ওরে মৃত্যু , জানি তুই আমার বক্ষের মাঝে বেঁধেছিস বাসা । যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর স্নেহ-ভালোবাসা , গোপন মনের আশা , জীবনের দুঃখ সুখ , মর্মের বেদনা , চিরদিবসের যত হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা বাসনা-সাধনা ; যেখানে নন্দন-ছায়ে নিঃশঙ্কে করিছে খেলা অন্তরের ধন , স্নেহের পুত্তলিগুলি , আজন্মের স্নেহস্মৃতি , আনন্দকিরণ ; কত আলো , কত ছায়া , কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের গীতিময়ী ভাষা — ওরে মৃত্যু , জানিয়াছি , তারি মাঝখানে এসে বেঁধেছিস বাসা! নিশিদিন নিরন্তর জগৎ জুড়িয়া খেলা , জীবন চঞ্চল । চেয়ে দেখি রাজপথে চলেছে অশ্রান্তগতি যত পানথদল ; রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে পাখিগুলি উড়ে যায় প্রাণপূর্ণ বেগে , সমীরকম্পিত বনে নিশিশেষে নব নব পুষ্প উঠে জেগে ; চারি দিকে কত শত দেখাশোনা আনাগোনা প্রভাতে সন্ধ্যায় ; দিনগুলি প্রতি প্রাতে খুলিতেছে জীবনের নূতন অধ্যায় ; তুমি শুধু এক প্রান্তে বসে আছ অহর্নিশি স্তব্ধ নেত্র খুলি — মাঝে মাঝে রাত্রিবেলা উঠ পক্ষ ঝাপটিয়া , বক্ষ উঠে দুলি । যে সুদূর সমুদ্রের পরপার-রাজ্য হতে আসিয়াছ হেথা , এনেছ কি সেথাকার নূতন সংবাদ কিছু গোপন বারতা । সেথা শব্দহীন তীরে ঊর্মিগুলি তালে তালে মহামন্দ্রে বাজে , সেই ধ্বনি কী করিয়া ধ্বনিয়া তুলিছ মোর ক্ষুদ্র বক্ষোমাঝে । রাত্রি দিন ধুক ধুক হৃদয়পঞ্জর-তটে অনন্তের ঢেউ , অবিশ্রাম বাজিতেছে সুগম্ভীর সমতানে শুনিছে না কেউ । আমার এ হৃদয়ের ছোটোখাটো গীতগুলি , স্নেহ-কলরব , তারি মাঝে কে আনিল দিশাহীন সমুদ্রের সংগীত ভৈরব । তুই কি বাসিস ভালো আমার এ বক্ষোবাসী পরান-পক্ষীরে , তাই এর পার্শ্বে এসে কাছে বসেছিস ঘেঁষে অতি ধীরে ধীরে ? দিনরাত্রি নির্নিমেষে চাহিয়া নেত্রের পানে নীরব সাধনা , নিস্তব্ধ আসনে বসি একাগ্র আগ্রহভরে রুদ্র আরাধনা । চপল চঞ্চল প্রিয়া ধরা নাহি দিতে চায় , স্থির নাহি থাকে , মেলি নানাবর্ণ পাখা উড়ে উড়ে চলে যায় নব নব শাখে ; তুই তবু একমনে মৌনব্রত একাসনে বসি নিরলস । ক্রমে সে পড়িবে ধরা , গীত বন্ধ হয়ে যাবে মানিবে সে বশ । তখন কোথায় তারে ভুলায়ে লইয়া যাবি — কোন্ শূন্যপথে , অচৈতন্য প্রেয়সীরে অবহেলে লয়ে কোলে অন্ধকার রথে! যেথায় অনাদি রাত্রি রয়েছে চিরকুমারী — আলোক-পরশ একটি রোমা ' রেখা আঁকে নি তাহার গাত্রে অসংখ্য বরষ ; সৃজনের পরপ্রান্তে যে অনন্ত অন্তঃপুরে কভু দৈববশে দূরতম জ্যোতিষ্কের ক্ষীণতম পদধ্বনি তিল নাহি পশে , সেথায় বিরাট পক্ষ দিবি তুই বিস্তারিয়া বন্ধনবিহীন , কাঁপিবে বক্ষের কাছে নবপরিণীতা বধূ নূতন স্বাধীন । ক্রমে সে কি ভুলে যাবে ধরণীর নীড়খানি তৃণে পত্রে গাঁথা — এ আনন্দ-সূর্যালোক , এই স্নেহ , এই গেহ , এই পুষ্পপাতা ? ক্রমে সে প্রণয়ভরে তোরেও কি করে লবে আত্মীয় স্বজন , অন্ধকার বাসরেতে হবে কি দুজনে মিলি মৌন আলাপন । তোর স্নিগ্ধ সুগম্ভীর অচঞ্চল প্রেমমূর্তি , অসীম নির্ভর , নির্নিমেষ নীল নেত্র , বিশ্বব্যাপ্ত জটাজূট , নির্বাক অধর — তার কাছে পৃথিবীর চঞ্চল আনন্দগুলি তুচ্ছ মনে হবে ; সমুদ্রে মিশিলে নদী বিচিত্র তটের স্মৃতি স্মরণে কি রবে ? ওগো মৃত্যু , ওগো প্রিয় , তবু থাক্ কিছুকাল ভুবনমাঝারে । এরি মাঝে বধূবেশে অনন্তবাসর-দেশে লইয়ো না তারে । এখনো সকল গান করে নি সে সমাপন সন্ধ্যায় প্রভাতে ; নিজের বক্ষের তাপে মধুর উত্তপ্ত নীড়ে সুপ্ত আছে রাতে ; পানথপাখিদের সাথে এখনো যে যেতে হবে নব নব দেশে , সিন্ধুতীরে , কুঞ্জবনে নব নব বসন্তের আনন্দ-উদ্দেশে । ওগো মৃত্যু , কেন তুই এখনি তাহার নীড়ে বসেছিস এসে ? তার সব ভালোবাসা আঁধার করিতে চাস তুই ভালোবেসে ? এ যদি সত্যই হয় মৃত্তিকার পৃথ্বী- ' পরে মুহূর্তের খেলা , এই সব মুখোমুখি এই সব দেখাশোনা ক্ষণিকের মেলা , প্রাণপণ ভালোবাসা সেও যদি হয় শুধু মিথ্যার বন্ধন , পরশে খসিয়া পড়ে , তার পরে দণ্ড-দুই অরণ্যে ক্রন্দন — তুমি শুধু চিরস্থায়ী , তুমি শুধু সীমাশূন্য মহাপরিণাম , যত আশা যত প্রেম তোমার তিমিরে লভে অনন্ত বিশ্রাম — তবে মৃত্যু , দূরে যাও , এখনি দিয়ো না ভেঙে এ খেলার পুরী ; ক্ষণেক বিলম্ব করো , আমার দুদিন হতে করিয়ো না চুরি । একদা নামিবে সন্ধ্যা , বাজিবে আরতিশঙ্খ অদূর মন্দিরে , বিহঙ্গ নীরব হবে , উঠিবে ঝিল্লির ধ্বনি অরণ্য-গভীরে , সমাপ্ত হইবে কর্ম , সংসার-সংগ্রাম-শেষে জয়পরাজয় , আসিবে তন্দ্রার ঘোর পান্থের নয়ন ' -পরে ক্লান্ত অতিশয় , দিনান্তের শেষ আলো দিগন্তে মিলায়ে যাবে , ধরণী আঁধার — সুদূরে জ্বলিবে শুধু অনন্তের যাত্রাপথে প্রদীপ তারার , শিয়রে শয়ন-শেষে বসি যারা অনিমেষে তাহাদের চোখে আসিবে শ্রান্তির ভার নিদ্রাহীন যামিনীতে স্তিমিত আলোকে — একে একে চলে যাবে আপন আলয়ে সবে সখাতে সখীতে , তৈলহীন দীপশিখা নিবিয়া আসিবে ক্রমে অর্ধরজনীতে , উচ্ছ্বসিত সমীরণ আনিবে সুগন্ধ বহি অদৃশ্য ফুলের , অন্ধকার পূর্ণ করি আসিবে তরঙ্গধ্বনি অজ্ঞাত কূলের — ওগো মৃত্যু , সেই লগ্নে নির্জন শয়নপ্রান্তে এসো বরবেশে । আমার পরান-বধূ ক্লান্ত হস্ত প্রসারিয়া বহু ভালোবেসে ধরিবে তোমার বাহু ; তখন তাহারে তুমি মন্ত্র পড়ি নিয়ো , রক্তিম অধর তার নিবিড় চুম্বন দানে পাণ্ডু করি দিয়ো ।