১
ফুলকি মনোযোগ দিয়ে লিখে চলেছিল। মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল সে। বুকে বালিশ দিয়ে সে লিখে চলেছে। চোখেমুখে তার নিবিড় স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের মধ্যে ডুব দিয়েই সে যেন আছে। সেই স্বপ্নটাকেই যেন সে তুলে আনতে চাইছে, ধরতে চাইছে, বন্দি করতে চাইছে কালির অক্ষরে তার খাতার পাতায়। তার বাঁ পাশে একটা দুধের গেলাস। মনে হচ্ছে দুধ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। গেলাসটা আছে কিনা সে খেয়াল ফুলকির আছে কিনা সন্দেহ। সিলিং ফ্যান বন বন করে ঘুরছে। ফুলকির চুলের গোছা কখনও ছড়িয়ে যাচ্ছে, কখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, কখনও ফুরফুর করে উড়ছে। ফুলকি খস খস করে লেখাটা শেষ করল। একবার সবটা পড়ে নিল। তারপর বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ন। স্বপ্ন মাখান চোখে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ফুলকি বালিশের ফাঁকা কোনটার দিকে, কেউ যেন সেখানে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ফুলকি ফাঁকা বালিশে আপন মনে হাত বুলোতে লাগল। যেন কাউকে আদর করছে। আবার উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল ফুলকি। অকস্মাৎ বালিশটাকে দুহাতে ওর বুকের মধ্যে টেনে নিল। এমন সময় দড়াম করে দরজা খুলে গেল।
অমিতা ঘুমকাতর চোখটা কষ্টে মেলে দেখে মন্টুর মা ঘরে ঢুকছে। ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে।
‘হ্যাঁ গো মা, ভাল আছ তো আজ? চোখমুখ দেখে মনে নাগছে ভালই আছ গো। দেখি শরীলটা।’ গায়ে কপালে মন্টুর মায়ের শীতল হাতটা ঠেকতেই অমিতার শরীরটা কিঞ্চিৎ কেঁপে গেল। ‘না গো মা, জ্বর লাই।’
যে স্বপ্নটা দেখে অমিতার ঘুম ভাঙল, সেটা তক্ষুনি মিলিয়ে গেল মন থেকে। সে প্রচণ্ড বিরক্ত হল মন্টুর মায়ের আদিখ্যেতা দেখে। এখন কি, না এলেই হত না? অমিতা স্বপ্নটাকে মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল।
মন্টুর মা অমিতাকে বিছানা থেকে তুলে ধরতে গেল।
অমিতা বলল, না থাক। আমি নিজেই উঠতে পারব।
কে ছিল সেই স্বপ্নটায়?
অমিতা বিছানায় উঠে বসল। একটু পরে বাথরুমে গেল। স্বপ্নে কাকে দেখল অমিতা? অমিতা বেসিনে দাঁত ব্রাশ করতে করতে আয়নার দিকে াইল। স্বপ্নটাকে মনে করতে পারছে না অমিতা। তার মনে কষ্ট হতে লাগল।
মন্টুর মা এক কাপ চা’আর খানকতক বিস্কুট তার ইজিচেয়ারের পাশে রেখে দিল। ‘হরলিক খাবে নাকি গো মা?’
এখন চা তো আপাতত খাই। যখন হরলিক্স খেতে চাইব, তখন বলব। তুমি তোমার কাজ সারতে থাক।
মন্টুর মা দেখল গতিক সুবিধের নয়। কথা না বাড়িয়ে সে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে গেল।
বসে বসে চা খেতে পারছিল না অমিতা। -এমন অস্বস্তিতে ভুগছিল। সে উঠে পড়ল। ঘরের মধ্যে ঘুরতে লাগল। যেদিকে দেখে সেই দিকেই বিশৃঙ্খলা। মুখখোলা তোরঙ্গগুলো হাঁ করে পড়ে আছে। যত সব পুরনো ফাইলে ভর্তি। আর ওর মধ্যে যে কি নেই আর কি আছে, সেটা জানতে হলে ডুবুরি ডেকে আনতে হবে, আর না হয় দমকলের লোকেদের।
স্বপ্নে কাকে দেখেছিল অমিতা? স্বপ্নটা যেমন সে ভুলে গিয়েছে, তেমনি যদি এই উদ্বেগটাও ভুলে যেতে পারত!
একটা বাক্সের ডালা খুলল, বইয়ের বিবর্ণ সব ফর্মা তেলাপোকা আর ইঁদুরের নাদিতে ভর্তি। সে আবার ডালাটার মুখ বন্ধ করে রেখে দিল। চিমসে গন্ধটা তার নাকে বিঁধছিল। আরেকটা বাক্সের ডালা খুলল অমিতা। একটু পদে আছে। ভিতরে উঁকি মেরে ভাল করে দেখতে লাগল। কিছু ছোট ছোট খাতা বাক্সটার মধ্যে আছে। ডায়েরির মতো। নিস্পৃহ ভাবে দেখতে লাগল সেগুলোকে। হাত দিতে ইচ্ছে করল না ভিতরে। নোংরা ডালাটা বন্ধ করে দিল। একবার ইচ্ছে হল একটা ডায়েরি খুলে দেখে। অমিতা উৎসাহ পেল না। এমন একটা সময় ছিল, যখন ডায়েরি না লিখলে অমিতার ভাত হজম হত না। অমিতা ঘর ফাঁকা পেলেই, তা দুপুরেই হোক, আর রাতেই হোক, মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে ফ্যান খুলে দিয়ে এক মনে ডায়েরি লিখে যেত। অনেক সময় তার বাহ্যজ্ঞান থাকত না। বাক্সটার ডালা বন্ধ করে অমিতা আবার তার ইজিচেয়ারে এসে বসল। তারপর সে চায়ের কাপে চুমুক দিল। আর তক্ষুনি স্বপ্নটার কথা অমিতার মনে পড়ে গেল। অমিতা মেঝেয় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ডায়েরি লিখছে এই স্বপ্নটাই তো দেখছিল আজ ভোরে। আশ্চর্য! অমিতা, না না সে তো অমিতা নয়, যে ডায়েরি লিখছিল সে ফুলকি। এমন একটা স্বপ্ন সে কি না ঘুম ভাঙতেই ভুলে গিয়েছিল!
মন্টুর মা, মন্টুর মা! আহ্ কাজের সময় এরা যে কোথায় যায়!
ওর কাছে যে ডায়েরিগুলো আছে, সেগুলো কোন সময়ের? হঠাৎ সেটা জানা অমিতার পক্ষে দারুণ জরুরি হয়ে উঠল। ওকে এক্ষুনি দেখতে হবে ডায়েরিগুলো। কিন্তু ওর দেহে এখন এমন অবসাদ যে, চায়ের পেয়ালা তুলতেও ইচ্ছে করছে না।
মন্টুর মা, মন্টুর মা!
সাড়া পেল না মন্টুর মায়ের কাছ থেকে। হঠাৎ অমিতার মনে হল, মন্টুর মা তো ছাতে গিয়েছে। তোশক চাদর নিয়ে। রোদে দিতে। মন্টুর মায়ের দেরি হবে। তার শরীরে ক্যানসার হবার পর থেকে অমিতার আর দেরি সয় না। এই দেরির জন্যই না অমিতাকে আজ এই খোয়ারে সহ্য করে যেতে হচ্ছে। যদি ঠিক সময়ে সে যেতে পারত ঠিক ডাক্তারের কাছে, যদি ঠিকমতো তিনি রোগটা ধরে ফেলতে পারতেন, ঠিকমতো ওষুধগুলো তার কাজ করে যেতে পারত, তাহলে কি অমিতাকে আজ এত মার খেতে হয় ভাগ্যের হাতে! অবশ্য ভাগ্য সে মানে না। তবে আর কি করেই বা বোঝানো যায় তার অবস্থাটা।
.
অমিতার শরীরটা বেশ কয়েক মাস ধরেই তো খারাপ চলেছে। টের পেয়েছিল সে। ব্লাড সুগার, কোলাইটিস তো আছেই। তার উপরে ঘুম হয় না তার। অনেক দিন থেকেই। ছেলে হবার পর থেকেই তার অনিদ্রার শুরু। খোকা রাতে ঘুমাতে চাইত না। তার বাবার আবার ঘুমের ব্যাঘাত হলে প্রচণ্ড শরীর খারাপ হত। কাজেই খোকার ঘুম ভেঙে যাতে না যায় অমিতাকেই তার বিধিব্যবস্থা করতে হত। বিধিব্যবস্থা আর কি? খোকাকে কোলে নিয়ে সেই একখানা ঘরের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে খোকাকে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হত। এমনও কতদিন হয়েছে, ভোর হয়ে গিয়েছে। খোকাকে শুইয়ে দিয়ে সন্তর্পণে ঘরের কাজ সারার জন্য তাকে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হয়ছে। খোকা থাকতেও তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। না থাকতেও অমিতার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে গিয়েছে খোকা। হয়ত ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে অমিতা, হঠাৎ ‘মা’ ডাক তার কানে ঢুকেছে। ব্যস্, ঘুমের দফা সারা অমিতার। বিন্তি কি কম ঘুম নষ্ট করেছে অমিতার! জন্মে ইস্তক রু। কি রোগ ধরতে পারেননি ডাক্তার। এটা বলতেই হবে যে, যোগী, বিন্তির বাবা, তার খোকার বাবা সমীরেন্দ্রের মতো অমানুষ নয়। মেয়েকে ডাক্তার বদ্যি দেখাবার কসুর করেনি সে। কিন্তু তাতে রাত হলেই বিন্তির নিত্য রাতের ট্যাঁ ট্যাঁ কিছুমাত্র কমানো যায়নি। সেই অমিতাকেই আবার সারা রাত ধরে বিন্তিকে কোলে করে ঘুরে ঘুরে দুলিয়ে দুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়েছে। কালক্রমে অনিদ্রাই সঙ্গী হয়ে রইল, আর সবাই তো একে একে সরে পড়ল।
কাজেই প্রথম দিকে এই উপসর্গগুলোই যখন পীড়া দিতে লাগল ওকে, অন্তত তখন অমিতার মনে সেই ধারণাই হয়েছিল যে, যে উপসর্গগুলো তাকে জ্বালাচ্ছে সেগুলো সবই তার চেনা। কাজেই বিচলিত হবার বা সতর্ক হবার কী আসছে? আর অমিতার স্বভাব হচ্ছে এই যে, যতক্ষণ সে শয্যাশায়ী হয়ে না পড়ছে, ততক্ষণ সে কোনও অসুখকে পাত্তা দিত না। নানা কাজের মধ্যে ডুবে থাকত সে। আফিসের কাজ কড়ায় ক্রান্তিতে মিটিয়ে যেত রোজ। এ ছাড়াও ছিল নানা লোক কি সংস্থার জন্য বেগার খাটা। তার উপরে তার ছিল একটা সাংস্কৃতিক জগৎ। সেখানে কত ধরনের কাজ! কত কাজ! শরীরের কথা ভুলে যেতে সময় লাগত না তার। কিন্তু একটুও ঘুম হচ্ছে না কেন? গা বমি বমি করছে কেন দিনের পর দিন? কেনই বা এত গা জ্বালা করে তার? দিদি মারা যাবার পর থেকেই তার কেমন মনে হচ্ছে, কিছু একটা সাংঘাতিক রকমের ঘটতে যাচ্ছে তার। চুমকির কাছে যাবে যাচ্ছে করেও বছর পার করে দিয়েছিল অমিতা।
ও বেশ বুঝতে পারছিল বাঁ দিকের নরম স্তনটা ক্রমেই যেন শক্ত হয়ে উঠছে। ব্যথাও কখনও সখনও অনুভব যে করেনি তা নয়। তবুও অমিতা একে কোনও গুরুত্ব দেয়নি।
মন্টুর মা কি এল? কি এত কাজ থাকে ওর ছাতে তাও তো বুঝিনে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠতে লাগল অমিতা। ডায়েরিগুলোতে কি আছে, জানবার আগ্রহ তার ক্রমেই বেড়ে উঠতে লাগল।
একদিন তার স্তন থেকে সাদা সাদা কষ গড়াতে লাগল যখন, আর ব্যথা বেশ জোরেই টের পেল, তক্ষুনি সে ফোন করল চুমকিকে।
‘এর মধ্যেই রোদ কি চড়ে গিয়েছে গো মা। ছাতে পা পাততে পারা যাচ্ছেনি।’
চুমকি বলল, ‘দিদি তুই আজ আপিস যাসনে। এক্ষুনি আমার এখানে চলে আয়।’
কোথায় ছিলে মন্টুর মা! তোমাকে সেই কখন থেকে ডাকাডাকি করছি। একটা কাজ করতে হবে।
‘আমি বলছি দিদি, তুই আজ আফিসে যাবি নে। তুই সোজা বাড়ি থেকে আমার চেম্বারে চলে আসবি। স্তনটায় ভাল করে হাত বুলিয়ে দেখ। লাম্প হয়েছে, মনে হচ্ছে?’
হ্যাঁ তাই লাগছে বটে।
‘স্তনের বোঁটাটা ভিতরে ঢুকে গিয়েছে?’
মন্টুর মা, যাও তো, ওই আলমারিটার বাঁ পাশে যে ট্রাঙ্কটা আছে, আমার বিছানার পাশে সেটা আনতে পারবে?
‘তা না হয় এনে দেব। কিন্তু তোমাকে কিছু খেতে দিই।’
‘ঢুকে গিয়েছে? পুঁজ, পুঁজের মতো রস রস কিছু বেরুচ্ছে?’
যা বলছি তাই কর না মন্টুর মা। ওই তোরঙ্গটা এখানে এনে দাও। পরে খাব।
‘চলে আয় দিদি, একদম সময় নষ্ট করবিনে।’
নমিতা তার চেম্বারে অমিতাকে দেখবার পর সময় নষ্ট না করে রায় দিল, ‘দিদি, আমার জ্ঞানবুদ্ধিমতো যা জানি, তাতে বলতে পারি, তোর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে। তোকে স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে তোকে ফোনে খবর দেব।’
.
ক্যানসার কথাটা অনেকবার অনেক রকম ভাবে শুনেছে অমিতা, যেমন বাঘের ডাক, সুন্দরবনে শুনেছে, দার্জিলিং-এ শুনেছে, চিড়িয়াখানায় শুনেছে, কিন্তু সে বাঘের মুখে পড়বে, এ কথা কখনও ভাবেনি। ক্যানসার কথাটাই তার কাছে ছিল দূরের বস্তু। সে কখনও ভাবেইনি, ক্যানসার কোনওদিন তারই ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। তাই চুমকির ঠাণ্ডা মাথার রায়ের অর্থ প্রথমটায় তার মাথায় গুরুত্ব নিয়ে ঢোকেনি। কিন্তু সে তো মাত্র এক লহমা। যেমন বাজ আগে পড়ে, মেঘের ভয়াবহ গর্জনটা শোনা যায় পরে, তেমনি ‘তোর ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছে দিদি’, এই কথাটা আগে তার মাথায় ঢুকল অতর্কিতে, মানেটা এল তার খানিক পরে।
অমিতা চুমকির রায়টাকে শান্ত মনেই গ্রহণ করল। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকেই অমিতা বুঝে গেল, তার সত্তাটা চৌচির হয়ে গেল। আসলে সে অনেক অমিতায় ভাগ হয়ে গেল। যেমন একটু আগেই, আজ ভোরে, এক অমিতা যখন এই বিছানায় শুয়ে ঘুমাচ্ছিল, আর এক অমিতা সেই সময়, না সে সময়ে নয়, অন্য কোনও সময়ে অন্য কোনও জায়গায় মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে এলো চুলে বুকে বালিশ দিয়ে ডায়েরি লিখে যাচ্ছিল।
মন্টুর মা ভারী তোরঙ্গটাকে টানতে টানতে অমিতার বিছানার কাছে নিয়ে এল।
‘দাঁড়াও গো মা, হাত দিয়োনি এখন। বড্ড আরশোলার নোংরা ভিতরে। আরও কি যে আছে, অ্যাঁ। এখন মোটেই হাত দিয়োনি।’
মন্টুর মা আবার তোরঙ্গটাকে অমিতার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেল ঘরের কোণায়।
সাফ করবে কর, কিন্তু ভিতরের কোনও জিনিস ফেলে দিও না যে। অনেক দরকারি খাতা আছে।
অমিতার বুক ঢিপ ঢিপ করতে লেগেছে। তার এখন তর সইছে না। কি আছে, কোন ডায়েরিগুলো আছে ভিতরে? ফুলকি যে ডায়েরিটা লিখছিল সেটা পাবে তো ওর মধ্যে? মন্টুর মায়ের যত দেরি হচ্ছে অমিতার উত্তেজনা তত বাড়ছে। তার শরীরে এখন দ্রুততালে রক্ত বইছে। এই ছেলেমানুষি উত্তেজনা চাপা দেবার জন্য অমিতা কত রকম চেষ্টাই না করল। কিন্তু ফল উল্টো হল। শেষে থাকতে না পেরে অমিতা তার চেয়ারটাতে টান টান হয়ে উঠে বসল।
মন্টুর মা বলে উঠল, ‘এসোনি মা, এধারে এখন এসোনি। ভিতরে অনেক খারাপ জিনিস আছে গো। মরা ইঁদুরও আছে। সব সাফ করে তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছি। একটু সবুর কর মা, একটু সবুর কর।’
২
‘৮ই আগস্ট ১৯৪৫।
‘এক নতুন পথে চলার অঙ্গীকার রাখলাম আজ। ভালবেসেছি, এই কথাটাই সমস্ত দিয়ে বোঝাব—এই আমার প্রতিজ্ঞা। ভয় আসছে, মনে আসছে আনন্দ, নতুন কিছুর দোলায় দুলছি। আমায় শক্তি দাও, সাহস দাও। জানি ঝড় আসবে—সেই ঝড়েরর মুখোমুখি দাঁড়াতে দাও। জাগতিক সুখভোগ ছেড়ে পরমার্থের দিকে এগোই।’
তার ডায়েরিতে এই কথা ফুলকি লিখেছিল শামিমকে। তোমাকেই সে কথাগুলো বলতে চেয়েছিল। মনে আছে শামিম, তুমি সেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলে সাতসকালে। খবরের কাগজ ছিল তোমার হাতে। বাবা সেদিন দিল্লিতে। আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের বিচার হবার কথা তখন আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। বাবা হরিকিশোরমেসো, তায়েব কাকাদের দলে তখন তুমিও ভিড়ে গিয়েছ। ফুলকি প্রথমে দূর থেকে তোমার উপর নজর রেখেছিল। তুমি কয়েক মাস আগে যখন প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছিলে শামিম, এক বিকেলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে, তখন ফুলকি ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিল না। বাবা তখনও কোর্ট থেকে ফেরেননি। দরজা ফুলকিই খুলেছিল। তোমার ভাব দেখে মনে হয়েছিল, তুমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। তুমি মাথা নিচু করে বলেছিলে, শামিম। তখন কি লাজুক ছিলে তুমি, ‘সুধাকরবাবু আমাকে আসতে বলেছিলেন।’ ফুলকি বলেছিল, ‘কিন্তু বাবা তো এখনও কোর্ট থেকে ফেরেননি।’ তুমি বলেছিলে, ‘আমি বোধ হয় অসময়ে এসে পড়েছি।’ এবং আর টু শব্দ না করে তুমি পা বাড়িয়েছিলে পথে। ফুলকিকে তুমি তোমার নামটাও বলনি। তুমি কি সেদিন ফুলকিকে ভয় পেয়েছিলে? ফুলকি তোমার জড়সড় ভাব দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আসলে ফুলকি তোমার মতো লাজুক পুরুষকে তো দেখেনি এর আছে। বাবা কোর্ট থেকে ফিরে এলে তোমার বর্ণনা দিয়েছিল। বাবা বলেছিলেন, ‘ও তো শামিম। আশ্চর্য, ও চলে গেল কেন? কবে আসবে বলেছে কিছু?’ আর দিদি বাড়ি ফিরলে ফুলকি তাকে বলেছি, ‘দিদি তুই আজ খুব মিস্ করলি।’ দিদি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কি?’ ফুলকি বলেছি, ‘এক জ্যান্ত লজ্জাবতী লতা।’
ফুলকির প্রগলভতা মাফ কর শামিম। ওই একটি মন্তব্য ছাড়া ফুলকি কোনদিন তোমার সম্পর্কে কাউকে ওই ধরনের কোনও কথা বলেনি। বলবে কি করে? তোমাকে ফুলকি যে ভালবেসে ফেলেছিল। দেখামাত্র ফুলকি তোমার প্রেমে পড়েছিল, এ কথা বলা নিশ্চয়ই ভুল হবে। তবে তুমি ওর মনে যে একটা ছাপ ফেলতে পেরেছিলে, সে বিষয়ে ভুল নেই। তোমার সঙ্গে আলাপ হবার আগে ফুলকি কোনওদিন বাবাদের বৈঠকে বসেনি।
রাজনীতিতে ওর তো কোনও আগ্রহ ছিল না। আর বাবাদের বৈঠকে রাজনীতি ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে আলোচনাই হত না। কিন্তু তুমি যেদিন থেকে বাবাদের বৈঠকে যোগ দিতে আরম্ভ করলে, তুমি লক্ষ করেছ কিনা জানিনে শামিম, সেদিন থেকেই ফুলকি সেই বৈঠকে যেতে লাগল। প্রথম দিকে ছুতোনাতা করে। পরের দিকে তো সে সরাসরিই যেতে শুরু করল। কেন গিয়েছিল ফুলকি? তুমি কি ভেবেছিলে রাজনীতিতে ওর আগ্রহ জন্মেছে বলে? না শামিম, না। ফুলকির আগ্রহ ছিল তোমাতে। ফুলকি লক্ষ করেছিল, ফুলকি বৈঠকে উপস্থিত থাকলে তোমার চোখমুখ বদলে যায়। এ ব্যাপার তোমাদের টের পেতে দেরি হয়, যেমন তোমার হয়েছিল। কিন্তু মেয়েরা যেন কি করে টের পেয়েই যায়। একেই কি ইনটিউশন বলে শামিম?
৮ আগস্ট, হ্যাঁ ৮ আগস্ট, সকালে নটা নাগাদ যখন তুমি এসে নিচের থেকে আমার নাম ধরে ডাকলে তখনই বুঝেছিলাম, গুরুতর একটা কিছু কোথায় ঘটে গিয়েছে। আমি তখনও খবরের কাগজ পড়িনি। সকাল থেকে উঠে ফুলকি তোমার কথাই ভাবছিল। বাবার দিল্লি যাবার আগের সন্ধ্যায় তুমি বলেছিলে, ‘নেতাজি কি করে হিন্দু মুসলমান শিখ এদের বিভেদটা ঘুচিয়েছিলেন, সেই মন্তরটা দিল্লি থেকে ফিরে এসে আমাকে যদি বলেন, তবে আমার উপকার হবে। আজাদ হিন্দ ফৌজে তো হিন্দু ছিল, মুসলমান ছিল, শিখ ছিল, নানা ভাষাভাষী লোকও তো ছিল কাকাবাবু, তবে ওদের মধ্যে ভাষা নিয়ে ধর্ম নিয়ে কোনও গোলাযোগ তো হল না। কেন হল না? কি ওদের ছিল, যা আমাদের নেই, সেটাই আমার জানা দরকার। আপনার সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের অনেকের সঙ্গেই তো দেখা হবে। এই কথাটা ওদের কাছ থেকে জেনে আসবেন।’
ফুলকি তোমার ডাক শুনে নিচে নেমে তোমাকে দেখেই হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তোমার চেহারাটার উপরে যেন বাজ পড়েছে। তোমাকে তেমনি দেখাচ্ছিল। ফুলকি কোনও দ্বিধা সংকোচ না করেই একরাশ উদ্বেগ নিয়ে তোমাকে বলে উঠেছিল, কি হয়েছে আপনার শামিম? তুমি তোমার সেই উদ্ভ্রান্ত মুখে ফুলকির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়েছিল শুধু। কোনও কথা বলতে পারিনি। ফুলকিই তোমার হাত ধরে তোমাকে বাবার চেম্বারে নিয়ে বসিয়েছিল। পাখা খুলে দিয়েছিল। জিজ্ঞসা করেছিল, জল খাবেন? মনে পড়ে শামিম? তুমি একটা কথাও না বলে বগল থেকে কাগজখানা বের করে হাত বাড়িয়ে আমাকে দিলে। মনে পড়ে?
খবরটা প্রথম পাতাতেই ছিল শামিম। হিরোশিমার উপর আমেরিকা অ্যাটম বোমা ফেলেছে! একটা বোমায় হিরোশিমার সর্বনাশ ঘটে গিয়েছে। ২০ হাজার টন টি-এন-টি বোমা ফেললে যে প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটত, একটি অ্যাটম বোমা সেই কাজ করে দিয়েছে। কত হাজার নরনারীশিশু প্রাণ হারিয়েছে, কত হাজার হাজার পশুপাখি গাছপালা কীটপতঙ্গ যে পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে তার হিসেব কোনওদিন কেউ করে উঠতে পারবে কিনা সেটা জানা যায়নি। যারা মরেনি তারা আরও হতভাগ্য, কারণ তারা যতদিন বাঁচবে রেডিয়েশনের দরুন চিরজীবন বিকলাঙ্গ হয়ে থাকবে, গর্ভের শিশুও নিস্তার পাবে না।
অমিতার মাথা ঝিমঝিম করছিল। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ফুলকির কেমন বমি বমি পেত লাগল।
.
তুমি দুটো কথা বলেছিলে শামিম। তোমার ফুলকি তা আজও মনে করে রেখেছে। তুমি বলেছিলে, ‘মানুষ মানুষের এমন সর্বনাশ ঘটাতে পারে! তাহলে আমরা কার উপর বিশ্বাস রাখব?’ আর তুমি বলেছিলে, ‘সকালে কাগজটা হাতে আসবার পর যখন দেখলাম, আমার চারিপাশে লোকেরা রোজ যা যা করে তাই তাই আজও করে যাচ্ছে, তখন আমি ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম একটা আশ্রয়ের সন্ধানে। এমন একটা আশ্রয় যেখানে গেলে আমি বুঝতে পারব, সেখানে এমন একজন কেউ আছেন যিনি আমি যা বলতে চাইছি, সেটা আমাকে দেখেই বুঝতে পারবেন। আমাকে মুখে আর বলতে হবে না। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে দয়া মায়া স্নেহ প্ৰেম সব বুঝি ওই একটি অ্যাটম বোমা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের মন এবার মরুভূমি হয়ে যাবে। অমিতা, মানুষ মরুভূমি হয়ে যাবে।’ অমিতা? হ্যাঁ, তখন তুমি ফুলকিকে ওই নামেই ডেকেছিলে। তোমার মুখে প্রথম ডাক শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি শামিম। আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেছিলাম। তোমার কাছে আমার এত দাম! এ দাম আমাকে এতদিন কেউ দেয়নি। টেবিলে মাথা রেখে আমি কাঁদতেই থাকলাম। কতক্ষণ? আন্দাজ ছিল না তো। যখন মুখ তুললাম, দেখলাম তুমি নেই। খবরের কাগজটা সারা গায়ে সর্বনাশ মেখে সারা ঘর ফরফর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখার বাতাসে।
তুমি চলে যাবার পর দুপুরে আমি ঘরে দরজা বন্ধ করে, না না আমি না, ফুলকি ডায়েরিতে তোমার কথা প্রথম তুলেছিল।
তুমি সেদিন সকালে কেন উধাও হয়ে গেলে। শামিম? শামিম! শামিম! শামিম!
১৮ আগস্ট ১৯৪৫।
‘তোমার চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা করি তোমার আদর্শকে। তাই তো আমার ভালবাসা, এ কোনও শৌখিন বিলাস নয়—তুমি কি সেটা বোঝনি, অথবা না বোঝার ভাব করে চলেছ? ভালই যদি বাসি তবে ছেড়ে যাব কেন, আর শুধুমাত্র আমাকে নিয়ে বেঁচে থাকার এত বড় ভয়ঙ্কর শপথই বা কেন! আজ সমস্ত সন্ধে জুড়েই দুর্দান্ত বৃষ্টি। মনেপ্রাণে অনুভব করি এই ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে তুমি আর আমি পাশাপাশি বসে আছি। তোমাকে নিয়ে- কেবলই স্বপ্নের জাল বুনি, তুমি কি তা জান? ধন নয় মান নয় এতটুকু বাসা। এই আমার স্বপ্ন; এই আমার আশা। আশা কি কোনওদিন মিটবে? ‘
বাবা দিল্লি থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই তোমাদের মধ্যে যে সব আলোচনা শুরু হয়েছিল শামিম সেই আলোচনায় তুমি যা যা বলতে, তোমার সেই কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনত ফুলকি। তুমি বুঝতেও পারবে না, কত দ্রুততালে ফুলকি তোমার দিকে ছুটে চলেছিল তখন। তোমরা তখন আলোচনা করতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কে অবনতি নিয়ে। হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে তখন ঘৃণা যেভাবে বেড়ে চলেছিল, তাতে তুমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলে। তোমাদের কথা হত আজাদ হিন্দ ফৌজের আদর্শ নিয়ে। মনে আছে শামিম, তুমি বাবাকে প্রশ্ন করেছিলে, ‘নেতাজি, এত অল্প সময়ের মধ্যে আজাদ হিন্দ বাহিনী যে গড়ে তুললেন, এর মন্ত্রটা কি ছিল কাকাবাবু?’ তুমি ততদিনে বাবাকে কাকাবাবু বলতে শুরু করেছিলে। বাবা খুব খুশি হয়েছিলেন।
বাবা বলেছিলেন, ‘মাত্র তিনটে কথা শামিম, মাত্র তিনটে শব্দ। ইত্তেহাদ ইত্তেফাক কোরবানি। ঐক্য মিলন আত্মত্যাগ। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য এই তিনটে কথাই তো জরুরি।
আমরা তখন শামিম, সকলেই গলা মিলিয়ে সমস্বরে গাইতাম, ‘কদম কদম বাঢ়ায়ে যা, তু খুশি কা গীত গায়ে যা। এ জিন্দগী হৈ, কৌম কি, (তো) কৌম পে লুটায়ে যায়। শেরে হিন্দ আগে বাঢ়, আফৎ সে তু না ডর।’ একদিন চুমকির বন্ধুদের নিয়ে আমাদের বাড়িতে যখন জমজমাট গানের আসর বসেছে, তখন তুমি বাবার কাছে এসে হাজির হয়েছিলে। বাবা তখনও ফেরেননি। চুমকি তোমাকে দেখে হইহই করে বলে উঠেছিল, ‘আজ আবার পালিয়ে যাবেন না শামিমদা। বাবা আপনাকে থাকতে বলে গিয়েছে। বাবা শরৎ বোসের বাড়ি গিয়েছেন আই এন এ মামলার নথি তৈরি করতে।
তখন তুমি আমাদের বাড়িতে প্রায় পুরনো হয়েই গিয়েছ। তবু ফুলকির কাছে আড়ষ্টতা তোমার তখনও তেমন কাটেনি।
চুমকি তোমার হাত ধরে টানতে টানতে ওর বন্ধুদের কাছে নিয়ে গেল। তোমাকে দিয়ে ওরা সেদিন গান গাইয়ে নিয়েছিল। তোমার গলা যেমন সুরেলা তেমনি ভরাট। তুমি সেদিন কি গানটা গেয়েছিলে শামিম, তোমার মনে আছে? ফুলকির অন্তরে উঁকি দিয়ে দেখো শামিম, কত গভীর ভাবে তোমার সেই প্রথম গানটা সেখানে দাগ কেটে আছে। আমাকে একা রেখে তুমি যখন চুমকির বন্ধুদের সঙ্গে হইহই করছিলে, সমানতালে, তখন সত্যিই আমি মিলিয়ে নিতে পারছিলাম না, তুমি সেই একই শামিম কি না। অর্থাৎ যে আমার কাছে এলে আড়ষ্ট আর গম্ভীর হয়ে যায়, আবার চুমকিদের দলে বেমালুম মিশ খেয়ে যেতে যার এক মুহূর্তও সময় লাগে না। বাবাদের বৈঠকেও তো তুমি বেশ সাবলীল। কেবল ফুলকির কাছে এলেই বদলে যাও কেন, শামিম? অভিমানে আমার চোখে তোমার এই অবহেলায় হয়ত জল এসে যেত, কিন্তু তার আগেই শামিম তুমি গাইতে শুরু করে দিলে, আহ্ সে কী গান! ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা, মম শূন্যগগনবিহারী। আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা, তুমি আমারি, তুমি আমারি—’ ফুলকির আর বুঝতে অসুবিধে হয়নি, তুমি কি চাও কারে চাও।
২১ আগস্ট ১৯৪৫।
‘শামিম শামিম, তোমাকে আরও ভাল লাগে, সুন্দর লাগে যখন তুমি থাক আবেগবর্জিত, শান্ত, স্নিগ্ধ। মনে হয়, একে যেন সমস্ত দিয়েও ধরতে পারি না। তোমারে আপন কোনে স্তব্ধ করি যবে, পূর্ণ রূপে দেখি না তোমায়, মোর রক্ত তরঙ্গের মত্ত কলরবে বাণী তব মিশে ভেসে যায়। তোমার মহত্ব আমাকে বিস্মিত করে শামিম—সত্যি কত যে ভালবাসা–আমি কি পারি—আমি বুঝি না—সত্যিই হয়ত বা ছেলেমানুষ—অনেক দুঃখ পাচ্ছ তুমি, আমিও পাচ্ছি শামিম, দুঃখ পেয়েছি। আর নয়—কিছু নাই ভয়, জানি নিশ্চয় তুমি আছো আমি আছি।’
তোমার মনটা যে বড় মাপের ফুলকি প্রতিদিনই তা টের পাচ্ছিল। এমন মানুষ আছে! সত্যিই আছে? আর তারই বুকের মধ্যে, এ ভাবনাটা তাকে ক্রমেই সুখী করে তুলছিল। শামিম, সেদিন অত রাত পর্যন্ত ফুলকি যে বাবাদের বৈঠকে বসেছিল, সে শুধু তোমার কথা শুনবে বলে। বড় বড় সমস্যার কথা সেদিন উঠে পড়েছিল। বৈঠক শেষ হয়ে হয়েও হচ্ছিল না। তবুও এদিন ফুলকির ঘুম পায়নি মোটেই।
বাবা বলছিলেন, ‘এটা মনে রাখতে হবে, নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনীর মধ্যে যে ঐক্যটা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, সেটা ছিল একটা বিশেষ অবস্থার চাপে। ভেবে দেখ, তায়েব, যারা বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল, তারা মূলত কারা? তারা কি পেট্রিয়ট? তারা কোনওদিন কি পেট্রিয়ট ছিল? জাপানিদের হাতে ৭০ হাজার মিত্র পক্ষের সৈন্য বন্দি হয়েছিল। এই যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে ২০ হাজার সৈন্য আই এন এ-তে যোগ দিয়েছিল। বন্দি হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা ছিল রাজভক্ত ইন্ডিয়ান আর্মির শৃঙ্খলাপরায়ণ সৈন্য। তাহলে বুঝে দেখ ব্রজকিশোর, স্বাভাবিকভাবেই তো প্রোসিকিউশন থেকে এই প্রশ্নটা উঠবে, তাহলে এরা রাজভক্ত থেকে দেশভক্ত হল কোন পর্যায়ে?’
‘এই প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক।’
‘এই ব্যাপার নিয়েই তো কদিন ধরে শরৎবাবুর সঙ্গে আলোচনা করছি। শরৎবাবুর দেখলাম সাধু এবং ভুলাভাই দেশাইয়ের উপর, বিশেষ করে ভুলাভাইয়ের উপর অগাধ বিশ্বাস।’
‘তেজবাহাদুরকে শেষ পর্যন্ত তোমরা তাহলে তোমাদের পক্ষে হাজির করতে পারছ?’
‘পারছি বই কি? স্যার তেজবাহাদুর আর ভুলাভাইকে পাওয়ার ফলে আমরা তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছি।
‘কাগজে লিখেছে জওহরলাল নাকি শামলা পরে লাল কেল্লায় হাজির হচ্ছেন?’
‘কথাটা সত্যি। শরৎবাবু রাজি হয়েছেন। যদিও তিনি এটাকে মনে করেন নৈবেদ্যর উপর কাঁটালি কলা।’
‘কি রকম হল!’ শামিম তুমি খবরটা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিল এবং সেটা হঠাৎ প্রকাশও করে ফেলেছিল। তোমার কথা শুনে বাবা, হরিকিশোরমেসো, তায়েবকাকা সবাই তোমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তুমি খুব অপ্রস্তুত বোধ করছিলে শামিম। তোমার মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল।
বাবা বলেছিলেন, ‘শামিম, কিছু বলবে?’
‘মাফ করবেন, আপনারা মুরুব্বি লোক, আপনাদের কথার মধ্যে কথা বলা ঠিক না। কিন্তু নেহরু এই মামলায় উকিল হয়ে যোগ দিচ্ছেন শুনে আমি বিস্ময় চেপে রাখতে পারিনি। এই নেহরু একদিন তো বলেছিলেন, সুভাষ সৈন্য নিয়ে ভারতে ঢুকলে তিনিই সবার প্রথমে যাবেন, তাঁকে প্রতিরোধ করতে। তাই ভাবছি, আজ সেই নেহরু সুভাষের আই এন এ সহকর্মীদের ডিফেন্সের জন্য উকিলের শামলা গায়ে চাপাতে চাইছেন। হঠাৎ তাঁর মতি পরিবর্তন হল কেন? একটা শামলা বানাবার খরচ আছে তো!’
শামিম, তোমার এই শেষ মন্তব্যটাতে আমি পর্যন্ত হেসে উঠেছিলাম। একটা শামলা বানাতে কত খরচ লাগে শামিম?
‘ও গো মা, মা! খাওয়ার তৈরি হয়ে গিয়েছে গো। খেয়ে লাও।’
মন্টুর মায়ের গলার সুর যেন বহুযুগের ওপার থেকে ভেসে এল অমিতার কানে। প্রথমে সে ধরতে পারল না কে কি বলছে, কাকে বলছে? তার হাতে তখন ফুলকির ডায়েরিটা খোলা। যেদিক থেকে মন্টুর মায়ের স্বর ভেসে এসেছিল সেদিকে একবার চাইল অমিতা। আবছা, যেন ঘষা কাঁচের ভিতর দিয়ে কোনও আবছা মূর্তিকে দেখছে অমিতা। চিনতে পারল না।
‘ও মা’, মন্টুর মা বলে উঠল, ‘খেয়ে লাও গো। বেলা বাড়ছে সে খেয়াল আছে? ও মা।’
অমিতার চোখে এখন শামিম। শান্ত। স্থির। তোমার মুখটা কি নিষ্পাপ শামিম।
‘সেদিন সারাদিন তো ছবি দেখে দেখে কাটিয়ে দিলে। আজ কি নেকা পড়ে কাটাবে? হ্যাঁ মা?’
২রা সেপ্টেম্বর ১৯৪৫।
‘আরও একটা সন্ধ্যা কেটে গেল খুব কাছাকাছি সমস্ত দেহমন দিয়ে পারস্পরিক অনুভূতিতে। সুন্দর সময়টা—আরও একটা স্মৃতি জড়িয়ে থাকল জীবনে। তবু কেন ছেড়ে আসতে এত কষ্ট হয়, তবু কেন চিত্ত পিপাসিত হয়ে ওঠে—মনে মনে ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করি—তাই নিয়ে মনে মনে রচি মম ফাল্গুনী—আরও আরও কতদিন—অপরের বিশ্বাস হয় না এমন অসাধ্য সমাজ ভাঙা কাজ আমরা করব কি করে? আমি কিন্তু বিশ্বাস করি, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এ আমি করবই। অন্যেরা যদি ভাবে ভাবুক যা খুশি, তারা মানুষ চেনেনি—ভালবাসার গভীরতা বোঝেনি, ভালবাসার শক্তি বোঝেনি। সমাজ তো কোন্ ছার, রক্তের সম্পর্কও সে পথে বাধা হতে পারে না। হায় রে ভারতবর্ষ, কতকাল আর নামের পাশে ধর্মে সাঁটা লেবেল দিয়ে মানুষ চিনবে? এখনও কি শৈশব গেল না তোমার? আর কবে, কতদিনে চোখ খুলে দেখবে?’
‘মা, ওগো মা, কি হল তোমার? খেয়ে লাও গো, খেয়ে লিয়ে লেখাপড়া কর। খাবার জুইড়ে গেল যে মা।’
তোমার মনে পড়ে শামিম, তুমি এক দুপুরে ফুলকিকে কলেজ থেকে বের করে আনলে। সেদিন তোমরা কলেজ স্কোয়ারে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করেছিল। পুরনো বইয়ের দোকানগুলোতে হানা দিয়ে বেড়িয়েছিলে। তারপর এক সময় কফি হাউস না প্যারাগন সোডা ফাউন্টেন, এই নিয়ে কিছুক্ষণ তর্ক করে প্যারাগনে গিয়ে বসেছিল। সেদিন তোমাকে কি বিষণ্নই না দেখাচ্ছিল শামিম। আর হতাশ। তুমি আমার দিকে চেয়েছিলে, কিন্তু ফুলকিকে একটুও দেখতে পাচ্ছিলে বলে তার মনে হচ্ছিল না। কতবার ফুলকি জিজ্ঞাসা করতে চাইল, কি হয়েছে শামিম? তুমি অমন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছ কেন? কিন্তু সে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে ভরসা পায়নি। তুমি তখন এ জগতে ছিলে না শামিম। ফুলকি চাইছিল তোমার হাতখানাকে স্পর্শ করতে। কিন্তু সেই ঘরে আরও দু’জন শরবত খাচ্ছিল। আর তোমাদের দিকে বারবার চাইছিল। তাই ফুলকি তোমার হাতটা ছুঁতে পারছিল না। তার মনে তখন কি দুঃখের বানই না বইছিল। তোমার মনের সব দুঃখের ভার ফুলকি তুলে নিতে চাইছিল। লোকদুটো বেরিয়ে যেতেই ফুলকি তোমার একখানা হাত তার দু’ হাতের মধ্যে তুলে নিয়েছিল। তোমার দৃষ্টিতে যেন প্রাণ ফিরে এসেছিল। তুমি কি বুঝতে পেরেছিলে নিশ্চয়। তুমি আমার হাতে একটা আলতো চাপ দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিলে। তারপর আপন মনেই বলে উঠেছিলে, ‘ফুলকি, মুসলিম নেতারা বুঝতে পারছেন না, লোকের মনে কেবলই ঘৃণা ছড়িয়ে কারও কোনও মঙ্গলই তাঁরা করতে পারবেন না।. ভাবতে পার, আজ আমার হোস্টেলে কি বিষয় আলোচনা হচ্ছিল? এখন তো সবাই পাকিস্তানের স্বপ্নে মশগুল। আমি বলেছিলাম, পাকিস্তান না হয় হল, কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, ভারতে যত মুসলমান আছে সবাইকে পাকিস্তানে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হবে কি না? আমার প্রশ্নটা ওরা ধরতেই পারল না। তখন আমি ওদের বললাম, পাকিস্তান হলেও ভারতে মুসলমান প্রচুর থেকে যাবে। আপনাদের পাকিস্তানে সব মুসলমানের ঠাঁই হবে না। আবার সেই পাকিস্তানে হিন্দুও অনেক থাকবে। তাই যদি হল, তবে একটা দেশকে দুটো ভাগ করে লাভ হবে কার? এবার একজন বললেন, আপনি তো দেখি হিন্দুদের মতো কথা বলছেন।’
‘যার মতো কথাই বলি না কেন, প্রশ্নটার জবাব তো দেবেন?’
‘এ সব মুসলিম-বিরোধী কথার জবাব সাচ্চা মুসলমান দিতে বাধ্য নয়।’
আরেকজন বললেন, ‘পাকিস্তানে যদি হিন্দু থাকে তবে তো ভালই হবে, তারা হবে জিম্মি।’
‘জিম্মি বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন!’
‘তারা জামিন হিসাবে থাকবে। হিন্দুস্তানে মুসলমানদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয় সেটা যদি হিন্দুরা না দেখে, তবে পাকিস্তানে যে সব হিন্দু থাকবে তারা তার গুনাহগার দেবে।’
ফুলকি রাজনীতিতে কখনওই আগ্রহ দেখায়নি। কিন্তু এটা ওরও চোখ এড়ায়নি যে, দিন দিন কেমন উগ্রতা বেড়ে চলেছে। কেউ আর যুক্তিবুদ্ধির ধার ধারছে না। কথার মানেই কেমন বদলে যাচ্ছে ওদের। ওদের কলেজে বেশিরভাগই বড় ঘরের ছেলেমেয়ে পড়ে। মেয়েরা তৈরি হচ্ছে আই সি এস বর পাকড়াবার জন্য। তাদের মুখে শুধু শাড়ি আর গাড়ি আর সিনেমায় দেখা নতুন ফ্যাশনের কথা। আর ছেলেদের মুখে রাজা উজির মারার গল্প। এর মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা তাদের কেরিয়ার গড়ার ফিকিরেই মত্ত। দেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা ওদের কোনও ভাবনার মধ্যেই আসে না। ইট ড্রিংক অ্যান্ড বি মেরি, অধিকাংশের জীবনদর্শনই এই। তাই তো ফুলকি শামিমকে দেখে প্রথমে এত অবাক হয়েছিল। এই একটা লোক যে ভাবে, যে কষ্ট পায়। শামিম, শামিম আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আমি আমার ভালবাসা দিয়ে তোমায় ভরিয়ে দেব। তোমার মনের কষ্ট মুছে দেব।
তোমার মনে আছে শামিম, ফুলকি কি বলেছিল? মনে আছে তোমার?
আজকাল কথার মানেই বদলে যাচ্ছে শামিম। আমি তো মুসলমানদের চিনিনে। কিন্তু আমার ধারে কাছের লোকেদের তো চিনি। কিছুদিন আগেও যারা গুণ্ডাবাজি বলত, এখন তারা সেটাকে বলছে বীরত্ব। ভদ্রতা শালীনতাকে ওরা এখন বলছে কাপুরুষতা। গলার জোরকে ওরা বলছে যুক্তি। আর দলের জোরকে ওরা বলছে শক্তি।
‘হ্যাঁ ফুলকি, আর ঘৃণাকে বলছে, এটাই আজকের দিনের ক্রিড। আজকের যুগের ধর্ম।’
তুমি অত হতাশ হয়ো না শামিম, ফুলকি মনে মনে বলছিল। তুমি বিচলিত হয়ো না। জগতে কোথাও যদি ভালবাসা না থাকে শামিম, তুমি বিশ্বাস রেখো, আমার হৃদয়ে ভালবাসা আছে। আমি তাই দিয়ে তোমাকে ঢেকে রাখব।
‘আমার ভয় করে ফুলকি। আমরা এক জীবন্ত আগ্নেয়গিরির উপর দাঁড়িয়ে আছি। অথচ কেউ যে সে সম্পর্কে সচেতন, কেউ যে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন, কারও কথা শুনে সেটা মালুম হয় না। আমার ভয় করে।’
‘ওগো মা, সেই তখন থেকে খাবার লিয়ে বসে আছি গো। সব ঠাণ্ডা হয়ে গেল।’
‘তোমাকে যখন ভেঙে পড়তে দেখি শামিম, তখন আমারও, আমারও কেমন ভয় করে।’
শামিম আমার মনে ভালবাসা আছে, তোমার মনে ভালবাসা আছে। এই ভালবাসার শক্তি কি জগতের সমস্ত ঘৃণাকে মুছে দিতে পারবে না?
‘ওগো মা ওগো মা ওগো মা। কি শরীল ভালো আছে তো? কথা কইছনি কেন?’
৩
‘আমি মারা গেলে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান হবে না। নিজে হিন্দু ব্রাহ্মণ কন্যা বর্তমানেও আমি ব্রাহ্মণ। কিন্তু ঐ সব তথাকথিত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মন্ত্রঃপূত উৎসর্গ করা তিল চালের পিও গ্রহণে আমার বিশেষ আপত্তি।’
এই ডায়েরি অমিতার। ফুলকির নয়। অমিতা ডায়েরিতে তারিখটা দেখে নিল।
২৬ জানুয়ারি ১৯৮২।
২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবসে, অমিতা দেখল, সে ঘোষণা করছে যে, সে হিন্দু কন্যা! নিজেকে বলছে, ‘বর্তমানেও আমি ব্রাহ্মণ।’ আশ্চর্য! এটা তার তো কখনও খেয়াল হয়নি। অবশ্য এটা ঠিক যে, সে ব্রাহ্মণের ঘরেই জন্মেছে। তার বাবা সুধাকর চক্রবর্তী। তার দিদি ঝুমরি বাবাকে অস্বীকার করেছিল, কিন্তু তার বাবার কৌলিক পদবী সে ছাড়েনি। সে, অমিতা, বিয়ের পর বাবার পদবী ছেড়েছিল। তার প্রথম স্বামী সমীরেন্দ্রের পদবী সে গ্রহণ করেছিল। সমীরেন্দ্রকে সে ছেড়েছিল, কিন্তু সমীরের পদবী নিয়েই সে জীবনটা কাটিয়ে দিল। কেন? সে বলতে পারে না। সমীরেন্দ্রও তো ব্রাহ্মণ ছিল! ব্রাহ্মণ মার্কসবাদী। অমিতার চোখের উপর যেন এক একটা করে অজানা জগৎ ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হচ্ছে। সমীরেন্দ্রও ব্রাহ্মণ ছিল! অমিতা তথ্যটাকে উদ্ঘাটন করে যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। যোগীশ্বর? হ্যাঁ, যোগীর আবার পৈতেও ছিল। বামুন চিনি পৈতে প্ৰমাণ, বামনি চিনি কি করে? অমিতা বামনি! বামনি চিনি কি করে? অমিতা বামনি! বামনি চিনি কি করে? রামুন বাড়ির ছেলে হয়ে জন্মালে অমিতার চুড়ো হত, উপনয়ন হত। গলায় পৈতে ঝোলাতে পারত। আচমন করতে পারত। গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতে পারত। সে যে বামুন সর্বদাই একটা না একটা ঘটনা তাকে সেটা মনে করিয়ে দিত। কিন্তু অমিতা কতটা বামুন, সেটা সে জানে না। যেটা জানে, সে মেয়ে। মেয়ে বলেই সে জানে, বামুনগিরি জাহির করবার জন্য যে-সমস্ত অনুষ্ঠান, সে সব তার জন্য নয়। বামুনের ঔরসে বামনির গর্ভে সে জন্মেছে, তাই সে ব্রাহ্মণ কন্যা। কিন্তু ‘বর্তমানেও আমি ব্রাহ্মণ’ এবং ‘হিন্দু’, এ কথা লিখে রাখার অর্থ কী? তুমি ব্রাহ্মণ বর্ণের শ্রেষ্ঠ, এ কথা জাহির করার জন্যই কি তোমার ডায়েরিতে কথাগুলো লিখে রেখেছিলে? তুমিও তাহলে জাত মানো? ভুলে যেও না অমিতা, তুমি কোন অবস্থায় এ কথা লিখেছিলে? তুমি তখন অসহায়। এবং একা। এবং ক্যানসারে আক্রান্ত। অস্বীকার করো না অমিতা, তুমি তখন মৃত্যু ভয়েও আক্রান্ত হয়েছিলে। আর তা ছাড়া তোমার বর্ণের গৌরব প্রতিষ্ঠা করার কোনও উদ্দেশ্যও তোমার ছিল না। তুমি মরে যাবার পর অন্যেরা তোমাকে ‘কি চোখে দেখবে, সেটাই তুমি বলতে চেয়েছিলে। হয়ত তোমার ছেলে মেয়ের কথাও তখন তোমার মনে থাকবে। তাদেরই হয়ত তোমার অন্তিম ইচ্ছাটি জানিয়ে যেতে চেয়েছিলে।
‘আমি অশৌচকেও মানিনে। আমার জন্য কারও মনে যদি কোনও শোক বা শ্রদ্ধা জাগে, তাহলে বাইরে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে সেটা জানাবার দরকার নেই। যে আমাকে ভালবাসবে আমি তার হৃদয়েই বাসা বেঁধে থাকব সেই ভালবাসার উষ্ণ নীড়ে।’
এই ইচ্ছাটিই সে লিখে রেখেছিল, সেই প্রজাতন্ত্রী দিবসের ভোরে। আরও কত ইচ্ছে যে তার ছিল! অমিতার মনে হয়েছিল, কেউ বা কারা যদি তার একটা ছোট স্মরণসভার আয়োজন করে তবে সে তৃপ্তি পাবে। সেই সভায় আর কিছুই হবে না, তবে উপনিষদ এবং গীতা থেকে কিছু পাঠ হলে তার ভাল লাগবে। এক সময় আত্মা-ফাত্মা নিয়ে তার মার্কসবাদী মন খুব ঠাট্টা বিদ্রূপ করেছে। সমীরেন্দ্রকে খুশি করবার জন্য নয়, মার্কসবাদেই তার আস্থা ছিল। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে তার এইসব ব্যাপার বড় খতিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। সন্দেহ নেই, এক সময় অমিতা এতই নির্বোধ ছিল যে যে নিজে কিছু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি কেবলই পরের মুখে ঝাল খেয়েছে। পরবর্তীকালে সে নিজেকে ‘শুননি মার্কসিস্ট’ বলে ঠাট্টা করেছে। সে শুনে শুনে মার্কসিস্ট। কিন্তু তখন সে অমিতা তো আর এ অমিতা ছিল না। তখন তার ক্যানসার হয়নি। এক সময় সে ভাবত, মানুষ মরে গেলেই চুকে গেল। তার আর কিছু থাকে না। ‘দেহপট সনে নট সকলই হারায়।’ কিন্তু সে দেখেছে মানুষ চলে গেলেও তার স্মৃতি থাকে। কিন্তু কোথায় থাকে সেই স্মৃতি? আত্মায় না মস্তিষ্কে? অমিতা জানে, সে মৃত্যুর জন্য এবং মৃত্যু অমিতার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছে। কার ধৈর্য আগে ফুরোবে, এখন তারই অপেক্ষা। কিন্তু এত যে সংগ্রাম সে করে গেল, করে চলেছে নিরন্তর, তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তার দাগও মুছে যাবে? ভাবতে অমিতার কষ্ট লাগে। কেউ তাকে মনে রাখবে না! কেউ তাকে স্মরণ করবে না!
‘যদি আমাকে নিয়ে কেউ স্মৃতিসভার আয়োজন করেন, তবে তাঁর বা তাঁদের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা বাছাই তালিকা করে রেখে যাব। তার মধ্যে প্রথম গানটা থাকবে, ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।’ জর্জদা তুমি তো আমাকে খুবই ভালবাসতে, তুমি গানটা গাইবে আমার স্মৃতিসভায়? এর চাইতে ভাল কিছু আর ভাবতে পারিনে জর্জদা। হেমন্ত, তুমি তো আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলে, আমার অসুখের মধ্যে এসেও তো কত গান গেয়ে গিয়েছ। আমি তাতে প্রাণ ফিরে পেয়েছি হেমন্ত। আমার বাঁচার সংগ্রামকে তুমি উসকে দিয়েছ হেমন্ত। তুমি আমার স্মৃতিসভায় সেই গানটা করবে : ‘যখন রব না আমি দিন হলে অবসান, আমারে ভুলিয়া যেও মনে রেখো মোর গান।’ আহ হেমন্ত, কী মধু ঢালা তোমার কণ্ঠস্বর! কিন্তু কি পাগল আমি দেখো। এখন তোমাদের কোথায় পাব জর্জদা? কোথায় তোমাকে পাব হেমন্ত? পরলোকে? পরলোক কি আছে? থাকুক না থাকুক, এই বিশ্বাসটা থাকলে ক্ষতি কি, তোমরা কোথাও না কোথাও আছো। আমার জন্য অপেক্ষা করছ! আমি তো পরে যাচ্ছি। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে আমার। কোনও এক সুন্দর আনন্দলোকে, কোনও অমৃতলোকে।
অমিতার চোখ ভিজে হয়ে এল। যন্ত্রণায় নয়। আনন্দের অনির্বচনীয় এক অনুভূতিতে। ধরা গলায় অমিতা ডাকল, মন্টুর মা!
মন্টুর মা কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি বলছ গো মা?’
.
অমিতা মন্টুর মাকে যেন নতুন দেখছে, সেই ভাবে তার দিকে চেয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি পোশাকের আলমারিটা খোল তো?
অমিতার আচমকা হুকুমে মন্টুর মার বুকটা দুর দুর করে উঠল। সে ফ্যাল ফ্যাল করে অমিতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। কপালে আজ কি নেখা আছে কে জানে? মন্টুর মায়ের মনে এক অজানা ভয় ক্রমশ ছয়ে পড়তে লাগল।
তুমি পোশাকের আলমারিটা খোল মন্টুর মা।
অমিতা আজ আর নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। সে অনুভব করছে ভিতরে ভিতরে তার মধ্যে একটা আকুলতা জেগে উঠছে। যে সব রশি দিয়ে তার প্রাণটা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকে, আজ সেই সব রশির বাঁধন পট পট করে ছিঁড়তে শুরু করেছে যেন। এখনই অমিতাকে একটা কিছু করতে হবে। পোশাকের আলমারিটা খুলে আজ তাকে কিছু জঞ্জাল সাফ করতে হবে।
আলমারিটা খোল না মন্টুর মা। দেখি কি ছাইভস্ম ওতে আছে।
মন্টুর মা বুক ঢিপ ঢিপ করতে করতে এগিয়ে গেল অমিতার পোশাকের আলমারিটার দিকে। আজ কপালে কি আছে কে জানে?
অমিতার আর তর সইছিল না। মন্টুর মা আলমারিটার কাছে এগিয়ে যেতেই সেও তাড়াতাড়ি উঠতে গেল, অমনি ফুলকির ডায়েরিটা তার কোলের উপর থেকে মেঝেই পড়ে গেল। অমিতা তাড়াতাড়ি সেটা আবার কুড়িয়ে নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। ডায়েরিটা খুলে ফেলল সে। কয়েকটা পাতায় কোনও কিছুই লেখা নেই। আবার কয়েকটা পাতায় পর পর লেখা রয়েছে। মন্টুর মা ততক্ষণে আলমারির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু অমিতার আর সে দিকে মন নেই।
.
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘প্রতি অঙ্গ লাগি কান্দে প্রতি অঙ্গ মোর। এমন কোনও চিন্তা বা চেতনা মনে আসবে বলে ভাবিনি। চিরকালই নীতিবাগীশদের দলে—সমস্ত কিছুকেই সংস্কারের ঘেরাটোপ দিয়ে দেখেছি, অসংস্কৃত সমস্তই ছিল ঘৃণ্য, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির এমন অসামান্য বদল হল কেন?
মন্টুর মা আলমারিটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
৯ সেপ্টেম্বর
‘আজ সন্ধ্যাটা বেশ সুন্দর কাটল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক পথ চলেছি। কী আশ্চর্য ভালই না লাগছিল তোমার সাথে পথ চলতে—সিনেমার সেই গানটার মতো—জানি না কোথায় আছি রাশিয়া কিংবা রাঁচী, শুধু জানি পাশাপাশি দুজনে—
‘সরু রাস্তা ধরে চলেছি—এমন একান্ত করে কাছে পাওয়ার সুখ বহুদিন অনুভব করিনি যেন—অথচ গতকালই…….
‘তৃপ্তি নেই—লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয় রাখল তয়ো হিয়া জুড়ন না গেল—ঘরে ফিরে এসে ভাবছি সত্যই তুমি আমার কতখানি জুড়ে আছ—আমার সমস্ত সত্তায় মিশে গেছে তোমার অস্তিত্ব—কোনও আবেগ নয়, তরল উচ্ছ্বাস নয়, আমি বুঝি, সকল হৃদয় দিয়ে বুঝি।
তুমি যে তুমিই ওগো
সেই তব ঋণ
আমি মোর প্রেম দিয়ে
শুধি চিরদিন।
.
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘ভাল লাগছে না। দুপুরের ট্রেনে সে চলে গেল। ভাল লাগছে না। পড়াশোনাও হল না। শামিম শামিম শামিম! নাহ আর পারছি না।’
যে দ্বার খুলিয়া গেলে রুদ্ধ সে হবে না কোনওমতে।
কানপাতি রবে তব ফিরিবার প্রত্যাশার পথে
তোমার অমূর্ত আসা যাওয়া
যে পথে চঞ্চল করে দিগালার অঞ্চলের হাওয়া।
.
১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘দেখা পাওয়ার একটা ব্যর্থ আশা সমস্ত মনটাকে ভেঙে দিল—শুধু মন নয়, সমস্ত শরীর আজ বিপরীত পথে চলছে, বিষাদ-অবসাদ পরিপূর্ণ মন আর দেহ সব রকমের আনন্দ উচ্ছ্বাসকেই চোখের জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি উদ্বেগ দুশ্চিন্তা মনটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে—প্রভু, আর কত?’
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘আজ আর সহ্য হচ্ছে না। অনেক মূহুর্তই কেটে গেল—কত কত দিন! অকাজের সময় কাটতে চায় না। বিকালে ফাঁকা লাইব্রেরিতে কেমন একটা খালি খালি লাগছিল বুকটা। যেন কিছুই নেই অথচ সবই আছে—নেই শুধু তুমিই।
‘এই হল প্রেম—একেবারে আমার আমিকে বিলিয়ে দেওয়া তোমার কাছে। ভাবতে ইচ্ছে করে সেই তুমি এখন কোথায়—কিভাবে—জানি হয় তো বা নানা কাজে ব্যস্ত, তবু তার অন্তরের অন্তরালে বয়ে যাচ্ছে আমি সত্তা।
মন্টুর মা অমিতার পোশাকের আলমারিটা খুলে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। একবার ভাবল ডাকে বুড়িকে। বুড়ি কি আমাকে ভুলে গেল?
৪
ফুলকি বুকে বালিশ দিয়ে ডায়েরি লিখছিল। ‘২০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫। তার এক অসাধারণ বিশ্লেষণী চিঠি পেয়েছি কাল। আমায় সে কেমন দেখেছে—কেমন বুঝেছে তার জীবনে আমার প্রয়োজন—ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে অপূর্ব ভাষায়। আমার কেমন মনে হয়, শামিমের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক কবি। শামিম শামিম! সত্যিই আমার শামিম, আমার কবি, আমাকে ভুল বোঝেনি, সমস্ত জীবন দিয়েই এই তো তাকে বোঝাব, কবি আমার, সমস্ত পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও তোমার কাছেই আমি আছি রইব, তুমি শুধু এই বিশ্বাসটুকু রেখো শামিম–কিছু নাহি ভয় জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি।’
চুমকি দড়াম করে দরজা খুলে ফুলকিকে দেখে অবাক হল।
‘দিদি তুই এখানে!’
ফুলকি আঁচলের তলায় ডায়েরিটাকে চাপা দিয়ে উঠে বসল।
‘আমি ভেবেছি, তুই বাবাদের কাছে। শামিমদা যেন কাকে নিয়ে এসেছেন
শামিম! শামিম কখন এসেছে?
‘সেটা তো তোরই জানার কথা। এসেছে তো অনেকক্ষণ। বাবা একবার তোকে ডেকেও ছিলেন।’
অমিতার বুকটা ধক করে উঠল। ওর মুখে ছলাৎ করে রক্ত উছলে পড়ল। শামিম! শামিম এসেছে আর সে কিছু জানে না! তার প্রচণ্ড অভিমান হল।
‘বাবা তোকে খুঁজছেন দিদি।’ চুমকি যেমন এসেছিল তেমনই চলে গেল। ফুলকি বসে রইল। কিছু যেন সে বুঝতে পারছিল না। শামিম এসেছে, আর সে কিছু জানে না? ফুলকির চোখ হঠাৎ জলে ভরে এল। কেন, সে জানে না। শামিম এসেছে! কথাটার মানে যেন সে এই মুহূর্তে ধরতে পারল। সে ধড়মড় করে উঠে পড়ল। ডায়েরিটাকে সে যত্ন করে তার ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে তর তর করে নিচে নেমে গেল। তারপর সে থমকে দাঁড়াল। আবার ফুলকি উপরে উঠে গেল তর তর করে। নিজের ঘরে ঢুকে আয়নায় মুখটা দেখে নিল। সর্বনাশ! তার চোখে জলের দাগ। ভাগ্যিস বাবার ঘরে ঢোকেনি! ফুলকি বাথরুমে ঢুকল। একটু পরে সে যখন বেরিয়ে এল তখন তার চেহারা অন্যদের পাতে দেবার মতো হয়েছে। ফুলকি ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাবার ড্রয়িংরুমে ঢুকল। বাবা বললেন, ‘হাসেম সাহেব, এ আমার মেয়ে অমিতা।’
হাসেম সাহেবের চেহারা দেখে সম্ভ্রম হয় মনে। তাঁর চোখে কালো চশমা।
‘বসো মা।’ হাসেম সাহেবের আন্তরিক ভাব ফুলকির খুব ভাল লাগল। ‘সুধাকরবাবু, এই একটা ব্যাপারে আপনাদের খুব ঈর্ষা করি আমরা। আপনাদের কবি বলেন, না জাগিলে ভারত ললনা, এ ভারত বুঝি জাগে না। আর আমাদের মোল্লা সাহেবরা বলেন, মুসলমানের ললনা, খবরদার তোমরা জাগিও না। তোমরা জাগিলেই ইসলামের সর্বনাশ ঘটিবে।’
হাসেম সাহেবের কথার ধরনে সবাই হেসে উঠলেন।
তায়েবকাকা বললেন, ‘জাগতেই হবে হাসেমভাই। যে কথাটা আমরা বুঝতে চাইছিনে কেবলই চোখ বুজে নসল্লা করে যাচ্ছি, মহাকাল সেটা আর বেশিদিন বরদাস্ত করবেন বলে মনে হয় না। ভাবতে পারেনে, একটা সমাজ, একটা জাতি জেগে উঠতে চাইছে তার অর্ধেক সত্তা অন্ধকারে রেখে। এ কখনও হতে পারে, না কোথাও এটা হয়েছে?’
‘এইটেই তো মুসলমান সমাজকে পঙ্গু করে রেখেছে তায়েবভাই। আমরা এমনই আত্মবিস্মৃত যে, একটা মহাসত্যকেও আমরা অগ্রাহ্য করে চলেছি, ভুলে গিয়েছি যে, বিশ্বের প্রথম মুসলমানই নারী।’
তায়েবকাকা বললেন, ‘আমি যখন নয় দশ বছরের বালক, তখন আমার বাবা আমাকে বাংলায় নবীর জীবনী পড়ে শুনিয়েছিলেন। সে কী ভাষা! বইটার নাম মহম্মদ চরিত। যেন সঙ্গীত। আমার মর্মে মর্মে তা গিঁথে আছে। তায়েবকাকা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করতে লাগলেন। বহুদিনের অশেষ যাতনার পর মহম্মদ পূর্ণকাম হইয়াছে, তাঁদের বদনে আনন্দের দ্যুতি, হৃদয়ে উল্লাসের তরঙ্গ উন্মত্ত হইয়া ছুটিয়াছে। পবিত্রতার সৌরভ তাঁহার অঙ্গ হইতে চারিদিকে বিকীর্ণ হইয়া পড়িতেছে, তিনি আনন্দে বিভোর হইয়া প্রাণাধিকা খদিজার নিকট উপস্থিত হইলেন। দিবানিশি অশ্রুজল যাঁহার নয়নে লাগিয়াছিল, দিবানিশি হাহাকার আর্তনাদ ব্যতীত যাঁহার মুখে অন্য শব্দ ছিল না, আজ তিনি আনন্দে চারিদিক উদ্ভাসিত করিয়া গৃহে আসিলেন। তাঁহার মুখ দেখিয়াই খদিজা বুঝিলেন, স্বামীরত্ন যাঁহার বিরহে দিনযামিনী বিলাপ করিয়াছেন, আজ নিশ্চয়ই লাভ করিয়া কৃতার্থ হইয়াছেন। মহম্মদ প্রাণ খুলিয়া ঈশ্বরকৃপার অলৌকিক ব্যাপার, ঈশ্বর প্রকাশের অদ্ভুত কথা, স্ত্রী নিকট প্রকাশ করিলেন, সে অমৃতময় কথা শ্রবণ করিতে করিতে খদিজার সর্বাঙ্গ পুলকিত হইয়া উঠিল, প্রাণাধিক স্বামীর মুখে ঈশ্বরকথা শুনিয়া তিনিও ব্রহ্মাণ্ড ঈশ্বরময় দেখিতে লাগিলেন। ভ্রম কুসংস্কার তিরোহিত হইল, পৌত্তলিকতা পরিহার করিয়া খদিজা মহম্মদের সর্বপ্রথম শিষ্য হইলেন, খদিজার প্রাণে সতধর্মের বীজ বদ্ধমূল দেখিয়া মহম্মদ অপরিসীম আনন্দ লাভ করিলেন, স্ত্রীকে সহচারিণী দেখিয়া মহম্মদের উৎসাহ আরও বর্ধিত হইল। স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মিলিয়া প্রতিদিন ভক্তি ও বিশ্বাসভরে একমাত্র ঈশ্বরের অর্চনা করিয়া কৃতার্থ হইতে লাগিলেন।’
তায়েবকাকার আবৃত্তিতে ফুলকি অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তায়েবকাকার পরের কথায় বিস্ময় আরও বেড়ে গেল।
‘এই জীবনী এক হিন্দুর লেখা। আজকের যুগে কেউ এ কথা বিশ্বাস করবে!’
সবাই চুপ করে বসেছিলেন। তায়েবকাকার গম্ভীর ভরাট গলার আবৃত্তি, ফুলকির মনে হল, সমগ্র ঘরটার মধ্যেই যেন প্রতিধ্বনি করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক অপূর্ব অনুভূতিতে তার মন ভরে উঠল।
শামিম স্তব্ধতা ভাঙল। ‘এটা কার রচনা চাচা?’
তায়েরকাকা বললেন, ‘কেশব সেনের বন্ধু কৃষ্ণকুমার মিত্রের রচনা। কেশব সেন তাঁর আরেক বন্ধু গিরিশচন্দ্র সেনকে দিয়ে কোরানের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। সেইটাই হচ্ছে বাংলা ভাষায় কোরানের প্রথম অনুবাদ। সেই গ্রন্থটিও অপূর্ব। গিরিশ সেনকে সেই আমলের মুসলমানেরা শ্রদ্ধা জানিয়েছিল মওলানা গিরিশ নাম দিয়ে।’
‘খদিজা আজ যদি জন্ম নিতেন তাহলে তাঁকে আজকের বাংলাদেশের মুসলমান সমাজ কোথায় স্থান দিত?’
‘হেঁশেলে কিংবা আঁতুড়ঘরে।’ তায়েবকাকা তিক্ত হাসি ছড়িয়ে দিলেন তাঁর ঠোঁটে।
হাসেম সাহেব বললেন, ‘হিন্দু কোরানের অনুবাদ করছে, মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করছে, একেই তো বলে কসমোপলিটান কালচার। এইটাই ছিল আমাদের, বাঙালিদের স্বাভাবিক ঐতিহ্য।’
তায়েবকাকা বললেন, ‘বাঙালি এক সময়ে সমগ্র ভারতকে পথ দেখিয়েছে। আজ সে কেবলই তল্পী বয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলার শেষ নেতা ছিলেন দেশবন্ধু সি আর দাশ।
হাসেম সাহেব বললেন, ‘বঙ্গভঙ্গ পর্যন্ত বাঙালি বাঙালি ছিল। তখনও পর্যন্ত বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান, এই সাধনা চলেছে। আমার বাবা সুরেন্দ্রনাথের ফলোয়ার ছিলেন। বাবা সুরেন্দ্রনাথকে মিঃ সারেন্ডার নট্ বলেই ডাকতেন।’
‘আমরা এখন সুরেন্দ্রনাথকে ভুলেছি, দেশবন্ধুকে ভুলেছি। যত ভুলছি ততই বাঙালির মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছে। কসমোপলিটান কালচার থেকে সরে যাচ্ছে। বাঙালি তার কসমোপলিটান দৃষ্টিভঙ্গী বিসর্জন দিয়ে অখণ্ড ভারতীয়ত্বের কাল্পনিক ধারণার কাছে আত্মসমর্পণ করছে। বাঙালি হিন্দু এখন ভারতীয় জাতিতত্ত্বের মহিমাকীর্তনে ব্যস্ত। তার নেতা এখন গান্ধী, জওহরলাল, বল্লভভাই। আর এরই প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি মুসলমান জোট বাঁধার চেষ্টা করছে পশ্চিমা মুসলমান নেতাদের সঙ্গে। পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখছে। তাদের একচ্ছত্র নেতা বলে জিন্নাকে মেনে নিয়েছে। এতে বাঙালি হিন্দু কতটা ভারতীয় হবে বা বাঙালি মুসলমান কতটা পাকিস্তানি হয়ে উঠবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। কিন্তু বর্তমান যে দিন দিন বাঙালি হিন্দুর এবং বাঙালি মুসলমানের কাছে বিষাক্ত হয়ে উঠছে, এটাই আশঙ্কার কারণ হাসেমভাই।’
হঠাৎ শামিম বলে উঠল, ‘আজ হিন্দু আর মুসলমানকে আপন ভাবে না, মুসলমানও ঠিক করে ফেলেছে যে, হিন্দুই তার শত্রু। এর কারণেই কাজ এত বিদ্বেষ এত ঘৃণা ছড়িয়ে পড়েছে। আমি জানতে চাই, ঘৃণা যে সন্তানের জন্ম দেয়, সে কি কারও কোনও কল্যাণ করতে পারে?’
ফুলকি দেখল বাবা এতক্ষণ পরে মুখ খুললেন। বাবা বললেন, ‘না, ঘৃণাই যে সন্তানের জনক সে কারও মঙ্গল করতে পারে না শামিম। হিন্দু মুসলমানের মধ্যে এই বিদ্বেষ উভয়েরই ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু যাঁরা বলছেন, আজকের পলিটিকসই এই বিদ্বেষকে তীব্র করে তুলেছে, তাঁরা আমার মনে হয়, সমস্যাটার সরলীকরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যা নিয়ে ভেবেছিলেন। সেই ১৯১১ সালেই তিনি বলেছিলেন, এখন জগৎ জুড়িয়া এ সমস্যা নহে, কী করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া এক হইব—কিন্তু কী করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়াই মিলন হইবে। সে কাজটা কঠিন—কারণ, সেখানে কোনওপ্রকার ফাঁকি চলে না, সেখানে পরস্পরকে জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়। সেটা সহজ নহে, কিন্তু যেটা সহজ সেটা সাধ্য নহে, পরিণামের দিকে চাহিলে দেখা যায় যেটা কঠিন সেটাই সহজ। আজ আমাদের দেশে মুসলমান স্বতন্ত্র থাকিয়া নিজের উন্নতিসাধনের চেষ্টা করিতেছে। তাহা আমাদের পক্ষে যতই অপ্রিয় এবং আপাতত তাহাতে আমাদের যতই অসুবিধা হউক, একদিন পরস্পরের যথার্থ মিলনসাধনের ইহাই প্রকৃত উপায়।
‘সুধাকর, রবীন্দ্রনাথের এই কথাতেও আমরা গুরুত্ব দিয়ে কখনও ভেবে দেখেনি।’
‘কেউ যে একেবারে দেননি তাও ঠিক নয়, তায়েব। দেশবন্ধুর পলিটিককে, আমার তো মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের এই চিন্তাধারা বেশ প্রভাবিত করেছিল। তাঁর বেঙ্গল প্যাক্ট ভেদ রক্ষা করেই তো মিলনের প্রচেষ্টা ছিল।
সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত আলোচনা চলেছিল। হাসেম সাহেবকে ফুলকির খুব ভাল লেগেছিল। ওঁর কথাগুলো যেমন যুক্তিপূর্ণ আবার ওঁর যুক্তিগুলো খুব জোরাল।
হাসেম সাহেব বলেছিলেন, ‘দেখুন সুধাকরবাবু, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আজকের হিন্দু মুসলমান বিদ্বেষের তীব্রতা বেড়েছে এবং এটা আমাদের ভুল পলিটিক্সের জন্য। কিন্তু পলিটিক্স হিন্দু মুলসমানের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করছে, এটা ভুল। বা ব্রিটিশ হিন্দু মুসলমানের মনে বিদ্বেষের জন্ম দিয়েছে, শুধু মাত্র এই কথা বলাটাও ঠিক নয়। হিন্দু মুসলমানে একটা বিরোধ ছিল, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তার সুযোগ পূর্ণ মাত্রায় গ্রহণ করেছে। এটা অস্বীকার করে লাভ নেই হিন্দু মুসলমানে বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে, ভারতে মুসলমান আসবার পর থেকেই।
বাবা বলেছিলেন, ‘আগে আমরা এমন এক রকম করে মিলে ছিলাম যে, আমাদের মধ্যেকার ভিন্নতাটা চোখে পড়ত না। ভেদ সম্বন্ধে আমরা যে অচেতন ছিলাম তা নয়। অল্ বিরুনীকে তো আর আজকের পলিটিশিয়ান বলা যাবে না। তিনি এগারো শতকের লোক। তাঁর বিবরণে তিনি লিখেছেন, হিন্দুরা সর্বাংশে আমাদের চাইতে পৃথক। মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের সাধারণ মনোভাব সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন, হিন্দুদের গোঁড়ামি এত প্রবল যে, সকল বিদেশীরাই ম্লেচ্ছ বা অপবিত্ৰ এবং তাদের সঙ্গে বিবাহ বা অন্য কোনও প্রকার সম্বন্ধ যেমন একত্রে উপবেশন, পানভোজন ইত্যাদি নিষিদ্ধ, কারণ এতে তারা কলুষিত হয়ে যাবে। বিদ্যাপতি বলেছেন, হিন্দু তূরকে মিলিল বাস, একক ধম্মে অওকো উপহাস। অতএব এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, হিন্দু মুসলিম ভেদ সম্বন্ধে আমরা সচেতন ছিলাম। এবং সেই ট্রাডিশন আমরা এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। অবিশ্যি সন্ত-সাধকদের অক্লান্ত চেষ্টা, কবীর নানক দাদু রজ্জব, এইসব সন্তের নিরন্তর সাধনা মিলনের একটা বাতাবরণ এক সময় তৈরি করেছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত মহল এ সবে ভ্রুক্ষেপও করেনি। সন্তের চেয়েছিলেন মানুষকে তার ধর্মীয় খোলস থেকে বার করে আনতে। এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন ঘটাতে।’
তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘সন্তসাধকদের আমরা ব্যর্থ নমস্কারেই দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছি সুধাকর।’
‘একদিকে ধর্মের গোঁড়ামি আর একদিকে আচার বিচারের গোঁড়ামি, হিন্দু মুসলমানকে আলাদা করে রেখেছে এই ঘটনা। মসজিদের সামনে বাজনা বাজালে মুসলমানেরা খেপে যাবে, অতএব বাজাও মসজিদের সামনে বাজনা। সেটাই ধর্ম পালন। প্রকাশ্য স্থানে গো কোরবানি করলে হিন্দুরা ধর্ম নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করে, তবে করো প্রকাশ্য গোরু জবাই। এই তো আমাদের ধর্ম পালনের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কাকাবাবু।’
তায়েবকাকা বললেন, ‘অথচ দেখ, ইসলামে উপাস্য তো অলখ নিরঞ্জন। তিনি জ্ঞানের অতীত, ধারণার অতীত। তাঁর মহিমাকে অন্তরে উপলব্ধি করাই মুসলমানদের কর্তব্য। এই যে মসজিদের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করা, এটাও কি এক ধরনের পৌত্তলিকতা নয়? যে অলখ নিরঞ্জন তাঁকে উপলব্ধি করার যে উপাসনা তার জন্য মসজিদ লাগবে কেন? যে কোনও জায়গাতেই তাঁর উপাসনা চলতে পারে। একজন সন্তু একবার মসজিদের দিকে পা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এক ভক্ত এসে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আপনার কি আক্কেল নেই! মসজিদের দিকে পা বাড়িয়ে শুয়ে আছেন? পা সরান। সন্ত জিজ্ঞাসা করলেন, মসজিদে কী হয়? ভক্ত বললেন, আল্লাহর উপাসনা হয় জানেন না? সন্তু বললেন, আমি তো জানি, তুমি জান কিনা সেইটাই হল প্রশ্ন। আচ্ছা ভাই তাহলে তুমি অনুগ্রহ করে আমার পাটাকে এমন দিকে ঘুরিয়ে দাও, যেদিকে আল্লাহ নেই। আমরা পৌত্তলিকতা মানিনে বলে দাবি করি, কিন্তু আমরা মসজিদ মানি। মহাজ্ঞানী এবনে রোদ্ বলেছেন, অধিকাংশ ধর্মই পৌত্তলিকতার নামান্তর মাত্র। অসীমকে সসীম করে দেখা মানেই তাকে রূপ দেওয়া। তাকে কোনও আধারে ধরতে যাওয়া মানেই তাকে রূপ দেওয়া। মসজিদের চৌহদ্দির মধ্যে আল্লাহকে ভরতে যাওয়ার নামই তাকে সীমার মধ্যে এনে ফেলা। তার মহিমাকে খর্ব করা। এনে রোদ্ বলেছেন, ধর্মের সত্য আমার মাথার মানিক, কিন্তু কোনও বিশেষ রূপ আমি স্বীকার করতে পারিনে। কি আশ্চর্য! মানুষ মন্দির ভেঙে গির্জা গড়ছে, গির্জা ভেঙে মসজিদ গড়ছে খোদার সান্নিধ্য পাবে, এই আশায়। যে অনন্ত অনাদি পরাৎপর বিশ্বের অণুতে অণুতে তরঙ্গায়িত হচ্ছে, প্রতি আত্মার নিভৃত কন্দরে যার স্পন্দন জাগছে, তাঁর সান্নিধ্যের জন্য এত গণ্ডির প্রাচীর দাঁড় করাবার প্রয়োজন কি? আজ এমন কোনও মুসলমানের দেখা পাবে তুমি, যিনি এবনে রোশদ-এর এই বাণীর মর্ম বুঝতে পারবে? এই তো ইমান। বাংলার মুসলমানেরা যদি ইমান কি তা সত্যই বুঝত, তবে মসজিদের পবিত্রতা রক্ষার নামে এত দাঙ্গা ফ্যাসাদে যেত না। তবে বুঝত আল্লাহই একমাত্র পবিত্র, মসজিদ নয়।’
তায়েবকাকার কথার মধ্যে একটা চাপা বিষাদ লুকিয়ে ছিল, ফুলকির মনে সেটা দাগ কেটে গেল। এইসব লোক কি কখনও কারও কাছে মর্যাদা পাবে? যেদিন আমরা এঁদের মতো লোককে মর্যাদা দিতে পারব, সেদিন থেকেই কি ঝগড়া দ্বন্দ্ব মিটে যাবে না?
‘তুমি যা বলছ তা ঠিক, কিন্তু এক হাতেই তো তালি বাজে না তায়েব। দেখ না, হিন্দু যেদিন থেকে আপন হিন্দুত্ব নিয়ে গৌরব করতে উদ্যত হল, তখন মুসলমান যদি হিন্দুর গৌরব মেনে নিয়ে চুপচাপ পড়ে থাকত তবে হিন্দু খুব খুশি থাকত সন্দেহ নেই। কিন্তু যে কারণে হিন্দুর হিন্দুত্ব উগ্র হয়ে উঠল সেই কারণেই মুসলমানের মুসলমানি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। এখন সে মুসলমান রূপেই প্রবল হতে চায়, হিন্দুর সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রবল হতে চায় না।’
হাসেম সাহেব বলেছিলেন, ‘আপনি যা বললেন সুধাকরবাবু, এটাই আজকের সব মুসলমানের মনের কথা।’
‘হাসেম ভাই, এ আমার কথা নয়। কথাটা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ
‘ঠিক কথা বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সুধাকরবাবু। রবীন্দ্রনাথ ঠিক বুঝলে, হবে কি, অন্য হিন্দুদের এ কথা বোঝানো যাবে কি করে? আমাদের যে, কিছু কথা বলবার আছে, আমাদের যে, কিছু বেদনা আছে, আমাদের যে, কিছু দাবি আছে, মুসলমান হিসাবেই, সে কথা আমরা বলতেও চাই, বলেও যাচ্ছি, কিন্তু শোনাব কাকে?’
তায়েবকাকা বলে উঠলেন, ‘আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল শুধাইল না কেহ। এও রবীন্দ্রনাথ হাসেমভাই।’
‘কিন্তু গরজটা যে আমাদেরই। আমাদেরই কথা আমাদের তো শোনাতে হবেই। অপর পক্ষ যত চোখ কান বুজে থাকবেন, ততই ক্ষতি হবে দুই পক্ষেরই। কথায় কথায় হিন্দু নেতারা আমাদের বক্তব্যগুলোকে ভুল ভাবে উপস্থাপিত করছেন। কথায় কথায় তাঁরা আমাদের বক্তব্যগুলোকে ভুল ভাবে উপস্থাপিত করছেন। কথায় কথায় তাঁরা আমাদের বলছেন, কমিউন্যাল। কিন্তু তারাই কি ধোয়া তুলসীর পাতা? এইসব ঘটনাই তো আমাদের উভয়কে এক আগ্নেয়গিরির চূড়ায় ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। এবং সে আগ্নেয়গিরি কিন্তু জীবন্ত। যে কোনও সময় ফেটে পড়তে পারে। আমরা মুসলিমরা এই বিষয়ে খুবই কনসানর্ড। লাহোর প্রস্তাব নিয়ে হিন্দু নেতারা এত জল ঘোলা করেছেন। কিন্তু একবারও কেউ সহৃদয়তার সঙ্গে বুঝতে চেষ্টা করেননি, কি আছে ওটায়।
হাসেম সাহেব দম নিতে একটু থেমেছিলেন, না তখন চা এসেছিল, অমিতার এখন তা মনে নেই! ওর শুধু মনে আছে, শামিম আর ফুলকি সেদিন পাশাপাশি বসেছিল। এত কথাবার্তার মধ্যে ফুলকি তার পাশে বসে থাকা শামিমের অস্তিত্বটাকে যেন ছুঁতে শুরু করেছিল তার মন দিয়ে।
‘লাহোর প্রস্তাবে, কি অন্যায়টা ছিল বলুন তো সুধাকরবাবু। কি চাওয়া হয়েছিল লাহোর প্রস্তাবে? লাহোর প্রস্তাব ছিল ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ গঠনের জন্য আন্দোলনের ভিত্তি। ভারতীয় মুসলমানদের আবাসভূমি হিসাবে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের একটি হল, পাঞ্জাব সিন্ধু বেলুচিস্তান উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও কাশ্মীর নিয়ে গঠিত উত্তর-পশ্চিম ভারতে, অন্যটি হল বাংলা আসাম নিয়ে গঠিত উত্তর-পশ্চিম ভারতে, অন্যটি হল বাংলা ও আসাম নিয়ে গঠিত উত্তর-পূর্ব ভারতে। একজন বাঙালি হিসাবে এবং একজন মুসলমান হিসাবে, হ্যাঁ একজন মুসলমান হিসাবে, আমি নিজের স্বাধীনতা দেখেছিলাম লাহোর প্রস্তাবে এবং ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে আমি আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলাম।’
হাসেম সাহেবের কথাগুলো এত প্রাঞ্জল, এত আন্তরিক, এবং ওর কাছে এত নতুন যে ফুলকি একমনে হাসেম সাহেবের কথা শুনতে লাগল।
হাসেম সাহেব বলে যাচ্ছিলেন, ‘জিন্নাহ্, দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রচার করেছিলেন এবং এ তত্ত্বকে তিনি তাঁর রাজনীতির ধুয়ো হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। আমি জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলাম না। এবং বাংলায় সেটা প্রচারও করছিনে। আমি প্রচার করেছিলাম বহুজাতিতত্ত্ব। আমি মনে করি, ভারতবর্ষ কোনও একটা দেশ নয়। এ হল একটি উপমহাদেশ। ভারতবর্ষ বিভিন্ন দেশ ও জাতির সমন্বয়ে গঠিত। আমার কাছে ইওরোপ বলতে যা বোঝায় ভারতবর্ষ বলতেও তাই বোঝায়। ফ্রান্সের নাগরিক যখন বলে সে একজন ফরাসি সেটাও যেমন সত্য, আবার যখন বলে সে একজন ইওরোপীয় সেটাও তেমন সত্য।’
হাসেম সাহেব যখন এমনি করে কথাগুলো বলছিলেন, তখন ফুলকি ভাবছিল, এ তো সত্য কথা। কেন আমরা এ কথা শুনতে চাইছি না?
হাসেম সাহেব এরপর যে কথা বললেন, সেগুলো ফুলকির মনে গভীর দাগ কেটে যেতে লাগল। আজও অমিতার সে সব কথা মনে হয়।
‘বাংলার নাগরিক যখন বলে সে একজন বাঙালি সেটাও যেমন সত্য আবার সে যখন বলে সে একজন ভারতীয় সেটাও তেমনি সত্য।’
হঠাৎ হঠাৎ তার শরীরের সঙ্গে শামিমের শরীরের ছোঁয়া লেগে যাচ্ছিল। ফুলকির শরীরে তখন যেন বিদ্যুৎ-তরঙ্গ খেলে যাচ্ছিল।
‘ভারতবর্ষ মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হিসাবে পৃথিবীর কাছে সুপরিচিত। প্রদেশসমূহে মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির দাবি ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিনিধি মুসলিম লিগ উত্থাপন করেছিল। আসামের বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করে মুসলিম লিগ আসামের এবং সেই সঙ্গে বাংলারও স্বাধীনতা দাবি করেছিল। মুসলিম লিগ ভারতবর্ষের কোনও দেশকে বিভক্ত অথবা পাঞ্জাব বা পাঞ্জাবীদের বিভক্ত করার কথা চিন্তা করেনি। কাজেই ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে সাম্প্রদায়িক কিছু ছিল না।’
হাসেম সাহেব অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। ঘরে কেউ কোনও কথা বলছিলেন না। তখন রাতও হয়ে ইগয়েছে। উঠবার মুখে হঠাৎ তিনি শামিমের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তারপর বলেছিলেন, ‘ইয়ং ম্যান, উই নিড ইউ।’
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘আজ সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আদর্শের বিতর্কে বারে বারেই হেরে যেতে যেতে অযৌক্তিক যুক্তির অবতারণা করছিলাম—বেচারার বিরক্তির সীমা ছিল না–হয়ত মনে করছিল এই মেয়েটির সত্য রূপ এই! হয়ত বা শামিমের মনের অন্তরালে ভেসে যাচ্ছে অন্য এক ভবিষ্যৎ চিন্তা–হয়ত এক সাথে জীবনের পথে হাঁটার ক্ষমতা আমার থাকবে না, যা ছেড়ে আসতে চাই, তার কাছেই ফিরে যেতে চাইব। আশঙ্কা স্বাভাবিক।
‘আমি এতে দোষ দেখি না। অক্ষমতা আমার, নিজেকে মেলে ধরতে পারি না। জানি, খুব ভাল করেই আমি আমার আত্মীয়দের স্বরূপ জানি, আমাদের হিন্দু সমাজের স্বরূপটাও ধীরে ধীরে জানছি। প্রচণ্ড ঘৃণা নিয়েই সহ্য করি, পালাতে চাই বারে বারে, এই চরম সত্যটুকু শামিম বোধ হয় বোঝে না। অবচেতনে বোঝে না, তবে চেতনে সাড়া মেলে।
‘এর পাশাপাশি আজ এক বিচিত্র অনুভূতির স্বাদ পেলাম। এমন কিছু অপ্রীতিকর আলোচনায় বিষিয়ে উঠেছিল আবহাওয়া—শামিমের সার্থ প্রয়াসে আবার কাছাকাছি এলাম আমরা—এই হয়ত বা আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম—তলিয়ে যাচ্ছিলাম চেতনের অতলে, নিবিড় সান্নিধ্যে ভালবাসার উষ্ণ স্পর্শে মিশে যাচ্ছিলাম তোমাতে–এ এক আশ্চর্য অনুভূতি, এ এক অনুপম পাওয়া, তাই আজ বাক্যহারা, স্তব্ধ মনে শুধুই চেয়েছি তোমাকে, আমার শামিমকে, আমার কবিকে
‘শুধু মনে হয় কত সুখী হব আমরা—ভাল থাকব কত। তাই ফেরার পথে দু’জনের পথ যখন দুদিকে বেঁকে গেল তখনও মনের অতলে বাজতে লাগল অরূপবীণা—তোমার পাশে পাশেই চলেছি আমি, জড়িয়ে রয়েছি সমস্ত সত্তায়। এত ভালবাসাও যায়!’
কদিন ধরেই তর্কে তর্কে কাটছিল দিনগুলো। ফুলকি কেমন যেন স্বস্তি পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল তুমি যেন তাকে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিনিধি হিসাবে ধরে নিতে শুরু করেছিল। এ রকম অবস্থা সত্যিই অস্বস্তিকর। আরও অস্বস্তি তুমি স্পষ্ট করে কিছু বলছিলে না শামিম। তবে কি আমাদের মধ্যে কোথাও একটা পাঁচিল উঠছে। একবার ভাবি শামিম, তুমি আমার সেই শামিমই আছো, পরক্ষণেই তুমি এমন কোনও মন্তব্য করে বস, তখন আমার মনে হয়, আমি বোধ হয় তোমার মন থেকে ঈষৎ সরে গিয়েছি। কেন এমন হচ্ছে শামিম? কেন আমার মনে এমন চিন্তাটা ঢুঁ মেরে মেরে উঠছে?
তুমি সেদিন মুসলিম লিগের মেনুফেস্টোর একটা খসড়া আমাকে পড়ে শোনালে প্যারাগনে বসে। সেদিন দুপুরে প্যারাগনে আমরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। ছেলেটা আমাদের দেখে এগিয়ে এল, হাসল একটু, তারপর আমাদের দু’জনকে সেই ছোট্ট আধো-অন্ধকার ঘরটাতে জায়গা করে দিল। ছেলেটা যেটার নাম দিয়েছিল কেবিন। তুমি কি লক্ষ করেছিলে শামিম ছেলেটার হাসিটা। আমরা কে, সব প্রথম সেই ছেলেটাই যেন তা বুঝতে পেরেছে। আমার খুব মজা লেগেছিল। একটু লজ্জাও।
মনে হয় তুমি সেদিন কিছু লক্ষই করনি। নিজের ভাবনার মধ্যেই গভীরভাবে ডুবেছিলে। মাঝে মাঝে তুমি পড়তে পড়তে থেমে যাচ্ছিলে। তখন আমার মনে আশা জেগে উঠছিল, এই বুঝি কচকচিটা থামিয়ে তুমি আমার হাত ধরে বসে থাকবে চুপটি করে। আসলে শামিম, তুমি পাছে মনে দুঃখ পাও তাই আমি ওই মেনফেস্টোটা সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করছিলাম। আসলে আমি সেদিন তোমাকেই একান্ত করে চাইছিলাম। হোল্ড্ দাই টাং অ্যান্ড লেট মি লভ্। আমার মনে এই ইচ্ছেটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল। সেদিন এই ভেবে আমার অভিমান হয়েছিল যে, তুমি আমার দিকটা একেবারেই দেখছ না। শুধু নিজেকে নিয়েই মগ্ন হয়ে আছো।
তুমি হঠাৎ বলে উঠলে, ‘আচ্ছা মিতা, বল তো আমি যে অংশটুকু পড়ছি তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা কোথায় আছে? অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের একই অধিকারে হস্তক্ষেপ না করে এবং ইসলামের মৌলিক নীতি অনুসারে জীবন গঠনের অধিকার ছাড়া মুসলমানদের জন্য কোনও বিশেষ অধিকার সংরক্ষিত হবে না। অমুসলমানিদের কেবল যে, এই জায়গাটা একটু মন দিয়ে শোনো মিতা প্লিজ, অমুসললিমদের কেবল যে, সমান অধিকার থাকবে তাই নয়, স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা তাঁদের প্রতি সদাশয় আচরণও করবেন। প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংবিধান সভা গঠনের কথাও এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে। এটা আবুল হাসেমের প্রস্তাব। কি, এর সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাওয়া গেল?’
আমি বলেছিলাম, না শামিম এর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা নেই।
শামিম তোমার কি মনে আছে, তুমি আমাকে কি বলেছিলে সেদিন? তুমি বলেছিলে, ‘এ কথাটা তাহলে তোমার কংগ্রেস ভাইদের বলো। তাঁরা তো না পড়েই এটাকে কমিউন্যাল প্রস্তাব বলে দেগে ছেড়ে দিলেন। অনবরত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন যে, মুসলিম লিগ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালাল।’
আমি তৎক্ষণাৎ তোমাকে বলেছিলাম শামিম, আমি যেহেতু তোমদের মতো পলিটিক্স করিনে, তাই আমার কোনও পলিটিক্যাল দলেই কোনও ভাই নেই। এ কাজটা তো তোমার মুসলিম লিগ ভাইদেরই কথা উচিত। আমাকে বলছ কেন? মনে পড়ে শামিম? তুমি সেদিন আমাকে কাঁদাতে বাকি রেখেছিলে। মনে পড়ে? আমি যখন উঠে পড়লাম শরবতটা শেষ না করেই তখন তোমার টনক নড়েছিল। তুমি ঝনাত করে আমার হাত দুটো ধরে আমাকে চেয়ারে বসিয়ে দিলে। তারপরে আমতা আমতা করে বলে উঠলে, ‘আমার রসিকতার যে এমন রিঅ্যাকশান হবে, আমি বুঝতে পারিনি মিতা, আমাকে মাফ কর।
আমার রাগ তখনও কমেনি। আমি বলেছিলাম, রসিকতা! এটা যদি রসিকতা হয়, তবে আমি বলব, এমন অশালীন রসিকতা শুনতে আমি অভ্যস্ত নই।
‘মিতা মিতা, তুমি বিশ্বাস করতে পার আমি আসলে তোমাকে ও কথা বলিনি। ঘা খেতে খেতে আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে যে, একটুতেই আমরা ণত্ব ষত্ব জ্ঞানটা হারিয়ে ফেলছি। মিত প্লিইজ।
তারপর আমরা যতক্ষণ ছিলাম প্যারাগনে, শামিম, তুমি সারাক্ষণ আমার হাত দুটো ধরে কাতরভাবে মুখের দিকে চেয়ে বসে রইলে। আমার মনে তখন অনুশোচনার বান বয়ে যাচ্ছে। সেদিনের সেই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই শামিম। তোমার আঙ্গুলের মধ্য দিয়ে আমার সর্ব দেহে তখন বিদ্যুৎ-তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছিল। আমি ক্রমশ অবশ হয়ে পড়ছিলাম। শামিম শামিম তুমি তখনও বুঝে উঠতে পারছিলে না, আমার রাগ পড়েছে কি না। আমি যে তখন কোনও কথ বলতে পারছিলাম না সে এই কারণে যে, আমার কথা বলার সমস্ত ক্ষমতা তখন হারিয়ে গিয়েছিল। অত কথার দরকারই বা কি? হোল্ড্ দাই টাং অ্যান্ড লেট মি লভ্।
তারপরই শামিম, তুমি সেই দুঃসাহসিক কাজটা করলে। ছেলেটা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তুমি বিদ্যুদ্বেগ্নে আমার কাছে চলে এলে। আর আর আর আমার ঠোঁটে একটা আলতো চুমু খেয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়লে।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫
‘অধরের কানে যে অধরের ভাষা
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে।
এ কোথায় চলেছি, প্রভু! এ কি আশ্চর্য খেলা! বিচিত্র পৃথিবী—অবশেষে সেই চিরন্তন তবে কি সত্যই হল! আমি আশ্চর্য হয়েছি, আমার মধ্যে কোনও অনুতাপ বিরক্তি কিছুই জন্মায়নি।