প্রতিবেশী – ২.৪০

৪০

ক্রিপ্‌স্‌ যখন একা এসেছিলেন ভারতে, তখন কি হয়েছিল, অমিতা জানে না। তবে কেবিনেট মিশন যে তাদের বাড়িতে আশা নিরাশার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল, সেটা অমিতা প্রতিদিন টের পেত। বাবা তখন খুবই অস্থিরতায় ভুগছিলেন। একদিন খাবার টেবিলে বসে বাবা তাকেও বলেছিলেন, ‘ফুলকি, এটাই আমাদের লাস্ট চান্স। এবারও যদি আমরা আমাদের মূল প্রশ্ন—হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের প্রশ্নটার সমাধান না করতে পারি, আর কখনও তা পারব না। তার মানে কি; বুঝছিস কিছু?

তুমি অত ভেবো না বাবা। তোমার শরীরটা দিন দিন কি হয়ে উঠছে, সেটা কি দেখতে পাও?

‘তুই কিছুই বুঝতে পারছিসনে ফুলকি। কিছুই দেখতে পাচ্ছিসনে।’ বাবা সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন।

তাদের বাড়িতেও বাবার বন্ধুরা ওই এক বিষয় নিয়েই কথা বলতেন। কেবিনেট মিশন।

সেই বিয়াল্লিশে জাপান যখন ভারতের শিওরে এসে দাঁড়িয়েছিল, গান্ধী সেই তখনই ব্রিটিশকে বলেছিলেন, তোমরা ভারত ছাড়। আমাদের তোমরা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাও। আর সেটা যদি অসম্ভব হয়, তবে আমাদের অরাজকতার হাতে ছেড়ে দাও।

গান্ধী যখন এ কথা বলেছিলেন, তখন জিন্না মুসলিমদের একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াননি। বাংলায় তখনও অনেক মুসলমান নেতা ছিলেন, যাদের প্রভাব তুল্যমূল্য ছিল। যাঁরা তখনও জিন্নাকে কায়েদে আজম বলে স্বীকার করতে বাধ্য হননি। শুধু বাংলাতেই নয়, উত্তর প্রদেশ, পঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু, সব জায়গাতেই তখন জিন্নার বশ্যতা স্বীকার না করার মতো অনেক নেতা ছিলেন। তাঁরা সবাই কংগ্রেসি নন, তাঁরা জাতীয়তাবাদীও নন হয়ত, কিন্তু জিন্নার নেতৃত্বের বিরোধী তাঁরা ছিলেন নিঃসন্দেহে।

‘তুমি সে সময়কার কংগ্রেসের প্রস্তাব বিবৃতি ইত্যাদি পড়েছ তো সুধাকর। তাহলে গান্ধীর ভূমিকা নিয়ে আজ এত বিভ্রান্ত বোধ করছ কেন তুমি? আমার তো মনে হয়, গান্ধী এইটাই ভেবে নিয়েছিলেন, জাপানের ভারতকে আক্রমণ করার কোনও ইচ্ছে নেই। জাপানের শত্রুতা ব্রিটেনের সঙ্গে। কাজেই ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে গেলেই জাপানও তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিজের দেশে ফিরে যাবে। ভারতের সীমান্ত দিয়ে ঢুকবেই না।’ তায়েব বলেছিলেন।

‘চিনের উপর বছরের পর বছর কোন্ উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালিয়েছিল জাপান?’

হরিকিশোরের প্রশ্নে সায় দিলেন তায়েব।

‘সোভিয়েটের শাখালিন দ্বীপপুঞ্জ থেকে আর বর্মা পর্যন্ত এ বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখন জাপানের দখলে। এটা দেখেও কি এ কথা বলা যায় যে, জাপানিরা সুযোগ পেলে ভারতকে দখল করত না। ব্রিটিশ ভারত থেকে চলে গেলে জাপানও তার আগ্রসী রূপ বিসর্জন দিয়ে ফিরে চলে যেত ভারতের সীমান্ত থেকে?’

সুধাকর বলেছিলেন, ‘ঠিক এই কথাই ভেবেছিলেন গান্ধী। কিন্তু কেন? আমি তো এর জবাবই খুঁজে বেড়াচ্ছি।’

‘অবশ্য জওহরলাল বলেছিলেন ফুলকি’ বাবা তাকে একদিন বলেছিলেন, ‘গান্ধী ধরেই নিয়েছিলেন যে, যুদ্ধে জাপান এবং জার্মানি জিতছে। নেহরু এই ব্যাপারে গান্ধীনীতির বিরোধী ছিলেন। পন্থ, সরোজিনী নাইডু, ভুলাভাই, আসফ আলি, নেহরুকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বল্লভভাই রাজেন্দ্রপ্রসাদ ইত্যাদি গান্ধীনীতিকে সমর্থন করেছিলেন। ভারত ছাড়ো প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একমত হতে পারেননি। আসলে কংগ্রেস রাজনীতির দেউলিয়াপনা তখনই প্রকাশ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনিও ঘটনার স্রোতে ভেসে যাওয়াকেই শ্রেয় বলে মনে করলেন।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘বিয়াল্লিশের পর থেকেই গান্ধী আর ভারতীয় রাজনীতিতে থাকলেন না। তিনি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছিলেন ফুলকি। নৈবেদ্যর উপর কাঁটালি কলা থাকে দেখেছিস তো? কংগ্রেসে গান্ধীর পজিশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাই। তোর বাবার উদ্বেগের কারণ ছিল সেইটাই।

অমিতা খুব দুঃখ পেয়েছিল কথাটা শুনে। খুবই কষ্ট হয়েছিল তার। অহিংসা অসহযোগিতা এবং আপস, এই ছিল গান্ধীজির সংগ্রামের পন্থা। আপস অন্যায়ের সঙ্গে নয়, ন্যায়ের পথে পদক্ষেপকে সুদৃঢ় করার জন্যই আপস। এই ছিল গান্ধীর সংগ্রামের পন্থা। সেটাই ছিল গান্ধীর সত্যাগ্রহ। মানুষের মনের পশু ভাবকে দমন করে তার মনে মনুষ্যত্বকে উদ্বোধন করা, মানুষের মনে বিবেককে জাগ্রত করাই ছিল গান্ধীর সাধনা। বাবার মুখে শুনেছে, গান্ধী এর জন্য কত ঝুঁকিই না নিয়েছেন। চৌরিচৌরায় সত্যাগ্রহীরা হিংসাত্মক কাজ করেছিল, এই কারণে গান্ধী একটা প্রায় সফল গণআন্দোলনকে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কেন করেছিলেন সেটা গান্ধী। তাঁর স্বেচ্ছাসেবকেরা, তাঁর অহিংসা সৈনিকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে পড়েছিল, উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল। সেই কারণে। উদ্দেশ্য গান্ধীর কাছে যত গুরুত্ব পেত, উদ্দেশ্যসিদ্ধির পথটাকেও তেমনই গুরুত্ব দিতেন গান্ধী। গান্ধীর শরীরটা পুরুষের হতে পারে, কিন্তু তাঁর হৃদয়টা যে নারীর, সে বিশ্বাস অমিতা ছাড়তে পারেনি। কিন্তু বিয়াল্লিশের গান্ধীর সঙ্গে তাঁর আগের গান্ধীর কোনও মিল খুঁজে পাচ্ছেন না কেন অমিতা? সত্যিই কি গান্ধীর শক্তি ফুরিয়ে এসেছিল। বিয়াল্লিশের গান্ধী কি তবে সেই অর্জুন যিনি পরে গাণ্ডীবে গুণ যোজনা করতেও অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন?

‘বিয়াল্লিশের ভারত ভাড় আন্দোলনে হিংসা এবং নাশকতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং সবই কংগ্রেসের নামে। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে, এটা ছিল কংগ্রেসেরই রণধ্বনি, সেই বিয়াল্লিশের আন্দোলনে। কংগ্রেসের নামেই সেই লাগাম ছাড়া উচ্ছৃঙ্খলতা ছড়িয়ে পড়েছিল এবং কেউ তাকে নিন্দা করেনি। গান্ধীও না। সব দোষ সরকারের দমন নীতির উপর অর্পণ করা হয়েছিল। চৌরিচৌরাতে কিন্তু গান্ধী দনম নীতির উপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকেননি। তিনি আন্দোলন হিংসার পথে ঘুরে যেতেই নিজেই এগিয়ে এসে সেই প্রবল আন্দোলন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ কথা আমাদের মনে রাখা দরকার ফুলকি।’

তায়েবকাকা একটু দম ধরে থেকে বলেছিলেন, ‘সম্পত্তির ক্ষতির কথা আমি বলছিনে ফুলকি। তার চাইতেও বেশি ক্ষতি হয়েছিল মানুষের মনে। হিংসা দ্বেষ আক্রোশ অবিশ্বাস মানুষের মনে সেই যে দৃঢ়ভাবে বাসা বাঁধল, তা আর কোনোদিন নামল না। পরবর্তীকালে যা কিছু উচ্ছৃঙ্খলতার ঘটনা ঘটেছে, সেসবেরই স্যাংশন এসেছে ওই বিয়াল্লিশের আন্দোলন থেকে।

বাবা বলতেন, ‘কংগ্রেস রাজনীতিতে গান্ধীর মুঠি যত আলগা হয়ে পড়তে লাগল, মুসলিম লিগের রাজনীতিতে জিন্নার মুঠি তত শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। ক্রিস্‌ প্রস্তাব যখন এল, তখনও জিন্না তাঁর নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এতটা নিঃসন্দেহে ছিলেন না। তিনি তখনও নেতাই ছিনেল, কিন্তু একমাত্র নেতা হয়ে ওঠেননি। কেবিনেট মিশন যখন ভারতে এলেন পঁয়তাল্লিশে তখন জ্বিন্না মুসলিম লিগের নেতাই শুধু নন, একচ্ছত্র নেতা। কায়েদে আজম। তখন জিন্নাই লিগ। জিন্নার কথাই লিগের কথা।’

ভারতের রাজনৈতিক ছক দ্রুত বদলে যাচ্ছিল। ছেচল্লিশের নির্বাচন মুসলিম লিগকে মুসলমানদের একমাত্র দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। এই নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী মুসলমান বলে যাদের বলা হত, তাঁরা একেবারে মুছে গেলেন যেন।

‘বাংলা আর সিন্ধুতে মুসলিম লিগ সরকার গড়ল। কিন্তু সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না হরিকিশোর। যেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল, পলিটিকসে পোলারাইজেশন। মুসলিম ভোটাররা মুসলিম লিগকে এমনভাবেই ভোট দিল যে, কংগ্রেস কার্যত হিন্দু ভোটারদের পার্টি হয়ে দাঁড়াল। হিন্দু মেজরিটি ছয়টা প্রদেশে কংগ্রেস একচ্ছত্র ক্ষমতা পেয়ে গেল। মুসলিম লিগ ক্ষমতায় এল দুটো প্রদেশে। কিন্তু তাহলে কি হবে? সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লিতে প্রত্যেকটা মুসলিম আসন মুসলিম লিগ তার দখলে এনে ফেলল। এগারোটা প্রদেশের ৫০৯টা মুসলমান আসনের মধ্যে ৪৪২টা আসনই জিতে নিল ১৯৪৬-এর রাজনৈতিক ছবিটা ছিল এই রকম হরিকিশোর। এর তাৎপর্যটা কি বুঝতে পেরেছিলে সেদিন?’

অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন তায়েবকাকা। হরিকিশোরমেসো তায়েবকাকার হাতখানা ধরে বলেছিলেন, ‘একটু শান্ত হও তায়েব। এখন আর কথা বলো না।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আর শ্রোতা পাব কোথায় যে বলব। হাসনু ঢাকায়, পাকিস্তানে। টুকলু লণ্ডনে। সে আসতে চায় না। আছি। ওরা বলে, আপনার উচিত আমাদের কাছে এসে থাকা। আমি কোথায় গিয়ে থাকবো ফুলকি? আমি তো ওদের এনিমি। হা হা হা।’

ওয়াহেদ করাচিতে হরিকিশোর, আমি ওদের বাপ, এখানে পড়ে

‘তোর বাবা, তায়েরকাকা আকেরদিন বলেছিলেন, ‘তোর বাবা কেবিনেট মিশনের উপর শেষ ভরসা রেখেছিল। দেখিসনি, প্রতিদিন কেমন উদ্বেগের মধ্যে থাকত?’

বাবার সে উদ্বেগের কোনও উপশম ছিল না। অমিতার মনে পড়ল। ফুলকিরই কি ছিল? শামিম জানিয়েছিল সে আসছে কলকাতায়। সেই খবরে ফুলকির অস্থিরতা একটু একটু করে বাড়ছিল। এবার তবু রিনি ছিল। যদিও রিনির সঙ্গে পারতপক্ষে শামিমের কথা আলোচনা করত না। পড়ায় মন বসাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল সে। কিন্তু মনের উপর ফুলকি কিছুতেই রাশটা টানতে পারছিল না।

বাবা বলেছিলেন, ‘কেবিনেট মিশন সফল হতে পারে তখনই যখন কংগ্রেস আর লিগ নেতারা একে অপরের কথা বিশ্বাস করছেন এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। না হলে কিছুই হবে না।

‘তোর বাবা বলতেন, তায়ের এইটেই আমাদের শেষ সুযোগ। এই সুযোগটা আমরা যদি কাজে লাগাতে পারি, তবে আমরা একটা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারব। একটা দেশ সম্পূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে বিদেশি শাসকের কাছ থেকে নিজের হাতে শাসনব্যবস্থা নিয়ে নেবে। আর এটা যদি আমরা ভণ্ডুল করে ফেলি তাহলে যে সর্বনাশ ঘটবে তার সীমা পরিসীমা নেই।’

কেবিনেট মিশনের আলাপ আলোচনার প্রতিটি খুঁটিনাটি বাবা তখন লক্ষ করে যাচ্ছেন। এটা ফুলকি খেয়াল করেছিল। এটা সেই সময় যখন নীলগঞ্জ থেকে শামিমের চিঠি আসত। চিঠিগুলো থাকত হতাশায় ভরা। নীলগঞ্জে থাকার সময় পাকিস্তানের দাবি যে উগ্রতা নিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, শামিম তাতেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। শামিম ফুলকিকে লিখেছিল, জিন্না যে পাকিস্তান চেয়েছিলেন, হাসেম যে পাকিস্তান চাইছেন, তার সঙ্গে মোল্লাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বশীভূত নীলগঞ্জের এই সরল মুসলমানদের দাবির কোনও মিল নেই ফুলকি। এদের পাকিস্তান মানে শরিয়তের বিধান। এদের পাকিস্তান মানে ইসলামের পুরাতন গৌরবে ফিরে যাবার এক অলীক স্বপ্ন। হিন্দুদের কাছে থেকে যে অপমান যে অবিচার, এরা মুসলমান বলে পেয়েছে, তারই কড়ায় ক্রান্তিতে শোধ করার হাতিয়ারই হচ্ছে এদের পাকিস্তান। এরা আর কিছু বোঝে না। শামিমের চিঠিতে এই ধরনের কথা থাকত সে সময়। ফুলকির উদ্বেগ, তার উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিত। ফুলকি সর্বদাই অস্থিরতার মধ্যে থাকত।

বাবাও তখন অস্থির হয়ে উঠছেন। শরৎবাবু সে সময় সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেমব্লির বিরোধী নেতা। অর্থাৎ কংগ্রেসের নেতা। কিন্তু কেবিনেট মিশনের সঙ্গে আলাপ আলোচনার কোনও পর্যায়েই শরৎবাবুকে ডাকা হয়নি, কোনও পর্যায়েই তাঁর সঙ্গে কোনও পরামর্শ করা হয়নি। সরকারিভাবে তিনি তো বিরোধী নেতা।

যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সরকার বিরোধী নেতার পরামর্শ গ্রহণ করবেন, এটাই তো গণতান্ত্রিক প্রথা। গণতন্ত্রের এটা একটা বড় শর্তও বটে। ‘কিন্তু কি হয়েছিল জানিস ফুলকি, শরৎবাবুকে কংগ্রেস নেতারাই যে শুধু অগ্রাহ্য করেছেন তা নয়, সরকারও তাঁকে কোনও পাত্তা দেননি।

‘শুধু কংগ্রেস কেন তায়েব, হরিকিশোমেসো বলেছিলেন, ‘মুসলিম লিগও কেবিনেট আলোচনার কালে বাংলার লিগ নেতাদেরকে কোনও পাত্তা দেয়নি।’

‘লিগ কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে তাঁরা তখন মতামত দিতেন।’

‘তাতে কি কিছু বোঝা যায়? শরৎবাবুকেও তো কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে নেওয়া হয়েছিল। তাতে তাঁর বা বাংলার গুরুত্ব কি কিছু বেড়েছিল?’

‘কিছু মাত্র না। যে বাংলা ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লিগকে পায়ের নিচে শক্ত মাটি দিয়েছিল, সেই বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুসলিম নেতা নাজিমুদ্দিনের জিন্নার হাতে কী হাল হয়েছিল মনে আছে হরিকিশোর? ইন্টারিম্ গভর্নমেন্টে মন্ত্রী করা হবে বলে নাজিমুদ্দিনকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জিন্নারই নির্দেশে। কিন্তু জিন্না তাঁর সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিলেন, বাড়ির চাকরের সঙ্গেই কেবল লোকে সেই ধরনের ব্যবহার করে থাকে। জিন্না নাজিমুদ্দিনকে ইন্টারিম গভর্নমেন্ট মন্ত্রী তো করেনইনি, কথাও বলেননি।’

‘দেশবন্ধু যতদিন ছিলেন, সুরেন বাড়ুজ্যে যতদিন ছিলেন, ততদিনই সর্বভারতীয় রাজনীতিতে বাংলার গুরুত্ব ছিল। ওঁরাও গত হয়েছেন, আর বাংলাও সর্বভারতীয় রাজনীতির তল্পিবাহক হয়ে উঠেছে।’

‘আমি একটু অন্য কথা বলব হরিকিশোর। তুমি হয়ত আমাকে প্রাদেশিক বলতেও পারো তার জন্য। আমি কিছু মনে করব না। আমার মনে অন্য রকম চিন্তা হয়। দেখ হরিকিশোর, বাঙ্গালি, কি হিন্দু কি মুসলমান, যতদিন বাঙ্গালি সত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছে, ততদিনই বাংলা ভারতের লিডার হতে পেরেছিল। ততদিনই আমরা দেশবন্ধু সুরেন বাঁড়জ্যর মতো লিডার পেয়েছিল, ফজলুল হকের মতো লিডার পেয়েছি। বাঙ্গালি তখন আগে বাঙ্গালি ছিল, পরে অন্য কিছু। বাঙ্গালি হিন্দু আগে বাঙ্গালি পরে ভারতীয় ছিল, বাঙ্গালি মুসলমান আগে বাঙ্গালি পরে ভারতীয় ছিল। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর থেকে একটা পরিবর্তন বাঙ্গালিদের মধ্যে দেখা দিতে লাগল। বাঙ্গালি হিন্দু ভারতের হিন্দু সত্তার মাঝে নিজের সত্তাকে বিলীন করে দিতে লাগল। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় বাঙ্গালি মুসলমানও পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ল।

‘সুধাকর বলত, ‘পোলারাইজেশন।’ হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন।

‘হ্যাঁ হরিকিশোর, সুধাকর ঠিক বলত, হিন্দু মুসলমানে একটা পোলারাইজেশন হতে শুরু করেছিল। বঙ্গভঙ্গের আগেও বাংলায় হিন্দু-মুসলমানে বিরোধ ছিল। কিন্তু আবার এক ধরনের মিলমিশও ছিল। হিন্দু-মন মুসলমান-মনের মধ্যে এ ভাবে পাঁচিল উঠে যায়নি। বঙ্গভঙ্গের পরে পাঁচিলটা ক্রমশ উঁচু হতে লাগল, সেটা বলি। উনিশ শতকের শেষে, এই শতকের প্রথম দিকেও হিন্দু কবি সাহিত্যিক পলিটিক্যাল নেতারা বাংলার বৈশিষ্ট্য, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার স্বাতন্ত্র্য, বাংলার জল, বাংলার ফল, বাংলার মাটি এই সব কথা গানে গল্পে বক্তৃতায় চমৎকার ফুটিয়ে তুলতেন। তুলতেন না?’

‘তুলতেন বই কি তায়েব। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি। এ সব তো আমরা গাইতাম আমাদের যৌবনে।’

‘এ সবকে কি বলবে হরিকিশোর, এ সব কি বাঙ্গালি সত্তারই প্রকাশ নয়?’

‘এ সব কথা যাঁরা বলতেন তাঁরা কি শুধুই বাঙ্গালি ছিলেন? তাঁরা কি ভারতীয় ছিলেন না? হ্যাঁ ছিলেন। তবে তাঁরা আগে বাঙ্গালি, পরে ভারতীয় ছিলেন। এটাই মানুষের স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব হরিকিশোর।’

তায়েবকাকা দম নিয়ে বলে চললেন, ‘কিন্তু যেদিন পরিষ্কার হয়ে গেল যে, ভোটের অধিকার সম্প্রসারিত হয়েছে, এখন গণতন্ত্র মানেই মেজরিটি রুল এবং বাংলায় মুসলমানই মেজরিটি, তাই বাংলার রাষ্ট্রশাসন ক্ষমতা মুসলমানদের হাতেই চলে যাবে। লক্ষ করে দেখ হরিকিশোর, সেই দিন থেকেই বাংলার হিন্দু নেতাদের মুখের বুলি বদলাতে থাকল। বাংলার জল বাংলার ফল বাংলাতেই থাকল বটে, কিন্তু মুখের বুলি বদলে যেতে লাগল। ভারতীয় জাতির কথা শোনা যেতে লাগল, ভবারতীয় কৃষ্টির কথা শোনা যেতে লাগল, এমনকি আর্য সভ্যতার কথাও শোনা যেতে লাগল। ভারত আমার ভারত আমার যেখানে মানব মেলিল নেত্র, মহিমার তুমি জন্মভূমি মা, এশিয়ার তুমি তীর্থক্ষেত্র। এইভাবে ভারত বন্দনা শুরু হল। লক্ষ করেছ কি না হরিকিশোর, সেদিন থেকে কন্ঠে আর তেমন করে বাজছে না, বঙ্গ আমার জননী আমার ধাত্রী আমার আমার দেশ। বাজলেও স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে সুর। এর মানে কি?’

আবার খনিকটা দম নিয়ে তায়েরকাকা বলেছিলেন, ‘এর মানে একটাই। বাংলার হিন্দুরা যখন বুঝতে পারলেন স্বশাসিত বা স্বাধীন বাংলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় হিন্দু মাইনরিটি হয়ে পড়বে, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার বিপন্ন হয়ে পড়বে, সেই দিন থেকেই বাংলার হিন্দু নেতাদের মন বুদ্ধি সবই বাংলার মুসলিম মেজরিটির আওতা থেকে নিখিল ভারতীয় হিন্দু মেজরিটি আশ্রয়ে চলে গেল। ভয় হরিকিশোর, ভয়।’

৪১

অমিতা স্বপ্ন দেখছিল। সে ট্রেনে বসে আছে। সে অন্ধকারে বসে আছে। কেউ একজন ছিল তার পাশে। কে? সে মনে করতে পারল না। ঘোর অন্ধকার। ট্রেনটার কোথাও এক ফোঁটা আলো নেই। অমিতা যেখানে বসেছিল সেখানে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। ট্রেন কি চলছে? ঠাহর করতে পারল না অমিতা। ট্রেন কি দাঁড়িয়ে আছে? ঠিক বুঝতে পারছিল না সে। লম্বা জার্নিতে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চট করে বোঝা যায় না, ট্রেনখানা নড়ছে কি দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তেমন একটা অনুভব তার হচ্ছিল। তার মনে হল, এই ট্রেন কোথায় এখন দাঁড়িয়ে? এটা কি কোনও জংশন? এটা কি নৈহাটি? এটা কি ব্যান্ডেল? এটা কি বর্ধমান? অমিতা জানবার জন্য জানালা দিয়ে উঁকি দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু বুঝতে পারল না, তার পাশে বা সামনে কোনও জানালা আছে কি না! অন্ধকার এতই গাঢ় যে কিছু ঠাহর করা সম্ভব হচ্ছিল না তার পক্ষে।

যেটা সে বুঝতে পারছিল তা এই যে, কেউ একজন তার পাশে এতক্ষণ বসেছিল। কতক্ষণ? কতক্ষণ?

কতক্ষণ বসেছিল সে? কে? কেউ একজন তোমার পাশে এতক্ষণ বসেছিল অমিতা। যার অস্তিত্ব তুমি তোমার অনুভব দিয়ে স্পর্শ করছিলে।

হ্যাঁ, সে এখন কোথায় গেল? না কি সে আছে এখনও? অন্ধকারে তাকে টের পাওয়া যাচ্ছে না।

হয়ত সে অন্ধকারের ওপারেই আছে।

অন্ধকার ক্রমে লম্বা হতে লাগল। তার মানে ট্রেন চলতে শুরু করেছে? অমিতা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে জানালা দিয়ে তাকাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু জানালাটাই খুঁজে পাচ্ছে না তো সে। অমিতার হঠাৎ মনে হতে লাগল, ও-ধারের প্ল্যাটফর্মে আরেকটা গাড়ি নিশ্চয়ই দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশের লোকটা এই অন্ধকারে সেই গাড়িতেই উঠে পড়েনি তো?

ট্রেনটা একটা ধাক্কা দিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে থেমে পড়ল। অমিতার মনে হল তার পাশের জায়গাটা তখনও খালি। তার মানে সে উঠতে পারেনি তার কামরায়। উঠতে পারেনি, না ওঠেনি? পানি পাঁড়ের কাছে কি জল খেতে গিয়েছে লোকটা?

‘হিন্দু পানি, মুসলিম পানি
‘হিন্দু পানি, মুসলিম পানি।’

হিন্দু পানি হিন্দুদের জন্য, মুসলিম পানি মুসলমানদের জন্য। বেশ ছোটবেলায় অমিতারা একবার কাশী গিয়েছিল। তখন বিভিন্ন স্টেশনে ‘হিন্দু পানি’, ‘মুসলিম পানি’, হিন্দি পানি’ ‘মুসলিম পানি’, অমিতা দেখেছিল হাঁক পেড়ে পেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

‘জলকে পর্যন্ত যে দেশে এত সহজে হিন্দু পানিতে আর মুসলিম পানিতে ভাগ করে ফেলে মানুষ, এটাই যে দেশের ঐতিহ্য তায়েব, সেই দেশে আমরা সেকুলারিজমের বীজ পুঁততে চাইছি। কী অসম্ভব শক্ত কাজ!’ তায়েবকাকা মোতি শীল ওয়ার্ডে ধুঁকতে ধুঁকতে বলেছিলেন, ‘ফুলকি, তোর বাবা এ কথা বলেছিল।

গাড়িটা আবার একটা ধাক্কা দিল। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই কি! স্টেশনে কেউ নেই কি! একদম বুঝতে পারছিল না অমিতা। গাড়ির জোর ধাক্কায় অমিতার যেন সম্বিত ফিরে এল। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল, শামিম ছিল তার সঙ্গে।

শামিম! শামিম! ট্রেন ছাড়ছে শামিম! তুমি গাড়িতে উঠে এসো।

অমিতার আর্ত স্বর অন্ধকারে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াতে লাগল। কেউ উঠল না। কেউ সাড়া দিল না। অমিতার মনে হতে লাগল, শামিম উল্টো দিকের ট্রেনে বসে আছে।

অন্ধকারে সে বুঝতে পারছে না, সে কোথায় গিয়ে বসেছে।

ট্রেনটার গতিবেগ ক্রমেই বাড়ছে। শামিম! শামিম! অমিতা ডেকেই চলেছে।

ট্রেন থেকে, ট্রেনের ইঞ্জিন থেকে, ট্রেনের চাকা থেকে ক্রমাগত একটাই আওয়াজ উঠছে। হিন্দু পানি মুসলিম পানি হিন্দু পানি মুসলিম পানি হিন্দু পানি…..

শামিম!

ফুলকি! ফু-ল-কি!

হিন্দু পানি মুসলিম পানি হিন্দু পানি হিন্দু পানি মুসলিম পানি মুসলিম পানি।

অমিতার মনে হল, শামিম সেই অন্ধকারে তার আওয়াজ শুনে প্রাণপণে ছুটে আসছে। শামিমের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না অমিতা। একটুও দেখতে পাচ্ছে না সেই প্রগাঢ় অন্ধকারে। তবে অনুভবে টের পাচ্ছে শামিম ছুটছে ছুটছে অমিতার কামরায় ওঠবার জন্য। কিন্তু কাছে এসেও নাগাল পাচ্ছে না। শামিম হাত বাড়াচ্ছে। অমিতা হাত বাড়াচ্ছে কিন্তু কেউ কারো নাগাল পাচ্ছে না। কেউ কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না। অন্ধকার। অন্ধকার। অন্ধকার ক্রমেই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। একটা বিশ্রী শব্দে, যেন একটা আততায়ী চিলের চিৎকার, না না, ইঞ্জিনের হুইসেল, আবার তীক্ষ্ণ চিৎকার আবার তীক্ষ্ণ চিৎকার অমিতা দেখল লম্বা অন্ধকার বলে যেটাকে ধরে নিয়েছিল, সেটাই আদতে ট্রেন। চিৎকার করতে করতে ট্রেনটা তার গতিবেগ ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে লাগল। হঠাৎ অমিতা বুঝতে পারল ট্রেনের মতলবটা কি? ট্রেন এখন সুড়ঙ্গে ঢুকবে। অমিতাকে, অনিচ্ছুক অমিতাকে, অসহায় অমিতার শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে নিয়ে যাবে ট্রেনটা। অমিতা ভয় পেল।

চা চা গরম চা হিন্দু চা।

চা চা গ্রাম চা মুসলিম চা।

অমিতা প্ল্যাটফর্মে চা-ওয়ালাদের হাঁকাহাঁকি শুনতে পেল। সে উঁকি মেরে চা-ওয়ালাকে ডাকতে চাইল।

চায়ে নাহিক কোনও দোষ।

চা পানে করে চিত্ত পরিতোষ।

অমিতার তার ছোটবেলায় রেলের কামরায় এই সাইনবোর্ড দেখেছে। এখন সেটা খুঁজতে চেষ্টা করল তার কামরার দেওয়ালে। কোথাও সেটা খুঁজে পেল না। কী আশ্চর্য! দেওয়াল কোথায় গেল এই কামরার? এই কামরায় তো কোনও দেওয়ালই, নেই। গোটা ট্রেনেই কোনও কামরা নেই। কোথাও কোনও ট্রেন নেই। তবে তাকে কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে সেই সুড়ঙ্গের দিকে। অমিতা ভয় পেয়েছে, বেজায় ভয় পেয়েছে অমিতা।

না আমি যাব না, যাব না। কিছুতেই যাব না। কিন্তু ট্রেন তখন কিংবা ট্রেন নয়, সেই গতিশীল লম্বা অন্ধকারটাই যেন অজগরের মতো তাকে পাকে পাকে জড়িয়ে কেবলই টেনে নিয়ে যেতে চাইছে সেই অন্তহীন সুড়ঙ্গটার ভিতরে। অমিতা তার সিট থেকে উঠে পালাতে চাইল। সিট থেকে সে কিছুতেই উঠতে পারছে না। যতবার সে উঠতে যাচ্ছে ততবার সে দেখছে তার শরীরটাকে একটুও নড়াতে পারছে না। অন্ধকার তীব্র হুইসেল দিল। গমগম শব্দ উঠতে লাগল। তবে কি অন্ধকারটা সেই সুড়ঙ্গে ঢুকছে। ভয় পেয়েছে অমিতা। সে তার শরীরটাকে প্রাণপণে সিট থেকে টেনে তুলতে চেষ্টা করছে। অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে ছুটছে। হুইসেল চিৎকার করে উঠছে। অন্ধকারের চাকা থেকে, না না, ট্রেনের চাকা থেকে শব্দ উঠছে হিন্দু চা মুসলিম চা হিন্দু পানি মুসলিম পানি।

অমিতা সিট থেকে উঠে পড়ার চেষ্টা করছে। পারছে না। আবার উঠবার চেষ্টা করল। পারল না। একটা অদৃশ্য শক্তি অমিতাকে অন্ধকার থেকে অন্তবিহীন অন্ধকার সুড়ঙ্গে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। অমিতা যাবে না, কিছুতেই ঢুকবে না সেই সুড়ঙ্গে। অমিতা নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে তাকে বাধা দিতে চাইছে। পারছে না। অন্ধকারটা, না না ট্রেনটা সুড়ঙ্গে ঢুকতে লেগেছে, আওয়াজ শুনেই অমিতা টের পেল। সিট থেকে উঠতে চেষ্টা করছে অমিতা। তার শরীর ঘেমে উঠেছে। তার বুক ফেটে যাবার উপক্রম হচ্ছে। অমিতা পালাতে চেষ্টা করছে। পারছে না। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ইঞ্জিনটা সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়েছে। গম গম করে আওয়াজ হচ্ছে। হুস্ হুস্ করে কোথা থেকে এক ভয়াবহ আওয়াজ অমিতার কানে এসে ঢুকছে। সে ভয় পাচ্ছে। সে ঘামছে। হুস্ যা হুস্ যা গ্রাম চা গ্রাম চা হুস যা হুস যা গ্রাম চা গ্রাম হুস্ যা হুস্ যা হিন্দু চা হুস্ যা মুসলিম চা হুস্ খানি হুস্ খানি হিন্দু পানি হুস্ খানি মুসলিম পানি। ট্রেনের, না অন্ধকারের, কামরাগুলো একটার পর একটা সুড়ঙ্গে ঢুকতে শুরু করেছে। অমিতার মাথা বালিশের উপর অসহায়ভাবে এদিক ওদিক দুলছে। সুড়ঙ্গে ঢুকব না আমি সুড়ঙ্গে ঢুকতে চাইনে আমি চিৎকার করে অমিতা বলতে চাইছে এ কথা। কথাগুলো তার গলার কাছে জট পাকিয়ে বের হবার চেষ্টা করছে। বের হতে পারছে না। তার বুকে চাপ বাড়ছে। বিছানা থেকে উঠতে চেষ্টা করছে অমিতা। পারছে না। পারছে না পারছে না। অনেক হ্যাঁচকা হেঁচকির পর ট্রেনের কামরাটা, না অন্ধকার তাকে যখন সুড়ঙ্গের মুখে এনে ফেলেছে, অমিতা সুড়ঙ্গে যখন ঢুকতে যাচ্ছে, তখনই সে এক টানে তার শরীরটাকে বিছানা থেকে তুলে ফেলল। হিস্ সা হিস্ সা হিন্দু চা হিস্ সা মুসলিম চা হিস্ সা হিস্ সা হিস্ সা। অমিতাকে বিছানার উপর ফেলে রেখে সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার না না সেই ভয়ঙ্কর ট্রেনটা বিরাট অজগর সাপের মতো তার শরীরটাকে টেনে টেনে সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। অমিতার বিছানায় বসে হাঁফাতে হাঁফাতে সেই ভয়ঙ্কর অজগরটাকে গর্তে ঢুকে যেতে দেখল। প্রথমে তার মাথা, তারপরে একটু একটু করে তার বিরাট শরীর তার খলখলে পেট, সব শেষে তার হিলহিলে লেজটা গর্তে ঢুকে গেল। অমিতার শরীর শিউরে উঠল। তার গায়ে কাঁটা দিল। প্রচণ্ড জলতেষ্টা পেয়েছে অমিতার। কিন্তু সে বিছানা থেকে নামতে ভয় পেল। ভয় ভয় ভয়। বিছানায় বসে বসে সে হাঁফাতে লাগল। বিছানায় বসে সে অস্ফুট স্বরে কাতরাতে লাগল।

এই স্বপ্নটা অমিতাকে সারা জীবন তাড়া করে ফিরছে। মাঝে মাঝেই এই স্বপ্নটা দেখে অমিতা। অবিকল এই স্বপ্নটা নয়, এরই নানা রকমফের।

নির্জীব অমিতা, বিছানায় বসে বসে প্রচণ্ড রকম হাঁফাতে হাঁফাতে, সেই অন্ধকারের মধ্যেই শুনতে পেল তায়েবকাকার কন্ঠস্বর।

‘ভয় ফুলকি ভয়। এই ভয়ের হাতে আত্মসমর্পণ করেছিলাম বলেই আমাদের হিতাহিত জ্ঞানটা লোপ পেয়েছিল। বাংলার হিন্দু নেতারা ভয় পেয়েছিলেন, বাংলায় মুসলিম মেজরিটির শাসনে তাঁদের থাকতে হবে। প্রভিন্সিয়াল অটোনমি, প্রদেশের স্বশাসনের অধিকার কংগ্রেসেরই তো নীতি ছিল। তাতে হিন্দু মুসলমান বলে কোনও কথা ছিল না। যে প্রদেশে যে সম্প্রদায় মেজরিটি সেখানে তাদের শাসনই তো প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাংলার হিন্দু নেতারা ভয় পেয়ে গেলেন ফুলকি। তাঁরা ভারতে হিন্দু গরিষ্ঠতার মধ্যে আত্মবিলোপ করে নিরাপত্তা খুঁজতে চাইলেন।’

তায়েবকাকার রুগণ মুখ অমিতার চোখে ভেসে উঠল। বেচারা তায়েবকাকা!

‘প্রভিন্সিয়াল অটোনমি নীতিগত ভাবে মুসলিম লিগও মেনে নিয়েছিল। কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের মূল কথা ছিল প্রভিন্সিয়াল অটোনমি। সবই তো আমাদের নীতিতে ছিল। কিন্তু কি হল? সব ব্যর্থ হয়ে গেল কেন?’

তায়েবকাকা! বেচারি তায়েবকাকা! তায়েবকাকার করুণ মুখ ক্রমেই অমিতার চোখে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে লাগল। তায়েবকাকা, বাবা, হরিকিশোরমেসো, এরা সব যেন স্বপ্ন দিয়ে গড়া। সারা জীবন ধরে স্বপ্নই দেখে গেলেন! বেচারিরা সব! অমিতার ভয় ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। অমিতা অনুভব করল, তার শুলুনিটা কমে আসছে। হঠাৎ হঠাৎ ভয়টা উঠে আসে। তার মনে হয়, ভয়টা তার গুহ্যদ্বার থেকে উঠে আসে। অমিতা আমাশয়ে ভোগে। অনেকদিন থেকে ভুগছে। আমাশার অস্তিত্ব সে বুঝতে পারে মাঝে মধ্যে যখন তার গুহ্যদ্বারে শুলুনিটা বেড়ে যায়। এই সব ভয়ের উৎসও যেন সেখানে। এবং ভয় তার ইড়া পিঙ্গলা সুষুম্না ভেদ করে সহস্রারে গিয়ে যখন পৌঁছায় তখন, তখনই অমিতা একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন সে সঙ্গ চায়। তখন সে বুড়ির কথার মানে বুঝতে পারে। মানুষের জীবনে সঙ্গীর কি মূল্য সেটা তখনই জানা যায়। অমিত। জানে, তখনই জানে।

একটা সন্ধ্যার কথা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। একবার সে গোসাবা পেরিয়ে কুমিরমারি গ্রামে যাচ্ছিল অফিসের কাজে। এ সব কাজ খুবই ভাল লাগত অমিতার। কত লোকের সঙ্গে দেখা হত তার। কত রকম চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটত তার। ওহ্ সে কী জীবন! অমিতার আর কুমিরমারির এক শিক্ষক নৌকা করে যাচ্ছিল। সামনের গলুই-এর দিকে পাটাতনে সে শুয়ে ছিল একা। একা? না না, একা নয়। সঙ্গী ছিল তার। শিক্ষক ছিলেন। দুজন মাঝি ছিল। মাঝির নামও তার মনে অছে। গঙ্গাধর। হ্যাঁ গঙ্গাধর। আর এক জন তুফান মিঞা। তুফান নাম তার কে রেখেছিল? হয়ত ঝড় বাদলের দিনে জন্ম হয়েছিল তার। বাপ মায়ে নাম রেখেছিল তুফান। তুফান মাঝি। গঙ্গাধর ছিল বুড়ো, তুফান ছিল শা জোয়ান। শুধু মাত্র একটা লুঙ্গি পরে খালি গায়ে দাঁড় টানছিল তুফান। ছবিগুলো একটার পর একটা তার চোখে ভেসে উঠতে লাগল। প্রথমে বসে ছিল অমিতা। বসে বসে তুফানের দাঁড় টানা দেখছিল। হাতের পেশীগুলো, সেই জ্যোৎস্নার আলোতে দেখা যাচ্ছিল, কেমন ফুলে ফুলে উঠছিল। বাতাস খুব বেশি ছিল না। কি মাস ছিল সেটা? ঠিক মনে নেই। ভরা পূর্ণিমার রাত সেটা। জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি পড়েছে। অমিতা ছইয়ের পাশ দিয়ে আকাশে উঁকি মেরেই অবাক। উই দূরে ডাঙায় একটা বাজ পড়া ন্যাড়া তালগাছ, চাঁদটা যেন তার মাথাতে আটকে গেছে। অমিতা পা ছড়িয়ে বসল। খুব ভাল লাগছে, খুবই ভাল লাগছে তার। সে ধীরে ধীরে তার মাথাটা হাতের তালুর উপর রেখে আধ শোয়া অবস্থায় দেখতে লাগল ডাঙা সরে সরে যাচ্ছে। জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে। মাঝে মাঝে ঢেউগুলো চিকচিক করে উঠছে। অমিতার মনে হল ওগুলো সব মাছ।

‘তুফান, ওগুলো কি মাছ?’

‘মাছ কুথায় দেখতে পেলে?’

ওই যে ওই যে, ঢেউয়ের মাথায় চিকচিক করছে?

‘ওগুলো মাছ?’ তুফান হা হা করে হেসে ফেলল।

‘কি রে তুফান, হাসতিছিস কেন?’

‘শহরের দিদি মাছ দেখতেছে গো চাচা।

‘তা এতে হাসার কি আছে? অ্যাঁ?’ গঙ্গাধর ধমক মারল।

তুফান কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

অমিতা জিজ্ঞাসা করেছিল ওই যে চিকিচিক করছে ঢেউয়ের মাথায় ওগুলো মাছ নয়! আমি ভেবেছি মাছ। তা ওগুলো কি তুফান?

‘পানি গো দিদি পানি। ভর কোটালে নদীর পানি যোবতী হয়ে ওঠে, জাননি?’

ভর কোটালে নদীর পানি যোবতী হয়ে ওঠে, জাননি? কী সুন্দর উপমা। অমিতা ভোলেনি সে কথা। আজও তার মনে আছে। তুফান নিশ্চয়ই কবি। অমিতা নৌকোর পাটাতনে গা এলিয়ে শুয়ে পড়ল। মাথার তলায় হাত দিয়ে সে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ভাল লাগছিল অমিতার। খুব ভাল লাগছিল। কানে বাজছিল তুফানের দাঁড় টানার শব্দ। আর কিছু নেই। সঙ্গী শিক্ষকটির কথা তখন মনে ছিল না। সে ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল। ছপাত। ছপাত। ছপাত। এখনও অমিতার কানে ভেসে ওঠে তুফানের দাঁড় টানার শব্দ। চোখে ভাসে ঘামে ভেজা তার বলিষ্ঠ দুই বাহুর ফুলে ফুলে ওঠা পেশী। ছপাত ছপাত ছপাত।

‘তোর বাবা বলত কি জানিস ফুলকি?’ তায়েবকাকার প্রশ্নে অমিতা চমকে গেল।

‘তোর বাবা বলত, আমরা কি কম বাহাদুর তায়েব? হিন্দু মুসলমানে আমরা চা ভাগ করেছি, জল ভাগ করেছি। সেখানে দেশ ভাগ হবে, এ আর বেশি কথা কি? আহাম্মকি, আহাম্মকি। আহাম্মকি ছাড়া আর কী?’

বেচারি তায়েবকাকা।

হিন্দু জল মুসলিম পানির কথা তায়েবকাকার মুখ থেকেই একদিন শুনেছিল অমিতা।

‘আমাদের সময়ে ইন্ডিয়ান রেল ছিল। এক এক প্রান্তে এক এক কোম্পানি রেল চলত। কোথাও ই বি আর কোথাও এ বি আর, কোথায় ই আই আর, কোথাও বি এন আর। এই সব কোম্পানির মালিক ছিলেন ব্রিটিশ। টিকিট ঘর ছিল একটাই। হিন্দুকেও যেখান থেকে টিকিট কিনতে হত, মুসলমানদেরও এই একই জায়গা থেকে টিকিট কিনতে হত। হিন্দুর টিকিট ঘর আলাদা, মুসলমানের টিকিট ঘর আলাদা, এটা ছিল না। ট্রেনে ফার্স্ট ক্লাস ছিল, ইন্টার ক্লাস ছিল, আর ছিল থার্ড ক্লাস। সেখানেও হিন্দুর জন্য আলাদা গাড়ি মুসলমানের জন্য আলাদা গাড়ি, এমন বায়না কেউ তোলেনি। কিন্তু স্টেশনে স্টেশনে হিন্দু পানি মুসলিম পানি ছিল। ছিল মানে কি? হিন্দু পানি পাঁড়ে মুসলমানকে জল দিত না। মুসলমান পানি হিন্দুরা তো ছুঁতোই না।’

তায়েবকাকার মুখটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে লাগল। অমিতার কানে এসে বাজতে লাগল ছপাত ছপাত ছপাত শব্দ। তুফান দাঁড় টেনে চলেছে এক চাঁদনি রাতে ভরা কোটালে, এই দৃশ্যটা অমিতার বিষণ্ণ চোখে এক লহমা দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল।

সেই অন্ধকারে আবার ফিরে এল অমিতা, যেখানে সে বসেছিল ঘুম থেকে উঠে, ঠিক সেই বিছানাতেই। প্রচণ্ড জলপিপাসা পেয়েছে তার। বুক ফেটে যাচ্ছে।

‘এই গল্পটা আমাকে শুনিয়েছিল ওয়ালিউল্লাহ। এক সময় প্রচণ্ড কংগ্রেসি ছিল। পরে হয়েছিল মুসলিম লিগের সদস্য। অনেক অনেক পরে ফুলকি। এঁরা সবাই শিক্ষিত, প্রতিভাবান। তবু কংগ্রেসে থাকতে পারল না, সেটা খুঁজে দেখা উচিত। মৌলানা আক্রাম খান, তমিজুদ্দিন খান, এঁরা সবাই কংগ্রেসি ছিলেন। আমার বন্ধু মনসুর কংগ্রেসি ছিল ফুলকি। কট্টর কংগ্রেসি। এঁরা কেউ হেঁজিপেঁজি লোক ছিলেন না তো। কেন এঁরা কংগ্রেস ছেড়ে দিলেন? ওঁরা হঠাৎ কমিউন্যাল হয়ে গেলেন বলে? আর কোনও কারণ কি থাকতে পারে না? কেন এই সব লোক কমিউন্যাল হয়ে যায়? তার কি কোনও কারণ থাকে না?

অমিতার কানে ভেসে আসতে লাগল তুফান মিঞার দাঁড় টানার শব্দ ছপাত ছপাত ছপাত। সেই ভরা জ্যোৎস্নায় যখন চরাচর আলোর প্লাবন বয়ে যাচ্ছে, তখন অমিতার চোখে ভেসে উঠছে দুটো ঘাম সপসপে বলিষ্ঠ পেশী।

‘অভিজ্ঞতাটা যদিও ওয়ালির, তবু ফুলকি, এ রকম অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনেও ঘটেছে। রেল স্টেশনে হিন্দু পানি আর মুসলমানি পানি, তখন একটা সাধারণ দৃশ্য ছিল। ওয়ালির কথাটাই এখন বলি। ওঁরা সেবার যাচ্ছিলেন লাহারে। মোগলসরাই স্টেশনে গাড়ি থামতেই ‘হিন্দু জল’ ‘হিন্দু জল’ বলতে বলতে পানি পাঁড়ে কামরার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ওয়ালি তাকে ডেকে জল দিতে বলল। পানি পাঁড়ের ডান হাতে জলের বালতি, আর বাঁ হাতে দুটো বিভিন্ন সাইজের গেলাস। ওয়ালি তাঁর কামরা থেকে মুখ বাড়াতেই পানি পাঁড়ে তাঁর গলায় পৈতে না দেখে জিজ্ঞাসা করল, বাবুজি আপ কায়েত হ্যাঁয়? বলেই ছোট গেলাসে বালতি থেকে জল ভরে ওয়ালির দিকে উঁচু করে তুলে ধরল। ওয়ালি হাত বাড়িয়ে পানি পাঁড়ের হাত থেকে গেলাস নেবার আগেই বলে উঠল, নেহি, ম্যায় মুসলমান হুঁ। অমনি পানি পাঁড়ে গেলাসের জল বালিতে ঢেলে দিয়ে আঙুল দিয়ে বালতির গায়ে লেখাটা দেখিয়ে দিল। বালতির গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘হিন্দু পানি : দাতা মাঙ্গুরাম ছোটিলাল আগরওয়ালা, হিন্দু ধর্ম সহায়ক সমিতি।’ ওয়ালির সহযাত্রী এক অধ্যাপক। হিন্দু তিনি পানি পাঁড়ের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন, কেন সে ওয়ালিকে জল দিচ্ছে না। পানি পাঁড়ে সরল ভাবে বলল, উসকো আপনা লোটা ধরনে কহিয়ে বাবুজি। গিলাসে মে দেনা মানা হ্যাঁয়। এ তো হিন্দুকে লিয়ে হ্যাঁয়। ওয়ালি আরও একটা ঘটনার কথা বেশ মজা করে বলত। ফিরতি পথে সেই মোগলসরাই। গোটা কামরায় রাত থেকেই জল ছিল না। কাজেই সবাই তেষ্টায় কাহিল হয়ে ছিল। পানি পাঁড়ে পানি পাঁড়ে বলে একটা লোক হাঁকতে হাঁকতে ওয়ালিদের কামরার কাছে আসতেই ওয়ালি তার বদনাটা বের করে বলল, পানি। বদনা দেখে পানি পাঁড়ে বলল, ইয়ে মুসলমান পানি নেহি হ্যায় বাবুজি। ইয়ে হিন্দু পানি হ্যাঁয়। তেষ্টায় আমাদের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, চোখের সামনে জল, তবু পানি পাঁড়ে জল দেবে না। তখন বাহার সাহেব, হবিবুল্লাহ্ বাহার, কামরা থেকে তাঁর মুখটা বের করে বললেন, জলং নামঃ জীবনং। দানে পুণ্যং সঞ্চয়তে, অস্বীকার নরকং গচ্ছতি। সীতারাম সীতারাম। বাহার সাহেবের চেহারাটা ছিল রাজপুত ব্রাহ্মণের মতো। তদুপরি তার মুখে সেই বাহারি সংস্কৃত শুনে পানি, পাঁড়ের মনটাই পুণ্যলাভের জন্য কাতর হপেয় উঠেছিল, না কি তার মাথাটাই গুলিয়ে গিয়েছিল, ঠিক জানিনে। তবে সে যাত্রা পানি পাঁড়ে ওয়ালির বদনাটা ভরে দিয়েছিল।’

ছপাত ছপাত! তুফান মিঞার দাঁড় অক্লান্ত পড়ে যাচ্ছে জলের উপর। অমিতা চিত হয়ে শুয়ে আছে নৌকোর উপর। আকাশে পূর্ণ চাঁদের আলো, আলো নয় আলোর প্লাবন। কে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে অমিতাকে? নদীর স্রোত, না জ্যোৎস্নার প্লাবন? অমিতা দেখল, নৌকোটা নদীর মাঝ বরাবর এসে গিয়েছে। এপার ওপার দুপারই অনেক দূরে। আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।

ছপাতা ছপাত ছপাত ছপাত

পূর্ণ চাঁদের মায়া অমিতাকে যখন অপার্থিব লোকের দিকে নিয়ে চলেছিল, এমনকি সে এই যাত্রা যদি শেষ যাত্রা হয় এমন এক রোমান্টিক ভাবনা ভাবতে লেগেছিল সে, ঠিক সেই সময়ে এই কাণ্ডটা ঘটল।

তুফান বলল, ‘ও চাচা, মনে লয় লৌকোয় জল ঢুকিতেছে।’

গঙ্গাধর বলল, ‘সে কি এখন ঢুকতিছে? লৌকোর টাল দেখে বুঝতি পার না। আবার মাঝি হবার শখ। জল ছেঁচতি শুরু কর?’

‘মাঝ নদীতি লৌকো চাচা, তায় আবার কোটালের টান। দাঁড় ছেড়ে দিলি তুমি একা সামলাতি পারবানে তো?’

‘সিডাও একটা কথার মতো কথা রে তুফান। এখন দাঁড় ছাড়লি লৌকো ভিড়োনো দায় হয়ে যাবেনে।’

অমিতা তড়াক করে উঠে বসল। কি হয়েছে, ও মাঝি?

গঙ্গাধর তার পাশে বসা শিক্ষককে বলল, ‘ও মাস্টর তুমি বসে বসে শুনতিছো কি? লাও হাত লাগাও। জল ছেঁচো, জল ছেঁচো।

এই মাঝ নদীতে নৌকোয় জল উঠছে! সর্বনাশ! সঙ্গী শিক্ষক মশায় ততক্ষণে একটা ছোট বালতি নিয়ে জল ছেঁচতে শুরু করে দিয়েছেন।

কি হয়েছে তুফান? নৌকোয় জল উঠছে?

তুফান দাঁড় টানতে টানতে বলল, ‘কখনও জলের উপর লৌকো থাকে, আবার কখনও লৌকোর উপর জল ওঠে। লৌকোর গোঁড়ায় বানচেরা হয়েছে তো কদিন আগে। জল উঠতিই পারে।’

আতঙ্কে অস্থির করে তুলেছিল অমিতাকে। সে একবার চেয়ে দেখল, কোনও দিকে ডাঙা দেখতে পেল না। আকাশে সেই ভরা চাঁদ, নদীতে সেই ভরা কোটাল। সর্বনাশ! অমিতার এখন মনে হল, সর্বনাশ! এখানে নৌকা ডুবলে আর দেখতে হবে না। অমিতা হাত বাড়িয়ে মাঝিদের ভাত খাবার একখানা সানকি পেল। তাই দিয়েই সে প্রাণপণে জল ছেঁচতে লাগল। তার একবার মনে হল, তুফানের কালো পেশী দুটোই কেবল চকচক করছে না, তার দুপাটি দাঁতও সেই জ্যোৎস্নায় চিকচিক করতে লেগেছে। অমিতা আতঙ্কে উদ্বেগে অস্থির হয়ে উঠেছে বলেই কি তুফান হাসছে? আকাশে চাঁদও কি হাসছে তাকে দেখে, সে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে, তাই দেখে? কিন্তু অমিতার মন তখন সেখানে ছিল না। সে তখন সানকিতে করে জল ছেঁচতে লেগেছিল। সঙ্গী শিক্ষক বালতিতে করে নৌকোর জল নদীতে ফেলছিল। দাঁড়ের ছপাত ছপাত শব্দের সঙ্গে অমিতা সেই শব্দও শুনতে পাচ্ছিল।

গঙ্গাধর বলে উঠল, ‘তুফান পাল খাটা পাল খাটা। শুধু দাঁড়ে হবেনি বাপ। এতটা রেত ঠেলে যাওয়া যাবেনি।’

তুফান দাঁড় ছেড়ে পাল খাটাতে উঠে পড়ল। নৌকোটা টাল খেয়ে বিপরীত দিকে ভেসে চলল।

বাতাস নেই, পাল খাটিয়ে লাভ কি? এমন একটা চিন্তা অমিতার মনে দেখা দিয়েছিল কিন্তু সে কিছু বলল না। তুফান পালের দড়িটা গঙ্গাধরের হাতে ছুঁড়ে দিয়েই আবার দাঁড় তুলে নিল।

গঙ্গাধর বললল, ‘ঝিকে মার বাপু ঝিকে মেরে চল।

তুফান দাঁড়টা এমনবাবে ফেলতে লাগল যে নৌকা টলমল করতে করতে এগিয়ে চলল।

গঙ্গাধর পালটাকে এদিক ওদিক করে ঠিক করে নিয়ে বলল, ‘মাস্টার, হাত চালাও হাত চালাও।’ তারপর গলুইয়ে বসে গলা ছেড়ে গান ধরল।

‘আমি একদিনও না হেরিলাম তারে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না হেরিলাম তারে।
গেরাম বেড়ি অগাধ পানি
তার নাই কেনারা নাই তরণী পারে।
আমি একদিনও না হেরিলাম তারে।’

অমিতার হাত ক্রমেই অবশ হয়ে আসছে। ঘামে শরীর ভিজে সপসপে হয়ে উঠেছে। তবু সে সানকিতে জল ভরে ভরে নদীতে ফেলে যাচ্ছে। এতেই যেন তার প্রাণ বাঁচবে। গঙ্গাধরের গলায় সুর আছে। তবে বয়সের ভারে সেটা যেন কেমন ভেঙে ভেঙে যায়। কিন্তু তার উদাত্ত কণ্ঠের গান অমিতাকে যেন একটু জোর দিল। সে ছোট সানকিটা ভরে ভরে জল সেঁচে ফেলতে লাগল।

‘মন বাঞ্ছা করি দেখবো তারে
আমি কেমনে সেথায় যাই রে।
বাড়ির কাছে আরশিনগর
এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না হেরিলাম তারে।’

অমিতা হাঁফাতে হাঁফাতে বসে পড়ল নৌকোর পাটাতনে। তারপর শুয়ে পড়ে হাঁফাতে লাগল। হঠাৎ সে শুনল জলের উপর দিয়ে একটা যেন ক্ষীণ শব্দ ভেসে আসছে।

‘আমি কি হব পড়শির কথা
তার হস্তপদস্কন্ধমাথা নাই রে।
সে ক্ষণেক ভাসে শূন্যভরে।
আবার ক্ষণেক ভাসে নীরে।’

অমিতা দেখল তুফান জলের উপর মুখটা নিয়ে কেমন একটা হাঁক ছাড়ল। কিছুক্ষণ পরে আবার দূর থেকে জলের উপর দিয়ে সেই ক্ষীণ শব্দটা ভেসে এল।

তুফান বলল, ‘ঘাটে সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করতেছে দিদি।’

‘সেই পড়শি যদি আমায় ছুঁতো
ভবের যমযাতনা সকল যেতো দূরে
সে আর লালন একখানে রয়
আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।’

কুমিরমারি তাঁরা পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। মাটিতে পা দিয়ে অমিতা নিরাপদ বোধ করেছিল।

৪২

‘সে আর লালন একখান রয়
আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।
বাড়ির পাশে আরশিনগর
এক পড়শি বসত করে।
আমি একদিনও না হেরিলাম তারে।’

তায়েবকাকা! বেচারি তায়েবকাকা! বেচারি বাবা! ওদের কথা মনে হলে অমিতার লালনের এই গানটা মনে পড়ে। কেন মনে পড়ে? হিন্দু আর মুসলমান। পড়শি তো। সে আর লালন একখানে রয়, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে। এই ফাঁকটা তোমাদের পীড়া দিত তায়েবকাকা, এই ফাঁকটা কমছে না, বেড়েই যাচ্ছে, এতে তুমি খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলে বাবা। বেচারি বাবা! তোমার শেষদিকের উদ্বেগ সবই আমি লক্ষ করতাম বাবা। যদিও আমি উদ্বেগেই সে সময়টা কাটাচ্ছিলাম। তুমি তো শেষদিকে খাওয়া দাওয়াই ছেড়ে দিয়েছিলেন। ঘুম হত না তোমার। তুমি কি জানতে, তোমার ফুলকিও তোমার জন্য, রাত জেগে বসে থাকত। তোমরা কেউই কারও সঙ্গে তেমন করে কথা বলতে না। অথচ এক বাড়িতেই তো তোমরা থাকতে বাবা? তোমরাই কি সেই আরশিনগরের বাসিন্দা ছিলে বাবা? নাকি আগে ছিলে না, পরে হয়ে পড়েছিলে? এখন কেমন মনে হয় আমার। মনে হয়, তুমি তায়েবকাকা তোমরা সবাই সকলেই ছিলে আরশিনগরের বাসিন্দা। লালন ঠিকই বলেছেন বাবা, সে আর লালন, একখানে রয়, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে। আহা বেচারা!

হিন্দু জল মুসলিম পানি, একই জল একই পানি, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

হিন্দু চা মুসলিম চা, একই চা, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

হিন্দুর মন্দির মুসলমানের মসজিদ, একই ঈশ্বর, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

হিন্দু মুসলমানে প্রতিবেশী, পড়োশি। আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে।

বেচারা বাবা! বেচারা তায়েবকাকা! আহা আহা রে!

আরশিনগরে বাস করে লক্ষ যোজন ফাঁক কি মেটানো যায় বাবা? যায় তায়েবকাকা?

‘আমরা সবাই উপর দিকে চেয়েই পথ হেঁটেছি ফুলকি। পায়ের দিকে কখনও তো তেমন ভাবে নজর করিনি। ভেবেছিলাম ফাঁকটা বোধ হয় উপরে। নিচের দিকে ঠিকই আছে।’ তায়েবকাকার গলা বেজে উঠল।

‘আজ আমার মনে হয় তায়েব,’ ‘এটা আমার বাবার গলা, অমিতা বলল, ‘হিন্দু মুসলমানের মিলন ঘটাবার ব্যাপারে হয় আমাদের আন্তরিকতার অভাব ছিল, আমরা সবাই ভণ্ডামি করেছি, আর না হয় আমরা কেউই ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করিনি।’

‘তোর বাবা বলত ফুলকি, আমরা আন্দোলন তো কম করিনি! কিন্তু কখনও কি এক কথা ভেবে দেখেছি, এই সব মাঙ্গুরাম ছোটিলালদের কথা। যারা সরল বিশ্বাসে তৃষ্ণার্তদের স্টেশনে স্টেশনে জল বিলিয়ে বেড়ায় সামান্য টাকা বেতনে। এরা বিভেদের যে বীজ পুঁতে চলেছে, সে সম্পর্কে ওরা সচেতনও নয়। কিন্তু আমরা তো সচেতন ছিলাম তায়েব, না কি? তাহলে আমরা কেন এগিয়ে যাইনি হিন্দু জল আর মুসলিম পানি, হিন্দু চা আর মুসলিম চা, এই সব বন্ধ করতে। গিয়েছি কি কোনও নেতা কি এই কথা নিয়ে ভেবেছেন তায়েব? আমরাও তো একদিন ছোটখাট নেতা ছিলাম। আমরা কি এ নিয়ে ভেবেছি কোনও দিন?

‘গল্পে আছে ফুলকি, নল রাজার দেহে কলি প্রবিষ্ট হয়েছিলেন পায়ের দিক দিয়েই।

গ্রিক পুরাণেও আছে তায়েবকাকা, অন্ধকারের দিকে স্থির চোখে চেয়ে অমিতা মন্তব্য করল, গ্রিক পুরাণেও এই ধরনের গল্প আছে তায়েবকাকা। বিরাট যোদ্ধা একিলিসের গোড়ালিতেই ছিল দুর্বলতা। আর সেটাই হয়েছিল তার মৃত্যুর কারণ।

বাবা বলতেন, ‘হিন্দু মুসলমানের বিরোধ বড় বড় নেতারা চেয়েছিলেন বলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, এটা পুরোপুরি ঠিক নয়। নেতারা আসর গরম করে তুলতেন, এটা ঠিক। কিন্তু যে সব মানুষ মাটির কাছে ছিল, তাদের অধিকাংশের সঙ্গেই তো নেতাদের যোগ ছিল না। তবে? তবে তাদের মধ্যে বিভেদের বীজ কে পুঁতে দিল?’

‘তোর বাবা একটা কথা বলত ফুলকি। হিন্দু সমাজের খোলনলচে না বদলালে, এখন যে কাঠামো আছে সেই কাঠামোটা ভেঙে ফেলতে না পারলে, এক কথায় হিন্দু সমাজকে ঢেলে সাজাতে না পারলে, এ দেশে প্রকৃত জাতীয় ভাব কখনও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সমাজে যদি অসাম্য থাকে, তাহলে ভাই বেরাদরি হয় কি করে?’

বাবা বলতেন, ‘হিন্দুরা ভাতের হাঁড়ির আর জলের কলসি, স্পর্শদোষ থেকে এই দুটো জিনিসকে বাঁচাতে গিয়েই দেশটাকে ভাগ করে ফেলল।’

‘একদিন পানি পাঁড়ে নিয়ে আমরা হাসি ঠাট্টা করছি, তোর বাবা দেখি গম্ভীর ভাবে বসে আছে। আমাদের আলোচনার মধ্যে হঠাৎ তোর বাবা বলে উঠল, এটা এত হাসি ঠাট্টার ব্যাপার নয় তায়েব। তোমরা এর মধ্যে হিন্দু পানি মুসলিম পানির চক্করই দেখছো, কিন্তু ওই অজ্ঞ পানি পাঁড়ের কাছে এটা শুধু জল দেবার সওয়াল ছিল না। ওর বালতিটায় শুধু হিন্দু জল কথাটাই লেখা ছিল না। পানি পাঁড়ের হাতে দুটো গেলাসও ছিল। একটা বড় এবং একটা ছোট। হিন্দু হলেই তো হবে না। কারণ বেচারি পানি পাঁড়ের কাছে হিন্দু বলতে কিছু বোঝায় না। সে তাই দুটো গেলাস নিয়ে ঘোরে। একটা বড় গেলাস। সেই গেলাসে সে শুধু ব্রাহ্মণকেই জল দেয়। কারণ তাকে তাই তার জন্মইস্তক শেখানো হয়েছে। আর তার হাতে যে ছোট গেলাসটা থাকে সেই গেলাসে সে অব্রাহ্মণকে জল দেয়। তাহলে দেখ, হিন্দু জলেও ভাগ। সামান্য পিপাসার জল নিয়েও হিন্দু সমাজেই যখন এত বড় ভেদ, তখন জাতীয় ভাবের সৌধ কোথায় গড়া হবে? কোন্ জমিনে? এ সব কথা যখন আমাদের গুরুত্ব দিয়ে ভাববার কথা ছিল, তখন আমরা তা ভাবিনি। শুধু ভেবেছি, মুসলমানরা বেয়াড়াপনা করছে, ওদের মনে জাতীয় ভাব নেই, হিন্দু মুসলমানে ঐক্য না গড়ে ওঠার দায়টা তাই মুসলমানের।’

একদিন বাবা খেতে খেতে হঠাৎ বললেন, ‘আমি তো নিজের চেহারা নিজে দেখতে পাইনে ফুলকি। কেউ যদি সেটা দেখে ঠিক ঠিক বর্ণনা দেয়, আবার তাতেও আমি দুঃখ পাই। যে বলে তার উপর রেগেও যাই।’

অমিতা বারার কথা শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু মুখটা দেখতে পাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেছে অমিতা। কিন্তু বাবাকে তার স্বপ্নে কখনও আনতে পারেনি সে। বাবা শুধু তার স্মৃতিতে আসেন। কেন বাবা? কেন তুমি অমন করে লুকিয়ে রাখো তোমাকে?

‘কলেজে আমার এক সহপাঠী ছিল ফুলকি। এ তায়েব নয়। এর নাম ছিল আমিনুল। বেশ স্পষ্ট কথা শোনাত বলে আমার হিন্দু মুসলিম সহপাঠীরা ওকে এড়িয়ে চলত। তবু আমার ছেলেটাকে ভাল লাগত। ও যা বুঝত সেটা অকপটে আমাদের বলে দিত। সে একদিন বলেছিল, জানো, আমি ছোটকাল থেকেই হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে মিশছি।. হিন্দু মুরুব্বিদের সাথেও কথাবার্তা বলি। এই সব থেকে তোমাদের সম্পর্কে আমার একটা ধারণা গড়ে উঠেছে। আমি দেখেছি তোমরা মুসলমানদের চাইতেও গোড়া এবং ধর্মান্ধ, অনুদার, স্বজাতিবৎসল, এবং তোমাদের মনোবল আমাদের ছেলেদের চাইতে বেশি। বৈষয়িক ব্যাপারে তোমরা সমশ্রেণীর মুসলমানের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান এবং দূরদর্শী। দাম্পত্যজীবনেও, আমার মনে হয়, তোমরা অনেক সুখী এবং তোমরা আমাদের চাইতে বেশি সংযমী। মুসলমান ছাত্রদের তুলনায় হিন্দু ছাত্ররা গুরুজনদের প্রতি অনেক বেশি শ্রদ্ধাশীল, জ্ঞানপিপাসু, এবং তোমাদের বাস্তববুদ্ধি আমাদের চাইতে বেশি। আমিনুল পরে লিগের একজন বড় চাঁই হয়ে উঠেছিল, কিন্তু সেই সময়েও সে আমাকে বলেছিল, হিন্দুদের সম্পর্কে তার ধারণা আগেও যা ছিল, তা এখনও আছে। আমাদের অনেকেই এ কথা বুঝতে পারেন না ফুলকি যে, আমরা হিন্দুরা অন্যের চোখে, গোঁড়া, ধর্মান্ধ এবং অনুদার। কেউ যদি কখনও আমাদের চরিত্রের এই দিকটা দেখিয়ে দেয়, তো আমরা মার মার করে উঠি। এই জন্যেই তো আমরা আমাদের দোষ ত্রুটিগুলো আর শুধরে নিতে পারলাম না।’

বাবা বাবা, তুমি যখন আমাকে এ কথাগুলো বলতে তখন তোমার আন্তরিকতায় সন্দেহ করার কোনও কারণ আমি খুঁজে পেতাম না। আর তখনই তুমি আমার কাছ থেকে সরে সরে যেতে। তুমি আমার সামনে বসে আছ খাবার ঘরে। খাচ্ছ আমার একেবারে সামনে বসেই তো, কিন্তু বাবা তোমার মুখ থেকে এই ধরনের কথা শুনতে শুনতে আমি বোধ করতাম, তুমি আর আমার সামনে বসে নেই। তোমার আর আমার মাঝখানে কোথা থেকে একটা ঘষা কাঁচের দেওয়াল এসে পড়ত। হ্যাঁ বাবা, ঘষা কাঁচের ওপিঠে তুমি, ঘষা কাঁচের এপিঠে আমি। আমার কেমন অস্বস্তি হত বাবা। কেন আমার এমনতর বোধ হত, তুমি বলতে পার বাবা? আমি কতদিন ধরে তোমার কাছ থেকে একটা কথা জানবার জন্য চেষ্টা করেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম তুমি নিজেই আমাকে বলবে হয়ত। কিন্তু তুমি তখন বেজায় উদ্বিগ্ন। তুমি কেবিনেট মিশন নিয়ে খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলে। তোমার মনে কেবিনেট মিশনের পরিণতি কী দাঁড়াবে সেটা নিয়ে উদ্বেগের অন্ত ছিল না। তোমার ঘুম হত না। তুমি ঘরময় পায়চারি করতে। আমি জানি বাবা। কিন্তু তুমি কি জানতে, তোমার ফুলকি, তারও ঘুম হত না রাতে। অসহ্য যন্ত্রণায় সে ভুগত। বিছানায় ছটফট করত। মাঝ রাতে খাটের বাজু ধরে বসে থাকত। তোমার উদ্বেগ ছিল দেশের কি হবে, তাই নিয়ে। তুমি বলতে, প্রায়ই বলতে, তোমার বন্ধু বান্ধব সকলকেই বলতে, কেবিনেট মিশনের যে প্রস্তাব তাকে খারিজ করলে দেশকে সর্বনাশ থেকে বাঁচানো যাবে না। শরৎবাবু এটলির আশ্বাসে বিশ্বাস করতে পারছেন না, এতে তুমি খুবই দুঃখ বোধ করতে। শরৎবাবুর কাছে চার্চিলও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী এটলিও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী। অতএব ওদের কথায় তিনি বিশ্বাস করতে পারেননি। তাঁর কাছে কেবিনেট মিশনটাই ছিল একটা ধোঁকাবাজি। এ বিষয়ে শরৎবাবুর সঙ্গে নেহরু প্যাটেল রাজেন্দ্রপ্রসাদের কোনও তফাত ছিল না। তুমি এই সময়ে এম এন রায়ের দিকে ঝুঁকেছিলে। তুমি সেই খসড়ার মধ্যে দেশের মঙ্গল দেখতে পেয়েছিলে এবং তোমার বন্ধুদের নিয়ে তুমি কয়েকবার তার সঙ্গে দেখাও করেছিলে। আর হ্যাঁ, রাজা গোপালাচারি। আমার মনে আছে বাবা, তুমি ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে রাজা গোপালাচারির বক্তৃতা শুনে এসে উল্লসিত হয়ে বলেছিলে, ‘এই একজন বিচক্ষণ নেতা ফুলকি। কি বললেন জানিস, সি আর বললেন, ঐক্যের জন্য চিন্তা নেই। ইউ হ্যাভ ইউনিটি। কিন্তু মুশকিলটা এইখানে যে, তাতে আমরা সন্তুষ্ট নই। ইউ ওয়ান্ট টু হ্যাভ মোর ইউনিটি। যত গোলমাল ওইখানে।’

আমিও উদ্বেগে ভুগছিলাম বাবা। উদ্বেগ তোমার জন্য। উদ্বেগ শামিমের জন্য। শামিম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল নীলগঞ্জে গিয়ে। কলকাতায় আসতে পারছিল না সে। উদ্বেগ সেই কারণে। আর তোমার জন্য প্রচণ্ড উদ্বেগ আমার হয়েছিল, সে তোমাকে বুঝতে পারছিলাম না বলে। তখনই আমাদের মধ্যে সেই ঘষা কাঁচের দেওয়ালটা উঠে পড়েছে। যার মধ্য দিয়ে তোমাকে দেখতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল। শামিম এসেছিল শেষ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয়নি। আর কখনো হলই না। তোমার সঙ্গে শামিমের কথা হয়েছিল। কিন্তু তুমি সে সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্য করনি। যেন শামিম আসেইনি আমাদের বাড়িতে। যেন তোমার সঙ্গে দেখাই হয়নি শামিমের। যেন শামিম বলে কারও কোনও অস্তিত্বই ছিল না। কি বলেছিল শামিম? কেন তুমি সে সম্পর্কে একটা কথাও আমাকে বলনি? কেন, কেন, কেন? সেই কথাটাই আমি জানতে চাই তোমার কাছ থেকে। বাবা বাবা বাবা!

অন্ধকার থেকে কোনও জবাব এল না। অমিতা ঝিম মেরে বসে রইল।

ছপাত ছপাত ছপাত
কেউ দাঁড় টেনে টেনে কোথাও পৌঁছুতে চাইছে।
তুমি আমি এখানেই রই, আবার লক্ষ যোজন ফাঁক রে
ছপাত ছপাত ছপাত ছপাত

৪৩

মুসলিম লিগ এবং জিন্নাকে নিয়ে বাবাদের বৈঠকে মতভেদ ছিল। তায়েবকাকা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার মানতেন কিন্তু স্বতন্ত্র নির্বাচনে তাঁর আস্থা ছিল না। বলতেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই মানুষকে ভাগ করে নিয়ে সফল করে তোলা যায় না। তিনি এ কথা মানতেন, মুসলমানদের সমস্যা আছে। তাদের প্রতি অবিচার হচ্ছে। এ সবই বলতে গেলে, মুসলিম সমাজের পিছিয়ে থাকার কুফল। ইংরেজের শাসন প্রতিষ্ঠা হলে মুসলমান তাকে দুশমন ভেবে তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে ছিল। ইংরেজি শিক্ষাকে সে বর্জন করেছিল। আজকের মুসলমানের দুর্গতি মূলত সেই কারণে। হিন্দুরা এই শিক্ষা গ্রহণ করেছিল, তারা এ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার যোগ্যতা অর্জন করেছে। মুসলমান সেটা পারেনি।

‘না ফুলকি মা, মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থা দিয়ে এর প্রতিবিধান করা যাবে না।’ তায়েবকাকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে তিনি বলতে থাকলেন, ‘সবই তো হল। মুসলমানদের জন্য আলাদা নির্বাচন, মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ। কী না হল! কিন্তু আসল সমস্যার কোনও সমাধান হল?’

‘কোনও কিছুরই সমাধান হয়নি তায়েব।’ হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘ভারতে মুসলমান সেই মাইনরিটিই থেকে গেল। সেই সাম্প্রদায়িকতা, সেই ঘৃণা, সেই বিদ্বেষ, সেই দাঙ্গা, সেই হানাহানি, সবই তো রয়ে গেল।’

‘ভারতের কথা বলছ হরিকিশোর? ভারত তো তবু স্বর্গ। পাকিস্তানের কোনও খবর রাখ? পাকিস্তান এখন দোজকিস্তান হয়ে উঠেছে। ভারতে এখনও মুসলমানে হিন্দুতে সেই পুরনো দাঙ্গা কোথাও কোথাও হচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানে দাঙ্গা হচ্ছে মুসলমানে মুসলমানে। মুসলিম বেরাদরির পালিশ এইমাত্র এই কয় বছরের মধ্যেই ধুয়ে মুছে একাকার হয়ে গিয়েছে। সব চাইতে খারাপ অবস্থায় পড়েছে বিহার ইউ পি-র সেই সব মুসলমান যারা চেয়েছিল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। এখন তাদের কেউ আর পাকিস্তানি নয়, হরিকিশোর।

‘কেন তায়েব, পাকিস্তান তো তাদেরই দাবি ছিল। তাই না? তবে? হরিকিশোরমেসো অবাক হলেন।

‘তারা? যারা এদিক থেকে ওদিকে গিয়েছে? যারা পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিল? যারা বিশ্বাস করেছিল জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বে? তারা সব সবাই এখন পাকিস্তানে মোহাজির। উদ্বাস্তু। হরিকিশোর, তারা সব এখন উদ্বাস্তু।’

তায়েবকাকা উত্তেজনায় হাঁফাতে লাগলেন।

‘ভাবতে পারবে না হরিকিশোর, বিষবৃক্ষের কি ফলটাই না ফলছে। এখানেও ফলছে, পাকিস্তানেও ফলছে।’

‘থাক তায়েব, এখন থাক।’

‘বলি হরিকিশোর, বলে নিই একটু। আর কবে সময় পাব? আর কবে তোমাদের পাব?’

‘একটু সুস্থ হয়ে ওঠো তায়েব। একটু সুস্থ হও।’

‘আরে ওইটেই তো আমার অসুখ হরিকিশোর। কথা বলতে পারিনে কারও সঙ্গে। এ সব কথা কেউ শুনতেও চায় না। এখন দেখছ তো, এখানেও মানুষ ভাগ হতে শুরু হয়েছে। এখানেও মানুষ আবার হিন্দু হতে শুরু করেছে, মানুষ আবার মুসলমান হতে শুরু করেছে। দেখতে পাও, নাকি পাও না, হরিকিশোর?

‘পাই পাই তায়েব।’

‘ভয় হয় না হরিকিশোর?’ যেন খুব গোপন কথা, তায়েবকাকা তেমনি ফিস ফিস করে বলতে লাগলেন।

‘ভয়? হ্যাঁ হ্যাঁ হয়। আমার জন্য নয় তায়েব, তোমার জন্যও নয়। আমাদের দিন তো শেষ হয়ে এলো। তবু ভয় হয়, ভয় হয় তায়েব। ভয় এদের জন্য।’

হরিকিশোরমেসো আমার দিকে আঙুল তুলেছিলেন সেদিন।

‘আমরা হিন্দু হতে চাইনি, মুসলিম হতে চাইনি, হরিকিশোর। আমরা মানুষ বলেই আমাদের পরিচয় দিতে চেয়েছিলাম। বিংশ শতাব্দীর মানুষ। কিন্তু আমরা পারলাম না হরিকিশোর। মানুষ হিসাবে আমাদের পরিচয় তুলে ধরতে পারলাম না। আমরা হিন্দু হয়ে উঠলাম, আমরা মুসলমান হয়ে উঠলাম। আমরা পাকিস্তানি হয়ে উঠলাম, আমরা হিন্দুস্থানি হয়ে পড়লাম। আমরা বাপ দাদার ভিটে ছেড়ে ছুটলাম নিরাপদ আশ্রয় পেতে। আমরা উদ্বাস্তু উদ্বাস্তু, সবাই উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে গেলাম। এই উদ্বাস্তুদের বংশধরেরা ঘৃণার ফসল, বিদ্বেষের ফসল, হিংস্রতার ফসল। ভাবতে পার হরিকিশোর, এরা কিসের ফসল ফলাবে?’

শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে অমিতা এদের কথা শুনছিল। স্মৃতি স্মৃতি, এঁরা এখন শুধু স্মৃতিতেই আসা যাওয়া করেন।

অমিতারও কিছু বলার থাকে তো? কাকে বলবে? কে শুনবে তার কথা? তবে তোমরাই শোন। তায়েবকাকা শোনো তুমি, হরিকিশোরমেসো তুমি শোনো, বাবা বাবা তুমিও শুনবে তো, শুনবে তো বাবা?

শামিম কেন মুসলিম লিগে ভিড়েছিল, সে কথা আমাকে বলেছিল। শামিমের ভয় ছিল, সে মুসলিম লিগে যোগ দিলে তোমাদের স্নেহচ্যুত হবে। বিশেষ করে তোমার আর তায়েবকাকা সম্পর্কেই ওর এই ভয়টা ছিল। শামিম কেন মুসলিম লিগে যোগ দিয়েছিল, জানো তায়েবকাকা? জানো বাবা? শামিম চেয়েছিল মুসলমান ছাত্রদের মনকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে মুক্ত রাখতে।

‘ফুলকি, তুমি জানো না মুসলিম ছাত্ররা কত সরল স্বভাবের ছেলে। তাদের মন অন্যান্য ছাত্রদের মতই উদার। অন্য ছাত্রদের মতই ওরা স্বপ্ন দেখে ফুলকি। ওদের মধ্যে এমনিতে কোনও সাম্প্রদায়িকতা নেই। একটা আড়ষ্টতা আছে। বেশির ভাগ মুসলমান ছেলেই যারা কলকাতায় কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে, তারা হয় মফস্বলের শহর নয়তো গ্রাম থেকে আসে। ওরা শহুরে হালচাল সহবৎ কিছুই জানে না। শিক্ষিত মেয়েদের চালচলন দেখে থ মেরে যায়। এ সব তো ওরা দেখেনি কখনও। তাই ওদের লজ্জা বা আড়ষ্টতা যায় না। ওদের মনে মনে খুবই ইচ্ছে থাকে যে, ওদের হিন্দু সহপাঠীরা যেমন মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, ওরাও তেমন করার সুযোগ পাক। কিন্তু এই ব্যাপারে মুসলমান ছাত্ররা সর্বদাই পিছিয়ে থাকে। ওদের মফস্বলি লাজুকতা আড়ষ্টতা ওরা কাটিয়ে উঠতে পারে না। আর এরই থেকে ওদের মনে এক ধরনের কমপ্লেক্স বেড়ে উঠতে থাকে। যদি বা দু-একটা মুসলিম মেয়েকে ওরা কেউ কেউ সহপাঠিনী হিসাবে পায়, সেই মেয়েরা কলকাতার অ্যারিস্টোক্র্যাট পরিবারের মেয়ে, তারা গেঁয়ো ছেলেদের চাইতে স্মার্ট ছেলেদের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করে। আর তেমন স্মার্টনেস কলকাতার বনেদী পরিবারের ছেলেদের কাছ থেকেই পাওয়া যায়। যাদের এই স্মার্টনেস আছে তারা অধিকাংশই হিন্দু পরিবারের ছেলে। কয়েক জেনারেশন থেকে তারা লেখাপড়া শিখছে। কলকাতার আদবকায়দা সবই তারা পেয়েছে তাদের পরিবারের কাছ থেকে পুরুষানুক্রমে। সদ্য শিক্ষিত মফস্বল থেকে আসা মুসলিম ছেলেরা লেখাপড়ায় যতই ভাল হোক, সেই সব হিন্দু ছেলেদের কাছে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়াতে পারে, ফুলকি? না। তাই- তাদের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ আছে, হতাশা দেখা দেয়, যে হতাশা হীনম্মন্যতা থেকে জন্ম নেয়। মুসলিম ছাত্রদের মনে এই ক্ষোভ এই হতাশা বেড়ে যাচ্ছে। রাজনীতিই সব কারণ নয়, ফুলকি।

তুমিও কি সেই হতাশের দলে, শামিম?

‘হয়ত আমিও ওদের দল ভারী করতাম ফুলকি, যদি তুমি আমার জীবনে না আসতে। তুমি আমার জীবনে এসেছ বলেই না আমি ওদের মনটাকে এমন ভাল করে বুঝতে পেরেছি।’

ছেলেদের জীবনে মেয়েদের ভূমিকা সত্যিই কি এত বড় শামিম?

‘হ্যাঁ ফুলকি। হিন্দু মুসলিম বলে কথা নয়, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা পরস্পরের বন্ধু হবে, অবাধে মেলামেশা করবে, আমি এমন একটা দিনের স্বপ্নই দেখি ফুলকি।

কিন্তু শামিম, বন্ধুত্ব তো আর কল টিপলেই পাওয়া যায় না। সেটা তো অর্জন করতে হয়। নয় কি?

‘ঠিক ঠিক কথা ফুলকি! আমি তো এই কথাই হামেশা আমার বন্ধুদের বলি। কিন্তু ওরা তো এটা বোঝে না। এর মধ্যে ওরা হিন্দু মুসলমানের প্রশ্ন এনে ফেলে। আমি তোমার উদাহরণ দিই ফুলকি। ওরা মনে করে তুমি এক ব্যতিক্রম। ওরা মনে করে আমি লাকি ছেলে। আমি যখন তোমার কথা আমার অন্তরঙ্গ বন্ধুদের বলি, যদিও তাদের সংখ্যা খুবই কম, তোমার আমার ভালবাসার কথা বলি, আমরা কি স্বপ্ন দেখি, তাও মাঝে মাঝে বলি, ওরা অবিশ্বাস ভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। বুঝতে পারি যে, ওরা আমার কথার এক বিন্দুও বিশ্বাস করে না।’

শামিম তখন গভীর ভাবে ভাবতে শুরু করে। ওর চোখে মুখে একটা অস্বস্তির ছায়া এসে পড়ে তখন। ফুলকির মনে হয়, শামিম, দূরে কোথাও সরে গিয়েছে।

‘এই সরল গ্রাম্য স্বভাবের ছেলেগুলোই তো একদিন মুসলিম লিগকে শক্ত করে তুলবে। সেই দিনের কথা ভাবি ফুলকি। এই ছেলেদের মন যদি বদলাতে পারা না যায় তবে এদের হাতে মুসলিম লিগের চেহারা কেমন হবে, তাই ভাবি ফুলকি।’

হিন্দু মেয়েরা মুসলমান সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে ভয় পায় শামিম। এই ভয়টা যদি ওদের মন থেকে দূর করতে না পারা যায়, তবে কিছুতেই কিছু হবে না। আমার বন্ধুদের আমি তো লক্ষ করে দেখেছি। তারা ইচ্ছে করেই তাদের মুসলিম সহপাঠীদের এড়িয়ে যায়। যদিও বা কালেভদ্রে কোনও মুসলিম সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কফি হাউসে-টাউসে, হিন্দু সহপাঠী সঙ্গে থাকলে তবে হিন্দু মেয়েরা তার মুসলিম সহপাঠীর সঙ্গে কথা-টথা বলে অনেকটা স্বাভাবিক ভাবে এই তো আমি দেখি। একা-একা কফি হাউসে মুসলিম সহপাঠীর সঙ্গে কথা কইছে, এমন মেয়ে আমার নজরে তো পড়েনি। ইউনিভার্সিটির মুসলিম ছাত্রীকে আমি অনেক সময় কফি হাউসে তার হিন্দু সহপাঠীর সঙ্গে একা কথা বলতে দেখেছি। আড়ষ্টতা হিন্দু মেয়েদের মধ্যেও কম নেই শামিম।

‘তা হলে আমার বন্ধুরা যা বলে তুমিও তাই বলতে চাইছ। তুমি বলতে চাইছ, আমি তোমাকে পেয়ে বর্তে গিয়েছি। তাই তো ফুলকি।

অমিতা জানে, ফুলকি শামিমের মুখে হাল্কা কথা শুনলে আশ্বস্ত বোধ করত। মাঝে মাঝে শামিম গম্ভীর হয়ে পড়ে। আর যখন শামিম গম্ভীর হয়ে ওঠে তখন ফুলকির মনে হতে থাকে শামিম যেন তার কাছে নেই। দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। ফুলকির মনটা তখন কেমন এক ধরনের অস্বস্তিতে ভরে উঠত। তার কষ্ট হতে থাকত তখন।

আমি এ কথা বলছি না শামিম। তবে কেউ যদি আমার সামনে এই ধরনের কথা বলে আর আমি যদি তার প্রতিবাদ করি, তবে তার মুখটা থাকে কোথায়? কাজেই বাধ্য হয়েই আমাকে চুপ করে থাকতে হচ্ছে।

ফুলকি বেশ গম্ভীর ভাবেই কথা বলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি। সে আর শামিম দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠেছিল। আহ্ সে এক দিন!

‘তোর বুকের পাটা আছে অমিতা!’ তার স্কুলের বন্ধু অপরাজিতা বলেছিল। অপরাজিতা ম্যাট্রিক পাশ করতেই ওর বাবা খুব এক ভাল পাত্র পেয়ে যান। অপরাজিতাকে দেখে পাত্রের এতই পছন্দ হয়েছিল যে, তার আর তর সইল না, সেই অঘ্রানেই তিনি অপরাজিতার সিঁথিতে সিঁদুর টেনে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। বছর তিনেক পরে যখন আবার অপরাজিতার সঙ্গে দেখা, ওরা তখন মেট্রো থেকে ম্যাটিনি সিনেমা দেখে বেরুচ্ছে। ওরা মানে অমিতা আর শামিম। আর ওরা মেট্রোতে ঢুকতে যাচ্ছে।

‘অমিতা!’

অমিতা অপরাজিতাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ছিপছিপে চেহারা ছিল তার, কি কচি কচি মুখটাই না ছিল, কিন্তু এই অপরাজিতা সে নয়, আদপেই সে নয়, এ অপরাজিতা এখন এক পুরো গিন্নি। শাঁসে জলে তার চেহারা একেবারে গোল হয়ে উঠেছে।

অপরাজিতা!

সঙ্গের ভদ্রলোকই তার বর। বিয়ের দিন দেখেছিল কিন্তু এখন চিনতে পারল না অমিতা।

‘অমিতা, কেমন আছিস ভাই? ইনিই আমার কর্তা। ও গো, এ আমার ইস্কুলের বন্ধু অমিতা।’

ভদ্রলোক একগাল হেসে বলেছিলেন, ‘তা বেশ তা বেশ।’

‘তা বেশ তা বেশ কি? হ্যাঁরে অমিতা তুই এখনও পড়ছিস তো?’

‘পড়ব না তো কি করব?’

‘তা বেশ তা বেশ। হেঁ হেঁ।’

‘তুমি তো আমাকে সাতসকালেই পড়া ছাড়িয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিলে। দেখ তো এঁরা কেমন পাশ-টাশ করে বেরুবে।’

অমিতার মনে হল না, অপরাজিতার কোনও ক্ষোভ আছে তার জন্য।

‘হ্যাঁ রে, তোর কত্তার সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিবিনে। তোর কত্তাটি বেশ লাজুকই মনে হচ্ছে।’

‘কত্তা কোথায় পেলি? ও তো শামিম। আমার বন্ধু।

‘তোর বন্ধু! নাম কি বললি?’

শামিম।

‘শামিম! তোর বন্ধু!

অমিতার হঠাৎ কান গরম হয়ে উঠল।

‘এর সঙ্গে তুই যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াস! সিনেমায় যাস!’

হাঁ কেন?

‘কেন, তুই বুঝতে পারিসনে?

হঠাৎ অপরাজিতা অমিতার খুব কাছে চলে এল। তারপর চাপা স্বরে বলল, ‘শামিম তো মুসলমান। তোর বুকের পাটা আছে ভাই।’ বলেই অপরাজিতা তার বরের সঙ্গে হলে ঢুকে পড়েছিল।

‘আমার তো ভাই দিনেরবেলাতেও একা একা ট্রামে বাসে কলাবাগান কি রাজাবাজার কি পার্ক সার্কাস এলাকা দিয়ে যেতে গা ছমছম করে।’ বৈশাখী, তার সঙ্গে একই ইয়ারে প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাস পড়ত, একদিন বলেছিল।

কেন? অমিতার এই প্রশ্নে বৈশাখী তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। যেন এমন প্রশ্ন উঠতে পারে, এটাই বিস্ময়ের।

‘কেন! ও সব জায়গাতেই তো মুসলমানেরা থাকে।’

আচ্ছা বৈশাখী, ও সব জায়গায় দৈবাৎ যদি একা একা গিয়ে পড় ট্রামে কি বাসে চড়ে, ঠিক কি মনে হতে থাকে তখন তোমার?

‘আমার? বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে ভাই, সত্যি বলছি।’

কেন?

‘যদি কেউ আমাকে অতর্কিতে মুখে হাত চাপা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে চলে যায়!’

সত্যিই তুমি এটা সম্ভব হতে পারে বলে বিশ্বাস করো।

‘নিত্য দিন এটা ঘটছে। তুমি কি কাগজ পড় না? কালকের কাগজেই দেখো, দিনে দুপুরে একটা হিন্দু মেয়েকে মুখে হাত চাপা দিয়ে পাট খেতে টেনে নিয়ে গিয়েছে। ওদের অসাধ্য কি কিছু আছে?’

কিন্তু তুমি তো থাকো কলকাতায়। এখানে, কলাবাগানে কি রাজাবাজারে কি পার্ক সার্কাসে পাট খেত আসবে কোথা থেকে? এখানে তুমি অমন ভয় পাও কেন?

‘ভয় পাই কেন, তা বলতে পারব না। তবে ভয় পাই এটা সত্যি।

অমিতা ব্যথাহত চোখে শূন্যের দিকে চেয়ে বলেছিল, হিন্দু ছাত্রীরা, আমাদের সময়ের হিন্দু ছাত্রীরা, মুসলিম ছাত্রদের ভয় পেত শামিম। এটা সত্যি কথা। তাই তারা তাদের মুসলিম সহপাঠীদের দিকে ভিড়তে চাইত না।

‘ভয়, ভয় ফুলকি, এই ভয়ের হাত থেকে আমরা কেউই নিস্তার পাইনি। আমাদের মাঝখানের দেওয়াল যে আর ভাঙল না, ভয়ই তার কারণ।’

৪৪

‘হিন্দু মুসলমানে ঐক্য নেই, আমরা কেবল এই কথাটার উপরেই জোর দিই, ফুলকি। কখনও বলিনে হিন্দু হিন্দুতেও ঐক্য নেই।’ এটা বাবার কথা। ‘ঐক্য স্থাপনের জন্য যে মানসিকতা দরকার, হিন্দু সমাজের ভেদবুদ্ধি কখনও আমাদের মনে সেই মানসিকতার জন্ম দিতে পারেনি। হিন্দুর দীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে দেখতে পারিনে, হিন্দুরা জাতীয় ভাবের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনও কাজ করেছে। এখন জাতীয়তার জোয়ার উঠেছে দেখছিস, ওটাতে জাতীয় ভাবের বিন্দুবিসর্গও নেই ফুলকি। ওটা রাজনীতির জাতীয়তাবাদ। ওই জাতীয়তাবাদী জিগির এক শ্রেণীর উচ্চবর্ণের হিন্দুর গোষ্ঠীগত ফাঁপানো অহমিকার প্রকাশ। ওটা বেনো জল ফুলকি। জাতীয়তাবাদ অমঙ্গল ডেকে আনে এই জন্য যে, ওটার ভিত্তিভূমিতে আছে কারও না কারও প্রতি বিদ্বেষ এবং ঘৃণা। যেখানে কোনও জাতির প্রতি বৈরতা নেই, সেখানে জাতীয়তাবাদ দাঁড়াতে পারে না। জাতীয়তাবাদ আর জাতীয় ভাব, দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত জিনিস। জাতীয়তাবাদ অপরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে। জাতীয় ভাব মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়ায় না। ওটা বরং মানুষকে মানুষের কাছে টানে। ভালবাসা ছাড়া জাতীয় ভাব বেঁচে থাকতে পারে না। জাতীয় ভাব দেশের এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষকে যুক্ত করে দেয়। ধর্ম কোনও অন্তরায় হয় না। জাতীয় ভাব মনে জাগলে তবেই না ঐক্য বোধ জেগে ওঠে।

‘ঐক্যবোধ মুসলমানদের মধ্যেও নেই ফুলকি।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন। ‘আমরা তো ইতিহাসের উপর আস্থা কখনও রাখিনি। আস্থা রেখেছিলাম কিছু অলীক গালগল্পের উপর। মুসলিম বেরাদরি। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। এই কথাটাই সাধারণভাবে চালু আছে। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, এটা একটা ধর্মীয় অনুশাসন। কিন্তু এই ধর্মীয় অনুশাসন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমানেরা কোনও সময় কোনও দেশে পালন করেনি। সত্যি বলতে কি, যে দেশগুলোকে আমরা মুসলিম দেশ বলে থাকি, সেই দেশগুলো খ্রিস্টান শক্তির পদানত বা প্রভাবাধীন হবার আগের এক হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে যদি তাকিয়ে দেখিস ফুলকি, তা হলে বুঝবি, মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, এটা কত বড় একটা অলীক গল্প। খ্রিস্টান শক্তি মুসলিম শক্তির গলা টিপে ধরার আগেকার যে বিস্তীর্ণ ইতিহাস, তাতে দেখা যায়, ওই সময়কালের মধ্যে, মুসলমানেরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যত যুদ্ধবিগ্রহ করেছে, সেই সময়কালের মধ্যে সারা বিশ্বের অমুসলমানদের মধ্যে ওর অর্ধেক সংখ্যক যুদ্ধও সংঘটিত হয়নি। অপরের রাজ্য অধিকার, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নরহত্যা, অথবা জিঘাংসা চরিতার্থ করবার উদ্দেশ্যে পরিচালিত এই সকল যুদ্ধবিগ্রহকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মোল্লারা ফতোয়া দিয়ে গিয়েছেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ।’ কিন্তু এটাও যে অলীক গল্প, এ যুগের শিক্ষিত মুসলমানরাও সেটা মানতে চান না। ইতিহাসের চাইতে মোল্লার মুখের আজগুবি গল্পে তাদের বিশ্বাস বেশি, এইটেই আফসোস।’

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ।

‘তুমিও তো এ জিগির শুনেছো শামিম?

শামিম বলেছিল, ‘শুনেছি চাচা।’

‘ইসলাম যে বিপন্ন, সেটাও শুনছো তো?’

‘শুনছি চাচা।’

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ।

‘এই সর্বনাশা জিগিরটার মানে বোঝো শামিম?’

শামিম অবোধের মতন তাকিয়ে আছে তায়েবকাকার দিকে। এমন একটা আবছা ছবি অমিতার স্মৃতিতে ভেসে উঠে সেই মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। তায়েবকাকার সেই তেজি গলার স্বরটা তার কানে গমগম করতে লাগল।

‘ইসলাম বিপন্ন। ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ। এর মানে তো এই বাপ, ইসলাম এখানে বিপন্ন। ইসলামকে যদি বাঁচাতে চাও হে মুসলমান, তবে এখানেও কারবালা এনে ফেল। অর্থাৎ লড়াই শুরু করো। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এর মধ্যে গোঁজামিল আছে শামিম। বোঝো কি না জানিনে। তবে তোমাদের সেটা বুঝতে হবে।’

‘কারবালা কি মুসলিম দুনিয়ায় একটাই হয়েছে শামিম? একটাই হলে ‘হর কারবালা’ কথাটার তো মানে হয় না। মুসলমানদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, কারবালা যুগে যুগেই ঘটবে। সম্ভবামি, যুগে যুগে।’ তায়েবকাকা বলতে লাগলেন, ‘প্রথম কারবালার আগে যে ইসলাম আরবে ছিল, সেই ইসলাম কি কারবালার পরে ফিরে এসেছিল? কারবালার নায়ক এজিদের খলিফাগিরি এবং শান শওকত এ সবই অবশ্য অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু সেটাই কি ইসলাম? ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য হোসেন ইমামকে অন্যায় ভাবে হত্যা করা, এই কি ইসলাম? এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই, এটা হল ইসলামের ধর্মীয় বিধান। আর ক্ষমতা অধিকারের জন্য এজিদের হোসেন ইমামকে হত্যা করা হল ইসলামের রাজনৈতিক বিধান? পরবর্তীকালে স্পেনের বিপর্যয়কে যদি দ্বিতীয় কারবালা হিসাবে গণ্য করি, তবে বলতে হবে সেখানেও ইসলাম তার জীবন ফিরে পায়নি।’

‘হালাকু চেঙ্গিস মুসলমান ছিলেন না, সেজন্য তাদের কথা বলব না।’ তায়েবকাকা তুমি আরেকদিন এ কথা বলেছিলে। ‘এমন কি ফুলকি, তোকে তৈমুর কি নাদির শাহ কিভাবে ইসলামের অবমাননা এবং মুসলমান হত্যা করেছিলেন, সে কথাও বলব না। এ ইতিহাস খুবই জানা সকলের। অনেক পরের কারবালা, পলাশীতে যে কারবালা হয়েছিল তার কথাই তোকে বলি। পলাশীতেও ইসলাম পুনর্জন্ম লাভ করেনি, জিন্দা হয়ে ওঠেনি। আরব দেশে সবই তো মুসলিম রাষ্ট্র। সেখানে মুসলিম বেরাদরি নেই কেন? কেউ প্রশ্ন করেছে? সেখানে তো নিত্যই কারবালা ঘটে যাচ্ছে। ইসলাম কি জিন্দা হচ্ছে? আমি বলতে চাই যে, কবির কল্পনা আর বাস্তব এক নয়। যেমন মুসলমান আর ইসলাম এক নয়। ইসলাম অনড়ও নয়। ইসলাম যুগে যুগে বিভিন্ন লোকের হাতে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা লাভ করেছে, বিভিন্ন লোকের মুখে তাদের রুচি অভিরুচি অনুসারে বিভিন্নরূপে প্রতিফলিত হয়েছে। খলিফা ওমর ও গজনীর সুলতান মাহমুদ, পাঠান সম্রাট নাসিরুদ্দিন ও মোগল সম্রাট শাজাহান, বাবর ও আওরঙ্গজেব, টিপু সুলতান ও মির জাফর, এরা সকলেই মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাঁদের ইসলাম এক ছিল না।’

ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ।

‘যে মোল্লারা এই ফতোয়া দিয়েছেন বা এই ধরনের জিগির তুলছেন, তাঁরা স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ইসলাম মরে।’ তায়েবকাকাকে এই সব সময় একটু উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখেছে অমিতা।

আর তখনই শুনেছে হরিকিশোরমেসোর উদ্বেগ-ভরা সেই কথা, ‘আর নয়, আজ আর নয় তায়েব। এখন তুমি শান্ত হও। তুমি বিশ্রাম নাও।’

‘নেব নেব হরিকিশোর, আমার বিশ্রাম নেবার দিন তো ঘনিয়ে আসছে। একেবারেই বিশ্রাম নেব।’ তারপরই তায়েবকাকা হা হা করে পাগলের মতো হেসে উঠতেন। ‘চোখ বোজার আগে তোমাদের দেখা পাবো, তা কি কখনও ভেবেছি? জানো কি হরিকিশোর, মাঝে মাঝে কেমন এক পাগলামি চেপে বসে আমার ঘাড়ে। কতকগুলো কথা মনের মধ্যে হুড়পাড় হুড়পাড় করে বেরিয়ে আসতে চায়.। শোনাবার লোক পাইনে। জিজ্ঞাসা করার’ লোক পাইনে, হ্যাঁরে খুব তো বলেছিলি, ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায় হর্ কারবালা কে বাদ, কথাটার মানে তোরা জানিস? ইসলাম কি কখনও মরে? ইসলাম মরে না। ইসলাম যদি না মরে, তবে হর্ কারবালা কে বাদ তার জিন্দা হবার কথা ওঠে কি করে? ওটা কি তবে লোক খেপাবার কথা নয়? বলতে ইচ্ছে করে, ইসলাম মরে না বেওকুফ, মরে মুসলমান। হর কারবালাতেই মুসলমান মরে। সাধারণ সরল সব বিশ্বাসী মুসলমান। তাঁরা এই সব ফেরেববাজ মোল্লাদের কথায় অথবা পলিটিক্যাল লিডারদের কথায় বিশ্বাস করে প্রাণ দেয়, আর তার থেকে তারা নানা ভাবে ফায়দা উঠিয়ে নেয়।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আত্মবিশ্বাসের অভাবেই হোক কিংবা দুর্বল বলে নিজেদের মনে করে, সেই কারণেই হোক অথবা ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সেই কারণে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে না বলেই হোক, ভারতের মুসলমানরা অনেকদিন থেকেই একটা ভুল ধারণার শিকার হয়ে আছে যে, বিপদে পড়লে তারা মুসলমান বলেই, বাইরের মুসলমান রাজ্যগুলো তাদের সাহায্য করতে ছুটে আসবে। কিন্তু এটা যে নিতান্তই অলীক ব্যাপার, এর মধ্যে সত্যের যে বিন্দুবিসর্গও নেই, প্যান্ ইসলাম অর্থাৎ ইসলামি বেরাদরি যে নিছক একটা স্বপ্ন, বাস্তব ব্যাপার নয়, সেটা বোঝার জন্য ভারতের মুসলমানদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। প্যান ইসলামের জুজু হিন্দুদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। আর ভয়কে সেই উসকে দিয়েছেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হিন্দু নেতারা। ইতিহাস থেকে, বাস্তবতা থেকে কেউই শিক্ষা নিতে চায় না। মুসলমানও নয়, হিন্দুও না। এ দেশে ট্র্যাজেডি ঘটবে না!’

‘তোর বাবা বলত ফুলকি, তোর বাবা বলত, সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে হবে তায়েব। বলত না হরিকিশোর?

‘হ্যাঁ তায়েব। সুধাকর বলত। শুধু মুখে বলত তাই নয়। সে এটাতে বিশ্বাসও করত। দেশবন্ধুও বলতেন এ কথা।’

‘সিডিউল কাস্টের তালিকায় যারা পড়েছে, তারাও তো সংখ্যালঘু, তাই নয় কি?’

‘অবশ্যই তায়েব, তারাও সংখ্যালঘু। তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারও তো আমরা দাবি করেছি।

‘হ্যাঁ হরিকিশোর, যারা সিডিউল কাস্ট তারা সংখ্যালঘু, তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার কোন্ ধর্মীয় ভিত্তিতে ধার্য করার দাবি আমরা করেছিলাম?’

বাবা বলতেন, ‘ইংরেজ আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্য সিডিউল কাস্টকে উস্কে দিয়েছে, এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। বর্ণহিন্দু শাসিত সমাজে এদের পরিচয় ছিল, এরা শূদ্র। এঁরা জন্মসূত্রে দাস। দাস হওয়াটাই ওদের কর্মফল। অতএব শূদ্রদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে উচ্চবর্ণের দাস হয়ে থাকতে হবে। না হলে হিন্দু ধর্ম রসাতলে যাবে। এই অমানুষিক ধর্মীয় নীতি হাজার হাজার বছর ধরে চলে এসেছে। এটা যে মানব ধর্মের বিরোধী এটাও কখনও বর্ণহিন্দু সমাজের মনে হয়নি। কারণ এই দাসগুলো না থাকলে ব্রাহ্মণ শাসিত. হিন্দু সমাজের ভিতটাই যে ধসে যায়! এরা তাই হাজার হাজার বছর ধরে নীরবে উপরতলার প্রভুদের সেবা করে এসেছে। ওটা নাকি ওদের কর্মফল। অত্যাচার নিপীড়ন অসহ্য হয়ে উঠলে এদের অনেকে বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বন করেছে, ইসলাম এলে এরাই ইসলামকে বরণ করে নিয়েছে। ইংরাজের রাজত্বে এরাই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেছে। ইংরাজ এসেই ভারতে প্রথম সেকুলার আইনের প্রবর্তন করে। ইংরাজ রাজত্বেই আমরা সেকুলার শিক্ষা পাই। তাই এত দিন পরে এদের মুখে কিছু ভাষা ফুটেছে। আর তাইতেই গেল গেল রব উঠেছে আমাদের সমাজে। আজ এরা আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি তুলেছে, তায়েব।

‘ওদের দাবির ভিত্তি কি ধর্ম?’

‘ওদের কী ধর্ম তা কি ওরা জানে? ওরা শুধু জানে যে, ব্রাহ্মণশাসিত ধর্মের নিগড় থেকে ওদের পরিত্রাণ পেতে হবে। মানুষের সমাজে ওদের মানুষের অধিকার পেতে হবে। ধর্ম নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না।’

‘সুধাকর আসল কথা বলেছিল হরিকিশোর। মানুষকে মানুষের সমাজে মানুষের অধিকার পেতে হবে। সংখ্যালঘুর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের আদত কথা হল তাই। ইসলামের অভিভাবকরা এই সহজ কথাটা ভুলে গিয়েছিলেন। ধর্ম সংখ্যালঘুদের আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তি হতে পারে না।’

১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লিগ ছিল আর পাঁচটা দলের মতোই সাধারণ একটা রাজনৈতিক দল। আর ১৯৪৬ সালে মুসলিম লিগ হয়ে দাঁড়াল ভারতের মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধি। আর জিন্না হয়ে দাঁড়ালেন কায়েদে আজম। নয় বছরের মধ্যেই এই পরিবর্তন ঘটে গেল। ঘটিয়ে ছাড়লেন জিন্নাই। কেমন করে ঘটালেন?

‘ভয় ভয় ফুলকি—জিন্না মুসলমানদের মনে হিন্দু প্রভুত্ব এবং হিন্দু রাজত্ব সম্পর্কে প্রচণ্ড ভয় ঢুকিয়ে দিতে পেরেছিলেন। ভয়টা প্রথম দিকে ছিল উপরতলায়। অর্থাৎ জমিদার নবাব নাইটদের মনেই এই ভয়টা জেগে উঠেছিল যে, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে তাঁরা হিন্দুদের অধীনেই বাস করতে বাধ্য হবেন। তাঁদের স্বার্থহানি ঘটবে। এর পরে এই ভয়টা ছড়িয়ে পড়ল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানদের মধ্যে। চাকরি-বাকরি পেশা ইত্যাদির ব্যাপারে যাঁরা ভয় পেয়েছিলেন, শিক্ষিত হিন্দু যারা এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে, তাঁদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মুসলিম মধ্যবিত্তরা এঁটে উঠতে পারবেন না। কাজেই তাঁরা জিন্নার বিভেদনীতির মধ্যে, তাঁর দ্বিজাতি তত্ত্বের মধ্যে, নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন। অন্তত তখন তাই ভেবেছিলেন। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায়, অধিকাংশই যারা যুবক ছিল, ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে, তারাই মুসলিম লিগের দল ভারী করেছিল। এরাই ছিল জিন্নার অগ্রবাহিনী। প্রোপাগ্যান্ডা ব্রিগেডের সূচীমুখ।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ফুলকি, সেই সময় মুসলিম যুবকেরা জিন্নার কথাকে বেদবাক্য বলে গ্রহণ করেছিল। শিক্ষিত মুসলমানের অধিকাংশেরই ধারণা হয়েছিল, কংগ্রেসের রাজত্ব মানেই হিন্দু রাজত্ব। এবং হিন্দু রাজত্ব মানেই মুসলমানদের সর্বনাশ। লজিক, যদি এটাকে লজিক বলা হয়, তবে সেই লজিকটা ছিল এতটাই সরল।’

শামিম বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, জিন্নার দেশভাগের দাবি, আসলে ওটা রাজনৈতিক দাবি আদায়ের এক কৌশল। পাকিস্তান ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। তাদের নিরাপদ আশ্রয়। পাকিস্তান মানে দেশভাগ নয়।

শামিম বলত, ‘ফুলকি, ভারতটা তো একটা দেশ নয়। কত রকম ভাষা, কত রকম লোক, কত রকম কালচার, কত রকম ধর্ম এই দেশে দেখছ তো? এ দেশকে অখণ্ড রাখা যাবে কি?

আবুল হাসেম বলেছিলেন, ‘এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাতেই আমাদের ভয়। ভারতে জনসংখ্যার যে রকম বিন্যাস তাতে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা মেনে নিলে মুসলমানেরা সব সময়ের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের হুকুম বরদার হয়ে থাকবে, এটাও মেনে নিতে হয়। এটা মুসলমানেরা কিছুতেই মেনে নেবে না। জিন্নাও মেনে নেবেন না।’

বাবা বলেছিলেন, ‘স্বাধীন ভারতে এককেন্দ্রিক সরকার হলে হিন্দুরাই মেজরিটি হবে, এতে সংখ্যালঘুদের ভয় তো পাওয়ারই কথা।

‘অখণ্ড ভারত সমাধান নয় মানি, কিন্তু পাকিস্তানই কি সমাধান সুধাকর?’

‘আমি সে কথা বলিনি তায়েব। আমি বলিনি পাকিস্তান কোনও সমাধান। আমি যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হল এই : ভারতকে অখণ্ড না রাখলে ভারতের লোক রসাতলে যাবে, এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হতে চলেছে আমাদের বন্ধুদের মনে। মানে ব্রিটিশের আঁকা ভারতের যে মানচিত্র সেটাই যে আমাদের ভারতমাতা, এই ধারণাটাই এখন আমাদের মনে গভীর ভাবে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। এবং এই মানচিত্রের অখণ্ডতা বজায় রাখাকে কেন্দ্র করেই আমাদের মনে জাতীয়তাবাদের উগ্রতা বেড়ে উঠছে। তায়েব, এই মানসিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই আরেক ধরনের ধর্মান্ধতা সৃষ্টি করা।’

শামিম বলত, ‘জিন্না কখনও ধর্মীয় রাষ্ট্রের কথা বলেননি ফুলকি। পাকিস্তান হবে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই।

‘পাকিস্তান কোনওমতেই ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না, জিন্না এ কথা বলেছেন ফুলকি।’

শামিম বলেছিল। জিন্না চেয়েছিলেন এক নতুন মুসলিম রাষ্ট্র, মুসলমানরা থাকবে এই রাষ্ট্রেরই আওতায়। পাকিস্তান হচ্ছে সেই রাষ্ট্র ফুলকি। অমিতার কানে শামিমের আওয়াজ ভেসে আসে। কিন্তু সে আওয়াজে তেমন জোর নেই। যেন নদীর ওপার থেকে শামিম কথাগুলো বলছে আর অমিতা আছে নদীর এপারে।

তুমি তখনও নীলগঞ্জে যাওনি। তুমি তখনও অসুস্থ হয়ে পড়নি। এ সেই তখনকার তুমি শামিম। উৎসাহে টগবগ করে ফুটতে। লিগের রাজনীতিতে তুমি তখন যোগ দিয়েছো। আমার সঙ্গে তখন তোমার যখনই দেখা হত, তুমি জিন্নার কথা বলতে। বলতে জিন্না নেহরুর মতোই সেকুলার লোক। জিন্না আধুনিক যুগের সাচ্চা প্রতিনিধি। জিন্না জানেন যে, হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানেরা কোনও ক্ষেত্রেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে উঠতে পারবে না। তাই মুসলমানদের জন্য তিনি পাকিস্তানের দাবি তুলেছেন। পাকিস্তানে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্ন থাকছে না। পাকিস্তানে হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিনাই মুসলমানেরা ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী হবে।

এই ধরনের যুক্তিতে ফুলকি মজা পেত কারণ এতে শামিমের পিছনে লাগবার সুযোগ পেত সে।

তোমার জিন্না মুসলমানদের কী ভাবেন শামিম? তারা নাবালক না মানসিক প্রতিবন্ধী?

‘কেন এ কথা জিজ্ঞাসা করছো ফুলকি?’

তুমি প্রায়ই জিন্না প্রসঙ্গে বল কি না যে, জিন্না হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াবার জন্যই পাকিস্তানের দাবি তুলেছেন। আমার কাছে এটা অত্যন্ত খেলো যুক্তি বলে মনে হয়। কারণ এর মধ্যে সত্যতা কিছুই নেই। আর জিন্নাকে আমার ধাপ্পাবাজ বলেও মনে হয় না।

এই সময় শামিম রেগে যেত। তুমুল তর্ক বেঁধে যেত দু’জনে।

‘তুমি জিন্নাকে ধাপ্পাবাজ বললে ফুলকি?’

আমি ও কথা বলিনি শামিম। তুমি আমার কথা বুঝতে পারোনি।

‘বুঝতে আমি ঠিকই পেরেছি ফুলকি। নিজের কানে শুনেছি তো? তবে কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনে।’

তুমি কানটা একজন ভাল ডাক্তার ডেকে অবিলম্বে দেখিয়ে নাও শামিম।

‘ডাক্তারের কাছে যাবার কি দরকার? আমার কানে তো অসুখ নেই।

হ্যাঁ শামিম আছে। লোকে যা বলে সেটা ঠিক ঠিক তোমার কানে ঢুকছে না আজকাল। যেমন জিন্না সম্পর্কে আমার মন্তব্যটা। আমি বললাম, জিন্নাকে আমার ধাপ্পাবাজ বলে মনে হয় না। আর তুমি বললে, আমি জিন্নাকে ধাপ্পাবাজ বলেছি।

‘তা যদি হয়ে থাকে তবে আমি সরি।

এর মধ্যে তো যদির প্রশ্ন নেই। আমি যা বলেছি তা বললাম। তুমি যা শুনেছো তা বললে। এর মধ্যে যদির প্রশ্ন কোথায় ওঠে?

‘সত্যি ফুলকি, কথা ভাল করে না শুনেই অতটা উত্তেজিত হয়ে ওঠা আমার পক্ষে ঠিক হয়নি।’

কানে যারা ভাল শুনতে পায় না. তারা ওই রকমই খেপে যায় শামিম। তুমি কানটা দেখিয়ে নাও। জিন্না সম্পর্কে আমার আরও কিছু কথা জানার ছিল, কিন্তু থাক। তোমার কানের এই অবস্থায় তোমাকে সে সম্পর্কে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পাইনে।

শামিম, তুমি সেদিন ফুলকির ফন্দি ধরতে পারোনি। সে তোমাকে নাচাতে চাইছিল।.

‘প্লিজ ফুলকি, আমার উপর রাগ করো না। আমার অন্যায় হয়ে গিয়েছে ফুলকি, আমি আন্তরিকভাবে মাফ চাইছি। প্লিজ!’

মাফ করতে পারি শামিম, যদি কথা দাও যে, কানটা দেখিয়ে নেবে।

‘কানে আমার কিছু হয়নি ফুলকি। হয়ত তখন অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। তাই তোমার কথা ভাল বুঝতে পারিনি।’

তার মানে কান তোমার ভাল, দোষটা হচ্ছে মনে? তা হলে বরং তোমার মনটাই দেখিয়ে নাও কাউকে দিয়ে।

শামিম একটু সময় নিল কথার মানেটা বুঝতে। তারপর দু’জনেই হেসে উঠল একসঙ্গে।

জিন্না প্রসঙ্গে সেদিন ওদের দুজনের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছিল।

অমিতার মনে আজও তার কিছু ছিটেফোঁটা লেগে আছে। মানুষের মনটাই কেমন অদ্ভুত। অমিতা রাজনীতি পছন্দ করত না। কিন্তু সেই রাজনীতির কথা এত খুঁটিনাটি তার মনে আছে কি করে?

‘হিন্দুদের সঙ্গে মুসলমানরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এঁটে উঠতে পারবে না, সেই জন্যই পাকিস্তান, এ যুক্তি জিন্না দিয়েছেন কি না, জানা নেই। তবে এটা যে নিতান্ত ছেঁদো কথা তা বলতে পারি। জিন্না নিজেই এর বড় প্রমাণ। তিনি আজ যেখানে উঠেছেন, তা রাজনীতির দিক দিয়েই বলো আর পেশার দিক দিয়েই বলো, তাকে তো উঠতে হয়েছে হিন্দুদের সঙ্গে কমপিট করেই। না কি হরিকিশোর?

‘বাইরে থেকে দেখায় বটে যে, কমপিটিশনটা হিন্দু মুসলিমে। আসলে কমপিটিশন তো এমন ভাবে হয় না। কে কমপিট করছে কার সঙ্গে, সেটাই হল আসল কথা। এটা হল ব্যক্তির ব্যাপার।’

‘মুসলিম লিগের প্রোপাগ্যান্ডা যত রকম ভাবে পারে মুসলমানদের একটা ভয়ের বাতাবরণের মধ্যে রেখে দিয়েছিল। ফলে তাদের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল।’

‘সেটা ঠিক বলা যায় না তায়েব।’ বাবা বলতেন। ‘ভয়ের কোনও কারণ ছিল না, মুসলিম লিগ মাস হিস্টিরিয়া সৃষ্টি করে মুসলমানের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, এটাই কি সত্যিকারের চিত্র তায়েব? তুমি যা বলতে চাইছো তাতে বড় জোর যাদের ভেস্টেড্ ইনটারেস্ট আছে সেই সব লোকেরা ভয় পেত। যেমন কংগ্রেসের নীতি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষক প্রজা আন্দোলনেরও এই ধরনের নীতি ছিল। তাতে তো মুসলমান কৃষক ভয় পায়নি। চাকরির ব্যাপারে ভয়ের কারণ ছিল, এটা একটা বড় ব্যাপার তায়েব। পেশাদার লোকেরাও ভয় পেতে পারতেন। কিন্তু সে ভয় এমনভাবে সাধারণ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল কেন? আর সে ভয়ের কোনও ভিত্তিই যদি না থাকবে, প্রতিপক্ষ সে ভয়কে ভেঙে দিতে পারল না কেন? কারণ কংগ্রেসেই তো তখন সব চাইতে পোড়খাওয়া রাজনীতিকেরা ছিলেন। গান্ধী ছিলেন, জওহরলাল ছিলেন, সর্দার প্যাটেল ছিলেন, আবুল কালাম আজাদ ছিলেন। আরও অনেক মুসলিম নেতা ছিলেন কংগ্রেসে। তাঁরা কি করছিলেন? জিন্না একা মিথ্যা ভয় ছড়িয়ে যেতে লাগলেন, আর অন্য সকলে তাঁর সঙ্গে এঁটে উঠতে পারলেন না, এটা কি বিশ্বাস্য বলে মনে হয়? অনেকেই অনেক রকম সাকাই গেয়েছেন তায়েব, কিন্তু আজ পর্যন্ত আমি দেখিনি, কেউ এই প্রশ্নটার জবাব ঠিক ঠিক দিয়েছেন।

‘হিন্দু মেজরিটির ভয়টা অমূলক ছিল না।’

‘ছিল না তো? বেশ এবার বলো, মুসলমানের পক্ষে, যে ভাবে দেশের পলিটিকস আজ চলেছে, তাতে হিন্দু মেজরিটিকে ভয় পাওয়াটা কি একেবারেই ভ্রান্তি? তাই কি বলতে চাইছো তায়েব?

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ফুলকি, তোর বাবা আমাকে একবার বলেছিল, তায়েব, ধর্ম যে জাতির · ভিত্তি হতে পারে না, এটা তো সহজ কথা। একদিক দিয়ে দেখলে এটা খুবই সহজ কথা। কিন্তু তবুও জিন্না হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি বলে যখন তার দাবি পেশ করলেন, তখন শত যুক্তি দিয়েও তাঁর দ্বিজাতি তত্ত্বকে খণ্ডন করা গেল না। শুধু যে হিন্দুরাই দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল তা তো নয়। মুসলমানদের মধ্যেও জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে অনেক আওয়াজ উঠেছিল। সব চাইতে তীব্র আওয়াজ তুলেছিলেন, দেওবন্ধের উলেমা সম্প্রদায়। জমায়েত-ই-উলেমা-ই-হিন্দ মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান, জিন্নার এই দাবির জোর বিরুদ্ধতা করেছিলেন। ভৌগোলিক জাতীয়তাবাদ ইসলামের বিরোধী, এই ছিল তাঁদের মত। লাহোরে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তাতে সভাপতিত্ব করেছিলেন স্বয়ং বাদশা খান। বাদশা খানের সভাপতিত্বে সেই সম্মেলনে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবি, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে নির্বাচন ও চাকুরিতে সংরক্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়েছিল। সিন্ধুর প্রধানমন্ত্রী আল্লা বসের সভাপতিত্বে কংগ্রেস ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত দিল্লির অখিল ভারতীয় আজাদ মুসলিম সম্মেলনে চোদ্দ শ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা সবাই একবাক্যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভাজনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন এবং মুসলিম লিগই মুসলমানদের একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান, এই দাবিকে খারিজ করেছিলেন। এতৎসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত মুসলমানেরা, সব মুসলমান না হলেও বিপুল সংখ্যক মুসলমান, জিন্নার কথাকেই বেদবাক্য বলে গ্রহণ করেছিলেন। কেন? জিন্নার ঝুলিতে তো কোনও ম্যাজিক পাওয়ার ছিল না।

বাবা বলেছিলেন, ‘মনে আছে তায়েব গান্ধীজি বলেছিলেন, ইংরাজ ধর্মান্তরিত হলেও ইংরাজই থেকে যায়। মনে আছে?’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মনে আছে সুধাকর, মনে আছে। এটাও মনে আছে, এর জবাবে জিন্না কি বলেছিলেন, সেটাও।

বাবা বলেছিলেন, ‘জিন্না বলেছিলেন, হ্যাঁ, কোনও ইংরাজ ভিন্ন ধর্ম গ্রহণ করলেও সে ইংরাজ থেকে যায়, কিন্তু ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সে যুক্তি খাটে না। কারণ এখানে ভিন্ন ধর্ম কেউ গ্রহণ করলে হিন্দুদের চোখে সে ম্লেচ্ছ হয়ে যায়। এবং হিন্দুরা সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অথবা কোনও ভাবেই তার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখে না।’

‘তোর বাবা বলত ফুলকি, কেউই জিন্নার এই কথাকে খণ্ডন করতে পারেনি। কারণ এই কথাটা সত্য। এই সত্যটার উপরেই জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব দাঁড়িয়ে ছিল।

তায়েবকাকা কিছুক্ষণ চুপ করে ছিলেন। ঘরে পাখার আওয়াজ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ ছিল না।

‘আমি জানি, আমি জানি তায়েব, জিন্নার এই উক্তি সত্য এবং কত মর্মান্তিকভাবে সত্য। এর জবাব ছিল না বলেই জবাব দেওয়া যায়নি। আমাদের দেশভাগের এটা হল আসল ভিত্তি। জিন্না নিমিত্তমাত্র।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *