প্রতিবেশী – ২.১০

১০

কলকাতায় ফিরে এল বটে ফুলকি, কিন্তু তার না কাটল অবসাদ, না বিষণ্ণতা। তার মনটা একেবারে একটা ঘষা কাঁচের মতো হয়ে,আছে। যার ভিতর দিয়ে বাইরের কিছুই দেখা যায় না। বিছানা ছেড়ে উঠতেই ইচ্ছে করে না ফুলকির। ওরা যেদিন মধুপুর থেকে ফিরল, বাবা সেইদিনই অমল রায়চৌধুরিকে ডেকে আনলেন। বাবা বোধ হয় অমলকাকাকে কিছু বলে থাকবেন। সেই রকমই সন্দেহ করল ফুলকি। কারণ অমলকাকা তাকে প্রায় কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। এটা অমলকাকার স্বভাব নয়। তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যেমন শরীরটাকে দেখেন, তেমনি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করেন না কথা যাতে রোগীর মনটাকেও জানতে পারেন। অমলকাকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এদিন শুধু তার শরীরটাকেই দেখলেন। বাবা সারাক্ষণ অমলকাকার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাবার মুখ উদ্বেগে ভরা। অমলকাকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘খেতে চাস না কেন? ফুলকি সে কথার জবাব দেয়নি সেদিন। অমলকাকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘খিদে পায় না, নাকি?’ তারপর অনেকক্ষণ ধরে ফুলকির চোখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। চোখে টর্চের আলো ফেলবেন। তারপর বাবাকে একটু ও ঘরে যেতে বললেন। বাবা তৎক্ষণাৎ সে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। অমলকাকার তীব্র চাহনিতে বেজায় অস্বস্তিতে পড়ল ফুলকি। তার বুক কাঁপতে লাগল। সে প্রাণপণে পালাতে চাইল। নিজের কাছ থেকেই পালাতে চেষ্টা করছিল ফুলকি। কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। তাই তার অস্বস্তি। অস্বস্তি অস্বস্তি অস্বস্তি। সেকি অস্বস্তি!

‘তোর কিছুই হয়নি ফুলকি। তোর শরীরে কোনও রোগ নেই। একেবারে সুস্থ তুই। তবে?’

অমলকাকা যা করলেন, ফুলকি বুঝল সেটা ভূমিকা। তার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লাগল।

‘তোর ঘুম তো ভালই হয়?’

ফুলকি বলেছিল, হয় কাকা।

অমলকাকা এবার হেসে ফেললেন। ফুলকির ভিতরকার অস্বস্তি এক মুহূর্তে চলে গেল।

‘ঘুমের জন্য তোকে আর বড়ি খেতে হবে না। কটা আছে তোর কাছে, সব আমাকে দিয়ে দে পাগলি। ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন ছাড়া ঘুমের বড়ি কাছে রাখা আইনত অপরাধ। দে আমাকে।’

ফুলকি চমকে গিয়েছিল। কিন্তু সে এক মুহূর্ত মাত্র। তারপর বিনাবাক্যে একটা শিশি এনে অমলকাকার কাছে দিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অমলকাকা শিশিটা নিয়ে তাঁর ব্যাগের মধ্যে পুরে ফেললেন।

ফুলকি ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা কি জানেন?

অমলকাকা বলেছিলেন, ‘মনে তো হল না। ওঁকে জানানো কি জরুরি?’ ফুলকি দেখল অমলকাকা মিচকি মিচকি হাসছেন। ফুলকি আঁতকে উঠে বলেছিল, না কাকা, না।

‘ঠিক আছে। তুই স্বাভাবিক কাজে কর্মে ঢুকে পড়। মনের চোট ঘরে আটক থেকে সারানো যায় না। তোর এই লেথার্জির কারণ মানসিক অবসাদ। ওটা তোকেই কাটাতে হবে।’

অমলকাকা চলে যাবার পর ফুলকির মন খানিকটা হাল্কা হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা নিতান্তই সাময়িক। ফুলকির মনের তলদেশ থেকে এক একটা বিশ্রী উদ্‌গারের মতো ঘৃণা হিংসা ওঠে আসত। আর সমস্ত মনটা তেতো হয়ে থাকত। একটা অবয়বহীন অভিযোগ সারা মনে এক এক সময় ছড়িয়ে পড়ত। আর বিষণ্নতার গভীর পাথারে ডুবে যেত সে।

.

২৭ অক্টোবর ১৯৪৫।

‘কাল আর আজ এতই বিশ্রী গেল। মনটা একেবারে বিষিয়ে রয়েছে। এতদিন কেন? আমি আর পারছি না। একটা চোখের দেখাও নেই। আর ভাল লাগে না, একটা আশ্রমে আশ্রয় চাই। সংসার থেকে পালিয়ে যেতে চাই। . হা ঈশ্বর, কি অন্যায় ছিল আমার? কোনও অন্যায় ছিল কি? তবে সে ভুলে গেল কেন?- গালিব যা বলেছেন একেবারে তাই—এদিকে আমি—শত সহস্ৰ আর্তনাদ, ওদিকে তুমি—এক পরমাশ্চর্য না শোনা। তাহলে আর রইল কি? তাহলে মৃত্যু আসে না কেন? তাহলে কেন আসে না বিস্মৃতিও? ওহ্ ফর্ দি টাইম হোয়েন্ আই শ্যাল স্লিপ উইদাউট আইডেনটিটি।’

সেদিন অসময়ে তার ঘরে বাবাকে আসতে দেখে খুবই অবাক হয়েছিল ফুলকি। এ সময়টায় বাবার কাছে তার বন্ধুরা আসে। এ সময়টাতে তাঁকে তার চেয়ার থেকে নড়ানো অসম্ভব। এটা ফুলকি জানে। মা বলত, এটা বাবার নেশা করার সময়। একদম বিরক্ত করবিনে বাবাকে। মা মারা যাবার পরেও সেই ট্র্যাডিশন বাবা বজায় রেখে চলেছেন।

বাবাকে দেখে ফুলকি বিছানা ছেড়ে উঠতে গেল। বাবা থাক থাক বলে বারণ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ ফুলকির দিকে চেয়ে রইলেন। . সেদিন বাবার দৃষ্টিটায় কত কীই যে ছিল—প্রসন্নতার অন্তরালে বিষাদ বেদনা অসহায়তা উদ্বেগ…কী না ছিল সেই দৃষ্টিটায়। বাবার এমন দৃষ্টি সে আর আগে কখনও দেখেনি।

‘ফুলকি, শামিম এসেছে।’

অমিতার মনে হল, সমস্ত পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। অমিতা দেখতে পেল বাবা স্থির দৃষ্টিতে ফুলকির দিকে চেয়ে আছেন। আচ্ছা, সেই দৃষ্টিতে কি, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল? ছিল না? সেই সূচীভেদ্য অন্ধকার ঘরে অমিতা তার মুখটা মেঝে থেকে তুলতে চেষ্টা করেছিল কি? যখন তার মনে এই প্রশ্নটা হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ল! অমিতা মনে করতে পারল না। অন্ধকার থেকেও সে কোনও সহায়তা পেল না। কিন্তু কথাটা জানা খুব জরুরি ছিল অমিতার পক্ষে। ফুলকির মনেও কি সেদিন এই প্রশ্নটা দেখা দিয়েছিল? সেটাও মনে করতে পারল না অমিতা। ফুলকির মনে কি আর এ প্রশ্নটা ওঠেনি? নিশ্চয়ই উঠেছিল।

‘শামিম এসেছে ফুলকি।’

ফুলকি ধীরে ধীরে উঠে বসল বিছানায়। সেও অসহায় চোখে চেয়ে থাকল তার বাবার দিকে। শামিম এসেছে, এই বাতাটা তার বাবা যেন কত যুগের ওপার থেকে দিচ্ছেন। তাই ফুলকির মনে এই বার্তায় কোনও সাড়া জাগল না। সে তার বাবার দিকে শুধু তাকিয়ে রইল। ফুলকি যদি তখন আয়নায় মুখটা দেখত, তাহলে দেখতে পেত ‘সেটা মুখ নয়, সেটা মোমের পুতুলের মুখোশ।

বাবার চোখে সেদিন ফুলকি কি কোনও অস্বস্তির ছায়া দেখেছিল? বাবার চোখে ফুলকি কি সেদিন সতর্কতার কোনও ইঙ্গিত দেখেছিল? এ সব খুঁটিনাটি কিছুই মনে করতে পারল না অমিতা।

‘তোকে আজ নামতে হবে না। আমি শামিমকে তোর ঘরেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বাবার প্রথম ঘোষণা যেমন তার ঘরে ভারি স্তব্ধতাকে নামিয়ে এনেছিল, বাবার দ্বিতীয় ঘোষণাও তেমনি ঘরের স্তব্ধতাকে আরও ভারি করে তুলল।

শামিম সাবলীলভাবে তার ঘরে ঢুকল।

‘তোমার বাবা বললেন; তোমার শরীর খারাপ।

স্তব্ধতা। ফুলকি শামিমকে দেখছে। ফুলকি শামিমকে দেখছে না।

‘তোমাকে কতদিন পরে দেখছি ফুলকি। মনে হচ্ছে…’

ঘরে স্তব্ধতা। ফুলকি শামিমের কথা শুনছে। ফুলকি শামিমের কথা শুনছে না।

শামিম কতকগুলো পত্রপত্রিকা এনেছিল। সেগুলো টেবিলের উপর রেখে চেয়ারটা ফুলকির একেবারে কাছে টেনে আনল। শামিম ফুলকির দিকে একটু ঝুঁকে কি বলতে গেল। বাতাসিয়া ঘরে ঢুকতেই সে সোজা হয়ে বসল। বাতাসিয়ার হাতে একটা ট্রে। ট্রেতে শামিমের জন্য চা আর কিছু খাদ্য। ফুলকির জন্য বাতাসিয়া এনেছে দুধ। ট্রে টেবিলের উপর রেখে শামিমের দিকে চেয়ে বাতাসিয়া হাসছিল। ফুলকি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রত্যেকের প্রত্যেকটি কাজ লক্ষ্য করে যাচ্ছিল। ফুলকি এখন এক আদিম নারী। আত্মরক্ষাই যার সহজাত প্রবৃত্তি।

বাতাসিয়া বলে উঠল, ‘আচ্ছা আপনিই বলুন তো শামিমদা, দিদির কোনও অসুখ হয়েছে বলে মনে হয়?’

ফুলকি বাতাসিয়ার কথা শুনছে। ফুলকি বাতাসিয়ার কথা শুনছে না।

‘কাকাবাবু বললেন, তোমার দিদির অসুখ হয়েছে, তাই আমি ভেবেছিলাম, তোমার দিদির অসুখ হয়েছে। কিন্তু দেখে তো তেমন কিছু মনে হচ্ছে না।

ফুলকি শামিমের কথা এবার খানিকটা স্পষ্ট শুনতে পেল। জলে ডুবলে মানুষের কানে যেমন তালা লেগে যায়, কিছু শুনতে পায় না তেমনি তার বাবার ঘোষণা ফুলকির মনে তালা ধরিয়ে দিয়েছিল। সে কিছু শুনতে পারছিল না এতক্ষণ।

বাতাসিয়া বেরিয়ে যেতেই শামিম একটু ঝুঁকে ফুলকির হাতখানা ছুঁয়ে নিল।

‘ফুলকি, তোমাকে সত্যিই তেমন অসুস্থ দেখাচ্ছে না, তবে তোমাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কি হয়েছিল তোমার?’

‘আমি খুব ক্লান্ত শামিম। খাও, ওগুলো খেয়ে নাও।’

শামিম বলেছিল, ‘এ দিকে কি কাণ্ড হয়েছে জানো? শরৎবাবু একটা বিবৃতি দিয়ে বাজার গরম করে দিয়েছেন।

শরৎবাবু? বিবৃতি?

‘তুমি পড়েছো ফুলকি বিবৃতিটা? আমার কাছে কাগজটা আছে। দেখবে!

শামিমের কথা যদিও সেই মুহূর্তে কিছুই বুঝতে পারছিল না ফুলকি, তবুও সে দেখল শামিমের কথা তাকে ধীরে ধীরে অবসাদগ্রস্ত শূন্যতা থেকে মাটিতে নামিয়ে আনতে সাহায্য করছে।

‘তুমি কাগজ টাগজ পড়ছ তো? না কি?’

ফুলকি দেখল শামিম নিজের মধ্যেই বিভোর হয়ে আছে। আর উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। ফুলকি বলতে চাইল, তুমি আমার কোনও খোঁজখবর নাওনি কেন শামিম? কিন্তু বলল না সে।

শামিম বলল, ‘তোমার জন্য একটা আশ্চর্য জিনিস এনেছি, ফুলকি। আমি জানি, তোমার ভাল লাগবে।’

সেই শামিম, যেমন শামিমকে রেখে গিয়েছিল ফুলকি গিরিডি যাবার আগে। কিন্তু গিরিডি যাবার আগে যে ফুলকিকে দেখেছিলে তুমি শামিম, অমিতা বলেছিল, সেই ফুলকিকে তুমি এখন আর দেখছ না। গিরিডির অভিজ্ঞতা ফুলকিকে খানিকটা জ্ঞানী করে তুলেছে শামিম, তা কি তুমি বুঝতে পারছো?

‘এই দ্যাখ, ফুলকি সওগাত পত্রিকা। আমার নানা রাখতেন। আমি সেখান থেকে কয়েকটা পুরানো সংখ্যা নিয়ে এসেছি। এর মধ্যে কয়েকটা মহিলা সওগাতের কপিও আছে। মুসলমানদের মন জানতে গেলে এ পত্রিকাটা পড়তে হবে।’

.

আশালতা, আমি যাকে বিয়ে করেছি, সে মুসলমান। অমিতা বলল, ফুলকি এ কথা আশালতাকে বলেছিল শামিম। আর আশালতা বলেছিল, ছি ছি, তুমি নষ্ট মেয়ে ফুলকিদি। তুমি মোছম্মানের কাছে জাত দিয়েছো। এ সব ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে শামিম। অথচ দ্যাখ, তুমি মনে করছ, সবই সেই গিরিডি যাবার আগের পর্যায়েই আছে। মুসলমান আর মোছম্মান, যোজন প্রমাণ তফাৎ শামিম। শব্দের মধ্য দিয়ে এত ঘৃণা ছড়ান যায়! কিন্তু কি সরল তুমি শামিম! তুমি বুঝতেও পারছ না, তোমার ফুলকি ইতিমধ্যে নরক দর্শন করে এসেছে। তোমার জগৎটা কত সোজা পথে চলে! ফুলকি.এক সময় তোমারই মতো বুঝত যে, এ জগৎটা সোজা পথেই চলে। সে বিশ্বাস করত, ভালবাসার শক্তি সব শক্তির উপরে। এখনও কি ফুলকির সেই বিশ্বাসে নির্ভরতা আছে? অমিতা প্ৰশ্ন করল। হ্যাঁ আছে, নাহলে বেঁচে আছে কেন? শামিম, তোমার সেই বিশ্বাসের জোরটা তেমনই অটুট আছে তো? তবে তুমি কেন কোনও খোঁজ নাওনি আমার? ফুলকি এতক্ষণে গলতে শুরু করল। সে দেখল অভিমানে তার মন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে আবার বাঁচতে লেগেছে তাহলে?

.

শামিম খবরের কাগজটা এগিয়ে ধরে বলল, ‘এটাও রেখে যাব তোমার কাছে। শরৎবাবুর বিবৃতিটা এতে আছে।’

কাগজ টাগজ পড়তে আমার ভাল লাগে না শামিম। তার চাইতে তুমি পড় আমি বরং শুনি।

‘এই বিবৃতিটাতে আমরা এত গুরুত্ব দিচ্ছি এই কারণে যে, আমরা ছাত্ররা আজাদ হিন্দ ফৌজের বীর সেনানী আর পরিবারবর্গকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে চাই। কেন না, আজাদ হিন্দ ফৌজ আজ সারা দেশে একটা প্রতীক হয়ে উঠেছে। হয়েছে ঐক্যের প্রতীক, হয়েছে বিশ্বাসের প্রতীক, হয়েছে আত্মত্যাগের প্রতীক। ইত্তেফাক ইতমাদ কুরবাণী। আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের এই বাণীটাই ছড়িয়ে দিতে চাই সারা দেশে। ফুলকি এ কাজে তোমাকেও চাই।’

শামিমের এই উৎসাহই প্রমাণ করে দেয় যে, বাবা তখনও তাকে কিছু বলেননি। বাবা শামিমকে কি বলবেন বলে ফুলকি আশঙ্কা করছে।

‘কংগ্রেস নেতারা যেটা ভুল করেছেন ফুলকি, সেটা হল আজাদ হিন্দ ফৌজের ইস্যু নিয়ে, তাদের পক্ষ সমর্থন করার জন্য একটা সর্বদলীয় কমিটি করতে পারতেন। সেটা যাঁরা করেননি। আমরা ছাত্ররা সে ত্রুটি শুধরে নেবার চেষ্টা করেছি। ১৮ মির্জাপুরে ছাত্র ফেডারেশনের আফিসে আমরা ছাত্র কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল কালকে গিয়েছিলাম। আলোচনা হল অনেক কিছু। আমরা যুক্ত আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই সংকটের সময়ে নেহরু এক রকম বলছেন শরৎবাবু তার প্রতিবাদ করে কাগজে আরেক রকম বিবৃতি দিচ্ছেন, এটা ভাল দেখায় না ফুলকি? তাই না? এতে আমরা যে ঐক্য গড়ে তুলতে চাইছি, তার মূলেই চোখে লাগবে।’

বাবা কেন শামিমকে তার কাছে পাঠালেন? বাবা কি বুঝতে পেরেছিলেন তার এই অসুখের গোড়ার কারণ হচ্ছে শামিম? বাবা কী ভাবে নিয়েছেন এটা, ফুলকি সেটা জানতে চায়।

‘শরৎবাবুর যে বিবৃতি আনন্দবাজারে বেরিয়েছে ফুলকি, আমি তার থেকেই তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি…’

বাবা যখন তার ঘরে এসে খবর দিলেন যে, শামিম এসেছে, তিনি নিজে এলেন কেন?

‘বোম্বাই এবং বাঙ্গলার আজাদ হিন্দ ফৌজ সাহায্য ভাণ্ডার কমিটি গঠনের কার্যে আমি কিছু অংশ গ্রহণ করিয়াছিলাম বলিয়া পণ্ডিতজীর এই দুইটি বিবৃতির ফলে ভারতীয় জনসাধারণের মনে যদি কোনও ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হইয়া থাকে তাহা দূরীভূত এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকেরা যাহাতে অর্থসংগ্রহ করিতে না পারে, তাহা ব্যর্থ করিবার উদ্দেশ্যে আমি সমস্ত ঘটনা যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করা একান্ত প্রয়োজন বলিয়া বিবেচনা করিতেছি।’

গিরিডির ঘটনার পর থেকেই বাবার কেমন যেন একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। অমিতা জানে ফুলকি প্রথম দিকে সে সম্পর্কে সচেতন ছিল না। সে তখন এতই পীড়িত যে, এ সব ব্যাপারে তেমন নজর দিতে পারেনি।

‘শ্রীসুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে গঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার এবং নরনারীগণের পক্ষ সমর্থনকল্পে সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য ১৯৪৫ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি একটি প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া স্যর তেজবাহাদুর সপ্রু, শ্রীযুত ভুলাভাই দেশাই, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, মিঃ আসফ আলী ও শ্রীযুক্ত রঘুনন্দন শরণকে লইয়া একটি ডিফেন্স কমিটি গঠন করেন।’

তার বাবা যে একটা গভীর যন্ত্রণায় ভুগছেন, এটা ফুলকি মধুপুরে যতই অসুস্থ হয়ে পড়ুক, তখনই ধরতে পেরেছিল। বাবা তার কাছেই থাকতেন সব সময়। ফুলকি দেখত তার বাবা তার মুখের দিকে অপলক চেয়ে আছেন, সে দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা আর অসহায়তা কেমন যেন ফুটে উঠত।

‘ফুলকি, তুমি কি শুনছ না?’

ফুলকি অপ্রস্তুত হল। তাড়াতাড়ি বলে উঠল, শুনছি শামিম। তুমি পড়ে যাও।

শামিম কাগজটা এক পাশে সরিয়ে রেখে ফুলকির হাতটা ধরতে গেল। শামিম তুমি কি লক্ষ্য করেছিলে, ফুলকি তার হাতখানা চট করে সরিয়ে নিয়েছিল। সে বুঝতে পারছিল না, তারই বা কি করা উচিত। শামিম, তুমি এক লহমা ফুলকির মুখের দিকে চেয়েছিল। এক লহমা মাত্র। তারপরেই তুমি হাত বাড়িয়ে ফুলকির হাত দুখানা তোমার হাতের মধ্যে টেনে নিয়েছিলে। ভালই করেছিলে। গিরিডির তিক্ত অভিজ্ঞতা ফুলকির মনের কত গভীরে যে ঢুকে গিয়েছিল সেটা ফুলকি তখনই বুঝতে পারল। ফুলকি যে তোমার সান্নিধ্যে এসেই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, তা কি তোমার নজরে এসেছিল? না, তুমি শরৎবাবুর বিবৃতি নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, এ সব দিকে তোমার তেমন নজর ছিল না।

ফুলকি বলেছিল তার হাতখানা সরিয়ে নিয়ে, তুমি পড়ে যাও শামিম। হাতটা সে সরিয়ে নিয়েছিল বটে কিন্তু তোমার সান্নিধ্য, ওহ্ তুমি কত কাছে শামিম, কতদিন কতদিন পরে, তোমার অস্তিত্বকে ফুলকির মনের গভীরে প্রোথিত করে দিচ্ছিল তাকে সে কোথায় সরাবে শামিম?

‘১৯৪৫ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি যে প্রস্তাব গ্রহণ করেন তাহা পরের দিন অর্থাৎ ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখে নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে উত্থাপিত হয়। নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির অধিবেশনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেন যে, স্যর তেজবাহাদুর সপ্রু, শ্রীযুত ভুলাভাই দেশাই, ডঃ কৈলাসনাথ কাটজু, পণ্ডিত জওহরলাল, শ্রীযুত রঘুনন্দন শরণ ও মিঃ আসফ আলীকে (আহ্বায়ক) লইয়া কংগ্রেস একটি ডিফেন্স কমিটি গঠন করিতেছেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ও নরনারীগণের বিচারের সময় যাহাতে যথোপযুক্তরূপে তাঁহাদের পক্ষ সমর্থন করা হয়—এই কমিটি তাহার ব্যবস্থা করিবেন। ইহাদের পক্ষ সমর্থনের জন্য কিরূপ কার্যক্রম অবলম্বন করা হইবে, তাহা ব্যাখ্যা করিয়া পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু বলেন যে, ডিফেন্স কমিটি আসামীদের অথবা তাঁহাদের আত্মীয়স্বজনের নিকট হইতে আবেদনপত্র আহ্বান করিবেন। এই সমস্ত আবেদন পত্রে আসামীদের পক্ষ সমর্থনের বা তাঁহাদের পরিজনবর্গকে সাহায্য করিবার ব্যবস্থা করিবার জন্য ডিফেন্স কমিটিকে ব্যবস্থা করিবার অনুরোধ করিতে হইবে। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের প্রস্তাবে কিংবা নিখিল ভারত রাষ্ট্রীয় সমিতির ২৩শে সেপ্টেম্বর তারিখের প্রস্তাবে আভাসে ইঙ্গিতে পর্যন্ত এমন কিছুই বলা হয় নাই, যাহা হইতে মনে করা যাইতে পারে যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের লোকজনকে এবং তাঁহাদের পরিজনবর্গকে আর্থিক সাহায্য দানের জন্য কংগ্রেসের ‘একটি সাহায্য কমিটি গঠনের কোনরূপ অভিপ্রায় আছে।’ ফুলকি তোমার কি হয়েছে, বলবে?’

ফুলকি চুপ করে শামিমের দিকে চেয়ে বসে ছিল, সে দৃশ্যটা মনে আছে অমিতার। কিন্তু ফুলকির মনে তখন যে ঝড় বইছিল, তা কি তুমি বুঝতে পারছিলে? সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, শরৎবাবুর বিবৃতির কোনও কথাই তার কানে ঢোকেনি। আসলে তার গোল বেধেছিল তার ঘরে ওই সময় তোমার উপস্থিতি নিয়ে। বাবাই তো তোমাকে ওর ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কেন? এই হিসাবটা কিছুতেই মেলাতে পারছিল না ফুলকি।

ফুলকির সান্নিধ্য তোমাকে ধীরে ধীরে মাতাল করে তুলছিল, সেটা লক্ষ্য করেছিল ফুলকি। তার অসাড় মনের বাঁধ ধীরে ধীরে ভাঙতে লেগেছে, অহল্যা আবার জেগে উঠছে, এ সব সে লক্ষ্য করেছিল। তোমার উপস্থিতির উষ্ণ অস্তিত্বের প্রতি ফুলকি যেমন একটা টান অনুভব করতে শুরু করেছিল আবার, তেমনি এও সত্যি তোমার ওই নিকট সান্নিধ্যে সে বিব্রত হয়েও উঠছিল। সে চাইছিল না, তুমি তার ঘরে আর থাকো। সে বিপন্ন হয়ে উঠছিল। তুমি এ সব লক্ষ্য করেছিলে কি না, অমিতা এখন তা বলতে পারে না। তুমি হাত বাড়িয়ে ফুলকির হাত ধরছিলে বারে বারে। ফুলকি শান্ত ভাবে তা সরিয়ে দিচ্ছিল বারে বারে। তুমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিলে ক্রমশ। ফুলকিকে উপর থেকে যত শান্ত দেখাচ্ছিল, ভিতরে তখন তার তত বেগে ঝড় বইছিল শামিম। সে যেন হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া এক অসহায় জাহাজ তখন, দুরন্ত বেগে ছুটে চলেছে, লক্ষ্যহীন, ডুবো পাহাড় গুঁতো খেলেই ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে। তুমি কি ফুলকির সেই দিনের মনের অবস্থার কিছুমাত্র আভাস পেয়েছিলে? তোমার চোখ দুটোর কাতর ভাষা পড়ে ফুলকি বুঝতে পারছিল শামিম, তুমি তাকে চাইছো, ভীষণ ভাবে চাইছো। সেও তোমাকে চাইছিল শামিম। কিন্তু ফুলকি সেদিন সংযত রেখেছিল নিজেকে। সে জানত, একটু প্রশ্রয় পেলেই সব কিছু ওলট পালট হয়ে যাবে। তুমি এক সময় আর থাকতে না পেরে ফুলকিকে তোমার বুকের মধ্যে টেনে আনতে চেয়েছিলে। ফুলকি ও সেই মুহূর্তে তাই চাইছিল শামিম। বিশ্বাস করো, তোমার বুকের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে ফুলকি চাইছিল অতীতের সব তিক্ত ঘটনা তার মন থেকে মুছে ফেলতে।

সেই গাঢ় অন্ধকারে অমিতা যখন অসহায়ভাবে সেই মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, সেই সময় হঠাৎ আলোর এক ঝলকানিতে অমিতার চোখে তাদের সেবক বৈদ্য স্ট্রিটের বাড়িটা, না.না ফুলকির ঘরটা, স্পষ্ট ভেসে উঠল। একটা কামাতুর যুবক দুই চোখে টানছে একটা যুবতীকে, ক্ষণে ক্ষণে যার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিন্তু সেই যুবতী অপ্রতিরোধ্য সেই আকর্ষণকে প্রাণপণে প্রতিরোধ করে চলেছে।

না, শামিম না। এখন তুমি যাও। তুমি যাও শামিম

‘ফুলকি ফুলকি ফুলকি। এক বার একটি বার এসো।’

শামিম তুমি যে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটা সেদিন পড়তে এসেছিলে, সেই শরৎবাবুর বিবৃতি তখন আনন্দবাজার পত্রিকার পিঠে চেপে পাখার হাওয়ায় ফর ফর করে সারা ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছিল একটা রুগ্ন চামচিকের মতন।

শামিম শেষ পর্যন্ত তুমিই জয়ী হয়েছিলে। তোমার কামনার তাপে ফুলকির সব প্রতিরোধ গলে জল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। ফুলকি সামলে নিয়েছিল সেদিন। সে শুধু বলেছিল, না। চুপ করে বসো। কথা আছে। ফুলকির সেই শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে ভালবাসা ঝরে পড়ছিল। তা তোমাকেও শান্ত করে দিয়েছিল। একটু পরেই দ্যাখ, উত্তেজনা কেমন কমে গেল। একটু পরেই দ্যাখ, সব কেমন সহজ হয়ে এল। অনেক স্বপ্ন সেদিন দেখেছিল তারা।

.

২৯ অক্টোবর ১৯৪৫

‘অবশেষে সহজ পথে আসা গেল। দুজনেরই প্রয়োজন দুজনের কাছে অপরিসীম। অতএব পথ পৃথক হতেই পারে না। এই মূল অসম্ভাব্যতাকে স্বীকার করতেই হল। অতঃপর রইল সহজ জীবন—দুইয়ে মিলে এক আবার একে একে দুই…?’

১১

অমিতা অন্ধকারের সুড়ঙ্গ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করছিল সেইদিনের সেই ফুলকিকে। বুঝতে চেষ্টা করছিল, ওদের অস্বাভাবিক আচরণের কারণ কি ছিল? ওদের মানে বাবার, ফুলকির আর শামিমের। এই তিনজন তখন একটা অসমবাহু ত্রিভুজে যেন পরিণত হয়েছিল। ফুলকি বুঝতে পারছিল না, কোনও কিছু ঘটছে না কেন তাদের বাড়িতে? কেন এত চুপচাপ সবাই? যেন কিছুই ঘটেনি কোথাও। বাবা আর ফুলকি মধুপুর থেকে বাড়িতে ফিরল। যেন কিছুই হয়নি। বাবা যেন ফুলকির অসুখ নিয়েই উদ্বিগ্ন। কলকাতায় তাদের আত্মীয়স্বজন তো কম নেই। তাঁদের আসা যাওয়া, যদিও মায়ের মৃত্যুর পর থেকে কমে আসছিল, প্রায় বন্ধ হয়ে গেল কেন? নিশ্চয়ই গিরিডি থেকে তাঁদের কাছে খবর চলে গিয়েছে। ফুলকির কীর্তিকাহিনীর কথা কি তাঁরা এতদিন জানতে পারেননি? নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছেন। তবে ফুলকির উপর কোনও আঘাত আসছে না কেন? বাবা কি বুক পেতে দিয়েছেন ফুলকিকে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে? যেমন গিরিডিতে দিয়েছিলেন? কিন্তু বাবার এই ব্যবহার কি অস্বাভাবিক নয়? তাঁর মেয়ে তাঁর অনুপস্থিতিতে শামিমের সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, হোটেলে রাত কাটিয়ে এল, এবং সেই ঘটনা বাবা জানলেন তাঁর বউদির কাছ থেকে। বাবা তা সত্ত্বেও কি করে এত শান্ত থাকছেন? ফুলকিকে তিনি কোনও কথাই জিজ্ঞাসা করেননি। কেন? তবে কি বাবার মনে সন্দেহ হয়েছিল যে, জ্যেঠিমণিরা যা বলেছিল, সেটা ঠিক বলেনি? ওরা শুধু শুধু তাঁর মেয়ের নামে কুৎসা রটাচ্ছিল? বাবার কি এই কথা মনে হয়েছিল যে, তাঁর মেয়ে নিরপরাধ? ফুলকি যেভাবে গিরিডিতে জ্যেঠিমণিদের সমস্ত আঘাত ফিরিয়ে দিচ্ছিল, কারোর মনে পা থাকলে সেটা অমন করে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বাবার মনে কি এই রকম কোনও চিন্তা এসেছিল সেদিন? অমিতা জানে সেদিন বাবা কারও অভিযোগে কান দেননি, শুধু স্থিরদৃষ্টিতে ফুলকির মুখের দিকে চেয়েছিলেন। কি দেখছিলেন সেই মুখে? সেখানে কোনও পাপের ছাপ আছে কি না? অমিতাও জানে, সেদিন ফুলকির মুখে কোনও পাপের ছাপ ছিল না।

কারণ, অমিতা জানে, ফুলকি শামিমের ভালবাসাকে সত্য বলেই গ্রহণ করেছিল। না হলে ফুলকি কিছুতেই শামিমের ডাকে অমন করে বেরিয়ে যেত না। সেদিন আত্মীয়স্বজনের কথা তার মনে হয়নি। কাজটা যে অন্যায়, সেটাও তার মনে হয়নি। অমিত সেদিনের ফুলকিকে বোঝবার চেষ্টা করছিল।

ফুলকি, শামিম তোমাকে ডাকল, আর তুমি অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোটেলে রাত কাটিয়ে এলে? তোমার কোনও দ্বিধা সংকোচ ভয়, কিছুই মনে হয়নি?

শামিমের ডাকে সেদিন যে জোর ছিল তাই আমার দ্বিধা সংকোচ ভয়কে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

কিসের জোর ফুলকি? ভালবাসার?

সত্যের জোর। আমাদের সেদিনের ভালবাসা সত্য ছিল।

শামিম তোমার মাথায় এক প্যাকেট সিঁদুর ঢেলে দিল, আর তুমি ভেবে নিলে তোমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান পূর্ণ হয়ে গেল। এটা কি পাগলামি নয়?

না না। সেদিন এটা পাগলামি ছিল না। শামিম সিঁদুর পরিয়ে বরং আমাকে বিব্রত করে তুলেছিল। সেই সিঁদুর নিয়ে আমাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। হোটেলে সব সিঁদুর তুলতেও পারিনি। বাড়ি গিয়ে বাতাসিয়াকে ডেকে শ্যাম্পু করতে হয়েছিল। আমি বাতাসিয়াকে হাসতে হাসতে বলেছিলাম…শম্পামাসির সিঁদুরের কৌটো ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়ে কি কাণ্ড ঘটেছে, এই দ্যাখ বাতাসি। তুলে দে ঘষে ঘষে। সিঁদুর একটা বড় ব্যাপার ছিল না সেদিন। আমাদের ভালবাসাই আমাদের মিলিত করেছিল।

সেটাই ছিল সত্য? এবং এই সত্যের উপর নির্ভর করেই তুমি তোমার ডায়েরিতে লিখেছিলে, উই হ্যাভ টার্নড্ কমপ্লিটলি এ হাজব্যান্ড অ্যান্ড এ ওয়াইফ।

অমিতা বলেছিল, ফুলকি তুমি বোকা হতে পার, তবে তুমি যে সেই ঘটনাকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিলে, সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই। তোমার ডায়েরির এই লেখাই তার প্রমাণ।

জ্যেঠিমণিরা বাবাকে সেই ডায়েরি দাখিল করে বলেছিলেন, তোমার গুণবতী মেয়ে সেই কলঙ্কের প্রমাণও বেখে দিয়েছেন। এই দ্যাখ, ওর ডায়েরিতে সেটা আবার লিখেও রেখেছেন। অমিতা জানে বাবা ডায়েরিটা দেখেননি। ফুলকির ডায়েরিটা দেখেছে বলে বাবা তাঁদের ভর্ৎসনাও করেছিলেন। এইখানেই, বাবার এই ব্যবহারের মধ্যেও অমিতা অস্বাভাবিকতা দেখেছিল। ফুলকি নিজেও বিভ্রান্ত ‘হয়েছিল। বাবাকে তার সমর্থনে অত জোরালোভাবে এগিয়ে আসতে দেখে।

কেন তুমি ফুলকির ডায়েরিটা খুলে দেখলে না? তোমার কি একটুও কৌতূহল হয়নি? তুমি কি সত্যিই জ্যেঠিমণিদের কথা বিশ্বাস করনি? নাকি তুমি ভয় পেয়েছিলে, ওঁরা যা বলছেন সত্যি বলছেন ভেবে? মধুপুরে ফুলকি যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তখন তুমি তাকে কি সেবাযত্নই না করেছিলে! সেদিন তুমি ফুলকির কাছে না থাকলে ফুলকি হয়ত পাগলই হয়ে যেত। সে কথা ফুলকি চিরদিন স্মরণ রেখেছে। সেটা কি তুমি জানতে? তবুও ফুলকি যখন চোখ মেলে তাকাত আর দেখত, তুমি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছ এবং সে দৃষ্টি স্থির, তখন এক অজানা আশঙ্কায় ফুলকির বুক কাঁপতে থাকত। ফুলকি কখনও কখনও দেখেছে, তোমার চোখে ভিজে ভিজে দৃষ্টি। তখন ফুলকির মনে হত, ফুলকির পা, যেন মাটিতে পড়ল। অমিতা জিজ্ঞাসা করল, ফুলকির মুখে তুমি অত কি দেখতে বাবা? ফুলকি নিষ্পাপ কি না তাই? তাই দেখতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে? ফুলকি যখন দেখত তোমার চোখে জল, তখন তার মনে হত, তুমিই তার প্রকৃত আশ্ৰয়। হ্যাঁ বাবা। এমন মনে হত তার। আর পরক্ষণেই সে যন্ত্রণা পেত এই ভেবে, তার বাবা তারজন্য কত হেনস্থা সহ্য করছেন। তার মনে এক ধরনের গ্লানি বোধ দেখা দিত। তা বলে মনে করো না, শামিমকে সে ভালবাসে বলে তার মনে কোনও গ্লানি ছিল।

সেদিনের ফুলকি বুঝতে পারেনি, আজকের অমিতা খানিকটা আন্দাজ করতে পারে, সেদিন তার বাবার মন কিসের দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। একদিকে বাবার সামাজিক সংস্কার আর একদিকে তাঁর মর্যাদাবোধ, এই দুইয়ের ভিতর তখন সংঘাত লেগেছিল। বাবা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। ফুলকিকে নিয়ে তিনি কি করবেন? তাঁর শরীর দ্রুত ভেঙে পড়ছিল। দিদির ব্যাপারটা তাঁকে যে আঘাত দিয়েছিল সেটাই তাঁর পক্ষে হজম করা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। কাউকে তিনি কোনও দিন এ কথা বলেননি। শুধু একটা ঘটনাই ফুলকির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল, বাবা কত অসহায়।

অমিতার চোখ খুলে গিয়েছিল। দিদির যখন মেয়ে হল, ফুলকি দেখতে গিয়েছিল। বাবাকে এ খবর কি দেব না, ফুলকি এই নিয়ে কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। দিদিকে জিজ্ঞাসা করতেই দিদি বলে উঠেছিল, ‘না ফুলকি, খবরদার না।’ কিন্তু দিদির চোখে জল দেখেছিল সেদিন। নিরঞ্জন বলেছিল, ‘উনি তো জানতে পারবেনই ঝুমরি, তুমি ফুলকিকে বারণ করছ কেন?’ দিদি বলেছিল, ‘তুমি মেয়ে হলে এটা বুঝতে।’ একদিন দেরি করেছিল ফুলকি। মাত্র একদিন। থাকতে না পেরে, বাবাকে খাবার সময় খবরটা দিয়েছিল। বাবা একটা ম্লান হাসি মুখে ছড়িয়ে বলেছিলেন, ‘বাসি খবর দিচ্ছিস ফুলকি। হরিকিশোর আমাকে খবরটা দিয়েছে। তারপর তিনি আর উচ্চবাচ্য করেননি। হ্যাঁ, একটা আশ্চর্য মন্তব্য বাবা করেছিলেন। ‘ফুলকি, পারিয়া, জানিস, জানিস ফুলকি, পারিয়া কাকে বলে? পারিয়া হল অস্পৃশ্য। দাক্ষিণাত্যে তাদের গলায় ঘণ্টা বেঁধে পথ চলতে হয়। কুষ্ঠরোগীদের তবুও কিছু সম্মান দেওয়া হয়। কিন্তু পারিয়াদের তাও দেওয়া হয় না।’ একটু থেমে বাবা বলেছিলেন, ‘ঝুমরির কাছে তার বাবা আজ পারিয়া হয়ে উঠেছে।’ বাবাকে দিদির বোধ হয় এই শেষ আঘাত। কিন্তু না। আরও একটু ছিল। পরমেশ্বরকাকাকে দিয়ে বাবা একটা রুপোর বাটি আর একটা ঝিনুক দিদির মেয়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন। মায়ের আমল থেকেই এই রেওয়াজ আমাদের পরিবারে চলে আসছিল, নিকট আত্মীয়স্বজনের কারও সন্তান হলে রুপোর বাটি আর রুপোর ঝিনুক দিয়ে তার মুখ দেখা হত। দিদি রুপোর ঝিনুক-বাটি পরমেশ্বরকাকার হাতেই ফেরত পাঠিয়েছিল। পরমেশ্বরকাকা বাড়িতে এসে কেঁদে ফেলেছিল। বাবা পাথর হয়ে গিয়েছিলেন বোধ হয় সেদিন। নিরঞ্জন বলেছিল, ‘ফুলকি, ঝুমরি যে এতটা কঠোর হবে, আমি তা ভাবতে পারিনি।’ অমিতার যখন খোকা হল, বাবা তখন শয্যাশায়ী। পরমেশ্বরকাকাকে দিয়ে খোকার জন্য রুপোর বাটি-ঝিনুক বাবা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। অমিতা সেটা নিয়েছিল। সমীরেন্দ্র নাটক করতে গিয়েছিল। অমিতা শোনেনি। সারা জীবন সমীরেন্দ্র ওই রুপোর ঝিনুক-বাটি নিয়ে তাকে খোঁটা দিয়ে এসেছে। ‘তুমি সব ছেড়ে এলে অমিতা, আর এই রুপোর বাটির আদিখ্যেতাটা ছাড়তে পারলে না! আশ্চর্য তোমার পাতি বুর্জোয়া লোভ! অমিতা সমীরেন্দ্রকে বলেছিল, তুমি মেয়ে হলে সেটা বুঝতে।

খোকার রুপোর বাটি-ঝিনুক মন্টুর মা চুরি করেছে। আবার তাই নিয়ে কত চোপা করে গেল। আমি পুলিশে দেব মন্টুর মাকে। সেই অন্ধকারে ভিজে মেঝে থেকে উঠবার চেষ্টা করতে করতে অমিতা এই প্রতিজ্ঞা নিল।

বাবা, তুমি তো ফুলকিকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারতে? দাওনি কেন? কোথায় তোমাব আটকেছিল? এটা কি তোমার পক্ষে অস্বাভাবিক আচরণ নয়? তোমার কি মনে হয়েছিল যে, তোমার সামাজিক সংস্কার তোমার পারিবারিক মর্যাদার উপর বড় বেশি হস্তক্ষেপ করছে? এই রকম কোনও ধারণাবশতই কি তুমি ফুলকি সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলে না? আর তার জন্য নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করেছিলে তুমি? দিদিই কি সেইদিন তোমার হাত চেপে ধরেছিল? বল না বাবা? আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে। এমন অস্বাভাবিক আচরণ তুমি আরও করেছিলে বাবা। সেটা এমন কি ফুলকিকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। তুমি শামিমকে ফুলকির কাছে পাঠিয়েছিলে। কেন? তুমি কি তবে এই ধরে নিয়েছিলে যে, ফুলকি যেটাকে সত্য বলে মনে করেছে, তাতে কোনও অন্যায় থাকতে পারে না। তাই কি? তবে মধুপুর থেকে ফিরে তুমি ফুলকিকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলছিলে কেন? কেন তুমি তাকে একটা কথাও জিজ্ঞাসা করনি? এটাকে কি তুমি তোমার পক্ষে মর্যাদাহানিকর বলে মনে করেছিলে? নাকি মেয়েদের ব্যাপারে কোনও কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলে? অমিতা সেই অন্ধকারে ততক্ষণে উঠে বসেছে। সে যেন এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেছে। এইটুকু পরিশ্রমেই সে কাতর হয়ে পড়ল। কিন্তু মন থেকে সে তাগিদ অনুভব করল তাকে উঠতেই হবে। বাবা, সেই অন্ধকারে সে বিড়বিড় করে বলতে থাকল, বাবা, তুমি তখন একটা সিদ্ধান্ত যদি নিয়েই ফেলতে, তাহলেই ভাল করতে। তুমি যদি ফুলকিকে তাড়িয়ে দিতে তবে ফুলকিও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারত। শামিমকে সে বিয়ে করতে পারত। হ্যাঁ বাবা, তখন এটা খুব সহজেই হতে পারত। কিন্তু তুমি তখন দোটানায় ছিলে, ফুলকিও তখন দোটানায় পড়েছিল। আসলে সে নিজের থেকে তোমাকে ছাড়তে পারছিল না। সে তো তখন জানে না যে, শামিমও আমাদের মতো দোটানায় ভুগছে। তারই কারণে ফুলকি তার বাবার বাড়িতে আশ্রয় হারিয়েছে, এই সত্যটা শামিমকে পীড়িত করে তুলত। শামিম এসে তার পাশে দাঁড়াত। দাঁড়াতই বাবা। অমিতা মেঝে থেকে উঠতে চেষ্টা করল। প্রথমবার পারল না। তার হাঁটু তার সঙ্গে অসহযোগিতা করেছিল। দু একবার চেষ্টা করেছিল সে। একটা কিছু যদি আঁকড়ে ধরতে পারত, তবে সে উঠে পড়তে পারত। খাটটা কোথায় সে ঠাহর করতে পারছিল না। দিদি হলে, দিদি এই অবস্থায় পড়লে, ঠিক উঠে যেত। দিদি কখনও কারও উপর নির্ভর করেনি। কিন্তু সে তো অমিতা। দিদি নয়। তাই অমিতার আঁকড়ে ধরার কিছু চাই।

এই সময় দিদির কাছে ফুলকি যেতে আরম্ভ করেছিল। দিদি বলেছিল, ‘তুই যা করেছিস ফুলকি, এটাই তো স্বাভাবিক। শামিমের সঙ্গে রাত কাটিয়েছিস, এতে আমাদের সমাজে আমাদের পরিবারে মড়া কান্না তো পড়ে যাবেই। এটা তো ওদের চোখে বিদ্রোহ। কিন্তু তুই মাঝ পথে থেমে পড়ছিস কেন? তোরও কি অনুতাপ হচ্ছে?’

আমি বাবার কথা ভাবছি দিদি।

‘তোর সামনে বাবা আর শামিম। একজনকে বেছে নিতে হবে তোকে। যাকেই বেছে নিস, অন্য জন কষ্ট পাবেন। এটা সত্য। শামিমকে তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না কেন?’

শামিমকে বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয় দিদি। এরসঙ্গে বাবার বাঁচা মরার প্রশ্নও জড়িত। আমি বুঝতে পারছিনে কি করব?

‘একটাই তোর কাজ ফুলকি। তোর ভালবাসাকে তুই বেছে নিবি। এতে এতো দ্বিধা কেন? তোর কি ধারণা, বাবা দাঁড়িয়ে থেকে শামিমের সঙ্গে তোর বিয়ে দেবেন?

এই দোটানা ফুলকির জীবনকে হতাশায় ক্রমশ গ্রাস করে ফেলেছিল। হতাশা যেমন, তেমন বিভ্রান্তিও। কোনওখান থেকেই ফুলকি আলো দেখতে পাচ্ছিল না। কেবলই অন্ধকার আর অন্ধকার।

৩ নভেম্বর ১৯৪৫

‘এই একটা মাসে জীবনের স্রোতে কত তরঙ্গ বয়ে গেল। কখনও পর্বতসমান, কখনও শান্ত—আশ্চর্য লাগছে। আর আমি কিছুই লিখি না। অভিজ্ঞতার ভার এত বেশি যে, কলমের ডগা দিয়ে তার কিছুই নামছে না। …সব কিছুর রঙ মুছে যাচ্ছে চোখের সামনে থেকে। সব বিবর্ণ, ফ্যাকাশে। আধুনিক কবিতা নাটক পড়ছি। পেসিমিজমের স্বরূপটা চোখে ফুটে উঠছে আর আমি আরও বেশি করে বিষণ্ণতায় ডুবে যাচ্ছি। কিছু ভাল লাগে না। সবই কেবল মিথ্যা, বিবর্ণ, জৌলুষবিহীন। আমি যেন আর কিছু চাই না, কোনও সুখ নয়, কোনও দুঃখ নয়, কোনও শান্তি নয়, ভালবাসাও যদি হঠাৎ পরিশ্রান্ত হতে থাকে, তবে পৃথিবীতে থাকল কি? কোনও ভ্যালুস্ নেই, আদর্শের কোনও ভিত্তিভূমি নেই—দিস ইজ ওয়েস্ট ল্যান্ড। এই পরিত্যক্ত ভূমি ছেড়ে আমাকে যেতেই হবে। …আমি হঠাৎ বড় হয়ে গেলাম, আবার পাশাপাশি অনেকদিন বাদে সত্যিকার জীবনকে চিনে, দুঃখ প্রেম সব কিছু জেনে, আবার প্রভু তোমার কাছেই ফিরলাম! ‘হ্যাভ ফেইথ্ ইন মি’, আমি তাঁর স্বর প্রাণের বীণায় শুনেছি—বিশ্বাস রাখতেই হবে। এই তো শেষ কথা।’

‘হ্যাভ্ ফেইথ্ ইন্‌ মি।’ বিশ্বাস রাখো। অমিতা দারুণ দুঃসময়েও এই স্বরটা শুনেছে। যে স্বেেরর কথা ফুলকি তাঁর কাঁচা বয়সের ডায়েরির পাতায় উৎকীর্ণ করে রেখেছিল—’আমি তাঁর স্বর প্রাণের বীণায় শুনেছি—বিশ্বাস রাখতেই হবে।’ এই স্বরের উৎস কোথায়? জমাট অন্ধকারের দিকে চেয়ে অমিতা প্রশ্ন করল। এটা কার স্বর? অমিতার জীবন যখন শুকিয়ে আসে, ও যখন মরুভূমির প্রান্তে গিয়ে পড়ে, তখন, তখনই অমিতা দেখেছে এই স্বরটা করুণাধারার মতো এসে হাজির হয়—’হ্যাভ ফেইথ ইন্‌ মি’। কে তুমি? অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অমিতা বিপন্ন পথিকের মতো প্রশ্ন করে, কে তুমি? কোনও উত্তর মেলে না। তবু আশ্চর্য, এই স্ববটা তার জীবনটাকে পথ দেখাতে দেখাতে নিয়ে এসেছে।

কয়েক বছর আগে অমিতা বন্ধে গিয়েছিল কলকাতার ডাক্তারদের পরামর্শে, ভাবা ইস্টিটিউটে। সেবার কি হেমন্ত ছিল? ছিল না? ঠিক মনে পড়ছে না। হেমন্ত! হেমন্তকে দেখলেই অমিতার মনে হত, এই বোধ হয় সেই স্বর যে তার অন্তরে জাগ্রত হয়ে বলে উঠত, ‘হ্যাভ্ ফেইথ্ ইন্‌ মি।’ কি অপূর্ব কণ্ঠস্বরই না ছিল হেমন্তর।

এই সেই জাতের স্বর যার উপর বিশ্বাস রাখা যায়, যার কাছে উজাড় করে সঁপে দেওয়া যায়। অমিতা হাত বাড়াতেই একটা আলমারির নাগাল পেল। আর হাতের কাছে আলমারিটা পেয়ে যেতেই ঝপ করে তার মনে সেই ঘরের মানচিত্রটা পরিষ্কার ফুটে উঠল। সে আলমারির গায়ে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। আলমারিটা ধরে হাঁফাতে লাগল। হাঁটুদুটো ওর শরীরের ভর বইতে পারবে বলে যখন অমিতার বিশ্বাস হল, তখন সে হাত ছেড়ে দিয়ে বিছানার দিকে এগুতে লাগল।

বোম্বাই পৌঁছুতেই অমিতার বন্ধুরা সোজা ছুটল প্যারেলে। শুধু একটা পরিচিত মুখ সেই বন্ধুগোষ্ঠীর মধ্যে না দেখে অমিতা কষ্ট পেল। এই প্রথম বম্বে এল অমিতা, যদিও অনেক বছর পরে, যখন সে বলরাজকে দেখতে পেল না। বলরাজ ছিল তার আই পি টি এ দিনের বন্ধু। প্যারেলে টাটা হাসপাতাল। ওপারে ভাবা ইন্সটিটিউট। সেখানে ‘আইসোটোপ’ ইঞ্জেকশন নিয়ে লিভার স্ক্যান হয়েছিল অমিতার। ফল বের হল—নরম্যাল লিভার। ‘হ্যাভ্ ফেইথ্ ইন্‌ মি 1’ ডাক্তার খুশি। টাটায় রক্ত পরীক্ষা, আনুষঙ্গিক অন্য সব পরীক্ষা সারা হল তিন চার দিন ধরে। টাটা হাসপাতালেই অমিতা ক্যানসার রোগের প্রকৃত চেহারা যেন দেখতে পেল। ওর নিজের বাইরের চেহারায় কোনও পরিবর্তন তখনও আসেনি। কিন্তু এ কোন জগৎ? স্বামী বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে যুবতী স্ত্রীকে শিশুর মতো। এক কালে হয়ত সুন্দরী ছিল, এখন মাথায় একগাছি চুলও নেই। বড় বড় চোখ কিন্তু এখন চুলহীন মাথা, ফোলা ফোলা পা আর রুক্ষ চামড়া ঢাকা বিশীর্ণ শরীর, তবু তাকে বাঁচাবার চেষ্টা ছাড়েনি আপনজন। তেমনি গলার পাশ দিয়ে পুঁটুলির মতো ফুলে আছে ক্যানসারের টিউমারটা, হুইল চেয়ারে করে সেই বুড়োকে তার পরিজনেরা নিয়ে যাচ্ছে সার্জেনের কাছে, একজনের তো সাইনাসে ক্যানসার হওয়ায় নাক আর চোখের তলা ফুলে বীভৎস হয়ে উঠেছে সেই মুখ, তার ছোট ভাই জড়িয়ে ধরে বসে আছে, ছোট ভাইয়ের চোখে সে কি আর্তি সে কি উদ্বেগ, সে কি মমতা, বিড়বিড় করে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে তারচেয়ে অনেক অনেক বড় বয়সী দাদাকে। ‘হ্যাভ ফেইথ ইন্‌ মি।’ আমাতে বিশ্বাস রাখো। এই কথাই কি ছোট ভাই দাদাকে বলতে চাইছে। অমিতা সেদিন তাঁর হাঁটুদুটোর উপর শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছিল, এবং খাটে এসে ধপাস করে বসে পড়েছিল। অমিতা সেদিন সেই টাটা হাসপাতালে সব রোগীর আরোগ্যের জন্য আকুল প্রার্থনা করেছিল, বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। ‘আমি পর্বতগণের দিকে চক্ষু তুলিব, কোথা হইতে আমার সাহায্য আসিবে, সদাপ্রভু হইতে আমার সাহায্য আইসে, তিনি আকাশ ও পৃথিবীর নির্মাণকর্তা। আমিন।’

অমিতা জানে, কেন এই সময় ফুলকি বারবার ‘হ্যাভ্ ফেইথ্ ইন্‌ মি’, এই ধারণাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিল। ফুলকি তার জীবনের কেন্দ্র থেকে বারবার পিছলে পড়ে যাচ্ছিল, সে প্রাণপণে উঠতে চাইছিল, একটা ধরবার কিছু চাইছিল ফুলকি। যেমন অমিতা একটু আগেই আলমারিটা আশ্রয় করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তেমনি ফুলকি চাইছিল একটা বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরতে। তবে কি বাবার উপর ফুলকির আস্থা কমে যাচ্ছিল? তবে কি শামিমের উপর ফুলকির আস্থা কমে যাচ্ছিল?

এই সময়েই আবার ফুলকির শরীরের ক্ষুধা থেকে থেকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছিল। অমিতা সেটা জানে। ফুলকির দেহের দাবি তার রক্ত মাংসকে উথাল পাথাল করে দিচ্ছিল। সে কী যন্ত্রণা! সে কী যন্ত্রণা! সে কী অতৃপ্তি! একটা উপোসী লোককে একদিন ভর পেট খাইয়ে দিয়ে তারপর তার আহারের থালা সরিয়ে নিলে যেমন অবস্থায় পড়ে সে, ফুলকিও সেই অবস্থায় এসে পড়েছিল। দিনে বা রাতে হঠাৎ হঠাৎ ফুলকি কামনার তীব্র কামড়ে অস্থির হয়ে উঠেছিল। বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যেত না। ‘এই পেয়েছি অনল জ্বালা দুঃখ কিছুই নাই’, জীবনমরণেই বোধ হয় গানটা গেয়েছিলেন সায়গল। ফুলকি তখন খুব ছোট। দিদির মুখে গানটা শুনে শুনে সেও তুলে নিয়েছিল। রেডিওতে যখনই গানটা বাজত, ফুলকি তখনই সায়গলের সঙ্গে তার গলা মেলাত। কিন্তু এখন ফুলকি বুঝতে পারছে, কবিটা নিতান্তই আহাম্মক। অনল জ্বালা কাকে বলে সে কিছুই জানেনি। ফুলকি অনল জ্বালাতে নিদারুণ কষ্ট পাচ্ছে। শামিমের প্রতি সে ক্ষপে উঠত এই সময়।

.

৭ নভেম্বর ১৯৪৫।

‘বড় কষ্ট। শ-কে দেখছি। ভাবতেই পারছি না ও আমার নাগালের এত বাইরে, ভাবতেই পারছি না ওর উপর আমার আর বিন্দুমাত্র অধিকার নেই। ও একেবারে আর সকলের মতোই আমার কাছে। কিন্তু আবার কত ক-ত যোজন দূরে! ওর অস্তিত্বটাকে কি সেইভাবেই স্বীকার করে নিতে হবে? কি চাও ঈশ্বর, আমি মরে যাই। হ্যাঁ তাই যাব। এত যন্ত্রণা আমি স্বীকার করে নিতে পারব না। এই ব্যবধানও আমি সহ্য করতে পারব না। এখনও বিশ্বাসে ভর দিয়ে আছি। যেদিন সেটা ভাঙবে, সেদিন হয়ত আত্মহত্যা করতেই হবে। সেদিন হয়ত আত্মহত্যা করব।’

দিদি বলেছিল, অমিতা বেশ মনে করতে পারে, ‘ফুলকি, এ তোর নিজের গড়া কারাগার। এটা ভাঙার সাহস তোর যদি না থাকে তবে তুই তিলে তিলে মরবি। এই কারাগার তোকে ভাঙতেই হবে ফুলকি, যেমন আমি ভেঙেছি। হ্যাভ্ ফেইথ্ ইন মি।’ দিদি বলেছিল, ‘সচেতন মানুষের জন্য সুখ নেই রে ফুলকি। সংগ্রাম আছে। নিরন্তর সংগ্রাম। বাঁধা সড়কে যারা চলতে চায় তারাই সুখের কাঙাল। কিন্তু তোর জন্য তো বাঁধা সড়ক নেই। কোনও সড়কই নেই। তোকে তোর মতো পথ করে নিতে হবে। তবে তুই থেমে পড়ছিস কেন? তোর যিশু কি বাঁধা পথে চলেছিলেন?’ কিন্তু অমিতা জানে, দিদির এই পরামর্শ সেদিন ফুলকি গ্রহণ করতে পারেনি। সে তখন মোহগ্রস্ত। সেদিনের কয়েকটা টুকরো ছবি অমিতার চোখে ভাসে।

ছবি ১। দুপুরে ঘরে শুয়ে বই পড়ছিল ফুলকি। একেবারে শান্ত। মেয়েটা যেন একটা নিস্তরঙ্গ দিঘি। অমিতা ফুলকিকে দেখছিল। হঠাৎ ফুলকির নিঃশ্বাস দ্রুততর হতে লাগল। তার নাক ফুলে ফুলে উঠতে লাগল। কপালে স্বেদ জমতে লাগল। অমিতা দেখছে। ছটফট করতে লাগল ফুলকি। একবার উঠে বসল। আবার শুয়ে পড়ল। অমিতা দেখছে। ফুলকি বালিশটাকে দুহাতে আলিঙ্গন করে চিত হয়ে এবার শুয়ে সেটাকে মষ্টাতে লাগল। ফুলকি থর থর করে কাঁপছে। যেন জ্বর এসেছে। ফুলকির বুক ফুলে উঠছে। বালিশটাকে নিয়ে এ পাশ ওপাশ করছে ফুলকি। বালিশটা মুহূর্তে শামিম হয়ে গেল। ফুলকি বালিশটাকে নিয়ে বিছানায় এ পাশ ও পাশ করতে লাগল। তারপর এক সময় পাগলের মতো ফুলকি শামিমের মুখে চুমু খেতে লাগল। অমিতা দেখছে। ফুলকির চোখ একেবারে বিস্ফারিত। চোখের মণি দুটো জ্বল জ্বল করতে লাগল। ফুলকি কেবলই বলে চলেছে, শামিম শামিম শামিম শামিম। অমিতা যেন সেই কথা শুনতে পেল। আর পারিনে আর পারিনে শামিম। তুমি কোন অপরাধে আমাকে ত্যাগ করলে শামিম। ফুলকি চুমু খাচ্ছে। অমিতা দেখছে।

ছবি ২। রাতে ফুলকি আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। অমিতা দেখছে। কিছুক্ষণ এ পাশ ও পাশ করতে লাগল বিছানায়। দিনের বেলার কাতরতা ফুলকির মুখে চোখে ফুটে উঠল। ফুলকি বিছানার উপরে উঠে বসল। অমিতা দেখছে। হঠাৎ ফুলকি এক টানে বুকের উপর থেকে কাপড়টাকে সরিয়ে দিল। ব্লাউজের বোতামগুলো পট পট করে খুলতে লাগল। ব্লাউজ খুলে ফেলল ফুলকি। অমিতা দেখছে। ভেতরের জামাটা খুলতে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল ফুলকি। তারপর একটানে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। কাপড়টাও খুলে ফেলল ফুলকি। অমিতা দেখছে। ফুলকির দেহে এখন শুধু সায়া। আর কিছুই নেই। ফুলকি বিছানায় শুয়ে পড়ল। নগ্ন স্তনে হাত রেখে ফুলকি অস্ফুট আর্ত স্বরে ডেকে উঠল শামিম। সেই অন্ধকারে অমিতা দেখল শামিমের ছায়া এসে ফুলকিকে একেবারে ঢেকে দিল। ফুলকি গোঙাচ্ছে তখন, শামিম শামিম শামিম।

ছবি ৩। ভোর বেলা। ফুলকি ঘুমাচ্ছে। মুখে চোখে তার কোনও যন্ত্রণার লেশ নেই। তার মুখে এখন সুখ উপছে পড়ছে। তার মুখে এখন অঢেল তৃপ্তি। অমিতা দেখছে। পাশ ফিরে শুয়ে আছে ফুলকি। তার হাতখানা এমন ভাবে বালিশের উপর ফেলা, সে যেন শামিমকে জড়িয়ে শুয়ে আছে।

অমিতা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। মন্টুর মা আস্তে ঘরে ঢুকল। দেখল অমিতার মুখখানা ভোরের আলোয় কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে। এ যেন বুড়ির মুখটাই নয়, এ মুখটা যেন দেওয়ালের ছবিটা থেকে নেমে এসে বুড়ির মুখের উপর সেঁটে গিয়েছে। খুটখাট শব্দ শুনেই অমিতার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ না খুলেই, চোখে সে তখনও সেই স্বপ্নটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছিল, অমিতা বলল, মন্টুর মা, রুপোর বাটি…

মন্টুর মা বলল, ‘সে বাটি তো আলমারির মধ্যেই রয়েছে। কাল দেখে গিয়েছি। শুধু শুধু ঝগড়াটা করলে কেন? হাঁ গা মা, চা খাবে? করে দেব?’

মন্টুর মা দেখল, অমিতা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

১২

বাবার বৈঠকখানা ওরা যখন সবাই আলোচনায় ব্যস্ত তখন ফুলকি নেমে গেল সেখানে। অনেকদিন পরে বাবার চেম্বারে ঢুকল ফুলকি। প্রথম ওকে কেউ খেয়াল করেনি। শামিম উৎসাহভরে বলে যাচ্ছিল, ‘নেহরু বলেছেন, আই এন এ বিচার জনমনে সাড়া জাগিয়েছে। আমি যেখানে গিয়েছি…

তায়েবকাকাই ফুলকিকে প্রথমে দেখেন। ‘এসো মা এসো। এখন শরীরটা ভাল বোধ করছ তো।’

হঠাৎ সবাই ফুলকির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। ফুলকি একটু বিব্রত বোধ করল। সে তায়েবকাকার কাছে গিয়ে তার পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল! শামিম তার দিকে একবার চেয়েই সুধাকরবাবুর উপর চোখ রাখল।

‘এখন শরীরে একটু ফূর্তি এসেছে মা।’

তায়েবকাকার কথার উত্তরে ফুলকি শুধু ঘাড় নেড়ে দিল।

বাবাই ওকে বাঁচিয়ে দিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, নেহরু কি বলেছেন, শামিম?’

শামিম বলল, ‘নেহরু বলেছেন, আমি যেখানে গিয়েছি, এমন কি সুদূর গ্রামেও, আই এন এ সম্পর্কে লোকে উদ্বিগ্নভাবে খোঁজ খবর নিয়েছে। এই সব সাহসী মানুষদের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি রয়েছে, এবং সবাই, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, তাদের মামলা লড়ার জন্য সাহায্য করেছে। … ভারতের ইতিহাসে এর আগে কখনও জনগণের বিভিন্ন এবং বিচিত্র অংশগুলোর মধ্যে এমন ঐক্যবদ্ধ আবেগ দেখা দেয়নি।’ শামিমের চোখ দুটো উৎসাহে চকচক করছিল। ফুলকি শামিমের উৎসাহ দেখে কেমন অবাক হয়ে গেল। ও কি জানে, ও কি জানে, কী যন্ত্রণায় আমি ভুগছি?

‘আই এন এ মামলার এটাই একমাত্র অবদান নয়, কাকাবাবু! নেহরু আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, এতদিন সরকার নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী ও জনমতের মধ্যে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ছিল, সেটা এবার ভেঙে পড়েছে। …আজাদ হিন্দ ফৌজের এই বিচার দুই পক্ষকে কাছাকাছি এনে দিয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকারি সেনাবাহিনীও দেশের আশা-আকাঙ্ক্ষার অংশীদার।’ শামিম বলে উঠল, ‘আপনারা যা চাইছিলেন, তাই হল কাকাবাবু।’

.

সুধাকর বললেন, ‘বুঝলে তায়েব, এবার বলটা পলিটিশিয়ানদের কোর্টে চলে গেল। আইনের হাত যেখানে পৌঁছতে পারবে না, জনতার হাত সেখানে পৌঁছবে।’

শামিম বলল, ‘শরৎবাবু বলেছিলেন, আই এন এ-র যে স্পিরিট হিন্দু-মুসলমানে কোনও পার্থক্য দেখে না, যেমন দেখে না এক শ্রেণীর থেকে অপর শ্রেণীর, এক জাতি থেকে অপর জাতির, এক ধর্ম থেকে অপর ধর্মের, তা আমাদের সকলের পথকে আলোকিত করেছে। শরৎবাবু যথার্থ কথা বলেছেন। দেখুন কাকাবাবু আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলার দারুণ ইম্প্যাক্ট পড়েছে ছাত্রদের মনে। মুসলিম লিগও নেমে পড়েছে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সমর্থনে। এই ঐক্যটা বজায় রাখাই সকলের কাজ।’

তায়েবকাকা বললেন, ‘বাপ শামিম, তুমি যা কথা বলছ, সেটা তোমাদেরই উপযুক্ত কথা। কিন্তু আমরা তো ঘর পোড়া গোরু। আমাদের মনটা অত সহজে নেচে ওঠে না। হিন্দু-মুলসমানে ঐক্য না হলে কিছুই হবে না। এমন কি হিন্দুর সম্মতি ছাড়া পাকিস্তানও হবে না। সবাই আমরা এ কথা জানি। তবু হিন্দু-মুসলমান এক হতে পারছে না কেন? এটা কি গভীরভাবে তোমাদের ভেবে দেখা উচিত নয়?’

শামিম কি বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তায়েবকাকা বলে উঠলেন, ‘শামিম, বাপ, আই এন এ ‘স্পিরিট’কে অশ্রদ্ধা করছিনে, শরৎবাবু আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে যা বলেছেন, সেটাও ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ইতিহাসের বিশ্লেষণ যদি ঠিকভাবে করতে আমরা না পারি, তবে শুধু আই.এন এ স্পিরিট আমাদের সকলের পথকে আলোকিত করবে কি না, বলতে পারছিনে।’

শামিম বলল, ‘চাচা, আপনারা মুরুব্বি লোক, আপনারা অনেক কিছু দেখেছেন, অনেক কিছু জানেনও। তবু কি আপনার মনে হয় না যে, আমাদের একটা স্টার্টিং পয়েন্ট থাকা দরবার। আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলা আমাদের স্টার্টিং পয়েন্ট।’

আচ্ছা শামিম, তোমার কি এর মধ্যে আমার কথা একবারও মনে হয়নি? একবারও আমাকে মনে পড়েনি? কাছে আসতে একবারও ইচ্ছে হয়নি? একবারও না?

তায়েব বললেন, ‘শামিম, বাপ, উত্তেজনা উন্মাদনা স্টার্টিং পয়েন্ট না হওয়াই ভাল। ইতিহাসের সঠিক বিশ্লেষণই আমাদের স্টার্টিং পয়েন্ট হওয়া উচিত। হিন্দু-মুসলমানের মনের খবর না জানলে, বুঝবে কি করে, কোথায় এসে সব পয়মাল হচ্ছে??

তারপর অনেক রাত ধরে সেদিন তায়েবকাকা অদ্ভুত এক কাহিনী বলে গেলেন। ফুলকি যে ফুলকি, রাজনীতিতে যে আগ্রহ বোধ করে না, সেও মনোযোগ দিতে বাধ্য হল।

তায়েব বললেন, ‘এই বিশ্লেষণ খানিকটা আমার আর খানিকটা আমার বন্ধু মনসুরের।’

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ হল। বাংলার মুসলমান বঙ্গভঙ্গকে আশীর্বাদ বলে ভেবেছিল, বাংলার হিন্দুরা ওটাকে নিয়েছিল, অভিশাপ হিসাবে। এই শতকৈ হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের সেই শুরু। ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের পত্তন হল এই বাংলায়, ঢাকায়, আসান মঞ্জিলে। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হল। ব্রিটিশের সেটেলড ফ্যাট্ বাংলার হিন্দু আনসেটেড্ করে দিল। ১৯১৬ সালের লখনৌ প্যাকট, ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাকট, ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস অধিবেশন থেকে ওয়াক আউট, ১৯২৯ সালে সর্বদলীয় মুসলিম কনফারেন্সে জিন্নার চোদ্দো দফা আলোচনা, ১৯৩০-৩৩ সালের গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান, এইসব ঘটনার মধ্যে দেখা যায়, মুসলমানরা একটা কথা বলতে চেয়েছে। তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-ধারার একটা সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু তৎকালীন হিন্দু নেতারা এটাকে গ্রাহ্যই করেননি। কত বেদনার কাহিনী এর মধ্যে আছে, হিন্দু নেতারা সেটা আমল দিতেই চাননি। বাঙালির রাজনীতিতে প্রজা আন্দোলন, তার স্বরূপ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টা, তাঁর হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জন্য বেঙ্গল প্যাক্ট, কলকাতা কর্পোরেশনে তার প্রয়োগ শুরু, দেশবন্ধুর আকস্মিক মৃত্যু, কংগ্রেসের প্রজাস্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ, ডেপুটি মেয়র শহীদ সোহ্রাবর্দীকে মেয়রের পদে বঞ্চিত করা, বেঙ্গল প্যাক্‌ট বাতিল, মুসলমানদের কংগ্রেস ত্যাগ, প্রজা সমিতি গঠন, এর প্রত্যেকটার পিছনেই আছে বেদনার ইতিহাস। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধী তাঁর ইয়ং ইণ্ডিয়া পত্রিকায় ‘লিখেছিলেন : হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ছাড়া ভারতের মুক্তি হতে পারে না। তাই তিনি খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মিঃ জিন্নার মতো মুসলিম নেতা খিলাফত আন্দোলনকে ভ্রানত ও বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় আন্দোলন বলে ঘোষণা করে ওই আন্দোলনকে ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় আন্দোলন বলে ঘোষণা করে ওই আন্দোলনে যোগ দেননি। সেখানে গান্ধির নেতৃত্বে হিন্দু-নেতৃবৃন্দ খিলাফতকে নিজেদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলেন। কেন? কারণ এঁরা সত্যি সত্যি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য জাতীয় স্বাধীনতার পক্ষে জরুরি বলে বিশ্বাস করেছিলেন। গান্ধিজীর আগে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলেছিলেন, গোখলে আর দাদাভাই নৌরজি। মিঃ জিন্নাও বলেছিলেন হিন্দু মুসলিম একতা ছাড়া ভারতের মুক্তি নাই। জিন্নার এই উক্তির জন্য সরোজিনী নাইডু জিন্নাকে বলেছিলেন, জিন্না হচ্ছেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের দূত। তবে যে যাই বলুন, এই সদিচ্ছাটা কাগজে কলমেই ছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনই প্রথম এই সদিচ্ছাটা কাজে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করেছিলেন। বেঙ্গল প্যাকট এই প্রচেষ্টারই ফল। কিন্তু নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধতায় দেশবন্ধুর অল্পকালস্থায়ী জীবনে সেটা সফল হয়নি। তাঁর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুর পর দেশবন্ধুর অনুগামী বাংলার হিন্দু নেতারাই দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাকট বাতিল করে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সারিতে ‘অখণ্ড ভারত’ গড়ার দাবিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন।

তায়েব বললেন, ‘এখানে আমাদের দেশবন্ধুর কথা আবার বলতে হয়। কারণ লোকে তাঁর নামে যতটা গদগদ হয়, আমি দেখেছি, তাঁকে ততটা বোঝে না। দেশবন্ধু স্বরাজ আর জাতীয়তাবাদের মধ্যে যথেষ্ট তফাত করতেন। তাই তো সুধাকর?’

বাবা বললেন, ‘দেশবন্ধুর একতার মূলে ছিল, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে। নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান। দেশবন্ধু আমাদের কতদিন বলেছেন, ভারতকে যদি এক রাখতে হয়, তবে তার মিলনের মন্ত্রটা হবে এই। স্বরাজেরও সুর এই ছিল তায়েব।’

‘হ্যাঁ সুধাকর। উনি কোনও জিনিস, অন্য নেতাদের মতো ধোঁয়াটে রাখতে চাইতেন না। উনি স্বরাজ কথাটা যখনই বলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের একথাও মনে করে দিয়েছেন, পাওয়ার টু দি পিল। জনগনের হাতে ক্ষমতা, এই হচ্ছে দেশবন্ধুর স্বরাজ। গয়া কংগ্রেসে দেশবন্ধু জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে যা বলেছিলেন, তোমার সেটা মনে আছে সুধাকর?’

‘আছে বই কি তায়েব?’ বাবা চোখ বুজে বলতে শুরু করলেন, ‘দি ন্যাশনালিটি অফ্ হুইচ্ আই অ্যাম স্পিকিং মাস্ট নট্ বি কনফিউজড্ উইথ্ দি কনসেপশন অফ্ ন্যাশনালিটি অ্যাজ ইট্‌ একজিস্ ইন্ ইওরোপ টু ডে। ন্যাশনালিজম্ ইন ইওরোপ ইজ্ অ্যান্ অ্যাগ্রেসিভ্ ন্যাশনালিজম, এ সেলফিশ্ ন্যাশনালিজম্, এ কমার্শিয়াল ন্যাশনালিজম্, অফ্ গেইন অ্যান্ড লস্। দি গেইন্‌ অফ্ ফ্রান্স ইজ্ দি লস্ অফ জার্মানি অ্যান্ড দি গেইন অফ জার্মানি ইজ দি লস অফ ফ্রান্স। দেয়ার ফোর, ফ্রেঞ্চ ন্যাশনালিজম ইজ্ নারচারড অন দি হেডে অফ্ জার্মানি, অ্যান্ড জার্মান ন্যাশনালিজম ইজ নারচারড অন দি হেডে অফ্ ফ্রান্স।’ বাবা ফুলকির দিকে চেয়ে বলতে লাগলেন, যেন তিনিই এই কথাগুলো বলছেন, ‘যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ঘৃণা ও বিদ্বেষ দেশবন্ধু খারিজ করেছেন। তাঁর কাছে পেট্রিয়ট্রিজম আর ন্যাশনালিজম ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জিনিস। স্বরাজের ভিত্তি হচ্ছে পেট্রিয়টিজম। দেশকে ভালবাসা। স্বরাজের ভিত্তি ‘ভালবাসা। তাই তিনি বারবার সতর্ক করেছেন আমাদের এই বলে, আমি যে জাতীয়তাবাদের কথা এখানে বলছি তারসঙ্গে যেন ইওরোপে আজ যে জাতীয়তাবাদ টিকে আছে, তার সঙ্গে যেন গুলিয়ে ফেলা না হয়। ইওরোপের জাতীয়তাবাদ আগ্রাসী জাতিবাদ, স্বার্থসর্বস্ব জাতিবাদ, বেনেদের জাতিবাদ, যেখানে বিচার্য শুধু লাভ আর লোকসান। ফ্রান্সের যাতে লাভ, জার্মানির তাতে লোকসান। আবার জার্মানির যাতে লাভ, ফ্রান্সের তাতে লোকসান। কাজেই, ফরাসি জাতিবাদ দাঁড়িয়ে আছে জার্মানির প্রতি ঘৃণার উপর, এবং জার্মান জাতিবাদ দাঁড়িয়ে আছে ফ্রান্সের প্রতি ঘৃণার উপর। এই উপলব্ধিটা কারও মনে জাগেনি যে, তুমি মানবতাকে আঘাত না করে কিছুতেই জার্মানিকে আঘাত করতে পার না। তুমি যদি ফ্রান্সকে আঘাত কর তবে তুমি সেই সঙ্গে মানবতাকেও আঘাত করছ। এই হল ইওরোপীয় জাতীয়তাবাদ বা জাতিবাদ। আমি এই জাতীয়তাবাদের কথা আজ বলতে আসিনি.। আমি বলতে চাই যে প্রত্যেক ধরনের জাতিবাদের মধ্যে একটা বিশেষ ধরনের ঐক্য আছে, এই ঐক্য হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের ঐক্য, অর্থাৎ মানবতায় পৌঁছানো, কিন্তু কোনও জাতিই যতক্ষণ না ‘নিজে’ হয়ে উঠতে পারে এবং সেই সঙ্গে মানবতার সঙ্গে তার একাত্মতার সম্পর্কটা বুঝতে পারে, ততক্ষণ সেই জাতি সার্থকতায় পৌঁছাতে পারে না।’

‘আমরা জাতি আর নেশন নিয়ে বড় ঝঞ্ঝাটে পড়ে যাই সুধাকর। নেশনের যে সংজ্ঞা সাহেবরা ধার্য করে দিয়েছেন, সেটা হচ্ছে এই : বিশেষ জনগোষ্ঠী বা জনসমষ্টি যারা একই এথনিক উৎস থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যারা একই ভাষায় কথা বলে, যাদের ইতিহাস এক, এবং যাদের রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো একই রকম। এই হল নেশন। এই সংজ্ঞা অনুসারে ভারতকে কি নেশন বলা যায়?’

ভারতকে কি এক নেশন বলা যায়? তায়েবকাকার এই অব্যর্থ প্রশ্নটা ফুলকির ভাবনা চিন্তার উপর যেন মুগুরের ঘা দিল। এবং আশ্চর্য, ফুলকি দেখল, এই প্রশ্নটা তার মনকে তোলপাড় করতে শুরু করেছে এবং যতই তার মনে তোলপাড় চলতে লাগল, ততই সে যেন আবার তার জীবনে ফিরে আসতে শুরু করল।

১০ নভেম্বর ১৯৪৫।

‘নতুন নতুন উপলব্ধি জাগছে। চিন্তার স্রোতে কত নতুন দিগন্তে এসে পড়ছি। কত নতুন সিদ্ধান্তে এগিয়ে এসেছি। নিজেকে আবার ভাল লাগতে শুরু করেছে। এই যে একটা আইডেনটিটি খুঁজে পাওয়া, এই যে আমার অস্তিত্ব বলে আলাদা কিছু আছে, সে সম্পর্কে অবহিত হওয়া, এটা আমার আগে ছিল না। আজ যখন নির্ভরতাকে ছেড়েছি, নিজের পায়ে দাঁড়াতে যাচ্ছি তখনই উপলব্ধি করলাম তখনই যেন নতুন করে জেগে উঠলাম। মনে হল, হঠাৎই মনে হল, ভারতে মুসলমানদের কিছু কথা বলার ছিল, অস্পৃশ্যদেরও কিছু কথা বলার ছিল। এরা বঞ্চিত। কিন্তু ভারতে সব থেকে বঞ্চিত কি নারীরা নয়? এদেরও নিজের কথা নিজে বলা উচিত। তখনই মনে হল, আই অ্যাম্ এ উওম্যান। আমি নারী। সেই নারী যার উপর দিয়ে সব ভোগান্তি যায়। যাকে সব অবিচার সহ্য করতে হয়। আমি নারী, আই ওয়ান টু একজিস্ট্। অ্যান্ড আই নো হোয়ার আই হ্যাভ টু গো।’

১৩

অমিতা সেদিন সকাল থেকে ফুলকির সেই মোটা খাতার পাতা উলটিয়ে দেখছিল। কত কথা ফুলকি যে লিখে রেখেছে তাতে!

‘গান্ধী আমাকে আকৃষ্ট করেন। গান্ধী বলতেই আমি সত্য এবং অহিংসাকে বুঝি। যিশুর পরেই আমার কাছে গান্ধী। যিশু আমার কাছে পুরুষোত্তম না মানবোত্তম। তার পরেই গান্ধী। এঁদের দুজনের মধ্যেই যে মিলটা আমাকে আকৃষ্ট করে, সেটা এঁদের দুঃখ সইবার অসীম ক্ষমতা। যিশু বলেছেন, প্রত্যাঘাত করো না। যিশু বলেছেন, যে তোমাকে আঘাত করবে, তাকে প্রেম করো, তাকে ঘৃণা করো না। গান্ধী বলেছেন, অহিংস হও। কাউকে আঘাত করো না। যে তোমাকে আঘাত করবে, সেটা সহ্য করো। তাকে প্রত্যাঘাত করো না। প্রত্যাঘাত না করলেই তুমি একদিন তোমার আঘাতকারীকে জয় করবে। তার বিবেক জাগ্রত হবে এইভাবেই। বিবেক জাগ্রত হলে সে আর কাউকে আঘাত করতে পারবে না। ফুলকি জানে এটাই গান্ধীজির অহিংসার মূল বাণী বা মর্মবাণী। গান্ধীর সত্য এইটাই। গান্ধীর অহিংসার উৎস কি প্রেম? যিশু যে প্রেমের কথা বলেছেন, সেই প্রেম?’ এইখানটায় ফুলকি ঠিক বুঝতে পারে না। ‘গান্ধীর অহিংসা আর যিশুর প্রেম কি একই জিনিস? আমি ঠিক জানিনে। কিন্তু এটা জানি, ওঁদের দুজনের আচরণের পিছনে যে মন কাজ করেছে সেটা নারীর মন। নারী ছাড়া আর কেই বা এত দুঃখ, এত যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে! পুরুষের জগৎ আগ্রাসী জগৎ। সেটা হিংসার জগৎ। অথচ আমি দেখি যিশু পুরুষ, গান্ধীও পুরুষ। কিন্তু উপলব্ধিতে তাঁরা দুজনেই নারী। তাঁরা দুজনেই নারীর মতোই সাফার করেছেন।’

ফুলকি এটা কবে লিখেছিল? অমিতা কোথাও তারিখ পেল না।

‘গান্ধী আমাকে মুশকিল ফেলেছেন। গান্ধী প্রার্থনা সভায় বলেন, ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম সব কো সম্মতি দে ভগবান। তবে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র হরিলাল সম্পর্কে গান্ধী এমন বিপরীত আচরণ কেন করলেন? হরিলাল ইস্লাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধী তাঁকে ত্যজ্যপুত্র করলেন? যিশুর ক্ষমা ছিল। তবে কি গান্ধীর ক্ষমা ছিল না? হরিলাল যদি গান্ধীর মেয়ে হতেন এবং তিনি যদি কোনও মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করতেন, তাহলে কি গান্ধী বলতেন, আমি ধরে নেব আমার মেয়ে মারা গিয়েছে! আমার বাবা যেমন দিদির বেলায় বলেছিলেন? হয়ত গান্ধী এ কথা বলতেন না। কিন্তু আমার সংশয় জাগছে কেন?’

অমিতা আন্দাজে বুঝল, এই কথা যে সময়ে লেখা, ফুলকি তখন দারুণ দোটানায় পড়েছে। তার একদিকে তখন বাবা এবং অন্যদিকে শামিম। ফুলকি জানত, বাবার শরীরের এখন যা অবস্থা, এই অবস্থায় বাবাকে সে ছেড়ে গেলে বাবা বাঁচবেন না। ফুলকি সত্যিই সেদিন এই কথা বিশ্বাস করেছিল। ফুলকির তখন আবার এমন অবস্থা, শামিমকে ছাড়া সে বাঁচবে না। এই সে ভেবেছিল সেদিন।

শুধু ফুলকির ব্যক্তিগত জীবনেই নয়, তার বাবার পারিবারিক জীবনেও নয়, অমিতা বেশ মনে করতে পারে, দেশের জীবনেও তখন একটা উত্তেজনা পাকিয়ে উঠছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের মামলাকে কেন্দ্র করে কলকাতার আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। ফুলকি অবাক হয়ে দেখছিল যে, শামিমকে এই উত্তেজনা ফুলকির কাছ থেকে ক্রমশ সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন বাবাদের ওখানে রোজ তর্কবিতর্ক হচ্ছে। নানা লোক আসছেন। শামিম বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, আজাদ হিন্দ স্পিরিট হিন্দু-মুসলমানের বিভেদ ঘুচিয়ে দিতে পারবে। এই সময় বাবাদের বৈঠকে নিয়মিত যেত ফুলকি। শামিমকে, তার উপস্থিতির দ্বারা, এই কথাটা বোঝাতে যে, সেই মেয়েটার অস্তিত্ব মুছে যায়নি। তার মনে শামিমের কারণে যে নিদারুণ কষ্টটা হত, ফুলকি সেটাকে লাঘব করার জন্যই মুখ্যত বাবাদের বৈঠকে যোগ দিতে শুরু করেছিল। এবং ভাগ্যিস সেখানে গিয়ে বসতে লেগেছিল ফুলকি, তাই তো এমন একটা অজানা ইতিহাস তার জানা হয়ে গেল। বাবার ওখানে তায়েবকাকা হরিকিশোর মেসো তো আসতেনই, কয়েকদিন তায়েবকাকার বন্ধু মনসুরও এসেছিলেন। এমন কি, হাসেম সাহেবও। দেশবন্ধুর কথা তায়েবকাকা আর মনসুর বলতেন। ওঁদের সকলের কথা শুনতে শুনতে ফুলকির মনে দেশবন্ধু সম্বন্ধে এমন একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, যার সঙ্গে তার আগের বাবার মিল খুঁজে পেত, কখনও বা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর মিল পেত, কখনও বা যিশুর সঙ্গে। দেশবন্ধু যদি থাকতেন, তবে বোধ হয়, তার সঙ্গে শামিমের বিয়েটা দিয়ে দিতেন।

দেশবন্ধু কেমন ছিলেন তায়েবকাকা?

‘এমন সর্বত্যাগী মানুষ আমি দেখিনি মা। সি আর দাশ বা দাশ সাহেব কেমন ছিলেন, ঠিক বলতে পারব না তোকে। শুনেছি, প্যারিস থেকে উনি কাপড় ধুইয়ে আনতেন। এই সব হ্যান ত্যান তাঁর নামে রটেছিল। প্যারিসের ধোপা আমাদের ধোপার চাইতে ভাল কাপড় কাচে, বোধ হয় এটাই প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য ছিল সেই সব লোকের যারা এই গল্পটা রটাত। আমরা দেশবন্ধুকে দেখেছি তখন উনি রাজনীতিতে নেমে এসেছেন। তখন স্বদেশীর যুগ। মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। কত নেতাই তো এই কথা মঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করে গেলেন। কেউ কেউ আবার কোটপ্যান্ট ছেড়ে কাপড় ধরলেন বটে, কিন্তু র‍্যালির কাপড় পর্যন্ত গিয়ে তাঁদের দম ফুরিয়ে গেল। কিন্তু আমাদের নেতার যে কথা সেই কাজ। খদ্দরের মোটা ধুতি খদ্দরের পাঞ্জাবি আর খদ্দরের মোটা চাদর, এই বেশেই আমরা দেশবন্ধুকে দেখেছি। বাসন্তী দেবীও তাই।

মনসুর বলেছিলেন, ‘হিন্দু মুসলিম ঐক্য-চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার কারণ এই যে, ঐক্যবাদী মুসলিম নেতৃত্ব আর ঐক্যবাদী হিন্দু নেতৃত্বের মধ্যে একটা মৌলিক বিরোধ ছিল। মুসলিম নেতৃত্ব চেয়েছিলেন দুই স্বতন্ত্র সত্তার মধ্যে রাজনৈতিক মিলন বা ফেডারেশন। হিন্দু নেতৃত্ব চেয়েছিলেন সার্বিক মিশ্রণ বা ফিউশন। একমাত্র দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনই তাঁর উদার দূরদৃষ্টি বলে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের বাস্তব রূপ দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি হিন্দু মুসলিম ঐক্যের পক্ষে দরদী ভাষায়, প্রাণস্পর্শী বাগ্মীতায় বলেছেন যে, ‘হিন্দু মুসলিম ঐক্য অর্থ সংমিশ্রণ নয়, মিলন। ফিউশন নয়, ফেডারেশন। দুইটি স্বতন্ত্র সত্তাবিশিষ্ট সম্প্রদায় রাজনৈতিক কারণে ও সেই উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হইবে মাত্র। মিশিয়া এক সম্প্রদায় হইয়া উঠিবে না। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অর্থ যদি দুই সম্প্রদায়ের মিশ্রণে এক সম্প্রদায় হওয়ার কথা হইত তবে আমি সে ঐক্যের কথা বলিতাম না।’ সুধাকরবাবু, আপনি ভাল জানেন, যে লোক এমন কথা বলতে পারে তার মনে ভালবাসা থাকা চাই। দেশবন্ধু নিজে ছিলেন বৈষ্ণব। নিজের ধর্মমতে তাঁর আকুল প্রাণভরা আস্থা ছিল। সে আস্থায় কোনও দ্বেষ ছিল না। ছিল শুধু ভালবাসা। তাই স্বদেশবাসী মুসলমান প্রতিবেশীর ধর্মের প্রতিও তাঁর অগাধ আস্থা ছিল। নিজের বাপকে যে সন্তান শ্রদ্ধা করে, পরের বাপের প্রতিও সে কখনও অশ্রদ্ধা দেখাতে পারে না। এটা ছিল দেশবন্ধুর জীবনদর্শন। নিষ্ঠাবান হিন্দু হয়েও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যে কেমন করে আন্তরিক বিশ্বাস করা যায়, দেশবন্ধু ছিলেন তার আদর্শ নিদর্শন। দেশবন্ধুর পরে আমি আর একজন মাত্র বাঙালি হিন্দু নেতার মধ্যে এই গুণ দেখেছি, তিনি হচ্ছেন শরৎ বসু।’

সুধাকর বলেছিলেন, ‘দেখুন, এ রকম ভাবনাচিন্তা যে হয়নি তা নয়। রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির লোক না হলেও হিন্দু মুসলমানের প্রশ্নে অনেক ভেবেছেন। তিনি বলেছেন, আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতির চেষ্টা করিতেছে। তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় হউক এবং তাহাতে আপাতত আমাদের যতই অসুবিধা হউক, একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলনের ইহাই প্রকৃত উপায়।’

বাবা বলেছিলেন, ‘দেশবন্ধুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অনেক বিষয়ে মতবিরোধ ছিল। নারায়ণ পত্রিকায় তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি। রবীন্দ্রনাথকে তখন আমিও তেমন করে বুঝতাম না। তা ছাড়া আমরা ছিলাম পলিটিক্যাল বিয়িং, রবীন্দ্রনাথকে কবি বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু অনুভব করতাম রবীন্দ্রনাথ যা কিছু দেখেন বিশ্বদৃষ্টিতে দেখেন। এই বিশ্বদৃষ্টির পরিচয় আমি দেশবন্ধুর চিন্তার মধ্যেও পেয়েছি। ভারতীয় জাতির প্রকৃত উন্নত নিহিত আছে স্বরাজের মধ্যে। দেশবন্ধু একথাটা বারবার বলতেন। এবং নিজেও তা বিশ্বাস করতেন। স্বরাজ জাতীয় মনেরই প্রকাশ। স্বাতন্ত্র্য বা স্বার্থপরতায় এবং স্বার্থরক্ষায় দোষের কিছু নেই, যদি সেই স্বাতন্ত্র্য, সেই স্বার্থপরতা এবং সেই স্বার্থরক্ষার প্রবৃত্তি আমাদের বিশ্বজনীনতার দিকে নিয়ে যায়, মানবতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এটাই ছিল দেশবন্ধুর কথা। আবার দেখ, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আজ সমস্ত পৃথিবীতেই একদিকে দেখিতেছি প্রত্যেক জাতিই নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতেছে, কোনোমতেই অন্য জাতির সঙ্গে বিলীন হইতে চাহিতেছে না, তখনি দেখিতেছি প্রত্যেক জাতিই আজ বৃহৎ মানব সমাজের সঙ্গে আপনার যোগ অনুভব করিতেছে। সেই অনুভূতির ফলে সেই-সকল বিকট বিশেষত্ব বিসর্জন দিতেছে—যাহা অসঙ্গত অদ্ভূতরূপে তাহার একান্ত নিজের—যাহা সমস্ত মানুষের বুদ্ধিকে রুচিকে ধর্মকে আঘাত করে। যাহা কারাগারে প্রাচীরের মতো, বিশ্বের দিকে বাহির হইবার কোনোপ্রকার পথ নাই। আজ প্রত্যেক জাতিই তাহার নিজের সমস্ত সম্পদকে বিশ্বের বাজারে যাচাই করিবার জন্য আনিতেছে। তাহার নিজত্বকে কেবল তাহার নিজের কাছে চোখ বুজিয়া বড়ো করিয়া তুলিয়া ধরিয়া তাহার কোনো তৃপ্তি নাই, তাহার নিজত্বকে কেবল নিজের ঘরে ঢাক পিটাইয়া ঘোষণা করিয়া তাহার কোনো গৌরব নাই। তাহার নিজত্বকে সমস্ত জগতের অলংকার করিয়া তুলিবে তাহার অন্তরের মধ্যে এই প্রেরণা আসিয়াছে। আজ যে দিন আসিয়াছে, আজ আমরা কেহই গ্রাম্যতাকেই জাতীয়তা বলিয়া অহংকার করিতে পারিব না। …আমরা যে সকল প্রতিষ্ঠানের পত্তন করিতেছি তাহার মধ্যে একই কালে আমাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ এবং বিশ্ববোধ দুই প্রকাশ পাইতেছে।’

‘সুধাকরবাবু’, মনসুর বলেছিলেন, ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ বিশ্ববোধের সঙ্গে মিলুক, মুসলমানেরা, বিশেষত বাংলার জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন কোনও মুসলমানই এতে আপত্তি করেনি। কিন্তু অধিকাংশ হিন্দু নেতাই মুসলমানদের স্বাতন্ত্র্যের দাবিকে তো আমল দিতে চাননি। এ কথা অস্বীকার করা যায় কি? এই সব হিন্দু নেতা হিন্দু মুসলিম দুই সামাজিক পৃথক সত্তা ‘এক দেহে লীন হোক’, এটাই চাইতেন। কিন্তু লীন হয়ে কি হবে, সে সম্পর্কে কোনও পরিষ্কার ধারণাও তাঁদের ছিল না। তাঁরা এ নিয়ে ভেবেছেন, এমন তো দেখিনি। তাঁদের মোদ্দা কথা ছিল, যখন আর্য অনার্য শক হুণ এই ভারতে একাকার হয়ে মিলে গিয়েছে, তখন পাঠান মোগলই বা মিলে যাবে না কেন? তাঁরা সহজ বুঝ বুঝতেন, মুসলমান এ দেশে মাইনরিটি, বিপুল বেগবান হিন্দু সম্প্রদায়ে তারা বিলীন হয়ে যাবে। তাঁদের উপমা ছিল এই : ক্ষুদ্র জলাশয়ের জল মহাসমুদ্রে বিলীন হয়। তাঁদের উদাহরণ ছিল এই : ধর্মে পৃথক হয়েও তো ব্ৰাহ্ম খ্রিস্টান বৌদ্ধ জৈন পার্শি গুর্খা শিখেদের মহান হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত থাকতে বাধেনি, তখন মুসলমানেরই বা বাধবে কেন?’

বাবা বলতেন, ‘হিন্দু সমাজের কাঠামো এত থাকে থাকে বিভক্ত যে, বাইরের সম্প্রদায়কে এই কাঠামোর মধ্যে ঢোকালে তাকে কোন্ থাকে জায়গা দেওয়া হবে, সেটাই তো জানা যায়নি। জন্ম দিয়ে যেখানে উঁচু জাত নিচু জাত নির্ণয় করা হয়, সেখানে, সেই সমাজে মুসলমান যদি ঢুকতেও চাইত, তাকে কোন সারিতে স্থান দেওয়া হত। মনে আছে হরিকিশোর আশুতোষবাবু ডঃ শহীদুল্লাহকে নিয়ে কি বিপদে পড়েছিলেন? সংস্কৃত কলেজে শহীদুল্লাহ ভর্তিই হতে পারলেন না, তিনি মুসলমান বলে। ফ্রান্সে গিয়ে তাঁকে সংস্কৃত শিখতে হল।’

‘এই সব বিষয়গুলোই তো আগে ঠিক করে ফেলা উচিত ছিল, নয় কি?’ মনসুর বললেন। ফুলকির মনসুরকে এই কারণেই ভাল লেগে গিয়েছিল যে, উনি কথা বলেন খুব স্পষ্টভাবে। আর কথার মধ্যে তায়েবকাকার মতোই একটা বেদনাবোধ লুকিয়ে থাকে।

ফুলকি শামিম সম্পর্কে আশালতাকে বলেছিল, মুসলমান। আশালতা বলেছিল, মোছম্মান। ফুলকি কোনদিন ভুলবে না সে উচ্চারণ। আশালতার মুখে, জেঠিমণির মুখে তার পিসি মামীদের মুখে ছিটকে ওঠা ‘মোছম্মান’ এই কথাটা। কত অবজ্ঞা কত ঘৃণা থাকলে মানুষ এমনভাবে একটা সম্প্রদায়কে এই ভাবে চিহ্নিত করতে পারে!

মনসুর বলেছিলেন, ‘আমাদের শুধু ভারতীয় মুসলমান থাকলেই চলবে না। আমাদের হতে হবে ‘হিন্দু-মুসলমান’। এটা শুধু কংগ্রেসি বা হিন্দু মহাসভার লোকেদের মত ছিল না, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথও এক সময়ে এই মতের শরিক ছিলেন। আমাদের দুঃখ তাই। মুসলিম নেতৃবৃন্দ স্পষ্টতই এমন ঐক্যে বিশ্বাস করতেন না। মুসলিম নেতারা এটাকে নিছক একটা রাজনৈতিক ঐক্য হিসাবে দেখেছিলেন। সামাজিক ঐক্য হিসাবে দেখেননি। দেখবার উপায়ও ছিল না। হাজার বছর ধরে মুসলমান এদেশে হিন্দুর সঙ্গে ঘর করেছে। হিন্দুদের রাজা হিসাবেও, হিন্দুদের প্রজা হিসাবেও। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই হিন্দু-মুসলমানে সামাজিক ঐক্য হয়নি। এই ঐতিহাসিক ব্যাপারটা গুরুত্ব দিয়ে বোঝা দরকার।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পরে তায়েবকাকা বললেন, ‘মনসুর, রবীন্দ্রনাথই কিন্তু এ কথা বলে গিয়েছিলেন যে, এখন জগৎ জুড়িয়া এ সমস্যা নহে যে, কী কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব। কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়াই মিলন হইবে সে কাজটা কঠিন—কারণ, সেখানে কোনও প্রকার ফাঁকি চলে না, সেখানে পরস্পরকে জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়।’ এ কথা ফুলকি বাবার মুখেও শুনেছে। ফুলকি কতদিন বাবা, হরিকিশোর মেসো এঁদের বলতে শুনেছে, ভেদ রক্ষা করে যে মিলন তারই বাস্তব পন্থা ছিল দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্‌ট। দেশবন্ধুই প্রথম সাহস করে মুসলমানদের জন্য জায়গা ছেড়ে দিয়েছিলেন। মনসুর তায়েবকাকার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের মুখে আমরা তো এই কথাই শুনতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি তো আবার ‘শক হুণ দল পাঠান মোগল এক দেহে হবে লীন’ এই তত্ত্বও দিয়ে গিয়েছেন। এই দুইয়ে তুমি কোথায় মিল খুঁজে পাবে? ফলে হল কি, হিন্দু নেতারা রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’কেই সাদরে বরণ করে নিলেন, ‘ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন’‘ রবীন্দ্রনাথের এই কথাটায় কানই দিলেন না।’

মনসুর বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখ, মুসলমানেরা এক দেহে লীন হয়ে গেল। সে দেহটা কি? হিন্দুসমাজ তো? ছোঁয়াছুঁয়ির উপর যে সমাজটা দাঁড়িয়ে আছে, সেই সমাজে মুসলমানেরা কোথায় গিয়ে ঢুকত? বৌদ্ধরাও তো এক সময়ে হিন্দু সমাজের মধ্যে লীন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হিন্দু সমাজের কোথায় তাদের ঠাঁই হয়েছে? মুসলমানরা কোনও সমাজেই অচ্ছুৎ অস্পৃশ্য হয়ে থাকতে কেন চাইবে? আসলে যাঁরা ‘এক দেহে হবে লীন’ এই তত্ত্ব প্রচার করেছেন, তাঁরা সদিচ্ছাবশতই করেছেন, এই পর্যন্ত বলা যায়, কিন্তু তাঁরা এই বিষয়টা শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখেছেন। অথবা অঙ্কটাকে গোঁজামিল দিয়েই করে রেখে গিয়েছেন।

‘এই গোঁজামিলের ব্যাপারটা বাংলার মুসলমানদের মধ্যেও কি নেই?’ তায়েবকাকা বলেছিলেন। ‘এই গোঁজামিলের কারণেই না বাংলার মুসলমানের অবস্থা আজকে না ঘরকা, না ঘাটকা। শত শত বছর ধরে মুসলমান এ দেশে আছে, আমরা তো এই দেশেরই মানুষ। তবু দেখ ভারতের মুসলমানদের দৃষ্টি যেন আরবের খর্জ্জর বন আর পারস্যের দ্রাক্ষাকুঞ্জেই নিবদ্ধ। ফলে ভারতীয় বলে সে নিজেকে ভাবতে পারছে না। অথচ আরবি পারসিও হতে পারছিনে আমরা। মাতৃভূমিকে ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ বলে আমরা কি নিতে পেরেছি? কেন মুসলমান এটা ভাবতে পারে না? এটা কি গোঁজামিল নয়? রাস্তা দিয়ে হিন্দু মুসলমান যুবকেরা যখন চলে, হিন্দুদের চলাফেরার কায়দা দেখ, বলে দিতে হয় না যে, তারা নিজের দেশের মাটির উপর দিয়ে হাঁটছে, দেশ যেন তাদেরই। আর মুসলমানেরা এমনভাবে চলে তারা যেন এখানকার মুসাফির। এই হতভাগা ‘কওম’ কি এখনও ভাববে না, বাংলা যদি তার দেশ না হয় তবে সে কি শূন্যে বাসা নির্মাণ করবে?’

মনসুর বলেছিলেন, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বলেছেন, দেশকে ভাল না বাসিয়া দেশের স্বার্থে কোনও কাজ না করিয়া মুসলমানেরা শুধু ফললাভে সিংহের ভাগ বসাইতে চায়।’ তারেবকাকা বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে, মেরে দিলে বড় ভাগটা।’ মনসুর বলেছিলেন, ‘সিংহ ভাগ কথাটা অতিশয়োক্তি কিন্তু মোটের উপর কথাটা যে সত্য, এটা অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক যত কারণ ও পারিপার্শ্বিকতার যত যুক্তিই থাকুক না কেন, এই যুগের বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে, মুসলমানেরা সাধারণভাবে ও শিক্ষিত সম্প্রদায় বিশেষভাবে নিজেদের মাতৃভূমিকে আপন মনে করেনি। তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কামকাজে এটা মনে হওয়া মোটেই অযৌক্তিক ছিল না যে, মুসলমানেরা নিজের দেশের চাইতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলিকেই বেশি আপন মনে করত। তার কারণ মুসলমানদের কোনও সুস্পষ্ট চিন্তাধারা ছিল না। যদি কিছু থেকে থাকে সেটা ছিল আবছা একটা প্যান ইসলামিজম্। আমি বাঙালি মুসলমানদের কথাই বলছি। মুসলিম হ্যায় হাম সারা জাঁহা হামারা, এটাই ছিল যেন তাদের সত্যকার জীবন দর্শন। ১৯২০-২১ সালে খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন যে, ভারতীয় মুসলমানের অভূতপূর্ব গণআন্দোলনে পরিণত হয়েছিল, সেটা খিলাফত ও তুর্কী সাম্রাজ্যের জন্য যতটা, ভারতের স্বরাজের জন্য ততটা ছিল না। ১৯২৩ সালে কামাল পাশা যখন খলিফাকে তাড়িয়ে খিলাফতের অবসান ঘোষণা করলেন, তখনই ভারতের মুসলমানের উৎসাহে ভাঁটা পড়ল। খিলাফত কমিটি মরে গেল। মুসলমানেরা কংগ্রেস ছেড়ে দিল। এতে তারা এটাই বুঝিয়ে দিল যে, খিলাফত যখন শেষ হয়ে গেল তখন দেশের স্বাধীনতায় তারা আর ইন্টারেস্টেড নয়।’

‘নজরুলের একটা কথা আমার কানে সতত বাজে সুধাকর।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন। ফুলকির মনে কথাটা দাগ কেটে বসে গিয়েছিল। ‘আজ বাঙালি মুসলমানের মধ্যে একজনও চিত্রশিল্পী নাই, ভাস্কর নাই, সঙ্গীতজ্ঞ নাই, বৈজ্ঞানিক নাই ইহা অপেক্ষা লজ্জার কথা আর কি আছে! এই সবে যাহারা জন্মগত প্রেরণা লইয়া আসিয়াছিল, আমাদের গোঁড়া সমাজ তাহাদের টুটি টিপিয়া ফেলিয়াছে ও ফেলিতেছে। … পশুর মতো সংখ্যা গরিষ্ঠ হইয়া আমাদের লাভ কি, যদি আমাদের গৌরব করিবার মতো কিছুই না থাকে। ভিতরের দিকে আমরা যত মরিতেছি, বাহিরের দিকে তত সংখ্যায় বাড়িয়া চলিয়াছি। এক মাঠ আগাছা অপেক্ষা একটি মহীরুহ অনেক বড়, অনেক শ্রেষ্ঠ। নজরুলের ছিল এই কথা।’ তায়েবকাকা আরেকদিন বলেছিলেন, ‘সকল বিধিনিষেধের চেয়ে মানুষের প্রাণের ধর্ম বড়। কথাটা মুসলিম তরুণদের বুঝতে হবে। সুন্দরের সৃষ্টির শক্তি লইয়া শিল্পী জন্মগ্রহণ করিয়াছে, কে তাহার সৃষ্টিকে দেখিয়া কুফরির ফতোয়া দেবে? এই খোদার উপর খোদকারী আর যাহারা করে করুক, আমরা করিব না।’

মনসুর বলেছিলেন, ‘বাংলার মুসলমান অনেকদিন পর্যন্ত দেশটাকে আপন করে নেয় নাই। বাংলার মুসলমানদের দুর্গতির এইটিই প্রধান কারণ। শুধু রাজনীতির ব্যাপারই যে তাদের দৃষ্টি মধ্যপ্রাচ্যের দিকে আটকে ছিল তা নয়, এমনকি যে সব ব্যাপারের সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক ছিল না, সেই সব ব্যাপারেও বাংলার মুসলমানদের মনোভাব ছিল বিদেশমুখী। একটা উদাহরণ দিই মুসলমানদের মধ্যে ধনী ও দানশীল লোকের অভাব যে খুব বেশি ছিল তা নয়। কিন্তু সারা ভারতে মুসলমানের ব্যক্তিগত দানে হাসপাতাল বা কলেজ স্থাপনের নজির নেই।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘একমাত্র ব্যতিক্রম হুগলির হাজি মহম্মদ মহসিন।’

‘হ্যাঁ। তিনি প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি। বিদ্যোৎসাহে তাঁর দান অস্বীকার করবার নয়। কিন্তু এই বাংলার হিন্দুদের মধ্যে যেখানে হাজার গণ্ডা মহসিন পাবে, সেখানে মুসলমানদের মধ্যে ওই এক মহসিন। এটাই কি মুসলমানদের দুর্গতির পরিচয় বহন করছে না? না বাংলার মুসলমান ধনীরা খয়রাত করেননি? তাঁরা কলেজ হাসপাতাল তৈরির জন্য টাকা ঢালেনি, তাঁদের দানশীলতা মসজিদ নির্মাণেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওটা নিশ্চয়ই মুসলিম জনতার সুবিধার জন্য ততটা ছিল না, পরকালের পারের কড়ি জোগাড়ের জন্য একটা গ্রামে কটা মসজিদের দরকার হয়?’ মনসুর বলেছিলেন, ‘সওয়াব হাসিল করে নিজের বেহেশতে যাবার সিঁড়ি পাকা করে নেওয়াই ছিল মসজিদ বানাবার উদ্দেশ্য। বাংলার ধনী মুসলমান যে নৈসর্গিক বিপদ আপদেও অর্থ সাহায্য করতেন না এমন নয়, কিন্তু সেটাও দেশের জন্য নয় বিদেশের জন্য। এই বাংলাতেই যদি বন্যা খরা মহামারি হত তবে তার রিলিফের কাজেও হিন্দু দাতাদের উপরেই নির্ভর করতে হত। মুসলমান দাতারা থলির মুখ খুলতেন না। একবার উত্তরবঙ্গের এক বিশাল এলাকায় বন্যা হয়ে প্রায় আশি লক্ষ লোক বিপন্ন হল। যারা বিপন্ন হয়েছিল তাদের অধিকাংশই মুসলমান। আচার্য প্রফুল্ল রায়ের নেতৃত্বে ‘সংকট ত্রাণ সমিতি’ প্রায় কোটি টাকা চাঁদা তুলে বহুদিন পর্যন্ত রিলিফ চালিয়েছিল। আমি এই সমিতির স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করেছি। সেই সময় কলকাতার ধনী মুসলমানদের কাছ থেকে আমরা উল্লেখযোগ্য কোনও চাঁদা পাইনি। কিন্তু এর কিছুদিন পরে তুরস্কের আনাতোলিয়া শহরে ভূমিকম্প হল। সেই ভূমিকম্পে আনাতোলিয়ার যে সব মানুষ দুর্গত হয়েছিল তাদের রিলিফের জন্য মোহাম্মদ আলি পার্কের এক জনসভাতেই তিন লাখ টাকা চাঁদা উঠেছিল। এই ভাবগতিক দেখে হিন্দু প্রতিবেশী তো দূরের কথা কোনও নিরপেক্ষ বিদেশী পর্যটকেরও মনে হত এখানকার মুসলমান ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভালমন্দের চেয়ে মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম জাহানের ভালমন্দের কথাই বেশি চিন্তা করে। এই ভাবগতিক দেখে হিন্দু নেতৃবৃন্দের এমন যদি সন্দেহ হয়ে থাকে যে, মুসলমানদের দাবি দাওয়া মতো চাকরি বাকরি দিলেও তারা ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রামের শরিক হবে না, তারা ইংরাজ সরকারকেই সমর্থন করবে, তবে সেটাকে অযৌক্তিক বলা যাবে কি?’

‘দেশকে পর করে দিয়ে দেশের ভাষা মাতৃভাষাকেও মুসলমানেরা ঘৃণার চোখে দেখেছে। যদি মাতৃভাষার সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের নিবিড় পরিচয় থাকত, দেশপ্রেম তবে বোধ হয় তার অন্তরে জাগরিত হত।’

‘মোট কথা ভারতের মুসলমানরা এই যুগে ছিল কার্যত এক দেশহীন ধর্মসম্প্রদায় মাত্র। নিজের দেশকে অবস্থা বৈগুণ্যে এরা হিন্দুর দেশ মনে করত। কেউ কেউ ‘দারুল হর্ব’ ছেড়ে পশ্চিমে দারুল ইসলামে হিজরত করবার কথাও ভাবতেন। কাজেই এই ‘হিন্দুর দেশ’ হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক উন্নতির কথা তারা ভাবতে যাবে কেন? এই দেশ যে তাদের, এই দেশ শাসন করার অধিকার ও দেশের কল্যাণ সাধনের দায়িত্ব যে তাদের, তাদেরই ভাইয়েরা যে কৃষক-মজদুর হিসাবে দেশের খোরাকি ও অন্যান্য সম্পদ সৃষ্টি করছে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, এ কথা যেন তাদের মনেই পড়ত না। কাজেই দেশগত প্রাণ, দেশের জন্য যে-কোনও-ত্যাগস্বীকারে-প্রস্তুত, পরাধীনতার জ্বালায় দগ্ধ এবং স্বাধীনতা-সংগ্রামে লিপ্ত হিন্দুরা যদি মুসলমান নেতাদের দেশপ্রেমে সন্দেহ করেও থাকে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।’

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘এইটেই ট্রাজেডি’।

বাবা বলেছিলেন, ‘কিন্তু যতই অল্প হোক, তোমাদের মতো লোকও যে মুসলমানদের মধ্যে আছে, তাদের মর্যাদাও তো আমরা হিন্দুরা দিতে পারিনি। আমাদের সংগ্রামে তাদেরও তো কাছে টানতে পারিনি। আমরা কি এই বলিনি, আমাদের সঙ্গে তোমাদের যদি মিলতে হয়, তবে আমাদের শর্তেই তোমাদের মিলতে হবে। আমার মনে হয়, ট্রাজেডি এইখানে।’

১৪

৭ নভেম্বর ১৯৪৫

‘আজকের বিকালটা মনে রাখার মতো। অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা। শা-কে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি পাশ কাটিয়ে চলেই যাবে। সঙ্গে কয়েকজন বন্ধু ছিল। উত্তেজনায় ওদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হঠাৎ শা সোজা আমার কাছে চলে এল। আমার বুক ধক করে উঠল। প্যারাগনে গিয়ে বসা হল। মেঘলা দিন। দোকানে লোক নেই। ছোট্ট ছেলেটা হাসল। শা দুটো ভ্যানিলা দিতে বলল। অনেকক্ষণ চুপচাপ। ভ্যানিলা এল। আবার চুপচাপ। ভ্যানিলার গ্লাসে স্ট্র নাড়ার জন্যই যেন আমরা সেখানে এসেছি। ধীরে ধীরে একটা দুটো কথাবার্তা শুরু হল। দু পক্ষই সচেতন। দু পক্ষই সতর্ক। হঠাৎ প্রবল বন্যা এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কথাবার্তা গড়িয়ে গেল ভবিষ্যতের ভাবনায়। বিয়ের কথা উঠল। আবার যেন ভবিষ্যৎকে ছুঁতে পারছি। তবে সমস্যা একটাই—সেই আইডেনটিটির সমস্যা। মনে হল শা যেন এতে একটু অস্বস্তি বোধ করছে। মনে হল আমি যে বদলে গিয়েছি এই কদিনের মধ্যে, সেটার খবর যেন পায়নি। তাই বোধ হয় শা-এর বড় লেগেছে। আমি আর পাঁচজনের মতো নই, অথচ একে সে ভালবাসে, কিন্তু সংসারে একে কি করে ধরাবে, তাই বোধ হয় ওর দুর্ভাবনার কারণ। আমার আইডেনটিটি কি এতই বিচলিত হবার জিনিস? কি করে বোঝাব যে, আইডেনটিটির সাথে সংসারের সংঘাত বাধতে পারে না। যদি ভালবাসায় বিশ্বাস থাকে। অনেক তর্ক হল। বেশ অনেকদিন বাদে। তারপর হঠাৎ শা-এর ছেলেমানুষি আকাঙ্ক্ষা মনকে রাঙিয়ে দিল আবির রাঙা ছোপে।

তবু সন্ধ্যা নামে।। সমস্ত দিনের সেই প্রাণ উজাড় করা অনুভূতি, পরম পাওয়ার কাছে আত্মসমর্পণের চরম মুহূর্ত মেলে না। চারিদিকে এ কী কারাগার? নিজেদেরকে নিয়মের শাসনে বেঁধে অনিচ্ছুক মনে ফিরে যাই। শা-এর স্বাভাবিকতা অনেক ম্লান হয়ে গেল। আর আমাকে পাকে পাকে জড়িয়ে ধরল বিষণ্ণতা।

অমিতা যেন একটা টেলিস্কোপ দিয়ে দেখছে দুজনকে। প্রথমে ছবিটা আবছা ছিল। ফোকাসটা সঠিক ভাবে সুবিন্যস্ত করে নিতেই ফুলকি আর শামিম স্পষ্ট এসে গেল তার দৃষ্টিপথে। দুপুরেই বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তোমাদের যখন মির্জাপুর স্ট্রিটের উপর দেখা শামিম, তখনও রাস্তার এখানে ওখানে বেশ জল দাঁড়িয়ে। ফুলকিকে তুমিই আগে দেখতে পেয়েছিলে। তোমার কি তখন ফুলকির মুখখানাকে মলিন মলিন লেগেছিল? তুমি উৎসাহভরে তোমার বন্ধুদের সঙ্গে হাত পা নেড়ে কি যেন বলতে বলতে আসছিলে। তুমি রাস্তার যে ফুটপাথে ছিলে, ফুলকি ছিল তার উল্টো ফুটপাথে। তুমি বন্ধুদের কাছে কি যেন বললে। এবার তোমাকে খানিকটা গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বন্ধুরা চলে গেলে তুমি পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলে। কি যেন ভাবলে। সিগারেট কিনেছিলে। কাতার দড়িটা থেকে সেটা ধরিয়ে নিয়েও কিছুক্ষণ তুমি ইতস্তত করেছিলে। তুমি কি ভাবছিলে? ফুলকিকে ডাকাটা ঠিক হবে কি না? ফুলকি একরাশ চিন্তার মধ্যে ডুবে ছিল সেদিন। তোমাকে সত্যিই দেখতে পায়নি। তাই তুমি যখন পায়ে পায়ে ফুটপাথ পেরিয়ে ফুলকির পিছনে এসে নরম গলায় ডাক দিয়েছিলে ফুলকি বলে। তখন সেই মুহূর্তে, ফুলকি চমকে উঠেছিল। তোমাকে দেখামাত্রই শামিম, ফুলকির বুকটা ধক করে কেঁপে উঠেছিল। তার মুখে একঝলক রক্ত জমা হয়েছিল। সেটা লক্ষ্য করেছিলে কি? তার যদি চলার শক্তি থাকত তখন তাহলে শামিম, সে চলেই যেত। কিন্তু তোমার ডাক শুনে তোমার দিকে ফিরে চেয়েছিল, তোমাকে দেখতে। হ্যাঁ শামিম, তোমাকেই দেখতে সে ফিরে দাঁড়িয়েছিল। ওর চোখে কি কোনও ভাবান্তর দেখেছিল শামিম? ফুলকির চোখে কি তুমি জল দেখছিলে? না, বেদনার স্রোত বইছিল তার অন্তরে। তুমি যখন আবার ডাকলে তাকে ফুলকি বলে, সে তোমার চোখে চোখ রেখে সোজা তাকিয়েছিল না? তুমি একটু ইতস্তত করছিলে কেন? কি ভাবছিলে তুমি?

‘ফুলকি, কোথাও একটু বসবে?’

কিছু কি বলেছিল ফুলকি?

‘ফুলকি চল না, কোথাও গিয়ে একটু বসি। প্যারাগনে যাবে? তোমার কি তাড়া আছে ফুলকি?’

ফুলকি বলেছিল, ‘বেশ, চল। তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল আমার। তোমার সময় হবে?’

‘ফুলকি, তুমি আমার উপর রাগ করেছো। আমি জানি তুমি রাগ করেছো। এ কদিন তে। তোমাদের বাড়িতে যেতে পারিনি তার কারণ একদমই সময় পাইনি ফুলকি, বিশ্বাস করো।’

ফুলকি কথা বলছিল না, তুমি অস্বস্তিতে ভুগছিলে। তাই তো? তোমরা প্যারাগনে গিয়ে ঢুকলে। তারপর আজাদ হিন্দ ফৌজ মামলার আসামীদের ছাড়িয়ে আনবার জন্য তোমরা একটা আন্দোলন চাগিয়ে তুলছো, তার বিবরণ বিশদ করে দিতে শুরু করেছিলে।

‘ফুলকি, তুমি শুনে খুশি হবে, ছাত্ররা আজাদ হিন্দ ফৌজের স্পিরিটটাকে ঠিক ভাবে নিতে পেরেছে। শাওয়াজ, ধীলন, সেগলকে ভারতীয় জনতাই মুক্ত করে দেবে। কলকাতা থেকেই শুরু হবে তার অপ্রতিরোধ্য অভিযান।

শামিম, এমন কি হতে পারে না, একদিন যখন আমি ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি তুমি আমার বুক চিরে বেরিয়ে এলে হাঠৎ। আমি যখন শুয়ে আছি আমার ঘরে। ফুলকি বলেই জড়িয়ে ধরলে আমাকে। তারপর…

‘ফুলকি, আজাদ হিন্দ ফৌজের স্পিরিট এবার হিন্দু মুসলমান ঐক্যকে সত্য করে তুলবে।’

তুমি উৎসাহে টগবগ করে তখন ফুটছিল। ফুলকি অবাক হয়ে তোমাকে দেখছিল। সে কেন পারে না তোমার মতো হতে। একটা কাজে ডুবে যেতে।

‘তুমি দেখে নিয়ো ফুলকি, আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের ভারত সরকার যে সাজাই দিন, ভারতের জনতা সেটা ব্যর্থ করে দেবে। এ বিষয়ে আমরা সকলেই একমত। বিয়াল্লিশেও একটা জাগরণ দেখেছিলাম, কিন্তু এমন সার্বিক ঐক্য দেখিনি, এটা তোমাকে বলতে পারি।

তুমি ভাবতে পার শামিম, আমার দিন কেমন যাচ্ছে? একটুও আন্দাজ করতে পার? দিনের পর দিন তোমাকে কাছে না পেয়ে, তোমাকে না দেখে আমি যে কষ্ট পেয়েছি, যে কষ্ট পাচ্ছি, সেটা কথায় ব্যক্ত করা যায় না। আর আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কোথাও কিছু ঘটেনি। কি করে এটা হতে পারে শামিম? তুমি কি আমাকে ভালবাস না?

‘আরও একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে জানো, এবার কমুনিস্টদের আমাদের সঙ্গে পেয়েছি। বিয়াল্লিশে ওরা তো সরে ছিল। এবার ওরাই এগিয়ে এসেছে। আমরা, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র লিগ, এ ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধভাবে এ সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের তথাকথিত মামলার আসামীদের বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে।

তুমি আমাকে ভালবাস না?

‘মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।’

যে শামিম আমার সামনে বসে এখন, যার চোখমুখ জ্বল জ্বল করছে, যার চোখে স্বপ্নের ঘোর মাখানো, সে কোন শামিম?

‘ছাত্র ফেডারেশনের ছেলেরা খুবই উৎসাহী, কিন্তু মুশকিল হয়েছে কি জানো ফুলকি, শরৎবাবু ওদের সঙ্গে কাজ করতে রাজি নন। তাঁর ধনুক-ভাঙা পণ, কমুনিস্টদের সঙ্গে তিনি কোনও সংস্রব রাখবেন না। বিশেষত ভারতীয় কমুনিস্টদের সঙ্গে।’

শামিমের সঙ্গে এতদিন পরে দেখা, ও তো একবারও তার কথা জিজ্ঞাসা করল না?

‘আমরা শরৎবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলাম ফুলকি। শরৎবাবু বললেন, ওদের কি কথা জিজ্ঞাসা করেছো যে, আজাদ হিন্দ ফৌজের আসামীদের মুক্ত করার ব্যাপারে হঠাৎ কমুনিস্টদের প্রাণ এত কেঁদে উঠল কেন?’

ও কি আমাকে দেখতে পাচ্ছ? আমি যে ওর কাছে বসে আছি, সেটা কি ও অনুভব করছে? ‘শরৎবাবু বলছিলেন ফুলকি, ওরা সুভাষকে কুইলিং বলেনি? ওরা, ওরা সুভাষকে তোজোর কুকুর বলেনি! আমরা জিজ্ঞাসা করেছিলাম ফুলকি আপনারা বরাবর নেতাজিকে আক্রমণ করে এসেছেন, এখন কি ভাবে আই এন এ ফৌজদের সমর্থন করবেন? ওরা বলেছে, এখন অবস্থান বদলে গিয়েছে। ফাসিবাদ পরাজিত হয়েছে। শরৎবাবু বললেন, সুভাষ তো ওদের চোখে ফ্যাসিস্ট, আই এন এ-ও ফ্যাসিস্ট সৈন্য। ওদের তো আওয়াজ তোলা উচিত, আজাদ হিন্দ ফৌজ যুদ্ধাপরাধী, ওদের বিচার করো। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তো তাই করছে।’

আমার এখন কি করা উচিত? এখানে থাকা উচিত? এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত?

‘শরৎবাবু বললেন, ওদের যা চরিত্র, ওরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের চর, ওদের পক্ষে এটাই ছিল উচিত দাবি। কিন্তু ওরা এখন উল্টো সুর গাইছে কেন। আমার ধারণা ওরা এজেন্ট প্রোভোকেটিয়ারের ভূমিকা নেবে।’

ফুলকি সেদিন হঠাৎ উঠে পড়েছিল। আর তুমি খুব হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলে এই আকস্মিকতায়। হঠাৎ তোমার সমস্ত উৎসাহ কেন উবে গিয়েছিল সেদিন? তুমি ফুলকির হাতখানা ধরে কাতর ভাবে বলে উঠেছিলে, ‘যেও না ফুলকি, প্লিজ।’

শামিম ফুলকির হাতখানা ধরতেই তার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গিয়েছিল। শামিম তুমি কি অনুভব করেছিলে ফুলকির হাতখানা তখন কবুতরের বুকের মতো কাঁপছিল। ফুলকির স্পর্শ পেয়ে তোমারও ভাবান্তর ঘটে গিয়েছিল শামিম।

‘আমি নিজেকে নিয়েই মশগুল ছিলাম ফুলকি। এমনই মত্ত যে, এটাও বুঝতে পারিনি তুমি এতক্ষণ একটাও কথা বলনি। ফুলকি ফুলকি, তুমি আমাকে ক্ষমা করবে?’

অমিতা ওদের দুজনকে দূর থেকে দেখছিল। শামিমের কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। কোনও ই সন্দেহ নেই,, প্যারাগনে বসে তখন যে কথাগুলো বলছিল শামিম বা ফুলকি, সেগুলো ছিল ওদের আন্তরিক কথা। কিন্তু আজ অমিতার মনে হল, সমস্ত আন্তরিক কথার মধ্যেই একটা ন্যাকামি লুকিয়ে থাকে। বয়সটা কম থাকলে সেটা ধরা যায় না। কাঁচা বয়সটা কত ভাল।

ফুলকি বলেছিল, শামিম, তুমি কেন আর আমাদের বাড়ির পথ মাড়াচ্ছ না? কেন আমার সঙ্গে দেখা করছ না? কিছু কি ঘটেছে?

‘সেটাও অন্যায় হয়ে গিয়েছে ফুলকি। আসলে আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যাপারে এমন জড়িয়ে পড়েছি…’

ফুলকি বলেছিল, এটাই কি কারণ শামিম, আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হবার? দুজনেই তো কলকাতায় আছি। কোথায় কোথায় আমরা থাকতে পারি, তা জানি। কোথায় আমরা থাকি তাও জানি। তবু দেখা হয় না। ফুলকি তুমি কত সহজে এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে!

ফুলকি বলেছিল, কেন এটা হচ্ছে শামিম? আমরা সরে যাচ্ছি কেন?

‘আমরা কি সরে যাচ্ছি? কি করে সরে যাব আমি তোমার কাছ থেকে ফুলকি? কোথায় সবে যাব?’

ফুলকি বলেছিল, তবে আমার এখন এত ভয় হয় কেন? এত সংশয় আসে কেন? আমাদের মধ্যে কি আড়াল উঠছে শামিম?

‘না না, ফুলকি না।’

শামিমের সেই আর্তস্বর ফুলকির হৃৎপিণ্ডকে যেন ফালাফালা করে দিল। ফুলকি বলেছিল, আমি জানি তুমি আমার কাছে কি চাও? আমি জানি শামিম, তুমি আমার কাছে বড় বেশি কিছু চাওনি। কিন্তু সেই তোমার সেই সামান্য চাওয়াটাকেও আমি দিতে পারিনি। নিজের মধ্যে এমন এক বিপন্নতা তৈরি হয়ে গেল পারিপার্শ্বিকতার চাপে তার থেকে আমি মুক্ত করতে পারছিনে নিজেকে। অথচ এ কথাও তো বড় সত্যি আমি তোমাকে অনেক কিছু দিতে চেয়েছি—আমার সব, সবটুকু। যদিও তোমার কাছ থেকে পাওয়া অনন্ত ভালবাসার কাছে তা কিছুই নয়। তবু তো দিতে চেয়েছি। মনে হয়, হয়ত দিয়ে উঠতে পারিনি, কিংবা আমার মধ্যেই কোনও অপূর্ণতা আছে। তাই কি আমাদের সরিয়ে নিচ্ছে?

আবেগে শামিমের গলা ধরে এল। সে শুধু ফুলকির হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বসে রইল। কথা বলার ক্ষমতা তার ছিল না। তোমাকে দেখে তখন কি মনে হচ্ছিল শামিম জানো, মনে হচ্ছিল তুমি যেন এক পশলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক গাছ। একটু ঝাড়া পড়লেই পাতা থেকে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়বে।

ফুলকি বলেছিল, আমি কেমন করে বোঝাব, কেমন করে কাকে বোঝাতে পারব, তুমি আমার কাছে কী? আমার অভিজ্ঞতা কম, সংকীর্ণ পরিধি আমার, তবু তো ভালবাসতে দ্বিধা করিনি। এবং সেই প্রেমে ভর দিয়েই তো আমি জেগে উঠতে পেরেছি, উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। শামিম শামিম, প্লিজ ডোন্ট লিভ্ মি।

‘ফুলকি, কত বেদনা তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ। আমারই কারণে। আর আমি—কোথায় তোমার কাছে থাকব—আচ্ছা ফুলকি তুমি কি তোমার বাবার আচরণ সম্প্রতি লক্ষ করেছো’?

ফুলকির বুকে যেন হাতুড়ির ঘা পড়ল। কোনও কথা বলতে পারল না ফুলকি। একদৃষ্টিতে শামিমের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

‘তোমার বাবার আচরণে কি কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছো’?

ফুলকি তোমাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেমন পরিবর্তন? শামিম তুমি কিছু লক্ষ করেছ?

শামিম বলেছিল, ‘ঠিক বলতে পারব না। হয়ত আমারই মনের ভুল।’

ফুলকি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি হয়েছে বল শামিম। আমি জানতে চাই।

‘কি জানতে চাও ফুলকি, তোমার বাবা একটা কথা বলেছিলেন, সেই কথাটা? কিন্তু আমিই নিশ্চিত নই যে, কথাটা তিনি আমাকেই বলেছিলেন কি না? সেদিন তোমাদের বাড়িতে কমুনিস্টদের সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। তোমার বাবার যুদ্ধের সময়কার কতকগুলো ঘটনা বলছিলেন। আগস্ট আন্দোলনকে কমুনিস্টরা কি ভাবে বিট্রে করেছিল, সে কথা বললেন। সেটা আমিও জানি। তোমার বাবার ধারণা, আমাকে কম্যুনিস্টরাই ধরিয়ে দিয়েছিল। তোমার বাবা বলেছিলেন বারে বারে ওরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বিট্রে করেছে। বলতে বলতে একবার আমার দিকে তোমার বাবা চাইলেন। এবং কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কি ঠাণ্ডা তার চোখের চাহনি! আমি কিছুতেই সেটা ভুলতে পারিনে ফুলকি। তারপর…

তারপর ফুলকির প্রতিক্রিয়াটা তুমি লক্ষ করেছিলে শামিম? ফুলকি কেমন অস্বাভাবিক স্বরে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তারপর কি হল? বাবা কি বললেন? তুমি ওর আর্তিটা কি বুঝতে পেরেছিলে?

‘তারপর তেমনি ঠাণ্ডা স্বরে বলেছিলেন, ট্রাস্ট যারা বিট্রে করে তারা অমানুষ।’

তারপর!

‘তারপর আর কিছু না। তোমার বাবা আবার স্বাভাবিক হয়ে এলেন। কিন্তু এই ঘটনা আমার মনের গভীরে দাগ কেটে গেল। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি নে। তোমাদের বাড়িতে তারপর থেকে যেতে আমার পা যেন কে টেনে ধরে। তোমাদের বাড়িতে এখন যে কম যাই সেটার এও একটা কারণ বটে।’

না শামিম, তুমি ট্রাস্ট বিট্রে করোনি। যদি করে থাকি তবে আমিই সেটা করেছি। সেদিন বাবা আমাকেও একটা কথা বলেছিলেন শামিম। বলেছিলেন, ঝুমরির চরিত্রে একটা বড় গুণ ছিল ফুলকি, সে যা করত বলে কয়ে করত। তার সাহস ছিল। ঝুমরি আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে। কিন্তু কোনও দিন আমার শ্রদ্ধা হারায়নি।

‘তোমার বাবা কি সেই ঘটনা জানতে পেরেছেন?’

অনেক দিন আগেই জেনেছেন।

‘তোমাকে কিছু বলেননি?’

না।

তারপর তোমরা দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে চুপ করেছিলেন।

শামিম বলেছিল, ‘ফুলকি, আমাদের তাহলে বিয়ে করে ফেলা উচিত।’

তোমার মুখ থেকে এই কথাটাই শুনতে চেয়েছিল ফুলকি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *