প্রতিবেশী – ১.৫

শামিম চলে যাবার পর অমিতার জীবনে একটা প্রচণ্ড ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। ওর জীবনের সব আলো যেন দপ করে নিবে গিয়েছিল। কী যন্ত্রণা! সে কী যন্ত্রণা! অমিতা ভাবতে পারেনি, সে কোনও দিন সেই যন্ত্রণার পাথারে সাঁতার দিয়ে পারে উঠতে পারবে। সেই যন্ত্রণা কি আজকের যন্ত্রণার চেয়েও বেশি ভয়াবহ ছিল? দিদি বলেছিল, ‘ফুলকি কোনও কিছুতেই ভেঙে পড়িস না। সেটা পরাজয়। তুই ভুলে যাস না ফুলকি, তুই মেয়ে। তুই যদি হেরে যাস, এই পুরুষের ছক-কাটা সংসারে কোথাও একটা বুদবুদও ভেসে উঠবে না। পরাজয়ের গ্লানির চাইতে দুঃসহ যন্ত্রণা মেয়েদের জীবনে আর কিছুই হতে পারে না। এমন কি মৃত্যুযন্ত্রণাও নয়। কথাটা মনে রাখিস ফুলকি।’ মরবার কদিন আগেই দিদি বলেছিল এই কথা। ‘লোকে আমার সম্পর্কে কত কথাই বলে ফুলকি। আমার এ হল না, তা হল না,এইসব ব্যাপারে কত দুঃখ তাদের। আমার ব্যপারে আমার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, প্রাক্তন প্রেমিকেরা, স্বামীরা সবাই একমত যে, একগুঁয়ে স্বভাবের জন্যই আমি আমার জীবনটা নষ্ট করেছি। এ সব বাজে কথা ফুলকি। একদম বাজে ভপর। ওরা যেটা বলে না, বা জানে না, সেটা এই, আমি আমাকে কারও কাছেই হার মানতে দিইনি। আমি আমার জীবনকে নষ্ট করিনি ফুলকি, আমি আমার জীবনকে প্রতিষ্ঠা করেই গিয়েছি।’

‘তুই যদি পোষ মেনে যাস ফুলকি, তবে দেখবি তোর জীবনটা মোটামুটিভাবে সুখে স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে। কিন্তু মানুষ পোষ মানতে চাইবে কেন? মানুষ, তা সে পুরুষই হোক আর মেয়েই হোক, পোষ্য জীব হয়ে থাকতে চাইবে কেন? আমি পোষ্য জীব নই ফুলকি, আমি মানুষের মতোই জীবন কাটিয়ে গেলাম। এবং মানুষের মতোই মাথা উঁচু করে। মেয়ে হয়ে আমি যে মানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠা পেতে চেয়েছিলাম, আমার পছন্দ অপছন্দ নিয়ে আমার জীবনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম, ওদের অহংকার এটা সহ্য করতে পারেনি। বাবা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। আমার যেসব প্রেমিক আমার স্বামী হয়েছিল তারাও এটা বরদাস্ত করেনি। আমার জন্য কাউকে চোখের জল ফেলতে বারণ করিস। মউমাছি আমাকে জানে। আমার অমর্যাদ। হয়, এমন কিছু সে করবে না।’

অমিতার তন্দ্রা ভাঙল দিদির কথা শুনে। চারিদিকে চেয়ে দেখল। ফর্সা হয়ে আসছে। সে ভিজে বিছানার উপরেই শুয়ে আছে। একটু আগেই দিদি তার মাথার শিওরে এসে দাঁড়িয়েছিল? চকিতে মনে হল, কোথায় গেল সে? পরক্ষণেই অমিতা বুঝতে পারল, সে স্বপ্ন দেখছিল। এখন স্বপ্নই তার নিত্য সঙ্গী, এ কথা বললে ভুল হয় না। দিদি কি যেন বলছিল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। দিদি বলছিল, ‘আমি মানুষের মতোই জীবন কাটিয়ে গেলাম। মানুষের মতোই মাথা উঁচু করে। আমার জন্য কাউকে চোখের জল ফেলতে বারণ করিস।’ ফুলকি বিড় বিড় করে বলল, আমিও মানুষের মতো জীবন কাটিয়ে যাচ্ছি দিদি, তোর মতোই মাথা উঁচু করে। শেষ রাতটা স্বপ্ন দেখেই কাটিয়ে দিল অমিতা। দিদিকে ঘিরেই এই স্বপ্ন। এখন সব আবছা হয়ে আসছে। নিরঞ্জন, শঙ্কর, ভ্যাবল, মউ, নিলু, নমি। কত লোক এসেছিল শ্মশানে দিদিকে দেখতে? ঠিক মনে করতে পারল না। সে মরলে কত লোক যাবে শ্মশানে? মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ অমিতা। তেমন কাউকে মনে করতে পারল না। দীর্ঘদিন ধরে যে রোগে ভোগে তার কাছে যাওয়া-আসার লোক বিশেষ থাকে না। একটা একঘেয়েমি আছে না? টাকা দিয়ে লোক পুষেও দেখেছে অমিতা। যাকেই রাখো প্ৰথম প্ৰথম সে ঠিকই যাতায়াত করতে থাকে। তারপর থেকেই সে পালাই পালাই করে। তারপর একদিন পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে চলে যায়। থাকে শুধু স্মৃতি আর স্বপ্ন। আজকাল স্বপ্নও তার কাছে আসতে চায় না।

মন্টুর মায়ের উপর সে রাগ করে বটে, কিন্তু সেই এখন কিছুদিন নিয়মিত আসছে। দিনটা তো যেমন তেমন করে কেটে যায়। রাতই অমিতার কাছে ভয়াবহ রকমের দুঃসহ। রাত আসবার আতঙ্কে অমিতা যেন কেমন হয়ে যায়। যতদিন চোখে ভাল দেখতে পেত অমিতা, মাঝে মাঝে যন্ত্রণা চেপেও সে বইটই পড়ত। ডায়েরি রাখত ইদানীং তাও পারে না। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা যে কত প্রাণান্তকর সেটা অমিতাই বোঝে। তাকে কেন বেঁচে থাকতে হবে? এই প্রশ্নটা সে নিজের কাছে এতবার করেছে যে তার পুনরাবৃত্তি করতেও ইচ্ছে জাগে না অমিতার মনে। বরং এখন সে প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে।

কেন তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে অমিতা :

আমি জানিনে।

তোমার জীবনের উপর খুব কি মায়া অমিতা?

মায়া? জীবনের উপর মায়া? যে জীবন সঙ্গীবিহীন, যে জীবন ক্যানসারে আক্রান্ত, যে জীবনে যতিহীন যন্ত্রণা প্রবল যন্ত্রণা, সেই জীবনের উপর মায়া!

কি, কোনও উত্তর পাচ্ছ না?

না। তবে একটা ঘটনা মনে পড়ছে।

কি সেই ঘটনা, বলবে?

আমি যখন এই বাড়িটা করি, একাই দাঁড়িয়ে থেকে তদারক করেছিলাম, ইঁট পাথর সিমেন্ট বালি সবই সরেশ দেখে কিনেছিলাম, দরজা জানলার কাঠগুলো পর্যন্ত বেছে বেছে কিনেছিলাম যাতে ঢেঁকসই হয়, তবুও দেখলাম, একটা দরজায় ঘুণপোকা ধরে গেল। অনেক চেষ্টা করা হল, ঘুণপোকা মারবার। কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেল না। ওরা কুরকুর কুরকুর করে দরজাটাকে খেতেই লাগল। খেতেই লাগল।

তারপর?

তারপর। ঘুণপোকাগুলো কুরে কুরে দরজাটাকে খেতেই লাগল।

তারপর হলটা কি?

হল এই যে, ঘুণপোকারা দরজাটাকে খেয়েই চলল আর দরজাটাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জীর্ণ হতে লাগল। সবাই প্রতীক্ষা করছি, জীর্ণ হতে হতে জীর্ণ হতে হতে কবে একদিন দরজাটা মুখ থুবড়ে পড়ে যাবে।

এই ঘটনা তোমার মনে এল কেন?

দরজাটার সঙ্গে আমি আমার খুব মিল দেখি বলে। আমার শরীরটাকে ক্যানসারে কুরে কুরে খাচ্ছে। এত যন্ত্রণা যে এক মুহূর্তও বাঁচতে ইচ্ছে করে না। তবু মৃত্যু না আসা পর্যন্ত মরতে আমার ইচ্ছে নেই। অথচ ইচ্ছে করলেই আমি মরতে পারি। আমার কাছে ব্লেড আছে, ঘুমের ওষুধ এত পরিমাণে আছে যে, তা দিয়ে একটা বাঘকে অবধি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যায়।

এটাই কি তাহলে তোমার মানুষের মতো মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা!

হ্যাঁ। না না। আমি আজ আর এ রকম কথা বলব কি না, সন্দেহ। কারণ এখন আমার কাছে এইসব কথার কোনও মানে নেই। মানুষের মতো বেঁচে থাকা, মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা, এ সব এখন বড় ঢ্যাপঢেবে শোনায়।

এখন অমিতা জানে, শুধু একটা ঘটনার জন্যই বেঁচে থাকা। মৃত্যু। সে জানে মৃত্যু এলে সে মরবে। যতক্ষণ সে না আসছে, ততক্ষণ সে বেঁচে আছে। ব্যস্।

সে, অমিতা। সে আর তার অতীত দিনের স্মৃতি। সে আর অতীতকে ঘিরে তার স্বপ্ন। এখন বেঁচে আছে। স্বপ্নের কথা মনে হতেই অমিতা ভেবে দেখল, আশ্চর্য, সে তো তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে না। অথচ অমিতা তো তার বাবাকে ভুলেও যায়নি। না, একটুও নয়। স্মৃতিতে বাবার কথা কী ভীষণভাবেই না জড়িয়ে আছে! তবে কেন সে তার বাবাকে স্বপ্নে দেখে না? সে কি বাবাকে ভালবাসে না? সে কি বাবাকে ভালবাসেনি? ‘ফুলকি, তোর মা যখন মারা যায় আমার হাত ধরে বলে গিয়েছিল, তিনটে মেয়ে থাকল, দেখো ওরা যেন ভেসে না যায়। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি তোর মা কি বলতে চায়। তাকে বলেছিলাম, তোমার মেয়েরা ভেসে যাবে কেন বলছ কুসুম? ওরা কেউই ভেসে যাবে না। এ কথা বলার পরে তোর মা আমার হাতদুটো আরও চেপে ধরল। বেশ জোরে। তারপর থেমে থেমে বলেছিল; যজ্ঞেশ্বর ঠাকুরপোর কথা মনে পড়ে? ওর মেয়েদুটো বড় যন্ত্রণা পেয়ে বড় হয়েছিল। যজ্ঞেশ্বরের কথা চট করে আমার মনে পড়েনি। পরে হঠাৎ মনে পড়ল। যজ্ঞেশ্বর ডালিমতলায় আমাদের প্রতিবেশী ছিল। পুনি আর টুনি ছিল তার দুই মেয়ে। যজ্ঞেশ্বর মেয়েদুটোকে খুব ভালবাসত। তোর হয়ত মনে নেই ফুলকি, না থাকারই কথা, টুনি তোর খেলার সাথী ছিল, না কি পুনি, ঠিক মনে নেই। পুনি টুনির মা মারা যাবার পর যজ্ঞেশ্বর সংসার নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সংসার রাখে না চাকরি রাখে? যজ্ঞেশ্বরের সংসারে আর কোন মেয়েছেলে ছিল না। অনেক দিন সে পুনি টুনিকে তোর মায়ের কাছে রেখে অফিসে বেরিয়ে যেত। তোর মা ওদের খুব ভালবাসত। বছর না ঘুরতেই যজ্ঞেশ্বরকে আরেকটা বিয়ে করে আনতে হল। তারপর থেকে ওদের বাড়িতে শুরু হল অশান্তি। এই বউটা খানিকটা খেপাটে ধরনের ছিল। মেয়েদুটোকে রাগ চড়ে গেলে বেদম মারত। তোর মা মৃত্যুকালে যজ্ঞেশ্বরের কথা তুলল। তখন বুঝলাম, কুসুম কি বলতে চায়। তোর মাকে বলেছিলাম, তুমি নিশ্চিন্ত হও কুসুম, আমার সংসার যজ্ঞেশ্বরের সংসার হবে না।’

দিদি সেইদিনই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। গিয়ে নিরঞ্জনকে বিয়ে করেছে। বাবা দিদিকে কোনও দিন ক্ষমা করেননি। যতদিন বেঁচে ছিলেন, দিদির মুখ দেখেননি। বাবা তো দিদিকে ভালই বাসতেন। বাবার ধারণা ছিল, নিরঞ্জন একটা লোফার। ওর বদ মতলব আছে। দিদি না বুঝে শুনেই নিরঞ্জনের খপ্পরে গিয়ে পড়েছে। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন দিদির মন ফেরাতে। কিন্তু বাবা নিরঞ্জনের কাছ থেকে দিদিকে সরাবার জন্য যতটা জেদ করেছিলেন, দিদিও নিরঞ্জনকে বিয়ে করবার জন্য তত জেদ ধরেছিল। দিদির জেদই বজায় রইল শেষ পর্যন্ত। কিন্তু ফুলকি দেখল, তাদের সংসারেও ভাঙন ধরল।

ফুলকির ধারণা ছিল, নিরঞ্জন কাজকর্ম কিছু করে না বলে বাবা তাকে তাঁর মেয়ের পক্ষে উপযুক্ত বিবেচনা করেননি। যতদিন ফুলকির এই ধারণা ছিল, ততদিন সে বাবার পক্ষেই ছিল। কোন্ বাবা না চাইবেন যে, তাঁর মেয়ে ভাল বরের হাতে পড়ুক। দিদি ফুলকির মুখে এই ধরনের কথা শুনলেই অসম্ভব রেগে যেত। বলত, ‘ফুলকি, তোর মুখে’ এ কথা সাজে না। তুই যথেষ্ট লেখাপড়া শিখেছিস। তাহলে তোর সঙ্গে আর বাতাসিয়ার তফাত রইল কোথায়?’ বাতাসিয়া ওদের বাড়িতে কাজ করত। ‘বাবা আমাদের বড় করে তুলেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। বাবার কাজ সেইখানেই শেষ হয়েছে।’ দিদি বলেছিল, ‘যে বাবা-মা তারপরেও ভবিষ্যতের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে চান, তাঁরা ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে ছেড়ে দেন। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের বিচারবুদ্ধিও যে বেড়ে ওঠে এ কথা যে বাবা-মা বুঝতে না চান তাঁরা কষ্ট পাবেন না তো কে পাবেন?’

কিন্তু দিদি এটা তো মানিস, তোর জন্য বাবা খুবই কষ্ট পাচ্ছেন? তোকে বাবা খুবই ভালবাসেন। ‘কোনটাই অস্বীকার করছিনে ফুলকি, তবুও মনে হয়, এটাও সত্যি যে বাবা আমার থেকে যে আঘাতটা পেয়েছেন, সেটা উনি আমাকে নিছক ভালবাসেন বলেই নয়। বাবার অহংকারেই এই আঘাতটা জোর লেগেছে। বাবা ধরেই নিয়েছিলেন যে, যেহেতু আমি ওঁর মেয়ে সেই হেতু উনি আমার স্বত্বাধিকারী। বাবার এই অধিকারে আমি ঘা দিয়েছি। বাবার তাইতে বেশি লেগেছে।’ দিদির সেদিনের কথায় সায় দিতে পারেনি ফুলকি। ফুলকির মনে হয়েছিল, দিদি বাবার প্রতি অবিচার করেছে। বাবা দিদিকে সত্যিই ভালবাসেন। ‘ভালবাসাই যদি হয় ফুলকি, তবু ভালবাসার হাত কতদূর পৌঁছবে, এটা কি ঠিক করে ফেলা দরকার নয়? তোর ভালবাসার হাত কি অন্যের ভালবাসার উপর হস্তক্ষেপ করবে? আর সে যদি তোর মেয়ে হয়, তুই ধরে নিবি, যেহেতু তুই বাবা তোর মেয়ের উচিত নয় এমন কাউকে ভালবাসা যাকে তুই মেনে নিতে পারছিসনে? তোর মেয়ে যাকে ভালবাসে তাকে তুই মেনে নিতে পারছিসনে, তাহলে তুই তোর মেয়েকে ভালবাসলি কোথায়? যেহেতু তেরি মেয়েকে ভালবাসিস তুই, সেই কারণে, স্রেফ সেই কারণে, তোর মেয়েকে তোর শর্ত মেনে কাউকে ভালবাসতে হবে? তবে তোর ভালবাসা থাকবে, নয় তো নয়? ব্যস্! এটা কি ধরনের ভালবাসা, তুই বিচার করে দেখ ফুলকি?

দিদির একথার ভাল উত্তর সেদিন ফুলকির মুখে আসেনি। ‘বাবাকে আমি ভালবাসি কি ভালবাসিনে, সে কথা আজ বলে লাভ নেই। তবে বাবাদের এই শর্তকেই আমি অস্বীকার করি।

বাবাদের এই শর্তকেই আমি অস্বীকার করি। দিদি এ কথা যেদিন বলেছিল, সেদিন ফুলকি কি ভাবতে পেরেছিল, এই কথা তাকেও একদিন বলতে হবে? ‘ঝুমরিকে যখন বিয়ে করি, তখন এটা ঠিক যে, আমার কোনও নির্দিষ্ট আয় ছিল না, মানে আমার কোনও স্থায়ী চাকরি ছিল না। চাকরি করতাম না মানে এই নয় ফুলকি, তোমার বাবা যা ধরে নিয়েছিলেন, আমি একটা গুডফরনাথিং, অকর্মার ধাড়ি আমি তাই। সেই যুদ্ধের মধ্যে যারা লণ্ডনে থেকেছে এবং টিঁকে আছে, তাদের সারভাইভিং ইনস্টিংক যে কত কড়া সেটা তারাই একমাত্র জানে। ব্রজকিশোরকে জিজ্ঞেস করতে পার, যুদ্ধের মধ্যে আলালের ঘরের দুলালটি হয়ে লণ্ডনে নেমেছিলেন। কেমন মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে, দেখছ তো।’

দিদির মৃত্যুর কদিন পরে ওরা কয়েকজন ভ্যাবলের বাড়িতে জড় হয়েছিল। মউ চেয়েছিল জিতেনের সঙ্গে ওর বাবা আর নিলুর পরিচয় করিয়ে দিতে। জিতেন এসেছে, এবার মউকে নিয়ে চলে যাবে।

নিরঞ্জন এবারে একেবারে সাফসুতরো হয়ে এসেছে। ‘ঝুমরির মনটা বড় একবগ্‌গা বলে ওর মনে ভ্যাবলের সেই ছেলেবয়সের যে ছাপটা ছিল, তা থেকে সে আর কখনও সরে এল না। ও ভ্যাবলকে জানে, ব্রজকিশোরকে চিনতেই চাইল না।’ ব্রজকিশোর হঠাৎ উঠে চলে গেল। ‘বুঝলি মউ, তোর দাদু আর তোর মায়ের স্বভাব কতকগুলো দিক থেকে প্রায় এক রকম ছিল। ওরা খুব ধরে নিতে পারত। তোর মা ভ্যাবলকে ভ্যাবলা বলে ধরে নিয়েছিল। সেই ধারণা থেকে সে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি।’ মউ বলেছিল, ‘না বাবা, মা কিন্তু ভ্যাবলের উপর খুব নির্ভর করত। যা কিছু গুরুতর পরামর্শ সব ভ্যাবলের কাছ থেকেই নিত। আমার বিয়ের সময় শঙ্কর খুব হাঙ্গামা শুরু করেছিল, বিয়ের সব ব্যবস্থা সেই করবে বলে। শঙ্করের সঙ্গে তখন তুমুল ঝগড়া চলেছে মায়ের। তাই মাকে কিছু বলতে সাহস পেত না। আমাকে এসে বলত, ‘তোর মা একটা পাগল মউমাছি, বদ্ধ পাগল। নিজের জীবনটা গোঁয়ারতুমি করে শেষ করেছে। আমারটাও শেষ করবে দেখিস। আমাকে তোর বিয়ের ব্যাপারে নাক গলাতে দিচ্ছে না কেন, আমি যেন তা জানিনে? আমার চাইতে ওই এঁটুলিটা সুমির আপন হল? বেশ ওই এঁটুলিটাকে তোর মা ভালবাসে, তা ভালবাসুক, কিন্তু মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে ওকে কর্তৃত্ব করতে ডেকেছে কেন? তুই তো এঁটুলির কেউ নস। আমি তোর বাবা, তোর বিয়ে দেবার রাইট একমাত্র আমারই আছে। আমাকে অপদস্ত করার জন্যই তোর মা ওই এঁটুলিটার পরামর্শে এই বদমায়েসি করে চলেছে। কিন্তু আমিও ছাড়ব না। দরকার লাগলে গুণ্ডা লাগিয়ে দেব এঁটুলিটাকে চিরকালের মতো ঠাণ্ডা করে দিতে। আমি শঙ্করের হাত চেপে ধরে বলেছিলাম, শঙ্কর তুমি আমার গা ছুঁয়ে বল, ও সব হাঙ্গামা করবে না। মা যা ভাল বোঝে তাই করবে। শঙ্কর বলেছিল, ও ভাবে হয় না, সব কিছু মেনে নেওয়া যায় না। আমি তোমার বিয়েতে আমার সার্কেলের পাঁচ শ বন্ধুকে নেমন্তন্ন করব। একটা পার্টি দেব গ্র্যাণ্ডে। তোমার মা পারবে এর খরচ দিতে? বড় বড় কথাই কেবল আছে। আমি শঙ্করকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে তো ভালবাস শঙ্কর, তাহলে আমার যা ভাল লাগে তুমি তাই কর। মা যে ভাবে আমার বিয়েটা দিচ্ছে, একেবারে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, তুমি কোনও কথা না বলে, সেটাই মেনে নাও। এটা তো ঠিক, আমি আমার মায়ের মেয়ে। আমি তোমার কেউ না হলেও তুমি আমাকে ভালবাস শঙ্কর, নিজের মেয়ের মতোই ভালবাস আমাকে। আমার কথা তোমাকে তাই শুনতেই হবে। তুমি কি চাও, তোমাদের বড়দের গুঁতোগুঁতিতে আমি কষ্ট পাই। শঙ্কর, তুমি কি তাই চাও? মা আমার বিয়ের অনুষ্ঠানের সব ভার ভ্যাবলের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল। আমার কথা শুনে শঙ্কর থ হয়ে গিয়েছিল বাবা। আমিও বুঝতে পারিনি শঙ্করকে সেদিন কত বড় আঘাত দিয়েছলাম। শঙ্করের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছিল। বার কয়েক শুধু বলেছিল, আমি তোর কেউ নই মউ! আমি কেউ নই! শঙ্কর খুব চাইত, আমি ওকে বাবা বলে ডাকি। কোনও দিন আমি ওকে বাবা বলে ডাকিনি। তবে আজও কেন তার জন্য এত কষ্ট পাই?

নিরঞ্জন বলেছিল, ‘মানুষ এক জটিল জীব মা। বারে বারে তারা জীবনের পাকা খেলা কাঁচিয়ে দেয়। শঙ্কর তোকে খুবই ভালবাসে, না মা?’

মউ বলেছিল, ‘হ্যাঁ বাবা। আমি তাই তো শঙ্করকে ভুলতে পারিনি। ভালই হয়েছে, শঙ্কর সংসার পেতেছে। ওর কাজকারবার দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ভালই আছে তো শুনি। যেতেও নাকি বলেছে দিল্লিতে। তোমার জামাইও বলে, তুমি যখন ওকে এতই ভালবাস, তবে না হয় একবার আমরা গেলামই দিল্লিতে। আমাকে তো প্রায়ই যেতে হয়। আমি বলি, না তা হয় না। আমি চাইনে ওদের নতুন জীবনে অতীতের ছায়া গিয়ে পড়ুক। তুমি কি বল বাবা?’

‘মউমাছি, আমার সেই ছোট্ট মউমাছি, কত জ্ঞানী হয়ে গিয়েছে এখন! হ্যাঁরে এত সব জানলি কোথা থেকে?’

‘সব এই জীবন থেকে বাবা। সব শিক্ষাই সংসারের দুঃখ কষ্টের মধ্য থেকে উঠে এসেছে। হাঁসের বাচ্চাকে যেমন সাঁতার শিখতে হয় না, তেমনি যে সব ছেলেমেয়ে সংসারের ছ্যাঁকা খেতে খেতে বড় হয়ে ওঠে, তারাও আপনা থেকেই এক ধরনের জ্ঞানী হয়ে ওঠে।

সবাই চুপ করে আছে দেখে নিলু মউয়ের কাছ ঘেঁষে বসে বলল, ‘দিদি, তুমি সেদিন বাবাকে সিগারেট খেতে বারণ করার পর থেকে বাবা সিগারেট আর খাচ্ছে না।’

ব্রজকিশোর ফিরে এল। নিরঞ্জন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। ‘শুনলে ব্রজকিশোর, ঝুমরি তোমার উপর কত নির্ভর করত। ওর বাবার কাছে তোমার চাইতে সুপাত্র কেউই ছিল না। তুমি ঝুমরির যে কি ছিলে সে আমরা সবাই জানি। তবুও তোমাদের বিয়ে হল না। মানে ঝুমরি তোমাকে বিয়ে করতে রাজিই হল না। এর চাইতে আজগুবি উপাখ্যান আর শোনা যায় কি? জীবন হে ব্রজকিশোর, জীবন! কি বলবে তুমি একে? এমন কাজের কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়? ঝুমরি বেছে নিল আমাকে। এর কোনও ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারে? ঝুমরি যেমন চট করে আমাকে বেছে নিয়েছিল, ঝুমরির বাবা তেমনি আমাকে চট করে বাতিল করে দিলেন। তিনি আমাকে তখনও চোখে দেখেননি। কেবল শুনেছেন আমি লোফারি করি। কি ব্যাখ্যা দেবে এর? ঝুমরির বাবা পাকা উকিল ছিলেন। লোক চরিয়ে উনি খেতেন। পলিটিক্যাল লিডার ছিলেন। কাজেই লোকচরিত্র ওঁর তো নখদর্পণে থাকবার কথা। একটা লোককে দেখলাম না জানলাম না, তাকে বাতিল করে দিলাম! এটা কেমন কথা?’

‘এখন আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না ফুলকি, তোমার বাবাও স্বর্গে গিয়েছেন, ঝুমরিও বিদায় নিয়েছে আমাদের কাছ থেকে। তবুও যে একথাগুলো বলতে ইচ্ছে করছে, সেটা শুধু নিজেকে হাল্কা করার জন্য। এটাকে একটা একাডেমিক একসারসাইজ বলতে পার।

নিরঞ্জন আপন মনেই বলতে থাকল, ‘আমি তখন লোফার ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না এটা ঠিক। তার মানে এই নয় যে, আমার কাজকর্মের কোনও যোগ্যতা ছিল না। বিদ্যে ফিদ্যের কথা ছেড়ে দেওয়াই ভাল। আমি কখনোই সেটার উপর নির্ভর করিনি। আমার যেটা বৈশিষ্ট্য ছিল ফুলকি, যেটাতে ঝুমরির মতো মেয়েও আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল, সেটা আমার বোলচালের এলেম। এটাও একটা গুণ। আমি আমার ওই এলেম ভাঙিয়ে চা-বাগান কি জুট মিলের একটা ছোট কি মেজো সাহেব বনে যেতে পারতাম। বামার লরি কি ম্যাকলিন ব্যারি, কিংবা ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জিদের কোনও একটা কিছুতে ভিড়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। ভিড়ে যে যাইনি, সেটা অযোগ্যতার জন্য নয়, বলতে পার ব্রজকিশোর, সেটা আমার স্বভাব গেঁতুমি। আর একটা প্রবল বিতৃষ্ণা। দশটা পাঁচটায় বাঁধা জীবন, উফ্, সে আমার পক্ষে অসহ্য লাগত। ঠিকে কাজেই আমার প্রতিভা অধিকতর বিকশিত হত। কাজেই সুধাকরবাবুর বড়মেয়ে আমার হাতে পড়লে তাকে না খেয়ে মরতে হত না। তা ছাড়া সুধাকরবাবু যেটা জানতেন না, সেটা এই যে, তাঁর বড়মেয়ে পুরুষের গলগ্রহ হয়ে কখনও জীবন কাটাতে পারত না। এমন কি সেই পুরুষটি যদি তার স্বামী হয়, তবুও। আমাদের দেশে ঝুমরির মতো ইওরোপিয়ান টাইপের মেয়ে তখন ক্বচিৎ দেখা যেত। দেখা পাওয়া যেত না বলাই ভাল। আমরা যতদিন একসঙ্গে ঘর করেছি, ফুলকি, ততদিন ঝুমরিও আমার মতোই সংসারে সর্ববিষয়ে পার্ট টাইমার ছিল। এবং সর্বদাই ঝুমরি আমার চাইতে বেশি রোজগার করত। অবশ্য ঝুমরির চোখধাঁধানো রূপ ওকে আমার চাইতে একটা বাড়তি সুবিধা দিয়েছিল কি না জানিনে। ওর ব্যক্তিত্বেরও একটা আকর্ষণ ছিল।

নমিতা হুড়মুড় করে ঢুকেই বলল, ‘সরি, ভ্যাবল, দেরি হয়ে গেল। আবার এক্ষুনি বেরিয়ে যেতে হবে। মউ, তুই কদিন আছিস?

মউ জিতেনের দিকে চাইল। জিতেন বলল, ‘অদ্যই শেষ রজনী ছোটমাসি।’

‘সে কি, তোরা ওবাড়িতে থাকবিনে?

‘এবার আর হল কোথায়? তা ছাড়া তোমার তো পাত্তাই পাওয়া যায় না। খালি রোগী আর অপারেশন।’

নমিতা বলল, ‘বাহ্, নিরঞ্জনদা যে এলিমেন্টে ফিরে এসেছ দেখছি। শেভ করেছ তুমি! আশ্চর্য! দাঁতগুলো বাঁধিয়ে নাও প্লিজ। না হলে বড্ড অড় লাগে। সেদিন অনেকদিন পরে তোমাকে শ্মশানে দেখে আমার বিচ্ছিরি লেগেছিল। তুমি নাকি ঘর ছেড়ে কোথাও বের হও না আজকাল। নিলু বলছিল।’

‘চকমকি, তোর যে কিছুই বদল হয়নি, সেটা দেখে ভাল লাগল।’

‘চকমকি! তুমি এটাও মনে রেখেছ নিরঞ্জনদা! ওয়াণ্ডারফুল। তুমি ছাড়া এই নামে আমাকে আর কেউ ডাকেনি। তোমাকে সত্যি, সেই পুরনো দিনের নিরঞ্জনদা বলেই মনে হচ্ছে। সেদিন তোমাকে খুবই খারাপ দেখেছিলাম। কি হয়েছে তোমার? এই নিলু, তোর বাবাকে একদিন আমার নার্সিং হোমে নিয়ে আয়। ওকে একটা থরো চেক আপ করা দরকার।’

‘তবে তো আমার একটা হিল্লে হয়েই গেল। কি বল হে ব্রজকিশোর? চকমকির হেফাজতে থাকা, সে তো দারুণ একটা একসাইটিং ব্যাপার।

নিলু বলল, ‘দিদি তুমি কালই চলে যাবে! কালই?’

মউমাছি নিলুর মলিন মুখটাকে কাছে টেনে নিয়ে এল। ‘কালই চলে যেতে হবে রে। আবার কবে আসব? আবার কবে দেখা হবে? তা ভ্যাবলই সব ব্যবস্থা করে আজ সবাইকে জড় করল এখানে। আমি ভেবেছিলাম, ছোটমাসি বুঝি আসতেই পারবে না। আমার ভাগ্যি ভাল, তুমি এসেছ ছোটমাসি।’

ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করল, ‘খেয়ে যাবার সময় পাবে তো চুমকি?

নিলু বলল, ‘বাহ্! কালকেই যদি চলে যাবে দিদি, তো আমাদের বাড়ি কখন যাবে?

নমিতা বলল, ‘সরি, ভ্যাবল, আমি আর বসতে পারব না। আমার একটা জরুরি অপারেশনের কেস আছে। একেবারে কলুর বলদ হয়ে আছি। সময় টময় একদম নেই।

নিলু জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাদের বাড়ি যাবে না দিদি? আমি কিন্তু মাকে বলে এসেছি যে, তুমি যাবে আমাদের বাড়ি।’

মউ বিপন্ন হয়ে বলল, এবার তোর বাড়ি যাওয়া হবে না।মনে দুঃখ পাসনে নিলু।’

নিলু বলল, ‘না দিদি তুমি যাবে।’

নিরঞ্জন বলল, ‘মউমাছিকে আর বিব্রত করিসনে নিলু। আমরা সুখে স্বচ্ছন্দে আছি, এটা শুনলেই তোর দিদি খুশি হবে। মউমাছি আমাদের জীবনে আর অতীতের ছায়া ফেলতে চায় না।’ নিরঞ্জন হঠাৎ চুপ মেরে গেল। কি ভাবছিল সে? মউ আমার মেয়ে। মউ ঝুমরির মেয়ে। মউ আমাদের দুজনেরই মেয়ে? কোথায় মিলছে না অঙ্কটা? কোথায় কোথায়?

অমিতা বলল, ‘চুমকি, কখন গেলে তোকে পাওয়া যায়। আমার একটা দরকার আছে।’

নিরঞ্জন হঠাৎ বলে উঠল, ‘অতীতের ছবি, জব্বর বলেছিস মা। অতীতের ছবি।’ নিরঞ্জন হা হা করে হেসে উঠল। ‘বর্তমানের ছবিগুলো সব অতীতের ছবি হয়ে গেল। আর কত তাড়াতাড়ি!

নমিতা বলল, ‘তুই একটা ফোন করে চলে আসিস দিদি। আচ্ছা চলি ভ্যাবল। জিতেন, মউ, নিলু চলি আজ কেমন? নিরঞ্জনদা তুমি এসো কিন্তু। নিলু, তোর বাবাকে আনিস।

ব্রজকিশোর বলল, ‘চুমকি, এক পাড়াতে থাকি। ক বছর বাদে দেখা হল বলত। তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে কি এ জন্ম পার হলে?

নমিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘এই জন্মেই দেখা হবে। তুমি আমার উকিল, আমি তোমার মক্‌কেল। আমাতে তোমাতে দেখা না হয়ে যায়? তোমার কেরানীবাবুকে কবে পাঠাবে আমার কাছে?’

‘তাড়া কিসের? ঠিক সময়েই যাবে সে। আর কোনও গোলমাল হয়নি তো?’

‘না না, ভ্যাবল, নতুন কোনও কম্‌প্লিকেশন হয়নি। লিজের কনট্র্যাকটা নিয়ে এখনও ল্যাজে খেলাচ্ছে। চলি।

নিরঞ্জন বলল, ‘আমরা কেমন অতীতের ছবি হয়ে গেলাম ব্রজকিশোর, অ্যাঁ! ইওরোপের যুদ্ধ শেষ হবার পর আমাদের সকলেরই কেমন ‘দেশে ফেরার তাড়া পড়েছিল, মনে পড়ে! ভ্যাগাবন্ডে আর জেন্টেলম্যানে তফাতটা যে কত সেটা তখন বুঝতে পেরেছিলাম। তোমরা সব জেন্টেলম্যানরা প্যাসেজ জোগাড় করার জন্য যখন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে, মনে পড়ে?’

ব্রজকিশোর বলল, ‘মনে পড়ে বই কি? তখন সবে ও দিকের যুদ্ধ শেষ হয়েছে। অ্যালায়েড ফোর্সের কাছে তখন সারেন্ডার করেছে জার্মানি। অকজিলারি সার্ভিস থেকে আমরা সবে ছাড়া পেয়েছি। জাপান তখনও লড়ে যাচ্ছে।’

নিরঞ্জনের চোখে স্বপ্নের ঘোর। তার ঠোঁটে দুষ্টুমির চিলতে পরিমাণ হাসি ফুটে উঠেছে। ফুলকি মনোযোগ দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগল।

‘সব ব্রিটিশ জাহাজ তখন ছুটছে ইস্টার্ন থিয়েটারে যুদ্ধের সরঞ্জাম বোঝাই করে।’

‘ব্রিটেন তখন বিধ্বস্ত। লন্ডন প্রায় ধ্বংসস্তূপ

‘কলকাতায় জাহাজের পর জাহাজ আসছে।’

‘কিন্তু একটা জাহাজও সিভিলিয়ানদের জন্য নয়।’

‘ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার নট এ ড্রপ টু ড্রিংক, কি বল ব্রজকিশোর!

‘ব্যাপারটা সেই রকমই বটে।’

‘হঠাৎ শোনা গেল, লিভারপুল থেকে একটা প্যাসেঞ্জার শিপ ছাড়ছে।’

‘তুমিই খবরটা দিয়েছিলে নিরঞ্জন। পি অ্যান্ড ও প্রথম প্যাসেঞ্জার জাহাজ ছাড়বে। তুমি বলেছিলে ডেস্টিনেশন ক্যালকাটা। আমাদের বিশ্বাস হয়নি।

‘তোমাদের জেন্টেলম্যানদের ওই হচ্ছে বদভ্যাস। আমি হর্সেস্ মাউথ থেকে খবর জোগাড় করেছিলাম।

‘ঠিক খবরই ছিল সেটা। তারপর আমাদের কি ছুটোছুটি। একটা প্যাসেজের জন্য আমরা কি না করেছি। কিন্তু আমরা আনফরচুনেট। কেউই সেই জাহাজে প্যাসেজ জোগাড় করতে পারিনি। কিন্তু তুমি, আমাদের মধ্যে একমাত্র তুমিই সে জাহাজে উঠতে পেরেছিল।

‘আমি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা স্টোকারের চাকরি জুটিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কলকাতায় পৌঁছুতে পারব, সে ভরসা ছিল না। মাইনে মাইনে নর্থ সি আর আটলান্টিক তখন ঠাসা ব্রজকিশোর। তুমি আমার বন্ধু বব হাইলিকে চিনতে কি?’

‘ববকে চিনব না! সেই ক্যামেরাম্যান তো? যার তোলা যুদ্ধের ব্রিলিয়ান্ট সব ডকুমেন্টারি আমরা দেখতাম।’

‘হ্যাঁ সেই বব। সে তখন সেই জাহাজে কলকাতা আসছিল। ডকুমেন্টারি তুলতে। সেই আমাকে স্টোকারের চাকরিটা জোগাড় করতে সাহায্য করেছিল। বয়লারে কয়লা ঠেলতে ঠেলতে নানা রাস্তা ঘুরে ববের সঙ্গে কলকাতায় নেমেছিলাম।’

‘তুমি খুব ডেয়ার ডেভিল ছিলে নিরঞ্জন।’

‘ঝুমরির বাবা, তোমার সুধাকর মেসোমশাই, এটা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারেননি। তাঁর চোখে আমি ছিলাম লোফার।’

ফুলকি দেখল নিরঞ্জনের ঠোঁটে সেই হাসির ফালিটা ধারাল ছুরির মতেই চকচক করছে।

নিরঞ্জন বলল, ‘কত তাড়াতাড়ি আমরা অতীত হয়ে গেলাম! ঝুমরি আর আমি প্রেমে পড়লাম। অতীত। আমার সঙ্গে ওর বাবা ওকে ধিয়ে দেবেন না, এই নিয়ে কত উদ্বেগ, কত ভয় ছিল ঝুমরির অতীত! তোমার দিদির অদ্ভুত একটা মন ছিল ফুলকি। ও দুরকম ভয়ে ভুগত। একটা ভয় ছিল এই যে, তোমার বাবা তোমার দিদির সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন না। আরও একটা ভয় ছিল ওর মনে। কেন সুধাকরবাবু, লিবারেল সুধাকরবাবু, কসমোপলিট্যান সুধাকর তার বড়মেয়ের সঙ্গে নিরঞ্জন মুখোটির বিয়েটা খারিজ করে দিলেন তার কারণটা পাছে আমি জেনে ফেলি। এই ভয়টাই তার প্রবল ছিল ফুলকি। ‘আমার বাবা তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে কিছুতেই দেবে না নিরঞ্জন। এস যা করার আমরাই করে ফেলি;’ আমি বলতাম, আমরা কি করব তা আমরা তো জানিই ঝুমরি। তবু মনে হয়, ব্যাপারটা তোমার বাবাকে জানিয়েই করা উচিত। আমরা তো অপরাধ কিছু করিনি। তুমি এতে আপত্তি করছ কেন ঝুমরি? ওকে আমি কতবার বলেছি, তোমাকে কিছুই করতে হবে না, প্রস্তাবটা আমিই তো তোমার বাবার কাছে করব? তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’ ‘না, তুমি বাবাকে কখনো বলবে না এ কথা।’ ‘ঝুমরি প্রথম প্রথম এক কথায় দু কথায় আমার প্রস্তাব খারিজ করে দিত।’ কখনও বলত, ‘আমার বাবা, আমি ওকে যত জানি নিরঞ্জন, তুমি কিছুতেই ওর মত পাবে না।’ ‘আমার জেদ চেপে গিয়েছিল ব্রজকিশোর, ঝুমরির বাবাকে আমি বলবই, আমি তার মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। এই নিয়ে আমাদের মধ্যে ঘর বাঁধবার আগেই মতবিরোধ ঘটে যাচ্ছিল। হয়ত আমি পুরুষ বলে, কিংবা খ্রিষ্টান বলেও হয়ত বা আমার জেদটা, আমার খ্রিস্টানি অভিমানটা, প্রকাশ পাচ্ছিল গোঁয়ারের মতো। এখন মনে হয়, ঝুমরিকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল। যেটা ঝুমরির কথা শুনে আমি বুঝতে পারিনি, সেটা পরবর্তী ঘটনা যখন প্রকাশ করে দিল তখন বুঝলাম, ঝুমরি চায়নি তার বাবার সত্য রূপটা আমার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ুক। ঝুমরি যে ভয়টা করছিল সেটা এই। বাবার ইমেজটা ও প্রাণপণে বাঁচাতে চাইছিল। বলতে কি, এইটাই ওর উদ্বেগের প্রধান কারণ ছিল।’

‘আমি তোমার দিদিকে বুঝতে ভুল করেছিলাম ফুলকি।’ নিরঞ্জন কি অনুতাপ করছে? নিরঞ্জনের কন্ঠের হাহাকারটা সেই কাকভোরে যেন অমিতার শিওরের কাছ থেকে ভেসে এল। অমিতার নিঃসঙ্গ বিছানার পাশে এখন ওরা কেবল তন্দ্রার ঘোরেই এসে দাঁড়ায়। চোখ মেললেই সবাই মিলিয়ে যায়। তার কাছেই বা সবাই কনফেস করতে এত জড় হয় কেন? নিরঞ্জনের গলার স্বর যে কথাটা বলতে বলতে মিলিয়ে যেতে থাকল সেটা এই, ‘ভালবাসার ব্যাপারে একটা গুরুতর ভুল করে ফেললে সেটা আর শোধরান যায় না ফুলকি। তোমার দিদির স্পর্শকাতর মনটাকে বোঝাবার জন্য যতটা ধৈর্য থাকার দরকার ছিল, যতটা মমতা বজায় রাখা দরকার ছিল আমার অহংকার সে সব নষ্ট করে দিয়েছে। সেই জন্যই তোমার দিদিকে আমি বুঝতে পারিনি ফুলকি।’

তন্দ্রায় যে সব পরিচিত মুখ ওকে সঙ্গ দিতে আসে তারা ওর যন্ত্রণার কোনও লাঘব করতে পারে না। তবে অমিতা তন্দ্রা কেটে যাবার পর প্রতিবারই আশ্বস্ত হয় যে, তার ব্রেন এখনও সজীব আছে। সেটা ভাল না মন্দ, মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না। ধন্ধ লাগে মনে। এটা একটা সমস্যা অমিতার। ব্রেন যতদিন চালু থাকবে, অমিতা জানে, ততদিনই পৃথিবী প্রতিদিন তার ঐশ্বর্যের ডালি নিয়ে তার জানলায় হাজির হবে। ভোর হবে সকাল দীর্ঘ হয়ে দিনের মধ্যে ঢুকে যাবে, দিন গড়িয়ে বিকেল হবে বিকেল সন্ধেয় গিয়ে মিশবে। অমিতা জানে দিনের পারাবারের পারেই রাত্রি। যেমন জীবনের পারাবারের পরেই মৃত্যু। এইসব বোধ যে তার এখনও আছে, তার কারণ তার ব্রেন এখনও সচল আছে। ব্রেন যেদিন বিকল হয়ে পড়বে, সেদিন অমিতা জানে রোগযন্ত্রণার এই অসহ্য অনুভূতি তাকে ত্যাগ করবে! অর্মিতা তখনও বেঁচে থাকতে পারে আবার নাও থাকতে পারে। যদি বেঁচে থাকে তবে সে কি ভাবে বেঁচে থাকবে? ভেজিটেব্‌ব্ল হয়ে? অমল হোমের মতো? অমলদা খুব ভালবাসতেন তাকে। একদিন অমিতা সেই দশাসই রসিক মানুষটাকে দেখতে গিয়েছিল। নিথর দেহটা পড়ে আছে বিছানায়। অমিতাও অমনি নিথরভাবে পড়ে থাকবে বিছানায়। ‘নট নড়ন চড়ন নট্‌ কিচ্ছু’। দিদির কথাটা মনে পড়ল অমিতার। দিদি ডালিমতলায় গাব্বু খেলত ওর ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এটা সেই খেলারই ভাষা। সারা গায়ে ধুলো কালি মেখে দিদি বাড়ি এসে পৌঁচেছে। মা চিৎকার করছেন, ‘ঝুমরি ঘরে ঢুকো না, খবরদার। উঠোনেই দাঁড়িয়ে থাক। বদমাস মেয়ে। রাস্তার যত নোংরা মেখে এসেছ। এখন চান করে তবে ঘরে ঢুকবে। নড়ো না ওখান থেকে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি আসছি!’ দিদি বলত, ‘নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু।’

অমিতা হিসাব কষতে বসল, কোনটা কাম্য? কোনটা ভাল? ওর বাছাই বাঁচা আর মরার মধ্যে নয়। তাহলে তো অমিতার কাছে বাছাইয়ের কাজটা সহজতর হত। অমিতার এখন বাঁচা আর বাঁচার মধ্যেই বাছাইয়ের সমস্যা। নট নড়ন চড়ন নট্‌ কিচ্ছু হয়ে ভেজিটেবলের মতো বেঁচে থাকা, না অসহ্য অপরিসীম যন্ত্রণাময় অনুভূতির মধ্যে ডুব দিয়ে বেঁচে থাকা। যম এসে বললেন, ‘ফুলকি তোমার তপস্যায় আমি তুষ্ট হয়েছি। এবার বর চাও। তোমার সামনে বাঁচার দুটো পথ মেলে ধরছি, যেটা চাইবে তুমি সেটাই পাবে।’ এইসব সময়ে অমিতা হাসবে কি কাঁদবে বুঝে উঠতে পারে না। শালা যম, তুমি যদি ক্যান্সারের রোগী হতে তবে তোমাকেই আমি এই প্রশ্ন করতাম।

এখন এখানে যম নেই ফুলকি, শুধু তুমি আছ তোমার পেচ্ছাবে-ভেজা বিছানাতে একা, একেবারে একা। এবং এই প্রশ্নটা নিয়ে তুমি তোমার সঙ্গে বোঝাপড়া করছ। এখন তোমার কি রায় সেটা বল। অমিতা কোনও রকমে ঘাড় ফিরিয়ে পুরের জানালাটার দিকে চাইল। ওর শরীরটা থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। যেন প্রথম প্রেমিকের ঠোঁটে সে ঠোঁট ঠেকাতে যাচ্ছে। বাইরে অন্ধকারটাকে যেন একটু ফিকে ঠেকল তার চোখে। ভোর হচ্ছে। একটু পরেই পাখির ডাক শুরু হবে। পথে ধীরে ধীরে প্রাণের সাড়া জেগে উঠবে। প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে কথাবার্তা শুরু হবে। কার মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ছে, শীত নেই গ্রীষ্ম নেই ভোররাতে উঠে ভার মা তাকে তুলে দিচ্ছে ঘুম থেকে, বাচ্চাটা প্রাণপণে অনিচ্ছা জানাচ্ছে, কিন্তু পলাইবার পথ নেই মা আছে পিছে, পাশের ফ্ল্যাটে ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে, একটা ক্যাসেট বাজছে, তার মানে মোটা ধুপসি যুবতী মেয়েটি এখন জেন ফন্ডার কি রেখার পদ্ধতিতে স্লিম হবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ওরা বলে ‘ওয়ার্কআউট’, নিচে ভুরররব ভুরররর শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে মাদ্রাজি চার্জম্যানটি এখন গানশেল ফ্যাক্টরিতে সকালের ডিউটি সারতে স্কুটারে চড়ছে, কলকাতা জাগছে অমিতা দুরু দুরু বুক নিয়ে প্রত্যেকটি শব্দ তার দু কানে ধরে রাখছে। এই রোগগ্রস্ত পৃথিবীতে, রোজ এই ভোরটুকুর জন্যই অমিতা প্রতীক্ষা করে থাকে। অমিতা জানে আজকের পৃথিবীও তারই মতো ক্যান্সারে ভুগছে। তবু এই ভোরটাকে তার মনে হয়, রোজ মনে হয়, এ-ই যেন নীরোগ আছে, ভে রটাকে সদ্য ভূমিষ্ট নধরকান্তি এক নিষ্পাপ শিশু বলে মনে হয় তার। আবার কখনও মনে হয়, এ যেন তার প্রথম প্রেমিক। মনে হয়, সে যেন চিরবিরহিনী রাধা আর এই ভোরটুকু তার কৃষ্ণ অমিতা থরোথরো দেহটা নিয়ে, সারারাত ধরে এরই প্রতীক্ষায় থাকে। পূর্দা ঠেলে এক ঝলক হাওয়া এসে অমিতার সর্ব শরীরে আদর বুলিয়ে দিতে লাগল। আহ্!

সেদিনও এমনই একটা ভোর ছিল। নার্সিং হোমের কেবিনের পর্দা সরিয়ে এক ঝলক হাওয়া ঢুকে তাকে আদর করছিল। আর সিস্টাররা সেই কাকভোরেই তাকে অপারেশনের জন্য রেডি করছিল। সেই নির্জন ঘরে সিস্টাররা তার উলঙ্গ শরীরে একটা সাদা আলখাল্লা চাপিয়ে দিল। তার আগেই একজন নার্স একটা ব্লেড দিয়ে তার বুকের বগলের পেটের সমস্ত লোম চেঁছে সার্ফসোফ করে দিতে দিতে বলেছিল, অমিতার শরীরটা কি সুন্দর! ও জীবনে কখনও লোম চাঁছেনি। কি সিরসিরানি ধরেছিল তার! সে অনুভূতি যৌন অনুভূতির মতোই মোলায়েম আর তেমনি রোমাঞ্চকর। হাঁ, অমিতা অস্বীকার করবে না, নগ্ন শরীরের উপর দিয়ে ধাতুর সেই সূক্ষ্ম একখণ্ড পাত যখন নাভি পর্যন্ত যাতায়াত করছিল, অমিতা তখন যৌন উত্তেজনা বোধ করেছিল। এমন কি তার দুই স্তনের উপত্যকাদেশে নার্স যখন আলতোভাবে সেই ব্লেডটা দিয়ে রোমগুলি চেঁছে দিচ্ছিল অমিতার তখন মনে হচ্ছিল সেটা বোধহয় শামিমের হাত। কেন না একমাত্র শামিমের হাতই এমন কোমল হতে পারে, শামিঙ্কের হাতই এমন আদর ছড়িয়ে দিতে পারে তার স্তনে। অমিতা দেখেছে, পুরুষের, সে স্বামীই হোক কি প্রেমিকই হোক, পুরুষত্ব ফলাবার ইচ্ছা নারীদেহের যে কয়টা জায়গায় এসে উদগ্রভাবে জেগে ওঠে, স্তন তার একটা। ওরা ব্যথা দেবেই। মেয়েদের পীড়ন করার প্রবৃত্তি পুরুষের যেন জন্মগত। প্রেমিকেরা যদিও বা কিছু সমীহ করে, স্বামীদের কাছে সেই বিবেচনার কণামাত্রও আশা করা যায় না। স্ত্রী তো স্বামীর সম্পত্তি। তাই যখন নার্সটা অমিতার স্তনের উপত্যকায় ব্লেডটা আলতোভাবে নামিয়ে এনেছিল, অমিতার তখন আবেশে চোখ বুজে এসেছিল। অমিতা কিছু না ভেবেই নার্সের হাতটা তার থরোথরো হাতখানা দিয়ে ধরে ফেলেছিল। নার্স ব্লেড চালাতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল। তারপর অমিতার মুখের দিকে চেয়ে কি বুঝেছিল সে জানে না। সিস্টারের হাতখানাকে অমিতা চাইছিল বুকের উপর তুলে আনতে। তার কেবলই মনে হচ্ছিল সেখানা যেন শামিমের হাত। সিস্টারের মুখে গভীর সমবেদনা ফুটে উঠতে দেখেছিল অমিতা। ‘এ পেয়ার অব্ বিউটি। এগুলো যেন কুমারীর স্তন বলে মনে হয়। এ বানচ অব হোয়াইট লিলি’। শামিম! শামিম! অমিতা মনে মনে তখন শামিমকেই ডাকছিল।

সিস্টারকে জিজ্ঞাসা করেছিল অমিতা, আমার কি হয়েছে, সত্যি করে বলবে?

সিস্টার বলল, ‘সে কী! তুমি জান না?’

অমিতা বলল, ঠিক জানিনে।

সিস্টার বলল, ‘ডক্টর মজুমদার বলেছেন, কারসিনোমা।

অমিতা বলল, তার মানে কি?

‘তোমার ক্যান্সার হয়েছে, এটা তো তুমি জান?’

হাঁ, ডাক্তার মজুমদার বলেছেন। আর কিছু বলেননি। হাঁ বলেছেন, অপারেশন করলে সেরে যাবে।

সিস্টার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার বাঁদিকের স্তনে কারসিনোমা হয়েছে। ক্যান্সারের পুরো লক্ষণ ছড়িয়ে গিয়েছে। ওটা সম্পূর্ণ কেটে বাদ দিতে হবে। তুমি আরও আগে কেন আসোনি? তুমি শিক্ষিত মেয়ে, গ্রোন আপ্, তোমার আরও আগে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।’

আশ্চর্য, অমিতা তখন কিছুই ভাবছিল না। সে শুধু শামিমের কথাই ভাবছিল। শামিম! শামিম! শামিমই প্রথম তার স্তনকে ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছিল। এ বাচ্ অব্ হোয়াইট লিলি। না, শামিম এ কথা বলেনি। এ কথা সিস্টার বলেছিল। ‘এবং এই বয়সেও এত ফার্ম ব্রেস্ট, সিস্টার সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল। শামিম বলেছিল, ‘ফুলকি, তোমার স্তনদুটো যেন শুভ্র ফুলের স্তূপ। হাত দিতে মায়া লাগে আমার।’

‘ইট শুড বি এক্সক্লুডেড ইমিডিয়েটলি।’ ওটা অবিলম্বে বাদ দিতে হবে, এটা ডাক্তারের নির্দেশ। সিস্টার তাকে বলেছিল। সিস্টার যে তাকে মৃত্যুদণ্ডের কথা শোনাচ্ছে, এ কথা অমিতার সে সময়ে একবারও মনে হয়নি। সে তখন এক ধরনের কামনার তাড়সে ক্রমশ অভিভূত হয়ে পড়ছিল। অমিতা কিছু না ভেবেই সিস্টারের হাতখানা তুলে তার বাঁ বুকের উপর আস্তে করে রেখে দিল। তারপর আবার সেখানা তার ডান বুকে নিয়ে রাখল। তার খুব ইচ্ছে করছিল তার স্তনদুটোর উপর একটা উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ পড়ুক। কোনও প্রেমিকের হাত, মানুষের হাত, পিষ্ট করুক শেষ বারের মতো। সিস্টার যেন তার মনের কথা বুঝতে পারল। অমিতা এক ঝটকায় সিস্টারের মুখটাকে তার বুকের মধ্যে টেনে নিল। তারপর নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। সিস্টার শান্ত কণ্ঠে অমিতাকে বলতে লাগল, ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। তোমার এখন দরকার ধৈর্য এবং সাহসের। সারা জীবন ধরে তোমাকে সাহস জাগিয়ে রাখতে হবে। তোমাকে ধৈর্য হারালে চলবে না।’

সিস্টারকে সে ভুলে গিয়েছে। অর্থাৎ তার নাক মুখ অবয়বের যে কেমন আদল ছিল সেটা ভুলে গিয়েছে অমিতা। কিন্তু রোজ ভোরে তাকে মনে পড়ে অমিতার। এই একটা লোককে সে পেয়েছিল জীবনে যে তাকে মিথ্যে বলেনি, তাকে বৃথা স্তোকবাক্য দেয়নি। অমিতাকে যত্ন করে কামিয়ে শান্তভাবে তার দেহে মেথিলেটেড স্পিরিটের শিশিটা যখন উপুড় করে দিল তখন তার মনে হয়েছিল আগুনের তরল যন্ত্রণা সেই শিশিটা থেকে গায়ে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে ফুলকি সহ্য করেছিল সেই আগুনের ছ্যাঁকা। এই তাহলৈ শুরু? অমিতার মনে হল। তবুও তো সেটা ছিল এক ঝলকের ব্যাপার। কয়েক লহমামাত্র স্থায়ী হয়েছিল সে যন্ত্রণা। ততক্ষণে সিস্টার তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে গিয়েছে। কাঁচির মাথায় চট করে স্টেরিলাইজড গজ পুরু করে জড়িয়ে সেটা ইথারের বোতলের ছিপি খুলে তার মধ্যে ভিজিয়ে নিল। তারপর অমিতার শরীরের যে যে অংশে কামানো হয়েছিল, সিস্টারের হাতের কাঁচিতে জড়ানো সেই ভিজে গজ দিয়ে যত্ন করে সেই জায়গাগুলো মুছে দিতে লাগল। অমিতা এবারও মুখে কোনও শব্দ করল না। কেবল তার দুই স্তনের মধ্যবর্তী কোমল উপত্যকায় সেই ইথারে ভেজানো গজ নেমে কাঁচির টানে যখন তার টানটান ত্বকের উপর দিয়ে এধার ওধার যাচ্ছিল তখন, কেবল সেই মুহূর্তগুলোতে তার শরীরটা কেঁপে উঠছিল। তার শীত শীত করছিল। তার শরীরটা সিরসির করছিল। ‘গুড়, তুমি পারবে। তোমার সহ্যশক্তি আছে।’

অমিতা সিস্টারকে সেদিন যে কথা বলেছিল, কেন না তাকে তখন ওর খুব বন্ধু বলে মনে হয়েছিল, সেটা মনে পড়তেই এখন, এই আজকের ভোরে, তার কেমন হাসি পেয়ে গেল। সিস্টার, আমার কি হবে, আমি তা জানিনে, গ্রাহ্যও করিনে। তুমি ডিউটির সিস্টারদের বলে রেখো, প্লিজ, অপারেশন থিয়েটার থেকে আমাকে যখন বেডে ফিরিয়ে আনা হবে, যদি আমি ফিরে আসি, যদি ফিরেই আসি, তবে আমাকে যেন ওরা সর্বদাই সাজিয়ে রাখে, একেবারে টিপ টপ, আমার সমস্ত কসমেটিকের শিশিগুলো ওই ব্যাগটার মধ্যেই আছে, আমি নিয়ে এসেছি, আমি সকলের চোখের সামনে সর্বদাই চিয়ারফুল থাকতে চাই। কেউ যেন আমাকে সিম্প্যাথি দেখাবার স্কোপ না পায়। এই ব্যবস্থাটা আমার জন্য করে দিতে পারবে তো সিস্টার? প্লিজ প্লিজ প্লিজ। সিস্টার কথা রেখেছিল। তার স্তনে গোটা বুকে সিস্টার একটার পর একটা নানা আকারের স্টেরিলাইজড্ গজ জড়িয়ে জড়িয়ে যখন তাকে রেডি করে আলখাল্লা পরিয়ে দিল তখন অমিতাকে মনে হচ্ছিল যেন একটা মমি। এবার কি ওরা আমাকে কফিনে পুরবে? ট্রলি করে অপারেশন থিয়েটারে আলোআঁধারির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, তাকে একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, অ্যানাস্থেশিয়া, তার ঘুম ঘুম পাচ্ছিল, অ্যানাস্থেশিয়া, একটা প্রশ্নই বারবার অমিতার মনে হচ্ছিল, এবার কি তাকে ওরা কফিনে পুরবে? তার শরীরটাকে আশ্চর্য নীরোগ লাগছিল অমিতার। কোনও অস্বস্তি তো নেই তার। তবে কি ডাক্তাররা ভয় পেয়ে গিয়েছেন অযথা। ভুল করেছেন রোগ চিনতে? কই অমিতার তো কোনও ভয় লাগছে না। তার ঘুম পাচ্ছে খালি চোখের সামনে থেকে আলোগুলো কেমন নিস্তেজ আর কেমন থ্যাবড়া থ্যাবড়া হয়ে উঠছে যেন। সিস্টার কি তার স্তনে, তার ঠোটে চুমু খেয়েছিল? সিস্টারের ঠোঁট সেটা নাকি শামিমের ঠোঁট অপারেশন টেবিলে ঘুমিয়ে পড়ার আগে অমিতা নিশ্চিত হয়েছিল, সেটা পুরুষেরই ঠোঁট। শামিমের শামিমের। শামিম শামিম, তুমি আমার কাছে থাকো, তুমি আমার পাশে থাকো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ! অমিতার ঠোঁটে স্মিত হাসিটা তখন খেলা করছিল। ডাক্তার মজুমদার তার সহকারীদের বলেছিলেন, ‘শি ইজ্ ব্রেভ ইনডিড।

মা মারা যাবার পর থেকে অমিতা টের পেতে শুরু করেছিল, দিদি আর বাবার মধ্যে সংঘাত বাধছে। মায়ের সঙ্গে যে-সব কারণে দিদির খিটিমিটি বাধত, অমিতা দেখল, এখন বাবার সঙ্গে সেই একই কারণে দিদির গোলামাল লেগে গিয়েছে। মা তখন দিদিকে পিটতেন। পরবর্তী সময়ে মা, ভদ্দরলোকের পাড়ায় বাস করার জন্যই হোক কি দিদি বড় হয়ে ওঠার জন্যই হোক; দিদির গায়ে আর হাত দিতেন না। যা বলবার মুখে বলতেন। কিন্তু মা দিদিকে কিছুতেই সহবত শেখাতে পারেনিন। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন বাবা এ সব দিকে মাথা গলাতেন না। অমিতার এমনও মনে হয়েছে যে, বাবা দিদিকে প্রশ্রয় দিয়েই চলেছেন। ‘তোমার প্রশ্রয়েই ঝুমরি বখে যাচ্ছে। এর পরিণাম খুব খারাপ হবে তা বলে দিচ্ছি।’ মা এমন অভিযোগ নিত্য বাবার কাছে করতেন। বাবা হাসতেন। ‘ঝুমরি যদি তোমার ছেলে হত কুসুম, তা হলে কি হত? ধরেই নাও না কেন, ঝুমরি আমাদের মেয়ে নয়, ছেলে। বড় ছেলে।’ বাবাকে কী ভালই না লাগত ফুলকির! মা বলতেন, কিন্তু ঝুমরি আমাদের ছেলে নয়, ও মেয়ে। এ হুঁশটা তোমার কবে হবে? এ সংসারে মেয়েকে মেয়ে হয়েই থাকতে হবে। এটা কি অস্বীকার করতে পার?’ বাবা হাসি দিয়ে ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিতেন। কুসুম, ঝুমরি এখনও ছেলেমানুষ। এ সবই ওর ছেলেমানুষি কাণ্ড। করছে দুদিন করতে দাও না? তোমার মহাভারত এতে অশুদ্ধ হবে না। বুদ্ধি পাকার বয়েস হতে দাও। ওর ছেলেমানুষি আপনিই যাবে।’ মা বাবার এই ধরনের কথাবার্তায় খুবই রেগে যেতেন। ‘ওর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।’ বাবা হাসতেন। ‘কুসুম তোমাদের যুগ আর ঝুমরিদের যুগ যে আলাদা এটা বোঝো না কেন? ওরা এ যুগের মেয়ে, ওদের ধরনধারণ চালচলন আলাদা হবে বইকি? ‘ বাবা আমার বাবা! ফুলকির এইসব সময় ওর বাবার আদর খাবার জন্য খুবই ইচ্ছা হত.। মা মারা যাবার পর বাবা মেয়েদের উপর খুব নজর দিতে লাগলেন। এমন স্নেহ ভালবাসা আর কেই বা দিতে পারে তার বাবা ছাড়া! ফুলকি তখন এইসব ভাবত। বাবা যেন তাদের বাবা আর মা দুইই হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ফুলকি লক্ষ করেছিল, দিদি খুব অস্বস্তিতে ভুগছে। ফুলকি যতটা তার বাবার কাছে এগিয়ে আসছে, দিদি ততটাই যেন বাবার কাছ থেকে সরে সরে যাচ্ছে। এবং এটা খুবই সূক্ষ্মভাবে ঘটে যাচ্ছিল। দিদি সব সময় তখন একটা অস্বস্তিকর ভাবনার মধ্যে পড়ে যাচ্ছিল। দিদি একদিন রাতে ওকে বলেই ফেলল, ‘দেখ ফুলকি, বাবার মতিগতি আমার সুবিধে ঠেকছে না। এত আদিখ্যেতা ভাল নয়।’ ফুলকি দিদির এই কথায় খুবই বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। দিদির কথার মধ্যে বাবা সম্পর্কে একটা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল। সেটা ফুলকিকে আহত করেছিল। বাবার আদিখ্যেতা কোথায় দেখলি? ফুলকির কথায় ঝাঁজ ফুটতে দেখে দিদি একটু গুম মেরে গেল। তারপর বলেছিল, ‘বাবা বদলে যাচ্ছেন ফুলকি। তোর কি এটা নজরে পড়ছে না?’ ফুলকি সেদিন দিদির এই কথাটা বুঝতে পারেনি। ‘বাবা যে ধীরে ধীরে মা হয়ে উঠছে, ওটাও কি তোর নজরে পড়েনি!’ ফুলকি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল সেদিন। দিদি বাবাকে বুঝতে চাইছে না কেন, ফুলকির বিরক্তি এই কারণে। বাবা তাঁর মেয়েদের জন্য উদ্বেগ বোধ করছেন, এটার মধ্যে কি আদিখ্যেতা পেয়েছে দিদি? বাবা মেয়েদের ভালবাসেন, তাঁর উদ্বেগ এই কারণে তো হতেই পারে। ফুলকি একদিন কলেজ সেরে কফি হাউসে আড্ডা মারতে এসেছিল। কলেজ স্ট্রিটে অ্যালবার্ট হলে কফি হাউসটা তখন নতুন হয়েছে। বন্ধুর বেবি অস্টিনে চেপে ঘোরার প্রস্তাবটা কফি খেতে খেতে জীবন-ই পেড়েছিল। পারমিতা আর বনানী সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটা সমর্থন করল। ‘অমিতা চল। বেশ একটা থ্রিল হবে। অমিতা কিন্তু কিন্তু করতে যাচ্ছিল, ততক্ষণে সকলেই হইহই করে উঠে পড়েছে। ওকে সেদিন যেতে হয়েছিল। এবং বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছিল। এমন কিছু রাত নয়, আটটা টাটটা হবে।

বাড়ি ফিরে ফুলকি শুনেছিল, একটা হইহই কাণ্ড ঘটে গিয়েছে। ফুলকি সন্ধের পরেও বাড়ি ফিরল না দেখে বাবা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। নানা জায়গায় ফোন টোন করেও বাবা যখন ফুলকির খবর পেলেন না, তখন পরমেশ্বর কাকাকে তাদের পরিচিত সব বাড়িতে ঘুরে দেখে আসতে বললেন। ফুলকির খোঁজে। দিদি ঠিকই বুঝেছিল সেদিন। বাড়ি ফিরে তুলকালাম কাণ্ড হচ্ছে দেখে দিদি বাবাকে বলেছিল, ‘তুমি ফুলকির জন্য এত চিন্তা করছ কেন? এমন কিছু রাত তো হয়নি। কোনও বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে গিয়েছে হয়তো। তা এতে এত বিচলিত হবার কি আছে?’ বাবা বলেছিলেন, এ সব তার দিদির মুখে শোনা, ‘ফুলকি তোমার মতো রাস্তায় ঘোরা মেয়ে তো নয়, ওর জন্য চিন্তা হবে বই কি! দিদি বাবাকে তবু বলেছিল, ‘কোথায় গিয়ে আটকেও তো পড়তে পারে। তোমার কি ধারণা, তোমার মেয়েরা তাদের বাড়ির পথ চেনে না? না কী? তোমার এই উদ্বেগের কারণটা কী আমি ঠিক বুঝতে পারছিনে।’ বাবা বলেছিলেন, ‘তাই যদি তুই বুঝবি, তা হলে তোর জন্য চিন্তা করতে করতে তোর মায়ের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে কেন? কলকাতায় গোরা সৈন্যরা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেটা খেয়াল আছে? চিন্তা এই কারণেই হয়।’ ফুলকি বাবার কাছে ধমক খেয়েছিল। অবশ্য সে সেটাকে ধর্মক বলে ধরে নেয়নি। বাবা বলেছিলেন, ‘বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, বুড়ো ছেলেদের এমন উদ্বেগের মধ্যে ফেলে রাখা ঠিক নয় মা।’ বাবা যে ফুলকির জন্য এতটা উদ্বেগ বোধ করছেন এতে সে খুশিই হয়েছিল। সে তো ধরেই নিয়েছিল এটা বাবাদের ভালোবাসার স্বাভাবিক প্রকাশ। দিদিকে সেটা বোঝানো যায়নি। দিদি বলেছিল, ‘ভালবাসায় দোষ নিই ফুলকি, আদিখ্যেতায় বিপদের গন্ধ পাই আমি।’ কেন তুই বিপদের গন্ধ পাস দিদি? দিদি বলেছিল, ‘আদিখ্যেতাটা স্বাভাবিক নয় বলে। ভালবাসা স্বাভাবিক, আদিখ্যেতা অস্বাভাবিক। ওটা মনের ভাবটা লুকিয়ে রাখবার একটা কায়দা ফুলকি। বাবার মধ্যে এখন দুটো মন কাজ করছে। একটা বাবার আগের মন, আরেকটা হচ্ছে আমাদের মায়ের মন। এবং আমি দেখছি, বাবার মনের উপর মায়ের মনটাই আধিপত্য বিস্তার করতে লেগেছে। বাবাকে মা মরে গিয়ে গ্রাস করতে শুরু করেছে ফুলকি। আমি এটাতেই বিপদের গন্ধ পাচ্ছি। বাবা, এখন তাই আদিখ্যেতা দিয়ে তার মনটাকে ঢাকতে চাইছেন। আমার তাতেই ভয়!’ ফুলকি বেশি কথা বলেনি সেদিন। দিদি বলেছিল, ‘আমি বাবাকে বলেছিলাম, তুমি অত ভাবছ কেন? ফুলকি হয়তো ওর বন্ধুবান্ধদের সঙ্গে কোথাও গিয়েছে। বাবা বললেন, ফুলকি তোমার মতো রাস্তায় ঘোরা মেয়ে নয়। ওর কাণ্ডজ্ঞান আছে, দেরি হলে ও বলে যেত। আমি বললাম, বাবা ঘটনা এমনভাবেই ঘটে যায় যে, ইচ্ছে থাকলেও সব সময় খবর দিতে পারা যায় না। তোমাদের জীবনে কি এমন ঘটনা ঘটেনি? তোমরা যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় জমে যেতে তখন বাড়ির কথা কি তোমাদের মনে থাকত? বাবা বললেন, এখন রাস্তায় রাস্তায় গোরা সৈন্য ঘুরছে। এটা কি একটা উত্তর হল? এ কথার কোনও মানে হয়! এই যে বাবা বললেন, বুড়ো ছেলেটাকে তোমরা যদি হার্টের অসুখে পেড়ে ফেলতে না চাও, তবে বাড়ির নিয়মটা মেনে চল। এ কথার মানে কি ফুলকি, তুই বুঝতে পারছিস?’

সেদিনের ব্যাপারে ফুলকি লজ্জা পেয়েছিল। রাগ করতে পারেনি। দিদি বেজায় রেগে গিয়েছিল। বলেছিল, ‘তোর রাগ হচ্ছে না কেন, তাতেই আমি অবাক হচ্ছি। বাবার কথার মধ্যে দুটো জিনিস খুবই খারাপ লেগেছিল আমার। গোরা সৈন্য ঘুরছে কলকাতার রাস্তায়। ইচ্ছে হয়েছিল বলি, গোরা সৈন্য ঘুরছে তো ঘুরুক না। কিন্তু সেদিনের বাবার মেজাজ তোর খবর না পেয়ে এমন জায়গায় চড়ে গিয়েছিল যে, ও কথাটা বলতে আমি আর ভরসা পাইনি।’ ফুলকি জিজ্ঞাসা করেছিল, বাবা গোরা সৈন্যের কথা হঠাৎ বলল কেন? দিদি বলেছিল, ‘বোধ হয় আমাদের জুজুর ভয় দেখাবার জন্য। আমরা মেয়েরা জুজুর ভয়ে ঘরে ঢুকে বসে থাকব, হয়তো সেই জন্য। মা আমাদের ছোটবেলা থেকে জুজুর ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা করেছে। আমি ভাবতে পারিনি, বাবা, আমাদের রাবা, এতদিন পরে নতুন করে সেই জুজুর ভয় দেখাবে। বাবার আরেকটা কথা তো আরও খারাপ। বাবা হার্টের অসুখের ভয় দেখিয়ে আমাদের বাড়ির নিয়ম মেনে চলতে বলল। বাড়ির নিয়ম কার নিয়ম? কি নিয়ম সেটা? বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরে আসা? মা যেটাকে বাড়ির নিয়ম বলত, সেই নিয়ম? না কী? বাবা কি চায় ফুলকি? মায়ের কাছে দুই সেট নিয়ম ছিল। এক সেট পুরুষদের জন্য, আরেক সেট মেয়েদের জন্য। মায়ের মধ্যে এ নিয়ে কোনও ভণ্ডামি ছিল না। বাড়ির নিয়ম বলতে বাবা কি মায়ের নিয়মে ফিরে যেতে চাইছে? সেই নিয়ম, অর্থাৎ পুরুষের জন্য এক সেট আর মেয়েদের জন্য আরেক সেট, সেই নিয়মটাই ফিরিয়ে আনতে চাইছে? তুই এখন দুঃখ পাবি ফুলকি আমি জানি, আমার উপর রেগেও যাবি জানি, কারণ বাবার উপর এখনও সেই আগের মতো নির্ভরতা তোর আছে, কিন্তু আজ যা বলছি, পরে একদিন বুঝবি সেটা সত্যি, বাবার আদিখ্যেতা যে দিন দিন বাড়ছে সেটা তার ভণ্ডামি ঢাকা দেবার জন্য। এই যে হার্টের অসুখের কথা তোলা, এটা ডেন্জারাস্ মনোবৃত্তি ফুলকি। এটা মনের উপর জুলুম করা। এটা এক ধরনের ব্ল্যাকমেল। মা সহজ সরল মানুষ ছিল। মায়ের পছন্দ অপছন্দ স্পষ্ট জানা যেত। মা যা পছন্দ করত না তেমন কাজ করলে বেধড়ক পিটিয়ে দিত। কিন্তু মা কখনও আমাদের মনের উপর চাপ দেয়নি। বাবা তাই দিচ্ছে। দিস্ ম্যান ইজ্ ডেন্জারাস্। ফুলকি, বাবার থেকে এখন সাবধান হবার সময় এসেছে।’ নিরঞ্জন একদিন বলেছিল, ‘ফুলকি, তোমার দিদিই তোমার বাবাকে ঠিক চিনেছিল। আমাদের বিয়ের ব্যাপারেই তোমার বাবার ভিতরের খড় বেরিয়ে গিয়েছিল। আমি ভ্যাগাবন্ড বলে উনি ঝুমরির সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে রাজি হননি, তোমরা তাই, জানো। কিন্তু আসল ব্যাপারটা তা নয়। তোমার বাবার অমত ছিল, আমি খ্রিস্টান বলে। ঝুমরি সেটা বুঝতে পেরেছিল।’ ফুলকির ধারণা ছিল, নিরঞ্জন বাউণ্ডুলে বলে বাবা তার সঙ্গে দিদির বিয়ে কিছুতেই হতে দেবেন না। জাতপাতের ব্যাপার বাবা মানতেন না। অন্তত ফুলকিরা তাই জানত। বাবার বৈঠকখানা থেকে, অবশ্য তখন সেটাকে আর বৈঠকখানা বলা হত না, ড্রয়িং রুম বলা হত, বাবার গলাকে কতদিন উচ্চগ্রামে, উঠতে শুনেছে ফুলকি। ‘ঠিক আছে ঠিক আছে কৈলাসবাবু, হিন্দু চিন্তা খুব উদার, এটা মেনে নিলাম। কিন্তু তাতে তো কিছু যাচ্ছে আসছে না। হিন্দু-জীবন নিয়ন্ত্রণ করে তো হিন্দুসমাজ। সে সমাজ যদি এত রিজিড় থাকে, তবে হিন্দুদের মধ্যে ঐক্য বোধ আসবে কি করে? আর ঐক্য বোধ না এলে জাতীয়তা বোধই বা গড়ে উঠবে কি করে?’ এ সব কথা ফুলকিরা যখন বাবার মুখে শুনত, তখন মা বেঁচে। বাবা গলা চড়িয়ে বলছেন, ‘তোমরা তপশীলীদের দাবিগুলোকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছ মণিময়? তোমরা বলছ, তপশীলীদের সৃষ্টি করেছে ব্রিটিশ পলিটিক্‌স্। ডিভাইড অ্যান্ড রুল। ব্রিটিশ ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি নিল, আর আমরা হিন্দুরা সুবোধ বালকের মতো উচ্চবর্ণ আর তপশীলীতে ভাগ হয়ে পড়লাম। তোমাদের এই কথাটার মধ্যে সত্যের বিন্দুবাষ্প নেই বলেই তা এত হাস্যকর। ব্রিটিশ তোমাদের ভাগ করেনি। তোমাদের হিন্দুসমাজ বর্ণাশ্রমের নামে তোমাদের উঁচু জাতে নিচু জাতে ভাগ করেছে। এবং স্পৃশ্য অস্পৃশ্যে ভাগ করেছে। পৃথিবীর আর কোনও সমাজে, তা সে সভ্য সমাজ হোক কি অসভ্য সমাজ হোক, এত বড় অলঙ্কের নজির পাবে? মানুষ মানুষকে ছুঁতে চাইছে না ঘৃণায়। কেন? ওর জন্ম নিচু জাতে। মনুষ্যত্বের এত বড় অবমাননা আর কোনও সমাজে আছে?’ বাবা, আমার বাবা! বাবার কথা ভেবে ফুলকিদের বুক কেমন ফুলে ফুলে উঠত। সুধাকরবাবুর মেয়ে বলে ওরা ওদের বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে বিশেষ খাতির পেত। সেই কাঁচা বয়সেও সেটা বুঝতে পারত ফুলকি। ‘হিন্দু সমাজই হিন্দুদের ডিভাইড করে রেখেছে। তার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ তাদের একচ্ছত্র রুল চাপিয়ে দিয়েছে। এটাই সত্য ইতিহাস। ফুলকির মনে পড়ে, সে তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাংলা রচনায় লিখেছিল, হিন্দুসমাজের বড় ত্রুটি হইল ইহাতে মানুষকে মানুষ বলিয়া গ্রহণ করা হয় না। এই ত্রুটি সংশোধন করিতে হইলে হিন্দুসমাজের সকলকেই ভাই বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। বলিতে হইবে মুচি আমার ভাই মেথর আমার ভাই। এবং তাহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিয়া তাহাদিগকে আলিঙ্গন করিতে হইবে। তবে ইন্দুসমাজের বিভেদ ঘুচিবে, হিন্দুসমাজ বলশালী হইবে।’ ফল হয়েছিল এই যে, বাংলার দিদিমণি, বরুণাদি, পাকা মেয়ে বলে তার কান মলে দিয়েছিলেন। নিরঞ্জন বলেছিল, ‘ফুলকি, ঝুমরি বুঝে ফেলেছিল, তোমার বাবা যা বলেন, ও সব তাঁর কথার কথা। নিজে তিনি তার এক বর্ণও বিশ্বাস করেন না। পাছে এই সত্যটা আমার কাছেও ফাঁস হয়ে যায়, তোমার বাবাকে আমি ভণ্ড বলে অশ্রদ্ধা তে থাকি, সেই কারণেই তোমার দিদি তোমার বাবার সামনে যেতে আমাকে প্রাণপণে বাধা দয়েছিল। সেই কারণেই তোমার দিদি চেয়েছিল, আমরা লুকিয়ে বিয়েটা করে ফেলি। তারপর যা হ্য় হবে। কি আবার হবে! একটা ব্যাপারই ঘটবে। তোমার বাবা ঝুমরিকে ত্যাগ করবেন। কিন্তু সেটার অন্য মানে করা যাবে। বাবা মেয়েকে ভালবাসেন, সেই মেয়ে বিদ্রোহ করেছে, বাবাকে অমান্য করেছে, বাবা তাকে শাস্তি দিয়েছেন। এতে দোষটা ঝুমরির উপরেই পড়ত। অপরাধ হত এই, না জানিয়ে বিয়ে করা। লোকে বলত, সুধাকরবাবু এমন উদার লোক, তিনি তো এ বিয়েতে বাধা দিতেন না।’ কেন সুমিতা এমন অন্যায়টা করল? ফুলকি ওদের পরিচিত মহলে এমন কথা শুনেছে।

‘তোমার দিদিকে আমি যখন বিয়ে করি, তখন আমি ডি. জে কিমারে কাজ করি। ববের বন্ধু বলেই ওই সাহেবি বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজটা আমি পেয়ে যাই। বিজ্ঞাপনের কপি এডিট করার কাজ। তখনকার দিনে দু হাজার টাকা রোজগার প্রতি মাসে। তোমার বাবা বলতে পারতেন না, আমি ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই। আমার হাতে সর্বদাই ক্র্যাভেন এ কিংবা প্লেয়ার্স থ্রি সিগারেটের কৌটো থাকত। স্কচ ছাড়া কিছু পান করতাম না। মিকাডো লজে সিংগল সিটেড রুমে থাকতাম। হোয়াইটওয়ে লেডল কি হল্ অ্যাণ্ড অ্যান্ডারসনে, মাঝে মধ্যে আর্মি নেভি স্টোরে ঢুকতাম, অবশ্যই ঝুমরিকে ইম্প্রেস্ করার জন্য। তখন কলকাতায় কেউ শানেল থ্রি টির নামও শোনেননি। ইনিং ইন প্যারিস তখন কলকাতার অভিজাত মহলকে ডমিনেট করছে। একবার এক শিশি তোমার দিদিকে আমার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলাম। সে কখনও সেটা গায়ে মাখেনি। শিশিটা স্মৃতি উপহার হিসেবে রেখে দিয়েছিল। পুরুষ মানুষকে নিঃশব্দে তার মাপে এনে ফেলার এটা ছিল ঝুমরির ইউনিক কায়দা। ঝুমরি নিজে কি একটা মেখে আসত, এখন আর মনে নেই।’

আমাদের পরিবারে তখনও অগুরু-ই চলছিল। আর কেশরজ্ঞন। মা জোর করে আমাদের তিন বোনকেই কেশরঞ্জন মাখাতেন। বলতেন, কেশরঞ্জনে চুলের গোছা ঘন হয়।

‘ঝুমরির চুল একটা দেখবার মতো বস্তু ছিল।’

দিদি কখনও ওর শরীরের যত্ন নিত না। এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে দিদির ধস্তাধস্তি লেগেই থাকত। শেষ কালে মা হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। মা প্রায়ই রেগে গিয়ে বলতেন, সঠিক আছে। যখন বিয়ে হবে না তখন বুঝবি।’ দিদি ঝাঁজ দেখিয়ে বলত, ‘সে তো আমি বুঝব। এখন আমাকে কেশচর্চা থেকে রেহাই দিলেই আমি বাঁচি।’

ফুলকিকে দিদি বলত, ‘কে আমাকে বিয়ে করে ধন্য করবে তার জন্য আমি এখন থেকে শরীরে গন্ধ মেখে গন্ধগোকুল হয়ে বসে থাকি। শুনলে গা জ্বলে যায় ফুলকি? বিয়ে যদি করি, আমি বিয়ে করব, কাউকে আমাকে বিয়ের বর জোগাড় করে দিতে হবে না। সে আমি হতে দেব না।’

নিরঞ্জন বলেছিল, ‘ঝুমরির নিষেধ অমান্য করে একদিন তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করলাম। তোমার বাবার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুকে বলেছিলাম, আমার আইনের একটা পরামর্শ খুব জরুরি হয়ে উঠেছে। তিনি যদি এই বিষয়ে সুধাকরবাবুকে একটু বলে দেন। তিনি একটা চিঠি তোমার বাবাকে লিখে দিয়েছিলেন। তোমার বাবা আমাকে জানতেন না। অন্তত আমার ধারণা তাই ছিল। ওঁর চেম্বারে গিয়ে দেখা করলাম। চিঠিখানা পড়ে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কি তাড়া আছে? আমি না বলতেই উনি অন্য মক্কেলদের কাজগুলো সেরে নিলেন। ঘর ফাঁকা হবার পর কেরানিবাবুকেও ছেড়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে রইলেন যেন আমার ভিতরটাকে ওলটপালট করে দেখে নিচ্ছেন। পরে কিছুক্ষণ চুপ করে কিছু একটা চিন্তা করে নিলেন। তারপর শান্তভাবে বললেন, কি আপনার কাজ? আমি বললাম, একজন হিন্দু ঘরের মেয়ে যদি কোনও খ্রিস্টান কি মুসলিমকে হিন্দুমতে বিয়ে করতে চায় তবে কি এ বিয়ে হওয়া সম্ভব?’

‘পাত্র যদি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করে তবে সম্ভব।

‘না হলে?’

‘এ বিয়ে ধর্মসম্মত এবং আইনসম্মত হবে না।’

‘মেয়েটিও তার ধর্ম বজায় রাখতে চায় এবং পাত্রটিও তার ধর্ম বজায় রাখতে যদি চায়, সে ক্ষেত্রে এ বিয়েটা কি ভাবে হওয়া সম্ভব?’

‘সে ক্ষেত্রে বিয়েটা তিন আইনে রেজিস্ট্রি করতে হবে। সে ক্ষেত্রে পাত্র এবং পাত্রী উভয়কে একটা ডিক্লারেশন দিতে হবে যে, তারা কোনও ধর্ম মানে না।’

‘হিন্দু মেয়ের ক্ষেত্রে তার অভিভাবকেরা কি এই বিয়েতে বাধা সৃস্টি করতে পারে? আমি আইনগত বাধার কথাই বলছি।’

‘মেয়েটির বয়স কত?

‘ধরুন কুড়ি একুশ।’

‘না, আইনত তাঁরা তা পারেন না।

ফুলকি বাবা এবং নিরঞ্জনকে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল।

নিরঞ্জন বলেছিল, ‘এর পর আমি পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ওয়ালেট বের করলাম তারপর তোমার বালকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে কত দিতে হবে স্যর? তোমার বাবা বলেছিলেন, এক পয়সাও না। তবে গোটা কতক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, বলুন।

এ বিয়ের পরিণাম কি হবে, ঝুমরি সেটা জানে কি?’

‘তার বাবার যে মত নেই ঝুমরি সেটা ভালই জানে।’

‘বাবার মত অগ্রাহ্য করে ঝুমরি এই বিয়েটা করতে সাহস পাবে কি?’

‘ঝুমরির সে সাহস আছে বলেই তো আমার মনে হয়।

‘ঝুমরির সেই দুঃসাহসের পরিণাম কি হবে, সেটা কি সে জানে?’

সেটা বোধ হয় ভাল জানে না। আচ্ছা, ঝুমরি যদি তার বাবার অমতে এই বিয়েটা করেই তবে কি পরিণাম হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

‘সে ক্ষেত্রে তার বাবা ধরে নেবে যে, তার মেয়ে মারা গিয়েছে।’

এই কথা শুনে নিরঞ্জন থ মেরে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ পরে বলেছিল, ‘কোনও বাবা যিনি নিজের মেয়েকে গভীরভাবে ভালবাসেন, তিনি কি এত দূর যেতে পারেন?

‘বাবাকে যদি কোনও মেয়ে অগ্রাহ্য করে তবে সে ক্ষেত্রে কোনও বাবা অত দূর যেতেও পারেন। অন্তত আমি তো যাব।’

‘যাবেন! সত্যিই যাবেন?’

‘যাব যাব যাব।’

‘দেখুন স্যর, আপনার মেয়ে এই পরিণামের কথা ভালই জানে। তবুও সে এ বিয়েটা করবে। কেননা, কিছু মনে করবেন না স্যর, আপনার মেয়ে আপনারই মতো একবগ্‌গা জেদি। শুনেছিলাম, আপনি মানুষকে মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেন না। সেই কারণেই জিজ্ঞাসা করছি, আমার সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে দিতে আসল আপত্তি কোনখানে?’

‘কিছু মনে কর না, সরলান্তঃকরণে কথাটা বলছি, তোমরা খ্রিস্টান আমরা হিন্দু। আমাদের সংস্কার আলাদা, তোমাদের সংস্কার আলাদা। এই দুইয়ে কখনও মিল হতে পারে না। এ বিয়ের ফল শুভ হতে পারে না। পিতা হিসাবে আমার কর্তব্য হচ্ছে তার মেয়ের যাতে শুভ হয় সেই কাজ করা। এটা তর্কের বিষয় নয়, এটা আমার কর্তব্য।’

‘তোমার বাবা বলেছিলেন ফুলকি, হিন্দু সংস্কার আলাদা এবং খ্রিস্টান সংস্কার আলাদা। আমাদের বিয়ের পক্ষে সেইটেই নাকি বড় বাধা। তোমার বাবার কথাটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনি। যে মুখোটি কুলে আমার জন্ম, সেটা হল ফুলিয়ার মুখোটি। বল্লাল সেনের আমল থেকে তাদের পরম্পরা চলে আসছে। গণ্ডায় গণ্ডায় স্মৃতিতীর্থ ন্যায়তীর্থ ব্যাকরণচঞ্চুরা মহামহোপাধ্যায়ের দল এই বংশের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছেন। আমার প্রপিতামহ ভরতারণ মুখোটি রঘুনন্দনের নতুন ভাষ্য রচনা করেছিলেন। আমার পিতামহ ভবার্ণব মুখোটি একটি বালবিধবার পাণিগ্রহণ করেছিলেন বলে এবং আমার পিতামহীর মাতার চরিত্রদোষ ঘটেছিল বলে রটনা হওয়ার কারণে পিতামহের পিতা পরম পণ্ডিত ভবতারণ পুত্রকে পত্নী ত্যাগ করতে নির্দেশ দেন। একে তো বালবিধবাকে বিয়ে, তার উপর আবার শ্বাশুড়ি ঠাকুরাণীর চরিত্রদোষ। সমাজে একেবারে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। পিতামহের উপর নির্দেশ এল সেই পত্নী ত্যাগ করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে তাঁকে। পিতামহ সমাজের বা পিতার কোনও নির্দেশই পালন করেননি। কারণ তিনি এইসব নির্দেশের পিছনে কোনও যুক্তি খুঁজে পাননি। কাজেই ভবার্ণব যুগপৎ ত্যাজ্যপুত্র এবং সমাজে পতিত হয়ে গেলেন। তাঁকে পৈতৃক ভিটা ছাড়তে হল, উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হল। পিতামহ তখন যুবক এবং পিতামহী তখন কিশোরী। ওঁরা কেউই ফুলিয়া ছাড়লেন না। পিতার এক মুসলমান প্রজার কাছ থেকে একখণ্ড জমি কিনে ছোটখাট একটা ঘর তৈরি করে দু’জনে নবোদ্যমে সমাজ সংস্কারের কাজে হাত লাগালেন। অস্পৃশ্যের হাতের জল খেতে লাগলেন। তাদের লেখাপড়া শেখাবার জন্য বাড়িতে ইশকুল খুললেন। টোল নয় ফুলকি ইশকুল। পিতামহের প্রথম এবং প্রধান কাজ হল পত্নী লীলাময়ীকে লেখাপড়ায় তালিম দেওয়া। লীলাময়ী অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তিনি এনট্রান্‌স্ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। যেদিন পিতামহীর পরীক্ষার ফল বের হল, সেদিন পিতামহের মাথায় লাঠি পড়ল এবং সেই রাত্রেই তাঁদের ঘর পুড়ল। তাঁরা ভিটে ছাড়া হলেন। পিতামহের বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ী ছিলেন গোয়াড়ির রামতারণ লাহিড়ি। তিনি তাঁদের আশ্রয় দিলেন। তাঁর প্রভাবেই সম্ভবত পিতামহ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এবং বেঁচে গিয়েছিলেন। আমার পিতা স্বর্গত রেভারেন্ড ভূপালক মুখোটি ছোটনাগপুরে এক গ্রাম্য গীর্জায়, মেরিগঞ্জে, সারাজীবন যাজকবৃত্তি করে কাটিয়ে গিয়েছেন। যজনযাজনের চাইতেও তিনি অধিকতর উৎসাহী ছিলেন আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে। দিক মহাজনদের শোষণের কায়দাকানুন সম্পর্কে আদিবাসীদের সচেতন করে তোলাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। হ্যাঁ, আর একটা কাজও তিনি করেছিলেন। নিজে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর পুত্রকে বাপ্তাইজ করেননি। কেন করেননি, সে রহস্য কেউ জানে না। অনুমান করি, এ বিষয়ে আমার পিতামহীর দ্বারাই তিনি প্রভাবিত হয়ে থাকবেন। পিতামহীকে বলতে শুনেছি, মানুষ হয়ে ওঠাই হল আসল। কে খ্রিস্টান আর কে অখ্রিস্টান, তা দিয়ে কি মানুষ চেনা যায়? আমি যখন ছোট তখন দেখেছি, বুড়ি মহা উৎসাহে আদিবাসী বালিকাদের পড়িয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যালয়টি তাঁরই প্রতিষ্ঠিত।

নিরঞ্জন বলেছিল, ‘ফুলকি, আমাদের বাড়িতে অজস্র বই ছিল। এক দিকে সংস্কৃত কাব্য ব্যাকরণ স্মৃতি ন্যায় ইত্যাদির হরেক রকম টীকা নানা ভাষ্য ইত্যাদি। আমি সেগুলির পাতা উলটেও দেখিনি। অন্য দিকে রামায়ণ মহাভারত নানা রকম পুরাণ উপনিষদ বেদ বাইবেলের সঙ্গে সঙ্গে আমার পিতামহ এবং পিতা সেইগুলিরও চর্চা রেখেছিলেন। রামায়ণ মহাভারত আর বাইবেল আমার খুব প্রিয় বই ছিল। আমার পিতামহী মাইকেলের মেঘনাদবধ থেকে আবৃত্তি করে করে আমাকে ঘুম পাড়িয়েছেন। প্রমীলার চাইতে ট্র্যাজিক নায়িকার সন্ধান আমি পাইনি। আমি যে ছাত্র বয়সে ভাল আবৃত্তি করতাম তার মূলে আমার পিতামহীর অনুপম প্রেরণা। যেমন তার স্মৃতিশক্তি ছিল, তেমনি ছিল তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। মেঘনাদবধ পুরোটাই আমার কণ্ঠস্থ ছিল তাঁরই কল্যাণে। যাক, আজ আর নিজের বা পরিবারের গুণপনা জাহির করে লাভ নেই। আসলে তোমার বাবা যদি আমাকে সময় দিতেন সেদিন, খানিকটা সময়ও অন্তত দিতেন, তবে এই ইতিহাসটা বলতে পারতাম তাঁকে। আজ তিনিও নেই তাঁর বড় মেয়েও নেই। দুজনেই ধরাছোঁয়ার বাইরে। কাজেই এ সব কচকচিতে লাভ কি? তবে তোমার বাবা হিন্দু সংস্কার আলাদা এবং খ্রিস্টান সংস্কার আলাদা এবং সেই কারণেই এই দুইয়ের মিলন ঘটা অশুভ বলে যে তত্ত্ব দিয়েছিলেন সেদিন, অবশ্যই আমার মুখ বন্ধ করার জন্য, তাতে তাঁর জাতিগত অভিমান, যেটা তিনি তাঁর পোশাকের তলায় ঢেকে রাখতেন সেটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল। আমি দুঃখ পেয়েছিলাম এই কারণে। ঝুমরি যদি এ বিয়েটা তার বাবার অমতে করে তবে তার বাবা ধরে নেবেন তার মেয়ে মারা গিয়েছে। হোয়াট এ কোল্ড ব্লাডেড্ স্টেটমেন্ট!’

নিরঞ্জন চলে যাবার পরে বাবা দিদিকে ডেকেছিলেন। নিরঞ্জন বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল বলে দিদি নিরঞ্জনের উপর প্রচণ্ড চটে গিয়েছিল।

বাবা দিদিকে বললেন, ‘নিরঞ্জন মুখোটি বলে একটা যুবক আজ আমার চেম্বারে এসেছিল।’ দিদি শান্ত কন্ঠে বলল, ‘এসেছিল বুঝি?’

‘হ্যাঁ, ছেলেটি খ্রিস্টান।

দিদি চুপ করে রইল।

‘ছেলেটি যা বলল, তাতে বোঝা গেল, তোমরা বিয়ে করবে, এটা ঠিক করে ফেলেছ?’ ‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক হয়ে আছে।

‘আমার মত, নেওয়া প্রয়োজন আছে বলে মনে করনি?’

‘বাবা, তুমি কি এ বিয়েতে মত দিতে?’

‘তোমাকে স্বাধীনতা দেওয়ার কি এই পরিণাম যে, তুমি বাবার মত অগ্রাহ্য করবে!

‘স্বাধীন হওয়া মানেই তো নিজের মতে চলা বাবা। স্বাধীন হওয়ার আর কি উদ্দেশ্য থাকবে? আমি তর্ক করছিনে বাবা, তোমার কাছ থেকে আন্তরিকভাবেই জানতে চাইছি, তুমি আমার আর নিরঞ্জনের বিয়েতে মত দিতে?

‘অবশ্যই যে বিয়েতে আমার মেয়ের ঘোর অকল্যাণ, সে বিয়েতে আমি মত দিতাম না।

‘সেই জন্যই তোমার মত আছে কি না, সেটা জানার জন্য তোমার বা আমার কারোরই সময় নষ্ট করিনি। তোমাকেও অযথা বিরক্ত বা বিব্রত করিনি।

‘তুমি এই বিয়ের পরিণাম কি ভেবে দেখেছ?’

‘আচ্ছা বাবা, আমি মেয়ে বলেই কি তুমি পরিণামের কথা ভাবছ বা আমাকে তা মনে করিয়ে দিচ্ছ? আমি যদি তোমার ছেলে হতাম, এক সময় তোমরা যা নিয়ে আদিখ্যেতা করতে, আমাকে ছেলের পোশাকে সাজিয়ে রাখতে ভালবাসতে, আমাকে তোমাদের ছেলে বলেই ভাবতে ভালবাসতে, ধর আমি যদি সেই ছেলেই হতাম তোমাদের, এবং আমি সাবালক হবার পরে, যদি এক খ্রিস্টান মেয়েকেই বিয়ে করে আনতে চাইতাম, কি বলতে তুমি? মত দিতে?’

বাবা চুপ করে পায়চারি করছেন। তার মুখে কঠোরতা দেখতে পায়নি ফুলকি, দেখেছিল, বাবার মুখটা কেমন অসহায় হয়ে এসেছে।

দিদি একটু পরেই জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ছেলেকে তুমি মত দিতে?’

হঠাৎ বাবা দিদির দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ সব তর্ক নিরর্থক। এটা তর্কের ব্যাপার নয়।’

‘তবে কিসের ব্যাপার বাবা?’

‘সন্তান হলে বুঝবি, এটা পিতামাতার কর্তব্যের ব্যাপার। কোনও পিতাই চান না, তার মেয়েকে তিনি জেনে শুনে জলে ফেলে দিতে। মেয়ের শুভ কাজে অশুভের ছায়াপাত ঘটুক, কোন্ পিতামাতা সেটা চাইবে? তুই কি করতিস?’

‘আমার ছেলেই হোক কি মেয়েই হোক, মা হিসাবে আমার কর্তব্য হবে, তাকে পরম যত্নে সাবালক করে ফেলা। তারপর তার কর্তব্যাকর্তব্য তার মতো সে বেছে নিতে যাতে পারে সেই শিক্ষা তাকে দিয়ে যাওয়া। বাবা মায়ের এ ছাড়া কী করণীয় থাকতে পারে?’

‘আমি তোকে ভালবাসি ঝুমরি। তোর মা মৃত্যুকালে আমাকে বলে গিয়েছিল, তোরা যেন ভেসে না যাস। তোর সম্পর্কে তোর মায়ের যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। আমি তোর মাকে কথা দিয়েছিলাম, তুমি চিন্তা কোরো না, ওরা ভেসে যাবে না। এ কথা আমাকে রাখতেই হবে ঝুমরি। আমি নিরঞ্জনকে উপযুক্ত পাত্র বলে মনে করি না।’

দিদি আর কথা বাড়াল না। বাবাকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি কাল সকালেই চলে যাব, বাবা। তোমার আর দুটি মেয়ে থাকল। ওরাও বড় হচ্ছে। তোমার ইচ্ছে অনিচ্ছের ভার ওদের উপর যত কম চাপাবে ততই ভাল হবে।’

বাবা আর দিদির মধ্যে ওই শেষ কথা। বাবা আর দিদির ওই শেষ দেখা i

মা বেঁচে থাকতেই বাবা সেবক বৈদ্য রোডের বাড়িটার খোলনলচে একেবারে বদলে দিয়েছিলেন। তাঁর তখন রমরমা পসার। তাঁদের তিন মেয়ে বড় হবে, তাঁদের বিয়ে-থা হবে এই বাড়িতে। নহবত বসবে। তাদের ছেলেপুলে হবে। সর্বদাই বাড়িটা গমগম করবে। তাঁদের চিন্তায় এই জিনিসটাই শুধু ঘুরত। সেই চিন্তা অনুযায়ী বাবা সেই বাড়িটার মধ্যে তিন মেয়ের জন্য আলাদাভাবে তিনটে ‘মহল’ বানিয়েছিলেন। মহল মানে কি, এমন বন্দোবস্ত যাতে তিন বোনের কোনও অসুবিধা না হয়। বাড়িটা ছিল ভাগ না করা চারটে ফ্ল্যাটের বাড়ি। এক একটা মহল তৈরি হত, আর বাবা মাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দেখাতেন, এই দেখ বড়বাবুর বাথরুম, এটা বড়বাবুর শোবার ঘর। এখানে থাকবে বড়বাবুর ছেলেমেয়েদের জন্য দোলনা। মা সময়োপযোগী দু একটা মন্তব্য করত। তা নিয়ে হাসি ঠাট্টাও চলত। দিদির অংশটা যেদিন তৈরি হয়ে গেল, সেদিন বাড়িতে যেন উৎসব। খাওয়া-দাওয়া গান-বাজনা হইহুল্লোড় খুব হল। ফুলকিকে সেদিন বিলাতি স্টাইলে বেহালা বাজিয়ে শোনাতে হয়েছিল। ফুলকি সেদিন ওয়াজের গৎ বাজিয়ে শুনিয়েছিল। দিদির ঘরের দেওয়ালে ফিকে সবুজ রং লাগানো হয়েছিল। বাবা দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কি বড়বাবু, রংটা পছন্দ হয়েছে তো?’ দিদির চোখে স্বপ্নের ঘোর সেই একদিনই দেখেছে ফুলকি। দিদি গান ধরেছিল, স্বপন দেখি প্রবাল দ্বীপে তুলব আমি বাড়ি, সাগর থেকে ঝিনুক এনে গড়ব সোপান তারি, আমার তিন মহলা বাড়ি। নিউ থিয়েটার্সের দিদি ছবিতে গানটা সায়গল ‘গেয়েছিলেন। সায়গলের অপূর্ব কন্ঠ মাধুর্য, তার কোনও তুলনা হয় না। কিন্তু ফুলকির সেই দিন মনে হল, এই গানটাকে কেউ যদি জীবন্ত করে তুলতে পারে তবে সে তার দিদি। দিদি সেদিন গানটায় প্রাণসঞ্চার করেছিল। দিদির কি ঘর বাঁধার আশা ছিল না? এখন দিদির সেই প্রবাল দ্বীপের সাত মহল একেবারে খাঁ খাঁ। নিষুতি রাতে ফুলকির ঘুম ভেঙে গেলে কখনও কখনও দিদির ঘরে কারও চলাফেরার খসখস শব্দ পায়। সে জানে বাবা চুপি চুপি আসেন।

মায়ের মৃত্যুর পর বাবা যে রক্ষণশীল হয়ে পড়ছিলেন, সেটা দিদির চোখেই প্রথম ধরা পড়েছিল। দিদি অস্বস্তিতে ভুগত সেই কারণে। তাদের বাবা চিরদিন এমন ছিলেন না। বাবার মুখে, মার মুখে, বাবার বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের মুখে ভালমন্দ মিলিয়ে সে সব কথা ফুলকি শুনেছে। শামিমও অনেক কথা শুনিয়েছে তাকে। বাবাকে হরিকিশোর মেসোমশাই ছাত্র অবস্থা থেকে জানেন। একই কলেজের এক ইয়ারের ছাত্র ছিলেন দুজনে। এবং ওদের বিষয়ও ছিল এক। এক সঙ্গে রাজনীতিও করেছেন। হরিকিশোর মেসোমশাই যখন কর্পোরেশনের কাউন্সিলার ছিলেন, সেই সময় বাবা অল্ডারম্যান হয়েছিলেন। সে অনেকদিন আগের কথা। দিদি তখন দু বছরের। ফুলকি তখন পেটে। মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর ফুলকি একদিন হরিকিশোর মেসোমশাই ফুলকিকে হঠাৎ বলেছিলেন, ‘সুধাকর খুবই আপসেট হয়েছে দেখছি। তোর মায়ের শোকটা যেন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তোরা নজর টজর রাখছিস তো মা।’ এ কথায় সে কথায় মেসোমশাই বাবা সম্পর্কে অনেক পুরনো কথা শোনালেন। ‘তোর বাবা বরাবরই স্বাধীনচেতা ছিল। স্পষ্ট কথা বলতে আটকাতো না ওর। সে সব কথা এখন যখন ভাবি, অবাক হয়ে যাই। কি সব কথা বলেছে তখন! সুধাকরের কথায় তখন নেতারা যদি কান দিতেন, তাহলে আমার তো মনে হয়, আজকের অনেক দুর্দৈব থেকে আমরা মুক্তি পেতাম।’

হরিকিশোর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকবার পর বললেন, ‘সুধাকর তোদের যে ভাবে মানুষ করেছে, আমি তার প্রশংসা করি। কিন্তু ইদানীং তার ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, তার মনে যেন তার জন্য অনুশোচনা দেখা দিচ্ছে। সুধাকর ছিল আমাদের যুগের এগিয়ে থাকা মানুষ। ও আগে যা ভেবেছে এখনও লোকে সেইসব ভাবনাকে ছুঁতে পারেনি।’

‘আজও একটা ঘটনার কথা আমার মনে পড়ে। তখন স্বামী শ্রদ্ধানন্দ নিহত হয়েছেন। আমাদের মধ্যে তখন তুমুল উত্তেজনা। আমরা প্র্যাকটিস করতে হাইকোর্টে ঢুকেছি। বার লাইব্রেরি উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। আবদুর রশিদ নামে এক মুসলিম যুবক স্বামীজিকে রোগশয্যায় গুলি করে মেরে ফেলেছে। এবং ধরা পড়ার পর সে বলেছে, সে স্বামীজিকে মেরেছে এবং সেই কারণে সে আদৌ অনুতপ্ত নয়। কারণ এটা ব্যক্তিগত দ্বেষ বিদ্বেষের ব্যাপার নয়। আবদুর রশিদ বলেছে যে, সে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে মুসলমান সমাজ ও ইসলামের শত্রু বলে মনে করত, তাই সে তাকে মেরেছে। আমরা সবাই ক্ষুব্ধ উত্তেজিত এবং সাংঘাতিক রকমে ক্রুদ্ধ। আমাদের বন্ধু তায়েবউদ্দিন যতবার কিছু বলতে যাচ্ছেন ততবারই টেবিল থাপড়িয়ে চেঁচিয়ে তাঁকে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ সুধাকরের দিকে আমার নজর পড়ল। সে শান্ত অবিচলিত। এই উত্তেজনা তাকে যেন স্পর্শই করছে না।’

‘সুধাকর শান্তভাবে বলল, আমি কিছু বলতে চাই। সুধাকরের কথায় উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হল। প্রথম কথাটা আমি বলতে চাই এই যে, হোয়েন ব্লাড় বিগিনস টু বয়েল ব্রেন বিগিনস টু মেলট। এই সমস্যার আলোচনা যদি আমরা করতেই চাই তবে হাটুরে লোকেদের স্টাইলে করলে চলবে না। এখানে যারা আছি তারা কেউই হাটুরে লোক নই। সবাই সাবালক এবং শিক্ষিত। সর্বোপরি এটা বার লাইব্রেরি। কাজেই আমাদের সবাইকে বুদ্ধিকেই কাজে লাগাতে হবে। দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে এই যে, তায়েবউদ্দিনের উপর আমার মনে হচ্ছে আমরা অবিচার করছি। উনি কিছু বলতে চাইছেন, ওঁকে কেন বলতে দেওয়া হচ্ছে না? এই ব্যাপারে ওঁর কথাই আমাদের আগে শোনা উচিত। সুধাকরের কথায় কাজ হল। তায়েবউদ্দিন বললেন, স্বামী শ্রদ্ধানন্দ প্রবীণ লোক এবং রোগশয্যায় তাঁকে মারা হয়েছে। যার মধ্যে বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব আছে তিনিই এই জঘন্য কাজকে নিন্দা করবেন। আপনারা লক্ষ করে দেখবেন, মুসলিম নেতারা এক বাক্যে এই ঘটনাকে নিন্দা করেছেন কিন্তু ওই একই দিনে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে গিয়ে যাঁরা উন্মত্তের মতো সুফি নিরপরাধ বৃদ্ধ আলেমকে খুন করেছেন তাঁদের নিয়ে আপনাদের মধ্যে যে কোনও উচ্চবাচ্য নেই, এটাই আমাকে আশ্চর্য করেছে। মনুষ্যত্বের বেলায় কি কোনও পক্ষ বিচার চলে? আমাদের মনও যদি ন্যায়পরায়ণতা জাত বা ধর্ম বিচার করে নির্ধারিত হতে থাকে তবে আমশ যে সভ্য সমাজে বাস করছি, সেটা বুঝব কি করে? আমাদের বিচারবোধকে জাগ্রত রাখতে হবে। যে অন্যায়কারী তাকেই নিন্দা করতে হবে। আর কোনও সমাজের কেউ একজন অন্যায় করে ফেললে তার জন্য সমস্ত সমাজকে দায়ী করা চলে কি? সেটা উচিত নয়। বা তাকে শহিদের মর্যাদাও দেওয়া উচিত নয়। সুধাকর বলেছিল, তায়েব সাহেবের এই কথায় আপত্তির কি আছে, আমি তো দেখতে পাচ্ছিনে। এ তো ন্যায্য কথা। স্বামীজির হত্যাকাণ্ডে আমরা যে এত বিচলিত হয়ে উঠেছি, সে কি এই জন্য যে, তিনি হিন্দু? না তিনি একজন মানুষ? যদি এই একপেশে মনোভাব নিয়ে আমরাও চলতে থাকি তা হলে ন্যায় বিচারের তুলাদণ্ডে মর্যাদা রাখব কি করে?

‘আমি জানি, সেদিন সবাই চুপ করে গেল বটে, সুধাকরের এই কথায় আমাদের অধিকাংশ বন্ধুই সন্তুষ্ট হতে পারেনি। কিন্তু চরম কাণ্ড ঘটল যেদিন কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন মির্জাপুর পার্কটাকে স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নামে উৎসর্গ করার ব্যাপারটা পাকা করে ফেলতে উদ্যত হল।’

হরিকিশোরমেসো উদাস চোখে ফুলকির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ফুলকির সেদিন কিন্তু মনে হয়েছিল, হরিকিশোরমেসো অতীতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তার বাবাকে কি? ফুলকির বাবার সেই যৌবনকালের তেজোদৃপ্ত সবল উদারতাকেই কি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন হরিকিশোরমেসো তাঁর স্মৃতি রোমন্থনের মধ্য দিয়ে?

‘তোর বাবা বদলে যাচ্ছে ফুলকি। আমাদের সময়ে সুধাকর ছিল তরুণ মনের নেতা। ভ্যানগার্ড। অগ্রপথিক। সুভাষচন্দ্র তখনও রাজনীতিতে আসেনি। ও তখন কেমব্রিজে। আই সি এস প্রোবেশনার। তোর বাবাই তখন সি. আর দাসের কাছের মানুষ। সুভাষ পরবর্তীকালে গ্রেট লিডার হয়েছিলেন, এটাও ঠিক, কিন্তু দাস সাহেবের স্বরাজ্য দলে সুধাকর ছিল অন্য ধাতুতে গড়া। দেশবন্ধু নিজেই তোর বাবার সম্পর্কে এই কথাটা বলতেন ফুলকি, বলতেন, আন্তরিকতা সাহসিকতা আর বিচক্ষণতা এই তিন যুক্ত হলে সুধাকর হয়। দেশবন্ধু বলেছিলেন, উইম, আমি বলি বিচক্ষণতা, এই ছিল তোর বাবা ফুলকি। আমরা তখন যুবক। হিন্দু মুসলিম প্যাকটের পিছনে তোর বাবার পরিশ্রম, আমি তো ভুলতে পারিনে। তোর বাবা আর তায়েবউদ্দিন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছে মুসলিম লিডারদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায়। দাস সাহেবের সঙ্গে তাদের এনে এক টেবিলে বসিয়েছে বারবার। সকলের কথা শুনেছে ওরা, অসুবিধাগুলো দূর করার কথা ভেবেছে। যেগুলো তখন তখনই দূর করা সম্ভব নয়, সেগুলো আলাদা করে রাখা হয়েছে, পরবর্তীকালে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ফয়সালা করবার জন্য। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ কথাটা তোর বাবার মুখেই আমি প্রথম শুনি। যতদিন দাস সাহেব জীবিত ছিলেন, ততদিন তিনি বাংলার মুসলমানদের মনে অবিসংবাদী প্রিয় নেতার আসন পেতে বসেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সে সব ভেস্তে গেল। প্রথম বড় আঘাত পড়ল শ্রদ্ধানন্দ পার্কের নামকরণ নিয়ে। দাস সাহেবের নেতৃত্বে আমরা, স্বরাজ্যিদের, দল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলকে সুদৃঢ় করার জন্য ১৯২২ সাল থেকে যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম, দেশবন্ধুর চিতা ঠাণ্ডা হতে না হতেই বাংলার কংগ্রেসিরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সেই ভিত্তিমূলে শাবল কোদালের প্রচণ্ড ঘা মারতে শুরু করে দিলেন। শ্রদ্ধানন্দের নামে মির্জাপুর পার্কের নাম রাখা হবে, কংগ্রেস মেজরিটির জোরে এই প্রস্তাবটা যেদিন কর্পোরেশনে পাশ করিয়ে নিল তার কদিন বাদেই তোর জন্ম হয়েছিল ফুলকি। তোর মুখ দেখে তোর বাবা বলেছিল, আমরা তো পারলাম না হরিকিশোর হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির দৃঢ় ভিত্তির উপরে জাতীয়তার শুভ্র তাজমহল গড়ে তুলতে। আমি আশা রাখি, এরা যখন বড় হবে, তখন ওরা বুঝতে শিখবে, ওদের বাবারা কত বড় মূর্খ ছিল, আর মূর্খতাবশতই কত ভুল তারা করে গিয়েছে। তখন ওরাই এগিয়ে আসবে, অতীতের ভুলগুলো শুধরে নিয়ে হিন্দু মুসলমানের মিলনের দৃঢ়ভিত্তির উপর জাতীয়তার সেই তাজমহল গড়ে তুলতে।

ফুলকি আবেশের ঘোরে হরিকিশোরমেসোর কথা শুনে যাচ্ছে। ‘তোর বাবা করেছিল কি জানিস, তুই তখন দু দিনের বাচ্চা। তোকে তোর মায়ের কোল থেকে টপ করে তুলে নিয়ে তোর দুই গালে চুমু খেতে খেতে বলল, দেখ হরিকিশোর দেখ, এটা একটা ফুলকি। হ্যাঁ, এরাই পারবে আমাদের ফেলে যাওয়া মহাশ্মশানে নতুন প্রাণের ফুলকি ছোটাতে।’

কিন্তু তুমি আজ কোথায় হরিকিশোরমেসো? হরিকিশোর মিলিয়ে যাবার আগেই ফুলকি প্রশ্নটা করল। তুমি কোথায় থাক এখন? কোন লোকে? সেখানে কি আলো? সেখানে কি অন্ধকার? সেই অন্ধকারে কি নতুন প্রাণে ফুলকি ছুটছে? বাবা কোথায় হরিকিশোরমেসো? বাবা কি তোমার কাছাকাছি থাকে? দেখা হয়? তোমরা কি সবাই আবার যুবকত্বে ফিরে গিয়েছ? তোমরা কি এখনও নতুন বিশ্ব বানাবার স্বপ্ন দেখছ? বাবা কি আরও বুড়ো হয়ে গিয়েছে? আরও স্থবির? আরও রক্ষণশীল? আরও কঠোর? আরও নির্মম? নাকি বাবার মধ্যে দুটো মানুষ বরাবর বাস করেছে হরিকিশোরমেসো, এবং সেই দুটো মানুষই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সিসিয়ার? একটা মানুষ তার মেয়েদের প্রাণের চাইতে ভালবাসে। আর একটা মানুষ তার মেয়েদের স্বত্বাধিকারী হয়ে ওঠে। মেয়ে বাবাকেই ভালবাসবে, এই হল তার শর্ত। মেয়ের ভালবাসা তার বাবার স্বত্ব, বাবারই। সেই স্বত্ত্বে অন্য কেউঁ ভাগ বসাতে এলে বাবা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বাঘের মতো। বেচারি বাবা! তুমি কেন আমার স্বপ্নে আস না বাবা? কেন তুমি আমাকে এড়িয়ে থাক? কেন কেন কেন! শামিমের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যখন ভেঙে গেল, তখন তুমি তো নিশ্চিন্ত হয়েছিলে? তুমি শামিমকে নিশ্চয় বলেছিলে বাবা, ‘হিন্দু কালচার আলাদা, মুসলিম কালচার আলাদা। এ দুইয়ে কখনও মিল হবে না। এতে আমার মেয়ের ঘোর অমঙ্গল হবে। সেই কারণেই শামিম, আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে হতে পারে না।’ এ কথা তুমি শামিমকে বলেছিলে বাবা, যেমন নিরঞ্জনকে তুমি সংস্কারের দোহাই দিয়েছিলে? বলেছিলে, হিন্দু সংস্কার আলাদা আর খ্রিস্টান সংস্কার আলাদা। এই দুইয়ে মেলে না। তাই ঘোর অমঙ্গল হবে মেয়ের। তুমি শামিমকে সেই একই কথা বলেছিলে তো? তুমি জানতে এ কথা ঠিক নয়। হরিকিশোরমেসো তোমার যে সব কাহিনী আমাকে বলেছেন, সেইসব কাহিনী জুড়ে জুড়ে আমি আমার মনে তোমার যে চেহারা গড়ে তুলেছি বাবা, সেটা দিদির গড়া তোমার চরিত্রের সঙ্গে মেলে না। দিদির মনে হয়েছিল, তুমি একটাই মানুষ। তুমি মুখে এক রকম বল, কাজে এক রকম কর। তাই দিদি তোমাকে ভণ্ড বলত বাবা। আমি তো তোমাকে দিদির চোখে দেখিনে। আমার মনে হয় বাবা, তুমি একটাই মানুষ নও। তুমি দুটো মানুষ। তোমার মন বুদ্ধি বিবেচনা ভালবাসা, হ্যাঁ বাবা ভালবাসা, সবই দু’ভাগ করা। আমি কি ঠিক বলছি বাবা? তুমি আমার স্বপ্নে স্বচ্ছন্দে আসতে পার, বাবা। তুমি এসে আমার কাছে বসতে পার, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারো, সেই যেমন দিতে ছোটবেলায় আমার অসুখ করলে। এমন কি, এমন কি, স্বপ্নে আমাকে যদি তুমি সেই আগের মতো চুমু খাও তবু আমি কিছু বলব না তোমাকে। কেন তুমি আস না বাবা? কেন তুমি এড়িয়ে যাও আমাকে? সেই শামিম যেদিন চলে গেল আমার বুক ভেঙে দিয়ে, আমি জানতাম, এর পিছনে তোমার হাত আছে। শামিম আমাকে কিছুই খুলে বলেনি। তবু আমি জানতাম। দিদি বারবার আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। বারবার তোমাকে অমান্য করে শামিমকে বিয়ে করতে বলেছিল। আমি তোমাকে অমান্য করিনি। সে কিন্তু তোমার ভয়ে নয়। তোমাকে ভালবাসতাম বলে। দিদি তোমাকে অমান্য করে নিরঞ্জনকে বিয়ে করেছিল, আমি তোমাকে অমান্য করে শামিমকে বিয়ে করিনি। আর এই ভোগান্তি দিদিকে যেমন, তেমন আমাকেও পোয়াতে হয়েছিল। তুমি কি তোমার দুই মেয়ের এই ভোগান্তির মধ্যে কোনও তফাত দেখতে পেয়েছিলে বাবা? আমার যন্ত্রণা কি তুমি বুঝতে পেরেছিলে বাবা? পেরেছিলে? পেরেছিলে? এই কথাটা জিজ্ঞাসা করব বলে আমি তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি অনেকদিন ধরে। আর তুমি আমাকে খালি এড়িয়েই যাচ্ছ, খালি এড়িয়েই যাচ্ছ। আমি তো পরজন্মে বিশ্বাস করিনে বাবা, না না, এক সময় পরজন্মে বিশ্বাস করতাম না। তখন আমার স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল। কোনও অসুখ মানে কঠিন অসুখ মানে ক্যান্সার তখনও আমাকে ধরতে পারেনি, সেই যে সময়, তখনও অনেক কিছু বিশ্বাস করতাম, অনেক কিছু বিশ্বাস করতাম না। এখনও কিসে যে বিশ্বাস করি, আর কিসে যে করিনে, সব তালগোল পাকিয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যুই সত্য। মৃত্যুযন্ত্রণাই ধ্রুব। তুমি আমাকে কানসারে ভুগতে দেখনি বাবা। খুব বেঁচে গিয়েছ। আমাকে এ অবস্থায় তুমি যদি দেখতে, তবে এই কথা ভাবতে, কালচারে মিলুক না মিলুক, ভবিষ্যতে মঙ্গল হোক কি অমঙ্গল, শামিমকে বিয়ে করে ফুলকি আমার ফুলকি, দু দিন সুখের স্বর্গ যদি রচনা করে তো করুক না আর তাতে কয়েক মুহূর্তের জন্যও সুখী হয় তো হোক না। এই কথা তুমি বলতে কি না, সেটাই তোমার কাছ থেকে জানতে আমার বড় ইচ্ছে করে বাবা! আমার এই জন্মের স্বপ্নে তুমি যদি নাই আস বাবা, তবে আমার এই প্রশ্নের জবাব পেতে কোথায় কতদূরে যাব তোমার নাগাল পেতে?

কত রকম করে নিজেকে যে উলটে পালটে এখন দেখে ফুলকি! কখনও তার শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। সেই দাই বুড়িকে দেখতে ইচ্ছে করে তার। দাই বুড়ি, তাকে যে মায়ের গর্ভ থেকে টেনে এনে ছেড়ে দিয়েছিল এই পৃথিবীতে, তার চেহারাটা দেখতে বড় ইচ্ছে জাগে ফুলকির মনে। কিছু মনে নেই তার, কিচ্ছু মনে করতে পারে না সে, দাই বুড়ি কেমন ছিল। হরিকিশোরমেসো একবার বলেছিলেন, ফুলকি যখন দু দিনের তখন তার বাবা তাকে মায়ের কোল থেকে খপ করে তুলে নিয়েছিল আদর করার জন্য। আদর! আহ্ আদর! কথাটার মধ্যেই কেমন একটা মাদকতা মেশানো আছে। ‘তোর বাবা আর আমি কোর্ট ফেরতা গিয়েছি তোদের ডালিমতলার বাড়িতে। জুতো জামা ছাড়া নেই, কোর্টের পোশাকেই তোর বাবা সটান আঁতুড়ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তুই তখন অ্যা-ত্তো টুকুন ফুলকি। কেমন কুত কুত করে তাকাচ্ছিলি। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে তোর বাবার ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মেরে তোর সেই কুতকুতে চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম। তোর মাথায় চুল ছিল, না ছিল না, সেটা ঠিক এই বয়সে আর মনে নেই। তোর বাবার মেজাজ সেদিন খুব খারাপ। মির্জাপুরের পার্কটার নাম স্বামী শ্রদ্ধানন্দ পার্ক হওয়াটা আমরা কিছুতেই আটকাতে পারিনি। স্বরাজ্যিরা একে একে দল ছেড়ে কংগ্রেসে ঢুকে পড়ছে তখন। অন্ধ আবেগের প্রবল তরঙ্গ আমাদের সমস্ত যুক্তি সমস্ত বিবেচনাবোধকে ভাসিয়ে নিয়েছিল। আর তখন সকলে কংগ্রেসের সঙ্গে স্বরাজ্যিদের মিলনটাকেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি বলে প্রচার করতে লেগেছে। তোর বাবা বিরক্ত হয়ে অল্ডারম্যানের পদ ছেড়ে দিয়েছে। আমি কাউন্সিলারের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া স্থির করে ফেলেছি। মনের কি অবস্থা আমাদের বুঝে দেখ। সেই সময় তুই সুধাকরের ঘরে এসে পড়লি। সুধাকর সেদিন খুব ইমোশনাল হয়ে উঠেছিল। তাই অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই তোর বাবা তোর মায়ের কোল থেকে তোকে খপ করে তুলে নিল। আর তোর মুখে চুমু খেতে শুরু করল। আর যাবে কোথায়! কোথা থেকে দাইটা ছুটে এল। হয়তো তোর কান্না শুনেই এসেছিল। এসেই তোর বাবার কোল থেকে তোকে চিলের মতো ছিনিয়ে নিল। আর সে কি বকাবকি!

‘কেমন মানুষ গো তুমি! আক্কেলের মাথা খেয়েছ! বলা নেই, কওয়া নেই, হুট করে পুরুষ মানুষ আঁতুড়ঘরে ঢুকে পড়লে! জানো নি তোমার নোংরা হাতের ছোঁয়াচ নেগে ওই বাচ্চার ইনভেনশন হয়ে যেতে পারে? দাইটা বেশ ইংরেজি জানে দেখা গেল। ইভেনশন্ হয়ে যেতে পারে! আমি আর সুধাকর পালাবার পথ পাইনে।’

ইনভেনশন কথাটা ফুলকির মনে গেঁথে আছে। যতবারই তার কোনও না কোনও ইনফেক্‌শন হয়েছে, হরিকিশোরমেসোর কাছ থেকে ইনভেনশন কথাটা শোনা ইস্তক, ফুলকি তাকে ইভেন্‌শনই বলে গিয়েছে।

একটা লোক কত ভাবে বেঁচে থাকে। অ্যাঁ! ফুলকির মাঝে মাঝে বিস্ময় লাগে। এই দাইটা কিভাবে বেঁচে আছে তার মনের ভিতরে! কত রকম মুখ মনে আনতে চেষ্টা করল অমিতা সেই ভোরে, কলকাতা যখন জাগছে একটু একটু করে, যার মুখের সঙ্গে তার জীবনে হারিয়ে যাওয়া সেই দাই বুড়ির মুখের আদলটা আসে! সেই মুখটা কি গোলগাল, ভালমানুষ-ভালমানুষ? নাকি চ্যাপটা খরখরে, মন্টুর মার মতো? সেই মুখটা কি লম্বাটে তামাটে? না কালো? না মেটে মেটে? নাকি উজ্জ্বল? সেই মুখটা কি উলকি পরা? সে কি দাঁতে মিশি দিত?’ ‘জানো নি তোমার ছোঁয়াচ লেগে ওই বাচ্চার ইনভেনশন্ হয়ে যেতে পারে?’ বুড়ি বাবাকে বেশ অপ্রস্তুত করেছিল। বুড়িটার কি ফোকলা গাল ছিল? পান খেত? তার মুখ তার কপাল কি বলিরেখায় ভর্তি ছিল? আহা, অমিতার বুকটা কেমন হা হা’ করে উঠল। আহা, বুড়িটা যদি বেঁচে থাকত, তবে কি অমিতাকে এমন একলা ছেড়ে রাখতে পারত? আহা! ‘সেই বুড়িই তো আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে,’ অমিতা বিড় বিড় করে বলতে লাগল, ‘সে বেঁচে থাকলে কক্ষণো আমাকে, আমার এই সময়ে, এমন অরক্ষিত ফেলে রাখতে পারত না। কক্ষণো না, কক্ষণো না।’

জানালার বাইরে ভোরের রঙ একটু একটু করে ফুটে উঠছে। ফুলকি মন্ত্রাবিষ্টের মতো সেইদিকে অপলক চেয়ে রইল। পৃথিবীটা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে শুরু করেছে তার দু চোখের সামনে। অমিতার মনে হল, হঠাৎই মনে হল, এই তো সেই তার ধাইয়ের মুখ। সে তো তা হলে তাকে ছেড়ে থাকেনি। না, ছেড়ে থাকেনি। সেই জন্মের মুহূর্ত থেকেই তো তার ধাই, ধাত্রী, ধরিত্রী, তার প্রিয়তম পৃথিবী তাকে ধারণ করে আছে। এক মুহূর্তের জন্য তো সে, একমাত্র সেই, তার কাছ ছাড়া হয়নি। আশ্চর্য, আশ্চর্য, এটা কেন সে বুঝতে পারেনি এতদিন?

অমিতা এতক্ষণে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়ল।

ভোরের আলো কলকাতার ধোঁয়াশার বুক চিরে হাঁফাতে হাঁফাতে অমিতার বাড়ির গায়ে-ঠেকা দেবদারু গাছটার ডগায় এসে বসল। দেবদারুর ডগা একটু বুঝি তিরতির করে নড়ে উঠল। ভোরে সেই আবছা আলো দেবদারুর সেই নাজুক ডগার থেকে দুলতে দুলতে ঝুলতে ঝুলতে ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে লাগল। অমিতা তখন নিদ্রামগ্ন। দেবদারু গাছটাকে অন্ধকারে মনে হচ্ছিল সেটা যেন নিটোল একটা দণ্ড। আলো যত নামছে ততই তার ডালপালাপাতা ক্রমশ প্রকট হতে লাগল। অমিতার পুবদিকের জানলার কাছে এসেই আলোটা টুপ করে তার ঘরে ঢুকে গেল। অমিতা ঘুমাচ্ছে। ঘরের অন্ধকারটাকে ঠেলতে ঠেলতে আলোটা ক্রমেই এগোতে লাগল অমিতার দিকে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। কয়েকটা তোরঙ্গ আধখোলা অবস্থায় পড়েছিল কোণের দিকে। আলো তাদের উপর পড়তেই একটা ইঁদুর, যে বই কাটতে ঢুকেছিল তোরঙ্গের ভিতরে, আচমকা ভয় পেয়ে কিচকিচ করতে করতে ছুটে নর্দমা দিয়ে পালাল। আলো অমিতার শরীরের দিকে এগোতে লাগল। অমিতা ঘুমাচ্ছে। আলো ছড়িয়ে পড়ল অমিতার ওষুধের শেলফে, বই রাখার তাকে। আলো পড়লে দেখা যাবে অমিতার ওষুধের শেলফে বই, বইয়ের তাকে ওষুধ ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। আলো এগিয়ে যেতে লাগল। বাথরুমের দরজা বন্ধ। আলো একটু থমকে দাঁড়াল দোরগোড়ায়, তারপর সেখান থেকেই লাফ মেরে চলে এল অমিতার খাটে। অমিতার অবিন্যস্ত শরীরে। চিত হয়ে শুয়ে আছে অমিতা। ঈষৎ হাঁ করে। ঘুমাচ্ছে সে। আলো অমিতার অগোছাল শরীরটায় যেন চষে বেড়াতে লাগল। প্রায় উলঙ্গ হয়ে আছে অমিতার শরীর। হাউস কোটটার কোমরের দড়ি খোলা। উঁচু পেটটা ঢাউস। উঁচুনিচু হচ্ছে শ্বাসপ্রশ্বাসে। যেন হাঁপর চলছে ঘরে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। আলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে। অমিতার একটা বুক বেশ উঁচু হয়ে আছে, অন্যটা একেবারে খাদে। তার একটা পা হাউস কোটের কিছুটা আড়ালে, অন্য পাটা জঙ্ঘার কাছ থেকেই একেবারে খোলা। আলো অমিতার গায়ের উপর, অমিতার পায়ের উপর। গোড়ালিটা ফুলে আছে। রাতের অন্ধকারে যা কিছু কুৎসিত অমিতা ঢেকে রেখেছিল, রাখতে চেয়েছিল, সকালের আলো অতর্কিতে এসে সে সবই প্রকাশ করে দিয়েছে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। মাছি এসে বসতে শুরু করল মুখে। অমিতার মুখে লালা গড়িয়ে পড়েছিল। মাছি এসে সেটা খুঁটতে শুরু করল। আলোয় অমিতার ঘর ভরে উঠছে। অমিতার মুখে এখন কোনও মেক আপ নেই। সে সব এখন খাবচা খাবচা হয়ে মুখের এখানে ওখানে জমা হয়ে আছে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। অমিতার মাথার কাছে যুবতী অমিতার একটা সুন্দর ফটোগ্রাফ টাঙানো আছে। আলো পড়ে সেটা অমিতার দিকে মুখ করে হাসছে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরে। একই আলোয় একই রমণীর দুটি মুখ ভাসছে। অথচ মুখ দু রকম। দেওয়ালেও অমিতার মুখ। বিছানাতেও অমিতার মুখ।

দেওয়ালের অমিতা নিশ্চল। বিছানার অমিতা প্রাণময়। মানে তার প্রাণটা এখনও আছে। অমিতা ঘুমাচ্ছে। তার বুক পেট ওঠানামা করছে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তালে তালে। বিছানার অমিতা বেঁচে আছে, মাত্র এই প্রমাণটুকুর উপর নির্ভর করে। তবু দেওয়ালের অমিতাকেই অনেক প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে এখন, এই আলোয়। তার ঘন কালো চুলে সিঁথিটা কি টান টান! তার দু চোখে কি সমুজ্জ্বল স্বপ্ন! তার দুই ভুরুতে ছিলা পরানো ধনুকের অনুপম বক্রতা! তার নাসায় ব্যক্তিত্বের সে কি অপূর্ব প্রকাশ! তার মুখের অপ্রতিম ডৌলে সে কি লাবণ্য! তার ঠোঁটে, সেই তরুণ যুগ্ম ওষ্ঠে কি অপ্রতিরোধ্য আমন্ত্ৰণ! এ সব ঐশ্বর্য এখন কোথায় পাবে অমিতা, কি করে পাবে? অমিতা বিছানায় ঘুমাচ্ছে। আলো যত ফুটে উঠছে বিছানার অমিতা তত নিষ্প্রভ হয়ে উঠছে। ভোরের স্নেহময় আলো ক্রমে রোদ হয়ে উঠল। অমিতা ঘুমাচ্ছে। গত রাতে অমিতার চোখের জলের যে ধারা নেমেছিল, সেই ধারা চোখের কোণ থেকে বেরিয়ে অমিতার গালের বাসি মেক আপ ফুঁড়ে মোটা দাগ রেখে গিয়েছে সেখানে। যেন কোনও প্রস্তরীভূত প্রাগৈতিহাসিক নদীই বুঝি বা।

মন্টুর মা ঘরে ঢুকল। কি বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বিছানায় শোয়া অমিতার মুখে এমন একটা অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল তখন, অমিতাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন একটা রিক্ত বিধ্বস্ত শরীরের তাল মাত্র, যে, মন্টুর মায়ের মনেও মায়া উথলে উঠল। সে আস্তে আস্তে চারিদিকে চেয়ে দেখল যেমনটি সে রেখে গিয়েছিল সবই তেমনটি আছে। কোনও কিছুতেই হাত পড়েনি। কিচ্ছু খায়নি অমিতা কাল রাতে। মন্টুর মার মনে পড়ল ওর পড়োশি কুঞ্জ দাসের ছ বছরের নাতনিটা পুকুরে ডুবে মরেছিল। তিনদিন পরে ডুবুরি এসে জাল ফেলে তাকে তোলে। সেই মেয়েটা ফুলে ঢোল হয়ে এমনি, এই অমিতার মতোই বড়সড় হয়ে গিয়েছিল। অমিতাকে এখন অবিকল কুঞ্জর সেই নাতনিটার মতোই দেখাচ্ছে। মন্টুর মার শরীরটা শিরশির করে উঠল। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কপালে তার শীতল হাতটা রাখল! ‘ও মা ও মা জ্বরে যে শরীল পুড়ে যেইছে গো।’ অমিতার ঘুম ভেঙে গেল। রোদের কড়া তেজে তক্ষুনি সে চোখ বন্ধ করে ফেলল। তখনও অমিতার চোখে ঘুম এঁটে আছে ভারি ভারি নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল অমিতা। যেন তার দম আটকে আসছে। ‘উঠতে পারবে লিজে লিজে? না ধরব গো?’ মন্টুর মার মুখে বিপরীত কথা শুনে অমিতা ভাবল, সে বুঝি এখনও স্বপ্ন দেখছে। ‘না না মা, তোমার ওঠবার খ্যামতা লেই গো, তুমি উঠতে যেওনি। তুমি উঠতে যেওনি।’ মন্টুর মা এগিয়ে এল। তারপর অমিতার ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে যত্ন করে তাকে বসিয়ে দিল বিছানায়। কি কপালটাই করে এয়েছিলে গো মা! ধর আমারে চেপে ধর। না না, একটু সবুর কর। একটুখন বসে থাকো বিছানায়। আমি চেয়ারটা একটু ঠিক করে দিই। মিস্তিরিটাকে দেখা হলেই বলছি, ওগো একবার এসনি আমাদের বাড়ি। মায়ের চেয়ারটার আর কিছু লাই। লাড়িভুড়ি সব বেইরে গিয়েচে। তা সে লবাবের ব্যাটা লবাব আমার কথা গেরাজ্যিই করে না। রোজই বলে এই যাচ্ছি এই যাচ্ছি। মুখপোড়া তুই ভাবিস কি? আমার মা তোকে দিয়ে মিনিমাংনায় চেয়ার সারিয়ে লেবে!’ মন্টুর মাকে আজ ঠিক বুঝতে পারছে না অমিতা। মন্টুর মা ততক্ষণে চেয়ারটার অবাধ্য স্প্রিংগুলোকে তেবড়ে তাবড়ে ঠিক ঠাক করতে শুরু করে দিয়েছে। চেয়ারটার উপর একটা ছোট তোষক বিছিয়ে দিয়েছে। ‘লাও এবার এসো। ধর আমাকে। হ্যাঁ এবার লামো। ভয় লাই, আমি তোমাকে ধরে আছি। হ্যাঁ এবার বসে।। কি কপাল তোমার গো তাই ভাবি? মন্টুকে সেদিন বলছিলাম, দ্যাখ মন্টু আমি যাই বঙ্গে কপাল যায় আমার সঙ্গে। কপাল কপাল। আমার মাকেই দেখ না। বলে অতি ঘরন্তি না পায় ঘর। মা আমার তাই। কে লাই ওর। ছেলে আছে মেয়ে আছে। কিন্তু আবার দ্যাখ কেউ বলতে কেউই লাই তো। তা এটা কপাল লয়?’ মন্টুর মা ততক্ষণে বিছানার তোষক চাদর বালিস, যা যা ভিজে গিয়েছিল রাত্রে, সব মেঝেতে ডাঁই করে ফেলেছে। ‘লতুন তোষক এখন কোথায় পাই? তোমার খোকার তোষকটাই তবে আজ পেঁটরা থেকে বার করি, কি বল?’

অমিতার নিজেকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। এই মন্টুর মাকে সে কত গালমন্দ করেছে। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। কেমন ঝিমুনি পাচ্ছিল। তার ভারি মাথাটা কোলের উপর ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছিল। ঘুমের ঘোরটা কাটছিল না তার। তার ভয় হচ্ছিল, এই ঘোরটা কেটে গেলেই সে বাস্তবতায় নেমে আসবে। না না। সে এই স্বপ্নের ঘোরটা কাটাতে চাইছিল না। সে বরং ঘুমিয়েই পড়ুক। মন্টুর মার চিৎকারে তার ঝিমুনির ভাবটা কেটে গেল। ‘হায় কপাল! দ্যাখ প্যাঁটরার ভিতরে যা কিছু রেখেছিলে মা, ইঁদুরে সে সব কুটি কুটি করে কেটে ফেলেছে। কতদিন থেকে বলছি, বিষ লে আসি বিষ লে আসি, ইঁদুরগুলো বড় উৎপাত করতে নেগেছে ত্যাখন তো সে কথায় কান দিলেনি। এখন দ্যাখ, কি তোমাকে পেতে দিই! বলো?’ মন্টুর মা সেই তুলো বের হওয়া তোষক নিয়ে তার বিছানার কাছে এল। ‘এ বাড়িতে যত অনাছিষ্টি কাণ্ড। শালার ইঁদুর সেও পিছনে নেগেছে। কিচ্ছু আর রইবেনি, তা বলে দিলাম।’

অমিতা মাঝে মাঝে ঢুলুনি থেকে মুক্ত হচ্ছে, চোখ দুটো কিছুক্ষণ খুলে রাখছে। মন্টুর মা যতটা সম্ভব যত্ন নিয়ে বিছানাটা পেতে ফেলল। একটা সুজনি, সেটাও খানিকটা ফুটো হয়ে গিয়েছে, বিছানাটা ঢেকে খানিকটা ভদ্রস্থ করে তুলল। ‘কি, এখন শোবে?’

অমিতা বলল, ‘না। আমি এখন মুখ ধোব। ব্রাশ আর পেস্ট নিয়ে এসো।’

মন্টুর মা টুথব্রাশে পেস্ট লাগাতে গেল। অমিতা তাকে বারণ করল। এখনই সে পঙ্গু হয়ে পড়তে চায় না। যতটা পারে সে নিজের কাজ করে নেবে। সে যখন বুঝল, সে এখন স্বপ্ন দেখছে না, তখন অমিতা ভাবতে লাগল, তা হলে মন্টুর মা আজ তার সঙ্গে এমন সুন্দর ব্যবহার করছে কেন? কিছু একটা মতলব নিশ্চয়ই আছে। অমিতা ব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে বলল, আমাকে একটু তুলে ধর। আমি বেসিনটাতে মুখ ধোব। মন্টুর মা ওকে ধরে চেয়ার থেকে তুলে দিল। বেসিনটার কাছে নিয়েও যেতে চাইছিল মন্টুর মা। অমিতা সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল তার মাথাটা টলে গেল। সে মন্টুর মার গায়ে ভর দিয়ে সেটা সামলে নিতে চেষ্টা করল। ‘তুমি হড়বড় করতে নেগেছো কেন? আমি তো বননু, আমি সব করে দিচ্ছি।’

অমিতা বলল, ‘আমি এটা পারব। তুমি খাবার তৈরি করো। খিদে পেয়েছে।’

‘রাতে কিছু না খেলে খিদে পাবে না? সব করে রেখে গেনু। পই পই করে বলে গেনু গো সবই হাতের কাছে রইল। এখন এসে দেখি, যেমন সব রেখে গিইছিলাম, সব তেমনই আছে। কিছু তো পশ্ করনি মা। এমন করলে শরীল টিঁকবে?

অমিতা ততক্ষণে মন্টুর মাকে ছেড়ে দিয়ে দু পায়ে টাল রেখে ধীরে ধীরে বেসিনটার সামনে পৌঁছে গেল। মাথার টলানি কমেছে। অমিতা সামনের আয়নাটায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগল। ব্রাশটা বেসিনের গায়ে রেখে মুখটা বেশ করে ধুতে লাগল। যেন সব যন্ত্রণা সে এই ঠাণ্ডা জলে ধুয়ে ফেলবে। শুধু যন্ত্রণাই নয়, গত রাতের সব ভয় সব আতঙ্ক সব গ্লানিই সে কল থেকে আঁজলা আঁজলা জল নিয়ে ধুয়ে ফেলবে। এখন একটা চকচকে দিন। এই দিনটায় সে প্রমাণ করবে সে মরে যায়নি। সে বেঁচে আছে। অন্যরা যেমনভাবে বেঁচে আছে, সে হয়ত তেমনভাবে বেঁচে নেই, কিন্তু বেঁচে তো আছে। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে অনেকটা আরাম বোধ করতে লাগল। অমিতা দাঁত মাজতে শুরু করল। কোনও কিছুই ঠিক নেই তার। দাঁতই কি ঠিক থাকবে? ডাঃ রায় কবেই তার চেম্বারে যেতে বলেছেন। এমন কথা সকলেই বলেছেন তাকে। এক একটা দাঁতে ব্রাশের ঘষা লাগছে আর কোনওটা শিরশির করছে, কোনওটা টনটন করছে, বেশ জানান দিচ্ছে দাঁত নামক বস্তুটি আছে। ছিল, একসময় অমিতার দাঁতের পাঁতি সুন্দর ছিল, সুন্দর চুলের গোছা ছিল। এই সেদিন পর্যন্তও ছিল। কিন্তু কেমোথেরাপি শুরু হওয়ার পর থেকেই সে সব গোল্লায় গিয়েছে। মাথার চুল উঠে গিয়েছে, দাঁতগুলো এখন যাই যাই করছে। আপদ যায়। ‘ফুলকির দাঁত ইঁদুরের মতো’। মা গর্ব করে বলত। সুনন্দনের দাঁত সম্পর্কেও গর্ব ছিল অমিতার। অবিকল অমিতার মতো সুষম দাঁতের পাটি ছিল সুনন্দনের। দাঁত দেখেই লোকে বলে দিতে পারত এ অমিতার ছেলে। তার খোকা। তার প্রথম সন্তান। যার জন্য অমিতার বুকে দুধ এসেছিল প্রথম। অমিতার মন ভরে গিয়েছিল মাতৃস্নেহে। নাতৃস্নেহ! আয়নার দিকে সে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তাকিয়েই রইল। টুথব্রাশটা তার গালের মধ্যে পোরা। তার হাত নড়ছে না। মাতৃস্নেহ! কথাটা যেন প্রথম শুনল অমিতা।

‘কি কপাল গো মা তোমার? ছেলে আছে।’

হ্যাঁ আছে। আমেরিকায়। ওহাইওতে। তার বাবার সঙ্গে সেই ছোট বয়সেই চলে গিয়েছিল। সমীরেন্দ্র, তার প্রথম স্বামী, খোকাকে তার কাছ থেকে ভুলিয়ে, নিয়ে চলে গিয়েছিল। না ভুলিয়ে নয়, কোর্টে দরখাস্ত করে তার প্রথম স্বামী তার প্রথম সন্তানকে নিজের ‘কাস্টডিতে নিয়ে গিয়েছিল। বিচারক সমীরেন্দ্রের আবেদনই মঞ্জুর করেছিলেন। মায়ের কাস্টডি ছেলের মেন্টাল হেলথের পক্ষে সহায়ক নয়। ভুলিয়ে নয়, সমীরেন্দ্র খোকাকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। বাপের কাছেই সে মানুষ হয়েছে তো! মাকে তার দরকার হয়নি।

‘মেয়ে আছে তোমার।’

মেয়ে? হ্যাঁ আছে। বিন্তি। তার দ্বিতীয় পক্ষের মেয়ে। সে খুব ভাল ছাত্রী ছিল। এখন টোরোন্টোতে থাকে। কানাডায়। নিজে যেমন ভাল ছাত্রী ছিল বিয়েও করেছে তেমনি ব্রিলিয়ান্ট এক ছেলেকে। ওদের ছেলেমেয়েরাও পড়াশুনায় খু উ ব ভাল। বিন্তি তার ল্যাবরেটরির গবেষণা ঘরসংসার এখানে ওখানে পড়াতে যাওয়া লেকচার নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে, এদেশে আসতে আর সময় পায় না। আগে চিঠি লিখত মাঝে মধ্যে কখনওবা টেলিফোন করত। এখন সব বন্ধ। শুধু কার্ড আসে ক্রিস মাসে আর নিউ ইয়ারে। মাতৃস্নেহ!

‘কি কপাল! কি কপাল গো তোমার মা। সবাই আছে আবার কেউই লাই।

হঠাৎ দাঁতে ব্রাশের খোঁচা লেগে রক্ত পড়তে শুরু করল বলে অমিতা যেন জেগে উঠল।

‘কি গো খেতে দিই?’

না। অমিতা বলল, আমাকে চানের জল দাও। সারা শরীরে গন্ধ ছাড়ছে। চান না করলে খেতে পারব না। অমিতা দেখল তার বোধগুলো এখনও কাজ করছে। এই তো সে বেঁচে আছে। চান ব্রেকফাস্ট সারতে পারলে অনেকটা সুস্থবোধ করবে সে। থাকুক তার গায়ে জ্বর। এখন মুখে ভাল করে মেক আপ দিয়ে সে অপেক্ষা করবে সারা দিন। কার প্রতীক্ষা করবে অমিতা? কে আসবে সে জানে না। কেউ আসবে কি না, তাও না। সিস্টার, তুমি বলে দিও আমার ডিউটিতে যে সব সিস্টার আসবে তাদের, তারা যেন আমাকে রোজ সাজিয়ে গুজিয়ে ফিটফাট করে রাখে। আমি সব সময় চিয়ারফুল থাকতে চাই। চিয়ারফুল থাকতে চেয়েছিল অমিতা। ওর কাছে এসে কেউ যেন আহা উহু করতে না পারে। যেদিন প্রতাপ তাকে দেখতে এসেছিল, সেদিনও সে চিয়ারফুল ছিল। প্রতাপ, তার সহপাঠীদের মধ্যে সব চাইতে সুপুরুষ ছিল। আর ফিটফাট। গায়ে ল্যাভেন্ডারের গন্ধ ম ম করত। ‘এই গন্ধগোকুলটাকে কোত্থেকে জোগাড় করলি ফুলকি, দিদি বলেছিল, যেদিন অমিতাকে ইমপ্রেস করার জন্য প্রতাপ তাদের বাড়িতে খুব সেজেগুজে এসেছিল। ‘ছেঁটে ফ্যাল ছেঁটে ফ্যাল ফুলকি, এ সব ভপ্‌পর সঙ্গে নিয়ে ঘোরা আর সাতমণি বোঝা বয়ে বেড়ান একই কথা। খরচা পোষায় না।’ ভপ্‌পর বলতে দিদি যে কি বোঝাত দিদিই জানে। এটা দিদির গোয়াবাগান কালচার থেকে পাওয়া। সেই প্রতাপ তাকে দেখতে এসেছিল নার্সিং হোমে। কতদিন বাদে ওর সঙ্গে দেখা। মাঝে যখন অমিতা রাইটার্সে বসত, সেই সময় একদিন ডালহৌসিতে দেখা, তখনও ওরা ডালহৌসি স্কোয়ার বলত, এখন বিবিডি বাগ। প্রতাপ তড়বড় করে কোথায় চলেছিল। হঠাৎ তাকে দেখে চিৎকার, ‘হ্যালো বিউটি!’ তখনই তার সেই আগের স্মার্টনেস ঢিলে হয়ে পড়েছে। তবু অমিতার মনে হল, প্রতাপ সেটাকে এখনও ঠেকা দিয়ে রেখেছে। প্রতাপ তখন শেয়ার মার্কেটে দালালি করছে। কিন্তু নার্সিং হোমে প্রতাপকে দেখে অমিতা অবাক হল। যেমন তার চেহারা টসকেছে, তেমনি তার স্মার্টনেস। এ যেন পুরনো প্রতাপের প্রেতাত্মা। ধপাস করে চেয়ারটায় বসে আবেগ ভরে অমিতার হাতটা ধরে ফেলল। অনুকম্পা? অমিতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতাপকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে প্রতাপ তোমার?’

‘ডায়েবিটিস। কিন্তু তুমি বিউটি, তুমি ঠিক তেমনই আছ। কি করে এমন রাখ নিজেকে?’

অমিতা ডিউটি সিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়েছিল মনে মনে। পাকা বিউটিশিয়ানের মতোই রোজ সে সাজিয়ে যায় অমিতাকে।

‘তুমি কি করে জানলে প্রতাপ, আমি এখানে আছি?’

‘আমি তো কিছুই জানতাম না। আমি এখন নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত অমিতা যে, বন্ধুবান্ধবদের কারোর খোঁজই রাখিনে। রাখতে পারিনে। হঠাৎ তোমার ছেলের সঙ্গে দেখা। সেই তোমার অসুখের খবরটা দিল। খুব আফসোস করছিল, থাকতে পারছে না সে। সেও নাকি জানত না, এখানে এসে শুনেছে। তোমার অপারেশন হয়েছে। বলছিল, আগে যদি খবর পেত তবে তোমাকে ওদের ওখানে নিয়ে যেত। বললে, ওদের ওদিকে এ সব রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা অনেক উন্নত। খুবই কন্সার্নড দেখলাম তোমার ছেলেকে। বড় চমৎকার ছেলে হয়েছে তোমার। ওর বার্থ ডে পার্টিতে গিয়েছিলাম একবার তোমাদের বাড়ি। ও তো তখন এইটুকু একটা টডলার। এখন দেখ কেমন জোয়ান মদ্দ। আর চেহারাও পেয়েছে তোমারই। তা যাও না অমিতা, তোমার ছেলের কাছে। ওখানে তো উন্নত বন্দোবস্ত।’

‘প্রতাপ, ওখানকার ব্যবস্থা কত উন্নত? আমেরিকার লোকে ক্যান্সারে মরে না বুঝি? খোকা কি তাই তোমাকে বলল?’

অমিতা আয়নার দিকে চেয়ে দেখল, তার দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ছে। বলল, বাজে ভপর। খোকা বাপের কাছেই এসেছিল। খবর পেয়ে দুদিন দুটো ফুলের তোড়া নিয়ে দেখতে এসেছিল মাকে। আন্‌ট শাল্ট ওকে বকে বাক্-আপ করতে চেয়েছিল। মনে হল সুনন্দন যেন অন্য গ্রহের প্রাণী। ওর বাপ একদিনও আসেনি। মাতৃস্নেহ!

‘লাও গো মা, একটু জল গরম করে দিলাম। উষ্ণ উষ্ণ জলে চানটা সেরে লাও। আরাম নাগবে। আমি চানঘরে টুল পেতে রেখে এয়েছি। তুমি গিয়ে বস। সাবান টাবান আমি তোমাকে মাখিয়ে দেবখনি। মন্টুর মা আজ সত্যিই মাতৃস্নেহ দেখাচ্ছে। কি মতলব অমিতা কিছু বুঝতে পারছে না। ওর মনে একটা অস্বস্তিকর ভাবনা জেগে উঠতে লাগল। যোগী যেদিন এসেছিল নার্সিং হোমে, সেদিনও অমিতা খুব চিয়ারফুল ছিল। যোগীশ্বর তার দ্বিতীয় স্বামী। যোগমায়াতে ইকনমিক্‌স্ পড়াত। আর কাঁচা কাঁচা কবিতা লিখত। সমীরেন্দ্রর সঙ্গে সব চুকে বুকে যাওয়ার পর অমিতা কিছুদিন যোগমায়াতে পার্ট টাইম পড়িয়েছে। সরকারি শিক্ষাবিভাগে ঢুকবার আগে।

‘অমিতা, তোমার ক্যান্সার হয়েছে! ক্যান্সার?’ যোগীশ্বর যেন তক্ষুনি মূর্ছা যাবে। ও তো সারে না শুনেছি।’ প্রতাপ অনেক সভ্য ছিল। অনেক বিবেচক। সে যতক্ষণ ছিল তার কাছে, একবারও তার রোগের নাম উচ্চারণ করেনি। অমিতা বুঝতে পেরেছিল, প্রতাপ মৃত্যুভয়ে ভুগছে। কিন্তু সে জানত অমিতার কি হয়েছে। অমিতার মুখে ক্যান্সারের কথা শুনেই বরং প্রতাপ পীড়া বোধ করেছিল। অমিতা প্রতাপের কাছে মন খুলে কথা বলেছিল সেদিন। আজ আমার জীবনটাকেই কেমন লাগে। তোমাকেই বলছি প্রতাপ, মনে হয়, কেবলই মনে হয়, চলে তো যাচ্ছি। কিছুদিন আগেই ‘আমি রোজ মৃত্যু চাইতাম, রোজ ভোরে, কার কাছে যে, এই প্রার্থনা জানাতাম নিজেই জানিনে। হয়ত জীবনের কাছেই অব্যাহতি পাবার জন্য প্রার্থনা করতাম। বলতাম, আজকের ভোর রাতটাই যেন শেষ ভোর হয় আমার জীবনে। অব্যাহতি চাইতাম ভালবাসাহীন নীরস জীবন থেকে। তখন মনে হত জীবনের এই দুঃখটাই বোধ হয় দুঃসহ। প্রতাপ বলেছিল, ‘তোমার এমন সিরিয়াস কিছু হয়নি অমিতা। তোমার চিকিৎসক ডাঃ মজুমদারকে আমি চিনি। তিনি আমাকে বলেছেন, তুমি সেরে যাবে। আমি এখানে আসবার আগে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি।’ অমিতা বলেছিল, আমি যা বলছি তা এই, প্রতাপ কোনও দুঃখই জীবনের শেষ দুঃসহ দুঃখ নয়। ক্যান্সার হবার পর আমার মনে হল, এর আগে যে সব দুঃখের জন্য মৃত্যু কামনা করেছি, সে সবের কোনটাই এত গুরুতর ছিল না। আমার জীবনে এই যেন প্রথম দুঃখ শুরু হল। এখন আর আমি মৃত্যু কামনা করিনে প্রতাপ, আমি জানি মৃত্যু আম’র জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে আছে। দুঃখ যন্ত্রণার দীর্ঘ পথ পার হয়ে আমাকে সেখানে পৌঁছতে হবে। এটা আমার জীবনে যেমন সত্য, তোমার জীবনেও তেমন সত্য। মৃত্যুতেই আমাদের সমাপ্তি। প্রতাপ বলেছিল, ‘তুমি গ্রেট, বিউটি। তুমি পাকা দার্শনিক হয়ে উঠেছ। অথচ বিএ-তে দর্শন তোমার সাবজেক্ট থাকা সত্ত্বেও তুমি বি কে ডি-কে তোমার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করেছ। তাঁর ক্লাস তুমি ফাঁকি দিয়েছ। অথচ তুমি জানতে বি কে ডি তাঁর সুন্দরী ছাত্রীর বিরহ সইতে পারতেন না।’ এই হল প্রতাপ। অমিতা হাসি চাপতে পারেনি সেদিন।

প্রতাপ কি আমাকে সত্যি ভালবাসত। না ওটাও ছিল তার ভপর।ফুলকির জিভের উপরে আজ ঝুমরিই যেন এসে বসে আছে।

‘লাও গো মা, এসো। জল আবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তোমাকে চান করিয়ে খাইয়ে রেখে আমাকে আবার এই সব মুক্ত করতে হবে তো। দেরি করনি।’

‘তোমার ক্যান্সার হয়েছে শুনেই তো আমার আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়। কত কষ্ট যে পেয়েছি অমিতা এই খবরে তা আর কি বলব?’ যোগী আবার কবি! বুড়ো বয়সে তরুণ কবিদের দলে ভিড়েছে। অধুনিক কবিতা লিখছে। রেডিওতে একদিন ওর ন্যাকা ন্যাকা সুরে আবৃত্তিও শুনেছে অমিতা। কিন্তু ওর রুচিবোধ একটুও পালটাল না!

‘গুচ্চের কাচাকাচি করতে হবে আমায় গো মা। বিছানার চাদর কাচতে হবে। তোষকটা রোদে দিতে হবে। কাজ যে কত বাড়িয়ে রেখেছ মা! তা তুমি আর কি করবে বল? কপাল কপাল!

যোগীর চাইতে মন্টুর মা শতগুণে ভাল। কিন্তু মন্টুর মা আজ এত ভাল ব্যবহার করছে কেন তার সঙ্গে? মন্টুর মা যত সদয় হচ্ছে অমিতার উপর, অমিতার মনে ততই এই প্রশ্নটা খচখচ করে বিধছে, কি চায় মন্টুর মা?

তুমি এক কাজ কর মন্টুর মা, অমিতা টয়লেটের তাক থেকে একটা শ্যানেল থ্রি-র ছোট্ট বোতল পেড়ে আনল। তার ছিপিটা খুলে বলল, এটা আমার টুলের উপর রেখে দাও। আমি ওটা জলে মিশিয়ে নেব।

চানের জলে শ্যানেল থ্রি খানিকটা স্প্রে করে নিল অমিতা। সারা ঘরই যেন তার গন্ধে ভরে উঠল। সারা রাত নরকে পড়েছিল অমিতা। সেই গন্ধটা সে জানত, সাবান ঘষে উবিয়ে দেওয়া যাবে না। শ্যানেল থ্রি নরকের গন্ধটাকে উড়িয়ে দিল। ভাগ্যিস অমিতার মনে পড়েছিল শ্যানেল থ্রির কথা। ভাগ্যিস এই বুদ্ধিটা তার মাথায় এসেছিল! তার মানে অমিতার ব্রেন এখনও কাজ করছে? তার মানে অমিতা এখনও বেঁচে আছে। সাত বছর আগে যোগীশ্বর নার্সিং হোমে এসে হা হুতাশ করেছিল, ক্যান্সারে নাকি কেউ বাঁচে না! বাঁচে কি না বাঁচে এসে দেখে যা না। নেকু! না পাড় বদমাস! অমিতাকে যন্ত্রণা দেবার জন্যই যোগী ওই ন্যাকামি করে গিয়েছিল। অসভ্য! স্কাউণ্ডেল! খেয়ে দেয়ে অমিতা যখন ইজিচেয়ারটায় এসে বসেছে, তখনও যোগীশ্বরের কথা মনে পড়ায় ওর সারা শরীরে জ্বালা ধরেছে। সে হাত আয়নাটা নিয়ে প্রসাধন করতে বসল।

‘তুমি এখন সাজুগুজু কর মা বসে বসে, আমি হাতের কাজগুলো সেরে ফেলি। আজ সন্ধ্যেয় তোমাকে খাইয়ে রেখে যাব মা।’

কি মতলবে আছে মন্টুর মার? মন্টুর মার এই ব্যবহার কেন তার মনের অস্বস্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে? ‘তুমি এখন সাজুগুজু কর’, মন্টুর মার এই কথাটা অন্যদিন অনর্থ বাধিয়ে দিত। কিন্তু আজ, আশ্চর্য, অমিতা দেখল মন্টুর মার কথায় ওর আদৌ রাগ করতে ইচ্ছে করছে না।বরং কথাটা শুনে সে মজাই পাচ্ছে। তুমি এখন সাজুগুজু কর। সাজুগুজু করতে করতে অমিতার মুখে বরং এক চিলতে হাসিই ফুটে উঠল। কার জন্য এত সাজুগুজু করছ অমিতা? আমি চিয়ারফুল থাকতে চাই সিস্টার, সেটা তুমি ওদের বলে দিও প্লিজ প্লিজ প্লিজ! তুমি বুড়ি বুড়ি বুড়ি অমিতা, তুমি একা একা একা। কেউ তোমাকে দেখতে আসবে না। কে আসবে কি না, আমি জানিনে, কেউ আসবে কি না, আমি জানিনে। অমিতা যেন আয়নাটাকেই শোনাচ্ছে। কিন্তু অতর্কিতে কেউ একজন এসেই হয়ত পড়ল। আসতেও তো পারে? কে সে? সে কে, আমি তা বলতে পারব না। কেউ একজন। আসতেই তো পারে। কোনও বন্ধু? আত্মীয়দের কেউ? কি কোনও উটকো লোক? বাড়ি ভুল করে? যেমন টেলিফোনের রং নাম্বার হয়? ধর কোনও চোর, কি ডাকাত? কি চাঁদাওয়ালাদের কেউ? কোনও রক্ত-মাংসের মানুষ? ধর মন্টু, মন্টুই এসে পড়ল। কি প্রতাপ? আমি চাইনে প্রতাপ আমার এই বীভৎস মুখটা দেখুক। প্রতাপ? চার বছর আগেই তো তুমি প্রতাপের মৃত্যুসংবাদ পড়েছিলে অমিতা। এখন তো আর খবরের কাগজটাও রাখ না। না, প্রতাপ আসবে না। আসবে না মানে সশরীরে আসবে না। তুমি তো কেঁদেছিলে? হ্যাঁ আমি কেঁদেছিলাম। দুটো কারণে। এক,প্রতাপ রেহাই পেল বলে। দুই, আমি আরও একা হয়ে গেলাম বলে। অমিতা এখন,একই কারণে, প্রত্যেক মৃতজনের জন্য কাঁদে।

অমিতা পরিপাটি করে প্রসাধনে মন দিল। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই নিপুণতার সঙ্গে মুখটার শ্রী সত্যিই ফিরিয়ে আনল। হাল্কা তুলি বুলিয়ে ভুরু দুটো দেওয়ালের অমিতার ভুরুর কাছাকাছি নিয়ে গেল। নাক আর গালের মধ্যে যে রেখাটা গভীর হয়ে ফুটে উঠেছিল, সেখানে একটা পিংক বেস্ দিয়ে তারপর তার উপর আলতো করে পাউডার ঘষে সেই গভীর রেখাটাকে ঢেকে দিল। মুখখানা আয়নায় নেড়েচেড়ে দেখে সে খুশি হল। ঠোঁট দুটোকে মৃত মাংসের টুকরো বলে মনে হচ্ছে এখন। বুড়ির পলিত মুখে প্রসাধনের প্রলেপ দিয়ে দিয়ে রোজই অমিতা একটা মাঝবয়সী নারীর মুখোশ এঁটে দেয়। ঠোঁটে হালকা গোলাপী, লিপস্টিকটা বোলাতে বোলাতে সেই মুখোশটাকে দেখতে লাগল অমিতা। মোটামুটি শ্রী ফিরেছে তার। এবার প্রসাধনের সঙ্গে ম্যাচ করে পোশাকটা পরে ফেলতে পারলেই সারাদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। কে আসবে, সেটা এখন বড় কথা নয় অমিতার কাছে। কেউ তো তাকে রাজা করে দিচ্ছে না। সিঁড়ি ভেঙে চারতলায় তার সঙ্গে দেখা যদি কেউ করতে আসে, তবে সেটা আগন্তুকেরই অনুগ্রহ। যেই আসুক সে যেন একটা ফিটফাট অমিতাকে দেখতে পায়। যখনই আসুক কেউ তার ঘরে, সে যেন এ কথা বুঝতে না পারে, অমিতা ধুকে ধুকে মরে যাচ্ছে। সে পরিচিত লোকেদের কেউ হতে পারে, সে অপরিচিত কেউ হতে পারে। বন্ধু হতে পারে, অবন্ধু হতে পারে। ডাক পিওন হতে পারে। শুকুল বলে একটা ডাক পিওন ছিল। দিন কতক সেই ছিল অমিতার সম্বল। এ দিকে তার বিট থাকলেই সে আসত। চিঠি থাকুক না থাকুক, একবার উঁকি মেরে যাবেই শুকুল। তাকে দিয়ে টুকটাক কত ফরমায়েশই না খাটিয়ে নিয়েছে অমিতা। বছর খানেকের জন্য অমিতার নিঃসঙ্গ জীবনকে কিছুটা ভরে দিয়েছিল শুকুল। বছর দুয়েক আগে পর্যন্তও। আর আসত তার পুরনো ড্রাইভার মহম্মদ। বেশ লম্বা বুড়ো। ছাপরায় বাড়ি। সেও আজকাল আসে না। কেন আসে না অমিতার শিওরে বসে মৃত্যু যে পরম ধৈর্যে অপেক্ষা করছে, সেটা কি ওরা টের পেয়ে যায়। তারপরই পালায় ভয় পেয়ে? নাকি মৃত্যু পছন্দ করে না অমিতার কাছে কেউ এসে ঘনিষ্ঠ হোক। কেউ একটু ঘনিষ্ঠ হয়েছে কি থাবা মেরে সরিয়ে দেয় তাকে। এখন তবে মৃত্যুই তার স্বত্বাধিকারী? শৈশবে নারীরা পিতার অধীন, যৌবনে পতির অধীন বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। মনু হিন্দু নারীদের জন্য এই অমোঘ ছ বেঁধে দিয়েছেন। আজ পর্যন্তও কোনও মিঞা এটাকে খণ্ডাতে পারল না। আমার তো এখন বার্ধক্য। আমি তবে কার অধীন? আমি সরকারী পেনসনের অধীন। আমার স্বত্বাধিকারী কি তবে সরকার? মনুর মতে তো আমার পুত্রের অধীন থাকবার কথা। কোথায় সেই পুত্র? সুনন্দন? খোকা?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *