১৫
তুমি যেটা আশঙ্কা করছিলে ফুলকি, শেষ পর্যন্ত তাই হল তো? বাবার বজ্র পড়ল তো শামিনের মাথায়? অমিতা যেন দিদির কণ্ঠস্বরই শুনতে পেল। ওরা কিছুই ভোলে না ফুলকি। খালি সময় সুযোগের অপেক্ষা করে। এখন কি করবে? সিদ্ধান্ত এবার তো নিতেই হবে।
সিদ্ধান্ত? ফুলকি বলেছিল, সিদ্ধান্ত তো নিয়ে ফেলেছি। বিয়ে আমরা করব।
এত চটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললি ফুলকি? অমিতা যেন দিদির স্বরটাই শুনতে পাচ্ছে। বিয়ের সিদ্ধান্ত তোর না শামিমের?
প্রস্তবটা অবশ্যই শামিমের। সিদ্ধান্তটা দুজনের।
সিদ্ধান্তটার গুরুত্ব বুঝেছিস তো ফুলকি.? গভীরভাবে তলিয়ে দেখেছিস এর পরিণাম?
জানি কি বলতে চাইছ? আমি এখন সব কিছুর জন্য তৈরি।
এরই মধ্যে এত সাহস বেড়ে গেল তোর ফুলকি! এই কদিন আগেও তো দুলছিলি। একদিকে তোর বাবা আরেক দিকে তোর শামিম? ঠাট্টা করছে দিদি! অমিতা ফিরে দেখল পিছনে। কোথায় দিদি? সেখানে তো অন্ধকার। অমিতা দূরবীনে চোখ রাখল আবার। প্যারাগনে দুই বিপন্ন প্ৰাণী। পাশাপাশি বসে আছে নির্জন ঘরে।
তুমি এত আপসেট হচ্ছ কেন শামিম?
‘আমি নিশ্চিত হতে চাই ফুলকি, তোমার বাবা আমাকেই ও কথাটা বলেছেন কি না?’
এতে কিছু যায় আসে শামিম?
‘ট্রাস্ট বিট্রে করা মানে তো বেইমানি করা। সাদা বাংলায় এই মানেই তো দাঁড়ায়। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না ফুলকি, কাকাবাবু, যে কাকাবাবুকে জীবনে সব চাইতে শ্রদ্ধা করি, তিনি আমাকে বেইমান বলেছেন।’
এতে কি আসে যায় শামিম? অমিতা দিদির কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গেল। ফুলকির কথাটাই বলে দিল দিদি। কোথায় দিদি।
ফুলকি শামিমকে খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল। অপমানে ক্ষোভে ব্যথায় অসহায়ত্বে শামিমের সমস্ত স্নায়ু যেন টান টান হয়ে রয়েছে। ফুলকির হাতে শামিমের বলিষ্ঠ হাতের চাপ ক্রমশ কঠিন হতে লাগল। ক্রমশ কঠিন। তার হাত বুঝি চাপ দিয়ে গুঁড়িয়েই দেবে শামিম। সেদিন যে কথাটা শামিমের মুখে শুনে চমকে উঠেছিল ফুলকি, ‘তুমি বোধ হয় একটু ছেলেমানুষি করে ফেলেছিলে ফুলকি, –এবং বিস্মিত হয়ে সে শামিমের মুখের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল—আমাদের কথাটা চট করে ফাঁস করে দেওয়াটা, আমি বলব, ছেলেমানুষিই হয়েছে—শামিম কি তার বিচার করতে বসেছে,—’আমি বলতে চাইছি, আমাদের একটু সময় পাওয়ার দরকার ছিল’—শামিম রায় দিচ্ছে বিচারকের মতো,—নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, ফুলকি, সে কথাটাকে অমিতা এখন কত সহজেই না নিতে পারছে! শামিম কেমন অসহায় হয়ে পড়েছিল, ফুলকি তখন সেটা ধরতে পারেনি। বেচারা শামিম! তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘রাস্তা দিয়ে হিন্দু মুসলমান যুবকেরা যখন চলে, সুধাকর, হিন্দুদের চলাফেরার কায়দা দেখ, বলে দিতে হয় না যে তারা নিজের দেশের মাটির উপর দিয়ে হাঁটছে, দেশ যেন তাদের। আর মুসলমানেরা এমনভাবে চলে তারা যেন এখানকার মুসাফির। তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ মা, তোর বাবা আর হরিকিশোর আমার সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। যাকে প্রাণের বন্ধু বলে একেবারে সেই বন্ধু। আমরা একের জন্য অন্যে অনায়াসে প্রাণ বলি দিতে পারতাম। সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই। তবুও তো আমি বলতে পারিনি, হরিকিশোর আমার মেয়েটাকে তুমি নাও তোমার বউ করে। এটাও তো ঠিক। আমি তো তোর বাবাকে বলতে পারিনি, সুধাকর তোমার তো তিনটে মেয়ে আছে, একটাকে আমাকে দাও, আমি বাড়ির বউ করে নিয়ে যাই। আমি এ কথা বলিনি, কারণ কথাটা আমার মনেই ওঠেনি। তোর কাকিমাই আমাকে এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল, আপনাদের এই ঐক্যের কথা আমি কিছুই বুঝিনে। আপনাদের মধ্যে মূলে ফাঁক, আপনাদের মনের কলা আপনারা মনেই খান, আর বাইরে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বড় গলা করে গাবিয়ে বেড়ান, ওতে কি সত্যকারের ঐক্য হয়? ওদের ঘরের মেয়েরা যেদিন স্বাভাবিকভাবে আমাদের ঘরে বউ হয়ে আসতে পারবে, আমাদের ঘরের মেয়েরা যেদিন স্বাভাবিকভাবেই ওদের ঘরে বউ হয়ে যেতে পারবে, সেইদিনই হবে আমাদের মধ্যে মিলন। সেদিন আর আপনাদের মাঠে ময়দানে মাচা বেঁচে ঐক্য ঐক্য বলে চেল্লাতে হবে না। কেবল চেল্লানিতে আপনাদের মধ্যে ঐক্য আসবে না, ওয়াহেদের বাপ। ওটা কেবল ফাঁকা আওয়াজ। ভালবাসার আওয়াজ নয়। পারেন তো আপনি আর আপনাদের বন্ধুরা কাজটা এখান থেকে শুরু করেন। তোর চাচিই ছিল সত্যকারের জ্ঞানী মা। মেয়েদের সহজ বোধ আমাদের কাছে এসে কত দুর্বোধ্য হয়ে যায়।’ তায়েবকাকার সেই করুণ মুখ কি কখনও ভুলতে পেরেছে অমিতা?
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘আমাদের মুসলমানদের এই হীনমন্যতার একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে। সেটা না বুঝলে আমাদের ব্যথাটা বোঝা যাবে না।’ মনসুর বলেছিলেন, ‘আমরা জন্ম থেকেই দেখে আসছি, হিন্দুর আসন সবার সামনে, আমাদের আসন সবার পিছনে। জমিদারের কাছারিতে যাও, হিন্দু উকিলের বাড়িতে যাও, যেখানেই যাও তুমি মুসলমান তোমার আসন অসম্মানের মধ্যে। যুগ যুগ ধরে এই অসম্মান মুসলমানদের মেরুদণ্ডকে বাঁকিয়ে দিয়েছে। হিন্দু সমাজের আওতায় তা কি কোনও দিন সোজা হতে পারে? একটা বড় গাছের ছায়ায় আর কোনও গাছ কি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে?’ অমিতা এখন বুঝতে পারে সে কথা। কিন্তু ফুলকি সেদিন তা কি করে বুঝবে?
ফুলকি সেদিন প্রায় খেপে উঠেছিল। সে শামিমের হাত থেকে নিজের হাতখানা টেনে নিল। আর ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, তোমার কখন সুসময় আসবে, সেটা তো কখনও বলনি শামিম? আমি সেদিন কিছুই ছেলেমানুষি করিনি। তোমার প্রতি আমার ভালবাসা বাঁচ বার দায় আমারই ছিল। আমাকে আর বাবাকে না জানিয়েই আমার পরমাত্মীয়েরা আমার বিয়ের ঠিক করে ফেলেছিলেন। সেদিন ছিল পাকা দেখা। আমি তোমাকে ভালবাসি, আর আমি সেই কারণেই বিশ্বাস করেছিলাম, সেই রাত্রে আমাদের বিয়ের একটা অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে। তুমিই আমাকে সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছিলে শামিম। তুমিই বলেছিলে, তুমি আমার স্বামী। সেই চিহ্নই সিঁদুর দিয়ে তুমি আমার কপালে একে দিয়েছিলে। আমি এটাকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলাম বিনা দ্বিধায়। সেই রাতে আমরা প্রকৃতই স্বামী-স্ত্রী হয়ে উঠেছিলাম। এখন তুমি বলছ, আমি ছেলেমানুষি করেছিলাম!
শামিম তুমি অমন হতবাক হয়ে ফুলকির দিকে চেয়েছিলে কেন? অমিতা যেন তার অদৃশ্য দূরবীনটার ফোকাস শামিমের মুখে তুলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিল।
আর এখন তুমি বলছ শামিম, ফুলকি কথাটা ফাঁস করে দেওয়াটা তোমার ছেলেমানুষি হয়ে গিয়েছে! তুমি এ কথা বলছ শামিম! কী করে এ কথা আমাকে বলতে পারলে?
আসলে শামিম তুমি হীনমন্যতাবোধে ভুগছিলে। তাই তুমি সেদিন হিসেব করে কথাটা বলনি। ফুলকি যেমন তোমাকে প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিল, তুমিও ফুলকিকে তেমনই ভালবেসেছিলে। সে ভালবাসায় সত্য আছে, ফুলকি যদি এটা বিশ্বাস না করত, তাহলে কিছুতেই তোমার ডাকে অত সহজে সাড়া দিতে পারত না। হোটেলে অত নিঃসংকোচে সে যেতে পারত না। তার ভালবাসায় খাদ ছিল না। সে ভালবাসা ফুলকির অন্তরে সূর্যের মতোই জ্বলে উঠেছিল। ফুলকি শামিমকে ই ভালবেসেছিল। সে শামিম হিন্দু কি মুসলমান, সে প্রশ্ন তার মনে ওঠেনি। তুমিও ওকে ভালবাসতে। কিন্তু তুমি আর তোমার ভালবাসার মধ্যে যে হীনমন্যতার ছায়া পড়েছিল ফুলকি কি করে বুঝবে তা? অমিতা বলে উঠল, বেচারা!
মনসুর বলেছিলেন, ‘ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম দুটো স্বতন্ত্র সমাজ আগে থেকেই ছিল।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘বাংলার মুসলমানদের অর্থনীতিতে অধঃপতন, যেটা বাংলায় কর্নওয়ালিসের দান, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, ত্বরান্বিত করেছিল। কর্নওয়ালিস প্রজাস্বত্বকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আওতায় না এনে ভূস্বামীদের স্বত্বকে যেদিন থেকে এই বন্দোবস্ত দিয়ে পাকা করে দিলেন, তারপর থেকেই মুসলমানদের কপাল পুড়ল।’ মনসুর বলেছিলেন, ‘অর্থনীতিতে এই অধঃপতনের ফলে জীবনের সকল স্তরে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির পার্থক্য একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ফজলুল হক বলতেন বাংলার অর্থনীতিই বাংলার আসল রাজনীতি। মনসুরও তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় এই প্রভেদটা প্রজা আন্দোলনে খুবই তীক্ষ্ণভাবে ফুটিয়ে তুলেছিল। যেখানেই সভা হত, আর মনসুর সেই সভায় হাজির থাকত, বলত, বাংলার জমিদার হিন্দু, প্রজা মুসলমান। বাংলার মহাজন হিন্দু, খাতক মুসলমান, উকিল হিন্দু, মক্কেল মুসলমান। ডাক্তার হিন্দু, রোগী মুসলমান। হাকিম হিন্দু, আসামী মুসলমান। খেলোয়াড় হিন্দু, দর্শক মুসলমান। জেইলার হিন্দু কয়েদী মুসলমান। এই তালিকা বেড়েই যেত। কিন্তু পার্থক্যটা স্পষ্ট ফুটে উঠত।’
মনসুর বলেছিলেন, ‘আওয়াজটা এমনি এমনি তো ওঠেনি। যে অপমান আমরা মুসলমানেরা ব্যবহারিক জীবনে সহ্য করেছি নিত্য, সেখান থেকেই এ সব কথা উঠে আসত সুধাকরবাবু। এগুলো নিছক বানানো গল্প নয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি বাংলার প্রজা আন্দোলন গোড়ায় ছিল মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদার দাবি আদায়ের আন্দোলন। এই মর্যাদার অভাবেই শিক্ষিত অশিক্ষিত সব মুসলমানের মেরুদণ্ড বেঁকে গিয়েছিল। এটাকে নিছক অর্থনীতির আন্দোলন বললে ঠিক বোঝা যাবে না। কলকাতায় বসে আজ সেদিনের অপমানের কথা অনেক হাল্কা শোনাবে। তবে আপনার অভিজ্ঞতা আছে, সুধাকরবাবু আপনি বুঝবেন। শুধু হিন্দু জমিদাররাই মুসলমান প্রজাদের তুই তোকারি করে অবজ্ঞা করতেন না। এঁদের কাছারিতে ও বৈঠকখানায় মুসলমানদের বসতে দিতে হিন্দু জমিদারেরাই যে শুধু আপত্তি করতেন, তা নয়। বাবু যত বলে পারিষদ দলে করে তার শতগুণ। জমিদারদের দেখাদেখি তাঁদের আমলা-ফয়লা, তাঁদের আত্মীয়স্বজন, তাঁদের ঠাকুর পুরোহিত, তাঁদের উকিল-ডাক্তারেরাও মুসলমানদেরকে নিজেদের প্রজা ও সামাজিক মর্যাদায় নিম্নস্তরের লোক বলে মনে করতেন। এটা জমিদার-প্রজার স্বাভাবিক সম্পর্ক ছিল না। এটা ছিল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক। এটা ছিল ভাতের হাঁড়ি ফেলাফেলির সম্পর্ক। এটা ছিল কলসীর জল ছোঁয়াছুঁয়ির সম্পর্ক। একদিকে বামন কায়েত প্রজারা জমিদারের কাছারিতে বৈঠকখানায় বসতে পারত, সেখানে মুসলমান ‘প্রজা তাদের সঙ্গে বসতে পেত না, অন্যদিকে বর্ণ হিন্দুর কাছে অমন নিগৃহীত হয়েও নিম্ন শ্রেণীর তালুকদার বা ধনী মহাজনেরাও মুসলমানের সঙ্গে বর্ণ হিন্দুদের মতোই ব্যবহার করত। এই ভেদ কি মুসলমানেরা রচনা করেছে সুধাকরবাবু?
তায়েবকাকা বলতেন, ‘শত শত বছর ধরে মুসলমানের যে মেরুদণ্ড হিন্দুসমাজের বৈষম্যের জন্য বেঁকে গিয়েছে, তা আবার সোজা হতে অন্তত দু এক জেনারেশন তো লাগবেই।’
‘হিন্দু সমাজের আওতায় থাকলে মুসলমানদের মেরুদণ্ড কখনোই সোজা হতে পারবে না তায়েব, যদি না এই হিন্দু সমাজের খোল নলচে পালটে দেওয়া হয়।’ আমার বাবা বলেছিলেন এই কথা। অমিতা বলে উঠল। বাবা আমার বাবা!
শামিম আর ফুলকি পাশাপাশি বসেছিল। এখন কেউ কারও হতে ধরে নেই। কেউ কারও দিকে চাইছিল না। ওরা দুজনেই মনোনিবেশসহকারে যেন টেবিল ক্লথের নকশাটা খুঁটিয়ে দেখছিল। কেউ কারও সঙ্গে কথা কইছিল না। না, কথা কইছিল মনে মনে।
অমিতা ফুলকির বাঁধানো খাতার দিকে চেয়ে আছে। তখন কি উৎসাহ ছিল ফুলকির। কত লিখতে পারত সে! কত কথা লিখে রেখে গিয়েছে। বাবাদের বৈঠকে যে সব কথা তার ভাল লাগত সে সব কথা, কি কোথাও ভাল কিছু পড়লে তার পরিচ্ছেদকে পরিচ্ছেদ রাত জেগে টুকে রেখে দিত। এগুলো তার ডায়রি নয়, তার সংগ্রহ। অনেক সময় এই খাতার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে আসত তার বাবার, কখনও বা হরিকিশোর মেসোর, কখনওঁ বা তায়েবকাকারু কখনও বা মনসুর সাহেবের, কখনও বা যিশু কখনও গান্ধী, কি তার ভাললাগা কোনও লোকের গলার স্বর।
ফুলকি হঠাৎ চোখ তুলে চাইল শামিমের দিকে।
শামিমও চোখ তুলে সেই একই সময় চাইল ফুলকির দিকে।
অমিতা খাতার দিকে চেয়ে বসে আছে।
শামিম : ফুলকি এত কাণ্ড ঘটে গিয়েছে! আর আমি—
শামিমের চোখে মুখে কুণ্ঠা জড়ানো।
ফুলকি : তুমি কি করেই বা জানবে শামিম, সেদিন কী ঘটেছিল?
অমিতা ফুলকির খাতার দিকে চেয়ে বসে আছে।
শুদ্ধি আন্দোলনের কথা তোমার মনে আছে সুধাকর? কি ঝড়টাই না বয়ে গেল।
হ্যাঁ শামিম, সেই ঝড় সেদিন আমাকে যে গুঁড়িয়ে দিতে পারেনি, সে শুধু আমি তোমার উপর বিশ্বাস রেখেছিলাম বলে। আমি মরীয়া হয়ে তোমাকেই আঁকড়ে ছিলাম।
ফুলকি শামিমের দিকে চেয়ে আছে। ফুলকির ঠোঁট নড়ছে না। ফুলকি যেন মমতা দিয়ে স্পর্শ করতে চাইছে শামিমকে।
শামিম চেয়ে আছে ফুলকির দিকে। বিষণ্নতায় শামিমের চোখ মুখ ভরা।
অমিতা নিষ্পলক চেয়ে আছে ফুলকির বাঁধনো খাতার দিকে। সব মৃতেরা যেন তাকে সঙ্গ দিতে উঠে আসবে সেই খাতা থেকে।
‘মুসলমান হিন্দুর পূজা পার্বণে যোগ দেয়, সত্যনারায়ণের সিন্নি খায়, শুদ্ধিওয়ালারা বলতে শুরু কবলেন, ওই দ্যাখ ওরা তো আসলে হিন্দু, ওরা মুসলমান না। অতএব ওদের আবার হিন্দু সমাজে ফিরিয়ে আনলে মুসলমানদের আপত্তি করার কিছু থাকতে পারে না।’
ফুলকি : ওরা তোমাকে বলছিল, তুমি মোছম্মান। আমি তোমাকে ভালবেসেছি তাই আমি জাত খুইয়েছি। মুসলমান নয় শামিম, মোছম্মান। ভাবতে পারো?
শামিম তাকিয়ে আছে ফুলকির দিকে। শামিমের চোখে মুখে ক্রমশই একটা যন্ত্রণা ফুটে উঠছে।
অমিতা তাকিয়ে আছে ফুলকির খাতার দিকে। অমিতার মুখ দেখে মনে হচ্ছে ওর মনের শূন্যতা কাটছে আস্তে আস্তে। এবার কে আসবে? বাবা তুমি আসবে? না, এবারও তায়েবকাকা?
‘আমাদের শুদ্ধির দরকার ছিল না। দরকার ছিল ওই সব অশিক্ষিত মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা। ওদের অন্ধকার মনগুলোকে আলোকিত করে তোলা। ওরা যাতে আধুনিক হয়ে উঠতে পারে সেই ব্যবস্থা করা সুধাকর।
অমিতার চোখ মুখ ক্রমেই সজীব হয়ে উঠতে লাগল।
‘গোড়ায় গলদ তায়েব, গোড়ায় গলদ। তুমি করবে কি? আমাদের দরকার ছিল হিন্দু মনকেও আধুনিক জগতের দিকে ফেরানো। আমরা পারিনি।
‘আমরা শুধু রাজনীতি করেছি সুধাকর। বাংলার মুসলমানকে আমরা আধুনিক করতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি!’
ফুলকি : আমরা ভালবেসেছি শামিম।
‘অশিক্ষিত লোকদের কথা ছেড়েই দাও তায়েব, শিক্ষিত মনের অন্ধকারও কি আমরা ঘোচাতে পেরেছি?’
অমিতা হঠাৎ পাশ ফিরে দেখল। তার বাবা কি তার পাশে দাঁড়িয়েই কথা বলছেন?
শামিম হঠাৎ ফুলকির হাতখানা চেপে ধরল। এবার অমিতা আবার ওদের দেখতে পাচ্ছে। ওরা কথা বলছে। অমিতা এতক্ষণে আবার ওদের কথা শুনতে পাচ্ছে।
‘ফুলকি, আচ্ছা এমনও তো হতে পারে, তোমার বাবা আমাকে ও কথা বলেননি।’
ফুলকি শামিমের যন্ত্রণাটা মনের মধ্যে এবার অনুভব করতে পারল। ফুলকির মুখটা সমবেদনায় কোমল হয়ে এল।
‘ফুলকি, আমি ভাবছি, এখন কদিন তোমাদের বাড়িতে যাব না।
না শামিম না!
কে এ কথা এমন আর্তস্বরে বলল? ফুলকি না অমিতা? অমিতা নিজেই নিজের উত্তেজনা দেখে অবাক হয়ে গেল।
না শামিম না। ফুলকি বলে উঠল, তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে।
‘শুদ্ধি আন্দোলন কতজন মুসলমানকে হিন্দু করে ‘ঘরে ফিরিয়ে আনতে পেরেছে এবং ঘরের কোথায় তাদের ঠাঁই দিয়েছে সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু নিঃসন্দেহে এই আন্দোলন মুসলমানদের, বিশেষত যে সমস্ত মুসলমান ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে শুরু করেছিল তাদের, ভীত, ত্রস্ত এবং ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তাদের অধিকাংশই আধুনিক জগতের দিকে মুখ ফেরানো ছেড়ে দিয়ে কওমের স্বার্থে মোল্লাদের কবলে গিয়ে পড়তে লাগল। এবং ‘খাঁটি মুসলমান হতে শুরু করে দিল। জিন্নার মতো আধুনিক মানসিকতা সম্পন্ন মুসলমানের সংখ্যা আর বাড়ল না।’
ফুলকি শামিমের দিকে চেয়ে আছে।
অমিতা শামিমের দিকে চেয়ে আছে।
শামিম ইতস্তত করছে। যেন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
‘ধর্মীয় গোঁড়ামি বর্জিত কোনও মুসলমানের কথা মনে হলেই আমার সব চাইতে আগে মহম্মদ আলি জিন্নার কথা মনে পড়ে সুধাকর।’
শামিম অনেক ইতস্তত করে বলেছিল, ‘দ্যাখ ফুলকি নানা কারণেই, আমার মনে হয়, আমার এখন তোমাদের বাড়িতে না যাওয়াই উচিত।
ফুলকি উত্তর দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই অমিতার ঠোঁটের থেকে কথাটা ছিটকে গিয়ে ফুলকির ঠোঁটে আছড়ে পড়ল।
না শামিম, না। আমাদের বাড়িতে তুমি যাবে।
অমিতা উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল।
ফুলকি উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগল।
শামিম কি সিদ্ধান্ত নেবে ঠিক করতে পারছে না।
‘মহম্মদ আলি জিন্নার মধ্যেই আমি এক সেকুলার মুসলমানকে পাই সুধাকর। ১৯২৪ সালে যিনি স্যর তেজবাহাদুরকে বলেছিলেন, ‘হিন্দু মুসলমান সমস্যার, আমার মনে হয়, আমি একটা সমাধান বাতলাতে পারি। আপনারা আপনাদের গোঁড়া পুরোহিত শ্রেণীকে উচ্ছন্নে দিন, আমরাও আমাদের মোল্লাদের ধ্বংস করি—তাহলে সাম্প্রদায়িক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কথাটা হয়ত ঠাট্টাই ছিল, কিন্তু আবার অতটা ঠাট্টাও ছিল না।’
শামিম প্রায় নিরুপায় হয়েই যেন বলে উঠেছিল, ‘ফুলকি, তুমি আমার পজিশনটা ঠিক বুঝতে হয়ত পারছ না। আমি তোমার বাবার সামনে মাথা উঁচু করে হাজির হতে চাই।’
‘ভুল চাল ভুল চাল। আমাদের ইতিহাসটা দেখলে কি মনে হয় না সুধাকর, এটা ধারাবাহিক কতকগুলো ভুল চালের উপর দাঁড়িয়ে আছে?’
ফুলকি বলেছিল, তুমি আমার বাবার বাড়িতে যাবে শামিম।
অমিতা বলেছিল, তুমি আমার জন্য যাবে, বাবার জন্য নয় শামিম, আমারই জন্য যাবে তুমি।
অমিতা উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছে।
যুলকি উত্তেজনায় হাঁফাচ্ছে।
শামিম কোনও জবাব দিল না। দু হাত দিয়ে মাথাটা চেপে প্যারাগনের টেবিল কনুই ঠেকিয়ে বসে রইল।
‘এই সময় থেকে হিন্দু আর মুসলমান সমাজের মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে অবিশ্বাস ছিল, যে বিদ্বেষ যে ঘৃণা তা আর বশে রইল না। এই সময় থেকে মওলানা মৌলভীরা মুসলমানদের শরিয়তী আচার আচরণে ফেরাবার বিশেষ উৎসাহ উদ্যম প্রকাশ করতে লাগলেন। আর হিন্দুদের তখন প্রচার ছিল এই, হিন্দু-মুসলমানে এতদিন বেশ একটা মিল ছিল, এখন মৌলভি মওলানারা মুসলমানদেরকে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে সাম্প্রদায়িক কলহ বিবাদের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে।’
শামিম বলে উঠল, ‘আচ্ছা ফুলকি, তোমার বাবা কি আমাকে অবিশ্বাস করেন?’
ফুলকি বলে উঠল, তাতে কি আসে যায় শামিম?
অমিতা বলে উঠল, কি আসে যায়?
শামিম : আচ্ছা ফুলকি, তোমার বাবা কি আমাকে ঘৃণা করেন?
ফুলকি : তাতে কি এসে যায় শামিম?
অমিতা : কি এসে যায় শামিম?
শামিম : ‘আচ্ছা ফুলকি, আমার উপর কি তোমার বাবার, আমি মুসলমান বলে কোনও বিদ্বেষ আছে?’
ফুলকি : এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না শামিম।
অমিতা : কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তুমি এ কথা বুঝছ না কেন শামিম। অমিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্যারাগনের দিকে। ওইখানেই ওরা বসে আছে।
ফুলকি : তুমি এ কথাটা বুঝতে চাইছ না কেন শামিম। আমরা তো আমাদের অবিশ্বাস করিনে। আমরা তো আমাদের ঘৃণা করিনে। আমাদের উপর আমাদের বিদ্বেষ নেই। আমি আমার কথা বলছি শামিম। বাবা কি ভাবেন তা আমি জানিনে। আমি সেটা গ্রাহ্য করি নে। বাবা তোমাকে ভাল চোখে দেখতেন সেটা আমি জানি। বাবার ধারণা পালটেছে কি না, সে তুমি জানো। তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে, সেটা আমি জানি। এখনও তেমন ভালবাস কি না, সেটা শামিম, তুমি জানো।
ফুলকি এক দমে এতগুলো কথা বলে চুপ করে গেল। অমিতা তাকে দেখছে।
শামিম প্যারাগনের টেবিলে ঝুঁকে বসে আছে। তার দুহাতের মুঠিতে নিজের মাথার চুল গোছা করে ধরা।
অমিতা দেখছে।
ফুলকি এক রাশ উৎকণ্ঠা চোখে মুখে মাখিয়ে শামিমের দিকে চেয়ে আছে।
অমিতা দেখছে।
ফুলকি নরম, খুব নরম সুরে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি শামিম।
শামিম অসহায়ভাবে ফুলকির দিকে চেয়ে রইল।
হাঃ ভালবাসা! অমিতা বলে উঠল হঠাৎ। ভালবাসি। অমিতার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।
শামিম চেয়ে আছে ফুলকির দিকে। ফুলকির কথা শুনতে পেয়েছে কি না বোঝা গেল না।
অমিতার চোখে তখন একটা পুকুর। একটা বড়শি। বড়শিতে বেঁধা একটা মাছ। মাছটা বড়শি থেকে বেরিয়ে আসবার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে জলের মধ্যে তুমুল আন্দোলন তুলছে মাছটা। মাঝে মাঝে নিথর হয়ে পড়ছে। শামিম প্যারাগনের টেবিলে সামনে ঝুঁকে। ওর দুটো মুঠিতে চুলের গোছা চেপে ধরে আছে।
অমিতা দেখছে। তার ঠোঁটের হাসিটা ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। ধীরে ধীরে হাসিটা তলোয়ারের ফলার মতো চিকচিক করতে লাগল। অমিতা শামিমের দিকে সোজাসুজি চেয়ে নিঃশব্দে হাসতে থাকল।
তোমাকে ফুলকি ভালবাসে, শামিম। আমি জানি আমি জানি। অনেকক্ষণ ধরে যে-যন্ত্রণা ফুলকির বুকে ঘুরপাক খাচ্ছিল, অনেকক্ষণ ধরে যে বেদনা অমিতার বুকে ঘুরপাক খাচ্ছিল, বের হবার পথ পাচ্ছিল না। সেই দুঃসহ যন্ত্রণা এবার অমিতার চোখের কোণ দিয়ে বেরিয়ে যাবার পথ করে নিল।
আমি জানি শামিম, জানি, ফুলকি তোমাকে কত ভালবাসে! এ কথা আর কেউ জানে না।
১৬
বাবা তুমি শামিমের সঙ্গে বাহ্যত বরাবরই স্বাভাবিক আচরণ করে গিয়েছ। শামিমের ব্যাপার নিয়ে আমাদের পরিবারে যে ঘোঁট তখন পাকিয়েছিল, তার জন্য তুমি কোনদিনও কোনও কথা আমাকে বলনি। কোনদিন অভিযোগ করনি তুমি’। তুমি আমার অস্বস্তি উত্তরোত্তর সেই কারণে বাড়িয়েই তুলেছিলে। কি করে যে আমাদের আত্মীয়স্বজনকে সামাল দিয়েছিলে তুমি, সে তুমিই জানো। শামিম আমাদের বাড়িতে এসেছে তুমি তাকে গ্রহণ করেছো সেই আগেরই মতন। তুমি শামিমের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলে কি হবে বাবা, তোমার সামনে এলে শামিম যে অস্বস্তির মধ্যে পড়ত, তার থেকে তুমি শামিমকে রক্ষা করতে পারনি। এ তফাৎ কেন ঘটত? এই সময় তুমি তোমার কাজের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলে। প্র্যাকটিস নয়, তোমার প্র্যাকটিস তুমি ধীরে ধীরে ভ্যাবলকে দিয়ে দিচ্ছিলে। কিন্তু তোমার অন্য কাজ, বিশেষ করে আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলার ঝামেলায় তুমি জেরবার হয়ে পড়ছিলে। তুমি বলেছিলে, ‘শরৎবাবুর শরীর ভাল নয়, ও লোকটাকে একটু রিলিফ দেওয়া দরকার।’ এই সময় তুমি শরৎবাবুর বাড়িতে ঘন ঘন যেতে শুরু করেছিলে। তোমার নিজের স্বাস্থ্যও দ্রুত ভেঙে পড়েছিল বাবা। তুমি আমার কাজটা কঠিন করে তুলছিলে। আমি আর শামিম ঠিক করে ফেলেছিলাম, আমরা যত শীঘ্র পারি বিয়ের কাজটা সেরে নেব। আমাদের যে হিসেব ছিল, তাতে তুমি এ বিয়েতে বাধা দিতে। আমি দিদির মতোই তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম আমার ঘর বাঁধতে। দিদি যখন চলে যায়, তোমার স্বাস্থ্য তখন খারাপ হয়নি বাবা। আমি তো ঠিক করে ফেলেছিলামই, আর পেন্ডুলামের মতো দুলব না। সে বড় কষ্ট বাবা। তোমাকে ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়াটাও আমার পক্ষে মর্মান্তিক ছিল। কিন্তু কি করব? আমি শামিমকে ছেড়ে তো বাঁচতে পারতাম না।
সেই শামিমও আজকাল এ বাড়িতে আসা কেমন কমিয়ে দিয়েছে। তুমি কি লক্ষ করেছিলে সেটা? শামিম বলে, ওর খুব কাজ। ও যে মিথ্যে বলে না, তা বুঝতে পারি। কিন্তু সে এড়িয়ে যাচ্ছে, এটাও বুঝতে পারি। শামিম তোমার সামনে মাথা উঁচু করে এসে দাঁড়াবে, তারপর আমার সঙ্গে ওর বিয়ের প্রস্তাব করবে, এই হয়ে উঠেছিল ওর ইদানীংকার বাতিক। শামিম তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের আসামীদের মুক্ত করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলতে ওর সমস্ত শক্তিঢেলে দিয়েছিল। এ ব্যাপারে শামিমের. শুধু একটাই খচখচানি ছিল। তুমি আর শরৎবাবু দুজনেই এই আন্দোলনে কম্যুনিস্টদের সঙ্গে নেবার বিপক্ষে ছিলে। তোমাদের কথা ছিল, কম্যুনিস্টরা এই আন্দোলনের ক্ষতি করবে। শামিম তোমাদের এই কথা শোনেনি। শামিম বলত, কম্যুনিস্টদের মধ্যে আমি যে সিনসিয়ারিটি দেখেছি ফুলকি, সেটা অন্যদের মধ্যে নেই।’ শামিম স্বপ্ন দেখত বাবা, এই আন্দোলন সফল করে সে তোমার কাছে মাথা উঁচু করে আসবে। তখনও আমি কম্যুনিস্ট চিনিনি। তাই শামিমের কথাতেই আমি বিশ্বাস করতাম। রাজনীতিতে আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। শামিম রাজনীতি করে বলেই রাজনীতিতে আমার ইন্টারেস্ট দেখা দেয়।
ইতিমধ্যে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আমাকে আরও মুশকিলে ফেলে দিয়েছিলে। ডাঃ অমল রায়চৌধুরি এসে তোমাকে বেড রেস্ট দিয়ে গেলেন আমাকে বলে গেলেন, ‘ফুলকি, তোর বাবার শরীরটা খারাপ। বড্ড শ্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিছুদিন ঠিকঠাক রেস্ট নিলেই ভাল হয়ে উঠবে। তিন দিন বিছানা থেকে একেবারে নামতে দিবিনে। নার্স একজনকে পাঠিয়ে দেব। সে দেখাশুনা করবে। তুই একেবারে কাছ ছাড়া হবিনে। নার্স এসেছিল ঠিক। কিন্তু কি করতে হবে, আমি তার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম বাবা। আমি নার্সকে তোমার সেবা বিশেষ করতে দিইনি। সব নিজেই করতাম। এমনি করে কি বিরোধের সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। তখন তোমার আমার বিরোধ দরকার ছিল বাবা। খুবই জরুরি ছিল। রাতে তোমার পাশেই শুতাম। তুমি আমার মাথাটা তোমার বুকের মধ্যে টেনে নিতে মাঝে মাঝে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। কখনও কথা বলতে। কখনও চুপ করে শুধু আমাকে আদরই করে যেতে আদরই করে যেতে। আহ্ আদর! বাবা! বাবা!
আবার তুমি সব গুলিয়ে দিলে। আমার খেলার ঘুঁটি কাঁচিয়ে দিলে। হ্যাঁ বাবা, আমার খেলার খুঁটি কাঁচিয়ে দিলে বাবা। আমাকে আবার পেন্ডুলামে ঝুলিয়ে দিলে। আবার আমার সেই দোটানা। আমার জীবনের দুই প্রধান পুরুষ, তুমি আর শামিম। একবার তোমার দিকে যাই, একবার শামিমের দিকে। তোমার অসুখের মধ্যে শামিম এসেছিল বাবা। তোমার মনে নেই? সে এসেছে খবর পেয়ে আমি নিচে চলে গেলাম। তুমি বললে, ‘ওকে নিয়ে আয়।’ শামিম এসে তোমার পাশের চেয়ারে বসতে যাচ্ছিল, তার আগেই তুমি তাকে বুকে টেনে নিলে। তারপর ঠাট্টা করে বলেছিলে, ‘তারপর কমরেড, খবর কি?’ আমাকে বললে, ‘ফুলকি, ভাল করে চেয়ে দ্যাখ তো, আমার যেন মনে হচ্ছে, শামিম বেশ রোগা হয়ে গিয়েছে।’ আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, বাবার মুখে ছেলের সম্পর্কে, অনেকদিন পরে তাকে দেখলে, যেমন উদ্বেগ প্রকাশ পায়, তোমার মুখে সেই রকম ‘উদ্বেগই যেন প্রকাশ পেয়েছিল। আমার ভুলও হতে পারে বাবা। আমি যা বলছি তা কি ঠিক? আমি দিদির মতো কেন তোমাকে বুঝতে পারিনে বাবা? তুমি পরক্ষণেই বললে, ‘শামিম কত কাজ করে এসেছে। বাতাসিয়াকে বল, ওর জন্য কিছু খাবার করে আনুক।’ যে যাই বলুক বাবা, আমি জানি, এটা তোমার অভিনয় ছিল না, এটা ছিল তোমার অন্তরের কথা।
তোমরা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছিলে দুজনে। আমি চুপ করে বসে বসে শুনছিলাম। আর শামিমকে লক্ষ্য করছিলাম খালি। শামিম যেন তোমার কাছে এসে নতুন জন্ম পেয়েছে। প্রথমে কত আড়ষ্ট ছিল শামিম! মেপে মেপে কথা বলছিল। তারপর শামিম ক্রমশ সহজ হয়ে উঠল তোমার ব্যবহারে। হ্যাঁ বাবা, তোমার আন্তরিক ব্যবহারে। তোমার কারণে বেচারি মনে মনে কি ভোগান্তিই না ভুগছে। শামিমের জন্য খাবার এনে দেখি বাবা, তুমি আর শামিম আবার সহজ সম্পর্কে ফিরে এসেছ। আমি সেদিন মনে প্রাণে প্রার্থনা করেছিলাম, তোমাদের এই সম্পর্ক যেন কোনদিন না ভাঙে। তোমাদের কথাবার্তায় আমি সেদিন বাধা দিচ্ছিলাম বাবা বার বারে। শেষে এক সময় তুমি বলে উঠলে, ‘তুই এক কাজ কর, তুই একটু তোর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে নে। আমি আর শামিম ততক্ষণ কিছু কথা বলে নিই। এমন টিক টিক করলে কথা বলা যায়?’ আমি বলেছিলাম বাবা, অমলকাকাই তোমাকে বেশি কথা বলতে বারণ করে গিয়েছেন। আর আমাকে বলে গিয়েছেন খবরদারি করতে। আমি কি সেদিন একটু বাচাল হয়ে পড়েছিলাম? তোমাকে আর শামিমকে সহজ হতে দেখে আমার খুশি যে আর ধরছিল না, সে তো আমার চেহারাই বলে দিচ্ছিল। আমি সেদিন যেন মাটিতে পা দিয়ে হাঁটছিলাম না। একটা হাল্কা পালক যেমন আকাশে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায় তেমনি আমার অবস্থা হয়েছিল। আমি চাইছিলাম তোমাদের কথাবার্তা চলুক। কিন্তু তুমি কথা বল না। তুমি শ্রোতা হয়ে থাকো। তুমি বললে, ‘কি বলে গেল অমল, কবে আমাকে এই বন্ধনদশা থেকে ছাড়বে।’ আমি বলেছিলুম, দুচার দিনের মধ্যেই তোমাকে নিচে যেতে দেবেন বলেছেন। তবে দেখবি, ততদিন তোর বাবা যেন আবার শোবার ঘরটাকে না বৈঠকখানা করে তোলে। অনেকদিন পরে তুমি প্রাণ ধুলে হেসেছিলে বাবা। তারপর এক সময় শামিমকে নিয়ে নিচে চলে এলাম। তোমারই বৈঠকখানায় এসে বসেছিলাম দুজনে। আমাদের সব বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল সেদিন। কত স্বপ্ন দেখলাম, আমরা দুজনে। বিয়ের কথা উঠল। শামিম এখন বেশ সাহস করে কথা বলছিল। তার মনে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিল। শামিম কি করবে যেন ঠিক করতে পারছিল না। একবার ঘুরে ঘুরে তোমার আলমারি ভরা বইগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তে লাগল। একবার হঠাৎ বলল, ‘ফুলকি আমি তাহলে আইনের রাস্তাতেই যাই কি বল? তাহলে অন্তত বইগুলোকে কাজে লাগানো যাবে। ‘আমি বলেছিলাম গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। শামিম জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তার মানে? আমি বলেছিলাম, নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। লোভ ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে দেখছি। শামিম বাবার চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, ‘না ফুলকি, বইয়ে আমার লোভ নেই। তোমার বাবার একটা সম্পত্তিতেই আমার লোভ। সে তুমি।’ আমি আমার বাবার সম্পত্তি। ছপাৎ করে আমার গায়ে যেন চাবুক পড়ল। তুমি তাহলে আমাকে সম্পত্তি হিসাবেই গণ্য কর, শামিম? শামিম নিশ্চয়ই এটাকে ঠাট্টা বলে ধরে নিয়েছিল। তাই বুঝি শামিম, আমার প্রতি তোমার এত লোভ? আমি কথাটা এত গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাইনি সেদিন। ও কথাটাও আমার নয়। কথাটা যেন আমার মুখ দিয়ে দিদিই বলিয়ে নিল। ওটা তো দিদির কথা! সত্যিই কি তাই অমিতা, ওটা কেবল দিদির কথা, তোমার কথা নয়? তুমি কি স্থির নিশ্চিত সে ব্যাপারে?
অমিতা তার ঘরে একা, এখন একা।
অমিতা : সম্পত্তি! আমি শুধু সম্পত্তি! সত্তা নই সম্পত্তি। এখন তো একেবারেই অস্থাবর।
শামিম ফুলকির বাবার চেয়ারে বসে। তর চোখে মুখে স্বপ্ন।
শামিম : তোমাকে চাই আমি তোমাকে চাই, তোমাকে ছাড়া নেই শান্তি নেই।
অমিতা তার ঘরে একা, একেবারে একা।
অমিতা : আমি আমার বাবার সম্পত্তি!
শামিম ফুলকির বাবার ঘরে। চেয়ারে বসে। মুখে সিগারেট। চোখে স্বপ্ন।
শামিম, তোমাকে ছাড়া আমার গতিও নেই ফুলকি।
অমিতা তার ঘরে একা, একেবারে একা।
অমিতা : বাবার চেয়ার—বাবার সম্পাত্ত। বাবার টেবিলটা—বাবার সম্পত্তি।
শামিম ফুলকির বাবার চেয়ারে। তার চোখে স্বপ্ন। সিগারেটের ধোঁয়াটা রিং করে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠে গেল।
শামিম : আমরা বিয়ে করব ফুলকি।
অমিতা তার ঘরে একা, একেবারে একা।
অমিতা : বাবার বই—বাবার সম্পত্তি। বাবার আসবাব –বাবার সম্পত্তি।
শামিম ফুলকির বাবার বসবার ঘরে। আরেকটা রিং শামিমের মুখ থেকে গোল গোল হয়ে পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠে গেল।
শামিম : তোমার বাবাকে বলব, আমি বলব, আমি ফুলকিকে চাই কাকাবাবু। আর কিচ্ছু নয়।
অমিতা তার ঘরে একা, একেবারে একা।
অমিতা : অনূঢ়া কন্যা বাবার সম্পত্তি…
আর একটা বড় রিং অমিতার মুখের উপর দিয়েই যেন উপরে উঠে গেল। অমিতা ঢাকা পড়ে গেল যেন। কিন্তু অমিতার গলা শোনা গেল।
অমিতা : বিবাহ হলে কন্যা স্বামীর সম্পত্তি…
শামিম ফুলকির বাবার চেয়ারে। শামিম স্বপ্ন দেখছে। শামিমের চোখে মুখে তৃপ্তি।
শামিম : বলব, কাকাবাবু আমি ফুলকিকে বিয়ে করতে চাই।
ফুলকি এতক্ষণ ফুসছিল। সে বুঝতে পারছিল না, তার এখন কি বলা উচিত। সে একমনে এতক্ষণ শামিমকে লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। ওর কথা কান পেতে শুনছিল।
ফুলকি ওর বাবার বসবার ঘরে। শামিমের সামনের চেয়ারে বসে আছে। সে এতক্ষণ বসেছিল নিশ্চল।
না শামিম না।
অমিতা তার ঘরে একা। অমিতা দেখল তার বাবার ঘরে যে চেয়ারে বসেছিল ফুলকি সেটা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।
না শামিম, না।
শামিমের মুখ থেকে যে ধোঁয়টা বের হল তাতে কোনও মতে একটা রিং হল বটে, কিন্তু সেটা আঁকাবাঁকা হয়ে খানিকটা উঠেই ছেতরে যেতে শুরু করল। শামিমের স্বপ্নটা অকস্মাৎ চোট খেল। সে ফুলকির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ফুলকির তীক্ষ্ণ স্বরটা তাকে বিচলিত করে তুলেছিল। ফুলকি বলেছিল, আমাকে বিয়ে করার জন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে তোমাকে কারও কাছে যেতে হবে না শামিম। দোহাই। শামিম কি বলেছে? সে কিছু বুঝতে পারল না। ফুলকির রাগটা তার বুকে দুম করে ঘা দিল। অমিতা দেখছে। শামিম ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ফুলকি ফুলকি, কি হয়েছে?’ অমিতা দেখছে। ফুলকি প্রাণপণে উত্তেজনা দমনের চেষ্টা করছিল। অমিতা দেখছে। ফুলকি চেয়ারটা ঠেলে সরিয়ে বইয়ের আলমারির পাশে গিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়াল। অমিতা দেখছে। শামিম মুখের সিগারেটটা তক্ষুণি অ্যাশ্ ট্রেতে গুজড়ে দিল। অমিতা দেখছে। শামিম চেয়ারে টান টান হয়ে বসল। অমিতা দেখছে। উঠবে কি উঠবে না, খানিকক্ষণ ইতস্তত করল শামিম। অমিতা দেখছে। আস্তে করে ফুলকিকে ডাকল শামিম। ফুলকি সাড়া দিল না। অমিতা দেখছে। শামিমের মুখ বিপন্ন। অমিতা দেখছে। শামিম চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। ফুলকির দিকে এগিয়ে যাবে কি যাবে না, ইতস্তত করতে থাকল শামিম। অমিতা দেখছে। শামিম বিপন্ন কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ফুলকি, আমি কি তোমার মনে কোনও আঘাত দিয়েছি?’ ফুলকি ফিরে চাইল না। জবাব দিল না। অমিতা দেখছে। শামিম মনে জোর আনল। সটান চলে গেল ফুলকির কাছে। শামিম অমিতার কাঁধে হাত রেখেছিল। অমিতা দেখছে। তুমি শামিম, আবারও জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ফুলকি, কি হয়েছে? বলবে? আমি কিছু করেছি?’ তোমার সেই মুহূর্তে যন্ত্রণার শরিক হতে চেয়েছিল অমিতা। কিন্তু তুমি ফুলকির আঁতে ঘা দিয়েছিলে। আচ্ছা, পুরুষ বলেই কি তোমাদের সূক্ষ্মবোধ থাকতে নেই শামিম? মেয়েরা যতক্ষণ না মুখ ফুটে বলছে, ততক্ষণ কিসে যে তারা আহত হচ্ছে, সেটা কি তোমরা কিছুতেই বুঝবে না? সব কথাই বা মেয়েদের মুখে বলতে হবে কেন? তুমি, তায়েবকাকা, মনসুর তোমরা বল, মুসলমানের কত গভীর বেদনার কথা বলার ছিল, কিন্তু শোনবার কান ছিল না। কান শুধু নয়, মনও শামিম। কথাটা সত্যি তো। এমন বেদনার কথা শূদ্রেরা, অচ্ছুৎ অস্পৃশ্যেরা যুগ যুগ ধরেই তো শোনাতে চেয়েছে। তারাও তো শোনবার কান, বা বুঝবার মন পায়নি। তেমনি তোমাদের কখনও মনে হয় না শামিম, কখনও মনে হয়নি যে, আরও একটা সম্প্রদায় আছে তোমাদেরই কাছে, একেবারে কাছে, সেই তাদেরও বেদনার কথা আছে। তারাও শোনাতে চায় তাদের বেদনার কথা। হাজার হাজার বছর ধরে তারা চেষ্টা করে আসছে তাদের কথা শোনাবার। তারাও তো শোনবার কান আর বোঝবার মন খুঁজে হন্যে হয়ে গিয়েছে। পায়নি না? তাদের কথা তারা কাউকে কোনও দিন শোনাতে পারেনি। এরা হচ্ছে নারী। নারীকে সম্প্রদায় বলবে কিনা এ নিয়ে তর্ক উঠতে পারে শামিম। কিন্তু এরা যে স্বতন্ত্র একটা জগতের বাসিন্দা সেটা কি করেই বা বোঝাই তোমাদের। জগৎ তো আসলে দু ভাগে বিভক্ত। একটা পুরুষের জগৎ আর একটা মেয়েদের জগৎ। এইটেই আসল ভাগ শামিম। নারীর জগৎ বঞ্চিতদের জগৎ। সে নারী হিন্দুই হোক, মুসলমানই হোক, খ্রিস্টিয়ান হোক কি যেই হোক। নারী মানেই বঞ্চিত। হিন্দু নারী হিন্দুপুরুষ জগতের বঞ্চনার শিকার, মুসলমান নারী মুসলমান পুরুষ জগতের বঞ্চনার শিকার, খ্রিস্টিয়ান নারী খ্রিস্টিয়ান পুরুষ জগতের বঞ্চনার শিকার, অস্পৃশ্য নারী অস্পৃশ্য পুরুষ জগতের বঞ্চনার শিকার। সব চাইতে বড় বঞ্চনা নারীদের মাথা তুলে দাঁড়াবার অধিকার হরণ। পুরুষের রচিত সমস্ত শাস্ত্র নারীর এই অধিকার হরণ করেছে শামিম। মেরুদণ্ড খাড়া করে মানুষ মাত্রেই দাঁড়াতে চায়। নারীরাও মেরুদণ্ডী প্রাণী, এ কথা নারীরা জানেই না। এই বঞ্চনার কোনও নজির নেই। নারীরা যে পুরুষের মতোই একটা অস্তিত্ব, সেটা যেমন পুরুষেরা ভুলে গিয়েছে, তেমনি নারীরাও ভুলে গিয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়ানো যে মানুষের মৌলিক অধিকার, মেয়েরা মানুষ হলেও, সেটা যেন তাদের সম্পর্কে খাটে না। তোমাদের আচার আচরণ দেখে তাই মনে হয় শামিম।
তুমি ফুলকির কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিল শামিম, ‘আমি কি এমন বলেছি ফুলকি যে…’
ফুলকি নরম সুরে বলেছিল, না শামিম, তুমি এমন কোনও আলাদা কথা বলনি, তুমি যা বলেছ তেমন কথাই তো সবাই বলে থাকে।
শামিমকে তবুও যথেষ্ট বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। সে সত্যিই বুঝতে পারছিল না, তার অন্যায় কোথায় হয়েছে?
ফুলকি বলেছিল, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যাপারে কারও কাছে তোমাকে ভিক্ষা চাইতে হবে না। এটা অনুগ্রহ করে মনে রেখো। আমাদের বিয়ে আমরাই করব। কারণ আমরাই তো ভালবেসেছি। কিছু মনে করো না, তোমার কি এমন সাহস হবে?
শামিম বলেছিল, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি ফুলকি। তুমি যা চাইবে তাই হবে।’
অমিতা সারাক্ষণ যেটাকে টেলিস্কোপ বলে মনে করেছিল, সেটা আদতে যে একটা অপেরা গ্লাস, সেটা এখন বুঝল। অপেরা গ্লাস চোখে লাগিয়ে বিলাতে সাহেব মেমেরা থিয়েটার দেখে। ‘আমি তোমাকে ভালবাসি ফুলকি।’ এক্ষুনি যেন একটা মিলনান্তক নাটক শেষ হবে। অমিতা প্রতীক্ষা করে বসে রইল ড্রপ সিন পড়ার অপেক্ষায়। ফুলকির পার্ট বেশ বড় ছিল। বাছা বাছা সংলাপ ছিল তাতে। যেমন, শামিম, আমি নারী। সেটাই আমার আইডেন্টিটি, সেটাই আমার পরিচয়। আমার একটা ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে। এ সবই বলতে চেয়েছিল ফুলকি। হয়ত। কিন্তু ততক্ষণে শামিমের হাত দুটো থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে ফুলকির কাঁধ থেকে গলায়, গলা থেকে ঘাড়ের পিছনে, সেখান থেকে সামনের দিকে পরিক্রমা শুরু করল, করতল এগিয়ে গিয়ে ফুলকির চিবুকের কাছে এসে থামল। অমিত দেখছে। ফুলকি বলতে চেষ্টা করল, শামিম, আমাকে যদি গ্রহণ কর তবে আমার মূল্যেই গ্রহণ করো। কিন্তু ফুলকি কথা বলেনি। শামিমের হাত দুটো ফুলকির চিবুকের নিচে এসে তখন থেমেছিল। ধীরে ধীরে সেই করতল দুটো জুড়ে গিয়ে অঞ্জলি হয়ে উঠল। অমিতা দেখছে। সেই করপুট ফুলকির চিবুক থেকে কণ্ঠা পর্যন্ত নামতে লাগল। ধীরে অতি ধীরে। কণ্ঠার কাছে এসে থামল। ফুলকি বলতে চাইল, আমি নারী শামিম, সম্পত্তি নই। একটা সত্তা। বলতে পারল না। শামিমের করপুট ফুলকির কণ্ঠ বেয়ে ততক্ষণে উপরে উঠতে শুরু করেছে। ফুলকি ভেসে যেতে লাগল। অমিত দেখছে। শামিমের করপুট উঠছে উঠছে। চিবুক থেকে ওষ্ঠ, ওষ্ঠ থেকে নাসিকায় অমিতা দেখছে নাসিকা থেকে কপোলে, কপোল থেকে ললাটে, অমিতা দেখছে। ফুলকি ঘুরে দাঁড়াল দ্রুত। যেন কত অসহায়। আমি তোমায় ভালবাসি শামিম। অমিতা দেখছে। ফুলকি কাঁপছে। আমি তোমায় ভালবাসি শামিম। আহ্ ভালবাসা! অমিতা মন্তব্য করল এতক্ষণে। সে দর্শকের আসনে বসেছিল। আহ্ ভালবাসা! দর্শনের অধ্যাপক বিকেডি সেদিন পড়াতে এসে অমিতাকে দেখে খুব এন্ধু পেয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘লভ্ ইজ্ দি নোবলেস্ট সেন্টিমেন্ট। ভালবাসা এক মহত্তম অনুভূতি। প্রতাপ সঙ্গে সঙ্গে পিছনের বেঞ্চি থেকে ফোড়ন কেটেছিল, ‘হর্স ইজ এ নোব্ল এনিম্যাল। অশ্ব হয় এক মহৎ প্রাণী।’ ফুলকিকে যেন একটা প্রবল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে প্রাণপণে শামিমকে ধরে সেই স্রোতকে ঠেকাতে চাইছে। নিরঞ্জন দিদির মৃত্যুর পর একদিন বলেছিল, ‘সেই একটা গান আছে না ফুলকি, তোমার দিদি যেটা প্রায়ই গাইত, ভালবাস। এল জীবনে, তাই তারে ভালবাসি রে। কেমন একটা লজিক লজিক ভাব, না? তাই তারে ভালবাসি রে। কে বলে ভালবাসায় লজিক নেই।’ অমিতা বলল, হ্যাঁ, তাই তারে ভালবাসিরে। ভালবাসা যদি কিছুই নয়, ভালবাসাতে যদি কিছুই না থাকবে তবে ওই দুটো প্রাণী প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে কেন? আর কেনই বা সেই টাকিন অমিতা অনুভব করছে তার অন্তরে?
১৭
উদয়ের পথে। অমিতা ফুলকির খাড়াখানা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল। উদয়ের পথে। নিউ থিয়েটার্সের নতুন ছবি, বিমল রায়ের তোলা। দিদির কি উৎসাহই না ছিল। তখন দিন কতক দিদি নিউ থিয়েটার্সের স্টুডিওতে যাতায়াত করেছিল। বিনয়দা দিদির বন্ধু ছিলেন। নিউ থিয়েটার্সের চিত্রনাট্য লিখতেন। সেই বিনয়দার সঙ্গে দিদি কয়েকবার গিয়েছিল সেখানে। ছবিটা রিলিজ করলে ওরা দল বেঁধে দেখতে গিয়েছিল চিত্রায়। ছবিটা দেখবামাত্রই ফুলকি রাধামোহনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। দিদি যেমন এক সময়ে সুভাষচন্দ্র বসুর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল গভীরভাবে। সেই যুদ্ধের সময়ে। বাড়ি থেকে পালিয়ে একেবারে বার্লিনে চলে গিয়েছিলেন সুভাষ। যেদিন রেডিওতে ওঁর কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল প্রথম, সেইদিনই দিদি কোথা থেকে সুভাষের একখানা সুন্দর ফটো এনে তার ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে দিয়েছিল। আর রোজ সেই ছবিতে মালা পরাত। দিদির সেদিনের উত্তেজনার কোনও পরিমাণ ছিল না যেন। দিনরাত ঘুরছে ফিরছে দিদি, আর একটার পর একটা মীরার ভজন গেয়ে চলেছে। দিদি এত থাকতে মীরাকেই কেন বেছে নিয়েছিল, আজ অমিতার সে কথা মনে পড়লে অবাকই লাগে। ‘আয়ো পিতম সুন্দর নিরুপম অন্তর হোতা উদাসী… দিদির মুখে মীরার এই আর্তিটা এখনও কানে বাজে অমিতার। দিদির ফার্স্ট লাভ যেমন সুভাষচন্দ্র, ফুলকিরও ফার্স্টলাভ তেমন রাধামোহনদা। রেডিওতে ফুলকি আর রাধামোহনদা যে কতদিন একসঙ্গে নাটক করেছে, আবৃত্তি করেছে এককালে! মস্কোতেও দেখা হয়েছিল। রাধামোহনদার সঙ্গে। কিন্তু তখন কেমন মিইয়ে গিয়েছিলেন বলে মনে হয়েছিল। বলেছিলেন; ‘এখানে শরীর মন ভাল থাকছে না ফুলকি। কলকাতা ছাড়া আমার গতি নেই।’ একবার রবীন্দ্রসদনে কি একটা প্রোগ্রাম ছিল, এখন মনে নেই অমিতার, রাধামোহনদা এসেছিলেন, আর হেমন্ত, বলে উঠেছিল, ‘জানো তো আমরা সেধে সেধেও ফুলকির মন পাইনে, আরে পাব কি করে, মনটা যে ফুলকি তোমাকেই দিয়ে রেখেছে, তা কি জানি! রাধামোহনদা সটান অমিতার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘অমিতা এ কি সত্যি!’ এক ঝলক রক্ত সেদিন অমিতার মুখে উঠে এসেছিল। সামলে নিয়ে অমিতা বলেছিল, সে কি আজকের কথা রাধামোহনদা, সেই আপনাকে উদয়ের পথেতে যখন প্রথম দেখি, সেই তখন থেকে। ‘এমন একটা কথা এতদিন চেপে রেখেছে অমিতা তুমি মানুষ খুন করতে পার।’
‘উদয়ের পথে’ এতখানি সাফল্য পেল কি করে? ফুলকি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে যেটুকু টুকে রেখেছিল, অমিতা পড়তে শুরু করল সেটা। ‘এ প্রশ্নের জবাব ছোট একটা কথায় দেওয়া সম্ভব নয়। ছবি ওতরায় বিশেষ একটি কারণের দরুন নয়, নানা কারণের অঙ্গাঙ্গী সাহচর্যে। অভিনয় হয়েছে অসাধারণ, বিশেষ করে রাধামোহন, দেবী, বিনতা ও বিশ্বনাথের অভিনয়। কিংবা আর একটু সাবধানে কথাটা বলতে হলে বলব আশ্চর্য অভিনয় করেছেন দেবী মুখোপাধ্যায়, বিনতা বসু ও বিশ্বনাথ ভাদুড়ি। আবার রাধামোহন যেন অভিনয়ই করেননি। এত সহজ, এত স্বাভাবিক, এত সজীব তাঁর চলাফেরা, কথা কওয়া, এমন কি হাসিটুকু পর্যন্ত, বসে থাকাটুকু পর্যন্ত।’
রাধামোহনদা তাঁর টনটনে গলায় গালিব থেকে আবৃত্তি করলেন, ‘সপ্তী-কশান-এ ই-কী পুছে হৈ কেয়া খবর, বোহ্ লোগ রক্তহ্ রক্তহ্ সরাপা অলম হুয়ে। তোমাকে দেখে মনে হয় অমিতা, আমার মনের কথা একমাত্র গালিবই প্রকাশ করতে পারেন। তিনি বলেছেন, প্রেমের কৃচ্ছ্রসাধকদের খবর আর কি শুনবে, তারা ক্রমশ আপাদমস্তক দুঃখের মূর্তি হয়ে গেল। বোহ্ লোগ রক্তহ্ রক্তহ্ সরাপা অলম হুয়ে।’ কী রকম টনটনে গলা ছিল রাধামোহনদার। উরদু শুনলে মনে হত যেন রবাব বাজছে।
সবাই হো হো করে হেসে উঠেছিলেন সেদিন। কিন্তু রাধামোহনদা খুব সিরিয়াস মুখ করে বলে উঠেছিলেন, ‘প্রেমের ব্যাপার এত সহজে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অমিতা তুমি যদি তখন আমাকে কথাটা আকারে ইঙ্গিতেও পৌঁছে দিতে, তাহলে আমাকে খামখা এতগুলো বছর একা একা পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসে থাকতে হত না। কোনও একটা ফাল্গুনে আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা হয়ে যেতে পারত।’ যেতেই পারত। যেতেও তো পারত। কে জানে? ‘আয়ো প্রীতম সুন্দর নিরুপম অন্তর হোতা উদাসী।’
রাধামোহনদার জন্য অমিতার অন্তর এখন উদাস হয়ে উঠেছে। যেমন দিদির অন্তর একদিন উদাস হয়েছিল সুভাষচন্দ্রের জন্য, যেমন মীরার অন্তর একদিন উদাস হয়েছিল তাঁর প্রীতম রণছোড়জির জন্য। প্রেমের জন্য ঘর ছেড়েছিলেন, মীরা একজন বিবাহিতা নারী, নিজের স্বামীকে ছেড়েছিলেন, ‘লাজ আপমানকো দোধারে পটকে’ মীরা পথে বেরিয়ে পড়েছিলেন তাঁর প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের জন্যে। রাধামোহনদার প্রতি অমিতার যে ভালবাসা, এর কখনও ক্ষয় হয় না। সুভাষের প্রতি দিদির সেদিনের যে ভালবাসা তারও কখনও ক্ষয় হবে না। দিদি সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করেনি। শুধু দিদি কেন, কোনও বাঙালিও সেদিন বোধ হয় এ কথা বিশ্বাস করেনি। অমিতা সেবারই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল। ওর মনে আছে, দিদি আনন্দবাজার পত্রিকা এনে বলেছিল, ‘এই দেখ ফুলকি আনন্দবাজারও এই খবর বিশ্বাস করেনি। এই দেখ ওরা কি লিখেছে। লিখেছে, আমরা শোক-লিখন লিখিব না। এই দেখ, এই শোন, রয়টার পরকীয় সংবাদের উপর নির্ভর করিয়া সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা করিয়াছেন। আমরা শোক-লিখন লিখিব না। সুভাষচন্দ্র দীর্ঘজীবী হউন। দিদির চোখে জল কিন্তু মুখে স্বস্তি। কিন্তু কেলেঙ্কারি করেছিল বিজনদা। অমিতার বড় পিসির ছেলে। দিদির চেয়ে বছর দুয়েকের বড়। বিজনদা কমিউনিস্ট ছিল। সে একদিন আমাদের বাড়িতে এসে বলল, ঝুমরি, তুই তো এবার বিধবা হলি। তোর সুভাষ তো ফট্। বলেই দিদিকে ‘পিপল্স ওয়ার’-এর পাতাটা দেখতে দিল। বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে তাতে ছাপা হয়েছে, ‘ইন্ডিয়ান কুইসলিং ডেড্। দিদি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। `ওর ফরসা টকটকে মুখ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছিল। অনেকক্ষণ লেগেছিল দিদির সামলে উঠতে। তারপর দিদি বিজনদাকে ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল, ‘তোমরা দেশদ্রোহী জাতিদ্রোহী। তোমাদের মুখ দেখতে লজ্জা করে না।’ বিজনদা চলে গেলে দিদি সুভাষচন্দ্রের ফটোতে একটা নতুন মালা ঝুলিয়ে দিতে দিতে বলেছিল, ‘এ সব লোকের মৃত্যু হয় না ফুলকি। এরা অমর।’ তারপর বলেছিল, দেখিস ফুলকি, বিজনদা আজ যে থুথু নেতাজির মুখে ছুঁড়ছে, সেটা ওরাই একদিন চেটে তুলে নেবে।’ অনেক অনেক দিন পরে দিদির কথাটা অমিতার মনে পড়েছিল, যেদিন সে কাগজে ছবি দেখেছিল, মার্কসিস্ট মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ময়দানে মই বেয়ে উঠে নেতাজির গলায় মালা পরিয়ে দিচ্ছেন।
দেশবন্ধুর মতো সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে, ভারতে যারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের মন থেকে আশঙ্কা ভয় এই সব দূর করার দায়িত্ব সংখ্যাগুরু হিন্দুদেরই নিতে হবে। বিজনদা সুভাষচন্দ্রকে বলত কুইসলিং। বিজনদারা ছিল কমিউনিস্ট। কুইলিং কথাটার মানে ফুলকি ভাল জানত না। শুধু এইটুকু জানত যে কথাটার মানে ‘ঘরশত্রুবিভীষণ’। দিদি কমিউনিস্টদের দু’চক্ষে দেখতে পারত না। কিন্তু অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে, অমিতাকে পরবর্তী জীবনে কমিউনিস্টের ঘরই করতে হয়েছে। ভালবাসার উপরে তো কাহারও হাত নাই! কার মুখে অমিতা যে কথাটা শুনেছে, অমিতা সেটা মনে করতে পারল না। সুভাষ কারও চোখে কুইলিং আবার কারও চোখে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক। আজাদ হিন্দ ফৌজের স্পিরিট হিন্দু মুসলিম ঐক্যের স্পিরিট। শামিম সে কথা বিশ্বাস করত সে সময়। শামিমকে ভালবাসত ফুলকি। ‘ভালবাসার উপরে তো কাহারও হাত নাই।’ কথাটার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে না? অমিতার মনে হল। কথাটা সে কার মুখে শুনেছে? মনে করতে পারছে না অমিতা। কারও মুখে শুনেছে, না কোনও বইতে পড়েছে? নাকি কোনও নাটকের সংলাপ এটা? মনে করতে পারছে না অমিতা। মানুষের স্মৃতিটা কেমন অদ্ভুত না? মনটা তার চাইতেও অদ্ভুত। সেটা যেন একটা ছাঁকনি। সজীব ছাঁকনি। স্মৃতির কোন অংশটাকে সে যে ধরে রাখে আর কোন অংশটাকে যে সে ছেঁটে ফেলে দেয়, এবং কেন, কিছুই বুঝতে পারে না অমিতা।
শামিম বলেছিল, তার চোখ মুখ তখন উৎসাহ জ্বলজ্বল করছিল, ‘অতীতে কেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল তা বলতে পারব না ফুলকি।’ অমিতা দেখছিল, ফুলকি আর শামিম তখন প্যারাগনে। তাদের দুজনের সামনেই ভ্যানিলার গেলাস।
‘তবে এটা তোমাকে বলতে পারি ফুলকি, এবার আমরা ছাত্ররা আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলায় সাম্রাজবাদী ব্রিটিশ সরকার যে সব আসামীদের সোপর্দ করেছে, তাদের মুক্তির জন্য আমরা এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলছি।’ অমিতা দেখছে। শামিম আর ফুলকি একটা প্রায় খালি ট্রামে ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সিটে বসে আছে। ‘ফুলকি এই আন্দোলন, দেখে নিও, হিন্দু মুসলমান ঐক্যের এক দৃঢ় ভিত্তি গড়ে তুলবে।’
অমিতা দেখছে। ট্রামটা কালীঘাট ডিপো থেকে বের হচ্ছে। অমিতা দেখছে। শামিম উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। শামিম উৎসাহভরে ফুলকির একটা হাত টেনে নিল। ফুলকি চোখ বুজল। ফুলকির হাতে চাপ দিয়ে শামিম বলে উঠল, ‘মুসলিম ইনস্টিটিউটে সর্বদলীয় ছাত্র নেতাদের এই বৈঠক হয়ে গিয়েছে ফুলকি।’ অমিতা দেখছে। একটা স্টপে ট্রাম থামল। দুজন লোক উঠল ট্রামে।’
‘নয়া দিল্লি ৫ নভেম্বর ১৯৪৫’। ফুলকির খাতায় চোখ ফেলল অমিতা। যেন একেবারে সদ্য সদ্য লেখা। একেবারে জ্বলজ্বল করছে। শামিমের চোখের মতো। যেন আঙুল ঠেকালেই কালি লেগে যাবে।
‘আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার আরম্ভ হওয়ার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পূর্বে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের দেশপ্রেমিক লোকদিগকে বায়চাও’ এবং ‘ দেশপ্রেমিকগণ বিশ্বাসঘাতক নহেন’ বাক্য লিখিত প্লাকার্ডসহ বহুসংখ্যক লোক লালকেল্লার বাইরে প্রধান রাস্তায় সমবেত হয়। তাহারা রাস্তা দিয়া সরকারি ও সামরিক মোটর গাড়ি চালিয়ে সাইবার সময়ে ‘জয়হিন্দ’দ ধ্বনি করে।—আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্ট টুকে রেখেছিল ফুলকি।
অমিতা দেখছে। হাজরা রোডের মুখে ট্রাম এসে পড়েছে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। ছাতা মাথায় দুজন মহিলা ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন লোক ট্রাম থেকে নেমেই ছাতা খুলে ফেললেন।
অমিতা দেখছে। শামিম হাত পা নেড়ে বলে যাচ্ছে। বৃষ্টির ছাঁট ফুলকির গায়ে লাগছে। কন্ডাক্টার টিকিট চাইতে শুরু করেছে।
‘হিন্দু নেতারা প্রথম থেকেই মুসলিম লিগের উপর খাপ্পা হয়ে বসে আছেন। মুসলিম লিগ তো এই ভারতেরই একটি রাজনৈতিক দল না কি?’ এটা মনসুর সাহেবের গলা। ‘মুসলিম লিগ যা বলে তারই একটা ভুল ব্যাখা যদি হিন্দু নেতারা দিতে থাকেন, তবে কি মনে হয় না সুধারকরবাবু তারা মুসলমানদের কোনও কথা কানে তুলবেন না বলে মন স্থির করেই ফেলেছেন। এটা কি ডেমোক্রেটিক অ্যাটিচিউডের লক্ষণ হল?
অমিতা দেখছে। পিছন থেকে কন্ডাক্টার একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে
শামিম বলল, ‘আমরা একটা বিরাট মিছিল বের করব। বুঝলে ফুলকি। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, ফরওয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট,’সকল দলেরই পতাকা থাকবে সেই মিছিলে।’
অমিতা দেখছে। ট্রাম কালীঘাট ব্রিজের স্টপে এসে থামল। ফুটবোর্ডে একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। কন্ডাক্টার তার কাছে গিয়ে টিকিট পাঞ্চ করার মেশিন থেকে খট খট আওয়াজ করতে লাগল। লোকটা যেন কিছু ভাবছে। সে কন্ডাক্টারের দিকে চাইল না। ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়েই রইল।
‘আর এক হয়েছে আপনাদের জাতীয়তাবাদী প্রেস! দেশের লোকের মনে বিদ্বেষ ছড়াতে এদের আর জুড়ি নেই সুধাকরবাবু।’
অমিতা দেখছে। ছাত্রদের একটা ছোট মিছিল উল্টো দিক থেকে আসছে। মিছিল ভিজছে বৃষ্টিতে। ‘জয় হিন্দ! জয় হিন্দ!’
‘সবাই যদি আমরা বিদ্বেষ জাগাবার কাজে মন ঢেলে দিই, তবে অন্য পক্ষের কথা শোনার কান এবং মন কি করে পাব? বলতে পারেন? আমাদের সংখ্যালঘুদের হয়েছে এই মুশকিল। আমরা যেন হিন্দুদের বাড়া ভাতের থালা কেড়ে নিতে যাচ্ছি। ঘোলা চোখে দেখলে সত্যকে চিনতে পারা যায় না।’
অমিতা দেখছে। অমিতা শুনছে।
ফুলকি বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচার জন্য হাতটা ভেতরে টেনে নিল। ট্রামের কন্ডাক্টার ‘টিকিট’ বলে হাঁকতেই ফুটবোর্ডের লোকটা লাফ দিয়ে নেমে গেল। এবং মিছিলকে উদ্দেশ করে ‘জয়হিন্দ’ বলে হাঁকাড় মারল। তারপর পানের দোকানের দড়ি থেকে বিড়ি ধরিয়ে হাঁটা দিল।
মিছিলের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে এল ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তি চাই। বিচারের প্রহসন বন্ধ কর বন্ধ কর।
ট্রামের কন্ডাক্টার চোখ পাকিয়ে ফুটবোর্ড থেকে নেমে যাওয়া লোকটার দিকে চেয়ে টিকেট পাঞ্চ করতে করতে আপন মনে গজগজ করতে থাকল, ‘খালি চালাইকি খালি চালাইকি।’
‘দেখলে ফুলকি, আমাদের স্কোয়াড বেরিয়েছে।’
‘জ য় হি ই ন্ দ।’ মিছিলের ফিকে আওয়াজ অমিতার কানে পৌঁছল। তার ঘরের জানলা দিয়ে তখন ঢল নেমেছে। মন্টুর মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল।
‘হায় গো মা, সব ভিজে গেল যে। জানালাটা বন্ধ করে দিই। হাঁ মা!’
না না! অমিতা যেন আঁতকে উঠল। এক্ষুনি যেন স্মৃতিটা ছিঁড়ে যাবে। না না মন্টুর মা জানলা বন্ধ করার দরকার নেই।
‘সব যে ভিজে ন্যাতা হয়ে গেল মা। এ যে ছিষ্টি ভাসানো বিষ্টি গো।’
অমিতা অসহায় হয়ে মন্টুর মার কাছে আত্মসমর্পণ করল। মন্টুর মা একে একে সব জানলা বন্ধ করে দিল। ঘরটায় ভ্যাপসা গরম ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। একটা অদৃশ্য ড্রাগন যেন ঘরের কোণায় বসে বসে ভ্যাপসা নিশ্বাস ফেলে যেতে লাগল।
পাখা চালিয়ে দিল মন্টুর মা।
‘শান্তি লাই গো মা, কোনও কিছুতেই শান্তি লাই। জানলা খুলে রাখো বিষ্টি। জানলা বন্ধ করো ঘাম, তখন ঘামের বন্যেয় ভাসো। তোমার ঠাঁই আছি গো তাই, নইলে এই বিষ্টি বর্ষায় আমার আর হেনস্থার বাকি রইত না মা। বাড়ি বাড়ি কাজ করে ছুটতে হয়। পায়ের আর কিছু রইতনি মা। হাজা ধরে যেত। মন্টুকে তাই বলি, ঝিয়ের ছেলে তুই, তোর এত লবাবি তো ভাল নয়। ডাগর হয়েছিস। যা না, এখন রোজগার করে খা। মায়ের বয়স হলনি, না কি? আর তোকে কতদিন খাওয়াবে তোর মা। তা কতা কি কানে তুলছে?’
ফুলকি ট্রামের জানলাটা ঠক করে বন্ধ করে দিতেই অমিতারা সেই দিকে চাইল। বন্ধ জানলার গা দিয়ে জলের মোটা মোটা ধারা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ট্রাম তখন জজকোর্টের মোড়ে। ‘লাহোর প্রস্তাব মুসলিম লিগ গ্রহণ করল যেদিন, তারপর দিনই সকালে জাতীয়তাবাদী কাগজগুলোতে ফলাও করে ছাপা হল, একেবারে বড় বড় অংকরে, পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হইল।’ ফুলকির বন্ধ জানলার উপরে মনসুরের কথাটা যেন ঝপাৎ করে আছড়ে পড়ল।
১৮
অমিতা দেখছে। ট্রাম মোমিনপুরের মোড় থেকে খিদিরপুরের দিকে ঘুরছে। ট্রামের টিকিট ইন্সপেক্টার চেক করতে শুরু করলেন। ‘টিকিট’। একজন টিকিট দেখালেন। একজন পয়সা দিয়ে বললেন, ‘এসপ্ল্যানেড।’ ইন্সপেক্টার টিকিটটায় একবার চোখ বুলিয়ে লোকটির হাতে দিয়ে দিলেন। অমিতা দেখছে। ইন্সপেক্টার ফুলকিদের কাছে এগিয়ে গেলেন। শামিম দুটো অল্ ডে টিকিট তাঁর হাতে তুলে দিল। ইন্সপেক্টার তারিখটায় চোখ বুলিয়ে টিকিট দুটো শামিমকে ফেরত দিলেন। অমিতা দেখছে। একটা স্কোয়াড কংগ্রেস আর লিগের পতাকা নিয়ে বেরিয়েছে। এবার বৃষ্টি নেই। ‘সরমায়দারি সরকার কো এক ধাক্কা অওর দো’ বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে ট্রামের সঙ্গে সঙ্গে। ‘জ য় হি ন দ!’ ট্রাম থেকে সে একজন মুলখ বাড়িয়ে বলল, ‘জয় হিন্দ।
শামিম : আমরা ঠিক করেছি ফুলকি, হিন্দু মুসলিম ঐক্যের যে ভিত্তি এবার আমরা ছাত্ররা তৈরি করেছি, তা অটুট থাকবে।’
‘আজাদ হিন্দ ফৌজ কো ছোড় দো ছোড় দো।’
‘দু পক্ষে এত ভুল বোঝাবুঝি থাকলে ঐক্য হবে কি করে?’ অমিতা শুনল, স্পষ্ট শুনল, তায়েবকাকার গলা। ‘সত্যিই তো মুসলিম লিগের লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান সম্পর্কে কোনও উচ্চবাচ্যই ছিল না। কিছু না জেনে কিছু বুঝতে চেষ্টা না করে জাতীয়তাবাদী কাগজগুলো এমন করে ‘পালে বাঘ পড়েছে পালে বাঘ পড়েছে’ বলে চেঁচাতে শুরু করল যে, সকলেরই ধারণা হয়েছিল, লাহোর প্রস্তাব বুঝি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠারই প্রস্তাব। এবং সকলেই তাই মেনেও নিয়েছিল।
‘এমন কি সুভাষবাবুর মতো বিবেচক নেতারও ওই একই ধারণা হয়েছিল।
শামিম : ‘শুনতে পাচ্ছি, ফুলকি, গভর্নমেন্ট এই সর্বদলীয় ছাত্র মিছিল বার হতে দেবে না। ১৪৪ ধারা জারি হবে সেদিন। কলকাতার সর্বত্র। মিটিং মিছিল বেআইনি ঘোষণা করা হবে।’
‘জিন্না বলেছিলেন, পাকিস্তান শব্দটি আমরা চালু করিনি। হিন্দুরাই এই শব্দটি আমাদের উপহার দিয়েছে। লাহোর প্রস্তাবের সমালোচনা করতে গিয়ে হিন্দুরা বার বার এটাকে পাকিস্তান প্রস্তাব বলে উল্লেখ করেছেন। অবশ্য জিন্না তার জন্য হিন্দু নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।’
শামিম। ‘দেখলে তো ফুলকি, কংগ্রেসের তিনরঙা আর লিগের চাঁদতারা এক সঙ্গে কেমন মিলেছে।
অমিতা দেখছে। ফুলকি কোনও কথা বলছে না। এবার সে-ই শামিমের হাতটা ধরে আছে। যেন শামিমের সমস্ত উৎসাহ তার দেহে মনেও প্রবাহিত হয়।
মনসুর : ‘১৯৪০ সালের কথা এটা। আমি তখন দৈনিক কৃষক কাগজের সম্পাদক। সেই এপ্ৰিল মাসে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। হক মন্ত্রিসভা কলিকাতা মিউসিনিপ্যাল আইন সংশোধন করে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছেন। কলকাতা কর্পোরেশনে মোট ৯৩টি নির্বাচিত সিটের মধ্যে ২২টি মুসলমানদের জন্য রিজার্ভ করা হয়েছিল। মহাত্মাজির সঙ্গে বিরোধ করে সুভাষ তখন কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদ ছেড়ে এসেছেন।
তায়েবকাকা : ত্রিপুরি কংগ্রেসে সুভাষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, গান্ধি এটা মেনে নিতে পারেননি।
সুধাকর : কিন্তু সুভাষের জনপ্রিয়তা কিছুই কমেনি বাংলায়।
তায়েবকাকা : তিনি তখন তো যুবা ও তরুণদের নয়নের মণি।
শামিম : ফুলকি, এখান দিয়ে চিড়িয়াখানায় যাওয়া যায়।
ফুলকি : এখন তো বৃষ্টি থেমেছে। যাবে চিড়িয়াখানায়? বৃষ্টির দিনে চিড়িয়াখানা কেমন লাগে দেখলে ভাল হত।
অমিতা দেখছে। শামিম আর ফুলকি ট্রাম থেকে নামল।
মনসুর : এটা সেই সময়ের গল্প। সুভাষ, যেমন পপুলার, তেমনই তখন মুসলিম লিগ ও কলকাতার মুসলমানদের কাছে খুবই পপুলার। সুভাষচন্দ্র মুসলিম লিগের সঙ্গে প্যাক্ট করে কলকাতার কর্পোরেশনের নির্বাচনে নামলেন। নির্বাচনে জয়জয়কার। মুসলিম লিগ নেতা আবদুর রহমান সিদ্দিকী মেয়র হলেন। স্বয়ং সুভাষবাবু তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। মেয়র ছাড়া পাঁচজন অলডারম্যানের দুইজন হন মুসলিম লিগের। এ ছাড়ারও শর্ত হয়েছিল, পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন বছরে একজন করে মুসলিম কলকাতার মেয়র হবেন। মুসলিম লিগের পক্ষে এ একটা সুস্পষ্ট বিজয়। কংগ্রেস নেতাদের পক্ষে মুসলিম লিগকে মুসলমানদের প্রতিনিধি-প্রতিষ্ঠান রূপে মেনে নেওয়ার এটাই হল প্রথম পদক্ষেপ। অবশ্য সুভাষবাবুকে তখন ঠিক কংগ্রেসি হয়তো বলা যায় না। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করেছেন।
ট্রাম থেকে নেমে শামিম আর ফুলকি চিড়িয়াখানায় যাবার পথ ধরে এগুচ্ছে। অমিতা দেখছে। মন্টুর মা যখন জানলা বন্ধ করে দিতে এসেছিল বৃষ্টির ছাট বন্ধ করতে, অমিতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল, এই বুঝি তার স্মৃতির সূত্র ছিন্ন হয়ে যাবে। কিন্তু অমিতা দেখল, না ওরা আছে। আছে তার স্মৃতিতে। শামিম আর ফুলকিকে পিছন থেকে দেখছে অমিতা। ওরা বেশ দূরে।
‘কংগ্রেস নেতারা, বিশেষ করে সুভাষবাবুর মতো নেতা, মুসলিম লিগকে মুসলিম প্রতিনিধি-প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমল দিলে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের পরম পরাজয় হয়। কংগ্রেস সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করলে জাতীয়তাবাদের আশা থাকল কই?’
অমিতা দেখছে তার বাবার বৈঠকখানায় তখন হাওয়া গরম হয়ে উঠছে। মনসুর সাহেব এসেছেন। তায়েবকাকা হরিকিশোরমেসো বাবা শামিম ফুলকি বসে আছে। মনসুর বলে যাচ্ছেন।
‘কাজেই আমরা জাতীয়তাবাদী মুসলমান, লিগ বিরোধী মুসলমান, আমরা সুভাষবাবুর উপর খুবই চটে গেলাম।’
তায়েবকাকা : ‘তোমরা তো কাগজে তখন একটা বিবৃতিও দিয়েছিলে মনসুর।’
মনসুর : ‘দিয়েছিলাম। সুভাষবাবুর মুসলিম লিগের সঙ্গে এই আপসের বিরুদ্ধে বেশ কড়া করেই আমরা বিবৃতি দিয়েছিলাম। ডাঃ আর আহমদ, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির আর আমি। আমাদের তিন জনের প্রতিবাদ দৈনিক কৃষক-এ ছাপা হল। সুভাষবাবু তাঁর বাড়িতে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন।
ফুলকি আর শামিম খিদিরপুরের দিক থেকে চিড়িয়াখানায় আসছে। অমিতা দেখছে। এবার সামনের থেকে ওদের দেখা যাচ্ছে। পথটা প্রায় নির্জন।
‘সুভাষবাবু আমাদের তিনজনের সঙ্গেই দেখা করতে চেয়েছিলেন। কারণ দৈনিক কৃষকের আমরাই ছিলাম মাথা। এবং কৃষক তখন সুভাষকে সমর্থন করছে। ডাঃ আর আহমেদ তখন কৃষকের ডাইরেক্টার, অধ্যাপক হুমায়ুন কবির ম্যানেজিং ডাইরেক্টার, আর আমি এডিটর। ডাঃ আহমেদ আর হুমায়ুন সুভাষবাবুর উপরে এতই গোসা করেছিলেন, যে তাঁরা চা খেতে গেলেন না।’
বৈঠকখানার ঘরে ট্রে ভর্তি চা এল। সকলেই এক এক কাপ তুলে নিলেন।
মনসুর : ‘অগত্যা আমাকে একাই যেতে হল।
শামিম আর ফুলকি ততক্ষণে চিড়িয়াখানার গেটের কাছে। এক পাশে দাঁড়িয়ে ভাঁড়ে করে দুজনে চা খাচ্ছে। একদল হিন্দুস্থানী ছেলেপুলে নিয়ে গেটে লম্বা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু ট্যাকসি ভর্তি মার্কিন সৈন্য গেটে নামল। এক ট্যাকসিতে সাদা আর একটা ট্যাকসিতে কালো সৈন্যরা। তাদের সকলেরই গলায় গাঁদা ফুলের মালা। কালীঘাট মন্দির থেকেই আসছে নির্ঘাৎ। ফুলকি আর শামিম ভাঁড়টা মুখে ঠেকিয়ে চোখ ফুটো ঈষৎ উঁচু করে সৈন্যদের দিকে একবার চাইল। মার্কিন সৈন্যরা দিব্যি লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অমিতা দেখছে।
মনসুর : ‘দুই তশতরি মিঠাই আর চা খাবার পরে সুভাষবাবু আসল কথায় এলেন।’
মনসুর টেবিলের পর চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রাখলেন। অমিতা দেখছে। তার চোখে বাবার বৈঠকখানা।
মনসুর : ‘আলাপের গোড়াতেই সুভাষবাবু দুঃখ করে বললেন, তাঁর সঙ্গে কথা না বলে আমরা কাগজে বিবৃতি দিলাম কেন? এটা কি বন্ধুর কাজ হয়েছে? আমি বললাম, আমাদেরকে ঘুণাক্ষরে না জানিয়ে মুসলিম লিগের সঙ্গে আপস করলেন কেন? এটা কি বন্ধুর কাজ হয়েছে? ঝগড়ার সুরে কথা শুরু হয়েছিল বটে তায়েব, কিন্তু একটু পরেই আমরা উচ্চ কণ্ঠে হেসে উঠতেই আবহাওয়া হালকা হয়ে উঠল। সুভাষ তখন বললেন, যা বলেছিলেন তার মর্ম এই : হিন্দু মুসলিম ঐক্য ছাড়া ভারতের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দিয়েও কোনও আশা নেই।’
বাবা বললেন, ‘সুভাষ বলেছিলেন এই কথা!
খুব ভিড় নেই চিড়িয়াখানায়। যারা আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। ফুলকি দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। আকাশ ঘন মেঘের প্রেক্ষাপটে ফুলকির সামনেই একটা’ ময়ূর, যেন ফুলকিকে দেখাবার জন্যই, পেখম মেলে দিল। অমিতা দেখছে। ফুলকির চোখ বিস্ময়ে গোল হয়ে উঠেছে।
শামিম : কি হল ফুলকি দাঁড়িয়ে পড়লে যে?’
ফুলকি ময়ূরটার দিক থেকে চোখ না ফিরিয়েই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে শামিমকে বলল, স্স্স্স্।
তারপর সন্তর্পণে তার একটা আঙুল তুলে পেখম ধরা ময়ূরটাকে দেখিয়ে দিল।
অমিতা দেখছ।
ফুলকির চোখে যেন স্বপ্ন নেমে এসেছে। ফুলকি বলল, আকাশে ঘন মেঘ—ময়ূর পেখম মেলেছে—আমার সামনে ময়ূর এই প্রথম পেখম মেলেছে—আমার সামনে ময়ূর এই প্রথম পেখম মেলল—এ যেন একটা স্বপ্ন শামিম–আচ্ছা শামিম এই স্বপ্ন তোমার ভাল লাগে না, না?
শামিম : ‘স্বপ্ন। স্বপ্ন দেখি বই কি ফুলকি। আজাদ হিন্দ…’
ফুলকি : ও? রাজনীতির স্বপ্ন! বাবারা যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে জীবন কটিয়ে দিলেন, সেই স্বপ্ন এখন তুমি দেখতে আরম্ভ করেছো। তুমিও হয়ত তোমার জীবনটা এই রাজনীতির স্বপ্নের পিছনেই কাটিয়ে দেবে শামিম।
মনসুর : ‘সুভাষ বলেছিলেন, মুসলিম লিগ মুসলিম জনগণের মন জয় করেছে। জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের দ্বারা কোনও আশা নেই। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে একটা চীনা দেওয়াল উঠে পড়েছে। সে দেওয়ালের এমন একটা জানলাও নেই যে, যার মধ্যে দিয়ে মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলা যায়।’
ফুলকি : আমি ওই রাজনীতির স্বপ্নের কথা জানতে চাইছি না শামিম?
শামিম : ‘তবে তুমি কোন স্বপ্নের কথা জানতে চাইছ?’
ফুলকি : ওই স্বপ্নের কথা। যাতে ভালবাসা আছে সেই স্বপ্নের কথা
অমিতা দেখছে। ফুলকির চোখে তখনও স্বপ্ন। তখনও ময়ূরটা পেখম মেলে আছে। আকাশে ঘন মেঘ ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠেছে। আর কি কালো!
মনসুর : ‘সুভাষবাবু আবেগভরে বলে উঠেছিলেন, আমি মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। তাদের সঙ্গে মিশতে চাই। তাদের একজন হতে চাই। বলুন মনসুর সাহেব, মুসলিম লিগ ছাড়া আর : কার মারফত এটা করতে পারি? আর কোনও রাস্তা আছে কি?’
অমিতা দেখছে। চিড়িয়াখানায় ওরা দুজনে মুখোমুখি। ফুলকির চোখে স্বপ্ন। শামিমের চোখে স্বপ্ন। যেন দুটো পথ চলে গিয়েছে দুদিকে।
মনসুর : ‘সুভাষবাবু জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বলুন, আর কোনও রাস্তা আছে কি? আমি তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছিলাম। তবে বলেছিলাম, কিন্তু আপনি যে জানলা খুলতে চাইছেন তার ফাঁকটা খুব ছোট। আপনি বড় বড় জানলা দরজা বের করুন। সিদ্দিকি ইস্পাহানিদের না ধরে একেবারে সরাসরি জিন্নার সঙ্গে কথা বলেন। সুভাষবাবু পরম আগ্রহভরে টেবিলের উপর দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলেছিলেন, আমি কিছুদিন থেকেই মনে মনে তাই ভাবছিলাম। কিন্তু সেদিন লাহোরে ওই যে ধর্মীয় রাষ্ট্রের কি একটা প্রস্তাব পাশ করিয়ে ফেলেছেন তিনি। এর পর থেকে নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে আপসের আশা আমি প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। আমি তখন বলেছিলাম, জিন্না সাহেবের সঙ্গে দেখা না করার একশ একটা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু লাহোর প্রস্তাব তার একটা, একথা বলবেন না। লাহোর প্রস্তাব আপনি পড়ে দেখেছেন? সুভাষবাবু স্বীকার করেছিলেন যে, তিনি লাহোর প্রস্তাব পড়ে দেখেননি। খবরের কাগজের হেডিং পড়েই তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ওটাতে আর পড়ার কি আছে? পাকিস্তান চেয়েছে। পাকিস্তান মানেই থিয়োক্রেসি। ধর্মতন্ত্র।’
হরিকিশোরকাকা: পাকিস্তান ধর্মতন্ত্র নয়।
মনসুর : ‘শতকরা একশ জন হিন্দুর মনে এ ধারণা জন্মালেও যা সত্য তা এই হরিকিশোরবাবু, লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তানের নামগন্ধও ছিল না।’ আর জিন্না যে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা থিয়োক্রেটিক স্টেটের স্বপ্ন নয়, সেটা ছিল সেকুলার পাকিস্তানের স্বপ্ন।’
তায়েবকাকা একদিন বলেছিলেন, ‘জিন্না হিন্দু মনের কাছে কেমন যেন একটা শয়তান জাতীয় জীব বিশেষই হয়ে রইলেন। জিন্নাকে কি তোমার ভিলেন বলে মনে হয় হরিকিশোর?’ তায়েবকাকা তখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছিলেন। হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, না তায়েব, জিন্নাকে কখনোই ভিলেন বলে ভাবতে পারিনি আমি। অতীতের জিন্নাকে আমরা জানি। তবে কি জানো তায়েব, অতীতের জিন্নাকে পরবর্তী জিন্নার সঙ্গে মেলাতে পারিনি। অন্য কিছুর জন্য নয়, তিনি, যিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের যথার্থ অ্যামবাসাডার ছিলেন, তিনি কেন বিদ্বেষের রাজনীতির কাছে আত্মসমৰ্পণ করেছিলেন, সেটা আমি বুঝতে পারিনে। না জিন্না ভিলেন নন, আমার কাছে তিনি এনিগমা, এক প্রহেলিকা।’ বাবা বলেছিলেন, তখন ভারত ভাগ হয়ে গিয়েছে, ‘জিন্না ভিলেন? তিনি ‘কেন ভিলেন হতে যাবেন? জওহরলাল কি ভিলেন? ওরা পলিটিশিয়ান। জিন্নাকে বলিহারি, তিনি কত কমজোরী তাস নিয়েও কত বড় খেলাটায় জিতে বেরিয়ে গেলেন! জিন্না আমার কাছে বিস্ময়।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘জিন্না আদ্যন্ত সেকুলার। তার পাকিস্তান হবার পরেও সেকুলারিজমের উপর জিন্নার বিশ্বাস একটুও টলেনি হরিকশোর। ১৯৪৭ সালে আগস্ট মাসে জিন্না পাকিস্তান গণপরিষদে প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, এ দেশের কোনও সংবাদপত্রে তা ছাপা হয়নি হরিকিশোর, ওয়াহেদ সেটা আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল, তাতে তিনি যে কথাগুলো বলেছিলেন, হিন্দুদের শোনা সেটা খুবই জরুরি ছিল। গণপরিষদের সদস্যদের তিনি বলেছিলেন, আপনারা স্বাধীন। এই পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনাদের ইচ্ছামতো মন্দির মসজিদ অথবা অপর যে কোনও উপাসনালয়ে যাবার অধিকার আপনাদের আছে। আপনাদের ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায় যাই হোক না কেন…আমরা একই রাষ্ট্রের অধিবাসী। আমার মতে এই মূল নীতিকে আমাদের আদর্শরূপে সদাজাগরুক রাখা কর্তব্য। তাহলে আপনারা দেখবেন যে, কালক্রমে হিন্দুরা আর হিন্দু, এবং মুসলমানরা আর মুসলমান থাকবে না—ধর্মবিশ্বাসের দিক থেকে নয়, কারণ সেটা হল প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের প্রশ্ন—এটা হল রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রে নাগরিক হিসাবে। হরিকিশোর এমন কথা কি কোনও ধর্মোন্মাদ বলতে পারে?’
হরিকিশোরমেসো : ‘না তায়েব। ভারতের সেকুলার রাষ্ট্রের নাগরিক হিসবে এটা আমারও কথা। নেহরুও এই স্বপ্ন দেখেছেন।’
অমিতা দেখছে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ওরা দুজনে একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। ওরা—শামিম আর ফুলকি। সেই নির্জনে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে আছ।
শামিম : ‘স্বপ্ন আমি দেখি ফুলকি। অহরহ স্বপ্ন দেখি। আমি স্বপ্ন দেখি, আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতাদের মুক্ত করার দাবিতে যে আন্দোলন আমর।ছাত্ররা গড়ে তুলছি, সেই আন্দোলন আমাদের কে হিন্দু কে মুসলমান কে খ্রিস্টিয়ান আর কেই বা অস্পৃশ্য সেই ভেদটা ঘুচিয়ে দেবে! আমি স্বপ্ন দেখি ফুলকি, এই আন্দোলনে আমাদের মধ্যে যে ঐক্য গড়ে উঠবে তা আমাদের নিয়ে যাবে এমন দেশ গড়ার দিকে যেখানে হিন্দুরা আর হিন্দু, এবং মুসলমানরা আর মুসলমান থাকবে না, হয়ে উঠবে একই রাষ্ট্রের নগরিক : ধর্ম যাবে যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আশ্রয়ে। স্বপ্ন দেখি ফুলকি। সে স্বপ্নের প্রেরণা তুমি। তুমি। তুমি।’
ফুলকির কাঁপুনি ধরেছিল। বৃষ্টির জন্য নাকি শামিমের জাদুকরী কথার জন্য, নাকি ওরা পরস্পরের শরীর স্পর্শ করে আছে, দুজনের ঠোঁটের ব্যবধান কমে আসছে, ক্রমেই কমে আসছে, তার জন্য অমিতা সেই দূরে, তার ঘরে বসে ঠাহর করতে পারছিল না।
‘এই স্বপ্ন আমার সফল হবে আমি জানি, শুধু যদি হিন্দু নেতারা বাস্তবতাবোধের পরিচয় দেন। একটু বিবেচনা যদি তাঁরা দেখাতে পারেন।’
‘হিন্দু নেতারা’!! অমিতা বিস্মিত হল। শামিম বলছে, ‘হিন্দু নেতারা!’ অমিতার কানে খট্ করে কথাটা বাজল। শামিম পলিটিশিয়ানের মতোই কথা বলছে!
১৯
সুভাষবাবু বলেছিলেন, আমি মুসলমানদের সঙ্গে কথা বলতে চাই, তাদের সঙ্গে মিশতে চাই, তাদের একজন হতে চাই; বলুন মনসুর সাহেব, মুসলিম লিগ ছাড়া আর কার মারফতে এটা করতে পারি? আর কোনও রাস্তা আছে কি?’
মনসুর যেদিন এ কথা তাদের বাড়িতে বসে বলেছিলেন, অমিতার বেশ মনে আছে, বাবা তার দুদিন আগেই দিল্লি থেকে ফিরেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার মুলতুবি হয়ে গিয়েছিল বলে।
‘ভুলাভাই পিটিশন করেছিলেন’ বাবা বলেছিলেন। ‘আসামী পক্ষকে সাক্ষিগণের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সম্পূর্ণ করার জন্য এবং যে সকল প্রমাণ সরকার দাখিল করেছেন সেগুলোকে খতিয়ে দেখার সুযোগ দেবার জন্য বিচার তিন সপ্তাহের জন্য মুলতুবি রাখা হোক। সেই পিটিশনে প্রার্থনা ছিল এই
পরপর কদিন ধরে তাদের বাড়িতে আজাদ হিন্দের মামলার ব্যাপারেই আলোচনা চলেছিল। বাবাই ছিলেন মুখ্য বক্তা আর সকলে ছিলেন শ্রোতা। যেদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বিচারের খবরটা ফলাও করে বের হল, সেদিন বাবার বৈঠকখানা ভর্তি। কয়েকজন কংগ্রেসি নেতা; মুসলিম লিগের আবুল হাসেম, জাতীয়াতাবাদী মুসলিম নেতা আবুল মনসুর আহমেদ, সত্যরঞ্জনবাবু, তায়েবকাকা, হরিকিশোরমেসো, শামিম এবং শামিমের কয়েকজন বন্ধুও এসেছিল।
বাবা বলেছিলেন, ‘জজ-অ্যাডভোকেট ক্যাপটেন শাহ্ নাওয়াজ খান, ক্যাপটেন পি কে সায়গল এবং লেফটেন্যান্ট জি এস ধীলনের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল, সেগুলো তাঁদের পড়ে শোনান।’
হরিকিশোরমেসো জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ওদের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী ছিল?’
বাবা ফুলকিকে সেদিন ডেকেছিলেন। অমিতা এখনও দেখতে পায় সেদিনের ফুলকির মুখটা। বাবার আচমকা ডাকে ফুলকি বোধ হয় কিছুটা চমকেই গিয়েছিল। তার গালে লাল ছোপ খানিকটা পড়েছিল। সে বোধ হয় শামিম ফুলকির দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল বলে। বাবা ফুলকিকে বললেন, ‘আজকের আনন্দবাজার পত্রিকাটা নিয়ে আয় তো মা।
ফুলকি কাগজখানা এনে বাবার হাতে দিতেই তিনি একটা পাতা বের করে ফুলকির হাতে দিয়ে বললেন, ‘এই জায়গাটা পড়ে দে তো। জোরে জোরে পড়িস। তাহলে সকলেই শুনতে পাবে।’
ফুলকি, কাগজের যে-অংশটা ‘বাবা পড়তে বললেন, সেটা পড়ে শোনাতে লাগল : ‘জজ-অ্যাডভোকেট আসামীদিগকে চার্জ পড়িয়া শুনান। তিনজন আসামীই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২১ ধারা অনুসারে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছেন। চার্জসীটে উল্লিখিত হইয়াছে যে, সিঙ্গাপুর, মালয়ে, রেঙ্গুনে, পোপার সন্নিকটে, কিয়াকপাডাউং-এর নিকটে এবং ব্রহ্মের নানা স্থানে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাস হইতে ১৯৪৫ সালের ২৬শে এপ্রিল মাসের মধ্যে আসামীগণ সম্মিলিতভাবে সম্রাটের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত, লেঃ গুরুবক্স সিং ধীলন, হরি সিং, দুলীচাঁদ, দারোদারিত সিং এবং ধরম সিং নায়ক চারি ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধে অভিযুক্ত হইয়াছেন। ১৯৪৫ সালের ৬ই মার্চ অথবা তাহার কাছাকাছি সময়ে ব্রহ্মের অন্তর্গত পোপা হিলের সন্নিকটে এই ব্যাপার সংঘঠিত হয়। পূর্বে যে চারি ব্যক্তিকে হত্যা করার বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে, ক্যাপটেন পি কে সায়গল ঐ হত্যাকাণ্ডের সহায়তা করার অভিযোগেও অভিযুক্ত হইয়াছেন। খাজিন শা ও আয়া সিং কর্তৃক গানার মহম্মদ হোসেনের হত্যাকাণ্ডে ক্যাপ্টেন শাহ নওয়াজ সাহায্য করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ করা হইয়াছে।
‘আসামীগণ সকলেই প্রত্যেকটি অভিযোগে নিজদিগকে নিরপরাধ বলিয়া ঘোষণা করেন। অতঃপর আসামীদিগকে তাঁহাদের কৌঁসুলীর পশ্চাদভাগে বসিবার অনুমতি দেওয়া হয়। বসিবার পূর্বে তাঁহারা সকলে পণ্ডিত নেহরুকে এবং ‘ডিফেন্স কমিটি’র অন্যান্য সদস্যকে অভিবাদন করেন! অতঃপর মামলা…’
বাবা বললেন, ‘থাক থাক মা, আর পড়তে হবে না।’
‘ভুলাভাই মামলা স্থগিত রাখার জন্য যে যুক্তি দেখিয়াছিলেন, কোর্ট শেষ পর্যন্ত তা মেনে নিয়েছিলেন।’ বাবা বলেছিলেন। ‘ভুলাভাই বলেছিলেন, আসামী পক্ষ আরও একটু বেশি সময় পেলে সাক্ষ্যপ্রমাণ তৈরি করে ফেলতে পারবেন, অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় অংশ বেছে নিতে পারবেন। এর ফলে আদালতের বহু সময় বেঁচে যাবে।’
আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলা প্রসঙ্গে নানা কথা আলোচনা হত বাবাদের বৈঠকে। তারপর গড়াতে গড়াতে সেই আলোচনা চলে যেত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, সেখান থেকে পৌঁছে যেত হিন্দু মুসলিম ঐক্যে। অমিতা এখন অন্ধকারে তার ঘরে বসে সেদিনের সেই উজ্জ্বলতাকে অনুভবে আনতে চেষ্টা করছে। কী সব দিন ছিল!
‘জিন্নাহ্ দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন, এটা ঠিকই। এবং সেই তত্ত্বকে তাঁর রাজনীতির ধুয়ো হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, এটাও ঠিক।’ একদিন তাদের বাড়িতে বসে আবুল হাসেম এ কথা বলেছিলেন। অমিতার মনে আছে। আবুল হাসিমের একটা কথা সেদিন ফুলকির মনে ধাক্কা দিয়েছিল, অমিতা জানে। ফুলকি কথাটা লিখেও হয়ত রেখেছিল তার খাতায়।
আবুল হাসেম বলেছিলেন, ‘আমি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলাম না এবং বাংলায় আমি সেটা প্রচারও করিনি।’
‘কিন্তু একজন মুসলমান হিসাবে এবং একজন বাঙালি হিসাবে আমি নিজের স্বাধীনতা দেখেছিলাম লাহোর প্রস্তাবে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের উপর নির্ভর করেই আমি মুসলিম লিগের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলাম, সুধাকরবাবু।’ হাসেম বলেছিলেন।
‘লাহোর প্রস্তাবে কোথাও দেশ ভাগ করার কথা ছিল না।’ মনসুরও বলেছিলেন। ‘এবং ওটা থিয়োক্রেটিক রাষ্ট্রেরও নকশা ছিল না। হিন্দু নেতারা একটু ধৈর্য ধরে সেটা যদি বুঝতে চেষ্টা করতেন, তাহলে বিদ্বেষটা অন্তত কমানো যেত।’
তায়েবকাকা মেডিকেল কলেজের বেডে শুয়ে একদিন বলেছিলেন, ‘হরিকিশোর জিন্নাহকে দূরে ঠেলে দিয়ে ঠিক কাজ হয়নি। জিন্নাহ্ ইসলামি রাষ্ট্র চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, মুসলমান-প্রধান একটা রাষ্ট্র, এবং সে রাষ্ট্র হবে ডেমোক্রেটিক, সে রাষ্ট্র হবে সেকুলার। এ কথাটা সেদিন, এমন কি জহরলাল নেহরুর মতো নেতাও বুঝতে পারেননি। এটাই আফসোস।
‘সুভাষবাবুর মতো নেতাও ওই একই ভুল করেছিলেন।’ মনসুর বললেন, ‘সুভাষবাবুর মুখে আমি যখন শুনলাম, জিন্না থিয়োক্রেটিক রাষ্ট্রের প্রস্তাব পাশ করিয়েছেন লাহোরে, তখন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি লাহোর প্রস্তাব পড়ে দেখেছেন? সুভাষবাবু স্বীকার করেছিলেন, তিনি মূল প্রস্তাব পড়ে দেখেননি, কাগজের হেডিং দেখেই তাঁর ধারণা গড়ে নিয়েছেন।’
‘লাহোর প্রস্তাব ছিল, ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ গঠনের জন্য আন্দোলনের ভিত্তি।’ হাসেম বলেছিলেন, ‘অন্তত আমি তো তাই বুঝেছিলাম। লাহোর প্রস্তাবে ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি হিসাবে যে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা আছে, তার একটি হল পঞ্জাব সিন্ধু বেলুচিস্তান, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র, এবং অন্যটি হল উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র।’
‘লাহোর প্রস্তাবে যে ব্যাখ্যা আমি সুভাষবাবুকে দিয়েছিলাম’, মনসুর বলেছিলেন, ‘সেটা এই রকম : প্রথমত ভারতের বর্তমান এগারোটি প্রদেশকে রেসিডুয়ারি পাওয়ার-সহ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটি নিখিল ভারতীয় ফেডারেশন গঠন করতে হবে এবং তার হাতে মাত্র তিন চারটি বিষয় থাকবে। দ্বিতীয়ত, এগারোটির মধ্যে যে পাঁচটি মুসলিম-প্রধান প্রদেশ আছে, তাদের মেজরিটি অর্থাৎ তিনটি প্রদেশ যদি দাবি করে তবে মুসলিম-প্রধান পাঁচটি প্রদেশকে নিখিল ভারতীয় ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র ফেডারেশন করবার অধিকার দিতে হবে।’
‘জিন্নাহ্ দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তিনি মুসলিম লিগের একচ্ছত্র নেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন, কায়েদ্-এ-আজম্। আমি মুসলিম লিগের সদস্য হয়েও জিন্নাহ্-এর দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নিতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করতাম বহুজাতি তত্ত্বে। কংগ্রেস বিশ্বাস করত একজাতি তত্ত্বে। এক জাতি এক প্রাণ একতা। এই ছিল কংগ্রেসের স্লোগান বা রাজনৈতিক ধুয়ো।’ হাসেম বলেছিলেন। শামিম হাসেমের মন্ত্রশিষ্যা হয়ে পড়ছিল। সেটা ফুলকি বুঝতে পারছিল।
‘ফুলকি, ভারত কোনও একটি দেশ নয়।’ শামিম বলেছিল। ‘এ হল একটি উপমহাদেশ। ভারতবর্ষ বিভিন্ন দেশ ও জাতির সমন্বয়ে গঠিত।’
আবুল হাসেমের কথাই তখন শামিয়ের মুখে ফুটে উঠতে শুরু করেছে।
হাসেম বলেছিলেন, ‘আমার কাছে ইউরোপ বলতে যা বোঝায় ভারতবর্ষ বলতেও তাই বোঝায়। ফ্রান্সের নাগরিক যখন বলে সে একজন ফরাসি সেটা যেমন সত্য, আবার যখন বলে সে ইওরোপীয় সেটাও তেমন সত্য।’
মনসুর বলেছিলেন, ‘আমার ব্যাখ্যা সুভাষবাবু প্রথমে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন, আমাকে লাহোর প্রস্তাবের ফুল টেক্সট্ দেখান। আমি সুভাষবাবুর কথামতো তার পরদিনই খবরের কাগজে প্রকাশিত লাহোর প্রস্তাবের ফুল টেক্সট্ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তিনি তখন বউবাজার স্ট্রিটে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের তিন তলায় একটি আফিস খুলে রোজ সেখানে বসতেন। উনি পড়তে বললেন। আমি সেটা পড়ে যেতে লাগলাম। উনি মন দিয়ে শুনতে লাগলেন। ইংরাজিতে যা পড়েছিলাম, তার তর্জমা এই রকম : সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইল ইহা নিখিল ভারত মুসলিম লিগের বিবেচিত অভিমত যে, নিম্নের মূল নীতি ব্যতিরেকে কোনও সাংবিধানিক ব্যবস্থা এদেশে কার্যকর করা সম্ভব নহে, অথবা মুসলমানদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নহে, যথা : ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন ইউনিটগুলিকে এক একটি অঞ্চল হিসাবে প্রয়োজন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে এমন করিয়া গঠন করিতে হইবে যাহাতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, যেমন ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং পূর্বাঞ্চলগুলিকে, সংঘবদ্ধ করিয়া এক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র করা যায়, যাহার শাসনতন্ত্র হইবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। এই সমস্ত ইউনিট ও অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের পর্যাপ্ত কার্যকর এবং আইনানুগ নিরাপত্তার ব্যবস্থা সংবিধানে রাখিতে হইবে যাহাতে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকারও তাহাদের পরামর্শ অনুযায়ী সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে যেখানে মুসলমান সংখ্যালঘু সেখানেও তাহাদের পরামর্শসাপেক্ষে তাহাদের জন্য সংবিধানে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখিতে হইবে।’ মনসুর বলেছিলেন, ‘সুভাষবাবুকে বলেছিলাম, এই হল লাহোর প্রস্তাব। কোনখানে আপনি থিয়োক্রেসি পেলেন, বলুন?’
হাসেম বলেছিলেন, ‘ভারত একটি দেশ নয়। উপমহাদেশ। এর মধ্যে অনেক নেশন। কাজেই বাংলার নাগরিক যখন বলে, সে একজন বাঙালি সেটা যেমন সত্য, আবার সে যখন বলে আমি ভারতীয় সেটাও তেমন সত্য। ভারতবর্ষ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে পৃথিবীর কাছে সুপরিচিত। যে সব প্রদেশে মুসলমানসংখ্যাগরিষ্ঠ সেইসব প্রদেশে ভারতীয় মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির জন্য ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি মুসলিম লিগ দাবি উত্থাপন করেছিল। আসামের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে মুসলিম লিগ আসামের এবং সেই সঙ্গে বাংলারও স্বাধীনতা দাবী করেছিল। মুসলিম লিগ ভারতবর্ষকে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে ভাগ করার প্রস্তাব করেনি।’
‘এবার সুভাষবাবু কি বলেছিলেন, সেইটা বলি।’ মনসুর বললেন। ‘সুভাষবাবু সব শুনে বলেছিলেন, আপনার ব্যাখা যদি ঠিক হয় মনসুর সাহেব, তবে তার সবটুকু আমি মেনে নিলাম। এমন কি আমি আরও বেশি যেতেও রাজি। যদি পাঁচটা মুসলিম প্রদেশের মেজরিটি আলাদা ইউনিয়ন করতে চায়, তবে তাতে আমি রাজি তো আছিই, এমন কি একটা প্রদেশও যদি সিসিড্ করতে চায় অর্থাৎ আলাদা হতে চায়, আমি তাতেও রাজি।’ এই কথা বলে সুভাষবাবু রুশ শাসনতন্ত্রে সেই ধারাটা আমার সামনে মেলে ধরলেন যাতে প্রত্যেক ইউনিয়ন রিপাবলিককে সিসিড্ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। এটা শুধু কথার কথা নয়। সুভাষবাবু বোম্বাইতে গিয়ে জিয়ার সঙ্গেও আলোচনা করেছিলেন।’
‘হ্যাঁ, সুভাষ ওই সময়টাতে মুসলমানদের মন জয় করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন।’ বাবা বলেছিলেন। ‘তার মধ্যে একটা কাজই সলিড্।
হরিকিশোরমেসো জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কোন্ কাজটা সুধাকর?’
‘হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের আন্দোলন গড়ে তোলা। সেটাও ছিল হিন্দু মুসলিম ঐক্য সাধনার একটা বড় পদক্ষেপ।’
১৯৪০ সালের গ্রীষ্মে যখন জার্মান ফৌজ নরওয়ে, ডেনমার্ক, হল্যান্ড একটার পর একটা দখল করে নিয়ে ফ্রান্সের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, বাবা কাকারা বলতেন, ‘ব্লিৎসক্রিগ’, জার্মান বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণ, যখন কমিউনিস্টরা তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘এটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ, এই যুদ্ধে এক পাই নয় এক ভাই নয়’, যখন এম এন রায় বলে যাচ্ছেন, ‘এই যুদ্ধ ফাসিবাদী যুদ্ধ, এবং ফাসিবাদ সর্বরকম স্বাধীনতা ও সভ্যতার শত্রু’, যখন গান্ধি আন্দোলন একেবারে স্তব্ধ, সেই সময় সুভাষ ‘হলওয়েল মনুমেন্ট হটাও’ আন্দোলন শুরু করে দিলেন। এ সবই ফুলকির বাবা কাকাদের মুখে শোনা।
বাবা একদিন বলেছিলেন, ‘বুঝলে হরিকিশোর, ১৯৪০-এর জুনের শেষের দিকে সুভাষ প্রথম বজ্রটি নিক্ষেপ করলেন। অর্থাৎ হলওয়েল মনুমেন্ট ডালহৌসি স্কোয়ারে রাইটার্স বিল্ডিংসের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণায় তখন বিরাজ করছে। সেটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যাগ্রহ শুরু করলেন সুভাষ। ছোট ছোট দলে। মনে আছে?’
‘লোকে তখন বলতে লাগল, এত বড় বড় ঘটনা আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় জীবনে ঘটে চলেছে, সে সবে গুরুত্ব না দিয়ে সুভাষবাবু শেষ পর্যন্ত হলওয়েল মনুমেন্ট সরাবার জন্য সত্যাগ্রহ শুরু করলেন। গান্ধীও সুভাষের এই ধরনের কাজকর্মকে পছন্দ করতেন না। ঠাট্টা করে বলতেন, ‘ফায়ার ওয়ার্কস্’। গোদা বাংলায় যাকে বলা হয় ‘তুবড়ি ছোটানো’। কিন্তু হলওয়েল মনুমেন্ট হটাও, সুভাষের এই উদাত্ত আহ্বান বাংলার হিন্দু মুসলমানকে এক মহা আবেগের ঐক্যে আবদ্ধ করে ফেলতে পেরেছিল। এই যেমন আজ শামিমবাবুদের আজাদ হিন্দু ফৌজের মুক্তির দাবিতে বাংলার হিন্দু মুসলমান ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে এসেছে।
হরিকিশোরমেসো বললেন, ‘কথা কি জানো, হলওয়েল মনুমেন্ট নিয়ে যে সত্যাগ্রহ চলেছিল, দিনের পর দিন রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে, সুভাষকে যে অনির্দিষ্টকাল কারাবরণ করতে হয়েছিল তার জন্য, সে কথা আজ কে মনে রেখেছে? তার চেয়েও বড় কথা হলওয়েল মনুমেন্ট সংগ্রামের পূর্বশর্ত হিসাবে সুভাষ যে ‘সিরাজদ্দৌলা দিবস’ পালনের কথা দেশবাসীকে বলেছিলেন, সেই কথাই বা কজন আজ মনে রেখেছেন?’
বাবা বলেছিলেন, ‘পলিটিক্যাল আন্দোলনে এই রকমই হয় হরিকিশোর। নতুন হুজুগ ওঠে, পুরানো হুজুগ লোকে ভুলে যায়।’
সিরাজউদ্দৌলা যখন কলকাতা দখল করেন, তখন একটা ঘরে অনেক বন্দীকে পুরে দেওয়া হয়েছিল। সেই বদ্ধ ঘরে অনেকে মারা যান। হলওয়েল সাহেবও ছিলেন তার মধ্যে। একে ইংরাজরা বলত, ‘ব্ল্যাক হোল ট্রাজেডি’। ‘হলওয়েল মনুমেন্ট সেই অন্ধকূপ হত্যারই স্মারক হিসাবে ডালহৌসি স্কোয়ারে খাড়া ছিল প্রায় দেড়শ বছর ধরে। অমিতা এ সব কথা জেনেছে কিছুটা পড়ে আর কিছুটা তার বাবাদের বৈঠক থেকে।
শামিম আবেগভরে বলে উঠেছিল, ‘না না কাকাবাবু, আপনারা যা ভাবছেন এবারের আন্দোলন তা নয়। অর্থাৎ হুজুগের আন্দোলন নয়। ছাত্ররা হিন্দু মুসলিম ঐক্যই গুরুত্বটা বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছে। আপনারা দেখে নেবেন এই ঐকাই আমাদের স্বাধীনতা এনে দেবে। আমাদের মধ্যে আই এন এ-র স্পিরিটই কাজ করছে। ইত্তেফাক, ইমদ, কোরবানি। এই হচ্ছে আমাদের ছাত্রদের স্পিরিট।
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ঐক্য তো হচ্ছে। কিন্তু বার বার সেই ঐক্য কেন টিকছে না, আমার মনে হয় তোমাদের তরুণমনে সেই কথাটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে দেখো। ফল্স্ গড তৈরি করে কোনও মহৎ কাজই করা যায় না। সুভাষবাবুর সিরাজউদ্দোলা ছিল ওই রকমই একটা ফল্স্ গড। হলওয়েল মনুমেন্ট ধরাপৃষ্ঠ থেকে সুভাষবাবু অপসারিত করতে পারলেন এটা ঠিকই। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলাকে লোকের মনে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেন না। যাকে তাকে ন্যাশন্যাল হিরো বানালেই যে সে টিকে থাকবে, এমন কোনও কথা নেই। সিরাজউদ্দৌলা এখন টিকে আছেন বাংলার থিয়েটার হলে, শচীন সেনগুপ্ত মশায়ের নাটকে, আর নির্মলেন্দু লাহিড়ি মশায়ের কণ্ঠের নাটকে মডিউলেশনে।’
‘সুভাষের অনুরোধেই শচীনবাবু সিরাজদ্দৌলা নাটকটা লেখেন।’ হরিকিশোরমেসো সেদিন বলেছিলেন।
‘বাংলা বিহার উড়িষ্যার মহান অধিপতি, তোমার শেষ উপদেশ আমি ভুলিনি জনাব। নির্মলেন্দুবাবুর হেঁড়ে গলায় যে সিরাজ প্রতিষ্ঠা পেত, তাকে দেখে এক সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারত না ফুলকি।
‘হিন্দু মুসলিম ঐক্য তো হচ্ছেই, গড়েই উঠছে, তবু তা ভাঙছে কেন? নিশ্চয়ই এর এক বা একাধিক গূঢ় কারণ আছে।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন। ‘ঠাণ্ডা মাথায় সেই কারণগুলোকে খুঁজে বার করাই তো সকলের কাজ। বিশেষত তোমাদের, তরুণদের কাজ বাপ।’
এর জবাবে শামিম কি বলেছিল এখন আর মনে নেই। সে এখন অন্ধকারে। এবং সে এখন একা। একেবারে একা।
তায়েবকাকা শামিমকে বলেছিলেন বটে যে, ঠাণ্ডা মাথায় খুঁজে বার করো কোথায় গলতিটা হচ্ছে, কিন্তু ফুলকি ক্রমেই টের পাচ্ছিল, শামিম আর ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারছে না। সর্বদাই সে এক উন্মাদনার মধ্যে আছে। ফুলকি তার অস্বস্তিটাকে ঢাকতে পারত না। এখন শামিমের সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ কমে যাচ্ছে। এত ব্যস্ত থাকে শামিম। শামিম কি তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। না সে-ই শামিমের কাছ থেকে সরে সরে আসছে? কখনও যদি শামিম আর সে কোথাও নিরিবিলিতে বসল তখন ফুলকি দেখে শামিম তাকে দেখছে না। জ্বলজ্বলে দুটো চোখ কোন্ ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আছে তার। ফুলকির কখনও কখনও আশঙ্কা জাগতে থাকে, শামিমের সেই ভবিষ্যতে যে ভবিষ্যতের ছবি শামিমের চোখে এখন হামেশাই ফুটে উঠছে, ফুলকি নামক একটি মেয়ের স্থান থাকবে কি? সেই বা কেন শামিমের এই উন্মাদনার শরিক হতে পারছে না? কোন্ বাধা ফুলকিকে টেনে রাখছে? শামিমের সংস্পর্শে এসে ফুলকির কি নবজন্ম হয়নি? কি ছিল ফুলকি, এই কিছুদিন আগেও? পিছন ফিরে যখন ফুলকি তার সেই ছোট অতীতটায় দৃষ্টি ফেলতে যায়, তখন অমিতার চোখে তার দীর্ঘ অতীত পেরিয়ে ফুলকির চোখের সঙ্গে মিশে যায়। কি ছিল সেই ফুলকি! বাবা তাকে আচ্ছন্ন করে ছিলেন। সদ্য সে কলেজে পা দিয়েছে। তার মনে যে রাজকন্যাটা ছিল, সে তখন ঘুমে অচেতন। দিদি তার মনে মাঝে মাঝে ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। শামিমের স্পর্শেই না তার ভিতরের ফুলকির ঘুম ভেঙেছিল। সেই শামিম! তার প্রাণ ছিল মমতায় ভরা। অথচ কি লাজুক। পরদুঃখে কাতর ছিল শামিম। সে তখন ভাবত মানুষের কথা। হিন্দুর কথা নয়, মুসলমানের কথা নয়, মনুষ্যত্বের কথা। হিরোসিমায় আণবিক বোমা পড়েছিল যেদিন, নাগাসাকি ধ্বংস হল যেদিন আমেরিকার তৈরি আণবিক বোমায়, সেদিন শামিম, একমাত্র শামিমই তার কাছে ছুটে এসেছিল খবরের কাগজখানা হাতে নিয়ে। না এসে পারেনি সে। শামিম সেদিন এমন মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছিল যে বুঝতে পারবে তাকে, কি যন্ত্রণায় সে কাটাচ্ছে তার প্রতি মুহূর্তগুলো। ফুলকির মধ্যে সেই মানুষের সন্ধান পেয়েছিল শামিম। সেইদিনই, হ্যাঁ সেইদিনই অমিতার মধ্যে ফুলকির, ফুলকির মধ্যে ফুলকির যেন জাগরণ হল। হ্যাঁ, সেই মুহূর্তে ফুলকির মধ্যে যে ফুলকিটা ঘুমিয়ে অচেতন হয়ে পড়েছিল, এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে শামিম তাকে জাগিয়ে দিয়ে শোনালো পৃথিবীর রূঢ় অস্তিত্বের কথা। ফুলকি সেইদিনই জানল, মানুষের সংসারে ধ্বংস আছে, আবার সেই ধ্বংসসাধনের জন্য অসুস্থ অহমিকাও আছে। শামিম পড়ে শুনিয়েছিল, খবরের কাগজ থেকে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের সেই সদম্ভ উক্তি, আজও যা অমিতা ভুলতে পারে না, ‘এই বোমার সঙ্গে আমরা যুক্ত করেছি এক নতুন এবং বিপ্লবাত্মক ধ্বংসের শক্তিকে, যা আমাদের ক্রমবর্ধমান সৈন্যবাহিনীর ক্ষমতাকে আরও আরও বাড়িয়েই চলবে। বর্তমানে এই ধরনের বোমা আমরা তৈরি করে চলেছি এবং এমন কি এর চাইতেও ধ্বংসের শক্তি ধরে এমন বোমা আমরা উদ্ভাবন করছি।’ সেদিন শামিম শুনিয়েছিল এই কথা। ফুলকির মনে হয়েছিল সেদিন, শামিমের সেই আর্তস্বর শুনে, হিরোসিমায় নাগাসাকিতে যারা অ্যাটম বোমায় মরেছে, যারা ধুকছে, যারা রেডিয়েশনের যন্ত্রণায় ছটফট করছে, তারা সবাই ফুলকিরই নিকটাত্মীয়। এই বোধটা সেদিন শামিমই তাকে দিয়েছিল। শামিম শামিম, তুমিই আমাকে বলেছিলে, ‘হিংসার ঔরসে যার জন্ম তার দ্বারা মানুষের কোনও কল্যাণ হতে পারে না।’ বলনি তুমি শামিম? আমি তো সেই বিশ্বাসে এখনও দাঁড়িয়ে আছি। তবে কেন আমাদের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে চলেছে?
১২ নভেম্বর, ১৮৪৫
‘কতকগুলো অ-চাওয়া ঘটনা ঘটে যাচ্ছে—রুখতে পারছি না। এই যেমন শামিমের সঙ্গে অকারণ মনোমালিন্য। তবে এ ব্যাপারে আমার কোনও হাত নেই। আমি কেবলই চেষ্টা করছি কথার খোঁচা না খেতে, অপমান গায়ে না মাখতে—কিন্তু ছাড়ছে না তো কেউ। যেখানে একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারত, সেখানে অনর্থক কতকগুলো ঝামেলার জট পাকিয়ে যাচ্ছে। যেন আমি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়, আমার উপস্থিতিটাই অনর্থক, এইটেই আমাকে বাজছে। আজকে আমার স্বাভিমানে বড় বাজল। সেদিন চিড়িয়াখানায় শামিমের একটা কথা শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। শামিম বলেছিল, ‘আমার স্বপ্ন সফল হবে, আমি জানি, শুধু যদি হিন্দু নেতারা বাস্তবতাবোধের পরিচয় দেন। একটু বিবেচনা যদি তারা দেখাতে পারেন।’ শামিমের মুখে আচমকা ‘হিন্দু নেতা’ কথাটা আমার কানে খট করে বেধেছিল। কারণ এই ধরনের কথা শামিমের মুখে আমি প্রথম শুনলাম। এই কথা নিয়েই কথায় কথায় কথান্তর হয়ে গেল শামিমের সঙ্গে, না হলেই ভাল ছিল। আমি যে ভালবাসি এত, সেটুকুর কি কোনও মূল্যই নেই? ওই ভালবাসার জন্যই না আত্মীয়দের অমন পরিকল্পিত অপমান সহ্য করে এসেছি। মনটা ভীষণ ভেঙে গেল। শুধু শুধু কতকগুলো তৈরি করা শক্ত কথা শুনতে হল। শুনতে হল তারই কাছে যে কিনা আমাকে শুনিয়েছিল, ‘হিংসার ঔরসে যার জন্ম তার দ্বারা মানুষের কোনও কল্যাণ হয় না।’ যে কিনা একদিন আমাকে জীবনদেবতা শুনিয়েছিল! সবই কি বদলে যাচ্ছে? যাই হোক, আমি তো নিয়ন্তা নই—যে যার নিজের মতো চলুক।’
ফুলকি যে একটা চাপের মধ্যে আছে অমিতা সেটা জানে। শামিমরা তখন তাদের আন্দোলনের পথে উন্মাদের মতো ছুটে চলেছে। তার পরিণতি কি হবে ফুলকি বুঝতে পারছিল না। তাই কি তার মনে শামিমের জন্য আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল? নাকি সে অন্য কিছু ভাবছিল? এমন কিছু যার মূল ছিল আরও গভীরে? ফুলকি আর শামিম স্বপ্ন দেখেছিল, যে-হিংসা যে-বিদ্বেষ তাদের চার পাশে ঘনিয়ে আসছিল, তাদের প্রেমই সেটা প্রতিরোধ করবে। এ কি শুধু স্বপ্নই?