প্রতিবেশী – ২.৫

অমিতা দাঁড়িয়ে আছে। মেঝেয় একটা মুখ খোলা তোরঙ্গ হাঁ করে পড়ে আছে। পুরনো বইখাত ডাঁই হয়ে মেঝের উপর ছড়ানো। কয়েকটা কীটদষ্ট খাতার পাতা খোলা। অমিতা একটা বাঁধানে খাতা খুঁজছে। ফুলকির ডায়েরিগুলো বিছানার উপরে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। না ওর মধ্যে নেই। তোরঙ্গের মধ্যেও নেই?

মন্টুর মা, ভাল করে খুঁজে দেখ না। নিশ্চয়ই খাতাটা কোথাও না কোথাও থাকবেই, থাকবেই থাকবে। ফুলকির ডায়েরিগুলো আছে, আর সেই খাতাটা থাকবে না! এই ডায়েরিগুলো পড়তে পড়তেই তো অমিতার খাতাটার কথাটা মনে পড়ে গিয়েছিল। একটা মোটা খাতা বাঁধিয়ে নিয়েছিল ফুলকি। শখ করে সোনার জলে নাম লিখিয়ে নিয়েছিল তাতে। যখন যেখানে যা পড়ত তার ভাল ভাল কথাগুলো লিখে রাখত ফুলকি। কত জিনিস তাতে ছিল!

ভাল করে খুঁজে দেখ না মন্টুর মা! অনুনয় করল অমিতা। ছেলেমানুষ সে, যেন বয়স্ক কারোর কাছে আবদার করছে।

‘আমি কি নেখাপড়া জানি, হাঁ গো মা? কেমন খাতা বলবে তো? নাল না লিল, না কি কালো -? মোটা না সরু?’

একটা মোটা খাতা। বেশ মোটা। শক্ত মলাট। এই বাকসের মধ্যেই কোথাও আছে। আছে। ছিল। থাকার কথা।

‘তুমি তো নিজের চক্ষে দেখলে মা, বাকসোর ভিতরে আর কিছুই নেই। ওই দেখো, ভিতরে যা কিছু ছেল, সব বের করে দিইছি। ভিতরে আর কিচ্ছু নেই সারা দিন নাগবে গো মা ওগুলো গুছিয়ে তুলতে।’

আচ্ছা উই কোণায় দেখ তো? ওই যেখানে বইগুলো ডাঁই করা আছে। বইগুলো নামাও। একটা খুব মোটা খাতা। ভারী খাতা।

হঠাৎ মন্টুর মার কি মনে পড়ে গেল। সে পোশাকের আলমারিটার কাছে গেল।

ফুলকির তখন কত উৎসাহ ছিল। দিনরাত পাগলের মতো খালি লিখত। লিখে রাখত যা তার ভাল লাগত। ভাল মনে হত।

মন্টুর মা পোশাকের আলমারিটার ভেতর থেকে একটা মোটা পুরনো খাতা টেনে বার করল। ‘হ্যাঁ গো মা, দেকোদিকিনি, এইটা কী?’

খাতাটা দেখে অমিতার বুক ধক করে উঠল। মন্টুর মায়ের হাত থেকে খাতাটা প্রায় ছিনিয়েই নিতে গেল সে। কিন্তু সে ধরে রাখতে পারল না। ভারী খাতা তার হাত থেকে মেঝেয় পড়ে গেল। শ্রান্ত অমিতা খাতাটা তুলবার কোনও চেষ্টা করল না। সে তখন হাঁপাচ্ছে। ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে বসার চেয়ারটার কাছে গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল।

‘হাঁ গো মা, এই খাতার কতাই তো বলছিলে?’

অমিতা কথা বলল না। মাথা নেড়ে জানাল হাঁ।

‘তুলে দেব তোমাকে।

আমার কাছে এনে রেখে দাও।

মন্টুর মা খাতা তুলতে গিয়ে দেখল, অনেক জিনিস ভিতর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সে যত্ন করে সংগুলো তুলে খাতার ভেতরে রেখে দিল। তার খাতাটা অমিতার হাতের নাগালে এনে রাখল। সে দেখল, অমিতা ঘামছে। একটা তোয়ালে দিয়ে সে অমিতার মুখ ভালো করে মুছিয়ে দিল। পাখাটা জোরে ঘুরিয়ে দিল।

‘জল খাবে মা? চা খাবে?’

অমিতা কথা বলল না। মাথা নেড়ে জানাল, তাকে কিছু দিতে হবে না। ভিতরে যে উত্তেজনাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, ধীরে ধীরে তা শান্ত হয়ে আসতে লাগল। বুকের অস্বস্তি প্রশমিত হয়ে এলে অমিতা চেয়ারটাকে বিছানার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বসল। খাতা খুলতেই এলোমেলো কিছু লেখা কাগজ তার নজরে পড়ল। একটা কাগজে, সে দেখল সোনার দর লেখা। ফুলকি কেন সোনার দর লিখে রেখেছে? অমিতার মনে পড়ল না। কিন্তু সে সোনার দরটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে ছিল। সোনার দর : ১ আগস্ট ১৯৪২ পাকা সোনা ভরি একান্ন টাকা চোদ্দ আনা (৫১), বড়াল বার একা টাকা তের আনা (৫১), গিনি প্রতিখানা ঊনচল্লিশ টাকা দু আনা (৩৯ )। রূপা প্রতি একশ ভরি তিরাশি টাকা (৮৩ ), ঐ খুচরা তিরাশি টাকা চার আনা (৮৩ )। একটা কাগজের টুকরোয় লেখা আছে, শেষ উত্তর, শ্রী পূরবী পূর্ণ—২।।, ৫।।, ৮।।,–কানন, প্রথমেশ, অহীন্দ্র যমুনা। এম পি প্রোডাকশন। নাট্য ভারতী : দুই পুরুষ। কুমার, ছবি, জহর, তুলসী, নরেশ, মনোরঞ্জন, মিহির, যোগেশ, প্রভা, ছায়া, পূর্ণিমা। একটা কাগজে লেখা : ব্রিটেন ও সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের নিকট কংগ্রেসের শেষ আবেদন—উপেক্ষিত হইলে মহাত্মার নেতৃত্বে গণ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত—ভারতবর্ষ যাহাতে কার্যকরভাবে সম্মিলিত রাষ্ট্রসমূহের মিত্র হইতে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিতে সক্ষম হয়, তজ্জন্য ব্রিটিশ শক্তির অপসারণ নিমিত্ত কংগ্রেসের দাবী ও কংগ্রেসের মনোভাব নূতন করিয়া পুনরায় বর্ণনা করিয়া অদ্য কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে ১২ শত শব্দ সম্বলিত এক প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে। যাবতীয় এশিয়াবাসীর স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তার উপরে জোর দিয়া প্রস্তাবে বলা হইয়াছে যে, স্বাধীন ভারত বিশ্ব রাষ্ট্রসঙ্ঘে যোগদান করিতে ইচ্ছুক থাকিবে—উক্ত বিশ্ব রাষ্ট্রসঙ্ঘ বর্তমান যুদ্ধ চলিবার সময় সম্মিলিত রাষ্ট্রসমূহকে লইয়াই গঠন করিতে হইবে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট। ৬ আগস্ট ১৯৪২। অমিতার খুব মজা লাগছিল। কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারছিল না, ফুলকি কেন এই খবরগুলো যত্ন করে কাগজ থেকে খাঁতায় টুকে রেখে দিয়েছিল। আরেকটা কাগজে লেখা নৃত্যশিল্পীর বিবাহ : ৭ আগস্টের খবর। প্রসিদ্ধ নৃত্যশিল্পী মাদমোয়াজেল সিমকি—যিনি বহু বৎসর ধরিয়া বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করের নৃত্যসঙ্গিনী হইয়া পৃথিবীর বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে প্রাচ্য নৃত্য প্রদর্শং করিয়া সুনাম অর্জন করিয়াছেন, জানা গিয়াছে যে, আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর কালচার সেন্টারের উদীয়মান ছাত্র শ্রীপ্রভাতকুমার গাঙ্গুলির সহিত অদ্য (৪ আগস্ট) বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছেন।

অমিতা সিমকির নাচ দেখেছে নিউ এম্পায়ারে। এখনও মনে আছে হরপার্বতী নৃত্যের কথা। উদয়শঙ্কর শিব, পার্বতী সিমকি। সিমকির খুব ফ্যান ছিল ফুলকি। উদয়শঙ্কর ছিলেন তার হিরো। পরে আর একটু বড় হয়ে আবার যখন উদয়শঙ্করের হরপার্বতী নৃত্য সে দেখেছিল, তখন সিমকি দল ছেড়ে দিয়েছিলেন। উদয়শঙ্করের পাশে তখন নতুন পার্বতী এসে গিয়েছেন। অমলাশঙ্কর। অমলাদি। ‘অমলাশঙ্করের কাছে শিখি নৃত্য শিখিয়াছে, কোন কবি যেন তাঁর কবিতায় এই ধরনের একটা লাইন লিখেছিলেন। সিমকি বিয়ে করেছিলেন, সেটা অমিতা ভুলেই গিয়েছিল। ফুলকির খাতা সেটা মনে করিয়ে দিল।

খাতার মধ্যে ফুলকির লেখা একটা চিঠি। কবে লেখা সেটা এতই অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, অমিতা সেটা বুঝতে পারল না। শামিমাকে লেখা চিঠি। কিন্তু ফুলকি এ চিঠি ডাকে দেয়নি কেন?

‘প্রিয়তম, দিনটা গড়িয়ে গেল প্রায়—কালই রওনা হতে হবে নির্বাসনে। গতকালই চিঠি লিখেছি, নিতান্তই বাস্তবকে ছুঁয়ে—কিন্তু এই মুহূর্তে আর পারছি না। আমি জানি না কি করে এক মাস থাকব এখানে। কি আমার অবস্থা জানো, যদি বলি মরি গিয়েছি তাতেও কিছু স্পষ্ট হয় না, ‘বেঁচে আছি, এর চেয়ে নেই লজ্জা নেই বড়ো গ্লানি’–শুধু তোমার মুখ চেয়ে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল—এখনি সাতটা বাজবে—এমন কত সন্ধ্যা গিয়েছে দুজনের—আর আজকে——আমি পারছি না, এই দেখো লিখতে হাত অবশ হয়ে আসছে—দু চোখ ভিজে গেল জলে—তবু দয়া নেই এই পৃথিবীটার। ভালবাসার জন্য তার একটুও করুণা নেই। তুমি কেমন আছ—একটু একটু বুঝছি–হয়ত আমারই মতো—কাগজের মধ্যে আছ—ভাবছ কি আমাকে—কতদিন যে তোমাকে ডাকতে পাব না—শামিম শামিম—সেই যে ভেবেছিলাম সব কিছুর অতি চর্চা হয়ে যাচ্ছে—কড়া হতে হবে, এই তো এসেছে কড়া হবার বাঁধুনি। কাজ করো তুমি—চাইনি তোমাকে বিরক্ত করতে—কিন্তু আর পারছি না, তোমারই সেই চিঠিটাও এলো না—কাল রবিবার, পেলাম না কিছুই। বিরহের অনেক স্রোত পেরিয়েছি দুজনে—কিন্তু এমন দিনেরও যে দেখা মিলবে, কোনও দিন ভাবিনি। আর চারিপাশে সমস্ত আকাশ জুড়ে ঘৃণাই ঝরছে—রক্তাক্ত সম্পর্কগুলো তলিয়ে যাচ্ছে ঘৃণার জলে—ভাবিনি মানুষকে কোনওদিন এত ঘৃণা করব। আমিও—। মনে আছে শামিম; একদিন তুমি তথাকথিত অর্থলোলুপ সম্প্রদায়ের মুখোশ খুলে ধরেছিলে আমার সামনে—বিশ্বাস করলেও মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারিনি সে কথা, কারণ আমিও তো তাদেরই রক্তে গড়া। আর আজ, আজ আমার কোনও দ্বিধা নেই—এরা মানুষ না, পশুরও অধম। আমার ‘মঙ্গলের জন্য’ আমাকেই রসাতলেই ডুবাতে চায়—সম্মান বাঁচে যে! আমি এদের কিছু চাই না, সম্পর্ক অস্বীকার করলেও আপত্তি নেই—তুবও আমার নিস্তার নেই, তার চেয়েও বড় ভয় আমার তোমাকে নিয়ে—না জানি তোমার কি ক্ষতি হয়—তাই সবই সয়ে যাচ্ছি—মৃতবৎ বেঁচে আছি।

‘সেই মেয়েটিকে মনে পড়ে তোমার শামিম, মনে পড়ে, প্রথম পরিচয়ের কদিন পরেই যে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, নিষ্পাপ সরল মনে, ‘আপনি ইংরাজি সাহিত্যের এত খবর রাখেন! তাহলে রাজনীতি করেন কেন? তুমি খানিকটা অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়েইছলে? মনে পড়ে? কিংবা অনেকদিন পরে একদিন দুর্গা পূজার সন্ধ্যায় বাগবাজার সার্বজনীনে সেই বিজলিচালিত বিশাল নাগরদোলায় চড়া! মনে পড়ে শামিম? আজ তোমার সঙ্গে কেবলই কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেদিন কি বলেছিল তোমাকে মেয়েটা? মনে আছে? নাগরদোলায় যখন ওপরে উঠছিল তখন তার গা সিরসির করছিল, ভয়ও লাগছিল কিন্তু ভালও লাগছিল। আর নামার মুখে তার কি ভয় কি ভয়! মনে হচ্ছিল এই বুঝি হার্টফেল হবে! তবু সে বলেছিল, ‘এত আনন্দ আর কোনওদিন পাইনি। সে সত্যি কথাই বলেছিল শামিম। কেন, জানো? তুমি পাশে বসে তার হাত ধরে ছিলে বলে। সেই মেয়েটিকে এখন আর কিছুতেই খুঁজে পাইনে। হয়ত সে আছে কোথাও, কিন্তু আমি তাকে চিনতেই পারি না।

এই চিঠিতে ফুলকি ঠিকানাও লিখেছিল। কিন্তু কি খেয়াল দেখ তার? চিঠিটা সে ডাকেই ফেলেনি।

কবে ফুলকি এই চিঠি শামিমকে লিখেছিল? করে? সময়টা অমিতার কাছে থেকে এত দূরে সরে গিয়েছে যে, সবই এখন তার কাছে ঝাপসা লাগছে। বাবা তাকে একবার গিরিডি নিয়ে গিয়েছিলেন জ্যেঠুদের কাছে। সেবার বাবার শরীরটাকে কিছুটা বিশ্রাম দেবার দরকার পড়েছিল। সেটা কবে বাবা যখন আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপটেন শাহ নওয়াজ খান, ক্যাপটেন ধীলন এবং ক্যাপটেন সেহগালের মামলার জন্য কলকাতা দিল্লি ছুটোছুটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, সেইবারে কি? সেইবার ফুলকি ওর বাবাকে নিয়ে জ্যেঠুদের গিরিডির বাড়িতে উঠেছিল, না কি মধুপুরে স্যর আশুতোষের বাড়িতে উঠেছিল? নাকি তারক সাধুদের বাড়িতে? অমিতার সব হিসাব গুলিয়ে যাচ্ছে। কেন না, সেই সময়টা যেমন ফুলকির পক্ষে সুসময় আবার তার পক্ষে সেটা দারুণ দুঃসময়ও বটে। ছ’মাসের ব্যবধানে বাবাকে নিয়ে দুবার গিরিডি মধুপুর করতে হয়েছিল। একবার গিরিডি এবং মধুপুর একই বারে। আর একবার, না সেবার গিরিডি যেতে হয়নি ফুলকিকে। ওর কাছে তার জ্যেঠুদের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ওরা শুধু মধুপুরেই গিয়েছিল। ও আর বাবা মধুপুরে যেবার আগে গিয়েছিল, সেই সময়টা ফুলকির মোটেই ভাল কাটেনি। সে তখন ভয়ে সন্ত্রাসে উদ্বেগে নিপীড়নে দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। গিরিডির জ্যেঠুদের বাড়ি! ওহ্, সেটা তো ফুলকির পক্ষে নরক! মানুষ মানুষের উপর এতগুলো উৎপীড়ন করতে পারে!

অমিতা এবার ফুলকির পাতা উল্টাতে লাগল।

১৯ অক্টোবর ১৯৪৫

‘ভীষণ রকমের ডিপ্রেসড হয়ে পড়েছি। আমার মনটাকে চারিদিক ধরে ঘিরে রেখেছে বিষণ্ণতা—ডুবছি, ডুবছি, কেবলই ডুবে যাচ্ছি অতলে। আমাকে ত্যাগ করলে কেন প্রভু! আমার অবস্থাটা এত বেশি একান্ত, নিজস্ব যে আর কারুরও বোঝার উপায় নেই—’

এটা কি গিরিডিতে বসে লেখা? ফুলকির উপর যে মানসিক উৎপীড়ন তার জ্যেঠুদের বাড়িতে চলেছিল, ফুলকি সে কথা তার বাবাকে কোনওদিন বলেনি। তোমাকেও না শামিম। তোমাকেও না। জ্যেঠিমা তার ভাইপোর সঙ্গে ফুলকির বিয়ে প্রায় ঠিক করেই রেখেছিলেন। অথচ সে কথ। তিনি ঘুণাক্ষরেও তার বাবাকে বা আর কাউকে বলেননি। এমন ব্যাপার যে সভ্য জগতে ঘটতে পারে, ফুলকি তা কল্পনাতেও আনতে পারেনি। হঠাৎ একদিন বাড়িতে যেন উৎসব পড়ে গেল। জ্যেঠিমার ভাই সপরিবারে গিরিডিতে বেড়াতে এলেন। ফুলকি কিছুই বুঝতে পারেনি। সে সরল মনে ওদের সঙ্গে মেলামেশা করতে লাগল। জ্যেঠিমার ভাইঝিটা আশা, আশালতা তার নাম। তার চাইতে বয়সে বেশ ছোটই হবে। চুমকিদের বয়সী প্রায়। ফুলকির সঙ্গে মাখামাখি শুরু করে দিল। আর সেই একদিন জ্যেঠিমার চক্রান্ত ফাঁস করে দিল। আশাই জানাল যে, ফুলকি আর বাবাকে চেঞ্জে আনার ফন্দিটা নাকি আশালতার পিসিমার অর্থাৎ তাঁর বড় জ্যেঠিমার। তিনি অনেকদিন থেকেই নাকি ভেবে রেখেছিলেন, ফুলকি আর অবনীশ মানে আশার দাদার মধ্যে বিয়ে দিতে পারলে সেটা হবে রাজযোটক। কারণ বৈদ্যনাথধামে জ্যেঠিমার যে গুরু থাকেন তিনি অবনীশের মা, যাকে ফুলকি জীবনে এই প্রথম দেখল, আর জ্যেঠিমার সামনে অবনীশের কোষ্ঠী বিচার করে বলে দিয়েছেন যে, অবনীশের বউ ফুলকিই হবে।

‘গুরুদেবের কথা ফলে যাবে ফুলকিদি।’ আশালতা খুব খুশি হয়ে বলে উঠল।

জ্যেঠিমার গুরুদেব আমার কোষ্ঠী কোথায় পেলেন, আশালতা? আমার তো কোনও কোষ্ঠী নেই।

‘সত্যি ফুলকিদি তুমি না বড় মজার মানুষ। তোমার কোষ্ঠীর কি দরকার গুরুদেবের। তুমি মেয়ে। মেয়েদের কোষ্ঠীর কোনও গুরুত্ব আছে নাকি?

তাও তো বটে আশালতা, আমি যে মেয়ে সেটা সব সময় মনে থাকে না। তা তোমাদের গুরুদেব তোমার দাদার কোষ্ঠী বিচার করে বুঝলেন যে, আমিই তোমার বউদি হবার সর্বাংশে উপযুক্ত পাত্রী?

‘বা রে!’ আশালতা ফুলকির কথা শুনে দস্তুরমতো অবাক হয়ে গেল। ‘গুরুদেব জানবেন না তো কে জানবেন? পিসিদের গুরুদেব তো ত্রিকালজ্ঞ, তিনি ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সবই বলে দিতে পারেন। তিনি পিসিকে আর মাকে তোমার চেহারার যে বর্ণনা দিয়েছিলেন, তিনি তোমাকে তো দেখেননি, তবু দেখ তোমার সঙ্গে তা হুবহু মিলে গিয়েছে। দেখছিলে না, মা প্রথম যখন তোমাকে দেখল, তখন কেমন অবাক হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছে মা। আর তাতেই তো মায়ের বিশ্বাস জন্মেছে, তুমিই দাদার বউ। মাকে কেউ তার এই ধারণা থেকে নড়াতে পারবে ভেবেছ?’

ফুলকি আগাগোড়া এটাকে রসিকতা বলে ধরে নিয়েছিল।

‘জানো ফুলকিদি, এটা কিন্তু কাউকে বলো না, বলবে না তো? প্লিজ।’

কি কোনও গোপন কথা?

‘তা নয়ত কি? এটা দাদার কথা। তুমি যদি কথা দাও। তবে তোমায় বলব। নাহলে মুখ খুলছিনে কিন্তু। বল কাউকে বলবে না?’

কি এমন কথা আশালতা?

‘দাদা বলেছে, না তোমায় বলব না, তুমি আবার বলে দেবে। আর বলে দিলেই বা কি, এ তোমাদেরই দুজনের কথা। দাদা বলেছে, তোমাকে দাদার না খুব পছন্দ হয়েছে। আসলে এতটা যে মিলে যাবে এটা দাদাও ভাবেনি।’

১ অক্টোবর ১৯৪৫

‘কাম এবং প্রেম পরস্পর মিলে যেতে পারে এ উপলব্ধি কোনওদিন হয়নি—নতুন করে সমস্তই চিনেছি। বুঝেছি নিজের সঙ্গে হঠকারিতা ভুল। সুস্থ মনের চাওয়াকে দমিয়ে রাখলে অসুস্থ মন জেগে ওঠে—ভাল নয়।

‘সবচেয়ে বড় ভালবাসা–আর সবই গৌণ। তবে এই ভালবাসা গ্রহণ করার জন্য মনের শুদ্ধি দরকার। নিজেরও এগিয়ে আসা দরকার। এমন অসম্ভব ভালবাসা আর কখনও পাইনি। ঈশ্বর তোমার পায়েই তখন লুটিয়ে পড়েছিলাম। তবে সত্যিই আমায় দিলে—আমার সেই চিরবাঞ্ছিত ধন—ভালবাসা…’

বাবা তখন দিল্লিতে ছিলেন। বাড়িতে কাল সেই সময় কেউ ছিল না। কাজের লোকেরা আড়াইটের ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখতে চলে গিয়েছিল। বাড়িতে আমি ছিলাম একেবারে একা। কয়েক পশলা বৃষ্টি ঝরার পর আকাশটা মাত্রই ধরেছে। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। মনে পড়ে শামিম, তুমি এলে। তোমাকে দেখেই আমার সমস্ত দেহ থরথর করে কাঁপতে লেগেছিল। বেল বাজতেই বুঝে গিয়েছিলাম, এ তুমি এ তুমি শামিম। তোমার কথা ভাবছিলাম বসে বসে। কলিং বেল যে এমন করে কাউকে অস্থির করে তুলতে পার, এটা জানা ছিল না। বাঁশি কি রাধাকে এমন করেই অস্থির করে তুলত! আমি আমার ঘরে বসে বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলাম। কিন্তু মন তো বইয়ের পাতায় ছিল না শামিম। ছিল তোমাতে। সেদিন যে কি করে দরজা খুলে দিয়েছি তা আমিই জানি। তুমি আমাকে দেখে হাসলে। সেটা লক্ষ করার মতো চোখও আমার ছিল না। আমি অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। কেবলই অস্থির। অনেক কষ্টে আমাকে সামলে রেখেছিলাম সেদিন শামিম। একটা সান্তনায় নিজেকে ধরে রাখবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। তুমি ভিতরে এলে, আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। বাড়িটা যে ফাঁকা সে বোধহয় তুমিও বুঝতে পেরেছিলে। তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, ‘বাড়িটা এত নির্জন কেন? কেউ নেই নাকি?’ বাবার ঘরে ঢোকার মুখে আমি অস্পষ্ট স্বরে বলেছিলাম, আমরাই শুধু একা। আমি হয়ত এটা বলতে চাইনি। তবু মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুমি দাঁড়িয়েছিলে একেবারে আমার পিঠের কাছে। তোমার গরম শ্বাসপ্রশ্বাস আমার ঘাড়ে এসে পড়ছিল.। শামিমএকেবারইে আর পারছিলাম না। তুমি আমার সেই অসহ্য যন্ত্রণার শরিক হয়েছিলে কি না, এখন মনে নেই।’ কিন্তু তুমি আমার মনটা বুঝতে হয়ত পেরেছিলে। নইলে এত সাহস তোমার এল কোথা থেকে? বাবার ঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়েই তুমি আমাকে তোমার বুকে টেনে নিলে। কত সহজ ভাবে। কত স্বাভাবিক ছিলে তুমি সেদিন। আমার মুখে তখনই এঁকে দিলে একটা সুদীর্ঘ চুম্বন! আমি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশিয়ে যাচ্ছিলাম মাটিতে। আমার কি দম বন্ধ হয়ে আসছিল? আমি তোমার সুদৃঢ় বাহুর আলিঙ্গনের মধ্যে গলে যাচ্ছিলাম তখন? আমার কিছু মনে নেই। কিছুই মনে নেই শামিম। শুধু মনে আছে, তোমার চাপে পিষ্ট হয়ে আমি বলে যাচ্ছিলাম, আমাকে নাও শামিম, আমাকে পূর্ণ করে নাও। আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনে।

তুমি আমাকে আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে দেওয়া মাত্র আমি তোমার হাত ধরে টানতে টানতে একেবারে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিলাম। আমিই তোমাকে টেনে এনেছিলাম আমার বিছানায়। অমিতা তার চারপাশে ছড়ানো খাতাগুলো থেকে মুখ তুলে বলল, হ্যাঁ শামিম, আমিই। মনে পড়ে শামিম, ফুলকির তখনকার অবস্থা। তখন তার শরীরে কামনার জোয়ার এসে গিয়েছে। কিসে তার উপশম হবে, সে জানত না। কি করে সে শান্ত হবে, সেটা সে জানত না। তুমিই তার জীবনের প্রথম পুরুষ যার সামনে সে তার নির্লজ্জতাকে সহজে প্রকাশ করতে পেরেছিল। তাকে একেবারে মেলে ধরেছিল উজাড় করে। শামিম, তুমি খুব ভাল। খুব ভাল সেদিনের সেই আনাড়ি কুমারীকে যত না ভালবাসা দিয়েছিলে, তার চাইতে অধিক দিয়েছিলে মমতা। তোমাকে যে ফুলকি কোনওদিন ভুলতে পারল না, অমিতা যে এখনও তোমাকে ভুলতে পারেনি তা এই কারণে যে, তুমি সেদিন তার কাছ থেকে কোনও অন্যায় সুযোগ নাওনি। অথচ সৈদিন ফুলকির দুর্গ তোমারই করতলে ছিল।

বুকের কাপড় এক টানে খুলে দিয়েছিল ফুলকি, এক এক টানে ব্লাউজ আর অন্তবাস। কিন্তু তুমি শামিম, তুমি আশ্চর্য সংযমে তোমাকে টেনে রেখেছিলে। তার যন্ত্রণা তুমি বুঝতে পেরেছিলে। আমার উদ্ধত স্তন দুটো সেদিন তোমার লালসাকে বাড়িয়ে দেয়নি। আমার পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে তুমি আমার স্তন যখন দেখছিলে, তখন ফুলকি ক্রমশ নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু শামিম, তুমি ছিলে নিষ্কম্প। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়ই না ফুটে উঠেছিল তোমার চোখে মুখে! অমিতা সেটা জানে। অনেকক্ষণ ধরে তুমি চেয়েছিলে ফুলকির অনাবৃত বুকের দিকে। ফুলকি তখন বলে যাচ্ছিল, দয়া কর শামিম, দয়া কর, আমাকে নাও, আর পারছিনে, আর পারছিনে। সেদিন ফুলকির মধ্যে যত অস্থিরতা, ততটাই শান্ততা তোমার মধ্যে শামিম। ফুলকিকে দেখে দেখে যদিও তোমার বিস্ময় বাঁধ মানছিল না। তুমিও কি এই প্রথম নারী দেহ দেখলে শামিম? তারপর তুমি এক আশ্চর্য কথা বললে। তুমি কি ফুলকির বুকের উপর খুব সন্তর্পণে তোমার ঠোঁট রাখলে। ফুলকির মনে হয়েছিল, এটা মায়ের ঠোঁট। আলতো করে তোমার হাত রাখলে ফুলকির বুকে। তারপর বলেছিলে, ‘ফুলকি, এ য়ে দেখি ফুলের স্তূপ! শুভ্র ফুল! এ আমি পিষ্ট করতে পারব না ফুলকি। এ আমি নষ্ট করতে পারব না। আমাব বড় মায়া’ লাগে ফুলকি, আমার বড় মায়া লাগে।’

‘ফুলকিদি, যে কথা তোমাকে বলবার জন্য এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি, সে কথাটা শোনো। আসলে তোমাকে দাদার ভীষণ ভাল লেগে গিয়েছে। তুমি সত্যি জাদু জানো ফুলকিদি।’

ফুলকির মজা লাগছিল শুনতে। শামিম, সাবধান!

‘দাদা বলছি, দাদা তোমাকে নিয়ে একদিন বেরুতে চায়।’

এই তো সেদিন আমরা উশ্রী দেখে এলাম।

আশালতা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছে যেন।

‘আহা, ও রকম বেড়ানো নয়। শুধু তুমি আর দাদা। যাবে?’

তোমার দাদাকে বল আশালতা, আমি সকলকে নিয়েই বেড়াতে ভালবাসি।

‘সত্যি ফুলকিদি, তুমি না একটা—কি আর বল? তোমরা তো কলকাতার মেয়ে তোমাদের সম্পর্কে আমি কত কিই যে শুনেছি। আমি তো ভেবেছিলাম, তোমরাই আমার আদর্শ। এখন দেখছি ধ্যাৎ। না ফুলকিদি তুমি আমাকে নাচাচ্ছ? তোমার মনটাও দাদার সঙ্গে ঘুরতে চাইছে, কিন্তু তুমি সেটা লুকিয়ে রাখতে চাইছ।

কি শামিম, আমার মনটা কি আশালতার দাদার সঙ্গে ঘুরতে চাইছে? ঠিক বলবে কিন্তু?

হঠাৎ আশালতা উঠে পড়ল। বলল, ‘যাই দাদাকে বলিগে। তুমিও দাদার সঙ্গে যেতে চাইছ বেড়াতে। আমি কি বোকা ফুলকিদি। মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না, এ কথাটা বুঝতে এত দেরি হল!’

৩ অক্টোবর ১৯৪৫

‘দুটো দিন কেটে গেল। অসংখ্য মুহূর্ত কেটে গিয়েছে। না, যেমন মিলনে নয়, তেমনি বিরহেও অভ্যস্ত হতে পারিনি—খারাপ লাগছেই। মেঘে ঢাকা আকাশটা তার সমস্ত ভার নিয়ে বুকের উপর চেপে বসেছে—এ এক অসম্ভব বেদনা, একাকিত্বের অসহ্য যন্ত্রণা। অথচ এই তো শুরু—আরও কত মুহূর্তের যন্ত্রণা বাকি। মাঝে মাঝে ভাবি যে কোনও এক মন্ত্রবলে পুরনো আমির উত্তরণ ঘটেছে আজকের নতুন আমিতে। মাত্র দুটো দিনের মধ্যেই। সমস্ত জীবনের না পাওয়া বোঝা বয়ে যখন ভেবেছি পাব না কখনওই, তখনই এসেছে পরিপূর্ণ পাওয়া, চাওয়ার অবসান ঘটিয়ে। আজ সারাদিন মনে পড়ছিল তোমার আমার সম্পর্কের কথা। কোনও এক অজ্ঞাত অবচেতনের প্রভাবে এই ভালবাসা একদিন রাত্রির ভালবাসায় দাঁড়াবে, দিবালোকে এটা কিছুতেই মানতে পারিনে—যদিও জানি ভালবাসার অমোঘ নিয়মে সেই দিকেই আমরা যাচ্ছি—যদিও পাশাপাশি দাঁড়ালে সুতীব্র কামনার দহনে বুক জ্বলে ওঠে। জানি এও ভালবাসা তবু মনে হয় নিতান্তই প্রাথমিক স্তর। আজন্মের বিশ্বাস বা সংস্কারকে ত্যাগ করা খুবই কষ্টকর। তোমার মনেও কি এইসব সংশয় দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে? না, তুমি তো সংস্কারমুক্ত, তাই জানি তোমার মনে এই সব তুচ্ছতাকে স্পর্শ করতে তুমি দাও না। সেখানে প্রয়োজনকে ছাপিয়ে উঠেছে ভালবাসা। অপরদিকে আমি আমার দ্বিধায় লজ্জিত হই, সংকুচিত হই, হই বিমূঢ়। না, আমি একে অন্যায় ভাবি না, ভাবি না অনৈতিক গর্হিত কিছু। জানি, এতে আছে স্বর্গীয় প্রেম, পবিত্রতার আলোক, তবু মনের কোণ থেকে অযথা উঁকি মারে সংস্কার—আমি হয়েছি তার ক্রীতদাসী—কিছুতেই মুক্তি পাই না, তবে ঘুচেছে, ঘুচে যাচ্ছে অনেক কিছুই। জানি একদিন সবই ঝেড়ে ফেলতে পারব। এই মুহূর্তে তোমাকে পাশে পেতে বড় মন চায়!

৫ অক্টোবর, ১৯৪৫

‘দুঃখের বরষায় চক্ষের জল যেই নামল
বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল
অবশেষে সব উৎকণ্ঠা, প্রতীক্ষার অবসান। এল পথিক—

আমি এখন রাত্রে স্বপ্ন দেখি আর দিনেও স্বপ্ন দেখি, রাত্রে আমরা পরস্পরের কাছাকাছি সামাজিক দৈহিক সকল প্রকার সংকটই আমরা কাটিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছি। মনের ভিতর তখন অনুভব করি, আমরা সুখী হব, কৃত সুখী! সকলের চেয়ে সুখী হব আমরা কারণ ভালবাসায় আমাদের নবজন্ম হয়েছে—আমি স্বপ্ন দেখি ‘বিবাহিত’ জীবনে জন্ম নেবে নতুন এক সংসার সদা সুখী ভালাবাসায় পূর্ণ—কিন্তু তার অনেক দেরি অনেক অনেক অনেক দেরি—এইটেই রড় সত্য।’

সেদিন ফুলকির আনন্দ আর বাঁধ মানছিল না। তুমি এসেছিলে শামিম। তার আগে বাবার টেলিগ্রামও ফুলকির কছে পৌঁছে গিয়েছিল। বাবা ৮ ফিরছেন দিল্লি থেকে। সেদিনও বৃষ্টিতে কলকাতায় বান ডাকছে। সেদিনও ফুলকি তোমাকে হাত ধরে তার ঘরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। যদিও সেদিন বাড়িতে লোক ছিল। ফুলকির সাহস দিন দিন বাড়ছে, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু ফুলকি লক্ষ করেছে, তার সাহস যতই বাড়ছে, তার ও শামিমের মধ্যে সম্পর্কটা ততই সুন্দর সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। শামিমকে ঘরে বসিয়ে ফুলকি বাতাসিয়াকে ডাকল বারান্দায় গিয়ে। বাতাসিয়া তার ঘরে ঢুকে শামিমকে দেখে সুন্দরভাবে হাসল। বাতাসিয়ার হাসিটা ফুলকির প্রাণের মল্লিক’ বনে যেন হিল্লোল তুলে দিল। ফুলকি বলেছিল, দেখ বাতাসি, শামিমদার চেহারাখানা একবার দেখ। একেবারে ভিজে কাক হয়ে এসেছেন। দেখ তো, বাবার একটা ধুতি কি পায়জামা পাও কি না? চুমকির বাথরুমে সেটা রেখে এসো। শামিম, তুমি কিন্তু সেদিন কেবলই প্রতি কথায় না না, থাক, আমি ঠিক আছি’ এইসব অবান্তর কথা বলে যাচ্ছিলে। তাতে বাতাসিয়াও হেসে ফেলছিল। অবশেষে তুমি পোশাক টোশাক ছেড়ে দিব্যি ভদ্রস্থ হয়ে বাতাসিয়ার সঙ্গে আমার ঘরে এসে বসেছিলে। বাতাসি একটু পরে তোমাকে খাবর দিয়ে গেল। বলল, ওগুলো খেয়ে নাও, তারপরে কড়া করে চা বানিয়ে দেবখন। দিদি তুমি কি চা খাবে? ফুলকি বলেছি, তুমি আচ্ছা লোক তো বাতাসি, আমার সামনে বসে বসে একটা লোক কড়া চা খাবে, আর আমি হাঁ করে শুধু দেখব, এই কি তোমার বিচার হল? আমি বুঝতে পারছিলাম, সেদিন ফুলকির মধ্যে ফুলকি কথা বলছিল না। ফুলকি তখনও অত স্মার্ট হয়ে উঠতে পারেনি। আসলে সে শামিমের জড়তা ভাঙবার জন্য দিদির মতো স্মার্ট হতে চাইছিল। বাতাসিয়া যখন এসে কাপ ডিশ নিয়ে চলে গেল নিচে, বলে গেল দরকার লাগলে ডেকো, আমি নিচেই রইলাম, তখন ফুলকি উঠে একবার বারান্দায় গিয়েছিল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। একেবারে ঘন ঘোর বরষা যাকে বলে।

ফুলকি ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। জল যেমন জলকে টানে, প্রেম কি তেমনি প্রেমকেও টানে? ধীরে ধীরে সে শামিমের হাত ধরে তাকে নিয়ে বিছানায় গেল। এক বালিশে ওরা দুজনে মাথা রেখে সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলেছিল তারা। মাঝে মাঝে শামিম ফুলকিকে আদর করছিল। কিন্তু, আশ্চর্য, সেদিন কারও মনে তেমন অস্থিরতা ছিল না। সেই গভীর অন্তরঙ্গতার পেয়ালায় ওরা দুজনে ধীরে ধীরে চুমুক মারছিল।

শামিম বৃষ্টি একটু ধরলে চলে গেল। বাবা ৮ তারিখে ফিরছেন শামিম। বাবার শরীরটা বোধ হয় ভাল যাচ্ছে না।

৬ অক্টোবর ১৯৪৫

‘সম্পর্কটা ভারি সুন্দর মোড় নিয়েছে। ঠিক যেমন যে কোনও সুখী দম্পতির মধ্যে থাকে—প্রেমের প্রাথমিক উচ্ছ্বাসের ঢেউ পেরিয়ে এসেছি। সুস্থির স্বাভাবিকতায় কোনও লুকোচুরি নেই—পরস্পরের প্রতি অকপট আলাপন—সেখানে কোনও সংকোচ নেই, নেই জড়তা, অস্পষ্টতা, মন- যোগানোর প্রচেষ্টা। এই তো ভালবাসা!’

শামিম আজও এসেছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার নিয়ে খানিকটা কথাবার্তা হল। শামিম তুমি সেই সময়টা কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে খুব মেতে উঠেছিল। হয়ত এই কারণেই বাবা এবং তোমার মধ্যে সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বাবা তোমাকে ভালবাসেন এবং তাতে কোনও খাদ নেই, শামিম। তুমিও কি তা বুঝতে পারো? নিশ্চয়ই পারো। বাবার প্রতি তোমার আচরণই তা আমাকে বলে দেয়। তুমি সেদিন মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বেশ সহজ ভাবেই গড় গড় করে কথা বলে যাচ্ছিলে। আবার হঠাৎ থমকে থমকে যাচ্ছিলে। কথার খেই হারিয়ে ফেলছিলে। সেটা ধরতে অবশ্য আমার সময় লেগেছিল। এক সময় তুমি চুপ করে গেলে। আমি সেদিন আমাকে নিয়ে এতই মগ্ন হয়ে ছিলাম যে, তোমার ভাবান্তরগুলো যথাসময়ে আমার মনে কোনও রেখাপাত করেনি।

হঠাৎ তুমি বললে, ‘আচ্ছা ফুলকি, তুমি তো আমাকে ভালবাস।

তোমার এই কথায় আমার ঘোর কেটে গেল। ভাবলাম, তুমি ঠাট্টা করছো। আমি বলেছিলাম, কেন তোমার কি কোনও সন্দেহ আছে। আমি কথাটা বলে মিটি মিটি হাসতে শুরু করেছিলাম।

তুমি বলেছিলে, ‘ফুলকি এটা হাসিঠাট্টার কথা নয়। আমি সিরিয়াসলি তোমাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করছি। প্লিজ তুমিও এটাকে সিরিয়াসলি নাও।

তোমার কি হয়েছে শামিম? তুমি হঠাৎ এখন আমাকে এমন কঠিন কঠিন প্রশ্ন করতে শুরু করলে কেন? তুমি কি জান না, আমি তোমাকে কতটা ভালবাসি। এটা আমাকে এখন বলে বোঝাতে হবে।

শামিম তুমি বলেছিলে, ‘এখন তুমি আর আমি আমাদের প্রেমকে একটু পরখ করে নিতে চাই। আমি যা বলব, তুমি তা করতে পারবে?’

তোমার জন্য আমি প্রাণ দিতে পারি শামিম, তুমি কি তা এতদিনে বুঝতে পারনি।

‘কি করে বোঝাব তোমাকে ফুলকি, আমি কি বলতে চাইছি। আমি যে কথা বলছি, আমিই তো সেটা বুঝতে পারছিনে।’

তুমি কি করতে বলছ, শামিম তুমি নিঃসংকোচে তা বলতে পারো। দেখবে তুমি যা বলবে আমি সেটা পালন করব।

‘বেশ’, তুমি আবার থমকে গেলে শামিম, ‘বেশ, তবে শোনো, পরশুদিন কাকাবাবু ফিরছেন। কাল আমরা একসঙ্গে রাত কাটাব। পারবে তুমি?

আমি সহজেই বলেছিলাম, কেন পারব না শামিম। কিন্তু কোথায়?

‘সেটা এখনও ঠিক করিনি, কারণ চিন্তাটা এখনই আমার মনে হল। হয়ত কোনও হোটেলে। কি পারবে?

তুমি কি আমাকে পরীক্ষা করছ শামিম?

‘না না ফুলকি, পরীক্ষা তোমাকে করছিনে? আমাকেও আমি পরীক্ষা করতে চাই। আমাদের প্রেমটাকেই আমি পরীক্ষা করতে চাই। কোন সত্যের উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি, আমি সেটাই বুঝে নিতে চাই ফুলকি। এটা তোমার প্রতি কোনও মতেই অনাস্থা নয়, দোহাই তোমার, তুমি কি বুঝতে পারছো?’

হ্যাঁ শামিম, বুঝতে পারছি। তুমি যা করতে চাও তাই হবে। তুমি আমাকে বলো আমাকে কি করতে হবে।

শামিম তুমি এতখানি কথা বলে যেন একটু হাল্কা হলে। আমি দেখলাম তোমার মুখের অস্বস্তির ভারটা কেটে যেতে লাগল। বাইরে বাজ পড়ল। আবার বৃষ্টি শুরু হল।

শামিম তুমি ততক্ষণে আবার শান্ত হয়ে এসেছ। আমিও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তুমি বললে, ‘ফুলকি, কাল রাতে আমরা একসঙ্গে থাকব। আমি হোটেল ঠিক করে ফেলব। তুমি বিকাল ৪টা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা প্যারাগনে চলে আসবে। বাড়িতে তুমি কি বলে যাবে, সেটা তুমি ঠিক করবে। আমরা পরশু সকালেই ফিরব। কাকাবাবু কখন আসবেন?’

সন্ধ্যার ট্রেনে।

‘বেশ। তোমাকে কোনও জিনিস নিতে হবে না।’

আশালতা আশালতা! অনেক কষ্টে সেদিন আশালতাকে ফিরিয়ে এনেছিল ফুলকি।

৮ অক্টোবর ১৯৪৫

‘উই হ্যাভ্ টার্নড্ এ হাজব্যান্ড এ ওয়াইফ। গতকাল রাতে আমার বিবাহ ঘটেছে। এটাকে কী রীতি বলব? সামাজিক না গন্ধর্ব বিবাহ? সংস্কারমুক্ত না সংস্কারযুক্ত? লিখতে যতই কাঠখোট্টা লাগুক না কেন আমার কিন্তু একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিবাহের প্রধান রীতিটাই পালিত হয়েছে—সিঁদুর পরানো—শামিম যে এত জানে আমার ধারণা ছিল না। হঠাৎ প্যাকেট খুলে সুিদর নিয়ে আমার সিঁথিতে পরিয়ে দিল, পরিয়ে দিল না বলে মাখিয়ে দিল বলাই ভাল। এ যেন বসন্ত উৎসবে আবির মাখানো। সিঁথির সিঁদুর আমার লাল রঙের জর্জেটের শাড়িতে গড়িয়ে পড়ল। সাক্ষী আমরা নিজেরাই। না প্রভু না! সাক্ষী তুমিও ছিলে। আমার একটা সম্পূর্ণ অন্য রকমের অনুভূতি এসেছিল। মনে হচ্ছিল ক্রুশ ছুঁয়ে বাতিস্ত করলে যেন নবজন্ম হয়, তেমনি যেন পুনর্জন্ম হল।

আশালতা আশালতা!

আশালতা ঘরে ঢুকল। হাসতে হাসতে বলল, ‘কি এতক্ষণে মুখ ফুটেছে। তবে তুমিই বল, দাদাকে কি বলব? তুমি কি কোনও বিশেষ জায়গায় যেতে চাও, বিশেষ কোনও স্পটে? তুমি যেখানেই বলবে, দাদা তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাবে। ইশ্, তোমার জন্য আমার এখন ঈর্ষা হচ্ছে ফুলকিদিদি।’

আমার উপর তোমার ঈর্ষা জাগবার কোনও কারণ নেই আশালতা।

‘কেন ফুলকিদিদি’?

সেই কথাই তো, তোমাকে জানাতে চাই। তবে তোমাকে আমার কথাটা শোনাবার জন্য একটু ধৈর্য ধরতে হবে। বসো। বলছি।

আশালতা টেবিলের ধারে যে চেয়ারটা ছিল, সেখানেই বসে পড়ল। ফুলকির ডায়েরির উপর আশালতা হাত রাখল। ফুলকি আর আশালতা রাতে একই ঘরে শোয়। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘রোজ রোজ ওই খাতাটায় কি লেখ ফুলকিদি? ফুলকি বলেছিল, এটা আমার ডায়েরি রোজ রোজ আমার মনে যে সব ভাবনা ভেসে ওঠে কি কোনও ঘটনা আমার কাছে খুব জরুরি বলে মনে হয়, আমি সেইগুলো সব অকপটে লিখে রাখি। তোমার ডায়েরি নেই আশালতা? আশালতা বলেছিল, ‘না তো।’ যদি কখনও ডায়েরি দেখো তবে দেখবে সেটা পুরনো হলে পড়তে কত ভাল লাগবে। তবে সব যা দেখবে, যা ভাববে—সত্য কথা লিখে রাখবে। দেখবে তোমার কালকের আমি আর আজকের আমিতে কত তফাত ঘটে গিয়েছে।

‘হ্যাঁ ফুলকিদি বলো, কি আমাকে বলতে চাইছো।’

আমি এই বলতে চাইছি আশালতা যে, তোমার দাদা আমার জীবনে খুব দেরি করে এসেছেন। এখন আমি ওর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাব না। তোমার দাদাকে বলো, আমি খুব দুঃখিত।

আশালতা ফ্যাল ফ্যাল করে ফুলকির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘তার মানে কি ফুলকিদি? আমার দাদা তোমার জীবনে দেরি করে এসেছে, এ কথার মানে কি? একটু স্পষ্ট করে বলবে?’

আশালতা, তুমি হয়ত খুব দুঃখ পাবে। আমি তোমার দাদাকে বিয়ে করছি না।

‘যাঃ! তুমি আমার সঙ্গে সেই তখন থেকে খালি ঠাট্টাই করে চলেছো। তুমি কি ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু জানো না। তোমার গুরুজনেরা এই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন, এই রবিবারে তোমাদের পাকা দেখা হবে। দেওঘরে গুরুদেবকে আনবার জন্য লোক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। শহরে পিসেমশাইয়ের বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনকে সব নেমন্তন্ন কথা হচ্ছে, আর তুমি বলছ, তুমি আমার দাদকে বিয়ে করবে না। ঠাট্টা ছাড়া এটা আর কী ফুলকিদি।’

এবার ফুলকি সত্যই প্রমাদ গণল।

আশালতা আমি তোমার সঙ্গে মোটেই ঠাট্টা করছি না। মনে হচ্ছে তুমিই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ। এবং এটা মারাত্মক ঠাট্টা। যদি সত্যই এটা ঠাট্টা হয়ে থাকে। আর যদি এটা ঠাট্টা না হয় তাহলে তোমার পিসিমাকে এক্ষুনি গিয়ে বল, তাঁরা আর এ ব্যাপারে একটুও না এগোন। আমার পক্ষে তোমার দাদাকে বিয়ে করা সত্যিই সম্ভব নয় আশালতা।

‘কেন ফুলকিদি, এর কোনও কারণ নিশ্চয়ই আছে।

হ্যাঁ, আশালতা কারণ আছে। তোমরা এত কাণ্ড করে ফেলছ আমাকে না জিজ্ঞাসা করেই। আশ্চর্য!

আশালতা যেন আকাশ থেকে পড়ল। ওর মুখ শুকিয়ে এসেছে। ‘ফুলকিদি, বিয়ের কনেকে কে আর কবে আমাদের সমাজে আগে ভাগে মত জিজ্ঞাসা করে। কলকাতায় যদিও এখন হচ্ছে ও সব ফ্যাশন, কিন্তু আমাদের এদিকে ও সবের চল এখনও হয়নি। সম্ভবত পিসিমণি সেই কারণেই তোমাকে আগে থাকতে কোনও কথা বলেননি। এদিকের মেয়েদের লজ্জাশরম কলকাতার মেয়েদের চাইতে বেশি হয়তো সেই কারণেই পিসিমণি খেয়াল হয়নি অত। তোমাকে তো ভালবাসেন ফুলকিদি। হয়ত ভেবেছেন এই বিয়েতে তুমি সুখী হবে। এবং তিনি সম্বন্ধ ঠিক করে দিলে তুমি অমত করবে না, এই বিশ্বাসটাও তার হয়ত ছিল।

আশালতা আশালতা ব্যাপারটাকে তোমরা অত হালকাভাবে নিও না। তোমার দাদাকে আমার বিয়ে করবার কোনও উপায় নেই।

‘কেন, আমার দাদা পাত্র হিসাবে কি এতই খারাপ।

আশালতা আশালতা, এ সব কোনও ব্যাপারই নয়। ব্যাপার তার চাইতেও গুরুতর।

‘কি এমন গুরুতর ব্যাপার ফুলকিদি? তুমি কি আমাকে তা বলতে পার না?’

আশালতা আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

‘কি বললে, তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!’ আশালতা ফ্যাল ফ্যাল করে ফুলকির দিকে চেয়ে রইল। তার চোখ মুখ কেমন ভয়ার্ত হয়ে উঠল। ফুলকিদি, তোমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে!

ফুলকি আর কথা বলল না। চুপ করে বসে রইল।

আশালতা সামলে নিল নিজেকে।

‘কেউ জানে?’

না।

‘তুমি মিছে কথা বলছ না, তার ঠিক কি?’

তোমরা বিশ্বাস না করলে আমার কিছু করার নেই। ছেলেটি মুসলমান। সেই জন্যই আমরা বিয়েটা লুকিয়ে করেছি, এবার বুঝেছ তো?

সেই প্রলয়ংকর দিনের বর্ণনা অমিতা কি ভাবে করবে, ভেবে পাচ্ছিল না। ফুলকির মাথায় সেদিন যেন নরকই ভেঙে পড়েছিল। সেদিন যে সে বেঁচেছিল, সে কেবল তোমাতে আশ্রয় নিয়েছিল বলে শামিম। আশালতা ফুলকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাথায় যেন বাজ পড়েছে। নিচে এক একটা জায়গা থেকে একজন আত্মীয় এসে পড়তেই সমস্ত বাড়িটাতেই একটা হুল্লোড় পড়ে যাচ্ছে। আশালতা আর ফুলকি শুনল, দানাপুরের সেজো মামী আর দ্বারভাঙা থেকে ফুলকির রতনপিসি এসে পৌঁছে গেলেন। আবার নিচে থেকে মেয়েমহলের হল্লা উপরে ঠেলে উঠল।

আশালতা বলল, ‘এখন কি হবে ফুলকিদি।’ আশালতার গলায় ত্রাস। আশালতা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘ফুলকিদি, তুমি সেদিন বলেছিলে, তোমার জীবনের যা কিছু বিশেষ বিশেষ ঘটনা তুমি এই ডায়েরির মধ্যে সেটা লিখে রাখো। এত বড় একটা ঘটনা তোমার জীবনে তুমি ঘটালে, আর সেটাকে কি লিখে রাখোনি, নিশ্চয় রেখেছ। আমি দেখবো একবার? কিছু মনে করো না ফুলকিদি আমার কিন্তু এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।

ফুলকি ইতস্তত করছিল, সে ডায়েরিটা আশালতাকে দেখতে দিতে চাইছিল না। এটা তার প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ। আবার ভাবল, এইটুকুর উপর দিয়েই ফাঁড়াটা যদি কাটে, তবে কাটুক। আশালতার আর তর সইছিল না। ফুলকি অনুমতি দিল আর না দিল, তার অপেক্ষা না করেই টেবিল থেকে খপ করে ডায়েরিটা তুলে নিল হাতে।

নিচে থেকে দানাপুরের সেজো মামী তখন, চিলের মতো তার গলা, বলছে, ‘বড়দি তুমি একটা কাজের মতো কাজ করলে বটে। তোমার মাথাতে আসেও বটে আসল ফন্দীগুলো। তা কেমন লেগেছে ওদের?

জেঠিমণি কি বললেন, উপর থেকে শোনা গেল না। কিন্তু নিচে অন্দরমহল ফেটে পড়ল হুল্লোড়ে।’

‘কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে, না হলে আর আত্মকুটুম থাকে কেন?’ এটা রতন পিসির আওয়াজ। ‘মেজদার কত রকম কাজ। আজ হিল্লি কাল দিল্লি। বউদি মারা যাবার পর তো চিঠি লেখারই সময় পায় না। তা মেজদা কি বলল, সম্বন্ধের কথা শুনে?’

আশালতা ডায়েরির পাতাটা বের করে ফুলকির সামনেই পড়ে দিল, ‘উই হ্যাভ টার্ড কমপ্লিটলি এ হ্যাজব্যান্ড অ্যান্ড এ ওয়াইফ।’

ফুলকির মনে হল, আশালতা যেন কথাটার মানে সম্যক বুঝতে পারছে না। তারপর আরও কয়েকটা ছত্র সে দ্রুত পড়ে গেল। এর পর আশালতা যখন ফুলকির দিকে চাইল, অমিতার মনে আছে, আশালতার মুখটা ঘৃণায় বিতৃষ্ণায় কেমনভাবে কুঁকড়ে উঠেছিল।

নিচে থেকে দমকে দমকে কেবলই হুল্লোড়ের আওয়াজ অমিতার, না ফুলকির কানে এসে বাজছিল।

আশালতা এতক্ষণে কথা বলল, ‘একে তুমি বিয়ে বল ফুলকিদি, ছিছি, এ তো নষ্ট মেয়েরা করে। এর চাইতে তুমি বিয়ে করে জাত খোয়ালেও ভাল করতে। ছি ছি ফুলকিদি তুমি এমন! তুমি এমন জঘন্য! এত খারাপ মেয়ে!’

মামীই বোধ হয় নিচে থেকে বলে উঠল, ‘তা দুজনকে দেখে তোমার কি মনে হল, দিদি পাত্রটিকে কি মেমসাহেবের মনে ধরেছে?’

জেঠিমণি বললেন, ‘কেন পাত্র রূপে গুণে বিদ্যায় বুদ্ধিতে চাকরিতে কি কম কারোর চাইতে কিছু যে, মনে ধরবে না।’

‘তুমি খুব নোংরা মেয়ে ফুলকিদি। আর বোকাও বটে। মোছলমানের ফুসলানিতে পড়ে তুমি তার সঙ্গে হোটেলে রাত কাটালে!’

‘আজ তো বাবু বিবির দুজনে একসঙ্গে বেরোবার কথা।’

‘ও বাব্বা, এর মধ্যে এতদূর গড়িয়েছে!

‘তা নয়তো কি? বয়স কি কম হয়েছে ফুলকির, সময় কালে বিয়ে হলে এতদিন কটা ছেলেমেয়ের মা হয়ে যেত, বল তো?’

না, আশালতা। আমাকে কেউ ফুসলে আনেনি। আমি নিজের ইচ্ছেয় ওর সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমি জানি, আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের যা প্রধান অনুষ্ঠান সেটাই পালিত হয়েছে আশালতা। আর কি চাই?

‘আশা, ও আশা, এতক্ষণ উপরে দুজনে কি গুজগুজ ফুসফুস করছিস? ফুলকিকে নিয়ে নেমে আয়। ওর মামী এসেছে, ওর পিসি এসেছে। খাওয়া দাওয়া করবি তো?’

আশালতা হঠাৎ মর্মভেদী চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘পিসিমণি গো, সর্বনাশ হয়ে গিয়েছে।’ বলেই আশালতা দৌড় মারল নিচেয়। ফুলকির ডায়েরি ওর হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা।

আশালতাকে দেখে অন্দরমহলে তুমুল হট্টগোল শুরু হল। আশালতা হাউ হাউ করে কাঁদছে। সকলে একসঙ্গে ‘কি হল, কি হয়েছে’ বলে চিৎকার করছে।

বাবা সেদিন সকালের ট্রেনে মধুপুরে চলে গিয়েছেন। ফিরবেন সন্ধ্যার ট্রেনে। বাবার বন্ধু তারকনাথ সাধুর সঙ্গে বাবা দেখা করতে গিয়েছেন। জেঠামণি দিবাকর চক্রবর্তী, নেমপ্লেট অনুযায়ী রায় বাহাদুর ডি কে চক্রোভারটি, সিনিয়র গভর্নমেন্ট প্লিডার অ্যান্ড নোটারি পাবলিক যথাসময়ে কাছারিতে বেরিয়ে গিয়েছেন। বাড়িতে আছেন আশালতার বাবা বন্ধুবিহারী ভট্টাচার্য এবং তার দাদা অবনীশ। অবশ্য অবনীশ আছে কি না সেটা ভাল জানত না ফুলকি। বাড়িতে থাকলেও এদের কোনও সাড়া পাচ্ছিল না সে।

এতগুলো বছরের ব্যবধান থেকে অমিতা একটা ঘষা কাঁচের মধ্য দিয়ে যেন সেদিনের প্রলয়ংকর কাণ্ডগুলোকে দেখে যাচ্ছিল। ফুলকি দোতলার ঘরে বিমূঢ় হয়ে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না কি ঘটতে যাচ্ছে তার জেঠামণির বাড়িতে।

নিচে আশালতা হিস্টিরিয়া রোগীর মতো কাণ্ড করছে। ওর চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসবে যেন। ওর হাতে ফুলকির ডায়েরিটা ধরা।

‘পিসিমণি পিসিমণি আমাদের সর্বনাশ হয়েছে, পিসিমণি ও মা মা আমাদের সর্বনাশ হয়ে. গিয়েছে।’

‘কি হল, ও আশা? কার সর্বনাশ হল?’—পিসিমণি।

‘সর্বনাশের কথা কি বলছিস, তুই আশা। আজকের দিনে এমন অলুক্ষুণে কথা কেউ বলে।’ দানাপুরের মামীমা।

‘এই ছুঁড়ি, আ মর কেবল তখন থেকে চেঁচিয়েই যাচ্ছে। কি হয়েছে সেটা বলবি তো?’—দ্বারভাঙার রতনপিসি।

ফুলকি বসে আছে তার দোতলার ঘরে। সে একেবারে বিভ্রান্ত।

‘ও মা, আশা, কি হল মা তো, এমন করছিস কেন? কার সর্বনাশ কে করল, মা আশা ও আশা?’—আশার মা।

ফুলকি হঠাৎ অবস্থাটা বুঝতে পারল। আশালতার হাতে তার ডায়েরি। সেটা যদি আশালতা পড়ে দেয় তাহলে কি হবে, সেটা পুরোপুরি তার মাথায় এখন ঢুকল। কেন সে আশালতাকে তার ডায়েরিটা নিতে দিল! তার হাত থেকে কেড়ে নিল না কেন?

অমিতা ঘরের চারিদিকে ইতস্তত ছড়ানো ডায়েরির খাতা ইত্যাদির দিকে একবার চেয়ে দেখল। মন্টুর মা এলে ওগুলো গুছিয়ে রাখতে হবে। শাড়ি শাড়ি, সেই জর্জেটের লাল শাড়িটা অমিতার চোখে ভেসে উঠল। সেদিন এই শাড়িটার জন্যই তো মন্টুর মাকে দিয়ে আলমারিটা খুলিয়েছিল অমিতা। কিন্তু কি ভুলো মন দেখ, মন্টুর মার, শাড়িটা বের করে দিল না। কিন্তু সে বলেছিল কি শাড়িটা বের করে দিতে? সেই শাড়িটা আছে কোথাও। ফুলকি রেখে দিয়েছিল শাড়িটা যত্ন করে। সকলের চোখের থেকে আড়াল করে। অমিতারও মনে আছে শাড়িটার কথা। সেই লাল জর্জেটের শাড়িটা ফুলকির জীবনের যত আনন্দের প্রতীক, তার আশা আকাঙ্ক্ষা স্বপ্নের প্রতীক, আবার ততই তার দুঃখ বেদনা যন্ত্রণার প্রতীক। আছে নিশ্চয়ই। অমিতার কাছেই কোথাও আছে। মন্টুর মা এলে খুঁজে বের করতে হবে। তার নিজেই একবার ইচ্ছে হল, উঠে গিয়ে দেখে কোথায় রেখেছে সেটাকে। কিন্তু অমিতা এখন ফুলকির মতোই বিপর্যস্ত। তার উঠতে ইচ্ছে করল না।

‘ফুলকিদি আমাদের সর্বনাশ করে ছেড়েছে পিসিমণি।’ সকলের আওয়াজ ছাপিয়ে আশালতার গলা শোনা গেল। ‘ফুলকিদি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মোছম্মানের হাতে জাত খুইয়ে এসেছে।’

ফুলকি সেই দোতলার ঘরে বসে এই আর্ত চিৎকার শুনল। আশালতার প্রতিটি শব্দ তার কানে এসে ঢুকল। মুহূর্তে নিচের সব গোলমাল থেমে গেল। গোটা বাড়িটাই কেমন এক লহমায় স্তব্ধ হয়ে পড়ল। অমিতা শূন্যের দিকে চেয়ে বলল, সেদিন ফুলকির মনের অবস্থা যা হয়েছিল, সেটা কি তুমি কখনও আন্দাজ করতে পারবে শামিম? পারবে না। করুসভায় বিবস্ত্র হবার মুখে দ্রৌপদীর মনের অবস্থা কি হয়েছিল, ব্যাসই কি তা বর্ণনা করতে পেরেছিলেন। কোনও পুরুষের পক্ষেই নারীর সেই লজ্জা সেই অপমান সেই গ্লানি যে কি দহনের জ্বালা সৃষ্টি করে নারীর মনে, তা একমাত্র সেই বুঝতে পারে যে জ্বলেছে, পুড়েছে তিলে তিলে ফুলকি যে সেই বিপর্যয়ের মধ্যেও আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল সে শুধু তোমাকে আশ্রয় নিয়েছিল বলে। ভুল বুঝো না শামিম। ফুলকি নিজের জন্য ততটা আতঙ্কিত হয়নি, ওদের ঘৃণা ওদের হিংস্রতা পাছে তোমার কোনও ক্ষতি করে ফেলে সেই উদ্বেগেই সে অস্থির হয়ে উঠছিল। তার মনে নিজের জন্য ভয় তেমন ছিল না, শামিম। · ছিল কেবল বিমূঢ়তা। বরং একদিকে সে নিশ্চিন্ত হয়েছিল, সত্যটা প্রকাশ হয়েছিল বলে। আর তো ঢাক ঢাক গুড় গুড় কিছু থাকল না। ফুলকি ভাবছিল, এ ববং ভালই হল।

অনেকক্ষণ পরে নিচে মেয়েমহলে একটা একটা করে আওয়াজ ফুটতে লাগল।

‘কি বলছিস তুই আশালতা!’

‘তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল!’

‘মোছম্মানের হাতে জাত খুইয়েছে, তার মানে কি?’

‘হোটেলে এক ঘরে তোমাদের ফুলকি তার ভাবের মানষের সঙ্গে রাত কাটিয়েছে।’

‘কী সর্বনাশ!’

অমিতা বলল, কতটুকু আর জানবে ওরা। ফুলকির ডায়েরিতে কতটুকুই বা লেখা আছে শামিম। তোমাকে কিন্তু বেশ স্মার্ট দেখাচ্ছিল। একেবারেই অন্য রকম। ধুতি পরেছিলে সেদিন। ভাইফোঁটায় যেমন আনাড়ি ভাইয়েরা ধুতি পরে আসে, তোমাকে অবিকল সেই রকম দেখাচ্ছিল। কিংবা বরেরা যখন ধুতি পরে সেজে গুজে আসে, তেমনধারাই হয়ত তোমাকে দেখাচ্ছিল। ফুলকির এই নতুন শামিমকে দারুণ ভাল লাগছিল। পাঞ্জাবিটা পরেছিলে দারুণ। সেটা ছিল ঘিয়ে রঙের একটা সিল্কের পাঞ্জাবি। ঘামে ভিজে গিয়েছিল। দেখো, শামিম, কতদিনের কথা তো, কিন্তু অমিতার এখনও ঠিক মনে আছে। তোমার হাতে ছিল একটা সুটকেস। নতুন বউরা যেমন বরের পিছনে পিছনে যায়, ফুলকিও তেমনি তোমার পিছনে পিছনে হাঁটছিল। কেউ যদি দেখত, তবে ভাবত, নির্ঘাৎ ভাবত, ওরা বাঙ্গাল দেশ থেকে এসেছে। শিয়ালদার হোটেলের এসে তুমি ফুলকিকে বলেছিলে, ‘ফুলকি যতক্ষণ আমরা বাইরে থাকব, তুমি ঘোমটা টেনে দেবে। একেবারে মুখখানা ঢেকে রেখো না, ঘোমটার ফাঁক দিয়ে তোমার মুখখানা যেন হোটেলের ম্যানেজার দেখতে পান। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র। দেখো ওইতেই হয়ত পার পেয়ে যাব। ফুলকি ঘোমটা দিয়েছিল। রাস্তার এক পানের দোকানের আয়নায় আড় চোখে একবার উঁকি দিয়ে ফুলকি নিজের চেহারা দেখেও নিয়েছিল। হোটেলের নামটা অদ্ভুত লেগেছিল তার। আর্য নিবাস বা ওই ধরনের কিছু হবে। তোমার মনে আছে শামিম? সেদিনের আনন্দ সুখের অনুভূতি তো লেখা নেই ডায়েরিতে। সেদিনের দুঃখ যন্ত্রণার অসহ্য সব অনুভূতির কথাও তো লেখা নেই কিছুই। কি বুঝবে ওরা।

‘তোকে এ কথা কে বলল আশা? তুই কি করে এই সর্বনাশের কথা জানতে পারলি?’

‘তুই ঠিক বুঝতে পারিসনি। কি বুঝতে কি বুঝেছিস আর চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করছিস। চুপ কর। যা বলবি আস্তে বল। বলে কি মেয়েটা?’ কথা শুনে ফুলকির মনে হল, গলাটা যেন দানাপুরের মামীর। তার চিলের মতো গলাও এখন কেমন গম্ভীর হয়ে এসেছে।

শুধু চেহারাতেই নয় শামিম, তুমি আচার আচরণেও কেমন চটপটে হয়ে উঠেছিল। আমার চেনা লোকটাকে আমি যেন চিনতেই পারছিলাম না। হোটেলে গিয়ে তুমি নাম লেখালে মিঃ অ্যান্ড মিসেস এস জোয়ারদার। পেশা লিখলে মুখটিয়ার। ঠিকানা লিখলে নীলগঞ্জ, মেহেরপুর, জেলা কুষ্ঠিয়া। পরে আমি জিজ্ঞাসা করলে বলেছিলে, ওটা তোমার মাসির বাড়ি।

‘বলবে আবার কে, পিসিমণি। সব কথা তোমাদের ওই গুণবতী মেয়েই আমাকে বলেছেন।’

মেয়েমহলের সমস্ত আলোচনা মাঝে মাঝে এক একটা ঢেউয়ের মতো ফুলকির কানে এসে বাজছিল।

‘কি শুনতে কি শুনেছিস তুই। এমন একটা অসম্ভব কাজ আমাদের বাড়ির মেয়ে করবে, এটা বিশ্বাস হয় না।’ দ্বারভাঙার রতনপিসিরি গলা। তিনি তখনও ফুলকিকে বাঁচিয়ে কথা বলছেন। ‘ফুলকি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করছে আশালতা।

‘কি বললে, ঠাট্টা! যা বলেছে তোমাদের মেয়ে, তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।’

‘এত চেঁচাচ্ছিস কেন আশালতা। আস্তে বল না। তুই এত খেপে যাচ্ছিস কেন?’

‘আমি বলেই তাই মাথাটা এখনও ঠাণ্ডা রেখে চলেছি। আমাকে তোমরাই তো খেপিয়ে দিচ্ছ।’

ফুলকিকে নিয়ে তুমি ঘরে ঢুকলে শামিম, তার রক্তে তখন সুখসাগরের জোয়ার বইছে। যদিও হোটেলের সেই ঘিঞ্জি ঘরটা তেমন পছন্দ হয়নি ফুলকির। তার তখন মনে পড়ছিল তার নিজের খোলামেলা ঘরটার কথা। গলগল করে ঘামছিলে তোমরা পাখা খুলে দিয়েও আরাম হচ্ছিল না। শামিম তুমি তখন একটা মাত্র জানলা খুলে দিয়েছিলে। সেটা রাস্তার দিকে তবুও এক ঝলক বাতাস ঢুকল। তুমি জানলা খুলে রেখেই বয়কে ডাক দিলে। বয় এলে চায়ের অর্ডার দিলে। চা-টা খেয়ে ফুলকি বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল। তারপর এক সময় তুমিও তার বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লে। একবার বলেছিলে, ‘জানলাটা কি বন্ধ করে দেব?’ ফুলকি বলেছিল, থাক না খোলা।

‘তোমাদের মেয়ে ঘটনাটা আমাকে শুধু মুখেই বলেনি রতনপিসি। ঘটনাটা তোমাদের মেয়ে লিখেও রেখেছে তার ডায়েরিতে। দেখতে চাও!’

হঠাৎ যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেল নিচে। হয়ত সকলে তখন এক সঙ্গে ডায়েরিটা নিয়ে টানাটানি শুরু করেছিলেন। প্রমাণ দেখবার জন্য।

একটু পরে একটা পুরুষ গলা ডায়েরিটা পড়তে শুরু করল বেশ জোরে জোরে। সে কি ফুলকিকে শোনাবার জন্য? পুরুষ গলাটা কার, সে ঠাহর করতে পারল না। শামিম, তখন তুমি ফুলকিকে আদর করতে শুরু করেছিলে। আহ্ শামিম! ফুলকিকে তুমি তখন ভাসিয়ে দিচ্ছিলে সুখের স্রোতে।

ভরাট গলা ডায়েরিটা পড়ে চলল, ‘উই হ্যাভ্ টার্নড কমপ্লিটলি এ হাজব্যান্ড অ্যান্ড এ ওয়াইফ্।…’

আহ্ শামিম, তোমার আঙ্গুলে- তোমার ঠোঁটে সে কি উষ্ণতা! আমি তখন স্রোতে ভাসছি শামিম। না না, আমি তখন আকাশে ভাসছি। না, শামিম না, আমি তখন স্বপ্নে ভাসছি। একেই কি স্বৰ্গীয় সুখ বলে!

‘এ এ-কথার মানে কি?’ ফুলকি বুঝল এ গলাটা দানাপুরের মামীর।

ভরাট গলাটা বলল, ‘আমি পড়ে যাই মানেটা সবাই স্পষ্ট বুঝতে পারবেন।’ গলাটা তাহলে অবনীশের। ফুলকির মনে হল, অবনীশই-তাহলে তাকে বিবস্ত্র করার দায়িত্ব নিয়েছে। ফুলকির মনে অবনীশের জন্য কষ্ট হতে লাগল।

‘গতকাল রাতে আমার বিবাহ ঘটেছে। এটাকে কী রীতি বলব? সামাজিক বিবাহ না গান্ধর্ব বিবাহ?…’

ওরা তাহলে এখন জেনে যাচ্ছে। আমার গোপন কথা ওরা সব জেনে যাচ্ছে শামিম? যাক ভালই হল। আমি তো গোপন করতে চাইনি কিছুই। যা সত্য তাকে কেনই বা গোপন কর? তুমি আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাও শামিম। এমন জায়গায় যেখানে মানুষ প্রেমের মূল্যেই মানুষকে গ্রহণ করবে।

‘সংস্কারমুক্ত, না সংস্কারযুক্ত? লিখতে যতই কাঠখোট্টা লাগুক না কেন আমার কিন্তু একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিবাহের প্রধান রীতিটাই পালিত হয়েছে, সিঁদুর পরানো। শামিম যে এত জানে তা আমার ধারণা ছিল না। …’

‘কি এখন তো বোঝা গেল? না আরও বোঝার বাকি আছে কিছু!’ আশালতার গলা লাফ দিয়ে সকলের উপরে উঠে গেল।

শামিম তখন ফুলকির কানে কানে বলে চলেছে, এবার একটা চুমু খাও প্লিজ ফুলকি, প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’ নাছোড় শামিমের আবদার রাখতে ফুলকি তাকে একটা চুমু খেল। ‘ধ্যাৎ, এটা কি কি ধরনের কাজ হল? ‘এটা কি চুমু খাওয়া হল।’ ফুলকি লজ্জা পেল। সে কাতর ভাবে বলে উঠল, আমি জানিনে শামিম। আমি ওটা পারিনে। বলেই শামিমের বুকের মধ্যে নিজের মুখটা গুঁজে দিল। শামিম হাসতে লাগল। ‘একেবারে আনাড়ি, অ্যা! তোমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে ফুলকি বলেছিল, তা বেশ তো গুরুমশাই, মনে হচ্ছে তুমি তো এ বিষয়ে এক্সপার্ট তা তুমিই না হয় শিখিয়ে নিলে। একদিন দেখবে গুরুমারা বিদ্যে কাকে বলে।

এবার যে মেয়েমহল এতক্ষণ নিচে ‘জটলা করছিল, তারা সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে ফুলকির ঘরে ঢুকে পড়ল। জেঠিমণির হাতে ফুলকির ডায়েরি।

‘সর্বনাশী, তুই নিজের মুখ পুড়িয়েছিস পুড়িয়েছিস, আমাদের মুখ পোড়ালি কেন?’

‘ছি ছি ছি! তুই মরলিনে কেন?’

‘তোর পেটে পেটে এত! ভেবেছিস ডুবে ডুবে জল খাচ্ছিস শিবের বাবাও টের পাচ্ছে না।’

‘তুই মর মর মর ফুলকি! গলায় দড়ি দে যদি তোর হায়া লজ্জা কিছু থাকে।’

অমিতা বিছানার উপর বসে বসে ফুলকির সেদিনের মনের অসহায় অবস্থার কথা অনুভব করার চেষ্টা করছিল। এত ঘৃণা, এত বিদ্বেষ কেমন করে ঝরে পড়ে মানুষের মুখ দিয়ে। গিরিডির জেঠিমণি, দানাপুরের মামী, দ্বারভাঙ্গার রতনপিসি, বাবা, বেচারি বাবা, জেঠামণি, আজ তারা কোথায়? কোথায় তুমি শামিম? সবাই মরীচিকার মতোই না মিলিয়ে গিয়েছ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমিতা। অতীতের লোকগুলো গিয়েছে, কিন্তু অতীতের দাগগুলো তবু কেন যায় না!

অতীতে চোখ ফেলতেই গিরিডির জেঠামণির বাড়িটা ভেসে উঠল অমিতার চোখে। বাড়ি থেকে খবর পেয়ে জেঠামণি কাছারি থেকে বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলেন। ওকে ফুলকির ঘরেই নিয়ে এলেন জেঠিমণি। আদালতের পোশাক তখনও জেঠামণির পরনে। সেই চোগা চাপকান, পকেট-ঘড়ির গার্ড চেন বুক পকেট থেকে ঝুলছে। সকলেই তাঁকে দেখে একসঙ্গে হাউমাউ করে উঠেছিল। এক ধমক মেরে তিনি সবাইকে থামিয়ে দিলেন। সকলের নালিশের একই কথা। ফুলকি মুসলমানের সঙ্গে হোটেলের রাত কাটিয়ে তার জাত খুইয়েছে। এদিকে ওরই পাকা-দেখার নেমন্তন্ন শহরসুদ্ধ লোককে করে ফেলা হয়েছে। এখন কি করা? জেঠামণির হাতে ফুলকির ডায়েরি তুলে দেওয়া হল। তিনি সেটা পড়লেন। তাঁর জেঠামশাই, অত বড় ডাকসাইটে উকিল। অথচ দেখো, লোকটাকে কত অসহায় দেখাচ্ছে। তিনি ফ্যালফ্যাল করে কেবলই ফুলকির দিকে চাইছেন। যেন সব কিছুর সমাধান ফুলকিই করে দিতে পারবে। সেইদিন কথাটা ফুলকির মনে এসেছিল, ওই অত বিপর্যয়ের মধ্যেও, সব গুরুতর ঘটনার মধ্যে এক-এক জন প্রহসনের নায়ক থাকেন। ফুলকির জেঠামণিকে দেখে মনে হল, তিনিই আজকের প্রহসনের নায়ক। জেঠামণি একটা কথাও বললেন না। দু’হাতে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ দাঁইড়য়ে রইলেন ঘরের মধ্যে। তারপর ফ্যাসফেসে গলায় বললেন, ‘ওর বাবাকে আসতে দাও, যা করবার ওই করবে। আমি কিছু ভাবতে পারছিনে।’

সবাই যখন দিশেহারা তখন একমাত্র ফুলকিই ছিল আত্মস্থ। প্রাথমিক বিপর্যয়ে সে অসহায় হয়ে পড়েছিল, এটা ঠিকই। তবুও সেই সবার আগে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। কেন জানো শামিম? কারণ সে তোমাকেই আশ্রয় করেছিল তখন। সেই সন্ধ্যার মধুর স্মৃতি আজও ভুলতে পারেনি অমিতা। কারণ তার জীবনে সেই সন্ধ্যাটার মতো অমন সুখের সময় আর কখনও আসেনি। তুমি। ফুলকিকে সিনেমায় নিয়ে যাবে বলে ফুলকির খোঁপা বেঁধে দেবার বায়না ধরেছিলে। তুমি ওকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলে যে, তুমি খুবই ভাল। খোঁপা বাঁধতে পারো। তার আগে ফুলকি খোঁপা বাঁধেনি বললেই হয়। একবার ওর বন্ধু সুচন্দ্রার বাড়িতে সুচন্দ্রার জন্মদিনে তাদের মধ্যে খোঁপা বাঁধার ঝোঁক উঠেছিল। সেদিন সুচন্দ্রার মা-ই ওদের সকলের খোঁপা বেঁধে দিয়েছিলেন। ফুলকি কলেজজীবনটা বিনুনি দিয়েই চালিয়ে দিয়েছে। এর জন্য ওর বন্ধুদের কাছে কত কথা শুনতেই না হয়েছে। পুরুষমানুষ খোঁপা বাঁধে, এটা ফুলকির কাছে হাসির ব্যাপার ছিল। তখন পাড়ায় পাড়ায় বিউটি পারলারের চল ছিল না তো? ডালিমতলার বাড়িতে মায়েদের খোঁপা বেঁধে দিত নাপিত বউ। কিন্তু শামিম, তুমি সত্যিই সেদিন অবাক করেছিলে ফুলকিকে। কত যত্নে কত সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দিয়েছিলে। তোমার আঙুল যেন স্বপ্ন দিয়ে তৈরি শামিম। মানুষের আঙুল ছিল কি তোমার? ত বে তাতে হাড় মাংস ছিল না কেন? কেবলই মমতা দিয়ে কি সে আঙুল গড়া ছিল? আমার সারা শরীরে ক্ষণে ক্ষণে শিহরন তুলছিল তোমার সেই অপার্থিব স্পর্শ। খোঁপা বাঁধতে গিয়ে দেখা গেল কাঁটা নেই। তুমি ফুলকিকে সেই অবস্থায় ঘরে বসিয়ে রেখে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গিয়ে বেলকুঁড়ি কাঁটা নিয়ে ফিরলে। তারপর সত্যিই ফুলকিকে সুন্দর করে একটা খোঁপা বেঁধে দিলে। তুমি বলেছিলে শামিম, ‘মায়ের এবং বোনেদের খোঁপা বেঁধে দিই ফুলকি যখন বাড়ি যাই। এটা অমার হবি। এখন বিশ্বাস হল তো? এখন মজুরি দাও।’ ভাল করে মজুরি দিতে পারেনি সেদিন, তা নিয়ে হাসিঠাট্টা হল। তার পর সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে তোমরা নাইট শোতে ছবিঘরে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। সে ছবিটাও বড় আশ্চর্য ছিল। হাউ গ্রিন ওয়াজ মাই ভ্যালি। কি আশ্চর্য! দেখ শামিম দেখো, এতদিন পরেও নায়ক নায়িকার নাম আমার মনে আছে। ওয়াল্টার পিজিওন নায়ক আর মরিন ‘ও হারা নায়িকা। আর অদ্ভুত সেই রোমান্টিক দৃশ্যটা! নায়িকা নায়কের বাড়ি এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকারে। পাদ্রী নায়ক বারবার দেশলাই কাঠি জ্বালতে চেষ্টা করছে লণ্ঠন ধরাবার জন্য। নায়কের আঙুল কাঁপছে তাই কাঠি ধরাতে পারছে না। অস্বস্তি দ্বিধায় ভুগছে নায়িকা! স্বপ্ন স্বপ্ন শামিম, সারা সন্ধ্যা তুমি আর ফুলকি এই স্বপ্নেই তো ভাসছিলে। তাই না? ছবি দেখে ফিরতে ফিরতে কত কথা হল দু’জনের। কথা আর ফুরোয় না! স্বপ্ন, স্বপ্ন! সেই প্রথম রাতের স্বপ্ন যদি না থাকত শামিম, তা হলে সেদিন রাতে ফুলকি যে কি করত তা সে জানে না।

‘এ কি গো মা, তুমি উঠে পড়েছ। মুখ ধুয়েচ? তা হলে চা করে দিই।’

প্রথম রাতের রেশ এত তাড়াতাড়ি কাটিয়ে দিতে তুমি এমন পাগল হয়ে উঠেছিল কেন শামিম? আমি তো আমার শরীর আমার মন আমার সত্তা সবই তোমাকে সমর্পণ করেছিলাম, তা হলে? সারা রাতই তো ছিল আমাদের দখলে। তা হলে? তবে তোমার এত তাড়া ছিল কিসের শামিম?

‘মা গো, কি চা খাবে তো এখন? করব?’

মন্টুর মা! এসে গিয়েছ। দেখ তো আমার সেই শাড়িটা কোথায় আছে?

হোটেলের ঘরে ফিরে এসে দরজাটা দিয়ে তুমি একটার পর একটা এমন আবদার করতে শুরু করেছিলে শামিম, যার সঙ্গে তোমাকে মিলিয়ে নিতে সময় সময় আমার যথেষ্ট অসুবিধে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল এ যেন অন্য কোনও শামিম? কেন শামিম? তুমি তো সেই একই লোকই ছিলে? নাকি ছিলে না? কত রকম ছেলেমানুষি খেয়াল তোমার ঘাড়ে ভর করেছিল সেদিন শামিম, তা কি তুমি জানো? দরজা বন্ধ করে তুমি একটা সিঁদুরের প্যাকেট খুলে আমার কপালে সিঁদুর ঢেলে দিলে।

‘কোন শাড়িটার কথা কইছ, ও গো মা।

সিঁদর আমার সমস্ত চুলে ছড়িয়ে পড়ল, আমার শাড়িতে গড়িয়ে পড়ল। ভাগ্যিস ফুলকি সেদিন লাল একখানা জর্জেট পরে গিয়েছিল।

কোন শাড়িটা দেব মা তোমাকে? সেটা কইবে তো?’

আমার একটা লাল জর্জেটের শাড়ি আছে মন্টুর মা। সেটাই ক’দিন ধরে খুঁজছি। একটু খুঁজে দাও না। আলমারিটার কোনাখুঁজিগুলো একটু খুঁজে টুজে দেখ।

‘আগে চা খাও, পরে শাড়িটা খুঁজে দেবখন।’

তুমি সিঁদুর পরিয়ে কি বলেছিলে শামিম, মনে পড়ে? তুমি বলেছিলে, ‘তুমি আমার বউ, সেটা চিহ্নিত করে দিলাম।’ ফুলকির শরীরে তখন আর সুখ ধরছিল না শামিম। তখনও সে সুখেই ভাসছিল। সে বলেছিল, আর তুমি যে আমার বর আমি সেটা চিহ্নিত করে দেব কী ভাবে, শামিম? মুহূর্তের জন্য কি তুমি একটু থমকে গিয়েছিলে শামিম? না কি সেটা ফুলকিরই বোঝার ভুল? হয়ত ফুলকিরই মনের ভুল। কারণ তুমি ততক্ষণে ফুলকিকে তোমার প্রশস্ত বুকের আশ্রয়ে টেনে নিয়েছিলে শামিম। তারপর তাকে চুমায় চুমায় পর্যুদস্ত করে দিয়েছিলে। তুমি যখন তাকে ছেড়ে দিলে তখন তার আর দাঁড়াবার অবস্থা ছিল না। তুমি বলেছিলে, ‘ফুলকি এই হচ্ছে সেই অমোঘ চিহ্ন যা দিয়ে তুমি চিনে নিতে পারবে তোমার ভালবাসার মানুষকে।

‘এই শাড়িটা কি হাঁ মা? তুমি এই শাড়ির কথা বছল?’

অমিতার দৃষ্টি তখন আবার ফুলকির উপরেই নিবদ্ধ হয়েছে। সে মন্টুর মায়ের কথার জবাব দিল না। নিচে শোরগোল শুনে ফুলকির মনে হল বাবা এসেছেন। ঠিকই, বাবাই এসেছিলেন। ওরা বোধ হয় বাবাকে নিয়ে উপরে আসছেন। ফুলকির বুকের ধক ধক আওয়াজটা বেড়ে উঠল। হ্যাঁ, শামিম, তুমি বড্ড ছেলেমানুষি আবদার শুরু করেছিলে। তুমি আবদার করলে, আমার শরীরটা তুমি বিজলির আলোয় দেখতে চাও। আমি আঁতকে উঠেছিলাম। না না, শামিম, না। আমার চোখে মুখে রক্তের স্রোত তখন লজ্জায় সংকোচে উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। না শামিম, আলোয় না, না না। তুমি তখন আলো নেবালে। তারপর অন্ধকারে আমার নিদারুণ অস্বস্তির মধ্যেও তুমি আমাকে ধীরে ধীরে অনাবৃত করলে শামিম। আর তারপরেই আমার উপর হিংস্রভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লে। সে কি হিংস্রতা! সে কি বন্যতা! তুমি আমাকে কি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলে শামিম? একেবারে? আমি তো আমার শরীর, আমার মন, আমার সত্তা সবই তোমাকে নিবেদন করে রেখেছিলাম। সেটাও কি তোমার মনে পড়ল না? উহ্ কি যন্ত্রণা, কি যন্ত্রণা! কোথায় গেল তোমার এত কোমলতা, সারা সন্ধে যার মধ্যে আমাকে ডুবিয়ে রেখেছিলে? কোথায় গেল আমার প্রতি তোমার এত মমতা? তুমি কি আমাকে একেবারে ভুলে গিয়েছিলে শামিম, তোমার ফুলকিকে? আমার কুমারীত্বকে তুমি যখন সবলে ফালা ফালা করে ছিঁড়েছিলে, তখন, তখন কি তোমার একবারও মনে পড়ল না, যে মেয়েটি পুরুষালি হিংস্র রথের তলায় চাপা পড়ে পিষ্ট হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ছে, সে নারী। সে মানুষ। সে তোমারই প্রেমিকা? একবারও তোমার এ কথা মনে পড়ল না, শামিম। শামিম, এই হিংস্রতা, এই দস্যুতার জন্য আমি তৈরি ছিলাম না। যন্ত্রণায় আমি কঁকিয়ে উঠছিলাম। প্রতি মুহূর্তে ভাবছিলাম, এই বুঝি তোমার উন্মত্ততা কমবে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই তুমি নিষ্ঠুরতর হয়ে উঠেছিলে। আমার শরীর যে সাড়া দিচ্ছে না, হায়, এটাও তুমি টের পেলে না। আমি তোমাকে ভয় পেতে শুরু করেছিলাম। এ তুমি কোন শামিম? বারবার আমার মনে এই প্রশ্ন ভেসে উঠছিল। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। তোমার বিবেচনা বোধ ফিরে আসবে, আমি তারই প্রতীক্ষায় ছিলাম। সন্ধ্যার রঙিন স্বপ্ন রাত না পোয়াতেই বিভীষিকা হয়ে উঠল। দাম্পত্যের কি এই পরিণতি? নারীত্বের কি পুরুষের পদতলে নিষ্ঠুরভাবে পিষ্ট হওয়াই নিয়তি? এই কি বিবাহ? ওরা আমার ডায়েরি পড়ে আর কতটুকু জেনেছে? ‘ক্রুশ ছুঁয়ে বাপতিজম করলে যেমন নবজন্ম হয়, তেমনি যেন পুনর্জন্ম হল’, এই কথাটার মানে ওরা বুঝতে পারেনি। নবজন্ম আমার হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সে তো ক্রুশে প্রাণ দেবার জন্যই।

১০ অক্টোবর ১৯৪৫

‘কি হবে আর সকলের মতো প্রেম বিবাহ সংসার সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকে—সে কি কোনও বাঁচা হল? এই যে মানুষ এমন নানা ভাবে রিপুর সেবা করে, কামকে নিয়ে সাধনা করে—কি তাতে লাভ? আমার ঘৃণা হয়, ঘৃণা হয় ভাবতে যে আমিও অমন একটা জীবনে বাঁচতে চাই—কিন্তু তোমরা কেউ বোঝো না পুরুষ জাতটা ও ছাড়া নারীর কাছে কিছু চায় না—কিন্তু আমি সম্পূর্ণভাবে আমার মতো বাঁচতে চাই—আর কারো ইচ্ছায় নয়/ আর কারো মতে নয়—আমি ভালবাসি—সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে ভালবাসি—কিন্তু তার জন্য পুতুল খেলায় আমার শখ যায় না—ভালবাসা আমার কাছে অনেক দামি জিনিস—অত সহজে ব্যবহারের জন্য নয়।’

হ্যাঁ শামিম, অমিতা বলল, সেই এক রাতের অভিজ্ঞতা ফুলকিকে এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছিল। তারপর থেকেই ফুলকি তোমাকে নিয়ে বেশ বিপদে পড়ে গিয়েছিল। একদিকে তোমার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ তার সমস্ত প্রতিরোধকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল, আরেক দিকে তার অবচেতন মন তোমাকে ভয় করতে শুরু করেছিল। তার এই দ্বিধা ফুলকির মনকে নাস্তানাবুদ করে তুলছিল। সে তোমাকে দিনের শামিম আর রাতের শামিমে স্পষ্টত ভাগ করে ফেলেছিল। দিনের তোমাকে সে আগের মতোই গভীর ভাবে ভালবাসত, রাতের তোমকে সে কেবলই এড়িয়ে চলছিল। তুমি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলে, এটা ফুলকি বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছিল। কিন্তু সে কি করবে তা বুঝতে পারছিল না। বাবা দিল্লি থেকে ফিরে আসার পর আবার তোমাদের বৈঠক যথারীতি বসতে শুরু করেছিল। আলোচনার বিষয় খুবই উত্তেজক। আজাদ হিন্দ ফৌজীদের বিচার। ফুলকি প্রথমে ভেবেছিল, সে বোধহয় শামিমের সামনে সহজ হতে পারবে না। কিন্তু শামিমের সহজ ব্যবহার তাকেও সহজ করে তুলল। এই সেই শামিম! কোমল, সংযত এবং বিবেচক শামিম। তার প্রেমিক, তার ভালবাসা। বাবা বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ রয়্যাল আর্মির জন্য কোর্ট মার্শালের যে আইন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য কোর্ট মার্শালের জন্য সেই একই আইন। আরসে আইন বড়ই কড়া। কাজেই আইনের পথে এগিয়ে আমরা যে খুব সুবিধা করতে পারব, সেটা মনে হয় না।’

হরিকিশোরমেসো জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি চার্জ এদের বিরুদ্ধে হয়েছে?

‘প্রথম চার্জ, সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, এরা ট্রেটর এবং দ্বিতীয় চার্জ ওয়ার ক্রাইম।’

‘ওয়ার ক্রাইম মানে?’ শামিম জিজ্ঞাসা করল।

‘ওদের হেফাজতে যেসব যুদ্ধবন্দি ছিল, তাদের উপর অভিযুক্তরা শারীরিক বা মানসিক উৎপীড়ন করেছে কি না? যদি করে থাকে এটা প্রমাণিত হয়, তবে এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যুদ্ধ অপরাধী বলেই সাব্যস্ত হবে এবং তার যা সাজা সেই সাজা ওদের পেতে হবে। সরকারি কৌঁসুলি স্যর নওশিরওয়ান ইনজিনিয়ার আজাদ হিন্দ সরকারকে স্বীকার করেননি। তিনি চাইছেন আজাদ হিন্দ ফৌজকে একদল ট্রেটর হিসাবে প্রতিপন্ন করতে।’

তায়েবকাকা বললেন, ‘তা তোমাদের ডিফেন্স্ কি ভাবে তোমরা সাজিয়েছ?’

‘স্যার তজবাহাদুর এবং ভুলাভাই দু’জনেই বিশেষত ভুলাই আজাদ হিন্দ সরকারের স্বাধীন অস্তিত্ব মেনে নিয়ে তাকে মূলে রেখেই মামলা সাজিয়েছেন। কিন্তু ব্যাপারটা কি জানো তায়েব, এটা আইনের এমনই সূক্ষ্ম কচকচি যে এটা দিয়ে অভিযুক্তদের কতটা উপকার করা যাবে, সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। ভুলাভাই মনে করেন, একটা স্ট্রং পাবলিক ওপিনিয়ন যদি গড়ে তোলা না যায় তবে শুধু আইনের লড়াই করে ডাল গলানো যাবে না। শরৎবাবু প্যাটেলের সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে কথা বলেছেন। প্যাটেল চান একটা গণ-আন্দোলন আজাদ হিন্দ ফৌজকে নিয়ে গড়ে উঠুক। কংগ্রেস একটা আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রতিরক্ষা কমিটি গড়েছেন। নেহরু হচ্ছেন তার প্রাণপুরুষ। সকলেরই মত দেখলাম নেহরুর নেতৃত্বেই আজাদ হিন্দ আন্দোলন গড়ে উঠুক। এখন এইটেই দেখতে হবে যে, ভারতের হিন্দু মুসলিম- সবাইকে এই আন্দোলন শামিল করা যাবে কি না? যদি যায় তবে এই আন্দোলনের তীব্রতাই ভাইসরয়কে বিপদে ফেলে দেবে। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার নিয়ে ভাইসরয় এমনিতেই অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাঁর ভয় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার নিয়ে খুব একটা হইচই হলে তার প্রভাব ভারতীয় আর্মির উপর বিরূপ ভাবে পড়তে পারে। দিল্লিতে শুনে এলাম যে, ভাইসরয় কম্যান্ডার ইন-চিফ জেনারেল অকিনলেকের সঙ্গে কয়েকবার আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেছেন। এদিকে আমাদের ঘরেই তো ঐক্য নেই তায়েব। তার কি করবে। নেহরু আর শরৎ বোসে তো বিবাদ বেধে গিয়েছে।

১১ অক্টোবর ১৯৪৫

‘বেশ কিছুক্ষণ পাশাপাশি, কাছাকাছি। তবুও দুজনের জন্য দুজনেরই মন খারাপ। কেউ কষ্ট পায় ‘উস অফ লাভ’-এর জন্য, কেউ দুঃখ পায় ভবিষ্যৎ মানসিক একাকিত্বের আশঙ্কায়।’

ফুলকির ডায়েরির এই লেখাটা তুমি যদি পড়তে শামিম, তবে কি বুঝতে তুমি কে জানে? তুমি কি এর তাৎপর্যটা ধরতে শামিম?

১২ অক্টোবর ১৯৪৫

‘বারে বারে সকলেই আমায় সংসারে টেনে আনছে—কেন প্রভু? এইটুকু সামান্যর জন্য পৃথিবীতে বেঁচে আছি আমি! শুধুমাত্র দিনযাপনের প্রাণধারণের গ্লানি বয়ে বেড়াব—মগ্ন থাকব ইন্দ্রিয়চর্চায়? যতই বলুন রবীন্দ্রনাথ, বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়—আমি বিশ্বাস করি না। আমার কাছে জীবনের পরমানন্দ ত্যাগে, ভোগে নয়। আর সংসার! সে আমায় কি দেবে? এইসব ছোট ছোট ক্ষুদ্রতা, তুচ্ছতা—এর মধ্যে আমিও বাঁচি না—কোনও দিন পারবও না বাঁচতে।’

এই সময় ফুলকির জীবনটাতে যেমন একটা সংকট ঘনিয়ে আসছিল, অমিতা ভাবল, তেমনি সংকট দেশের চতুর্দিকেও ঘন হয়ে আসছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারকে কেন্দ্র করে তখন এক উত্তেজনা দেশের ভিতরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। শামিম এই উত্তেজনা জাগাতে তার সমস্ত শক্তি উজাড় করে দিয়েছে। শামিম দিন দিন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠছে, হিংস্র হয়ে পড়ছে কথায় কথায়। এটা মোটেও ভাল লাগছে না ফুলকির। সে যখন শামিমকে হিংসার আশ্রয় নিতে দেখে তার আচারে ব্যবহারে, তখনই শামিমকে তার ভয় করে। শামিম তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। আন্দোলন হোক, কিন্তু আন্দোলন কি সংহত হতে পারে না? ফুলকি রাজনীতিকে এড়িয়ে যায়। কারণ রাজনীতি দিন দিন হিংস্রতার জন্ম দিচ্ছে। তুমি তো একদিন বলেছিলে শামিম, হিংসার ঔরসে যে সন্তানের জন্ম সে কারও কল্যাণ করতে পারে না। বলনি কি শামিম? তবে? তবে তোমার মধ্যে তুমিও সেই ঘৃণাকে কেন প্রশ্রয় দিচ্ছ?

এই নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করতেও ভয় করে শামিম। আসলে ফুলকি প্রথম দিকে যদিও আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বগাথায় মুগ্ধ হয়েছিল, পরে যখন শামিম এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ল, তার মন এই হিংসাত্মক আন্দোলনে কিছুতেই সায় দিতে পারেনি। এই সময়ের শামিমকে দেখলেই তার ‘রাতের শামিমকে মনে পড়ত। কেন এ রকম হচ্ছে শামিম? আমি কি আর তোমাকে তেমন ভালবাসি না, তুমি কি আর আমাকে তেমন ভালবাস না? না না, শামিম। ঠিক তা নয়। আমরা কি ভালবাসা দিয়ে এই পৃথিবীকে জয় করব, এমন স্বপ্ন দেখিনি? আমি তো এখনও সেই স্বপ্নে বিশ্বাসী। কিন্তু তুমি শামিম, তুমিও এখন এই স্বপ্নে বিশ্বাস রাখো তো?

ফুলকি সচকিত হয়ে উঠল। তার বাবাকে নিয়ে ওরা তখন তার ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। একসঙ্গে সবাই কলরব করছেন। কিন্তু ফুলকির মন ততক্ষণে শান্ত হয়ে এসেছে। এবার বাবা জেনে যাবেন। শামিম তুমি কি কল্পনাতেও আনতে পারবে কোন হিংস্রতা, কত ঘৃণা আমি সেদিন প্রতিহত করেছিলাম তোমাতে আমি আত্মস্থ ছিলাম বলে?

জেঠিমণি বললেন, ‘এবার তুমিই বিচার করো ঠাকুরপো। তোমার মেয়ের বেলেল্লেপনায় তোমার দাদার মুখটা যে পুড়ল, আমরা এর পরে এখানে মাথা উঁচু করে থাকব কি করে, কি কালনাগিনীই তোমার ঘরে এসেছিল ঠাকুরপো, জাত ধর্ম সব জড়িয়ে দিল, এর বিহিত তোমাকেই করতে হবে।

বাবা একবার আমার দিকে চেয়ে দেখলেন। মুহূর্তের জন্য ফুলকি তার বাবার বেদনার্ত মুখ দেখতে পেয়েছিল।

বাবা বলেছিলেন, ‘তোমরা কি সারাদিন আমার মেয়ের উপর এই অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে গিয়েছ, বউদি?’

‘সারা শহরের আত্মীয়স্বজন, তোমার দাদার বন্ধুবান্ধবকে নেমন্তন্ন করা হয়ে গিয়েছে, এখন যদি তারা শোনে তোমার মেয়ে মোছম্মানের কাছে জাত খুইয়ে বসে আছে, তারা কি বলবে! বলতে পারো? তোমার দাদা বলেছেন, এ সব আমি জানিনে, সুধাকরের মেয়ে, সুধাকর এসে যা করবার করবে। এখন একটা বিহিত তোমাকে তো করতেই হবে?’

‘ফুলকিকে সারাদিন কিছু খেতে দিয়েছ, না তাও দাওনি।’

‘এই নাও এটা পড়, তা হলেই তোমার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হবে।’

‘ওটা কি?’

‘ডায়েরি, ডায়েরি, তোমার গুণধর মেয়ে তার প্রণয়লীলার কথা এর মধ্যে সবিস্তারে লিখে রেখেছেন।’

বাবা ডায়েরিটা নিয়ে থমথমে গলায় বললেন, ‘ফুলকির ডায়েরি তোমাদের হাতে গেল কি করে? তোমরা সবাই কি জ্ঞানগম্যির মাথা খেয়ে বসে আছো? তোমাদের কি এই ভদ্রতাটাও নেই, এটাও বোঝো না যে, একের ডায়েরি অন্যের পড়তে নেই।’

এতক্ষণে জেঠিমণির হুঁশ হল যে, বাবা তাদের সুরে সুর মেলাচ্ছেন না। বাবা তাঁদের কাজে বিরক্ত হয়েছেন। অমনি তিনি চুপ মেরে গেলেন। তাই দেখাদেখি অন্যেরাও কি করবে ভেবে না পেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।

বাবা রাগ চেপে বললেন, ‘তোমরা আমার মেয়ের পাকা দেখার ব্যবস্থা না করলে এ সব কিছুই ঘটত না। আমার মেয়েকে তোমরা জিজ্ঞাসা করেছিলে? আমাকে জানিয়েছিলে? আমাদের না জানিয়ে এইসব কাণ্ড করবার অধিকার কে তোমাদের দিয়েছে? আবার তোমাদের আহাম্মকির জন্য আমার মেয়েকে তোমরা সারাদিন ধরে নির্যাতন করেছ! তোমাদের আর কি বলব? শোনো, আমরা কাল ভোরেই চলে যাব। পারলে আজ রাত্রেই চলে যেতাম। কিন্তু আমি কোনও নাটক সৃষ্টি করতে চাইনে। এখন তোমরা যাও, আমি মেয়ের কাছে আছি।’

জেঠিমা ভীত হয়ে বললেন, ‘তোমরা না হয় চলে গেলে, কিন্তু আমরা কি করব ঠাকুরপো। সেটা বলে দাও। তোমার দাদা তো শস্যে নিয়েছেন।’

‘তোমরা কি করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। আমি কোনওদিন তোমাদের সাতেপাঁচে থাকিনে। এবারও থাকব না।’

বাবা আমার বাবা। ফুলকি মনে মনে তার বাবাকেই ডাকতে লাগল। আর তার মনে হল সে যেন গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছে। পরদিনই ওরা মধুপুরে চলে এসেছিল।

‘ও গো মা, এই শাড়িটা কি?’

বাবা তুমি কেন আসো না? আমার স্বপ্নে কোনও দিন তোমাকে পাইনে কেন বাবা?

‘হ্যাঁ গো মা, এই শাড়িটার কথাই কি বলছিলে তুমি। দেখো না?’

অমিতা ক্লান্তস্বরে বলে উঠল, হবে হয়ত মন্টুর মা, যেখান থেকে শাড়িটা এনেছো সেখানেই রেখে দাও গিয়ে।

হেমন্ত গান গাইছিল। আহ্ কি গলা তোমার হেমন্ত! ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে, কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।’ অমিতার বোধহয় জ্বর আসছে। সে একবার ভাবল চোখ মেলে দেখে হেমন্তকে। কিন্তু জ্বরের তাড়সে সে চোখ মেলতে পারল না। তুমি কিছু মনে করো না হেমন্ত, আমি এখন উঠতে পারছিনে। ‘কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।’ এ গলাটা তো হেমন্তর নয়। এ তো একটা মেয়ের গলা। কার গলা? হেমন্তর সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান গাইছে। হেমন্তের জন্য নয়, মেয়েটাকে দেখবার জন্যই বুঝি অতি কষ্টে চোখ মেলল। কেউ নেই। ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। অমিতার জল তেষ্টা পাচ্ছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ। অমিতা একবার উঠবার চেষ্টা করল। মাথাটা দুলে গেল তার। হেমন্ত, হেমন্ত, তুমি কোথায়? ‘তবু যে পরাণ মাঝে গোপনে বেদনা বাজে—এবার সেবার কাজে ডেকে লও সন্ধ্যাকালে।’ মন্টুর মা, মন্টুর মা! একটু জল খাওয়াবে আমাকে? হেমন্তকে এক কাপ চা করে দেবে মন্টুর মা। গলা দিয়ে স্বর বেরুতে চাইছে না অমিতার। জিভটা মোটা হয়ে ভারি হয়ে বিশ্রিভাবে লেগে আছে তার টাকরায়। ‘বিশ্ব হতে থাকে দূরে অন্তরের অন্তঃপুরে, চেতনা জড়ায়ে রহে ভাবনার স্বপ্নজালে।’ তবু গানটা ভেসে আসছে? মেয়েটা কোথায় বসে তার সুরে সুর মেলাচ্ছে? অমিতা কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সেই অন্ধকারে। অমিতা কাউকেই দেখতে পাচ্ছে না সেই অন্ধকারে। কিন্তু সে জানে ওরা দুজনেই বসে আছে একান্তে কোথাও। কোথায়! কোথায় তারা? ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে’—হ্যাঁ স্পষ্ট হেমন্তেরই গলা। ‘কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে…’

এই গলা সেই মেয়েটার। অমিতা অতি কষ্টে উঠে পড়ল বিছানায়। অন্ধকার, সুচীভেদ্য অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। লোডশেডিং। সুইচ টিপেও অন্ধকার দূর করা গেল না। কষ্ট হচ্ছে অমিতার।’ খুবই কষ্ট হচ্ছে তার। না, এ শুধু জ্বরের কষ্ট নয়। অমিতা হাতড়ে হাতড়ে বিছানার ধারে এসে পৌঁছুল। জল! জল! জল তাকে খেতেই হবে। শরীরটা কী বেজায় ভারি হয়ে উঠেছে? টানতে পারছে না অমিতা। ভারি শরীরটাকে ঠেলতে ঠেলতে বিছানা থেকে নামতে চেষ্টা করল অমিতা। হঠাৎ সে হুড়মুড় করে পড়ে গেল নিচে। ‘দুঃখ সুখ আপনারই সে বোঝা হয়েছে ভারী, যেন সে সঁপিতে পারি চরম পূজার থালে।’ গানটা খুউব দূরে সরে গেল এখন। হেমন্ত, হেমন্ত তুমিও আমাকে ফেলে চলে গেলে? আমাকে এই দুঃসহ একাকিত্বের মধ্যে ফেলে! এই অন্ধকারে আমাকে একা ফেলে! পারলে তুমি পারলে তুমি হেমন্ত! ‘তোমার আমার এই বিরহের অন্তরালে কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।’ মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল অমিতা। তার হাঁটুতে চোট লেগেছে। সে জন্য নয়। মেয়েটাকে সে চিনতে পেরেছে, সেই কারণে। হেমন্ত যাকে বলত, মিতা, আমার সুদূরের মিতা। মেঝেতে দুহাত ভর দিয়ে উঠবার চেষ্টা করল অমিতা। তাকে উঠতেই হবে। হেমন্ত নিজেই আজ সুদূরের মিতা হয়ে উঠেছে। হেমন্তের মৃত্যুর খবরটাও তো সে সহ্য করেছে। সে তো এখনও বেঁচে আছে। ‘তোমার আমার বিরহের অন্তরালে কত আর সেতু বাঁধি সুরে সুরে তালে তালে।’ হাঃ। অমিতা তার ভারি শরীরটাকে মেঝে থেকে তুলে ফেলল এক সময়। তার মনে হল, অনন্তকাল যেন কেটে গেল এই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টায়।

বসে বসে সে হাঁফাতে লাগল। এবার তাকে জল খেতে হবে। না, তারও আগে তাকে একবার বাথরুমে যেতে হবে। এটা জরুরি। কারণ কাল মন্টুর মা আসবে কি না, কে জানে? মন্টুর মা আবার বিগড়েছে। অমিতার অপরাধ, সে মন্টুর মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, খোকার দুধের বাটিটা কোথায় গেল? বাটিটা ছিল রূপোর। রূপোর বাটি আর রূপোর ঝিনুকটা তার বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খোকা হবার খবর পেয়ে। সমীরেন্দ্রের সঙ্গে বিয়েতে বাবার মত ছিল না। তিনি সমীরেন্দ্রকে পছন্দ করেননি। সমীরেন্দ্রও তার বাবার উপর খুব খাপ্পা ছিল। তিনি বড়লোক। তিনি বুজোঁয়া ছিলেন তার চোখে। অমিতারও আপত্তি ছিল। সে চাইত না, তাদের বস্তিবাড়িতে বাবা কখনও আসেন। রূপোর বাটিটা ছিল সমীরেন্দ্রের চক্ষুশূল। কতদিন যখন তার সিগারেটের টাকা ফুরিয়েছে, তখনই তার নজর পড়ত বাবার দেওয়া রূপোর বাটির উপর, অমনি সমীরেন্দ্র তাকে খোঁটা দিত, ‘কেন, টাকা নেই বলছ, রূপোর ঝিনুক বাটিটা আছে কি করতে’? ওইটাই আজ ঝেড়ে দাও না। বেশ কয়েক প্যাকেট ভাল সিগারেট আনানো যাবে।’ কখনও বলত সমীরেন্দ্র, ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন, কি বল ফুলকি! প্লোরিতারিয়েতের ছেলে রূপোর ঝিনুক বাটিতে দুধ খাচ্ছে, এ কখনও শুনেছ? আসলে তোমার বাবার এটা বড়লোকি চালই শুধু নয়, এটা আমাকে অপমান করার একটা ছুতো।’ অমিতার রাগ হত, এ কথায়। অমিতা দুঃখ পেত, এ কথায়। কিন্তু সমীরেন্দ্র, যে কুটোটি নাড়ত না, বউয়ের পয়সায় বসে বসে খেত, আর উঠতে বসতে খোঁটা দিত, অমিতা যে মনে বড় কষ্ট পায় সেটা জানত সমীরেন্দ্র। ভাল করেই জানত। অমিতাকে কষ্ট দিয়ে যেন সমীরেন্দ্র স্বর্গসুখ লাভ করত। শুধু সমীরেন্দ্র কেন, কত লোকের কবল থেকে খোকার দুধ খাবার রূপোর ঝিনুকবাটি বাঁচিয়ে রেখেছিল অমিতা—অমিতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল।

ঝিনুক বাটিটা কোথায় গেল মন্টুর মা? ওটাকে তো দেখতে পাচ্ছিনে। তুমি কি কোথাও ওটাকে রেখেছো?

‘হ্যাঁ গা মা, আমি কি কোনও জন্মে রূপোর ঝিনুক, বাটি এ বাড়িতে দেখিচি যে, তোমাকে বলব?’

আমি তো তোমাকে কত দিন খোকার ঝিনুকবাটি নাড়া চাড়া করতে দেখেছি।

‘হাঁ গা মা, তোমার মন যখন এত সন্দবাতিকে ভরা, তোমার মন যখন এত নীচে, ত্যাখন তুমি ঝি বাড়িতে রাখো কেন বল দিকিনি। তুমি এর পর থেকে তোমাকে আর তোমার যক্ষির ধন পাহারা দেবার জন্য বাড়িতে পুলিশ পুষে রেখো। তারাই সব সামলে রাখবেখন।’

সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে, সেই ঠাণ্ডা মেঝেয় বসে বসে মন্টুর মাকে লক্ষ্য করে গায়ের ঝাল মেটাতে লাগল। হারামজাদি, চোর বদমাশ। এত করি, এত দিই, তবু তোদের মন ভরে না। একটা অসহায় মানুষ, তাকে দেখেও মায়া দয়া হয় না।

পুলিশের কথাই যখন তুললে মন্টুর মা, তাহলে আমিই তাই করব। পুলিশই ডাকব। তোমার হাতে দড়ি পরাবো। তোমাকে জেলে দেব।

‘ঢোঁড়া সাপের আবার কুলোপনা চক্কর’। তুমি লোক দেখ। আমি আর কাল থেকে আসবনি। এই বলে গেলুম।’

জলটুকুও রেখে যায়নি মন্টুর মা। কি নিষ্ঠুর কি স্বার্থপর তোমরা গো। এই অন্ধকারে কোথায় জল খুঁজবে সে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে! প্রাণপণে উঠতে চেষ্টা করল অমিতা। তার ভারী শরীরের ভার হাঁটুদুটো সইতে পারছে না। সে উঠতে পারছে না। অমিতা এখন এক বৃহদাকার সরীসৃপ। সে তার শরীরটাকে ঘরের মেঝের এদিকে ওদিকে টেনে টেনে হিঁচড়ে হিঁচড়ে নিয়ে চলল। তারপর এক সময় মাথা ঘুরে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সেই কঠিন সিমেন্টের মেঝেয়। বাবা! অস্ফুট আর্তস্বরে বলে উঠল বাবা!

‘কি মা, খুব কষ্ট হচ্ছে? ফুলকি, ফুলকি!’

কেমন ঘোর লাগা চোখদুটো চারিদিকে ঘুরিয়ে আনল ফুলকি। ওর বাবাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না। সে চোখ বুজে ফেলল। আবার সে চাইল। ফুলকির দৃষ্টি খানিকটা স্বচ্ছ হয়ে এল। ফুলকি এবার বাবাকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে। সে আবার চোখ বুজল। আবার চোখ মেলল। এবার বাবাকে বেশ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। গিরিডিতে যে তার কত ধকল গিয়েছে, মধুপুরে এসে বুঝতে পারল ফুলকি।

সুধাকরবাবুর ক্লান্ত মুখে উদ্বেগ থমথম করছে।

‘ফুলকি, জল খাবি মা?’

ফুলকি তখন একেবারে ছোট একটা মেয়ে হয়ে গিয়েছে। মাথা নেড়ে জানাল, হাঁ।

সুধাকরবাবু ফুলকির মুখে যত্ন করে জলের গ্লাস ধরলেন। সে উঠে বসবার চেষ্টা করতেই সুধাকরবাবু বললেন, ‘না না মা। এখন উঠতে হবে না। আমি বরং কাপে করে তোর মুখে একটু একটু করে জল দিই, তুই একটু একটু করে চুমুক দে।’

খানিকটা জল খেয়ে ফুলকি আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকল। সুধাকরবাবু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।

বাবা!

‘কি মা, কিছু বলবি?

ফুলকি চুপ করে শুয়ে রইল।

‘কিছু বলবি মা?’

ফুলকি মাথা নেড়ে জানাল, না। তারপর বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়ল। অন্তত সুধাকর তাই মনে করলেন।

বাবা!

সুধাকরবাবু মেয়ের দিকে চাইতেই ফুলকি বলে উঠল, বাবা তোমার কত কাজ পড়ে আছে কলকাতায়। আমরা কবে কলকাতায় যাব?

‘সে হবেখন। তুই একটু সুস্থ হয়ে উঠলেই আমরা চলে যাব এখান থেকে।’

আমি তোমাকে সেই কথাটাই জানাতে চাই বাবা।

‘এখন কোনও কথা নয় মা। সব কথা কলকাতায় হবে।’

আমি তোমাকে জানাতে চাই বাবা, আমি এখন সুস্থ হয়ে উঠেছি। চল আমরা কলকাতায় ফিরে যাই।

‘বেশ তো যাব। এত তাড়া কি মা? তোর এখানে ভাল লাগছে না?’

ফুলকি সেদিন বাবার কথার জবাব দেয়নি। অমিতা জানে, সে তার ডায়েরিতে এই কথা কটা লিখে রেখেছিল।

১৯ অক্টোবর ১৯৪৫।

‘এতদিন লেখার কোনও উপায় ছিল না—ইচ্ছেও না। এত অসুস্থ হয়ে পড়েছি আমি। এবারে এমন যে হবে, ভাবিনি। যেন সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। নিজের উপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি এত দুর্বল! এবার আমি মৃত্যুকেও চেয়েছি—এমন ভাবে মৃত্যুকে কখনও চাইনি। শুধু বাবার কথাটা ভাবছি। আমার জন্য বাবার এত উদ্বেগ আগে কখনও দেখিনি। কদিন আমার কাছ ছাড়া হননি। সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল। বাবার এই ভালবাসার মূল্য উপেক্ষা করব, আমার এত সাধ্যি নেই। কি ভাবে দিন রাত্তির কাটছে—অসম্ভব ভাবা। মাথাটা অস্থির সমস্ত দিন। আর ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে সর্বক্ষণ আটকে রাখার ভ্রান্ত প্রচেষ্টা—যেটা কখনও করিনি।’

সত্যি বলতে কি, মধুপুরে ফুলকির মন একদম টিকছিল না। তাই বাবাকে কলকাতায় যাবার কথা বলেছিল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, সেটা ছিল কথার কথা। ফুলকি কোথাও যাবার কথাই ভাবতে পারছিল না। তার মনটা হয়ে পড়েছিল নিস্তরঙ্গ একটা ডোবার মতো। আবেগের কি ইচ্ছার কোনও ঢেউই খেলত না সেখানে। প্রচণ্ড এক আকস্মিক আঘাতে ফুলকির মনটা একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিল। বাবাও ভয় পেয়েছিলেন খুব। উনি অবশ্য মুখে কিছুই প্রকাশ করতে চাইতেন না। কিন্তু বাবার চোখ মুখ তার মনের উদ্বেগকে প্রকাশ করে দিত। এই লোকটাকে কোনওভাবেই কষ্ট দিতে চায় না ফুলকি। তাই সে বাবার জন্যই কাতর হয়ে উঠেছিল। এখানে এসে বাবার শরীর কিছু সারেনি। তার উপর ফুলকিকে নিয়ে চিন্তায় বাবা তো আরও কাহিল হয়ে পড়তে লাগলেন।

২১ অক্টোবর ১৯৪৫।

‘আবার একটা বিশ্রী দিন! প্রভু, এত ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে কেন আমার মনে? কেন এত ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম—কেন এত মরতে ইচ্ছে হচ্ছে? মানুষকে কত নীচে নামাবে? না আমি মরতে পারব না বাবার কথা ভেবে। আর একজনকে মারার অধিকার আমার নেই, ইচ্ছেও নেই। আমাকে পথ দেখাও ঈশ্বর! গিভ মি এ ওয়ে!

মধুপুরে থাকতে আর ভরসা পাচ্ছিল না ফুলকি। সে পালাতে চাইছিল। ফুলকি যে মধুপুর থেকে পালাতে চাইছিল তার কারণ সে ঘৃণার হাত থেকে অব্যাহতি চাইছিল। গিরিডি থেকে যে অসুস্থতা নিয়ে ফিরেছিল, ফুলকি, আজ আমরা জানি, তার নাম নার্ভাস ব্রেক ডাউন। অন্তত অমিতা জানে যে, সেটা নার্ভাস ব্রেক ডাউনই। গিরিডিতে জ্যোঠামণির বাড়িতে অতর্কিতে সপ্তরথী বেষ্টিত হয়ে ফুলকির অবস্থা দাঁড়িয়েছিল অবিকল অভিমন্যুর মতো। সে প্রাণপণে লড়াই করে গিয়েছে। কারও কাছেই হার মানেনি। কিন্তু ওদের ওই বিষধর ছোবলে সে যে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, মধুপুরে এসে বুঝতে পেরেছিল সেটা। তার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। ওরা সমবেত ভাবে ফুলকির মনেও বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিল। মানুষের প্রতি ঘৃণার বিষ। মানুষের প্রতি বিদ্বেয়ের বিষ যে ফুলকিকেও এমন ভাবে আক্রান্ত করবে, ফুলকির মনকে অভিভূত করে তুলবে, ফুলকি কখনও ভাবেনি। যদিও সে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল তাদেরই যারা তাকে এবং শামিমকে, হাঁ শামিম তোমাকেও, হয়ত তোমাকেই, বারবার ছোবল মেরেছিল। সে ছোবল ঘৃণা এবং বিদ্বেষে ভরা শামিম এবং সে বিষ এমনই তীব্র যে, তার সংস্পর্শে এলে ভালবাসা প্রেম স্নেহ শ্রদ্ধা করুণা, এই সব কিছুই মরে যায়। তখনই জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে শামিম, জীবনের কোনও মানে খুঁজে পাওয়া যায় না। তোমার যে মনে ভালবাসার বন্যা বইছিল, সেই মনেই ঘৃণা এবং বিদ্বেষের ক্লেদাক্ত তরঙ্গ ঢেউ তোলার চেষ্টা করে। মনকে অশুচি করে তোলে। হ্যাঁ, অমিতা বলতে চাইল, ফুলকির মনটা অশুচি করে তোলে। হ্যাঁ, অমিতা বলতে চাইল, ফুলকির মনটা অশুচি হয়ে পড়ছিল। সেই ভয়ে সে পালাতে চাইছিল মধুপুর ছেড়ে। কারণ মধুপুরের উপর ও তেমন ভরসা করতে পারছিল না, মধুপুর আবার গিরিডি তো এ পাড়া আর ও পাড়া, ডালিমতলা আর সেবক বৈদ্য স্ট্রিট। তাই মধুপুর থেকেও প্রাণপণে পালাতে চাইছিল ফুলকি। ওর তখন মনের অবস্থা এমনই, যে যখন তখন যা কিছু সে করে ফেলতে পারত।

.

২৩ অক্টোবর ১৯৪৫।

আমার আর উপায় ছিল না। এমন সামান্য জোরও নেই।

নিজের উপর থেকে সমস্ত বিশ্বাস কাল ভয়ঙ্কর একটা সংকল্প

‘ঘুমের ওষুধ আজ খেতেই হল। চলে যাচ্ছে, নিজেকে ধরে রাখি নিয়েছিলাম। যাক, আত্মহত্যার হাত থেকে তো আপাতত বাঁচা গেল। মানুষের অবিবেচনা, অনৈতিকতা, অমানবিকতা, এ সমস্তই তো দেখা হল। আমি সত্যিই খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছি। আমার নিজের অবনতিতেই আমি কষ্ট পাচ্ছি বেশি। এ আমি কোথায় নেমে যাচ্ছি! এত দিশেহারা হয়ে পড়ছি কেন? কেন মনে হচ্ছে, যেটা ছিল আমার বিশ্বাসের জায়গা, যার জন্য এত লড়ে এসেছি, সেটাও হয়ত নড়ে গিয়েছে? কেন এটা মনে হচ্ছে আমার? যদি তাই হয়, কোথাও বিশ্বাস না থাকে, কোথাও ভালবাসা না থাকে, কাউকে বোঝার মতো মন যদি কারোর না থাকে, তবে কেবলই অন্ধকার থাকে। অন্ধকার আর বিভ্রান্তি, বিভ্রান্তি আর হতাশা, হতাশা আর ঘুমের বড়ি, ঘুমের বড়ি আর ঘুম, শেষে চিরনিদ্রা? ভাল লাগছে না কিছুই, কোথায় যেন তলিয়ে যাচ্ছি। বড় কষ্ট বড় কষ্ট.! মাই লর্ড মাই লর্ড! হোয়াই হ্যাখ্ দাউ ফরসেকেন মি?

যখন মনে ঘৃণা জেগে ওঠে তখনই জাগতে থাকে কুণ্ডলীকৃত অন্ধকার। কোথায় এই অন্ধকারের শুরু আর কোথায় যে শেষ, সেটা খুঁজে পায় না অমিতা।

অমিতা : আমি কি কোনও দিন এই অন্ধকার পার হতে পারব?

সেই শীতল মেঝেয় বুকে হাঁটতে হাঁটতে শ্রান্ত ক্লান্ত অমিতা, যখন তার হাউ কোট ভিজে সপসপ করছে নিজেরই পেচ্ছাবে, নিজেকে এই প্রশ্নই করল।

ফুলকি : আমি কি আমার ভালবাসায় আর সেরে যেতে পারব?

ফুলকি একাধিক ঘুমের বড়ি খেয়ে যখন কেমন এক ধরনের কষ্ট পাচ্ছে শরীরে, তখন নিজেকে দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে এই প্রশ্নটা করেছিল।

অমিতা : আমাকে এ অন্ধকার পার হতে হবে।

ফুলকি : ফিরতেই হবে আমাকে আমার ভালবাসায়। নইলে তো আত্মসমর্পণ করতে হবে ঘৃণার কাছে, বিদ্বেষের কাছে, হিংসার কাছে, সে যে পরাভব। ঈশ্বর, আমাকে কি হারতেই হবে?

‘আমি পর্বতগণের দিকে চক্ষু তুলিব
কোথা হইতে আমার সাহায্য আসিবে
সদাপ্রভু হইতে আমার সাহায্য আইসে
তিনি আকাশ ও পৃথিবীর নির্মাণ কর্তা’

অমিতা মেঝেয় মুখ থুবড়ে যেন পৃথিবীকে চুম্বন করছে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠল, লেট ইট্‌ বি। তবে তাহাই হউক।’ আমিন। অমিতা সেই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেল তাদের ‘সেকরেড হার্ট কনভেন্ট স্কুলের ক্লাস ঘরটা। ওরা সবাই দাঁড়িয়ে আছে সার বেঁধে। আর সিস্টার সুপিরিয়র ডেলিশিয়া, ওরা সমস্বরে আমিন বলার পরক্ষণেই অমিতাকে বুকের কাছে টেনে এনে অমিতার কালিমাখা মুখটা পরমযত্নে মুছিয়ে দিচ্ছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *