প্রতিবেশী – ২.২৫

২৫

‘আমাদের অভক্তি কেবল অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, ধর্মব্যবসায়ী মোল্লার প্রতি।’ এই সোচ্চার ঘোষণা যেন ফুলকির খাতার পাতা থেকে উঠে এল। ‘যে মোল্লা শয়তানের বিরুদ্ধে যায়, সে মোল্লাই না।’

মহিলা ‘সওগাতে’ লিখেছিলেন ওমদাতুন্নেছা খাতুন। ফুলকি তার খাতায় টুকে রেখেছিল।

‘মাতৃভাষা বাঙ্গালা ও রাজভাষা ইংরেজি শিক্ষার বিরুদ্ধে যে মোল্লা ফতোয়া দেয়—সে মোল্লায় আমাদের অভক্তি।’

কে তুমি ওমদাতুন্নেছা? অমিতা একবার চাইল তার অন্ধকার ঘরের চারদিকে।

‘মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষাদানের জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ প্রাণপণ চেষ্টা করেন, সেই মহাপ্রাণ স্যার সৈয়দ আহমদকে যাহারা কাফের বলিয়াছেন, আমরা সেই সব মোল্লার উচ্ছেদ কামনা করি।’

তায়েবকাকা, তুমি বলেছিলে, গিরীশ সেন কোরান অনুবাদ করেছিলেন বলে গিরীশ সেনকে সেই আমলের মুসলমানেরা শ্রদ্ধা জানিয়েছিল ‘মওলানা গিরীশ’ নাম দিয়ে। মনে পড়ে? এখন তো দেখছ তায়েবকাকা, তোমার কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। হয়ত তোমার মতো কয়েক জন তাঁকে ‘মওলানা গিরীশ’ নাম দিয়ে থাকতেও পারেন কিন্তু মোল্লারা তাঁকে কাফের বলেছিল। মোল্লারা তাঁর মাথা কেটে কুকুর দিয়ে. খাওয়াতে চেয়েছিল। কে এই সত্যবাদিনী ওমদাতুন্নেছা, তায়েবকাকা? তুমি কি তাকে চেন? তুমি কি তাকে চিনতে?

‘এক কথা’, যে মোল্লার দল অশিক্ষিত ও দরিদ্র মুসলমান সমাজকে বোকা বানাইয়া আরও অন্ধকারে লইয়া যাইতেছে, তাহাদেরই কষ্টোপার্জিত অর্থে নিজেদের উদর পূর্ণ করিয়া তাহাদের আর্থিক ও নৈতিক উন্নতির পথ রুদ্ধ করিয়া দিতেছে,—আমরা সেই সব মোল্লার বিনাশ কামনা করি।

কী বুকের পাটা তোমার ওমদাতুন্নেছা! তোমার সমাজের যারা সব চাইতে শক্তিশালী গোষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে এমন সরাসরি বিদ্রোহ করার সাহস তুমি কোথায় পেলে?

অমিতা এখন অন্ধকারে। ঘরে। আলোর প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। ফুলকি তখন আলোতে। দুপুরে। রোগশয্যায়। গিরিডির ধকল কাটাচ্ছে। তার হাতে মহিলা সওগাত। শামিম তাকে দিয়ে গিয়েছে। গোগ্রাসে যেন গিলছে ফুলকি মহিলা সওগাতের পাতাগুলো। পাশে একটা বাঁধানো খাতা। ফুলকির নিত্য সঙ্গী ছিল এই খাতাটা তখন। ফুলকি পড়ছে। কখনও বা খাতার পাতা ভরে তুলছে।

‘বাঙ্গালার নারীদের শিক্ষার সর্বাপেক্ষা প্রতিবন্ধন মোল্লা সমাজ। শিক্ষার আলোক পাইলে নারীদের মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দিবে, পতিভক্তি কমিয়া যাইবে—মোল্লাদের এ সমস্ত আশঙ্কা অমূলক। তাহারা এ কথা ভাবিয়া দেখেন না যে, নারীজাতিকে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া হইলে তাঁহারা শুধু উপযুক্ত গৃহিণী বা উপযুক্ত মাতা হইয়া উঠেন না, সঙ্গে সঙ্গে, তাঁহার স্বামীর উপযুক্ত পরামর্শদাত্রী ও সত্যকার সহধর্মিণী হইয়া উঠেন।’ ফিরোজা বেগম এই কথা ঘোষণা করেছিলেন মহিলা সওগাতে। আজ নয় ফুলকি। এই শতকের প্রথম দিকে। ভাবা যায়!

‘যে সংসারে মুখ্যু মেয়েলোক থাকে সে সংসারের ভাষ্য থাকে না।’ বুড়ি তুমি বলতে এ কথা? তুমি কি ফিরোজা বেগমকে চেন? চিনতে তুমি তাকে? তোমার কথার সঙ্গে এদের কথার এত মিল পাচ্ছি কেন?

‘আজ সত্যই মুসলিম মাতা-ভগিনীদের শিক্ষা চাই, মুক্তি চাই।’

বুড়িও এই ধরনের কথা বলত ফিরোজা বেগম। তুমি নিশ্চয়ই তাকে চিনতে না। অথচ কী মিল কী মিল তোমাদের মনের সঙ্গে বুড়ির মনের।

ফুলকি নাওয়া খাওয়া ত্যাগ করেছিল প্রায়। কী হতাশায় ভুগছিল তখন। মহিলা সওগাতের একজন লেখিকা তার সেই হতাশ প্রাণে আশা জাগিয়ে তুলেছিল। তার বাঁচার একটা অর্থ এনে দিয়েছিল। এক একটা রচনা যেন এক একটা বিস্ফোরক। এমন অনুভূতি ফুলকির কখনও হয়নি, কারও লেখা পড়ে। ফুলকি তখন এক একটা লেখা পড়ছে, আর তার চোখের সামনে থেকে এক একটা করে অন্ধকারের পর্দা সরে যাচ্ছে। কেন সে এদের সন্ধান এতদিন পায়নি। শামিম শামিম, তুমি এই পত্রিকাটা না এনে দিলে জানতেও পারতাম না এমন একটা আশ্চর্য জায়গা আছে মানুষের সমাজে? আমাদের সমাজে? নারীদের সমাজে? এটা তো একটা আকস্মিক ঘটনা যে, সওগাত পত্রিকা আমার হাতে এসে পড়েছিল। নাও তো পড়তে পারত? তাহলে কি করে জানতাম, তোমরা ছিলে আমার এই পৃথিবীতে? কি করে তোমাকে চিনতাম ওমদাতুন্নেছা? কি করেই বা তোমাকে চিনতাম ফিরোজা? তোমরা তো এক একটা আগুনের ফুলকি! কী করে তোমরা তোমাদের ব্যথা এমন করে প্রকাশ করতে পারলে? তোমাদের গর্দান যায়নি?

‘মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো প্রত্যেক পিতামাতার অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহতালা মানুষকে বুদ্ধি বলে একটা জিনিস দিয়েছেন।’ বলেছিলেন বদরুন্নেছা খাতুন। ‘এই বুদ্ধি বা বিবেক জিনিসটাকে জ্ঞানচর্চার দ্বারা যতই মাজাঘষা করা যায় ততই এর উন্নতি সাধিত হয়। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির যেরূপ দ্রুত উন্নতি লাভ হয়, এমনটি আর কিছুতে হয় না।’

শামিম, শামিম, তুমি একদিন বলেছিলে, কোরানে নারীদের যে স্থান নির্দিষ্ট করা আছে পাকিস্তানে মুসলিম নারীদের জন্য সেই রকম উচ্চস্থানই রেখে দেওয়া হবে। সেদিন তোমার সঙ্গে আমার কিছু তর্ক হয়েছিল শামিম। তোমার উপর আমার আস্থা ছিল। কিন্তু তবুও তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল হচ্ছিল না।

শামিম বলেছিল, ‘ফুলকি, আমাদের এখনকার সমাজকে দেখে তুমি বিচার কর না। বরং খোঁজ নিয়ে দেখ কোরানে মুসলিম রমণীকে কি অধিকার দেওয়া হয়েছে। পুরুষের যত অধিকার, নবী বলেছেন, নারীরও সেই অধিকার আছে। তুমি সেদিন বলেছিলে, মাবিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে রসুলুল্লাহ্, আমার উপর আমার স্ত্রীর কি দাবী আছে?’ এতেই কি বোঝা যায় না ফুলকি, ইসলাম কত গুরুত্ব দিয়েছে নারীকে। কোরানে বলা হয়েছে, নারী পুরুষের অংশ। কোরানে বলা হয়েছে, নারীর অধিকার পবিত্র—তাহাতে হস্তক্ষেপ করিও না। কোরানে বলা হয়েছে, জগৎ এবং জগতের যাবতীয় বস্তুই মূল্যবান, কিন্তু নারীই সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্যবান সামগ্ৰী।

এর আগে তোমাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম শামিম, তুমি কি কোরান পড়েছ? তুমি তখন বলেছিলে, না। তবে মুসলমান মাত্রেই কোরানের বাণীকে জানে। বুঝলাম তুমি এই দিন কোরানকে ঝালিয়ে এসেছিলে।

আমি সেদিন বলেছিলাম, কোরানে তো নারীকে উচ্চস্থানে রাখা হয়েছে। আমি বলছি এখনকার সমাজের কথা। শামিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কি মিসেস এম রহমানকে চেন? শামিম অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কে মিসেস্ এম. রহমান?

মিসেস এম রহমান কে তা আমিও জানিনে শামিম? মহিলা সওগাতে ওর লেখা পড়েছি আমি। তুমি একটু খোঁজ নেবে? আমি ওদের সঙ্গে দেখা করব? তুমি ইসলামের ব্যবস্থার কথা বললে না? শোন শামিম এই মহিলা কী বলছেন।

‘ইসলামে আমাদের জন্য কি ব্যবস্থা দিয়েছে, তা না জেনে জানবার চেষ্টা না করে এতদিন শুধু প্রভুদের হুকুম তামিল করে এসেছি, আর তা করব না। মোসলেম রমণী আমরা, আমাদের ধর্মতঃ প্রাপ্য অধিকার দাবী করছি। নারীর নব জাগরণের যুগে অনুষ্ঠানকে ধর্ম বলে মানব না।’

‘মহিলা এই সব কথা লিখে গিয়েছেন ফুলকি! তাজ্জব। আমি এঁদের কথা কিছু জানিই নে।’ শামিম উত্তরোত্তর বিব্রত হয়ে উঠেছিল।

‘ইসলাম আমাদেরকে কারাপ্রাচীরের ভিতরে অবরুদ্ধ থাকতে, জড় পুত্তলিকার মত গৃহসজ্জার উপকরণ হয়ে থাকতে বলেনি, জ্ঞানলাভ অবশ্যকর্তব্য বলে নির্দেশ দিয়েছে।’

আয়েষা আহমেদ কে শামিম, জানো? এর নাম কখনও শুনেছ?

‘না ফুলকি। না।’

‘আমাদের বহু বর্ষব্যাপী অশিক্ষা ও কঠোর অবরোধপ্রথা অনেকাংশই আমাদের নারীর অধঃপতিত অবস্থার জন্য দায়ী। …সমাজের রীতি-নীতি নারীর মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে প্রতি পদে বিঘ্ন আনয়ন করিতেছে। এই নিত্য পরিবর্তনশীল জগতে কত জাতির উত্থান-পতন হইতেছে, কত নূতন উদ্‌ভাবনা আবিষ্কার পুরাতনের স্থান অধিকার করিতেছে, কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষতঃ আমাদের নারীর অবস্থা আবহমানকাল হইতে একই রূপ আছে। নারী চিরকালই মূর্খ ও হেয়।’

ফুলকি বলেছিল, এ সব জানলে কি মনে হয় না শামিম তোমার কোরানের বাণী পাষাণে নিষ্ফল মাথা কুটে বিলীন হয়ে গিয়েছে? তোমার এ কথা মনে হয় না?

‘জ্ঞানতঃ শুনে আসছি, মোসলমান জাতের মত পর্দা কোনও জাতের নেই। এখন জিজ্ঞাসা এই যে, ইসলাম আমাদের জন্য কিরূপ পর্দার ব্যবস্থা দিয়েছে? আব্রু রক্ষা করা না অর্ধ-উলঙ্গাবস্থায় অবরোধে বাস করা?

এই সব দারুণ প্রশ্ন এই সব মহিলারা তুলেছিলেন এই শতকের গোড়া থেকে তিনটি দশক ধরে। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত বলেছেন, ‘আচ্ছা, দেশকালের নিয়মানুসারে কবির ভাষায় স্বর মিলাইয়া না হয় মানিয়া লই যে, আমরা স্বামীর দাসী নহি—অর্ধাঙ্গী। অথবা তাঁহাদের গৃহে গৃহিণী, মরণে (না হয় অন্ততঃ তাঁহাদের চাকুরি উপলক্ষে যথা তথা) অনুগামিনী, সুখ দুঃখে সমভাগিনী, ছায়াতুল্যা সহচরী ইত্যাদি। কিন্তু কলিযুগে আমাদের ন্যায় অর্ধাঙ্গী লইয়া পুরুষগণ কিরূপ বিকলাঙ্গ হইয়াছেন। তাহা কি কেহ একটু চিন্তাচক্ষে দেখিয়াছেন? আক্ষেপের (অথবা ‘প্রভুদের সৌভাগ্যের) বিষয় যে, আমি চিত্রকর নহি—নতুবা এই নারীরূপ অর্ধাঙ্গ লইয়া তাঁহাদের কেমন অপরূপ তাহা আঁকিয়া দেখাইতে পারিতাম। শুক্লকেশ বুদ্ধিমানগণ বলেন যে, আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়—ওই শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। …মনে করুন, কোন স্থানে পূর্ব দিকে একটি বৃহৎ দর্পণ আছে, তাহাতে আপনি আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিতে পারেন। আপনার দক্ষিণাঙ্গ পুরুষ এবং বামাঙ্গ স্ত্রী। এই দর্পণের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দেখুন—

আপনার দক্ষিণ বাহু দীর্ঘ (ত্রিশ ইঞ্চি) এবং স্থূল, বাম বাহু দৈর্ঘ্যে চব্বিশ ইঞ্চি এবং ক্ষীণ। দক্ষিণ চরণ দৈর্ঘ্যে ১২ ইঞ্চি, বাম চরণ অতিশয় ক্ষুদ্র। দক্ষিণ স্কন্ধ উচ্চতায় পাঁচ ফিট, বাম স্কন্ধ উচ্চতায় টারি ফিট। (তবেই মাথাটা সোজা থাকিতে পারে না, বাম দিকে ঝুঁকিয়া পড়িতেছে কিন্তু আবার দক্ষিণ কর্ণভারে বিপরীত দিকেও ঝুঁকিয়াছে। ) দক্ষিণ কর্ণ হস্তি কর্ণের ন্যায় বৃহৎ, বাম কৰ্ণ রাসভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ। দেখুন! ভাল করিয়া দেখুন, আপনার মূর্তিটা কেমন!! যদি এ মূর্তিটা অনেকের মনোমত না হয়, তবে দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না। সে কেবল একই স্থানে (গৃহ-কোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছে না।

ফুলকি যখন প্যারাগনে বসে বেগম রোকেয়ার রচনা থেকে শামিমকে এই অংশটুকু পড়ে শোনাচ্ছিল, তখন সে মাঝে মাঝে মনে মনে হেসে উঠছিল। সম্ভবত তার গলার স্বরেও এর প্রভাব কিছু পড়ে থাকবে। নয় তো শামিম সে সব জায়গায় ওর দিকে বার বার চাইছিল কেন? শামিম কি ধরে নিচ্ছিল যে, ফুলকি ওকেই পুরুষ জাতির প্রতিভূ বলে ধরে নিয়েছে? ঠিক জানে না ফুলকি। শামিম তুমি কি সেদিন অস্বস্তি বোধ করছিলে?

মেয়েদের কত সম্মান করে আমাদের সমাজ তা দেখাবার জন্য কত শত উদাহরণ দেয় যে গুরু পুরুতরা, তারা বলে তোমরা দেবী, তাদের বাড়িতে কখনও উঁকি দিয়ে দেখেছ বউমা? বাড়ির মেয়েদের উদয়াস্ত খাটতে খাটতে যে আয়ুক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, ভ্রুক্ষেপও নেই মদ্দদের। কচি কচি মেয়ে বিয়ে হয়ে ঘরে এসেছে, তারপর থেকেই বিয়োতে বিয়োতে হাড়ি সারা হয়ে যাচ্ছে। সূতিকায় মরছে, যক্ষ্মায় মরছে। ওর মধ্যে যারা বিধবা তাদের তো মানুষ বলেই জ্ঞান করা হয় না। আবার বলে আমরা নাকি অর্ধনারীশ্বর। তার আবার আধখানায় (নারী) কাছাখোলা, আর বাকি আধখানায় (নর) কাছাকাছো আঁটা। আহা হা কী ছিরি!’ বুড়ি মায়েদের কাছে বলত।

শাশুড়ি এমন করে অর্ধনারীশ্বর দেখাতেন, আমরা হেসে কুটি কুটি হতাম। যদি কখনও বলতাম ঠাকুর দেবতা নিয়ে কোন সাহসে আপনি এমন হাসি ঠাট্টা করেন মা, আমার তো ভয় লাগে। আপনার কিছু মনে হয় না। মা বলতেন, কাঁচকলা।’

‘আমরা চাই—আমাদের ইসলাম দত্ত সম্মান স্বাধীনতা, চাই ইসলাম দত্ত অধিকার, চাই আমাদের মধ্যে বিরাট মাতৃত্ব জাগাতে, চাই মঙ্গলসাধিকা রূপে ইসলামের সেবা করতে।’

মিসেস এম রহমান, শামিম! কেন তুমি এদের জান না?

‘যুগ-ভেরী নিনাদে আমাদের ঘুমন্ত আত্মা জেগে উঠেছে, আমাদের সত্য সাড়া দিয়েছে। কোথায় সমাজ? কোন্ দোজখের অগ্নি গহ্বরে পতিত রয়েছে?’

এমন বলিষ্ঠ আহ্বান তোমাদের পুরুষদের মধ্যে কে দিয়েছেন? কেউ কি দিয়েছেন শামিম?

‘নির্যাতিতা বালিকার অভিভাবক রূপে, উপেক্ষিতা নারীর বন্ধু রূপে আমি জাগ্ৰত জ্ঞানী মানুষদের কাছে বিচার প্রার্থনা করছি। এস সমাজপতিগণ! শাসনদণ্ড ধারণ কর। এস আলেমগণ! ইসলামি আইন নিয়ে-ধর্মাধিকার অলঙ্কৃত কর। ধর্মতঃ বিচারে যদি দোষী সাব্যস্ত হই, দণ্ড দাও, নত মস্তকে গ্রহণ করব। যদি নির্দোষ হই, তবে দোষীকে, অত্যাচারীর চণ্ডালকে সাজা দাও। ‘ওমর কাজীর করাঘাতে তার মাংস খসে খসে পড়ুক, লৌহ গোর্জাঘাতে তার অস্থি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে বাতাসে উড়ে যাক। আমি তাই দেখে চোখের জলে বুকের জ্বালা ঠাণ্ডা করি, মনের ময়লা ধুয়ে ফেলি। তা যদি না পার, ততটুকু মনুষ্যত্ব যদি না থাকে তোমাদের, তা হলে আমি মুক্ত কণ্ঠে বলব, তোমরা নাস্তিক, ভণ্ড, নরাকারে শয়তান! তোমরা ভণ্ড-সমাজরূপ শয়তানী-চক্রে দুবলা অসহায়া মাতৃজাতিকে খণ্ড বিখণ্ড করে পৈশাচিক ক্ষুধার আহার যোগাচ্ছ।’

মিসেস্ এম রহমানকে তুমি চেন না শামিম! অন্যরা যদি আগুনের ফুলকি, মিসেস্ এম রহমান তবে দাউদাউ আগুন! ফুলকির তাই মনে হয়েছিল।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আমাদের যুগে একজন প্রধান প্রতিবাদী মহিলা ছিলেন মিসেস এম রহমান। নজরুল ওঁকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন। নজরুল ওঁকে মা ডাকতেন ফুলকি। উনি মারা গেলে নজরুল ওঁর নামে শোক-গাঁথা রচনা করেছিলেন। আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেটা। এখন সবটা মনেও নেই।

যতটুকু তোমার মনে আছে, তুমি বল বল তায়েবকাকা!

‘তুই মা ওঁর সন্ধান পেলি কি করে?’

মহিলা সওগাতে ওঁর লেখা পড়েছি আমি। আমি এমন মহিলা আর দেখিনি।

তায়েবকাকা অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘তোর দাদীর মধ্যে আমি এই মন, এই আগুন দেখেছি ফুলকি। অবিকল এই স্পিরিট।’

তারপর তায়েবকাকা আবার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর আবৃত্তি শুরু হল তাঁর। প্ৰথমে ভাঙা ভাঙা গলায়। তারপর ক্রমেই উদাত্ত হয়ে উঠতে লাগল তাঁর কণ্ঠ। সেদিন মেডিক্যাল কলেজে মোতি শীল ওয়ার্ডের কেবিন থেকে তায়েবকাকার যে কণ্ঠ ধ্বনিত হয়েছিল আবেগভরে সেটাই আজ সমুদ্রের ঢেউ হয়েই যেন আছড়ে পড়তে লাগল অমিতার কানে, ছড়িয়ে যেতে লাগল অমিতার গোটা ঘরটায়।

‘মহরমের চাঁদ ওঠার ত আজিও অনেক দেরী,
কোন কারবালা-মাতম উঠিল এখনি আমায় ঘেরি?
ফোরাতের মৌজ ফোঁপাইয়া ওঠে কেন গো আমার চোখে?
নিখিল-এতিম ভিড় করে কাঁদে আমার মানস লোকে।

জীবন-প্রভাতে দেউলিয়া হয়ে যারা ভাষাহীন গানে
ভিড় করে মাগো চলেছিল সব গোরস্থানের পানে,
পক্ষ মেলিয়া আবরিলে মা তুমি সকলে আকুল স্নেহে,
যত ঘর-ছাড়া কোলাকুলি করে তব কোলে তব গেহে!

আমাদেরও চেয়ে গোপন-গভীর কাঁদে বাণী-ব্যথাতুর,
থেমে গেছে তার দুলালী মেয়ের জ্বালা-ক্রন্দন-সুর!
কমল-কাননে থেমে গেছে ঝড় ঘূর্ণির ডামাডোল,
কারার বক্ষে বাজে নাকো আর ভাঙন ডঙ্কা-রোল!
—বসিবে কখন জ্ঞানের তখতে বাঙলার মুসলিম!
বারে বারে টুটে কলম তোমার না লিখিতে শুধু ‘মিম্‌’!

আবৃত্তি শেষ হলেও তায়েবকাকার ভরাট গলায় আবেগের যে তরঙ্গ উঠেছিল মোতি শীল ওয়ার্ডের কেবিনে তার রেশটা কেবিনকে ভরে রেখেছিল। তায়েবকাকা শুয়ে পড়েছিলেন বেড়ে। ফুলকির চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল ঝরে পড়ছিল তখন। জল ভরে এসেছিল অমিতার চোখেও। তায়েবকাকা কোনও কথা না বলে ফুলকির মাথাটাকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। তায়েবকাকার বুক তখনও ওঠানামা করছিল। ফুলকি তায়েবকাকার বুকে মুখ গুঁজে পড়েছিল। আর তাঁর মাথায় যত্ন করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। অমিতাও তখন যে তার মাথার বালিশে হাত বুলিয়ে চলেছিল, সে বুঝতে পারেনি।

অনেকক্ষণ পরে তায়েবকাকা যেন ঘোরের মধ্যে ডাক দিলেন, ফুলকি?

ফুলকি সাড়া দিল, উঁ!

‘তুই গোর্কির মাদার পড়েছিল মা?’

অমিতা উত্তর দিল হ্যাঁ।

‘এরা হলেন সেই মা, ফুলকি। মিসেস রহমান, বেগম রোকেয়া, তোর দাদী…’

অমিতা লক্ষ করল তায়েবকাকা বুড়িকে বলছেন তোর দাদী।

‘তুই ব্রেখটের মাদার কারেজ পড়েছিস ফুলকি?’

অমিতা উৎসাহভরে বলে উঠল, হ্যাঁ তায়েবকাকা।

‘তোর দাদী, মিসেস রহমান, রোকেয়া, নিবেদিতা, এঁরা হলেন সেই মাদার কারেজ।

.

অমিতার ঘরে তখনও অন্ধকার। অমিতার চোখ থেকে অন্ধকার একটু একটু করে কাটতে লাগল।

‘আমি জ্ঞান হয়ে আমার মাকে দেখিনি। খুব ছোট বয়সে আমি নানীর কাছে মানুষ। তোর দাদীর মধ্যে আমার মাকে পেয়েছিলাম ফুলকি।’

তায়েবকাকা বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছিলেন, ‘আর সে কি মা ফুলকি!’

‘আচ্ছা ফুলকি,’ তায়েবকাকার স্বর এখন বেশ স্পষ্ট। ‘তুই গোরা পড়েছিস? গোরা?’

অমিতা উত্তর দিল, গোরা পড়েছি তায়েবকাকা? শুনছ তুমি?

‘তোর মনে আছে, গোরা আনন্দময়ীকে কি বলেছিল?

অমিতা উত্তর দিল, হ্যাঁ তায়েবকাকা। প্রতিটি কথাই আমার মনে আছে। কিন্তু আমি যে কথাগুলো বলছি, তুমি শুনতে পাচ্ছ তো তায়েবকাকা?

‘গোরা সব শেষে এই কথা বলেছিল আনন্দময়ীকে, গোরা বলেছিল, মা, তুমিই আমার মা। যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই, বিচার নেই, ঘৃণা নেই—শুধু তুমি কল্যাণের প্রতিমা।’

একটুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বেশ স্পষ্ট করে বললেন, ‘তুমিই আমার ভারতবর্ষ।’

অমিতা চোখের জল আর ধরে রাখতে পারছিল না। সেই আবছা অন্ধকারে একা অমিতার গাল বয়ে জলের ধারা বইতে লাগল।

তায়েবকাকা আবার বিড় বিড় করতে লেগেছেন, ‘মিসেস রহমান—বেগম রোকেয়া—ভগিনী নিবেদিতা—সুধার মা–আমার মা—এরাই তো আনন্দময়ী ফুলকি—এরা এরাই ভারতবর্ষ—এদের জাত নেই—বিচার নেই—ঘৃণা নেই—এরাই তো মা, ফুলকি। এদের আমরা চিনতে পারিনে কেন?

২৬

‘সুধার এক মামু ছিল। মওলা বস্। বিহারী মুসলমান। মাসিমার পাতানো ভাই। দুজনের মধ্যে এমন সম্পর্ক আমি আর দেখিনি ফুলকি।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন।

ফুলকি তাদের মোল্লা দাদুর কথা শুনেছিল। কিন্তু তার তেমন মনে নেই। ফুলকিরা যখন বড় হয়েছে, তখন সেই মোল্লা দাদুর আসা যাওয়া কমে গিয়েছে। তারপর তো বুড়িই মরেই গেল। মোল্লা দাদুর ‘আপা’ ছিল বুড়ি। আপা মানে দিদি। মা বলেন, ‘যথার্থই দিদি আর ভাই। মা রাখী বন্ধনে নিয়ম করে রাখী পাঠাতেন। বেশ কয়েকবার ভাইফোঁটা নিতে এসেছিলেন বাবার ‘মামুজি’। ছাপরা জেলায় বাড়ি ছিল তাঁর। চামড়ার কারবারী ছিলেন। কলকাতায় এলেই বুড়ির সঙ্গে দেখা করে যেতেন। দু একবার বুড়ির অনুরোধে তাঁদের ডালিমতলার বাড়িতেও থেকে গিয়েছে মোল্লা দাদু। ফুলকি মওলা দাদু বলত না। বলত ময়লা দাদু। তারপর বাবাই তাকে মোল্লা দাদু বলতে শিখিয়ে দেন।

‘আমরা তোর মোল্লা দাদুর ছাপরার বাড়িতে গিয়েছি ফুলকি। কি বিশাল বাড়ি। মামুজির ছেলের বিয়েতে যাবার জন্য দাওয়াত এসেছিল। আমি গিয়েছিলাম, সুধা গিয়েছিল আর কে গিয়েছিল বল তো?’

হরিকিশোরমেসো। ফুলকি বলেছিল।

‘হ্যাঁ। হরিকিশোর। আর? আর কে? বল? বল?’

ফুলকি খুঁজে পেল না, আর কে হতে পারে? কে হতে পারে? হঠাৎ ফুলকির মাথায় চমক খেলে গেল, বুড়ি নয় তো!

ফুলকি বলল, বুড়ি?

‘আবার কে? পয়গাম আসা মাত্র মাসিমা এক পায়ে খাড়া। কি বল হরিকিশোর?’

‘মাসিমা এক কাণ্ডই বাধিয়ে ফেলেছিলেন। দিবুদা বেজায় রেগে গিয়েছিল। বলেছিল, তোরা আর মাকে নাচাসনে হরি। মামু অবিশ্যি লোক ভাল। আমাদের বাড়িতে আসেন টাসেন সে এক রকম। না তাকে আবার বাড়িতে রাখো। মায়ের যত আদিখ্যেতা।’

‘আসলে আপত্তিটা কোথায় বুঝতে পেরেছ হরিকিশোর? দিবুদার শ্বশুর বাড়ির।

‘হ্যাঁ, জানবাজারের পণ্ডিত বংশ তো।’ হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন। ‘দিবুদার বড় শ্বশুর তো ছিলেন পঞ্জিকা সম্রাট।

‘পঞ্জিকা সম্রাট কী হরিকিশোরমেসো?’

‘তোর দাদীই বেয়াইয়ের ওই নাম দিয়েছিল।’ তারপর দুই বুড়োর সে কি হাসির ধুম।

‘দিবুদার শ্বশুর মশায়ের টোলে পুরোহিতদের পড়তে হত। ওখান থেকে পাশ করলে তবেই পুরুত বলে তারা কল্কে পেত। ওঁর ছিল আচার বিচার খুব কড়া।’

তবে কেউটের চেয়ে কেউটের বাচ্চার ফোঁস বেশি। দিবুদার সম্বন্ধী তাঁর বাবাকেও টেক্কা মারতেন। দিবুদার বউ ওঁরই তো বোন কিন্তু দাদার বিধানে বোন বাপের বাড়ির হেঁসেলে ঢুকতে পারত না। ‘দিবুদা শেষ পর্যন্ত তো বেঁকেই বসল। বলল, তায়েব, তোরা যাচ্ছিস যা। মাকে আর টানিসনি। তোরাই তো মায়ের যোগ্য প্রতিনিধি।

‘মাসিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মানুষের বাড়ি মানুষ যাবে, সেখানে দিবুর আপত্তিটা উঠছে কোথায়?’

‘দিবুদা বলল, কোনও ব্যাপারেই বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। আমরা তো সমাজে বাস করি।’

‘মাসিমা বললেন, তাই বল, সমাজপতিদের বিধান এসে গিয়েছে। তা পঞ্জিকা সম্রাটদের এ ব্যাপারে আপত্তিটা কি?’

‘দিবুদা জানাল, মামুজিরা তো গোরু টোরু খান, মা এসব ছোঁয়া ছুঁত বাঁচিয়ে ওদের বাড়িতে থাকবেন কি করে?’

‘মাসিমা বললেন, অ, পঞ্জিকা সম্রাটের আপত্তি তাহলে গোমাংসে। পঞ্জিকা না গঞ্জিকা সম্রাট। হিন্দুদের গোমাংসে অভক্তি হল কবে থেকে? গোমাংস তো হিন্দুদের মাচায় ঝুলে থাকে, গোমাংস তো হিন্দুদের চালের উপরে গড়াগড়ি খায়। তোরা দেখিসনি?’

‘মাসিমার এ কথায় আমরা সত্যই ফাঁপড়ে পড়ে গেলাম। মনে আছে হরিকিশোর?’

হরিকিশোরমেসো মুখ টিপে টিপে হাসতে লাগলেন।

‘আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি বলেছেন, গোমাংস হিন্দুর বাড়ির চালে গড়াগড়ি খায়। কোথায় এটা হয় মাসিমা?’

‘তোদের মাথায় গোবর। পঞ্জিকা শাস্তর পড়ে দেখেছিস, কি লেখা আছে? তোমাদের মোল্লারা, বাবা আর কটা ফতোয়া দেন। ফতোয়া শুনে জন্ম সার্থক করতে চাও তো হিন্দুদের পঞ্জিকা খুলে বসো। শুষ্কশাক খাইও না উহা গোমাংস। করমথিত দধি, মানে ঘোল খাইও না। উহা গোমাংস। বর্তুলাকা (অর্থাৎ গোল গোল) লাউ খাইও না। উহা গোমাংস। সাদা বেগুন এবং কলম্বী শাক কদাচ ভক্ষণ করিও না। গোমাংস। নবমীতে অলাবু (লাউ) গোমাংস। দশমীতে কলম্বী (অর্থাৎ কি না কলমি শাক) খাইও না। গোমাংস। দেখছ তো বাবা, হিন্দুদের বাড়িতে গোমাংস কেমন চাদ্দিকে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি হিন্দুর মেয়ে, জন্মে ইস্তক তো গোমাংস নিয়েই ঘর করছি। তার আবার মুসলমানের বাড়ির গোমাংসে এত ভয় হবে কেন? সমুদ্রে যে শয্যা পাতে সে কি শিশিরে ডরায়? কি বল? শুনছিস ফুলকি, এই ছিল তোর দাদীর ব্যাখ্যা।

‘না বাবা হরিকিশোর, ও সব আমার ব্যাখ্যা নয়। ও সব ব্যাখ্যা গঞ্জিকা সম্রাটদের। ফতোয়াও তাঁদের। কলিকালের পুরুতরা তো এক সিধে আলো চাল আর একটা কাঁচকলা পেলেই সন্তুষ্ট। হবিষ্যি করার ফল যা হবার তা হয়েছে। ঝাড়ে বংশে সব টিং টিং সিং। পেটে আমাশা একেবারে থক থক করছে। তাই এদের এটা খেও না ওটা খেও না—এত বাতিক। গোরু খাবার হিম্মত থাকত তো দেখতে হিন্দু জাতটা আজ জগতের মধ্যে একটা শ্রেষ্ঠ জাত বলে গণ্য হত। মুনিঋষিরা যতদিন গোরু খেয়েছে, ততদিনই তাদের হাত দিয়ে বেদ মহাভারত উপনিষদ গীতা বেরিয়েছে। মহাভারতে আছে যুধিষ্ঠিরের পূর্বপুরুষ রাজা নহুষ অতিথি বাড়িতে এলে তাকে গোরু মেরে খাইয়ে সৎকার করতেন। একে মহাভারতে ‘দেববিধি অনুযায়ী সৎকার বলা হত। মাংসের যে কত গুণ তা বৈদিক ঋষিরা ভালই জানতেন। তাই তাঁদের সমাজে মহিষ ও গোমাংস অবাধে চলত।’

‘তোর দাদী, বলেছি না ফুলকি, কতটা লেখাপড়া করেছেন, আদৌ করেছেন কি না, তাঁকে দেখে, সেটা তো বোঝা যেত না। কিন্তু এই সময় তাঁর ভিতরের সত্তাটা স্বতঃস্ফূর্ত বেরিয়ে আসত। একদিন আমাকে বললেন, তায়েব বাবা, তোমরা একটু পড়াশুনা কর। হিন্দুর শাস্তর পড়। সংস্কৃত নাটক পড়। এতে অনেক জিনিস পাবে। ভবভূতির নাম জান তো? উত্তরচরিতম্ ওঁর বিখ্যাত নাটক। কি বলছে শোন। মাসিমা, আমাকে নাটক থেকে কটা ছত্র পড়ে শুনিয়ে দিলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ, বশিষ্ঠ ছিলেন রামের কুলপুরোহিত, রানী কৌশল্যা ইত্যাদি সকলকে নিয়ে মহর্ষি বাল্মীকির তপোবনে আসছেন। সেখানে দুজন তাপস কথাবার্তা বলছেন :

সৌধাতকি। ওহে ভাণ্ডায়ন! অদ্য এই প্রাচীন দলের ধুরন্ধন (মোড়ল) রূপে যে অতিথি আসছেন, ওঁর নাম কি?

ভাণ্ডায়ন। ছি ছি! এরূপ পরিহাস বাক্য প্রয়োগ নিতান্ত অন্যায়। উনি ভগবান বশিষ্ঠ। অরুন্ধতীকে (বশিষ্ঠের ব্রাহ্মণী) আগে আগে নিয়ে মহারাজ দশরথের মহিষিগণকে নেতৃত্ব দিয়ে উনি ঋষ্যশৃঙ্গের আশ্রম থেকে আগমন করছেন। তুমি কেন এমনধারা প্রলাপ বকে চলেছ?

সৌধাতকি। অ্যা—ইনি বশিষ্ঠ?

ভাণ্ডায়ন। হ্যাঁ।

সৌধাতকি। আমি তো ভেবেছিলাম এ একটা বাঘ। বুক।

ভাণ্ডায়ন। আঃ কি বলছ?

সৌধাতকি। ইনি এসেই সেই বেচারি গো-বৎসের অস্থিমাংস মড়মড় করে চর্বণ করে ফেললেন।

ভাণ্ডায়ন। মাংসের সঙ্গে মধুপর্ক দান কর্তব্য, এই বেদবাক্যের প্রতি গৌরব প্রদর্শন করে গৃহস্থগণ অতিথি রূপে সমাগত বেদধ্যায়ী, তায়েব বাবা লক্ষ্য রেখো, ভাণ্ডায়ন বলছেন, বেদধ্যায়ী বিপ্র বা রাজাদের অভ্যর্থনার জন্য গোবৎস, বৃষ অথবা ছাগ প্রদান করে থাকেন।’

মাসিমা বলেছিলেন, ভবভূতির এই নাটক রাম সীতাকে নিয়ে লেখা, বাবা তায়েব। স্বয়ং রামের কুলপুরোহিত একটা আস্ত বাছুর কড়মড় করে চিবিয়ে খাচ্ছেন, তাঁকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বাঘ,—এসব মর্ম জানবাজারের পঞ্জিকা সম্রাটরা কি করে বুঝবে? কাঁচকলা পেটে না পড়লে আমাশার কামড় সামলাবে কি করে? বল? তাই তাঁদের ফতোয়ায় গোমাংস গাছে ঝুলে থাকে। মনটাকে ওরা আর ছড়াতে পারল কই?’

‘সমস্ত নারীর মন আজ বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু সংগ্রাম করার যে প্রধান অস্ত্র—শিক্ষা ও জ্ঞান, তাই তাদের নাই।’ বলছেন মিস ফজিলতুন নেসা এম এ। মহিলা সওগাতে। ফুলকির খাতা আবার কথা বলে উঠছে। সেই প্রায় ভোরে অমিতা আজ আর রাত জাগবার গ্লানি বিশেষ টের পেল না। শুধু জলতেষ্টা পাচ্ছিল তার। ‘আছে কেবল দারুণ একটা আত্মগ্লানি, মর্মভেদী একটা অনুশোচনা, আর সর্বোপরি মুক্তির জন্য দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা। এর জন্য সর্বপ্রথম আবশ্যক শিক্ষা। শিক্ষা বলতে কেবল কয়েকটি ডিগ্রির ছাপ নয়—যে শিক্ষা মনকে উন্নত ও প্রশস্ত করে বিবেক বুদ্ধিকে সুমার্জিত ও সুচালিত করে সেই শিক্ষা, যে শিক্ষা ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মান রাখার উপযোগী শক্তি দেয়, সেই শিক্ষা।

বুড়ি, তুমি কি এই ফজিলতুন নেসার কথা শুনছ? এ তোমার নিজের কথা বলে মনে হচ্ছে না? তুমি কি এঁকে চিনতে বুড়ি?

‘বঙ্গ-মুসলিম পল্লী-নারী আজ স্পন্দনহীন। তারা যেন ধরার বুকে মূর্ত অভিশাপের হৃদয়-বিদারক মূর্তি। ‘—সৈয়দা জয়নব খাতুন অমিতার ঘরে গমগম করে উঠলেন। ‘সমাজের দারুণ নির্যাতনে ও কঠোর শাসনেই আজ তারা নির্জীব। তাদের জীবন আজ সমাজের নিষ্ঠুর শাসন-দণ্ডকে উপেক্ষা করিতে অক্ষম। নারীরা আজ সমাজের গুপ্ত সামগ্রী। পুরুষের শুধু ভোগেরই বস্তু, বিলাসের পুতুল মাত্র। …পাড়াগাঁয়ের নারী-নির্যাতন দেখিলে নারী-জীবনের ব্যর্থতার কথা ভাবিয়া হৃদয় ফাটিয়া যায়। নারীরাও যে রক্ত মাংসের শরীর, তাদেরও যে প্রাণ আছে এটা পল্লী পুরুষেরা খুব কমই ধারণা করিতে পারে। লাঙ্গল স্কন্ধে লইয়া গোরুকে যেমনভাবে হৃদয়হীন কৃষকেরা মারিতে থাকে, পল্লীগ্রামের লোকেরাও আপন স্ত্রীকে খুঁটিনাটি অপরাধে তদ্রুপ নির্যাতন করে।’

‘পুরুষানুক্রমে যুগ যুগান্তর ধরে বাঙ্গলা দেশের গণ্ডীর মধ্যে বাস করে, আজন্ম বাঙ্গলার ফলে আর জলে কলেবর বৃদ্ধি করে, আর এই বাঙ্গলা ভাষাতেই সর্বক্ষণ মনের ভাব প্রকাশ করেও যদি বাঙ্গালী না হয়ে অপর কোনও একটা জাতি সেজে বেঁচে থাকতে চাই, তা হলে আমাদের আর কখনও উত্থান নাই, অধিকন্তু চির তমসাচ্ছন্ন গহ্বর মধ্যে পতন অবশ্যম্ভাবী।’—নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী অমিতার ঘরে তাঁর কণ্ঠস্বরও তুলে ধরলেন। এ সবই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। এঁরা প্রত্যেকেই প্ৰতিবাদ করে গিয়েছেন নিজের সমাজের অনাচারের বিরুদ্ধে, যেমন করত বুড়ি। এদের সঙ্গে অমিতার মনে, বুড়ি এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে, একজনের কারও কথা মনে পড়লেই বুড়ির কথা মনে পড়ে যায়।

‘তোদের বাড়ির আরও কথা শুনবি? ভারি মজার কথাসে সব। আহা সুধা নেই! সুধা বেঁচে থাকলে আজ তোর জেঠির আচার বিচারের গল্প বলতে পারত। তোর জেঠি যখন এ বাড়িতে এল, আমাদের থেকে বয়সে ছোটই ছিল। তাই তো হরিকিশোর?

‘সুধার চাইতে বছর দুয়েকের ছোট ছিলেন বউদি। সে সব মজার গল্প। তায়েবের মুখ থেকে শোন ফুলকি, মজা পাবি।

‘তোর জেঠি যতদিন এই বাড়িতে ছিল, ততদিন বেচারির সে কি অবস্থা! এই দিকে এই রকম এক শাশুড়ি, যিনি ধর্মকর্ম কিচ্ছু মানেন না, আর ওদিকে বউদির বাবা, তার দাদা তো আরও এক কাঠি সরেস, হাঁচি টিকটিকি—সব কিছু মানেন। বেচারি এই অবস্থায় পড়ে করে কি? যতদিন বয়েস কম ছিল, সুধাকর ছিল তার পরামর্শদাতা। কিন্তু বউদি বুঝে নিলেন, এই দেওর আর শাশুড়ির পরামর্শ শুনলে তার বাপের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। তখন তোর পরামর্শদাত্রী হিসাবে বেছে নিলেন পঞ্জিকা যুবরাজের বউকে, অর্থাৎ তার বউদিকে।’

‘এদিকে তোদের পরিবারে সুধার মামুজির আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে। মাসিমা তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন ভাইকে ইদের সময় ভাইফোঁটায় আর রাখীবন্ধনে। মামুজি তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন তাঁর আপাকে পুজোয়, ভাইফোঁটায়, রাখীবন্ধনে। আর মামুজির তত্ত্ব কী, আপার জন্য এক সেট ছেলেদের জন্য আলাদা সেট বউদের জন্য আলাদা আলাদা সেট। তারপর তো আমের সময় আম, আর কলকাতায় এলেই মিষ্টি—এ সব তো আছেই। বেশ চলছিল। হঠাৎ বউদির দাদা, পঞ্জিকা যুবরাজ বোনকে বিধান দিলেন, যা হয়েছে হয়েছে, কিন্তু অনাচার আর চলবে না। ভবিষ্যতে যদি ম্লেচ্ছের প্রেরিত তত্ত্বাদি, উপঢৌকনাদি গ্রহণ কর তো তোমাকে বাপের বাড়ি আসিতে হইলে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে।’

হরিকিশোরমেসো বললেন, ‘আর হবি তো হ, সেইবারই মামুজি তত্ত্বে পাঠিয়েছে সুন্দর সব রেশমি শাড়ি। ভাগলপুরের সকিল। বুঝে দেখ।’

‘তোর জেঠি সেই শাড়ি না পারে ফেলতে না পারে গিলতে। কি করে? মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করা হল, বললেন, এটা বড় বউমার ব্যাপার। যা ভাল বোঝে করবে। তখন সুধা বলল, বউদি তুমি এক কাজ কর। তোমার দাদাকে এ সব জানাবার দরকার নেই। তুমি বরং তোমার বউদির কাছ থেকে বিধান নাও। মেয়েদের ব্যাপারে পুরুষ লোক কি কিছু বোঝে যে বিধান দেবে? সুধার কথাই মেনে নিল তোর জেঠি। তোর বাবাই জেঠির চিঠির খসড়া করে দিল। বউদি লিখেছিল, পূজনীয়া বউদি, দাদার বিধান তো শুনিয়াছ? দাদা তো বিধান দিয়েই খালাস। এদিকে আমার মাথায় বজ্রাঘাত। মামুজি এবার তত্ত্বে ভাগলপুরের সিলকের শাড়ি পাঠাইয়াছেন। যেমন রং, তেমন বাহার। আমি অবিশ্য দাদার কথা মান্য করিয়া উহা স্পর্শ করি নাই। কিন্তু তোমাকে শাড়িখানা দেখাইতে পারিব না। এই দুঃখে মরিতেছি। তুমি যদি উহা দেখিতে চাও তবে তোমাকে দেখাইতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে তোমাকেই বিধান দিতে হইবে, ওই শাড়ি স্পর্শ করিতে গেলে আমাকে নিয়ম রীত কী পালন করিতে হইবে। কারণ তুমি ঠাকুরের ভোগ রাঁধিবার অধিকার পাইয়াছ। তুমি ভাগ্যবতী। আমি কি করিব ‘

‘সুধা যা ভেবেছিল তাই। পত্রপাঠ জানবাজার থেকে বিধান এসে পৌঁছুল। বউদির বউদি বিধান পাঠিয়েছেন। সুধা আমাদের সেটা পড়ে শুনিয়েছিল। আমার বেশ মনে আছে হরিকিশোর। তুমিও তো আমাদের সেই মজলিসে ছিলে।

‘কিন্তু আমার কিচ্ছু মনে নেই।

‘তবে শোন, বউদির বউদি লিখেছিল, ঠাকুরঝি এখনই ভোগ রাঁধিতে যাইতে হইবে, লোম বস্ত্ৰ পরিতে হইবে। সময় নাই। রেশমি বস্ত্রে এমনিতে কোনও দোষ নাই। তুমি আমাকে তোমার শাড়ি অবশ্যই দেখাইবে। তবে এখানে আনিবার পূর্বে শাড়িটি শোধন করিয়া লইও এবং ভাঁজ না ভাঙ্গিয়াই আনিও। শোধন করার মন্ত্র তোমাকে পাঠাইলাম। ভোরে শুদ্ধ মনে চান করিবে। গন্ধ তৈল মাখিতে পার। চান সারিয়া ছাতে গিয়া পূর্বাস্য হইয়া এই মন্ত্রটি সাতবার ভক্তিসহকারে বলিবে। প্রতিবার বলিবার পর সাতবার করিয়া সূর্যকে নমস্তুতে নমস্তুতে বলিয়া প্রণাম করিবে। শাড়িটাতে গঙ্গাজল ছিটাইয়া সাতটি তুলসী পাতার সহিত কিছু তুষ শাড়িতে ছড়াইয়া দিলেই শাড়ি শুদ্ধ হইয়া যাইবে। শাড়ির পাট খুলিও না তবে ভাঁজে ভাঁজে তুলসী রাখিয়া দিও। মন্ত্রটা ছিল এই :

‘তুষ তুষলী মুখে ভাসলি      আখা জ্বলন্তি পাখা চলন্তি।
চন্দন কাঠে রান্না করে খাবার আগে তুষ পড়ে।
খড়কের আগে ভোজন করে প্রাণ-সুখেতে নতুন ঘরে।।
ঘর ভরবে মোর নাতিপুতে।
কাল কাটাব আমি জন্ম এয়োতে।।
তুষলী গেল ভেসে আমার বাপ ভাই এল হেসে।
তুষলী গেল ভেসে ধন দৌলত টাকা পয়সা এল হেসে।।

এই হল সেই মন্ত্রটা ফুলকি। তবে সেবার তোর জেঠি শাড়িতে এত গঙ্গাজল ছিটিয়ে ছিল, আর এত তুলসী পাতা আর তুষ শাড়িতে ছড়িয়ে রেখেছিল যে, শাড়িটার সর্বত্রই দাগ লেগে গিয়েছিল। এমন দাগ যে, তোর জেঠির বউদি মন্ত্র পড়েও সে দাগ তুলতে পারেনি।’

‘আর যেবার মামুজির কাছ থেকে তত্ত্বে শাল এল সেবার কি হয়েছিল?’

‘এবার মামুজি শাল দিয়াছেন।’ তোর বাবা এমনভাবে তোর জেঠিকে নকল করত, হাসতে হাসতে আমাদের পেট ফাটবার জো হত। ‘এবার মামুজি শাল দিয়াছেন। তোমার নন্দাইয়েই জন্য একখানা দোশালা। আমার জন্য একটা তুষ। এবার বল কী করিব?’ তায়েবকাকা আর হরিকিশোরমেসো যেন দুজনেই ছেলেমানুষ হয়ে উঠলেন।

তায়েবকাকা বললেন, ‘ততদিনে তোর জেঠি খানিকটা হুঁশিয়ার হয়েও গিয়েছে। শালে আর গঙ্গাজল ঢালেনি। তবে মন্ত্র পড়েছিল। সেটা শুনবি। এক সময় সুধাও তোর জেঠিমার পিছনে লাগতে হলে ওই অক্ষয় শালের মন্ত্রটা আওড়াত। আমরা বলতাম, শাল-শুদ্ধির মন্ত্র। ওটা উপোসে থেকে পড়তে হবে, এমন বিধান তোর জেঠির কাছে এসেছিল। মন্ত্রটা পড়ে শালটা আলমারিতে তুলে রেখে তার উপর একটা তাঁবার পয়সা রেখে দিতে হবে। খবরদার খবরদার আর গঙ্গাজল কি তুলসী নয়। পশমে ম্লেচ্ছ স্পর্শের দোষ ঘটে না—এই বিধান তোমার দাদাই দিয়াছেন।

‘কোন মন্ত্র পড়েছিলেন জেঠিমা, তায়েবকাকা? ‘

তায়েবকাকা যেই বলতে শুরু করলেন, ‘তুষলী গো বাই তুষলী গো মাই…’

ফুলকি বলতে যাচ্ছিল, কাঁচকলা। কিন্তু চেপে গেল। বলল, ওটা আমরা জানি তায়েবকাকা। ওটা কি শাল-শুদ্ধ করার মন্ত্র? বুড়ি বলত, ওটা তুষ তুষলী ব্রতের মন্ত্র।’

‘তা হবে। তা তুই বলত দেখি মিলে যায় কি না?

তুষলী গো বাই তুষলী গো মাই।
তোমায় পুজিয়ে আমি কি বর পাই।।
অমর গুরু বাপ চাই ধন সাগরে মা চাই।
রাজ্যেশ্বর স্বামী চাই, সভা আলো জামাই চাই।।
সভাপণ্ডিত ভাই চাই, দরবার শোভা বেটা চাই।
সিঁথের সিঁদুর ধপধপ করে, হাতের নোয়া ঝকমক করে।।
বাক্‌সে কাপড় ঝলমল করে, ঘটিবাটি চকচক করে।
সিঁথে সিঁদুর মরাইয়ে ধান, এই এয়োতি এই বর চান।।

এই সেই মন্ত্ৰ তো?’

‘হ্যাঁ, ফুলকি তোর জেঠি শাল রক্ষের জন্য ঠিক এই মন্তরটাই পড়েছিল।’

জেঠির শাল অক্ষয় হয়েছিল? তায়েবকাকা, ও তায়েবকাকা? অমিতা কতবার যে জিজ্ঞাসা করল!

২৭

‘দিবুটার ওই রকম স্বভাব বউমা।’ বুড়ি বলেছিল মাকে। ‘ও মানুষে মানুষে ভেদ মানে। আমার শ্বশুরও ছিলেন ওই রকম। মানুষকে মানুষ জ্ঞান করতেন না। একে ছুঁলে চান, তাঁকে ছুঁলে প্রায়শ্চিত্ত! এ সব চলতই নিত্যদিন। আমার শাশুড়ি আমাকে বলতেন, বউমা খবরদার, খবরদার, জমাদারনী, মেথরানী, এদের ছায়াও মাড়াবে না। তোমার শ্বশুর তাহলে অনখ করে ছাড়বে। খবরদার খবরদার। এইসব ছিল দিবুর ঠাকুরদার স্বভাব। নদীতে নাইতে যেতেন যেদিন, মজা হত সেদিনই বেশি। ঠাকুর গাঙে নাইতে গেছেন। সেই ভোরে। কিন্তু ফিরলেন প্রায় দুপুরবেলায়। ব্যাপার কি, যতবার চান করে উপরে উঠে আসেন, ততবারই নাকি কোনও না কোনও হীনজাতি লোকের ছায়া তাঁকে মাড়িয়ে ফেলতে হচ্ছিল। তাই আবার গিয়ে ডুব দিচ্ছিলেন গাঙের জলে। যখন বাড়ি এলেন তখন হাতপায়ের আঙুলে প্রায় হাজা ধরে যাবার জো হয়েছিল।’

বিন্দুমাসি বলেছিলেন, ‘আমি তোর ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ফুলকি, আচ্ছা মাসিমা, আপনি এ সব ছোঁয়াছুঁয়ি মানতেন না?’

বুড়ি নাকি হাসতে হাসতে জবাব দিত, ‘ও বাব্বা মানব না ঘাড়ে কটা মাথা! তা ছাড়া বয়েসটা তখন কত বল দিকিনি। আমাকে নিয়ে সারা শ্বশুরবাড়িতে সামাল সামাল রব পড়ে যেত। দেখ কোথায় গেল বউ? খোঁজ কোথায় গেল বউ? আমি আমাদের মেথরানীর মেয়েটার সঙ্গে, আমারই বয়েসীই, গঙ্গাজল পাতিয়ে ফেলেছিলাম কি না। বাড়িটা তাই নিয়ে তটস্থ হয়ে থাকত।’

‘তবে মাসিমা, আমরা যখন থেকে আপনাকে দেখছি, তখন থেকে আপনাকে এইসব ছোঁয়াছুঁয়ি মানতে দেখিনি। কবে থেকে বদলাল?’

‘যেদিন থেকে বুঝলাম বউমা, ওতে আছে কাঁচকলা, সেইদিন থেকেই ও সব ছেড়েছি। দিবুর বাবা তো কই কোনদিন আপত্তি করেননি। আমাদের বাড়িতে দিবুই একমাত্র সমাজপতি হয়ে বসেছিল। কথায় কথায় বিধান দিতে শুরু করেছিল। তাই তো আমি দিবুকে বোঝালাম, তুই এখন উপযুক্ত হয়েছিস বাবা। তুই নিজের পথ দেখে নে।’

আমার বাবা বলতেন, বুড়ির কথা উঠলে, ‘বাবার সঙ্গে মায়ের বয়সের তফাত তো অনেক ছিল। হলে হবে কি, মায়ের স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি এমনই ছিল যে, বাবাও সেটা মেনে চলতেন। বলতে কি বাবা যতটা সংস্কারমুক্ত হতে পেরেছিলেন, সেটা আমার মায়ের জন্য।’

‘আমার শ্বশুরমশাই শাশুড়িকে মেনে চলতেন মানে কি?’ মায়েদের হাতে হাতে সেই দুপুরে তখন বুড়ির ছোট ব্লাউজটা, সেই বেনারসীর ব্লাউজটা, বুড়িকে যেটা পরিয়ে কনে সাজানো হয়েছিল, ঘুরছে।

বিন্দুমাসি সেটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বলছেন, ‘এটা দেখলে পরের কালের মাসিমাকে কি চেনা যায়!’

মা বলেছিলেন, ‘আমার শ্বশুরমশাই তো শেষ পর্যন্ত শাশুড়ির কথাতেই চলতেন।

জহুরাকাকিমা ব্লাউজটা দেখতে দেখতে বলেছিলেন, ‘তেলাপোকা যেমন কাঁচ পোকাকে টেনে নিয়ে যায়, সেই রকম কি কুসুম?’

অমনি হাসাহাসির ধুম পড়ে যেত মায়েদের মহলে। অমিতার সে কথাগুলো আবছা মনে পড়ে। ‘যোগ্যতা হে হরিকিশোর যোগ্যতা। সুধার মায়ের মতো অমন একটা মা তো কই আমার নজরে আজও পড়ল না! কিভাবে বুড়ি তৈরি করেছিলেন নিজেকে সে ইতিহাস জানা থাকলে কত লোককে যে সেটা প্রেরণা দিত, তার কি ইয়ত্তা আছে?’ তায়েরকাকা শীর্ণ কণ্ঠে সেদিন বলেছিলেন। তিনি তখন মেডিকেল কলেজের কেবিনে শুয়ে

‘দিবুদার ব্যাপারটাই ধর। দিবুদা মাসিমাকে কিছুতেই ঠেকাতে পারলেন না। মাসিমা আমাদের নিয়ে ছাপরায় তার ভায়ের বাড়িতে গেলেন। মাসিমা দেদার মিয়াকে বলতেন, ‘আমার ভেইয়া’। আর তাই নিয়ে সুধাদের বাড়িতে কি হুজ্জুত বেধে গেলো! অশান্তি একেবারে চরমে উঠল। এই হাঁড়িতেই যদিও খাওয়া-দাওয়া সবই চলছিল তখন, কিন্তু তোদের বাড়িটা স্পষ্ট যেন দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল।’ তায়েবকাকা সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে শুরু করেছেন।

মা বলেছিলেন, ‘আমি পড়েছিলাম মহা মুশকিলে। আমার বড় জা শেষ পর্যন্ত মায়ের সামনেই যেতেন না। আমার মারফতে সব কথাবার্তা হত। আমার বয়সও তখন তো খুব বেশি নয়। আমি সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকতাম। সেই যে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, আমার হয়েছিল অবিকল সেই অবস্থা। বড়দি বলেন, কুসুম যাও মাকে জিজ্ঞেস করে এসো, আজ রান্নার কি হবে? মাকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমাকে আর জিজ্ঞেস করছিস কেন কুসুম, তখন মা আমাকে মাঝে মাঝে কুসুম বলতে শুরু করেছিলেন, আমার ডাকটা কিন্তু ভালই লাগত, মা বলতেন, এ সব কথা আমাকে কেন জিজ্ঞেস করতে এসেছিস কুসুম। বড় বউমাই তো এ সব করে। তাকে বলগে যা। দেখছিস নে আমি কাজ করছি। মা তখন চিঠি লিখতে ব্যস্ত। মামুকে চিঠি লিখছেন নিশ্চয়ই। না হলে এত উৎসাহ দেখা দিত না। আমি বড়দিকে গিয়ে বললামল, মা বলেছেন তোমার যা ইচ্ছে হয় তাই রাঁধ। বড়দি তখন কথায় কথায় ব্যাজার হয়ে উঠত। সে এক জ্বালা আমাকে সইতে হয়েছে।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘তোর দাদী বলতেন, দিবুর বড় কষ্ট যাচ্ছে। ও না পারছে আমাকে মেনে নিতে, না পারছে আমাকে ছাড়তে। কিন্তু তায়েব বাবা, ওকে একটা তো ছাড়তেই হবে। এত অশান্তি নিয়ে মানুষ কি সুস্থ থাকতে পারে?

‘মাসিমা যে কোনও একটা কিছু সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন, এটার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল।’

হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘দিবুদা বলতেন, মাকে এটা কিছুতেই বোঝানো যায় না যে, আমরা সমাজে বাস করি। সমাজ যতদিন না বদলাচ্ছে ততদিন সমাজ যা মানে, আমাকেও সেটা মানতে হবে?’

‘তা হলে সমাজটা বদলাল কে, সেটা দিবু কি বলেছে?’

‘মাসিমার এই ধরনের কথায় আমাদের মুখ বন্ধ হয়ে যেত।—

‘দিবুরা মানুষের জন্য সব আলাদা আলাদা খোপ তৈরি করে রেখেছে। সেই খোপে মানুষকে পুরে দিয়ে দিতে পারলে দিবুরা নিশ্চিন্ত। এটা মেথরের খোপ, এটা মুচির খোপ, এটা ডোমের খোপ, এটা মেছোদের খোপ, এটা মুসলমানদের খোপ, এটা খ্রিস্টানদের খোপ। মানুষ কি ডাকের চিঠি যে তাকে খোপে খোপে ভরবি? মানুষের জন্য কোনও খোপ দিবুরা রাখতে চায় না। এই নিয়েই আবার ওদের কত বড়াই!’

‘পাশের বাড়ির ক্ষেমী বামনি, তার তো আচার বিচারের অন্ত নেই। একদিন আমাদের মেথরানী সুখলটকার মেয়েটাকে নিয়ে ক্ষেমী কি খিটকেলটাই না করল! চৈত্রমাসের গনগনে দুপুরে ওর মা ওদের বাড়ি সাফসুতরো করছে, মেয়েটা বাইরে দাঁড়িয়ে ঘরে মুখ বাড়িয়ে যেই না বলেছে, মা একটু জল দেবে, বড় তেষ্টা পেয়েছে, অমনি ক্ষেমী চিৎকার করে উঠল, হারামজাদি তুই আমায় ছুঁয়ে দিলি অবেলায়। বলেই কুটনো কোটার পিঁড়িটা ওই বাচ্চা মেয়েটার দিকে ছুঁড়ে দিলে। পিঁড়িটা এসে দুম করে লাগল ওর পেটে। মেয়েটা ককিয়ে উঠেই পড়ে গেল। আমি জানলা দিয়ে ক্ষেমীকে বললাম, করেছ কি ও তো মরল, পুলিশ এসে হাতে দড়ি দেবে। শিগগির ওর চোখেমুখে জলের ছিটে দাও। পেটটা ডলে দাও। ছি ছি ছি! ওই বাচ্চাটাকে কি অমন করে মারতে আছে! আমার কথায় ভয় পেয়ে ক্ষেমী জলটল দিয়ে ওকে চাঙ্গা করল। ক্ষেমীকে পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তো ঠাণ্ডা মানুষ ক্ষেমী, তুমি সেদিন ওই বাচ্চাটার উপর অত ক্ষেপে গেলে কেন? ক্ষেমী বলল, অবেলায় মেথরানী মেয়েটা আমায় ছুঁয়ে দিল দিদি, তাই মাথাটা কেমন গোলমাল হয়ে গেল। কি করে ছুঁল ও তো তোমার ঘরেও ওঠেনি ক্ষেমী। ক্ষেমী একটু অবাক হয়ে বলল, সে কি! ওর ছায়াটা ঘরে এসে আমার পিঁড়িটার উপর পড়ল যে! তুমি দেখনি দিদি? আমি বললাম, না ক্ষেমী আমার চোখের দোষ আছে। অত সুক্ষু জিনিস দেখতে পাইনে। সেই ক্ষেমীকে প্রায়ই .দেখি একটা বিড়াল কোলে নিয়ে আদর করছে। আমি একদিন বললাম, ক্ষেমী, এই অবেলায় তুমি বিড়ালটাকে ছুঁলে? ক্ষেমী জিজ্ঞাসা করল, কেন দিদি, দোষ কি হয়েছে? আমি বললাম, এই মাত্র আদাড়ে পাঁদাড়ে মুখ দিয়ে দিয়ে মাছ মাংসের এঁটো খেয়ে এল কি না। ক্ষেমী এক গাল হেসে বলল, দিদি, বিড়ালের খাবার জিনিস বিড়াল খাবে না! বললাম, তোমার আবার ছোঁয়াছুঁয়ি বিচার আছে কি না, তাই জিজ্ঞাসা করলাম। সেদিন সুখলকার মেয়েটাকে পিঁড়ি ছুঁড়ে মেরেছিলে তো। ক্ষেমী অম্লান বদনে বলল, মেথারানী আর বিড়াল কি এক হল দিদি? আর তা ছাড়া বিড়ালের গায়ে সব সময় লোমবস্তর থাকে না, তাই বিড়ালে কোনও দোষ হয় না। গুরুদেব বলেছেন।

‘শুধু এই নয় ফুলকি, তোর দাদী এই গল্পটা আমাকে বলে বলেছিলেন, শুনেছ বাবা গুরুদেবের বিধান। বিড়ালের গায়ে লোম বস্তর আছে, তাই বিড়াল ছুঁলে দোষ নেই মেথর ছুঁলেই দোষ। ক্ষেমীকে তার গুরুদেব আরও বলেছিলেন, বিড়াল খাবার পর আচমন করে। দেখো বিড়াল কেমন তার থাবা চেটে পরিষ্কার করে। ওই হল বিড়ালের আচমন। ক্ষেমীর গুরুদেব বলেছিলেন, বিড়াল পশুদের মধ্যে তাই তপস্বী। হেসো না বাবা, তায়েব, হেসো না, আমাদের গুরুদেবেরা চিরকাল ক্ষেমীদের এই জিনিসই বুঝিয়ে এসেছেন। আর আমাদের ক্ষেমীরা চিরকাল এটাকে শাস্তর বলে মেনে এসেছে। কেউ তো কোনওদিন প্রতিবাদ করেনি বাবা।’

‘তোর দাদীর কথাবার্তা ছিল এই ধরনের।’

তোমাদের সঙ্গে বুড়ি বুঝি খুব কথা বলত?

‘হ্যাঁ রে ফুলকি। আর সে সব কি কথা!’

‘অথচ এই দিবুই তো একদিন, তোমাদের অনশন করিয়েছিল বাবা, তায়েব না? সেই গান্ধীজি যখন আমরণ অনশন করেছিলেন পুনা জেলে? সেই দিবু কত বদলে গিয়েছে, বাবা, না?’

জ্যেঠামণি তোমাদের অনশন করিয়েছিলেন? কেন তায়েব কাকা?

‘ওহ্ সে এক কাণ্ড! বলতে গেলে দিবুদাই তখন আমাদের লিডার বনে গিয়েছিলেন। কি বল, হরি?’

‘কার মধ্যে কি থাকে, বলা শক্ত, তাই না তায়েব? দিবুদাকে আমরা বরাবরই সংসারী লোক বলে জানতাম। এত আন্দোলন গেল, এত কিছু ঘটে গেল দেশে, কিন্তু দিবুদা কোনটাতেই ভূক্ষেপ করেনি। বরাবরই আমাদের বলেছে, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে আমরা, লেখাপড়া শিখে সংসারের ভার আমাদের নিতে হবে। আমাদের বাবা মায়েরা আমাদের মুখের দিকে চেয়েই তো বসে আছেন। আমাদের উচিত লেখাপড়াটা ঠিকমত করে যাওয়া। আন্দোলন ফান্দোলন আমাদের জন্য নয়।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘সেই দিবুদা, গান্ধীজির আমরণ অনশনের সংকল্পে কেমন বিচলিত হয়ে পড়েছিল। দেখেছ তো? মানুষ বড় বিচিত্র জীবন হে, হরিকিশোর।’

‘দিবু সেদিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙিয়েছিল। দিবুকে দেখেই মনে হল, সারারাত সে ঘুমোয়নি। আমি বিছানা থেকে চোখ মুছতে মুছতে উঠে আসার সঙ্গে সঙ্গে দিবু বলল, মা আজ আমাদের বাড়িতে আগুন জ্বলবে না। আজ রান্না হবে না মা। আজ অরন্ধন। দিবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে বাবা? আজ ২০ সেপ্টেম্বর মা, দিবু যেন ককিয়ে উঠল। আজ থেকে পুনা জেলে গান্ধীজি আমরণ অনশন শুরু করছেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার প্রতিবাদে। এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা যদি রদ করা না যায়, তাহলে সব থেকে ক্ষতি হবে হিন্দু সমাজের। হিন্দু সমাজ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। গান্ধীজি সমাজে ভাঙন রোধ করবার জন্য প্রাণ বলি দিতে উদ্যত হয়েছেন। আমরা দেখাতে চাই মা, ভারতের সমস্ত হিন্দু গান্ধীজির পিছনে আছি। গান্ধীজিকে বাঁচাতেই হবে মা। আমি তায়েবদের বাড়িতে যাচ্ছি। সুধাকে বলে যাচ্ছি হরিকিশোরকে ডেকে আনতে।’

তায়েবকাকা বললেন, ‘সাতসকালে দিবুদার সেই হতচ্ছিন্ন চেহারা দেখে আমি বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম, ফুলকি। কি হয়েছে দিবুদা?’

‘আমাদের আজ অরন্ধন তায়েব। তোর বাড়িতেও তুই বলে দে। আজ যেন সকলে অনশন করে। গান্ধীজি আজ থেকে আমরণ অনশন শুরু করে দিয়েছেন। তুই আমাদের বাড়িতে চলে আয়।’

‘দিবুদার সেই মূর্তি আমি কিছুতেই ভুলতে পারিনে। সেদিন যখন সুধাদের বাড়িতে পৌঁছলাম, তখন দেখলাম, দিবুদা রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্ভাগা দেশ’ কবিতাটা আপন মনে আবৃত্তি করে চলেছেন, কবিতা নয়, সেটা যেন মন্ত্ৰ।’

হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,

‘সেটা ১৯৩২ সাল ফুলকি। তোকে ইতিহাসটা বলি, না হলে সেদিনের উন্মাদনা ধরতে পারবিনে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র‍্যামজে ম্যাকডোনাল্ড যে সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারের খসড়া তৈরি করেছিলেন, সেটা ১৭ আগস্ট প্রকাশিত হয়। ম্যাকডোনাল্ডের এই সিদ্ধান্তে মুসলমান, ইউরোপীয় ও শিখ সম্প্রদায়ের জন্য স্বতন্ত্র বা পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতে প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার দেওয়া হয়। মারাঠীদের জন্যও বোম্বাই প্রদেশে সাধারণ নির্বাচন কেন্দ্রে কিছু আসন সংরক্ষিত হয়। এই ঘোষণাবলে হিন্দু সমাজের নির্যাতিত ও অনুন্নত শ্রেণীগুলিকে একটা স্বতন্ত্র সংখ্যালঘিষ্ঠ সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য করা হয় এবং স্বতন্ত্র নির্বাচনের ভিত্তিতে তাদের জন্য কিছু আসন নির্ধারিত হয়। তা ছাড়া সাধারন নির্বাচকমণ্ডলীতেও তাদের ভোটাধিকার দেওয়া হয়। আদতে ম্যাকডোনাল্ডের এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা জিন্নার চোদ্দো-দফা শর্তাবলীকে সামনে রেখেই রচিত হয়। কংগ্রেস এতদিন ধরে যুক্ত নির্বাচন দাবি করে এলেও এই রোয়েদাদের ব্যাপারে কিন্তু মুসলমান ও শিখদের স্বতন্ত্র নির্বাচনে উচ্চবাচ্য করেনি। এমনকি গান্ধীজিও তুষ্ণীভাব অবলম্বন করেছিলেন। কিন্তু গান্ধীজি প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন অনুন্নত হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনের প্রস্তাবে। তিনি এই রকম কিছু আশঙ্কা করছিলেন। এই ঘটনার পাঁচ মাস আগে স্যামুয়েল হোরকে তিনি যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন যে, অনুন্নত হিন্দুদের জন্য স্বতন্ত্র নির্বাচনব্যবস্থা করা হলে তিনি আমরণ অনশনব্রত গ্রহণ করবেন। সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার ঘোষণা হওয়া মাত্র দেশব্যাপী তুমুল বিক্ষোভ আর আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। গান্ধীজির জন্য গোটা দেশটারই সেদিন কী উদ্বেগ! কেউ বললেন, যিশুকে নতুন করে ক্রুশবিদ্ধ করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘সূর্যের পূর্ণগ্রাসের লগ্নে অন্ধকার যেমন ক্রমে ক্রমে দিনকে আচ্ছন্ন করে তেমনি আজ মৃত্যুর ছায়া সমস্ত দেশকে আবৃত করেছে। এমন সর্বদেশব্যাপী উৎকণ্ঠা ভারতের ইতিহাসে ঘটেনি…’ কিন্তু এই ব্যাপার যে দিবুদাকেও এতখানি আলোড়িত করবে, তা আমরা বুঝতেই পারিনি।’

মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে
বিধাতার রুদ্ররোষে
দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে
ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

‘তোর জেঠামণির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাভক্তি বেড়ে উঠেছিল সেদিন। দিবুদাকে আমরা নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু তোর দাদীকে এই ঘটনায় আমি আরও ভালভাবে চেনবার সুযোগ পেয়েছিলাম, ফুলকি।’

‘যাদের আমরা ছুঁতে পর্যন্ত ঘৃণা করি, তারা যদি আজ ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবি তোলে, তাদের সেই দাবি তো আমাদের সমর্থনই করা উচিত, তাই নয় কি বাবা? অবিশ্যি যদি ন্যায্য বিচার করতে চাও।’

তোমার আসন হতে যেথায় তাদের দিলে ঠেলে
সেথায় শক্তির তব নির্বাসন দিলে অবহেলে।
চরণে দলিত হয়ে
ধুলায় সে যায় বয়ে,
সেই নিম্নে নেমে এসো নহিলে নাহিরে পরিত্রাণ।
অপমানে হতে হবে আজি তোরে সবার সমান।

‘দিবুদার গলায় এই কবিতাটা তখন যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। তখন যেখানে যত সভাসমিতি হয়েছে, দিবুদা এই আবৃত্তিটা আবেগের সঙ্গে আন্তরিকতা মিশিয়ে করতেন বলে লোকে মুগ্ধ হয়ে শুনত। শুধু মুগ্ধই হত না, ফুলকি। কী এক প্রচণ্ড উদ্দীপনাও ছড়িয়ে পড়ত লোকেদের মনে।’

‘তোর দাদী সেই সময় কি বলতেন জানিস ফুলকি?’

কি বলত বুড়ি? অমিতা সাড়া দিয়ে উঠল।

‘বলতেন, আচ্ছা বাবা তায়েব, গান্ধীজি সব ছেড়ে অস্পৃশ্যদের মন্দিরে ঢোকার অধিকারের উপর এত জোর দিচ্ছেন কেন, বলতে পার? আমি তো মেয়ে, অবহেলা আর অপমানের কী জ্বালা সে আমি বুঝি। মেয়েরা যেমন চিরকাল বঞ্চিত, ওই ওদের, অস্পৃশ্যদের চোখ মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারি, কী জ্বালা ওরা নিরন্তর বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। একদিন হৈ হৈ করে ওদের মন্দিরে ঢোকালেই ওদের জ্বালা যন্ত্রণার উপশম হয়ে যাবে, এমন ধারণা গান্ধীজির মতো পোড়-খাওয়া মানুষের হল? এটাই বড় আশ্চর্য।’

‘আমি তোর দাদীর কথায় চমকে উঠতাম, ফুলকি।’

‘দিবু কবিতা আবৃত্তি করছে করুক। কিন্তু দিবু কি জানে কবিতাটিতে কি বলতে চাইছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? ওর মনে কি সত্যিই ঘা মারে ওই কবিতার বাণী?’

যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

‘তোর দাদী যা বলেছিলেন সেদিন আমি তার মানেটা পুরো ধরতে পারিনি। আজ তা কত পরিষ্কার আমার কাছে।’

‘দিবুর মন সমাজপতির মন। এই মন নিয়ে এই ধরনের কবিতার মর্ম বোঝা যায় কি না আমার সন্দেহ হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাইছেন, হিন্দু সমাজকে বাঁচাতে। অধঃপতিত মানুষকে মন্দিরে ঢোকাতে পারলেই যেন, যারা পতিত করে রাখার গুরুমশাই তাদের মনটা বদলে যাবে। গান্ধীজি হিন্দু সমাজকে বাঁচাতে চাইছেন বলেই দিবুর গান্ধীভক্তি উথলে উঠেছে কিন্তু আমি হিন্দু সমাজের মেয়ে বলেই জানি বাবা তায়েব, হিন্দু সমাজ মরে পচে ঢোল হয়ে আছে। ওই মড়াটাকে কাঁধে তুলে গাজনের নাচ নাচলেই কি সে মড়া বেঁচে ওঠে। মড়া নিয়ে বেশি নাচানাচি করলে মড়াটা ভূত হয়ে ঘাড়ে চেপে থাকে। কেবল রবীন্দ্রনাথই এই সত্যটা দেখতে পেয়েছিলেন।

‘তারপর তোর দাদী কবিতাটার শেষ পক্তি আবৃত্তি করলেন। আমি আমি জানি—সে কখনও ভুলতে পারব না।’ তায়েবকাকার চোখ দিয়ে টসটস করে জল পড়তে লাগল কিছুক্ষণ পরে তায়েবকাকা ধরা ধরা গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন। ফুলকি তার সঙ্গে গলা মেলাল। অমিতাও দেখল, সে আবৃত্তি করে চলেছে—

‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে,
অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকারে।
সবারে না যদি ডাক,
এখনো সরিয়া থাক,
আপনারে বেঁধে রাখ চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান-–
মৃত্যুমাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।’

‘গান্ধীজির জন্য তখন দেশসুদ্ধ সবাই ভাবনায় অস্থির। কালীঘাটের কালীমন্দিরের দরজা হুটপাট করে খুলে দেওয়া হল, দল বেঁধে অস্পৃশ্যরা সেদিন তো ঢুকল মন্দিরে বাবা তায়েব। তারপর কতদিন তো পার হয়ে গেল।—তারপর—’

‘শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার
মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।’

‘কি বাবা, কোনও পরিবর্তন হয়েছে কারও। ক্ষেমী সেই ক্ষেমী বামনীই রয়ে গিয়েছে, সুখটকাও সেই মেথরানীই রয়ে গিয়েছে। ক্ষেমী বামনীকে দিয়ে সুখটাকে নমস্কার করাতে পারা গেল! পারলে তোমরা কেউ সেটা করাতে? তাহলে কি মনে হয় না, এর মধ্যে কোথাএ একটা বড় ফাঁকি রয়ে গেল?’

তোর দাদী আরও মারাত্মক কথা বলেছিল সেদিন, যেদিন দিবুদা এসে তোর দাদীকে প্রণাম করে বলল, ‘মা, আজ আমাদের স্বপ্ন সফল হয়েছে। অস্পৃশ্যদের কালীঘাটের মন্দিরে অবাধে ঢুকতে দেওয়া হয়েছে। আজ সারাদিন দলে দলে ধাঙড় মেথর মুচি মুদ্দফরাস মন্দিরে ঢুকে মাকে দেখে গিয়েছে।

‘বেশ বাবা, ভালই হয়েছে। ওরা মন্দিরে ঢুকেছে। এবার তবে ওদের শোবার ঘরে ঢোকার পথটা খুলে দাও, আমাদের হেঁশেলে ঢোকার পথটাও খুলে দাও। ওরা যাতে আমাদের হৃদয়মন্দিরে ঢুকতে পারে, সেই পথটা খুলে দাও। আমাদের শোবার ঘর মাড়িয়েই আমাদের হেঁশেল মাড়িয়েই না ওরা আমাদের মনের মন্দিরে ঢুকতে পারবে বাবা।

২৮

সেই জেঠামণি আলাদা হয়ে গেলেন। অমিতা বলে উঠল, না, বুড়িই জেঠামণিকে আলাদা বাসা নিতে বললেন।

জেঠামণি নাকি বলেছিলেন, ‘মা তুমি তোমার পাতানো সম্পর্কের জন্য তোমার রক্তের সম্পর্ককে পর করে দিলে!’

বুড়ি বলেছিল, ‘ও তুই বুঝবিনে দিবু। রক্তের সম্পর্কের চেয়েও কখন যে পাতানো সম্পর্ক আপন হয়ে ওঠে, সেটা তো সমাজপতিদের মন নিয়ে বোঝা যায় না বাবা। সত্যি বলতে কি, এ ব্যাপারটা অনুভবের ব্যাপার, কথা দিয়ে সবটা বোঝানোও যায় না। তুই বড্ড দোটানায় ছিলি দিবু, তোর কষ্ট মায়ের মন নিয়ে আর সহ্য করতে পারলাম না। তাই তোকে মুক্তি দিলাম। ভাল মনেই তোকে যেতে বলেছি, তোর ভাল হবে।’

‘দিবুদা সত্যিই সেদিন খুব আপসেট হয়ে পড়েছিলেন ফুলকি। মাসিমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মা, তুমি আমার কাছে চল।’

‘তুই বুদ্ধিকে স্থির রাখ দিবু। আমি যাই বঙ্গে আমার কপাল যায় আমার সঙ্গে। আমি তোর ওখানে গেলে আমার পাতানো সম্পর্কের লোকেরা তো সেখানেও ধাওয়া করবে। যা তুই এড়াতে চাইছিস, তুই কি আবার তার মধ্যেই জড়িয়ে পড়তে চাস?’

‘দিবুদা আর কোনও কথা বলতে পারেনি। ফুলকি, আমরা ঘটনাগুলো তখন কি ঘটছে সবই জানতাম। রোজ খবরের কাগজও পড়তাম। ডাঃ আম্বেদকর স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ভোজ কিংবা মন্দির কূপ চাইনে—আমি চাই সরকারি চাকরি, খাদ্য বস্ত্র, শিক্ষা, এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। সমাজে জাতিভেদ ছাড়া গুণভেদ ইত্যাদি অন্যান্য বৈষম্যও রয়েছে। এই সবের উচ্ছেদের জন্য রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। এই কারণেই আমার মত এখন বদলেছে। আমি এখন বুঝতে পারছি যে, সমাজ সংস্কারের আগে শাসন সংস্কার হওয়া উচিত। ১৯৩২-এর ২২ মে পুনাতে এই ঘোষণা করেছিলেন আম্বেদকর।’

অথচ বুড়ি কত সহজে এই সমস্যার মূলে পৌঁছে গিয়েছিল তাঁর নারীর হৃদয় দিয়ে, অমিতা যত ভাবে তত অবাক হয়।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘গান্ধীজির-আমরণ অনশন নিয়ে যে সময় দেশের সবাই উত্তাল হয়ে উঠেছে, সেই সময় তোর দাদী মাথা ঠাণ্ডা রেখে সমস্যাটাকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল। যখন সবাই অস্পৃশ্যদের মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য নাচানাচি শুরু করেছিল, তখন তোর দাদী বলেছিল, মন্দিরে কি আছে যার স্পর্শে ওরা শুচি হয়ে উঠবে? ময়লা জমে আছে তো আমাদেরই মনে। যার জন্য আমরা ওদের অস্পৃশ্য করে রেখেছি। আমাদের সেই মনের ময়লা দূর কর না তোমরা। ছত্রিশ জাতকে নিয়ে এক একটা ভোজের আয়োজন কর। বসাও সবাইকে এক পঙ্ক্তিতে। হিন্দু মুসলমান ব্ৰাহ্মণ শূদ্র স্পৃশ্য অস্পৃশ্য—মিলেমিশে অন্নপূর্ণার অন্নভোগ খাক। জাতের বালাই পালাই পালাই করবে। সুধা তোরা এটা করে ফেল তো?’

‘সুধা বলেছিল, করব মা, করব।

‘মাসিমা বলেছিলেন, শোন সুধা, তোকে একটা কথা বলি, তোকেই বলি, তুই বুঝবি।. আমি ম’লে চালকলার যা পিণ্ডি, সেটা দিবুই দেবে। তার জন্য তোকে ভাবতে হবে না। তুই করবি কি, আমার শ্রাদ্ধের দিন এ বাড়িতে বা যেখানেই থাকিস তখন, একটা মঙ্গলঘাট রাখবি একটা ঘরে, আর যারা ভালবাসে সেই মেথর ধাঙ্গড় মুচি, তাদের পরিবারের লোকেরা মুসলমান খ্রিস্টান তোদের বন্ধুবান্ধব সবাইকে জড়ো করবি সেদিন। তারা সকলে আসবে, আর তুই আমার ছেলে হিসাবে তাদের প্রত্যেকের হাতে এক কুষি জল ধরিয়ে দিবি। আর মঙ্গলঘাটে সেই জল ঢালতে বলবি। এই হল আমার শ্রাদ্ধের বিধান। কি, তায়েব বাবা কোনটা ভাল, আমার বিধান না পঞ্জিকা সম্রাটদের বিধান? এটা তুই করতে পারবি তো সুধা?’

‘সুধার বাড়িতে মাসিমার শ্রাদ্ধ এইভাবেই হয়েছিল। তোর মনে নেই ফুলকি?’

ফুলকি বলেছিল, মনে আছে। গোল হয়েছিল, সেটা মনে আছে।

অমিতা বলল, খুব মনে আছে তায়েবকাকা, খুব মনে আছে।

‘নেতারা এত কথা বলেন, কেবলই বকবক করছেন কেবলই বকবক করেই চলেছেন, কিন্তু কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। গান্ধীজির জীবন বাঁচাবার জন্য আম্বেদকর তাঁর দাবি থেকে সরে এলেন। পুনা চুক্তি হল। গান্ধীজি অনশন ভাঙলেন। গান্ধীজি বাঁচলেন। হিন্দু সমাজকেও বাঁচালেন। কিন্তু কি হল সুখকাদের? মানুষের অধিকার কতটুকু পেল তারা, তায়েব? আজকেও না তারা দাঁড়িয়ে আছে সেই একই জায়গায়, সেই অসম্মানের মধ্যে, হাজার হাজার বছর ধরে যেখানে তাদের ঠেলে রাখা হয়েছে।’

‘তোর দাদী একবার রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা থেকে, লেখাটা প্রবর্তক কাগজে বেরিয়েছিল, আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। কিছু কিছু জায়গা আমার মনে আছে, যেমন—প্রবাদ আছে, কথায় চিঁড়ে ভেজে না। তেমনি কথার কৌশলে অসম্মান অপ্রমাণ হয় না। কুকুরকে স্পর্শ করি, মানুষের স্পর্শ বাঁচিয়ে বলি। বিড়াল ইঁদুর খায়, উচ্ছিষ্ট খেয়ে আসে, খেয়ে আচমন করে না, তদবস্থায় ব্রাহ্মণীর কোলে এসে বসলে গৃহকর্মে অশুচি হয় না। মাছ নানা মলিন দ্রব্য খেয়ে থাকে, সেই মাছকে উদরস্থ করেন বাঙালী ব্রাহ্মণ, তাতে দেহে দোষস্পর্শ হয় না। মেথরের বৃত্তিতে যে মলিনতা, সে মলিনতা প্রতিক্ষণ আমাদের দেহে। …যাকে আমরা হীনবৃত্তি বলি, সে আমাদের প্রয়োজনে, ব্যক্তিগত আবশ্যকতা অনুসারে সেই সকল কাজ আমাদের প্রত্যেকেরই করা উচিত ছিল, আমাদের হয়ে যারা সেই দায় গ্রহণ করে, তাদের ঘৃণা করার মতো ঘৃণ্যতা আর নেই। …দেহের কলুষ জলে ধুয়ে যায়, মনের কলুষ কোনও বাহ্য স্নানে দূর হয় মনে করা মূঢ়তা। …কোনও জাতির হীনতা জন্মগত ও নিত্য, এ কথা মনে করাকে আমি অমার্জনীয় অধর্ম জ্ঞান করি

‘এরপর তোর দাদী আমাকে একটা কথা বলে থ বানিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই লেখাটা তোমাকে পড়ালাম এই কারণে, রবীন্দ্রনাথ এখানে মহাভারতের ভীষ্মকেও ছাড়িয়ে গেছেন মহত্ত্বে।

‘আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি তোর দাদীর দিকে ফুলকি। তিনি বললেন, ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে মরার আগে এই কথাই শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন যে, হীনজাতিকে উপদেশ প্রদান করা কখনই কর্তব্য নহে। যে ব্যক্তি নীচকে উপদেশ প্রদান করেন, তাঁহাকে শাস্ত্রানুসারে অবশ্যই অপরাধী হইতে হয়। এই হলেন মহাভারতের সর্বজনশ্রদ্ধেয় পিতামহ ভীষ্মমশাই। আর শোন রবীন্দ্রনাথের কথা, কোনও জাতির হীনতা জন্মগত ও নিত্য, এ কথা মনে করাকে আমি অমার্জনীয় অধর্ম জ্ঞান করি। আমার বলতে ইচ্ছে করে তায়েব, হে যুধিষ্ঠির, এখন বল, ভীষ্ম এবং রবীন্দ্রনাথ উভয়ের মধ্যে প্রকৃত জ্ঞানী কে? এবং যুধিষ্ঠির, ধর্মরাজ মহাশয়, তুমি বল, এমন শাস্ত্র কে রচনা করিয়াছেন যাহা যুগ যুগ ধরিয়া মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছে এবং মানুষকে কেবল ঘৃণা করিতেই শিখাইয়াছে। এবার তুমিই বল তায়েব, যে সমাজ এই ধরনের ধর্ম দিয়ে চলে সে সমাজকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য অস্পৃশ্যরা কেন উৎসাহ বোধ করবে? এ সমাজ ভেঙে যায়, এটাই কি তারা চাইবে না? এই কাজে বাধা দেওয়ার পিছনে যে কি মাহাত্ম্য কাজ করছে সে কেবল মহাত্মারাই জানেন।’

তায়েবকাকা থামলেন। কিন্তু অমিতা বুড়ির কথা শুনে যেতে লাগল সেই ঘরে, একা, আবছা অন্ধকারে বসে বসে। আর একটু পরেই তো কলকাতায় আরেকটা সকাল হবে। তার মানে অমিতার জীবনে আর একটা দিন শুরু হবে।

বুড়ি বলছিল, ‘দিবুকে আমি পর করে দিয়েছি বলে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা বলে। কথাটা ঠিক নয় বউমা। তোমার জেনে রাখা উচিত। দিবু দোটানায় খুব কষ্ট পাচ্ছিল। এক দিকে ওর সমাজের টান আরেক দিকে ওর মায়ের টান। আমি আমার দিকের বাঁধন কেটে ওকে মুক্ত করে দিয়েছি বউমা। আমার ভেইয়ার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক সেটা বোঝার মতো মন তো দিবুর ছিল না। ও এটা বুঝবে কি দিয়ে? আর কেই বা এই সম্পর্কটা বুঝবে? ছাঁচে ঢালাই সম্পর্ক এটা নয় বউমা। আমরা সম্পর্কটাকে নিত্যনতুন করে তৈরি করে নিয়েছি তো। এটা চট করে বোঝা মুশকিল।

আমি বুঝতে পারি বুড়ি। বুঝতে পারি।

‘তোমার শ্বশুরের সঙ্গে রাজগীরে গিয়েছিলাম। সে তো তোমরা জান। তোমার শ্বশুর আর আমি উষ্ণকুণ্ডে চান করে ফিরে আসছি আমাদের ঘরে। দেখি একজন মুসলমান ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে নিয়ে উষ্ণকুণ্ডের দিকে যাচ্ছেন। তোমার শ্বশুরের সঙ্গে ভদ্রলোকের কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। তারপর আমরা এসে ঘরে ঢুকলাম। তোমার শ্বশুর বললেন, ভালই হল একজন প্রতিবেশী পাওয়া গেল। উনি ছাপরা থেকে আসছেন। ওঁর চামড়ার ব্যবসা। কলকাতায়ও যান মাঝে মাঝে। হ্যাঁ জানো, ওঁর স্ত্রী পক্ষাঘাতে একেবারে পঙ্গু। হেকিম বলেছেন, ওঁকে উষ্ণকুণ্ডে রোজ চান করালে উপকার হবে। তাই কাল রাতে এখানে এসে পৌঁছেছেন। লজ্জাটজ্জা কর না কুসুম। গিয়ে ওঁর সঙ্গে গল্প করে এসো। আমি বললাম, আচ্ছা আচ্ছা সে হবে। আমরা একটু ঘুরে টুরে নিই। ওঁরাও গুছিয়ে নিন। এত তাড়া কিসের?’

অমিতা বলে উঠল, আর সেই রাতেই দাদু মারা গেলেন।

‘হ্যাঁ, সেই রাতেই আমি নিঃস্ব হয়ে পড়লাম। কেঁদেছিলাম কি? না। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম কি? বলতে পারিনে। তালগাছে বাজ পড়া কেউ কি দেখেছ?’

না বুড়ি। অমিতা বলে উঠল। অমিতা একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যেতে দেখল। বুড়ির কথা তার যখন কানে পৌঁছুচ্ছে তখন বুড়ির মুখটা তার ঘরের অন্ধকার ভেদ করে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠছে। বুড়িও চুপ করে করছে, তার মুখখানাও মিলিয়ে যাচ্ছে।

আমি দেখেছিলাম আমার বাপের বাড়িতে। বাজ পড়ার আগেও যে তালগাছ ছিল, বাজ পড়ার পরেও সেই অলগাছটা রইল। কিন্তু কোথাও একটা মারাত্মক রকমের তফাত ঘটে গেল। কোথায় তফাত ঘটল, কি তফাত ঘটল, বাইরের লোকে তক্ষুনি তক্ষুনি বুঝতে পারে না সেটা। আমার কোলে স্বামীর মড়া আর আমার সামনে সেই রাতটা। বিরাট রাত বউমা? আমার এখন মনে হয়, বেহুলার মন যার মধ্যে আছে সেই হয়ত আমার সেই তখনকার মনটাকে বুঝতে পারবে।’

বুড়ি, বুড়ি, আমার মনে হয়, আমি বোধ হয় তোমার সেইদিনের মনটাকে বুঝতে পারি। হ্যাঁ বুড়ি, পারি।

‘আমার জীবনটা এতদিন সোজা পথে চলছিল, হঠাৎ সেখানে পড়ে গেল একটা মোটা দাঁড়ির দাগ। এ যে কি ধরনের বিপর্যয় মনে জীবনে সংসারযাত্রায় তা কে বুঝবে বউমা?’

আমি বুঝতে পারছি বুড়ি। এবং এ বিপর্যয় শুধু মেয়েদের জীবনেই আসে। তাই না?

‘হ্যাঁ, পুরুষের জীবনে এমন বিপর্যয় ঘটে না। এ আমার অভিজ্ঞতা। কারণ কোনও পুরুষকে তো আর তার মৃত পত্নীকে কোলে নিয়ে বেহুলার ভেলায় ভাসতে হয়নি কখনও। পুরুষরা বড় জোর তাজমহল গড়ে দিতে পারে। মৃত পতির মাথা কোলে নিয়ে সারারাত নির্বান্ধব পুরীতে একা, কেবল সে, একা, যে কাটায়নি, সে ছাড়া আর কে বুঝবে বন্ধুর সঙ্গলাভের ইচ্ছা নারীর মনে কেন জেগে ওঠে এমন তীব্রভাবে?’

বুড়ি, বুড়ি, তুমি কি তখন কোনও বন্ধুর কথা ভাবছিল?’

‘না। তা ছাড়া আমার তো কেউ বন্ধু ছিল না তখন।’

সেই রাতে সেই ভয়ঙ্কর রাতে বা পরের রাতগুলোতে দুঃস্বপ্নে তোমার নিঃশ্বাস কি বন্ধ হয়ে এসেছিল, বুড়ি?

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’

ভূমিকম্পে পায়ের নিচে থেকে যেমন মাটি সরে যায় হঠাৎ, তোমার কি এই রকম অনুভূতি হয়েছিল বুড়ি?

‘হ্যাঁ। আমার কি তখন এ কথা মনে হয়েছিল, পৃথিবী বর্তমান আছে সূর্যচন্দ্র নিয়ে, আমার কি এ কথা মনে হয়েছিল, আমার ছেলেরা আমার আত্মীয়স্বজন মানুষও আছেন, কিন্তু কোথায় তাঁরা, কত দূরে তাঁরা? আমার মনে ও জীবনে এত শূন্যতা কেন, এত নিঃসঙ্গতা কেন, এ কথা কি তখন আমার মনে হয়েছিল?

নিশ্চয়ই তোমার মনে হয়েছিল বুড়ি। আমি জানি আমি জানি আমি জানি।

‘কিন্তু কখন আমার মনে হল, মানুষের জীবনে মানুষের সঙ্গ না হলে চলে না, কখন আমার মনে হল মানুষ মাত্রেই মানুষের প্রতিবেশী, তার জাত নেই ধর্ম নেই তার জ্ঞাত গোত্তর নেই। সে প্রতিবেশী।’

‘পরদিন খুব ভোরে পাশের বাড়িতে নামাজ পড়ার আওয়াজ পেয়ে আমার জড়ত্ব ভাব কেটে গেল। আমি কোল থেকে তোমার শ্বশুরের মাথাটা যত্ন করে বালিশের উপর নামিয়ে রাখলাম। গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললাম, ভেব না, তোমাকে আমি তোমার ছেলেদের কাছে পৌঁছে দেব। তারপর বাইরে থেকে দরজার শিকলটা টেনে নিয়ে নামাজের শব্দ শুনে আমার ভেইয়ার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। নামাজের শব্দ শেষ হতেই ভেইয়ার দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেইয়া বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখেই অবাক হয়ে বলে উঠলেন, আপা ক্যয়া হুয়া?

আমি বললাম, ‘আমার ঘরে চলুন ভেইয়া।’

আর কথা না বলে তিনি তিন লাফে আমাদের ঘরে পৌঁছে গেলেন। আমি যখন ঘরে ঢুকলাম, তখন দেখি ব্যস্তসমস্ত হয়ে তিনি তোমার শ্বশুরের নাড়ি দেখছেন বউমা। ভেইয়া পরক্ষণেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর তার একটু পরে ওঁর বিবিকে পাঁজাকোলা করে বয়ে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে রেখে বললেন, তুমি আপার কাছে থাক, আমি যা করবার তা করছি। আমার মুক্তি বউ, মুসলমানি নামটা মনে থাকে না কিছুতেই! তাই আমি ভেইয়ার বউকে মুক্তি বলে ডাকি। মুক্তি বউ আমার হাতটা টেনে নিয়ে যতক্ষণ ভেইয়া না এল, ততক্ষণ বসে থাকল। ওর পক্ষে অমনভাবে বসে থাকা যে কি কষ্টকর, আশ্চর্য এই কথাটাই আমার মাথায় তখন ঘোরাফেরা করছিল।’

কিছুক্ষণ বুড়ির কোনও সাড়াশব্দ পেল না অমিতা। তার জানলায় তখন আলোর ইশারা।

তারপর তো সবই হল। কিন্তু পঙ্গু বউটাকে যে আমার কাছে বসিয়ে রেখে গিয়েছিল ভেইয়া, এটা আমি কি করে ভুলি। আমার ভেইয়া ছাড়া এমন কাজ কেউ করত! আমার সমস্ত জীবনের ভালবাসা দিয়েও কি আমি এই ভালবাসার কণামাত্র প্রতিদান দিতে পেরেছি। সঙ্গী শুধু পুরুষেরই দরকার এটা বাজে কথা। মনের মতো সঙ্গী মেয়েদেরও দরকার। মেয়ে বলেই তো জানি মেয়েদের জীবনে সবটাই বিপর্যয় ও সংঘাতের মধ্যে দিয়ে চলা। নিজের ছেলেও বৈরি হয়ে যায়। পুরুষদের চলাফেরার বিধিনিষেধ নেই। বন্ধু নির্বাচনেও বিধিনিষেধ নেই। কিন্তু মেয়েরা সঙ্গী ও সঙ্গহীন জাত।’

‘এটা কি কেউ বুঝবে যে, মনের দিক দিয়ে পুরুষের যা যা দরকার, মেয়েদেরও তাই তাই দরকার।’

কেউ বুঝবে না বুড়ি। কেউ না। ঊষার আলোকে সাক্ষী রেখে অমিতা এই সত্যটা উচ্চারণ করল।

২৯

এই ভোরের আলো আজ অমিতার কাছে কোনও প্রত্যাশা নিয়ে এল না। তবুও আলো তো? দুদিন আগে কেমোথেরাপি নিয়েছে অমিতা। তার ধকল এখনও সামলাতে পারেনি। কেমোথেরাপি তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, এ কথা বলতেই হবে। কিন্তু এত হুজ্জত সামলাতে হয়। প্রতিবার কেমোথেরাপি নেবার আগে রক্ত পরীক্ষা, টি সি ডি সি হিমোগ্লোবিন প্লেটেলেট সুগার সব পরীক্ষা। ডব্লিউ বি সি তিন হাজারের কম হলেই মুশকিল। রক্ত পরীক্ষা প্রত্যেকবার, কেননা সেটাই বড় কথা। শরীর কেমোথেরাপি নিতে পারবে কি না সেটা দেখতে হবে। প্লেটেলেট আড়াই লাখের কম হলে চলবে না। তাই প্রাণিজ প্রোটিনযুক্ত খাবার খুব বেশি করে খেতে হবে। অমিতার যেহেতু আলসারেটিভ কোলাইটিস আছে। দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে। কোন্ ব্যাধি নেই শরীরটায়!

অমিতা চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগল ঘরটা কেমন রোদে ভরে উঠছে। সকালে রোদটাকে অমিতার কেমন বিষণ্ণ বোধ হল। কেমন যেন তারই মতো অবসন্ন। সূর্যদেবও কি তাহলে কেমোথেরাপি নিচ্ছেন? কোলাইটিস আছে কি তাঁর? অমিতা তেজোহীন চোখ দিয়ে সকালের সেই নিস্তেজ আলোকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। সূর্যের জিয়ারডিয়া আছে? পেটে হাত দিল অমিতা। জিয়ারডিয়া চাগাড় মেরে উঠতে চাইছে। ডাক্তার বলেছেন, ভেজিটেবল প্রোটিন আপনার জন্য নয়। এত সব ব্যাধি জমিয়ে রেখেছেন শরীরে! আপনাকে অ্যানিম্যাল প্রোটিনই খেতে হবে। অমিতা এমন কোনও ওষুধও খেতে পারবে না, ভিটামিন, যাতে ফলিক অ্যাসিড আছে। ফলিক অ্যাসিডে রক্ত তাড়াতাড়ি বাড়ায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়ে দেয় ক্যান্সারের সেলগুলোকেও। অমিতার মনে পড়ল ইস্কুলের বেঞ্চিতে বসে বসে বাসনা বা সুপ্রীতির সঙ্গে কাটাকুটি খেলার কথা। বাসনা প্রায়ই তাকে দোফাঁদে ফেলে দিত। যেদিকে যাও তোমার হার। ওর শরীর নিয়ে অমিতা যেন ক্যান্সারের সঙ্গে কাটাকুটি খেলা খেলছে। আর দোফাঁদে পড়ে গিয়েছে। বাসনার কাছে যত হেরে যেত অমিতা, ততই তার জেদ বেড়ে যেত। বাসনাকে হারাতেই হবে, এই ছিল অমিতার প্রতিজ্ঞা। একটা খেলাতেও সে বাসনাকে হারাতে পারেনি।

বাসনাকে সে হারাতে পারেনি। কিন্তু তার লড়াই চালিয়ে গিয়েছে নব নব উদ্যমে। কি কষ্টকর চিকিৎসা ক্যান্সারের! ইন্টারভেনাস্ ইঞ্জেকশন। স্যালাইন ওয়াটারের ভেতর দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় তার রক্তের ভেতর ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ক্যান্সার প্রতিষেধকের যা কিছু ওষুধ।

তার সঙ্গেই মিশিয়ে দেওয়া হয় ঘুমের ওষুধ। ভাগ্যিস দেয়। না হলে যন্ত্রণার মুক্তি নেই তো। ধীরে ধীরে অমিতা কেমন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আহ্ আহ্ আর যদি তাকে জেগে না উঠতে হত! কোনও দিন জেগে না উঠতে হত! ‘আমরা মৃত্যুর আগে কি বুঝিতে চাই আর? জানি না কি আহা, সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে/ধূসর মৃত্যুর মুখ, একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল—সোনা ছিল যাহা/নিরুত্তর শান্তি পায়—’

আহ্ শামিম, তুমি এই কবিতাটা একদিন শুনিয়েছিলে আমাকে সেই দিন আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনের মাঠে বসে অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম। আমরা বিয়ে করব—ঘরকন্না করব—তুমি আমি, দুজনকেই অবশ্য চাকরি নিতে হবে। আমি বলেছিলাম আর কয়েকটা মাস, কয়েকটা মাস আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে। আমার বি-এ পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই আমরা বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে ফেলব। কিন্তু তোমার আর তর সইছিল না তো। তুমি পরদিন থেকেই মহা উৎসাহে কলকাতায় যত ম্যারেজ রেজিস্ট্রার আছে তাদের ঠিকানা তোমার বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে জোগাড় করতে শুরু করেছিলে। মনে পড়ে শামিম?

একদিন পৃথিবীতে স্বপ্ন ছিল—সোনা ছিল
নিরুত্তর শান্তি পায়

নিরুত্তর শান্তি! তুমি সেদিন জানতে না শামিম, নিরুত্তর শান্তি কিসে পাওয়া যায়। আমি আজ জানি, সূক্ষ্ম মুখ দিয়ে ঘুমের ওষুধ যখন ফোঁটা ফোঁটা শরীরের রক্তে মিশে যেতে থাকে, নিরুত্তর শান্তির সময় তখনই আসে। কিন্তু তবুও ঘুম ভাঙে। মাঝ রাতে। নিঃসঙ্গ জীবনে। সারা মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা তখন। ‘তোমার সব উদ্বেগ তোমার ভয় তোমার আশঙ্কা, এই দেখ সব আমি আমার ঠোঁট দিয়ে শুষে নিলাম তোমার মন থেকে। আমার উপর ভরসা রাখো ফুলকি।’ আহ্ শামিম শামিম! যা বলেছিলে, তুমি তাই করেছিলে। তোমার সেই মায়াবী ঠোঁটের স্পর্শে আমার মনে যা কিছু যন্ত্রণা সেদিন শুষে নিয়েছিলে তুমি। দু’দিন তো ইঞ্জেকশন দেবার পর রাইগারই হল। সে কি কাঁপুনি, সে কি কাঁপুনি! আর জ্বর। গরম জলের ব্যাগ মোজা ও ওষুধ ডাক্তার কত কাণ্ড।

বুড়ি তুমি বলেছিলে, মৃত পতিকে কোলে নিয়ে যে নারী বেহুলার ভেলায় ভাসেনি, নারীর নিঃস্বতা নিঃসঙ্গতা আর রাতের অন্ধকার কী রূপ ধরে তার কাছে আসে, সেটা তার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়! আমি বেহুলার ভেলাতেই তো ভাসছি বুড়ি, একেবারে নিঃস্ব। নিঃসঙ্গ। ফুলকি, তোমার ফুলকিও বেহুলার ভেলারই যাত্রী বুড়ি। তবে তার কোলে তোমার মতো মৃত স্বামী ছিল না, ছিল মৃতবৎ এক প্রেম কি কষ্টকর এই কেমোথেরাপি! গত দু’দিন ধরে ধকল সইছে অমিতা। ঘুমের ওষুধের প্রভাব কাটতেই শুরু হয় মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। বুড়ি তোমার সেই অন্ধকার রাত। এক নিঃস্ব নিঃসঙ্গ নারী আর তার সামনে রোজই আসে পারাবারহীন এক জমাট রাত।

সব রাঙা কামনার শিয়রে যে দেয়ালের মতো এসে জাগে
ধূসর মৃত্যুর মুখ

আহ্ শামিম, তুমি জীবনানন্দের এত কবিতা থাকতে বেছে বেছে এই কবিতাটাই বা আবৃত্তি করেছিলে কেন? প্রেসিডেন্সি কলেজের পিছনের মাঠে, সেই আবছা অন্ধকারে কামনার জোয়ারে আমরা দুজনেই যখন ভেসে যাচ্ছিলাম, তখন তুমি দেখতে পেয়েছিলে কি ধূসর মৃত্যুর মুখ আমাদের ভালবাসার শিয়রে এসে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে? বেহুলার ভেলায় তখন উঠে পড়েছে ফুলকি। তার কোলে তখন যে ভালবাসা, সেটা জীবিত না মৃত, ফুলকি বুঝতে পারছিল না। আর পারছিল না বলেই সে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করছিল। সেটা আমার এখনকার সঙ্গী, সেই সকালের ভোঁতা আলোটাকে শুনিয়ে যেন বলতে চেষ্টা করছিল। কেমোথেরাপির যন্ত্রণাকে আর কোনও যন্ত্রণার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়। গা বমি বমি, সারা গায়ে যেন ছুঁচ ফুটছে, এমন যন্ত্রণা কি তুমি অনুভব করেছিলে বুড়ি, যেদিন তুমি রাজগীরে তোমার ঘরে দরজা দিয়ে দাদুর মড়া কোলে করে বসেছিলে? কেমন একটা অসহনীয় ভাব যে শরীরে ফুটে ওঠে তখন, কিছুতেই বোঝানো যায় না। কোনও তুলনা কোনও উপমাই ধারেকাছে পৌঁছুতে পারে না। ক্রমে ক্রমে দুর্বল করে ফেলে তার শরীরকে। আর সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে তার বহুদিনের অযত্নে ফেলে রাখা ব্যাধিগুলি। কোলাইটিস, ডায়াবিটিস। কি নেই তার শরীরে! অথচ এই শরীরই না একদিন কামনার তাড়সে থরথর থরথর করে কেঁপেছে। আজ সেই শরীরকে তেমন করেই কাঁপায় রাইগার আর প্রবল জ্বর! শরীর, আহ্ শরীর! বেহুলার ভেলা!

ফুলকি বুঝতে পারছিল না, তার ভালবাসা তখনও বেঁচে আছে না নেই। শামিমের সঙ্গে তখন ক্বচিৎ দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে তার। যত সে মনে করছে শামিম তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ততই শামিমকে পাবার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে প্রবল হয়ে জেগে উঠছে। সুখকর স্মৃতির বর্ণনা বেশি দেওয়া যায় না। বারে বারে একই কথা বলতে হয়। দুঃখের স্মৃতিই দীর্ঘ। কষ্ট যন্ত্রণা অভিমান কত কি যে থাকে তার মধ্যে মিশে! ফুলকির ডায়েরিগুলো উল্টে দেখেছে অমিতা। তখন দিনের পর দিন ডায়েরি লিখছে না ফুলকি। পাতাগুলো ফাঁকা একেবারে ফাঁকা। ওর মোটা খাতায় এলোমেলো কিছু কিছু অক্ষর সাজানো। জায়গায় জায়গায়।

‘বড় কষ্ট। বারে বারেই শ-কে দেখছি। ভাবতেই পারছি না, সে আমার থেকে এত সরে গিয়েছে। ভাবতেই পারছি না ওর উপর আমার আর বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। ভাবতেই পারছি না ও আমাকে আর সকলের মতোই দেখছে। ওর অস্তিত্বটাকে কি তাহলে সেইভাবেই স্বীকার করে নিতে হবে? কি চাও ঈশ্বর? আমি মরে যাই? হ্যাঁ তাই যাব। এই অবহেলা এই অনাদর আমি কিছুতেই স্বীকার করে নিতে পারব না। এখনও বিশ্বাসে ভর করে আছি—যদিও মনে হচ্ছে সমস্তই অলীক—যেদিন ভাঙবে সেদিন হয়তো আত্মহত্যাই করব।’

বেহুলার ভেলা!

‘চলে যাওয়া দিনগুলো পেরচ্ছি ঠিকই—কিন্তু প্রতিটি মুহূর্তে মনে হচ্ছে একটা কাঁটা বিঁধে আছে আমার মনে—হোয়াই শুভ্ আই লিভ—কেন বেঁচে থাকব—কেন কেন—এত অন্যায়ের মধ্যে কি বেঁচে থাকা যায়—কেন বেঁচে থাকব কোনও কারণ খুঁজে পাচ্ছি না—কোনও কারণ তো নেই—আমি তো চারদিকের সমস্ত মানুষকে দেখেছি—কাউকে ভালবাসি না—ভাল লাগে না—বড় দুঃখ দিয়েছে এরা।

বেহুলার ভেলা!

‘দেখতে দেখতে দশ দিন কেটে গেল। কোনও দিক থেকেই কোনও সাড়াশব্দ নেই। যে যার নিজেকে নিয়ে মগ্ন—শুধু আমাকে একটা রাস্তার মাঝখানে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছে। এই ক’দিনে বিচিত্র মানসিক উত্তরণ অবতরণের মধ্য দিয়ে চলেছি কেবল কতকগুলো আকারবিহীন অনুভবকে নিয়ে। আমার মুল অনুভূতি এখন ঘৃণা আর আক্রোশ—চারপাশের সমস্ত কিছু—অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমানের প্রতি জেগে উঠছে আক্রোশ। কারণ যখনই বিশ্লেষণ করে দেখছি, আমার পরিস্থিতির পটভূমি বিচার করে দেখছি, আমার সব কিছুকেই দেখছি বুঝছি, তখন দেখছি, যে অন্যায়কে ঘৃণা করি, দূর থেকে এতদিন যার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছি, এখন দেখছি সেই অন্যায়েরই শিকার আমি—ঈশ্বর ঈশ্বর, মানুষ আমার অস্তিত্বকে মুছে ফেলতে চায় কিন্তু তুমি তুমি তুমি—আমি কারও সন্তান হতে চাই না—কারও আত্মীয় হতে চাই না, কারও প্রেমিকা, হ্যাঁ প্রেমিকা হতে চাই না—চাই না না—আমি আমি হতে চাই প্ৰভু।

না বুড়ি, তুমি যখন বেহুলার ভেলায় চেপে সেই নিঃসীম শূন্যে ভেলা ভাসিয়েছিলে তখন তোমার মনে ঘৃণা ছিল না, আক্রোশ ছিল না কারও প্রতি। তোমার সারা মনটা জুড়েই তো শূন্যতা বিরাজ করছিল। তবু তোমার মনে তখনও ভালবাসার ফল্গুধারা বইছিল। না হলে তুমি তোমার ভেইয়াকে পেতে না। না হলে এ কথা বলতে পারতে না, ‘দিবু কি বুঝবে কেন ভেইয়ার বাড়িতে যাব। সে মন তো ওর নেই।’

কিন্তু ফুলকি তখনও তোমার মনটা পাযনি বুড়ি। ও তখন বড্ড ছেলেমানুষ ছিল। ও এই সংসারের দাবাখেলার কিছু বুঝতে শেখেনি তখন। ফুলকি তখন কেবলই হেরে যেতে বসেছিল। কিন্তু বুড়ি তুমি তো জানো, তুমি তো বোঝ, সংসারের দাবাখেলার ছকে ফেললেই হারজিতের মীমাংসা করা যায় না। হার হয়, জিতও হয় ভাগ্যদেবীর নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বুড়ি, তুমি কি ভাগ্যদেবীকে পাত্তা দিতে? মনে হয় না। কিন্তু আর কিভাবেই বা তোমাকে বোঝাব? আমিও ভাগ্যদেবীকে পাত্তা দিইনি বুড়ি। কিন্তু কোনও কথা বোঝাতে ‘ভাগ্য’ কথাটাকে টেনে আনতেই হয়। হার হয়, জিতও হয় ভাগ্যদেবীর নিয়ন্ত্রণে। যখন হেরে যায় সেই নারী, পরাজিত হয় ‘নারী’ নামের মানুষটা, তখনও সে যায় কোথায়? সেইটেই হল সমাজের নিষ্ঠুর অনুশাসনে মানুষের অপচয়ের দিক। এই অপচয়ের জগৎই হল নারীজগৎ। ফুলকির তখন মনে হয়েছিল বুড়ি, সে ক্রমাগত হেরে যাচ্ছে। সকলেই তাকে হারিয়ে দিচ্ছে। অপচয়ের ঝুড়িতে তাকে ফেলে দিচ্ছে সবাই। সেও একটা শূন্যতার মধ্যে তখন বন বন করে পাক খাচ্ছিল তো! কিন্তু দেখ বুড়ি, এটা তুমি দেখ, হেরে যেতে যেতেও ফুলকি, তোমার ফুলকি, তোমারই মতন দান ছাড়েনি। তখন সে বলে চলেছে, ‘আমি আমি হতে চাই প্ৰভু। যতই যন্ত্রণা সে পাক, ভালবাসার প্রতি বিশ্বাসটা সে গোয়াঁরের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। এই জায়গায় তোমাদের দুজনের মধ্যে মিল পাই বুড়ি।

হ্যাঁ, এটা অবশ্য ঠিক যে, তার হাত থেকে মাঝে মাঝে বৈঠাটা ফসকে ফসকে যাচ্ছিল, তখন সে হালে পানি না পেয়ে মৃত্যুকে বরণ করার কথা ভাবছিল। এক জায়গায় লিখেছিল, ‘নো অপশন, বাট্ ডেথ।’ মৃত্যু ছাড়া গতি নেই। খাতটার সেই পাতায় আর কিছুই লেখা ছিল না। কিন্তু ঠিক কবে এ কথা লিখেছিল ফুলকি? মনে করতে পারল না অমিতা। তবে সময়টা তার মোটামুটি মনে আছে। তখন শামিমের সঙ্গে তার দেখাই হচ্ছে না। অবশ্য সে সময়টাও সব দিক থেকেই খুব খারাপ সময়। আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রথম হাঙ্গামা মিটতেই আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রসিদ আলিকে মুক্ত করা নিয়ে কলকাতার ছাত্রদের মধ্যে আবার উত্তেজনা সৃষ্টি হতে লেগেছিল। আবার শামিম হারিয়ে যেতে লাগল ফুলকির কাছ থেকে। আবার এই সময়েই কোনও একদিন ফুলকি তার খাতার পাতায় লিখে রেখেছিল, ‘সবচেয়ে সত্য মোর, সে আমার প্রেম, সেই মৃত্যুঞ্জয়।’ সেই উত্তেজক সময়ে দেখা যাচ্ছে, ফুলকির মনে হতাশা, আবার কখনও প্রত্যাশার একটা ক্ষীণতম আলোর রেখা উকিঝুঁকি মেরেই যাচ্ছিল।

আর কি সমস্ত ঘটনা ঘটে গেল তিন মাসের মধ্যে। নভেম্বর মাসে ক্যাপ্টেন শাহ্ নওয়াজ, ক্যাপ্টেন আর ধীলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের এই তিন সেনানীর বিচারকে উপলক্ষে করে তুমুল ছাত্রবিক্ষোভ হয়ে গেল কলকাতায়। হাঙ্গামার জের দু-তিনদিন ছিল। রামেশ্বর ছাড়া আরও অন্তত ২০ জন শহীদ হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে আজাদ হিন্দ ফৌজের আর একজন সেনানী রসিদ আলির মুক্তির দাবিতে ছাত্র বিক্ষোভ কলকাতায় হয়েছিল, তা উত্তেজনায় আলোড়নে হাঙ্গামায় নভেম্বরের হাঙ্গামাকে অনেক দূর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬—হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল আর তার জের চলেছিল ১৪, ১৫ তারিখ পর্যন্ত। শহীদের সংখ্যাও ঢের বেড়ে গিয়েছিল। এই ক’দিনে মোট শহীদ হয়েছিলেন প্রায় ৬০ জন। অমিতা গাঢ় স্বরে বলেছিল, তাদের নাম কেউ মনে রাখিনি।

তুমি কি এখন সে কথা ভাব শামিম? আজ এখান থেকে কি সেই দিনের ছবি তোমার মনে উদয় হয়। হাঙ্গামা চুকে গেলে ফুলকিকে বলেছিলে, ‘ফুলকি হিন্দু মুসলমান, সব এক মায়ের সন্তান, সেটা এবার তারা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে।’ তুমি হয়ত লক্ষ করনি সেদিন শামিম, তোমার উৎসাহে ফুলকি সাড়া দিতে পারেনি। কিন্তু তুমি তো, তোমার আরেকটা স্বপ্ন নিয়েই সেদিন মগ্ন ছিলে, তাই ফুলকির এই আগ্রহের অভাব তোমার নজরে পড়েনি। ফুলকি যে জিনিস সেদিন দেখতে পেয়েছিল, তোমার নজর সেটা এড়িয়ে গিয়েছিল। সে কি তুমি পুরুষ বলেই? তোমার উৎসাহে সেদিন বাধা দেয়নি ফুলকি। তুমি ভেবেছিলে, তুমি বীরের চেহারা নিয়েই হাজির হয়েছ ফুলকির সামনে। তাই না শামিম? এমনি কিছু ভেবেছিলে তো?

তুমি বলেছিলে, তোমার সেদিনের চোখে মুখে।. . . এক উন্মাদনা ছিল সেইদিন, ফুলকি তাকে ভয় করতে লেগেছিল, তুমি বলেছিলে শামিম, ‘কংগ্রেসের পতাকা আর মুসলিম লিগের পতাকা এবার এক হয়ে পথে বেরিয়েছিল ফুলকি। এ কাজ আগে আর কখনও হয়েছে? আমি তোমার বাবাকে সেদিন এ কথা বলেছিলাম ফুলকি। এবার ছাত্রসমাজ অনেক হুঁশিয়ার আছে। এবার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন হবে। কি হল তো? তোমার বাবা সেদিন আমার কথা বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারেননি। আজ নিশ্চয়ই করবেন।’

তুমি ঠিকই বলেছিলে শামিম, রশিদ আলি দিবস সত্যিই কংগ্রেস পতাকা আর মুসলিম লিগের পতাকাকে সেদিন বিক্ষোভের আগে রেখেছিল কিন্তু ফুলকি তাতে বিশেষ আশ্বস্ত হতে পারেনি। কারণ সে দেখেছিল, এ বন্ধন ভালবাসার বন্ধন ছিল না। এটা ছিল আক্রোশের বন্ধন, হিংসার বন্ধন, হিংস্রতার বন্ধন। তুমিই তো বলেছিলে শামিম, হিংসার ঔরসে যে সন্তানের জন্ম হয়, তার দ্বারা কোনও কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। বলনি কি তুমি? যে মন নিয়ে তুমি ফুলকিকে এই কথাটা বলেছিলে সেদিন, সেই যেদিন হিরোসিমা নাগাসাকিতে অ্যাটম বোমা পড়েছিল?, সেই মন তোমার কোথায় গেল শামিম? তুমি কি, তুমিও কি সেই মনটা হারিয়ে ফেললে? ফুলকি, তোমার ফুলকি, যদি অবশ্য এখনও তোমার মনে তার আসন থেকে থাকে, সে কিন্তু তোমার কথা থেকে নড়েনি? সে কি মেয়ে বলেই?

সন্দেহ নেই, তোমরা রশিদ আলি দিবসে হিন্দু মুসলিম ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করেছিলে, সন্দেহ নেই শামিম, তোমরা পাশাপাশি কংগ্রেসের পতাকা আর মুসলিম লিগের পতাকা বয়ে নিয়ে গিয়েছিলে বিক্ষোভ মিছিলে। কিন্তু তুমি কি এটা লক্ষ করেছিলে যে, তোমরা একটা বৃত্তের মধ্যেই ঘুরছ। সেই নভেম্বরের আন্দোলনেও যা যা করেছিলে তোমরা, ফেব্রুয়ারির আন্দোলনেও ঠিক এই একই কাজ করেছিলে? নজরে পড়েনি তোমার? হিংসা আর উন্মাদনা যেন তোমাদের গ্রাস করেছিল শামিম। ফুলকি ক্রমশই ভয় পেয়ে যাচ্ছিল। ক্রমশই সে তোমার কাছ থেকে সরে যাচ্ছিল। আর কি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে ভুগছিল। তার কেবলই মনে হচ্ছিল শামিম, তুমি ফুলকির কাছ থেকে সরে যাচ্ছ। সরে যাচ্ছ।

ছাত্ররা একইভাবে ১৪৪ ধারা ভাঙছিল, একইভাবে সরকার, সরকারের পুলিশ তোমাদের ওপর লাঠি মারছিল, টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছিল, গুলি চালাচ্ছিল। বাড়িঘরে আগুন লাগাচ্ছিল। গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছিল। তারপর তোমাদের শেষ দাবি : তোমরা ডালহৌসি স্কোয়ারে ঢুকবে। সেই আগের বার যেমন ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সভা হয়েছিল, যেমন শরৎবাবু সরকারের উপর চাপ দিয়ে তোমাদের ডালহৌসি স্কোয়ারে যাবার রাস্তা করে দিয়েছিলেন, এবারও তো তাই হল। তবে এবার নাজিমুদ্দিন আর সুরাবর্দী এসেছিলেন তোমাদের কাছে। সুরাবর্দী তখন সরকারের মাথা। প্রধানমন্ত্রী। প্রিমিয়ার। তাঁরই নেতৃত্বে তোমরা ডালহৌসি স্কোয়ারে পৌঁছে গিয়েছিল। সেই শরৎবাবুর দেখানো পথে। তোমরা বলতে চেয়েছিলে, এটা তোমাদেরই বিজয়। হাঃ! শরৎবাবু এবার বিবৃতি দিলেন যে, ‘শহরের গুণ্ডাপ্রকৃতির এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকেরাই যে অত্যন্ত প্রবল হইয়াছে, গত দুই দিনের ঘটনায় তাহা আর একবার প্রমাণিত হইল। …গতকল্যকার সভা ও শোভাযাত্রা আগাগোড়া শান্তিপূর্ণ ছিল, কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লাঠি ও গুলিচালনার কোনই অজুহাত বা যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। …আমরা সংবাদ পাইয়াছি যে, ঐ সকল লোক পথচারীদিগকে এবং সরকারি ও বে-সরকারি যানবাহনসমূহকে আক্রমণ করিয়াছে। কোনও কোনও স্থলে তাহারা মোটর গাড়ি ও মোটর লরিতে আগুন ধরাইয়া দিয়াছে। এমন কি তাহারা গৃহস্থবাড়ির আসবাবপত্রেও আগুন দিতে দ্বিধা করে নাই। আমরা অতি বিনীতভাবে কলিকাতার নাগরিকগণকে, বিশেষ করিয়া যুবকদিগকে এই বিষয়টি উপলব্ধি করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছি যে, এই শহরকে গুণ্ডাদের ও দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকদের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া যাইতে পারে না। …যে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলিতেছে তাহার সাফল্যকল্পে আমাদিগকে শান্ত ও নিয়মশৃঙ্খলাধীন সৈনিকের ন্যায় কাজ করিতে হইবে।’ পড়েছিল কি শামিম?

আনন্দবাজারে খাজা স্যর নাজিমুদ্দিন ও মিঃ এইচ এস সুরাবর্দীর বিবৃতিও বেরিয়েছিল : ‘গত সোমবার যে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়াছে তাহা অত্যন্ত শোচনীয়। আমরা রাজনৈতিক দল নির্বিশেষে নাগরিকগণকে অদ্য (মঙ্গলবার) বেলা ১টার সময় ওয়েলিংটন স্কোয়ারে সমবেত হইতে অনুরোধ করিতেছি। ঐ সভায় আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারিত হইবে। তৎপূর্বে আমরা প্রত্যেককেই শান্তিরক্ষা করিতে এবং শান্ত থাকিতে অনুরোধ করিতেছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে যে, আমাদের ন্যায়সঙ্গত উদ্দেশ্যের বৈধতা প্রতিপন্ন হইবে। আমাদের যে সমস্ত মুসলমান ও হিন্দুভ্রাতা আহত হইয়াছেন, তাহাদিগকে আমরা আন্তরিক সহানুভূতি জ্ঞাপন করিতেছি।’ পড়েছিলে কি শামিম?

তোমরা বিক্ষোভ মিছিলে কংগ্রেস পতাকা আর মুসলিম লিগের পতাকা এক ঠাঁই করেছিলে বলেছিলে না? কিন্তু কংগ্রেস নেতা ও মুসলিম লিগের নেতা এই বিক্ষোভকে কী চোখে দেখেছিলেন শামিম?

শামিম, ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্টেই কলকাতার পথ নাগরিকদের রক্তে ভিজে যায়নি। যে ঘৃণা যে হিংস্রতা সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে কলকাতায় রক্ত ঝরিয়েছিল, তার সূচনা হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে। না, না, ১৯৪৫-এর নভেম্বর মাসে। রামেশ্বর সেই ঘৃণা ও সেই হিংস্রতারই বলি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *