৩০
বেহুলার ভেলা! তখন ফুলাক বেহুলার ভেলায় ভেসে চলেছিল। বেহুলা কি জানত, কোথায় গিয়ে পৌঁছুবে লখিন্দরকে কোলে নিয়ে ভেলায় ভেসে? আহা মৃত লখিন্দর! সেই ভেলায় শুধু মৃত পতিই সঙ্গী ছিল না বেহুলার। তার সঙ্গে ছিল, তার সঙ্গী ছিল নিঃস্বতা, নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ। স্বর্গের পথে ভেলা ভাসিয়েছিল বেহুলা, স্বর্গের ঠিকানা কি বেহুলা জানত? না। বেহুলা তো একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল যে, তার কোলে যে স্বামী সে মৃত। কিন্তু যে প্রেম বুকে ধরে বেহুলার ভেলায় উঠেছিল ফুলকি, সে তো তখন বুঝতে পারছিল না, তাদের সেই ভালবাসা জীবিত আছে কি নেই? এটা এক নিদারুণ অনিশ্চয়তা। আর এই অনিশ্চয়তাই মনে জন্ম দেয় নানা উপসর্গের। এটা এক নিদারুণ অনিশ্চয়তা। আর এই অনিশ্চয়তাই থেকে আসে আশঙ্কা। আশঙ্কা থেকে আসে হতাশা। হতাশা থেকে আসে অভিমান। অপমানবোধ। আসে তীব্র ব্যর্থতাবোধ। আসে ঈর্ষা। আসে আক্রোশ। আসে ঘৃণা। এই সব নিয়েই সাজানো ছিল ফুলকির বেহুলার ভেলা। বুড়ি, তোমার ভেলায় এই রিপুগুলো ছিল না তো। নিশ্চয়ই ছিল না। না তা হলে তুমি তোমার ভেইয়াকে পেতে না। তোমার ভেইয়া ছিল তোমার ভালবাসার সোনালি ফসল। না বুড়ি, তুমি অস্বীকার করতে পার না যে, তোমার সঙ্গে তোমার ভেইয়ার যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার রঙ যাই থাক, সেটার ভিত্তি ছিল অকৃত্রিম ভালবাসা। সেখানে পাবার কোনও প্রশ্ন নেই, প্রতিদানের প্রশ্ন নেই, কেবল দিয়েই তোমার আনন্দ। আমার জেঠামণির পক্ষে এই সব সম্পর্কের রূপ বুঝতে পারা খুব শক্ত। কারণ তুমি এমন পুরুষ খুব কমই পাবে, যেমন তুমি তোমার ভেইয়াকে পেয়েছিলে, যে এই বিলিয়ে দেবার আনন্দকে বুঝতে পারবে।
শামিমের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা যখন শুরু হয়, তখন প্রথম দিকে ব্যাপারটা এই রকমই ছিল। শামিমকে নিয়ে আমার কোনও উদ্বেগ ছিল না, কোনও অস্বস্তি ছিল না। কোনও অশান্তি ছিল না মনে। আমার মনের উন্মেষ শামিমই তো ঘটালো। সেই প্রেম ছিল দেবতার প্রসন্নতা। বুড়ি, তুমি দেবতা টেবতা তো মানো না। বলতে পারো, আর কিভাবে তোমাকে বোঝাব, আমার সেদিনের অনুভূতি, ‘দেবতার প্রসন্নতা’ ছাড়া। দেবতার প্রসন্নতা কথাটার মানে আমি জানিনে বুড়ি। কারণ দেবতা বা ঈশ্বরে আমার বিশ্বাসও নড়ে গিয়েছে। কিন্তু ‘ভাগ্যদেবী’ ‘দেবতার প্রসন্নতা’ ‘প্রভু’ ছাড়া অসহায়ত্বকে আর কিভাবেই বা প্রকাশ করা যায়। অমিতা এই কথাগুলো বলত টলত না। ফুলকি তার যন্ত্রণার দিনে অনেকবারই ‘প্রভুর’ শরণাপন্ন হয়েছে। তার খাতায় তার ডায়েরিতে বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যাবে। ফুলকির সেইদিনের সেই উদ্ভ্রান্ত মনকে বুঝতে এ সবই আমাদের সাহায্য করবে বুড়ি।
ফুলকি শুরুর দিনগুলো কিভাবে বোঝাবে? সে কি নিজেও বুঝতে পেরেছিল সে সময়? কেউ কি বুঝতে পারে, কার মনে প্রেম কিভাবে আসে? তবে ফুলকি এইটুকু জানে শামিমের প্রতি তার প্রেম এসেছিল গোপন পদসঞ্চারে। ফুলকি যে মুহূর্তে দিদিকে বলেছিল, দিদি খুব মিস করলি। দিদি জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কি আবার মিস করলাম?’ ফুলকি বলেছিল, একটা আস্ত লজ্জাবতী লতা। এই পরিহাসটুকুর ফাঁক দিয়েই শামিম তার মনের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল সেদিন। ফুলকি বুঝতে পারেনি। ওই পরিহাসটুকুর ছিদ্র দিয়েই ভালবাসার অদৃশ্য একটা বীজ ফুলকির মনে গভীরে ঢুকে গিয়েছিল, ফুলকি টের পায়নি একটুকুও। তার মনের জমিনে সেই বীজটা অঙ্কুরিত হতে বেশ কিছু সময় নিয়েছে। সেই সময়টায় ফুলকির জীবনের সব চাইতে ভাল সময়। কোনও উদ্বেগ ছিল না। তখন। শামিমের সঙ্গসুখটাই প্রধান ছিল। আহ্ শামিম, তুমি তখন যখন বাবার কাছে আসতে ফুলকির বিশেষ কিছু মনে হত না। সে তখন ফাইফরমায়েস খাটতে বাবার বৈঠকখানায় তোমাদের আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়ত। ‘বাতাসিয়াকে বল ফুলকি, কিছু ভেজে টেজে দিক আমাদের। খালি পেটে কথা জমে না।
এই সময় ফুলকি হঠাৎ রান্নাবান্নায় মনোযোগী হয়ে পড়েছিল দেখে বাতাসিয়া খুব মজা পাচ্ছিল। ফুলকি রান্নাঘরকে চিরকালই এড়িয়ে চলেছে। ওর মার কাছে রান্না করাটাই ছিল জীবনের প্রধান কাজ। মা ম্যাট্রিক পাস করেছিল। সেও ওই বুড়ির তাড়না। মা বলতেন, ‘এমন শাশুড়ি দেখিনি। মা আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কত যত্নই না নিয়েছে। তোর দিদি হবার আগে আমাকে তো কুটোটি নাড়তে দেননি। বড় জায়ের ব্যাপারেও তাই। বলতেন, যে সংসারে মুখ্যু মেয়েমানুষ থাকে, সে সংসারে ভাষ্যি থাকে না। তা কি হল দেখ, দিদি তো ক্রমেই আচারি বিচারি হয়ে পড়লেন। আর আমি হয়ে উঠলাম পাকা রাঁধুনি।’ বুড়ির দুঃখ ছিল মনে যে, তার বউয়েরা কাজের কাজ না করে শুধু তামসিকতায় মন ঢেলে দিল। বুড়ি চেয়েছিল, বইপত্তর পড়ে বাইরের জগতের খবরাখবর নিয়ে তার বউয়েরা তাদের চিত্তটাকে মেলে ধরতে শিখুক।
বুড়ির নাতনিরা যে ঘরকন্নার কাজে ভিড়ত না, এতে বুড়ি খুশিই ছিল। ‘ও সবের মতো সোজা কাজ আর নেই, বউমা। ও সব শেখবার জন্য ওদের সময় যত কম নষ্ট করাবে তত ভাল।’ বুড়ির নাতনিরা তাই কখনও হেঁশেলে ঢোকেনি। হয়তো সেই কারণেই বাতাসিয়াকে সে সেদিন যখন বলেছিল, যে জিনিসগুলো ভাজছিস, সেগুলো আমাকে একটু দেখিয়ে দিবি কি করে করতে হয়, তখন বাতাসিয়া ঠিক সে কথা শুনতে পেয়েছিল কি না তার মুখ দেখে সেটা বোঝা যায়নি। তাই আবার ফুলকি বলেছিল, এই বাতাসিয়া, আমাকে একটু দেখিয়ে দিবি কি ভাজছিস? কেমন করে ভাজছিস? আমার ইচ্ছে করছে বাবাকে একটু চমকে দিই। ‘বাবাকে একটু চমকে দিই’, এই কথাটা ছলনা বলে কেউ ধরে নিতে পারে, আসলে তা ছলনা ছিল না। বাবাকে নিজের হাতের তৈরি কিছু খাবার খাওয়াতে ইচ্ছেই করেছিল ফুলকির। তবে এতদিন বাদে ওই সদিচ্ছাটা ফুলকির মনে জেগে উঠেছিল কেন, সেটা বলা মুশকিল। বাবার বৈঠকখানায় বাবার আর যে সব বন্ধুরা এসে থাকেন তাঁরাই এসেছিলেন। একটিই শুধু সংযোজন ছিল, সে শামিম। কিন্তু শামিমকে নিজের হাতের তৈরি করা খাবার খাওয়াবার কথা তার তখন মনেই হয়নি। বাবার কথাই মনে হয়েছিল। তার মনের চেতনে তখন বাবা, বাবাই, যেমন তিনি আগেও ছিলেন, কিন্তু তার মনের সঙ্গোপনে তখন শামিম বিরাজ করছিল, ফুলকি তা জানতে পারেনি। এইভাবেই হয়।
৩ আগস্ট ১৯৪৫
‘আজ ঘুম থেকে উঠেই মনে জেগে উঠছে একটা সিরসিরে ভাব। এটাই কি আনন্দের অনুভুতি? আজ সব কিছুকে ভাল লাগছে। সবাইকে ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে বিশ্ব যেন আমার আপন জনে ভরে আছে। সববাই চেয়ে আছে আমার দিকে স্নেহভরে এমন কি এই যে গাছটা আজকের পশলা পশলা বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে সারাক্ষণ সেও যেন আমাকে তার প্রসন্ন স্নেহ দিতে চাইছে। মনে গুনগুনিয়ে উঠছে একটা জিপসি টিউন, লোবো যার গতটা আমার ভায়োলিনে তুলিয়ে দিয়েছিলেন। সুরটা আমাকে যেন হেলিয়ে দিচ্ছে, দুলিয়ে দিচ্ছে, নাচিয়ে দিচ্ছে, ভাসিয়ে নিচ্ছে। আজ আমার মনে আনন্দ রাখার আর জায়গা নেই। অনেকদিন পরে ভায়োলিনটা পেড়ে জিপসি গতটা বাজাতে শুরু করলাম। চোখ দিয়ে অশ্রুর বান নামল। কি শান্তি!’
অমিতা বলল, এইটেই ছিল ফুলকির ডায়েরিতে প্রথম লেখা। তার ভালবাসার প্রথম আভাস। ভালাবাসা কি সকলের কাছেই এমন করে আসে? ফুলকি তখনও বেহুলার ভেলায় চড়েনি। তখনও তার মনে সুখের অনুভূতি ছিল, ছিল একটা নিরাপত্তাবোধ। ছিল একটা বলিষ্ঠ প্রত্যয়। প্রতি অঙ্গ তার কাঁদত শামিমের প্রতি অঙ্গের জন্য। শামিম, তুমিও তখন ফুলকির সান্নিধ্যে কী আনন্দেই না ভাসতে! মনে পড়ে তোমার, তুমি যেদিন ফুলকিকে ইডেন গার্ডেনে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলে! মনে পড়ে? সেই ইডেন গার্ডেনকে আজ দেখলে তুমি চিনতে পারবে না। ইডেন’ এখন ক্যান্সারে ভুগছে। কিন্তু সেদিন ইডেন ইডেনই ছিল। সেই বিকালটার কথা কি তোমার মনে আছে শামিম? একটা হালকা মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে সূর্যদেব তখন পাটে নামছিলেন। গঙ্গার ওপারে। বিচিত্র আলো ছড়িয়ে পড়েছিল ইডেনে। ‘সূর্য তখন পাটে নামে, রাজার কুমার ভাবছে একা, স্বপনপুরীর রাজকন্যে এমন সময় দিলেন দেখা।’ হঠাৎ তুমি ভরাট গলায় সায়গলের গাওয়া এই গানের এই কলিটা গেে চুপ করে গেলে।
ফুলকি বলেছিল, কি হল, থেমে গেলে যে?
তুমি বলেছিলে, ‘স্বপনপুরীর রাজকন্যে দেখা দিলেন যে।’
তারপরে তোমরা দুজন একটা বেঞ্চে গিয়ে চুপ করে বসে রইলে। প্যাগোডার কাছে বসে বসে একটা অন্ধ দরিদ্র ফিরিঙ্গি সাহেব মাথার টুপিটা সামনে পেতে রেখে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে যাচ্ছিল। জলদ গম্ভীর স্বরে ভোঁ বাজিয়ে একটা বড় জাহাজ মন্থর গতিতে গঙ্গার জল কেটে কেটে চলে যাচ্ছিল। কয়েকটা পায়রা উড়ে এসে বসছিল, আবার উড়ে যাচ্ছিল। তুমি কি তখন নীল স্বপ্নে অবগাহন করেছিলে শামিম? দুটো সত্তা পাশাপাশি বসে আছে একই বেঞ্চিতে। স্রেফ বসেছিলে তোমরা শামিম। কেউ কাউকে স্পর্শও করনি। তবে অত সুখ কি করে এল তোমাদের মনে? অত স্বপ্ন কি করে এল তোমাদের দুজনেরই চোখ ভরে? তোমরা একদিন ব্যান্ডেল চার্চে গিয়েছিল শামিম।
ব্যান্ডেল চার্চকে খুব ভাল লেগেছিল ফুলকির। এমন শান্ত এবং গম্ভীর পরিবেশ যে, ওই ভূমিতে পা দিলেই মনে হয়, কোনও একটা আশ্রয়ে এসে পৌঁছুলাম। দুপুর নাগাদ পৌঁছেছিলাম আমরা। সেদিন এমনিতে ভিড় বেশি ছিল না। চায়ের দোকানি বলেছিল, এইটেই বেশ নিরিবিলি সময়। এখন লোক বেশি আসে না। ভিড় হয় শীতকালে। বিকাল পর্যন্ত তোমরা চার্চের মধ্যে কাটালে। কবে যেন জাহাজ ডুবি হয়েছিল গঙ্গায়। কয়েকজন ভক্ত জাহাজের মাস্তুল আঁকড়ে ভেসে এসেছিলেন ব্যান্ডেলের এই জায়গায়। সেই মিরাকলের স্মারক হিসাবে মাস্তুলটা পোঁতা আছে চার্চের মধ্যে। কয়েকজন আমেরিকার সৈনিক, কালো, ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছিল। মেঘলা রোদ। গুমোট ছিল সেদিন। বৃষ্টি পড়েনি। তোমাদের আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির আন্দোলন প্রথম পর্যায়ে শেষ হয়েছিল। সেই আন্দোলনে তুমি এমন ভূমিকা নিয়েছিল শামিম, আমার মনে হয়েছিল, বুঝি তোমাকে আর ফিরেই পাব না। মনে হচ্ছিল, তুমি কেবল সরে যাচ্ছ শামিম, আমার কাছ থেকে কেবলই সরে যাচ্ছ। কী যন্ত্রণাই না পাচ্ছিলাম তখন। তুমি তখন একেবারে একটা রাজনৈতিক মানুষে পরিণত হয়েছিলে। তোমার সত্তাকে রাজনীতি গ্রাস করেছিল। ব্যান্ডেল চার্চ আমার সেই মানুষ শামিমকে—ভালবাসার শামিমকেই ফিরিয়ে দিয়েইছল। অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল। মিরাল। একেই তো মির্যাক্ল বলে। না কি?
আমাকে ঘন ঘন সেই মাস্তুলটার দিকে নজর দিতে দেখে তুমি বলেছিলে, ‘কি অত দেখছ ফুলকি? ওই মাস্তুলটায় কি এমন দেখার আছে?’
আমি বলেছিলাম শামিম, মিরাল।
তুমি বলেছিলে, ‘তুমি মির্যাকূলে বিশ্বাস কর ফুলকি?’
আমি বলেছিলাম, করলে ক্ষতি কি শামিম?
তুমি আমার মুখের দিকে শুধু চেয়েছিলে।
আমি বলেছিলাম, তুমি ভালবাসায় বিশ্বাস কর শামিম? আমাদের ভালবাসায়?
তুমি বলেছিলে, ‘করি ফুলকি, করি। এই বিশ্বাস নিয়েই তো আমি চলেছি।’
আমি হেসে বলেছিলাম, অনেকদিন পরে আমি মন হাল্কা করা হাসি হাসতে পেরেছিলাম সেই ব্যান্ডেল চার্চের উদার প্রাঙ্গণে বসে, বলেছিলাম, এটা যদি মিরাল না হয় শামিম, তবে মিরা কি?
তুমি খুব খুশি হয়েছিলে, সেটা তোমার মুখ দেখেই আমি তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলেছিলাম। মনে পড়ে শামিম? তুমি উঠে গিয়ে কোথা থেকে অনেক চিনেবাদাম ভাজা কিনে নিয়ে এলে। আর সেগুলো আমার কোঁচড়ের উপর ঢেলে দিলে। আমরা একই জায়গা থেকে বাদাম তুলে তুলে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে খেতে থাকলাম। আবার এরই রকমফের ঘটল। প্রথমে আমি আমার বাদাম খোলা ভেঙে মুখে পুরছিলাম, শামিম আমার কোঁচড় থেকে একটা একটা করে বাদাম তুলে নিচ্ছিল, আর সেটা ভেঙে ভেঙে টুকটুক করে খাচ্ছিল। রোদের তেজ তখন কমে এসেছে, কারণ তখন একটা ভারী মেঘ সূর্যকে ঢেকে রেখেছিল। হঠাৎ ঠাণ্ডা বাতাস ছাড়ল। গঙ্গায় পাল তুলে নৌকো যাচ্ছে। কোনোটার পাল হলদে, কোনও পালটা সাদা, কোনও পাল নীল, কোনও কোনওটা গেরুয়া রঙের.।
শামিম বলল, ‘বল তো এখন বৃষ্টি হবে কিনা?
আমি আকাশের দিকে না তাকিয়েই বললাম, না, হবে না।
শামিম বলল, ‘কেন হবে না? আকাশে যেমন মেঘ, এতে বৃষ্টি হবারই কথা।’
আমি যেন আকাশটাকে পড়তে পারি তেমনি করেই বললাম, এ মেঘে বৃষ্টি হবে না, আমি সে কথা বলিনি। অন্যদিন হতেও পারে। তবে আজ যে হবে না সেটা আমি জানি।
শামিম গোটা দুই বাদাম একসাথে ছাড়িয়ে বলল, ‘কি করে জানলে?’
আমি অম্লানবদনে বললাম, ‘আজ মির্যা হবে।’
শামিম হাসতে হাসতে ছাড়ানো বাদাম দুটো আমার মুখে টুপ করে ভরে দিয়ে বলল, ‘পুরস্কার।’
আমার মন কানায় কানায় ভরে উঠেছে। আমি আসলে ওই পালতোলা নৌকোর মতোই তখন ভাসতে লেগেছিলাম, সূক্ষ্ম আবেগের স্রোতে। নিশ্চিন্ত কি নিশ্চিন্ত আমি। আমার শামিম আমারই আছে। আমার অতি কাছেই আছে। দূরে চলে যায়নি। বৃথা যন্ত্রণায় দিনগুলো কাটিয়েছি। কত সন্দেহ, কত অবিশ্বাস এসে আমাকে ঘিরে ধরেছিল। কোনও দরকার ছিল না। কোনও দরকার ছিল না।
কিন্তু তুমি কি সেই জ্বালা যন্ত্রণাকে তো এড়িয়ে যেতে পারনি ফুলকি। অমিতা বলল। তুমি লিখেছিলে, তুমিই লিখেছিলে, ‘আবার সেই—আর নয় আর নয়—’ তুমিই লিখেছিলে,
‘ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশন
এ খেলা খেলাবে আর কতক্ষণ
হে ভগবন্।
শেষ যাহা হবেই হবে তারে
সহজে হতে দাও শেষ।
সুন্দর রেখে যাক স্বপ্নের রেশ।’
এ তোমারই লেখা ফুলকি। তোমারই তো? কিন্তু তখন, সেই ব্যান্ডেল চার্চের সামনে মাঠে যখন ছিল ফুলকি, জ্বালা যন্ত্রণা উদ্বেগ অবিশ্বাস আক্রোশ কিছুই ছিল না তার মনে। ফুলকি যে এই মুহূর্তে জন্ম নিল, এমন তরতাজা নির্ভার তার মন।
ফুলকি একটা বাদাম ছাড়িয়ে শামিমের মুখে দানা তিনটে আলগোছে ছেড়ে দিতে গেল। কিন্তু শামিম তার দুটো ঠোঁট দিয়ে ফুলকির আঙ্গুলের ডগায় আলতো একটা চাপ দিল। আর সেই স্পর্শেই ফুলকির শরীরে কামনার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। মুখে কোনও ভাব ফুটল না ফুলকির। কিন্তু মনে মনে কাতর কণ্ঠে ডেকে চলল, শামিম শামিম শামিম।
শামিম বলে উঠল, ‘আচ্ছা, বল তো ক্যাপ্টেন রশিদ আলিকেও আমরা মুক্ত করতে পারব কি না?’
শামিম ফুলকির গালের ভিতর রাদামের কয়েকটা দানা ছেড়ে দিল।
আগুন আগুন শামিম! অসহ্য! ফুলকি মনে মনে ভয়ানকভাবে কাতরাতে লাগল।
‘এই আন্দোলনেও সব দলে ছাত্র ঐক্যবদ্ধ থাকবে। মিছিলে থাকবে শুধু দুটো পার্টির পতাকা। ভারতের দুই প্রধান রাজনেতিক দলের প্রতীক। সংগ্রেস আর মুসলিম লিগ, এরাই নেতৃত্ব দেবে ফুলকি।’
ফুলকি শান্তভাবে বলল, পতাকা এক করে কি হবে? পতাকা আজ এক হবে, কাল আবার দুই হয়ে যাবে। দুই জায়গায় উড়বে। মনটাকে কি মেলাতে পেরেছ? বুড়িই যেন কথা বলে উঠল।
‘পেরেছি বইকি ফুলকি?’ শামিম আবার ফুলকির মুখে বাদামের দানা পুরে দিল।
এই স্পর্শগুলো মারাত্মক। শামিম যখন কাছে থাকে তখন এই স্পর্শগুলো তাকে যন্ত্রণায় অস্থির করে ফেলে। আবার শামিম যখন দূরে থাকে, যখন তার দীর্ঘ অনুপস্থিতি ফুলকিকে প্রায় বিশ্বাস করিয়ে ছাড়ে যে, শামিম বলে কোনও অস্তিত্বই বোধ হয় নেই, তখন এই ছোঁয়াছুঁয়ির স্মৃতিগুলো কেবলই তাকে পাগল করে তোলে কেবলই পাগল করে তোলে।
মনটাকে মেলাতে তোমরা পারনি শামিম। মনের মিল ঘটাতে হয় প্রেম দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে। উন্মাদনা দিয়ে আক্রোশ দিয়ে, ঘৃণা ছড়িয়ে তোমরা কখনই মনের মিল ঘটাতে পারবে না। অমিতা বলল, আমি জানি আমি জানি আমি জানি শামিম।
ফুলকি উপরে শান্ত ছিল। কারও পক্ষে ধারণা করা সম্ভবই ছিল না যে, যে মেয়েটি চুপ করে বসে বসে একমনে গঙ্গা দিয়ে যাওয়া পালতোলা নৌকোগুলোকে দেখে যাচ্ছে, তারই মন তখন কামনার দাউ দাউ তাড়সে অস্থির অস্থির অস্থির।
‘শামিম ভাই, শামিম ভাই। চাচী এসেছে, রেশমা আপা এসেছে। তুমি এদিকে এসো।’
শামিম ছেলেটাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল। তারপর হাতের বাদামগুলো ফুলকির কোঁচড়ের উপর ফেলে রেখে উঠে চলে গেল। ফুলকি অন্যমনস্ক ছিল। শামিমের যাওয়া সে লক্ষ করল না তেমনভাবে। আজ তার কাছে শামিম আছে। সে একটা শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ তার পায়ের নিচের মাটিকে এতটাই শক্ত লাগছে তার’ যে, তার মনে হতে লাগল আস্থাটাকে সে যেন নতুন করে ফিরে পেয়েছে।
ফুলকি দেখছে গঙ্গার উপর একটার পর একটা নৌকো পাল তুলে ভেসে চলেছে।
শামিম দূরে দুজন বোরখা পরা মহিলার সঙ্গে কথা কইছে। আকাশে একটা শকুন ডানা মেলে ভেসে গেল। ফুলকি একটার পর একটা বাদাম কোঁচড় থেকে তুলে নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে মুখে পুরছে। একটা গাঙচিল ঠোঁটে করে একটা মাছ ধরে এসে ডালে বসল। একটা শামুক চলেছে! একেবারে পরিপূর্ণ শান্তিরই এক বাতাবরণ। শুধু যদি থেকে থেকে শরীরটা কামনার কামড়ে বিপর্যস্ত না হত! একটা অসহ্য জ্বালা তার নাভিমূল থেকে দাউ দাউ করে উঠে আসছে। না নাভিমূল থেকে নয়, জঙ্ঘার সন্ধিস্থল থেকেও বুঝি বা। অস্থির করে তুলছে ফুলকিকে। এই সময় যে স্মৃতিগুলো তার মনে আসতে থাকে ছায়াছবির মতো, সেগুলো ফুলকিকে আরও উতলা করে তোলে। আরও অস্থির। ফুলকি আশ্চর্য হয়ে দেখতে লাগল, আজ তার স্মৃতিগুলো নৌকার পালে যেন ছবি হয়ে ফুটতে লাগল।
প্রথম পালে শামিম তাকে আদর করছে। শামিমের কামার্ত হাত ফুলকির শরীরটায় ক্ষ্যাপার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফুলকি অস্থির।
ফুলকি বিপন্ন হয়ে শামিমের দিকে চাইল। শামিম বোরখা পরা মহিলাদের সঙ্গে কথা বলছে, তার থেকে অনেক দূরে। না শামিম দূরে নেই। শামিম আমার কাছে। আমার বুকের উপর। শামিম এখন নৌকার পালে। ফুলকি অস্থির অস্থির।
অমিতা দেখলু শামিম মহিলা দুজনকে নিয়ে চার্চের গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ফুলকি দেখছে, শামিম আর সে এখন নৌকার পালে। গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ তারা। চুম্বনে চুম্বনে অস্থির করে দিচ্ছে শামিম। আহ্ শামিম আহ্ শামিম!
অমিতার মনে হল শামিম উত্তেজিত হয়ে বোরখা পরা বড় মহিলাটির সঙ্গে যেন তর্ক করছে। আর একটি মহিলা হঠাৎ বোরখা থেকে মুখটা খুলে অবাক হয়ে বিস্ময়ে ফুলকির দিকে চেয়ে অছে। ও মা, মহিলা কোথায়? এ তো এক বালিকা! ফুলকি দেখল তার নাকে একটা নোলক ঝুলছে। বিকালের কনে-দেখা আলোর ঝলক সেই মেয়েটির মুখের উপর পড়েছে। ফুলকিও সেই মুখটির পানে চেয়ে রইল।
ধীরে ধীরে কামনার জ্বরে ভাঁটা পড়তে লাগল ফুলকির। শান্ত হতে লাগল সে। ক্রমে সে সুস্থির হল। শামিম শামিম আমার শামিম।
শামিম যেন বিপর্যস্ত হয়ে ফিরে এল। ওর করুণ অবসন্ন বিপন্ন মুখটা দেখে ফুলকির আদর করতে ইচ্ছে জাগল। শামিম শামিম! কি হয়েছে তোমার?
৩১
কি হয়েছে শামিম, কি হয়েছে?
শামিম বিষণ্ণ। শামিম অবসন্ন। শামিম চুপ করে যেন ভাবছে।
শামিম তার পাশে। শামিম তার কাছে। ফুলকি তেমন কোনও উদ্বেগ বোধ করল না। সে চেয়ে রইল দূরে, প্রগাঢ় এক শান্তি তার মনে। দূরে নৌকোর পর নৌকো ভেসে চলেছে পাল তুলে। না, সেই পালে এখন কোনও ছবি ফুটে উঠছে না। ফুলকির মনে এখন কোনও কিছুরই আক্রমণ নেই।
‘মেয়েটিকে দেখলে ফুলকি?’ শামিম যেন দূরে, অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, এই প্রশ্নটা করল।
ফুলকি তখন দু পায়ে শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। শামিম তার কাছে। সে এই শক্ত মাটি থেকে যেন নড়তেই চাইছে না। সে তখন দেখছে একটা শকুন বিরাট ডানা মেলে চক্রাকারে উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের মাথার উপর।
‘মেয়েটিকে দেখলে ফুলকি?’
শামুকটা বেশ দূরে চলে গিয়েছে তখন। তবু তাকে দেখা যাচ্ছে। পথের একটা আঠালো দাগ রেখে গেছে শামুকটা। রোদ পড়ে তার পিঠটা চকচক করছে। ফুলকি তখন তার চারপাশের সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত। শকুনের ছায়াটা মাঝে মাঝে ফুলকির গায়ের উপর দিয়ে আলতোভাবে পিছনে চলে যাচ্ছে।
যে মেয়েটা বোরখার ঢাকনা খুলে আমাকে দেখছিল?
একটা গরু দূর থেকে ডেকে উঠল হা ম্ বা।
‘ও রেশমা।’
একটা বাছুর তার মায়ের দিকে লেজ তুলে ছুটতে ছুটতে আসছে।
‘আর বড় জন আমার খালা। খালা কাকে বলে বোঝ ফুলকি?
শামিম আর ফুলকি দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। শামিম বিষণ্ণ।
রেশমা আমার খালাত বোন।’
‘নৈহাটি, কর্তা নৈহাটি। এখন ভাটা আছে। বাতাস আছে। তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাবেন।’
দেখতে দেখতে ওরা মাঝ গঙ্গায় এসে পড়ল। ঢেউয়ের হঠাৎ দুলকিতে টলে উঠেছিল ফুলকি। ধপাস করে সে পাটাতনে বসে পড়ল। ফুলকির কোনও ভয় ডর হল না তো?
একটা শঙ্খচিলের দেখা পেল ফুলকি। ডানা দুটো কেমন স্থির হয়ে মেলে আছে। সুন্দরভাবে একটার পর একটা পাক খেয়ে চিলটা যেন ফুলকিকেই সঙ্গ দিতে কিছুক্ষণ উড়তে লাগল।
শামিম বলল, ‘ওই দেখ ফুলকি পাটকল
‘গরফের মিল কর্তা। কত তাড়াতাড়ি গরফে এসে পড়লাম দেখেছেন।
উপর দিয়ে রেলপুল বেরিয়ে গেল। ফুলকি নিচু থেকে পুল এই প্রথম দেখল। একটা মালগাড়ি গম গম গম গম করতে করতে গঙ্গা পার হচ্ছে। ফুলকির ভয় হল না তো?
‘আমার খালু জুট ব্রোকার সাহেবের আফিসে ভাল কাজ করেন।’
আকাশে মেঘ ভেসে যাচ্ছে। ভাসুক। আজ বৃষ্টি হবে না।
‘রেশমাকে দেখলে, তারই বাবা।’
আজ কিছুতেই বৃষ্টি হবে না। মির্যা ঘটবে।
‘রেশমার বাবার আমার খালু।’
‘আর রেশমা তোমার খালুই। তাই তো?’
শামিম বিপন্ন ভাবে প্রত্যেকটি কথা উচ্চারণ করছে। হঠাৎ ফুলকি সচকিত হল। কি হয়েছে শামিমের? সে কেন এত বিষণ্ণ, সে কেন এত অবসন্ন হয়ে পড়ল।
শামিম ফুলকির দিকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তার মানে?’
ফুলকি বলল, প্রথমে খালা তারপরে খালু। এরপরে তো খালুই-ই হওয়া উচিত। মাসতুতো বোনকে তোমরা কি বল শামিম?
অতি ধীরে ফুলকির কথার মানেটা শামিমের মাথায় ঢুকতে লাগল। প্রথম দিকে বোকা বোকা মুখ করে শামিম ফুলকির দিকে চেয়ে মানেটা বুঝতে চেষ্টা করলছিল। ক্রমেই তার মুখের ভাব বদলাতে লাগল। তারপর শামিম ‘খালুই’, কথাটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে হো হো করে হেসে উঠল। ‘খা লু ই—হা হা হা। খালুই!’
‘দেখে নেব ফুলকি কথাটা আমাদের ডিকশনারিতে আছে কি না? না থাকে ওটাকে ঢুকিয়ে দেব। আমার একটা কীর্তি থেকে যাবে। খালা খালুর মেয়ে ইজিকলটু খালুই।’
কীর্তি তোমার হবে কেন শামিম। হলে তো আমারই হওয়া উচিত। নয় কি?
‘তোমার কীর্তিই আমি আমার বলে চালিয়ে দেব ফুলকি। সেরেফ মেরে দেব, বুঝলে?’
এবার ওরা দুজনেই হাসতে লাগল।
‘রেশমার কথা শুনবে?’
কিন্তু তুমি সেদিন রেশমার সব কথা বলার ফুরসৎ পাওনি। অমিতা বলল।
‘রেশমার এখন বয়েস কত? আন্দাজ করতে পার ফুলকি?’
ওই নোলক পরা মেয়েটা শামিম? মেয়েটার মুখ কিন্তু খুব সুন্দর শামিম। আমি অত দূর থেকে দেখেছি তো? কিন্তু আমার চোখে মুখটা এখনও জ্বল জ্বল করছে?
‘কিন্তু ওর বয়েস কত? আন্দাজ করতে পার?’ শামিম অসহিষ্ণু হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
ওই রকম মুখ মোগল পেইন্টিং-এ দেখা যায় শামিম?
‘ওর বয়স এখন কত হতে পারে আন্দাজ করতে পার?
ফুলকি টের পাচ্ছে, শামিম ফুলকির কাছ থেকে ওর প্রশ্নের জবাব না পেয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ফুলকি বুঝতে পারছে, শামিম তার কাছ থেকে এই প্রশ্নটার একটা সরাসরি জবাব চাইছে। না পেয়ে একটু একটু করে রেগে যাচ্ছে। ফুলকির মজা লাগল। শামিম তার কাছে আছে, শামিম তার পাশে আছে। তার পায়ের নিচে আজ শক্ত মাটি।
কিন্তু তুমি যখন কাছে থাক না, পাশে থাক না, তখন ফুলকির পায়ের নিচে মাটি টলমল করে। একটা অনিশ্চয়তার বোধ আক্রমণ করে তখন। তুমি কি এটা বুঝতে পার শামিম? অমিতা বলে উঠল, যখন ফুলকি তোমাকে কাছে পেত না শামিম, আশেপাশে কোথাও পেত না, তখন কি করত ফুলকি?-তার দিনরাতগুলো কি ভাবে কাটত? প্রতিটি মুহূর্তকে মনে হত প্রতিটি দিন, প্রতি দিনকে মনে হত, এক একটা যুগ। প্রতিটি সপ্তাহ, প্রতিটি মাস, আহ্ আহ্ শামিম, সে তুমি বুঝবে না। বুঝবে না। বুঝবে না।
‘ফুলকি বলতে পারলে না তো শ্রীমতী, না শ্রীমতী নয়, কুমারী, না কুমারী নয়, আমাদের মোল্লারা ফতোয়া দিয়েছেন, আমাদের নামের সামনে পিছনে ভিতরে কোথাও হিদুয়ানির কোনও স্পর্শদোষ থাকবে না। আমরা তাহলে আর মুসলমান থাকতে পারব না। নামের আগে আমি যদি শ্রী লিখি, তবে সর্বনাশ, আমি হয়ে যাব কাফের। অতএব রেশমা বেগমকে আমাদের বলতে হবে মুসাম্মাত, চিঠি যদি লিখতে হয়, তবে হয় লিখতে হবে মুসাম্মাত রেশমা, অথবা রেশমা বেগম। মিস্ চলবে।’
ফুলকির এ সব শুনতে বেশ ভালই লাগছিল শামিম।
‘বুঝলে ফুলকি, মুসলমান হওয়া জগতের মধ্যে সব চাইতে সহজ কাজ। কোনও কমে তোমাকে যদি কলেমা পড়িয়ে দিই, ব্যাস, তাহলেই তুমি মুসলমান হয়ে গেলে। কিন্তু মুসলমানি বজায় রাখা .আজকাল বড়ই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফতোয়ার পর ফতোয়া আসছে এটা করা ধর্ম বিরুদ্ধ সেটা করা ইসলাম বিরুদ্ধ। ইসলাম বিপন্ন। মোদ্দা কথা ইসলাম যদি বাঁচাতে চাও তবে হে মোমিনগণ তোমরা যাহারা আল্লাহ্র পথে আছ, তোমরা যাহারা আল্লাহর মেহেরবাণী পাইতে ইচ্ছা কর, তাহারা মোল্লাদের জন্য রোজদিন আন্ডা পরোটার ব্যবস্থা রাখো। বিরিয়ানি-কোমার ব্যবস্থা রাখিতে পারো তো আরও ভাল। কেয়ামত তক সাপ্লাই দিয়া যাইতে পারিলে তোমার গুনাহ্ খাতার পাতা সাফ হইয়া যাইরে এবং তোমার পক্ষে গড়গড় করিয়া ছরাছর পুল-সেরাত পার হইয়া গিয়া বেহেস্তে পহুছান সম্ভব হইবে।’
সেদিন ফুলকিকে যে সব কথা বলছিলে শামিম, তা শুনে মনে হচ্ছিল তোমার মনের মেঘটা কেটে যাচ্ছে। ফুলকি সেটা বুঝতে পারছিল, তার মনে তোমার উপর নির্ভরতা একান্তভাবে বেড়ে গিয়েছিল। কী শান্তি! এ রকম শান্তি ফুলকি আজকাল কদাচ পায়। তুমি তোমার আন্দোলন নিয়ে কাজ নিয়ে মেতে আছ। ফুলকির কাছে আসবার সময়ই পাও না। চিঠিও লেখ না বিশেষ। ফুলকি কি করে? ফুলকি কি নিয়ে থাকে? ফুলকির মনে তখন একটা ইচ্ছাই উদগ্র হয়ে উঠছিল, তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। তাকে রোজগার করতে হবে। কিন্তু সে তো এখনও অনেক দূর। তাদের ফাইন্যাল পরীক্ষা হবে মার্চে কি এপ্রিলে। তারপরে এম-এ। সে যে অনেক দূর! হা ঈশ্বর!
শামিমকে সে বিয়ে করবেই। কিন্তু সে শামিমের বোঝা হয়ে তো থাকবে না। কিন্তু একটা দিনও ফুলকি শামিমকে ছাড়া থাকতে পারছিল না। শামিম কাছে না থাকলেই ফুলকি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। সে যেন ঝড় খাওয়া পাখির মতো আশ্রয়চ্যুত হয়ে পড়ছিল হঠাৎ হঠাৎ। শূন্যে উড়ছিল, শূন্যে ঘুরছিল। কি অসহ্য সেই অনুভূতি।
‘কি বললে না ফুলকি, রেশমার বয়স কত হতে পারে বলে মনে কর তুমি? তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল ফুলকি। বলছিল, ও কে?’
ফুলকি এবার হাল্কা মনে বলল, তেরো, নয় চোদ্দো?
শামিম বেশ জোর দিয়েই বলল, ‘আন্দাজ, তোমার ঠিকই হয়েছে ফুলকি। তবে তেরো নয়, চোদ্দো। খালা সেটা আজ আবার মনে করিয়ে দিলেন।
ফুলকি ঠাট্টা করে বলল, খালুই বেগম জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমার কথা! তা তুমি কি বললে?
‘আমি আবার কি বলব? যা সত্যি তাই বললাম। বললাম, তুমি আমার সহপাঠিনী। আমরা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।’
ফুলকি বুঝতে পারছে, শামিম মনে মনে বিব্রত হয়ে উঠছে। তার এটা বেশ ভাল লাগল।
উহুঁ, সত্য কথা তো বলনি শামিম। আমি তোমার সহপাঠিনী নই, তুমি এবার এম-এ ফাইনাল দেবে আর আমি দেব বি-এ।
‘রেশমা সহপাঠিনী কথাটার মানেই ধরতে পারল না। বলল, মুনিবের মেয়ে?’
ফুলকির মন খুব হাল্কা তখন। হাসতে হাসতে বলল, তুমি তখন সত্য কথাটা বললে তো?
‘কোন্ সত্য কথাটা ফুলকি?’
আমি হলে তো বলতাম, মুনিবের মেয়ে নয়, ওই আমার মুনিব, খালুই বেগম।
শামিম ফুলকিকে হাসতে দেখে নিজেও বোকার মতো হাসতে লাগল। বলল, ‘ইশ্, এ কথা তো মনে পড়েনি।’
ফাঁদে পড়লে তো আবার শামিম। আবার একটা মিথ্যে কথা বললে তো?
শামিম আবার ততক্ষণে তার বিপন্নতার মধ্যে ফিরে গিয়েছে। কি অসহায় লাগছে তার মুখ! আদর করব, তোমাকে আদর করছি এখন শামিম। তুমি বুঝতে পারছ না? তোমার বেদনা সব আমি ধুয়ে দিচ্ছি শামিম, তুমি বুঝতে পারছ না?
শামিম বলল, তার সুরে সেই বিপন্নতা, ‘রেশমার বয়স…’
তুমি না খালুই বেগমের কথা বলছিলে শামিম?
‘হ্যাঁ খালুই বেগম।’ শামিমের সুর আরও বিপন্ন হয়ে উঠল। ‘খালুইয়ের বয়স চোদ্দো। আর আমার বয়স আঠাশ। খালুইয়ের ঠিক ডবল।’ চুপ করে গেল শামিম। ‘খালুই যখন জন্মায় তখনই আমার বয়স চোদ্দো।’ নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়েই শামিম যেন বলছে।
অমিতা বলল, তোমার সেই বিপন্নতা ফুলকির মনে গভীর সমবেদনা জাগিয়ে তুলেছিল শামিম। ফুলকি চাইছিল, যে সব কথায় তুমি কষ্ট পাচ্ছ, সে সব কথা আর না শুনতে। সে তখন চাইছিল, আদরে আদরে তোমার মনের সব দুর্ভাবনাকে চেঁছে ফেলে দিতে। এই জিনিস সে তোমার কাছ থেকেও আশা করে শামিম? ফুলকির মনের অবস্থা যখন এই পর্যায়ে চলে যায়, যখন সে পায়ের তলায় মাটি পায় না, যখন সে তোমাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চায়, আদর চায় তখন তোমাকে কোথায় সে পাবে শামিম? সে তোমাকে পায় না।
‘আমি ওকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছি। রিডিকিউলাস্!’
ফুলকি চাইছিল এ সময়ে শামিমের হাতখানা একটু ছুঁতে। তাতেই হয়ত শামিম নিজের মধ্যে ফিরে আসতে পারত? ও যে এখন ফুলকির মতোই শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটা ফুলকি শামিমের বিপন্ন মুখ দেখে বুঝতে পারল। শামিম, শামিম, বুড়ো মাঝি তাদের লক্ষ্য করছে দেখে, ফুলকি শামিমের হাতখানা ছুঁতে পারল না, শামিম, শামিম ফুলকি মনে মনে বলতে চেষ্টা করল, আমি আছি আমি তোমার পাশে আছি শামিম।
‘তোমাকে বলব ফুলকি, সব বলব। আসলে আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে হবে চটপট।’
‘আমরা এসে গিয়েছি মা। উই যে খেয়া ঘাট। ওখানেই ভিড়িয়ে দেবানে।
‘না ফুলকি, খুব দেরি করলে আমাদের চলবে না। বিয়েটা তাড়াতাড়িই সেরে ফেলতে হবে। তোমার পরীক্ষা ফরীক্ষা ও সব সেরে বিয়ে করতে গেলে তো জীবনটাই কাবার হয়ে যাবে।’
‘নেমে পড়ে আপনাদের একটুক পা চালাতি হবে মা। ট্রেনের সুমায় হয়ে গেছে পেরায়। তা খেয়াঘাট থেকে টেশন, পথ একটু আছে, মা। পা চালাতি পারলি, এ টেরেন ধরতে পারববা।’
না, শামিম প্লিজ, আমাদের এ কটা মাস অপেক্ষা করতেই হবে।
‘তুমি বুঝতে পারছ না ফুলকি, আমাদের বিয়েটা চটপট হয়ে গেলে আমার একটা অজুহাত থাকবে।’
কিসের অজুহাত শামিম?
‘বলব, ট্রেনে উঠে সব বিস্তারিতভাবে বলব। এখন শুধু শুনে রাখ, আমার খালা আর খালু, দুজনেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল, খালুইকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিতে।
খালুইকে! অমিতা দেখল, নৌকার গলুইটা ঠিক সেই সময়েই ঘাটের শানে ঠকাস করে গিয়ে লাগল। ফুলকির মাথা মাস্তুলের বাঁশে গুঁতো খেল।
তোমরা সেদিন ট্রেনটা ধরেছিলে জবর। আর একটু হলেই ফস্কে যেত। দেখে শুনে ওঠার সময় তোমাদের ছিল না শামিম। গার্ড তখন শেষ বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন। যে কামরা সামনে পেলে তোমরা সেই কামরাতে ঠেলে ঠুলে উঠে পড়লে। কী ভিড়! কী ভিড়!
তোমরা ভিড়ের চাপে একজন যেন আরেকজনের শরীরের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছিলে। ফুলকির মোটেও খারাপ লাগছিল না। তুমি ছিলে তো শামিম। ফুলকির পায়ের নিচে মাটি ছিল। ইছাপুরে এসে ভিড়টা একটু কমল। বারাকপুরে গাড়িটা অনেকটাই খালি হয়ে গেল। তোমরা বসলে। কিন্তু একটু তফাতে তফাতে। এক মহিলা উঠেছিলেন সেই কামরায়। শামিমই ‘একটু সরে বসল। ফুলকির ভাল লাগছিল না ব্যাপারটা। ভিড়েই বেশ ছিল! ওরা এক হয়ে মিশে ছিল। শামিমের শরীরের ছোঁয়া লাগছিল ফুলকির গায়ে। সুখসাগরের কোন্ গভীরতায় ডুব মেরে মেরে একটার পর একটা স্টেশন পার হচ্ছিল ফুলকি। সে রেশটা এখন কেটে গেল। মহিলা এক দৃষ্টিতে ফুলকির দিকে চেয়েছিলেন। ফুলকি মনে মনে অস্বস্তিতে ভুগছিল। সে শামিমের কাছে বেশি ঘেঁসতে পারছিল না।
৩২
অমিতার স্পষ্ট মনে আছে, শামিম ফুলকিকে বলেছিল, ‘আমার খালাকে আবার পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে তাঁদের বাড়িতে।’ তুমি কথাটা এতই সাদামাটাভাবে তাকে বলেছিলেন, ফুলকি ভেবেছিল, তুমি কলকাতাতেই কোথাও তোমার মাসিকে রেখে আসবার কথা বলেছ। তুমি যে একেবারে তাঁকে নিয়ে দেশে পৌঁছে দেবে, এটা ফুলকি ঘুণাক্ষরেও ভারতে পারেনি। হয়ত ব্যাপারটা তোমার কাছে এতই একটা সাধারণ ঘটনা ছিল যে, তুমি ফুলকিকে সেটা জানাওনি। আমরা শ্যামবাজার থেকে হাতিবাগান, কি ভবানীপুর থেকে বালিগঞ্জ কি টালিগঞ্জ যাওয়াটাকে তো কোনও ঘটনা মনে করিনে। করি কি? কিন্তু ফুলকি যদি বুঝতে পারত, তুমি পরদিনই তোমার খালাকে নিয়ে দেশে চলে গিয়েছ শামিম, তাহলে ফুলকি আর অত উদ্বেগে ভুগত না। নাকি তুমি ফুলকিকে বলেছিলে, ফুলকিই অন্যমনস্ক ছিল, কিংবা তোমার সঙ্গে সারাদিন ব্যান্ডেলে কাটানোর ঘোরে ছিল, তাই ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। কারণ যাই হোক তোমার অদর্শনের ফলটা ফুলকির উপর মারাত্মক হয়েছিল।
পরদিন তুমি এলে না। ফুলকি ভেবেছিল, তুমি কোনও কাজে আটকে গিয়েছ। তার পরদিনও তুমি এলে না। ফুলকি বুঝতেই পারছিল না, কি হল? তুমি কি অসুস্থ হয়ে পড়লে? ফুলকির কাছ থেকে যাবার পথে তুমি কি গাড়ি চাপা পড়লে? একদিন-দুদিন-চারদিন-এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। শামিম তুমি এলে না। তোমার কোনও খবরও পেল না ফুলকি। ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তা, সেই অনিশ্চয়তা এসে গ্রাস করল ফুলকিকে। সকাল থেকে বেলা যত দুপুরের দিকে গড়াতে থাকে আর দুপুর থেকে বিকালের দিকে ততই ফুলকির অস্থিরতা বাড়তে থাকে। দরজায় শব্দ হল, ফুলকির বুক ধ্বক করে ওঠে? শামিম? কেউ এসে দরজা খোলে, ফুলকির প্রত্যাশাটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। শামিম? নিশ্চয়ই শামিম। ফুলকি তার ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে বাতাসিয়ার ডাকের। ডাক পিওন আসবার সময়গুলো তো আরও যন্ত্রণার। কী যন্ত্রনা! ফুলকির মনে হয় সে যেন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। শামিম শামিম, কেন তোমার সাড়া শব্দ নেই? আমি কি কিছু অপরাধ করেছি? কি করেছি শামিম? এই সব সময় ফুলকি তার ডায়েরিতে, তার খাতায় তার মনের অবস্থা লিখতে চেষ্টা করেছিল। সে সবের মানে আজ অমিতা ভাল বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে অমিতার সেগুলোকে আদিখ্যেতা বলেও মনে হয়। কিন্তু অমিতা এও জানে, সেদিনের ফুলকির মনকে স্পর্শ করা আজ তার মনের পক্ষে সম্ভব নয়।
সেদিন ফুলকি লিখেছিল : একদিন—
‘সব কিছুর মধ্যে থেকেও বাঁচবার উৎসাহ ক্রমেই হারিয়ে ফেলছি। সামনে দেখছি এক অন্তহীন ভবিষ্যৎ—আমার আর ভাল লাগে না—শুধু বিশ্বাসটুকু আজও বেঁচে তাই—এই তো চারদিকে উজ্জ্বল পৃথিবী, দিন চলছে তার ছন্দে, সামান্য কীটেরও বেঁচে থাকার জন্য কী আগ্রহ! কী অক্লান্ত সংগ্রাম সে করে চলেছে! সামনে পুজো, ছুটি, বেড়ানো—দেশ থেকে দেশান্তর—বিশ্বে কত আয়োজন- সব সব কিছু আছে। তবু সব কিছুর মধ্যে কোনও কিছুর মধ্যেই আমি কেন নেই? আজ করছি প্রতীক্ষা, কিন্তু তার পরে—তারও তারও তারও পরে? যতদিন বেঁচে থাকব শুধুই প্রতীক্ষা করতে থাকবো? কত কতদিন বেঁচে থাকতে হবে? কেন বেঁচে থাকতে হবে? শুধু একবার শুধু একবার—কেউ যদি এসে বলত, ভেবো না ভেবো না, আমি আছি—সব ঠিক হয়ে যাবে—তাহলেই হয়ত শান্তি।
এই পৃথিবীর রণরক্ত সফলতা সত্য, তবু শেষ সত্য নয়—
কিন্তু আরও অপেক্ষা করি, তারপর…’
ফুলকি আরেকদিন লিখেছিল :
‘অনেকদিনের জমানো ভারের থেকে হঠাৎ আজ কেমন করে যেন মুক্ত হয়ে গেলাম। আর.এও জানা রইল ‘সব চেয়ে সত্য মোর সে আমার প্রেম, সেই মৃত্যুঞ্জয়।’ আমার জীবনের বড় সত্য এই। আমি খুব বাস্তব ভিত্তিতে দাঁড়িয়েই এ কথা বলতে পারি। কারণ ভালবাসার উপর নির্ভর করেই আমার সব কিছু চলে। সেই আমার প্রেরণা, আমার জীবন দেবতা। সে আছে বলেই আমি বেঁচে আছি। আপাতত পরিবেশ প্রতিকূল, বাহ্যিকতাকে বাদ দিয়ে মনকে নিয়েই থাকতে হবে—তবে তাই হোক। যে পর্যন্ত না স্বপ্নকে সত্যের মোড়কে ভরতে পারি যতদিন না সে যোগ্যতা আসে, ততদিন সব কিছুই থাক মনে। সে আছে, আমি জানি।
‘আমি আমার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই, সেও থাকুক তার কাজ নিয়ে। বুঝতে পারছি আমার চাওয়াটা বেশ বড় মাপের।’
ফুলকি আরেকদিন লিখেছিল :
‘অসম্ভব একা একা দুপুরটা—কি একটা পাখি তখন থেকেই ডেকে যাচ্ছে—আমার একলা ঘরের জানলা দিয়ে মিষ্টি একটা রোেদ ভরে দিয়েছে ঘরটা—একা-একা—আমার এই দুঃখ ভারাক্রান্ত জীবনকে নিয়ে ভাবছি আর ভাবছি—কি হতে চেয়েছিলাম, কি হয়েছিলাম আর আজ কি হয়েছি—মস্ত একটা কিছু করব, আমি আমি হয়ে উঠব, এই ভাবনাটা বড় ভাবায়—একা আছি, মাঝে মাঝে মনে হয় ভালই আছি, এমনি ভাবে থাকতে পারাটাও মন্দ নয়, কে জানে কি ভাল, সব কিছুই অদ্ভুত লাগে—’
ফুলকি লিখেছিল :
‘আজকেও মন খারাপ লাগছে—শামিম এল না। আমি জানি না কেন আমার প্রতি তার এই অবহেলা। এই অবহেলাকে স্বাভাবিকতা বলে আমি মেনে নিতে পারি না। পারি না। পারি না। এই যে দুঃখটা অনর্থক আমাকে পীড়া দিচ্ছে, কেন আমি বারে বারেই হাত পেতে সেটা নিতে যাচ্ছি। আমার ভাল লাগে না। আমি এমন আশ্চর্যভাবে, ওতপ্রোতভাবে আরেকজনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি যে, কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছি না। কেন কেন কে? আমার আশাগুলো অন্যান্য সব বারের মতই ব্যর্থ, নিরর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে—আমি তাদের স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। আমি কী বাঁচাতে চাইছি।’
আবার আর একদিন, ফুলকির লেখা :
‘নিজের জীবনটায় সামান্য একটু ছন্দ আনার পথ খুঁজে পেলাম। অন্তত অস্থিরতার হাত থেকে মুক্তি—আমার একটা চাকরি ভীষণ দরকার। গ্র্যাজুয়েট হয়েই যদি কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারি তবেই বোধহয় ভাল হয়। চাকরিটা পেলে নিজেকে অন্তর্ত স্বাধীনতাটুকু দিতে পারব। যা কিছু আমি নিজে দিতে পারি, সে ছাড়া আমার নিজের তো পাওয়ার কিছু নেই। আমার সেই ছোট ছোট আশার একটুখানি তো পূর্ণ হবে। তারপরে ভগবান আছেন—আমি তো আমাকে সেখানেই সমৰ্পণ করেছি—তুমি যদি চাও তো আরেকটি আশাও পূর্ণ হতে পারে—আজকের দিনে যা অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে সেই অসম্ভবকে তুমিই সম্ভব করতে পার।’
ফুলকির আরেকদিন :
‘ইট্ ইজ্ আনফেয়ার ভেরি আনফেয়ার। কেন সমস্ত কিছুই আমার বিরুদ্ধে যাবে? আমি তো কোনও অন্যায় করি না বরং মানুষের মঙ্গলকামনাতেই সময় কাটাচ্ছি—তবে কেন? কত আঘাত বাকি আছে আরও?’
আরও একটা দিনে :
‘এ ভাবে তো জীবন যায় না—সে তো উপন্যাস নয়—যেখানে কালির এক আঁচড়ে জীবন বয়ে যায় আমার কাছে অফুরন্ত সময়, আমার আছে অগণিত দিন অজস্র রাত—কোটি কোটি মুহূর্ত—এত সময় আমার হাতে—কী করব আমি!
অমিতা আবারও ভাবতে লাগল, ঠিক কোন সময় এই কথাগুলো লিখে রেখেছিল ফুলকি। ডায়েরিতে তারিখ আছে। খাতার পাতায় তারিখ নেই। সে সব মিলিয়ে মনে মনে একটা হিসাব কষতে চেষ্টা করল অমিতা। তুমি যখন ফুলকিকে কোনও কিছু না বলে চলে গিয়েছিলে তোমার মাসির বাড়িতে, এই লেখাগুলোর অধিকাংশই সেই সময়কার।
সে সময় তোমার খবর পাবার জন্য ফুলকি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার বাইরেকার ভাব দেখে কেউ ধরতে পারত না, ফুলকির মনের ভিতরে তখন কী তোলপাড়ই না চলছিল। ফুলকি তখন অস্থির হয়ে ঘর আর বাইরে শামিমের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্যারাগনে নিশ্চয়ই শামিম আমার জন্য অপেক্ষা করছে। ক্লাসে হয়ত কথাটা মনে পড়ল ফুলকির। সে তৎক্ষণাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত। তার মনে অস্থিরতা জাগত। ক্লাসটা কোনও মতে শেষ করেই ছুটত প্যারাগনে। নেই। শামিম নেই সেখানে। ছেলেটা লাজুক হেসে বলত, ‘বসেন দিদি। দাদা আসতেও পারেন।’ ফুলকি বসে পড়ত ভ্যানিলা নিয়ে। ক্লাসগুলো একটার পর একটা ফাঁক পড়ত। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলত। কোথায় শামিম!
আচ্ছা শামিম, তুমি তো বল, ইসলাম নারীজাতিকে পায়ের শিকলি কেটে মুক্ত করে দিয়েছে। তাই তো?
যদি শামিম : ‘হ্যাঁ ফুলকি, একমাত্র ইসলামই নর ও নারীর জন্য সমান বিধান দিয়েছে। পুরুষ নারীর কাছ থেকে কিছু আদায় করতে চায়, তবে পুরুষও নারীকে ততখানি দিতে বাধ্য। এ আমার মনগড়া কথা নয় ফুলকি। তুমি আমাকে কোরান পড়েছ বলে যে খোঁচাটা মেরেছিলে, তারপর আমি ইসলামিক হিস্ট্রির অধ্যাপক ডাঃ রায়চৌধুরিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে কোরান খুলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।’
ফুলকি কথা বলছিল না। অন্যমনস্কভাবে ভ্যানিলার গ্লাস থেকে স্ট্র দিয়ে সরবত শুষে যাচ্ছিল। ফুলকির কথায় তুমি যে গুরুত্ব দিচ্ছিলে শামিম, এতে তোমার প্রতি তার ভালবাসা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল। একেই তো ভালবাসা বলে শামিম। অন্তত ফুলকির মনে ভালবাসার যে ছবি ছিল, সেই আদর্শের সঙ্গে ফুলকির প্রতি শামিমের ভালবাসা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছিল! শামিম তার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে! আহ্ শামিম!
‘তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছিলে ফুলকি। ইসলামে মেয়েদের স্থান কোথায় দেওয়া হয়েছে, আমি তার বিন্দু বিসর্গও জানতাম না। তোমার জন্যই আমি সেটা জানতে পেরেছি।’
অমিতা দেখতে পেল, সেই কখন থেকে প্যারাগনে একলা বসে আছে ফুলকি। তার সামনে গ্লাসে, ভ্যানিলা। তবুও শামিমের গলার সুর স্পষ্ট শুনতে পেল ফুলকি। ‘ইসলামে স্ত্রী স্বামীর দাসী নয় ফুলকি—বন্ধু।’
অমিতা দেখল, ফুলকি হতাশভাবে উঠে পড়ল। হঠাৎ ফুলকির মনে হল, লাইব্রেরিতে নেই তো শামিম? যদিও সে জানত, শামিম লাইব্রেরিতে থাকবে না, থাকতে পারে না। তবুও ভাবল দেখতে দোষ কি? থাকতেও তো পারে? ফুলকি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে ছুটল। নেই। ফুলকির হতাশা বেড়ে উঠল। এমনও তো হতে পারে, শামিম তাদের বাড়িতে! কথাটা মনে হতেই ফুলকি চঞ্চল হয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে বাস স্টপে গিয়ে দাঁড়াল। ফুলকি যেন মনশ্চক্ষে দেখতে পেল শামিম তার বাবার বৈঠকখানায় বসে আছে। ঘন ঘন চাইছে দরজার দিকে। ফুলকি বাসের জন্য অপেক্ষা করল না। একটা ট্যাকসি ডেকে উঠে পড়ল।
‘হুকুর হুকুর কাশে বুড়া
হুকুর হুকুর কাশে।
নিকার নামে হাসে বুড়া
ফুকুর ফুকুর হাসে ॥’
‘হা হা হা। এটা তুমি কোথায় পেলে ফুলকি!’
‘ট্যাসির পিছন থেকে ভেসে এল শামিমের কণ্ঠস্বর।
কেন, তুমি পড়নি শামিম? এটা তো বেগম রোকায়োর লেখা। নারীর অধিকার। পড়নি তুমি!
‘কই না তো?’
তবে শোন শামিম। এ যুগের মুসলিম মেয়েদের ব্যাপারে কি বলেছেন বেগম রোকেয়া। ‘আমাদের ধর্মমতে বিবাহ সম্পূর্ণ হয় পাত্র-পাত্রীর সম্মতি দ্বারা। খোদা না করুন, বিচ্ছেদ যদি আসে, তবে সেটা আসবে উভয়ের সম্মতিক্রমে। কিন্তু এটা কেন হয় একতরফা, অর্থাৎ শুধু স্বামীর দ্বারা?
তুমি তো বললে শামিম; ইসলামে স্ত্রী স্বামীর দাস নয়—বন্ধু। কিন্তু দেখছ তো শামিম, কোরানের বাণীও বাংলার মুসলমান মেয়েদের জীবনে কোনও গ্যারান্টি দিতে পারেনি। দেখছ তো?
‘তোমার কাছে হার মানছি ফুলকি। তুমিই দেখছি, মুসলমান মেয়েদের মুখপাত্রী হয়ে দাঁড়িয়েছ?’
আমি তো তাই চাই শামিম, শুধু মুসলমান কেন, আমি সমস্ত নারী জাতিরই প্রতিনিধি হতে চাই।
তুমি হাসছ শামিম? রোকেয়া যে গল্পটি বলেছেন সেটি কিন্তু খুব নিষ্ঠুরতার গল্প। না শামিম, শোনো।
‘আমাদের উত্তরবঙ্গে দেখেছি, গৃহস্থ শ্রেণীর মধ্যে সর্বদা তালাক হয়, অর্থাৎ স্বামী স্ত্রীকে সামান্য অপরাধে পরিত্যাগ করে।
হঠাৎ ফুলকির মনে এই গল্পটাই বা ভেসে উঠল কেন? সে ট্যাকসি করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছে, সেই সময়?
‘মেয়েটির কোনও ত্রুটি হলেই স্বামী দম্ভ ভরে প্রচার করে, ‘আমি ওকে তালাক দেব, আজই দেব।’ তারপর ঘরের ভেতর বসে কতকগুলি স্ত্রীলোক ঐ ভাগ্যহীনা মেয়েটিকে নিয়ে, সামনে বারান্দায় কিংবা উঠানে বসে স্বামী নামক জীবটাকে নিয়ে কতকগুলি পুরুষ, এই সব লোকের সামনে স্বামী লোকটি তিনবার উচ্চারণ করে উচ্চস্বরে :
তায়েন তালাক বায়েন তালাক
তালাক তালাক তিন তালাক
আজ জরুরে দিলাম তালাক।
তুমি কি তবে আমাকে তালাক দিয়েছ শামিম? তুমি সেদিন কিছু না বলেই যখন চলে গেলে, একেবারে অন্তর্ধান করলে শামিম, তুমিও কি এমন ‘আয়েন তালাক বায়েন তালাক তালাক তালাক তিন তালাক আজ ফুলকিকে দিলাম তালাক’ বলেছিলে?
‘এই সময় পুরুষটিকে প্রফুল্ল দেখা যায়, খুব প্রফুল্ল, বোধ হয় নতুন পত্নী লাভ হবে, এই আনন্দে। কিন্তু মেয়েটি ভয়ানক কাঁদে। এরপর কোনও বয়স্থা স্ত্রীলোক মেয়েটিকে ধরে তার কানের, নাকের, হাতের অলঙ্কারগুলি খুলে তার শাড়ির আঁচলে বেঁধে দেয়। হাতের কাঁচের চুড়িগুলি এক টুকরা ইট বা কাঠের সাহায্যে ভেঙে দেয়, আর বলে, ‘দেন মোর মাফ করে দিয়ে যা!’ মেয়েটি এই সময় ভয়ানক কাঁদে। বেচারী স্বামী হারিয়ে, সাজ-সজ্জা হারিয়ে, হাতে-গড়া সাধের পাতানো সংসার হারিয়ে রিক্ততার দুঃখ নিয়েই কাঁদে।’
.
রিক্ততার দুঃখ তুমি কি বুঝবে শামিম? কতটুকু বুঝবে? ট্যাক্সিতে বসে ফুলকি কাতরভাবে বলে উঠল, তুমি আমাকে একেবারে রিক্ত করে ফেলে রেখে কোথায় পালালে? কোথায় গেলে শামিম!
‘এর পরের দৃশ্য—পুরুষটি হৃষ্টচিত্তে কোথাও বেড়াতে যায়। আর মেয়েটির বাপ, ভাই চাচা বা মামু যে অভিভাভবকরূপে উপস্থিত থাকে (কারণ এইরূপ দু’একজনকে পূর্বেই ডেকে আনা হয়) সেই অভিভাবক স্থানীয় লোকটি তখন ঐ ক্রন্দনরতা মেয়েটিকে টেনে হিঁচড়ে পাল্কী কিংবা গোরুর গাড়িতে নিয়ে চলে যায়।’
তুমি না বলেছিলে শামিম, কোরানে বলেছে, নারী পুরুষের অংশ।
তুমি না বলেছিলে শামিম, কোরানে বলেছে, নারীকে সম্মান কর, কেন না নারী পুরুষের জননী, ভগ্নী, স্ত্রী এবং নিকট আত্মীয়। (আমি তোমার কী শামিম? আমি কি স্ত্রীলোক নই! কোরানে যে ব্যবহার নারীর প্রতি নির্দিষ্ট, সে ব্যবহার আমি কি তোমার কাছ থেকে পেতে পারিনে?)
তুমি বলেছিলে কোরান বলেছে, নারীর অধিকার পবিত্র—তাহাতে হস্তক্ষেপ করিও না।
কোরান বলেছে, স্ত্রী তাহার স্বামীর গৃহের রানি—তোমরা কি তা মানো?
কোরান বলেছে, জগৎ এবং জগতের যাবতীয় বস্তুই মূল্যবান, কিন্তু নারীই সর্বাপেক্ষা মূল্যবান সামগ্রী—তোমরা পুরুষেরা, আজকের সমাজের মুসলমান পুরুষেরা কি নারীকে এই মূল্য সত্যিই দাও? কখনও দিয়েছ শামিম?
তোমরা আপন স্ত্রীকে ঘৃণা করিও না। যদি তোমার স্ত্রীর একটি দোষে তুমি বিরক্ত হইয়া থাক, তাহা হইলে তাহার অপর একটি গুণের জন্য আনন্দিত হও। কোরানে বলেছে!
কোরানে বলেছে, তোমরা নারীকে কখনও প্রহার করিও না বা তাহার প্রতি অত্যাচার করিও না। কোরানে বলেছে!
তোমরা পুরুষেরা কে এটা পালন কর শামিম? তবে কি কোরানের কথা এক পথে যেতে বলে, এবং তোমরা পুরুষরা সর্বদাই তার বিপরীত পথে চল, এবং তা সত্ত্বেও তোমরা বল, ‘আমরা মুসলমান’, তা সত্ত্বেও তোমরা বল, ‘আমরা ইমানকে ধরে আছি।’
কিন্তু এখন এই সব কথা কেন মনে হচ্ছে ফুলকির? ফুলকি কি ধরে নিয়েছে শামিমই মুসলমানদের প্রতিনিধি? না, না, মুসলমান নয়, পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি, ফুলকি শামিমকে সমগ্র পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি বলে, ধরে নিয়েছিল এবং তাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছিল। বেগম রোকেয়াকে উকিল মেনেছিল ফুলকি।
‘আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। …পুরাকালে যে ব্যক্তি প্রতিভাবলে দশজনের মধ্যে পরিচিত হইয়াছেন, তিনিই আপনাকে দেবতা কিম্বা ঈশ্বর-প্রেরিত দূত বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। এবং অসভ্য বর্বরদিগকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ক্রমে যেমন পৃথিবীর অধিবাসীদের বুদ্ধি-বিবেচনা বৃদ্ধি হইয়াছে, সেইরূপ পয়গম্বরদিগকে (অর্থাৎ ঈশ্বর-প্রেরিত মহোদয়দিগকে) এবং দেবতাদিগকেও বুদ্ধিমান হইতে বুদ্ধিমত্তর দেখা যায়। …তবেই দেখিতেছেন, এই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষ-রচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে।’
ফুলকি অনেকবার বেগম রোকেয়ার সওয়াল শুনেছে। খুবই ভাল লাগে তার। আর এ তো শুধু বেগম রোকেয়ার একার কথা নয়, নির্যাতিত সমস্ত নারী সমাজের কথাই বেগম রোকেয়া ফুটিয়ে তুলেছেন। ট্যাক্সিতে তারই কণ্ঠস্বর, যদিও সে কণ্ঠ কোনদিনই শোনেনি ফুলকি, তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে যে কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে তার কানে সেটাই তো রোকেয়ার আওয়াজ তার কাছে, সেই কণ্ঠস্বর শুনতে শুনতে, তার মনের ভিতর থেকেই উঠে আসছিল সে আওয়াজ, ফুলকি তার জ্বালা-যন্ত্রণা কিছুটা ভুলে থাকতে পারছিল।
‘যাহা হউক, ধর্মগ্রন্থসমূহ ঈশ্বর-প্রেরিত কি না, তাহা কেহই নিশ্চয় করিয়া বলিতে পারে না। যদি ঈশ্বর কোনও দূত রমণী-শাসনের নিমিত্ত প্রেরণা করিতেন, তবে সে দূত বোধ হয় কেবল এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকিতেন না। দূতগণ ইওরোপে যান নাই কেন? আমেরিকা এবং সুমেরু হইতে কুমেরু পর্যন্ত যাইয়া ‘রমণীগণকে নরের অধীন থাকিতে হইবে’ ঈশ্বরের এই আদেশ শুনান নাই কেন? ঈশ্বর কি কেবল এশিয়ারই ঈশ্বর? আমেরিকায় কি তাঁহার রাজত্ব ছিল না? ঈশ্বরদত্ত জলবায়ু তো সকল দেশেই আছে, কেবল দূতগণ সর্বদেশময় ব্যাপ্ত হন নাই কেন? যাহা হউক, এখন আর আমাদের ধর্মের নামে নতমস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। আরও দেখ, যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ সতীদাহ। (পাদটীকা : একজন কুলীন ব্রাহ্মণের মৃত্যু হইলে তাঁহার শতাধিক পত্নী সহমৃতা হইতেন কি?) যেখানে ধর্মের বন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।’
ফুলকি বাড়ি পৌঁছে হতাশ হল। বাবার বসবার ঘরে যে-প্রত্যাশা নিয়ে তাড়াতাড়ি উঁকি মেরেছিল ফুলকি, ঘর শূন্য দেখে সে আশা চুরমার হয়ে গেল তার। তার পায়ের জোর চলে গেল। যেন মাইল মাইল হেঁটেছে ফুলকি। ধীরে ধীরে ভারী শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে বাথরুমে চলল অমিতা। সে প্রচণ্ড হাঁফাচ্ছে।
সিঁড়ি বেয়ে এক পা এক পা করে উঠে যাচ্ছে ফুলকি।
অমিতা এক পা এক পা করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বিছানায় ফিরে যাচ্ছে অমিতা। ঘরে তখনও সেই ভোরের আলো যেন তারই মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে।
ফুলকি খাটের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ঘরে তার বিকালের অস্তগামী সূর্যের আলো পিচকারি থেকে যেন রাঙা রাঙ ঢেলে দিচ্ছে।
অমিতার ঘরে এখন বিকালের আলোতে বড় তেজ। অমিতা হাতের লেখা ভালই পড়তে পারছিল। শামিম, শামিম, তুমি বেশ স্পষ্টাক্ষরে তখন চিঠি লিখতে। অনেক কিছুর মতো শামিম রবীন্দ্র-ছাঁদে হাতের লেখাকেও আদর্শ করে নিয়েছিল। ফুলকিকে বিভিন্ন সময়ে চিঠিগুলো লিখেছিল শামিম। কত ভিন্ন ভিন্ন ভাবে, কত নামে তখন ফুলকির সম্বোধন করত শামিম। ‘সুচরিতাসু’, বলাই বাহুল্য এ সব প্রথম দিকের পাঠ। চিঠিখানা খুলল আমিতা। কত আড়ষ্ট, কত সতর্ক তুমি ছিলে শামিম তখন? ‘সুহৃদয়াসু’। এ-ও প্রথম দিকে। দু এক খানাই এই রকম চিঠি আছে, অমিতা দেখল। খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদের প্রতি ফুলকি, না না, তখন অমিতা, কখনও অমিতা দেবী, দৃষ্টি আকর্ষণ। সে সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা, সেই সঙ্গে জানতে চাওয়া শামিমের ব্যাখ্যা সম্পর্কে ফুলকির মত কি? ‘আপনি এ সম্পর্কে কি মনে করেন, জানতে বড় ইচ্ছা।’ তারপর থেকে ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠতায় উত্তরণ। উচ্চারণ সেই সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই বদলে গিয়েছে চিঠির। ‘অমিতা দেবী থেকে অমিতা’য় এবং ‘অমিতা থেকে মিতা-য় আসতে দেরি হয়নি বেশি। আর তারপরেই এসেছিল সেই উতল করা সময়। ‘ফুলকি’, ‘ফুলকি প্রিয়তমে’ আহ্ শামিম আহ্! ‘ফুলকি’, ‘ফুল-কি’, ‘ফু-ল-কি’ ‘ফুলকি ফুলকি ফুলকি ফুলকি আমার ফুলকি।’ হ্যাঁ, সেই মোক্ষম চিঠিখানা খুঁজে পেয়েছে অমিতা। সেই চিঠি! আঠারো দিন বিফল প্রত্যাশার পর যে চিঠি ফুলকি পেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই তো সেই দুঃস্বপ্নটা দেখেছিল ফুলকি।
চিঠিখানা কোলে নিয়ে বসে রইল অমিতা। খামের মধ্যে শামিমের কণ্ঠস্বর সেদিনও শুনতে পাচ্ছিল অমিতা, ফুলকি যেমন পেয়েছিল এই চিঠি তার হাতে এলে।
ফুল-কি, ফু-লকি, ফুলকি, ফু-ল-কি, আমার ফু-ল-কি।
তুমি আর ফুলকি কোথায় যাচ্ছিলে শামিম। কোলের চিঠিখানাকে উদ্দেশ্য করেই অমিতা বলল। যাচ্ছিলে ট্রেনে করে। বেজায় ভিড় ছিল, বেজায় ভিড় শামিম। তোমরা কোথাও বসবার জায়গা পাওনি। ফুলকি ভিড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তবু তার, তারই ভাল লাগছিল। তার শরীর তোমার শরীরের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তোমার গন্ধ, তোমার নিঃশ্বাস তোমার স্পর্শ ঝড় তুলেছিল ফুলকির রক্তে। একটা জংশন স্টেশনে গাড়ি আসতেই সব ভিড় হাল্কা হয়ে এল। আমাকে জানলার ধারে বসিয়ে দিয়ে তুমি কিচ্ছু না বলেই প্লাটফর্মে নেমে পড়লে। কোন্ জংশন সেটা? সেটা কি নৈহাটি শামিম? না, ব্যান্ডেল? না বর্ধমান? তুমি আমার পাশে এসে দাঁড়ালে। গাড়ির জানলায় রাখা আমার হাতখানার উপর আলতো চাপ দিয়ে তুমি বললে, ‘প্রেমের উপর বিশ্বাস রেখো ফুলকি। প্রেম মৃত্যুঞ্জয়।’ তারপর আর একটা কথাও না বলে, তুমি প্লাটফর্মের ও পাশটায় গিয়ে একটা উলটো দিকের গাড়িতে চেপে বসলে। আমি কিছু বোঝার আগেই তীব্র হুইশেল বাজিয়ে দুটো গাড়িই একসঙ্গে ছেড়ে দিল। আমাদের পথ সেই প্রথম আলাদা হয়ে গেল শামিম। আর আমার গাড়িটা একটা অন্তহীন সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। অন্ধকারে। গভীর অন্ধকারে।
মন্টুর মা ঘর মুছতে মুছতে দেখতে লাগল, বুড়ি সেই তখন থেকে একটা চিঠি কোলে করে বসে আছে। বসে আছে তো আছেই। মন্টুর মা ভাবল বুড়িকে একবার ডাকে। সে ঘর মুছতে লাগল।
৩৩
অমিতা এখন শামিমের সেই ভারী চিঠিটা কোলে নিয়ে বসে আছে ঠিক সেদিনরই মতো। যেদিন ফুলকি ওই চিঠিটা প্রথম পায় শামিমের কাছ থেকে। ফুলকিও চিঠিখানা অমনি কোলে নিয়ে বসে ছিল। ফুলকি কি চিঠিখানা খুলতে ইতস্তত করছিল? অমিতা সেইদিনের ফুলকির দিকে চেয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে। নানা ধরনের অনুভব ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া খেলে যাচ্ছিল ফুলকির মুখে। প্রথমেই অভিমান। এতদিন পরে শামিমের চিঠি পেয়ে ফুলকির চোখ ফেটে জল এসে যাচ্ছিল। এতই কি অবহেলার পাত্র আমি! কেন তুমি কিছু না বলেই সেদিন গায়েব হয়েছিলে? কি হয়েছিল তোমার শামিম? ফুলকি শামিমের চিঠিখানার দিকে বার বার চাইছিল। একবার ভাবছিল, খুলবে না, ফুলকি কিছুতেই শামিমের চিঠিখানা খুলবে না। পরক্ষণেই ভাবল, নিশ্চয়ই কোনও গুরুতর কারণ ছিল শামিমের, না হলে হঠাৎ সে অমন করে গায়েব হয়ে যেতে পারত না। নিশ্চয়ই সে কথা লিখেছে শামিম। ফুলকির কৌতূহল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কি লিখেছে শামিম? কথাটা মনে হওয়া মাত্র ফুলকি পেপার-কাটার ঢুকিয়ে দিলে খামের মুখে। তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ফুলকি।
‘ফুলকি, ফুলকি, ফু-লকি, ফুল-কি, আমার ফু-ল-কি!’
‘ফুলকি আবার পড়ল, আবার পড়ল। তারপরে তার খেয়াল হল, কোথা থেকে লিখেছে শামিম? সে কি এখন কলকাতায়? না, নীলগঞ্জ। নীলগঞ্জ থেকে আসছে চিঠিখানা। নীলগঞ্জ? নীলঞ্জ ভায়া মেহেরপুর, জেলা নদীয়া। নীলগঞ্জ?
নীলগঞ্জ? নীলগঞ্জ তাহলে কোনও কাল্পনিক জায়গা নয় শামিম? নয় কোনও স্বপ্নের দেশ, রূপকথার দেশ? এই নামটাই তো তুমি লিখিয়েছিলে শামিম, সেই আর্য নিবাস হোটেলে? তাই না? সেই জায়গাই তো এটা? নীলগঞ্জ। শামিম, তুমি সেদিন বলেছিলে, এটা তোমার মাসির বাড়ি।
‘প্রথমেই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি ফুলকি, আসার আগে তোমাকে কিছু বলে আসিনি, সেই কারণে। খুবই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলাম। আমার এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকে তুমি ক্ষমা কর।’
শামিমের কাতরতা প্রতি ছত্রে টের পাচ্ছে ফুলকি। তার তো তখন শামিমের প্রতি সহানুভূতিই জাগবার কথা। কিন্তু শামিমকে কাতরতার সাগরে অমন করে হাবুডুবু খেতে দেখে ফুলকির মনে সেই সহানুভূতি জাগল না। অমিতা শুনল, ফুলকির মন তখন বলছে, বেশ হয়েছে, যেমন…পরক্ষণেই ফুলকির মনে অনুশোচনা এসেছিল। সেটাও অমিতা জানে।
‘ফুলকি, আমার জীবনের কিছু কথা অনেকদিন ধরেই তোমাকে জানাতে চাইছি। কিন্তু ঘটনা এমনভাবে ঘটে যাচ্ছে যে, কিছুতেই তোমাকে আমার কথাগুলো বলতে পারিনি। আজ আমাকে সে সব বলতেই হবে।’
বল শামিম বল। আমি তোমার কথা, সব কথাই তো শুনতে চাই। তোমার মনের গভীরে কোথাও একটা গভীর ক্ষত আছে, এমন সন্দেহ আমি মাঝে মাঝে করি। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ হয়। আর আমি থেমে যাই 1
‘ফুলকি, আমার ফুলকি, একটা কথা বলে নিই, তুমি জেনো তুমি ছাড়া এই জগতে আমার আপন জন এমন কেউ নেই, যার কাছে আমার কথা অকপটে বলতে পারি।’
আবেগে ফুলকির চোখ ফেটে এবার জল বেরিয়ে এল। চিঠিখানা ঝাপসা হয়ে এল! শামিম আমার শামিম, তোমার সব কষ্ট আমি আমার ভালবাসা দিয়ে মুছে দেব। তুমি ভেব না শামিম।
‘তুমি খালুইকে দেখেছ ফুলকি। সেই যে, যে মেয়েটা ব্যান্ডেল চাচের ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে দেখছিল বারবার। সেই খালুই। আমি ভাবতে পারিনি, খালুইকে নিয়ে আমার জীবনে কোনও দিন সমস্যা সৃষ্টি হবে। অথচ ফুলকি, ঘটনার গতি সেই দিকেই যাচ্ছে।
অমিতা জানে, সেদিন ফুলকি এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। অন্তত যখন এই কথাটা পড়ল শামিমের চিঠিতে। খালুই শামিমের জীবনে কি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে? ফুলকি খুব হালকা ভাবে প্রশ্নটা নিজের মনকে করল।
‘কিন্তু তার আগে তোমাকে জানানোর দরকার, তোমাকে এতদিন চিঠি দিইনি কেন? ফুল-কি, ফু-ল-কি, আমার ফুলকি, আমি যেদিন খালা আর খালুইকে নিয়ে নীলগঞ্জে পৌঁছুলাম, তার পরদিনই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
শামিম অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এখন বোঝা গেল, কেন তার কোনও খবর পায়নি ফুলকি।
‘টাইফয়েড্ ফুলকি, টাইফয়েডে আমাকে খুবই কাবু করে ফেলেছে। এখনও সুস্থ হইনি। পরশু অন্নপথ্য করেছি। আর আজই তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি। জানি না, একবারে চিঠিটা শেষ করতে পারব কি না?’
একবারে শেষ করওনি তুমি শামিম। অমিতা কোলের উপর শামিমের সেই ভারী চিঠিখানার দিকে চেয়ে বলল, তুমি একটু একটু করে চিঠিখানা শেষ করেছিলে।
‘এখনও শারীরিক দুর্বলতা খুবই। মাথাটা হালকা। পায়েও বল আসেনি। টাইফয়েডে নাকি অঙ্গহানি হয়, কবিরাজমশাই জানিয়েছেন, আমার ক্ষেত্রে সে ভয় নেই।’
ফুলকি এইখানে চিঠিখানি বন্ধ করে চোখ বুজে কিছুক্ষণ বসে থাকল। ওর ভাল লাগছিল না, একদম ভাল লাগছিল না। ওর শামিমের পাশে গিয়ে পৌঁছুবার ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠছিল।
‘তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েই পরদিন ভোরে আমাকে হুগলি ছুটতে হয়েছিল। খালার কাছে। ইমামবাড়ার পাড়াতেই খালুর বোনের বাড়ি। সেখানে খালা আর খালুই এসেছিল, খালুর ভাগ্নের ছেলের আকিকা উপলক্ষে। খালুর কাজ থাকায় তিনি আসেননি। খালাদের পৌঁছে দেবার কথা ছিল নাকি আমার। আমি খালুর সে চিঠি পাইনি। ভেবেছিলাম পরদিনই চলে আসব। কিন্তু কি কপালের ফের দেখ! পড়ে গেলাম টাইফয়েডের চক্করে।’
অমিতা বলল, তুমি বোধ হয় প্রথম দিন এই পর্যন্তই লিখেছিলে শামিম। এরপরেই কালি আর কলম বদলেছে বলেই মনে হয়।
‘আমার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কথা বলছি। কিন্তু কোথায় শুরু করি, তাই চিন্তা। আমার আম্মা আমিনা আর খালা, জুবেদা, দুই বোন। পিঠোপিঠি। খালা আম্মার চাইতে দু বছরের বড়। আমার খালু সাদেক আলি আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সব চাইতে লেখাপড়া জানা লোক। তিনি বি এ, বি এল। কিন্তু তিনি ওকালতি করেননি কখনও। র্যালি ব্রাদার্সের পাটের মোকামের উপরওয়ালা ছিলেন। নীলগঞ্জেই সেই মোকাম। এই চাকরি থেকেই খালুর উন্নতি। খালু এখন তালুকদারও হয়েছেন। আমার জন্মের আগে খালার দু ছেলে জন্মেছিল। দুটোই জন্মে অল্পদিনের মধ্যেই মারা যায়। আর তার কিছুদিন পরে আমাকে জন্ম দিয়ে আমার মা মারা যান। আমার তখন দু মাস বয়স। খালা আপন সন্তান ভেবে আমাকে তাঁর কোলে টেনে নেন। আমি এই খালার কাছেই মানুষ ফুলকি। আমার বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন মা আমাকে গ্রহণ করতে পারেননি। সে অন্য ইতিহাস। আমি বিশেষ মনে করতে চাইনে।’
শামিমের ইতিহাস শুনতে শুনতে ফুলকির মন ক্রমেই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে লাগল। ফুলকির ভাল লাগছে না। একটুও ভাল লাগছে না।
অমিতা বলল, ফুলকি পারলে তক্ষুনি নীলগঞ্জে চলে যেত। কিন্তু কোথায় নীলগঞ্জ? কোথায় তুমি শামিম, আমি তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে চাই। এখনই এখনই এখনই।
‘আমার খালা আর রেশমা, এরা দুজন এবার আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে ফুলকি। ওদের যত্ন ওদের সেবাই বলতে গেলে আমাকে আবার ঠেলে তুলেছে। আমি মাত্রই গতকাল খালুর দহলিজে গিয়ে বসেছিলাম। দহলিজ মানে বোঝ তো? আমাদের গ্রামে হিন্দুরা ওটাকে বলে বারবাড়ি। মুসলমানেরা বলে দহলিজ। আসলে ওটা বৈঠকখানা। খবর পেয়ে আমার বন্ধুরা এসেছিল। যদিও আমার নিজের বাড়ি অন্য গ্রামে। এখান থেকে মাইল দুয়েক হবে। কিন্তু নীলগঞ্জই আমার গ্রাম ফুলকি। নীলগঞ্জ আমার জীবনের সঙ্গে একেবারে জড়িয়ে গিয়েছে। একে ভুলতে পারিনে।
ফুলকি লক্ষ করল, শামিম কেমন গভীর মমতার সঙ্গে নীলগঞ্জ, ওর খালা আর রেশমার উল্লেখ করেছে। খালুই নয়, এবার রেশমা। খুবই স্বাভাবিক। ফুলকি শামিমের মনের পরিচয় পেয়ে খুশি হল। ‘আমার খালা আর রেশমা, এরা দুজন এবার আমার জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে ফুলকি।’ কৃতজ্ঞ তো হতেই পারে শামিম। এমন কি ফুলকিও শামিমের খালা আর রেশমার কাছে কৃতজ্ঞ হল।
‘রেশমা এখন আমার সব সময়ের সঙ্গী। গত দু বছর বাড়িতে আসিনি আমি। বুঝতেই পারিনি রেশমা এত বড় হয়ে গিয়েছে। এমন কি, যেদিন ব্যাণ্ডেল চার্চে দেখা, সেদিনও ভাবিনি ফুলকি, আমার সেই ছোট্ট রেশমা, যে আমার কোলে পিঠে মানুষ, সে এমন একটা পাকা গিন্নি হয়ে উঠেছে। ওহ্, ওর কি শাসন! সে যদি তুমি দেখতে ফুলকি?’
অমিতা লক্ষ করছিল, ফুলকি নিজেকে কেমন যেন অপরাধী অপরাধী বলে মনে করতে শুরু করেছে। সে কেন এখন শামিমের পাশে নেই? সে কেন এ সময়, শামিমের জীবনে ঘোর বিপর্যয়ের সময়ে, শামিমের কাছে নেই? রেশমা মেয়েটার কথা যত সে শুনছে শামিমের চিঠিতে ততই সে ভালবেসে ফেলছে তাকে। রেশমা, রেশমা, আমি যদি শামিমের কাছে থাকতে পারতাম, তবে তোমার অনেক পরিশ্রম আমি কমিয়ে দিতে পারতাম।
‘রাতের পর রাত জেগেছে রেশমা। দিনে রাতে, যে-সব সময়, আমাকে ওষুধ খাওয়ানোর কথা, রেশমা ঘড়ি ধরে তাই করে গিয়েছে। ওর কাণ্ড দেখে ফুলকি, আমার ভয় লাগছিল যে, ওর আবার টাইফয়েড না হয়। সময় এখনও যায়নি। তাইতে উদ্বেগে আছি।’
আশা করি, রেশমা সুস্থই থাকবে শামিম। ভুমি এই শরীরে বেশি চিন্তা কর না। মনে রেখ, তোমার এখন সুস্থ হয়ে ওঠা দরকার। কত কাজ তোমার পড়ে রয়েছে শামিম। রেশমা সুস্থ থাকবে শামিম, আমার মন বলছে, রেশমা সুস্থ থাকবে। তুমি বেশি ভেব না।
‘রেশমার কথা পরে বলছি। এবার তোমাকে আমার গ্রামের পলিটিক্সের কথা বলি।’
ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে। অমিতা হাসল। শামিম পলিটিকসের কথা লিখেছে।
‘গ্রামের পলিটিক্স বলতে গ্রামের ঘোঁট বোঝায়, এ সে পলিটিকস নয় ফুলকি। কলকাতা শহরে যে পলিটিক্স্ নিয়ে আমরা মাতামাতি করছি, সেই পলিটিক্সের ভূতই নীলগঞ্জের ঘাড়ে এসে চেপে বসেছে। নীলগঞ্জ ছিল হিন্দু মুসলমানের মিলিত গ্রাম। সেই নীলগঞ্জ, এবার দেখছি, সম্পূৰ্ণ দুটো নতুন গ্রাম হয়ে উঠেছে। কলকাতা এতই বড় শহর যে, সেখানে কিছুই বোঝা যায় না। ফুলকি, তুমি ভাবতে পারবে না, কি সাংঘাতিক ফ্যানাটিক্ হয়ে উঠেছে এই গ্রামের মুসলমানেরা, আমার ছেলেবেলার বন্ধুবান্ধবেরা। এরা সব নাকি নতুন করে ইসলামে ফিরছে, নীলগঞ্জের মুসলমান এবার সাচ্চা মুসলমান হয়ে উঠছে। এ যে কী পরিবর্তন, তুমি ধারণা করতে পারবে না। কারণ তুমি এদের চেহারা দেখনি। কলকাতায় তুমি যে সব মুসলমান দেখেছ, ফুলকি, তায়েবচাচা, আবুল মনসুর সাহেব, আবুল হাসেম সাহেব, যারা তোমার চেনা, এরা সে মুসলমান নয়। এরা অন্ধ ফুলকি, এরা ধর্মান্ধ। এদের সঙ্গে যতটুকু কথাবার্তা আমার হয়েছে, তাতে এদের কবন্ধ ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি আমার। নীলগঞ্জে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ফুলকি। এখান থেকে কবে কলকাতায় ফিরব, তারই দিন গুনছি। এখনই পালাতাম। কিন্তু শরীর বৈরী। অতএব আর কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে। আমার ভয় করে ফুলকি, বড় ভয় করে।’
শামিম যত তাড়াতাড়ি আসতে চেয়েছিল, সেটা আর কিছুতেই হচ্ছিল না। তবে শামিমের চিঠি নিয়মিত আসতে শুরু করেছিল। ফুলকি তারই উপর ভরসা রেখেছিল।
‘আমার বাবা এসেছিলেন ফুলকি। বাবার কথা তোমাকে বলা হয়নি ফুলকি। যত ভাবছি, ততই অবাক হচ্ছি, তোমাকে আমার কথা কিছুই বলা হয়নি। অথচ এত ঘনিষ্ঠ আমরা?’
অমিতাও কম অবাক হয়নি। শামিম তার জীবনে প্রবেশ করেছিল কোনও পরিচয়পত্র ছাড়াই। আর সে তো শামিমকে গ্রহণও করে নিয়েছিল সহজে। শ্বাসপ্রশ্বাস যেমন সহজেই শরীরে বহে যায়। শামিম কে? কি তার পরিচয়? এ সব জানবার কোনও প্রয়োজনই পড়েনি ফুলকির। কেন? শামিমের মধ্যে এমন একটা মন দেখেছিল ফুলকি, যেখানে আশ্রয় নিতে তার দ্বিধা হয়নি। যে মনটা দেখেছিল সে, সেটা তার মনে হয়েছিল, মানুষের মন। তার তো আর কোনও পরিচয়ের দরকার ছিল না। অমিতা আজ ভাবে, কী করে সেদিন, ওই ছোট্ট মেয়ে ফুলকি শামিমকে আপন করে নিতে পেরেছিল! মাঝে মাঝে অমিতার মনে হয়, শামিম বলে সত্যই কেউ ছিল না। শামিম ছিল তার অলীক কল্পনা। শামিম তার স্বপ্ন। ‘স্বপ্নে আমার মনে হল, তুমি ঘা দিলে আমার দ্বারে।
ঠিক তাই!
‘আমি জাগি নাই জাগি নাই গো, তুমি মিলালে অন্ধকারে।
একেবারে ঠিক তাই-ই!
‘আমার বাবা, আবদুল আজিজ মোল্লা, কি বলব, লোকটাকে আমি যমের মতো ভয় করতাম। যেমন তার দেহে আসুরিক শক্তি, তেমনি তার মগজে ফিচলিমে বুদ্ধি ঠাসা। শুনেছি, বারা যৌবনকালে জমিদার সোনাউল্লা ভূঁইয়ার লেঠেল সর্দার ছিলেন। রোগে ভুগে এখন বাবার যদিও সেই স্বাস্থ্য আর নেই, তবু বাবা এখনও সর্দার। বাবা এখন মামলার তদারক করে বেড়ান। আর কোরান তেলাওয়াত করেন। অর্থাৎ আবৃত্তি করেন। এখন মুসলমানদের মধ্যে ধর্মে হিড়িক আবার জেগে উঠেছে। ইসলাম বিপন্ন। তাই বাবার পসারের অন্ত নেই। বাবারও খাতিরও খুব বেড়েছে। এবার দেখলাম বাবার মাথায় রুমি টুপি উঠেছে। পোশাক পরিচ্ছদও মৌলানার মতোই।’
ভাগ্যিস, তুমি কয়েকখানা চিঠি লিখেছিলে শামিম, তাই অমিতা জানে, তুমি কল্পনারও নও, তুমি নিছক স্বপ্নেরও নও শামিম, তুমি একদিন এই বাস্তব জগতের লোকই ছিলে। ফুলকি তোমার স্পর্শ পেয়েছে। ফুলকি তোমার আদর পেয়েছে। এগুলো মিথ্যে নয়।
‘আমার এই বাবার জন্যই রেশমার লেখাপড়া হয়নি। আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম ফুলকি। বাবা আমার লেখাপড়া বন্ধ করারও যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন। বাবার ধারণা ছিল, ইস্কুল কলেজে পড়লে আমি আর আল্লাহ্র পথে থাকব না। ইংরাজি শিক্ষা শয়তানের শিক্ষা। সেই শিক্ষা নিলে আমার মধ্যে হিন্দুয়ানি বেড়ে যাবে। কিন্তু ভাগ্যিস খালু আমার সহায় ছিলেন। খালু আমার শিক্ষার ব্যাপারে বাবার কথায় কান দেননি। বাবা আমাকে মক্তব মাদ্রাসায় পড়িয়ে মৌলানা বানাতে চেয়েছিলেন। বাবার তখন সাংসারিক অবস্থা এতই খারাপ যে, খালু তাকে পাটের মোকামে তখন একটা কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে আমার ব্যাপারে তাই পিছু হটতে হয়েছিল। কিন্তু বাবা সে কথা ভোলেননি। খালুর সঙ্গে আমাকে নিয়ে বাবার রেষারেষি শুরু হয়েছিল। বাবা খালুকে বহুবার অপদস্থ করেছেন।
ফুলকি সেদিন চিঠি পড়তে পড়তে মনে যেমন টনটনে একটা ‘ বেদনা অনুভব করেছিল, অমিতা দেখল এতদিন পরেও সেই পলাতক লোকটার জন্য তার মনে কেমন বেদনার ছায়াপাত ঘটছে।
‘রেশমা খালু-খালুর শেষ বয়সের সন্তান। বলাই বাহুল্য বড়ই আদরের। কিন্তু কেবল আদর দিলেই তো বাবা-মায়ের কর্তব্য ফুরিয়ে যায় না, মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়েও তো দিতে হয়। কিন্তু হন না। রেশমাকে কিছুতেই ইস্কুলে পাঠাতে ওঁরা রাজি হলেন না বাবা আমার ব্যাপারে খালুর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন, সেটার শোধ নিলেন রেশমার উপর দিয়ে। বেচারার জন্য আমার বড় দুঃখ হয় ফুলকি।’
রেশমার জন্য সেদিন ফুলকিও দুঃখ বোধ না করে পারেনি। বেচারা খালুই! অমিতার কানে ভেসে উঠল, মিস ফজিলতুন নেসা এম. এ-র কথা :
‘নারী এতকাল নিজেকে মোহ আবরণে ঢেকে রেখে এই বিচিত্র পৃথিবীর সৌন্দর্য থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেছে—কিন্তু আজ অনুতপ্ত নারী-প্রাণ সেই কুৎসিত বিলাসের ফাঁসি ছিন্ন করে বাহিরের জগতের সাথে পরিচয় স্থাপন করতে চাচ্ছে। সমস্ত নারী মন আজ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংগ্রাম করবার যে প্রধান অস্ত্র—শিক্ষা ও জ্ঞান, তাই তাদের নাই—আছে কেবল দারুণ একটা আত্মগ্লানি, মর্মভেদী একটা অনুশোচনা, আর সর্বোপরি মুক্তির জন্য দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। এর জন্য সর্ব প্রথম আবশ্যক শিক্ষা। শিক্ষা বলতে কেবল কয়েকটি ডিগ্রির ছাপ নয়—যে শিক্ষা মনকে উন্নত ও প্রশস্ত করে বিবেক বুদ্ধিকে সুমার্জিত ও সুচালিত করে সেই শিক্ষা, যে শিক্ষা ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান বজায় রাখার উপযোগী শক্তি দেয়, সেই শিক্ষা। …মুসলিম মেয়েদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে না পারলে এ সমাজের উন্নতি কোনও কালেই হবে না। তাই কেবলমাত্র পুরুষের উপর সব কর্তৃত্বের ভার দিয়ে বসে থাকলে আর মেয়েদের চলবে না। এবার নিজেদের হাতেই শিক্ষার ভার নিতে হবে। নারীও যে মানুষ, সভ্য সমাজে তার পরিচয় দিতে হবে। ভিক্ষুকের মতো কেঁদে, পায়ে ধরে চেয়ে, প্রত্যাখ্যান অপমানের পশরা না বয়ে নিজের ন্যায্য অধিকার জোর করে আদায় করে নারীত্বের বন্ধন মুক্ত করতে হবে। শিক্ষা নেই তাই সাহসও নেই—কিন্তু সে শিক্ষা অর্জন করতে হবে। …যে কারা-শৃঙ্খল মুসলমান নারীর পায়ে পরিয়ে তাকে আজ সমস্ত জগতের নারীর সামনে দীনা হীনা করে রাখা হয়েছে, সে শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলতে হবে, চূর্ণ বিচূর্ণ করতে হবে। হয়ত তার পা কেটে ক্ষতবিক্ষত হবে তবু অপমানের হাত থেকে—লজ্জার হাত থেকে নারী মুক্ত হবে। এই তার জয় গর্ব। কারা-শৃঙ্খল যে কেবল মুসলিম নারীকেই তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে তা নয়, সমস্ত মুসলিম সমাজকে ধ্বংসের মুখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
অমিতা গাঢ়স্বরে বলে উঠল, তুমি ১৯২৯ সালে এ কথা বলেছিলে ফজিলতুন নেসা। আজও আশ্চর্য, মুসলিম সমাজের কানে তোমার কথা ঢোকেনি! আজও মুসলিম সমাজ মেয়েদের পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে। কত জন মেয়ে তোমার পরে তোমার মতো এত আর্তি এত ব্যাকুলতা, এত যন্ত্রণাবোধ নিয়ে মেয়েদের শিক্ষার, বিশেষত মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে এসেছে, আমি তা জানিনে ফজিলতুন নেসা। আমি জানিনে। মুসলমান সমাজ তোমাদের কথায় কান যে দেয়নি, সে তো দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু তোমাদের মতো মেয়েকে হিন্দু মন কেন গ্রহণ করেনি? তোমরা আমাদেরই আত্মীয় ছিলে! আমরা তোমাদের জানিনে ফজিলতুন, আমরা হিন্দু শিক্ষিত মেয়েরাও তোমাদের নাম শুনিনি। আজকের আধুনিক মেয়ে হয়েও মেয়েরা তোমাদের লেখা পড়িনি। পড়তে সুযোগ পাইনি। কেন?
কেন শামিম? কেন তোমরা শুধু রাজনীতি নিয়েই পড়ে রইলে? গোড়ার কাজ করতে কেউই এগিয়ে এলে না কেন?
‘সমাজের কোনও পরিবর্তন করতে গেলেই—তা যত বড় উন্নতির জন্যই হোক না কেন—সমাজের সঙ্গে বিরোধ বাধে। আবার সমাজকে বাঁচাতে হলে পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যেতেই হবে। কারণ, যার প্রাণ আছে সে নিশ্চল অবস্থায় থাকতে পারে না। এই জন্য চিরদিনই সমাজের বুকে এমন কর্মীর প্রয়োজন হয়, যারা এই বিরোধের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সব বাধা ভেঙ্গে দিতে পারেন।
ফজিলতুন বলেছিলেন এ কথা। তোমাদেরই তো বলেছিলেন শামিম? তোমরা কেন এতে সাড়া দাওনি?’
‘ফুলকি ফুলকি ফু-ল-কি, আমার ফুলকি! তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাও?’
শামিমের চিঠি তখন এই ভাবেই আসত। ফুলকি অস্থির হয়ে চিঠি খুলত। বারবার চিঠিতে মুখ ঠেকিয়ে বলত, পাই পাই শামিম! তোমার ডাকে আমি স্থির থাকতে পারিনে প্রিয়তম। তুমি কবে আসবে? কবে আসবে? কবে আসবে?
৩৪
‘আমি খুব চেষ্টা করেছিলাম ফুলকি। খুবই চেষ্টা করেছিলাম রেশমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে। খালাকে বলেছিলাম, নীলগঞ্জে মেয়েদের পড়াশুনো করবার ভাল ব্যবস্থা নেই। তোমরা তো আমাকে কৃষ্ণনগরে পাঠিয়েছ, রেশমাকেও সেখানে রেখে দাও। ওখানে তো ভাল ইস্কুল আছে। খালা মেয়েকে ছেড়ে থাকতে চাননি। আমি খালুকে বলেছিলাম, আমার আর রেশমার পড়াশুনা করবার জন্য কৃষ্ণনগরে একটা বাসা নিন। খালা আমাদের কাছে থাকুক। খালু প্রায় রাজি হয়েছিলেন। বাবা কি পরামর্শ দিলেন, খালু মত বদলে ফেললেন। এত কথা তোমাকে জানাচ্ছি এই কারণে, তুমি মুসলিম সমাজে মুসলিম মেয়েদের স্থান নিয়ে আমার সঙ্গে অনেক তর্কবিতর্ক করেছ ফুলকি। মনে পড়ে? আমি কখনও কখনও তোমার প্রশ্নের জবাব না দিতে পারে কোরানের কথা তুলে সমস্যাটাকে তখনকার মতো পাশ কাটিয়ে যাবার চেষ্টা করেছি, এটা ঠিকই। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি নিজের থেকেই উদ্যোগ নিয়েছিলাম ফুলকি, সেই আমার ইস্কুলের জীবন থেকে, সেটা রেশমার শিক্ষার ব্যাপারে। এটা আমার নিজেরই উদ্যোগ ছিল ফুলকি। সেই তখন, যখন জানতাম না, এই দুনিয়ায় ফুলকি বলে একটা আশ্চর্য মেয়ে আছে, তখন তো জানতাম না, একদিন আমার নসিব আমাকে তার সঙ্গে জুড়ে দেবে। ফুলকি ফুলকি ফুলকি, তোমার সংস্পর্শে এসে আমার দুনিয়ার চেহারাই বদলে গিয়েছে।
তুমিও আমাকে অনেক দিয়েছ শামিম। অনেক দিয়েছ। এটা তো একতরফা নয়।
‘মুসলমানের ঘরে জন্মেছিলাম। সে জগৎটার পরিসর এত বড় ছিল না। পড়াশুনা করতে করতে আমার দুনিয়ার বদল শুরু হয়েছিল বলতে পার। তুমি কি জান, আমি যখন কৃষ্ণনগর কলেজে পড়ি, তখন আগস্ট আন্দোলনের একজন সৈনিক হিসাবে আমি প্রায় এক বছর জেল খেটেছিলাম। খালু অনেক তদবির করে আমাকে খালাস করে এনেছিলেন। ফরিদপুরের তমিজুদ্দিন খানকে ধরে খালু আমার মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। আমাকে হিজলি জেলে রাখা হয়েছিল ফুলকি। আমার জীবনে এমন তিক্তকর অভিজ্ঞতা আর হয়নি। বাইরে যে সব নেতাকে কর্মীকে চরিত্রবলের অসাধারণ সব উদাহরণ সৃষ্টি করতে দেখেছিলাম, জেলে ঢুকে তাঁরা সব কোথায় হারিয়ে গেলেন! দেশের জন্য যাঁরা প্রাণ বিসর্জন দিতে গিয়েছিলেন, জেলের মধ্যে যাঁরা অকথ্য নির্যাতন ভোগ করেছেন, তাঁরা আমার নমস্য ফুলকি, কিন্তু তাঁদের মনটা যে এত সংকীর্ণ এটা আমার স্বপ্নেরও অগোচর ছিল। কাছ থেকে তাঁদের দেখে আমি ক্রমশই বিমূঢ় হতে থাকলাম। ক্রমেই আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে লাগলাম। এক এক নেতাকে কেন্দ্র করে জেলে এক একটা কিচেন গড়ে উঠল। বারো রাজপুতের তেরো হাঁড়ি, কথাটা শুনেছিলাম। এখন দেখলাম, কথাটা কত সত্যি। আমরা যারা জেলে এসেছিলাম, তারা সবাই যুদ্ধ বিরোধী ছিলাম। আগস্ট আন্দোলনে আমাদের স্লোগান ছিল, এই যুদ্ধে এক ভাই নয়, এক পাই নয়। আগস্ট আন্দোলনকে আমি জেনেছিলাম, আমাদের মুক্তির আন্দোলন হিসাবে। মুসলমান সুযোগ সুবিধা চায়, স্বাধীনতার ফলটা ভোগ করতে চায় কিন্তু দেশের স্বাধীনতা আনবার জন্য কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে চায় না। এই ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের একটা প্রধান অভিযোগ। সে অভিযোগ মিথ্যা নয় ফুলকি। আমি যে আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলাম, সেটা দেশ স্বাধীন করবার প্রবল আবেগে। আমি কলেজের মুসলমান সহপাঠীদের বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, আগে দেশের স্বাধীনতা আসুক, পরে নিজেদের হিস্যা আদায় করে নেওয়া যাবে। জলে মাছ, সেটা ধরার আগেই পাড়ে বসে মাছের ভাগ কে কতটা নেবে তাই নিয়ে ঝগড়া করা কি মূর্খতা নয়? এ সব যুক্তি আমি দিতাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, আমার মুসলমান সহপাঠীরা এটাকে কোনই গুরুত্বই দেননি। এই সব কারণে, স্বভাবতই আমার পলিটিকসের যারা বন্ধু ছিল, তারা সবাই হিন্দু। আমি কলেজে মুসলিম ছাত্রদের কাছে একঘরে হয়ে পড়েছিলাম। এবার জেলে এসে আবার একঘরে হয়ে পড়লাম। কারণ আমি কোনও কিচেন পলিটিকসে যোগ দিইনি।
এই কিচেন পলিটিকস নিয়েই না তুমি মাঝে মাঝে ঠাট্টা পরিহাস করতে শামিম? তুমি যে একে চিকেন পলিটিকস বলতে, সেটা কি এই জন্য? তুমি একবার বলেছিলে শামিম, বাইরে থেকে যে সব নেতাদের সিংহ ব্যাঘ্র বলে মনে হয়, আদতে তারা যে সব চিকেন হার্টেড, সেটা বোঝা যায় তাঁদের হেঁশেলে গিয়ে দাঁড়ালে। সেটা কি তোমার এই অভিজ্ঞতার ফসল?
‘বাইরে যে সব নমস্য নেতারা ঐক্য চাই ঐক্য চাই বলে ময়দান ফাটিয়ে দিতেন, আমি জেলে গিয়ে দেখি ফুলকি, তাঁরা সব কিচেনে কিচেনে ভাগ হয়ে গিয়েছেন। গান্ধীবাদীদের একটা কিচেন, বিপিসিসি-র একটা কিচেন, সোস্যালিস্টদের আলাদা কিচেন, ফরওয়ার্ড ব্লক বন্ধুদের আলাদা কিচেন, আর সি পি আদের আলাদা কিচেন, মেদিনীপুরের বিপ্লবী বন্ধুদের আলাদা কিচেন। সবারই কিচেন আছে ফুলকি, শুধু ভারতমাতারই কোনও কিচেন ছিল না। না ছিল। সেটা জেলের সাধারণ কয়েদীদের কিচেন। আমি সেই কিচেনেই যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও কি নিস্তার পেয়েছি?’
শামিম! বেচারি শামিম!
‘সকাল হতেই এক এক কিচেনের মাতব্বর জেল গেটে গিয়ে হাজির হতেন, আর নিজের নিজের তালিকা অনুযায়ী রসদ কড়ায় গণ্ডায় কনট্রাক্টরের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে বিজয় গর্বে নিজেদের খাতায় ফিরে আসতেন। পান থেকে চুন খসলেই জেল কর্তৃপক্ষের ঘুম নষ্ট হত। সরেস জিনিসগুলো ওঁদের কিচেনে ঢুকে গেলে ঝড়তি পড়তি যা থাকত, সে সব যেত ভারতমাতার কিচেনে। সেখানে খাওয়া দাওয়া কি হচ্ছে সে খোঁজ নিতে কোনও নেতাকে কোনও দিন দেখিনি। কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে ফুলকি, সাধারণ কয়েদীদের মধ্যে একটা বেরাদরি ছিল। আমি ওদের মধ্যেই সহজে নিঃশ্বাস নিতে পারতাম। আর তাই আমার কাল হয়েছিল। নেতাদের কিচেনে কিচেনে একের প্রতি অন্যের কি অবিশ্বাস, কি দলাদলি, কি বিদ্বেষ কি বিদ্বেষ! এখনও আমার তাকে দুঃস্বপ্ন বলে মনে হয়।’
শামিমের চিঠির কয়েকদিন পরে আবার এল।
‘ফুলকি ফুলকি, আমার ধ্রুবতারা!
‘গতবারে তোমাকে বেশ একটা বড় চিঠি লিখেছি। সত্যি কথা বলতে কি, চিঠিখানা অসমাপ্ত রেখে তোমাকে পাঠাতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু তখন আর আমার হাত চলছিল না। মাঝে মাঝে আমার ভয় হচ্ছিল ফুলকি, আমি কি তবে পঙ্গু হয়ে যাব?’
না শামিম, না। তুমি এমন করে আমাকে ভয় দেখিও না। কবে তোমাকে দেখব, কবে তোমাকে আবার পাব, তার জন্য মাঝে মাঝে উতলা হয়ে পড়ি ঠিক,ল কিন্তু আমি তোমার চিঠি পাবার পর সামলে নিচ্ছি নিজেকে। তুমি, দোহাই, তোমার শরীরের দিকে নজর দাও। সুস্থ হয়ে তবে এসো। তোমাকে তো চিঠি লেখার উপায় নেই। এ যে কি যন্ত্রণা। তুমি আশা করি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? পাচ্ছ তো শামিম?
তখন কি পাগলামিতেই না পেয়েছিল ফুলকিকে। অমিতা সেদিনের কথা মনে করার চেষ্টা করল।
‘এত ক্লান্ত লাগে! এখন শুধু সুস্থ হবার অপেক্ষা, এখন শুধু তোমার কাছে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা—এ ছাড়া আমার আর কোনও ইচ্ছা নেই ফুলকি আর হ্যাঁ, এখন তোমাকে আমার মনের সব কথা, সব ভাবনা উজাড় করে দেবার ইচ্ছেটা পেয়ে বসেছে। সেদিন সবটা বলতে পারিনি। ইচ্ছে ছিল, শরীরে কুলোয়নি।
তোমাকে অত ঝুঁকি নিতে হবে না শামিম। যতটুকু শরীরে কুলোয়, এখন ততটুকু পরিশ্রম করাই তোমার উচিত।
‘শরীর এলিয়ে আসে ফুলকি, তবু তোমাকে চিঠি লিখি। কারণ ওই সময়টুকুতেই তুমি আমার কাছে থাক। তোমাকে দেখতে পাই, তোমাকে ছুঁতে পাই ফুলকি। তাই লেখাটা বন্ধ করতে পারিনে।’
শামিম, শামিম! আহ্!
‘আগেরবারের চিঠিতে তোমাকে রেশমার লেখাপড়া শেখাবার জন্য আমার আগ্রহের কথা বলেছিলাম। তখনও তোমাকে দেখিনি ফুলকি। তুমি যে এ জগতে আছ, তোমার মতো মেয়ে এ জগতে থাকতে পারে, এটাই আমি জানতাম না। তোমার মতো মেয়ের সান্নিধ্য, তোমার প্রেম আমার মতো ছেলের অন্তরে যে কি উত্তরণ ঘটাতে পারে, সেটা ছিল আমার অজানা। ফুলকি ফুলকি ফুলকি! শুধু এই একটা উচ্চারণত আমাকে উজ্জীবিত করে তোলে। আমার চারপাশের সমস্ত সংকীর্ণতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মহামানবের সাগরতীরে। তখনই বুঝতে পারি আমার পরিচয় মানুষ। আমি মানুষ ছাড়া আর কিছুই নই। এটা তোমার দান ফুলকি।
কবেকার চিঠি! অনেক অনেকদিন আগেকার, যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগেরই, সেই চিঠি! অমিতা শামিমের চিঠিখানা উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। জীর্ণ। বিবর্ণ। তবু কী আবেগ! কী আবেগ! সেই আবেগ অমিতাকেও যেন দুলিয়ে দিল। কবে এ চিঠি লিখেছিল শামিম? অমিতা সেই পোকায় খাওয়া চিঠিখানা থেকে তারিখটা দেখে নেবার চেষ্টা করল। *ই জুন (তারিখ পোকার পেটে চলে গিয়েছে) ১*৪৫। অমিতা শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। দেখতে চেষ্টা করল সেদিনের ফুলকিকে, যেদিন সে চিঠি পেয়েছিল।
‘তুমি আবার শুয়ে পড়লে কেন মা?’ মন্টুর মা ধীরে ধীরে অমিতার কাছে এসে দাঁড়াল। ‘খাবার তৈরি করে সেই কখন থেকে বসে রইছি গো। খেয়ে নেবে না, হ্যাঁ মা?’
খাব, মন্টুর মা, খাব। একটু শুয়ে নিই।
চিঠিখানা পড়তে পড়তে ফুলকির মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। আবেগে তার সর্বশরীর দুলছিল তখন। সে তখন থমকে গিয়েছিল। চিঠিখানা কোলের উপর মেলা ছিল তার। অনেক রকম অনুভূতি তার বুকের মধ্যে জমা হচ্ছি। সে যেন তখন একটা চায়ের কেটলি। অনুভূতিগুলোর কোনও স্পষ্ট আকার ছিল না। একটা অসহ্য অস্থিরতা তার বুক ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছিল। তার ঠোঁট দুটো কেবলই তিরতির করে নড়ছিল সে কি মনে মনে কাঁদছিল? শামিম শামিম! সে কি গুনগুন করছিল? হ্যাঁ, তার মনে সেই গানটাই গুনগুন করে বেজে উঠল, যে গানটা নমিতাদের ঘরে তুমি গেয়েছিলে শামিম। সেই গানটাই ফুলকি দেখল সে মনে মনে গেয়ে চলেছে।
‘মম হৃদয়রক্তরাগে তব চরণ দিয়েছি রাঙিয়া,
অয়ি সন্ধ্যাস্বপনবিহারী।
তব অধর এঁকেছি সুধাবিষে মিশে মম সুখদুখ ভাঙিয়া—
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম বিজনজীবনবিহারী।।’
শামিম, শামিম! যে আমাকে তুমি জানো, সেই আমিই আমি কি না, আমি ঠিক বুঝতে পারিনে। তবে এটা জানি শামিম, আমার অনেকটাই তোমার আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তুমিই রচনা করে নিয়েছ। তুমিও আমাকে তৈরি করেছ্ শামিম।
বলতে বলতেই ফুলকির চোখ দিয়ে টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা করে জল ঝরে তার কোলের উপর পড়তে লাগল। ফুলকি চিঠিখানা সরিয়ে নিল।
‘ফুলকি আমি মুসলমান, এ কথা আমি ভুলতে চাইলে কি হবে? ভুলতে দিচ্ছে কে? আমার কলেজের বন্ধুরাও, কি হিন্দু কি মুসলমান, কেউ আমাকে ভুলতে দেয় না। এমন কি যাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছিলাম, ভারত ছাড়ো, যাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলেছিলাম, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে, জেঁলে সেই তাদের চোখেও ধরা পড়ল, আমি মুসলমান। মুসলমান বলেই আমি ওদের কোনও কিচেনে মাথা মাড়াচ্ছিনে। ওঁরা প্রথমে বলেছিলেন, ও মুসলমান তাই কানা গোরুর ভিন্ন গোঠ। পরে আমাকে সন্দেহ করতে লাগলেন, আমি একজন কমিউনিস্ট স্পাই। ওদের কাজকর্মের উপর নজর রাখবার জন্যই আমি নাকি জেলে এসে ঢুকেছি। ফুলকি, ফুলকি! সেই দিনগুলোর স্মৃতি আমি মনে আনতে চাইনে। তবু এসে পড়ে। কমিউনিস্টদের সঙ্গে আমার কোনও পরিচয়ই তখন ছিল না। আমরা ‘ভারত ছাড়ো’ করছিলাম, আমরা ‘এই যুদ্ধে এক ভাই নয় এক পাই নয়’ এই জিগির তুলেছিলাম, কমিউনিস্টরা ‘জনযুদ্ধে’র জিগির তুলেছিল তখন। আমাদের বলছিল, পঞ্চম বাহিনী। সত্য মিথ্যা জানিনে, কমিউনিস্টরা নাকি আমাদের খুঁজে খুঁজে পুলিশকে খবর দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছিল। আমি মুসলমান, সম্ভবত কিচেনের দাদারা, যাঁরা তখন একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, হিংসা, বিদ্বেষ, নানা রকম অপবাদ ছড়িয়ে জেলের ভিতরকার আবহাওয়া কলুষিত করে তুলেছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন আমি বেওয়ারিশ, তাই আমাকে সরাসরি কমিউনিস্ট স্পাই অপবাদ দিতে ওঁদের বাধেনি। ফুলকি, তোমার সঙ্গে আমার যখন পরিচয় ঘটতে শুরু করেছে, সেই তখন আমার আড়ষ্টতাকে তুমি আমার হীনম্মন্যতা বলে মনে করেছিলে।’
ভুল করেছিলাম, শামিম!
‘যে লোক চারদিক থেকে এত ঘা খায়, তার হীনম্মন্য না হয়ে আর কি উপায় থাকে, ফুলকি?’
শামিম যেন ফুলকির দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে। অমিতার তাই মনে হল।
মন্টুর মা বলল, ‘হাঁ গা মা, খাবার গরম হয়ে গিয়েছে, এখন দিই তোমাকে?’
অমিতা বলল, তখন তো তুমি এ সব কথা বলনি শামিম! তাই তোমাকে বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু সে বাধা তো আমি কাটিয়ে উঠেছিলাম শামিম। উঠিনি কি?
‘সত্যি বলতে কি, তোমাদের দেখে, তোমাকে, তোমার বাবাকে, তায়েবচাচাকে দেখে, ফুলকি তোমাকে পেয়ে মানুষ সম্বন্ধে আমার নতুন ধারণা হল। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সেই কথাটার অর্থ তোমাদের সঙ্গে মিশেই বুঝেছি ফুলকি।
ফুলকি ব্যাকুল হয়ে বলে উঠেছিল, তোমার প্রতি আমাদের পুরো বিশ্বাস আছে শামিম। তোমার উপর নির্ভর করেই তো আছি আমি।
অমিতা চিঠিখানাকে এক পাশে রেখে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বাথরুমে যেতে যেতে বলল, মন্টুর মা, খেতে দাও।
‘তোমার বাবা একটা কথা বলেছিলেন ফুলকি, আমি যেটা কখনই ভুলতে পারিনে। কাকাবাবু বলেছিলেন, দেখ শামিম, দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে এত চেঁচামেচি আমরা যে করি, আমরা কতজন জানি যে, এরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। পশুদের বাঁচার জন্য একটা গণ্ডি দিয়ে ঘেরা জায়গা চাই না। না হলে তাদের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। তাই পশুর জন্য বিচরণযোগ্য দেশ চাই। কিন্তু মানুষের পক্ষে এ কথা খাটে না। কেন না, মানুষ শুধু টিকেই থাকতে চায় না, সে উত্তরণ চায়। আর তার জন্য চাই দেশ এবং কাল। মানুষ একই সঙ্গে দেশ এবং কালে বাস করে। শুনতে খুব সোজা। কিন্তু বুঝে দেখতে গেলে, দেখতে পাবে, এর মধ্যে অনেক জিনিস আছে। মানুষের উত্তরণ বলতে বৃহত্তর মানব সত্তার সঙ্গে খণ্ড খণ্ড মানব সত্তার মিলন বোঝায়। দেশ মানেই খণ্ড ভূমি। দেশভক্তি মানেই স্বতন্ত্রতা, দেশ মানেই বিচ্ছিন্নতা। মানুষ যেমন স্বতন্ত্রতাও চায়, তেমনি আবার মানুষের জন্য চাই এক বিরাট মানব সত্তার বোধ। সেই মানব সত্তাই একমাত্র অখণ্ড। আর তার মধ্যে মিশে যাওয়াই মানুষের সমাজে মিশে যাওয়া হিন্দু সমাজ মুসলমান সমাজ খ্রিস্টিয়ান সমাজ বৌদ্ধ সমাজ, এ সবই বৃহত্তর যে মানুষের সমাজ তারই খণ্ড খণ্ড রূপ শামিম। দেশচেতনা আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, কালচেতনা মানুষকে পূর্ণ রূপে ভাবতে সাহায্য করে। তুমি যে দেশে আছ, যেমন তার কথা ভাববে, কিন্তু সেইখানেই থেমে পড়বে না, তোমাকে ভাবতে হবে, যে-কালে তুমি আছ তার কথাও। এই কালচেতনাই মানুষকে মানুষের সম্পর্কে সচেতন করে তোলে, মানুষের মনে একটা বিশ্ব বোধ জাগায়, সমগ্র মানুষই এক জাতি, এই সুস্থ ধারণাতে আমাদের অবশেষে পৌঁছে দেয়। কাল সম্পর্কে তোমরা সচেতন হও শামিম। এটার জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করতে হয়। দুনিয়ার দিকে চোখ মেলে চাইতে হয়। দুনিয়াকে বুঝতে হয়। দেশের মধ্যে হানাহানির গন্ধ পাচ্ছ, কিন্তু আজকের কালে বিশ্ব কি বলছে? সে বলছে, বিদ্বেষের পথে মানুষের সঙ্গে মানুষের সমঝোতা আসবে না, আসবে মিলনের পথে, সহযোগিতার পথে। মানুষের সমাজ সেই পথই নির্দেশ করছে ফুলকি। আর আমরা সবাই তাকিয়ে আছি অতীতের দিকে। পিছনের দিকে। পিছনের আলো পথ দেখাতে পারে না শামিম। এগোবার পথে ছায়া ফেলে। পথ দেখায় সামনের আলো।’
কিন্তু আলো তো অমিতার সামনেও নেই, পিছনেই নেই। অমিতা খেতে খেতে মুখ তুলল। একটু থামল।
‘হ্যাঁ গো মা, রান্না কি খেতে পারছনি। ওই যে তোমার দোকানি, এত করে বললাম, তেলটা দেখে দিও বাপু, ভাল তেল দিও। মায়ের মুখ খুব অরুচি। কিন্তু ক্যা কার কতা শোনে? দোকানের জিনিস, যা দিচ্ছি তাই নিতে হবে।
‘জাতীয়তাবাদী মুসলমান! কথাটা কেমন শোনায় ফুলকি?’
‘হয়ত বননু—দোকানি, আমার মা অসুস্থ গো, জিনিসগুলো একটুকুনি দেকে শুনে দাও না? তা মিনসের কি চোপা গো? বললে, লেবে তো লাও আর লা হয় পথ দেখো। ইচ্ছে করে বলি, ক্যান রে মুখপোড়া, আমি কি তোর কাছে ভিক্ষে চাইতে এয়েচি, না জিনিস তুই মিনিমাঙনায় দিচ্ছিস যে অত চোপা?’
‘আর কারো বেলায় তো বিশেষণ জুড়ে দেওয়া হয় না, বলা হয় কি জাতীয়বাদী হিন্দু, বলা হয় কি জাতীয়বাদী খ্রিশ্চান, তবে জাতীয়তাবাদী মুসলমান কেন? এটা কি মুসলমানের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট ফুলকি? সেই রকমই শোনায় না?’
‘নোক মা, নোক। আজকালের নোকগুলো সব অমন ধারাই হয়ে উঠেছে।’
‘চিঠি বড় হয়ে যাচ্ছে। আজ অনেক জ্বালাযন্ত্রণার কথা তোমাকে অকপটে বলে ফেললাম। এ সব কথা শুধু তোমার কাছেই বলা যায় ফুলকি। শুধু তোমাকেই বলতে পারি।’
তুমি তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে ওঠো শামিম। তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমি তোমার সব জ্বালার অবসান ঘটিয়ে দেব শামিম। আমার ভালবাসা দিয়ে।
‘তোমাকে রেশমার কথা বলতে গিয়েছিলাম। রেশমা আমার খালার মেয়ে। রেশমা আমার বোন। ওকে আমি খুব ভালবাসি ফুলকি। আমাদের দুজনের বয়সে বেশ তফাত তবুও আমি ছিলাম ওর খেলার সাথী। ও ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। আর ওর লেখাপড়া শেখাবার জন্য আমার উদ্বেগ বেড়েই চলল। খালুর টাকায় আমি লেখাপড়া শিখছি। আর তার নিজের মেয়েই এ ব্যাপারে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে। আমার কেমন অপরাধী অপরাধী লাগত নিজেকে। বাবার পাল্লায় পড়ে খালু মেয়েকে ইসলামি শিক্ষা দেওয়াই সাব্যস্ত করলেন। বাড়িতে মৌলবী এল। কোরান পাঠ শুরু করল রেশমা। আমি দেখতে পেলাম মেয়েটার ভবিষ্যৎ গেল। কৃষ্ণনগর থেকে যখন আসতাম বিদ্যাসাগরের বর্ণ পরিচয় প্রথম ভাগ, দ্বিতীয় ভাগ, বোধোদয়, কথামালা এনে দিতাম রেশমাকে। বাড়ি এসে শুনতাম, মৌলবী ও সব পড়তে বারণ করেছেন। একদিন রেশমাকে বললাম, তুই কি পড়িস দেখি? রেশমার কোরান পড়ার ততদিনে বেশ এগিয়ে গিয়েছে। এখন দেখাল। বললাম, আর কিছু তুই পড়িস না? রেশমা বটতলার ছাপা অনেকগুলো পাতলা পাতলা বই এনে দেখাল। ওঁরা বলেন, পুঁথি। অদ্ভুত সব বই ফুলকি। আমি কোনও দিন যার নামও শুনিনি। শাহনামা, আমীর হামজা, আলেফ লায়লা, চাহার দরবেশ, কাসাসুল আম্বিয়া, শহীদে কারবালা, জঙ্গনামা, কেয়ামতনামা, গোলে বাকাউলি। এ সব কী!’