প্রতিবেশী – ২.২০

২০

ফুলকি আর শামিমের মধ্যে তখন যে ভুল বোঝাবুঝি চলছিল তাতে ফুলকি একাই কষ্ট পাচ্ছিল না। শামিমও কষ্ট পাচ্ছিল। কেন না শামিমও যথেষ্ট চাপের মুখে ছিল তখন। শামিমই বলেছিল ফুলকিকে প্যারাগনে চলে আসবার জন্য। ফুলকি এসেছিল। সে ভেবেছিল, এসেই সে শামিমকে দেখবে। না দেখে হতাশ হল একটু। দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল ফুলকি। কিন্তু দোকানের সেই ছেলেটাকে দেখে ঢুকে পড়ল ভিতরে। শামিম নেই। ঘড়ি দেখল ফুলকি। একবার ঘড়িটাকে কানের কাছে আনল। ঘড়ি বন্ধ। ছেলেটা এসে দাঁড়াল। ফুলকি অপ্রস্তুত। অর্ডার দেবে কি দেবে না, ইতস্তত করতে লাগল। তারপর ছেলেটাকে কি বলল। সে চলে গেল। ফুলকি বসে বসে ঘাম মুছতে লাগল। অমিতা দেখল, শামিম দ্রুতবেগে আসছে। একবার হাতের ঘড়িটা দেখল শামিম। সে তখন মির্জাপুরের মোড়ে। শামিম তার গতি বাড়িয়ে দিল। শামিম এসে পড়েছে প্রায়। প্যারাগনের সাইনবোর্ডটা দেখতে পেল অমিতা। শামিম ঢুকতে যাচ্ছে। এমন সময় একতাল ধোঁয়া মাটি ফুঁড়ে আকাশের দিকে উঠতে শুরু করল। শামিমকে ঢেকে ফেলল সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী। অমিতা একবার ডাকল, শামিম। অমিতা কলেজ স্কোয়ারের দিকে তাকিয়ে দেখল। অসংখ্য ছাত্রের জটলা। সকলেই উত্তেজিত, সকলেই ক্রুদ্ধ। জটলা ক্রমে চলতে লাগল। ফুলকি চোখ থেকে . ধোঁয়ার আবরণ সরাতে সরাতে পথে এসে নামল। অমনি সেই উত্তেজিত ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ মানুষের স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। ফুলকি ভয় পেয়ে আর্তস্বরে ডেকে উঠল, শামিম! শামিম! অমিতা দেখল সেই জনস্রোত কলেজ স্ট্রিটকে ভাসিয়ে বউবাজারকে ভাসিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারকে ভাসিয়ে ধর্মতলাকে ভাসিয়ে এসপ্ল্যানেডের দিকে তীব্র বেগে ধাবিত হতে লাগল। ফুলকি তার মধ্যে খড়কুটোর মতো ভেসে চলেছে। এক লহমায় দেখে ফেলল তাকে অমিতা। শামিম! শামিম! সেই উত্তাপ তরঙ্গের গর্জনে ফুলকির আর্তস্বর ডুবে গেল। আবার একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী মাটি ফুঁড়ে উঠল। ধোঁয়া আকাশে উঠতেই লাগল উঠতেই লাগল। ধীরে ধীরে সেই অতিকায় ধোঁয়া, ধোঁয়া নয় যেন অতিকায় এক ব্যাঙের ছাতা অমিতার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অমিতার পাশ থেকে কে একজন বলে উঠল, ‘রামেশ্বর ব্যানার্জি মারা গেল’। কে রামেশ্বর ব্যানার্জি? কোথায় মারা গেল? কেন মারা গেল? অনেক কথা জিজ্ঞাসা করেছিল অমিতা। কিংবা হয়ত কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। কারণ তখন তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। দুদিকের চাপে সে পিষ্ট হতে শুরু করেছিল। রেডিওতে যে গলায় বাংলা খবর পড়ে অবিকল তেমনি নাটুকে কায়দায় কে একজন খবরগুলো দিতে লাগল। ‘রামেশ্বর ব্যানার্জি, বয়স উনিশ বছর। ওর বাবার নাম সৌরীন ব্যানার্জি। যতদূর জানা গিয়েছে, ওদের বাড়ি ১৯৮ বি হরিশ মুখার্জি রোড। ধর্মতলা স্ট্রিট আর ম্যাডান স্ট্রিটের মোড়ে, নিউ সিনেমার সামনে সে পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে।’

পুলিশ ওকে গুলি করল কেন?

‘বাহ্, আপনি জানেন না, আজ যে ছাত্র বিক্ষোভ। আজ যে আজাদ হিন্দু ফৌজের মুক্তি দিবস।’

ক্রমেই দম বন্ধ হয়ে আসছে অমিতার। তবু সে জিজ্ঞাসা করেছিল, শামিম, শামিম কোথায়?

‘রামেশ্বর ব্যানার্জি মরেছে। আরও ষাট জন মরেছে।’ অদ্ভুত রকমের গলা খেলিয়ে সেই লোকটা যে সব কথা বলে যাচ্ছিল তা অমিতার কানে বাজতেই থাকল, বাজতেই থাকল। ‘রামেশ্বর ব্যানার্জি মরেছে। আরও জনা ষাটেক মরেছে আজ পুলিশের গুলিতে। ওরা সব শহীদ হবে। হ্যাঁ, ওরা শহীদ হবেই। এটাই নিয়ম।’

অমিতা আর থাকতে পারছে না। দুদিক থেকে তার উপর প্রচণ্ড চাপ পড়তে লাগল। ক্রমশ তার দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। ওর কিছু শুনতে ভাল লাগছিল না।

‘আবার দুদিন পরে আমরা আবার ওদের ভুলেও যাব। নতুন হুজুগ উঠবে, নতুন শহীদ হবে। আমরা ওদেরও ভুলে যাব। হ্যাঁ, ভুলে যাব। এটাই নিয়ম।

শামিম কোথায়? ফুলকি প্রাণপণে সেই আটক অবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। শামিম! শামিম? ফুলকি ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়তে লাগল।

‘ওদিকে যাবেন না। ওদিকে যাবেন না। পুলিশ গুলি ছুঁড়ছে।

অমিতা দেখছে কেবলই চারিদিক থেকে ধোঁয়া উঠছে। ধোঁয়া। গোল গোল ধোঁয়ায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। টিয়ার গ্যাস! টিয়ার গ্যাস! কিছুই দেখতে পাচ্ছে না অমিতা। তার উপর মানুষের চাপ বাড়ছে। বেড়েই চলেছে। ফুলকি মরিয়া হয়ে একটা ফাঁক খুঁজছে। যাতে সে বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু মানুষের দেওয়ালটা ক্রমশ চেপে আসছে। ক্রমেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। চারদিক থেকে ফুলকির উপর চাপ পড়ছে অসহনীয় সেই চাপ। মানুষের দেওয়ালটা ছোট হয়ে চলেছে। ছোট হয়েই চলেছে। তার মাঝে পড়ে গিয়েছে ফুলকি। বের হবার পথ পাচ্ছে না সে। ‘গুলি চলছে। টিয়ার গ্যাস ছুঁড়ছে। লাঠি চালাচ্ছে পুলিশ।’ চাপ খেতে খেতে ধাক্কা খেতে খেতে দিশাহারা হয়ে পড়েছে ফুলকি। কোথায় সে এখন? সে কি এগোচ্ছে? সে কি পিছু হটছে ভিড়ের সঙ্গে? কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। ক্রমেই ফুলকি টের পেতে লাগল, তার আর নড়বার শক্তি নেই। সে বসে পড়তে চাইছে। তার শরীর বইছে না। সে বসে পড়তে চাইছে। হঠাৎ ভিড়ের চাপ প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে গেল। ফুলকির হাড়গোড় যে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। অমিতা হাঁফাচ্ছে, অমিতা ধুঁকছে, অমিতা থামছে। থামছে বললে কিছুই বোঝায় না, ঘামের প্লাবন নেমেছে অমিতার শরীরে। সেই অন্ধকারেও দেখা যায় অমিতার বুকটা বাতাসের অভাবে ঠেলে ঠেলে উঠছে। বাতাস! একটু বাতাস! অমিতা খাবি খাচ্ছে। উঃ, একট বাতাস একটু বাতাস! অমিতা ধড়মড় করে উঠে পড়ল বিছানা। তারপর হাঁফাতে লাগল। বুকটা চেপে ধরে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল অমিতা। তার দুঃস্বপ্নের রেশটা তখনও মিলিয়ে যায়নি। শামিম! শামিম! ‘শামিম কে? সে কি এই মিছিলে ছিল?’ ফুলকি হাঁ করে নিঃশ্বাস টানতে টানতে বলল, হ্যাঁ ছিল। ‘তবে সেও শহীদ হয়েছে।’ ফুলকি আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, নাআআ। অমিতা তার হাতের তেলো দিয়ে দু’কান চেপে ধরে বলল, অতি শান্ত স্বরেই বলল না, শামিম শহীদ হয়নি। অমিতার উত্তেজনা, দম বন্ধ করা উদ্বেগ এখন কমে আসছে। তার বুক এখনও ঢিপ ঢিপ করছে। কিন্তু সেই ভয়াবহ মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে সে এখন অনেক দূরে এসে পড়েছে। সেদিন ফুলকি মিছিলের চাপে ছিটকে পথের পাশে পড়ে গিয়েছিল। পুলিশ বেপরেয়াভাবে তাড়া করেছিল মিছিলকে। লাঠি পিটতে পিটতে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছিল মিছিলকে। ফুলকিকে ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে ছাত্ররা পালাচ্ছিল। নিজের প্রাণ বাঁচানো ছাড়া ফুলকি আর কিছু ভাবতে পারেনি তখন। রামেশ্বর মারা গিয়েছিল। নিহত হয়েছিল আরও জনা ষাটেক। কিন্তু ফুলকি তাদের কারোরই নাম জানে না। আত্মরক্ষার অন্ধ প্রকৃতি সেদিন ফুলকিকে তার বাড়িতে টেনে এনেছিল। কলকাতার রাস্তায় কোনও যানবাহন ছিল না তখন। এমন কি রিকশাও দেখতে পায়নি সে। ধর্মতলা থেকে এ-গলি থেকে সে-গলি দিয়ে সেবক বৈদ্যের বাড়িতে সে ফিরে এসেছিল একা। একেবারে একা। নিঃসঙ্গ অমিতা সেই রাতে তার বিছানায় বসে বসে সেদিনের ফুলকিকে দেখবার চেষ্টা করেছিল।

ফুলকি তার বিপর্যস্ত শরীরটা টানতে টানতে এনে ফেলেছিল তাদের বাড়িতে। বাতাসিয়া দরজা খুলে দিয়ে তার ওই অবস্থা দেখে আঁতকে উঠেছিল। ফুলকি বাতাসিয়ার শরীরে ভর দিয়ে কোনও রকমে সেদিন তার বিছানায় এসে পৌঁছেছিল। তার তখন কোনও বোধ ছিল বলে মনে হয় না। বাবা শরৎবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে বাতাসিয়ার কাছে তার খবর পেয়ে তক্ষুনি তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু সে তখন ক্লান্তিতে কাতর। সে তখন ঘুমে কাতর। পরদিন রাতের দিকে বাবা তাকে শামিমের খবর দিয়েছিলেন। সে লাঠি খেয়ে পড়ে ছিল মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে। বাবার মুখেই শুনেছিল, ছাত্ররা শরৎবাবুর কথা বারবার অমান্য করেছিল। শরৎবাবু ছাত্রদের এই বিশৃঙ্খল আচরণ দেখে গভীর মনোবেদনা পেয়েছিলেন। তিনি ছাত্রদের প্রথম থেকেই বলে আসছিলেন, তোমরা শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল নিয়ে যাবে। এটাই কংগ্রেসের নির্দেশ। কিন্তু ছাত্ররা শরৎবাবুর কথা কানে তোলেনি। বাবা বলেছিলেন, ‘শরৎবাবু কিরণশঙ্কর রায়কে ছাত্রদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। ইন্দুবিদকে পাঠিয়েছিলেন। অতুল কুমারকে পাঠিয়েছিলেন। অঁর। সবাই কংগ্রেসের নাম করে, শরৎবাবুর নাম করে বলেছিলেন, মিছিলে তোমরা শান্তি রক্ষা করে চলো। ছাত্ররা শোনেনি। পরের দিন কলকাতায় হরতাল হয়েছিল। ছাত্ররা গুলিচালনার প্রতিবাদে ভয়াবহ বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। ফুলকি জানে না। সে তখন বিছানায়। সেদিন পুলিশের গুলি চলেছিল লাঠি চলেছিল। তেরো জন শহীদ হয়েছিল। একশ পঁচিশ জন আহত হয়েছিল। ফুলকি খবরের কাগজ পড়ে এ কথা জেনেছিল। ফুলকি বাড়ি চলে এসেছিল। কিন্তু ছাত্রেরা সারারাত ধর্মতলায় বসেছিল। তাদের তখন জেদ চেপেছে, তারা ডালহৌসি স্কোয়ারে যাবে।

‘অতঃপর শোভাযাত্রাকে শেষ পর্যন্ত ডালহৌসি স্কোয়ার অভিমুখে অগ্রসর হইতে দেওয়া হয়।’ আনন্দবাজারের খবর। ফুলকি পরদিনই বিছানায় শুয়ে খবরটা পড়েছিল। ‘অপরাহ্ণ প্রায় ৩। ঘটিকায় শ্রীযুত শরৎচন্দ্র বসুর মধ্যস্থতায় গভর্নমেন্ট শোভাযাত্রীদের ডালহৌসি স্কোয়ারের দিকে অগ্রসর হইতে অনুমতি দেন। শোভাযাত্রা বিরাট আকারে ডালহৌসি স্কোয়ার হইয়া মধ্য কলিকাতায় প্রত্যাবর্তন করিয়া শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিভ্রমণ করে। এত বড় শোভাযাত্রা ইতিপূর্বে বড় একটা দেখা যায় নাই।’

.

অমিতা সেই অন্ধকার ঘরে খাটের উপর বসে এই অশরীরী মিছিলটা দেখতে পেল। শামিম সেই দিনই ফুলকির সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘শরৎবাবুর পরামর্শ তোমরা যদি শুনতে শামিম, তাহলে এই লোকগুলো এমনভাবে মারা পড়ত না। তোমরা তো শরৎবাবুর নেতৃত্বেই এই আন্দোলন শুরু করেছিল। তাহলে তিনিই তো তোমাদের নেতা। নেতার কথা অমান্য করার কারণ কি ঘটল, আমি তো বুঝতে পারলাম না।’

শামিম বলেছিল, ‘কিসের থেকে কি হয়ে গেল, আমিও সেটা বুঝতে পারিনি ফুলকি।’

বাবা বলেছিলেন, ‘শরৎবাবুর ধারণা তোমরা সব হাঙ্গামা-প্ররোচকদের ফাঁদে গিয়ে পড়েছিলে। আমার মনে হয়, তিনি ঠিকই বলেছেন। কাজটা তোমরা ঠিক করনি। তুমি তোমার নেতাকে অগ্রাহ্য করতে পার না।’

অমিতা বলেছিল, তুমি কথাটা মেনে নিতে পারনি সেদিন শামিম। তোমার চোখ মুখ তাই বলেছিল। তুমি ফুলকির জন্য খুব উদ্বেগ দেখিয়েছিল। ‘ইউনিভার্সিটি থেকে আমাদের মিছিলটা বের করতে আমার একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। এসে দেখি তুমি চলে গিয়েছ। ভাগ্যে তোমার কিছু হয়নি!’

আজ আর কি এসে যায় তাতে। আজ কোথায় তুমি শামিম? কোথায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরেরা? আর কোথায়ই বা শরৎবাবু? বাবা? সেই অন্ধকারের দিকে চেয়ে চুপ করে রইল অমিতা। তার অস্বস্তি কমে এসেছে। আজ কি তিথি? কে যেন বলল।? কেন, আজ তো ২১ নভেম্বর। আজ শহীদ রামেশ্বরের মৃত্যতিথি। কোথায় তুমি আজ রামেশ্বর? আমাদের কার মনে তুমি জেগে আছ আজ?

২১

কী আসে যায়? কী যায় আসে অমিতা? অমিতা একটা হাই তুলল। অন্ধকার। এত লোড শেডিং হয় বলে এক বন্ধুর পরামর্শে ঘরে ইনভার্টার বসাল। অন্তত তিনটে আলো আর একটা পাখা তো চলবে। যে ভদ্রলোক ইনভার্টার বসিয়ে দিয়েছিলেন, তাকে বন্ধুটি ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন অমিতার অবস্থা। অমিতা অসুস্থ। অমিতা একেবারে একা থাকে। ‘হ্যাঁ দিদি, হ্যাঁ। এ কাজের কত গুরুত্ব কত যে দায়িত্ব সে আমি বুঝি। মাসে অন্তত একবার করে আমি লোক পাঠাব। সে এসে ব্যাটারিতে জলটল আছে কি না, সব দেখেশুনে যাবে। একে আমরা বলি সার্ভিস করা। আপনি সার্ভিস চার্জ দেবেন, আমরা সার্ভিস দিয়ে যাব। এ তো ব্যবসার এথিক্স দিদি।’ ঘামতে ঘামতে অমিতা বলল, শালা। এক বছরের উপরে হয়ে গেল ইনভার্টার বসেছে তার বাড়িতে। কিন্তু সেই বাক্যবাগীশের দেখা অমিতা আজও পায়নি। খবর দিয়ে দিয়ে হাল্লাক। মাস ছয়েক ধরে ইনভার্টার কাজ করছে না। কিন্তু যখন ইনভার্টার ছিল না, তখনও তো তুমি বেঁচে ছিলে অমিতা। হ্যাঁ, কিন্তু তখন ট্যাক থেকে অতগুলো টাকা গচ্চা যায়নি তো।

কী আসে যায় অমিতা!

এখন মাঝ রাত না শেষ রাত কে জানে? একটুও হাওয়া নেই ঘরে। বাতাস নেই। আছে শুধু লোড শেডিং। শালা! ভন্টু না ঝন্টু কি যেন নাম লোকটার যে ইভার্টার বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে, তার উদ্দেশেই বলে উঠল অমিতা, শালা! মা অমিতার মুখে এ কথা শুনলে নির্ঘাৎ মূর্ছা যেতেন। কিংবা মা আজ যদি বেঁচে থাকতেন, এই অবস্থায় যদি তাঁকে দিনের পর দিন কাটাতে হত, মা হয়ত নিজেই শালা বলতেন। কে জানে? কথাবার্তায় মা যত সভ্য ভব্য, থাকতে চেষ্টা করতেন, যতটা শালীনতা মেনে চলতেন, তার ঠাকুমা বুড়ি কিন্তু তার ধারে কাছেও মাড়াতেন না। তাঁর মুখ বেশ আলগা ছিল। এই রকম একটা স্মৃতি অমিতার আছে। তার যখন সাত বছর বয়স তখন বুড়ি মারা যান। জীবনে সেই প্রথম মৃত্যু দেখেছিল অমিতা। রাতে শোবার আগে বুড়িতে আর দিদিতে যথারীতি ঝগড়া হয়েছিল। যেমন প্রায়ই হুত। শোবার জায়গা নিয়ে। দিদি পাখার নিচে শোবে কেউই জায়গার দখল ছাড়তে চাইত না। শেষে বুড়িকেই হার মানতে হত। ‘আজই সুধাকে বলে দেব, হয় ঝুমরির জন্য বাড়ি বানিয়ে দে আলাদা করে, নয় ঝুমরির বিয়ে দিয়ে দে, নয় আমাকে তোর দাদার কাছে পাঠিয়ে দে। এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না।’ দিদি বলত, ‘বেশ বেশ, তাই বোলো তোমার আদরের ছেলেকে। আমাকে একটা আলাদা বাড়ি বানিয়ে দিতেই বোলো। আমি বেশ একা একা একটা বাড়িতে, জোড়া খাটে হাত পা ছড়িয়ে একা একা শুয়ে থাকব। সে না হয় হল, বুড়ি তুমি থাকবে কার কাছে?’

‘আমি? আমি এখেনেই থাকব। তোর বাবা তোর মা ফুলকি থাকবে আমার কাছে। চুমকিকে ও আমরা নিয়ে আসব এ ঘরে।

চুমকি তখন সদ্য হয়েছে!

‘চুমকিকে নিয়ে শোবে? কিন্তু চুমকি তো সারারাত হিসি করবে বুড়ি। তোমার গায়ে অ্যা করে দেবে, তখন কি করবে?’

‘করুক পেচ্ছাব। পেচ্ছাবে আমি ভয় পাইনে। সারা জীবন তো আমার তোদের জ্যেঠা বাবা পিসিদের কাঁথা বদলাতে বদলাতেই কেটেছে। চুমকি না হয় পেচ্ছাবই করবে, না হয় বাহ্যিই করবে, কিন্তু তোর মতো তো চোপা করবে না। বাব্বা, এইটুকু মেয়ের কি চোপা!’

বুড়ি ততক্ষণে হাঁফাতে লেগেছে। আর দিদি মুখে হাত চাপা দিয়ে খিক খিক করে হাসতে লেগেছে। বুড়ি উঠে বসেছে বিছানার উপর। হাত দিয়ে দিদিকে ইশারা করছে পাখাটা ফুল স্পিডে চালিয়ে দিতে। দিদি তড়াক করে বিছানায় উঠে বসেছে। পাখা ঘুরিয়ে দিয়েছে। বুড়ির বুক পিঠ ডলে দিতে শুরু করেছে। বুড়ির হঠাৎ হঠাৎ হাঁফানির টান উঠত।

‘বুড়ি ও বুড়ি, জল খাবে? ও বুড়ি জল খাবে? জল দেবো।

বুড়ি হাঁফিয়েই চলেছে হাঁফিয়েই চলেছে। দিদি আলো জ্বেলে দিয়েছে। অমিতাও তখন বিছানার উপর জড়সড় হয়ে উঠে বসেছে। বুড়ি গায়ে পিঠে কাপড় রাখতে পারত না। দিদি বুড়ির পিঠ দুহাতে ডলে দিচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বুড়ি মাঝে মাঝে কোঁক্ কোঁক্ করে শব্দ করত। আর দিদি ভয় পেয়ে যেত।

বুড়ির মুখের কাছে মুখ এনে বলত, ‘ও বুড়ি, বুড়ি, তোমার কষ্ট হচ্ছে গো? কি কষ্ট হচ্ছে? কি কষ্ট হচ্ছে বুড়ি তোমার? মাকে ডাকব? বাবাকে ডাকব?’ দিদিকে এই সময় অনেক বড় বলে মনে হত অমিতার। বুড়ির সঙ্গে তার ঝগড়াও যত, আবার তেমনি তাকে যত্নও করত খুব। দিদিকে সে সময় দেখলে কে বলবে সে মা নয়। ‘লেখাপড়া? আমরা লেখাপড়া শিখব, তবেই হয়েছে। আমি তো চিঠিও লিখতে পারতাম না।’ বুড়ি ফুকুর ফুকুর হাসত। ‘ন’বছর বয়েসে আমার বিয়ে হয়। সে তো বিয়ে নয় একেবারে যেন কুরুক্ষেত্তরের যুদ্ধ।’ বুড়ির কথায় বাঙাল টান আমাদের খুব ভাল লাগত। আমাদের মায়ের বাপের বাড়িও যশোরের গ্রামে। বুড়ির বাপের বাড়িও যশোরের গ্রামে। কিন্তু আমার মায়ের কথায় বাঙাল টান আমরা শুনিনি। তবে যখন ডালিমতলায় ছিলাম তখন মায়ের মুখে আমরা ‘বাথরুম’ শুনিনি। মা তখন পেচ্ছাবকে হিসি আর পায়খানাকে অ্যা করা বলত। অবশ্য বুড়ি পায়খানাকে বরাবর বাহ্যিই বলত। সেবক বৈদ্যে আমরা আসবার পর থেকে মায়ের মুখের কথাবার্তা ‘ভদ্রস্থ হতে থাকে। একবার দিদির একটা পোষা বেড়াল বাড়িতে পেট খারাপ করে হুলুস্থুলু বাধিয়ে দিয়েছিল। মা শেষ পর্যায় বিরক্ত হয়ে বলে উঠেছিল, ‘ঝুমরি অত যদি বেড়াল পোষার সখ, তাহলে তার বাথরুমও তোকে পরিষ্কার করতে হবে। বাড়ির লোকেরা বেড়ালের বাথরুম মুক্ত করতে করতে হল্লাক হয়ে উঠছে।’

দিদি ভালমানুষের মতো মুখ করে বলেছিল, ‘মা বেড়ালের বাথরুমটা কোথায় আমাকে দেখিয়ে দাও।’ মা বেজায় রেগে গিয়েছিল সেদিন। কিন্তু ‘বেড়ালের বাথরুম’ কথাটা আমাদের বাড়িতে চালু হয়ে গেল। মায়ের চোদ্দো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বুড়ি বলত, ‘চোদ্দো বছর বয়েস থেকে আমি বিয়োতে শুরু করি।’ বিয়োনো কি দিদি যখন জানল, বলল ‘অ্যাই!’

বাবা মাকে বাড়িতেই লেখাপড়া শেখাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মায়ের জন্য মাস্টার রাখা হয়েছিল। ‘তোর বাবা করবে কেন? হুকুমটা দিয়েছিল তো তোর বাবার বাবা। সেই মদ্দ বলত, যে বাড়িতে মুখ্যু মেয়ে থাকে সে বাড়ির কোনও ভাষ্যি থাকে না।’

‘ভাষ্যি কি, ও বুড়ি? ভাষ্যি কি, ও বুড়ি!’ বুড়ি ফুক ফুক করে ফোকলা মুখে হাসত। ‘আমি কি লেখাপড়া জানি যে সব কথার মানে বলব? তোর মাকে জিজ্ঞেস কর। তোর মা তো ম্যাটিক্ পাশ করেছে।’

দিদি বলত, ‘বুড়ি তোমাকে কতদিন না বলেছি, ম্যাটটিক নয়, কথাটা ম্যাটরিক।’

‘আমি কি লেখাপড়া জানি যে, ও কথা আমার মুখে ফুটবে? তোর ঠাকুদ্দা কথায় কথায় বলত, মুখ্যু মেয়েছেলে মুখ্যু মেয়েছেলে। আমি মনে মনে বলতাম, যদি অতই অসুবিধে তাহলে আমারে বিয়ে করলে ক্যান? পাছার থেকে ফুল না খসতিই তো আমার বিয়ে হয়ে গেল।’

দিদি ‘পাছা’ জাতীয় শব্দ বুড়ির মুখ থেকে বেরুলেই বলে উঠত, ‘অ্যাই’! তারপর দুই বোনে মিলে খিলখিল করে সে কি হাসি। অমিতার মনে হয় দিদি গোয়াবাগানের যে সব লব্‌জ আয়ত্ত করেছিল, তার প্রেরণা বোধ হয় বুড়ির কাছ থেকেই পেয়েছিল।

‘আমারে বিয়ে কর, আমারে বিয়ে কর বলে আমি কি কারও পায়ে ধরে সাধতি গিয়েছিলাম?’ বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসতে থাকত। তখন বুড়ির মুখখানাকে চুমকির মুখের থেকে আলাদা করা যেত না। চুমকি ফোকলা দাঁতে যখন হাসত, তখন দিদির আর অমিতার মনে হত, ওটা বুড়িরই হাসি।

কোথায় সে বুড়ি? আজ তাকে কে মনে রেখেছে? কিংবা যারা মনে রেখেছিল তারাই বা আজ কোথায়? একদিন যে বুড়ির মুখটা অমিতার কাছে অত উজ্জ্বল ছিল, কবে ছিল, মনে করতে পারে না সে, আজ সে মুখটা একেবারে মুছে গিয়েছে তার মন থেকে। কী আসে যায় অমিতা! কেবল অস্পষ্ট একটা ছাপ তার মনে আছে। তবে হ্যাঁ, বুড়ি তার স্মৃতিতে জেগে আছে এখনও। তবে সে বুড়ি কতখানি সত্য আর কতখানি তার নিজেরই তৈরি, সেটা বলতে পারে না। যেমন বলতে পারে না শামিমের যে মূর্তি তার স্মৃতিতে আছে সেটা কতটা আসল শামিম আর কতটা তার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করে নেওয়া। ‘তোমাদের পাকিস্তানে মেয়েদের স্থান কোথায় হবে সে বিষয়ে কোনও কথা বলেছেন তোমাদের কোনও নেতা?’ ফুলকি তখন তর্ক করতে শিখে গিয়েছে। শামিম ফুলকির এই আচমকা প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। বিব্রত হয়ে সে প্রশ্ন করেছিল, ‘তার মানে?’

ফুলকি বলেছিল, নারী তো সব সমাজেই অর্ধেক অংশ। কিন্তু তোমাদের ভাগ বাঁটোয়ারা এই হিস্যায় মেয়েদের পজিশন কোথায় থাকবে, কোথায় তোমরা নারীদের রাখবে? আজ যেখানে যেমনভাবে রেখেছ সেই ভাবে? সেইখানে?’

‘না না। তা কেমন করে হবে। পাকিস্তান তো পরাধীন দেশ থাকবে না। পাকিস্তান হবে স্বাধীন দেশ। সেখানে প্রত্যেকেরই থাকবে সমান অধিকার।’

পাকিস্তানে মেয়েদের সমান অধিকার থাকবে, এ কথা জিন্না ঘোষণা করেছেন?

‘কোরানে নারীকে খুব উচ্চ স্থানে রাখা হয়েছে ফুলকি। তুমি কোরানে যে সব—’

ফুলকি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোরান পড়েছ শামিম?

শামিম না বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আত্মসম্মানে ঘা লাগল বলে চুপ করে রইল। একটু পরে বলল, ‘আমাদের বাড়িতে সব সময় কোরান নিয়ে আলোচনা হয় ফুলকি। কোরানের অনেক কিছু তাই আমরা এমনিতেই জানি। অত পড়তে হয় না।’

ওটা আমার প্রশ্নের জবাব হল না শামিম? তুমি বেগম রোকেয়ার লেখা পড়েছ? মহিলা সওগাত, যেটা তুমি আমাকে অসুখের সময় দিয়েছিলে, সেটা দেখেছ? মুসলিম সমাজে মেয়েদের কত অধঃপতিত করে রেখেছেন মোল্লা মৌলভিরা সে সম্পর্কে লিখে গিয়েছেন কয়েকজন সাহসিকা মুসলিম লেখিকা। তাঁদের সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছি শামিম। এমন লেখা আমি এর আগে আর কখনও পড়িনি। পড়েছ তুমি?

‘যে সংসারে মেয়েরা মুখ্যু থাকে তার ভাষ্য হয় না।’ এটা বুড়ির কথা। আজও মনে পড়ে ফুলকির। কতদিন আগে বুড়ি বলেছিল। দুর্দান্ত ছিল বুড়ির বিয়ে হবার গল্পটাও।

‘বিয়ে করতে এলে বর যে আবার বন্দুক দেওড় করতে আসে, এ কথা কেউ শুনেছে?’ বুড়ি ফুক ফুক করে হাসত। ‘পাড়ায় ডাকাত পড়ল নাকি? সবাই তো সন্ত্রস্ত। ভয়ে সবাই অস্থির।’

দিদি আর ফুলকির তখন ঘুম-টুম মাথায় উঠে গিয়েছে। ওরা চোখ গোল করে বুড়ির বিয়ের গল্প গিলছে। ‘তুমি ভয় পেয়েছিলে বুড়ি?’ দিদি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করেছিল বুড়িকে। ‘আরে তোদের বুড়ি কি তখন জেগে ছিল যে ভয় পাবে? সে তো কখন বড় মামীর কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি তখন কতটুকু। নয় বছরে সবে পড়েছি। ঠিক এই তোর বয়িসি। ও বয়েসে বিয়ের মর্ম কেউ বোঝে?’

‘সে কি গো!’ দিদি বড়দের মতো গলা করে বলে উঠল, ‘বিয়ের কনে ঘুমিয়ে পড়ে, এমন কথা তো সাত জন্মেও শুনিনি।’ বুড়ি বলল, ‘শুনবি কি করে? এখন কি কারও ওই বয়সে হয় যে শুনবি? এই ঝুমরি পিঠে খোঁচা মারছিস কেন?

‘খোঁচা মারছি কোথায়? আমি তো তোমার ঘামাচি গেলে দিচ্ছি।’

‘না, ওটা ঘামাচি গালা নয়। ওটা খোঁচা দেওয়া।’

‘যত বুড়ো হচ্ছ, ততই তোমার বোধবুদ্ধি হারিয়ে যাচ্ছে বুড়ি। এটাকেই ঘামাচি গালা বলে।’ এইভাবেই দুজনে খুনশুটি বেধে যেত। এমন তুলকালাম ঘটে যেত এক একদিন যে মাকে রান্না ঘর থেকে ছুটে আসতে হত। এই ঝুমরি হচ্ছে কি? বুড়ো মানুষকে বিরক্ত করছ কেন?’ দিদি কিছু বলার আগেই বুড়ি বলে উঠত, ‘বৌমা তুমি আবার ছুটে এলে কেন?’ মা হাসি চেপে বলতেন, ‘ছুটে আসব না! বাড়িতে কি কাক চিল বসতে পাচ্ছে আপনার নাতনির জন্য?’ বুড়ি এক গাল হেসে বলত, ‘না বউমা, তোমার বড় মেয়ে তো আমার ঘামাচি গেলে দিচ্ছে। বড় আরাম হয় আমার। দে তো দিদি, ভাল করে গেলে দে।’

দিদি বলত, ‘আঃ, এত সময় নষ্ট করছ কেন? তোমার বিয়ের গল্পটা বলে ফেল না। সেই কখন ডাকাতেরা এসে বন্দুক দেওড় করেছে। তারপর কি হল বলবে তো? আচ্ছা মা, বন্দুক দেওড় কাকে বলে?’

মা হেসে ফিরে যেতে যেতে বলত, ‘আমার হাতে এখন বক বক করার সময় নেই। ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা কর না।’

বুড়ি বলত, ‘এই সোজা ব্যাপারটা জানিসনে। বন্দুক ফোকানোকে, গুড়ুম, গুড়ুম, এই হল দেওড় বুঝিছো। শুধু গেরামের লোকই নয়, বিয়ে বাড়ির লোকেরাও ভেবে নিল বুঝি ডাকাত পড়েছে। আমাদের বাড়িতেও বন্দুক ছিল। আমার বড়দা ওই অঞ্চলের একজন সেরা বন্দুকবাজ ছিল। কত বাঘ মেরেছে। ম্যাজিস্টরের কাছ থেকে পিরাইজ পেয়েছে

দিদির চোখ গোল গোল হয়ে উঠত। ‘ওরা কি সত্যিই ডাকাত ছিল বুড়ি?’

বুড়ি ফুক ফুক করে হাসত আর বলত, ‘কুথায় ডাকাত? ওরা তো বরযাত্রী।’

 ‘বরযাত্রী তো বন্দুক ছুঁড়ছিল কেন?’

বুড়ি গলা নামিয়ে এমন ভাবে কথাটা বলল যেন খুবই গোপন কথা, ‘না বরযাত্রীরা বন্দুক ছোঁড়েনি। বন্দুক তো মদ্দের হাতেই ছিল। মদ্দ নিজেই তো দেওড় করেছিল।’

‘কিন্তু দাদু তো সেদিন তোমার বর, দাদু বন্দুক ছুঁড়—দেওড় করছিল কেন?’

বুড়ির সারা মুখে তখন দুষ্টুমির হাসি ছড়িয়ে পড়েছে, পড়েছিল কি, না সেটা অমিতার কল্পনা, সেটা ভাল বলতে পারে না অমিতা।

‘বন্দুক ছুঁড়ছিল কেন, আমারে সে কথা জিজ্ঞেস করে কি হবে, তোর দাদুকে যেখানে পাস খুঁজে দেখ। তারে জিজ্ঞেস কর। তবে হ্যাঁ, আমারে বলেছিল, সে অবিশ্যি অনেক অনেক দিন পরে, বুড়ির চোখ দুটো উদাস হয়ে উঠেছিল, অন্তত অমিতার এখন তাই মনে হতে লাগল, এই অবস্থায় উদাস হওয়াই তো উচিত লোকের, অবশ্য যে সব লোকের প্রাণ তাজা থাকে তাদের কথাই বলতে চাইছে অমিতা। বুড়ি যেন স্বপ্নের ঘোরে কথা বলছিল, ‘একটা দশাসই চেহারা, তখন তোদের গোবরাবাবুর মতোই এক জোড়া ভারি গোঁফ, গোঁফ আমার মোটেও ভাল লাগত না, তবুও সেই মদ্দ আমার এই ছোট্টখাট্ট শরীরটাকে নিয়ে পেরায় লোফালুফি করতে থাকত, হ্যাঁ আমি অবিশ্যি বেজায় ভয় পেতাম, আমার বুক ঢিপঢিপ করত, কেবলই ঢিপ ঢিপ করত, কিন্তু সে আমারে আদরে আদরে ভাসায়ে নিত, সমস্ত শরীরে কেবল ঝিম ঝিম কেবল ঝিম ঝিম…’ বুড়ির স্পষ্ট কথাগুলো এক সময় তারা আর শুনতেই পারত না, বুড়ি যেন ঘুমিয়ে পড়ত।

দিদি তখন আর কৌতূহলকে চাপতে পারত না। বুড়ির গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে উঠত, ‘ও বুড়ি তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে বুড়ি?’

‘আমার মনে হত, আমার গালে ঠোঁটে বেড়ালে যেন লেজটা বুলিয়ে নিচ্ছে। কি সুড়সুড়িই যে লাগত!’ ওরা দেখত বুড়ি যেন স্বপ্নের মধ্যেই হাসতে লেগেছে।

‘কি উল্টো পাল্টা বকছ বুড়ি? এর মধ্যে বেড়ালের লেজ আবার এল কোত্থেকে?’ দিদি বেজায় রেগে উঠত।

‘ওটা কি আর সত্যিই বেড়ালের লেজ। ওটা তো তোদের দাদুর গোঁফ। আমার সুড়সুড়ি লাগত বেজায়। আমি শেষ পর্যন্ত খিলখিল করে হেসে উঠতাম। বলতাম, ‘ছাড় ছাড় বেজায় লাগে। তোর দাদু আচমকা ছেড়ে দিতেই আমি পিট্‌টান। একেবারে শাশুড়ির কাছে। নাও ধর কত ধরবা! তোর দাদুর গোঁফকে আমিই বলতাম, বেড়ালের লেজ।’ বুড়ির চোখ থেকে তখন স্বপ্ন-টপ্ন একদম ছুটে যেত। সে চোখদুটো হয়ে উঠত ছাই চাপা আগুনের মতো উজ্জ্বল। ‘বন্দুকের দেওড় কেন করেছিল জানিস?’ বুড়ি বালিসের নিচ থেকে একটা লজেন্সের কৌটো বের করত। আমাকে আর দিদিকে একটা একটা দিয়ে নিজের মুখেও একটা পুরে দিত। এ নিয়েও অনেক কাণ্ড হয়েছে। দিদি একদিন তার বন্ধুদের এনে ‘বুড়ি একে একটা দাও, ওকে একটা দাও’ বলে সব লজেন্সগুলো শেষ করে দিয়েছিল। বুড়ির সেদিন কী রাগ! ‘হতভাগী, আমার জন্য একটাও রাখিসনি!’ বলে বুড়ি হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। বুড়ির কান্না শুনে দিদির বন্ধুরা এতই ঘাবড়ে গিয়েছিল যে, সব দুদ্দাড় করে তক্ষুনি পালাল। দিদি পড়ল ফাঁপড়ে। কত বোঝাল বুড়িকে, ‘তোমার লবেঞ্চুস আমি এনে দেব। তুমি কাঁদছ কেন ও বুড়ি?’ বুড়ি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, ‘দ্যাখ বাড়িতে সুধা আছে না কাছারিতে বেরিয়ে গিয়েছে।’ ভাগ্যিস বাবা বাড়িতে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কাছে এসে বললেন, ‘কী হয়েছে মা?’ বুড়ি বাবাকে বললেন, ‘ও সুধা, আমার. লবেনচু এনে দিবি? সব লবেনচু ফুরিয়ে গিয়েছে।’ বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘পরশু যে এক বাক্স এনে দিলাম। এরই মধ্যে ফুরিয়ে গেল?’ বুড়ি অমনি ফুক করে হাসতে লাগল। অপরাধ করে ধরা পড়লে ছোট ছেলে মেয়েরা যেমন মুখ নিয়ে বাবা মার সামনে এসে দাঁড়ায়, বুড়ির মুখে অবিকল সেই রকম একটা মুখ দেখেছিল ফুলকি। বুড়ির মুখে এবার দুষ্টুমির হাসিটা ফিরে এল।’ ‘ফুরোবার জিনিস ফুরোয় গেলি তার আবার কৈফিয়ত হয় নাকি? তোর বাবা ও কথা বলত। মনে নেই?

বাবা দিদির আর আমার দিকে চাইছেন দেখে বুড়ি সাত তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘বেড়াল বেড়াল সুধা, এই ঘরে বেড়ালের উৎপাত বেড়েই যাচ্ছে।’ বাবা হাসতে হাসতে বললেন, ‘তাহলে আর লজেনস্ কী হবে? আজ বরং একটা লাঠি এনে তোমাকে দিই। তুমি বেড়াল তাড়িও বসে বসে।

অমিতা কী দিন! কী দিনই না ছিল সেই সব!

‘কী দিন কী সব দিন ছিল রে দিদি সে সব।’ পুরনো দিনের কথা ভেবে অমিতার মনে যেমন দুঃখ ঘনিয়ে আসে, বুড়ির সে সব ছিল না। বুড়ি ছিল একেবারে উল্টো।

‘মদ্দ বন্দুকের দেওড় কেন করেছিল শুনতে চাস? আমারে একদিন সোহাগ করতে করতে বলেছিল, উনি যে আসছেন,, সে কথা আমারে জানান দিতি। আমার ঘুম যাতে ভাঙ্গে সেই জন্যি। কথা শুনিছিস? গা জ্বলে না!’

‘তুমি বিয়ের কনে তুমি কি আক্‌কেলে ঘুমিয়ে পড়লে!

‘তা করব কি? আমার তখন নয় বছর বয়েস। বিয়ের দু দুটো লগ্ন পার হয়ে গেল। আরেকটা ছিল সেই শেষ রাত্তিরে। তা আমি কি সারা রাত হা পিত্যেশ করে বসে থাকব? সুখির শুকতুনি! বড় মামী বলল, কোথাও কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বর কখন আসে তার ঠিক কী। তুই আবার বসে থেকে কি করবি। চল শুবি চল। শুলাম গিয়ে। তারপর বন্দুকের দেওড়ের শব্দ কানে যেতেই ধড়মড় করে উঠে শুনলাম, গেরামে ডাকাত পড়েছে। ওদের বন্দুকের দেওড়ে তো আমার ঘুম ভাঙেনি। আমার ঘুম ভেঙেছিল আমার দাদার বন্দুকের আওয়াজে। দাদার ছিল দোনলা বন্দুক। মদ্দর হাতে ছিল একনলা বন্দুক। দাদার সঙ্গে ওরা পারবে কেন? ওরা যতক্ষণে একটা গুড়ুম করছে, দাদা ততক্ষণে দু দুবার দেওড় করছে। গুড়ুম গুড়ুম। সে কী আওয়াজ! থরহরি কম্প। হৈ চৈ চিৎকার চেঁচামেচিতে কানে তালা লেগে যাবার জো। শেষে শোনা গেল ওরা ডাকাত নয়, ওরাই বরযাত্রী। আমার ন কাকা বর আনতে গিয়েছিল। কাকা হাঁফাতে হাঁফাতে এসে ‘করিস কী করিস কী’ বলে দাদার হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিল। যেমন কৰ্ম্ম তেমন ফল। যাও আরও বন্দুক দেওড় কর।’ বুড়ি ফুক ফুক করে হাসে আর বলে যায় গল্পটা।

‘আচ্ছা বুড়ি, তোমার শুভদৃষ্টি হয়েছিল?

‘সুধার বাবার পালোয়ানি চেহারা। যেমন গোঁফ, তেমনি শা জোয়ান। . আমি তো তখন ভয়ে সিঁটিয়ে আছি। চোখ খুলিইনি। কত লোক বলল, ওরে ছুঁড়ি তাকা তাকা, বরকে দেখে নে ভাল করে। নইলে বর পালটে যেতে পারে। তা কে কার কথা শোনে? শুভদিষ্টিও হয়নি, মালা বদলও হয়নি। আমার হাত কি ওই আখাম্বা জোয়ানের গলা পর্যন্ত পৌঁছায়? সবাই বলতে লাগল মালা পরা মালা পরা এই ছুঁড়ি! আমার কাঁচকলা! আমি যেন বিয়ের জন্যি বুক ফাটে মরে যাচ্ছিলাম।’

২২

বুড়ি সেই কবে মরে গিয়েছে। বুড়ি মরে গেলে দিদি কদিন নাওয়া খাওয়া প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর একদিন তো অসুখেই পড়ল দিদি। কঠিন অসুখ। বুড়ি বলত, ‘ঝুমরি আমার সঙ্গে খুনশুটি করে খুব। কেন জানো বউমা? ও আমারে খু উ ব ভালবাসে।’ দিদিকে নিয়ে কদিন যমে মানুষে এমন টানাটানি শুরু হয়েছিল যে, বুড়ির জন্য শোক করবার সময়ই এ বাড়িতে কেউ পায়নি। কিন্তু সেই দিদিই বুড়িকে সবার আগে ভুলে গিয়েছিল। অন্তত অমিতার তাই মনে হয়েছিল। বুড়ির কথা মুখেও আনত না দিদি।

‘আমার লবেনচু চাই তো ঝুমরিরও লবেনচু চাই। আমার যে লবেনচু চাই ঝুমরিরও সেই লবেনচু চাই।’ বুড়ি কি রাগ করে নালিশ জানাত? তাহলে বুড়ির চোখে মুখে অমন দুষ্টুমি দুষ্টুমি ভাব ফুটে উঠত কেন? গলার স্বর আর মুখের ভাব এই সব সময়ে বুড়ির দু রকম হয়ে যেত, অমিতার এ কথা মনে জেগে উঠছে কেন?

‘বিছানায় আমার যে জায়গাটা চাই, ঝুমরির সেই জায়গাটাই চাই।’ একটা ফোকলা মুখের হাসি অমিতার মনে ছড়িয়ে পড়ছে কেন? অথচ মুখটা ঠাহর সে করতে পারে না।

‘আমার লবেন্‌চের ভাগ চাস, আমার বিছানার ভাগ চাস, তাহলে মদ্দ বেঁচে থাকলে তুই তার ভাগও চাইতিস? চাইতিস তো ঝুমরি?’

দিদি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠত, ‘বয়ে গেছে আমার তোমার বেড়ালের লেজের ভাগ নিতে। এ মা যা একখানা গোঁফ! ছ্যাঃ!’

‘ওই গোঁফে রসও ছিল কত!’ বুড়ি ফুক ফুক করে হাসত। ‘তোর যা বয়েস এখন, আমার তো ওই বয়েসেই বিয়ে হয়েছিল। কি সব হয়েছিল আমার তা ভাল মনেও নেই। চোখে তো তখন নিদ্রাপরী ঘুম আটকে দিয়ে গেছেন। জানবই বা কি করে?’

‘কেন বন্দুকের শব্দে তোমার ঘুম ভাঙেনি। তোমার মদ্দ তো দেওড় করেছিল।’

বুড়ি বুড়ো আঙুল তুলে বলেছিল, ‘কাঁচকলা। ও আবার বন্দুক নাকি? ও দিয়ে কেবল পাখি মারাই যায়। ওর দেওড়ের আওয়াজে কি আমার ঘুম ভাঙে! তবে হ্যাঁ, বন্দুক ছিল বটে আমার দাদার। বাঘ মারা বন্দুক। দোনলা। একটা দেওড়েই আক্কেল গুড়ুম। কান যেন ফেটে যেত। দাদা যখন দেওড় করল ছাদে উঠে তখন আমি ধড়মড় করে উঠে পড়েছিলাম। মামী আমাকে তক্ষুনি বুকের মধ্যে টেনে নিল। বলল, ঘুমো ঘুমো, বাড়িতে হয়ত ডাকাত টাকাত পড়েছে। আমি অমনি ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার চোখে তখন নিদ্রাপরীর ঘুমের কাজল পরানো।

‘বুড়ি, ও বুড়ি, তা তোমার বরকে কি সত্যিই ডাকাত ডাকাত মনে হচ্ছিল?’

‘কাঁচকলা! বুড়ি ফুক ফুক করে হাসতে লেগেছিল। ‘আমি তো দেখিইনি। এয়োরাও বর চিনতে পারেনি। সবাই বর দেখার জন্য হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে। বর কই বর কই? সেজ কাকা বেজায় রেগে গিয়েছিলেন নাকি? তুমাগের কারও কপালে কি চোখ নেই না জ্ঞানগম্যিও গুলে খায়েছো সবাই। কপালে চন্দনের ফোঁটা দেখেই কি বুঝতে পারলে না, বর কিডা? কি রকম এয়ো তুমরা গো? বলেই গুঁফো লোকটাকে তিনিই নাকি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বড় বউদি ফোড়ন কেটেছিল, ওমা ওই নাকি বর? ওতো বরকন্দাজ!’

ওদের খুব মজা লেগেছিল। বুড়ি এমনই মজার লোক ছিল। তার শোক তো লাগবেই। বাসর ঘরেও বুড়ি নাকি বরের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল কড়ি খেলার সময়। শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় পালকিতে বুড়ি নাকি বরের কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পথ পাড়ি দিয়েছিল। বুড়ির যখন বিয়ে হয় তখন দাদুর বয়েস ছিল তেইশ বছর। ভাবা যায়!

‘বিয়ে বউভাত অষ্টমঙ্গলা সব হয়ে টয়ে গেলে মদ্দ একদিন আমারে জিজ্ঞাসা করেছিল, লেখাপড়া কিছু শিখেছ না কি? আমি তখন মদ্দকে দেখি আর বুক গুডুগুডু করে আমার বেজায় ভয় লাগে আমি থরথর করে কাঁপতে থাকি। আমি মাথা নেড়ে জানালাম না। তাহলে কি হবে? মুখ্যু হয়ে থাকলে আমাকে চিঠি লিখবে কি করে? তুমি এখন তো বাপের বাড়িতে থাকবে আর আমি থাকব কলকাতায়। আমি চিঠি লিখলে জবাব দেবে কে? আমি তো মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে কলাবউ সেজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছি। আবার জিজ্ঞাসা করল, সেই চিঠির জবাব দেবে কে উত্তর দাও। আমি ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললাম, বড় বউদি। হা হা করে হেসে উঠল মদ্দ। বলল, মুখ্যু না হলে এমন জবাব কেউ দেয়? চিঠি লিখবে তোমার বর, আর জবাব দেবে বড় বউদি। যে সংসারে মুখ্য মেয়েলোক থাকে সে সংসারের ভাষ্যি থাকে না। আমি তোমাকে বই শেলেট সব কিনে দেব, তুমি বাপের বাড়িতে গিয়ে লেখাপড়া শিখবে। কি শিখবে তো? আমি তো কথা বলিনে।

‘তারপর? বুড়ি তারপর কি হল? দাদু তোমাকে বকল?’

‘কাঁচকলা।’ তারপর বুড়ি তলিয়ে গেল অতীতের স্বপ্নেই বোধ হয়। অনেকক্ষণ ধরে বুড়ির সাড়াশব্দ নেই। বুঝি ঘুমিয়েই পড়ল। দিদি যেই বুড়িকে কাতুকুতু দিতে গেল অমনি দেখি বুড়ি ফুক ফুক করে হাসতে শুরু করেছে। বুড়ির মুখে একটা আলো এসে পড়ল।

‘তোর দাদু বলেই যাচ্ছে, কি লেখাপড়া শিখবে তো? আমারে চিঠি লিখবে তো? আমিও ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। কি শিখবে তো? তোর দাদুর জেদ চেপে গিয়েছে তখন। আমারে দিয়ে কথা আদায় করে নেবে। আমিও তেমন বান্দা নই। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। তোমার জেদ আছে আমার জেদ নেই! আমিও কিছু বলছিনে। মদ্দও ছাড়ছে না। তারপর করল কি, মদ্দ একটানে আমাকে ওর মাথার উপর তুলে ফেলল। আমার তখন আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়। আমার সঙ্গে চালাকি! দেব এক আছাড়। আমি তখন ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেলেছি। মদ্দ বলল, যতই কাঁদো, আজ আর ছাড়াছাড়ি নেই। কথার জবাব না দিলে এক আছাড়ে ডাল গলিয়ে দেব। কি পড়বে তো, কি লেখাপড়া শিখবে তো। অগত্যা বলতেই হল, ছাড়েন ছাড়েন, আমারে ছাড়ে দেন। আপনি যা কবেন, আমি তাই করব। তখন সেই ডাকাত আমারে তার বুকের কাছে নামিয়ে আনল। বলল, দেখি মুখ দেখি। ঘোমটা ফোমটা খোলো। না হলে ফড়ফড় করে ঘোমটা ছিঁড়ে দেব। আমি কি করি? খুললাম ঘোমটা। দেখি কি হাসছে মিটমিট করে। তারপর আমার মুখের কাছে যেই বেড়ালের লেজটাকে এগিয়ে এনেছে আমি অমনি এক খামছি মেরে সেখান থেকে দিয়েছি পিটটান।’ বুড়ির মুখে তখনও আলো খেলছে।

বুড়ির মুখটা মনে নেই। একেবারেই মনে নেই অমিতার। কিন্তু বুড়ির কথা মনে হলেই এই আলোটাকে তার অন্ধকার ঘরেও ঘুরে বেড়াতে দেখে সে। কেমন যেন জাদু আছে ওই অপার্থিব আলোটায়।

‘তোমার হাতের লেখা কিন্তু সুন্দর বুড়ি। মাকে আগে যে সব চিঠি তুমি লিখেছ, আমি পড়েছি তো। মা-ই ডেকে ডেকে পড়িয়েছে।

‘তুই ভাবছিস ওই হাতের লেখা আমার? ওই মদ্দ লিখে লিখে দিত আর হুকুম করত দাগা বুলিয়ে যাও।’ বুড়ি দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে কি যেন ভেবে নিল। তারপর ফুক ফুক করে হাসতে লাগল। ‘প্ৰেথম চিঠিটায় আমি পাঠ লিখেছিলাম ‘পান্নাথ’। সেই চিঠি নিয়ে সকলের সে কি হাসাহাসি। তারপর একটা চিঠিতে লিখেছিলাম ‘বটকুকুর কেমন আছে’। সেই চিঠি নিয়েও খুব হুল্লোড় হয়েছিল।

‘কেন হুল্লোড় হল বুড়ি?

‘হুল্লোড় হবে না! বঠাকুর হলেন আমার ভাশুর আর তারে বলেছি বটকুকুর?

বুড়ি আবার ঝিম মেরে গেল। বুড়ি কি তখন স্বপ্ন দেখছিল? ওর চোখে মুখে সেই আলো চিকমিক করছিল তখন। ‘সব চাইতে মজা হয়েছিল যখন মদ্দ কলকাতার থেকে একবার এসে আমারে জিজ্ঞাসা করল, পনি কে? পনি কে তা আমি কি করে বলব? আমি উল্টে জিজ্ঞেস করলাম, পনি কে? তখন মদ্দ পকেট থেকে আমার চিঠি বের করে বলল, এই যে লিখেছ, পনি কেমন অছ, এই পনি কে? আমি চিঠিখানায় নজর বুলিয়ে বললাম, ওটা পনি কেন হবে, ওতো আপনি, ওই তো দেখে নিলেই হয় আ-টা উপরের লাইনেই আছে। উপরে আর নিচে পনি, আপনি হল না? মদ্দর মুখে সেই প্রথম কথা ফোটেনি।’ বুড়ির চোখে স্বপ্ন, বুড়ির চোখে মুখে সেই চিকমিকানো আলো। আর অন্ধকারে বসে এখন তাকে দেখছে অমিতা।

‘মা!’ বাবা এসে ঘরে ঢুকেছিলেন। বাবার মুখেও সেদিন একটা আলো দেখেছিল ওরা। বুড়ি ঝিম মেরে পড়ে আছে। বাবা ডাকলেন, ‘মা, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?’ বুড়ি সেই আমেজ মাখা গলায় যেন ঘুম থেকেই উত্তর দিয়েছিল, ‘সুধা! কিছু বলবি?’

বাবা বলেছিলেন, ‘তুমি একবারটি উঠে বসবে মা?’

বুড়ি বলেছিল, ‘উঠে বসব, কেন?’

‘তোমায় একবার প্রণাম করব মা।’

‘প্রণাম করবি? কেন রে?’ বুড়ি হঠাৎ যেন জেগে উঠল। ধীরে ধীরে উঠে বসল।

বাবা বুড়িকে প্রণাম করে পাশে বসে পড়লেন। ‘একটা বাড়ি কিনেছি মা। দলিল পত্তর সব হয়েই গিয়েছিল। আজ বাড়িটার দখল পাওয়া গেল। বেশ বড় বাড়ি মা। হাত পা ছড়িয়ে বেশ থাকা যাবে। তোমার জন্যে একটা আলাদা ঘর থাকবে মা। শুধু তুমি আর তোমার ঠাকুর।’

‘আর আমার এই দুই ঠাকরুন?’

‘ওদের জন্য আলাদা ঘর থাকবে মা।’

‘না সুধা না।’ বুড়ি আঁতকে উঠেছিল।

‘ওরা আলাদা থাকবে। তাহলে আর তোমার সঙ্গে কথায় কথায় ঝগড়া করতে পারবে না। ওরা তোমায় খুব বিরক্ত করে মা।’

‘না সুধা না। ওরাই আমার ঠাকুর। ওদের তুই আলাদা করে দিসনে। যে কটা দিন আছি, একসঙ্গেই থাকি।’

‘তুমি যদি তাই চাও, তাই হবে।’

‘হ্যাঁ রে সুধা, বাড়ির কোনও শরিক নেই তো?’

‘শরিক? না তো।’

‘তাহলেই ভাল। দেখলি তো আমাদের ওই অত বড় বাড়ি পেরায় রাজপ্রাসাদ, শরিকি বিবাদে একেবারে ছত্রখান হয়ে গেল। সংসারে হিংসে ঢুকলে সর্বনাশ হয়ে যায়। সুধা?’

‘মা?’

‘হ্যাঁরে, আমাদের বাড়ির কথা তোর মনে আছে? কি বিরাট বাগান! আম জাম কাঁঠাল তোর বাবা খুব কাঁঠালের ভক্ত ছিলেন—লিচু সবেদা নারকেল সুপারির গাছ কত গাছ—গাব কামরাঙা—কত বড় দিঘি—দিব ভাল সাঁতার দিত, তুই ছিলি ভীতুর ডিম—হ্যাঁরে সুধা তোর বাড়িতে পুকুর আছে?’

‘এটা সেই রকম বাড়ি নয় মোটেই। কলকাতার বাড়িতে পুকুর থাকে না মা।’

‘তুলসীতলা আছে তো সুধা?’ বুড়ি আপন মনে গুনগুন করে বলতে লাগল :

তুলসী তুলসী নারায়ণ, তুমি তুলসী বৃন্দাবন।
তোমার শিরে ঢালি জল, অন্তিম কালে দিও স্থল।
তুলসী তুলসী মাধবীলতা,
কও তুলসী কৃষ্ণকথা
কৃষ্ণকথা শোনেন কানে,
দ্বাদশ প্রণাম তুলসী চরণে।।

‘শোন এই শোন।’ বুড়ি ঘোরের মধ্যে ডুবে গেল। ‘একেবারে সাত সকালে আমরা ঘুম থেকে উঠতাম। ঠাকুমা ডেকে ডেকে তুলত। সেই সাতসকালে পায়খানা টায়খানা করে আমাদের চান সেরে নিতে হত। তুলসী গাছে জল দিতে হত। জল দেবার আগে তুলসী তুলসী নারায়ণ মন্তর পড়ে নিতে হত। তারপর তুলসী গাছের জল ঢালো। জল ঢেলে তুলসী তুলসী মাধবীলতা মন্তরটা পড়তে হত। আমরা পাঁচজন ছোট ছিলাম তো। সেঁজুতিদিদি, করালীপিসি, খ্যাঁদনদিদি, চাঁপা, আমি। সকাল থেকে সন্ধ্যে—সকালে তুলসীকে চান করাও আর সন্ধেবেলায় তুলসীকে সন্ধেবাতি দেখিয়ে তোমার ছুটি। সব কাজের জন্য আলাদা মন্তর…’

বাবা ডাকলেন, ‘মা।’

বুড়ি সে ডাকের উত্তর দিল না। সে তো তখন তার স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। বুড়ি তখন তুলসী তোলার মন্তর পড়ছিল :

ডালে কৃষ্ণ পাতায় হরি।
সরে বসো কৃষ্ণ তুলসী তুলি।।

‘তুলসী তোলারও তরিবত আছে।’ বুড়ির সুরটা মাঝে মাঝে জড়িয়ে যাচ্ছিল। গলা খাঁকারি দিয়ে সেটা সাফ করে নিচ্ছিল বুড়ি। ‘তুলসী তোলার আগে তিনবার হাততালি দিবি। বাঁ হাতে ডাল ধরে ডান হাত দিয়ে মঞ্জরী আর পাতা তুলবি। তারপর তুলসীতলায় গোবর দেবার মন্তর পড়ল :

নড়ি তুলসী, চড়ি তুলসী, করলাম তুলসী সার।
গোবর দিয়ে তুলসীতলায় জনম হয় না আর।।
তুলসীতলায় দিচ্ছি বাতি, সাক্ষী থেকো ভগবতী।
সাক্ষী থেকো দেবগণ, দেখো লক্ষ্মী নারায়ণ।।
বাতি দেখাই তোমায় সন্ধ্যাকালে      যেন তব বরে তিন কুল উজলে।
মিনতি গলে দিয়ে বাস     অন্তিমে দিও স্থান ওহে শ্রীনিবাস।।

বুড়ির গলাটা ক্ষীণ হতে হতে একেবারে যেন মিলিয়ে গেল। আর কথাবার্তা নেই। বুড়ি কি ঘুমিয়ে পড়ল আবার?

বাবা প্রথমে আস্তে করে ডাক দিলেন, ‘মা, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে? ও বাড়িতে জায়গা আছে। পুকুর কাটাতে পারা যাবে না। তবে তুলসীমঞ্চ তোমার জন্য থাকবে। একটা বেদী করে দেব। বুঝেছ মা?’

বুড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে বাবা উঠতেই যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কি মনে হতে বুড়ির মুখের কাছে এগিয়ে গেলেন। বুকে হাত দিয়ে কি দেখলেন। বাবার মুখটা কালো হয়ে উঠতে লাগল তাড়াতাড়ি বুড়ির নাকের কাছে হাত রাখলেন। তারপর আর্তস্বরে ‘মা’ বলে ডেকেই বাবা ভেঙে পড়লেন।

২৩

ঘরে মা, বিন্দুমাসি আর জহুরা কাকিমা বসে ছিলেন। মা একটা তোরঙ্গ খুলে একটা একটা করে জামাকাপড় যত্ন করে নামিয়ে রাখছিলেন। ওগুলো রোদে দেওয়া হবে। মায়ের মাথার উপরে দেওয়ালে বুড়ির একটা বেশ বড় ফটো ঝুলছিল। সেই ছবিটা এখনও চোখে ভাসে অমিতার। একটা হাতওয়ালা বাহারি চেয়ারে বুড়ি বসে আছে। তখন আর বুড়ি বুড়ি নয় মোটেই। কম বয়েসি একটা বউ। একেবারে দিদি। দিদিকে তুলে নিয়ে কেউ যেন ওই ছবিটায় সেঁটে দিয়েছে। দিদির এখন যেমন বয়েস, চোদ্দো, ছবিটা দেখে মনে হয় বুড়িও যেন সেই বয়েস। পাশে বরকন্দাজ দাঁড়িয়ে আছেন। ইয়া এক জোড়া গোঁফ নিয়ে।

মা একটা বেনারসীর পাট ভাঙছিল। ‘সেই কবে বিয়ে হয়েছিল মায়ের। দেখ জহুরা, দেখ বিন্দু দেখ। এটা সেই কনের বেনারসী! এখনও কেমন জেল্লা দিচ্ছে।’

ফুলকি মায়ের গা ঘেঁষে বসেছিল। চুমকি বিন্দুমাসির গায়ে হেলান দিয়ে একটা টফি চুষছিল।

জহুরাকাকি বলেছিলেন, ‘কেমন যত্ন করে রাখা আছে, সেটা দেখ।’

‘আমার শাশুড়ি ছিলেন ওই রকম পয়পরিষ্কার। কোনও জিনিসে তাঁর অযত্ন ছিল না। বলেছিলেন, এই বেনারসীটা ঝুমরির। ওর বিয়ের সময় এটা ওকে পরিয়ে দিয়ো।’

ছবিটা, বাবার মুখে শুনেছে ফুলকি, দাদু নাকি কলকাতায় বুড়িকে এনে যখন ঘর পাতেন, সেই সময়কার তোলা। তখন দাদুদের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। শরিকী বিবাদে সম্পত্তি সবই গিয়েছে। দাদুরা সর্বস্বান্ত হয়ে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। আলিপুর কোর্টে তখন ওকালতিতে সদ্য বসেছেন। সেই দুঃসময়ে এই ছবিটা তোলা। ভাবা যায়! বোরন্ অ্যান্ড শেফার্ড কোম্পানিতে বুড়িকে নিয়ে গিয়ে তাদের স্টুডিও থেকে বুড়ির ছবি তুলিয়ে এনেছিলেন দাদু!

বুড়ি এই ঘটনার কথা উঠলেই বলে উঠত, ‘পোঁদে নেই ইন্দি ভোজনে গোবিন্দি। রোজগারপাতি নেই। সংসার চলবে কি করে আমার তখন সেই চিন্তা, মদ্দ আদালত থেকে ফিরেই বললেন, তোমার বেনারসীটা পরে নাও তো! গহনা টহনাও সব পরে নিও। জিজ্ঞেস করলাম যেতে হবে কোথায়? মদ্দ বললেন, ফটো তুলতে। বোঝো, এই লোকেরে নিয়ে ঘর করতে হয়েছে বউমা।’

চুমকি খপ করে একটা ছোট জামা তুলে নিল। বুড়ির বিয়ের দিনের বেনারসীর ব্লাউস। ফুলকির মনে হল পুতুলের জামা। মা অমনি ধমক মারলেন, ‘কি হচ্ছে চুমকি, তোমার নোংরা হাতে জামা ধরছ কেন? যাও হাত ধুয়ে, ভাল করে মুখে এখানে এসে বস।’

‘ফটো তোলাতে গেলে কি হবে? সাহেব তো আমার পোশাক পরার ছিরি দেখে ফটো তুলবে না খালি বলে বিউটি, বিউটি। আর বলে ওয়েট ওয়েট। তারপর এক মেমসাহেব কোত্থেকে এল। আমাকে ডেকে একটা ঘরে নিয়ে গেল। তারপর আমাকে সাজাতে বসল। এক বাক্স ভর্তি কি সব জিনিস।

চুমকি জিজ্ঞেস করল, ‘এই ছোট্ট জামাটা কার মা?’

‘পরিপাটি করে চুল আঁচড়ে সামনে পাতা কেটে দিল আর একটা অ্যালবার্ট খোঁপা বেঁধে দিল। তারপর একে একে গয়নাগুলো গা থেকে খুলে নিয়ে আবার নতুন করে পরাতে লাগল।’

চুমকি ততক্ষণে ছোট্ট বেনারসীর ব্লাউজের ভাঁজ খুলে ফেলেছে। ‘এই জামাটা কার গো? আমি পরব? হ্যাঁ মা, আমি একবারটি পরব?’

‘মাথায় টায়রা পরিয়ে দিল। গলায় এঁটে দিল গিনি লাগানো কণ্ঠহার। তারপর পরিয়ে দিল আড়াই পেঁচি মপচেন। ঘোমটা কপালের উপর তুলে দিয়ে ব্রচ দিয়ে সেটা খোঁপার সঙ্গে এঁটে দিল। হাতের গুচ্চের গহনা তুলে পুঁটলি করে তুলে দিল আমার ঝুলিতে।

মা বললেন, ‘জহুরা, মা গ্রামের মেয়ে ছিলেন বটে। কিন্তু তাঁর রুচিতে কখনও গ্রাম্যতার ছাপ পাইনি।’ মা গেঁয়োমি বলত না, বলত গ্রাম্যতা। মা শ্বশুরবাড়িতে এসে আই এ পাশ করেছিল। বুড়ি যেসব ছড়া কাটত, মা সেসব মুখেও আনত না।

‘মা বলতেন, গহনাগাঁটি পরারও নিয়ম আছে। তোমার এক গাদা গহনা আছে বলেই এক সঙ্গে সব পরে ফেলবে, তাহলে স্যাঁকরার দোকানের কাঁচের শো-কেসের সঙ্গে তোমার তফাত রইল কোথায়? রূপটা খোলতাই করার জন্যই তো গহনা! বেশীরভাগ বড়লোকের মেয়েদের দেখে কি মনে হয় জানো বউমা, ওরা সব যেন সোনার বলদ।’

‘মা আমি এই জামাটা পারি?’ চুমকি ব্লাউজটা নিয়েই গায়ে পরতে গেল। মা এক থাপ্পড় দিয়ে সেটা কেড়ে নিয়ে চুমকিকে বলল, ‘এটা কি খেলার জিনিস! এটা তোদের ঠাকুমার বিয়ের জামা। একদম ছুঁবি নে। এসব তোমার দিদিকে দিয়ে গিয়েছেন।’

‘শাড়িটা কী ভারী গো কুসুম! আজকাল এমন বেনারসী মাথা খুঁড়লেও পাওয়া যায় না। এই যে জরি দেখছ, এগুলো সব সোনার জরি। এখন বেনারসী কত ফঙ্গবেনে হয়ে গিয়েছে দেখেছ?’

‘তারপর জানো বউমা, সেই মেমসাহেব আমাকে সাজিয়ে দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে দেখতে লেগেছিল। যেন আমি একটা চিনে পুতুল। তারপর আমাকে একটা চেয়ারে বসাল। একটা হাত চেয়ারের হাতলে আলাগোছে ছেড়ে দিল, আরেকটা হাত আমার কোলে তুলে দিল। তারপর দূরে গিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। তারপর এসে আমার দু’হাতে শুধু মকরমুখো রুলি এক গাছা করে পরিয়ে দিল। মুখে আলতো করে সামান্য একটু পাওডার মাখিয়ে সাহেবের কাছে নিয়ে এল। সাহেব আমাকে দেখে গুড় গুড় বলল। তারপরে ছবির পর ছবি তুলে দিয়েছিল।’

ওই সেই ছবি। ওদের সেবক দ্যৈ রোডের বাড়িতে ঝোলানো ছিল। অমিতার মনে পড়ে, বেশ মনে পড়ে, ছবিতে যে কচি বয়সের বউটি বসে আছে, মুখে তার বিস্ময়, আর দুচোখে তার চাপা কৌতুকের হাসি। দুষ্টুমির হাসিও বলা যায় তাকে। ওই ধরনের হাসি বুড়ির মুখেও ফুটে উঠতে দেখেছে ওরা। অবিকল দিদি।

‘ভেবে দেখ বিন্দি’, মা বলেছিলেন, ‘একটা ন বছরের মেয়ে এই শাড়ি জড়িয়ে সারারাত কাটিয়ে দিয়েছিল তার বিয়ের দিনে!

‘হ্যাঁ, মাসিমা অদ্ভুত ধরনের মানুষই ছিলেন। দেখেছি তো?’

‘আর সহ্য হয় না। সুধা আসুক, আজ একটা হেস্তনেস্ত করে তবে ছাড়ব।’

‘বুড়ি তুমি রেগে গেলে? বুড়ি তুমি রেগে গেলে? বেশ, আমি চলে গেলেই যদি তোমার শান্তি হয়, তবে আমি চলেই যাচ্ছি। আমি তো তোমার চক্ষুশূল।’

দিদি এমনভাবে বুড়ির বিছানা থেকে উঠে পড়ত যেন চিরকালের মতো চলে যাচ্ছে কোথাও। তখন শুরু হত বুড়ির দিক থেকে মান ভঞ্জনের পালা। আর দিদি ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকত। কি চাস, কি চাও ও মণি, কি পালি তোমার কান্না থামবে।’

দিদি বলত, ‘তোমার ব্রেত কথার ছড় বল।’ দুজনে সন্ধি হয়ে যেত।

বুড়ি বলত, ‘কোনটা শোনবা।’ এই সব সময়ে বুড়ির মুখ দিয়ে বিশুদ্ধ যশুরে ভাষা বের হতে থাকত। ‘কোনটা শোনবা? লোটন ষষ্ঠীর ব্রেত, না অনন্ত চতুর্দশীর ব্রেত, না কলুইচণ্ডীর ব্রেত, নাকি যমপুকুর ব্রেত? কোনটা শুনতে চাও?

‘বুড়ি তুমি কি ভুলো গো অ্যাঁ! পরশু রাত্তিরে বললে, যে অশথপাতার ব্রেত শোনাবে, আর এরই মধ্যে হজম হয়ে গিয়েছে সে কথা! বাহ্!’

বুড়ি বিড়বিড় করে আওড়ে যেত :

অশপাতা পুণ্যিলতা শ্যাম পণ্ডিতের ঝি।
চান করতে নদে গেল মাথায় দিয়ে কি।।
সে যে চাকুন্দে সুন্দরী শ্যাম পণ্ডিতের ঝি।
সাধ হল খেতে তার পান্তা ভাতে ঘি।।

‘মাসিমাকে দেখে প্রথম প্রথম আমার ভয় হত। নিষ্ঠাবতী বামুনের বিধবা। না জানি তার আবার আচার বিচার কত?

‘সাফ সুতরো থাকার ব্যাপারে বুড়ির নজর ছিল বেজায় কড়া। পান থেকে চুন খসলেই অস্থির কাণ্ড।’

‘সাত ভাই যায় সাত ঘোড়াতে সাত বউ যায় সাত দোলাতে।
গিন্নি যায় রুপোর খাটে চড়ে কর্তা যান শ্বেত হস্তীর উপরে।
কৈলাসে হর গৌরীকে কন নরলোকে নারীগণ এ কি বে করে?’

‘আগে আগে যখন তোমাদের বাড়িতে আসতাম, কুসুম, সত্যি বলতে কি, মাসিমা সম্পর্কে আমাকে তটস্থ থাকতে হত।’

গৌরী কহেন, মহেশ্বর করি নিবেদন অশথপাতার বেরত করে নারীগণ।।
হর কহেন এই বেতে কিবা ফল হয় গৌরী কহেন তবে শুন মহাশয়।।
পাকা পাতা দিলে মাথায় পাকা চুলেও সিঁদুর পায়।।
কাঁচা পাতা দিলে মাথায় সোনার মতো রূপ পায়।
কচি পাতা মাথায় দিলে নবকুমার পায় সে কোলে।।

‘আমার বসির কি রকম দুরন্ত ছিল জানো তো? আমার কেবলই ভয় হত—’

‘শুকনো পাতা দিলে মাথায় সুখ শান্তিতে ঘর ভরে যায়।’

‘এই বুঝি বসির মাসিমাকে ছুঁয়ে দিল। এই বুঝি—’

ঝুরঝুর পাতা মাথায় দিলে হীরা মুক্তা অঙ্গে ঝোলে।।

অমিতার বুক কাঁপতে লাগল। সেই ছোটবেলায় যেমন কাঁপন ধরত ওদের দুই বোনের মনে। বুড়ি এবার বলবে, ওরা নিঃশ্বাস চেপে বসে থাকত—

‘আমার বসির মাসিমার বিছানায় উঠে বসল।’

ওরা দম বন্ধ করে বসে থাকত আর যেই বুড়ি বলেছে, ‘উজোতে পারলে ইন্দ্রের শচী’ ওরা দুই বোনও এক সঙ্গে বলে উঠত, ‘উজোতে পারলে ইন্দ্রের শচী না উ জো লে কৃ ষ্ণে র দা সী।’ দিদি তাকে তালিম দিয়ে রাখত, বুড়ির গলার সঙ্গে তাদের দুই বোনের গলা যেন মিলে যায়। ফুলকি যত ভুল করত, দিদির জেদ তত চেপে যেত। আর ফুলকি ততই ঘাবড়ে যেত। একদিন সব ঠিক ঠাক করে ফেলল ফুলকি। বুড়ির আর দিদির গলার সঙ্গে ফুলকির গলাও মিলল একই তালে, কিন্তু হলে হবে কি, ফুলকি ঘাবড়ে গিয়ে ‘ইন্দ্রের শচীর জায়গায় ‘কৃষ্ণের শশী’ বলে ফেলেছে আর যাবে কোথায়? দিদি এই মারে তো সেই মারে। সব চাইতে যা মর্মান্তিক ফুলকির পক্ষে দিদি সেটাই রাগের মাথায় বলে ফেলল। ‘যে সংসারে মুখ্যু মেয়ে থাকে সেই সংসারের ভাষ্যি থাকে না।’ দিদির কথার কি মানে না বুঝেই ফুলকি সেদিন ভ্যাক করে কেঁদে ফেলেছিল।

‘যেখানে বাঘের ভয় সেইখানেই সন্ধে হল একদিন।’ জহুরা কাকিমাকে বলেছিলেন সেদিন, যেদিন ওরা সেবক বৈদ্যের বাড়িতে বুড়ির তোরঙ্গ খুলে জিনিসপত্র দেখতে বসেছিলেন।

‘সর্বনাশের মাথায় বাড়ি! দেখি কি, বসির মাসিমার শিওরে বসে আছে। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। চিৎকার করে ডাকলাম, বসির! বসির চট করে মাসিমার চাদরের মধ্যে সেঁদিয়ে গেল।’

‘না বউমা, বসির তো কোনও রকম দুষ্টুমি করেনি।’

‘আমার তখন মাথায় খুন চড়ে গিগেছে। বললাম, নেমে আয় হতভাগা, আজ তোকে মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব। রাগের মাথায় আর কি বলেছিলাম সেদিন এখন আর মনে নেই কুসুম।’ জহুরা কাকিমা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘আমার তখন ভয়ে হাত পা সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছিল। দেখি মাসিমা মিচকি মিচকি হাসছেন। আমি চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি।’ জহুরাকাকী উঠে গিয়ে বুড়ির ছবিতে চুমু খেতে লাগলেন।

জহুরা কাকির কান্না থেমে গেল। এক সময় তিনিও হেসে উঠলেন, ‘এমন লোক চর্মচক্ষে দেখব, ভাবিনি কুসুম।’

‘যত বয়েস বেড়েছে মার তত তিনি সংস্কারমুক্ত হয়েছেন। আমরা তো পারিনে। কেন? কোথায় আটকায়!’

‘সেদিনের ছবিটা কিছুতেই ভুলতে পারিনে কুসুম। তুমি তো রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আর মাসিমার ঘরে এই কাণ্ড। কত বলব?’

‘তুমি বড্ড রেগে গিয়েছ বউমা। তুমি কার হাড় ভাঙতে চাইছ? বাছুর মিয়ার?’

বসির তক্ষুনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠল, ‘আমি বাছুর নই বুড়ি, আমি যদি বাছুর হই তবে তুমি কি, গাই গোরু?

‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি। দেখেছ বসিরের আস্পদা!’ আমি রাগে কস্ কস্ করছি।

‘আরে তাই তো,। তুমি তো আমার নাগর। তবে তুমি বসির মিয়া। হল তো?’

বসির মাথা নাড়ল। তক্ষুনি বুড়ির চাদর ফুঁড়ে ডাকিনী যোগিনীর দল একে একে বেরিয়ে পড়তে লাগল। ঝুমরি, ফুলকি, হাসনু। বুড়িকে ছুঁয়েটুয়ে সব একাকার।

জহুরা কাকি বললেন, ‘আমি তো হায় আল্লাহ্ বলে কপাল চাপড়ে বসে পড়লাম।’

‘তোমার ছেলে আমার পুরো স্বত্ব চায় বউমা। ও ভাগের কারবারে বিশ্বাস করে না। তাই আমাকে নিকে করতে চেয়েছে।’

‘তোমাকে কিন্তু কলেমা পড়তে হবে বুড়ি। পারবে তো?’

‘বসির! তোর দেখি বড্ড বাড় বেড়েছে! তুই নেমে আয় এখান থেকে!

‘বসির মিয়া তুমি এই বুড়ির নতুন নাগর হবে, আর আমি আল্ হাম্দো পড়তে পারব না! এটা কি কথার কথা হল?’

‘ওটা না হয় হল বুড়ি, তুমি গোরু খেতে পারবে?’

এবার একধার থেকে জহুরা কাকি আর ফুলকির পাশ থেকে হা এক সঙ্গে যেন আর্তনাদ করে উঠল, ‘বসির! ভাই! ফুলকি দেখল হার চোখ তার মায়ের দিকে আর জহুরা কাকির চোখ বসিরের দিকে স্থির হয়ে আছে। কিন্তু বুড়িরই কোনও বিকার নেই। আজ যেন বুড়ি এক মজার খেলা পেয়েছে।

তা দাদু, কি আর করা যাবে? পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে। তা দেখছ তো আমার দাঁত নেই। তুমি যদি একটু একটু করে চিবোয়ে চিবোয়ে দাও তাহলে আমিও না হয় জিড়োয়ে জিড়োয়ে খায়ে নেবা নে। কিন্তু আর না দাদু, আর না। তোমার মার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, এক্ষুনি সে ভিরমি খায়ে পড়বে। তোমাকে একটা কথা বলি বউমা, কথাটা তুমি শুনেও থাকতে পার আবার নাও পার। তুমি তখনও তাহেরের বউ হয়ে ওর বাড়িতে আসনি। এ তখনকার কথা। আমার সুধা তাহেরের বাড়িতে একবার ইদের সময় গিয়ে গোরু খেয়েছিল। ফলে কি হয়েছিল জানো? তোমার দাদী শাশুড়ি, খুব জাঁদরেল বুড়ি ছিল, যখন জানলেন, তার নাতির বন্ধু মুসলমান নয়, বামুনের ছেলে, তখন তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, তাহের ও তোর বন্ধু, আর তুই ওর জাত মেরে দিলি? বলেই তাহেরের পিঠে খটাখট লাগালেন খড়মের বাড়ি। আমার সুধাকেও ছাড়েননি বুড়ি। খড়মের দু চার ঘা তো পড়লই সুধার পিঠে কিন্তু তার চাইতেও মারাত্মক কাজ তিনি করেছিলেন। সুধাকে গোবর খাওয়ায়ে শুদ্ধ করে ছাড়িছেলেন। মেয়েলোক ছাড়া এমন মন আর কার থাকতে পারে বউমা। কার জাত কে মারে? আমি সুধাকে কই, কী দিন রাত ফুসফাস গুজগাজ করিস তোরা, আর কথায় হায় হিন্দু হায় মুসলমান বলে বুক চাপড়াস। যদি পারিস ছত্রিশ জাতের মেলা বসিয়ে দে। রেলে যখন উঠিস তখন কে কোন জাত তোর সঙ্গে যাচ্ছে, সেটা কি তোরা ভাবিস? ভাবিস না? কারণ রেলে ছত্রিশ জাতের মেলা। মানুষই হল জাত। অর আবার জাত কি? মন সাফ রাখাই হল আসল। রাম রহিম না জুদা কর ভাই, সাচ্চা দিল রাখো জি—এ সব গান তো আমরা থিয়েটারে শুনতাম।’

জহুরা কাকি আবার কাঁদতে শুরু করলেন।

২৪

‘সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক, স্বামীর কোলে মাথা রেখে যেন মরতে পারি, অসতীনের ঘর করি, এরই জন্যিই তো এত কাণ্ড বউমা। এরই জন্যি তো আমাদের মেয়েদের এত উপোস কাপস, এত ব্রেত পালন, সে ব্রেতর কি সীমা সংখ্যা ছিল? প্রতি মাসে এ-ব্রেত সে-ব্রেত, এবার সেবার লেগেই আছে, সবই তো নিষ্ঠাভরে পালন করে গিয়েছি আমরা। একটাও বাদ দিইনি। তা কি হল? পাকা চুল ফক্ ফক্ করছে কিন্তু সিঁদুর কোথায় গেল। অক্ষয় সিঁদুর ব্রেতর ফল কি হল? কাঁচকলা।

মা বলতেন, ‘যতই বয়েস বেড়েছে আমার শাশুড়ির ততই দেখছি পূজা পার্বণে ভক্তি শ্রদ্ধা কমে যাচ্ছে।’

‘পুণ্যিপুকুর ব্রেত তো ছোটবেলায় বছরের পর বছর করে আসিছি। তা কি হল? সব ছেলে-ভুলোনো ছড়া বউমা। পুরুত বামুনেরা চালকলা খাবে বলে ওর সঙ্গে পুণ্যি জুড়ে দিয়েছে।’

এত সব ব্রত পালন করে বুড়ির কি হয়েছে অমিতা জানে না। কিন্তু অমিতা এটা জানে যে, বুড়ি ব্রতকথার সুর ছড়িয়ে তাদের ছেলেবেলাকে একেবারে ভরে দিয়েছিল। সে সব কী অনুভূতি! বুড়ি বলতেই অমিতার কানে ভেসে আসে জলের স্রোতের মতো একটানা একটা গুনগুন শব্দ।

‘পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা কে পূজেরে সকালবেলা।
আমি সতী পুত্রবতী সাত ভায়ের বোন ভাগ্যবতী।।
ঢালি জল তুলসী বিল্বে স্বামী আদরিণী হব ফলে ফুলে।
পুণ্যিপুকুরে ঢালি জল শ্বশুর কুলের হোক মঙ্গল।।
এ ব্রতের ফল কি হয় নির্ধনের ধন হয়
সাবিত্রী সমান সতী হয় স্বামী সোহাগিনী হয়
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে মরণ হরে গঙ্গাজলে।।

‘পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা কে পূজেরে ভোরের বেলা—কে আবার? সেই কাকভোরে উঠে আমরাই পূজেছিলাম। পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে মরণ হবে গঙ্গাজলে। কাঁচকলা। এ বেতর ফল হল কি? স্বামী আমার কোলে সংসার রেখে দিয়ে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেলেন।’

‘শিবরাত্তিরের উপোস করব? না বলতেন, কর না কর না বউমা। কেন শুধু শুধু শরীরটাকে কষ্ট দেবে? কিচ্ছু ওসব করতে হবে না। বলতেন, ওতে কিছু নেই বউমা, আমি সব করে দেখেছি। স্বামী সন্তানের যত্ন নিও, পাড়াপড়শিকে ভালবেসো, তাহলেই হবে। বামুনগের পেট ভরিয়ে কী পাবে? কাঁচকলা?’

‘শিবের পুজো কি কম করিছি। চোত মাসের সংক্রান্তির দিন থেকে আরম্ভ করতে হত। আর শিবপূজার ব্রেত চলত বোশেখ মাস ভর। রোজই আমাদের একটা করে মাটি দিয়ে বুড়ো-আংলা শিব গড়তে হত। রোজ সেগুলো রেখে দিতে হত। তারপর জ্যেষ্ঠ মাসের পয়লা সেগুলো জড় করে জলে ভাসিয়ে দিতে হত।’

দিদি মাঝখানে শিবপুজোর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছিল। দিদি অবিশ্যি সাতসকালে উঠে বুড়ি যেমন বলেছিল, সেই রকম পুজো করত না। ইস্কুল থেকে এসে তার খেলাঘরে শিবপুজোয় বসত। দিদি ছড়া বলে যেত, ফুলকি দিদির সঙ্গে গলা মেলাত।

‘শিল শিলাটন শিলে বাটন শিল অঝুরে ঝরে।’

ফুলকি প্রথম প্রথম ‘শিল শিলাটন’ বলত না, বলত, ‘শিল টনাটন’, আর দিদির কাছে খুব বকুনি খেত। ‘শিল অঝুরে ঝরে’ বলত না ফুলকি, বলত, ‘শিল অজুতে ঝরে’, আর দিদির কাছে বকুনি খেত। একদিন বলেছিল, ‘ফের যদি ভুলভাল বলবি, তাহলে আর তোকে খেলাতে নেবই না।’ তারপর থেকে ফুলকি সাবধান হয়ে গিয়েছিল। দুই বোনে, যখনই মনে হত শিবপুজোর সময় হয়েছে, তখনই ছড়াটা সমস্বরে আউড়ে যেত।

‘শিল শিলাটন শিলে বাটন শিল অঝুরে ঝরে।
স্বর্গে ভোলা বলেন গৌরী ওরা কাহার ব্রত করে।।
আশ নড়ে পাশ নড়ে নড়ে সিংহাসন।
ভোলা মহেশ্বরের কোলে গৌরী আরাধনা।।
কালো পুষ্প তুলতে গেলাম সেথায় লতাপাতা, অনেক লতাপাতা।
শিবের চরণ দেখা হল শিবের মাথায় জটা, অনেক অনেক জটা।।
আকন্দ বিল্বপত্র আর গঙ্গাজল।
এই নিয়ে তুষ্ট হলেন ভোলা মহেশ্বর।।’

দিদি তারপর বলত, ‘প্রণাম করে মন্ত্র পড় ফুলকি। এ বাবা ভোলা মহেশ্বর, আছে তো বেশ আছে, রেগে গেলে একেবারে প্রলয় কাণ্ড।’ বুড়ি এই ভাবেই বলত।

দিদি বলত, ‘স্পষ্ট উচ্চারণ করবি। বল, নমো শিবায় নমঃ, নমো শিবায় নমঃ, নমো শিবায় নমঃ, নমো হরায় নমঃ, নমোঃ বজ্ৰায় নমঃ, নমো শিবায় নমঃ।

নমো শিবায় শান্তায় কারণত্রয় হেতবে।
নিবেদয়ামি চাত্মানং ত্বং গতি পরমেশ্বর।।

দিদি সংস্কৃত পড়েনি কিন্তু তার সংস্কৃত উচ্চারণ শোনবার মতো ছিল। এক সময় দিদির ডাক পড়ত গীতা পড়ার জন্য। দিদি বিশুদ্ধ উচ্চারণে পড়ে যেত,

ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুৰ্ব্বত সঞ্জয়।।

কিংবা

স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়।

কত ছোট বয়সে দিদি এইসব শ্লোক অনায়াসে বলে যেতে পারত, ভাবতে অবাক লাগে। দিদি এ সমস্তই বুড়ির কাছ থেকে শিখিয়েছিল। বুড়িই দিদিকে এইসব শিখেয়ছিল।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘লোকে মনে করে সুধার মা অশিক্ষিত ছিলেন। না ফুলকি, উনি যে কত কি জানতেন ভাবলে অবাক হতে হয়। আসলে মাসিমার হয়ত সে অর্থে বিদ্যে ছিল না, মানে ইশকুল কলেজের শিক্ষা ছিল না, কিন্তু বিদ্যে যা দেয় সেইটেই ছিল মাসিমার। সেটা হচ্ছে জ্ঞান। আমি এমন লোক দেখিনি ফুলকি।’

মা বলেছিলেন, ‘আমার শাশুড়ি ছিলেন বইয়ের পোকা। যে বই হাতের কাছে পেতেন তা নাটক নভেলই হোক আর শাস্ত্রের বই হোক, তা-ই শেষ করে ফেলতেন। যতক্ষণ না হাতের বই শেষ হচ্ছে ততক্ষণ বুড়ি নাওয়া খাওয়া ভুলে যেত। বই মুখে করে দিন কাটিয়ে দিত।’

বাবা বলেছিলেন, ‘মায়ের মনে রাখার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। একবার যা শুনতেন সেটাকে মনে গেঁথে রাখতেন। ঠিক তোর দিদির মতো।’

‘তোর ঠাকুমার আর একটা বড় গুণ ছিল ফুলকি, সব কথা শুনতেন, কত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন, কিন্তু বিনাবিচারে কিছুই মেনে নিতেন না।’ আমাকে একদিন হঠাৎ বললেন, তায়েব বাবা, আল হামদো কি আমাকে একটু বোঝাবে? আমি তো অবাক। বললাম, আপনি আল হামদো বুঝে কি.. করবেন মাসিমা? মাসিমা বললেন, বলই না বাবা, শুনে রাখতে দোষ কি? আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মাসিমা আপনি কি মানেটা শুনতে চান। মাসিমা বললেন, মানেটা তো শুনতেই হবে বাবা, তুমি শ্লোকটা আগে শুনিয়ে দাও তার পরে মানেটা বলো। দূর থেকে আজান শুনি, ভালই তো লাগে। এখন কাছ থেকে শুনে দেখি, মুসলমানের শাস্ত্রর কানে গেলে গায়ে ফোস্কা পড়ে কি না? মাসিমা ছিলেন এই রকম।’

বুড়ির কথায় ছিল যশুরে টান। কিন্তু যখন সংস্কৃত শ্লোক আওড়াত তখন কে বলবে, বুড়ি ‘মুখ্য মেয়েমানুষ’। এই কথাটা দাদু নাকি প্রায়ই শোনাত বুড়িকে। বুড়ি এক দ্বার পণ্ডিতের কাছে সংস্কৃত শিখেছিল। তখনও বাবার জন্ম হয়নি। দাদুর কাছে মুখ্যু নাম ঘুচাবে বলে। কিন্তু এটা যেন এক লজ্জার কাজ, তাই বুড়ি কাউকে বলত না এ কথা।

একদিন দিদি বলেছিল, ‘বুড়ি তুমি যে পুরুত ঠাকুরের চাইতেও ভাল মন্ত্র পড়, দাদু কি সেটা শুনেছে?’

বুড়ি বলত, ‘চোখ দুটো যখন কপালের উপর রয়েছে তখন দেখতি যে পেত না নয়, আর মাথার পাশে যখন দুটো কান রয়েছে তখন শুনতি যে পেত না তাও নয়।’

‘দাদু কি বলত?’

‘কাঁচকলা! বত মুখ্যু মেয়েমানুষ।’ বুড়ি ফুকুর ফুকুর হাসতে লাগত।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘মাসিমার এক একটা কথায় আমি চমকে যেতাম ফুলকি। যেমন একদিন আমাকে বললেন, আচ্ছা বাবা, বাবা বাছা ছাড়া মাসিমার মুখে আর কোনও ডাক শুনিনি আমরা, বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমাদের শাস্তরে তো বলে ঈশ্বর এক। বললাম, হ্যাঁ মাসিমা। বললেন, তোমাদের শাস্তরে তো বলে ঈশ্বর সর্ব-নিরপেক্ষ? বললাম, হ্যাঁ মাসিমা। বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমাদের শাস্তরে তো বলে, ঈশ্বর কোনও যোনি থেকে জন্মাননি, তিনিও কারও জন্ম দেননি, তাই তো? বললাম, হ্যাঁ মাসিমা। তিনি বললেন, তাঁর সমকক্ষ নেই, এ কথাও তো তোমাদের শাস্তরে বলছে? আমি বললাম, হ্যাঁ মাসিমা। মাসিমা এইবার যা বললেন, তাতে আমি চমকে গেলাম। তিনি বললেন, তোমাকে একটা সংস্কৃত শ্লোক শোনাই বাবা, দেখ তো তোমাদের শাস্তরের সঙ্গে মেলে কি না? আমি শ্লোকটা শুনে চমকে গিয়েছিলাম ফুলকি। আমি সেটা তোর ঠাকুমার কাছ থেকে লিখে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি তো আর তোর ঠাকুমার মতো উচ্চারণ করতে পারব না। তায়েবকাকা মনে করে করে বলেছিলেন, মাসিমা বলতেন, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয় এবং তিনি সর্বত্র ব্যাপ্ত, তিনি সর্বশক্তিমান, দয়ালু, এবং বাক্য ও মনের অগোচর, এটা তো সব শাস্তরেরই কথা। মাসিমা আমাকে এই শ্লোকটা দিয়েছিলেন,

এক এবা দ্বিতীয়শ্চ, প্রকাশো, জ্ঞানমেব চ,
দয়ালুদানবান কর্তা সুরূপঃ সুপ্রকেতনঃ।
সর্বশক্তি, স্বতন্ত্রেচ্ছা, মনোবাচামগোচরঃ,
নামভিঘোষিতশ্চাবিঃ, প্রার্থনীয়ঃ পুনঃ পুনঃ।।

বলেছিলেন, দেখ তো এমনি ধারা কথার মধ্য দিয়ে যদি এটা প্রকাশ করা যায়, তাহলে এটা কেমন আমাদের ঘরের ঠাকুর হয়ে দাঁড়ায়। দাঁড়ায় না বাবা? আমার তখন মনে হয়েছিল, তায়েরকাকার গলা রুদ্ধ হয়ে এসেছিল প্রবল আবেগে। একটু থেমে বলেছিলেন, ফুলকির মা, ‘আমার তখন একটা কথাই মনে হচ্ছিল, নবির মুখ দিয়ে বুঝি এমনিভাবেই কোরানের বাণী নাজেল হয়েছিল। মাসিমা বলেছিলেন, সকলের ঈশ্বরের তো এই একই গুণ। তবে কিসের জন্য এত মারামারি এত রিষ এত বিদ্বেষ বাবা তায়েব?’

সেদিন মনে পড়েনি, কিন্তু আজ মনে পড়ল অমিতার, বুড়ি এইসব কথা অনেক শিখিয়েছিল তাদের।

‘এমন মন খুব দুর্লভ ফুলকি’, তায়েবকাকা বলেছিলেন। ‘কিন্তু দুর্লভ হলেও এই দুনিয়ায় তাদের দেখা পাওয়া যায়, যাদের মনটা রেডিওর এরিয়েলের মতো, যা কিছু সারবস্তু তা চট করে ধরে ফেলতে পারে। এমন মন আমাদের নবি হজরত মহম্মদের ছিল, এমন মন সন্তসাধকদের ছিল, এমন মন রবীন্দ্রনাথের ছিল। কিন্তু আমি তো তাঁদের দেখিনি। আমি তোর ঠাকুমাকে দেখেছি। ওই রকম মন তাঁর মধ্যে দেখেছি। তোর ঠাকুমা একটা গান গাইত। আমার মনে আছে। ‘তোমার পথ ঢাক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।’

গানটা আমরা জানি। বুড়ি দিদিকে শিখিয়েছিল। দিদি এক সময় খুবই গাইত।

তোমার পথ ঢাক্যাছে মন্দিরে মসজিদে।
ও তোর ডাক শুনি সাঁই চলতে না পাই,
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরশিদে।
ডুইব্যা যাতে অঙ্গ জুড়ায়,
তাতেই যদি জগৎ পুড়ায়
বলতো গুরু কোথায় দাঁড়ায়
(তোমার) অভেদ সাধন মারল’ ভেদে।
তোর দুয়ারেই নানান তালা
পুরাণ কোরান তসবী মালা
ভেদ পথই তো প্রধান জ্বালা
কাইন্দ্যা মদন মরে খেদে।’

আরও কত গান যে বুড়ির ভাঁড়ারে ছিল, হিসাব পাওয়া ভার। মা বলতেন, তিনি শুনেছেন, তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে কোনও বাউল ফকির বোষ্টম বষ্টুমি গেলেই শাশুড়ি তাঁদের মুখ থেকে গান শুনতে চাইতেন। একবার শুনলেই বুড়ির মনে সে গান গেঁথে যেত। দিদি বুড়ির এই গুণটাই পেয়েছিল। বুড়ির জেদ এবং সাহসও পেয়েছিল দিদি। বুড়ির গলায় তখন সুর বিশেষ ছিল না, তবে, ভাব ছিল, যখন ফুলকি বুড়ির গান শুনেছে তার কোলের কাছে শুয়ে শুয়ে। আজও অমিতার মনে সেসব গুনগুনিয়ে, ওঠে। বুড়ির কথা যখন তার মনে পড়ে। একটা গানের দুটো কলি তার মনে আছে। এক সময় অমিতাকে এ গানটা গাইতে হয়েছে গণশিল্পী সংঘের অনুষ্ঠানে। এখন মাত্র মুখটাই মনে আছে। সেই মুখটাই এখন গুনগুনিয়ে উঠল অমিতার মনে।

‘দেখলাম জাত কুল বিচারে দেখলাম জাত কুল বিচারে
কি বা হিন্দু কি মুসলমান যমে তো ছাড়বে না কারে
দেখলাম জাত কুল বিচারে—’

দাঙ্গার পরে অনেক সময় সভায় অমিতা এই গানটা গেয়েছে। লালনের গানও বুড়ি অনেক জানত। আশ্চর্যের কথা বুড়ি একবিন্দু হিন্দি জানত না। কিন্তু কবীর সুরদাসের তুলসীদাসের গান বুড়ি হিন্দি উচ্চারণেই গাইত। ‘ঘুংঘট পট খোল তেরা পিয়া মিলেঙ্গে।’ মীরার ভজনও দিদি বুড়ির কাছ থেকেই শিখেছে। আরও একটা আশ্চর্য গান বুড়ির কাছ থেকে দিদি শিখেছিল। আর সে গানটা দিদি যখন গাইত তখন তার মনের যত আবেগ, সে যেন গানটায় মিশিয়ে দিত।

‘দয়া লাগি নরপন বধৈ, ঘাতক-ধরম নন কোয়।
ভাইকুঁ হতি ভাইকুঁ পৌষে, সমঝে বহু দুখ হোয়।
বাচ্চা মারী বচ্চা খিলাবৈ জৈসে বাঘ বিলারী।
ভাবকুঁ মারি ভাবকুঁ সাধৈ, সাধনকী বলিহারী।।’

বাবার এক বন্ধু একবার বেনারস থেকে এসে তাদের বাড়িতে দিন তিনেক ছিলেন। মণিময়কাকা বেনারসেরই বাসিন্দা ছিলেন। মণিকাকার সঙ্গে সেবার এসেছিলেন ওঁরই এক বন্ধু, দ্বারকাপ্রসাদ দ্বিবেদী। দ্বারকাপ্রসাদজি দিদির মুখে এই গানটা শুনে একেবারে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘বেটি, তুমি এই গান কোথা থেকে পেলে? আর এই সুরটাই বা কে তোমাকে শিখিয়েছেন?’ দিদি যখন বলল, ঠাকুমার কাছ থেকে গানটা শিখেছে তখন দ্বারকাপ্রসাদজি বলেছিলেন, ‘তাজ্জব! আমার ধারণা ছিল, বাংলাদেশে রজ্জবপন্থী নেই।’ দ্বিবেদীজি বাংলা ভালই জানতেন। ‘এই দোঁহা রজ্জবের। যেমন নানক, যেমন কবীর সন্তসাধক ছিলেন তেমনি রজ্জব তেমনি ছিলেন দাদু। ক্ষিতিমোহন সেন এদের উপর খুব কাজ করেছেন। রবীন্দ্রনাথও এঁদের ভক্ত ছিলেন। এঁরা সবাই সমন্বয়বাদী ছিলেন। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সেতু বাঁধবার কাজ করে গিয়েছেন। দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন দ্বিবেদীজি, ‘বেটি, এই গানটার মানে তুমি নিশ্চয়ই জান? দিদি বলেছিল, ‘না, আমার ঠাকুমা হিন্দি জানতেন না।

‘কিন্তু গান শুনে তো মনে হয় না সে কথা। তুমি যে ভাবে গানটা গাইছ সেটাই বিশুদ্ধ উচ্চারণ। যে সুরে গাইছ সেটাই বিশুদ্ধ সুর। এখন এই সব গানের সুর পাল্টে যাচ্ছে।’

বাবা বলেছিলেন, ‘মা কানে একবার যা শুনতেন তা আর জীবনে ভুলতেন না। আমার বড় মেয়েরও সেই স্বভাব।’

দ্বিবেদীজি বলেছিলেন, ‘তবে মানেটাও শুনে রাখো বেটি। রজ্জব বলছেন, দয়া লাগি নরপন বধৈ, ঘাতক-ধরম নন কোয়। আহা, কী কথা! দয়া প্রবৃত্তির উৎকর্ষের জন্য মানুষ যে মনুষ্যত্বকে বধ করে, তাতেও একটা ঘাতকবৃত্তি আছে। ঘাতকধর্ম তো কোনও ধর্ম নয়। এক ভাবকে (বা মতকে) হত্যা করে অন্য ভাবকে (বা মতকে) উৎকর্ষদান হল এক ভাইকে মেরে অন্য ভাইকে পোষণ করা। বুঝে দেখলে এতে বড় দুঃখ হয়। বাঘ বিড়াল যেমন এক বাচ্চাকে মেরে অন্য বাচ্চাকে খাওয়ায়, তেমনি এক ভাবকে মেরে অন্য ভাবকে যে সাধনা করে, সেই সাধনকী বলিহারি। বলিহারি সেই সাধনায়! রজ্জব বলেছেন, প্রতি বিন্দু জলের মধ্যেই সাগরের প্রতি ব্যাকুল প্রেম নিহিত আছে। তাই একটি বিন্দু ডাকে অন্য সব বিন্দুকে, কারণ সকল বিন্দু মিলিলেই মিলে গতি।’

দ্বিবেদীজি সেদিন অনেকের কথা বলেছিলেন। অমিতার কাছে সেটা যেন অন্য একটা জগৎ। রজ্জব বলেছিলেন, ‘সব সাঁচ মিলে সো সাঁচ হৈ, না মিলে সো ঝুঠ’। বিশ্বের সকল সত্যের সঙ্গে যা মেলে তাই সত্য, যা না মেলে সেটাই হল মিথ্যা।

দ্বিবেদীজি বলেছিলেন, ‘কবীরও কথাটা অন্য ভাবে বলেছেন।’

‘জো খোদায় মসজীদ বস্তু হৈ, ওর মুলুক কেহিকেবা?
তীরথ মূরত রম নিবাসী, বাহর করে কো হেরা?’

খোদা যদি মসজিদেই বাস করেন, আর সব মুলুক তবে কার? তীর্থে মূর্তিতেই যদি রাম করেন বাস, তবে বাইরেটা দেখে কে?

‘এ সব ফাত্রা মানুষ যারা তারা বানায়নি বউমা।’ বুড়ি বলেছিল। ‘এ সব ভেদের কথা বানিয়েছে গুরু পুরোহিত মোল্লা মুরশিদরা। ওই যে লালন ফকির যা বলেছেন, সেটাই আসল কথা। কেউ মালা কেউ তসবী গলায়, তাইতে ত জাত ভিন্ন বলায়, যাওয়া কিংবা আসার বেলায় জাতের চিহ্ন রয় কার রে।

বুড়ি বলত, ‘কত দেখলাম! জাত কুল বিচারে কি বা হিন্দু কি মুসলামন যমে তো ছাড়বে না কারে। তাই তো সুধাদের বলি, তোরা ছত্রিশ জাতের মেলা যেদিন বসাতে পারবি সুধা, সেদিন দেখবি জাতপাত ছোঁওয়াছুঁয়ি কর্পূরের মতো উবে যাবে। বক্তৃতায় কিছু পাবিনে। তোদের ভাব সাব দেখে মনে হয় সুধা, এইটুকু একটা ডোবায় তোরা মাছ ধরতে নেমেছিস, আর মাছ ওঠার আগেই তোরা কার ভাগ কতটা হবে তাই নিয়ে তোরা লাঠালাঠি শুরু করেছিস। মানুষ ডোবায় বাস করে না বাস করে সৃষ্টিতে। সে এক বিরাট ব্যাপার। তোরা সেই মানুষের মধ্যে নিজেদের মিলিয়ে দে। সব পাবি।’

মা বলেছিলেন, ‘আমার শাশুড়ি আমাকে বার ব্রত উপোস কাপাস কিছু করতে দিতেন না। মা বলতেন, ও সবে কিছু নেই বউমা। সব ফক্‌কি। কিছু যদি সত্যিই থাকত, তাহলে আমার পাকা চুলে সিঁদুর দেখতে। ওরই জন্যি তো এত সব পালন করা। কাঁচকলা।

অমিতা মায়েদের কাছে শুনেছে, বুড়ির মনের জোর ছিল জবর। সে এক অবিস্মরণীয় কাহিনী! দাদু বুড়িকে নিয়ে রাজগীরে গিয়েছিল চেঞ্জে। একদিন রাতে দাদু বলল, তখন খেয়েদেয় দাদু শুয়েছে। বুড়িরও খাওয়া দাওয়া শেষ। দাদু বলল, দেখ তো দরজা ভিতর থেকে বন্ধ আছে কি না? না থাকলে খিল তুলে দিয়ে এস। বুড়ি বিছানায় এসে দেখে দাদু ছটফট করছে আর বুকে হাত বোলাচ্ছে। দাদু বলল, একটু ডলে দাও তো। বলতে বলতেই দাদু ঢলে পড়ল। শেষ। বুড়ি সেই একা ঘরে বিদেশ বিভুঁয়ে মড়া নিয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছিল। পরদিন সকালে বুড়ি বেরিয়ে এক মুসলমান ভদ্রলোককে বিপদের কথা বলল। সেই বিহারী ভদ্রলোক অনেক কষ্টে একটা ট্যাক্সি জোগাড় করে দিলেন। ডাক্তার এনে ডেথ সার্টিফিকেট লেখালেন। তারপর বুড়ি স্বামী কোলে করে কলকাতায় রওনা দিল। কোথায় রাজগীর আর কোথায় কলকাতা!

কলকাতায় গভীর রাতে পৌঁচেছিল বুড়ি। তারপর ছেলেদের হাতে তাদের বাবাকে সঁপে দিয়ে বলেছিল, ঈবার তোরা যা করবার কর। আমার ছুটি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *