1 of 2

প্রতীক্ষার ঘর

প্রতীক্ষার ঘর

টিকটিকিরা জল খায় না। বলে নতুন লোকটা খুব গম্ভীর চিন্তায় ডুবে গেল।

আমরা ক’জন দেশলাই কাঠি দিয়ে জুয়ো খেলছিলাম। তাসটা খুব পুরোনো হয়ে গেছে। চলে। ইস্কাপনের টেক্কা কি হরতনের গোলাম সবই ঘেঁড়ার দাগ দেখে পিছন থেকেই চেনা যায়, টেক্কাটা ছিঁড়েছে পাশ থেকে মাঝখান অবধি, গোলামটার দুটো কোণা নেই, এরকম সব তাসই একটু খেয়াল করলেই চেনা যায় আজকাল। বাদু তাস বাঁটতে–বাঁটতেই বলে–রন্টে, তোর ঘরে টেক্কা সাহেব গেছে, দেখ যদি বিবিটা পাস। শেষ তাসটা পেছন থেকে দেখেই মন বিগড়ে গেল। চিড়ের দুরি।

ব্লাইন্ড দিবি না? হারু জিগ্যেস করে।

বিস্বাদ মুখে বললাম–প্যাক। তাস ফেলে নতুন লোকটার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করি–টিকটিকিরা জল খায় না?

লোকটা মুখ ফিরিয়ে আমার মুখটা একটু দেখল, বলল –জল খেতে কখনও দেখেছেন?

–না।

–তবে?

–শুনেছি টিকটিকি পেচ্ছাব করে, জল না খেলে…

লোকটা শ্বাস ফেলে বলে–ওসব আন–কথা কান–কথা। দেওয়াল জুড়ে মরুভূমি, জল পাবে কোথায়?

একটু ভাবতে থাকি, নতুন লোকটার মাথায় এত কথাও আসে!

ডালিম রাজার জোড়া পেয়ে দুটো কাঠি ব্লাইন্ড দিল। তাস সবই চেনা। দেখেও যা, না দেখেও তাই। তবু ব্লাইন্ড আর সীন চালু আছে নিয়ম মাফিক। ব্লাইন্ড দিয়ে সে হারুকে বলল –কাল তেরোটা কাঠি জিতেছিলাম, তার মধ্যে সাতটা জ্বলেনি, ঠুকতেই বারুদ খসে গেল।

হারু উত্তর দিল না। সে আমাদের একটা বুদ্ধি শিখিয়েছিল, দেশলাই কিনে কাঠিগুলো। লম্বালম্বি ব্লেড দিয়ে চিরে ফেলে সে। তাতে কাঠিটা দু-ভাগ হয়, বারুদও দু-ভাগে হয়ে যায়। ঠিকমতো বুকে জ্বালতে পারলে দু-ভাগই জ্বলে। একটা কাঠিতে দুটো কাঠি পেয়ে যাই আমরা। দেশলাই সম্পর্কে হারুকে আমরা এক্সপার্ট বলে মানি।

হারু উত্তর দিল না, কিন্তু নতুন লোকটা বলল –জ্বলবে কী করে? ওই সাতটা কাঠিতে যে বারুদের বদলে মাটি লাগানো ছিল। আমিও কাল তিনটে কাঠি জ্বালতে পারিনি। কিন্তু আমার স্বভাব সবকিছু খুঁটিয়ে দেখা, বারুদ খুঁটে দেখলাম কাঠির মাথায় পোড়া দাগ। বারুদগুলো পিষে দেখি মাটি।

ডালিম অবাক হয়ে বলে–তাই বটে? কাজটা কার?

–হারুবাবুর ছাড়া আর কার! দেশলাই উনি ভাল চেনেন। হারু রুখে উঠল না। কেমন ঠাণ্ডা চোখে নতুন লোকটার দিকে চেয়ে বলল  কাঠিতে আমার নাম সই করা ছিল?

–না। ভেবেচিন্তে বের করলাম।

ডালিম হাত বাড়িয়ে বলল  দেখি তোর কাঠিগুলো।

হারু তার কাঠি সরিয়ে বলল –মাটি নয় রে। দেশলাইটা ড্যাম্প ছিল হয়তো। ডালিম তবু হাত বাড়িয়ে দুটো কাঠি ছিনিয়ে নিয়ে আঙুলে পিষে দেখল। মাটিই।

নতুন লোকটা ডেক চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজল। ডেক চেয়ারের বেতের বুনুনি কবে ছিঁড়ে গেছে। সেই  ছেঁড়া জায়গা দিয়ে লোকটার পশ্চাদ্দেশ ঝুলে আছে। কিন্তু বসবার ভঙ্গি দেখে কোনও অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হয় না। অভ্যাস হয়ে গেছে। চোখ বুজেই বলল –যখন পয়সার খেলা চালু ছিল তখন হারুবাবু কী দিতেন?

ঠিক প্রশ্ন নয়, যেন অনেকক্ষণ বাদে একটা ভাববার মতো বিষয় পাওয়া গেছে বলে লোকটা গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগল চোখ বুজে!

বাদু অবাক হয়ে বলল –মাইরি হারু, এ যে কেষ্টনগরের কারিগরদের কাজ। সেবার মাসতুতো বোন চিনেবাদাম খেতে দিয়েছিল, ধরতেই পারিনি, কামড়ে দেখি মাটি! তুই শালা তো মাটির দেশলাইয়ের কারবার খুললে লাখোপতি হয়ে যাবি!

এসব কথায় আমার কান নেই, ভারী তো দেশলাইয়ের কাঠি! টিকটিকি জল খায় না-এ ব্যাপারটা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

নতুন লোকটার দিকে চেয়ে বললাম টিকটিকি জল খায় না, এ কথাটা ঠিকই। আমিও ভেবে দেখলাম।

লোকটা শ্বাস ফেলে বলল –যখন আপনাদের পয়সার খেলা চালু ছিল তখন হারুবাবু কী দিতেন বলুন তো!

একটু ভাবতে হলো। বললাম–কী জানি! সেই কবে আমরা পয়সা দিয়ে খেলতাম তা কি আর মনে আছে! এখন পয়সা পেলেই সিগারেট কিনে ফেলি। খেলি না।

লোকটা বুঝদারের মতো মাথা নাড়ে!

কাঠের সুইং ডোরটা নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আর আপনা থেকে বন্ধ হয় না, হাঁ হয়ে থাকে। ইঁদুরের ডাকের মতো শব্দ করে সেটা ঠেলে মতে ঘরে এল। হাতে ঝাড়ু আর ফিনাইলের টিন, তার পরনে নীল হাফশার্ট আর নীল হাফপ্যান্ট। বলল –আজ ন’টার ট্রেনে প্যাসেঞ্জার আসছে। ঘর খালি রাখবেন।

ট্রেনের এখনও দেরি আছে। আমরা কেউ নড়লাম না। বাথরুমে মতের ঝাঁটার শব্দ হতে লাগল, আর ফিনাইলের ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া গেল। গন্ধটা আমার বেশ লাগে। আগে জামাকাপড় যখন বাক্স থেকে বের করে পরতাম তখন ন্যাপথলিনের গন্ধ ভুরভুর করত। সে গন্ধটা এরকমই। আজকাল আর বাক্সে রাখার মতো জামা–কাপড় নেই, সেই গন্ধটা আর পাই না, জামা প্যান্ট ময়লা হলে এক-একদিন রাতে ফিরে বাংলা সাবান দিয়ে কেচে দিই। সকালের মধ্যে শুকোয় না। একটু ভেজা-ভেজা থাকে। তাই পরে বেরিয়ে পড়ি, গায়ে-গায়ে শুকিয়ে যায় ঠিক।

মতে বাথরুমে তালা দিয়ে আবার বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলে গেল–প্যাসেঞ্জার আসছে। মনে থাকে যেন।

প্যাসেঞ্জার অবশ্য খুব কমই আসে। উত্তরে একটা নতুন জংশন হওয়ার পর পাহাড় লাইনের যাত্রীরা ওই জংশন থেকেই হিল–স্টেশনে চলে যায়। এদিকে কেউ বড় একটা উজিয়ে আসে না। সেইটে লক্ষ্য করেই আমরা কিছুদিন হল স্টেশনের প্রথম শ্রেণির ওয়েটিং রুমটা দখল করে আছি। স্টেশন মাস্টারও কিছু বলেন না। তাঁর মেয়েদের আমরা কখনও হুড়ো দিই না। তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে কলকাতায় গেলে আমরা তাঁর কোয়ার্টার্সের পেঁপে কাঁঠাল আর নারকেল গাছ পাহারা দিয়েছি। তিনি বলে গিয়েছিলেন বাবা, তোমরা দেখো। আমরা দেখেছিলাম। তিনি ফিরে এসে গাছে বোঁটাসুদ্ধ ফল দেখে ভারী খুশি। অবশ্য তাঁর ফিরে আসার দিন রাতেই আমরা

সব পেড়ে নিই, আর মঙ্গলবারে হাটে বেচে দিয়ে সিনেমা দেখি। তবু তিনি আমাদের ওয়েটিং রুমের ব্যাপারে কিছু বলেন না। ঘরের বাইরে থাকলে আমাদের মাথায় অনেক বদখেয়াল আসে যে!

বাদু একটা সিগারেট আদ্দেক খেয়ে ডালিমকে দিল। চার টানের পর হারু পাবে। হারু চেয়ে আছে। আবার তাস বাঁটছে বাদু। খুব আস্তে ধোঁয়া ছাড়ছে। আমার ভাগে একটা তিন আর নলা পড়েছে। দেখে চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। শেষ তাসটা পড়ার পর একপলক চেয়ে দেখলাম, ডায়মন্ডসের গোলাম।

তাসটা বড় তাসে রেখে দিয়ে বললাম–টিকটিকি তাহলে পেচ্ছাপ করে কী করে? অ্যাঁ!

লোকটা চোখ বুজেই বলল –ট্রেনটা কি রাইট টাইমে আসছে?

–তাই কখনও আসে?

–একটু খবর নিন তো। সকালবেলাটায় জ্বালালে! এ গরমে আর কোথায় যাব!

–ওভারব্রিজ আছে। আমি বললাম।

–দূর। ওখানে বড্ড ভিখিরির ভিড়।

লাইন ক্লিয়ারের ঘন্টার শব্দ শুনে আমরা তাস গুটিয়ে বড় গোল টেবিল থেকে নেমে পড়লাম। নতুন লোকটাও উঠল।

ওভারব্রিজের সিঁড়ির তলায় ভিখিরিরা কাঠের উনুনে খাসির নাড়িভুড়ি সেদ্ধ করছে। ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। ব্রিজের ওপরের দিকে কয়েকটা সিঁড়ি নেই। সেই গর্তগুলো সাবধানে আমরা পার হলাম। ছাউনি দেওয়া ব্রিজের ওপরের টিন তেতে আছে। ধুলোর  ঝাঁপটা মারছে গরম বাতাস। পশ্চিমা কুলি আর বুড়ো ভিখিরিরা গামছা পেতে টান–টান হয়ে শুয়ে। আমরা ফুঁ দিয়ে ধুলো উড়িয়ে এক জায়গায় বসলাম। হারু বলল –ডালিম তুই স্নান করিস না? গা থেকে চামসে গন্ধ আসছে।

–কুয়ো শুকিয়ে আসছে। বাবা পরশু সকালে জল মেপে আমাদের দু ভাইয়ের, যাদের চাকরিবাকরি নেই, তাদের স্নান বারণ করে দিল।

–জল মাপে কী করে? বাদু জিগ্যেস করে।

–দড়িতে গিঁট দেওয়া আছে। সেই গিঁট না ডুবলেই আমাদের স্নান বারণ হয়ে যায়। ডালিম বলে।

নতুন লোকটা বিজ্ঞের মতো বলল –কুয়ো দু-রকমের আছে, ঝরণা–কুয়ো আর বোম–ফাটা কুয়ো, আপনাদেরটা কোনরকমের?

ডালিম বলল –আমাদেরটা বোম–ফাটা। কাটতে কাটতে হঠাৎ চড়াক করে একজায়গা থেকে তোড়ে জল বেরিয়েছিল।

লোকটা বলল –ওই কুয়োই খারাপ, জল শুকিয়ে যায়। ঝরনা-কুয়ো কাটলে খুব ডিপ হয়, আর চারধার থেকে ঝিরঝির করে জল এসে কুয়ো ভরে ওঠে। তার জল শুকোয় না।

পৃথিবীর এত জল, তবু যে কেন টিকটিকি জল খায় না! ভাবতে ভারী অবাক লাগছিল আমার।

আমি নতুন লোকটাকে বললাম–আচ্ছা মাশাই, দেওয়াল কুঁড়ে অশ্বত্থ গাছও তো ওঠে! শেকড় দিয়ে দেওয়াল থেকেও রস–কষ টেনে নেয়। টিকটিকির তেমন কোনও ইন্দ্রিয় নেই তো?

লোকটা আমার মুখের দিকে চেয়ে কী একটু মনোযোগ দিয়ে দেখল, তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল –ওই ট্রেন আসছে!

দেখলাম, বাজারের লেভেল ক্রসিং পার হয়ে ট্রেনটা হনহন করে আসছে। দুটো কুলি সেই শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে মাথায় গামছা জড়াতে লাগল। আমরা ওভারব্রিজের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নীচে চেয়ে রইলাম।

দেখার কিছুই নেই এখন। এক সময়ে ছিল। ব্রিটিশ আমলে সাহেবসুবোরা এই স্টেশনে নেমেই উত্তরের পাহাড় লাইনে যেত। তখন মেল ট্রেন থামত এখানে, সারাটা স্টেশনে গমগমে ভাব ছিল, ওয়েটিংরুমে বার্মা সেগুনের ফার্নিচার, সূক্ষ্ম জালের দরজাওয়ালা রেস্টুরেন্ট–সবই ছিল। এখন উত্তরের জংশন হওয়ায় মেল ট্রেন আর এ পর্যন্ত আসে না। এটা হয়ে গেছে ব্রাঞ্চ লাইন, সারাদিনে দুটো প্যাসেঞ্জার আপ ডাউনে চলে। বিশাল স্টেশনবাড়িটা ফাঁকাপড়ে থাকে। বিনা-টিকিটের যাত্রী এত বেশি যে রেল কর্তৃপক্ষ এ লাইনটা তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে। ওভারব্রিজের তক্তা খুলে পড়ে যাচ্ছে, প্ল্যাটফর্মে হঁট বেরিয়ে আছে, ভিখিরির বাচ্চারা প্ল্যাটফর্মের যেখানে সেখানে তাদের শরীরের ক্কাথ ফেলে রাখে।

আমরা ট্রেন দেখবার জন্য ঝুঁকে পড়লাম। সবসুদ্ধ জনা ত্রিশ-চল্লিশ লোক নামল। বয়সের মেয়েছেলে নেই, সাহেব আমলের বুড়ো চেকার নিকলসন ঘাড় কাত করে গেট-এর কাছে দাঁড়িয়ে ভিখিরির মতো হাত বাড়িয়ে আছে। যে যার ইচ্ছেমতো সেই হাতখানা ঠেলে–ঠেলে চলে যাচ্ছে, টিকিট কেউ দেয় না। নতুন লোক এলে নিকলসনকে দেখে একটু থমকাবেই। নীল চোখ, লাল চুল, সাদা রঙের আস্ত একটা সাহেব। কিন্তু সে নিজে তার সাহেবত্ব ভুলে গেছে কবে। আমাদের বিজয়কে দেখলে ‘ভিজয় ভিজয়’ বলে ডাকাডাকি করে বিজয়ের কৌটো থেকে দু-তিন টিপ নস্যি নেয়। সাহেবি আমলে তার মেমবউ ছিল, সে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নিকলসন তাদের নেপালি আয়াকে প্রোমোশন দিয়ে বউ করে রেখেছে। নেপালি আর ইংরিজিতে তাদের মাঝে-মাঝে ধুন্দুমার ঝগড়া হয়। নিকলসন সাহেব ঝিঙে, টেকির শাক সবই খায় আজকাল।

মেয়েছেলে দেখা গেল না। তিন-চারজন বেশ ভালো চেহারা আর পোশাকের লোক ওয়েটিং রুমের দিকে গেল। ব্রিজের তলায় ভিখিরিদের উনুনে নতুন কাঠ গুঁজে দিয়েছে। সেই ধোঁয়ায় চোখে জল এসে যাচ্ছিল।

হারু বলল –নিকলসন সাহেব আর বেশিদিন বাঁচবে না, বুঝলি! ওর বোধবুদ্ধি ভোঁতা হয়ে কেমন হয়ে গেছে।

–কেন? আমি জিগ্যেস করি।

হারু বলে–সেদিন ডাউন প্যাসেঞ্জারটা চলে যাওয়ার পর নিকলসন বেঞ্চটায় বসে বিড়ি ধরাবার সময় যেই মাথার হ্যাট খুলেছে, অমনি হ্যাটের ভিতর থেকে একটা বোলতা বেরিয়ে উড়ে গেল।

–যাঃ!

–মাইরি–মাইরি! মাথার চুল ছাঁটে না বলে ঝোপড়া হয়ে আছে মাথা, তাই কামড়ায়নি, কিন্তু টুপির ভিতর বোলতা উড়লে লোকে টের পাবে না! ও কিন্তু পায়নি। তাই বলছিলাম–

ডালিম প্ল্যাটফর্মের লোক দেখতে-দেখতে হঠাৎ চেঁচিয়ে ডাকল–আরে! মদন, এই মদন–

আমরা সবাই ওভারব্রিজের রেলিঙ ধরে ঝুঁকে পড়লাম। নিকলসনের হাতটা ঠেলে মদন বেরিয়ে এল। বগলে একটা কাগজের প্যাকেট, মুখ তুলে আমাদের দেখে একটু ভ্রূ কুঁচকে বলল  

–তোরা!

–খালাস পেলি? বলে আমি চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, বাদু আমাকে খোঁচা দিয়ে বলে–এই শালা, খালাসের কথা চেঁচিয়ে বলতে আছে? তুই একটা–অশ্লীল কথা দিয়ে বাক্য শেষ করে বাদু। তারপর ঝুঁকে বলে–উঠে আয় না, মদন।

মদন একটু বিরক্ত চোখে আমাদের দেখল, একটু ইতস্তত করল, তারপর উঠে এল। তার মাথায় একটোকা চুল পিঙলে হয়ে জট বেঁধেছে, গায়ে বসা–ময়লা, হাত পায়ের গাঁট ফোলা ফোলা খুব রোগাও হয়ে গেছে।

–কবে খালাস পেলি? হারু জিগ্যেস করে।

মদন গম্ভীর গলায় বলে–কাল।

–খালাস না জামিন? আমি জিগ্যেস করি।

মদন গম্ভীরভাবে আমার দিকে চেয়ে বলল –তোর বয়স আর বাড়ল না রন্টে! দু বছর হাজতে থাকার পরও কেউ জামিন পায়?

আমি আমতা-আমতা করে বলি কাগজে কেবল জামিনের কথাই পড়ি তো। শোনা যায়, পুলিশ সবাইকে ধরে নিয়ে জামিনে আবার ছেড়ে দেয়, তারপর আর ধরে না।

মদন একটু গর্বের সঙ্গে বলল –আমারটা ছিল নন বেইলেবল কেস!

কথাটার মানে তেমন পরিষ্কার বুঝলাম না, ইংরেজিতে আমি বরাবর কাঁচা।

ডালিম জিগ্যেস করল–কেমন ছিলি?

মদনের চোখ চকচক করে ওঠে। একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে–কেমন আর! আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেমন হয়–বলতে-বলতে সে নতুন লোকটার দিকে চেয়ে বলে–ইনি কে?

ডালিম নীচু গলায় বলে–শ্রেণিহীন সমাজের লোক। বলে খুকখুক করে হাসে।

–তার মানে? মদন একটু রুখে উঠে বলে। ‘শ্রেণিহীন সমাজ’ কথাটা বোধহয় তার ভালো লাগে না।

নতুন লোকটা বলল –ঘাবড়াবেন না। ও একটা কথার কথা। মদন লোকটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে–কথার কথা মানে কী? ওসব কি ঠাট্টার কথা নাকি? ওই স্বপ্ন নিয়ে কত ছেলে লড়াই করে মরে যাচ্ছে।

লোকটা ঠান্ডা গলায় বলে–আসলে ইদানীং ভারতীয় অর্থনীতির রূপান্তরের সময়ে আমাদের মতো কিছু লোকের শ্রেণি লোপ পেয়েছে। ইংরিজি বলতে পারি, ক্রিকেট খেলা বুঝি, অচেনা জায়গায় ভিক্ষে করি, মচ্ছবের খবর পেলে যাই, বিয়ে–বাড়ি দেখলে সুট করে ঢুকে পড়ি। এসব অ্যাকটিভিটি থেকে একটা মানুষকে কোনও শ্রেণিতেই ফেলা যায় না। ভ ভদ্রলোক, ছোটোলোক, ভিখারি–কোনওটাই খাটে না….

মদন একটু হাসল এতক্ষণে, বলল –সেই নিজের শ্রেণিকে ফিরে পাওয়ার জন্যই তো আমাদের লড়াই…বলতে-বলতে ভুল বুঝতে পেরে মদন একটু থমকে গেল, তারপর আবার বলল –আসলে আমাদের লড়াই শ্রেণিমুক্ত, শ্রেণিহীন সমাজের জন্য, আমাদের লড়াই–

ডালিম জিগ্যেস করল–কার সঙ্গে?

–কার সঙ্গে! ভারী অবাক হয় মদন, তারপর কনুই চুলকোতে–চুলকোতে বলে–আমলা আর শ্রেণিশত্রুর বিরুদ্ধে।

হারু শ্বাস ফেলে জিগ্যেস করল–তারা কারা? কে আমলা, কে শ্রেণিশত্রু?

মদন রেল–ইয়ার্ডের দিকে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে বলল –বাবা।

আমরা চমকে উঠি। জিগ্যেস করি–তোর বাবা শ্রেণিশত্রু? আমলা?

মদন মাথা নেড়ে বলল –না। ওই দেখ বাবা বাজার করে ফিরছে।

আমরা চেয়ে দেখি, মদনের বাবা হরিবাবু বাজারের ব্যাগ হাতে লাইন পার হয়ে ফিরছেন। দূর থেকে তাঁকে একটা কাঁকড়ার মতো দেখাচ্ছে।

মদন সেদিকে চেয়ে থেকে বলল –দু-বছর বাদে বাবাকে দেখলাম। কী রোগা হয়ে গেছে দেখেছিস!

আমাদের মন নরম হয়ে যাচ্ছিল। চুপ করে রইলাম।

মদন একটা শ্বাস ফেলে মুখ তুলে আমাদের দিকে চেয়ে বলল –ততারা এখনও এইভাবে সময় নষ্ট করিস! ওয়েটিংরুম আর ওভারব্রিজ ঘুরে-ঘুরে জীবনটা কাটিয়ে দিলি। কত কিছু করার ছিল তোদের। বলে আমাদের মুখে সে একটু ভর্ৎসনার চোখে তাকাল, বলল –আমি জেল খেটে এলাম, দ্যাখ, কত কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু এখানেই থামছি না। আবার যাব জেল–এ। তারপরও আবার যাব। এই ভাবে একদিন জেলখানার দেওয়াল ভেঙে পড়বে। ওরা যত মারবে, আমাদের লড়াই তত ছড়িয়ে পড়বে….

বাধা দিয়ে ডালিম বলল –খুব কষ্ট দেয় জেল–এ?

বড়-বড় চোখে চেয়ে মদন বলল –দেবে না! চুল ছাঁটিনি কত দিন, মাথায় উকুনের বাসা, গায়ে চামড়ার নীচে একরকমের পোকা হয়েছে, ভীষণ চুলকোয় চাম পোকা বলে। গাঁটে গাঁটে। ব্যাথা।

–খুব মারত?

–জেল–এ মারধর নিষেধ। কিন্তু আমরা ফার্স্ট ক্লাস প্রিজনারশিপের জন্য আন্দোলন করায় মারে, তারপর এনকোয়ারির সময়ে ওপরওয়ালা এলে ওরা রিপোর্ট দিল যে আমরা জেল থেকে। পালানোর চেষ্টা করেছিলাম বলে মেরেছে। উঃ যাই এখন স্নান করব। বহরমপুর থেকে টানা এসেছি, রাতে ঘুম হয়নি। কতদিন দাঁত মাজি না রে। বলে মদন নেমে গেল।

গাড়ি চলে গেছে। প্ল্যাটফর্ম আবার ফাঁকা। আমি ভাবছিলাম, যদি মদনদের কুয়োটাও বোম ফাটা কুয়ো হয়ে থাকে আর ওর বাবা যদি জল মেপে থাকে তবে মদনের আজ স্নান হবে কি না! আমি খুব গম্ভীরভাবে ব্যাপারটা ভাবতে থাকি। সবসময়েই আমার মাথায় অদ্ভুত সব সমস্যার চিন্তা আসে।

হারু অনির্দিষ্টভাবে জিগ্যেস করল–সিগারেট আছে?

কেউ উত্তর দিল না, জানা কথা নেই।

গাড়ি চলে যাওয়ার পর নিকলসন প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চিতে বসে টুপি খুলে ঘাড় গলার ঘাম মোছে। তারপর একটু ঝিমোয়। আজও ঝিমোচ্ছে।

হারু উঠে বলল –যাই, নিকলসনের কাছে একটা বিড়ি পাই কি না দেখি।

আস্ত এবং খাঁটি একটা সাহেব কাছে পিঠে থাকলে অনেক সুবিধে। বিশেষ করে ইংরিজির ব্যাপারে। হারু এখনও এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড রিনিউ করে। দু-একটা ইন্টারভিউও পায়। সেইজন্য ইংরিজিটা ঝালিয়ে রাখে। নিকলসনের সঙ্গে সে সব সময়ে ইংরিজিই বলে। অবশ্য এমনিতে দরকার হয় না, সাহেব ভাঙা বাংলা, হিন্দি, নেপালি দিব্যি বলে।

হারু দূর থেকেই বলল –গট বিড়ি হেঃ নিকলসন?

নিকলসন চোখ খুলে ফোকলা হাসি হাসল, তারপর বলল –ন্যাও, গট খৈনি অ্যান্ড চুনা। ট্রাই?

হারু একটু অবাক হয়ে বলে–খৈনি কবে থেকে সাহেব? বলেই আবার ইংরিজি করে বলে–খৈনি ফ্রম হোয়েন নিকলসন?

–অঃ ও! বলে নিকলসন একটা শ্বাস ফেলে পকেট থেকে লম্বা দু-মুখো কৌটো বার করে। তার এক মুখে চুন, অন্য মুখে তামাক পাতা। পাতা ছিড়তে–ছিড়তে বলে–রিসেন্টলি, ট্রাই? ভেরি চিপ। আই গাটেন এ হানচ ফর ইট সিনস লঙ, ডিডনট ট্রাই। বাট ইটস নাইস।

হারু খৈনির জন্য হাত বাড়ায়।

ডালিম আর বাদু উত্তর দিকে মুখ করে সবচেয়ে দূরে কে থুথু ফেলতে পারে তার কমপিটিশন দিচ্ছে। বাজি কুড়িটা কাঠি। নতুন লোকটা চোখ বুজে রেলিঙে হেলান দিয়ে বসে। আমি হারুর খৈনি–খাওয়া দেখতে-দেখতে চেঁচিয়ে বললাম–আমার জন্য একটু আনিস হারু। সে কথার শব্দে নতুন লোকটা চোখ খুলে বলল –একটা কথা শুনেছেন?

–কী?

–উত্তরের মতো দক্ষিণেও একটা জংশন হবে।

–জানি।

লোকটা শ্বাস ফেলে বলল –দক্ষিণের জংশন উত্তরের চেয়ে পাঁচগুণ বড় হবে। আর তখন উত্তরের জংশনটা আমাদের এই স্টেশনের মতোই ফাঁকা পড়ে থাকবে।

–জানি

–ছাই জানেন! লোকটা ধমকায়। তারপর আবার আপনমনে বলল –দক্ষিণের জংশনটা হবে পৃথিবীর চতুর্দশ বৃহত্তম জংশন, ভারতের বৃহত্তম। কিন্তু রেলমন্ত্রী বলেছেন যে, ভারত ওখানেই থেমে থাকবে না। এরপর পুর্বদিকে যে জংশনটা হবে সেটা হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম, তারপর তাঁরা প্ল্যান পালটাবেন। তখন পশ্চিমে হবে বিশ্বের বৃহত্তম জংশন। এইভাবে ভারত তার পুরোনো প্রকল্প ছেড়ে বৃহত্তর নতুন প্রকল্প, এবং ক্রমে বৃহত্তম প্রকল্পগুলির দিকে এগিয়ে। যাচ্ছে।

আমি বললাম–যাঃ!

লোকটা চোখ ছোট করে আমার দিকে চেয়ে বলল –যাঃ বলবেন না। আপনি অনেক কিছুই জানেন না। যেমন আজ সকাল পর্যন্ত আপনি জানতেন না যে টিকটিকি জল খায় না।

খুব লজ্জিত হয়ে পড়ি। বাস্তবিক, আমার জ্ঞান কত সীমাবদ্ধ!

লোকটা বলল –ক্রমশ বিশ্বের বৃহত্তম প্রকল্প রচনায় ভারত রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছে, বুঝলেন?

আমি মাথা নাড়ি।

লোকটা বলে–যখন একের পর এক জংশন শেষ হবে তখন আলটিমেটলি দেখবেন পশ্চিমের বৃহত্তম জংশন ছাড়া অন্য তিনটি জংশনই মাইনর স্টেশন হয়ে গেছে। এবং সে সব স্টেশনের ওয়েটিংরুমগুলো আমরা ক্রমে দখল করে নেব। ওয়েটিংরুম দখলের লড়াইয়ে আমরা জিতবই। অবশ্য ততদিনে আমাদের মতো শ্রেণিহীন সমাজের লোকও অনেক বেড়ে যাবে, আরও বেশি–বেশি ওয়েটিংরুম দরকার হবে তখন। সেই ওয়েটিংরুমগুলো হবে শ্রেণিহীন সমাজের মুক্তাঞ্চল।

থুথু ফেলায় ডালিমের কাছে হেরে গিয়ে বাদু দশটা কাঠি দিয়ে দিল, আর দশটা বাকি রাখল। কাল দিয়ে দেবে। মুখ ঘুরিয়ে নতুন লোকটাকে বলল –আপনি আমার ইয়ে জানেন।

লোকটা বলে–পরিষ্কার করে বলুন।

বাদু সবজান্তার মতো বলে–দক্ষিণে জংশন হবে ঠিকই। তবে উত্তরেরটার সঙ্গে দক্ষিণেরটার যোগাযোগ হবে আমাদের এই স্টেশনের ভিতর দিয়ে। তখন এই স্টেশন দিয়েও মেল ট্রেন যাবে। তিনটে স্টেশনই তখন ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে উঠবে।

নিকলসন সাহেবের টুপির ভিতরের বোলতাটার মতোই আমার মাথার মধ্যে একটা সমস্যার চিন্তা বোঁ করে ডেকে চক্কর দিতে থাকে। আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে বলি–তাহলে ওয়েটিংরুমটার কী হবে?

বাদু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে–আবার সেগুন বা মেহগনির চেয়ার টেবিল আসবে, সুইং ডোরটা সারানো হবে, মতের জায়গায় নতুন কেয়ারটেকার আসবে। তখন দেখবি, সুন্দর সুন্দর মানুষ আর মেয়েমানুষ গাড়ি থেকে নেমে আমাদের ওয়েটিংরুমে দু-দণ্ড জিরিয়ে যাবে।

লোকটা একটু হাসল। তারপর বলল –বাদুবাবু, তার চেয়ে বলুনন না, পৃথিবীটা আবার পিছিয়ে যাবে, ইংরেজরা ফিরে আসবে, নিকলসন মেমসাহেব নিয়ে ঘর করবে–

বাদু লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব রাগের চোখ।

লোকটা ঠান্ডা গলায় বলে–আপনি যা বলছেন তা হল পশ্চাদপসরণের কথা। আমি যা বলছি তা প্রগতির কথা। আমার কথাই ঠিক হবে কারণ ভারত এখন প্রগতির মেলট্রেনে উঠে পড়েছে, নামবার উপায় নেই, চেন টানলে আড়াই শো টাকা জরিমানা। তাকে যেতেই হবে। অতএব আগামী পাঁচ-ছ’বছরের মধ্যেই আমরা আরও তিন–তিনটে ওয়েটিংরুম পেয়ে যাচ্ছি।

মনে-মনে অমি নতুন লোকটাকেই সমর্থন করতে থাকি। আমার মনে হয়, লোকটাই ঠিক বলছে। মনে-মনে তাকে আমি ভীষণ সমর্থন করি, মনে-মনেই পিঠ চাপড়ে দিই। বাদুর ভয়ে মুখে কিছু বলি না।

বাদু জিগ্যেস করল–আপনি ইয়ার্কি করছেন? লোকটা প্ল্যাটফর্মের দিকে চেয়ে ছিল। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চ–এ পাশাপাশি বসে হারু নিকলসনের সঙ্গে প্রাণপণে ইংরেজিতে কথা বলছে। দুজনেরই ঠোঁটের নীচে খৈনির টিপি। সেই দিকেই চেয়ে লোকটা বলল  সাহেবটা একেবারে দ্বারাভাঙ্গা জিলার লোক হয়ে গেল, দেখেছেন? আজকাল খুব চ্যবনপ্রাশ খায়। কার কাছে শুনেছে, চব্যনপ্রাণে যৌবনোচিত শক্তি বাড়ে।

বাদু বলে–ওর মেম–বউকে নাকি রেল কোম্পানি এখনও ওর মাইনে থেকে কেটে মাসোহারা পাঠায়।

ডালিম অবাক হয়ে বলে–সে তো বিলেতে। বিলেতে কি ইন্ডিয়ান টাকা পাঠানো যায়? আইনত পারে না।

–বিলেত না আমার ইয়ে! বলে বাদু-ওর বউ কানপুরে এক সাহেব মুচিকে বিয়ে করে সেখানেই আছে। বিয়ে করলে মাসোহারা পায় না।

আমি অবাক হয়ে বলি–তাহলে সাহেব খৈনি খায় কেন?

বাদু আমাকে পাগল দেখার মতো দেখে বলে–খৈনির সঙ্গে ওর মেম–বউয়ের কী সম্পর্ক?

আমার এইটাই হচ্ছে মুশকিল। মনের মধ্যে এমন সব চিন্তা আসে, এমনই জটিল সে সব চিন্তা যে হঠাৎ সেই চিন্তার কথা বলে ফেললে লোকে ঠিক বুঝতে পারে না। পাগল কিংবা বোকা। ভাবে। আসলে আমি ভাবছিলাম, বউকে মাসোহারা পাঠাতে না হলে নিকলসনের বেশ কিছু টাকা নিশ্চয়ই বেঁচে যায়। এবং সে ক্ষেত্রে খৈনি না খেলেও ওর চলে। অন্তত বিড়িটা তো ম্যানেজ হয়ই।

একমাত্র নতুন লোকটাই আমার কথা বুঝতে পারল বলে মনে হল। সে আমার দিকে চেয়ে বলে ঠিকই বলেছেন রন্টেবাবু। ব্রিটিশ আমলে যখন ও কম মাইনে পেত তখন ও মেমবউ পুষত, গোল্ডফ্লেক সিগারেটও খেত। গত পঁচিশ বছর ধরে একটানা চেকারের চাকরি, মাইনে নিশ্চয়ই ওর আন্দাজ ভালোই এবং ব্রিটিশ আমলের চেয়ে বেশিই পায়, তবু ক্রমে ব্র্যান্ড পালটে বিড়ি হয়ে খৈনিতে পৌঁছে গেছে। কিন্তু খৈনির পর কী? হোয়াট নেকস্ট সেইটাই সমস্যা! বলে। লোকটা গভীর চিন্তা করতে থাকে।

আমি লোকটাকে ভাবতে দিয়ে আবার টিকটিকিদের কথা ভাবি। জল খায় না? টিকটিকি সত্যিই জল খায় না?

ডালিম হাই তুলে বলে–হেঁদো কথায় কী হবে? মোটে সাড়ে দশটা বাজে, লম্বা দুপুর পড়ে আছে। রন্টে, ওয়েটিংরুমটার কী হবে? একবার মতের কছে খোঁজ নিয়ে আয় না!

ওয়েটিংরুমের কথায় নতুন লোকটা ধ্যান ভেঙে তাকায়। তারপর আমাকে চুড়ান্ত সম্মান দিয়ে আমাকেই বলে রন্টেবাবু, একটা জিনিস লক্ষ করেছেন?

লোকটার জ্ঞানের কাছে আমি ক্রমেই বিকিয়ে যাচ্ছি। সঙ্গে-সঙ্গে উৎসুক হয়ে বলি–কী?

–ওয়েটিংরুমটা আমরা পেয়েছি বটে, কিন্তু বাথরুমটা পাইনি। ওটা এখনো মতে তালা দিয়ে রাখে।

আমি সত্যটা উপলব্ধি করতে থাকি। মাঝখানে বাদু বলে–মতে খুলে দেয় না যে, কী করব? লোকটা চোখ ছোট করে বলে–তা হলে বলতেই হয় যে, আপনাদের জয় সম্পূর্ণ হয়নি। বাথরুমটা তালা দিয়ে রাখা কিন্তু চূড়ান্ত অপমান।

বলতে কি, এই ব্যাপারটা আমাদের বিশেষত আমার মাথায় কোনওদিনই আসেনি। ওয়েটিংরুমে বসবার অধিকার পেয়ে আমরা আনন্দে এতই আত্মহারা হয়ে যাই যে, বাথরুমটার তালার কথা মনেই হয়নি। আমরা যা পেয়েছি সেটার বিস্ময়ের ঘোরই এখনো কাটেনি। কিন্তু লোকটার কথায় আমার বুকের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেল। বস্তুত একটু আগে জেল–ফেরত মদনের কাছে সংগ্রাম এবং লড়াইয়ের কথা শুনে আমার ভিতরটা তেতেই ছিল। আমি ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম–মতের এটা ভারী অন্যায়।

নতুন লোকটা হাসল। ঠান্ডা গলায় নিকলসনের মতো ইংরেজিতে বলল –দ্যাটস দা স্পিরিট।

আমি সিঁড়ি ভেঙে উত্তেজিতভাবে নেমে যাচ্ছিলাম। ডালিম ডেকে বলল –রন্টে, বেশি মেজাজ দেখাসনি মতের সঙ্গে। বের করে দেবে। আজকাল দুপুরে কাঁঠাল–পাকানো গরম পড়ে, শহরের আর কোথাও অমন মাগনা বসতে দেবে না-এ সব মনে রাখিস।

মতে ওয়েটিংরুমের দরজার সামনেই বশংবদ দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে চোখের ইশারায় ধমকাল দূর থেকে। অর্থাৎ ভিতরে এখনও মেহমান আছে তারপর কাছে এসে নীচু গলায় বলল –এখন চলে যান।

আমি ভয়ে-ভয়ে বললাম–কারা এসেছে?

–চা–বাগানের বড়-বড় সাহেব সব। বাগান থেকে গাড়ি এসে নিয়ে যাবে, তাই ইনতেজার করছে। চলে গেলে আমি আপনাদের ডেকে দেব।

আমার ভিতরের সংগ্রামী মনোভাব তখন অর্ধেক হয়ে এসেছে। কাছে পিঠে যদি এমন লোক থাকে যে খুব বড় অফিসার, কিংবা খুব শিক্ষিত বা খুব বড়লোক, তা হলেই আমার ভিতরটা কেমন যেন ভয়-ভয় ভাবে ভরে ওঠে।

তবু আমি সাহস করে বললাম–মতে, তুমি আমাদের বাথরুমটা খুলে দাও না কেন?

–বাথরুম! বলে মতে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখে আমাকে। তারপর বলে বাথরুম দিয়ে কী হবে?

আমি রাগ করে বলি–বাথরুম দিয়ে কী হয় তুমি জানো না?

মতে বুঝদারের মতো মাথা নেড়ে বলে–পেসাপ করবেন তো? সে তো অ্যানেক জায়গা আছে। স্টেশনভর তো পেসাপেরই জায়গা, কত লোক করে যায়। বেগ পেলে লাইনের ধারে এসে ছেড়ে দেবেন। পিলাট ফরম থেকে নামতেও হবে না। মালগুদামের পিছনে টাট্টি ভি করতে পারেন। ওদিকের পুখুরে জল ভি আছে।

আমি পয়েন্ট খুঁজে পাই না। তার কথায় প্রায় সায় দিয়ে ফেলি আর কি! তবু কাঁইমাই করে একটা পয়েন্ট খুঁজে পেয়ে বললাম–পুকুরটার জল তো নোংরা।

মতে উদার গলায় বলল –নোংরা আবার কি! কয়েকটা ভৈষ বসে থাকে বলে একটু ঘোলা। জল–খরচে ওর চেয়ে ভাল জল দিয়ে কী হবে?

হতাশ হয়ে আমি ফিরে আসি।

–কী হল? ডালিম জিগ্যেস করে।

–বাথরুম খুলে দেবে না।

–ঘরটা?

–বাগানের সাহেবরা আছে, তারা গেলে ডেকে দেবে।

সবাই অপেক্ষা করতে থাকি। এগারোটা বাজতে চলল। বাতাস তেতে উঠছে, ধুলো উড়ছে। সিঁড়ির নীচে ভিখিরিরা নাড়িভুঁড়ি সেদ্ধ করে নামিয়ে একগাদা তরকারির খোসা সেদ্ধ চাপিয়েছে। প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চ–এ ঘুমিয়ে পড়েছে নিকলসন সাহেব, হাঁ–মুখ থেকে একটা বড় নীল মাছি বেরিয়ে এল। হারু অনেকটা তামাক–পাতা নিয়ে এসেছে, আর চুন।

সকলের পকেটেই একটা দুটো লুকোনো সিগারেট আছে। কেউ তো বের করে না। যে বের করবে সে পাবে প্রথম পাঁচ টান, বাকি সবাই তিন টান করে। তাই সবাই চেপে যায়। আমি হাত বাড়িয়ে খৈনি নিই। ঠোঁটে টিপে থুথু ফেলতে থাকি। নতুন লোকটা চোখ বুজে আছে। নতুন কিছু ভাবছে নিশ্চয়ই। লোকটা জানে অনেক।

ডালিম বলল –বাথরুমটা পেলে দুদিন বাদে স্নানটা হত।

লোকটা আবার চোখ খোলে। আমি উৎসুকভাবে তাকাই।

লোকটা বলে–রন্টেবাবু কোনও কাজের নয়। বাথরুমটা আমরা পাবই। পেতেই হবে।

আমি একটু অপমানিত বোধ করলেও চেপে গেলাম। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে যদি আরও তিনটে ওয়েটিংরুম আমাদের দখলে আসে তবে কি তখনও বাথরুম তালা দেওয়া। থাকবে? এই সমস্যাটা আমাকে ভাবিয়ে তোলে।

অনেকক্ষণ বাদে মতে এসে নীচে থেকে ডাকল–যান সব। ঘর খালাস হয়েছে। বকশিশ যেন মনে থাকে।

নতুন লোকটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেই আমাদের সংগ্রামে ডাক দেয়–উঠুন, ওকে ছেড়ে দেওয়া যায় না। সরকারি ওয়েটিং রুমে বসতে দেয়, তাতে তো ওর বাবার টাকা খরচা হয় না। ওসব সামান্য খাতিরে আমদের ভুলে গেলে চলবে না। বাথরুম ওকে খুলে দিতেই হবে।

আমরা গিয়ে মতেকে ধরি।

–বাথরুম খুলে দাও। দিতেই হবে।

আমাদের মারমুখো মুখের দিকে চেয়ে মতে একটু থতিয়ে যায়। বলে–বাথরুম খুলে দিলে তা আপনারা নোংরা করবেন। আমি বুড়ো হয়েছি, হাতে বাত, ধোলাই করতে আমার জান বেরিয়ে যায়।

আমরা অনেক পয়েন্ট পেয়ে যাই। নতুন লোকটা বলে–ধরো যদি এই স্টেশন আগের মতোই হত, রোজ প্যাসেঞ্জার নামত, তাহলে তো রোজই তোমাকে ভোলাই করতে হত! তখন কী করতে?

মতে গম্ভীর এবং করুণ মুখে বলে–সেদিন তো এখুন নাই। এখন একটু সুখে আছি, আপনারা দিবেন না?

লোকটা সরকারি কর্মচারীদের গাফিলতির কথা তোলে। নেহরুর একটা কোটেশন দেয়, এবং ভবিষ্যতে স্টেশনগুলোর ওয়েটিংরুম দখলে শ্রেণিহীন সমাজের সংগ্রামী ভূমিকার ভয়ও দেখায়। মতে ক্রমশ পয়েন্ট লুজ করতে থাকে। শেষদিকে কেবল নিজের বুড়ো বয়সের অক্ষমতার উল্লেখ ছাড়া আর কোনও জোরালো পয়েন্ট দিতে পারে না। তখন মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়ে লোকটা, বলে–তোমার বয়স কম করেও সত্তর।

মতে ভয় পেয়ে গিয়ে বলে–না না, ওই নিকলসন সাহেবের উমর কেবল পঁচাত্তর। ওই চোট্টা সাহেবটা ছাড়া আর আমরা কেউ, এই স্টেশনের কোনও গভরমিন্টের লোক উমর ছিপাইনি!

নতুন লোকটা কিন্তু চূড়ান্ত জয়ের মুখোমুখি এসে গেছে। আমরা বুঝতে পারি। এবং চারদিক থেকে হইহই করে উঠি। মতে ঘাবড়ে যায়। তারপর সত্তর বছর বয়সের পক্ষে অত্যন্ত সাদা এবং সুন্দর দাঁত দেখিয়ে সে হেসে ফেলে। বলে ঠিক আছে, মাঝে–মধ্যে বিড়িটা সিগারেটটা দিবেন, চা–পানির পয়সা দিবেন, বাথরুম খুলে দিচ্ছি।

দুদিন বাদে স্নান করে ডালিম খুব খুশি। হারুকে গা শুকিয়ে বলল –দ্যাখ তো, আর সেই চামসে গন্ধটা পাওয়া যাচ্ছে?

–না। হারু কে বলল ।

সবাই স্নান করলাম। ওপর থেকে ঝাঁঝরি দিয়ে কী মিঠে ঠান্ডা ঝিরঝিরে জল যে পড়ল! আহা! ঘুম পেয়ে গেল। স্নানের পর বেশ ভালোই দেখাতে লাগল আমাদের। তার সঙ্গে একটা লড়াই জেতার আনন্দ।

নতুন লোকটা আবার ডেক চেয়ারে বসেছে। পশ্চাদ্দেশ ঝুলে আছে ফুটো দিয়ে। টেবিলে আমরা চারজন। তাসগুলো আবার বাঁটা হচ্ছে। পিছন থেকেই তাসগুলো চেনা যায়। কিন্তু সামনে আরও অনেক দুপুর পড়ে আছে, আরও অনেক দিন। আমাদের কিছু করার নেই।

বাজে তাস পেয়ে আমি তাস ফেলে দিলাম। টিকটিকি কেন জল খায় না তা আবার গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগলাম। আশ্চর্য এই যে, প্রতিদিনই এরকম নতুন কিছু না কিছু ভাববার। জিনিস ঠিক পাওয়া যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *