৩৫
‘আমার মাথায় সেদিন হঠাৎ রাগ চড়ে গিয়েছিল ফুলকি। সেই বটতলার পুঁথিগুলো আমার রক্তের যেন আগুন ধরিয়ে দিল। বেচারি রেশমা!’
তুমি লিখেছিলে, তুমি আর রাগ সামলাতে পারনি শামিম। তুমি রেশমার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিলে। সেটা তোমার উচিত হয়নি শামিম।
‘আমি তো কখনও রেশমার গায়ে হাত তুলিনি ফুলকি। কিন্তু তখন আমার বয়েসও তো কম ছিল।’
‘তুই এ সব বই পড়িস, রেশমা?’
‘হ্যাঁ শামিম ভাই।’ রেশমার চোখ দুটো উৎসাহ। জ্বলজ্বল করছিল।
‘এই সব ছাই ভস্ম পড়ায় তোকে মৌলভী?’
‘হ্যাঁ শামিম ভাই, মৌলভী সাবে কয়, এই সব কিতাবই আসল। আখেরাতে এই শিক্ষাই সরাসরি আমাদের বেহস্তে পৌঁছে দেবে।’
‘মৌলভী তোকে এ সব কথা বলে?’
‘হ্যাঁ শামিম ভাই। রোজই তো বলেন।’
‘আর আমি যে বইগুলো তোকে এনে দিয়েছিলাম? সেগুলো কোথায় গেল?’
‘তুমি শুনবে শামিম ভাই, শহীদে কারবালা তোমাকে শোনাব?’
‘আমার শরীর রি রি করছিল ফুলকি। রেশমাকে জিজ্ঞাসা করলাম আবার, আর আমি যে বইগুলো তোকে এনে দিয়েছিলাম, সেগুলো কই?’
‘সে বইগুলো আছে। আমি যত্ন করে তুলে রাখিছি। তোমাকে তাইলে জঙ্গনামা শোনাব শামিম ভাই? মৌলভী সাব বলেন যে, আমি ভাল পড়ি। কত লোকের শুনাই। তুমিই খালি শুনতে চাও না শামিম ভাই?’
‘ও সব ছাই ভস্ম শুনে নষ্ট করার সময় আমার নেই। তুই যে এই সব যা তা পড়ে যাচ্ছিস, এতে তোর কি উপকার হবে রে রেশমা? ভেবে দেখেছিস কখনও?
‘রেশমা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইল। ওর উৎসাহে আমি জল ঢেলে দিয়ে আরাম পাচ্ছিলাম।
‘আমি যে বইগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো নিয়ে আয় তো দেখি?’
‘রেশমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটতে লাগল। নড়ল না।’
‘যা বইগুলো নিয়ে আয়?’
‘রেশমা নড়ছে না আমার সামনে থেকে। সে নখ খুঁটতে থাকল। রেশমা আমার অবাধ্য হচ্ছে! আমি যা বলছি রেশমা শুনছে না! রেশমা! য়ে আমার হুকুম নির্বিচারে পালন করে এসেছে এতদিন। সেই রেশমা আমার কথা শুনছে না!’
পুরুষ! পুরুষ! অমিতা শামিমের বিবর্ণ চিঠিখানা চোখের কাছে তুলে নিয়ে এল। যেন শামিমকেই স্পষ্ট ভাবে দেখে নিচ্ছে। তোমার মধ্যেও হিংস্র পুরুষটা জেগে উঠেছিল শামিম! তোমার থাবা তোমার নখ রেশমার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছি। তুমিও মূলত সেই পুরুষ শামিম! রেশমার জন্য অমিতার বুকটা টন টন করতে থাকল।
‘রেশমা, বইগুলো কি খেয়ে ফেলেছিস?’
‘না শামিম ভাই, আছে।’
‘আছে? কোথায় আছে? আমি দেখতে চাই।’
রেশমা কি বলতে যাচ্ছিল, শামিম চুলের মুঠি ধরে রেশমাকে তার কাছে টেনে আনল।
‘আনবি কি আনবি না!
রেশমা কোনও কথা বলল না। অবাক চোখে শামিমকে দেখতে লাগল। বুঝতে পারছিল না, তার কি এমন কসুর যে, শামিম ভাই, তার শামিম ভাই এমন ভাবে তার উপর রেগে গেল।
‘জেদী মেয়ে। কথা বলছি তা কানে যাচ্ছে না। এত জেদ তোর!’ শামিম রেশমার গালে ঠাস করে মারল এক চড়। রেশমার পাতলা গাল যেন ফেটে গেল। লাল টকটক করতে লাগল।
‘ফুলকি, সে কয়েক বছরের আগের কথা। কিন্তু আমার অনুশোচনা আজও যায়নি। রেশমা তখন শুকনো চোখে অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে রয়েছে। ফুলকি, তখন আমার খেয়াল হল, কি অন্যায় আমি করেছি। সেইদিনের সেই ছোট রেশমার ওই বিস্মিত চোখের দৃষ্টি আমি কখনোই ভুলতে পারিনি ফুলকি। সেই দৃষ্টি আমাকে অনেকদিন তাড়া করে বেড়িয়েছে। কতদিন আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে। .দেখেছি রেশমা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে। আসলে আমি তো একটা অক্ষম পুরুষ, সাহস নেই আমার সমাজকে এই কথা চেঁচিয়ে বলি, এই বিশ শতকে তোমাদের এই ‘দীনী এলেম’ মুসলমানকে অন্ধকারে বন্দি করে রাখবে। মুসলমান সমাজকে অন্ধ করে রাখবে। দুনিয়া এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তোমরা পড়ে থাকবে পিছনের দুনিয়ার এক মোহময় অলীক স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে অতীত গরিমা যতই মহিমময় হোক না কেন, সেটা অতীতই, সেটাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। সেখানে আর ফিরেও যাওয়া যাবে না। তোমাদের সার্থকতা দেবে ভবিষ্যতের দুনিয়া। বর্তমানে তোমরা চোখ খুলে দেখ, দুনিয়ার গতি বোঝবার চেষ্টা কর, ভবিষ্যতের দুনিয়ার সুনাগরিক যাতে হতে পারে, তার জন্য কঠোর তপস্যা কর। আসলে সেদিন এ কথা আমারও তত ভাল জানা ছিল না। এ সব কথা জেনেছি ফুলকি, তোমাদের সংস্পর্শে এসে। তোমাকে ভালবেসে।।’
রেশমা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। শামিমের রাগও পড়ে এল। অনুশোচনা তীব্র হয়ে উঠছে তখন তার মনে। তার চোখেও তখন জল এসে পড়েছিল। শামিম রেশমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে এল। আর সেই মুহূর্তেই রেশমা তার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল।
‘আসলে আমার রাগ তো রেশমার উপরে ছিল না ফুলকি। রাগটা ছিল অন্ধ সমাজের উপর। তার চোটটা পড়েছিল রেশমার উপর।’
রেশমা ফুলেফুলে কাঁদছিল আমার বুকে, আর বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিল, ‘আমার কসুর কি শামিম ভাই, আমার কসুর কি। মৌলভী সাব ওই সব বই পড়তে আমাকে মানা করেছেন। তবু আমি লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছি। একদিন খালু (আমার বাবা ফুলকি) ধরে ফেলেছিলেন। সে কি বকাঝকা। অনেক কষ্টে বইগুলো লুকিয়ে রেখেছি। অনেক রাতে যখন তোমার কথা মনে পড়ত, তুমি তখন জেলে, তখন খুব খারাপ লাগত আমার। আমি বইগুলো বের করে আনতাম। একটু একটু পড়তে চেষ্টা করতাম। কিন্তু কে আমাকে শেখাবে শামিম ভাই?’
‘তুই সত্যিই শিখতে চাস রেশমা?’
‘হ্যাঁ, শামিম ভাই, শিখতে চাই। তুমি আমাকে শেখাবে?’
‘আমি রেশমার সেই আশাদীপ্ত মুখটাকেও ভুলতে পারিনে ফুলকি। মুসলিম মেয়েদের অসহায়তা তুমি অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পার ফুলকি, কিন্তু বাস্তবে সে অসহায়তার চেহারা কি, সে সম্পর্কে তোমার বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই হয়ত?’.
সব মেয়েরাই সমান অসহায়। তুমি পুরুষ শামিম, তাই জান না। পুরুষের জগতে হিন্দু আছে, মুসলমান আছে। কিন্তু মেয়েদের জগতে শুধু মেয়েরাই আছে। তারা হিন্দু নয়, তারা মুসলমান নয়। তারা শুধুই মেয়ে। সব বঞ্চনার তারাই শিকার। অমিতার মুখটা থমথম করতে লাগল।
‘সত্যিই পড়বি তো রেশমা?’
‘তুমি যদি পড়াও শামিম ভাই তবে পড়ব। তুমি আমাকে পড়াবে?’
‘তোর খুব লেগেছে না রে?’
রেশমা শামিমের বুকে আবার মুখটা লুকিয়েছে সেদিন। অমিতা যেন শরৎবাবুর কোনও উপন্যাস পড়ছে। চিঠিখানা যেদিন আসে সেদিন ফুলকির কি মনে হয়েছিল সেটা জানার কোনও উপায় নেই। অমিতা তার স্মৃতির পসরা তুলে তন্ন তন্ন করে দেখল ফুলকির অনুভবের কোনও হদিশ পেল না তার অনুমান, ফুলকি মজাই পেয়েছিল।
‘আমি তোকে আজ সন্ধ্যা থেকেই পড়াব। তবে আমি আর কদিন। আমার ছুটি তো প্রায় ফুরিয়ে এল। এর মধ্যে আর কতটুকুই বা শিখবি?
‘আবার যখন ছুটিতে তুমি আসবে, তখন পড়বে।’
‘না, না, রেশমা, আমিও যাব, আর তুইও বইপত্তর গুটিয়ে রেখে দিবি। বামুন গেল ঘর তো লাঙল তুলে ধর। তোর সেই অবস্থাই হবে। একটা কিছু পাকা ব্যবস্থা করে যাব এবার। আবু যাই বলুন, আর তোর মৌলভী যাই করুন। এটা চলতে দেওয়া যায় না। বুঝতে পারছিস নে, কি সর্বনাশ তোর হবে।’ তুই যদি কেবলই গোলে বকাউলি আর জঙ্গনামা, এই সবই পড়তে থাকিস, তুইদুনিয়াকে চিনবি কি করে? আর তা ছাড়া বিয়ে শাদীও তো তোর হবে, নাকি? যা তোর এলেম, তোর তো মৌলভী ছাড়া বরই জুটবে না রে রেশমা? কি, ওই রকম একটা মৌলভীকেই কি তুই শাদী করতে চাস?’
রেশমা লজ্জা পেয়ে বলেছিল, ‘যাঃ!’
‘তুই লিখতে জানিসনে, পড়তে জানিসনে, খালি কোরান তোলাওয়াত করতে জানিস, কোনও শিক্ষিত ছেলে কি তোকে বিয়ে করবে? করবে না। তখন?’
‘আমার এই কথাতে বোধ হয় একটু কাজ হয়েছিল ফুলকি। রেশমা দেখি গম্ভীর হয়ে গেল। আমি রাতে খাবার সময় খালুকেও সেই কথা বলেছিলাম। আমার তখন হয় এসপার নয় ওসপার, এমনই অবস্থা। . আমি খালুকে স্পষ্ট করে বললাম, খালু, আপনি কি চান? আপনার এত বিষয় সম্পত্তি, এত প্রভাব প্রতিপত্তি, সেই আপনিও যদি মোল্লা মৌলভীদের ভয়ে রেশমাকে লেখাপড়া, যে লেখাপড়া আপনি করেছেন; সেই লেখাপড়া যদি না শিখিয়ে যান, তাহলে ওর ভবিষ্যতের হাল কি হবে, যা জানেন? রেশমাকে শাদী দেবেন তো? আপনার বিষয় সম্পত্তির অভাব নেই, জানি রেশমার পাত্রের অভাব হবে না। কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষিত সৎ ছেলে কি আপনি পাবেন, ওই অশিক্ষিত মেয়েটার জন্য। অথচ রেশমার তো কোনও কসুর নেই খালু? এটা কি আপনারা ভেবে দেখেছেন কখনও!
খালু বলেছিলেন, ‘তুমি যা বললে শামিম, তা তোমার মতো শিক্ষিত ছেলের উপযুক্ত কথাই বলেছ। ভয় তো আর কাউকে নয়, ভয় করি তোমার বাবাকে বাপ। দেখছ তো দেশ গাঁয়ের কি অবস্থা দাঁড়াচ্ছে? আজিজ এখন কাঠ মোল্লা হয়ে উঠেছে। ওর নুইসেন্স্ সৃষ্টি করবার ক্ষমতাকেই ভয় করি বাপ। তোমাকে সত্য কথাটা বললাম। আমাদের এদিকে কিছুদিন আগেও এত রেষারেষি, এত হিংসা দ্বেষ ছিল না। এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, কি হবে আমাদের ভবিষ্যৎ ভেবে ভয় পাই। তোমার বাবাই এখন ইসলামের রক্ষক হয়ে উঠেছেন। নায়েবে নবী, এই অঞ্চলের নায়েবে নবী এখন উনিই। কিন্তু কথাটা আমার মনে ধরেছে। রেশমার শিক্ষার জন্য একটা কিছু করা দরকার।’
খালা বললেন, ‘রেশমার সঙ্গে তো তোরই শাদী হবে বেটা। এটা আমরা ঠিক করে রেখেছি।’ ‘আমার সঙ্গে! বোঝ ফুলকি? ভাবতে পারা যায়। তুমি হয়ত হাসছ? কিন্তু কথাটা সত্যই সেদিন আমার কাছে মোটেই হাসির কথা ঠেকেনি। আমি খালার মুখে কথাটা শুনেই খেপে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম, বয়ে গিয়েছে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে। নিজেরা তো আমাকে লেখাপড়া শিখিয়েছ, আর মেয়েটাকে পাড় মুখ্য করে রেখেদিয়েছ। এখন আবার আমার ঘাড়ে সেই ভুষি মাল গছিয়ে দেবার মতলব করছ! সে হবে না খালা। তোমার মেয়ে লেখা জানে না, পড়া জানে না, খালি কোরান তেলাওয়াত করতে জানে। ও মেয়েকে নিয়ে আমি কি করব?’
অমিতা যেন শামিমের খালা আর শামিমের এই তর্ক বিতর্ক চোখে দেখতে পেল। তর বেশ মজা লাগছে। ফুলকিও নিশ্চয়ই মজা পেয়েছিল।
‘ব্যাপারটা তোমার কাছে হয়ত আজগুবি ঠেকছে। নয় কি? হিন্দুদের মধ্যে এ ধরনের বিয়ে হয় না। তারা আমাদের ঠাট্টা করে বলে, চাচা আপন চাচী পর, চাচীর মেয়ে বিয়ে কর। তাই শুনে আমাদের সমাজের লোকেরা খেপে যায়। কিন্তু এতে খেপার কি আছে? ব্যাপারটা তো সত্য।’
খালা আমার কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘ব্যাটা বলিস কি? তুই রেশমাকে শাদী করবিনে! হায় আল্লাহ!’
খালু বলেছিলেন, ‘থাক থাক, এখন ও কথা থাক। বরঞ্চ শামিম যা বলেছেন, সে কথাটাই বুঝতে চেষ্টা কর। না, রেশমাকে এমনভাবে রাখলে চলবে না। সত্যিই তো, হুঁ, ঠিক বলেছে শামিম বাপ। ব্যবস্থা একটা করতে হবে।’
‘খালুকে সেবার রাজি করাতে পেরে মনে বড় আনন্দ হয়েছিল ফুলকি। ফুলকি, তোমার মনে আছে, তোমাদের বাড়িতে তুমি একদিন তায়েবচাচাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে, তুমি তখন মহিলা সওগাত পড়েছে, মনে পড়ে ফুলকি, তুমি বলেছিলেন, এই সব প্রতিবাদী মহিলাদের আওয়াজ আজও কি তোমাদের সমাজে উঠছে তায়েবকাকা, এমনি ভাবে? চাচা বলেছিলেন, এখন শোনা যায় শুধু পলিটিক্যাল প্রতিবাদ। রাজনৈতিক প্রতিবাদের সমবেত কণ্ঠের সব রকম নৈতিক প্রতিবাদের সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদের আওয়াজ চাপা পড়ে গিয়েছে। তুই যাদের কথা বলছিস, তারা কোথায় হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের যুগে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা হাতে গোণা যেত। কিন্তু সেই যুগে শিক্ষিত লোকেরা কোনও কিছুই বিনা বিচারে মেনে নিত না। তর্ক করত, প্রশ্ন করত। এমন নির্বিচারে কিছুই তারা মেনে নিত না। প্রতিবাদ তাদের কণ্ঠেই শোনা যায়, যারা সব কিছু বিচার করে গ্রহণ করতে চায় মা। আজ প্রতিবাদ করতে কেউ সাহস করে না। যুক্তিহীন কথাকেও ‘কওমের স্বার্থে’ মেনে নিতে হবে। কি গো বাপ শামিম, ঠিক বলেছি তো। ‘কওমের স্বার্থে’ অন্যায়কে ন্যায় বলে মেনে নাও। ‘ইসলামের স্বার্থে’ জিগির দাও, ‘লে কর রহেঙ্গে পাকিস্তান’, ‘মুসলিম স্বার্থে নাড়া দাও, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। এর মধ্যে যুক্তির প্রশ্ন, বিচার বিবেচনার প্রশ্ন তুলতে গেলেই ‘কওমি লাঠি’ তোমার মাথায় পড়বে। কলকাতায় বসে তায়েবচাচার কথার যেকি গুরুত্ব সেটা বোঝা যেত না, ফুকি। নীলগঞ্জে এসে, এখানে আটকা পড়ে, বুঝতে পারছি, চাচার কথা কত সত্য! ভয় করে, আমার ভয় করে ফুলকি।
তুমি কবে আসবে শামিম, সেই আশায় আমি পথ চেয়ে বসে আছি। রোজই সন্ধ্যায় বাবার বৈঠকখানায় যখন থেকে কাকারা এসে বসেন, আমি সেই তখনই সেখানে চলে যাই। যদি তুমি আস! আর বৈঠক শেষ হওয়া পর্যন্ত বসে থাকি। যদি তুমি আস? কেউ ভাবেন, পলিটিকসে আমার আগ্রহ বেড়েছে, কেউ ভাবেন, আমি বোধ হয় বাবাকে দেখভাল করবার জন্যই সেখানে বসে থাকি। কিন্তু আমি জানি, আমি কেন ওখানে হাজির থাকি। তুমি জান শামিম, তুমিও জান। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়, এই বুঝি তুমি এসে পড়লে। কিন্তু তোমার শরীর কেন সারছে না শামিম? ওখানে কি ভাল ডাক্তার নেই?
‘বদলে যাচ্ছে নীলগঞ্জ। ফুলকি নীলগঞ্জ একেবারে বদলে গিয়েছে।
চিঠিখানা ফুলকি শামিমের আর্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
‘আমার ঘুষঘুষে জ্বর হচ্ছে। কবিরাজ বলেছেন, এতে ভয়ের তেমন কোনও কারণ নেই। একটা বড় অসুখের পর এই রকম উপসর্গ এসেই থাকে। সে নিয়ে আমি চিন্তা করছিনে। আমি শুধু চাইছি, আমার গায়ে কলকাতায় যাওয়ার মতো বলটা যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু আমি যত আঁকুপাকু করছি ততই সেটা ভেস্তে যাচ্ছ। এক সময় নীলগঞ্জকে খুব ভালবাসতাম ফুলকি। মাকে তো মনে পড়ে না, কিন্তু মায়ের কথা মনে হলেই আমার চোখে নীলগঞ্জের চেহারা ভেসে উঠত। এখন আর এখানে একমুহূর্তেও নিঃশ্বাস ফেলতে পারিনে। নীলগঞ্জে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।’
শামিম শামিম শামিম!
‘নীলগঞ্জ আমার জায়গা নয় ফুলকি, আমার জায়গা কলকাতা।’
তুমি চলে এসো শামিম। দেশে নানা ঘটনা দ্রুত ঘটে যাচ্ছে। বাবার বৈঠকখানায় অনেকদিন পরে উত্তেজনার ছোঁয়াচ লেগেছ শামিম, এ সময় তুমি কোথায়?
‘ফুলকি ফু-লুকি ফু-লকি! অসহ্য, এ অসহ্য!’
অনেকদিন বাদে বাবাকে আবার তাজা দেখলাম শামিম। তাঁর চোখে তাঁর মুখে উৎসাহের ঝিলিক দেখলাম শামিম। খেতে বসে বললেন, ‘কি রে শামিমের অসুখ এখনও সারছে না কেন?’ তারপর বললেন, ‘ফুলকি, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব যদি আমরা গ্রহণ করতে না পারি, তবে আমাদের চরম সর্বনাশ কেউ খণ্ডাতে পারবে না।
বাবা এর আগে আমার সঙ্গে কোনও দিনও এমন সরাসরি রাজনীতির কথা আলোচনা করেননি।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর কি মনে হয়?
আমার? বাবা আমার মত জিজ্ঞাসা করছেন! বাবার কথার একটা উত্তর দিতে আমার খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু বাবার এই আচমকা প্রশ্নের কোনও উত্তরই আমার মনে এল না তখন। ফুলকি দেখল, তার মাথাটা একদম খালি।
ফুলকি থতমত খেয়ে বলেছিল, আমি, আমি তো এ বিষয়ে কিছু ভাবিনি বাবা।
বাবা অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘তোরা না ভাববি তো কে ভাববে? তোদের ভবিষ্যৎ এই একটা ব্যাপারের উপর নির্ভর করছে। তোদের মতামতের, উপরেই নির্ভর করছে তোদের ভবিষ্যৎ। তোরা এই ব্যাপারটা ভাববি না!’
আসলে আমি তো তেমন করে বুঝতে চেষ্টা করিনি বাবা। গুরুত্ব দিইনি।
বাবার রুগ্ন পাণ্ডুর মুখে হতাশার একটা ছাপ পড়ল। অন্তত ফুলকির তখন তাই মনে হয়েছিল। বাবার জন্য কষ্ট বোধ করছিল ফুলকি। বাবা যে কত একা, সেটা এই প্রথম বুঝতে পারল ফুলকি। বন্ধুসঙ্গই বাবাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। দিদি নেই। চুমকি হস্টেলে। ফুলকির সঙ্গে তেমন কথাবার্তা কমই হয়। ফুলকি অনেকদিন পরে যেন ওর বাবার কাছে এসে গেল।
ক্যাবিনেট মিশন ক্যাবিনেট মিশন কথাটা তোমাদের মুখে শুনি। কাগজেও মাঝে মাঝে দেখি কিন্তু আমার মাথায় ভাল ঢোকে না। তুমি আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে বাবা?
৩৬
‘কাল শরীরটা একটু ভাল বোধ করছিলাম। জ্বর কমেছে। দুর্বলতা আছে। খালুর দহলিজে গিয়ে বসেছিলাম। দেখলাম হ্যাজাগ ডে-লাইট জড় হয়েছে সেখানে। আমার মনে হল বুঝি যাত্রার আসর বসবে নীলগঞ্জে। খালুর দহলিজে হ্যাজাগ লণ্ঠন জড় হবার মানে আমাদের কাছে ছিল যাত্রার আসর। নীলগঞ্জে এক সময় খুব যাত্রার হত। বাইরে থেকে, কলকাতা থেকে ভাল ভাল দল আসত। বরিশালের নট্ট কোম্পানির তখন খুব পসার। আর নদীয়ার মতি রায়ের দল। নীলগঞ্জে ছিল দু দুটো যাত্রার দল। আমরা যখন ছোট তখন মামুদ মিঞা একটা দলের অধিকারী ছিলেন। আর একটা দল ছিল পুন্নু তাঁতির। কত যে যাত্রা দেখেছি এই দুই দলের। তাই কাল ভেবেছিলাম, বুঝি আবার যাত্রাই হবে। কিন্তু খালুর বাড়ির মাহিন্দর গলু সর্দার জানাল, না যাত্রা নয়, তবলিগ হবে। যাত্রা তো এ পাড়ায় কবেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যাত্রা দেখতে চাও তো হিন্দু পাড়ায় যাও। শুনলাম আমার আব্বুই ফতোয়া দিয়েছিলেন। এটা আমার কাছে একটা প্রচণ্ড শক্ ফুলকি! এখন এ পাড়ায় হয় ওয়াজ মহফিল আর তবলিগ।’
‘সি আর দাশ আর এম এন রায়’, বাবা বলেছিলেন, ‘এই দুজনকেই আমি আন্তর্জাতিক ঘটনার বিশ্লেষণ ঠিক ভাবে করতে দেখেছি। এম এন রায় প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, এই যুদ্ধে ফাসিবাদের পতন ঘটলে সাম্রাজ্যবাদেরও পতন ঘটবে। আমাদের স্বাধীনতা আসবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মারফত। রায় বলতেন, ‘ট্রানস্ফার অফ্ পাওয়ার।’ তখন এই কথা বলাতে মানবেন্দ্রনাথকে অনেক হেনস্থা সহ্য করতে হয়েছিল। রায় বলেছিলেন, উপনিবেশগুলো হয়ে উঠবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদের গলগ্রহ। যুদ্ধের মধ্যেই উপনিবেশে স্থানীয় পুঁজিপতিরা সাম্রাজ্যবাদীদের মূলধনে ভাগ বসাবে। উপনিবেশ রাখাটা লাভজনক হবে না। তা সে কথাটা ফলেই গেল ফুলকি। যুদ্ধ শেষ হতেই ব্রিটেনে লেবার পার্টি সরকারে এসে গেল। তখন থেকেই প্রধানমন্ত্রী এটলি আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করে গিয়েছেন ভারতের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করতে।
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আর সি আর দাশ কি বলেছিলেন রাশিয়া সম্পর্কে, সেটা ফুলকিকে বল সুধাকর। ওরা জেনে রাখুন সি আর দাশ কত সত্যদ্রষ্টা ছিলেন।
বাবা বলেছিলেন, ‘রাশিয়াতে ১৯১৯ সালে বলশেভিক বিপ্লব হয়। আর সি আর দাশ গয়া কংগ্রেসের সভাপতি হন ১৯২২ সালে। সেই তখনই তিনি বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার সাম্প্রতিক বিপ্লব গভীর ভাবে ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। এখন যে অবয়ব উহা গ্রহণ করিয়াছে তাহা অনিচ্ছুক রাশিয়ার প্রতিভার উপর মার্কসীয় মতবাদ ও মতবিশ্বাসকে জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়ার ফল। হিংসা হিংস্রতার আবার পরাভব ঘটিবে। আমি যদি ঘটনাকে সঠিকভাবে বুঝিয়া থাকি তবে আমি একটি প্রতিবিপ্লব আশা করিতেছি। রাশিয়ার আত্মা কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্র হইতে মুক্তি পাইতে অবশ্যই চেষ্টা করিবে। অবশ্যই তাহাকে সংগ্রাম করিতে হইবে। ইহা কোনও স্বতন্ত্র আন্দোলনও হইতে পারে, অথবা এমনও হইতে পারে যে, বর্তমান আন্দোলনের মধ্যে যে মুক্তিকামী শক্তি কাজ করিতেছে তাহাই মুক্তি আনিয়া দিবে।’—এটা ছিল সি আর দাশের আন্তর্জাতিক ঘটনার বিশ্লেষণ।’
‘আমি সেদিন আরও একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম ফুলকি। সে আমার সাদিক স্যরকে দেখে। সাদিক স্যর ছিলেন নীলগঞ্জ এম ই ইস্কুলের বাংলার শিক্ষক। সাহিত্যরসিক হিসাবে নীলগঞ্জে ওর খুব নাম ছিল। আমি যখন নীলগঞ্জের ইস্কুলে পড়ি, তখন আমাকে দেখে স্যরের মনে হয়েছিল যে, আমার মধ্যে এক বিরাট কবি লুকিয়ে আছে। সেই কবিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য স্যার কত চেষ্টাই না করেছেন। বাংলা সাহিত্যের আস্বাদ আমি সাদিক স্যরের কাছ থেকেই প্রথম পাই। সাদিক স্যর আর আমাদের ইংরাজির স্যর জগত বিশ্বাস, এঁরাই ছিলেন আমার তখনকার গুরু। ওঁরা দুজনে হরিহর আত্মা ছিলেন। এবং নীলগঞ্জে একটা লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। এই সাদিক আমার অনুরোধে রেশমাকে বাড়িতে পড়াতে রাজি হয়েছিলেন। এবং সত্যিই যত্ন করে রেশমাকে পড়িয়েছেন। সাদিক স্যর ছিলেন শরৎচন্দ্রের গোঁড়া ভক্ত। আমাদের প্রায়ই বলতেন, শরৎচন্দ্রের মতন দরদী লেখক পৃথিবীতে একটাই হয়। ওঁরই উচিত ছিল নোবেল পুরস্কার পাওয়া। ব্যাকিং ছিল না বলে শরৎচন্দ্র নোবেল পুরস্কার পাননি, এ কথা সাদিক স্যর বিশ্বাস করতেন। এবং এ নিয়ে কী আফসোসই না করতেন!
‘লেবার গভর্নমেন্টের প্রাইম মিনিস্টার হয়েই এটলি কালবিলম্ব না করে ভারতে কেবিনেট মিশন পাঠিয়েছেন। লর্ড পেথিক লরেন্স, স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস আর মিঃ এ ভি আলেকজান্ডার।’
‘হ্যাঁ, এঁদেরকে আধুনিক যুগের পলিটিক্যাল ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বলতে পার সুধাকর। হরিকিশোরমেসো ঠাট্টা করেছিলেন।
‘দেখ হরিকিশোর, খবরদার ঠাট্টার ছলেও তুমি ক্যাবিনেট মিশনের মেম্বারদের ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর বলে চিহ্নিত করে দিও না। আমাদের মুসলিম মাইন্ডের কাছে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে না। আমাদের নাকে হিন্দু হিন্দু গন্ধ লাগবে।’
তায়েবকাকার রসিকতায় সকলেই হো হো করে হেসে উঠলেন।
বাবা বলেছিলেন, ‘বখেড়ায় দরকার কি রে ভাই, আমরা বরং ওঁদের ট্রিনিটি বলি, তাহলেই হল।’
হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘স্টেটসম্যান কি লিখেছে পড়েছেন?’
‘নো অল্টারনেটিভ’ তো পড়েছি।’
তায়েবকাকা বললেন, ‘তোমার কি মনে হল সুধাকর?’
বাবা বললেন, ‘নো অল্টারনেটিভ।’
হরিকিশোরমেসো বললেন, ‘আমার তো মনে হয় ঠিকই বলেছে। বেশ যুক্তিপূর্ণ কথা। ব্রিটিশ ক্যাবিনেট মিশন যে প্রস্তাব দিয়েছে, ভারতের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকে সেটা কিভাবে কার্যকর করা যায় তা ভেবে দেখতে হবে। এই দিনগুলোই ভারতের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে।
‘এতে ফেডারেশনের প্রস্তাব আছে তায়েব।
‘এটাও যদি গৃহীত না হয়, তাহলে পার্টিশন।’
‘১৯৪২-এ গান্ধী বলেছিলেন, কুইট ইন্ডিয়া। ভারত ছাড়ো।’
হ্যাঁ, আর জিন্না বলেছিলেন, ডিভাইড অ্যান্ড কুইট। ভারত ছাড় ক্ষতি নেই, তার আগে ভারত ভাগ করে দিয়ে যাও।’
‘মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মনোভাব যা, তা দেখে তো মনে হয়, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব তাঁর মনে ধরেছে।’
‘ক্রিপস মিশনেও তো মৌলানা আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু কোনও ফয়সালা হয়েছিল কি?’
‘হরিকিশোর, ১৯৪২ আর১৯৪৬ সাল এক নয়, এটা মনে রেখো। ১৯৪২-এ গান্ধীর ধারণা ছিল ব্রিটেন অর্থাৎ মিত্র শক্তির পরাজয় অনিবার্য। জার্মানি জাপান জিতছে। সেই হিসাবের উপর নির্ভর করেই কুইট্ ইন্ডিয়া আন্দোলনে সম্মতি দিয়েছিলেন গান্ধী। এখন তিনি জানেন, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়িয়েছে। আশা করি, তিনি আর পুরনো গত বাজাবেন না।’
‘ডিভাইড অ্যান্ড কুইট ইন্ডিয়া, জিন্না বলেছেন। জিন্না কেন এ কথা বলেছিলেন তায়েব? জিন্না হিন্দুদের বিশ্বাস করেন না, ব্রিটিশকে বিশ্বাস করেন।’
‘ফুলকি, সাদিক স্যরকে সেদিন তবলিগে যেতে দেখে দারুণ শক্ খেয়েছিলাম। বছর তিনেক বাদে স্যরকে দেখলাম। তাঁর ভোল একেবারে পাল্টে গিয়েছে। আমি কখনও স্যরকে ধুতি আর শার্ট ছাড়া কিছু পরতে দেখিনি। তাও শার্টটা গোঁজা থাকত ধুতির মধ্যে। সাহেবদের সঙ্গে নিত্য ওঠা বসা করতে হয় বলে, আমার খালু, গ্রামের মধ্যে একমাত্র খালু-ই প্যান্ট কোট পরতেন।. আর ভদ্রস্থ যাঁরা, গ্রামের মাতব্বর শ্রেণীর যাঁরা—হিন্দু মুসলমান—কোর্ট কাচারি করতে যাওগার কালে ধুতির মধ্যে পিরেন গুঁজে পায়ে মোজা আর পাম্প শু পরতেন। লুঙ্গি বা পায়জামা পরা লোক ছোটকালে কম দেখতাম। সাদিক স্যরের ইস্কুলে আসার পোশাকও ছিল তাই। এবার দেখি সাদিক স্যরের পরনে লুঙ্গি মাথায় গোল সাদা টুপি। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। বললেন, কি শামিম বাপ, একেবারে কাহিল হয়ে গেছ দেখছি। এখন কেমন আছে? বললাম, ভাল স্যর। কিন্তু বড় দুর্বল।
স্যর বললেন, ‘সান্নিপাতিক খুবই ছ্যাঁচড়া রোগ হে বাপ। সাবধানে থাকবা। ভাল যে হয়ে উঠিছ, এই ঢের।’
‘কিন্তু আমার তো টাইফয়েড হয়েছিল স্যর।’
‘ওই হল। আমরা যারে কই চালভাজা তোমরা তারেই কও মুড়ি। অ্যালোপাথি বলে টাইফয়েড, কবিরাজ বলে সান্নিপাতিক। যে নামেই ডাকো, রোগটা সাংঘাতিক বাপ। সাবধানে থাকো।
তোমার যে অত বড় একটা সাংঘাতিক অসুখ হয়েছিল শামিম, সেটা এখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। তুমি শরীরটাকে একেবারে ভাল করে ফিরে এসো শামিম। তোমাকে না দেখে যে পারিও নে। মনটা কেবল ছুটে যেতে চায় নীলগঞ্জে, যেখানে তুমি আছ, তোমার কাছে যেতে চাই। মনটা তো তোমারই কাছে পড়ে সাছে। দেহটার ডানা নেই। তাই এখানে পড়ে আছি।
বাবাদের বৈঠকে দিনের পর দিন ক্যাবিনেট মিশনের আলোচনা চলে। বাবা আশা নিরাশার দ্বন্দ্বে ভুগছেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে যেদিন ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব আলোচনার জন্য গেল সেইদিন থেকে বাবার সে কি অস্বস্তি! খাবার টেবিলে বসে বাবা ফুলকির সঙ্গে পলিটিক্স আলোচনা করেন। ফুলকি এই লোকটার উদ্বেগ বুঝতে পারে। বাবার দিকে নজর রাখছে ফুলকি। বাবাকে কেমন যেন হয়ে যেতে দেখছে ফুলকি। সে ঠিক বুঝতে পারে না। তার কেবল উদ্বেগ বাড়ে।
‘তোর কি মনে হয় ফুলকি, ক্যাবিনেট মিশন সফল হবে?’
‘তুমি বড্ড বেশি ভাবছ বাবা। তোমার শরীরটা দিন দিন যে কি হচ্ছে, তুমি তার দিকে একটুও নজর দাও না। আমার ভয় করে বাবা।
অমিতা দেখল, না অমিতার মনে হল, বাবা যেন তারই দিকে চেয়ে আছেন স্থির দৃষ্টিতে। কী দেখছ বাবা, কোথা থেকে দেখছ আমাকে? খাবার টেবিল থেকে? আমি কেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছিনে। বাবা ও বাবা?
‘কী ভাবি?’ থালা থেকে মুখ তুলে বাবা ফুলকির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ‘এই হতভাগা দেশটার কথা ভাবি মা।’ বাবাকে এমন স্বরে কথা বলতে আর কখনও শোনেনি ফুলকি। ‘আর তোদের কথা ভাবি।’
‘আমার এক মন বলছে, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগ গ্রহণ করবে। আবার একমন সেই সঙ্গে বলে উঠছে, সুধাকর ওটা তোমার উইশফুল থিংকিং। এত সহজে বখেড়া মিটবে না। তখনই ভয় পেয়ে যাই ফুলকি। সমস্ত শুভবুদ্ধির উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। তোদের ভবিষ্যৎ ভেবে ভয় পাই মা। যদি হিন্দু মুসলমানের শুভবুদ্ধি, মানে কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের স্থিরবুদ্ধি, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, কোনও সমঝোতায় পৌঁছুতে না পারে, অহমিকাবশে, হঠকারিতা বশত, নিজের জেদ বজায় রাটাই যদি প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, তবে আমাদের কপালে যে দুর্গতি আছে, সেটা কল্পনা করাও যায় না। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব কি দিতে পারে? দিতে পারে একটা পলিটিক্যাল সমাধান। কিন্তু সে তো আর ভারতীয়দের মন বদলে দিতে পারে না। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে না। সেই কাজটা তো করতে হবে আমাদের নিজেদেরই।’
‘সাদিক স্যর আমাকে বললেন, তুমি মুসলিম লিগ করছ, এটা খুবই ভাল কাজ বাপ। প্রত্যেকটা মুসলমানেরই আজ লিগের পিছনে এসে কাতার দেওয়া দরকার। নইলে হিন্দুরা আমাদের পিষে মেরে ফেলবে। হিন্দুদের মনে উদারতা আছে বলে আমার মনে এক সময় মোহ ছিল শামিম, তোমাদের শরৎবাবু সেটা খালে ছুঁড়ে দিয়েছেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোন শরৎবাবু? স্যর বললেন, নভেলিস্ট নভেলিস্ট। আজ আমি হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব বাপ। তুমি দেখবা। আমি বিস্মিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইলাম। স্যর বললেন, দেশবন্ধুর সদিচ্ছা সম্পর্কেও আমার এখন সন্দেহ হয় বাপ। এখন তো আমার মনে হয় দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্টও অশিক্ষিত অনভিজ্ঞ মুসলমানদের মাথায় হাত বুলিয়ে কাজ হাসিল করে নেওয়ার ব্যাপারে হিন্দুদের একটা পাটোয়ারি চাল। স্যরের কথা শুনে আমার মাথা বন বন করে ঘুরতে লাগল ফুলকি।’
শামিম, তোমার এখন শরীর অসুস্থ। তোমর উচিত উত্তেজিত না হওয়া। তার উপর তুমি এখন নীলগঞ্জে পড়ে আছ। দেশে কি ঘটতে চলেছে, তাই সেটা হয়ত তুমি এখনও জান না। ফুলকি শামিমের চিঠিখানার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। বাবা বলছেন, ক্যাবিনেট মিশন যে প্রস্তাব তৈরি করেছেন, সেটা কংগ্রেস ও মুসলিম নেতারা যদি মেনে নেন তবে দেশের সকলেরই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। তুমি কি ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব বিষয়ে কিছু জানো? তুমি এ সময় কলকাতায় থাকতে পারলে কত ভালই না হত! কবে তুমি আসবে শামিম? ‘তোমার আশা-পথ চেয়ে আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। না, না, শামিম, তুমি শরীরটা সারিয়েই চলে এসো।
বাবা বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে ফুলকি, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব ওরা গ্রহণ করবে। লিগ এখনও চুপ করে রয়েছে। কিন্তু বলটা তখনও তো লিগের কোর্টেই পড়বে। একটা সিদ্ধান্ত জিন্নাকে নিতেই হবে।
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘জিন্না হার্ড বার্গেনার। কিন্তু ক্যাবিনেট মিশন যা দিতে চাইছে, তার চাইতে বেশি আর তিনি কি পেতে পারেন? লাহোর প্রস্তাবে যা ছিল, ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে তো সেটা মেনে নেওয়া হয়েছে বলাই যায়। প্রভিন্সিয়াল অটনমি, গুপিং। সবই তো আছে ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাবে। কংগ্রেসেরই বরং অসুবিধা ছিল। অখণ্ড ভারতের জায়গায় ফেডারাল ভারত। কংগ্রেসও জোর দিয়েছে প্রভিন্সিয়াল অটনমির উপর। তিনটে গ্রুপ হবে। একটা পাব, সিন্ধু বালুচিস্থান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে, যেটাকে জিন্না বলছেন মুসলিম মেজরিটি আছে, সেটা নিয়ে একটা গ্রুপ। বাংলা আসাম নিয়ে পূর্বাঞ্চলে একটা গ্রুপ, আর ভারতের অন্যান্য প্রদেশগুলো নিয়ে একটা গ্রুপ। এটাতে মেজরিটি থাকবে হিন্দুরা। কেন্দ্রীয় অর্থাৎ ফেডারেল সরকারের হাতে ক্ষমতা থাকবে দেশরক্ষার, যোগাযোগ ব্যবস্থার, পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়াদির।’
বাবাদের আশা আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। ওহ্ শামিম, তুমি যদি এ সময়ে থাকতে!
বাবা বলেছিলেন, ‘একটা গণপরিষদ আমাদের সংবিধান রচনা করবে। সেই সংবিধানই হবে আমাদের রাষ্ট্রের চালক।
‘ফেডারেশনেই সকলের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে, পার্টিশনে অসুবিধা বাড়বে, এটা জিন্নার মতো রাজনীতিজ্ঞের বোঝা তো উচিত।’
‘উনি বুঝবেনই না, এটা ধরে নিচ্ছ কেন তায়েব?’
‘জিন্নার অহংবোধ প্রবল, জিন্নার আত্মাভিমানও প্রবল হরিকিশোর, কিন্তু জিন্না সত্যিই সেকুলার লোক এবং আধুনিককালের লোক। সেই জিন্নাকে আপন অভিলাষ পূর্ণ করতে সওয়ার হতে হয়েছে বাঘের পিঠে। সাম্প্রদায়িকতার বাঘ। এ যুগে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর নেই। আমার আশঙ্কা সেইখানে। কোথায় গিয়ে তিনি যাত্রার শেষ করবেন? আমার অস্বস্তির কারণ তাই।
‘ফুলকি, নীলগঞ্জে এসে বুঝতে পারলাম, আমার মুসলিম লিগ আর সাদিক স্যরেদের মুসলিম লিগ এক বস্তু নয়। হাশেম সাহেবের রাব্বানিয়ত তত্ত্ব এবং ইসলামি সমাজতন্ত্রের আকর্ষণেই আমি মুসলিম লিগে যোগ দিয়েছিলাম। রাব্বানিয়ত তত্ত্ব বলে যে, মহাবিশ্বের সব কিছুর রব অর্থাৎ মালিক মোক্তার আল্লাহ। মানব জাতি আর খলিফা বা. প্রতিনিধি। সুতরাং ভূমির উপর সম্পদের উপর ব্যক্তিগত স্বত্বসামিত্ব বলে কিছু নেই। সব কিছুই সকলের। এটাই হল ইসলামি সমাজতন্ত্র। এর মধ্যে ঘৃণা বিদ্বেষ বা হিংসার জায়গা নেই। কিন্তু কাল সাদিক স্যরের বক্তৃতা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছি। কাল সাদিক স্যর তবলিগ জমায়েতে বলেছেন, পাকিস্তান না আদায় করতে পারলে মুসলমান ধ্বংস হয়ে যাবে। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব গৃহীত হলে, আমি আশা করছি, যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ আজ দেশ ছেয়ে গিয়েছে, সেটা প্রশমিত হয়ে যাবে। কারণ উত্তেজনা মাথায় নিয়ে কেউ আলাপ আলোচনা চালাতে পারে না। বন্ধুত্বের পরিবেশ সৃষ্টি হলেই অবিশ্বাস দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। তাই আমার উদ্বেগ সুধাকর।’
শামিম ফুলকিকে লিখছে, ‘সাদিক স্যর বলেছেন, হিন্দুরা কিছুতেই পাকিস্তান হতে দেবে না। কারণ হিন্দুরা মুসলমানদের উন্নতি হোক, এটা চায় না। কিন্তু হিন্দুরা চাক বা না চাক, আজ মুসলমানেরা জেগেছে, পাকিস্তানকে কেউ রুখতে পারবে না। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এই হবে আমাদের নারা। মিলনের কথা আমরা ঢের শুনেছি। মিলনের জন্য মুসলমান কম চেষ্টা করে নাই। দেশের বড় বড় মাথা কেবল এই বলেই কাজ শেষ করেন, ‘হে হিন্দু হে মুসলমান, তোমরা এক মায়ের দুই সন্তান। নিজেরা বিরোধ করে পঙ্গু হয়ো না। উভয়ের শত্রুকে নিপাত কর। আমরাও একশতবার মানি সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে বৈদেশিক জাতি কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু যত গোল ওই সম্মিলিত হওয়ার ব্যাপারেই। মসজিদের সামনে বাদ্য বাজানো বা গো হত্যা নিবারণ করলে এ গোল মিটবে না। এ গোলের শিকড় কাটতে গেলে দৃষ্টি একটু নিচের দিকে দিতে হবে। মুসলমানদের ধর্মীয় উন্মাদনা দূর করলে কেবল চলবে না। হিন্দু গোঁড়ামিকেও ধুইয়ে মুছে ভারত মহাসাগরে ফেলে দিতে হবে। হিন্দু মুসলমান মিলনের মূলে যে কীট প্রবেশ করেছে তার আহার মুসলমানের ফ্যানাটিসিজম যদি জোগায় এক ভাগ তবে হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামি জোগায় তিন ভাগ। কিন্তু এ কথা কি হিন্দুরা স্বীকার করে? না। তারা শুধু আঙুল তুলে আমাদের দেখায়। আমরা মুসলমানেরাই যেন শত দোষের দোষীআর হিন্দুরা সব ধোয়া তুলসীর পাতা। কাজেই মুসলমান তুমি আজ আর মিলনের ফেরেরবাজিতে ভুলো না। নিজেদের দাবি থেকে পিছিয়ে যেও না। পাকিস্তান আমাদের চাই। এমন পাকিস্তান, যেখানে হিন্দুর কোনও আধিপত্য থাকবে না, যেখানে হিন্দু থাকবে গোলাম হয়ে, জিম্মি হয়ে।’
শামিম যেন আর্তস্বরে ফুলকিকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘এই যদি পাকিস্তান হয় ফুলকি, আর এক বিপরীতটা যদি হয় হিন্দুস্তান, তবে তোমার আমার স্থান কোথায় হবে ফুলকি? আমি মানুষ ফুলকি, আমি পুরুষ। তুমি মানুষ ফুলকি, তুমি নারী। তোমার আমার মিলনের ক্ষেত্রটা তবে কোথায় হবে ফুলকি? আমাদের ভালবাসার জায়গাটা কোথায় হবে?’
শামিম, শামিম, তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ। আমার ভাল লাগছে না।
‘নীলগঞ্জ হিংস্র বাহু বাড়িয়ে আমার কাছ থেকে তোমাকে ছিনিয়ে নিতে চাইছে ফুলকি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি পালাতে চাইছি। পালাতে চাইছি। ঘরে বসে ছিলাম। রাত হয়েছে। রেশমা এল। জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী এত ভাব শামিম ভাই? কারে ভাব? কারে এত চিঠি লেখ? রেশমা আমার গা ঘেষে বসল। আঁচল দিয়ে ঘাম মুছতে লাগল। বললাম, আমার বন্ধুকে ভাবি। সেই যে বন্ধুকে তুই দেখেছিস ব্যান্ডেল, সেই তাকে। রেশমা অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, শামিম ভাই তুমি আমাকে ইংরাজি শেখাবে? আমি বই কিনে এনেছি। সত্যিই ফুলকি, রেশমা আমাকে বইখানা দেখাল। এবার আমার অবাক হবার পালা। আমি কাউকে বলিনি এ কথা শামিম ভাই। শুধু তুমি জানলে। পড়াবে আমাকে? আমি বললাম, না তুই ধেড়ে মেয়ে। তোকে পড়াব না। যা ভাগ। রেশমা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। আর আমার বুকে মুখ ঘুষতে লাগল। আর তখন, সেই মুহূর্তে, আমার খেয়াল হল রেশমা বড় হয়ে গিয়েছে ফুলকি। আমি জোর করে ওর মুখখানাকে বুক থেকে সরিয়ে লণ্ঠনের আলোতে ওকে দেখতে লাগললাম। চোখের জল গড়িয়ে ওর দুই গালে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আলোতে চিকচিক করে উঠল ওর মুখ। আমার যে কি হয়ে গেল! আমার ভিতরের সেই ক্ষুধার্ত আমিটা জেগে উঠল ফুলকি। আমি রেশমাকে পাগলের মত চুমু খেয়ে যেতে লাগলাম। রেশমা বাধা দিল না একটুও, আমার কাছে আত্মসমর্পণ করল।
৩৭
অমিতা যে ফুলকিকে এখন বজ্রাহাতের মতো বসে থাকতে দেখছে, সে ১৯৪৬ সালের ফুলকি। তখন কতই বা বয়স ছিল মেয়েটার! ঘটনা প্রতিকূল হয়ে উঠলেই একেবারে মুষড়ে পড়ত ফুলকি। শামিমের চিঠিটা তখন ওর কোলের উপর ছিল কি! ঠিক মনে করতে পারছে না অমিতা। তবে সেই চিঠি এখন অমিতার কোলে। অমিতা পড়তে লাগল চিঠিটা।
‘রেশমা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। আর আমার বুকে মুখ ঘষতে লাগল। আর তখন সেই মুহূর্তে, আমার খেয়াল হল, রেশমা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে ফুলকি। চোখের জল গড়িয়ে ওর দুই গাল ভিজিয়ে দিচ্ছে। আলোতে চিক চিক করে উঠছে ওর মুখ। হঠাৎ দেখলাম, সে মুখ ওর নয় ফুলকি, সে তোমার মুখ। আমার যে কি হয়ে গেল! আমার ভিতরে সেই মুহূর্তে আমিটা জেগে উঠল ফুলকি।’
তারপর? অমিতা জিজ্ঞাসা করল, তারপর শামিম? হ্যাঁ, তুমি লিখেছিলে, রেশমা তোমার সেই ক্ষুধার্ত আমিটাকে বাধা দেয়নি সেদিন। তোমার ক্ষুধা মেটাবার জন্য যা করণীয় ছিল সে তা করেছে। তোমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল রেশমা। তোমার এই সরল স্বীকারোক্তির ফল কি হয়েছিল তা কি তুমি জানতে পেরেছিলে? সেদিনের ফুলকির মাথায় বাজ পড়েছিল। সেদিন ফুলকি ভেবেছিল, তার জীবনে একটা টোটাল ডিসাস্টার ঘটে গিয়েছে। সে ভেবেছিল, তার আর কোথাও কিছু রইল না। অমিতা সেদিনের ফুলকির সেই বজ্রাহত চেহারাটা মনে আনতে চেষ্টা করল। অনেক দূর চলে গিয়েছে সেটা। ভেসে গিয়েছে অভিজ্ঞতার বিচিত্রস্রোতা নদীতে। অথচ একদিন অমিতা নিজেই না এই যন্ত্রণার প্রধান শরিক ছিল। এটা তো ছিল তারই নিজের যন্ত্রণা। সেদিন কি আমার মরতে ইচ্ছে হয়েছিল? কম বয়সে মনে নাটক-নভেলের সিনেমার ছাপ গভীরভাবে পড়ে বলে, এ ইচ্ছেটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কাজেই ফুলকির যদি তখন মনে হয়ে থাকে, তার জীবনের আর কিছুই রইল না, তার মরাই ভাল। তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।
শামিম কি তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি?
ফুলকির মনে এই সন্দেহ জেগেছিল কি না সেদিন, অমিতা আজ সেটা মনে করতে পারে না। একেবারে খুঁটিনাটি ঘটনা সে মনে রাখেনি ঠিকই, কিন্তু আবার এমন কিছু ভাবনাচিন্তা যে-সব সেদিন ফুলকির মনে জড়ো হয়েছিল, তার সব কিছুই যে অমিতা ভুলে গিয়েছে তাও নয়। যেমন, ফুলকি সেদিন মরবার কথা ভেবেছিল সেটা মনে আছে অমিতার। সেই মুহূর্তে সেই মেয়েটার পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে গিয়েছিল তো। সেদিন ফুলকি অতল এক গহ্বরে তলিয়ে যেতে শুরু করেছিল তো। এটা অস্বীকার কি করে করবে অমিতা? ফুলকির অন্তরের হাহাকার মাঝে মধ্যে সে শুনতে পাচ্ছিল। সেইটেই তো আশ্চর্য লাগে অমিতার।
শামিম কি সত্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছে? না এটা তার অছিলা? আমাকে পরিত্যাগ করবার এর চাইতে আর কি ভাল অছিলা থাকতে পারে শামিমের? যদি জানতে পারতাম! কে আমাকে এই সংশয় থেকে উদ্ধার করবে? কে আছে? না, আমি আর ভাল থাকছি না। ভাল থাকার জন্য যে বিশ্বাসটুকু ছিল আমার, সেটুকুও আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল দুনিয়াটা। কি করেছি আমি? কার কি ক্ষতি করেছি আমি? তবে আমার উপরেই এই অভিশাপ এসে পড়ছে কেন? আমি কাউকে অভিযুক্ত করতে পারছিনে। কেন পারছিনে? কেন কেন কেন? তবু মনের আয়নায় যখনই দেখছি তাকে অন্য কোনও জগতে অন্য কারও সঙ্গে মনে হচ্ছে আমি ঠকেছি, ঠকেছি শুধু আমিই। সে নয়। আর তখনই সব কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে। আমি পারছি না, পারছি না দূরে সরে যেতে। কেন কেন কেন? কে বলে দেবে আমাকে? কে এই দুঃসহ দাহ থেকে আমাকে উপশমের পথ দেখিয়ে দেবে? না, আমি আর কিছু চাইনে কারও কাছে। শুধু জানতে ইচ্ছে করে, কি এমন করেছি আমি, যার জন্য এত জ্বালা আমাকেই সইতে হবে? আমি জ্ঞানত কোনও অপরাধ করিনি। সবাইকে ভালবেসেছি। শামিমকে ভালবেসেছি। তবে কেন আমিই শুধু জ্বলছি? না আমি মরব না। কেন মরব? আমি তো মরবই না,’সুখেই থাকব। শালা দুনিয়া আমায় চিনেছে বেশ! না ভগবান, আর আমাকে ডেকো না। আমি এবার অন্যায় করব, পাপ করব, নিষিদ্ধ ফল ছিঁড়ে খাব। চুরমার করে দেব সব। তুমি রুখবে না। সবাইকে সুখ দিলে, সবার স্বপ্ন তৈরি করে দিলে, আমায় কেন ঠকালে প্রভু? তুমি আমাকে ঠকিয়েছ। হ্যাঁ, তুমি তুমি তুমি! তুমিই আমাকে ঠকিয়েছ। তোমার মতো প্রবঞ্চক এই সংসারে আর কেউ নেই। আমার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কার কাছে কাঁদব? আমার কেউ নেই। কেউ নেই। কেউ কোথাও আমার নেই।
একটা কথা জানতে চাই। শামিম কি অসুস্থ। সত্যিই অসুস্থ?
অমিতা জানে, ফুলকির মনে তখন আরেক ধরনের ভাবনাও চেপে বসেছিল। ফুলকি ভাবতে শুরু করেছি, শামিমের কি দোষ? শামিম তাকে ঠকাতে চায়নি। শামিমের কোনও দোষ নেই, এ ব্যাপারে। ফুলকি তার মনকে মেলে ধরেছিল। তন্নতন্ন করে বিচার করে দেখল ফুলকি। শামিমের প্রতি তার অবিশ্বাস, এটা তার মনেরই বিকার। শামিম সত্যই গুরুতরভাবে অসুস্থ। শামিমের মতো ছেলে এই মুহূর্তে নীলগঞ্জে পড়ে আছে, এটাই তো তার মস্ত প্রমাণ। চলে আসবার মতো অবস্থা থাকলে শামিম এখন কলকাতাতেই থাকত। ফুলকির জন্য না হলেও কলকাতার জন্যই শামিমকে কলকাতায় আসতে হবে। আসবেই শামিম। যতদিন শামিমের খবরাখবর সে পায়নি, ততদিন অন্য ধরনের উদ্বেগে ভুগেছে ফুলকি। কি হয়েছে শামিমের? শুধুমাত্র এই খবরটা পাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। সেই যন্ত্রণার কথা আর মনেও আনতে চায় না ফুলকি। এখন সে ভাবছে অন্য কথা। আজ হোক কাল হোক, শামিম কলকাতাতে আসবেই। সে বিষয়ে ফুলকির কোনও ভুল নেই।’ কলকাতাতে শামিম এলে ফুলকির কাছেও আসবে। ফুলকি নিশ্চিতভাবে জানে শামিম এলে ফুলকির কাছেই আসবে। কিন্তু এই শামিমকে নিয়ে ফুলকি কি করবে? শামিমের জীবনের সঙ্গে এখন রেশমার জীবন জড়িয়ে গিয়েছে।
ফুলকির কি কোনও অধিকার আছে রেশমার জীবনকে নষ্ট করে দেবার?
রেশমা শামিমের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। যেমন ফুলকি একদিন আত্মসর্পণ করেছিল শামিমের কাছে। আহা! রেশমার জন্য ফুলকির মনে মায়া জেগে উঠল। কি সুন্দর সেই ছোট ফুটফুটে মেয়েটা, যাকে কয়েক ঝলক মাত্র দেখেছিল দূর থেকে ফুলকি, সেই ব্যান্ডেল চার্চের মায়াবী আলোতে। রেশমার জীবন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে শামিমের জীবনের সঙ্গে। আহা রে!
রেশমা এতদিনে শামিমকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। যেমন ফুলকি একদিন শামিমকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিল। রেশমার এই স্বপ্ন ভেঙে দেওয়া অন্যায় হবে। পাপ হবে ফুলকি!
ফুলকির চোখে মুখে এক অসহায় আতভাব ফুটে উঠত এই সময়গুলোতে, সে যখন এই ধরনের ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ত। অমিতা ফুলকির এই অসহায় আর্ত মুখটা বেশ দেখতে পায়। এতদিন পরেও।
ফুলকি এটা হতে দিতে পারে না। কিছুতেই না। আর তার জন্য শামিমের সঙ্গে তার একটা কথা হওয়া দরকার। আর তার জন্য শামিমের সঙ্গে তার দেখা হওয়া দরকার। শামিমের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা হওয়া দরকার। এটা জরুরি।
ফুলকি এ সময় বড় একা হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে ও তখন একা। দিদি চলে গিয়েছে। চুমকিকে বাবা মায়ের মৃত্যুর পরেই বোর্ডিং স্কুলে রেখে দিয়েছিলেন। চুমকিকে যদিও ছুটিছাটায় বাড়িতে হানা হত, কিন্তু সে ছটফট করত। বোর্ডিং-এর জীবনেই চুমকি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বাড়িটা ফাঁকা ছিল বলেই বা ফুলকিকে একা হয়ে পড়তে হবে কেন? তার স্কুলের বন্ধু ছিল। এক দেড় বছর আগেও তাদের সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল ফুলকির। এখন সে সব ছিন্ন হয়েছে কি? ফুলকি নিজেকেই প্রশ্ন করে। তার কলেজের বন্ধুরা, তারাও তো সবই আছে। সবাই আছে। রোজই দেখা হয়। ফার্স্ট ইয়ার থেকেই তো তাদের কফি হাউসে আড্ডা। কেউ কেউ ফাজলামি করত তা ঠিক। আবার কেউ কেউ তো ফুলকির প্রেমেও পড়েছে। কত হৈ হৈ করেছে তারা। সব চাইতে ফাজিল প্রতাপ। কিন্তু সব চাইতে প্রাণবন্ত সে-ই। সবাই তো আছে তার চারপাশে। তবু কেন মনে হয় যে সে একা। কেউ নেই তার? কেন এ কথা মনে হয় ফুলকির? কে তাকে এখানে এনে ফেলল? শামিম? হ্যাঁ, শামিম।
ফুলকি ভাবতে চেষ্টা করে, দেখতে চেষ্টা করছে এখন, যখন শামিম ছিল না তার জীবনে, তখন সে জীবনটা কেমন ছিল? চট করে ভাবতেও পারে না। তার জীবনের প্রথম কুড়ি বছরে শামিম ছিল না, এ কথা ভাবতেও অবাক লাগে ফুলকির। কোথায় বদলটা হল? কেমন করে সে বদলে গেল! ফুলকির মনে পড়ল, দিদির সঙ্গে সে যেদিন রেডিওতে গিয়েছিল আবৃত্তি করতে। সে কি থ্রিল! ফুলকির মনে পড়ল, সব চাইতে সুপুরুষ লোক তো সে সেই রেডিওতেই দেখেছিল। প্রভাত। হ্যাঁ প্রভাত। ‘প্রভাতই তো তাকে যত্ন করে মাইক্রোফোন সম্পর্কে তার আড়ষ্টতা কাটিয়েছিল। দিদি ছিল রেডিওর স্টুডিওতে মধ্যমণি। তাকে ঘিরেই ভিড় জমত বেশি। তবু ফুলকি বুঝতে পেরেছিল, তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে যে, দিদির মোহজাল ভেদ করেও, ফুলকির দিকেও, কোনও কোনও পুরুষের নজর পড়তে শুরু করেছে। অবশ্য তখন সে এ সম্পর্কে আদৌ সচেতন ছিল না। দিদি তাকে মাঝে মধ্যে মনে করিয়ে দিত। সে কিন্তু উড়িয়ে দিত সে সব কথা। দিদির চাইতে মাত্র দু বছরের ছোট ছিল ফুলকি। কিন্তু মনের দিক থেকে সে সত্যই তখন ছিল বালিকা। পুরুষ সম্পর্কে তার মনে যে কৌতূহল জাগত না তা নয়। তবুও তো ফুলকি ছিল তখন একটা কুঁড়িই। কুঁড়ির ভিতর যে পবিত্রতা, অবিকল সেই পবিত্রতার মোড়কেউ ঢাকা ছিল ফুলকির কুমারী মন।
আহ্ পবিত্রতা! অমিতার বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে পড়ল।
কত নিষ্পাপ, কত মনোহর দিনগুলোই না ছিল সে সব! ফুলকির সেই সব দিন কোথায় গেল! সেই যে আমার নানা রঙের দিনলগুলি! কে তা কেড়ে নিল! এই জটিলতার গোলকধাঁধায় কে তাকে টেনে নামাল?
শামিম? হ্যাঁ শামিম। প্রেম নহে মোর মৃদু ফুলহার, দিল সে দহন জ্বালা। গানটা দিদি এক সময়ে খুব গাইত। ফুলকিও গাইত। কখনও দিদির সঙ্গে গলা মিলিয়ে, কখনও একাই। তখন এটা ছিল নিছক একটা গানই। দহন জ্বালা কি জিনিস, ফুলকি সেটা তখন একদম বুঝত না। এখন শুধু জ্বালা জ্বালা জ্বালা! কত আর জ্বলবে ফুলকি, এ জ্বালায়? এর কি আর উপশম হবে না! এত জ্বালা সইতে হবে শুধু ফুলকিকেই! কেন?
এক এক সময় ফুলকির ইচ্ছে হয়, সে আবার ফিরে যাবে সেই জীবনে, যেখানে শামিমের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। কোনও জটিলতা ছিল না। হ্যাঁ, সেখানেই ফিরে যাবে ফুলকি যেখানে শামিম নেই কোত্থাও। না তার জীবনে, না তার মনের ভিতরে। যেখানে রেশমা নেই। যেখানে দাহ নেই। ফুলকি সেই জীবনে ফিরে যাবে। ওরা তো সবাই আছে। তার সব সহপাঠীরা। বঙ্কু, জীবন, প্রতাপ, শশিকুমার, গোপী। ওরা তো সব হাতের কাছেই আছে। আবার সে ওদের সঙ্গে হৈ হৈ করবে। ওরা যাবে দলবেঁধে কোম্পানির বাগানে। এই চিন্তায় মনে খানিকটা বল পেল ফুলকি। কাল থেকে আবার ক্লাস শুরু করবে সে নিয়মিত। বসবে কফি হাউসের আড্ডায়। প্রেম করবে ওদের কারও সঙ্গে। বঙ্কুকে সে আমল দেবে। শশিকুমার। হ্যাঁ, শশিকুমারের মন জানে ফুলকি। কত দিন তাকে আভাসে ইঙ্গিতে চেয়েছে। তাকে না পেয়ে সে মধুমিতাকে সঙ্গী করেছিল কিছুদিন। ওরা সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরেছেও কতদিন। কিন্তু ফুলকি জানে, সে তাকেই চায়। মধুমিতার বিয়ে হয়ে যাবার পর, এখন চওড়া করে সিঁদুর দিয়ে ক্লাসে আসছে মধুমিতা। শশিকুমার কি তাতে আঘাত পায়নি। নিশ্চয় পেয়েছে। শশিকুমারকেই সঙ্গ দেবে ফুলকি।
এমন একটা প্রস্তাব মনে মনে ভেঁজে ফেলল ফুলকি। আসলে সে মুক্তি পেতে চাইছে এখন। তাকে পড়াশোনাতেও মন দিতে হবে। অনেক কাজ জমা পড়ে আছে। ফুলকিকে ধীরে ধীরে আবার কাজের জীবনে ফিরে যেতে হবে। ফুলকি এখন নিজেকে ফিরে পেতে চাইছে। তার জন্য দরকার, ফুলকি সিদ্ধান্ত করল, তার গত এক বছরের জীবনকে মন থেকে মুছে ফেলা। আর কোনও জটিলতার মধ্যে যেতে চায় না ফুলকি।
এবং এই সিদ্ধান্তে আসতে পারায় ফুলকি তার মনের ভাব কিছুটা লাঘব করতে পারল। ফুলকি নিজেকে খানিকটা মুক্ত বলে বোধ করতে লাগল। তার মনে হল, যে জীবনটা এতদিন, এতদিনে মানে কি, মাত্রই তো এই কটা মাস, সবার থেকে আলাদা করে রেখেছিল তাকে, সেই জীবনটাই যেন এমনভাবে প্রতিশোধ নিল তার উপর। গত কয়েক মাসের কথা সে আর ভাববে না, না না না, সে আর ভাবতে চায় না। ফুলকি ভাবতে লাগল, সে এখন কী করবে? একটা প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে তাকে সর্বক্ষণ মগ্ন হয়ে থাকতে হবে। তার মনকে বেঁধে রাখতে হবে কাজের মধ্যে। পড়াশোনায় আবার মন ঢেলে দেবে সে। ফুলকি। আর কয়েক মাস পরেই তো তার পরীক্ষা! এ কথা মনে হতেই ফুলকি যেন আকাশ থেকে পড়ল। সর্বনাশ! পরীক্ষার কথা ভুলেই গিয়েছিল ফুলকি!
কোনও প্রস্তুতিই তো হয়নি তার? আবার হতাশার মধ্যে পড়ে গেল ফুলকি। গত কয়েকমাস কিছুই ক্লাস করেনি ফুলকি। ক্লাসে যায়নি তা নয়, কিন্তু কিছুই পড়েনি, কিছুই শোনেনি। নোট টোট কিছুই নেয়নি। এ অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়া অসম্ভব। কি করেছে ফুলকি! তার না স্বাধীন হবার কথা ছিল! তার না বাবার বাড়ির বন্ধন ছেঁড়ার কথা ছিল! পরীক্ষায় পাশ করা তো তারই প্রাথমিক শর্ত ছিল। এই পরামর্শই তো সে করেছে শামিমের সঙ্গে। শামিম ইদানীং চাইছিল ফুলকি বি-এটা পাশ করলেই তারা বিয়ে করে ফেলবে। তারপর তারা সংসার পাতবে। শামিম একটা চাকরি জোগাড় করে নেবে। ফুলকিও জুটিয়ে নেবে একটা স্কুল মাস্টারি আপাতত। তারপর সে মে-এতে ভর্তি হবে। এম-এটা শেষ করে একটা লেকচারারশিপ জোগাড় করে নেবে। সে বাবার গলগ্রহ হয়ে যেমন থাকতে চায় না, তেমনই শামিমেরও গলগ্রহ হবে না। যে সংসারের ছবি এঁকেছিল সে আর শামিম, তার চেহারাটা ছিল এইরকম। এইভাবেই দুটো স্বাধীন সত্তা গেরস্থালি পাতাবে। তারা হবে আদর্শ স্বামী স্ত্রী। স্বামী স্ত্রী মানে, আধুনিক যুগের স্বামী স্ত্রী। তার বাবা আর মা যেমন ছিলেন তেমন নয়। ফুলকি তো দেখেছে তার বাবাকে। ফুলকি তো দেখেছে তার মাকে। তাদের সংসাে বাবা ছিলেন বাইরের কর্তা, মা ছিলেন ঘরের কর্ত্রী। দিদি বলত, এর মধ্যে মস্ত ফাঁকি আছে ফুলকি। আসলে বাবাই সবের কর্তা। এই সংসারে বাবার কথাই শেষ কথা। কিন্তু ফুলকি দিদির কথা মেনে নিতে পারেনি। সে দেখত, সংসারের ব্যাপারে মায়ের কথাও টিকত। সে দিদিকে মাঝে মধ্যে যখন এ কথা বলত, দিদি বলত, দূর, ওর মধ্যেই তো ফাঁকিটা আছে রে বোকা। বাবার আলো সূর্যের আলো। এ সংসারে পুরুষেরাই সূর্য। মেয়েরা হল চাঁদ। মেয়েদের মধ্যে মাঝে মাঝে পূর্ণিমার আলোর যে ছটা দেখিস সেটা ধার করা। সূর্যের কাছ থেকেই ধার করা
অমিতা জানে, দিদির কথাই ঠিক। মেয়েদের আলো চাঁদের আলো। সেটা প্রতিফলিত। এবং এই আলো নিতে গেলে মেয়েদের অনেক মূল্য দিতে হয়। মেয়েদের ইচ্ছা অনিচ্ছা সবই অবদমন করতে হয়। সংসারে পুরুষের ইচ্ছাতেই সব কিছু চলে। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মা কি কোনও কাজ করেছিলেন? অমিতার মনে পড়ে না। এমন কি এই কথাটা মায়ের কাছ থেকে জেনে নেবে, এমন কথাও তার মনে পড়েনি তখন। সে তখন ছোট ছিল তো। সে তো তখন অমিতা হয়ে ওঠেনি। সে ছিল ফুলকি।
ফুলকির জীবনে তার দিদির প্রভাব কতটা পড়েছিল? বাইরে থেকে দেখতে গেলে মনে হত, হয়ত কিছুই পড়েনি। কিন্তু একেবার কিছুই যদি না পড়বে, তবে এতটা সতর্ক হবার ইচ্ছেটা কে তার মনে ঢুকিয়ে দিয়েছিল? কেন যখন শামিম তাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিল, তখন সে শামিমকে বলেছিল, না এখন নয়। তবে কখন? এই প্রশ্নে, এটা ঠিকই ফুলকি তার ইচ্ছেটাকে বারবার বদল করেছিল। প্রথমদিকে ফুলকি ভেবেছিল, সে আগে এম-এ পাশ করবে, চাকরি নেবে, তবে তাদের বিয়ে হবে। কিন্তু একদিন বছর হিসেব করতে গিয়ে তারা দেখে যে, সেটা বড্ড দেরি হয়ে যাবে। তখন ফুলকি ঠিক করেছিল, তবে বি-এ পাশ করার পরই তারা বিয়ে করে ফেলবে। তখনও ফুলকির শর্ত ছিল যে, তার আগে তাকে একটা চাকরি নিতে হবে। তখন তার মনে কি এই কথা জেগেছিল যে, সে শামিমের কাছ থেকে আলো ধার করে পূর্ণিমার চাঁদ হতে চায় না। সে বরং জোনাকি হবে, কারণ জোনাকির আলো তার নিজেরই আলো। শামিমের ভালবাসার প্রতি এটা তার অনাস্থা নয়। ফুলকি জানে, এটা তার নিজের প্রতি তার আস্থারই প্রকাশ। ফুলকিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তারপর সেখানে দাঁড়িয়েই শামিমকে গ্রহণ করবে স্বামী হিসাবে। ফুলকির ধারণা হয়েছিল যে, এইভাবেই সে তাদের প্রেমকে তাদের সংসারে প্রতিষ্ঠা দেবে। তাকে চিরস্থায়ী করবে। শামিম ফুলকির অন্তরে যে প্রেম জাগিয়ে তুলেছিল, ফুলকি এই ভাবেই সেই প্রেমকে রক্ষা করবে।
এ সেই ফুলকির কথা, যে ফুলকি জানত না, প্রেমে এত জ্বালা থাকতে পারে। প্রেমে এত জটিলতা থাকতে পারে।
অমিতা থমথমে মুখে সেই ফুলকির দিকে চেয়ে রইল। আহা রে!
না, ফুলকি আর শামিমের কথা ভাববে না। সে যাতে ফের উঠে দাঁড়াতে পারে, ফুলকি এখন সেই কাজেই মন ঢেলে দেবে। কিন্তু কি হত, শামিমের সঙ্গে যদি ফুলকির বিয়েটা হয়েই যেত। অমিতা ভাবতে চেষ্টা করল।
শামিমের কথা আর ভাবতে চায় না ফুলকি। ফুলকি এখন সেই জীবনে ফিরে যেতে চায়, তার যে জীবনে শামিম বলে কেউ ছিল না। সে আবার উঠে দাঁড়াতে চায়, নিজেকে ফিরে পেতে চায়। পড়ার মধ্যে ডুবিয়ে দিতে চায় নিজেকে। সে বড় ক্লান্ত, বড় বিপর্যস্ত। ঈশ্বর, ঈশ্বর, তুমি মুখ ফিরিয়ে আছ কেন? তুমিও মুখ ফিরিয়ে রইলে! তুমি কি দেখছ না কিছুই। তুমি কি বুঝছ না কিছুই! আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছি। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস টলে যাচ্ছে।
অমিতার মন সমবেদনায় ভরে উঠছে। আহা রে!
এই দুনিয়ায় সবাই তো ভাল আছে। সকাল হচ্ছে। সকলেরই কাছে তো সকাল হচ্ছে। তবে আমার সকালটাই বা কেন এত যন্ত্রণায় ভরা! সবাই তো সুখে আছে। তবে আমার সকালটাই বা কেন এত যন্ত্রণায় ভরা! সবাই তো সুখে আছে। তবে আমি কেন এত যন্ত্রণায় ভুগছি! শামিম শামিম! না শামিমের কথা আর ভাববে না ফুলকি ভাববে না। না না না! ফুলকি কলেজ যাচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু কারও কথা ঢুকছে না তার কানে। বইয়ের পাতা খোলা তার সামনে। কিন্তু কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না কেন? ফুলকি জানে, তার সহপাঠীরা তার এই পরিবর্তন লক্ষ করেছে। প্ৰতাপ তাকে একদিন সিনেমা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। লাইটহাউসে বসে কিছুই দেখতে পায়নি ফুলকি। শশিকুমার একদিন তাকে নিয়ে গঙ্গায় বেড়িয়ে এল নৌকো করে। ফুলকি সারাক্ষণ ভেবেছিল, যদি শামিমের সঙ্গে তার বিয়েটা হয়ে যেত, কি হত তাহলে? সে কি এত যন্ত্রণায় ভুগত? তখন কাজটা অনেক সহজ ছিল। কারণ রেশমা শামিমের জীবনে আসেনি তখনও। রেশমা!
রেশমা! না শামিমের কথা ভাববে না ফুলকি। রেশমার ক্ষতি হোক, এটা চায় না ফুলকি। বই খুলে রেখে ভেবে যাচ্ছিল ফুলকি। রেশমার কি দোষ? রেশমা যেন এই জ্বালাতে না জ্বলে। ফুলকি কিছুতেই হতে দেবে না তা। শামিমকে ফুলকির জীবন থেকে মুছে ফেলতে হবে। কিন্তু কী ভাবে? ফুলকিকে আবার তার পূর্ব জীবনে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু চেষ্টা কি সে করছে না?
সে তো পড়াশোনায় ফিরে চাইছে। প্রাণপণে সে কাজে মন দিতে চাইছে। তার সহপাঠীদের সঙ্গে তার পুরনো সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু যতই সে উঠতে চাইছে, ততই দেখছে একটা অদৃশ্য অক্টোপাশ আটখানা বাহু বাড়িয়ে তাকে তার জগৎ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যন্ত্রণার সীমাহীন অতল তলে। কেমন করে উঠে দাঁড়াবো ফুলকি? কে তাকে হাত বাড়িয়ে টেনে তুলে নেবে।
৩৮
সে সময় শুধু যে ফুলকি একাই জ্বলছিল তা নয়। ফুলকি যে একাই অস্থিরতায় ভুগছিল তা নয়। সে সময়টা এমনই যে, দেশের প্রত্যেকটা লোকই যেন আশঙ্কায় উদ্বেগে অস্থিরতায় ভুগছিল। মাঝে মধ্যে ফুলকির নজর পড়ত তার বাবার উপর। বাবা যেন দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছিলেন। তাকে কেমন যেন বিষণ্ণ ক্লান্ত অবসাদগ্রস্ত বলে মনে হত। মনে হত তাঁর বয়সের ভার যেন বেড়েই চলেছে। এই সময় ফুলকি চুমকিকে দেখাশোনার ভার নিজের হাতে তুলে নিয়েছিল। সপ্তাহে সে নিয়ম করে চুমকির হস্টেলে যেত। তার খোঁজখবর নিত। চুমকির বন্ধুদের সঙ্গে গল্পটল্প করে নিজেকে কাজের মধ্যে্য ডুবিয়ে রাখবার চেষ্টা করত ফুলকি। চুমকি বাড়ি আসতে চাইত না। বাড়িতে তার ভাল লাগত না। কেনই বা চুমকির মতো মেয়ের তাদের খাঁ খাঁ বাড়িটা ভাল লাগবে?
নিয়মিত ক্লাসে যেতেও শুরু করেছিল ফুলকি। এবং বুঝতে পারছিল, সে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। তার অবস্থা তখন এমন, সে বছর পরীক্ষায় বসবে কি না, সে সেটা স্থির করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে রিনি এগিয়ে এল ফলকির কাছে। রিনি ওদের সহপাঠী। কিন্তু এই মেয়েটিকে ফুলকির সব বন্ধুরাই এড়িয়ে চলত। রিনি শ্রীনিবাসন নাকি দেমাকি মেয়ে। কি দেখে ফুলকির বন্ধুরা যে রিনিকে দেমাকি বলেছিল, ফুলকি তা বলতে পারে না। সে ছিল ক্লাসের সব চাইতে ভাল মেয়ে। পড়াশুনো নিয়েই থাকত। পড়াশুনার ব্যাপার ছাড়া আর কিছুকে সে পাত্তা দিত না। ফুলকির পুরুষ বন্ধুরাই প্রথমে রিনি সম্পর্কে এই রটনা করে। তারপর, এখন ফুলকির অবাক লাগে ভাবতে, ওদের কথা ফুলকির মেয়ে বন্ধুরাও কেমন মেনে নিয়েছিল অনায়াসে। ফুলকি নিজেও কি গুজবের শিকার হয়নি? এতদিন ধরে একসঙ্গে পড়ছে ওরা। কেন একদিনও ফুলকির ইচ্ছে হয়নি রিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে? মানুষের মন কি ভাবে চলে? কার দ্বারা চালিত হয় আজকাল মাঝে মধ্যে এ সব নিয়ে ভাবতে বসে ফুলকি।
সেদিন কলেজ ক্যান্টিনে গেল ফুলকি। একটা পিরিয়ড অফ্ ছিল ওদের। প্রতাপরা দল বেঁধে কফি হাউসে চলে গেল। ওকে ওরা সাধাসাধি করেছিল। কিন্তু ফুলকির ভাল লাগছিল না সেদিন। সে ক্যান্টিনেই গেল। ভাগ্যিস গিয়েছিল। ক্যান্টিন ফাঁকা। ফুলকি প্রথমে রিনিকে দেখতে পায়নি। রিনিই তাকে হ্যালো বলে সম্বোধন করতে ফুলকির নজর তার উপরে পড়ল। রিনিও একটা টেবিলে একা বসে আছে। অগত্যা ফুলকি সেই টেবিলেই গিয়ে বসল। রিনি হাসল। ক্লাসে রিনিকে হাসতে দেখা যায় না। রিনি চোখের মোটা পাওয়ারের চশমা নিয়ে যখন তার দিকে চেয়ে হাসল, তখন তো তাকে ‘ওয়ালরাস্’ বলে মনে হল না। বঙ্কু এই নামটা রটিয়েছিল। ফুলকি তার কাছে বসে স্বচ্ছন্দই বোধ করতে লাগল।
রিনি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী, পড়াশোনা কেমন এগুচেছ?’
ফুলকি অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত রিনিকে বলল, ‘ভাবছি এবার পরীক্ষা দেব না।
‘পরীক্ষা দেবে না!’ রিনি যেন ইলেকট্রিকের শক খেল। ‘বাট হোয়াই?’
রিনি বাংলা টেনে টেনে বলে। কিন্তু চমৎকার বলে। রিনির ছোট প্রশ্নটা সোজা এসে ফুলকিকে ধাক্কা মারল। ‘বাট হোয়াই!’ সত্যিই তো কেন? কেন ফুলকি পরীক্ষা দেবে না? নিজেকেই উত্তর দিল নিজের মনে, আমার পড়াশুনা কিছুই হয়নি। পড়াশুনা হয়নি। বাট হোয়াই?
ফুলকি বলল, ক্লাস আজকাল ফলো করতে পারছিনে। মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না। এর মধ্যে কি যে পড়া হয়েছে, আমি তা জানিনে।
কেন যে এত কথা রিনিকে বলেছিল ফুলকি, সে তা জানে না। কিন্তু এই প্রথম সে বোধ করল, সে আরাম পাচ্ছে। তার ভাল লাগছে রিনির সঙ্গে কথা বলতে। ফুলকি রিনির দিকে চেয়ে রইল পুরু চশমার মধ্য দিয়ে রিনির চোখ দুটোকে কত বড় বড় লাগছে। আর গোল গোল। বঙ্কু কি এই কারণেই রিনির নাম দিয়েছে ওয়ালরাস্! বঙ্কুর উপর রাগ হল ফুলকির।
‘তুমি যদি ঠিক কর, তুমি পরীক্ষা দেবে, আর তুমি যদি চাও অমিতা তবে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি। সব নোট আমার আছে।
অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব। রিনির কথায় ফুলকির মন এতই আলোড়িত হতে থাকল যে, সে কোনও কথাই বলতে পারল না শুধু চোখ বুজে নিজের আবেগকে সামাল দিতে থাকল।
রিনিও আর কথা বলছিল না। রিনি কি তার অবস্থা বুঝতে পেরেছে? ওরা চুপচাপ খেয়ে যেতে লাগল। পাখাটা শব্দ করে ঘুরছিল ওদের মাথার উপর। সেই শব্দই যেন ওরা মনোযোগ দিয়ে শুনে যেতে লাগল।
‘তুমি যদি চাও অমিতা, আমি তোমার পার্টনার হতে পারি। আই নিড এ পার্টনার। দুজনে একসঙ্গে যদি পড়াশুনা করি, তাহলে দুজনেরই উপকার হবে।’
রিনি! রিনি! আহ্ কি ভাল মেয়ে তুমি!
‘তুমি যদি পুরুষ হতে অমিতা, তাহলেই এমন লাইটলি বলতে পারতে, আমিভাবছি, এবার পরীক্ষা দেব না। কিন্তু তুমি মেয়ে অমিতা। আমিও মেয়ে। আমরা এ ধরনের কথা বলতে পারি না। বলা আমাদের উচিত নয়। এইভাবে ভাবাও আমাদের উচিত নয়। এখন যে চান্স আমি পেয়েছি, কে জানে সেটাই হয়ত আমার জীবনের শেষ সুযোগ। সেই সুযোগটাকেই আমাকে কাজে লাগাতে হবে। এবং তাতে সফল হতে হবে। আমি তো এই ভাবে ভাবি। প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে একটু একটু করে আমাকে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে।
রিনির বেশি পাওয়ারের চশমার কাঁচ দুটো ফুলকির মুখের দিকে স্থির হয়ে থমকে রইল। চশমার পিছন থেকে রিনির বড় বড় গোল গোল চোখ দুটো যেন জ্বলতে লাগল ফুলকির মুখের উপর। সে অনুভব করতে লাগল, কী প্রচণ্ড একটা শক্তি সংহত হয়ে আছে এই রোগা পাতলা মেয়েটার মধ্যে। এমন আর কারও মধ্যে পায়নি ফুলকি। তার দিদির মধ্যেও প্রচণ্ড শক্তি আছে। কিন্তু দিদি যেন সাইক্লোন। রিনিকে তার এখন মনে হতে লাগল, রিনি যেন একটা পাওয়ার হাউস। রিনির সামনে বসে বসে ফুলকির মনে হতে লাগল, তার মনের অস্থিরতা যেন একটু একটু করে কমে আসছে। সে হয়ত মাটিতে পা রাখতে পারবে আবার।
‘তুমি কেন লেখাপড়া শিখছ অমিতা?’
রিনির আচমকা প্রশ্নে বিমূঢ় হয়ে পড়ল ফুলকি। সে কেন লেখাপড়া শিখছে? মনকে নানাভাবে হাতড়ে দেখল ফুলকি, কিন্তু কোনও জবাব ওর মনে পড়ল না। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ফুলকি ক্লান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানিনে।’
‘আমি কেন লেখাপড়া শিখতে এসেছি, আমি তা জানি অমিতা।’
তুমি জানো? ফুলকি রিনির দৃঢ় অথচ শান্ত কথাটা শুনে ব্যাকুলভাবে প্রশ্ন করল, তুমি জানো রিনি?
‘জানব না! তবে লেখাপড়া করছি কেন?’
কথাটা এত সত্য যে, ফুলকির সেটা মেনে নিতে এক মুহূর্তও দেরি হল না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই নিজের কথা মনে পড়ল তার। সে কেন জানে না? কেন সে বলতে পারল না, সে কেন লেখাপড়া শিখছে?
‘তুমি কেন লেখাপড়া শিখছ, তুমি এটা জানো না, তাই অত অনায়াসে তুমি ঠিক করে ফেলেছ যে, তুমি পরীক্ষা দেবে না। আসলে অধিকাংশ লোকই জানে না, তার কাজের উদ্দেশ্য কী?’
তুমি কি করতে চাও রিনি?
‘করছি তো লেখাপড়া। তুমি বোধ হয় সেটা জানতে চাইছ না। আমি কী হতে চাই, তুমি হয়ত সেটাই জানতে চাইছ?’
অমিতা জানে রিনি শ্রীনিবাসনের ভূমিকা ফুলকির জীবনে কত গুরুত্বপূর্ণ। সত্যি বলতে গেলে রিনিই ফুলকিকে সুস্থ করে তুলেছিল। তাকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছিল ফুলকির নিজের মধ্যে।
‘আমি অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যাব। আমি আমার বাবার আদলে গড়া। আমাকে বি-এ অনার্সে উঁচু দিকের ফার্স্ট ক্লাস পেতেই হবে। দেশের খবর রাখ?’
ফুলকি বলেছিল, আমার বাবার ওখানে পলিটিক্স প্রায়ই আলোচনা হয়। আমাদের বাড়িটাই পলিটিক্সের বাড়ি। কিন্তু তাতে আমি কোনও ইন্টারেস্ট পাইনে।
‘আমি যথাসম্ভব খবর রাখি। তোমাক বলছি অমিতা, আমাদের দেশের একটা দারুণ পরিবর্তন হবে। ভাল হবে কি মন্দ হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এটা বলতে পারি, যাই ঘটুক, মেয়েদের জীবনে তার প্রভাব খুবই পড়বে। ভারত স্বাধীন হলে, মেয়েরা যদি তাদের প্রাপ্য বুঝে নিতে না পারে, তাহলে তার চাইতে ক্ষতি আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু আমি দেখছি, এ বিষয়ে আমাদের মেয়েদের মধ্যে কোনও চেতনাই জেগে ওঠেনি। তারা কেমন নির্বিকার। আমরা যদি আমাদের পাওনা বুঝে নিতে না পারি, তবে কে সেটা আমাদের হাতে তুলে দেবে।’ এ সব কথা ভেবেছ কখনও?’
ফুলকি দেখল, কিছুই সে রিনির মতো গভীরভাবে ভেবে দেখেনি। আবেগের টানে কেবল সে ভেসেই গিয়েছে। এখনও যাচ্ছে না কি? স্রোতের শ্যাওলার মতো?
পরের দুটো পিরিয়ড ওরা করল। শেষ পিরিয়ডটা হল না। অধ্যাপক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ওরা লাইব্রেরিতে গেল। ততক্ষণে ফুলকি ঠিক করে ফেলেছে, সে পরীক্ষা দেবে। এবং সিরিয়াসলি পড়ায় মন দেবে। রিনি ফুলকির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
বাড়ি যাবার মুখে রিনি হঠাৎ বলেছিল, ‘আমি বাবাকে মিস করব অমিতা।’
কেন?
‘বাবা দিল্লিতে বদলি হয়ে যাচ্ছেন হঠাৎ। সেক্রেটারিয়েটে। আমাকে এখন একাই থাকতে হবে পরীক্ষা পর্যন্ত।’
কবে যাবেন তোমার বাবা?
‘সামনের সপ্তাহেই। এবারে একা থাকব আমি। বাবা রাজি হয়েছেন। আমাকে কোথাও একটা আস্তানা খুঁজে নিতে হবে।’
রিনিকে কিছুই বলেনি সেদিন, যদিও তার বেজায় ইচ্ছে হচ্ছিল রিনিকে জিজ্ঞাসা করে, সে যদি তাদের বাড়িতে থাকে পরীক্ষা পর্যন্ত তাহলে ফুলকি খুশি হবে। আসলে ফুলকি একটা সঙ্গী চাইছিল। তার প্রচণ্ড একাকিত্ব থেকে মুক্ত হতে।
অমিতা হিসাব নিতে চেষ্টা করল; তার এই তেষট্টি বছরের জীবনে রিনি কদিন তাকে সাহচর্য দিয়েছিল। কদিন রিনি ছিল তাদের বাড়িতে? এক সপ্তাহও নয়। ওর বাবা রিনির জন্য যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করে গিয়েছিলেন, যেদিনই রিনি সেটার চাবি পেল, তার পরের দিনই রিনি চলে গেল তার সেই ছোট এক কামরার ফ্ল্যাটটাতে। স্বাধীন জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, এই ছিল রিনির কথা। সেই ফ্ল্যাটটাতে ফুলকিও ‘গিয়ে মাঝে মধ্যে কাটাত। রিনির সঙ্গে পড়া তৈরি করত সে। রিনির ভাবনাচিন্তা খুব পরিষ্কার। যেমন নিজে সে বোঝে তেমনই ফুলকিকে সে বুঝিয়ে দিতে পারত। সব চাইতে বড় গুণ রিনির ছিল এই যে, সে ফুলকির ভাবনা চিন্তাকেও উসকে দিতে পারত।
রিনি বলেছিল, ‘অমিতা তুমি কেন ফাইট না করেই ডিফিট মেনে নিতে যাচ্ছ। পরীক্ষা না দেবার কথা তো পরাজয়ের কথা। অনেককেই দেখেছি। একটা কাজ করতে করতে মাঝপথে ছেড়ে দেয়। বলে ভুল করে এ কাজে এসেছিলাম। এ কথার কি কোনও মানে হয় অমিতা। ইউ আর নট দ্যাট চাইল্ড। অত ভুলই বা তুমি কেন করবে? আর যদি ভুল করেই থাকো, তবে কাজটা মাঝপথে ছেড়ে দিলেই কি তোমার সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করা হয়ে গেল? অমিতা বল, আমি ঠিক বলছি কি না। ছেড়ে দেওয়াটাই যদি প্রায়শ্চিত্ত হয়, তবে তো বেশ মজা। ওটা তো এসকেপ করা। আমি বলি অমিতা তুমি যদি কোনও কাজ ভুল করেও আরম্ভ করে থাকো, তবুও তোমাকে তাতে স্টিক করে থাকতে হবে। যন্ত্রণা পাবে। হ্যাঁ, সেইটাই তো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত অমিতা। এইভাবে তোমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও যন্ত্রণা পেতে পেতে তুমি একদিন যখন তোমার ভুল কাজটা শেষ করবে, তখন তুমি তার থেকে দুটো স্থায়ী লেসন পাবে। ভুল কাজটা শেষ করা যে তোমারই দায়িত্ব সেই শিক্ষা তুমি পাবে। ফলে কোনও কাজ বেছে নেবার আগে সেটা তোমার বিচারে ঠিক কি ভুল, সেটা স্থির করে নিতে পারবে। এবং জীবনে খুব বেশি ভুল কাজে আর এগিয়ে যাবে না।
রিনিকে তার সহপাঠীরা দেমাকি বলত। রিনি কি তাদের সঙ্গে এই ধরনের কথা বলেছে? রিনিকে যারা জানেনি, বোঝেনি তারাই রিনিকে দেমাকি বলে তফাতে রেখেছে। রিনির কথা যে কেউই চট করে মনে করতে পারত, রিনি বুঝি সর্বদাই সদুপদেশ দিচ্ছি। কিন্তু ফুলকি রিনির সঙ্গে যতই ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততই বুঝেছে, এগুলো রিনিরই মনের কথা। সে ওইভাবেই ভাবনাচিন্তা করে। ফুলকি রিনিকে পেয়ে বেঁচে গিয়েছিল। রিনি যতদিন ছিল, তার মধ্যেই ফুলকির মনে পড়াশুনোর আগ্রহটা আবার জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। ফুলকি বুঝতে পারছিল, তার আত্মবিশ্বাস পায়ে পায়ে ফিরে আসছে। ফুলকি ইদানীং রাতকে ভয় করতে শুরু করেছিল। রাত মানেই ফুলকির কাছে বিভীষিকা। রাত মানেই ফুলকির কাছে সেটা নরকযন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু ছিল না। একা একা একা।
একা একা একা। ফাঁকা ফাঁকা ফাঁকা। খাখা খাখা খাখা। উহ্!
অমিতা বলে উঠল, উ!
অমিতা এপাশ ওপাশ করছে। সে ক্যান্সারের যন্ত্রণায় এখন কাতর। অমিতা অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে কারও যেন সান্নিধ্য পেতে চেষ্টা করছে। এই এখন অমিতার রাতের নিত্য কর্ম। কাউকে খোঁজা। অমিতা এই পরিণত বয়সে, যখন বিছানায় একা রাত কাটায়, তখনও কাউকে খোঁজে। কোনও এক সঙ্গীকে। কি কোনও এক সঙ্গিনীকে। কোনও এক উষ্ণ মানুষকে। মানুষের উষ্ণতারই স্পর্শ পেতে চায় সে।
রিনি শ্রীনিবাসন ফুলকির এক ঘোরতর দুঃসময়ে তাকে সঙ্গদিয়েছিল। অমিতার মনের গভীর গোপনে সেই স্মৃতি যে এত উজ্জ্বল হয়ে আছে, সেটা সে বুঝতে পারেনি। কোথায় আছে এখন রিনি? ইহলোকে না পরলোকে? তা জানে না অমিতা। কিন্তু রিনির অস্তিত্ব অমিতার মন থেকে মুছে যায়নি, রিনি যে তার স্মৃতিতে সতেজ আছে এটা ভেবেই স্বস্তি পেল অমিতা। রাত এখনও অমিতার কাকে দুঃসহ। তবে তার সান্ত্বনা এই যে, রাতে রিনিরা তার কাছে আসে।
রিনি চলে গেলে বাবারও মন খারাপ হয়েছিল। যেদিন রাতে খাবার টেবিলে রিনি বলল, ‘আঙ্কল, আমি কাল চলে যাব? আমি কি অমিতাকে নিয়ে যাব? আমার সঙ্গে একটা রাত থেকে আসবে। আমার হেলপ হবে!’
বাবা রিনির কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন। ফুলকির স্পষ্ট মনে পড়ে।
‘সে কী! চলে যাবে? কেন?’ বাবা বেশি কথা বলতে পারছিলেন না। তার খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
রিনি বলেছিল, ‘বাবা আমার জন্য যে ফ্ল্যাটটা ঠিক করে রেখে গিয়েছিলেন, সেটা পজিশন আমি পেয়ে গিয়েছি।’ এখন সেখানেই থাকব।
‘পেয়ে গিয়েছ ফ্ল্যাট? এ তো ভাল কথা। তবে তো যেতে হবেই।’ বাবা হঠাৎ আবার চুপ করে রইলেন। ফুলকি দেখেছিল, বাবার প্রতি কথার সঙ্গে তার মুখে একটা চাপা বেদনার ঢেউ খেলে যাচ্ছিল।
তারপর বাবা যেন আপনমনেই বলতে লাগলেন, ‘দেখ, অ্যাডমিনিস্ট্রারের সঙ্গে উকিলের কত তফাত। উকিলদের এমনই শিকড় গজিয়ে যায় মা যে, তারা তো নড়তেই পারে না, তাদের কাছের মানুষদেরও তারা নড়তে দেয় না। ফুলকির বাবা হচ্ছে সেই শিকড়গজানো বাবা। তোমার বাবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর রিনি মা, তার স্বভাবে তাই শিকড়টার বেশি গুরুত্ব নেই। কোনও গুরুত্ব নেই বলাই বোধ হয় ভাল। কোত্থাও তাঁকে শিকড়ের টানে বাঁধা পড়তে হয় না। তাই অনায়াসে তোমার বাবা এই দেশের সব জায়গাকেই তাঁর নিজের জায়গা বলে সহজে গ্রহণ করে নিতে পারেন। এই দেশটাই তো তাঁর দেশ। গোটা পৃথিবীই তো তার নিজের জায়গা। আর আমরা? আটকে থাকি, তাই জায়গা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করেই শেষ হয়ে যাই।’
সেদিন বাবা আরও অনেক কথা বলেছিলেন। রিনিও বলেছিল। বাবা দিদি চলে যাবার পর থেকেই কেমন যেন নিজের মধ্যে গুটিয়ে আনছিলেন নিজেকে। রিনি বাবাকে কদিনর জন্য তার খোলস থেকে মুক্ত করে এনে ফেলেছিল। বাবা আবার ফিরে আসছিলেন তাঁর নিজের স্বভাবে। বাবার বিষণ্ণতা কেটে আসছিল। ফুলকি তাই চাইছিল, রিনি আর কিছুদিন থাকুক তাদের বাড়িতে।
রিনি বলেছিল, ‘আমার বাবা বলেন, আমি কোথাকার লোক একদিন এই দিয়েই আমাদের পরিচয় ঠিক হত। আমি কি হয়ে উঠেছি, এটাকে কেউ পাত্তাই দিত না। অথচ এটাই তো আমার আসল পরিচয়।
সঠিক কথা। তোমার বাবা ঠিকই কথাই তো বলেছেন রিনি মা। আমিও তো এই কথাই বলি। কিন্তু মুখে বলি, কাজে করি না। এই দেখ না, আমি যখন এই বাড়িটা কিনি তখন মনে মনে এটাই তো ভেবে রেখেছিলাম যে, আমার এই বাড়িটা হবে আমার তিন মেয়ের আশ্রয়। কেন ভেবেছিলাম? আমার মনের সেই শিকড় গজানোর আদিমণ প্রবৃত্তিই এটা আমাকে বুঝিয়েছিল। কিন্তু কার্যত কী হল? শিকড় যতই গভীরে ঢুকতে শুরু করল, ডালগুলো ততই ফাঁকা হতে লাগল। মেয়েদের জীবন যে তাদেরই জীবন, আমার বাবা হবার অহমিকা আমাকে তা বুঝতে দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে আমার এই রিনি মা-টি তখন কোথায় ছিল? রিনি মায়ের সঙ্গে আমার যদি অনেক অনেক আগে দেখা হত, তাহলে এই বোকা উকিলটা শিকড় গজানোর আহাম্মকিটা করত না।।’ বাবা হা হা করে হাসতে শুরু করে দিলেন। বাবার যে হাসি তাঁর বৈঠকখানা ঘর থেকে ভেসে আসত ফুলকি জন্ম ইস্তক শুনে এসেছে, এ সেই হাসি। ফুলকির চোখ দুটো কর কর করতে লাগল।
রিনি বলেছিল, ‘আঙ্কল, বাবা বলেন, যে পৃথিবী আমাদের সামনে আসছে সেটা মানুষের সমস্ত ধ্যানধারণা বদলে দেবে। বিজ্ঞান আর টেকনোলজি একেবারে ওলট পালট করে ছাড়বে। পলিটিক্স নিয়ে এত মাতামাতির কোনও অর্থ থাকবে না।’
‘এ সব কথা তোমার মুখ থেকে শুনতে এত ভাল লাগছে মা কি বলব? এই যুদ্ধে আমরা ধ্বংসর মুখটাই দেখেছি। কী প্রচণ্ড তার শক্তি। কিন্তু এই শক্তি তো শুধু ধ্বংসকেই আনেনি মা। আমরা চাইলে এটা গড়ার কাজেও লাগতে পারে। এবং গড়ার কাজেও এটা লাগবে। এবং বিপ্লব ঘটিয়ে ছেড়ে দেবে। যদিও আমরা কেউই এ সম্পর্কে সচেতন নই।
বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি যখন যাবেই, তখন যাবেই। তোমাকে দেখে আমার এই ধারণাই হয়েছে রিনি। শুধু একটা কথা বলি রিনি মা, তোমার ইচ্ছে হলেই এখানে চলে আসবে। আমি একটা সঙ্গী পাব।’
সেদিনই শুতে গিয়ে ফুলকি রিনিকে বলেছিল শামিমের কথা। এবং রিনি ধৈর্য ধরে শুনে গিয়েছিল। এই প্রথম কাউকে শামিমের কথা বলল ফুলকি। সব কথার বলার পর চুপ করে শুয়ে রইল ফুলকি। রিনি একটা কথাও বলেনি। তবুও ফুলকি বোধ করল, তার বুকের বোঝাটা যেন খানিকটা হালকা লাগছে।
রিনি বলেছিল, ‘আমি কি আজ তোমার কাছে শুতে পারি অমিতা?
রিনি বলেছিল, ‘আমি তোমার সাফারিংকে ছোট করে দেখছিনে অমিতা। আমাকে ভুল বুঝো না। তোমার এই প্যাশন তোমাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে অমিতা? তোমার কোনও ধারণা আছে?’
ফুলকি বলেছিল, না।
‘আমি দেখছি, তুমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছ। কেন হারিয়ে ফেলছ অমিতা তোমাকে? আজ হয়ত আমার কথা তোমার ভাল লাগবে না। কি মনে হবে তোমার জানি না তবু বলব, তুমি মেয়ে বলেই বলব, আমরা আমাদের ভেসে যেতে দিতে পারি না। তোমাকে একটা কিছু হয়ে উঠতে হবে অমিতা। উঠতেই হবে।
এই ছিল রিনির সে রাতের কথা। অমিতা এখনও মনে করতে পারে। রিনি অমিতাকে মায়ের মতো সে রাতে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। রিনির কথা সেদিন তেমন ভাল লাগেনি ফুলকির। কিন্তু রাগ হয়নি তার। সে শুধু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু রিনি যখন তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ল, তখন রিনিকে তার খুব খুব ভাল লেগেছিল।
রিনির ফ্ল্যাটে দুদিন কাটিয়ে যেদিন ফুলকি বাড়িতে ফিরে এল, সেইদিনই সে শামিমের চিঠি পেল।
৩৯
রিনি বলেছিল, ‘প্যাশন বন্যার মতো। আমি জানি ফুলকি।’
রিনি এর বেশি আর কিছু বলত না। কিন্তু যেমন ভাবে বলত, তাতে ফুলকির মতে হত, রিনির একটা গভীর ক্ষত আছে।
‘বন্যা তো ডিরেকশন মানে না। নিজের প্রবল বেগেই বয়ে যায় যেখান সেখান দিয়ে। প্যাশন ও তাই অমিতা। আমি বন্যাকে খুব ভয় করি।
পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ এই ধরনের কথা উঠে পড়ত।
‘জান কি, আমি একবার বন্যায় ভেসে যাচ্ছিলাম। বাবা তখন রাজসাহীতে। বন্যা-টন্যা হলে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে তো সেই সব জায়গায় যেতে হয়। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। পূজার ছুটিতে বাবার কাছে গিয়েছিলাম। আর সেবার পূজার সময় বন্যা হয়েছিল খুব। বাবাকে প্রায়ই যেতে হত। বাবার বোট ছিল। আমি একবার খুব ইনসিস্ট্ করেছিলাম, আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। আর সেইবারই পড়ে গিয়েছিলাম জলে। বাবার নৌকার বোটম্যান ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে তুলে এনেছিল। আমি বন্যাকে ভয় পাই।’
শামিমের চিঠি নিয়ে ফুলকি সেদিন রিনিকে কিছু কথা বলেছিল। বলেছিল রেশমার কথা। বলেছিল, শামিমের জীবনে রেশমা এসে পড়ায় ফুলকির জীবনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তার কথাও। শামিমের যে চিঠিটা পেয়েছে ফুলকি, তাতে শামিম লিখেছে, সে আসছে কলকাতায়। ফুলকি ঠিক করে ফেলেছে, শামিমকে জানিয়ে দেবে, এ সম্পর্ক আর চলতে পারে না। ফুলকি রেশমার জন্য এ আত্মত্যাগটা করবে। এসব কথাই বলেছিল রিনিকে।
রিনিকে অকপটে এসব কথা বলতে পেরে, ফুলকি, সেদিনের ফুলকি অনুভব করেছিল, সে বিরাট একটা কাজ যেন করে ফেলেছে। আর এটাই যেন তাকে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে। ফুলকি ভেবেছিল, রিনি অন্তত বুঝবে যে, ফুলকি কিছু একটা হয়ে উঠতে পারছে।
রিনি শান্তভাবে সব কথা শুনল ফুলকির। তারপর বলেছিল, ‘ডাজ ইট রিয়েলি ম্যাটার অমিতা? সত্যিই কি এতে এসে যায়?’
সেদিনও অমিতার খারাপ লেগেছিল রিনির কথা শুনে। কিন্তু তবুও ওর উপর তার বিন্দুমাত্র রাগ হয়নি।
ডাজ ইট্ রিয়েলি ম্যাটার অমিতা?
সত্যিই তো, আজ আর কিছুতেই এসে যায় না তার। এমন কি তার ক্যান্সারেও তো তেমন কিছু কারও এসে যাচ্ছে না। যাচ্ছে কি?
শামিমের সঙ্গে ফুলকির আর যে জীবনে দেখাই হল না, তাতেই বা কি এসে গিয়েছে অমিতার। শামিম কিন্তু কথা রেখেছিল। চিঠিতে লিখেছিল, সে আসবে। শামিম এসেছিল। কিন্তু ফুলকি সেদিনই বাড়ি ছিল না। ছিল রিনির ওখানে। জীবনে এক-একটা এমনই ঘটে যায়। যে শামিমের জন্য তার প্রতীক্ষার অন্ত ছিল না, সেই শামিম এসেছিল। হ্যাঁ এসেছিল। ফুলকি যদি বাড়ি থাকত সেদিন তবে শামিমের সঙ্গে তার দেখা হত। কী হত তাহলে? বাতাসিয়ার হাতে যে ছোট্ট চিঠিটা তাড়াতাড়ি করে লিখে রেখে গিয়েছিল শামিম, সেটা ছিল জরুরি। ‘ফুলকি; আমি ফিরে যাচ্ছি। আজ তোমার বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। শুনলাম আমার বাবাও তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করেছেন। সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গিয়েছে। তোমার সঙ্গে দেখা করা জরুরি। আমি এ বাড়িতে আর আসব না। তুমি কাল প্যারাগনে অবশ্যই এসো।’
শামিম যেদিন ফুলকিকে প্যারাগনে যেতে বলেছিল, সেদিন ছিল ডিরেক্টর অ্যাক ডে।
ডিরেক্ট অ্যাকশন!
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, এই সর্বনাশ এড়ানো যাবে। কিন্তু গেল না। তোর বাবা ক্রমেই বিচলিত হয়ে উঠছিল ফুলকি। কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব নিয়ে যত টালবাহানা চলছিল, ততই তোর বাবার উদ্বেগ বাড়ছিল। আমাকে বলেছিল, তায়েব, আলোচনা তো লড়াইয়ের ময়দান নয়। আলোচনার জন্য ঠাণ্ডা পরিবেশ দরকার। কিন্তু সর্বত্র এত উত্তেজনা জেগে উঠছে কেন? কাগজে যে সব বিবৃতি বের হচ্ছে নেতাদের, সেগুলো তো মানুষকে খেপিয়েই তুলছেছ। কোথায় যাচ্ছি আমরা বুঝতে পারছ তায়েব?
ডিরেক্ট আক্শন!
কিছুদিন ধরেই কলকাতায় এমন আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়ছিল যে, একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যাবে। কেউ তার সঠিক চেহারাটা জানত না। ১৬ আগস্টে দাঙ্গা শুরু হল কলকাতায়। সেটাই ডিরেক্ট অ্যাকশ্। তার আগের দিনও ফুলকি রিনির বাড়িতে গিয়েছে। তেমন কিছু টের পায়নি। ক’দিন ধরেই কলেজের ছেলেদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছিল, সেটারও বিশেষ আঁচ পায়নি ফুলকি। রিনিও না। ওরা তখন পরীক্ষার জন্য খুবই পরিশ্রম করছিল।
বাড়িতে এসে সেই সন্ধ্যায় শামিমের তাড়াহুড়োয় লেখা চিঠিটা পেয়ে সে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল। কবে এল শামিম কলকাতায়! এমন চিঠি কেন লিখল শামিম? বাবার সঙ্গে তার কি কথা হয়েছে, সে আন্দাজ ফুলকি করতে পারে। শামিম তার শেষ চিঠিতেই লিখেছিল, ‘এবার কলকাতায় গিয়েই আমাদের ব্যাপারটা পাকা করে ফেলব ফুলকি। এবার তোমার বাবাকে জানাবার সময় হয়েছে বলে আমি মনে করি। দোহাই তোমার তুমি একটু বুঝতে চেষ্টা কর। আমি আমার মনটা রেশমাকে জানিয়ে দিয়েছি। সে ব্যাপারেও তোমার সঙ্গে কলকাতায় আমার কথা হওয়া দরকার। আমার বাবার কথা তোমাকে লিখেছিলাম ফুলকি। এবার রণক্ষেত্রে তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন। তার লক্ষ খালুর সম্পত্তি। আমি তোমাকে বিয়ে করলে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাবে, এই চিন্তা বাবাকে খেপিয়ে তুলেছে। তিনি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করবেন বলে আমাকে শাসিয়ে রেখেছেন। যে করেই হোক, বাবা কলকাতায় পৌঁছবার আগেই আমাকে কলকাতায় পৌঁছুতে হবে। আমার বাবা পৌঁছুবার আগেই আমাকে তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে হবে। এবং আমার প্রস্তাব তাঁর কাছে পাড়তে হবে। আমি অনেক ভেবে দেখেছি ফুলকি, তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। আমার উপর ভরসা রেখো।’
ফুলকির সব সাধু সঙ্কল্পই শামিমের এই চিঠিখানা ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শামিম শামিম, তুমি আমারই আছ শামিম।
সেদিন সন্ধ্যায় বাতাসিয়ার হাত থেকে শামিমের চিরকুটটা নিয়েও ফুলকি বলেছিল, আমি তোমারই আছি শামিম। ফুলকি আশা করেছিল বাবা হয়ত তাকে কিছু বলবেন। কিন্তু বাবার চোখ মুখ দেখে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করতে পারেনি সেদিন।
বাবা একবার তার দিকে চেয়ে বলেছিলেন, ‘কাল হাঙ্গামা হতে পারে ফুলকি। আমি লোরেটোতে ফোন করেছিলাম। ওঁরা জানালেন, ওঁদের ওখানে কোনও ভয় নেই। নমিতার বিষয়ে আমি যেন নিশ্চিন্ত থাকি। লোককে এমন খেপিয়ে তোলা হয়েছে যে, সামান্য কিছু হলেই দাউ দাউ আগুন জ্বলে ওঠার আশঙ্কা আছে।’
দাউ দাউ আগুনই জ্বলে উঠেছিল কলকাতায়। আর তাতে শুধু ফুলকিরই প্রেম নয়, আরও অনেক কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল।
‘আমরা বিশ্বাস করিনি মা, বাংলায় এমন সর্বগ্রাসী দাঙ্গা হবে। আরও অনেকবার কলকাতায় দাঙ্গা হয়েছে। দাঙ্গা হয়েছে ঢাকায়। বাংলার অনেক জায়গাইে তো দাঙ্গা হয়েছে। কিন্তু এমন ভয়াবহ ব্যাপার আর কখনও দেখা যায়নি। মুসলমানের প্রতি হিন্দুর, হিন্দুর প্রতি মুসলমানের যেটুকু বিশ্বাস, যেটুকু আস্থা অবশিষ্ট ছিল সেটুকু পুড়ে একেবারে ছাই হয়ে গেল। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম ফুলকি, দেশভাগকে আর রোখা যাবে না। মনে মনে আমরা একেবারেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছি।
তায়েবকাকার মুখে শুনে এবং পরে নানা জায়গা থেকে নানা জনের মুখ থেকে ফুলকি সে সময়ের ইতিহাসটা সংগ্রহ করেছিল একটু একটু করে।
‘তোর বাবা বরাবরই হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপরেই আমাদের ভবিষ্যতের কল্যাণ নির্ভর করছে, এই নীতিতে বিশ্বাস করে এসেছে।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন।
বাবা বলতেন, ‘আমাদের যে কোনও রাজনীতির মূল সূত্রই হবে হিন্দু মুসলমানের ঐক্য। এটাকে সামনে রেখেই, এটাকে মূলে রেখে, আমাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের যাবতীয় ছক সাজাতে হবে। এখানে মান-অভিমানবশত আমরা যদি একের থেকে অন্যে মুখ ফিরিয়ে নিই, তবে আমাদের সর্বনাশ কেউ রুখতে পারবে না। আর সে সর্বনাশ হবে এত ব্যাপক এবং এতই ভয়াবহ, যার চেহারা আজ আমরা কেউ কল্পনাতেও আনতে পারছিনে।’
‘তাই তোর বাবা সেদিন ক্রিস্ মিশনকে অত গুরত্ব দিয়ে দেখেছিল। স্যর স্ট্যাফোর্ড ক্রিপ্স্ তখন ব্রিটেনের ওয়ার কেবিনেটের সদস্য। ১৯৪২-এ মার্চ মাসে ক্রিস্ ভারতে আসেন নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য। তার আগে রেঙ্গুনের পতন হয়েছে। জাপানি সৈন্য ইম্ফলের দিকে এগিয়ে আসছে। কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের সোসালিস্টরা ছাড়া আর সব প্রধান রাজনৈতিক দল যুদ্ধে মিত্রপক্ষকে সমর্থন করছে। ক্রিস্ যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, জাতীয়তাবাদী উগ্রতা যদি আমাদের বুদ্ধিকে গুলিয়ে না দিত, এবং মনকে যদি অবিশ্বাসে আচ্ছন্ন করে না ফেলত, তাহলে সেটা আমরা গ্রহণ করতে পারতাম। ক্রিস্ প্রস্তাব আমাদের হাতে স্বর্গ তুলে দেয়নি ফুলকি, কিন্তু সেটা নিঃসন্দেহে ছিল খোলা মনে পা বাড়াবার একটা সদর্থক পদক্ষেপ। ৪২ সালে ক্রিস্ প্রস্তাব গ্রহণ করলে হিংসার রাজনীতিকে আমরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম।
‘যেটা শ্রী অরবিন্দ বুঝতে পেরেছিলেন, সেটা গান্ধী বুঝতে পারলেন না কেন, আমি এর কোনও ব্যাখ্যা খুঁজে পাইনে তায়েব।
‘হতে পারে গান্ধী ভেবেছিলেন, শ্রীঅরবিন্দ ভগবৎ সাধনা নিয়ে আছেন, রাজনীতি সম্পর্কে এটা তাঁর অনধিকার চর্চা।’
বাবা বলেছিলেন, ‘এটা জওরলালের মনোভাব হলে আমি কিছু মনে করতাম না। কিন্তু ক্রিস্ প্রস্তাবকে মেনে নেবার প্রস্তাব শ্রীঅরবিন্দ তো জওহলালকে দেননি, প্রস্তাবটা পাঠিয়েছিলেন গান্ধীকে। গান্ধী সেটাকে শ্রীঅরবিন্দের অনধিকার চর্চা বলে খারিজ করে দেবেন, গান্ধীর স্বভাবের সঙ্গে ব্যাপারটা ঠিক মেলাতে পারা যায় না।’
‘অনেকে বলে, শ্রীঅরবিন্দ দিব্যদৃষ্টিবলে দেখতে পেয়েছিলেন, এই যুদ্ধে মিত্র শক্তি অর্থাৎ ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা এবং সোভিয়েট রাশিয়া জয়ী হলে পৃথিবীর কল্যাণ হবে। কারণ এরা দেবশক্তি। আর অক্ষশক্তিকে শ্রীঅরবিন্দ বলেছিলেন, জার্মানি, ইতালি, জাপান ওরা হল দানব শক্তি। তাই শ্রীঅরবিন্দ গান্ধীকে বলেছিলেন, এই যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্রিটেনের পিছনে এসে দাঁড়াতে। এ যুদ্ধে দানব শক্তি পরাজিত হলে ভারতও স্বাধীনতা পাবে।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘হরিকিশোর, এটা ছিল শ্রীঅরবিন্দের ইনার ভয়েসের কথা। গান্ধী নিজেও তো ইনার ভয়েসকে খুব গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু অন্যের ইনার ভয়েসের উপর গান্ধীর তেমন আস্থা ছিল না বলে বোধ হয়।’
তায়েব কাকা বলেছিলেন, ‘এম এন রায় তো ইনার ভয়েসে বিশ্বাস করতেন না। তিনি যুক্তি বুদ্ধির উপরেই শুধু ভরসা রাখতেন। তিনি ক্রিস্ প্রস্তাব গ্রহণ করার জন্য দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়ে ছিলেন। তিনিই একমাত্র মনীষী ফুলকি যিনি যুদ্ধের শুরু থেকে বলে আসছেন, এই যুদ্ধটা ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধ। ফ্যাসিবাদী জয়ী হলে মানব সভ্যতারই পরাজয় ঘটবে। এবং এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধের শেষে ব্রিটেন তার একটা উপনিবেশও রাখতে পারবে না। কারণ উপনিবেশগুলো তখন ব্রিটেনের গলগ্রহ হয়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধের প্রথমে ভারত ছিল দেনদার আর ব্রিটেন ছিল পাওনাদার। যুদ্ধের শেষে এই ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টো যাবে। তখন ভারত হয়ে দাঁড়াবে পাওনাদার আর ব্রিটেন হয়ে দাঁড়াবে দেনদার। এই কথাটা সত্যি ছিল ফুলকি। এন এন রায় বলে যাচ্ছিলেন, যুদ্ধের পরে ব্যালান্স অফ্ পেমেন্ট ভারতের পাল্লাই ভারী করবে। রায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল। যুদ্ধ যখন শেষ হল, তখন দেখা গেল যে, ভারত ব্রিটেনের কাছ থেকে ১৩০ কোটি পাউন্ড পাবে।’
এম এন রায়কে শরৎবাবু একদম পছন্দ করতেন না। কিন্তু তোর বাবা ক্রমেই এম এন রায়ের কথায় গুরুত্ব দিচ্ছে দেখে শেষ দিকে শরৎবাবুর সঙেগ তোর বাবার সম্পর্ক একটু ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল মনে হয়।’
বাবা বলেছিলেন, ‘ফুলকি, আমি এম এন রায়ের যুদ্ধের বিশ্লেষণ দেখে ওঁর প্রতি আকৃষ্ট হই। রায়ের যে কথাটা আমার মনে আছে, সেটা এই, বিপ্লব ঘটিয়ে ভারতে স্বাধীনতা আসবে না, প্রকৃত সত্য এই যে, ব্রিটেন ভারতকে তার কলোনি হিসাবে রাখতে পারবে না বলেই ভারতে স্বাধীনতা আসবে। ভারতে পাওয়ার ট্রান্স হবে। সংবিধানসম্মত পথে। আমাদের তার জন্যই তৈরি হতে হবে। এই কারণে তিনি ক্রিস্ প্রস্তাবকে গ্রহণ করতে বলেছিলেন। কারণ সেটা ছিল কনস্ট্রাকটিত পদক্ষেপ।’
হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘কংগ্রেসি নেতাদের কাছে ক্রিপ্স্ কোনও প্রত্যাশাই জাগাতে পারেনি।’
বাবা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেন?’
হরিকিশোর বলেছিলেন, ‘ওঁরা এই প্রস্তাবকে যে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেননি তার কারণ ক্রিপসের প্রস্তাবটা ছিল ভাসা ভাসা।
‘না হরিকিশোর, যতটা ভাসা ভাসা ওঁরা বলে বেড়িয়েছে, ততটা ভাসা ভাসা ছিল না কিন্তু প্রস্তাবটা। আমি এ নিয়ে অনেক ভেবেছি সেই বিয়াল্লিশ সালে যুদ্ধ যখন ঘোরতর হয়ে উঠেছে। এবং ব্রিটেন ক্রমাগত হারছে, সেই সময়েই তো ক্রিস্ এসেছিলেন। দুটো ঠিক সমস্যা ক্রিাের সামনে ছিল। একটা সমস্যা ছিল এই যে, এই যুদ্ধে মিত্র শক্তিকে জিততে হবে। এর জন্য ভারতের জনবল আর মনোবল, এ দুটোকেই আনতে হবে মিত্রশক্তির পক্ষে। আর দ্বিতীয় সমস্যা ছিল, যাতে রক্তপাত না ঘটিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটেনের হাত থেকে ভারতের তুলে দেওয়া যায়। এই প্রেক্ষিতে যদি ক্রিস প্রস্তাবকে অতটা ভাসা ভাসা লাগবে ন হরিকিশোর। আর যেখানে সমস্যার আকারটা প্রচণ্ড রকম বড়, সেখানে ভাসা ভাসা প্রস্তাবই তো সকলের পক্ষে ভাল। কারণ সবাই মিলে সেটাকে পরিষ্কার করে ফুটিয়ে তোলা যেত।’
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘একটা কথা গ্রাম দেশে চালু আছে, গাছে না উঠতেই এক কাঁদি। আমাদের নেতাদের এই স্বভাবটা কোনও সমাধানে কোথাও আমাদের পৌঁছে দিতে পারেনি।’
বাবা বলেছিলেন, ক্রিসের ঘোষণা ছিল : (১) যুদ্ধের পরেই ভারতকে স্বশাসনাধিকার দেওয়া হবে, (২) নব নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনপরিষদ গণপরিষদ নির্বাচন করবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য, (৩) রাজন্যবর্গ এখানে প্রতিনিধি পাঠাতে পারবেন, (৪) ভারত কমনওয়েলথে থাকতেও পারে, নাও পারে কিন্তু (৫) ব্রিটেনের স্বার্থ দায়িত্ব ইত্যাদির জন্য তাকে এক সন্ধি করতে হবে, (৬) অন্তবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বসাপেক্ষে ভারতীয় দলগুলি যাতে একজিকিউটিভ কাউন্সিলে আসতে পারে তার জন্য আলোচনা হবে, (৭) যদি কিছু প্রদেশ নতুন শাসনতন্ত্র মেনে না নেয় তবে তারা বর্তমান অবস্থায় থাকতে পারে। পরে তারা ইচ্ছে করলে ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারে, না হলে তাদের ভারতীয় ইউনিয়নের সমমর্যাদাসম্পন্ন শাসনতন্ত্র দেওয়া হবে। এই ছিল ক্রিস প্রস্তাবের মোদ্দা কথা এটাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা সদর্থক পদক্ষেপ বলে কি গ্রহণ করা যেত না?’
তায়েরকাকা বলেছিলেন, ‘তোর বাবাকে আমি এ কথা বলেছিলাম, সুধাকর, সেটা নির্ভর করে কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার জন্য তুমি তোমার পা বাড়াতে চাইছ তার উপর। দেখ সুধাকর, বাঁশ কেটে তুমি বাঁশিও বানাতে পারো, আবার তীর ধনুকও বানাতে পারো। কি বানাবে তুমি তার উপরই তো সব নির্ভর করছে, তাই না? ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, এবং আমি আমার কোলেই যতটা পারি ঝোল টানব, এটা যদি তোমার মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বলতেই হবে ক্রিপ্প্স্ প্রস্তাব তোমার কাছে অকিঞ্চিৎকর ঠেকবে। কিন্তু হিন্দু মুসলমানকে ঐক্যের মধ্যে বেঁধে নিয়ে তুমি ভারতের স্বশাসনের অধিকর অর্জন করবে, এই যদি তোমার মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তবে ক্রিস্ প্রস্তাব যে একটা সদর্থক পদক্ষেপ ছিল, সেটা স্বীকার করে নিতেই হবে। ক্রিস্ প্রস্তাব ভাসা ভাসা ছিল, তাই ক্রিস্ প্রস্তাব দীর্ঘ আলোচনার ভিত্তি হতে পারত।’
‘বিয়াল্লিশ সালের মার্চ মাসে দেশে এত ঘৃণা বিদ্বেষ ছিল না। ছিল না বললে হয়ত ভুল বলা হবে, কিন্তু সেটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। ক্রিকে গান্ধী ব্যক্তিগত ভাবে চিনতেন। যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্রিটিশ ভারতের বন্ধু ছিলেন, ক্রিস্ ছিলেন তাঁদের একজন। গান্ধীও ক্রিপসের সদিচ্ছাকে ভুল বুঝেছিলেন। এই গান্ধীর মুখেই তো আমরা কতবার শুনেছি, ইংরাজের সঙ্গে তাঁর কোনও বিরোধ নেই, তাঁর বিরোধ ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে।
বাবা বলতেন, ‘আমি গান্ধীকে বুঝে উঠতে পারিনে। ক্রিপসের প্রস্তাব গান্ধীকে সন্তুষ্ট করেনি। তাকে বরং ক্রুদ্ধই করে তুলেছিল। এবং গান্ধীর জবাব এল রুদ্র মূর্তি ধরে। গান্ধী বললেন, তোমরা ভারত ছাড়। আমাদের ঈশ্বর কিংবা অরাজকতার উপর ছেড়ে দিয়ে যাও। এ কথা কে বলতে পারে? একজন অতিশয় সাধারণ লোক। জাতির পিতা কি এই কথা বলতে পারেন? গান্ধীর মতো লোকের কি এই কথা বলা সাজে? গান্ধী এনার্কি কথাটা কেন ব্যবহার করেছিলেন – তখন? অরাজকতার হাতে, বিশৃঙ্খলার হাতে আমাদের ছেড়ে দিয়ে যাও! গান্ধী বলেছিলেন এ কথা হরিকিশোর! গান্ধী ছিলেন সত্যের সাধক। ঝোঁকের মাথায় কথা বলা তাঁর ধাতে ছিল না। তাই গান্ধী যখন বলেন, আমাদের ছেড়ে দিয়ে যাও ঈশ্বরের হাতে অথবা অরাজকতার হাতে, তখন উনি ঝোঁকের মাথায় এ কথা বলেছেন, আমি এ কথা মেনে নিতে পারিনে। এ তো একজন ডেস্পারেট লোকের কথা। ঈশ্বরের হাতে আমাদের ছেড়ে দিয়ে যাও, তবু এ কথার একটা অর্থ আমি করে নিতে পারি। কিন্তু অরাজকতার হাতে আমাদের ছেড়ে দিয়ে যাও, কিন্তু তোমরা ভারত ছাড়। আমি কোনও দিক থেকেই এই কথাটাকে মেলাতে পারিনে।’