প্রতিবেশী – ২.৪৫

৪৫

সকাল থেকেই অমিতার যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। যন্ত্রণা ধীরে ধীরে তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। সে বুঝতে পারছিল না কোথা থেকে এই যন্ত্রণাটা উঠছে। অমিতা প্রাণপণ চেষ্টা করছিল, এই যন্ত্রণার উৎসটাকে খুঁজে বের করতে। এটা কি তার বুক থেকে ঠেলে উঠছে? পিঠ থেকে উঠছে? তলপেট থেকে উঠে আসছে? না কি তার মন থেকে উপছে পড়ছে? অমিতা জানে যন্ত্রণা যখন গভীর থেকে উঠে আসে আর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে তখন তার উৎসের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়। এটা কি তার ক্যান্সারের যন্ত্রণা, না তার কোলাইটিসের? কিছুই বুঝতে পারে না সে। তীব্রতা যতই বাড়ে অমিতা ততই তার কাছে আত্মসমর্পণ করে। একেবারে আত্মসমর্পণ করে, তাও না। সে তো লড়াই করছেই। না, এটাকে আত্মসমর্পণ বলে না অমিতা। সে লড়াই করতে করতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ে।

সেই যন্ত্রণার মধ্যে সে অনুভব করল রিনির মুখটা একটু একটু করে জেগে উঠছে তার স্মৃতিতে। প্রথমে আবছাই ছিল ছবিটা। একটু একটু করে রিনির মুখটা পরিষ্কার হতে লাগল। আর তখনই অমিতা আশ্চর্য হল। রিনির মুখ উল্টো হয়ে আছে। যেন রিনির ফটোগ্রাফটা উল্টো করে ধরে আছে অমিতা। রিনির চিবুক, তার ঠোঁট, তার নাক চোখ, পুরু কাঁচের চশমা, তারপর তার ছোট কপাল আর সব শেষে তার চুল অমিতার চোখে ভেসে উঠল।

‘আমি দেখতে কি খুবই আগ্‌লি, অমিতা?’

রিনির শান্ত কণ্ঠস্বর অমিতার কানে ভেসে উঠল। রিনির স্বরে কি একটা সুর বেজে উঠল যা এর আগে শোনেনি অমিতা।

‘আমি কি খুবই আগলি অমিতা বল না?’

রিনির কণ্ঠস্বরে কেমন একটা ব্যগ্রতা। হ্যাঁ, অমিতা ভাবল, এটা নতুন বটে।

রিনি রিনি, তুমি কেন এটা ভাবছ?

‘আমি এই প্রশ্নের সোজা উত্তর তোমার কাছ থেকে পেতে চাই অমিতা। তুমি আমার বন্ধু, তুমি অনেস্‌ট্‌লি কি মনে করো আমাকে?’

রিনি, তোমাকে আমার কোনও দিনও আগলি মনে হয়নি।

‘মনে হয়নি তো।’

অমিতা দেখল, অমনি রিনির ছবিটা সোজা হয়ে গেল।

রিনি হেসে উঠে বলল, ‘সিলি। ফরগেট ইট।

রিনির বেশি পাওয়ারের চশমা, অমিতা দেখল বইয়ের পাতাতেই ঝুঁকে আছে। অমিতাও পড়ার দিকে মন দিল। সে রিনির নোটগুলো টুকে নিচ্ছিল। খেয়াল করেনি যে, রিনির চশমার পুরু পরকলা তারই মুখের উপর কখন থেকে আবার স্থির হয়ে আছে।

তুমি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিলে না?’ রিনির স্বর এখন তার স্বভাবের মতোই শান্ত।

হ্যাঁ রিনি, তুমি আমাকে একটু অবাক করে দিয়েছিলে। তুমি তো তোমার পারসন্যাল কথা বল না।

‘তুমি খুব অ্যাট্রাকটিভ অমিতা। সেই জন্য তোমার অত বন্ধু।’

কিন্তু তুমি তো জান রিনি, আমি এখন কত একা। তোমাকে না পেলে আমি হয়ত পাগল হয়েই যেতাম। কিংবা সুইসাইড করতাম।

‘শামিমের জন্য!’

শামিমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ক্রমেই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে রিনি। আমি জানিনে এর পরিণতি কী হবে?

রিনি আবার তার মধ্যেই ফিরে গেল যেন। রিনির মধ্যে কি কোনও সুইচ ছিল? ইচ্ছে করলেই যেটাকে সে অন্ অফ্ করে রাখতে পারত। সুইচটা অন্ করলে তবেই রিনির মনে উষ্ণতার সঞ্চার হত। আর তখনই রিনিকে তার কাছের লোক বলে মনে হত। আর রিনি যখন সেই সুইচটা অফ্‌ করে রাখত, বেশিরভাগ সময়েই সেটা অফ্ করাই থাকত, তখনই রিনি একেবারে দূরের এক অপরিচিত মানুষ হয়ে পড়ত। তখন রিনির নাগাল পাওয়া যেত না। সে যেন তখন একটা বর্মের মধ্যে আশ্রয় নিত। ক্লাসের রিনি ছিল এই রিনি। রিনির বাসাটায় এখন মাঝে মাঝে এসে থাকে অমিতা। রিনি তার বাসার নাম দিয়েছিল ‘নেস্ট’। পাখির বাসা।

‘ভালবাসা একটা না একটা কমপ্লিকেশন সৃষ্টি করবেই অমিতা। তুমি এটাকে অ্যাভয়েড করতে পারবে না।’

অমিতা রিনির কথা শুনে অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

রিনি অমিতার দিকে চেয়ে রইল। পুরু লেন্সের ওপারে রিনির চোখ দুটোকে কি বিষণ্ণ লাগছে অমিতার!

‘জটিলতা অ্যাভয়েড করা যায় না অমিতা। আমি জানি।

হঠাৎ অমিতা রিনিকে জিজ্ঞাসা করে বসল, তোমার জীবনেও কি এই জটিলতা দেখা দিয়েছে রিনি?

রিনি অমিতার কথার জবাব দিল না। সে এক মনে অমিতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। অমিতার কিন্তু মনে হচ্ছিল না, রিনি তাকে দেখছে। রিনির সে দৃষ্টি যে শূন্য সেটা টের পেয়েছিল।

‘জানো অমিতা, কাল বাবার চিঠি এসেছে। খুবই বড় চিঠি। কত খবর যে লিখেছেন বাবা। বাবা আমাকে এই ধরনের চিঠি লেখেন জওহরলাল নেহরুর স্টাইলে। তাঁর লেটারস টু ডটার বাবাকে খুব ইমপ্রেস করেছিল। তুমি পড়েছ অমিতা?’

পড়েছি বইকি রিনি। আমার নিজেরও ভাল লাগে সেই চিঠিগুলো।

‘আমার বাবার সঙ্গে নেহরুর এইখানে খুব মিল পাই। আমার বাবা চান, আমি সব কিছু জানি।’ রিনি থামল।

‘জানো অমিতা, এই চিঠিতে বাবা আমাকে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব সম্পর্কে এক বিস্তৃত খবর দিয়েছেন। দীর্ঘ চিঠি। অন্যে দেখলে মনে করবে বুঝি বাবা তাঁর কোনও উপরওয়ালাকে ব্রিফ করার জন্য এই রিপোর্ট লিখেছেন। বেচারি বাবা!

রিনির মুখে বেচারি বাবা কথাটা অমিতার মনে ধক করে একটা ঘা দিল।

‘এত বড় একটা চিঠি, কিন্তু তার মধ্যে আমাদের ফ্যামিলি সম্পর্কে একটা কথাও নেই।’

রিনির কথার মধ্যে অমিতা বেদনার আভাস পেল।

‘তোমাকে শোনাব চিঠিটা। দেখবে, পলিটিক্স সম্পর্কে বাবার কেমন জ্ঞান। আজ রাত্রে তুমি থাকবে তো অমিতা?’

থাকব, এ কথা বলে আসিনি। বলে এসেছি আমি রিনির ওখানে যাচ্ছি।

রিনি বলল, ‘তোমার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দেব যে, তুমি রাত্রে এখানে থাকছ। আজ তোমাকে অনেক কথা বলব। কেন যে এই ইচ্ছে হচ্ছে জানিনে। জানো, মা আমাকে বলত, আলি ডাকলিং। আমি বুঝতাম, সেই ছেলে বয়েস থেকেই বুঝতে পারতাম, মা আমাকে ভালবাসে না। মা দাদাকে ভালবাসে। বাবা একেবারে উল্টো। বাবাও জানতেন, আমি মায়ের ভালবাসা পাইনি, তাই আমাকে দারুণ ভালবাসেন। আলি ডাকলিং! রিনির চোখ দুটো বোধ হয় আরও ভারী হয়ে এল। রিনির পুরু চশমা ভেদ করে ওর মুখের যতটুকু দেখা যাচ্ছিল তাইতেই অমিতার এমন একটা অনুভূতি হচ্ছিল।

রিনি বলেছিল, ‘আমাদের ক্লাসের ছেলেরাও আমাকে একটা নামে ডাকে। তুমি কি জানো অমিতা সেটা কী? ওয়াল্রাস্!

বঙ্কু বঙ্কু! ওই এ সব নাম দিত। হাড় জ্বালানো ছেলে ছিল বঙ্কু! অমিতা তাদের ক্লাসে বঙ্কুকে খুঁজল, পেল না। কফি হাউসে উঁকি দিল। সেখানেও পেল না। বঙ্কুকে পাবে কোথায় অমিতা? বঙ্কু তো কবে মরে গিয়েছে। মনে নেই অমিতা, বঙ্কুর নাবালক ছেলেটা তার মায়ের কাছে বসে বসে পুরুতের নির্দেশমতো পিণ্ডদান করছিল, আর হাউ হাউ করে কাঁদছিল। আর বঙ্কুর বউ চোখের জল মুছতে মুছতে ছেলেকে বলছিল, এখন কাঁদতে নেই বাবা, এখন কাঁদে না, বাবার অমঙ্গল হবে। মনে নেই, তুমি প্রতাপ, পুরনো বন্ধুদের আরও কারা কারা যেন, তোমরা সব বঙ্কুর শ্রাদ্ধবাসরে গিয়েছিলে? মনে নেই?

ওয়াল্‌রাস্। বঙ্কু রিনিকে বলত, ওয়ালরাস্। ও ভাবত, এ এক স্মার্ট রসিকতা। মেয়েরাই বঙ্কুকে এর জন্য বাহবা দিত বেশি।

‘আমি কাল দুটো চিঠি পেয়েছি অমিতা। একটা বাবার। সেটা তো বলেইছি। আর একটা চিঠি পেলাম একজনের কাছ থেকে, যে চিঠি পাব বলে আমি এক্সপেক্ট করিনি। চার বছর পরে তাঁর চিঠি পেলাম।

রিনির চশমার কাঁচ দুটো ঠাঁই চেয়ে আছে অমিতার মুখের দিকে। তার ভিতর দিয়ে রিনির চোখ দুটোকে দেখলে অস্বাভাবিক রকম বড় বলে মনে হয়।

কিন্তু ডাক্তার বলেছেন, একটু কষ্ট হোক। আপাতত এর সঙ্গেই অ্যাডজাস্ট করো।

অমিতা জিজ্ঞাসা করল, রিনি, তোমার চোখের পাওয়ার এখন কত? ‘মাইনাস আট। মনে হচ্ছে পাওয়ার আরও বেড়েছে। যখন নিতান্ত আটকে যাবে তখন পাওয়ার বদলে দেব। আমার চোখে যা হয়েছে ডাক্তাররা বলেন, সেটা গ্যালপিং মাইওপিয়া। চোখের পাওয়ার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আমাকে তো তার সঙ্গেও অ্যাডজাস্ট করে চলতে হচ্ছে অমিতা। কত অভ্ ঘটনা জীবনে ঘটে। সব কিছুকেই তো উড়িয়ে দিতে পারা যায় না। সব কিছুর বিরুদ্ধে ফাইট্ করাও যায় না। কোথাও কোথাও অ্যাডজাস্ট করতেই হয়। জীবনটা এইরকমই অমিতা নয় কি?

রিনি সম্পর্কে অমিতার আড়ষ্টতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। রিনির ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করত না। না। এখন মনে হল, রিনিও তো কাউকে কিছু বলে হাল্কা হতে চায়। রিনিকে সে সুযোগ দেওয়া উচিত।

আগে মনে অনেক ইচ্ছে থাকলেও অমিতা অমিতার মনে হত, রিনি হয়ত পছন্দ করবে

অমিতার মনে হয়েছিল, কেন জানি না, অমিতার সেইদিনই এ কথা মনে হয়েছিল, রিনি কষ্টে আছে। রিনিও তা হলে কষ্ট পায়!

অমিতা বলেছিল, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব রিনি? তুমি কিছু মনে করবে না তো?

‘কেন মনে করব অমিতা? তুমি আমার বন্ধু। মেয়েদের মধ্যে তোমাকেই একমাত্র বন্ধু হিসাবে পেয়েছি। অনেস্ট্। তোমার কথায় কিছু মনে করব কেন?’

অমিতার মনের চাপটা হঠাৎ কমে গেল। সে অনেক সহজ হয়ে উঠল। রিনি রিনি রিনি। আজ কোথায় তুমি রিনি? আবেগের একটা দমকা ঢেউ হঠাৎ অমিতার মনকে আলতোভাবে দুলিয়ে দিয়ে গেল। সকাল থেকে যে যন্ত্রণা তাকে অস্থির করে তুলছিল, আবেগের ঢেউটা যেন তাকে এক পাশে সরিয়ে দিল। রিনি রিনি আহ্ রিনি!

অমিতা হাল্কাভাবে জিজ্ঞাসা করল, চার বছর পরে যার চিঠি তুমি কাল পেয়েছ রিনি, সেটা কি তোমার বয় ফ্রেন্ডের চিঠি?

অমিতার হাল্কা কথায় রিনির মুখের উপর থেকে এতদিনের ভারী পদাটা যেন এই প্রথম সরে গেল।

রিনির ঠোঁটে এক চিলতে দুষ্টুমিভরা হাসি যেন দেখতে পেল অমিতা। রিনির পুরু চশমার কাঁচ দুটোতে বরাবর যেমন নো এনট্রি সাইন দেওয়া থাকত, অমিতা দেখল, সেটা এখন সরে গিয়েছে। রিনির গলার স্বর থেকেও সেই কৃত্রিম গাম্ভীর্যটা যেন সরে গেল।

‘আমাকে কি ভাব তুমি অমিতা? আল্ট্রাড্ বাই হ্যান্ড? হস্ত দ্বারা অস্পৃষ্ট আছি আমি?’ আন্টাচড বাই হ্যান্ড, কথাটা শুনে অমিতা খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।

‘বাবার বয়সি, না মার বয়সি, কোনও লোককে কি বয় ফ্রেন্ড বলা যায়? যদি বলা যায় তবে হ্যাঁ, উনি নিশ্চয়ই আমার বয় ফ্রেন্ড। উনিই আমার প্রথম ভালবাসা।’

রিনি থেমে গেল। কিছুক্ষণ একেবারে চুপ করে থাকল। রিনির চশমার পুরু কাঁচ দুটোর উপর আলো এসে পড়ায় সে দুটো চকচক করতে লাগল। রিনির চোখ দুটো দেখা যাচ্ছিল না ভাল করে।

‘বাবা ছাড়া এই একটি পুরুষকেই আমি ভালবেসেছি, গভীরভাবে ভাল বেসেছিলাম অমিতা।’

আবার রিনি চুপ করে গেল।

এখন কি সে ভালবাসা নেই রিনি?

‘জটিল প্রশ্ন। ব্যাপারটাও খুব জটিল অমিতা। পরে তোমাকে বলব। ভালবাসা আছে কি নেই, ব্যাপারটা সব না বললে তুমি বুঝতে পারবে না। আপাতত ও ব্যাপারটা থাক। নানা কারণে মনটা আমার ভারী হয়ে আছে। আমি কষ্ট পাচ্ছি বাবার জন্য। বাবা দিল্লি গেলেন, আমি ভেবেছিলাম, বাবা আর মায়ের মধ্যে এবার একটা সমঝোতা বোধহয় হবে। কিন্তু তা আর হল না।’

তোমার বাবা কিছু লিখেছেন?

‘না অমিতা। কিন্তু আমি জানি। বাবার এই চিঠিই তার প্রমাণ। বাবা যখনই লোনলি ফিল করেন, তখনই বড় বড় চিঠি আমাকে লেখেন। চিঠিতে কত কথা থাকে, তোমাকে শোনাচ্ছি অমিতা, দেখবে তাতে কত কথা আছে, কত খুঁটিনাটি, কিন্তু আমাদের পরিবার সম্পর্কে একটা কথাও পারে না। কেমন অদ্ভুত জীবন আমাদের, না?’

‘মাই ডিয়ারেস্ট লিটল মামি, রিনির বাবা লিখেছিলেন। চিঠিটা ছিল ইংরাজিতে। সত্যিই রিনির বাবা সুন্দর চিঠি লিখতে পারেন। কেবিনেট মিশন আসা ইস্তক তাদের বাড়িতে রোজই এই বিষয়ে বৈঠক বসত। কত কথা আলোচনা হত। কত তর্কাতর্কি হত। সে সব ফুলকি শুনত। কেবিনেট মিশন সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা ধারণা ফুলকির মনে সেই সব কথাবার্তা থেকে গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সত্যি বলতে কি, রিনির বাবা যেভাবে রিনিকে সে সম্পর্কে চিঠি লিখেছেন, তাতে কেবিনেট মিশনের বিষয়ে অমিতার ধারণাটা অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেল।

‘আমার আদরের ছোট মামণি, অনেক দিন পরে তোমাকে বড় চিঠি লেখার সুযোগ পেলাম। এ চিঠি যখন তুমি পাবে, আমি জানি, ততদিনে তুমি পরীক্ষার জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছ। আমাদের হাতে এই একটি কাজই আছে। আমরা সব কিছুর জন্য কেবল প্রস্তুত হয়েই থাকতে পারি। যেন সুযোগ এলেই, সুযোগ পেলেই, আমাদের আরব্ধ কাজটুকু সমাধা করে ফেলতে পারি। যারা অপ্রস্তুত থাকে, তারা সুযোগ হারাবেই। জীবনে সুযোগ এত কম আসে যে, সুযোগ হারাবার ঝুঁকি আমরা নিতেই পারি না।

‘একটা লক্ষ্য স্থির করে কাজ করার সদগুণ তোমার মধ্যে আছে, সেটা তোমার ছেলে বয়েস থেকেই আমি দেখেছি। তুমি একবার বন্যার সময়ে আমার বোট থেকে জলে পড়ে গিয়েছিলেন। তোমার মনে পড়ে? অত ছোট বয়সে অমন বিপদে পড়েও তোমার বুদ্ধিকে তুমি স্থির রাখতে পেরেছিলে। তুমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে তোমার ছোট ছোট হাত পা চালিয়ে জলে ভেসে থাকার চেষ্টা করছিলে। দেখে লোকে অবাক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোমার সেই অসম্ভব চেষ্টার ফলেই তোমাকে সেবার তুলে আনা সম্ভব হয়েছিল।

‘মা, আমার মামণি, আমার ছোট্ট মিষ্টি পাখিটি, তোমার সেই কীর্তির কথা যখনই তোমার এই বুড়ো ছেলেটার মনে পড়ে, তখনই তার সব অবসাদ কেটে যায়। সে আবার তাজা হয়ে উঠে তার কাজের জন্য প্রস্তুত হয়। তুমি কি তা জানো?’

‘আমার বাবার ধারণা, আমি একটি দেশি জোয়ান অব্ আর্ক বা ওই জাতীয় কিছু।’

তোমার বাবা তোমাকে খুবই ভালবাসেন রিনি।

তুমিও কিন্তু আমাদের ভালবাসতে বাবা। খুবই ভালবাসতে। যতদিন তুমি ভাবতে, আমরা তোমার সেই ছোট মেয়েই আছি, যতদিন তোমার কথাই আমাদের কথা, যতদিন তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছেই ছিল আমাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে, ততদিন বাবা, তুমি আমাদের কী ভালবাসাই না বেসেছ। কিন্তু যেদিন তোমার কথা আর আমাদের কথায় ভিন্ন সুর বেজে উঠল, যেদিন থেকে তোমার ভাল লাগা আর আমাদের ভাল লাগা, তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছে, পছন্দ অপছন্দ আলাদা হয়ে ‘গেল, সেদিন থেকেই তুমি—বাবা তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ।

অমিতার গলার স্বর গাঢ় হয়ে এল আর বেশ নরম।

শামিম কেন এসেছিল বাবা? কী তোমাকে বলেছিল শামিম? কেন সে বসল না? কেন সে আমার জন্য অপেক্ষা করল না? রিনির বাড়ি থেকে সেদিন আমার ফিরতে দেরি হয়েছিল, এটা ঠিক। কিন্তু এমন কিছু রাতও নয় সেটা। সেটা তো ১৫ই আগস্টের রাত। রিনির বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখি একটা অস্বাভাবিক থমথমে ভাব। প্রথমে খেয়াল করিনি। বাসে উঠে সহযাত্রীদের মুখে নানা কথা শুনে জানলাম, কাল নাকি রায়ট হবে। ডিরেক্ট অ্যাকশন। পাকিস্তানের জন্য মুসলিম লিগ হিন্দুদের বিরুদ্ধে ডিরেক্ট অ্যাকশন শুরু করবে। দাঙ্গা করবে। সেই জন্যই কি শামিম অত তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিল? আমার বিশ্বাস হয়নি বাবা। শামিম মুসলিম লিগে ছিল তো, ওই জন্যই আমার বিশ্বাস হয়নি মুসলিম লিগ হিন্দুদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা করবে। শামিম যখন এসেছিল, তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল, কী কথা হয়েছিল তোমার সঙ্গে? যে কথাটা জিজ্ঞাসা তোমাকে করব ভাবি, কিন্তু ভয় হয়, ভয় লাগে আমার তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে, সেটা এই, শামিমকে তুমি সেই রাতে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দাওনি তো? তুমি শামিমকে আমাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছ, আমি এটা বিশ্বাস করিনে বাবা। তবু প্রশ্নটা মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে। আর উত্তর জানবার জন্য মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। সে যে কি যন্ত্রণা তুমি বুঝবে না।

‘ছোট্ট মামণি, ১৯৪৬ সালটা আমাদের দেশের পক্ষে, আমাদের সকলের পক্ষে একটা ক্রুশিয়াল ইয়ার। আমাদের দেশের, আমাদের সকলের ভাগ্য,, ডেসটিনি, একটা সূক্ষ্ম সুতোয় ঝুলে আছে। কি হবে কেউ বলতে পারে না। তবে কেবিনেট মিশনের যে তিন সদস্য এসেছেন, তাঁরা অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন দু’ পক্ষের গ্রহণযোগ্য একটা পথ বের করতে। এই বয়সেও লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস আর মিঃ আলেকজান্ডার যে পরিশ্রম করছেন, আমার কাছে সেটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, মামণি। এঁদের সিসিয়ারিটি এঁদের অনেস্টি অব পারপাস, জটিল সমস্যার সমাধান বের করার জন্য এঁদের ধৈর্য, এঁদের টেনাসিটি, একজন সিনিয়র বুরোক্র্যাট হিসাবে অনেক কাছ থেকে যা দেখেছি মামণি, তার তুলনা হয় না। আমাদের দেশের নেতারা যদি এঁদের কাছাকাছি ক্যালিবারের হতেন তবে অনেক আগেই আমাদের দুর্দশার লাঘব হত। ৩রা এপ্রিল থেকে কেবিনেটের সদস্যদের সঙ্গে আমাদের নেতাদের নেগোশিয়েশন শুরু হয়। কখনও গ্রুপে, কখনও একা একা, আমাদের নেতারা ক্রমান্বয়ে ভাইসরয় ও কেবিনেট মিশনের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। ১২ই মে পর্যন্ত, যাকে ম্যারাথন আলোচনা বলে, তাই চলেছে। কিছুটা আলোচনা সিমলায়, বেশিরভাগটাই দিল্লিতে হয়েছে। দিল্লিতে যে কি প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তা তোমাকে আর কি বলব। এবার সামার দিল্লিতে আগেই এসে গিয়েছিল। লর্ড পেথিক লরেন্স একদিন গরমে একেবারে এলিয়ে পড়েছিলেন।

‘কিন্তু তবুও ওঁরা ওঁদের দায়িত্ব থেকে সরে যাননি। একে অনভ্যস্ত পরিবেশ, এই দারুণ গরমটাই তো ওঁদের অসুস্থ হয়ে পড়ার পক্ষে যথেষ্ট, তায় প্রায় প্রত্যেক নেতার প্রতিকূলতা, এ সব সত্ত্বেও ওঁরা কাজ করে গিয়েছেন। কী পরিমাণ কর্তব্যবোধ থাকলে এটা করা যায়, আমি সেদিকেই তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই মামণি।

‘আমি জানি, পলিটিক্সে তোমার আগ্রহ কত গভীর। কেবিনেট মিশন এত দিন ধরে আমাদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়েছেন, আর সে সম্পর্কে খবরের কাগজে এত উল্টোপাল্টা খবর বেরিয়েছে যে, পলিটিক্স সম্পর্কে আগ্রহ যাদের আছে, তাদের মনে সব মিলিয়ে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। সেই কারণেই তোমাকে পরম্পরা অনুসারেই ঘটনাগুলো সাজিয়ে দিতে চাই।

‘১৯৪৬ সালের ১৯ই ফেব্রুয়ারি, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ এটলি পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে নিয়মতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতি, প্রকরণ কি হবে, সেই সম্পর্কে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে মতৈক্যে পৌঁছুবার জন্য ব্রিটিশ সরকার তার মন্ত্রিসভার তিন জন সদস্যকে দিল্লিতে পাঠাবেন। যাঁরা আসবেন তাঁদের নামও প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন। ভারত সচিব লর্ড পেথিক্ লরেন্স, বাণিজ্য সচিব স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং নৌসচিব মিঃ এ ভি আলেকজান্ডার। ১৩ই মার্চ মিঃ এট্‌লি হাউস অব কমন্‌সে বললেন, মিশন একটা সদর্থক মনোভাব নিয়েই ভারতে যাচ্ছে। বর্তমানে যে স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট কাজ করার সময় এসেছে, সে সম্পর্কে মিশন সচেতন। ভারত যাতে অবিলম্বে এবং পূর্ণভাবে স্বাধীনতা পায়, সে বিষয়ে মিশন ভারতকে সাহায্য করবে। বর্তমানে ভারতে যে সরকার আছে, তার বদলে কোন্ ধরনের সরকার ভারতে হবে, সেটা ভারতকেই ঠিক করতে হবে। মিঃ এট্‌লি শুধু এইটুকুই আশা করেছিলেন যে, ভারত স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্রিটিশ কমনওয়েলথের মধ্যেই থাকবে। মিঃ এট্‌লি স্পষ্ট করেই হাউস অব কমনসে এ কথা জানিয়েছিলেন, মামণি, ‘আমরা · মাইনরিটির অধিকার সম্পর্কে ভালভাবেই অবহিত আছি, মাইনরিটিকে আমরা বলছি, আপনারা নির্ভয়ে থাকুন। অপর পক্ষে, আমরা এ কথাও জানিয়ে দিতে চাই যে, মেজরিটি এগিয়ে যাবার অধিকারকে মাইনরিটি যেন ভেটো দিয়ে খর্ব করতে চেষ্টা না করেন। আমরা সেটা মেনে নিতে পারি না।

‘এর চাইতে স্পষ্ট ভাষায় আর কি বলা যেতে পারে, আমি তা বুঝতে পারিনে, মামণি। মুসলিম নেতাদের মনের সংশয় তবু যায়নি। তাই ভারত সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স ভারতে পৌঁছেই প্রেস কনফারেন সে বললেন, ‘কংগ্রেস বিপুল সংখ্যক লোকের প্রতিনিধি, এটা যেমন আমরা মেনে নিয়েছি, তেমনি এটাও মেনে নিয়েছি যে, মুসলিম লিগ বিপুল সংখ্যক মুসলমানের প্রতিনিধি।’ তিনি আরও বলেছিলেন যে, এখন তাঁদের কাজ হচ্ছে, দুই পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন একটা মেশিনারি অবিলম্বে তৈরি করে ফেলা যা দিয়ে ভারত একটা সরকার গড়ে তুলতে পারে, যার অধীনে ভারত পূর্ণ স্বাধীনতাকে করায়ত্ত করতে পারবে, এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলো সেরে ফেলতে হবে।

‘এটাই ছিল কেবিনেট মিশনের কাজ মামণি। এই কাজের সঙ্গে বাঁদরের পিঠে ভাগ করার তুলনা যাঁরা করেছেন, তাঁরা দেশের ক্ষতি করেছেন। অন্তত আমি তো তাই ভাবি। এটা ছিল একটা পজিটিভ অ্যাটিচিউড। আমাদের নেতাদের যদি পলিটিক্যাল ম্যাচিউরিটি থাকত, যদি স্টেটসম্যানশিপ থাকত, তাহলে তাঁরা এটাকেই স্টার্টিং পয়েন্ট ধরে নিয়ে নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে পারতেন। দিনের পর দিন কেবিনেট মিশনের সঙ্গে একজন অফিসার হিসাবে থেকে, যে অভিজ্ঞতা আমি সঞ্চয় করেছি, তার ভিত্তিতেই বলতে পারি, মামণি, আমাদের নেতাদের মধ্যে স্টেটসম্যানশিপ আদপেই ছিল না। ছিটেফোঁটাও না। তারা ডিমাগগিতেই ওস্তাদ ছিলেন। পেটি ব্যাপারে নিজের কোলে ঝোল টানার কাজে যে দক্ষতা তাঁরা দেখিয়েছেন, সেটা যদি তাঁরা দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কোটা নিজের হিস্যা থেকে ছাড়তে হবে, সে ব্যাপারে দেখাতেন, তাহলে কেবিনেট মিশনের কাজে স্টেলমেট্ হত না।

‘কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, কেউ কোনও পজিটিভ বিকল্প দিতে পারছেন না, কেবলই একে অপরকে দোষারোপ করছেন, এ জিনিস তুমি ভাবতে পারো? কিন্তু আমি বলছি, তাই হয়েছে। মিঃ জিন্না প্রথম যখন কেবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে এলেন, তখন তো তাঁর কথাবার্তায় সবাই মুগ্ধ। কি চার্মিং! কি রিজনেবল! বিলাতি শিষ্টাচার এবং আদবকায়দায় মিঃ জিন্না একেবারে সিদ্ধহস্ত। এ ব্যাপারে একমাত্র মিঃ নেহরুই ওঁর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন। মিঃ জিন্নাকে বলা হল, মাইনরিটি মেজরিটি নিয়ে যে জট পাকিয়েছে, সেই জট খোলার জন্য মিঃ জিন্না অনুগ্রহ করে মিঃ গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বসুন এবং দু’জনে ঐকমত্যে আসুন। তাহলেই এই জট খুলবে। মিঃ জিন্না এককথায় রাজি হয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন, এ ব্যাপারে তিনি মিঃ গান্ধীর সঙ্গে আলোচনায় বসবেন। কিন্তু দিনের পর দিন কেটে গেল। মিঃ জিন্নার কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অবশেষে মিঃ ক্রিপস বুঝলেন, মিঃ জিন্নাকে কোনও ব্যাপারে পিন ডাউন করা অসম্ভব। ভাসা ভাসা কিছু ইংরাজি ফ্রেজ ছাড়া তাঁর কাছ থেকে আর আশা করার কিছু নেই। কায়েদে আজমের টেক্‌নিকটা ছিল এই যে, প্রতিপক্ষ আগে তাঁদের হাতের তাস দেখাক, প্রস্তাব তাঁরা দিন, আর মিঃ জিন্না তাঁর অসাধারণ তীক্ষ্ণ বুদ্ধি প্রয়োগ করে সেটাকে কেবল ফুটো করে দেবেন।

‘আমার ধারণা, মামণি, মিঃ গান্ধীও ভাসা ভাসা শব্দের জাল বুনে আসল ইস্যুকে পাশ কাটিয়ে যাবার টেকনিকে সমান সিদ্ধহস্ত ছিলেন। কাজেই জিন্না-গান্ধি আলোচনায় কোনও পজিটিভ ফল প্রসব হত, এটা আমার মনে হয় না। বুরোক্র্যাট হিসাবে আমি বরং মিঃ প্যাটেলের দিকেই এ ব্যাপারে ঝুঁকতে ইচ্ছুক ছিলাম। আমার চোখে মিঃ প্যাটেল অনেক বেশি ডাউন-টু-আর্থ, ওঁর প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি বেশ প্রখর এবং উনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মিঃ নেহরু? না মামণি, আমি জানি, তুমি দুঃখ পাবে, আমি জানি তুমি মিঃ নেহরুর একজন গোঁড়া ভক্ত, তবুও আমি বলছি, কেবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনাকালে আমি ওঁর কথাবার্তা যা শুনেছি, তাতে এই ধারণা আমার হয়েছে, মিঃ নেহরু একজন আইডিয়ালিস্ট, সিনসিয়ার সন্দেহই নেই, কিন্তু উনি মূলত ডিমাগগ এবং একজন পারফেক্ট শো ম্যান। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে যিনি আমাকে ইমপ্রেস করেছেন, তিনি হচ্ছে মৌলানা আজাদ। ওঁর চাইতে ভাল নিগোশিয়েটার আমি আর দেখিনি। ইন ফ্যাক্ট, উনিই একমাত্র নেতা মামণি, যিনি পজিটিভ প্রস্তাব কেবিনেট মিশনের সামনে রাখতে পেরেছেন। এবং কেবিনেট সদস্যদের আস্থা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছেন। মৌলানা আজাদের একটাই ড্র ব্যাক যে, তিনি কংগ্রেসি মুসলমান, কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। এমন লোককে মিঃ জিন্না হয়ত নেগোশিয়েটার হিসাবে চাইবেন না। আর তা যদি হয় তবে সেটা হবে ঘোর দুঃখের কারণ। মিঃ জিন্নার দাবি, মুসলিম লিগ অর্থাৎ মিঃ জিন্নাই মুসলমানদের সোল রিপ্রেজেন্টেটিভ। এ দাবি থেকে তাঁকে নড়ানো যাবে কি না সন্দেহ। আমাদের ডেসটিনি, মামণি, এরই উপর ঝুলে আছে। অনেক অনেক ভালবাসা নিও। আর অনেক অনেক আদর। বাবা।’

৪৬

রিনি বেশ চটপট রান্না করে ফেলল। অমিতার মনে পড়ল, রিনির সঙ্গে যখন তার আলাপ হয়, তখন সে বলেছিল যে, সে কি হতে চায় তা সে জানে, কি তাকে করতে হবে তাও সে জানে। সেইভাবেই সে নিজেকে তৈরি করেছে। এখন রিনির রান্নাবান্না দেখে অমিতার মনে হল, সত্যিই রিনি আশ্চর্য মেয়েই বটে। রিনি এই রাসায় আসার আগে পর্যন্ত রান্নাবান্না জানত না। বাবার বাবুর্চিই তার ভরসা ছিল। কিন্তু এখন অমিতা দেখল, এই কদিনের মধ্যেই রান্নাবান্নায় কি ঘরকন্নায় রিনির বেশ পাকা রকম দখল এসে গেছে।

‘স্ট্রেনজ কোয়েনসিডেনস! কি বলো অমিতা ‘ ছোট্ট টেবিলে খাবার গোছাতে গোছাতে রিনি বলে উঠেছিল।

অমিতা বুঝতে পারেনি, রিনি কি বলতে চাইছে। সে তখন স্যালাড তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রিনির বাবার কথা মনে পড়ছিল তার। রিনি কত কথা বলেছিল সেদিন। তার বাবার কথা। তার মার কথা। তার বাবাতে আর মায়েতে যে বনিবনাও নেই, সে কথা। অথচ সে শুনেছে, রিনি বলেছিল, সে শুনেছে, তার বাবা আর মায়ের মধ্যে গভীর ভালবাসা ছিল এক সময়ে। রিনির বাবা মায়ের লাভ ম্যারেজ হয়েছিল।

ভালবাসা তবে কি ঝরেও যায়! কথাটা মনে হতেই অমিতা চমকে উঠেছিল। না না, শামিম তা হতে দেবে না, অমিতা তা হতে দেবে না।

‘একই দিনে কাল দুটো চিঠি এসেছে, অমিতা। একটা হয়ত আমি একসপেকট করছিলাম। কিন্তু বাবার চিঠি এল আর সেই সঙ্গে আরও একটা চিঠি এল, যে চিঠি আমি আশাই করিনি। হাউ স্ট্রেনজ!’

রিনির বিষণ্ণ চোখ চশমার পুরু কাঁচ দুটোর ভিতর দিয়ে অমিতার মুখের উপর স্থির হয়ে সেঁটে রইল।

‘শামিম তোমার প্রথম ভালবাসা, না অমিতা?’ রিনি খুব নরম গলায় এ প্রশ্নটা করল।

সেও আস্তে, খুবই আস্তে রিনিকে বলল, প্রথম ভালবাসা! প্রথম ভালবাসা মানে কি প্ৰথম জেগে ওঠা, রিনি?

রিনি বলল, ‘প্রথম জেগে ওঠা?’

রিনি চুপ করে গেল।

‘ঠিক বলেছ অমিতা, সেটা প্রথম জেগে ওঠাই বটে।’

রিনির চশমা দুটো অমিতার মুখের উপর আবার অনেকক্ষণ স্থির হয়ে চেয়ে থাকল।

‘আবার সেটা প্রথম যন্ত্রণাও বটে। ভালবাসা এত জটিল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, হয়তো যন্ত্রণাই দেয় অমিতা।’

খাবার ছোট্ট টেবিলে অমিতা আর রিনি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে, এই দৃশ্যটা অমিতার চোখে একবার ভেসে উঠল।

রিনি কেমন উদাসভাবে বলল, ‘ভালবাসা! জানো অমিতা, আমার বাবা এবং মা-ও বিয়ে করেছিলেন ভালবেসে। ভাবতে পারা যায়! কিন্তু এটাই তো ঘটেছিল তাঁদের জীবনে। বাবা তামিল, আমার মা বাঙালি। ওঁরা দুজনেই বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ দিল্লিতে। দুজনেই সিভিলিয়ান পরিবারের ছেলে মেয়ে। শিক্ষিত। কালচারড। সফিস্টিকেটেড। ভালবাসা! কোথায় গেল সে ভালবাসা এখন? আমি জন্মে ইস্তক দেখছি অমিতা আমাদের দিল্লির বাড়িটা কবরখানার মতোই শান্ত এবং শীতল। বাবাকে মাকে কোনদিন ঝগড়া করতে শুনিনি। কিন্তু দুজনের মধ্যে কোনও যোগাযোগই ছিল না। অথচ বাবা যখন কলকাতায় ছিলেন, তখন দেখেছি বাবার মধ্যে কী ওয়ামর্থ। আমার তেরো বছর বয়েস থেকে আর সতেরো বছর পর্যন্ত আমাকে মা আর দাদার সঙ্গে দিল্লির বাড়িতে থাকতে হয়েছে। বাবা তখন বেঙ্গল ক্যাডারে। মাঝে মাঝে দিল্লিতে আসতেন। ছুটিতে। তখনই আমি আমার সঙ্গী পেতাম। বাবার সঙ্গেই আমার সময় কাটত। বাবা চলে গেলেই একেবারে লোলি হয়ে পড়তাম। আমি কারও সঙ্গে মিশতেও পারতাম না। ক্লাসেও আমার বন্ধু ছিল না কেউ। মা বলতেন, আগুলি ডাকলিং। কথাটা আমার মনের খুব গভীরে ঢুকে গিয়েছিল, অমিতা। আমার ক্লাসের সুন্দরী মেয়েরা তাদের রূপ সম্পর্কে এতটাই কনশাস ছিল যে, তারা সব সময় সেটা ডিসপ্লে করত। আমাদের স্কুলে এক ধরনের বিউটি কনটেস্ট হত। আমার যে কী খারাপ লাগত! আমার সেই স্কুলটা ছিল যেন সিভিলিয়ানদের ঘরে বউ সাপ্লাই দেবার এজেনসি। আমি রেজাল্ট ভাল করে, প্রতি ক্লাসে ফার্স্ট হয়ে ওদের উপর প্রতিশোধ নিতাম।’

এ যেন অন্য রিনির গল্প শুনছে অমিতা। এ যেন একেবারেই অন্য একটা মেয়ে।

ওদের তখন খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছে। তবু কিচেনের সেই ছোট্ট টেবিলটায় বসে আছে ওরা। কারোরই ওঠবার নাম নেই।

‘আচ্ছা অমিতা, যাদের রূপ থাকে সেই মেয়েরা এ কথা মনে করে কেন যে, একমাত্র তারাই টপ অব দি ওয়ার্লডে আছে?’

অমিতা বলেছিল, তুমি যখন আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছ, তখন আমি কি এটাই ধরে নেব রিনি, তুমি আমাকেও বিউটি কুইনদের মধ্যে ফেলছ। না, রিনি, বিউটি কুইনদের দলে পড়তে পারি আমার সে রকম কিছু ঐশ্বর্য নেই। সে যোগ্যতা বরং আমার দিদির ছিল। আমার দিদির কাছে তোমাকে নিয়ে যাব। সে খুবই সুন্দর দেখতে রিনি। কিন্তু সে রিবেল।

‘তুমি যতই অস্বীকার করো অমিতা, তুমি সত্যিই সুন্দর। তবে তোমার কোনও অহংকার নেই। এটাই আমাকে অবাক করেছে। তোমার এই ইনোসেনট মুখটা তোমার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে জানো? আমাকে তোমার কাছে টেনে এনেছে।’

জেনে খুশি হলাম রিনি। তোমার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের কথা। একটা কথা বলি রিনি। তুমি নিজেকে সুন্দর ভাব না। সুন্দর তুমি কাকে বলো রিনি? তুমি কি জানো, তোমার মধ্যে এমন একটা জিনিস আছে, যা মেয়েদের মধ্যে পাওয়াই যায় না!

‘কি আছে আমার মধ্যে অমিতা? আমার মধ্যে তুমি কি দেখতে পেয়েছ?’ রিনি কথা বলছে এখন একটা ছোট্ট মেয়ের মতো। সব মেয়ের মধ্যেই তাহলে একটা করে ছোট্ট মেয়ে লুকিয়ে থাকে! শুধুই তার একার মধ্যে নয়? অমিতা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখল, রিনি তখন মুখের দিকে আগ্রহভরে চেয়ে আছে অমিতার জবাবটা শোনার জন্য। কত দিন হয়ে গেল রিনি, এখনও তুমি বসে আছ তোমার রান্নাঘরে? সত্যি তুমি অদ্ভুত মেয়ে।

‘কি আছে আমার মধ্যে অমিতা? আমার মধ্যে তুমি কি দেখতে পেয়েছ?

অমিতার মনের ভেতর থেকে রিনির গলার স্বর ফিসফিস করে বেজে উঠল। কিছুটা কিন্তু-কিন্তু করে রিনি বলল, ‘আমাকে বলবে অমিতা? বলবে?’

তোমার মধ্যে আশ্চর্য একটা দীপ্তি আছে রিনি। সেটা বুদ্ধির দীপ্তি, সেটা আসে ব্যক্তিত্ব থেকে রিনি। তোমার ব্যক্তিত্ব আছে রিনি। আর সেটাই তোমার প্রধান আকর্ষণ।

‘ওওওও, রিয়েলি অমিতা! তুমিও সত্যিই এটা ভাব? তুমিও!

রিনি বিস্ময়ে ফেটে পড়ল। রিনি যেন কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। রিনি যেন কিছু একটা মনে করবার চেষ্টা করছে।

অমিতা বলেছিল, রিনি, আমি সত্যিই বলছি রিনি, তোমার ব্যক্তিত্বই তোমার বিউটি রিনি।

রিনির চোখে এই প্রথম জল দেখল অমিতা। ওরা তখন রিনির শোবার ঘরে।

‘তাহলে এটা সত্যি অমিতা?’

অমিতা বলেছিল, হ্যাঁ রিনি। কথাটা সত্যি।

‘তাহলে কেউ যদি আমাকে এমন কথা বলে থাকে, তবে সেটাকে ফ্ল্যাটারি ভাবব না, সত্যি কথা বলেই ধরে নেব?’

অমিতা এতক্ষণে বুঝল, রিনি তার নিজের সঙ্গেই কথা বলছে। অমিতা চুপ করে তাকে দেখতে লাগল।

রিনি এবার অমিতার দিকে একবার তাকাল। তারপর উঠে গিয়ে অমিতাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ‘ওও অমিতা! অমিতা! অমিতা! এ কথা আমি একজন পুরুষের মুখে প্রথম শুনি।’

রিনির মধ্যে যে সুপ্ত আবেগটা ছিল, সেটা যে এমন প্রচণ্ডভাবে জেগে উঠতে পারে, সেটা ভাবতে পারেনি অমিতা। অনেকক্ষণ লাগল রিনির শান্ত হতে। তারপর রিনি আবার তার স্বভাবে ফিরে এল। যে রিনিকে অমিতা চেনে এ আবার সেই রিনি। শান্ত সমাহিত বিষাদময়ী।

রিনি শান্ত হল। কিন্তু অমিতার শরীরে তোলপাড় শুরু হল। যখন রিনি প্রবল আবেগে অমিতাকে তার বুকে জড়িয়ে ধরেছিল, আলোড়নটা যে তখন থেকেই শুরু হচ্ছিল, অমিতা সেটা টের পেয়েছিল। কতদিন পরে একটা রক্ত মাংসের শরীর অমিতার শরীরে আশ্রয় নিল। আহ্ রিনি! আহ্ রিনি! আহ্ শামিম! রিনি যখন তার শরীরটাকে অমিতার শরীরের থেকে সরিয়ে নিল, তখন অমিতা কাতরভাবে মনে মনে তাকে মিনতি করে যাচ্ছিল, সরে যেও না সরে যেও না রিনি। না না না। অমিতা তো শরীরের স্বাদ ভুলেই ছিল। রিনির সাহচর্যে আসার পর থেকে সে পড়াশুনায় মন ঢেলে দিয়েছিল। পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল সে। অমিতা যখন শামিমের অদর্শনে অস্থির হয়ে একটা লক্ষ্যহীন আবর্তে প্রচণ্ডভাবে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কি যন্ত্রণা কি যন্ত্রণা! তখন রিনিই তাকে সেই আবর্ত থেকে তুলে আনতে সাহায্য করেছিল। হায় শরীর, তুমি কি ভুলে থাকতে জানো না!

অমিতা মনে মনে আর্তনাদ করতে থাকল। ঈশ্বর, ঈশ্বর, তুমি কি আমাকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পার না! রিনি রিনি, তুমি আমাকে সাহায্য করো, প্লিজ। আমি আর শামিমের কথা ভাবব না। আর শামিমের আমি কামনা করব না। অন্যায় হবে রিনি, সেটা অন্যায় হবে। রেশমার জন্য আমাকে শামিমকে ভুলতে হবে রিনি। শামিমের জীবনে রেশমা এসে গিয়েছে। আমাকে সরে যেতে হবে। যে করেই হোক, আমাকেই সরে যেতে হবে। তুমি আমাকে পথ দেখাও রিনি। প্লিজ প্লিজ প্লিজ!

‘প্রেম অমিতা। আমার জীবনের প্রথম প্ৰেম।’

অমিতা রিনির মুখ থেকে কথাটা শুনে চমকে উঠেছিল। সে রিনির দিকে তাকাল। কিন্তু কোথায় রিনি? কোথা থেকে সে এ কথা বলছে? রিনি তো তার সামনেই নেই? না, রিনি তো তার সামনেই বসে আছে। ওই তো রিনি খাটের ধারিতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। কিন্তু তার চোখের চশমার পুরু কাঁচ দুটো এখন আর অমিতাকে দেখছে না। কোন্ দূরে চলে গিয়েছে রিনির চোখের দৃষ্টি। কার দিকে চেয়ে আছে রিনি গভীর বিষাদ ভরা দৃষ্টি ফেলে?

‘তিনিই আমার জীবনে প্রথম পুরুষ অমিতা, যিনি আমাকে একেবারে আলাদা চোখে দেখেছিলেন, তিনি একেবারেই আলাদা জগতের মানুষ অমিতা, যিনি আমাকে একেবারে আলাদা জগতে নিয়ে গিয়েছিলেন।’

রিনি কাকে শোনাচ্ছে এ কথা। হয়ত তাকেই। অমিতা ভাবল। হয়ত তাকেও নয়। হয়ত কাউকেই নয়। রিনি তার বুকের যন্ত্রণাকে প্রকাশ করতে চাইছে।

‘তাঁর কাছ থেকে আমি যা পেয়েছি অমিতা, সে জিনিস আর কেউ আমাকে দেয়নি। তিনিই আমাকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছেন। তিনিই আমাকে এ কথা বলেছিলেন অমিতা, এ জীবন. একটা গোলকধাঁধা। এ জীবনে কিছু একটা হয়ে উঠতে চাইলে গোড়া থেকেই তোমাকে সেই লক্ষ্যটা স্থির করে ফেলতে হবে। একটা মানুষের জীবনে অনেক কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। লক্ষ্য যদি স্থির না থাকে, তবে সে বাঁশ বনে কানা ডোমের মতো শুধু ঘুরেই মরবে। সে কিছু হতে পারবে না। তিনিই আমাকে ভালবাসা দিয়েছেন।’

রিনি থেমে থেমে, প্রত্যেকটা কথা বেশ ওজন করে বলছিল।

‘তাঁর সঙ্গে আমার বয়সের ব্যবধান বিস্তর। প্রায় তিরিশ বছর। কিন্তু তিনি তা মানতেন না। বলতেন, রিনি অঙ্কের হিসেব এক, আর জীবনের হিসেব অন্য। তোমার ভালবাসা আমাকে তোমার সমবয়সী করে তুলেছে। তুমি টের পাও না?’

তখন রাত গভীর হয়ে এসেছে। ওরা দুজনে পাশাপাশি শুয়ে আছে। রিনির একটা হাত অমিতার বুকের উপর।

‘টের পেয়েছি বই কি অমিতা। তখন আমি ক্রমাগত ওঁর দিকে আকৃষ্ট হচ্ছি। আর যত ওঁর কাছে আসছি, ততই টের পেতাম, আমাদের বাড়ির সেই কবরখানার হিমশীতলতা তাঁর উষ্ণতার স্পর্শে যেন বিদায় নিতে শুরু করেছে। আমি তাঁকে সমস্ত মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলাম। আর আমার প্রতি ভালবাসারও কোনও আগল ছিল না। আমি এটা কখনও ভেবে দেখিনি অমিতা, আমাকে ভালবাসার জন্য তাঁকে কি মূল্য দিতে হচ্ছে। তিনি সংসারী লোক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিল। চিররুগ্ণ তাঁর স্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রচণ্ড দায়িত্ববোধ ছিল। হয়ত আমাকে ভালবাসার আগে তাঁর স্ত্রীকে তিনি ভালও বাসতেন। কিন্তু আমি তাঁকে আমার ভালবাসা দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শুধু তাই নয়, আমি তাঁকে বিয়ে করব বলে খেপে উঠেছিলাম। সেটা অবশ্য তাঁর কাছে প্রকাশ করিনি। তখন আমার কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না তো। আমার বয়েস তখন ষোলো অমিতা। তুমি কি বিশ্বাস করবে, আমার এই পাগলামো আমাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল। আমি মনে মনে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করেছি। যেন তিনিই আমাদের পথের কাঁটা। ভাগ্যিস আমি আমার মনের কথা মনেই রাখতে পেরেছিলাম।

রিনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ওদের ঘরে কি তখন কবরখানার শীতল স্তব্ধতা নেমে এসেছিল? অমিতা অনুভব করার চেষ্টা করল।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিনি বলল, ‘ওঁর চিঠিতে জানলাম, ওঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে।’

‘এর জন্য আমিই দায়ী, আমিই দায়ী। কাল থেকে আমি এই গ্লানিবোধে ভুগছি অমিতা যে, তাঁর মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। পাপবোধের এই প্রচণ্ড ভারী বোঝা বয়ে নিয়ে আমাকে সারাটা জীবন চলতে হবে অমিতা।’

৪৭

রিনির কথাই ভাবছিল অমিতা। অনেক দিন পরে তার সঙ্গে আকস্মিকভাবে দেখা হয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে, কনট প্লেসে। শীতের আগে সেবার অফিসের কি একটা কাজে অমিতাকে দিল্লি যেতে হয়েছিল। সেদিন কাজ ছিল না, পরের দিন ফিরে আসবে। অমিতা তাই বেরিয়েছিল বিন্তির জন্য একটা গরম ফ্রক কেনা যায় কি না, তা দেখতে। অমিতার অফিসের যে সব সহকর্মী প্রায়ই দিল্লি যাতায়াত করেন, অমিতাকে বলেছিলেন, দিল্লিতে সস্তায় ভাল গরম জামা পাওয়া যায়। অমিতা দিল্লির তেমন কিছুই চিনত না তখন। কনট্ প্লেসের নামটা কে যেন বলে দিয়েছিল তাকে। তাই সেখানেই সে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দোকান অনেক আছে। ভাল জামাও আছে। কাট্-টাট্ সবই সুন্দর। কিন্তু দাম! কোথায় সস্তা? সরকারি অ্যালাউনস থেকে যে কটা টাকা বাঁচিয়েছিল কষ্ট করে, সেটাই তো অমিতার পুঁজি। তাতে অমিতা দেখল, কনট্ সার্কাসের দোকান থেকে জামা কেনা যায় না। হতাশ হয়ে সে শেষ দোকানটা থেকে বেরিয়ে আসছিল, তেষ্টা পেয়েছে, কোথায় যেন একটা কফি হাউস দেখেছিল, সেখানেই যাবে সে ঠিক করেছিল, হঠাৎ এক মহিলা তার পথ আটকে দাঁড়ালেন।

‘হ্যালো! অমিতা!’

সত্যিই রিনি না ডাকলে, অমিতা হয়ত তার পাশ কাটিয়ে চলেই যেত।

রিনি!

‘না অমিতা, ওয়ালরাস।’ রিনি হাসল।

অমিতাও হেসে ফেলল। আর তারপরেই এক রাশ প্রশ্ন হুড়পাড় করতে থাকল অমিতার মনে।

রিনি! রিনি! ওহ্ রিনি!

অমিতা রিনিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। আবেগে রিনির চোখে প্রায় জল এসে গিয়েছিল।

শান্ত হবার চেষ্টা করে রিনি বলল, ‘অমিতা, তোমাকে দেখে টায়ার্ড মনে হচ্ছে। তোমার তাড়া না থাকে তো চল কোথাও গিয়ে বসি।’

আমার তাড়া নেই রিনি। তা ছাড়া আমি কফি খাব বলেই ভাবছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে কোথায় একবার যেন কফি হাউসটা দেখলামও। এখন হয়ত আর চিনে বের করতে পারব না।

রিনি হাসল। বলল, ‘দিল্লি আমার শহর অমিতা, তোমার কোনও চিন্তা নেই।’

রিনিই তাকে কফি হাউসে নিয়ে গেল। সেটা লাঞ্চ টাইমের পরে একেবারে খাঁ খাঁ করছে। অমিতার কাছে কফি হাউস বলতে কলকাতার দুটো কফি হাউসই বোঝায়। কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে সব সময় ভিড় লেগেই আছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসের খবর ভাল রাখত না অমিতা। রিনির সঙ্গেই ওখানে বার কয়েক গিয়েছিল সে। কলেজ থেকে রিনির বাড়ি যাতায়াতের পথেই ওটা পড়ত। একদিন রিনি একজন বয়স্ক ফিনফিনে লোককে দেখিয়ে অমিতাকে বলেছিল, ‘উনি হচ্ছেন বাবার কলিগ। এস এন রায়।’ ভদ্রলোক রিনির কাছে এগিয়ে এসে তার বাবার খবর নিয়েছিলেন। আর এক দিন এক টেকো সাহেবকে দেখিয়ে রিনি বলেছিল, ‘উনি মিঃ এমারসন। স্টেটসম্যানে কাজ করেন। বাবার বন্ধু।’ এমারসন রিনিকে দেখে নড করেছিলেন।

কিন্তু এ কী কফি হাউস দিল্লির! কলকাতায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফি হাউসে হাউস অব লর্ডসও তো কখনও এত ফাঁকা থাকে না। রিনির সঙ্গে হাউস অব লর্ডসে প্রথম দিন ঢুকে অমিতার আফসোস হয়েছিল। শামিম যদি এখানকার খবর রাখত, তবে তারা এখানেই নিরিবিলিতে এসে বসতে পারত।

রিনি আর সে মুখোমুখি বসল। কিন্তু এ কোন রিনি? মানুষের চেহারা এত বদলে যেতে পারে! রিনিকে অবাক হয়ে দেখছিল অমিতা। রিনি ফুলে একেবারে গোল হয়ে গেছে। মাথার চুল সব পাকা। আর ছোট ছোট করে ছাঁটা। তার হাতে পেল্লাই সাইজের একটা ব্যাগ। রিনির চোখের চশমার কাঁচ কি আরও পুরু হয়েছে? কি করছে রিনি? কোথায় আছে রিনি? দিল্লিতে কি? কেমন আছেন ওঁর বাবা মা? ওঁরা বেঁচে আছেন কি? এবং এখনও কি ওদের বাড়িতে কবরখানার শীতলতা বিরাজ করছে? কোনও কথাই শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হল না ভাল করে। সময় কোথা দিয়ে যে চলে গেল।

রিনি বি এ-তে ফিলসফিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিল। তারপরই সে দিল্লি চলে এসেছিল। অমিতা সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছিল। তবে সে রিনির জন্যই। রিনি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যেতে পারেনি। চোখের জন্য। সে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি থেকে এম এ পরীক্ষা দিয়েছিল। রিনির বাবা মারা গিয়েছেন গত বছর। মা এখনও বেঁচে আছেন। মা কোনও এক আশ্রমে চলে গিয়েছেন। খোঁজখবর রাখে না রিনি। ওর দাদা আমেরিকাতে সেটল করে গিয়েছে। এত হাঙ্গামা করে ভারত স্বাধীনতা পেল। অমিতার অবাক লাগে, জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে করে, দেশটায় তবে থাকবে কে? সবাই যদি আমেরিকা চলে যাবে, ভাল ছেলেমেয়ে মাত্রই যদি পাখা গজাবার পরে এখানে ওখানে উড়ে যাবে, তবে এখানে পড়ে থাকবে কে? পঙ্গু প্রতিবন্ধী নির্বোধ, এই ধরনের লোকেরা?

রিনি সিমলার কাছে একটা রেসিডেনশিয়াল স্কুলে পড়ায়। সেখানেই থাকে।

রিনি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি হয়ে গেল বলত?’

অমিতা জিজ্ঞাসা করেছিল, কোথায় রিনি?

‘আমাদের দেশে? আমাদের জীবনে?

আমাদের দেশের খবর তুমি তো আমার চাইতে ভালই রাখতে রিনি। তোমার বাবার কথা আমার মনে পড়ে রিনি। তাঁর চিঠিগুলো ছিল যেন ভবিষ্যদ্বাণী।

‘অনেক পাঁয়তাড়ার পর অবশেষে কেবিনেট মিশন একটা প্রস্তাব তৈরি করে ফেলতে পারলেন। বলাই বাহুল্য মৌলানা আজাদের খসড়া প্রস্তাবের ভিত্তিটাই মিশন গ্রহণ করলেন। ভাইসরয় তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রস্তাবটির চুলচেরা বিচারে বসলেন। প্রাদেশিক গভর্নরদেরও ডাকা হয়েছিল। তাঁরাও তাঁদের সুচিন্তিত মত দিলেন। মৌলানাকে বার বার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তাঁর এই প্রস্তাব তিনি কংগ্রেসকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নিতে পারবেন তো। মৌলানার কথা শুনে মনে হয়েছিল, তিনি তা পারবেন।’ রিনির বাবা রিনিকে লিখেছিলেন।

‘মা মণি, আর কয়েকদিন পরেই তুমি হয়ত একটা পজিটিভ খবর জানতে পারবে।’

‘মা মণি, মৌলানা যখন তাঁর প্রস্তাব কেবিনেট মিশনের সামনে পেশ করেছিলেন, ওটা তখন ছিল নিছক তাঁরই প্রস্তাব। কেবিনেট মিশনের কাছে তোলার আগে মৌলানা সে সম্পর্কে কারও সঙ্গেই যুক্তি পরামর্শ করেননি। অনেকেই কেবিনেট মিশনকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, মৌলানার পিছনে কংগ্রেসের সমর্থন আছে কি না, সেটা ভাল ভাবে জেনে না নিয়ে আর এগুনো উচিত হবে না। বিশেষত স্যর স্ট্যাফোর্ড এই বিষয়ে মিঃ গান্ধী কি বলেন, সেটা জানবার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৪২ সালে মিঃ গান্ধীর ভেটোর জন্যই যে ক্রিসের দৌত্য ব্যর্থ হয়েছিল, সেটা তিনি ভোলেননি। স্যর স্ট্যাফোর্ড জানতেন, মিঃ গান্ধীর সম্মতি ছাড়া কোনও প্রস্তাবই কার্যকর করা যাবে না।’

‘আমার ছোট্ট পাখিটি, কেবিনেট মিশন এতখানি এগুবার পর আবার ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করেছেন। মিঃ নেহরুর মত হচ্ছে, মিঃ জিন্না কোনও কিছুর সঙ্গেই একমত হবেন না। অতএব কেবিনেট মিশনকেই কোনও কিছু মীমাংসা চাপিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কেবিনেট মিশন কোনও কিছু চাপিয়ে দেবার পক্ষপাতী ছিল না। সে অধিকার তাঁদের দেওয়াও হয়নি।

‘আমার ছোট মা, মামণি, আমি তোমাকে বলেছি বোধ হয়, ১৯৪২ সালে মিঃ গান্ধী স্যর স্ট্যাফোর্ডকে বলেছিলেন, ‘কুইট ইন্ডিয়া। লিভ আস আইদার টু গড অর টু অ্যানার্কি।’ রিনির বাবার চিঠি। সে চিঠি পড়েছে অমিতা। আর মিঃ জিন্না বলেছিলেন, ‘ডিভাইড অ্যান্ড দেন কুইট। অর্থাৎ আগে আমাদের ভাগ করো, তারপর কুইট করো। তারপর চার চারটা বছর কেটে গিয়েছে। ভারতের নেতারা কোনও মীমাংসাতেই আসতে পারেননি। সেদিন তাঁরা যে পজিশনে ছিলেন, আজও তাঁরা সেই একই পজিশনে আছেন। কেউ কারও জায়গা থেকে এক পা নড়েননি। মিঃ গান্ধী কিছুতেই ভারত ভাগ মেনে নেবেন না। তাঁর অখণ্ড ভারত চাই। মিঃ জিন্না কিছুতেই অখণ্ড ভারত মেনে নেবেন না আর এর মীমাংসা করতে হবে কেবিনেট মিশনকে! হোয়াট এ ফ্রাস্ট্রেটিং জব!’

‘তোমার মেয়ের বয়েস কত অমিতা?’

আমার মেয়ে! অমিতা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল। হ্যাঁ আমার মেয়ে। বিন্তি। ওর বয়েস আট, এই আটে পড়েছে।

‘এ কি তোমার বড় মেয়ে?’

বড় মেয়ে? না। রিনি আমার ব্যাপার কিছুই জানে না। কত দিন পরে ওর সঙ্গে দেখা। যেন অন্য জন্মে দেখা হল তাদের।

আমার প্রথম স্বামী তার ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় আছেন। বিন্তি আমার দ্বিতীয় স্বামীর মেয়ে।

রিনির চোখের পুরু চশম। আবার অমিতার মুখে স্থির হয়ে সেঁটে রইল। সেই আগের মতোই! অমিতা যেন এখন দিল্লিতে নেই। ওরা কফি হাউসে নেই। ওরা যেন রিনির সেই ঘরে সেই রাতে।

‘মিঃ গান্ধীকে আমি বুঝে উঠতে পারিনে মামণি।’

রিনি বলেছিল, ‘সর্বত্রই জটিলতা অমিতা। যেমন দেশের জীবনে, তেমনি আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে। যতই আমরা ভেবেচিন্তে কাজ করতে চাই, কোথা থেকে যেন সব জট পাকিয়ে যায়।’

‘দেশের লোক মিঃ গান্ধীকে জাতির জনক বলে। তাঁকে মহাত্মা বলে। দেশের একদল লোকের মনের গভীরে ওঁর স্থান, সেটা অস্বীকার করতে পারিনে। এটাও অস্বীকার করতে পারিনে মামণি, মিঃ গান্ধীর হাঁ বলা আর না বলার উপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। কিন্তু এটাও কি ঠিক নয় যে, মিঃ গান্ধী একটা একস্ট্রাকনস্টিটিউশন্যাল অথরিটি? বুরোক্র্যাট হিসাবে এই প্রশ্নটা আমার মনে সতত জাগে। কথাটা একটু ভেবে দেখো। গান্ধীর স্থান জাতির শ্রদ্ধার আসনে। কিন্তু আমি যখন নিগোশিয়েশনে যাব, তখন কোথায় যাব? মীমাংসা হবে দুটো বা ততোধিক পার্টির ডিসপিউটের। এখানে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে ডিসপিউট। এর মধ্যে জিন্নার স্থান মুসলিম লিগে, তিনি লিগের প্রেসিডেন্ট। এটা স্পষ্ট। মিঃ জিন্না কনস্টিটিউশন্যাল অথরিটি। আর মিঃ গান্ধীর স্থান জাতির শ্রদ্ধার আসনে। তাহলে এই বিরোধের মীমাংসার একদিকে আছে মুসলিম লিগ আর অন্য দিকে থাকবে জাতির শ্রদ্ধার আসন, এইটেই কি ধরে নিতে হবে? এ ভাবে কি আলোচনা কল্পনা করা যায়? তুমি বলবে, না আলোচনা হবে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের মধ্যে। রাইট। কিন্তু তাহলে মিঃ গান্ধী আসেন কেমন করে? তিনি তো কংগ্রেসের কেউ নন। কোনও অফিস বেয়ারারও নন, এমন কি মিঃ গান্ধীর নিজের কথায় তিনি কংগ্রেসের ‘চার আনার মেম্বার’-ও ছিলেন না। একদিকে মিঃ গান্ধী কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্যও নন, আবার অন্য দিকে কংগ্রেসের উপর মিঃ গান্ধীর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো মামণি, অবস্থাটা। মিঃ গান্ধী কংগ্রেস সংগঠনের কেউ নন, তাই তাঁর সাংগঠনিক দায়দায়িত্ব কিছু ছিল না। তবু তাঁরই কথায় কংগ্রেস উঠত বসত। অর্থাৎ মিঃ গান্ধী প্রকৃত অর্থে কংগ্রেসম্যান নন, কংগ্রেসে তিনি সুপারম্যান। এক পক্ষে এই অবস্থা। অন্য পক্ষে আছে মুসলিম লিগ। মিঃ জিন্না অবশ্য লিগের প্রেসিডেন্ট, তাঁকে কনস্টিটিউশন্যাল অথরিটি বলতেই হবে। কিন্তু মিঃ জিন্না পলিটিক্যাল আদর্শের দিক থেকে যতই মডারেট হন না কেন, আমরা যখনই তাঁকে আলোচনার টেবিলে পেয়েছি, তখনই দেখেছি, তিনি যে কায়েদে আজম, এটা আর ভুলতে পারছেন না। মিঃ জিন্নাকে আগে যাঁরা দেখেছেন, এবার তাঁরা তাঁর ভূমিকা দেখে অবাকই হয়েছেন। এবার তাঁরা গোলটেবিল বৈঠকের ‘সেই রিজনেবল’ ‘লিবারাল ডেমোক্রেটিক’ মিঃ জিন্নাকে দেখতে পাননি। যখন কেবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হল, মুসলিম লিগ তখন মিঃ জিন্নার পকেট সংগঠন হয়ে পড়েছে। মিঃ জিন্নার ইচ্ছা অনিচ্ছাই তখন লিগের ইচ্ছা অনিচ্ছা। মিঃ জিন্নাই প্রকৃতপক্ষে ভারতের মুসলমানদের একটা বড় অংশের ‘সোল রিপ্রেজেন্টেটিভ’, অর্থাৎ মুসলিম লিগে তিনিই সর্বেসর্বা, দি গ্রেট ডিকটেটার। কেবিনেট মিশন যখন আলোচনা শুরু করেন, তখন পটভূমিকা ছিল এই। একদিকে এক সুপারম্যান, যাঁর উইজডম তাঁর ভক্তদের কাছে ছিল তর্কাতীত, অন্যদিকে এক সুপার ডিকটেটার, যাঁর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়াকে লিগের নেতারা ‘আল্লাহের গজব’ নেমে আসার তুল্য জ্ঞান করতেন। আর এই দুজনের মাঝখানে পড়ে আছে এক জটিলতম ডিসপিউট। আর এই জটিলতম বিরোধের জট ছাড়াতে এসেছেন এমন এক দল মানুষ ঐশী শক্তি সম্পর্কে সামান্য মোহও যাঁদের নেই, এবং ডিমোক্রেটিক প্রিনসিপলকেই যাঁরা পাথেয় জ্ঞান করেন। যুক্তি বুদ্ধির প্রয়োগ আর আপস ছাড়া তাঁদের হাতে তো আর কোনও হাতিয়ার ছিল না, মামণি।

চিঠিটা পড়ে অমিতার সেদিন মনে হয়েছিল, রিনির বাবাও কি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? এই চিঠিটা মনে আছে। রিনির বাবা গান্ধীকে কংগ্রেসের সুপারম্যান বলে উল্লেখ করেছিলেন এবং জিন্নাকে বলেছিলেন তিনি মুসলিম লিগের সুপার ডিকটেটার। এঁদের সম্পর্কে এই ধরনের কথা অমিতা এর আগে আর কারও মুখে শোনেনি।

‘মামণি, আমার ছোট পাখি, এতদিন পরে তোমাকে একটা ভাল খবর দিচ্ছি। মৌলানার চিঠি আমাদের দফতরে সদ্য এসে পৌঁছেছে। মৌলানা আজাদ লিখেছেন, তিনি এই প্রথম কংগ্রেস ওয়ার্কিং-এর বৈঠকে তাঁর প্রস্তাবটা পেশ করেছিলেন। সেখানে অনেক আলোচনার পর ওয়ার্কিং কমিটি আজাদের প্রস্তাবটাকে গ্রহণ করেছেন। মিঃ গান্ধীও এই প্রস্তারে তাঁর সম্মতি জানিয়েছেন। অবশেষে মামণি, কেবিনেট মিশনের হাতে একটা সুস্পষ্ট প্রস্তাব এসে পৌঁছল। এটাই হবে আলোচনার ভিত্তি।’

‘আমরা আজমল খাঁ মার্কেটে যাব অমিতা। তুমি তোমার মেয়ের জন্য যে জামা চাইছ, আজমল খাঁ মার্কেটে সেই ধরনের জামা অনেক পাওয়া যাবে। দামও অনেক সস্তা।

রিনির কথায় স্মৃতির রেশটা কেটে গেল অমিতার। কলকাতায় রিনির বাসা থেকে অমিতা দিল্লির কফি হাউসে চলে এল।

‘টাঙ্গায় চড়েছ কখনও অমিতা?’

না রিনি, আমি কখনও টাঙ্গায় চড়িনি। বেনারসে টাঙ্গা দেখেছি।

‘দিল্লিতে টাঙ্গা তো উঠেই গেল প্রায়। এখন ফটফটিয়া এসেছে। আমার ফটফটিয়া ভাল লাগে না। টাঙ্গা এখনও ভাল লাগে। এখনও আমি টাঙ্গায় উঠলে থ্রিল অনুভব করি। জানো অমিতা! জীবনের এক একটা অভ্যাস যেতেই চায় না। এক সময় আমরা টাঙ্গায় খুব চড়তাম অমিতা। আমরা দুজনেই টাঙ্গায় চড়তে ভালবাসতাম।’

আমরা দুজনেই টাঙ্গায় চড়তে ভালবাসতাম।

রিনির এই কথাটা অমিতার কানে ধাক্কা দিল।

‘তুমি চড়বে টাঙ্গায়? আমার একটা চেনা টাঙ্গাওয়ালা আছে। তাকে বললে, সে আমাদের আজমল খাঁ মার্কেটে নিয়ে যাবে।’

অমিতা বলেছিল, চল। ভালই করেছিল অমিতা। রিনি সেদিন ওর জীবনের অনেক কথা বলেছিল, টাঙ্গায় যেতে আসতে।

টাঙ্গায় ওঠাও কম অভিজ্ঞতা নয়। বিশেষত আনাড়িদের কাছে। টাঙ্গায় উঠে বসতে না বসতেই বুড়োটা ঘোড়াকে একটা চাবুক মেরেছিল, আর ঘোড়াটা টাঙ্গায় দিয়েছিল হ্যাঁচকা টান। অমিতার মনে হল সে গড়িয়ে পড়ে যাবে। সে ওমা বলে সঙ্গে সঙ্গে রিনিকে জাপটে ধরেছিল। তাই দেখে বুড়োটার কি হাসি! রিনিকে কি যেন বলেছিল। রিনি হাসতে হাসতে তার জবাব দিয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অমিতা সামলে নিয়েছিল।

রিনিকে হাসতে দেখে অমিতার ভয় কেটে গিয়েছিল যদিও, তবুও সে যতক্ষণ টাঙ্গায় ছিল ততক্ষণ রিনির হাত ছাড়েনি।

রিনি বলল, ‘বুড়োটা আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, এ বেটি কি নতুন টাঙ্গায় চড়ছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। বুড়ো বলল, সে আমি বুঝেছি, তাই আমি ওকে একটু চমকে দিলাম। বেটি কিছু মনে করেনি তো? আমি ওকে বলেছি অমিতা যে, তুমি

অমিতা বলেছিল, মজা পেয়েছি সেটা ঠিকই। তবে পড়ে যাওয়ার ভয়টাকেও ভুলতে পারিনি। যতক্ষণ টাঙ্গায় চড়ছি ততক্ষণ তোমাকে কিন্তু ছাড়ছি না রিনি।

অমিতা রিনির হাতখানাকে শক্ত করে আঁকড়ে বসে রইল। রিনি হাসছিল।

‘আমরা যখন প্রথম প্রথম টাঙ্গায় চড়তাম, তখন আমারও ওই রকম ভয় হত। এই বুঝি টাঙ্গা থেকে হড়কে পড়লাম। টাঙ্গা চলতে শুরু করলেই আমি প্রাণপণে ওঁকে আঁকড়ে বসে থাকতাম। উনি হয়ত ভাবতেন, আমি কি ভিতু মেয়ে!’

রিনি বলেছিল, ‘কিন্তু আমি সত্যিই অত ভিতু ছিলাম না। আমি বেশ ছোট বয়স থেকেই আমার কাজকর্ম করে নিতে পারি। বাড়িতে আমি কারও উপর নির্ভর করতাম না। আমি স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু ওই একটি পুরুষের সংস্পর্শে এলেই আমি একটা ছোট মেয়ে বনে যেতাম। আমার বাবাও তো আমাকে ভালবাসেন, কত যে ভালবাসেন, সে তুমিও জানো অমিতা। কিন্তু আমার বাবার কাছেও আমি তাঁর স্বাবলম্বী মেয়েই ছিলাম। যে নিজেকে জানে, যে নিজের সব কাজ নিজে করে নেয়, কারও উপর নির্ভর করে না। আমার বাবা আমার মধ্যে এই রকমই একটা মেয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁর আশা পূর্ণ করেছি অমিতা। আমি তাঁর অসুখী জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা ছিলাম।’

‘কিন্তু বাবার কাছেও আমি কিছু চাইতে পারতাম না। কোনও দিন কোনও আবদার করেছি বলে মনে পড়ে না।’ রিনি বলেছিল, ‘কিন্তু আমার সব আবদার আমি এই লোকটির কাছে নিঃসংকোচে জানাতে পারতাম। কত যে জ্বালিয়েছি তাঁকে। এবং তিনিও খুশি মনে আমার আবদারকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর কাছে থাকলেই আমি অন্য একটা জগতে চলে যেতাম অমিতা। সে জগৎটা যে কেমন তা তোমাকে বোঝাতে পারব না।’

অমিতা রিনিকে দেখছিল। না ঠিক রিনিকে নয়, সে দেখছিল চশমার দুটো পুরু কাঁচকে। যে কাঁচদুটো অমিতার মুখের উপর কেবল স্থির হয়ে সেঁটে থাকে।

তুমি যে জগতের কথা বলতে চাইছ রিনি, আমার জীবনেও একদিন ওই জগৎটার অস্তিত্ব ছিল। তখন আমার জীবনে শামিম বলে কেউ ছিল। সে জগতে জেগে ওঠা, সে জগতে বেঁচে থাকা, সে জগতের জ্বালা-যন্ত্রণার তীব্র স্বাদ কি করে তোমাকে বোঝাব রিনি। সে কি বোঝানো যায়!

রিনি, তোমার সঙ্গে তাঁর, আর দেখা হয়নি?

রিনি যেন অমিতার কথা প্রথমে বুঝতে পারল না।

তাঁর সঙ্গে তোমার আর দেখা হয়নি? অমিতা কথাটা আবার জিজ্ঞাসা করল।

রিনির চশমার কাঁচদুটো অমিতার মুখের উপর কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থাকল। আর চশমার ওপার থেকে রিনির গলার স্বর ভেসে এল, ‘তিনি তো এখন আমার সঙ্গেই আছেন।’

অমিতা তখন কি যে ভাবছিল, এখন আর তা মনে করতে পারল না। সেও কি ভাবছিল তার প্রথম ভালবাসার কথা? ডাজ ইট রিয়েলি ম্যাটার? রিনিই একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল।

‘তিন বছর আগে তাঁকে আমি আমার কাছে নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম সবই বুঝি চুকে বুকে গিয়েছে। কিন্তু মানুষের মন কখন কি ভাবে কাজ করে, তার হিসেব পাওয়া যায় না, অমিতা।’

না, অমিতাও এ হিসেব বুঝতে পারেনি আজও।

‘কেন তিনি আমাকে সেই চিঠিটা লিখেছিলেন কলকাতায়? তুমি কি তার কোনও মানে খুঁজে পাবে? তুমি তো সে চিঠির কথা জানো।’

হ্যাঁ রিনি জানি। সে চিঠিতে শুধু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ ছিল।

‘হ্যাঁ অমিতা। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে, শুধু এই খবরটাই ছিল। তার বাইরে আর একটা কথাও না। তাঁর সঙ্গে আমার তখন কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। আমি তো তাঁকে ভুলতেই কলকাতায় এসেছিলাম। তবে এ চিঠি তিনি কেন আমাকে লিখলেন?’

তুমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলে সেদিন রিনি।

‘আমার সেদিন মনে হয়েছিল, আমিই যে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ, তিনি সেটা আমাকে মনে করিয়ে দিতে চাইছিলেন।’

কিন্তু তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক!

‘ছিল অমিতা ছিল। আর সেটাই আমাকে যন্ত্রণায় অস্থির করে দিচ্ছিল। আমি এক সময় ওঁর স্ত্রীর মৃত্যুকামনা করেছিলাম অমিতা। আমি তখন এতটাই নীচে নেমে গিয়েছিলাম।

কিন্তু তুমি তাঁকে এ কথা বলেছিলে?

‘আমি! তাঁকে! না না অমিতা, আমি এ কথা তাঁকে বলিনি। কাউকেই বলিনি। সেটা তো একটা পাগলামি। তখন আমি ভাবতাম, তিনি শুধু আমার। আমারই। আমার ভালবাসা কেবল আমারই থাকবে, আর কারও নয়। কিন্তু এটা আমি কি ভাবে দাবি করতে পারি? তাঁর স্ত্রী আছে, তাঁর সন্তান আছে, তাঁর সংসার আছে। তাঁর ছেলে আমার চাইতে বয়সে বড় ছিল অমিতা। তিনি আমার অনেক আবদার মিটিয়েছেন, কিন্তু এই আবদার মেটানো যে তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, সেই জ্ঞানটাও আমার লোপ পেয়ে গিয়েছিল। আমার আকাঙ্ক্ষা আমার চাওয়া সেদিন ছিল এমনই সীমাহীন। তখন প্রত্যেকটা মুহূর্তে

মনে হত, তাঁকে আমার চাই। তাঁকে আমার চাই। এই পাগলামিতে পেয়ে বসেছিল আমাকে। আমি আমার এই চাহিদার হাত থেকে বাঁচবার জন্যই বাবার কাছে চলে এসেছিলাম কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখিনি আর।’

৪৮

‘ভুলতেই তো চেয়েছিলাম, অমিতা। তাঁকে মন থেকে মুছেই তো ফেলতে চেয়েছিলাম। কলকাতায় যে চার বছর ছিলাম, একবারও ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। করতে চেষ্টাও করিনি।’

রিনি আপন মনেই বলে যাচ্ছিল। ওর মুখের চেহারা তখন কেমন তরল হয়ে উঠেছিল। ওর চোখ দুটো যে টলটল করছিল, তা সে রিনির চশমার পুরু কাঁচের এপার থেকেও দেখতে পাচ্ছিল।

যখন তুমি তাঁকে তোমার মন থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করছিলে, তখন তাঁকে তোমার দেখতে ইচ্ছে হত না রিনি?

অমিতার আচমকা প্রশ্নে রিনি যেন হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলল। অমিতার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘ইচ্ছে?’

‘হ্যাঁ অমিতা ইচ্ছে হত। আর সে সব যে কি সর্বনাশা ইচ্ছে! সেই সব ইচ্ছের সঙ্গেই তো চার বছর ধরে কলকাতায় লড়াই করেছি অমিতা।’

রিনি বলেছিল, ‘অল্প বয়সের ভালবাসা, কতই তো পড়ি অমিতা, কতই তো শুনি, তাতে গভীরতা থাকে না। বন্যার মতো সে সব আসে, ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ব্যস, পরে তার কোনও ছাপ থাকে না মনে। হয়ত সে সব কথা সত্যি। কিন্তু আমার কাছে এটা সত্যি নয় অমিতা। আমার মনে একবারই ভালবাসা এসেছিল, সে আমার অল্প বয়সে, আর সেটাই আমার জীবনে স্থায়ী হয়ে রইল অমিতা। আশ্চর্য নয়?’

অমিতা কিছু একটা হয়ত বলত, কিন্তু তার আগেই রিনি তাকে বলল, ‘এর কারণ কি জানো?’

জবাবটা নিজেই দিল রিনি।

‘এর কারণ একটাই। আমার মতো মেয়েকে, এক আলি ডাক্‌লিংকে, ভালবাসতে এই একটি লোকই এগিয়ে এসেছিলেন। ইনিই প্রথম এবং ইনিই শেষ।

‘আর আমি এই লোকটাকেই ভুলে থাকবার জন্য বছরের পর বছর নিজের মনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে গিয়েছি। একেই বলে হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করা। না, অমিতা?’

হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করা! বেশ বলেছে রিনি। হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করা। ভালবাসাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করাই বটে! অমিতা কি তার ভালবাসাকে ভুলে গিয়েছে? তার প্রথম ভালবাসা শামিম। সে কি শামিমকে ভুলে গিয়েছে? সে কি সমীরেন্দ্রকেই ভুলে যেতে পেরেছে? না কি যোগীকে ভুলে গিয়েছে?

‘আচ্ছা অমিতা, ভালবাসা কি করুণা থেকেই জন্মায়?’ রিনি সেদিন বলেছিল। ‘গভীর ভালবাসা, যে ভালবাসা জীবন থেকে যায় না, তার উৎস কি করুণা নয়?

রিনি ঠিক কি বলতে চাইছে, অমিতা ভাল বুঝতে পারেনি। সে জবাব দেয়নি। অমিতার মনে হয়েছিল, রিনি হয়ত এর উত্তর চাইছেও না। ও চাইছে কিছু বলতে। ওকে বাধা না দেওয়াই ভাল।

‘উনি যখন আমাকে পড়াতে এসেছিলেন, তখন আমার বয়স তেরো বছর। বাবা কলকাতায় গেলেন। আমি একেবারে একা হয়ে পড়েছিলাম।’ বিনি বলতে লাগল ওর কাহিনী। ‘যার কপালে অবহেলা জোটেনি, সে কিন্তু বুঝতেই পারবে না অবহেলা কি জিনিস।’

রিনি ছিল তার বাড়িতে অবহেলার পাত্রী। রিনির মায়ের এই অবেহলা রিনিকে সারা জীবন তাড়া করে ফিরেছে। তার দাদা রিনির চাইতে আট বছরের বড় ছিলেন। তার সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল না রিনির। রিনির দাদা হওয়ার সময় তার মা বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন। তাই তিনি ঠিক করে নিয়েছিলেন, ছেলেপিলের ঝঞ্ঝাট তিনি আর পোয়াবেন না। রিনির বাবাকেও তিনি এই কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। রিনির বাবাও কথাও দিয়েছিলেন, তাঁদের আর কোনও সন্তান হবে না। তার বাবা আর মায়ের মধ্যে যে ভালবাসার সম্পর্ক ছিল বলে রিনি শুনেছে, এরপর থেকেই সেটাতে চিড় ধরতে শুরু করেছিল কি না রিনি তা বলতে পারে না। তবে তার আন্দাজ, এই রকমই কিছু একটা হয়ে থাকবে। তবে রিনির বাবা আর মায়ের দাম্পত্য জীবন দাদার জন্মের পর থেকেই যে অন্য রকম হতে শুরু করেছিল, সেটা রিনি শুনেছিল। বাবার জীবনে আর কোনও নারী আসেনি। মায়ের জীবনেও আসেনি কোনও পুরুষ। তবু তার বাবা এবং মাগের মধ্যে ভালবাসার বন্ধন কেমন ঢিলে হয়ে গেল। আবার একটা বাচ্চা হবে, এই আতঙ্কে মা অস্থির হয়ে উঠত।

‘কাজেই আমি যখন মায়ের পেটে এলাম, অমিতা বুঝতেই পার, মায়ের আতঙ্ক কোন্ পর্যায়ে উঠে গিয়েছিল। আমি বড় হয়ে ওঠার পরেও মা যে সব কথা বাবাকে বলেছে, এবং অত্যন্ত শান্ত ভাবে, সে সব বাবা ছাড়া আর কেউ সহ্য করত বলে আমার মনে হয় না। মায়ের কাছে বাবা কি অপরাধ করেছেন, আমি সে সময় সেটা বুঝতে পারতাম না। মা বাবাকে বলতেন, যেন ঘর সংসারের কথাই তাঁরা পাশাপাশি বসে বলে চলেছেন, তুমি একটা বিশ্বাসঘাতক, তোমার চরিত্র অতি জঘন্য। তুমি লম্পটের অধম। তুমি একটা রেপিস্ট। নিজের বউকে যে ফুসলিয়ে ধর্ষণ করে তার চাইতে বড় অপরাধী আমি কাউকে দেখিনে। তোমাকে আমি কোনও দিন বিশ্বাস করব না। বাবাকে দেখতাম, অপরাধীর মতো মুখ করে মায়ের সব অভিযোগ যেন মেনে নিচ্ছেন। বাবা আর মায়ের ছবি আমার মনে যখন এক সঙ্গে ভেসে ওঠে, আর দেখি ওঁরা কোথাও পাশাপাশি বসে আছেন, তখন বাবার অপরাধী অপরাধী মুখটা আমাকে খুব কষ্ট দেয় অমিতা। আমি ভাবি, আমার জন্যই না বাবার এই অবস্থা। তখন আমার খুব কষ্ট হয়।

রিনি অমিতাকে বলেছিল, যে লোক খুব কষ্ট পায়, যন্ত্রণায় ভোগে, রিনির তাকেই ভাল লেগে যায়। রিনিদের দিল্লির বাড়িটা রিনিদের ছোট পরিবারের পক্ষে বেশ বড়ই ছিল। ঘরগুলো সব খোলামেলো। কিন্তু সেই বাড়ির সব চাইতে যেটা ছোট্ট ঘর, খানিকটা অন্ধকার অন্ধকার, সেটাই ছিল রিনির জগৎ। রিনির কলকাতার বাসায় অমিতা একদিন দৈবাৎ একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছিল। সেদিন অমিতা রিনির ঘরটা পরিষ্কার করছিল। খাটের নিচে একটা কাগজের প্যাকিং বাক্‌স ছিল। সেটাকে সেদিন বের করে এনেছিল অমিতা। ডালাটা খুলতেই দেখে ভিতরে অনেক রকমের পুতুল। কিন্তু কোনটাই আস্ত নয়। একটা কুকুর, তার একটা পা ভাঙ্গা। একটা টেডি বিয়ার, তার একটা কান নেই। একটা বড় ন্যাকড়ার পুতুল, তার একটা হাত নেই। এরকম আরও কয়েকটা পুতুল, যাদের কোনও না কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নেই। অমিতা সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিল। সেই বাকসে এমন একটা পুতুলও পায়নি অমিতা যেটা পুরোপুরি আস্ত আছে। রিনি ঘরে ঢুকে প্রথমটায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তারপর বোকার মতো হাসতে লেগেছিল।

‘ওরাই আমার ছেলেবেলার সঙ্গী অমিতা। ওরাই আমার নিঃসঙ্গ জীবনটাকে ভরিয়ে রেখেছিল। রিনির স্বরে তখন ভালবাসা ঝরছিল। রিনি ঝপ করে অমিতার পাশে বসে পড়েছিল। তার চোখে সেদিন যে স্বপ্নের ঘোর দেখেছিল অমিতা; সেটা কিছুতেই ভুলতে পারে না।

‘এরা প্রত্যেকেই সাফার করেছে অমিতা।’ রিনি এমন ভাবে কথা বলছিল যেন ওরা প্রত্যেকেই রক্ত মাংসের জীব, পুতুল মাত্র নয়। ন্যাকড়ার পুতুলটা তুলে এনে বলেছিল, ‘এ হল জিজু। আমার পাঁচ বছর থেকে জিজু ছিল আমার কথা বলার সঙ্গী। জিজু আমার মনের সব কথা জানে। ওর সঙ্গে আমার মিল কোথায় জানো, জিজুর মাও জিজুকে ভালবাসে না। জিজুর সে কষ্ট ভোলবার জন্য আমি ওকে কত সান্ত্বনাই না দিয়েছি। তাই না জিজু?’

রিনি জিজুকে তুলে নিয়ে চুমু খেতে শুরু করল। ‘জিজু এখন বড় হয়ে গেছে তো, জিজু এখন নিজেই সব করতে পারে। না জিজু? জিজু এখন বড় হয়ে গেছে, জিজু জানে এই জগতে সবাই সব কিছু পায় না। যে যেটুকু পেয়েছে, তাকে তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তাই না জিজু? আমি জিজুকে খুব ভালবাসি অমিতা। জিজু যখন বলত, মা ওকে আদর করে না, চুমু খায় না, কথা বলে না, আমি তখনই ওকে আদর করেছি অমিতা। চুমু খেয়েছি, ঘন্টার পর ঘন্টা ওর পাশে শুয়ে কত গল্প শুনিয়েছি। জিজু তখন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জিজু আমার গলা জড়িয়ে ঘুমোতে খুব ভালবাসত অমিতা। জিজুর সব থেকে কষ্ট হত, ওর জ্বর হলে। ওকে মাথা টিপে দিতে হত। মাথায় জলপট্টি দিতে হত। আমি যতক্ষণ বাড়িতে থাকতাম, কোনও অসুবিধে হত না। কিন্তু আমাকে তো স্কুলে যেতে হত। ফাঁকা বাড়িতে ওকে রেখে যেতে আমার খুব কষ্ট হত। সেদিন স্কুলে আমার কিছু ভাল লাগত না। মনটা সব সময় পড়ে থাকত জিজুর কাছে। বাড়িতে এসে তবে নিশ্চিন্ত হতাম। জিজু তখন আমাকে ওর কাছ ছাড়া করতে চাইত না। কত রকম যে বায়না করত! কিন্তু আমি তো বিরক্ত হতাম না। ওর সব আবদার আমি মিটিয়ে দিতাম। জিজু খুবই ভাল। জিজ্‌ ফিসফিস করে আমাকে বলত, জানো কাল রাতে বাবা আর মা আলাদা ঘরে শুয়েছে। বলেছে, এবার থেকে আলাদা ঘরেই শোবে। বাবা ওদিকের ছোট ঘরটায় চলে গিয়েছেন। আমি তো ছোট, এইটুকুনি, আমাকে ওরা কোনও ঘরেই নেবে না। আমি একা শুতে খুব ভয় পাই। জিজুকে আমি সেইদিন থেকে আমার বিছানায় নিয়ে শুয়েছি।’

‘জিজুর কত খেয়াল দেখ? জিজু আমাকে একদিন বলল, আচ্ছা, মা কি আমার সঙ্গে কোনও দিনই খেলা করবে না? কোনও দিনও না? আমি বললাম, জিজু বুঝে দেখ, মাকে কত কাজ করতে হয়, মাকে অফিসে যেতে হয়, মা তোমার সঙ্গে খেলার সময় পাবে কখন যে খেলবে? জিজু বলল, তাও তো বটে। আমি তবে তোমার সঙ্গেই খেলব। তুমি কিন্তু কোনও দিন আপিসে যেতে পারবে না। ঠিক তো? আমি জিজুকে বললাম, আমি তোমাকে ছেড়ে কি আফিসে যেতে পারি জিজু। তুমি ঘুমোও। জিজু অমনি ঘুমিয়ে পড়ল। জিজু কত ভাল।’

অমিতা হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, জিজু এখন কোথায় রিনি? সে এখনও আছে?

‘জিজু?’ রিনি অবাক হয়ে অমিতার দিকে চেয়ে বলল, ‘জিজু আর কোথায় যাবে? সে তো আমার সঙ্গেই এখন থাকে। তাঁকে তো আমি আমার কাছে নিয়ে গিয়েছি।

টাঙ্গা আজমল খাঁ মার্কেটের কাছে এসে হঠাৎ থেমে পড়তেই অমিতা টাল সামলাতে রিনিকে জড়িয়ে ধরেছিল।

রিনিও ওকে জড়িয়ে ধরে হাসতে থাকল। ‘জিজুই কিন্তু আমাকে টাঙ্গায় চড়া অভ্যেস করেছিল। জানো, আমি যখন আনাড়ি ছিলাম তখন টাঙ্গায় চড়লে আমার সব সময় মনে হত, এই বুঝি পড়ে যাব। আর সে কথা মনে হলেই আমি তক্ষুনি জিজুকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরতাম। জিজুকে জড়িয়ে ধরে থাকতে আমার ভাল লাগত। কেমন নিরাপদ মনে হত। তারপর থেকে আমি আর জিজু টাঙ্গায় উঠলেই আমি সর্বক্ষণ জিজুকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম। একদিন আমার মনে হল, জিজুর বোধ হয় এটা ভাল লাগে। আর সেই কারণেই জিজু আমাকে এত টাঙ্গায় চড়ায়।’

প্রথম দিকে রিনি ছিল বড়, জিজু ছিল ছোট। একেবারে অসহায়। রিনিই তখন জিজুকে আগলে রাখত। রিনির যেমন দিনে কোনও অসুবিধা ছিল না, একটা না একটা কাজ নিয়ে পড়ে থাকত, সময়টা এক রকম করে কেটে যেত, জিজুরও তেমন, দিনটায় ওর ভাবনা ছিল না। রিনি জিজুর অসুখের সময় জিজুকে একা ফেলে রেখে স্কুলে গেলে অবশ্য তার মন খারাপ হত। স্কুল থেকে রিনি ফিরে এলে বেজায় বায়না করত জিজু। কিন্তু সে তো তার অসুখ-সুখ হলে। এমনিতে সে ঠিকই থাকত। কিন্তু রাত হলে জিজুর হত খুব মুশকিল। আর অন্ধকার রাত হলে তো কথাই নেই। একা থাকতে চাইত না জিজু। রিনির স্বভাবও ঠিক জিজুর মতো ছিল। কী ভীষণ একা একা লাগত রিনির তখন! জিজু না থাকলে সে পাগলই হয়ে যেত। রাতে তাই রিনি জিজুকে কাছ ছাড়া করত না। ওকে নিজের বিছানায় টেনে আনত। তারপর জিজুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকত রিনি। নিরাপদ বোধ করত রিনি।

তারপর একদিন রিনি দেখল, জিজু বড় হয়ে যাচ্ছে। বড় হতে হতে বড় হতে হতে বড় হতে হতে জিজু একদিন রিনিকে অনেক দূর ছাড়িয়ে চলে গেল। আর রিনি সেই ছোট্ট মেয়েটিই রয়ে গেল। জিজু তখন তার নাগালের বাইরে। আবার যখন রিনি জিজুকে, তার জিজুকে, ফিরে পেল, তখন রিনির বয়স তেরো বছর। জিজু তখন রিনির প্রাইভেট টিউটর। রিনি তখন জিজুকে অবাক হয়ে কেবল দেখত। জিজু বলেই জিজুকে চিনতে পেরেছিল রিনি। কিন্তু কী অসম্ভব পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে জিজুর। চেহারা বয়েস, সব বদলে গিয়েছে জিজুর। রিনি বলেই জিজুকে চিনতে পেরেছিল। নইলে অন্য কারও সাধ্য ছিল না।

জিজু রিনিকে নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তাই রিনি মনে মনে প্রথম দিন থেকেই জিজুকে আঁকড়ে ধরেছিল। কিন্তু সে মুখে এ কথা কখনও বলেনি। জিজুকে তো বলার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ রিনি জানে, ওর ধারণা হয়েছিল, জিজু রিনির মনের সব খবর জানে। রিনি ক্রমেই বুঝতে পারছিল, সকলে রিনিকে যে চোখ দিয়ে দেখে জিজু সে চোখ দিয়ে তাকে দেখছে না। কেন এমন মনে হত রিনির, তা সে বলতে পারে না। কিন্তু তার মনে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়ে গিয়েছিল। পরে রিনি দেখেছে, তার ধারণা সত্য। যখনই রিনি মুষড়ে পড়ত কোনও কারণে, জিজু ঠিক সেটা জানতে পারত। আর জিজু পড়াশুনা হয়ে গেলে, রিনির সঙ্গে নানা গল্প করতে বসত।

সেই গল্পগুলোর মূল কথা একই, অমিতা। এই জগতে প্রতিটি মানুষকেই সার্থকতায় পৌঁছুতে গেলে নিরন্তর সংগ্রাম করে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এই কথাটাই জিজু কত বার যে কত রকম ভাবে, নানা গল্পের মধ্যে দিয়ে, আমাকে বলত, তার ইয়ত্তা নেই। জিজুর এই গল্পগুলোই আমাকে সাহসী করেছে, আমি যে কিছু পারি, সে সম্পর্কে আমার মনে বিশ্বাস এনে দিয়েছে।’ রিনি আজমল খাঁ মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে এই কথা বলেছিল।

আজমল খাঁ মার্কেট। রিনি! রিনি শ্রীনিবাসন! অমিতা যেন এই মাত্র স্বপ্ন দেখে উঠল।

‘এমন লোককে ভাল না বেসে কি পারা যায়, অমিতা?’

কোথায় রিনি তুমি? কোথা থেকে বলছ কথাগুলো? অমিতা জানে তার ঘরে এখন কেউ নেই। সে শ্রান্ত হয়ে চোখ বুজল।

‘জিজু। জিজুকে কি না ভালবেসে পারা যায়, অমিতা?’

রিনি জিজুকে ভালবেসেছিল। জিজুও যে তাকে ভালবাসতে শুরু করেছে, সেটা রিনি টের পেয়েছিল, তার ম্যাট্রিক পরীক্ষার বছরে। বাইরের দিক থেকে জিজুকে দেখলে কিছুই বোঝা যেত না। কিন্তু জিজু যখন রিনির কাছে এসে বসত, তখনই রিনি বোধ করত যে, তার মনের রং বদলে যেতে শুরু করেছে। রিনি যেন সমস্ত তুচ্ছতা নীচতা থেকে, তার দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা থেকে ধাপে ধাপে উঠে যাচ্ছে একটা বড় কোনও জায়গায়। সে জায়গাটা কি সেটা বুঝতে পারত না রিনি। কিন্তু একটা বড় কোনও জায়গায় পৌঁছুতে যাচ্ছে, এই বোধ তার মনকে অনেক খুলে দিত। রিনির মনকে অনেক ভরে দিত। জিজু তার জীবনের গল্প বলত। জিজুর লেখাপড়ার কথা, তার জীবনের দারিদ্র্যের কথা। এ সব রিনি শুনত। আর সহানুভূতিতে রিনির মন টসটস করত। জিজু যেদিন তার বিয়ের কথা বলল, তার স্ত্রীর সঙ্গে জিজুর জীবন যাপনের কথা বলল, জিজুর ছেলেমেয়ের কথা বলল, সেদিন রিনি খুব মুষড়ে পড়েছিল। জিজুর স্ত্রী দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে, এ কথা শুনেও রিনি জিজুর স্ত্রীর প্রতি কোনও সমবেদনা বোধ করেনি। জিজুর প্রতি অনুকম্পা হয়েছিল তার। সেই রাতেই রিনি, অনেকদিন পরে, জিজুকে তার প্যাকিং বাক্স থেকে তুলে বিছানায় নিয়ে এসেছিল। আর তার মুখে মুখ ঠেকিয়ে চুমু খেতে খেতে বলেছিল, ‘আমি কিছু জানিনে জিজু, তুমি আর কারও নও। তুমি কেবল আমার আমার আমার।’

জিজুও বলত, রিনি, তুমি আমার, আমার, আমার। আমি বিয়ে করেছি, এটা ঠিক রিনি। বয়স কম ছিল। আমি অত কিছু বুঝতাম না। তা ছাড়া তোমার মতো মেয়ে যে এ জগতে আছে, তাও তো জানতাম না। বাড়ির পীড়াপীড়িতে বিয়েটা করে ফেলেছি। নারী দেহ কি, রিনি, সেটাও জেনেছি। কিন্তু ভালবাসা কি, সেটা তুমিই আমাকে জানিয়েছ রিনি। আমি তোমাকে ছাড়তে পারব না। আবার আমার বউয়ের প্রতি আমার যে দায়িত্ব আছে, সেটাও আমি ছাড়তে পারব না। আমি ছাড়া ওর আর কেউই নেই রিনি। ও এখন ভাল করে চলতেও পারে না।

এই চাপের মুখে পড়ে রিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। রিনি অস্থির হয়ে উঠেছিল। সে জ্বলছিল, পুড়ছিল। রোজ রাতে জিজুকে বলেছিল, ‘তুমি আমার, আমারই জিজু। তুমি আর কারও নও। কেউ তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না জিজু। কেউ না, কেউ না। সে মরবে জিজু; তুমি ভেবো না, সে মরবে। তুমি আমারই হবে। আমারই হবে।’

এই রিনিকে ভালই বুঝতে পারে অমিতা। কেন রিনি দিল্লি ছেড়ে কলকাতায় তার বাবার কাছে চলে এসেছিল, সেটা বুঝতে পারে অমিতা। কেন রিনি রিনি হয়ে উঠতে চেয়েছিল, সেটা বুঝতে পারে অমিত।। রিনি আসলে জিজুর কাছ থেকেই পালাতে চেয়েছিল। রিনি প্রাণপণে জিজুকে ভুলতে চেয়েছিল। কেন, তাও জানে অমিতা। রিনি, রিনি, রিনি! বেচারি!

রিনি জিজুর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি। কাজ দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু জিজুর চিঠিতে তার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ রিনিকে আবার অস্থিরতার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলেছিল। রিনির দৃঢ় ধারণা হয়েছিল যে, জিজুর স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য রিনিই দায়ী। এই বোধ, একেই বোধ হয় পাপবোধ বলে, তাড়া করে নিয়ে বেড়িয়েছে রিনিকে। তবুও রিনি জিজুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেনি। তখনও রিনি রিনি হয়ে উঠতেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল। কিন্তু রিনির চোখ বাদ সাধল, রিনির অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ পরীক্ষা দেওয়া হল না। রিনির সেই হতাশা অমিতা বেশ বুঝতে পারে। রিনি সিমলার কাছে একটা স্কুলে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল।

রিনি বলেছিল, ‘অমিতা, ভালবাসার কাছ থেকে পালানো অসম্ভব। জিজু, আমার ভালবাসা, আবার আমার কাছেই ফিরে এসেছে। জিজু সেরিব্রাল স্ট্রোকে অথর্ব হয়ে পড়েছিল। তিন বছর আগে আমি এ খবর পাই। আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। জিজুকে আমি আমার কাছেই নিয়ে এসেছি। অনেক চিকিৎসার পর জিজু অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। কিন্তু জিজুর স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। জিজু আমাকে একেবারে ভুলে গিয়েছে, অমিতা। জিজুর ধারণা, আমি ওর স্ত্রী।’

রিনি আর অমিতা আজমল খাঁ মার্কেটের গেটে দাঁড়িয়ে আছে। অমিতা স্পষ্ট দেখতে পেল সেটা।

‘আমার ভয় হয় অমিতা, জিজু পাছে তার স্মৃতিশক্তি ফিরে পায়। আমি জিজুকে নিয়ে দিল্লি আসি চিকিৎসা করাতে। প্রতিবারই আমার ভয় হয়, জিজু বুঝি তার আগের স্মৃতি আবার ফিরে পেল।’

রিনির শেষ কথা, ‘আমি জানি অমিতা, জিজু তার স্মৃতি ফিরে পেলে আমাকে ঘৃণা করবে। আমার কেমন মনে হয়, জিজু বোধ হয় জানতে পেরেছিল, আমি ওর স্ত্রীর মৃত্যু চেয়েছিলাম। না হলে আমাকে জিজু তার স্ত্রীর মৃত্যুর খবর দিল কেন? তোমার কি মনে হয় অমিতা, জিজু কি তার স্মৃতিশক্তি ফিরে পাবে? ফিরে পাবে।’

৪৯

যে যা চায়, কখনও কখনও সে তা পায়ও। কিন্তু যেমন করে চায়, তেমন করে পায় না। জীবনের এই হল বড় ট্র্যাজেডি। রিনির কথা মনে পড়লেই অমিতার এই ট্র্যাজেডির কথাটাই মড়ে পড়ে। রিনি তার জিজুকে চেয়েছিল, রিনি তার জিজুকে পেয়েও ছিল। কিন্তু যেমন করে রিনি তার জিজুকে চেয়েছিল, তেমন করে তো জিজুকে পায়নি। কেন এমন হয়?

জিন্না পাকিস্তান চেয়েছিলেন, জিন্না পাকিস্তান পেয়েছিলেন। মুসলমানদের একটা অংশ, বড় অংশই, পাকিস্তান চেয়েছিল। ভেবেছিল সেটা হবে তাদের পবিত্র স্থান। যাঁরা পাকিস্তান চেয়েছিলেন, তাঁরা পাকিস্তান পেয়েও গেলেন। কিন্তু যে পাকিস্তান তাঁরা কামনা করেছিলেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তাঁরা দেখেছিলেন, সেই পাকিস্তান কি তাঁরা পেলেন?

কেন এমন হয়? কেন এমন স্বপ্ন ভঙ্গ হয়? অমিতার মনে প্রশ্নগুলো ওঠে। কিন্তু কোনও উত্তর পায় না সে। মাঝে মাঝে সে উদাস হয়ে যায়। কত ঘটনাই না ঘটে গেল অমিতার জীবনে। একটা ঘটনার উপরেও কি তার নিয়ন্ত্রণ ছিল? মানুষ নিজেই তার ভাগ্য গড়ে নেবে, এই মতেই তো বিশ্বাস করত অমিতা!

সেই বিশ্বাসে ভর করেই না একদিন শামিম আর সে স্বপ্ন দেখেছিল, তাদের ভালবাসার জোরেই তারা একদিন দেশের লোকের মন থেকে ঘৃণা বিদ্বেষ দূর করে দিতে পারবে। প্রতিবেশীর মনে প্রতিবেশীর প্রতি ভালবাসা জাগিয়ে তুলতে পারবে। কি ছেলেমানুষ, কি ছেলেমানুষই না তখন তোমরা ছিলে!

‘হিন্দুর জন্য যদি হিন্দুস্থান আর মুসলমানের জন্য যদি পাকিস্তান, দেশটা যদি এই ভাবে ভাগ হয়ে যায় ফুলকি, তাহলে আমাদের জায়গা কোথায় হবে? আমরা তো হিন্দু নই, মুসলমানও নই, আমরা মানুষ ফুলকি। দেশটা যদি ধর্মীয় চিহ্নের দ্বারা ভাগ হয়ে যায়, তাহলে? তাহলে যারা ভাবে সমস্ত ধর্মীয় চিহ্নের উপরে আছে মানুষের চিহ্ন, সেই তাদের কোনও ঠাঁই থাকবে না; আমাদের এই দেশে? তাহলে তোমার আর আমার মিলন হবে কোন ভূমিতে?’

এসব শামিমের আর্তি। মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে, অনেক দূর থেকে, কথাগুলো এসে যেন অমিতার বুকে ধাক্কা মারে। না কি ওটা অমিতারই মন থেকে, মনের গভীর তলদেশ থেকে, উঠে আসে? অমিতা সব সময় বুঝতে পারে না!

ফুলকি এখন অনেক দূরে সরে গিয়েছে অমিতার কাছ থেকে। শামিম তো এখন অস্পষ্ট একটা স্মৃতি মাত্র। যা শুধু গভীর যন্ত্রণায় এসে হাজির হয় অমিতার পাশে।

আজমল খাঁ মার্কেটে যেতে যেতে রিনি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত শরণার্থীদের ঝোপড়িগুলোর দিকে আঙুল তুলে দেখিয়েছিল। অমিতা বয়স্ক মেয়েদের চোখে এমন এক ধরনের দৃষ্টি দেখেছিল, যা সে কখনও ভুলতে পারেনি। মেয়েদের কারও চোখে মুখে কোনও দীপ্তি ছিল না। ছিল আতঙ্ক, ছিল উদ্বেগ, ছিল অবিশ্বাস, ছিল অসহায়ত্ব, ছিল অপরিসীম ক্লান্তি। যেন ওরা সকলেই এই মাত্র এক দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছে। সে মুখগুলো এখনও অমিতার স্বপ্নে ভেসে ওঠে।

রিনি বলেছিল, ‘ওরা শরণার্থী অমিতা। ওরা দেশভাগের শিকার।’

কয়েকটা অপুষ্ট মেয়ে রিজের জঙ্গলে এক একটা পুরুষের হাত ধরে ঢুকে যাচ্ছিল।

‘আর ওরা হল’, রিনি বলেছিল, ‘লালসার শিকার। দেশ ভাগেরই বলি।’

রিনি অনেকক্ষণ কথা বলেনি।

তারপর হঠাৎ অমিতাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘কি হয়ে গেল অমিতা?

অমিতা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। ও কি কিছু ভাবছিল তখন?

আনমনেই সে উত্তর দিয়েছিল, কিসের?

রিনি বলেছিল, ‘আমাদের দেশের? আমাদের জীবনের?’

এটা বড় প্রশ্ন রিনি। অমিতা চারধারে রিনিকে খুঁজছিল। এটা বড় শক্ত প্রশ্ন রিনি। উত্তর আমার জানা নেই। রিনি, রিনি! তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?

এই ধরনের প্রশ্নই হরিকিশোরমেসো তায়েবকাকাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন মেডিকেল কলেজের কেবিনে। তায়েবকাকা তখন খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

‘কি হয়ে গেল বল তো তায়েব? কোথায় আমাদের হিসেব ভেস্তে গেল?’

তায়েবকাকা এই আচমকা প্রশ্নে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন বোধ হয়। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ হরিকিশোরমেসোর মুখের দিকে, আবার কিছুক্ষণ অমিতার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

হরিকিশোরমেসো খেইটা ধরিয়ে দিলেন, ‘কেবিনেট মিশন।’

‘ওহ্ কেবিনেট মিশন!’ তায়েবকাকার বিভ্রান্তির রেশটা তখনও কাটেনি। ‘হ্যাঁ কেবিনেট মিশন। কি কেবিনেট মিশন?’

হরিকিশোরমেসা বললেন, ‘তুমি আর সুধাকর তখন তো খানিকটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিলে তায়েব, তাই না?

তায়েবকাকা চুপ করে রইলেন! যেন নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছেন।

‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল তো।

‘হ্যাঁ হরিকিশোর, ওয়ার্কিং কমিটি কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল।’

হরিকিশোরমেসো বললেন, ‘এ আই সি সি, নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও তো সেটা মেনে নিয়েছিল।

‘হ্যাঁ হরিকিশোর, নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিও সেটা মেনেই নিয়েছিল।’

‘মুসলিম লিগ কাউন্সিলও তো কেবিনেট মিশনের ফরমূলা গ্রহণ করেছিল।’

‘হ্যাঁ হরিকিশোর, লিগ কাউন্সিলও সেটা মেনে নিয়েছিল।’ অমিতা দেখল, তায়েবকাকা আবার নিজের মধ্যে ফিরে আসছেন।

‘শুধু কি তাই হরিকিশোর, কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবে গান্ধী সম্মতি দিয়েছিলেন। জিন্নাও সেটা মেনে নিয়েছিলেন।’

‘তবে কেন সেটা ভেস্তে গেল?’

তায়েবকাকা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন।

‘তোর বাবা ফুলকি, তোর বাবা। তোর বাবার উৎসাহ কেমন বেড়ে গিয়েছিল, তোর মনে আছে?’

সব মনে আছে অমিতার। সেই দিনগুলোর কথা সবই মনে আছে তার। মৌলনা আজাদের বিবৃতিটা যেদিন কাগজে বের হল, সেদিন বাবা যেন তাঁর যৌবনের উৎসাহকে আবার ফিরে পেয়েছিলেন।

জনে জনে টেলিফোন করছিলেন বাবা, আর বলছিলেন, ‘মৌলানার বিবৃতিটা দেখছ?

সেদিন বিকাল থেকেই তাদের বাড়িতে লোক আর ধরছিল না। সকলেই উত্তেজিত। কিন্তু বাবার উৎসাহ সব চাইতে বেশি। শুধু শামিমই সে বাড়িতে ছিল না। সে তখন নীলগঞ্জে।

‘এটা নিঃসন্দেহে পজিটিভ্ পদক্ষেপ তায়েব’।’ বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন।

‘আমরা ভেবেছিলাম, কংগ্রেসকে অখণ্ড ভারতের দাবি থেকে নড়ানো যাবে না।

বাবা বলেছিলেন, ‘কিন্তু মৌলানা মাইনরিটির স্বার্থরক্ষার জন্য কংগ্রেসকে সেই পজিশন থেকে সরিয়ে এনেছেন।’

‘আমরা ভেবেছিলাম, জিন্নাকে পাকিস্তানের দাবি থেকেও নড়ানো যাবে না।’

বাবা বলেছিলেন, ‘কিন্তু তিনি যে নড়েছেন, লিগ কাউন্সিলকে দিয়ে কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবকে সমর্থন করিয়ে নেওয়াই তো তার বড় প্রমাণ। নয় কি? মৌলানা তো স্পষ্টই বলেছেন, এই প্রস্তাব মাইনরিটির মন থেকে, বিশেষত মুসলমানদের মন থেকে, ভয় দূর করতে পারবে।’

বাবা তায়েবকাকাকে বলেছিলেন, ‘তুমি মৌলানার বিবৃতির ওই জায়গাগুলো পড়ে শোনাও না তায়েব।’

তায়েবকাকা বাবার রকম দেখে হাসছিলেন।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সেই বিবৃতিটা সত্যিই একটা ঐতিহাসিক বিবৃতি ছিল ফুলকি। লিগ নেতারা যদি সেদিন মৌলানার কথাগুলো শোনবার জন্য তাদের কান এবং কথাগুলো বোঝার জন্য তাদের মনকে খোলা রাখতেন, তাহলে আমাদের, মুসলমানদের, এত সর্বনাশ হত না। হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে ব্যবধান ছিল, সেটা বাস্তব। সেটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান তো একের কাছ থেকে অপরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এই ব্যবধানের মধ্যে এক সেতু নির্মাণ করাই ছিল সমাধান। মৌলানা তারই উপর জোর দিয়েছিলেন।’

মৌলানার এই বিবৃতি বাবাদের এতবার পড়া হয়েছে, এই নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে, এক সময় ফুলকির এটা কণ্ঠস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাবা কথায় কথায় তখন এই বিবৃতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে যেতেন। আর না হয় তার বন্ধুদের ডেকে বলতেন, ‘বল না হে, মৌলানা এই জায়গায় কি বলেছেন?’

মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, ‘মুসলিম লিগের পাকিস্তান পরিকল্পনার প্রস্তাবকে আমি সমস্ত সম্ভাব্য দৃষ্টিকোণ থেকে ভেবে দেখেছি। সামগ্রিকভাবে ভারতের ভবিষ্যতের উপর এর নিহিতার্থ কি একজন ভারতীয় হিসাবে আমি সেটারও বিচার করে দেখেছি। এই পরিকল্পনার সমস্ত দিক বিচার করে আমি এই এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, এই পরিকল্পনা সমগ্রভাবে ভারতের পক্ষেই ক্ষতিকর তা নয়, বিশেষভাবে মুসলমানদের পক্ষেও এটা ক্ষতিকর। প্রকৃতপক্ষে এটা সমস্যার যতটুকু সমাধান করবে, তার চাইতে অনেক বেশি সমস্যার সৃষ্টি করবে।’

তায়েবকাকা মৌলনার এই মনে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু বাবা, তুমি বরাবর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে বিশ্বাস করতে। তুমি বলতে, আমরা যাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বলে এসেছি, সেটা প্রকৃতপক্ষে হিন্দুদের আন্দোলন। তার মধ্যে আমরা মুসলমানদের টেনে আনতে পারিনি। এটাই সত্য। এটা আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতা। প্রচণ্ড ব্যর্থতা, ফুলকি।

এই সব মুহূর্তগুলিতে অমিতার মনে হত, বাবার দীর্ঘশ্বাস যেন তার সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। অমিতার মনে হত, সেই দীর্ঘশ্বাস যেন জমাট কুয়াশা হয়ে তাকে ঢেকে রেখেছে।

বাবা বলতেন, ‘শিক্ষিত হিন্দু সব সময়ে দুটো জগতে বাস করেছে। একটা তার ভাবনার জগৎ, আর একটা তার আচার আচরণের জগৎ। তার সংস্কারের জগৎ। তার ভাবনার জগৎটা গড়ে উঠেছিল, খানিকটা উপনিষদের উদার ভাবধারা দিয়ে, আর অনেকটাই ইওরোপের মানবতাবাদী চিন্তা ভাবনায় পরিপুষ্ট হয়ে। এটা শিক্ষিত হিন্দুর প্লাস পয়েন্ট। আবার এটাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে মনু-রঘুনন্দনের সমাজব্যবস্থার কঠোর ভেদনীতি। এটাই হল হিন্দু আজন্ম লালিত সংস্কার। যে সংস্কার মানুষকে মানুষের মূল্যে গ্রহণ করাকে পাপ বলে মনে করে। স্বীকার করে যে, মানুষের মূল্য স্থির হবে তার জন্মগত অবস্থান দিয়ে। যে ব্রাহ্মণ কূলে জন্মেছে সে ব্রাহ্মণই থেকে যাবে আর যে শূদ্রের ঘরে জন্মেছে সে শূদ্রই থেকে যাবে। সে অস্পৃশ্য। শিক্ষিত হিন্দু এই সংস্কারের নাগপাশে আজও বন্দি হয়ে আছে। এই কাঠামোতে জাতীয়তাবাদ দাঁড়াতে পারে না। জাতীয়তাবোধ জন্মই নিতে পারে না। আমাদের জাতীয়তাবাদী নেতারা এই হিন্দু সংস্কারকে নির্মূল করতে পারেননি। হিন্দু সমাজের ভেদনীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোটাকে ভেঙে চুরমার করতে পারেননি। কেউ তেমন করে ধাক্কাই দিতে পারেননি। এমন কি গান্ধীও না। গান্ধীও না।

বাবা তুমি একদিন বলেছিলে, নেতাদের যেমন দুই প্রস্থ পোশাক, একটা মিটিং কা কাপড়া আর একটা ঘর কা কাপড়া, তেমনি আমাদের শিক্ষিত হিন্দুদের দুটো মন। একটা তার ভাবনা ধারণার মন আরেকটা তার সামাজিক আচার আচরণের মন। আর এই দুইয়ে কোথাও মিল নেই। আমাদের জাতীয়তাবোধ আমরা যে গড়ে তুলতে পারিনি, এটাই তা মূল কারণ।

‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক যারা তারা হিন্দু সমাজের এই ভেদনীতির শিকার। তারা হিন্দু সমাজের ঘৃণার শিকার। এই ঘৃণা হিন্দু মনের এমন গভীরে বাসা বেঁধে আছে যে, অধিকাংশ হিন্দু এ সম্পর্কে সচেতনই নয়। এ সম্পর্কে তাই কোনও পাপবোধও নেই তাদের মনে।

তোমাকেও বাবা এই দুটো মনই সারা জীবন টেনে নিয়ে গিয়েছে। নয় কি? অমিতা এই কথাটা বাবাকে জিজাসা করতে চেয়েছিল। পারেনি।

‘সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আমরা চেয়েছিলাম এই কারণে।’

কিন্তু সেটা কি পাকিস্তান, বাবা?

‘পাকিস্তান আমার কাছে এক প্রতীক ছিল ফুলকি।’

‘আমাকে স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, পাকিস্তান এই শব্দটাই আমার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যায়। মৌলানা আজাদ বলেছিলেন। ‘এই শব্দটি নির্দেশ করে যে, পৃথিবীর কিছু অংশ পবিত্র যখন অন্য অংশগুলি অপবিত্র। অঞ্চলকে এই ধরনের পবিত্র এবং অপবিত্র খণ্ডে ভাগ করা ইসলামের আদর্শ বিরোধী। গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদই মানুষকে এবং দেশকে পবিত্র এবং অপবিত্র ভাগে ভাগ করে। এটা ইসলামের মূল সত্তাকেই অস্বীকার করে। ইসলাম এই বিভাগকে মানে না। পয়গম্বর বলেছেন, ঈশ্বর সমস্ত পৃথিবীকে আমার জন্য মসজিদ হিসাবে তৈরি করেছেন।’

‘মৌলানা আজাদের মোদ্দা কথা এই ছিল হরিকিশোর যে, ইসলামি তত্ত্বের দিক থেকে পাকিস্তান ছিল অসিদ্ধ। এবং বাস্তব অবস্থার দিক থেকে পাকিস্তান প্রস্তাব ছিল মুসলমানদের পক্ষে ক্ষতিকর। সেই কারণেই মৌলানা পাকিস্তান মেনে নেননি। তাই বলে মৌলানা আজাদ মুসলিমের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিকে খারিজ করেননি। এই দাবিকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন।

অমিতা তায়েবকাকার কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিল।

‘ভারতও মুসলমানদের পিতৃপুরুষেরই দেশ। হাজার বছর ধরে মুসলমান এখানে তার স্বাতন্ত্র্য যেমন বজায় রেখেছে তেমনি শিল্পে সাহিত্যে সঙ্গীতে স্থাপত্যে সমাজ বিন্যাসে তার দানও প্রচুর। আর আমাদের জীবনের সঙ্গে এগুলো এমনভাবে মিলে মিশে আছে যে শত চেষ্টা করলওে এটাকে আর আলাদা করা যাবে না। আমরা কেউ জন্মেছি হিন্দুর ঘরে, কেউ জন্মেছি মুসলমানের ঘরে, কিন্তু জন্মাবার পর থেকে যে সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে হিন্দু বৌদ্ধ জৈন মুসলমান খ্রিস্টানের মিলিত সাধনা। এটাই ভারতের সাধনা ফুলকি। এটাই ভারতের সংস্কৃতি। সেই কারণেই আমরা যে ঘরেই জন্মাই না কেন, হিন্দুর ঘরেই হোক আর মুসলমানের ঘরেই হোক, আমরা মরব ভারতীয় হয়েই।’

হরিকিশোরমেসো বলে উঠলেন, ‘এটা তো সুধাকরের কথা।’

‘এটাই আসল কথা হরিকিশোর। এটাই মূল কথা। কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলে এই কথাটা কি কারও মনে ছিল?’

মৌলানা আজাদ বলেছিলেন, ‘আমার কাছে যা আমার পিতৃপুরুষের তা ছেড়ে যাওয়া এবং মাত্র তার এক টুকরো অংশ নিয়ে বেঁচে থাকা ভীরুতার স্পষ্ট লক্ষণ বলে মনে হয়।’

মৌলানা বলেছিলেন, ‘ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখা যাক, আমরা যদি পাকিস্তান পরিকল্পনাকে রূপ দিতে যাই, তার ফলাফল কি হবে? ভারত দুটো রাষ্ট্রে বিভক্ত হবে। একটা রাষ্ট্র হবে মুসলমানের, অন্য রাষ্ট্র হবে হিন্দুর। হিন্দুস্থান রাষ্ট্রে সাড়ে তিন কোটি মুসলমান ছোট ছোট গোষ্ঠী হয়ে ছড়িয়ে থাকবে। যুক্ত প্রদেশ ১৭ শতাংশ, বিহারে ১২ শতাংশ এবং মাদ্রাজে ৯ শতাংশ। আজ হিন্দু মেজরিটি প্রদেশে তারা যেভাবে আছে তখন তার চাইতেও দুর্বল হয়ে পড়বে। প্রায় এক হাজার বছর ধরে তারা এই সব জায়গায় তাদের বসতি বানিয়ে আছে। এই সব জায়গায় তারা মুসলিম সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিখ্যাত সব কেন্দ্র স্থাপন করেছে।

‘একদিন ঘুম ভেঙে উঠে দেখবে তারা পর হয়ে গিয়েছে, তারা বিদেশী হয়ে গিয়েছে। শিল্পের দিক দিয়ে, শিক্ষার দিক দিয়ে, আর্থিক দিক দিয়ে পশ্চাৎপদ এই সব মুসলমানকে তখন নির্ভেজাল হিন্দুরাজের দয়ার উপর বেঁচে থাকতে হবে।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মৌলানার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছে হরিকিশোর। হাজার হাজার গ্রামে গঞ্জে শহরে, মহল্লায় মহল্লায়, পাড়ায় পাড়ায় হিন্দু মুসলমান একত্র বাস করছে ভারতে, ভাগ কেেরা বললেই কি তাদের ভাগ করা যায়?’

‘কিন্তু তবু তো ভাগ হল তায়েব। এই সর্বনাশকে রোখা তো গেল না!’

‘না গেল না।’

‘কিন্তু কেন? কেন রোখা গেল না তায়েব?’

‘সুধাকর কি বলত মনে আছে? সুধাকর বলত, ঘৃণা আর অবিশ্বাস, এই দুই শত্রুই আমাদের আলাদা করে রেখেছে। কথাটা সত্যি হরিকিশোর। এই দুই শত্রু আমাদের চোখের আড়ালে, আমাদের মনে, থাকে সংগোপনে, তাই সময় থাকতে এদের চিনতে পারিনে। অবশ্য আরও একটা শত্রু তখন আমাদের তাড়া করে ফিরছিল।’

‘সেটা কি?’

‘ভয় হরিকিশোর ভয়।’

‘কিসের ভয়?’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মুসলমানদের মনে এই ভয়টা ঢুকে গিয়েছিল যে, ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে গেলে তাদের হিন্দুদের অধীনে থাকতে হবে। আর হিন্দু আধিপত্য থাকা মানেই ইসলামের সর্বনাশ হওয়া। ইসলামের সর্বনাশ হবে, এই ধুয়ো উঠলেই মুসলমানের বিচার বুদ্ধি গুলিয়ে যায়। তারা ল্যাজ তুলে দেখতেও চায় না যে, এর পিছনে সত্য আছে কি না? জিন্না ইসলাম নিয়ে আদপেই মাথা ঘামাতেন না। তিনি ছিলেন এ যুগের মেকিয়াভেলি। ব্রিটিশ চলে গেলে ভারতে ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়বে, এই অলীক ভয়টা তিনি তাঁর রাজনৈতিক কৌশল হিসাবেই মুসলমানের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। এবং বাজিমাৎ করেছিলেন।

তায়েবকাকার গলা ভারি হয়ে এসেছিল।

‘হিন্দু মনেও ভয়; ঢুকেছিল! হরিকিশোর। প্যান্ ইসলামের ভয়। পাকিস্তান দাবির পিছনে হিন্দুরা প্যান্ ইসলামের জুজু দেখতে পেয়েছিল। এটাও অলীক ভয়। মৌলানা আজাদও বলেছিলেন, এই তর্ক উঠতেই পারে, যদি পাকিস্তান মুসলমানদেরই স্বার্থের এতখানি প্রতিকূল, তাহলে মুসলমানদের এত বড় একটা অংশ কি করে এই ভাবনার দ্বারা এতখানি প্রভাবিত হল? এর উত্তর পাওয়া যাবে হিন্দুদের মধ্যে কিছু উগ্রপন্থীদের আচরণে। যখন মুসলিম লিগ পাকিস্তানের দাবি তুলতে লাগল তখন তারা এর পিছনে এক অশরীরী প্যান্ ইসলামিক্ ষড়যন্ত্রের আভাস দেখতে পেল। এবং এই ভয় থেকেই তারা এমন তারস্বরে এর প্রতিবাদ শুরু করল, যেন এটা ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে বর্হিভারতের মুসলিম জগতের গাঁটছড়া বাঁধার সূচনা। এই বিরোধিতাই লিগ সমর্থকদের হাতে তুরুপের তাস তুলে দিল। লিগ নেতারা সরল কিন্তু দৃঢ় যুক্তি দিয়ে মুসলমানদের এক অংশকে এটাই বোঝাতে সমর্থ হলেন যে, যখন হিন্দুরা পাকিস্তানের এত বিরোধিতা করছে তখন নিশ্চয়ই এতে মুসলমানদের উপকার হবে। মানসিক উত্তেজনার এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা হল যেখানে যুক্তবাদী ভাবনা একেবারেই তলিয়ে গেল।’

সেদিনের কথা মনে পড়ে অমিতার। তার বাবার মুখটাও সে মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু সে মুখটা কেবলই ঝাপসা হয়ে ওঠে।

তুমি কি সেই দিনই এ কথা বলেছিলে বাবা? না অন্য কোনও দিনে? তুমি বলেছিলে, মৌলানা আজাদ ঠিকই বলেছেন। কিন্তু এই ভয়টা শুধু মাত্র কিছু সাম্প্রদায়িক উগ্রপন্থী হিন্দুদের ভয় ছিল না, সাধারণ ভাবে হিন্দু মাত্রেই এই ভয়ে ভুগত। ভারতে হাঁড়ি আর জলের কলসির পবিত্রতা রক্ষার জন্যই যাদের ইহ জীবনের সকল কর্ম ফুরিয়ে যায় তারা সদাসন্ত্রস্ত থাকবে না তো আর কি করবে? এই কারণেই তাদের বোঝাতে পারা যায় না যে, প্রায় হাজার বছর ধরে মুসলমান শাসনে থাকা সত্ত্বেও হিন্দু যখন মেজরিটি খোয়ায়নি, তখন এখনও তা খোয়াবে না।

তুমি কি সেই দিনই এই কথা বলেছিলে বাবা?

বাবার কাছ থেকে কোনও উত্তর এল না। তবে তায়েবকাকার গলা শোনা যেতে লাগল।

মৌলানা বলেছিলেন যে, ‘আমার অবশ্য এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই যে, যখন বর্তমান উত্তেজনার কাল কেটে যাবে তখন এই প্রশ্নকে আবেগবর্জিত ভাবে বিচার করা যাবে এবং যারা আজ পাকিস্তানকে সমর্থন করছে তারাই একে মুসলমান স্বার্থের বিরোধী হিসাবে ত্যাগ করবে।’

মৌলানা বলেছিলেন, ‘কংগ্রেসকে আমি যে সূত্র গ্রহণ করাতে সক্ষম হয়েছি, সেই সূত্রে পাকিস্তান তত্ত্বের যা কিছু ভাল তার সবই রয়েছে কিন্তু এই তত্ত্বের সমস্ত ভুল ত্রুটি বর্জন করা হয়েছে। পাকিস্তান পরিকল্পনার মূল ভিত্তি হল, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে কেন্দ্রের নাক গলানোর ভয় কারণ কেন্দ্রে হিন্দুরাই মেজরিটি হবে। কংগ্রেস তাদের এই ভয় দূর করতে সমস্ত প্রাদেশিক ইউনিটকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষমতা দেবে এবং সমস্ত রেসিডিউয়ারি ক্ষমতা প্রাদেশিক ইউনিটের হাতে সমর্পণ করা হবে। তাছাড়া কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি সম্বন্ধেও দুটো তালিকা প্রস্তুত করা হবে, একটি আবশ্যিক অন্যটি ঐচ্ছিক। যদি কোনও প্রাদেশিক ইউনিট চায় তবে সামান্য কিছু ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে দিয়ে সমস্ত বিষয়ই নিজের শাসনাধীনে রাখতে পারবে। কংগ্রেসের প্রস্তাব, এই ভাবেই, মুসলিম মেজরিটি প্রদেশগুলি যাতে তাদের ইচ্ছে মতো বিকাশ ঘটাতে পারে তার জন্য অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা পাবে, এটা সুনিশ্চিত করেছে। আবার যে বিষয়গুলির উপর সার্বিকভাবে ভারতে মঙ্গলামঙ্গল নির্ভর করবে সেই বিষয়গুলি সম্পর্কেও কেন্দ্রের উপর এরা তাদের প্রভাব ফেলতে পারবে।’

‘মৌলানা সব চাইতে যে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা বলেছিলেন হরিকিশোর সেটা এই।’ তায়েবকাকা একটু সময় নিয়েছিলেন বলতে।

মৌলানা বলেছিলেন, ভারতে এখন যে পরিস্থিতি তাতে এখানে একটা কেন্দ্রীভূত এবং অখণ্ড সরকার গড়ে তোলার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য। তেমনি ভারতকে দুটো রাষ্ট্রে বিভক্ত করার প্রচেষ্টাও সমভাবে ব্যর্থ হবে।’

বাবা বলেছিলেন, ‘মৌলানা আজাদ বিচক্ষণতা দেখিয়েছিলেন। মৌলানার সূত্রে মূল ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশগুলোর হাতে। কেন্দ্রে হত ফেডারেশন। সেই ফেডারেল সরকারের হাতে থাকত শুধু তিনটে ক্ষমতা। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র আর যোগাযোগ।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মৌলানার এই সূত্রের ভিত্তিতেই কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব রচিত হয়েছিল।’

বাবা, তুমি আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলে। তোমার যৌবনকালের স্বপ্নগুলোকে তুমি আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছিলে বাবা। তাই না?

বাবা বলেছিলেন, ‘কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু আর বাংলায় মুসলিম মেজরিটির শাসনই প্রতিষ্ঠিত হত। হিন্দু আধিপত্যে থাকার ভয় মসুলমানদের মন থেকে দূর হত।’

তায়েবকাকা, তোমার মতো সংশয়বাদী লোকও তখন এই কথা ভাবতে শুরু করেছিলে, মুসলমানদের মনে যে অহেতুক ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল, যার জন্য তারা প্রচণ্ড মানসিক উত্তেজনার চাপে ভুগছিল, তাদের বিচার বুদ্ধি তারা হারিয়ে ফেলেছিল, কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে, সেই উত্তেজনার চাপ থেকে মুসলমানদের মন মুক্ত হতে পারবে। তারা স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি আবার ফিরে পাবে। তাই না?

‘শুধু আমি নই ফুলকি, আমি একা নই, আমার মুসলিম লিগের অনেক বন্ধুও কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের মধ্যে তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হবার প্রতিশ্রুতি দেখতে পেয়েছিলেন। তাই লিগ যখন কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছিল তাঁদের মনে স্বস্তির ভাব দেখা দিয়েছিল।

বাবা বলেছিলেন, ‘এখনও আরও দুটো ধাপ আমাদের ওঠা বাকি তায়েব।’

‘হয়ে যাবে, হয়ে যাবে সুধাকর। গ্রুপিং ব্যবস্থা যখন লিগ মেনে নিয়েছে তখন অন্তবর্তী সরকার আর গণপরিষদ গঠনের ব্যাপারেও কংগ্রেস আর লিগের মতানৈক্য হবে বলে মনে হয় না। প্রথম ধাপটাই ছিল সব থেকে কঠিন। মুসলিম লিগের পক্ষে তো বটেই। তাদের পাকিস্তান দাবি ছাড়তে তো হয়েছে। অথচ ওটাই ছিল ওদের কমিউনিস্ট কমিটমেন্ট সুধাকর। সেটা ভুলে যেও না।’

হরিকিশেরমেসো তুমিই উৎসাহভরে সেদিন বাবাদের বৈঠকে এ কথা বলেছিলেন। তুমি সাধারণত শ্রোতা হয়ে থাকতেই ভালবাসতে। কিন্তু সেদিন তোমার উৎসাহ দেখে ফুলকি কিছুটা অবাকই হয়েছিল।

অমিতার চোখে হরিকিশোরমেসোর সৌম্য চেহারাটা ভেসে উঠল। ওঁকে কখনও বিচলিত হতে দেখেনি অমিতা।

‘আমি, তোর বাবা, তায়েব, আমরা সবাই তখন কি পরিমাণ মানসিক চাপে ভুগছিলাম, সেটা তুই আন্দাজ করতে পারবিনে ফুলকি। আমাদের মনে হয়েছিল, দেশভাগের অবধারিত সর্বনাশ আমরা বুঝি এড়াতে পারব না। লিগ যে তার পাকিস্তান দাবি ছেড়ে দিয়ে গ্রুপিং ব্যবস্থা মেনে নেবে, এটা আমি সত্যিই বিশ্বাস করতে পারিনি। বুঝে দেখ, জিন্নার পক্ষে পাকিস্তানের দাবি ছাড়া মানে জিন্নার জিন্নাত্ব শূন্য হয়ে যাওয়া। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তো এগিয়ে এসেছিলেন।’

ওয়ালি সাহেবের কথা এই সময় মনে পড়ে অমিতার। সেই ওয়ালি সাহেব যিনি রসিয়ে রসিয়ে ‘হিন্দু পানি মুসলিম পানি’-র গল্প করেছিলেন। বাবাদের বৈঠকে কমই আসতেন ওয়ালি সাহেব। তিনি ছিলেন গোঁড়া মুসলিম লিগপন্থী। তায়েবকাকার সঙ্গে তুমুল তর্ক বেধে যেত তার।

ওয়ালি সাহেব বলেছিলেন, ‘কি বলব সুধাকরবাবু, যেখানেই গিয়েছি সেইখানেই কি হিন্দু কি মুসলমান, সকলের মধ্যেই একটা উল্লাস আর স্বস্তির ভাব দেখেছি। হিন্দুদের উল্লাসের কারণ বুঝতে পারি। কিন্তু মুসলমানদের এত উল্লাসের কারণ কি, সেটাই আমাকে অবাক করে দিয়েছে। জিন্না গ্রুপিং সিসটেম মেনে নিতে গিয়ে পাকিস্তান দাবিকে স্যাক্রিফাইস করলেন এবং সেটা নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে কোথাও কোনও বিক্ষোভ দেখা দিল না, এটা, সত্যি বলতে কি, আমাকে বিভ্রান্ত করে ছেড়েছে। আমার কেবলই মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের দাবি যদি এতই ঠুনকো ব্যাপার হয়, তাহলে এটা নিয়ে এত জল ঘোলা করা হল কেন? আমি যখন ক্যালকাটা সিটি মুসলিম লিগ আফিস থেকে আসছি। এটাকে আমি মুসলিম লিগের দুর্ভেদ্য দুর্গ বলেই জানতাম। সেখানেও শুনলাম, নেতারা বলাবলি করছেন, গ্রুপিং সিসটেম যত শীঘ্র কার্যকর হয় ততই মঙ্গল।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *