশিতে পারে। পুরুষের সে গুণ নাই, থাকিলে সুবীরের ভারি সুবিধা হইত, গিরধর সিং-এর সঙ্গে গল্প জমাইয়া সময় কাটাইতে পারিত। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় সে যেন একটু নিরাশ্রয় হইয়া পড়িয়াছে। সঙ্গে যে-কয়টা বই আনিয়াছে তাহা মাঝে মাঝে খুলিয়া বসে। কিন্তু বই-এ মন বসে না। তখন সে উঠিয়া প্রাসাদের দ্বিতলে অগণিত কক্ষগুলিতে ঘুরিয়া বেড়ায়। ঘরগুলি পরিষ্কৃত নয়; কোথাও দেওয়াল হইতে পাথর খসিয়া পড়িয়াছে, কোথাও ছাদের কোণে চামচিকা বাসা বাঁধিয়াছে। সব মিলিয়া পরিত্যক্ত লোকালয়ের প্রাণহীন কঙ্কালসার শুষ্কতা।
দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর সুবীর ত্রিতলের খোলা ছাদে একাকী পরিক্রমণ করিতেছিল। আলিসার কিনারে ঘুরিয়া বেড়াইতে বেড়াইতে নানা অসংলগ্ন চিন্তার মধ্যে ভূত-প্রেতের চিন্তাও তাহার মনে আসিতেছিল। বিরাজবাবু বৈজ্ঞানিক হইলেও অলৌকিক ব্যাপার বিশ্বাস করেন। এ বাড়িটাতে বাজনার শব্দ শোনা যায়, ফুলের গন্ধ পাওয়া যায়; হয়তো কিছু আছে। হানা-বাড়ির কত গল্পই তো শোনা যায়, সবই কি মিথ্যা? এই বাড়িটা দু’হাজার বছর ধরিয়া মরুভূমির মাঝখানে পড়িয়া আছে; হয়তো জীবিত অবস্থায় যাহারা এখানে বাস করিত তাহাদেরই কেহ বাড়ির মায়া ত্যাগ করিয়া যাইতে পারে নাই, দুহাজার বছর ধরিয়া প্রতীক্ষা করিতেছে। কিসের প্রতীক্ষা করিতেছে কে জানে। এই রাজস্থানেই নাকি কোথায় একটা রাজপ্রাসাদ আছে, সেখানে রাত্রিকালে প্রেতাত্মা ‘ম্যায় ভুখা হুঁ’ বলিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়।—
আজও আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে। ঠাণ্ডা বাতাসে সুবীরের গা শীত-শীত করিয়া উঠিল। সে ঘরে ফিরিয়া গেল।
বসিবার ঘরে কেহ নাই, কিন্তু শয়নকক্ষ হইতে রুক্মিণীর কলকণ্ঠ আসিতেছে। সুবীর শয়নকক্ষের পর্দা সরাইয়া দেখিল, সেখানে দুটি মানুষের মজলিশ্ বসিয়া গিয়াছে। মেঝেয় পাটি পাতিয়া অরুণা ও রুক্মিণী মুখোমুখি বসিয়াছে, তাহাদের মাঝখানে একটি আগুনের ছোট আংটা; রুক্মিণী খোসাসুদ্ধ চীনাবাদাম আগুনে ঝল্সাইয়া খোসা ছাড়াইয়া অরুণাকে দিতেছে, অরুণা পরম সুখে নুন ও লঙ্কার গুঁড়া মাখাইয়া খাইতেছে।
সুবীরকে দ্বারের কাছে দেখিয়া রুক্মিণীর বাক্যস্রোত সংহত হইল, অরুণাও মুখ তুলিয়া চাহিল। সুবীর তাহাদের কাছে আসিয়া বসিল, হাসিমুখে বলিল—‘কি গল্প হচ্ছে? আমিও গল্প শুনতে এলাম।’
অরুণা একটু বিব্রত হইয়া বলিল—‘মেয়েলি গল্প কি তোমার ভাল লাগবে।’
সুবীর বলিল— ‘ভাল না লাগে উঠে যাব। অন্তত চীনেবাদাম ভাজা তো ভাল লাগবে।’ সে কয়েক দানা চীনাবাদাম মুখে দিয়া বলিল— ‘আচ্ছা রুক্মিণী, তোমরা এ বাড়িতে ফুলের গন্ধ পেয়েছ?’
সুবীরের আগমনে রুক্মিণী একটু আড়ষ্ট হইয়া পড়িয়াছিল, এখন আবার স্বচ্ছন্দ হইয়া বলিল— ‘জি মালিক, পেয়েছি। তাছাড়া গভীর রাত্রে বাঁশির আওয়াজ শোনা যায়, সিতারের আওয়াজ শোনা যায়।’
‘কোন্ ফুলের গন্ধ পেয়েছে— আতর গুলাব ধূপ-ধুনার গন্ধ নয়?’
‘জি না, তাজা ফুলের গন্ধ। জাই জুঁহি চম্পা— এই সব।’
‘কেয়া ফুলের গন্ধ কখনো পেয়েছ?’
অরুণা সুবীরের প্রতি একবার চকিত ভ্রূক্ষেপ করিল। রুক্মিণী উৎসুক স্বরে বলিল— ‘কেওড়া ফুলের গন্ধ! না বাবুজি, কেওড়া ফুলের গন্ধ, কেমন হয় আমি জানি না, কেওড়া ফুল কখনো দেখিনি। তবে কেওড়া ফুলের গল্প জানি।’
‘কেওড়া ফুলের গল্প।’
‘হ্যাঁ বাবুজি, ভারি চমৎকার গল্প। আমি আমার দাদি’র কাছে শুনেছিলাম আমার দাদি আবার তার দাদি’র কাছে শুনেছিল। বহুকাল ধরে এ-গল্প চলে আসছে। এই মহল নিয়েই গল্প।’
‘তাই নাকি! কী গল্প বল তো শুনি।’
তখন রুক্মিণী চীনাবাদাম পোড়াইতে পোড়াইতে গল্প আরম্ভ করিল—
‘অনেক অনেক দিন আগে এখানে একটি রাজ্য ছিল। মরুভূমির কিনারায় রাজ্য; ছোট রাজ্য হলেও বড় সুখের রাজ্য। শত্রুর উৎপাত নেই, অন্নাভাব নেই, মারী-মহামারী নেই; প্রজারা অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে মনের আনন্দে বাস করে।
‘রাজার নাম বিজয়কেতু। তরুণ রাজা, সম্প্রতি দক্ষিণ দেশের এক রাজকন্যাকে বিয়ে করেছেন। অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা; যেমন তাঁর রূপ তেমনি মধুর স্বভাব। নাম অরুণাবতী।’
সুবীর চমকিয়া প্রশ্ন করিল— ‘কি নাম বললে?’
রুক্মিণী বলিল— ‘অরুণাবতী। এ গল্পের নাম রানী অরুণাবতীর গল্প।’
সুবীর ও অরুণা বিস্ফারিত চক্ষে পরস্পরের পানে চাহিল, তারপর অরুণা চক্ষু সরাইয়া লইল। সুবীর বলিল— ‘আচ্ছা, তারপর বল—’
রুক্মিণী বলিতে লাগিল। —
রাজা আর রানীর মধ্যে গভীর ভালবাসা; কেউ কাউকে একদণ্ড না দেখে থাকতে পারেন না। রাজা যখন সভায় বসে মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজকার্য করেন, রানী তখন অলিন্দ থেকে উঁকি মেরে দেখে যান। রাজাও রাজকার্য করতে করতে হঠাৎ উঠে গিয়ে রানীকে দেখে আসেন। রাজা আর রানী যেন জোড়ের পায়রা।
রানীর মনে কিন্তু একটি দুঃখ আছে। তাঁর বাপের বাড়ির দেশে যেমন ঋতুতে ঋতুতে নতুন ফুল ফোটে— বসন্তে অশোক নবমল্লিকা জাতী যূথী, গ্রীষ্মে চম্পক বকুল পিয়াল, বষায় গোকর্ণ কদম্ব কেতকী— এদেশে তেমন ফুল ফোটে না।
একদিন সায়াহ্নে রাজা-রানী চন্দ্রশালিকার বিস্তীর্ণ ছাদে হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছিলেন, দেখলেন পশ্চিমের আকাশে মেঘ উঠেছে। দু’জনের মনে খুব আহ্লাদ হল। এদেশে বৃষ্টি কম, মেঘ বেশী আসে না। রানী কাজল কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন— ‘রাজা, অনেক দিন কেতকী ফুলের গন্ধ পাইনি। এদেশে কি কেয়া ফুল পাওয়া যায় না?’
বিজয়কেতু বলিলেন— ‘না। পশ্চিমে লাট দেশ, সেখানে বনেজঙ্গলে কেয়া ফুল ফুটে থাকে, গ্রামের লোকেরা কেয়ার ঝাড় দিয়ে ঘরের বেড়া বাঁধে।’
অরুণাবতী কুতূহলী হয়ে বললেন—‘লাট দেশ! সে কত দূর?’
বিজয়কেতু বললেন—‘ঘোড়ার পিঠে দুই-তিন দিনের পথ।’
রানী অরুণাবতী তখন রাজার বুকের ওপর দু’হাত রেখে পরম আগ্রহভরে বললেন— ‘রাজা, লাট দেশ থেকে আমাকে কেয়া ফুল আনিয়ে দাও। কেয়া ফুলের জন্যে আমার মন বড় ব্যাকুল হয়েছে।’
রাজা বিজয়কেতু বললেন— ‘এ আর বেশী কথা কি! আমি নিজে গিয়ে তোমার জন্যে কেয়া ফুল তুলে নিয়ে আসব।’
অরুণাবতী একটু শঙ্কিত হলেন— ‘তুমি নিজে যাবে?’
বিজয়কেতু বললেন— ‘কাল সকালেই যাত্রা করব। তিন-চার দিনের মধ্যে তোমার কেয়া ফুল নিয়ে ফিরে আসব।’
রানী কিছুক্ষণ রাজার বুকের ওপর মাথা রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপর হাসিমুখ তুলে বললেন— ‘বেশ, তুমি যতদিন না ফিরে আসবে আমি ততদিন রোজ পাঁচ ফোঁটা মধু খাব, আর কিছু খাব না।’
রাজা বললেন— ‘আর কিছু খাবে না কেন?’
রানী বললেন— ‘তাহলে তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।’
পরদিন ভোরবেলা রাজা ঘোড়ায় চড়ে পশ্চিমমুখে যাত্রা করলেন। রানী প্রাসাদের চূড়ায় উঠে যতক্ষণ দেখা যায় চেয়ে রইলেন।
তারপর একদিন গেল, দু’দিন গেল। রানী পাঁচ ফোঁটা মধু খেয়ে আছেন। তৃতীয় দিন থেকে রানী আবার ছাদের উপর যাতায়াত আরম্ভ করলেন। শরীর দুর্বল, কিন্তু মন মানে না! ছাদের কিনারায় গিয়ে পশ্চিমদিকে চেয়ে থাকেন। চতুর্থ দিনও ওইভাবে কাটল। রানীর শরীর দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখের কোলে কালি। ছয়দিন কেটে গেল রাজার কিন্তু দেখা নেই। কোথায় গেলেন রাজা! কী হল তাঁর?
রাজা বিজয়কেতু দ্বিতীয় দিন দুপুরবেলা লাট দেশে পৌঁছেছিলেন। সেখানে জঙ্গল থেকে কয়েকটি কেয়া ফুল তুলেছিলেন। তারপর একটি কেয়া ফুল বল্লমের ডগায় গেঁথে নিয়ে নিজ রাজ্যের দিকে ঘোড়ার মুখ ফিরিয়েছিলেন। ঘোড়া পবনবেগে ঘরের পানে ছুটেছিল।
রাজ্যের সীমানায় ছোট ছোট পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা, এই গিরিসংকট পার হয়ে নিজের রাজ্যে প্রবেশ করতে হয়। তৃতীয় দিন দুপুরবেলা রাজা গিরিসংকটের ভিতর দিয়ে চলেছেন, এমন সময় একদল সশস্ত্র লোক আশপাশের পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে রাজাকে ঘিরে ধরল।
রাজা বিস্মিত হয়ে বললেন—‘একি! কে তোমরা?’
তারা বলল— ‘আমরা যে হই, তুমি আমাদের বন্দী।’
রাজা ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হয়ে বললেন— ‘কি, তোমাদের এত স্পর্দ্ধা। জানো, আমি এ রাজ্যের রাজা?’
তারা জয়ধ্বনি করে বলল— ‘তবে তো ভালই হয়েছে। চল আমাদের সেনাপতির কাছে।’
পাহাড়ের মধ্যে বিদেশী শত্রু ছাউনি ফেলেছে, প্রায় বিশ হাজার সৈন্য। সেনাপতি তখন নিদ্রা যাচ্ছিলেন। সৈন্যরা বলল— ‘তুমি আজ বন্দী থাকো, কাল সেনাপতির সঙ্গে দেখা হবে।’
সৈন্যরা রাজা বিজয়কেতুর কথা বিশ্বাস করেনি, তারা ঠাট্টা তামাসা করতে করতে তাঁকে একটা শিবিরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করে রাখল। রাজা জানতেন, উত্তর থেকে দুর্ধর্ষ শত জাতি ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছে, কিন্তু তারা যে এতদূর অগ্রসর হয়েছে তা তিনি জানতে পারেননি।
পরদিন সেনাপতির সঙ্গে দেখা হল না, সেনাপতি অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার পরদিন দুপুরবেলা সৈন্যরা রাজাকে সেনাপতির কাছে নিয়ে গেল। সেনাপতির প্রকাণ্ড চেহারা, টক্টকে রঙ, বড় বড় চোখ। তিনি রাজাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন ‘আপনি সত্যি এদেশের রাজা?’
বিজয়কেতু বললেন— ‘হ্যাঁ, এই দেখুন আমার অঙ্গুরী, এই দেখুন কবচ।’
সেনাপতি বললেন— ‘আপনি সত্যই রাজা। আমরা আপনার রাজ্য জয় করতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে যখন ধরেছি তখন আর আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না। বিনা যুদ্ধে রাজ্য জয় হয়েছে।’
রাজা বললেন— ‘আমার রাজ্য ক্ষুদ্র, সৈন্যবল সামান্য। এ-রাজ্য জয়ে আপনার গৌরব নেই। তবে কেন এ-রাজ্য জয় করতে চান?’
সেনাপতি বললেন— ‘রাজস্থান বীরভূমি। মাটির গুণে মানুষ বীর হয়, মাটির দোষে কাপুরুষ হয়। তাই আমি রাজস্থান জয় করে নিজের রাজ্য স্থাপন করতে চাই।’
‘কিন্তু আমাকে বন্দী করে লাভ কী? আপনি যদি আমার রাজ্য আক্রমণ করেন রাজ্যের লোক স্বদেশরক্ষার জন্য যুদ্ধ করবে।’
‘না। তারা যখন জানতে পারবে আপনি আমার হাতে বন্দী, তখন আর যুদ্ধ করবে না, আত্মসমর্পণ করবে।’
রাজা চিন্তা করে বললেন— ‘সেনাপতি, আমাকে একবার আমার প্রাসাদে ফিরে যেতেই হবে। আপনি আমাকে দুদিনের জন্য মুক্তি দিন, আমি আবার ফিরে এসে স্বেচ্ছায় ধরা দেব।’
সেনাপতি কিছুক্ষণ রাজার মুখের পানে চেয়ে থেকে বললেন— ‘আপনি যে ফিরে আসবেন তার নিশ্চয়তা কি?’
রাজা সগর্বে— ‘আমি ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কখনো শপথ ভঙ্গ করে না।’
সেনাপতি প্রশ্ন করলেন— ‘কিন্তু প্রাসাদে আপনার এত কী প্রয়োজন?’
রাজা বললেন— ‘আমার পত্নী কেবল কয়েকবিন্দু মধু খেয়ে আমার জন্য প্রতীক্ষা করছেন, তাঁকে দেখা দিয়েই আমি ফিরে আসব।’ রাজা কেতকী ফুল আহরণের কাহিনী সেনাপতিকে বললেন।
শুনে সেনাপতি প্রীত হলেন, বললেন— ‘ভাল। আমি আপনাকে মুক্তি দেব। কিন্তু আজ তো দিন শেষ হয়ে এল। আজ যদি যাত্রা করেন, দিন থাকতে প্রাসাদে পৌঁছুতে পারবেন না। তার চেয়ে কাল সকালে আপনি যাত্রা করবেন। শর্ত রইল পত্নীর সঙ্গে দেখা করেই আপনি ফিরে আসবেন।’
পরদিন প্রত্যুষে রাজা শূলশীর্ষে কেতকী ফুল গেঁথে নিয়ে অশ্বপৃষ্ঠে যাত্রা করলেন।
ওদিকে রানীর অবস্থা তখন শোচনীয়। দিনের পর দিন অনাহারে কাটিয়ে শরীর এত দুর্বল হয়েছে যে শয্যা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হয়, মনের অবস্থা পাগলের মতো। এমন সময় বেলা তিন প্রহরে দাসীরা ছুটে এসে খবর দিল— রাজা আসছেন!
রানী পালঙ্ক থেকে নেমে ছাদের পানে ছুটলেন। দাসীরা মানা করল, কিন্তু শুনলেন না। ছাদের কিনারায় গিয়ে পশ্চিম দিকে তাকালেন। চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছেন না, তবু মনে হল, অনেক দূরে মাঠের পরপার থেকে একজন অশ্বারোহী ছুটে আসছে।
কিছুক্ষণ পরে অশ্বারোহী আরো কাছে এলে রানী চিনতে পারলেন, রাজা আসছেন; তাঁর ভল্লের মাথায় একটি কেয়া ফুল উঁচু হয়ে আছে। রাজাও রানীকে প্রাসাদ-শীর্ষে দেখতে পেয়েছিলেন, তিনি বল্লমসুদ্ধ হাত তুললেন।
রাণী আর আত্মসংবরণ করতে পারলেন না। দু’হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। দাসীরা চিৎকার করে উঠল, কিন্তু রানীকে ধরতে পারল না; তিনি আলিসা পেরিয়ে একেবারে নীচে পড়ে গেলেন।
রাজা এসে দেখলেন রানী অরুণাবতীর মৃতদেহ প্রাসাদমূলে পড়ে আছে। তিনি দু’হাতে মৃতদেহ বুকে তুলে নিলেন।
তারপর রানীকে চিতায় তুলে দিয়ে রাজা কেয়া ফুল দিয়ে চিতা সাজিয়ে দিলেন। চিতা জ্বলে উঠল। কেয়া ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরে গেল।
রাজা আর প্রাসাদে প্রবেশ করলেন না, ঘোড়ায় চড়ে একলা শক সেনাপতির শিবিরে ফিরে গেলেন। সেনাপতিকে বললেন— ‘আমি ফিরে এসেছি। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে আমার রাজ্য আপনি পাবেন না। আসুন, যুদ্ধ করুন।’
শক সেনাপতির সঙ্গে রাজা বিজয়কেতুর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হল। যুদ্ধে রাজা বিজয়কেতু মারা পড়লেন। তারপর শক জাতি এসে রাজ্য দখল করল, সেনাপতি রাজপুরী দখল করলেন। অনেক বছর কেটে গেল; মরুভূমি এসে রাজ্য গ্রাস করে নিল। দেশ জনশূন্য হল। প্রাসাদ শূন্য পড়ে রইল।
এই ভাবে কত শতাব্দী কেটে গেছে তার ঠিকানা নেই। কিন্তু এখনো প্রাসাদের বাতাসে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়ায়, হঠাৎ নিশুতি রাত্রে বীণার ঝঙ্কার শোনা যায়। যারা শুনেছে তারা বলে, রাজার আর পুনর্জন্ম হয়নি, তাঁর আত্মা এই প্রাসাদেই আছে। রানীর জন্ম হয়েছে, তিনি ষাট-সত্তর বছর অন্তর দেহ ত্যাগ করে আসেন, রাজার সঙ্গে তাঁর মিলন হয়। তারপর আবার তিনি চলে যান, রাজা প্রতীক্ষা করে থাকেন।
এই হচ্ছে রাজা বিজয়কেতু আর রানী অরুণাবতীর গল্প। —
গল্প শেষ করিয়া রুক্মিণী তাড়াতাড়ি চলিয়া গেল। তাহার এখনও অর্ধেক রান্না বাকি।
সুবীর দেখিল, অরুণা আচ্ছন্ন অভিভূতের মতো বসিয়া আছে। তারপরই অরুণা চমকিয়া সুবীরের পানে চোখ তুলিল, মুখে ছদ্ম হাসি টানিয়া আনিয়া বলিল— ‘আষাঢ়ে গল্প— না?’
সুবীর বলিল— ‘একেবারে আষাঢ়ে গল্প নাও হতে পারে। মূলে হয়তো একটু সত্যি আছে।’
অরুণা আর কিছু বলিল না। তাহার মুখের উপর রহস্যের পর্দা নামিয়া আসিল। তাহার মনের মধ্যে কী হইতেছে সুবীর তাহা নিঃসংশয়ে অনুমান করিতে না পারিলেও তাহার মনও অশান্ত হইয়া উঠিল। এ কোন্ অদৃশ্য কুহক জালে তাহারা জড়াইয়া পড়িতেছে! যে সন্দেহটা সুবীর জোর করিয়া মন হইতে সরাইয়া দিবার চেষ্টা করিল তাহা এই : অরুণা কি নিজেকে জন্মান্তরের রানী অরুণাবতী মনে করিতেছে এবং মনে মনে বিদেহাত্মা রাজা বিজয়কেতুর উদ্দেশ্যে অভিসারযাত্রার জন্য উৎসুক হইয়াছে? অসুস্থ শরীরে মনও অসুস্থ হয়। ইহা কি সেই অসুস্থতার লক্ষণ?
কিন্তু যাহাই হোক, গল্পের রানীর অরুণাবতী নাম আশ্চর্য রকমের সমাপতন তাহাতে সন্দেহ নাই।
সে রাত্রে অরুণা ‘ক্ষিদে নেই’ বলিয়া শয়ন করিতে চলিয়া গেল। সুবীর যথাসময় আহারাদি সম্পন্ন করিয়া শয়নকক্ষে গিয়া দেখিল অরুণা ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সুবীর তাহাকে জাগাইল না, অস্বচ্ছন্দ মন লইয়া কিছুক্ষণ খাটের চারিপাশে পায়চারি করিল, তারপর শয়ন করিল।
গভীর রাত্রে সুবীরের ঘুম ভাঙিয়া গেল। দূর হইতে যেন বীণাযন্ত্রের অস্ফুট মূৰ্ছনা আসিতেছে। সুবীরের সর্বাঙ্গে কাঁটা দিল। ঘরে আলো নাই, মোমবাতি নিভিয়া গিয়াছে।
অন্ধকারে হাত বাড়াইয়া সুবীর পাশের দিকে অনুভব করিল, অরুণা শয্যায় নাই।
বালিশের পাশে সুবীর একটা বৈদ্যুতিক টর্চ রাখে, সেটা জ্বালিয়া দেখিল শয্যা শুন্য। ঘরের চারিপাশে আলো ফেলিয়া দেখিল, ঘরেও অরুণা নাই। দূরাগত বীণাধ্বনি দূরে মিলাইয়া গেল।
সুবীর স্নায়ুপেশী শক্ত করিয়া কয়েক মিনিট অপেক্ষা করিল, কিন্তু অরুণা আসিল না। তখন সে উঠিয়া গায়ে চাদর জড়াইয়া লইল, টর্চ জ্বালিতে জ্বালিতে অন্য ঘর দু’টা দেখিল। সেখানেও অরুণা নাই।
দৃঢ়ভাবে নিজেকে সংযত করিয়া সুবীর ঘরের বাহিরে ছাদে আসিয়া দাঁড়াইল। পশ্চিম আকাশে প্রায় পূর্ণাঙ্গ চাঁদ ঢলিয়া পড়িয়াছে, আকাশ এবং মরুভূমিতে চাঁদের কিরণ যেন উদ্বেলিত হইয়া পড়িতেছে। কন্কনে ঠাণ্ডা হাওয়া বরফের কাঁটার মতো সুবীরের গায়ে বিঁধিল।
বিশাল ছাদ চন্দ্রকুহেলিতে ঝিমঝিম করিতেছে; সুবীর চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইল, কিন্তু অরুণাকে দেখিতে পাইল না। কিছুক্ষণ সে হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কোথায় গেল অরুণা? এই নির্জন পুরীতে গভীর রাত্রে একাকিনী কোথায় গেল? তবে কি নীচে গিয়াছে! কেন? তাহাকে না জাগাইয়া একাকিনী নীচের তলায় যাইবে কেন?…নিশির ডাক? …না, না, এ সব কী অবিশ্বাস্য কথা সে ভাবিতেছে! আজ সন্ধ্যাবেলা যে গল্প তাহারা শুনিয়াছে, এ সব তাহারই অনুরণন। অরুণা নিশ্চয় কাছেই কোথাও আছে—
সে গলা চড়াইয়া ডাকিল— ‘অরুণা!’
সাড়া নাই। কেবল ঠাণ্ডা বাতাস তাহার কানের কাছে ফিসফিস কথা বলিয়া চলিয়া গেল।
এতক্ষণ সুবীর নিজের মনকে দৃঢ় শাসনে রাখিয়াছিল। এইবার তাহার সংযমের বাঁধন ছিঁড়িয়া গেল। সে ছুটিয়া আলিসার কাছে গিয়া নীচে দৃষ্টিপাত করিল, তারপর নীচের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া সারা ছাদ পরিক্রমণ করিল। না, অরুণা ছাদ হইতে নীচে পড়িয়া যায় নাই। তবে সে কোথায়?
সুবীর ক্ষণকাল মাথায় হাত দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর আবার শয়নকক্ষের দিকে ছুটিল। শয়নকক্ষটা ভাল করিয়া দেখা হয় নাই, হয়তো অরুণা ঘুমের ঘোরে খাটের পাশে পড়িয়া গিয়াছে!
অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করিয়াই সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
ঘরের মধ্যে কেয়া ফুলের গন্ধ ভর্ভর্ করিতেছে। স্থাণুর মতো দাঁড়াইয়া সুবীর ভাবিল— কেয়া ফুলের গন্ধ তবে মিথ্যা নয়, রোগ-বিকৃত মস্তিষ্কের কল্পনা নয়। অতিপ্রাকৃত যতদূর প্রাকৃত হইতে পারে কেয়া ফুলের গন্ধ তাই। বীণাধ্বনিও তাই। এক সূক্ষ্ম জগতের অলৌকিক পরিবেশের মধ্যে তাহারা বাস করিতেছে।
সুবীর টর্চ জ্বালিল। বিছানার এক পাশে অরুণা শুইয়া আছে। তাহার বেশবাস বিস্রস্ত, চুল এলোমেলো; সে গভীর ক্লান্তির ঘুম ঘুমাইতেছে। সুবীরের সংশয় জাগিল, তবে কি অরুণা সারাক্ষণ বিছানায় শুইয়া ছিল! কিন্তু তাহাই বা কি করিয়া সম্ভব।
একটা মোমবাতি জ্বালিয়া সুবীর শয্যাশিয়রে রাখিল, তারপর শয্যায় উঠিয়া অরুণার পাশে বসিল। তাহার নিদ্রাশিথিল মুখের পানে চাহিয়া সুবীরের হৃদয়ে একটি বাষ্পীভূত স্নেহের উচ্ছ্বাস কণ্ঠ পর্যন্ত উদ্গত হইয়া উঠিল। সে দুই বাহু দিয়া নিবিড়ভাবে তাহাকে জড়াইয়া লইয়া রুদ্ধস্বরে ডাকিল— ‘অরুণা! অরুণা!’
অরুণার কিন্তু ঘুম ভাঙিল না; তাহার শ্লথ অঙ্গে কোনও প্রতিক্রিয়া নাই। ক্লান্ত শিশুর মতো সে ঘুমাইয়া রহিল।
নিশ্বাস ফেলিয়া সুবীর তাহাকে ছাড়িয়া দিল, তারপর আলো নিভাইয়া তাহার গায়ে হাত রাখিয়া শয়ন করিল। সে লক্ষ্য করিল, কেতকীর গন্ধ ধীরে ধীরে ঘর হইতে বিলীন হইয়া গেল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙিলে সুবীর অরুণাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কাল রাত্রে কোথায় গিয়েছিলে?’
অরুণার চোখে সদ্য ঘুম ভাঙার জড়িমা; সে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল— ‘কোথায় গিয়েছিলুম! যাইনি তো কোথাও।’
সুবীর বলিল— ‘গিয়েছিলে। দুপুর রাত্রে ঘুম ভেঙে দেখি তুমি বিছানায় নেই।’
অন্তর্লীন কণ্ঠে, অরুণা বলিল— ‘কি জানি— মনে পড়ে না—’ সুবীর দেখিল অরুণার স্মৃতি ফিরিয়া আসিতেছে। সে অপেক্ষা করিয়া রহিল।
অরুণা নত নেত্র তুলিয়া সুবীরের পানে চাহিল; চোখে শঙ্কা ও গোপন উত্তেজনা। সে জড়ানো গলায় বলিল— ‘ঘুমের ঘোরে কি করেছি মনে পড়ছে না।’ তাহার মুখের উপর অদৃশ্য মুখোশের আবরণ পড়িয়া গেল।
বাহিরের ঘর হইতে চায়ের সরঞ্জামের ঠুং ঠাং শব্দ আসিল, গিরধর প্রাতঃকালীন চা আনিয়াছে। সুবীর উঠিয়া পড়িল। তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে কাল রাত্রির কথা অরুণার মনে পড়িয়াছে, কিন্তু সে তাহা সুবীরের কাছে গোপন করিতে চায়। কী কথা গোপন করিতে চায়? স্বপ্নাভিসার?
দিনটা অবসন্ন আলস্যে কাটিয়া গেল। দু’জনেই শামুকের মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটাইয়া লইয়াছে। সুবীর এইরূপ বিচিত্র পরিস্থিতিতে কী করিবে ভাবিয়া পাইতেছে না। অরুণা একটা অন্তর্গূঢ় মাদকতায় নিমজ্জিত হইয়া আছে। তাহারা যেন দুটি সচল যন্ত্র, পরস্পরের সহিত কোনও সচেতন সংযোগ নাই, নিতান্ত আকস্মিকভাবেই একত্র বিন্যস্ত হইয়াছে।
সূর্যাস্তের পর রুক্মিণী ছাদের উপর পাটি পাতিয়া অরুণার চুল বাঁধিতে বসিল। চুল বাঁধার সঙ্গে মৃদুস্বরে জল্পনা চলিতেছে। সুবীর দূর হইতে দেখিল অরুণার মুখ উৎসুক ও উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে; তন্দ্রাচ্ছন্ন মাদকবিমূঢ় ভাব আর নাই। সে একটু আশ্বস্ত হইয়া নীচে নামিয়া গেল। সায়ন্তন জ্যোৎস্নার ম্লান বিজনতায় বালুর উপর ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
জামাইবাবু আজ যদি আসেন ভাল হয়…এ স্থানটা বিজনবাসের পক্ষে খুবই চমৎকার, কিন্তু…প্রাসাদে কোনও বুভুক্ষু আত্মা অদৃশ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে..কেয়া ফুলের গন্ধ, বাজনার আওয়াজ, এসব মিথ্যা নয়..অরুণার মানসিক অবস্থা এখানে আসার পর আরও অবোধ্য রহস্যময় হইয়া উঠিয়াছে…তাহার মনের মধ্যে কী হইতেছে তাহা যদি দেখা যাইত…জামাইবাবু আসিয়া পড়িলে ভাল হয়।…
ঘণ্টাখানেক পরে সুবীর বালির বাঁধ বাহিয়া প্রাসাদে ফিরিয়া আসিল। বসিবার ঘরে চার-পাঁচটা মোমবাতি জ্বলিতেছে; অরুণা একটি আয়না হাতে লইয়া নিজের মুখ দেখিতেছে। সুবীর চমৎকৃত হইয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া পড়িল। অরুণার চুলে নূতন ধরনের কবরীবন্ধ, মুখে অলকা-তিলক, সীমন্তে একগুচ্ছ মুক্তার ঝুম্কা; তাহাকে দেখিয়া মনে হয় সে একটি অজন্তার ছবি। রুক্মিণী তাহাকে সেকালের ভঙ্গিতে সাজাইয়া দিয়াছে।
সুবীর কিছুক্ষণ মুগ্ধনেত্রে চাহিয়া থাকিয়া বলিয়া উঠিল— ‘বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে তোমাকে!’
অরুণা সুবীরকে দেখিতে পায় নাই, ধরা পড়িয়া গিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকিল, তারপর ছুটিয়া শয়নকক্ষে চলিয়া গেল।
অরুণার লজ্জা যেন অস্বাভাবিক। সুবীর ক্ষণকাল অবাক থাকিয়া শয়নকক্ষে অরুণাকে অনুসরণ করিল। দেখিল, অরুণা শয্যায় বালিশে মুখ গুঁজিয়া শুইয়া আছে। খাটের পাশে দাঁড়াইয়া সুবীর হাল্কা সুরে বলিল—‘এতে লজ্জার কী আছে? ওঠো, আর একবার ভাল করে দেখি।’
অরুণা কিন্তু মুখ তুলিল না। কিছুক্ষণ সাধ্যসাধনা করিয়া সুবীর বসিবার ঘরে ফিরিয়া গেল, চেয়ারে বসিয়া চোখের সামনে একটা বই খুলিয়া ধরিল। জীবনটা হঠাৎ অত্যন্ত শুষ্ক এবং জটিল হইয়া উঠিয়াছে।
রাত্রির আহারের পর অরুণা একটা বই লইয়া পড়িতে বসিল। তাহার নূতন সাজসজ্জার লজ্জা কাটিয়া গিয়াছে।
সুবীর বলিল— ‘শুতে যাবে না?’
অরুণা বলিল— ‘না, দুপুরবেলা ঘুমিয়েছি, এখন শুলে ঘুম আসবে না।’
তিক্ত মনে সুবীর একাকী শয়ন করিতে চলিয়া গেল।—
রাত্রি তৃতীয় প্রহরে সুবীরের ঘুম ভাঙিল। এবার বীণাধ্বনি নয়, কেয়া ফুলের হিমগদ্গদ গন্ধ। সুবীরের ইন্দ্রিয়গুলি অতিমাত্রায় সজাগ হইয়া উঠিয়াছে।
শয্যায় অরুণা নাই; সে যে শয়ন করিয়াছিল তাহার চিহ্নও শয্যায় নাই। টর্চ হাতে লইয়া সুবীর খাট হইতে নামিল। পাশের ঘরও নিষ্প্রদীপ, সেখানে অরুণা নাই। সুবীর ছাদে গেল।
আজও চাঁদ অস্ত যাইতেছে, পশ্চিম আকাশে আলোর বন্যা। কিন্তু অরুণা এখানে নাই। ছাদে কেয়া ফুলের গন্ধও কম।
সুবীর ফিরিয়া আসিয়া সিঁড়ির মুখে দাঁড়াইল। এখন কেয়ার গন্ধ বেশী, মনে হয় নীচের তলা হইতে গন্ধটা আসিতেছে। সুবীর ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিল।
যে ঘরটাতে প্রত্নবস্তু রাখা ছিল সেই ঘর হইতে গন্ধ আসিতেছে। সুবীর টর্চ জ্বালিল না, দ্বারের সম্মুখে কিছুক্ষণ নিশ্চল দাঁড়াইয়া রহিল। প্রকাণ্ড ঘর অন্ধকার, কেবল দূরে ঘরের অন্য প্রান্তে মিট্মিট্ করিয়া একটি প্রদীপ জ্বলিতেছে। প্রদীপের আলোয় ঘরের ইতস্তত-বিন্যস্ত টেবিল প্রভৃতি আসবাবগুলি অস্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়।
সুবীর নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল, সন্তর্পণে টেবিলগুলি বাঁচাইয়া ওই আলোকবিন্দুর দিকে অগ্রসর হইল।
অর্ধপথে সে থমকিয়া দাঁড়াইল। মৃদু বিগলিত হাসির শব্দ! যেন দুইটি প্রণয়ী বাসকশয্যায় শুইয়া চুপিচুপি কথা বলিতেছে, গভীর রসালুতার গদ্গদ হাসি হাসিতেছে। দীপের ক্ষীণ আলোকে কিন্তু মানুষ দেখা যাইতেছে না।
সুবীরের মস্তিষ্কের ক্রিয়া বোধকরি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, একটা অন্ধ আবেগ তাহার কণ্ঠ চাপিয়া ধরিয়াছিল। সে আরও কয়েক পা অগ্রসর হইয়া দপ করিয়া টর্চ জ্বালিল।
দেয়াল ঘেঁষিয়া পাটি পাতা, তাহার উপর অরুণা একাকিনী শুইয়া আছে। টর্চের তীব্র আলোয় তাহার অঙ্গের অলঙ্কারগুলি ঝলমল করিয়া উঠিল। সে তড়িদ্বেগে উঠিয়া বিস্ফারিত চক্ষে চাহিল।
‘অরুণা!’
ব্যাধের সাড়া পাইয়া ত্রস্ত হরিণী যেমন পলায়ন করে, অরুণাও তেমনি ছুটিয়া পালাইল। সুবীর ক্ষণকাল হতবুদ্ধির মতো দাঁড়াইয়া রহিল, ঘরের এদিক ওদিকে টর্চের আলো ফেলিল। কেহ কোথাও নাই। কেবল পাটির শিয়রে পীতাভ দীপশিখা জ্বলিতেছে। সুবীর দৈহিক এবং মানসিক জড়তা ঝাড়িয়া ফেলিয়া দ্রুত উপরে ফিরিয়া গেল।
শয়নঘরে অরুণা খাটের উপর উপুড় হইয়া শুইয়া ছিল। সুবীর পাশে গিয়া দাঁড়াইল। — ‘অরুণা!’
অরুণা উঠিয়া বসিল, গলদশ্রু চক্ষে চাহিয়া বলিল— ‘কেন তুমি আমাকে নির্যাতন করছ?’
স্তম্ভিত হইয়া সুবীর বলিল— ‘আমি তোমাকে নির্যাতন করছি!’
অরুণা মিনতি-ভরা কণ্ঠে বলিল— ‘আমাকে ছেড়ে দাও! মুক্তি দাও।’
সুবীর খাটের পাশে বসিল, অরুণার হাত ধরিয়া স্নেহার্দ্রস্বরে বলিল— ‘অরুণা, চল আমরা এখান থেকে চলে যাই, এই অভিশপ্ত বাড়ি ছেড়ে দেশে ফিরে যাই।’
অরুণা সত্রাসে হাত ছাড়াইয়া লইয়া বলিল— ‘অ্যাঁ! না না না—’
সুবীর বলিল— ‘এখানে তোমার মনের রোগ সারবে না। আমি তোমাকে আর এখানে থাকতে দেব না। জামাইবাবু আসুন, কালই আমরা চলে যাব।’
‘না না না—আমি যাব না—’
‘হ্যাঁ যাবে। তোমাকে আমি জোর করে নিয়ে যাব। এ বাড়িতে আর নয়।’
‘না না না—’ অরুণা ধড়মড় করিয়া খাট হইতে নামিয়া পড়িল, তারপর তীরবেগে ছাদের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল।
‘অরুণা, অরুণা—’ ডাকিতে ডাকিতে সুবীর তাহার পিছনে ছুটিল।
চাঁদ অস্ত যাইতেছে, আকাশে বাঁধভাঙা জ্যোৎস্নার প্লাবন। সুবীর দেখিল অরুণা ছুটিতে ছুটিতে ছাদের পশ্চিম কিনারার দিকে যাইতেছে। সেও উচ্চকণ্ঠে অরুণার নাম ধরিয়া ডাকিতে ডাকিতে ছুটিল।
ছাদের আলিসার কাছে আসিয়া অরুণা একবার পিছন দিকে চাহিল। দেখিল, সুবীর ছুটিয়া আসিতেছে। অনৈসর্গিক চিৎকার করিয়া অরুণা ছাদ হইতে নীচে ঝাঁপাইয়া পড়িল।
সুবীর আলিসার উপর ঝুঁকিয়া দেখিল, জ্যোৎস্নালোকে অরুণা বিশ হাত নীচে বালুর উপর পড়িয়া আছে। সুবীর দীর্ঘ শিহরিত নিশ্বাস টানিয়া অন্ধের মতো সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া গেল।
আল্গা নরম বালুর উপর অরুণার দেহ বিস্রস্তভাবে লুণ্ঠিত রহিয়াছে। সুবীর দেখিল, তাহার জ্ঞান নাই কিন্তু প্রাণ আছে। আল্গা বালুর উপর পড়িয়াছিল বলিয়া দেহে আঘাত লাগে নাই। তখন সুবীর নিজের অজ্ঞাতসারে ‘অরুণা, অরুণা’ বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে তাহাকে দুই বাহু দিয়া তুলিয়া লইল, অসীম কষ্টে বালুর বাঁধ পার হইয়া উপরে আসিল; অরুণার বালু-ধূসর দেহ বিছানায় শোয়াইয়া দিল।
সকাল হইতে এখনও দুই-তিন ঘণ্টা বাকি। সুবীর ভিজা তোয়ালে দিয়া অরুণার মুখ ও দেহ মুছাইয়া দিল। অরুণার কিন্তু জ্ঞান হইল না।
নিঝুম রাত্রি! ঝি-চাকরদের জাগাইবার কথা সুবীরের মনে আসে নাই। সে অরুণার পাশে বসিয়া একদৃষ্টে তাহার মুখের পানে চাহিয়া রাত কাটাইয়া দিল।
সকাল সাড়ে সাতটার সময় জীপে চড়িয়া বিরাজবাবু আসিলেন। সুবীরের মুখে সমাচার শুনিয়া তিনি বলিলেন— ‘এখনি হাসপাতালে নিয়ে চল।’
রেল স্টেশনের কাছে হাসপাতাল। অরুণাকে জীপে তুলিয়া সেখানে লইয়া যাওয়া হইল। প্রবীণ ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন, শরীরে কোনও আঘাত নাই, কেবল কংকাশন হইয়াছে, শীঘ্রই জ্ঞান হইবে।
অপরাহ্নে তিনটার সময় অরুণার জ্ঞান হইল। ধীরে ধীরে চক্ষু মেলিয়া সে কিছুক্ষণ শুন্যপানে চাহিয়া রহিল, তারপর তাহার চোখের কোণ দিয়া দুই বিন্দু অশ্রু গড়াইয়া পড়িল। সুবীর পাশে বসিয়া ছিল, সে অরুণার মুখের উপর ঝুঁকিয়া ব্যগ্রস্বরে বলিল— ‘অরুণা!’
অরুণার ঠোঁট দু’টি একটু নড়িল— ‘আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।’
‘বাড়ি!’
‘হ্যাঁ। কলকাতায় আমাদের নিজের বাড়িতে ফিরে যাব।’
বিহ্বল উল্লাস দমন করিয়া সুবীর বলিল— ‘আজই আমরা কলকাতায় ফিরে যাব।’
মেল ট্রেন সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া বাংলা দেশে প্রবেশ করিয়াছে। সর্বাঙ্গ প্রকম্পিত করিয়া হু হু শব্দে ছুটিয়াছে। এখানে মরুভূমি নাই, যতদূর দৃষ্টি যায় হিমচর্চিত শ্যামলতা।
কুপে কামরার মধ্যে সুবীর অরুণার হাত ধরিয়া কাছে টানিয়া লইল, আস্তে আস্তে বলিল— ‘অরুণা, মরুভূমির মাঝখানে সেই পাথরের বাড়িটার কথা তোমার মনে আছে?’
অরুণা অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, শেষে বলিল— ‘ও কথা আর কোনও দিন আমাকে মনে করিয়ে দিও না। আমি ভুলে যেতে চাই।’
সুবীর তাহার মুখখানা গাঢ়ভাবে নিজের বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিল— ‘আমি তোমাকে ভুলিয়ে দেব। তুমিও একটা কথা মনে রেখো, ইহজন্মে তুমি আমার।’
১৮ পৌষ ১৩৬৮