প্রতিবেশী – ১.১৫

১৫

সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী! এই তার বাবা! এই ফঙ্গবেনে লোকটাই সুধাকর চক্রবর্তী! তার বাবা! সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী! জ্ঞান হওয়া অবধি অমিতা সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর কথা শুনে আসছে। অমিতার খুব কম বয়সে, সে সেটাকে ভাবত রূপকথারই এক রকমফের। এই হিলহিলে লোকটাই সুধাকর। তখন বাবার গোঁফ ছিল। হঠাৎ ফুলকির হাসি পেল। ওই রোগা শরীরে অত মোটা একটা গোঁফ বাবা টেনে নিয়ে চলত কি করে? তাদের ডালিমতলার বাড়িতেও বাবার গোঁফ দেখেছে ফুলকি। পছন্দ করত বলে মনে হয় না। কিন্তু ডালিমতলায় বাবা তো তার নয়। বাবা তখন ছিল দিদির বাবা। দিদি বাবার গোঁফ নিয়ে খুব গর্ব করে বেড়াত। দিদির এক বন্ধু ছিল গোয়ালাদের ছেলে নগিশ্বর। সে আবার তখন সেই বয়সেই গোবরবাবুর আখড়ায় কুস্তি করত। দিদি বলে বেড়াত, তার বাবার গোঁফ নগিশ্বরের বাবার গোঁফের চাইতে ঢের বঢ়িয়াঁ। নগিশ্বর এ কথা একদম মেনে নিতে পারত না। তকে না পারলে দিদিকে তামেচা ঝাড়ত। দিদি নগিশ্বরের কাছ থেকেই কুস্তির কিছু কিছু প্যাঁচ শিখে নিয়েছিল। গোবরবাবুর আখড়াতেও যেত তখন। কিছুদিন খুব বায়না ধরেছিল, গোবরবাবুর কাছ থেকে কুস্তি শিখে সে হামিদাবানুর মতো পালোয়ান হবে। ফুলকিদের ছোটবেলায় হামিদাবানুর কুস্তিগির হিসাবে খুব নাম ডাক ছিল। দিদির খেয়াল হয়েছিল, সে হামিদাবানু হবে। গোবরবাবু তাদের বাড়ির কাছেই গোয়াবাগানে আখড়া করেছিলেন। ওদের বাড়িতেও আসতেন মাঝে মাঝে। গোবরবাবুর আখড়ায় দিদির ছিল অবারিত গতি। মা মেয়ের মতিগতি দেখে খুব ভয় পেতেন। গোবরবাবু এসে মাকে বোঝাতেন, আমার আখড়ার মাটি মাখলে তোমার মেয়ের ভালই হবে বৌমা। তুমি ওর জন্য ভেবো না। তারপর ওদের রান্নাঘরের বারান্দায় পিঁড়ে পেতে বসে গোবরবাবু তাঁর তেলচকচকে পা দুটোকে টান টান করে এগিয়ে দিতেন দিদির দিকে। আবছা আবছা মনে পড়ে ফুলকির। গোবরবাবু তারপর ডাকতেন দিদিকে। ‘এই ঝুমরি এদিকে আয়, এগিয়ে আয়!’ দিদির ভয় ডর কিছু তো ছিল না। ফুলকিরই বরং ভয়ে বুক গুরগুর করত। দিদি দিব্যি গুটি গুটি গোবরবাবুর কোলের কাছে এগিয়ে যেত। গোবরবাবু বলতেন, ‘এই ঝুমরি, আমার পাটা সরিয়ে দে তো।’ তারপর চলত টানাটানি। দিদি প্রাণপণে যতরকমে পারে গোবর দাদুর পা ধরে হেঁইয়ো হেঁইয়ো টানছে। দিদির মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু দাদুর পাটাকে, দিদি বলত, পা নয় ফুলকি, ও দুটো তো থাম।’ এক চুলও নড়াতে পারত না। বাবা আর মা খুবই মজা পেতেন। আর গোবরদাদু বলতেন, ‘তোমরা স্বদেশী কর সুধাকরবাবু, কিন্তু ছেলেমেয়েদের শরীরের উন্নতির জন্য তোমরা একদম খেয়াল রাখো না। তোমরা বীর সন্তান চাও, কিন্তু বীর প্রসবিনী যারা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি সম্পর্কে তোমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। দেশটা নিজের করে যেদিন পাবে, সেদিন এই রোগজীর্ণ শরীরগুলো তোমাদের কোন কাজে আসবে!’

সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী। এই ছবিটা বাবার, আমার বাবার। রোগা ল্যাংপেঙে। ফুলকি যখন বড় হয়েছে, তখন বাবার এ চেহারা দেখেনি। গোয়াবাগানে থাকতেই বাবার গায়ে গত্তি লাগতে শুরু করেছিল। হরিকিশোরমেসো, তুমিও দেখি তালপাতার সেপাই ছিলে। বাবার চাইতে খানিকটা লম্বা ছিলে তুমি। তবে তুমি অনেক বদলে গিয়েছিলে। তুমি আমাদের গোয়াবাগানের বাড়িতে যখন যেতে হরিকিশোরমেসো তখনও কি তুমি এমন ল্যাগবেগে ছিলে? আমার মনে পড়ে না। সেবক বৈদ্যতে যখন থেকে তোমাকে দেখেছি আমরা, তখন তুমিও কথার মতোই শাঁসে জলে বাড়তে শুরু করেছ। আর তুমি? তায়েব কাকা, তোমাকে যতদিন থেকে আমরা দেখছি, তোমার চেহারাই কেবল বদলায়নি দেখছি। তখনও যেমন গালভর্তি দাড়ি, পরেও তোমার তেমনই গালভর্তি দাড়ি আমরা দেখেছি। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী! তোমাদের তিনজনে যখন দেখা হত, আমরা দেখতাম, তোমরা আর এ জগতে নেই। তোমরা ডুব দিয়েছ সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর স্মৃতি এবং স্বপ্নের গভীরে। ডালিমতলাতেই হোক, কি সেবক বৈদ্যতেই হোক, আর কি তায়েব কাকার বৈঠকখানার বাসাতেই হোক, তোমরা চেঁচামেচি শুরু করলেই মা কাকিমারা বলে উঠত, এই ওদিকে এখন আর মাড়াস না তোরা, ওখানে এখন সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর অধিবেশন শুরু হয়েছে।

রাজনীতিতে তখন কোনও আগ্রহ বোধ করেনি ফুলকি। ফুলকিই বা কেন, তার দিদিরও এ বিষয়ে আগ্রহ ছিল না। তবু ফুলকিকেই শুনতে হয়েছে বাবাদের আমলের রাজনীতির কথা, শামিমের কথা, এমন কি সমীরেন্দ্র যে সমীরেন্দ্র, মিন আত্মসর্বস্ব যে লোকটা, সেও তাকে বাগে পেয়ে রাজনীতির আবর্তে কিছুদিন ফেলে দিয়েছিল। ফুলকির হাতে খড়ি সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী থেকে। সিরাজগঞ্জ বলতে ফুলকির মনে একটা অসাধারণ জায়গার ছবি ফুটে ওঠে। পদ্মা বলতে যেমন স্বপ্নময় একটা ছবি। তার বাবারা কুমিল্লার লোক। বাবা বলতেন, তাঁরা কালিকচ্ছ গ্রাম থেকে এসেছেন। অথচ কালিকচ্ছ নামটা শুনলেই তার আর দিদির হাসি পেত। মা রেগে যেতেন। শ্বশুরের দেশ সম্পর্কে মা হাসি-ঠাট্টা একদম সইতে পারতেন না। দিদি জিজ্ঞাসা করত, ‘মা তুমি কালিকচ্ছ দেখেছ?’ প্রথম দিকে মাকে দেখে মনে হত, কালিকচ্ছ নামটা শোনামাত্রই মা বুঝি ঘোমটা টেনে দেবে। কালিকচ্ছ শুনলেই ফুলকির আর ঝুমরির মুক্তকচ্ছ কথাটা মনে পড়ে যেত। আর ওরা দুই বোনে খিলখিল করে হেসে উঠত। দিদি বলত কালিকচ্ছ না মুক্তকচ্ছ। আর দিদি এমন ভাবে কথাটা উচ্চারণ করত যে ফুলকি না হেসে পারত না। একদিন দিদি কথায় কথায় বলে ফেলেছে, ‘কালিকচ্ছ না মুক্তকচ্ছ’, আর ওরা দুই বোনে যথারীতি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। মা এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন দিদির উপর, দিদির চুলের মুঠি ধরে খুব করে ঝাঁকানি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘মেয়ে যত বড় হচ্ছে ততই মেয়ের ধিঙ্গিপনা উথলে উঠছে। বাপ ঠাকুর্দার গ্রাম নিয়েও ঠাট্টাবাজি শুরু হয়েছে।’ দিদি অনেক কষ্টে সেদিন মায়ের হাত থেকে, হাত না বলে থাবা বলাই ভাল, নিজেকে মুক্ত করে চুলটা জড়াতে জড়াতে বলেছিল, ‘আচ্ছা মা, তুমি কথায় কথায় অত খেপে যাও কেন বল তো? তোমার নির্ঘাৎ ব্লাড প্রেসার আছে। আচ্ছা, তুমিই বল, মুক্তকচ্ছ বলতে কি চোখে ভাসে না যে, একটা লোক এক হাতে শালগ্রাম শিলা আর এক হাতে পূজোবাড়ি থেকে পাওয়া একটা বড়সড় নৈবিদ্যি নিয়ে, তার মাথায় আবার একটা ইয়া বড়কা সন্দেশ আছে, লোকটা হন্তদন্ত হয়ে আরেকটা পূজোবাড়িতে ছুটছে, এমন সময় মাঝরাস্তায় লোকটা মুক্তকচ্ছ হয়ে পড়ল।’ বলেই দিদি খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল। ফুলকিও হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে তখন। দিদি হাসতে-হাসতে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘তুমি অবস্থাটা বুঝতে পেরেছ মা। পুরুত ঠাকুরের এক হাতে শালগ্রাম শিলা, আর এক হাতে জমিদারবাবুর বাড়ি থেকে ইয়া বড় এক নৈবিদ্যি ভর্তি থালা। আর মাঝ রাস্তায় তার কাছা খুলে গিয়েছে। কি সঙ্গিন অবস্থা মা, বুঝে দেখ বেচারির। একেই বলা হয় মুক্তকচ্ছ। তা এতে হাসি আসবে না? বল মা, হাসি আসবে না?’ মাকে জড়িয়ে ধরল দিদি। ‘তোমার হাসি পাচ্ছে না, মুক্তকচ্ছ লোকটার কথা ভেবে? হাসি পাচ্ছে না মা? পাচ্ছে না মা?’ দিদির রকম সকম দেখে মা সত্যিই হেসে ফেলেছিলেন সেদিন। মাকে হাসতে দেখে দিদি বলেছিল, ‘মুক্তকচ্ছ কথা মনে পড়লে আমার এই লোকটার মুখই মনে পড়ে মা। আর তখন আমার হাসি পায়।’ মা বলেছিলেন, ‘এটা অন্য ব্যাপার।’ দিদি এমন ট্যাটন ছিল যে, তক্ষুনি একেবারে নিপাট ভালমানুষের মতো মুখ করে মাকে বলল, ‘দ্যাখ মা, কিছু মনে কর না, তোমার শ্বশুরদের উচিত ছিল অন্য একটা গ্রামে বাড়ি করা।’ মা খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলেন, ‘কেন, এই গ্রামটা কি দোষ করল।’ দিদি বলেছিল, ‘তুমি কখনও শ্বশুরের ভিটে দেখেছ?’ মা বলেছিলেন, ‘না।’ দিদি বলল, ‘তাই বল, নিজে চোখে যদি দেখতে, তাহলে ব্যাপারটা বুঝতে পারতে। ও গ্রামে যারা থাকে তারা পারতপক্ষে গ্রামের নাম কালিকচ্ছ বলে না।’ মা বিস্মিত হয়েছিলেন। ‘কেন?’ দিদি মুখখানাকে যত নিরীহ করে তোলা সম্ভব সেটা করে বলেছিল, ‘কালিকচ্ছের সঙ্গে যে মুক্তকচ্ছের খুব মিল মা।’ বলেই খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল। ফলে ফুলকিকে কান মলা খেতে হয়েছিল।

কিন্তু সিরাজগঞ্জ নামটাতেই একটা জাদু। কত জনের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সিরাজগঞ্জ। ‘সিরাজগঞ্জ তো একটা জায়গামাত্র নয়, সিরাজগঞ্জ আমাদের কাছে একটা যুগ। স্বর্ণযুগ বলতে পার তাকে মা, আবার স্বপ্নের যুগও বলতে পার।’ মেডিকেল কলেজের পেয়িং ওয়ার্ডে শুয়ে শুয়ে তায়েব কাকা বলেছিলেন কথাগুলো। ‘স্বর্ণযুগ বলছি কেন, জানো মা, ওই একবারই বাংলার মুসলমান বাংলার এক হিন্দু লিডারের পিছনে কাতার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেশবন্ধুর ত্যাগ, তাঁর বিচক্ষণতা, তাঁর দূরদর্শিতা, তাঁর ব্যক্তিত্ব, তাঁর উদারতা দেশবন্ধুকে বাংলার অবিসংবাদী নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। আর সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীতেই দেশবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন দীপ্ত ভাস্কর।’ তায়েব কাকা শ্রান্তিতে চোখ বুজে ফেললেন।

বাবা, হরিকিশোরমেসো আর তায়েবকাকা যেখানে জমায়েত হতেন, আমরা সেটাকেই সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী নাম দিতাম। এই তিন বন্ধু ছিলেন হরিহর আত্মা। বাবার অতীত জীবনের কথা ফুলকি তায়েবকাকা আর হরিকিশোরমেসোর মুখ থেকেই শুনেছে। বাবা, ৪৯ সালে মারা যাবার পর সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীরও আয়ু ফুরিয়ে যায়। হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘তোদের ক্ষতির তো কোনও হিসেবই হবে না, কিন্তু সুধাকর হঠাৎ মারা গিয়ে আমার আর তায়েবের যে পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে গেল, সেই ক্ষতি আমরা সামলাব কি করে ফুলকি।’ হরিকিশোরমেসো কাঁদছিলেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। বুড়োমানুষরা চোখের উপর কাঁদছে, এই দৃশ্য বড় হৃদয় বিদারক। হরিকিশোরমেসোর কাছে অমিতা যাতায়াত রেখেছিল তার মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু তায়েবকাকা যে কেমন করে কবে তাঁদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলেন, সে খবর ভাল করে মনে করতে পারে না অমিতা। হরিকিশোরমেসোও এর জন্য বড় কষ্ট পেতেন। বলতেন, শেষ যেবার ওকে দেখি, হাইকোর্টে এসেছিল। প্র্যাকটিশ তো মন দিয়ে করেনি। তবুও বারে নাম ছিল ওর। আসলে ওকে সবাই সমীহ করত। আমাকে বলল, হরিকিশোর, ভাবছি, বৈঠকখানার বাসাটা তুলেই দেব। কি হবে আর ওই বখেড়া রেখে। কেউ তো থাকল না। ওয়াহেদ করাচি চলে গেল। আমাকে বার বার চিঠি লেখে, আব্বু তুমি কলকাতায় আর কেন পড়ে আছো? আরে, কেন পড়ে আছ? এ কথার কি জবাব হয়। আমার দেশ ছেড়ে এই বুড়ো বয়সে আমি কোথায় যাব? বসির লন্ডনে গিয়ে ডাক্তারি জমিয়েছে। সে ফিরবে না। হাসনুর বরও তাকে নিয়ে ঢাকায় আছে এখন। বৈঠকখানার বাসা আমার খাঁ খাঁ। ওয়াহেদের মা মারা গেলেন। তবু এক রকম করে চলছিলাম। তুমি আছ সুধাকর ছিল। তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে, এই ছিল আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সুখ হে হরিকিশোর।

কোথায় আর যাবে তায়েব, এই বয়সে? বৈঠকখানার ওই বাসা ছাড়া তুমি তো থাকতেও পারবে না কোথাও গিয়ে? কোথায় যাবে?’

‘রাধানগর চলে যাব ভাবছি হরি, বাপ দাদার কবর আছে। ওখানেই থাকব। ওখানে বিঘে কয়েক জমি আছে পৈতৃক। ভাবছি গ্রামে ফিরে একটা পাঠশালা খুলব। একটা কিছু নিয়ে থাকতে তো হবে, যতদিন না ওপারে যেতে হয়।’

‘আইডিয়াটা ভাল তায়েব। কিন্তু তুমি চিরকাল কলকাতায় বাস করে এলে, তুমি গ্রামের জীবনে এই শেষ বয়সে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে কি? ভাল করে ভেবে দেখেছ?’

‘তুমি বল কি হরিকিশোর? কত লিডার কত সাব লিডার বিদ্বান বুদ্ধিমান, সব ব্যক্তিরা, দেশ ভাগ হল আর পিলপিল করে এ পারের লোক ওপারে চলে গেল, ওপারের লোক এ পারে চলে এল। যারা পরস্পরের ভাষা বোঝে না, ভাব বোঝে না, তারা সব পিলপিল করে চলে গেল। আর আমি আমার গ্রামে, যে গ্রামে আমার বাপ দাদার গোর রয়েছে, সেই গ্রামে গিয়ে অ্যাডজাস্ট করতে পারব না! আচ্ছা হরি, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি তো, একা একা আর উত্তর খুঁজে পাইনে। বল তো হরিকিশোর, দেশটা কি পিঁপড়ের বাসা? দেশ ভাগ হল যেন পিঁপড়ের বাসা ভেঙে দু টুকরো হল। আর মানুষগুলো কোনও কিছু ভাবল না, চিন্তা করল না, বাসা ভেঙে যাওয়া পিঁপড়ের মতো পিলপিল করে যে যেদিকে পারল, ছটকে ছিটকে গেল! কোনও মানে খুঁজে পাও এর? দেশটা তাহলে কি, হরিকিশোর?

হরিকিশোরমেসো বলেছিলেন, ‘সেই আমার সঙ্গে তায়েবের শেষ দেখা।’ হরিকিশোরমেসো কথা বলেন এত সুন্দর; সব যেন চোখের উপর ফুটে ওঠে। ওয়াহেদ ছিল দিদির চেয়ে সামান্য কিছু বড়। হাসনু ছিল অমিতার বয়সী। হাসনু যখন মাঝে মধ্যে তাদের বৈঠকখানার বাসা থেকে তায়েবকাকার সঙ্গে তাদের ডালিমতলার বাড়িতে আসত, তখন ফুলকি তাকে সটান নিয়ে যেত তার খেলাঘরে। বসির ছোটবেলায় ছিল বেজায় ছিচকাঁদুনে। আর সেই জন্যই বসিরের সঙ্গেই ওর আর হাসমুর যত ঝগড়া শুরু হত। ইদের নেমতন্ন খেতে গিয়েছে তায়েবকাকার বাড়িতে। কাকিমা সিমায়ের পায়েস যে বাটিতে আমাকে কি হাসনুকে দিতেন, সেই বাটিটাই বসিরের চাই। না হলেই কান্না। ফুলকিই বা তার অধিকার ছাড়বে কেন? এই নিয়ে বসিরের হয় ফুলকির সঙ্গে না হয় হাসর সঙ্গে লাঠালাঠি বেঁধে যেত। ওরা যখন সেবক বৈদ্যতে উঠে গেল তখন বসির বেশ খানিকটা বড় হয়েছে। তবু ওর খুনসুটি একটুও কমেনি। ফুলকি একবার বসিরকে পায়েস বলে থকথকে মুগের ডাল খাইয়ে দিয়েছিল। ওটা এতই হাঁদা ছিল যে, ডাল আর পায়েসের তফাৎ বুঝতে পারত না। তারপর হাসনু ওকে খেপাতে শুরু করল, ‘খালা দেখ, তোমাদের ঘরে একটা ছাগল ঢুকেছে, ও খালা দেখে যাও।’ মা আর জহুরা কাকিমা ঘরে ঢুকে বললেন, ‘কোথায় ছাগল।’ হাসনু ওর কড়ে আঙুলটা বসিরের দিকে দেখিয়ে বলল, ‘ওই তো দাঁড়িয়ে পায়েস বলে ডাল চাটছে। ছাগল পায়েসও চেনে না, ডালও চেনে না। খালি চেটেই যায়।’ অমনি বসির চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল। আর হাসনুকে মারতে ছুটল। হাসনু খালা বলে ফুলকির মাকে জড়িয়ে ধরল। সকলের কি হাসাহাসি!

তায়েবকাকা। এক পাশে বাবা আর এক পাশে হরিকিশোরমেসো। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর ইতিহাস একটু একটু করে সংগ্রহ করেছিল ফুলকি। কারণ এক সময়ে এটা ফুলকির একটা অবসেশন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই কাহিনীর অনেকটাই অমিতা শুনেছে হরিকিশোরমেসোর মুখ থেকে। আর বাকিটা শুনেছে তায়েবকাকার মুখ থেকে। যখন তায়েবকাকার স্মৃতি প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে, প্রায় এই ছবিটার মতোই, তখন আকস্মিকভাবে অমিতা তায়েবকাকার সন্ধান পায়। অমিতা ভেবেই নিয়েছিল তায়েবকাকা বেঁচে নেই। না হলে এদেশে অন্তত নেই।

৫৮ সালের গোড়ার দিকে অমিতা দার্জিলিং থেকে সবে ফিরেছে। সে তখন স্পেশাল অফিসার। এবার রাইটার্সে এসে বসেছে। নমিতা তখন বিলাত যাবার তোড়জোড় করছে। পুরোপুরি ডাক্তার হয়ে উঠেছে তখন নমিতা। নমিতাই একদিন দুপুরে ফোন করল রাইটার্সে। ‘দিদি তায়েবকাকাকে তোর মনে আছে?’

‘তায়েবকাকা? ও হ্যাঁ। কোথায় তায়েবকাকা?’

‘মেডিক্যাল কলেজে। তুই এখন চলে আসতে পারবি? মোতি শীল ব্লকে চলে আয়। দোতলায়। বেড ১৮। আমি থাকব।

অমিতা তায়েবকাকাকে দেখে চিনতে পারেনি প্রথমে। ও রকম বলিষ্ঠ দেহটা বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। নাকে ড্রিপ চলেছে।

নমিতা বলেছিল, ‘আমি প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম।.কাজ শেষ করে মনে হল, যাই কৌশিকের সঙ্গে দেখা করি। শুনলাম ওর আউটডোর। আউটডোরে ঢুকছি। দেখছি, কেমন মনে হল তায়েবকাকা রোগীদের ভিড়ের মধ্যে বসে রয়েছেন। এই রকম অবস্থা। আমিও প্রথমে চিনতে পারিনি। আমি তো বেশী দেখিনি না? তবু আমার কেমন মনে হল লোকটি আমাদের চেনা। ঘরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে হল, বিশ্বাস কর দিদি, আমার কেমন মনে হল এই আমাদের তায়েবকাকা। আমি কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সাড়া শব্দ বিশেষ দিচ্ছিলেন না। কেমন যেন আচ্ছন্ন ভাব। ঘোলা চোখ দুটো তুলে আমার মুখের দিকে চাইলেন। হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বিড়বিড় করে বললেন, তুমি তো ফুলকি? সুধাকরের মেয়ে। তারপর বিড়বিড় করে আবোলতাবোল বকতে লাগলেন। ভাগ্যিস কৌশিক ছিল তখনও, ওকে ধরে এমার্জেন্সি কেস হিসাবে ভর্তি করালাম।’

চুমকি, ফ্রি বেডের অবস্থা তো দেখছিস। পেয়িংয়ে ভর্তি করা যায় কি না দ্যাখ। ‘বেড় একটা আছে! সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বলে সেখানে ভর্তি করা যায়। কৌশিক বলল, তোকে বলতে। বলল, পারলে তোমার দিদিই পারবে। তোমার দিদি সরকারি অফিসার, উপরে ওর ক্যাচ্ আছে।’

অমিতারও ক্যাচ্ আছে, এই প্রথম শুনল অমিতা। ডেপুটি হেল্‌থ্ সেক্রেটারিকে অবশ্য বলা যায়। চেনা আছে। সুপারিন্টেন্ডেন্টের ঘরে গিয়েছিল অমিতা। হঠাৎ কি মনে হল, অমিতা হরিকিশোর মেসোকে ফোন করল। বুলি মাসি এসে ফোন ধরলেন। ফুলকি তায়েবকাকার কথা বলতেই বুলি মাসি বলল, ‘তুই ধর ফুলকি। আমি ওঁকে ডাকি।’ হরিকিশোরমেসো শুনেই বললেন, ‘তুমি ব্রজকিশোর না যাওয়া পর্যন্ত মেডিকেল কলেজেই অপেক্ষা করো। আমি ওকে খবর দিচ্ছি। পেয়িং বেড টেড নয় ফুলকি, তায়েবের জন্য বেস্ট ট্রিটমেন্ট চাই। তুমি বলছ, ওর অবস্থা সুবিধের নয়। আমি ওকে ভ্যাগাবন্ডের মতো মরতে দিতে চাইনে। ইউ ওয়েট। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রজকিশোর হাইকোর্ট থেকে সটান চলে এল। কৌশিকের সঙ্গে ওরা পরামর্শ করল। কৌশিক বলল, ‘বেস্ট ট্রিটমেন্ট অন্তত এখন যা দরকার, সেটা মেডিকেল কলেজেই পাওয়া যাবে। ওকে আপনারা কেবিনে দেবার ব্যবস্থা করুন।’ ফুলকি আর ব্রজকিশোর কেবিনের ব্যবস্থা করে ফেলল। তায়েবকাকার জন্য দুবেলা নার্সের ব্যবস্থাও হল। কৌশিক নাকি চুমকিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি ব্যাপার বল তো? লোকটা কে? কোনও ভি আই পি, না ফ্রিডম ফাইটার? হাইকোর্ট থেকে ব্যারিস্টার বি কে রায় এসে তদবির করছেন। কেসটা কি? চুমকি বলেছিল, আমাদের পরমাত্মীয়।

পরমাত্মীয়! তায়েবকাকা। পরমাত্মীয়। ভালই বলেছিল চুমকি। অথচ কতটুকু জানে চুমকি তায়েবকাকার। প্রায় কিছুই জানে না তো। তবুও চুমকিই তায়েবকাকাকে খুঁজে বার করল। কি করে বুঝল চুমকি যে, এই তাদের তায়েবকাকা? সত্যি বলতে কি, যে চেহারা হয়েছিল তায়েবকাকার, পথে দেখলে ফুলকি কি তাঁকে চিনতে পারত? নিশ্চয় করে বলতে পারে না ফুলকি। আবার ওইদিনই চুমকি মেডিকেল কলেজে গিয়েছিল তার কাজে। আউটডোরে গিয়েছিল কৌশিকের সঙ্গে দেখা করতে। পরপর ঘটনাগুলো কেমন ঘটে গেল। যেন এই রকমই হবে এটা স্থির ছিল। একটু এদিক ওদিক হলেই তায়েবকাকার সঙ্গে তাদের আর জন্মেও দেখা হত না। তায়েবকাকা শামিমকে খুব ভালবাসতেন। একদিন বলেছিলেন, ‘ইসলাম বিপন্ন হবার ধুয়ো তুলে বাংলার মুসলিম নেতারা যেভাবে দিন দিন নতুন করে তেড়ে ফুঁড়ে মুসলমান হতে শুরু করেছেন, ভাষাটাকে পর্যন্ত হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ করে ফেলতে চাইছেন, তাতে ভয় হয় শামিম, কাকাতুয়াকে আর বেশি দিন বোধ হয় কাকাতুয়া বলতে দেবেন না ওঁরা। এর পর তাকে চাচাতুয়া বলতে হবে।’ কাকাতুয়াকে চাচাতুয়া বলতে হবে, তায়েবকাকার এই কথা শুনে অমিতার খুব হাসি পেয়েছিল সেদিন। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী। এঁরা সব সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর স্পিরিট। তায়েবকাকা, বাবা, হরিকিশোরমেসো। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী বলতে এঁদের কথাই মনে ভাসে ফুলকির। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী বলতে ফুলকি কতকগুলো নাম আওড়াতে থাকে। সেই জন্মে ইস্তক যে নামগুলো তাদের বাড়িতে কথায় কথায় উচ্চারিত হতে শুনেছে। এখন সে কথাগুলো আর কারও মুখেই শুনতে পায় না ফুলকি। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী বলতেই ফুলকি বোঝে দাশ সাহেব সি আর দাশ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন। সিরাজগঞ্জ সম্মিলনী মানে বেংগল প্যাকট্। স্বরাজ্য দল। হিন্দু মুসলিম ঐক্য।

১৬

অমিতার ঝিমুনি আসছিল। মন্টুর মা চা এনে দিল। ‘সারাক্ষণ ছবির দিকে চেয়ে চেয়েই কাটিয়ে দিলে মা। একটুকুনি বিশ্রাম, তাও লিলে না। কি দেখছ মা ওই ছবিটা ধরে ধরে।’

বিড়বিড় করে ফুলকি বলল, বাবা, তায়েবকাকা, হরিকিশোরমেসো।

‘চা আবার ঠাণ্ডা করে ফেলনি মা। জুইড়ে যাবে গো। আমি ছাতে যাচ্ছি। তোষক চাদর বালিশ সবই তো ছাতে পড়ে আছে। যাই নে আসি গিয়ে।’

ফুলকি এখন সম্পূর্ণ স্বপ্নের তলায় ডুব মেরেছে। ‘সুধাকর ছিল সেদিনের সেই সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীতে তরুণ দলের স্পিরিট। আর তায়েব। ওরা দুজনে বুক দিয়ে না খাটলে সিরাজগঞ্জে দাশ সাহেবকে মুশকিলে পড়তে হত ফুলকি।’ হরিকিশোরমেসো তার বাবার মৃত্যুর পর একদিন বলেছিলেন।

তায়েবকাকার বৈঠকখানার বাড়িতে একবার ইদের নেমন্তন্নে হাসনু আর ফুলকি মিছিল বার করেছিল। তায়েবকাকার বাড়ির উঠোনেই সেই মিছিলটা ঘুরপাক খাচ্ছিল। আর আওয়াজ উঠছিল দুটো কচি কন্ঠ থেকে। হিন্দু মুসলমান এক মায়ের দুই সন্তান। ভাই ভাই এক ঠাঁই নইলে আর রক্ষা নাই। মাঝে মাঝে বাগড়া দিচ্ছিল ছিঁচকাঁদুনে বসিরটা। মহা দুষ্টু ছিল। হাসনু আর ফুলকি তখন কত বড়? ছ সাত বছর হবে। হাসনুর এখনকার মুখটা মনে করতে পারবে না ফুলকি। কিন্তু সেদিনের সেই হাসনুর মুখটা পরিষ্কার ভেসে উঠল তার মনে। অবশ্য যে মুখটা ভেসে উঠল, সেই মুখটাই হাসনুর, এখন আর ঠিক করে বলতে পারে না ফুলকি। তবে যে মুখটা তার মনে ভেসে উঠল সেটা একটা ছ সাত বছরের মেয়ের উজ্জ্বল মুখ। ড্যাবাড্যাবা চোখ। তার কানে মাকড়ি চিকচিক করছে। এ মুখ যদি হাসনুর না হয়, তবে আর কার হবে?

হঠাৎ অমিতার চায়ের পেয়ালার উপর নজর পড়ল। মন্টুর মা চা রেখে গেল কখন? একটু বলে যাবে তো? এই জন্যই মন্টুর মার উপর রাগ হয়ে যায় অমিতার। অমিতা পেয়ালাটা মুখে তুলে চায়ে চুমুক দিল। কত কথা মনে আছে অমিতার? কত লোকের মুখ মনে আছে? বসির সেদিন ওদের মিছিলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিল না বলে ফোঁত ফোঁত করে কাঁদছিল। আর চিৎকার করে নালিশ জানাচ্ছিল। ‘মা আমাকে মিছিলে ঢুকতে দিচ্ছে না।’ কাকিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কিসের মিছিল হাঁ বাপ?’ বসির বলেছিল, ‘হিননু মুছলিম এক্কার মিছিল।’ হাসনু বেজায় রেগে গিয়েছিল। ‘এই হতভাগা ছেলে, এটা হিন্দু মুসলিম এক্কার মিছিল? এক্কার মিছিল? কথা বলতে শেখনি আবার মিছিলে ঢোকার শখ। যা তুই তাহলে ওই এক্কার মিছিলেই যা।’ কাকিমা বলেছিলেন, ‘আহ্ হা ভাই তো ছোট। ও ওই কথা বললে দোষ নেই। ওকে সঙ্গে নিয়ে খেল হাসনু।’ হাসনু বলেছিল, ‘আমরা ঐক্যের মিছিল করছি, আর ও বলছে এক্কার মিছিল। তুমি বলছ ওকে মিছিলে নিচ্ছি। তবে ওকে তাজটা দিতে বল ফুলকিকে। ফুলকি কতক্ষণ ধরে ভাইকে সাধছে, তাজটা একটিবার ওকে দিতে। ফুলকি মুসলমান হবে, আমি হব হিন্দু। তারপর আমরা দুজনে ইদের নামাজ পড়ব। এত করে সাধলাম। একবারও কি দিল!’ বসির ফুলকির মুসলমান হবার শখটা মিটিয়ে ছিল কি না, আজ এতদিন পরে সেটা আর মনে করতে পারে না।

অমিতা এক মনে চা খেতে লাগল। মন্টুর মা লেপ তোষকের ডাঁই নিয়ে ঘরে ঢুকল। ‘আজকাল হেঁপিয়ে যাই মা গো।’ মন্টুর মা চৌকির উপর বোঝা নামিয়ে সত্যিই হাঁফাতে লাগল। ‘শরীলের জুত সব চলে যেতে বসেছে।’

তুমি চা খেয়েছ মন্টুর মা?

‘আরেকটা ডাঁই এখনও ছাতে আছে মা, যাই সেটা লিয়ে আসি। তারপর চা খাব।

তায়েবকাকার সঙ্গে মেডিকেল কলেজে যখন দেখা হল অমিতার তখন ওর জীবনে দারুণ দুঃসময় যাচ্ছে। সমীরেন্দ্রের সঙ্গে তার ডাইভোর্স হয়ে গিয়েছে। খোকাকে নিয়ে সে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। যোগমায়া কলেজ ছেড়ে সরকারি দফতরে যোগ দিয়েছে অমিতা। ওর দার্জিলিং-এর পোস্টিং শেষ করে সে রাইটার্সে ফিরে এসেছে। যোগী পিছন পিছন ঘুরছে। আর থেকে থেকে নীল খামে পদ্য লিখে পাঠাচ্ছে। এখন সবটাই মনে হয় কেমন রিডিকিউলাস। কোনও কিছুতেই মন বসাতে পারছে না অমিতা। সব কিছুই তার কাছে যেন আলুনি। অমিতার জীবনের মূল শিকড়টাই তখন ছিঁড়ে গিয়েছিল। সে শুধু ভেসে বেড়াচ্ছিল। সে তখন একটা আশ্রয় চাইছিল। সে আশ্ৰয়টা কি স্নেহের আশ্রয়? অমিতা কি তার বাবাকেই তখন খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তাই কি তায়েবকাকাকে পেয়ে সে বর্তে গিয়েছিল? চাকরিটা বাঁচিয়ে যতটুকু সময় পেয়েছে অমিতা, সব সময়টুকু সে ঢেলে দিয়েছিল তায়েবকাকার তদারকিতে। ভ্যাবলও দেখাশুনো করেছে খুব। প্রথম দিকে রোজই সে কোর্ট ফেরতা আসত মেডিকেল কলেজে। তায়েবকাকার কেবিন সত্যি সত্যিই অমিতার আশ্রয় হয়ে উঠেছিল। সে কতদিন ভেবেছে ওয়াহেদকে চিঠি দিয়ে জানাবে তায়েবকাকার খবরটা। কি বসিরকে চিঠি লিখবে। হাসনুর কথাও মনে পড়েছে অমিতার। কিন্তু দেশভাগের পর কে যে কোথায় আছে তার ঠিকানা তো জানত না। তায়েবকাকাকেও জিজ্ঞাসা করতে মন উঠত না। তার কোন্ ব্যথার জায়গায় হাত দিয়ে ফেলে ফুলকি, তো ঠিক নেই। যোগীশ্বর আবার এই সময়ে তার পায়ে পায়ে ঘুরতে শুরু করেছে। যোগমায়াতে থাকতেই অমিতা বুঝে গিয়েছিল যে, যোগী তার দিকে ঢলেছেন। তখন সত্যি বলতে কি ভালই লাগত যোগীকে। তার নিঃসঙ্গ জীবনে, বলা ভাল বিপর্যস্ত জীবনে, একটা পুরুষ তাকে মূল্য দিচ্ছে, এই ভাবনাটা মেয়েদের কাছে কত মূল্যবান, অমিতার অবস্থায় যে পড়েনি তার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব নয়। যোগীর বাড়াবাড়িতে অমিতা বিব্রত বোধ করত। কিন্তু সে এটাও দেখেছিল যোগীর সঙ্গ ধীরে ধীরে তার পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠছিল। যোগীকে বিয়ে করবে অমিতা, এ কথা সে তখন স্বপ্নেও ভাবেনি। অমিতা তখন দুর্ভাগ্যের নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সে প্রাণপণে কুলে ভিড়তে চাইছিল। সেই খরস্রোতে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে যেতে সে অতিশয় শ্রান্ত হয়ে পড়ছিল। সে একটা শক্ত কিছু আঁকড়ে ধরে তীরে উঠতে চাইছিল। কখনও অমিতার মনে হয়েছিল, যোগীই বুঝি সেই শক্ত শিকড়। কিন্তু তার মন সায় দিচ্ছিল না। তায়েবকাকাকে এই সময় পেয়ে বেঁচে গেল অমিতা। সে বুঝতে পারল যোগীকে নয়, আসলে সে তার বাবাকেই খুঁজছিল। মেয়েদের জীবনে বাবাই হচ্ছে প্রথম পুরুষ। নিরাপদ আশ্রয়। দিদির কাছে বাবার গুরুত্ব এতটাই ছিল কিনা অমিতা জানে না। কিন্তু অমিতা তো দিদি নয়, অমিতা অমিতাই। বাবা আমার বাবা। তার বাবা ভোগেনি একটুও। রাতে বুকে ব্যথা উঠল, দুমিনিটেই শেষ। কাছে কেউ ছিল না। নমিতা তখন হস্টেলে। অমিতা সমীরেন্দ্রের সঙ্গে ঘর করছে। সকালে খবর পেতেই, ভ্যাবলই গাড়ি নিয়ে এসেছিল, গিয়ে দেখে বাবা নেই। তায়েবকাকাকে তার বাবা বলে মনে হয়েছিল। যেমন মাঝে মাঝে হরিকিশোরমেসোকে তার বাবা বলে মনে হয়।

কৌশিকই তায়েবকাকাকে শেষ পর্যন্ত চাঙ্গা করে তুলেছিল। দুমাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল তায়েবকাকাকে। হরিকিশোরমেসো তার খারাপ শরীর নিয়েও বেশীর ভাগ দিনই দেখতে আসতেন তাঁকে। ওঁদের দুজনের মুখে বাবার কথা শুনতে ভালই বাসত অমিতা। সে অনেক জিনিস জেনেছিল তায়েবকাকা আর হরিকিশোরমেসোর মুখ থেকে সেই মেডিকেল কলেজের কেবিনে। ‘সুধাকর আর তুমি, তোমরা দুজন না থাকলে সিরাজগঞ্জের সম্মিলনী পণ্ড হয়ে যেত তায়েব।’

‘আরও একজনের নাম আমাদের করা উচিত। মনসুর। বলতে কি মনসুরই শেষ পর্যন্ত সিরাজি সাহেবকে বাগে আনতে পেরেছিল। সিরাজি সাহেব যে রকম শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেছিলেন, তিনি বিরোধিতা করলে সিরাজগঞ্জ কনফারেন্স পয়মাল হয়ে যেত। একদিকে আঞ্জুমানে মুসলিমদের বিরোধিতা আর একদিকে কংগ্রেসের হিন্দু মাইন্ডেড নেতাদের বিরোধিতা। তারমধ্যে যার উপর ভরসা করে সিরাজগঞ্জে কনফারেন্স ডাকা হল সেই সিরাজি সাহেবই বিগড়ে গেলেন। বোঝ ঠ্যালা! সিরাজি সাহেবকে তুমি কি মনে করতে পার?’

‘মওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজি। নিজেকে সদা সর্বদা সৈয়দের পোলা বলে জাহির করতেন না তিনি?

‘আরে ওটা ছিল ওর ফ্যাড।’

‘যেদিন সিরাজগঞ্জের কনফারেন্স শেষ হল, সেদিন ওঁর বাড়িতে বিরাট ভোজ খেয়েছিলাম। মনে আছে তায়েব? সুধাকরকে দেখে বলেছিলেন, আপনে যে সাচ্চা ব্রাহ্মণ তা আপনার চেহারাতেই মালুম হয়। সাচ্চা ব্রাহ্মণের মুখ দিয়া আগুণ বাইর হয়, এ আমি বিশ্বাস করি। ক্যান্ জানেন? সুধাকর বলেছিল, সে জানে না। সিরাজি সাহেব দুঃখিত হয়েছিলেন সুধাকরের কথা শুনে। আজকালের যুগই হইছে অ্যামুন। ব্রাহ্মণ তার খানদান ভুইলা গেছে। আমি কিন্তু আমার খানদান ভুলি নাই। আমি হইলাম সাচ্চা সৈয়দের পোলা। ব্রাহ্মণের মুখ দিয়া যেমন আগুন বাইর হয়, তেমনি সাচ্চা সৈয়দের হাত আগুনে পোড়ে না। দ্যাখবেন নাকি পরখ কইরা? আখার থিকা আপনে একটা জ্বলন্ত কাঠের টুকরা আমার হাতের উপরে রাখেন, যতক্ষণ কইবেন, আমি সেই আগুন হাতে ধইরা রাখুম। আমার হাত একটুকুও পুড়ব না। হরিকিশোর বললেন, লোকটাকে আমার অদ্ভুত লেগেছিল। বোধ হয় তিনি এই কথাতে বিশ্বাসও রাখতেন।’

‘মনসুর আমাকে টিপে দিয়েছিল, আমরা যেন ওঁর কোনও কথার বিরোধিতা না করি। খুবই মেজাজি লোক ছিলেন সিরাজি সাহেব। দাশ সাহেবকে দেবতার মতো ভক্তি করতেন। সি আর দাশকে সিরাজগঞ্জ কনফারেন্সে যে না দেখেছে, সে তাঁর মহিমা কখনও উপলব্ধি করতে পারবে না। আমি গান্ধীকে দেখেছি, মতিলাল নেহরুকে দেখেছি জিন্নাকেও দেখেছি হরিকিশোর। খুব কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু দাশের মতো নেতা এ জীবনে দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। মরবার আগে উনি যেন সূর্যের মতো জ্বলে উঠেছিলেন। উনি ছিলেন কথারও মানুষ হরিকিশোর। তাই বাংলার মুসলমানও ওকে দেশবন্ধু বলে মেনে নিতে দ্বিধা করেনি। আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, সিরাজগঞ্জের সেই প্যান্ডেলটা। ডেলিগেটে একেবারে গিজগিজ করছে। এতবড় কনফারেন্স তখন আর হয়নি। পনের শ ডেলিগেটই এসেছিল। লোক জমেছিল হাজার পনের। দেশবন্ধু মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলছেন, হিন্দুরা যদি উদারতার দ্বারা মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে না পারে, তবে হিন্দু মুসলিম ঐক্য আসবে না। যদি আমরা হিন্দু মুসলমান ঐক্য গড়ে তুলতে না পারি তবে আমাদের স্বরাজের দাবি কল্পনার সৌধই থেকে যাবে। স্বরাজ আসবে না। মনে আছে তোমার হরিকিশোর? শ্রোতাদের মুহূর্মুহু করতালিতে বজ্রের আওয়াজ ধ্বনিত হচ্ছে। দেশবন্ধুর মুখে গোধূলির আলো এসে পড়েছে। লাল টকটক করছে সেই মুখ। মুখ নয় যেন একটা অগ্নির গোলক হরিকিশোর। ওই অগ্নিময় ব্যক্তিটিকে সেদিন সমবেত শ্রোতৃবৃন্দ, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানেরা, ফেরেস্তা বলেই ধরে নিয়েছিল।’

‘মনে পড়ে বইকি তায়েব। সেই বক্তৃতার পরে বেঙ্গল প্যাকটের প্রস্তাব সভায় ওঠানো মাত্র পাশ হয়ে গিয়েছিল। বিরোধিতা একজনও করেননি।

‘দাশ বলেছিলেন, হিন্দু ও মুসলমান তাদের সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র সত্তা বিলোপ করে একই সম্প্রদায়ে পরিণত হোক, আমার হিন্দু মুসলিম ঐক্যের রূপ তা নয়। ওভারে সত্তা বিসর্জন কল্পনাতীত।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘একেই আমরা সিরাজগঞ্জের স্পিরিট বলি।’

ফুলকি মেডিকেল কলেজের কেবিনে বসে বসে শুনছিল তায়েবকাকা আর হরিকিশোরমেসোর কথা। ওঁরা ডুবে গিয়েছিলেন নিজেদের মধ্যে। ‘হাওয়া উঠল দেশবন্ধু বাংলা দেশ মুসলমানদের কাছে বেচে দিয়েছেন। অন্যে পরে কা কথা, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তীর মতো ত্যাগী আজীবন নির্যাতিত নেতা, তিনিও দেশবন্ধুর উপর খড়্গা হস্ত হয়ে উঠলেন। সারভেন্ট পত্রিকায় একদিকে তিনি লিখছেন, পাঁচকড়ি বাঁড়জ্জে মশায় আরেক দিকে কলম দিয়ে তাঁর কাগজে আগুন ছোটাচ্ছেন। অমৃতবাজার পত্রিকায় ঘোষ ব্রাদার্স লিখে চলেছেন দেশবন্ধুর বিরুদ্ধে। সকলের কথাই প্রায় এক। দেশবন্ধু ভোটের রাজনীতির জন্য মুসলমানদের কাছে বাংলা দেশকে বেচে দিচ্ছেন। সুধাকর সার্ভেন্টে এক বড় চিঠি লিখেছিল সে সময়ে। মনে আছে হরিকিশোর?’ তায়েবকাকা একটু থামলেন। চোখ বুজে কিছুক্ষণ কি ভেবে নিলেন তারপর প্রায় অস্ফুটস্বরে বলতে লাগলেন, ‘সুধাকর লিখেছিল, তার মর্মটা এই ছিল : আপনারা বলছেন, দেশবন্ধু বাংলা দেশ বেচে দিচ্ছেন। কার কাছে তিনি বেচছেন? আপনারা সেটাও বলে দিয়েছেন। দেশবন্ধু মুসলমানের কাছে বাংলা দেশ বেচে দিচ্ছেন। এই মুসলমানরা কারা? কোন দেশের লোক? এরা কি বাংলা দেশের লোক নয়? বাংলা দেশের লোকের কাছে বাংলা দেশকে দেশবন্ধু যদি বেচে দিতে চান, তাতে দোষ কোথায়? আসলে আপনারা বলতে চাইছেন অন্য কথা। বাংলা দেশের মুসলমান বাংলা দেশের জনসংখ্যার মেজরিটি। শতকরা ৫৪ জনই মুসলমান। শতকরা ৪৬ জন হিন্দু। অথচ চাকরি বাকরি শিক্ষা প্রভৃতির ব্যাপারে এই গরিষ্ঠরা আজ বঞ্চিত। দেশবন্ধু এই অন্যায়ের প্রতিকার করতে এগিয়ে এসেছেন। দেশবন্ধুর প্রস্তাবিত বেঙ্গল প্যাটে দেশকে বেচে দেবার কোনও কথা নেই। যা আছে তা হল একটা বিরাট অন্যায়ের প্রতিকারের চেষ্টা। এই প্রস্তাবিত প্যাকটটি পড়ে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, সরকারি চাকরিতে মুসলমানেরা জনসংখ্যানুপাতে চাকরি পাবে। প্যাটে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এবং যতদিন ওই সংখ্যানুপাতে (শতকরা ৫৪) পৌঁছুতে পারা না যাচ্ছে ততদিন নতুন নিয়োগের শতকরা ৮০টি সরকারি চাকরি মুসলমানদের দিতে হবে। এই নীতি সরকারি চাকরি ছাড়া স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে, অর্থাৎ কলকাতা কর্পোরেশনে, সমস্ত মিউনিসিপ্যালিটিতে, ডিস্ট্রিক্ট ও লোকাল বোর্ড ইত্যাদিতেও মেনে নেওয়া হবে। এতে কি দেশকে বেচে দেওয়া হচ্ছে? না দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার মনে আস্থা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। স্বরাজ সাধনা একা হিন্দুদের কাজ বলে কি আপনারা মনে করেন? নাকি হিন্দু মুসলমানের যৌথ সাধনা স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজনই শুধু নয়, জরুরি প্রয়োজন। হিন্দু কখনও একা স্বরাজ আনতে পারবে না। মুসলমানেদের সঙ্গে নিতেই হবে। কিন্তু মুসলমানদের সঙ্গে নেবেন কি করে? চাকরি বাকরিতে ন্যায্য প্রাপ্য ওদের দেবেন না, শিক্ষাদীক্ষাতে ওদের পিছনে ফেলে রাখবেন, আর মুখে বলবেন, মুসলমান আমার ভাই, এই কথায়, শুধু শুকনো কথায় মুসলমানরা হিন্দুদের ভাই হয়ে যাবে না। তাদের বস্তুগত কিছু দিতে হবে। দেশবন্ধু কথার কথা বলছেন না। তিনি একটা বাস্তব প্রস্তাব আপনাদের সামনে উত্থাপন করছেন। আপনারা বিচার করে দেখুন। যদি সংশোধন করা প্রয়োজন মনে করেন, সেটা বলুন দেশবন্ধুকে। দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্ট্ আমাদের সামনে একটা সুযোগ এনে দিয়েছে। কুৎসা রটিয়ে সেটাকে বানচাল করে দেওয়া ঠিক হবে না।’

‘সুধাকর শুধু চিঠি লিখেই ক্ষান্ত হয়নি তায়েব। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করেছে সকলের সঙ্গে।’

তায়েবকাকা বললেন, ‘দেশবন্ধুর সঙ্গে অন্যান্য লিডারদের তফাৎ ছিল এইখানে যে, উনি যা বলতেন, সেই অনুসারে কাজও করতেন। মিটিংয়ে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিলাম আর পরমুহূর্তে সব ভুলে গেলাম, দাশ এটা করতেন না। কর্পোরেশন ইলেকশনের সময়, মনে আছে হরিকিশোর, প্রবীণ হিন্দু নেতারা, যাঁরা এমন কি কংগ্রেস করতেন, তাঁদের দেশসেবায় ফাঁকি ছিল না, সেই তাঁরাই দেশবন্ধুর বিরুদ্ধে চলে গেলেন। বললেন, দেশবন্ধু কর্পোরেশনকে মুসলমানদের হাতে বেচে দিচ্ছেন। এত বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও দেশবন্ধু গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে গেলেন। আমরা কী খেটেছিলাম বল তো হরিকিশোর? সুধাকরের বাড়ি আসা বন্ধ, নাওয়া খাওয়া বন্ধ। বছর দুই আগে বিয়ে করেছে সুধাকর। কিন্তু ঘর সংসার চুলোয় গেল। ওর ধ্যান জ্ঞান শুধু কর্পোরেশনের ইলেকশন। দেশবন্ধু দায়িত্ব দিয়েছেন। সুধাকর বলত, এই নির্বাচনে জিততে হবে তায়েব, এটাই হবে আমাদের পক্ষে ম্যানডেট।’

‘আমরা জিতেছিলাম তায়েব।’

‘দেশবন্ধু তাঁর কথা রেখেছিলেন হরিকিশোর। কর্পোরেশনের মেয়র হলেন দাশ সাহেব, ডেপুটি মেয়র করা হল শহীদ সুরাবর্দীকে। শহীদ তরুণ ব্যারিস্টার, তখন যেন একেবারে টাট্টু ঘোড়া। সুভাষকে চিহ্ন একজিকিউটিভ অফিসার করা হল। ডেপুটি একজিকিউটিভ করা হল হাজি আবদুর রসিদ সাহেবকে। আবদুর রসিদ তো বিশ্বাসই করেন নি যে, সি আর দাশ তাকে ওই পোস্টে নিয়োগ করেছেন। তাঁর চাইতেও বড় কাজ দেশবন্ধু করেছিলেন, বেশ কয়েকজন বেকার মুসলিম এম-এ বি-এ কে দাশ কর্পোরেশনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে বসিয়েছিলেন। দাশ সাহেবের এই কাজে বাংলার শিক্ষিত মুসলমান সমাজ নিজেদের উপর আস্থা ফিরে পেয়েছিল। তাদের হতাশা তাদের তিক্ততা অনেক কমে গিয়েছিল। মুসলমানের এই মন হিন্দুরা বুঝতে পারে না হরিকিশোর। দাশ বুঝেছিলেন। দাশ সাহেবের এই বাস্তব বুদ্ধিই তাঁকে বাংলার মুসলমানদেরও নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল।

‘তায়েব তোমার মনে পড়ে সেইদিনটার কথা যেদিন রেঙ্গল প্যাকটের মুসাবিদাটা সবাই মেলে নিলেন। সেদিন মৌলবি মুজিবর রহমান উঠে গিয়ে দেশবন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কি সেন্টিমেন্টাল হয়ে উঠেছিলেন মৌলবি সাহেব! বারে বারে বলছিলেন দাশ সাহেব, খোদার কাছে শোকর জানাই তিনি আপনারে দিয়া এই কাম করাইতেছেন। খোদা আপনারে শও সাল পরমায়ু দেন। বাংলার হিন্দু মুসলমানেরে এক করতে আপনিই পারবেন।

‘খুবই দিলখোলা লোক ছিলেন মুজিবর রহমান সাহেব। সেদিনের কথা ভেবে দ্যাখ হরিকিশোর, মুসলিম নেতাদের সমস্ত মাথা সেদিন দেশবন্ধুর পিছনে ছিল। সার আবদুর রহিম ছিলেন, মৌলবি আবদুল করিম ছিলেন, মৌলবি মুজিবর রহমান ছিলেন, মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন, মওলানা মনিরুজজমান ইসলামাবাদী ছিলেন। এদিকে ছিলেন, মিঃ জে এম সেনগুপ্ত, শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়, মিঃ জে এম দাশগুপ্ত, ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। বেঙ্গল প্যাকটের রচয়িতারা কেউ হেঁজিপেঁজি লোক ছিলেন না।’

‘কিন্তু কি হল বলতো তায়েব, হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপর গড়ে উঠবে একটা বলিষ্ঠ জাতীয়তাবোধ, এই স্বপ্নটাই তো আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু কি হয়ে গেল? কেন ভেস্তে গেল? কোথায় ছিল আমাদের ত্রুটি? ফুলকিরা যদি জিজ্ঞাসা করে কি জবাব তাদের দেবে তায়েব?’

সেই দুটো বুড়োর করুণ মুখ অমিতার মনে ভেসে ওঠে। ওই বুড়ো দুটো এই ছবিটার মধ্যে আছে। বুড়ো হরিকিশোরমেসো আছে, বুড়ো তায়েবকাকাও আছে। নেই কেবল একজন। তার বাবা। সুধাকর চক্রবর্তী। ছবির মধ্যে বাবা আছেন। তার যুবক বাবা। তাঁর চোখ ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে আছে! উজ্জ্বল সে দৃষ্টি। ওই বুড়োদের আড্ডায় সেদিন তিনি ছিলেন না। থাকলে ফুলকিও হয়তো জিজ্ঞাসা করত, বাবা, তুমি কি এর উত্তর জানো? হরিকিশোরমেসো তায়েবকাকাকে সেদিন মেডিকেল কলেজের কেবিনে রসে এই প্রশ্নটা করেছিলেন, হিন্দুমুসলমান ঐক্যের যে স্বপ্নটা তোমরা দেখেছিলে, সিরাজগঞ্জের কনফারেন্সে যার ভিত তোমরা স্থাপন করেছিলে বলে মনে কর, সেটা কেন ভেস্তে গেল বাবা? এর জবাব তুমি জানো? অস্পষ্ট ছবিটায় যাঁদের চেহারা ধরা আছে, অমিতা চোখের কাছে ফটোটাকে এনে তাঁদের মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল, দেখতে লাগল, দেখতে লাগল। একে একে তারা ঝাপসা হয়ে উঠছে। ক্রমেই তারা ঝাপসা হয়ে উঠছে। হঠাৎ তার মনে হল, ফটোটা থেকে যেন তার বাবার কণ্ঠস্বরটা ফুলকির কানে এসে বাজছে। ফুলকি, আমরা অতীত হয়ে গিয়েছি। এদেশের মন থেকে আমরা একেবারে মুছে গিয়েছি। তুই কেন টেনে রেখেছিস মা? তোর স্মৃতি থেকে আমাদের মুক্ত করে দে। আমরা বিস্মৃতিতে ঢুকে যাই।

১৭

তুমি কি চেয়েছিলে বাবা, আমি রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাই? আমার সম্পর্কে তুমি এমন কোনও ধারণা পুষে রেখেছিলে তোমার মনে? অমিতা সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীতে তোলা বাবার সেই গ্রুপ ফটোটা তার চোখের সামনে আবার এগিয়ে নিয়ে এল। বাবার রোগাসোগা চেহারাটার দিকে অপলক চেয়ে রইল অমিতা। যেন তার বাবার ফটোটাই প্রশ্নের উত্তর দেবে।

মন্টুর মা বিছানাটা পরিপাটি করে পেতে বলল, ‘তুমি এবার একটু শুয়ে লাও না মা? রোগা শরীল তোমার, একটানা বসে রয়েছ। একটু গইরে লাও। বেলাটাও গইরে এল।’

কথাটা এতদিন ভাল করে ভেবে দেখিনি বাবা। সেবার তায়েবকাকা মরমর অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। অনেক চেষ্টায় তাঁকে আমরা সুস্থ করে তুলি। ওঁর মুখেই আমি প্রথমে শুনি, তোমার ইচ্ছা ছিল আমি পলিটিক্‌স্ করি। তুমি নাকি প্রায়ই তায়েবকাকা আর হরিকিশোরমেসোকে বলতে, ফুলকির মধ্যেই একমাত্র ভাল রাজনীতিক হবার গুণ আছে। ফুলকি ইচ্ছে করলে সরোজিনী নাইডুর মতো হতে পারত। তায়েবকাকার কথা শুনে আমি সেদিন হেসে ফেলেছিলাম বাবা। কোথায় সরোজিনী নাইডু আর কোথায় তোমার মেয়ে ফুলকি!

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘এতে হাসবার কি আছে? সুধাকর যা বলে ভেবেচিন্তেই বলে।’ পলিটিশিয়ানদের মুখে তো খই ফোটে তায়েবকাকা। আমি পলিটিশিয়ান হব কি করে? আমার তো আবার সাত চড়েও কথা ফোটে না। সে বরং দিদি হতে পারত।

‘ঝুমরি মা একটুতেই অধৈর্য হয়ে যায় আর ওর মতামতও খুব স্ট্রং। এই ধরনের লোক দিয়ে রাজনীতি হয় না মা।’ তায়েবকাকা বলেছিলেন। ‘রাজনীতিতে যেমন চাই তেজ, আবার তেমনই চাই ঠান্ডা মাথা। মানিয়ে নেবার ক্ষমতা। সুধাকরের দৃঢ় ধারণা ছিল, তোর মধ্যে এই সব গুণই আছে। তুই অনেকটা তোর বাবার মতো। তুই যেমন নিজেকে জাহির করিসনে, তেমনি তোর উপস্থিতিকে কেউ অগ্রাহ্যও করতে পারে না।’

তায়েবকাকা কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভেবে নিলেন। ‘তুই লক্ষ করিসনি ফুলকি, তুই বড় হবার পর থেকেই আমরা বুড়োরা কেমন কারণে অকারণে তোকে ডাকাডাকি করতাম, আমাদের বৈঠকে যোগ দেবার জন্য। তোর বাবার ধারণা ছিল, এইভাবেই তোর মধ্যে রাজনীতিতে আগ্রহ জন্মে দেওয়া যাবে। আসলে তোর বাবা চাইত তার বংশে রাজনীতির ধারাটা বজায় থাকুক। তোকেই মনে মনে বেছে নিয়েছিল তোর বাবা।

‘ও মা, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে?’ মন্টুর মা এগিয়ে এসে অমিতাকে বলল, ‘এসো গো মা, তোমাকে একটু শুইয়ে দিই। সেই সকাল থেকে সারাক্ষণ বসে বসে কাটিয়ে দিলে। পিঠ কোমরটা একটু জিরিয়ে লাও।’

একটা ঘোরের মধ্যে অমিতা প্রায় গোটা দিনটাই কাটিয়ে দিল। এখন ওর শুতে ইচ্ছে করছিল। এখন নয়, অনেকবারই তার মনে হয়েছে একটু শুয়ে নিই। কিন্তু অমিতার কেমন ভয় হচ্ছিল, সে যদি ঘুমিয়ে পড়ে, তাহলে হয়ত এরা, আজ তার স্মৃতিতে এসে ঘোরাফেরা করছে, তারা সব চলে যাবে। সে পড়ে থাকবে একা একা। তবু সে মন্টুর মাকে বলল, বিছানায় তাকে তুলে দিতে।

মন্টুর মা তার গা ছুঁয়েই বলে উঠল, ‘এ কি গো মা, তোমার গা যে এখনও পুড়ে যাচ্ছে!’

নাও আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। ও তো আমার নিত্য সঙ্গী। পার তো একটু পরে আমাকে একটু হরলিক্‌স্‌ করে দিও। না না, হরলিক্‌স্ নয়, আমূলের দুধই তৈরি করে দাও।’

সত্যিই মন্টুর মা আজ আমাকে মেয়ের মতোই যত্ন করে যাচ্ছে। অমিতা ভাবল। এমন নরম বিছানায় অনেকদিন সে যেন শোয়নি। বিছানায় যে রোদের গন্ধ পেল অমিতা, হ্যাঁ, অমিতা জানে সেটা রোদেরই গন্ধ, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল, খোকা যখন বিছানা ভিজিয়ে ফেলত, কি বিন্তি, তখন অমিতাই তো তোষক লেপগুলোকে টেনে টুনে ছাতে নিয়ে যেত। বিশেষ করে খোকা তাকে খুবই ভুগিয়েছে। বেনেটোলার বাসায় লেপ তোষক নিয়ে তাকে উঠতে হত বাড়িওলার ছাতে। বাড়িওলার গিন্নি সেটা আদপেই পছন্দ করতেন না। কত অনুনয়-বিনয় করতে হয়েছে অমিতাকে। তারপর সেই রোদ-লাগা তোষক যখন শুত অমিতা খোকাকে কোলে নিয়ে, এমনই রোদের গন্ধ বিছানায় মাখামাখি হয়ে থাকত। রোদের গন্ধ ছাড়া এটাকে আর কি বলবে অমিতা। রোদের গন্ধ! ড়ানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে চিল। কতদিন পরে জীবনানন্দ দাশের কবিতার লাইনটা মনে পড়ল অমিতার। তার মানে অমিতা এখনও বেঁচে আছে!

‘রাতের জন্য কি বানাব মা? কি খাবে? কি খেতে তোমার ইচ্ছে? আই দেখ, ঘুমিয়ে পড়ল গো? সেই কখন থেকে বলছি, একটু শোও একটু শোও, তা গরিবের কতা কানেই তুললেনি। রোগা শরীলে একটানা এতক্ষণ বসে থাকার ধকল, সহ্য হবে কেন, বন, তখন তো বললে, আদিখ্যেতা। তোমার শরীলের জন্যই বলি। অ্যাখন এ দুধ কে খাবে?’

মন্টুর মা বকর বকর করতে করতে ঘরের অন্য কাজগুলো সেরে ফেলতে থাকল। কান পেতে মন্টুর মা শুনল, ফুসুর ফুসুর নাক ডাকতে লেগেছে বুড়ি। আহা আহা আহা! ঘুমাক।

সেদিন হরিকিশোরমেসো আসতে পারেননি, তাঁর শরীরটা খারাপ হয়েছিল। ভ্যাবলও না। একটা জরুরি কেসের ব্রিফ তৈরি করার কাজে ফেঁসে গিয়েছিল সে। সেদিন অমিতা আর তায়েবকাকা, এই দু’জনেই শুধু মেডিকেল কলেজের সেই কেবিনটায়। তায়েবকাকা অসুস্থ শরীর নিয়ে অমিতাকে কত কথাই না শুনিয়েছিলেন।

তায়েবকাকা বলেছিলেন, ‘ফুলকি মা, সব বাবাই চায় বংশে এমন একটা কেউ থাকুক যে, বংশের ধারাটাকে বয়ে নিয়ে যাবে।

আমার বাবাও কি তাই চাইতেন তায়েবকাকা?

‘বাহ্ চাইবে না!’

তুমি কি চেয়েছিলে তায়েবকাকা?

‘আমিও চেয়েছিলাম, হ্যাঁ, ফুলকি, এক সময় খুবই চেয়েছিলাম যে, হয় ওয়াহেদ নয় টুকলু, ওদের কেউ আমার ধারাটাকে বয়ে নিয়ে যাবে।’ তায়েবকাকা একটু থেমে একটা টানা নিঃশ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগলেন। অমিতা ফলের রস করে দিল। তায়েবকাকা আস্তে আস্তে চুমুক দিয়ে সেটা খেতে লাগলেন। ‘হাসনুও এতটা করত কিনা আমি জানিনে মা। কিন্তু তোর এই সেবাযত্ন যদি মৃত্যুর আগে সুধাকর পেয়ে যেত তবে তার আর কোনও আফসোস থাকত না। তোর দিদি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেটা সুধাকর সহ্য করে নিয়েছিল। যদিও আঘাত পেয়েছিল খুব। কিন্তু তুইওঁ একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি, এটা সুধাকর স্বপ্নেও ভাবেনি তো! এই আঘাতটা ওর মর্মে খুবই বিঁধেছিল। সুধাকর তো ধরেই নিয়েছিল, তুই তার ধারাটা বজায় রেখ্যোবি।

তায়েবকাকা, আজ ক’দিন ধরে আমি বাবাকেই ‘কেবল ভাবছি। তোমার আর হরিকিশোরমেসোর মধ্যে আমি আমার বাবাকে দেখতে পাই। তুমিই আমার বাবা তায়েবকাকা। আমি তো দেখেছি ছোটবেলায়, তুমি হাসনুকে যতটা ভালবাসতে আমাকেও ততটাই ভালবাসতে। কাকিমাও তাই। আচ্ছা তায়েবকাকা, তোমার মনে পড়ে এক ক্রিসমাসের দিন, না না, সেটা বোধ হয় ক্রিসমাসের আগের দিন, সন্ধে নাগাদ আমাদের বাড়িতে ফিটনে চেপে এসেছিলে। তারপরে সেই ফিটনে চেপে আমরা পার্ক স্ট্রিটে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। এক ফিটনে দুটো পরিবার আঁটানো কি চাড্ডিখানি কথা!

‘হ্যাঁ ফুলকি, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সে কথা। হরিকিশোররা দিল্লি না কোথায় গিয়েছিল।’

হতে পারে। আমার অত মনে নেই। আমার মনে আছে কোচোয়ান অত লোককে তার ফিটনে তুলতে চায়নি। তুমি বলেছিলে, এত লোক কোথায় দেখলে মিয়া সাহেব। তারপর তোমাকে বাবাকে আর মাকে কাকিমাকে দেখিয়ে বলেছিলে, লোক বলতে তো মোটে এই চারজন। তারপর কোচোয়ান যখন আমাকে দিদিকে চুমকিকে আর ওয়াহেদভাই হাসনু আর বসিরকে দেখিয়ে বলল, আর এরা? তখন তুমি, আমাদের সামনে অত যে গম্ভীর হয়ে থাকতে তায়েবকাকা, সেদিন বাঙালদের মতো গলা করে তুমি কোচোয়ানকে বলেছিলে, কি কইলেন মিয়া সাব, আপনে এই পোলাপানগুলারে মানুষ কইলেন, আরে এ গুলান তো বেবাক খুচরা। আনি দুয়ানি পয়সা। বসিরকে দেখিয়ে বললে, আর এইটা তো পুরো পয়সাও না। পাই। যা কইছেন কইছেন, ভাইগ্যে আপনার ঘোড়া হুনে নাই, এই আকামা কথা হুনলে আপনার ঘোড়া আর আপনারে মানুষ বইলা জ্ঞান করত না। তোমার এই কথা দিদির মনে একেবারে গিঁথে গিয়েছিল তায়েবকাকা। সে বড় হয়ে অবধি কথায় কথায় তোমার ওই বাঙাল কথা উগরে দিত। তোমার মনে পড়ে না?

‘হাঁরে বিটি, আজ তোর পাল্লায় পড়ে সে সব মনে পড়ে যাচ্ছে।’

সেদিন ওয়াহেদভাই কোচোয়ানের পাশে গিয়ে বসল তো অমনি বসির পোঁ ধরল, সেও ওখানে গিয়ে বসবে।

‘হাঁ টুকলুর ওই এক স্বভাব। চট করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারত না।’

দেখলে না, গাড়ির মধ্যেও সেদিন ও কি করছিল? তুমি বাবা মা আর কাকিমা তো একদিকে বসলে, আর দিদি আমি হাসনু চুমকি আর বসির আরেক ধারে বসলাম। বসির একবার কাকিমার কোলে গিয়ে ওদিকে বসে, আবার এদিকে এসে আমাদের সঙ্গে বসে। দিদি বলল, ওটা একটা ময়ূরপুচ্ছধারী ধেড়ে কাক। তাই শুনে বসির কান্না জুড়ে দিল।

‘হাঁ মা, টুকলু সব সময় দুটো মন নিয়ে বাস করত। এখন তার সে স্বভাব বদলেছে কিনা জানিনে। শুনেছি বিলেত গেলে লোকে মানুষ হয়।’

তায়েবকাকা হঠাৎ চুপ মেরে গেলেন। হয়ত একটানা কিছুটা উত্তেজনার মধ্যে থাকবার ফলে তার ক্লান্তি এসে গিয়েছিল। অমিতা যত্ন করে তায়েবকাকার গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। হঠাৎ সে দেখল তায়েবকাকা ফুলে ফুলে কাঁদতে শুরু করেছেন। তারপর অমিতার দিকে চেয়ে বললেন, ‘এই বুড়োটাকে একটু নিশ্চিন্ত মনে কাঁদতে দে মা। বয়স হলে আ লোক ছাড়া আর কারও সামনে কাঁদা যায় না। তোর বাপ মারা গিয়েছে, আমি কাঁদতে পারিনি, তোর কাকির এন্তেকাল হয়েছে আমি কাঁদতে পারিনি। ছেলেমেয়েরা এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, আমি কাঁদতে পারিনি। কার কাছে কাঁদব? কে বুঝবে কি বেদনা মনে পুষে এই অভিশপ্ত লোকটা জন্ম থেকে জন্মান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে? বুকটা কেবলই হা হা করে। কেন করে, কার জন্য করে, বুঝতে পারিনে। আজ তোকে পেয়ে, হরিকিশোরকে পেয়ে আমি যেন হারানিধি পেয়েছি। তাই বুকটা একটু হালকা করে নিই।’

তায়েবকাকা শুয়ে পড়লেন বিছানায়। অমিতা তার চেয়ারটাকে একেবারে বেডের কাছে টেনে গিয়েছিল সেদিন। তারপর তায়েবকাকার মাথাটাকে তার কোলের কাছে টেনে এনেছিল অমিতা। মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল যত্ন করে। অমিতার মনে হল, তার বাবা এসে তায়েবকাকার শরীরে আশ্রয় নিয়েছে তখন। কেন এমন ধারণা হল অমিতার, সে আজও তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। বাবা কি তার আদর খেতে এসেছিল! কত রাতে যখন সে অনিদ্রাগ্রস্ত, এই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে করেছে তার বাবাকে। তুমি কি সেদিন সত্যিই এসেছিলে বাবা? তুমি কি সেদিন সত্যিই ভর করেছিলে তায়েবকাকার শরীরে? না হলে তায়েবকাকার শরীরে হাত বুলোবার সময় কেন সেটাকে তোমার শরীর বলে মনে হচ্ছিল বাবা? কেন মনে হচ্ছিল!

‘তুই বললি, ফুলকি, আমাকে তোর বাবা বলে মনে হয়। তোর মধ্যে আমি আমার হাসনুকে পাচ্ছি। তুই আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিস, আমার মনে হচ্ছে যেন, আমার হাসনু মা-ই আমার গায়ে হাত বুলোচ্ছে। আসলে আমরা, আমি তোর বাবা, হরিকিশোর তো আলাদা লোক ছিলাম না। আমাদের ছিল হরিহর আত্মা। আমাদের মধ্যে হরিকিশোরকেই আমি বলব, একমাত্র তারই ভাগ্য ভাল। ব্রজকিশোর তার উত্তরাধিকার বজায় রেখে চলেছে। সুধাকর চেয়েছিল, ব্রজকিশোরকে জামাই হিসাবে পেতে। তা তোর দিদিও রাজি হল না, ব্রজকিশোরও আর বিয়ে করল না। অদ্ভুত ছেলে!’ ‘তায়েবকাকা একটু কাশলেন। ‘আচ্ছা ফুলকি মা, ব্রজকিশোর যদি হাসনুর বর হত! তাহলে কেমন হত?’

দুম করে এমন একটা প্রশ্নের মুখে পড়বে অমিতা ভাবেনি। সে যেন প্রথমটা প্রশ্নটার মানে বুঝতে পারছিল না। ভ্যাবল যদি হাসনুর বর হত! তাই তো? এ দিকটা তো স্বপ্নেও ভেবে দেখেনি অমিতা।

খুবই ভাল হত তায়েবকাকা। খুব ভাল হত। অমিতা যেন তার কৈশোরকালে ফিরে গেল এক ধাক্কায়। আশ্চর্য। আশ্চর্য! এই সম্ভাবনার কথা অমিতার কখনও মনে আসত না, তায়েবকাকা যদি না বলতেন। কেন এমন কথা তাদের মনে ওঠেনি আগে? জানো তায়েবকাকা, আমি কখনও ব্যাপারটা এদিক থেকে ভেবেই দেখিনি।

‘ব্রজকিশোরকে জামাই হিসাবে পাব, এ কথা কি আমিই কখনও ভেবে দেখেছি? হরিকিশোর যেমন সুধাকরের বন্ধু, তেমন আমারও তো বন্ধু। সত্যিই ফুলকি, লোকে আমাদের বলত থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। সি আর দাশই আমাদের এই নাম দিয়েছিলেন। আমরাও বিশ্বাস করতাম আমরা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তবু দেখ, সুধাকর যত অনায়াসে ব্রজকিশোরকে তার জামাই হিসাবে ভাবতে পেরেছিল, আমি কি তাই পারতাম? আমার মনে কেন ও কথা একবারও উঁকি মারেনি?

তায়েবকাকা অমিতার কোলে মাথা রেখে শ্রান্ত শিশুর মতো অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে শুয়ে থাকলেন।

অমিতাও তাকে তখন আর কোনও কথা জিজ্ঞাসা করল না। কিন্তু তখন অমিতার মনে অজস্র প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইছিল। আমার বাবা সুধাকরবাবুর পক্ষে যেটা সহজ ছিল, আমার কাকা তায়েবউদ্দিনের পক্ষে সেটা বলা কেন সম্ভব হল না? কেন আদৌ সম্ভব হল না! আমার বাবা, তুমি আর হরিকিশোরমেসো, তোমরা তো থ্রি মাস্কেটিয়ার্স ছিলে, ছিলে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। হরিকিশোরমেসো অনায়াসে আমার রাবাকে অথবা আমার বাবা হরিকিশোরমেসোকে অনায়াসে বলতে পারলেন, ঝুমরিকে আমি আমার ছেলের বউ করতে চাই অথবা তোমার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই। তায়েবকাকা তোমারও তো ছেলেমেয়ে ছিল, তুমিও এমন প্রস্তাব দিতে পারতে, সুধাকর তোমার মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে দিতে চাই, কি হরিকিশোর তোমার ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে দিতে চাই। বলতেও তো পারতে? হোক বা না হোক, বলে দেখতেও তো পারতে? পারতে নাকি? কেন পারনি তায়েবকাকা?

কিন্তু অমিতা এ প্রশ্নগুলোকে চেপে রাখল তার মনে। সে শুধু তায়েবকাকার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। এই লোকটা তখন অমিতার সমস্ত সত্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। করুণায় মমতায় ভালবাসায়। তায়েবকাকা যেন এক ছিন্নপক্ষ নীড়হারা পাখি তার কাছে। তায়েবকাকাকে কদিন আগেই অমিতা প্রশ্নে করেছিল, তোমরা যে বলতে তায়েবকাকা, সিরাজগঞ্জ স্পিরিট। তা সে সিরাজগঞ্জ স্পিরিটটা কি, বলবে আমাকে?

‘ফুলকি মা, সিরাজগঞ্জ স্পিরিট বলতে আমরা বুঝতাম স্বরাজ।’

তোমরা যাকে স্বরাজ বলতে, সেটা কি?

‘দেশবন্ধু গয়া কংগ্রেসে সভাপতির ভাষণে এটাকে যেভাবে বলেছিলেন আর আমরা যারা গয়া কংগ্রেসে ডেলিগেট হিসাবে বাংলা থেকে গিয়েছিলাম তারা যেভাবে বুঝেছিলাম সেটা মোটামুটি এই মা। স্বরাজ মানুষের জীবনের দীর্ঘ পথপরিক্রমা করার লক্ষ্য। স্বরাজ-চেতনা মানুষকে ব্যক্তি-মানুষ হিসাবে স্বীকৃতি দেবে। তাকে মুক্ত করবে গোষ্ঠীগত সম্প্রদায়গত যূথবদ্ধতার সংকীর্ণতা থেকে। আবার এইসব মুক্তমনা ব্যক্তিকে মেলাবে এক বৃহৎ পরিবারে। এই মেলাবার প্রেরণা মুক্ত মানুষ পাবে যুক্তিবোধ থেকে, অহিংসবোধ থেকে আর প্রগাঢ় ভালবাসার বোধ থেকে। দাশ বলেছিলেন, এটা জাতীয়তাবোধ, তবে পজিটিভ অর্থাৎ সদর্থক জাতীয়তাবোধ। এবং সেই জাতীয়তাবোধ মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করবে না। ফরাসিকে জার্মানির মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে উস্কে দেবে না। বা হিন্দুকে মুসলমানের বিরুদ্ধে কি খ্রিস্টানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রবৃত্ত করবে না।স্বরাজ হচ্ছে সেই উপলব্ধি যা মানুষকে মানুষের কাছে টেনে আনবে, মানুষেরই মূল্যে। দাশ সেই জাতীয়তাবোধের কথা বলেছেন, যে জাতীয়তাবোধে মানুষ নিজেকে খুঁজে পাবে এবং নিজেকে প্রকাশ করবে। দাশ, যতদূর মনে পড়ে, ন্যাশন্যালিজম্ কথাটাই ব্যবহার করেছিলেন। তবে আমার মনে হয়, এই ন্যাশন্যালিজমের মানে জাতীয়তাবাদ নয়, মানুষের জাতীয়তাবোধ। ন্যাশন্যালিজম কথাটা ইউরোপ থেকে আমদানি। আর ইউরোপের ন্যাশন্যালিজম বিভেদের ইতিহাস। মানুষকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করার ইতিহাস। রাষ্ট্রের নামে, ধর্মের নামে বর্ণের নামে। দাশের স্বরাজ-চেতনা ইউরোপের ন্যাশনালিজমের ভিত্তিভূমিতে গড়ে তোলা কোনও সৌধ নয়। দাশের স্বরাজ-চেতনা গড়ে উঠেছিল বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ভারতের এই গভীর উপলব্ধির ভিত্তিভূমির উপরে। ভারতই এই সত্যকে বিশ্বকে দান করেছে। দাশ বিশ্বাস করতেন, এবং আমাদের বলতেন, ডাইভারসিটি ইজ অ্যাজ রিয়াল অ্যাজ ইউনিটি। এই হল দেশবন্ধুর স্বরাজ। ১৯২২ সালে তিনি গয়া কংগ্রেসে বিশ্বের পটভূমিতে তাঁর স্বরাজ চেতনাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। যদি পারিস মা গয়া কংগ্রেসের সভাপতি সি. আর. দাশের ভাষণটা পড়ে নিস। তিনি কংগ্রেসে তাঁর কর্মসূচি পেশ করেছিলেন, তার মধ্যে ভাইসরয়ের কাউন্সিলে ঢোকার কর্মসূচিও ছিল। তাঁর কথা ছিল, ভারতে ব্রিটিশ রাজকে অব্যাহত রাখার জন্য আমরা কাউন্সিলে ঢুকব না, যা তখনকার মডারেট নেতারা করেছিলেন, আমরা ভাইসরয়ের কাউন্সিলকে হয় প্রকৃত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করব, নয় আমরা কাউন্সিল ভাঙব। তাঁর স্লোগান ছিল, আইদার মেন্ড ইট অর এন্ড ইট। কিন্তু এ প্রস্তাব কংগ্রেস গ্রহণ করেনি। তাই তিনি ১৯২৩ সালে কংগ্রেস ছাড়েন। এবং স্বরাজ্য দল গঠন করেন। সেই বছরেই বাংলার জন্য হিন্দু-মুসলিম প্যাকট রচনা করলেন। ১৯২৪ সালে জুন মাসে সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীতে সেই বেঙ্গল প্যাকট সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। বেঙ্গল প্যাকট মুসলমানদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় মা। হ্যাঁ মা, সিরাজগঞ্জেই সেই অলৌকিক কাজটা হয়। হিন্দু মুসলমান একযোগে প্যাকটের পক্ষে ভোট দেয়। রাজনীতির দিক থেকে হিন্দু-মুসলমানকে এত কাছে আর কেউ টেনে আনতে পারেননি, দাশ যেমন পেরেছিলেন সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীতে। এটার মধ্যে আমরা স্বরাজের স্পিরিটকে খুঁজে পেয়েছিলাম মা। সেটাই সিরাজগঞ্জ সম্মিলনীর স্পিরিট।’

অমিতা তায়েবকাকার মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়েছিল। তাঁর মুখের রেখার প্রতিটি কম্পন খুঁটিয়ে লক্ষ করছিল অমিতা। তায়েবকাকা মুখে যতটুকু উচ্চারণ করছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি প্রকাশ পাচ্ছিল তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে, তাঁর মুখমণ্ডলের ত্বকের প্রতিটি কুঞ্চনে। কখনও তাঁর মুখে ফুটে উঠছিল অতীত দিনের গরিমা, কখনও সেখানে ফুটে উঠছিল আশাহত এক ব্যর্থতাবোধ। কখনও তায়েবকাকার কণ্ঠে ফুটে উঠছিল অভিমান। কার প্রতি এই অভিমান.? এক বালকের হাত থেকে তার সব চাইতে প্রিয় বস্তু কেউ কেড়ে নিলে যে ধরনের অভিমান সেই বালকের মুখে চোখে ফুটে ওঠে, অবিকল সেই অভিমান। এ মুখ অমিতার খুব চেনা। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ, এ যে তার খোকার মুখ। যাকে তার বাবা নিয়ে গিয়েছে। অমিতা কিছু না ভেবেই বিছানায় ঝুঁকে পড়ে তায়েবকাকার মুখখানাকে তার বুকের মধ্যে নিয়ে এল। কী মমতাই না সঞ্চারিত হচ্ছিল তখন অমিতার দেহের প্রতিটি কোষে। কী স্নেহই না সঞ্চিত হচ্ছিল তখন অমিতার দুই স্তনে। অনেকদিন পরে অমিতার মনে হল, সে মা। কী অস্বস্তি, তার টন টন করা দুই স্তন নিয়ে অমিতার সে কি অসহায়তা। গাঢ়স্বরে অমিতা জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কেন ব্যর্থ হলে তায়েবকাকা? তোমরা এতটা এগিয়ে গিয়েও কেন মিলনের সেতুটা বাঁধতে পারলে না? সে কি তোমাদের স্বরাজ-চেতনা অলীক ছিল বলে?

‘না। না ফুলকি মা, না।’ তায়েবকাকা যেন কঁকিয়ে উঠলেন।

তোমার কি কষ্ট হচ্ছে তায়েবকাকা? তুমি এখন একটু ঘুমাও।

‘না। হাসনু না।’

অমিতা যে অসহায়তার মধ্যে, যে অস্বস্তির মধ্যে পড়েছিল, সব কিছু উপসম হয়ে গেল তায়েবকাকার আর্তস্বরে ‘না’, এই ডাক শুনে। তায়েবকাকা বোধ হয় ঝিমিয়ে পড়েছেন। সে আর কোনও কথা বলল না। শুধু তায়েবকাকার সারা শরীরে তার হাতটা বুলিয়ে দিতে লাগল। বাবা আমার বাবা। খোকা আমার খোকা।

‘না হাসনু না। স্বরাজ-চেতনা অলীক ছিল না। দেশবন্ধু বলেছিলেন, স্বরাজ জাতীয়তাবোধের স্বাভাবিক প্রকাশ। স্বরাজকে যারা সরকারের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন, তাঁরা ভুল করেন। স্বরাজ আর স্বরাজা এক জিনিস নয়। স্বরাজ অত ছোট জিনিস নয়, হাসুন।’ তায়েবকাকা বিড়বিড় করে বলতে থাকেন। একটু বোঝা দরকার। যেমন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টিশীল জাতীয়তাবোধের পরিপূর্ণ এবং অবাধ বিকাশ চাই, তেমনি জাতিগুলোর জন্য চাই ব্যক্তি-মানুষের অবাধ ও পূর্ণ বিকাশ। ব্যক্তিমানুষের অবাধ ও পূর্ণ বিকাশ না ঘটলে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটতে পারে না। ইওরোপ আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, জাতীয়তাবাদ কত মারাত্মক রূপে দেখা দিতে পারে। কত আগ্রাসী হতে পারে। কত বিধ্বংসী হতে পরে। জাতিগত অহমিকা আজ ইওরোপের মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করে ছাড়ছে। তাই দেশবন্ধু সেই গয়া কংগ্রেসেই সাবধান করে দিয়েছিলেন আমাদের। যে,ইউরোপের জাতীয়তাবাদ আমাদের আদর্শ হতে পারে না। আমাদের আদর্শ হবে স্বরাজ। আমাদের এ কথা বুঝতে হবে, প্রতিটি জাতিকে তার নিজের ক্ষমতাতেই উন্নত হতে হবে, নিজেকে চিনতে হবে, নিজেকে আপন স্বভাবে উন্মোচিত করতে হবে, তাহলেই মানবত্ব উন্নত হবে নিজেকে চিনতে পারবে এবং আপন স্বভাবে উন্মোচিত করবে নিজেকে। দেশবন্ধু বলেছিলেন, মানবসমাজকে যদি টিঁকে থাকতে হয় তাহলে বিভিন্ন জাতিগুলিকে একদিন এই উপলব্ধিতে আসতেই হবে।এ কথা একদিন সব জাতিকেই বুঝতে হবে যে, যদি তুমি তোমার প্রতিবেশীর ক্ষতি কর, তবে তোমার বিনাশও ত্বরান্বিত হবে। এ কথা যেমন বিশ্বের পক্ষে সত্য তেমনি সত্য আমার দেশের পক্ষেও। এই হচ্ছে আমাদের স্বরাজ-চেতনার মূল কথা হাসনু। না, না হাসনু, আইডিয়াল হিসাবে স্বরাজ-চেতনার কোনও ত্রুটি ছিল না। গলদ ছিল অন্য জায়গায়। সেটা তখন আমরা বুঝতে পারিনি।’

তায়েবকাকার কপাল ঘামছিল তখন। অমিতা তাঁর মাথাটা বিছানায় ঠিকমতো রেখে কপাল মুখ সব তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতে লাগল।

পাখাটা খুলে দেব বাবা?

‘না হাসনু। আমাদের কিছু কথা শোনাবার ছিল। বলবার লোক পাইনে আজকাল। কারোর সময় নেই বিটি। তোকে যদি শোনাতে চাই, শুনবি হাসনু?’

শুনব বাবা। তোমার যা বলার কথা আমাকে বলো, আমি সব শুনব। তবে এখন তুমি একটু বিশ্রাম কর বাবা।

তায়েবকাকার বুকটা তখন হাঁপরের মতো উঠছে আর নামছে। অমিতার খুব ইচ্ছে হল, তায়েবকাকার ওই উদ্বেলিত বুকের উপর তার মাথাটা ঠেকিয়ে শোয়। যেমন সে ছোটবেলায় তার বাবার বুকে মুখ ডুবিয়ে থাকত। সে আস্তে আস্তে তার মাথাটা নুইয়ে তায়েবকাকার বুকের উপর রাখল। তায়েবকাকা দু’হাতে অমিতার মাথাটা ধরে তাঁর বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। অমিতা মনে মনে বলতে লাগল, বাবা বাবা বাবা। অমিতা টের পেল তায়েবকাকা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। তায়েবকাকা না বাবা? শীর্ণ হাত দুটো তায়েবকাকার, সে বিষয়ে অমিতার কোনও সন্দেহ ছিল না মনে। কিন্তু স্পর্শটা কার? এই স্পর্শ তার বাবার, তার বাবার। হ্যাঁ, এটা তার বাবারই স্পর্শ, তাতে ভুল নেই। অভিমানে অমিতার চোখ জলে ভরে এল। তায়েবকাকার মধ্যেই তার বাবা আছেন, তাতে ভুল নেই।

অনেকক্ষণ পরে যখন তায়েবকাকার বুকের বিক্ষোভ কমে এসেছে, তখন অমিতা তার অভিমান প্রকাশ করল।

বাবা, আমাকে তোমার মনে পড়ে না? একবারও মনে পড়ে না?

‘পড়ে হাসনু, পড়ে।’

তাহলে তোমাকে খুঁজে পাই না কেন?

‘কোথায় খুঁজিস বিটি? কোথায় আমাদের খুঁজিস হাসনু? তুই কি আমাদের খুঁজিস অতীতকালে? তুই কি আমাদের খুঁজিস ব্যর্থদের দলে? কোথায় আমাদের খুঁজে বেড়াস বিটি?

তুমি কি সত্যিই ভাবো বাবা যে, তোমরা ব্যর্থ!

‘ব্যর্থ বই কি বিটি। আমরা তোদের কাছে অপরাধীও। তোদের সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতেও আমাদের লজ্জা করে হাসনু। তোদের আমরা এই পৃথিবীতে এনেছিলাম। আমাদের উচিত ছিল তোদের জন্য একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ে রেখে যাওয়া। যে পৃথিবীতে অসাম্য থাকবে না, অনাচার থাকবে না, অন্যায় থাকবে না, মানুষকে গ্রহণ করা হবে স্রেফ মানুষেরই মূল্যে। জাতি গোষ্ঠীর মূলে আছে মানুষ। সেটাই আদত কথা। মানুষই মানব সমাজের উৎস। সেটাই আদত কথা। সব ধর্মের মূলে আছে মানবতার ধর্ম। মানুষের ধর্মই সব ধর্মের উৎস। আর সে ধর্মের নাম হচ্ছে মনুষ্যত্ব। সম্প্রদায়ের ধর্ম থাকে নাহাসনু। সম্প্রদায় মানুষের খণ্ডিত রূপ। সেই কারণেই মানবতার ধর্মে কোনও বিরোধ নেই, সাম্প্রদায়িক ধমর নিয়ে কেবলই লাঠালাঠি ফাটাফাটি। এমন পৃথিবী আমরা তোদের দিয়ে যেতে পারিনি হাসনু। আমরা বিশ্বাস করতাম প্রতিবেশীর উত্থানে তোমার উত্থান, প্রতিবেশীর বিনাশে তোমার বিনাশ। তোমার প্রতিবেশীকে তুমি ভালবাস। কেননা, মানুষের সমাজে এইটেই হল মূল কথা। তোদের মনেও এই বিশ্বাসের বীজ আমাদের পুঁতে দিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। আমরা পারিনি। কি করে আমরা আমাদের মুখটা তোদের দেখাব? আমরা কেবল স্বপ্নই দেখেছি হাসনু, স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে যাদের উপর নির্ভর করেছিলাম বিটি, সেটা খুবই ভুল জায়গা ছিল।’ অনেকক্ষণ ধরে দম নিয়ে তায়েবকাকা ক্লান্ত স্বরে বললেন, আমরা মধ্যবিত্তদের ওপর বড় বেশি নির্ভর করেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম যে, মধ্যবিত্তরা শিক্ষিত, এরা যেহেতু অধিকাংশই পেশাদার লোক, তাই আমরা আশা করেছিলাম যে এদের ভেতর থেকেই আমরা পাব স্বার্থশূন্য স্বাধীনচেতা সব সৈনিক। যারা স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করবে দেশে। দেশবন্ধু বলেছিলেন, স্বরাজ প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে দাও। আমলাতন্ত্রকে যদি ভাঙতে হয়, ভাঙ্গতেই হবে, তবে গ্রামে গ্রামে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা কর। মনে রেখো, আমাদের দেশে ব্রিটিশকে টিকিয়ে রেখেছে আমলাতন্ত্রের এই স্টিল ফ্রেমটাই।এটাকেই ভাঙতে হবে। স্বরাজ বলতে দেশবন্ধু বুঝতেন, সাদা আমলাতন্ত্রের জায়গায় কালা বা বাদামি আমলাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা নয়। আমলাতন্ত্রের পুরোপুরি উচ্ছেদই ছিল দেশবন্ধুর কাছে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক শর্ত। দেশবন্ধু চেয়েছিলেন, ক্ষমতাকে জনগণের হাতে তুলে দিতে। গ্রাম স্বরাজকেই সার্বভৌম করতে। কিন্তু বিড়ালের গলায় কে ঘণ্টা বাঁধবে বিটি? আমরা ভেবে নিয়েছিলাম যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীই হবে এই সংগ্রামের অগ্রসেনা। তখন কি জানতাম, আমরা ডাইনের হাতে ছেলে সমর্পণ করতে যাচ্ছি? পরবর্তীকালে একটার পর একটা ঘটনা প্রমাণ করে দিল যে, আত্মসর্বস্ব সংকীর্ণমনা কুচুটে এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, এরাই দেশটাকে লুটে পুটে খেয়েছে। এরা ছড়িয়ে পড়েছে অকটোপাসের মতো সব দলে, ক্ষমতার লোভে। আর এরাই চালিয়ে যাচ্ছে অবাধ শোষণ, পেষণ এবং শাসন। এরাই মিলিটারিতে, এরাই সিভিলিয়ানে, এরাই কংগ্রেসে, এরাই মুসলিম লিগে, এরাই হিন্দুমহাসভায় আবার এরাই মার্কসবাদী দলগুলিতে।

বাবা,বাবা, আজ তুমি ভাল নেই। বাকিটা আরেকদিন শুনব। এখন তুমি চুপ কর। তায়েবকাকা কি বলতে যাচ্ছিলেন, অমিতা তাঁর ঠোঁট টিপে ধরে বলেছিল, না বাবা, আজ অনেক হয়েছে। আজ আর না।

‘আমার দিন তো ফুরিয়ে এসেছে পাগলি। আজটাই আমার কাছে এখন প্রধান। রোজ সকালে আমি যখন চোখ মেলি আর নার্সের মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে, তখন বুঝি যে, আমার জীবনে আবার একটা আজ এল। আবার রোজ যখন সন্ধে আসে, রাত হয় ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তখন মনে হয় আর কোনও দিন এ চোখ দুটো খুলবে না। একটা ঘটনা তোকে বলি বিটি, শুনে রাখ।’

অমিতা ভাবল তায়েবকাকাকে বাধা দেয়। কিন্তু কি মনে করে তাঁকে আর বাধা দিল না।

তায়েবকাকা বলতে লাগলেন, ‘এখন আর স্মৃতিশক্তির উপর নির্ভর করতে পারিনে বিটি। সন তারিখে গোলমাল হয়ে যায়। আগের ঘটনা পরের ঘটনার ঘাড়ে এসে চাপে। তবু শুনে রাখ। ১৯২২ সনে দেশবন্ধু গয়া কংগ্রেসে তাঁর স্বরাজ প্রস্তাব রাখলেন। মহাত্মা গান্ধী তখন জেলে। দাশ বললেন, স্বরাজ সাধনার প্রথম কাজ হিন্দু মুসলমানের মধ্যে চুক্তি, এমন চুক্তি সম্পাদন করতে হবে যাতে মুসলমানদের আস্থা আমরা হিন্দুরা অর্জন করতে পারি। প্রত্যেকের স্বতন্ত্র সত্ত্বা স্বীকার করে নিতে হবে এবং তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। হিন্দু মুসলমানের ঐক্যের দৃঢ় ভিত্তি তৈরি হয়ে না উঠলে স্বরাজ আমাদের কাছে মরীচিকাই হয়ে থাকবে। ১৯২৪ সালে সিরাজগঞ্জ সন্মিলনীতে বেঙ্গল প্যাকট গৃহীত হল। সেই প্যাকট মুসলমানদের বুকে আশা সঞ্চার করল। বেঙ্গল প্যাকটকে সামনে রেখে দেশবন্ধু গোঁড়া হিন্দুদের প্রবল বিরোধিতার মুখে কলকাতা কর্পোশেনের নির্বাচনে একক গরিষ্ঠতা নিয়ে জিতে গেলেন। তিনি মেয়র। শহীদ সোহরাবর্দী হলেন ডেপুটি মেয়র। ১৯২৫ সনে দেশবন্ধুর মৃত্যু হল। ডেপুটি মেয়র সোহ্রাবর্দীরই ন্যায়ত মেয়রের পদে যাওয়ার কথা। হঠাৎ সব উল্টে গেল। জে এম সেনগুপ্তকে মেয়র পদে বসিয়ে দেওয়া হল। বাংলার মুসলমানের বুকে যেটুকু আশা জেগে উঠেছিল, এই একটি ঘটনায় সেটা নড়বড়ে হয়ে গেল।’

তায়েবকাকা হাঁফাতে লাগলেন। তবুও অমিতা তাঁকে বাধা দিল না। এখানেও শেষ নগ বিটি, আরও আছে। ১৯২৭ সনে মির্জাপুর পার্কের নাম শ্রদ্ধানন্দ পার্ক রাখা হল। মুসলমানদের মনে বিক্ষোভ দেখা দিল। আমি তোর বাবা, আমরা প্রাণপণে বাধা দিয়েও এই আত্মঘাতী কাজটাকে রুখতে পারলাম না। কারা নাম বদলের পক্ষে ছিল জানিস বিটি? যারা সিরাজগঞ্জ সন্মিলনীতে দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাকটকে সমর্থন করেছিল, তারা। কংগ্রেসওয়ালারা। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, দেশবন্ধুর ডান হাত যাঁরা ছিলেন স্বরাজ্য দলের সেই নেতারাও এই কাজকে সমর্থন করেছিলেন। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের উপর সেই দিন থেকে আমি আস্থা হারাতে শুরু করি। এমন সুবিধাবাদীদের সঙ্গ আমরা পরিত্যাগ করেছিলাম। সেনগুপ্ত যখন মেয়র সময়েই মির্জাপুর পার্ক শ্রদ্ধানন্দ পার্ক হয়ে যায়। আরও আছে বিটি। ১৯২৮ সনে কলকাতায় কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বার্ষিক অধিবেশন হয়েছিল। সুধাকর বলেছিল, আশা খুলবতিরাজন। আশা রাখো তায়েব আশা রাখো। এই অধিবেশন আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিটি। কংগ্রেস অধিয়েশনের সভাপতি ছিলেন মতিলাল নেহরু। তিনি দেশবন্ধুর বন্ধু ছিলেন। আরও একটা কারণ ছিল আমাদের। ১৯২৭ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডঃ আনসারি। তাঁরই উদ্যোগে মতিলালকে সভাপতি করে একটা কমিটি গঠিত হয়েছিল। নেহরু কমিটি। নেহরু কমিটির কাজ ছিল ভারতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তার শাসনতন্ত্র কেমন হবে, সেটা সুপারিশ করা। নেহরু কমিটি ও হিন্দু মুসলিম ঐক্যের উপর জোর দেন এবং সেটা প্রতিষ্ঠার জন্য একটা নতুন ফরমূলা দেন। কাজেই কলকাতার কংগ্রেস অধিবেশন আমাদের সকলের মনেই আশা নিরাশার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল।

তায়েবকাকা জল খেতে চাইলেন। অমিতা ফিডিং কাপে জল ভরে তাঁর মাথাটা কোলের উপর এনে তাঁকে ঢোঁকে ঢোঁকে জল খাইয়ে দিল। তারপর তোয়ালে দিয়ে তায়েবকাকার মুখটা মছিয়ে দিতে লাগল। তায়েবকাকা কিছুক্ষণ ঝিম ধরে পড়ে রইলেন। অমিতা তাঁর বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

‘কংগ্রেস অধিবেশনের কয়েকদিন আগে, কদিন আগে ঠিক মনে নেই, ‘দি মুসলমান’ কাগজের আফিসে বাংলার হিন্দু মুসলমান নেতাদের এক মিটিং হয়। যাঁরা এই মিটিংয়ে ছিলেন তাঁরা সবাই দেশবন্ধুর ভক্ত। হিন্দুদের পক্ষে ছিলেন এম সেনগুপ্ত, শরৎ বসু, ডাঃ বিধান রায়, জে এম দাশগুপ্ত জে সি গুপ্ত, ললিতচন্দ্র দাস, নলিনী সরকার, আরও সব কে কে ছিলেন মনে নেই। তোর বাবাকে এবং আমাকেও ডাকা হয়েছিল। মুসলিম নেতাদের পক্ষে ছিলেন স্যার আবদুর রহিম, মৌলবি ফজলুল হক, মওলানা আজাদ, আবদুল করিম, মৌলবি আবদুল করিম, মৌলবি আবুল কাসেম, মৌলবি মুজিবর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা ইসলামাবাদী আর আমাদের বন্ধু কৃষক প্রজা দলের নেতা মনসুর।

সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে তায়েবকাকা যখন এই নামগুলো উচ্চারণ করছিলেন অমিতার মনে হচ্ছিল এই লোকেদের যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন। তাঁর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছিল। একমাত্র বিধান রায় ছাড়া আর কাউকে দেখেনি অমিতা।

‘দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাকট তখনও কাগজে কলমে বেঁচে আছে। কাজেই সেই প্যাকটকে কেন্দ্ৰ করেই আলোচনা এগিয়ে চলেছিল। ভোটের জোরে মেয়র নির্বাচনে সোহরাবর্দীর দাবিকে নাকচ করা এবং মির্জাপুর পার্কের নাম বদলে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক করে দেওয়া, এই দুটো ঘটনাই মুসলিম নেতাদের হিন্দু মনোভাব সম্পর্কে সন্ধিহান করে তুলেছিল। মুসলমান নেতারা স্বভাবতই বেঙ্গল প্যাকটে মুসলিমদের দাবি যেভাবে মেনে নেওয়া হয়েছিল সেই প্রসঙ্গ তুলে তার গ্যারান্টি দাবি করছিলেন। হঠাৎ ডাঃ বিধান রায় তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, তাহলে মুসলমানদের কথা এই, স্বাধীনতা সংগ্রামে যাব না, কিন্তু চাকরিতে অংশ দাও। পাল্টা জবাবে স্যার আবদুর রহিম বলে উঠলেন, তাহলে হিন্দুদের কথা এই, চাকরিতে অংশ দৈব না, কিন্তু মুসলমান, তোমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে আইস। স্যার আবদুর রহিমের কথার ভঙ্গিতে সব নেতা হেসে উঠেছিলেন। তারপর স্যার আবদুর রহিম খুবই গম্ভীরভাবে ডাঃ বিধান রায়কে বললেন, লুক হিয়ার ডাঃ রায়, ইউ ফরগেট দ্যাট ইউ হিন্দুজ্ হ্যাভ ওয়ান এনিমি, দি ব্রিটিশার্স টু ফাইট, হোয়ার অ্যাজ উই মুসলিমস হ্যাভ গট টু ফাইট থ্রি এনিমিজ : দি বিট্রিশার্স অন্ দি ফ্রন্ট, দি হিন্দুজও অন দি রাইট অ্যান্ড দি মোল্লাজ অন দি লেফট্।

অমিতার মনে তায়েবকাকার শেষ মন্তব্য বেশ জোরে এসে আঘাত করল। স্যার আবদুর রহিম কে অমিতা তা জানে না। আগে এ নাম শোনেনি সে। কিন্তু তাঁর বক্তব্যের মধ্যে যে অসহায় বেদনা তায়েবকাকার বর্ণনার মধ্যে ফুটে উঠেছিল সেটা বুঝতে অমিতার দেরি হয়নি একটুও। ‘তোমাদের হিন্দুদের একটাই শত্রু ব্রিটিশ, আর আমাদের মুসলমানদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে তিনটে শত্রুর বিরুদ্ধে, সামনে ব্রিটিশ, ডাইনে হিন্দু আর বাঁয়ে মোল্লারা।’ এ কোন মুসলমানের কথা বলেছেন স্যার আবদুর রহিম? যে মুসলমানকে এই তিনটে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের কি আমি চিনি? তায়েবকাকা কি সেই মুসলমান? তায়েবকাকা কি মুসলমান? কই কখনও তো তার মনে হয়নি এ কথা। শামিম? শামিম কি সেই মুসলমান? শামিম কি মুসলমান? শামিমকে অমিতা তার কুমারিত্ব অর্পণ করেছিল বিনা দ্বিধায়। শামিম ছিল তার জীবনের প্রথম প্রেমিক। তায়েবকাকাকে তার বাবা বলে মনে হয়। তায়েবকাকাতে অমিতা তার বাবার স্পর্শ পেয়েছে। তবে অমিতা কি? সে কি মুসলমান? মাথা গুলিয়ে ওঠে অমিতার। শামিমকে অমিতা পায়নি। সে যদি মুসলমান তবে শামিমকে পেল না কেন? সে কি তবে হিন্দু? শামিমের শত্রু? তাই কি শামিম তার জীবন থেকে সরে গেল?

বিছানায় শুয়ে অমিতা ছটফট করছিল। সে উঠে পড়ল। আবার টেনে নিল সেই ফটোখানা। সিরাজগঞ্জ সন্মিলনীর সেই তিনটি আদর্শবাদী যুবকের ফটো। ভাল দেখতে পাচ্ছে না অমিতা তাদের। চোখের একবোরে কাছে ফটোটা টেনে এনে দেখতে শুরু করল।

‘এ. কি গো মা। এর মধ্যেই উঠে পড়লে? অন্ধকারে কি দেখছ অমন করে? কাকে দেখছ? আলো জ্বেলে দিই।’ মন্টুর মা এক প্রস্থ কাজ সারা করে বকবক করতে শুরু করেছে। দরজায় বেল বেজে উঠল। অমিতা অবাক হল। কে আবার এল? দরজায় বেল বাজিয়ে কে আসবে? মন্টুর মা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। অমিতা তাড়াতাড়ি পাউডার মেখে নিল।

১৮

‘অপুই লে! অমিতাদিদি!

ভাল দেখতে পাচ্ছে না অমিতা। তবু ডাকটা তার খুবই চেনা লাগছিল। আগন্তুকের আবছা অবয়বটা খানিকটা স্পষ্ট হয়ে আসা মাত্র অমিতার শরীরটা থেকে জরার ভারটা একটানে কে যেন ছিনিয়ে নিল। এতক্ষণ যেন জরার ভারী বেড কভারটা দিয়ে অমিতার শরীরটাকে কেউ ঢেকে রেখেছিল, এখন একটানে সেটা খুলে দিতেই অমিতা সটান চলে গেল দার্জিলিংয়ে। এ যেন ১৯৯০-এর অমিতা নয়, একেবারে ১৯৫৭-এর অমিতা।

মন্টুর মা অবাক হয়ে দেখল, বুড়িটা বিছানা থেকে এক লাফে নেমে পড়ে যেন এক দৌড়েই এগিয়ে গেল দরজার দিকে।

অরে তিমি! চন্দ্রমায়া! কি আশ্চর্য আমি কি স্বপ্ন দেখছি!

‘না দিদি, স্বপ্ন কেন হবে? একেবারে স্পষ্ট দেখেছেন আমাকে।

চন্দ্রমায়া! সেই ছোট্ট মেয়েটা! তিমি অতি সানী থিয়ৌ।

‘হোইন হে দিদি! না দিদি, ম ত এত্রেই থিয়ে। আমি তো এই রকমই ছিলাম। তপাইলে চিভয়কী কেটী ত অকৈ থিই নি। মা কাহা হোর।’

আমি যাকে চিনতাম সে অন্য মেয়ে, তুমি বলছ চন্দ্রমায়া। হয়ত হবে। কিন্তু আমি তো দেখছি সেই মেয়েটাকেই, যার নাম চন্দ্ৰমায়া প্রধান। যতদিন দার্জিলিং-এ ছিলাম, যে আমাকে লেপ্টে থাকত। হাঁ রে এতবড় হয়ে গিয়েছিস। তোর চুলে পাক ধরেছে?

‘ধরবে না? কী বলছ তুমি দিদি? কত বচ্ছর হয়ে গেল বল তো? আমি বদলেছি, কিন্তু তুমি তো বদলাওনি?’

চন্দ্রমায়া তাকে ঠাট্টা করছে নাকি? না, চন্দ্রমায়ার মুখ দেখে অমিতা আশ্বস্ত হল চন্দ্ৰমায়া তাকে ঠাট্টা করছে না। চন্দ্রমায়ারা বদ রসিকতা করে না। অবশ্য এখন করে কি না সে জানে না। দার্জিলিং! তার জীবনের মধুরতম স্বপ্ন।

চন্দ্ৰমায়া বলল, ‘না দিদি তিমি ত্যাহী নৈ হৌ নি…..’

অমিতা জুড়ে দিল, আমি বদলাইনি, পহিলে জস্তী থিয়ৌ তস্তে রহছৌ। এই তো বলবি হতভাগী। তা বল, তোর মুখে মিথ্যে কথা শুনতেও আমার ভাল লাগে।

‘দিদি, তুমি আয়নায় তোমার মুখটা দেখ, তাই তোমার মনে হয় সময় তোমাকে বদলে দিয়েছে, কিন্তু তোমার হৃদয়, সেটা তো তুমি দেখতে পাও না, দেখতে পাও কি দিদি? সেটা আমরা দেখেছি। সেখানে তোমার কিছুই বদলায়নি দিদি। কি করে তোমার হৃদয়টাকে তুমি ছড়িয়ে দিতে দিতে পার, তা তুমিই জান? তোমাকে তো আমরা আমাদের মনের মধ্যে পেয়েছিলাম দিদি, তাই তোমার কোনও বদল আমাদের চোখে পড়বে না।

চন্দ্রমায়া তার সাইডব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল। অমিতার হাতে দিয়ে বলল, ‘নাও দিদি, তোমার জন্য মহাকালের পূজা দিতে গিয়েছিলাম আমরা। অঞ্জলি গুরুংকে কি তোমার মনে আছে?’

অঞ্জলি? হ্যাঁ। ও তো ডাইরেকটরেটে আমার সঙ্গে কাজও করে গিয়েছে কিছুদিন। দার্জিলিং-এ আমি ওকে দেখিনি। অঞ্জলি আমার রাইটার্সের কলিগ।

‘আমি আর অঞ্জলি এখন দুজনেই স্পেশাল অফিসার। তোমারসময়ে এই পোস্টে তুমি একাই ছিলে। এখন আমরা দুইজনেও হিমসিম খেয়ে যাই। এখন আমার বয়স হয়েছে, আমি আর কলকাতায় আসিনে। অঞ্জলিই আসে.। এবার একটা বিশেষ কাজে কলকাতায় আসব শুনে অঞ্জলি বলল, তবে চল মহাকালের পূজা দিয়ে আসি। এ পূজা দিদির জন্য।

সকাল থেকে সন্ধে, আজ তার হয়েছে কি? এই দিনটা কেন তার প্রতি এত সদয় হয়ে উঠল? মন্টুর মা থেকে চন্দ্রমায়া, সবাই কেন তার অন্তরটাকে এমন করে ভরিয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সত্যিই কি অমিতা এদের জন্য কিছু করেছে?

‘আমি আর অঞ্জলি মহাকালের পূজা দিতে যাচ্ছি শুনে আরও কয়েকজন আমাদের অফিস থেকে আমাদের সঙ্গে গেল। আমরা সবাই তোমার কল্যাণ কামনা করে মহাকালের পূজা দিলাম। এই নাও সেই ভস্ম, এগুলো চিনতে পার, অমিতাদি?

ও মা, এ তো ধুপি পাতা! তোর মনে আছে চন্দ্রমা,,প্রথমবার আমরা যখন মহাকালের মন্দিরে যাই, আমি কিছুতেই পূজা দেব না, বললাম পূজা আচ্চায় আমার বিশ্বাস নেই। তোরাও ছাড়বিনে। শেষ পর্যন্ত সুবল দত্তগুপ্ত এগিয়ে এসে বলল, আচ্ছা আমিই দিদির হয়ে প্রকৃসি দিচ্ছি। আমাদের সে কি হাসাহাসি। মনে পড়ে চন্দ্ৰমা?

গাঢ়স্বরে চন্দ্রমায়া বলল, ‘আসলে, কোনও কিছুই ভোলা যায় না দিদি।’ চন্দ্রমায়ার দীর্ঘশ্বাসে অমিতার মনে হল, কিছু না ভেবেই সে চন্দ্রমায়ার ব্যথার জায়গাটা মাড়িয়ে দিয়েছে। সুবলের নাম করা উচিত হয়নি তার।

চন্দ্রমায়ার অত উচ্ছ্বাস এক নিমেষে যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। চন্দ্রমায়ার মুখে এখন অমাবস্যার ছায়া। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে চন্দ্রমায়া ঘোর কাটিয়ে উঠল।

‘সুবল মারা গেল দিদি।

সুবল মারা গেল মানে? কবে? কোথায়?

‘কাল সন্ধেবেলায় ওদের বাড়িতেই মারা গিয়েছে। বেশ কয়েক মাস ধরেই আমাকে চিঠি লিখছিল। বলছিল ওকে ক্ষমা করতে। আমি তো কবেই ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি দিদি। ওর ধর্ম ওর কাছে। তবে আমি ওর কোনও চিঠির জবাব দিইনি। তার শেষ চিঠিখানা পড়ে আমি আর না এসে থাকতে পারিনি দিদি। চলে এলাম কলকাতা। অঞ্জলি বলল, তবে অমিতাদিকেও দেখে এসো। আর চল মহাকালের পূজা দিয়ে প্রসাদ নিয়ে আসি। দিদির জন্য নিয়ে যাও। আমি গোপনে সুবলের জন্যও পূজা দিয়ে এসেছিলাম দিদি। এই দেখ।’ ব্যাগ থেকে চন্দ্রমা একটা জলের বোতল আর ভস্ম আর ধুপি পাতা বের করে ওর টেবিলে রাখল।

‘তোমার কাছে এসে যেন বেঁচে গেলাম দিদি। ট্রেন থেকে নেমে সোজা সুবলের বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। আমি যাবার আগেই সব শেষ হয়ে গিয়েছে। তাকে পোড়ানোও শেষ। আমি আর দাঁড়াইনি। সারাদিন দিদির বাড়িতে ছিলাম। সেখানে থেকে সোজা তোমার এখানে। তোমার মনে আছে দিদি, আমি আর সুবল কি সব ছেলেমানুষিই না করেছি।’

তোরা ছিলি আমাদের চোখে আদর্শ প্রেমিক। কি তাজাই না ছিলি দু’জনে। গানে গানে সব সময় মাতিয়ে রাখতিস তোরা। যেমন তোর গলা তেমনি সুবলের।

‘আমি সাধাসিধে ঘরের মেয়ে দিদি, সবে বি এ পাশ করে বেরিয়েছি। সেই বছরেই আমার চাকরি। কয়েক মাস পরে তুমি এলে। তার আগেই সুবল আমার মনে প্রেমের আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে। ওর গানই আমাকে পাগল করে দিয়েছিল দিদি। আমি সরল সাধারণ একটা মেয়ে, সুবলের প্রেম আমাকে রাণি বানিয়ে দিয়েছিল দিদি। আবার দেখ যে প্রেম সে আমাকে দিয়েছিল, সেই আবার নিজেই তা কেড়ে নিল। তুমি বদলি হয়ে গেলে। এক বছর পরে সুবলও বদলি হয়ে গেল। সুবলের যাবার দিন আগের রাতে আমার সব সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে গিয়েছিল দিদি। কে কি বলবে, কোনও কিছু গ্ৰাহ্য না করে আমি সুবলের বাসায় চলে গিয়েছিলাম। সেই প্রথম আমি শরীর খুললাম ওর কাছে। ঢেলে দিলাম নিজেকে দিদি। সুবল একদিন হঠাৎ চিঠি বন্ধ করে দিল। আমি চিঠি দিই, কোনও উত্তর পাইনে। তিন মাস পর পাগল হয়ে যেতে বসেছিলাম। তোমাকে নিয়ে সেদিন যখন সুবলের বাড়িতে গেলাম, তখন সুবল বাসরঘরে উঠতে যাচ্ছে। সেদিন তুমি খুব বাঁচিয়েছিলে দিদি, সে কথা জীবনে ভুলব না। আমার শুধু একটাই জিজ্ঞাসা ছিল ওর কাছে, কেন এমন কাজ সুবল করল? বিয়ে করবে আমাকে জানালেই তো পারত। আমি কি ওকে বাধা দিতাম?

চন্দ্ৰমায়া কাঁদল না। হঠাৎ গুনগুন করে একটা গান ধরল।

হৃদয় মেরো চোরে র ন জাও বাণী ছোরের
মায়া পীরতি গাসের
জীবন বিতাউঁ হাঁসের
ইন্দ্রনি কো রঙ্গ চোরি
জীবন রঙ্গাই দিউ ল
আকাশ কো তারা টিপি
মালা গাঁথি দিউ ল।

হঠাৎ অমিতাও দেখে কখন সে চন্দ্রমায়ার গলার সঙ্গে গলা মিলিয়েছে। ‘ইন্দ্রনি কো রঙ্গ চোরি জীবন রঙ্গাই দিউ ল’, ইন্দ্রধনুর রং চুরি করে এনে তোমার জীবনকে রাঙ্গিয়ে দেব। ‘আকাশ কো তারা টিপি মালা গাঁথি দিউ ল’, আকাশ থেকে তারা পেড়ে এনে তোমার গলায় মালা গেঁথে, দেব।

অমিতা অবাক হয়ে দেখল, তার প্রিয় পাহাড়ি গান সে ভোলেনি। তার চোখে ভেসে উঠল এক জোড়া তরতাজা তরুণ তরুণী হাত ধরাধরি করে মহাকালের মন্দির থেকে এই গানটা গাইতে গাইতে বেরিয়ে এল। তখন বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। অমিতা সেই যুগলের পিছনে পিছনে দৌঁড় মেরে সামনের একটা আশ্রয়ের নিচে দাঁড়াল। মেয়েটি বলছে, গাও না দিদি, আমাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গাও। সেই চিকন লাজুক ছেলেটা বলছে, সোজা সুর দিদি, ধরুন ধরুন, এক্ষুনি শিখে যাবেন। এ তো আর রবীন্দ্রসঙ্গীত নয় যে, অত কাঠখড় পোড়াতে হবে। সুর মিলিয়ে গাইতে হবে। রবীন্দ্রসঙ্গীতও সুবল খুব ভালই গাইত। চন্দ্রমায়াও আশ্চর্য ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীত করত। সুবল আর চন্দ্রমায়ার পীড়াপীড়িতে অমিতা দুবার গেয়েই সুরটা তুলে নিয়েছিল, সেইদিন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আজ সে যখন চন্দ্রমায়ার গলার সঙ্গে তার গলাটা মেলাতে গেল, তখন ভেবেছিল বোধ হয় তার গলা থেকে সুরই বের হবে না। কিন্তু যতই সে গাইতে লাগল ততই দেখতে পেল তার তেষট্টি বছরের গলার সুর পঞ্চান্ন বছরের অনূঢা বিরাহিনীর সুরে একেবারে মিশ খেয়ে যাচ্ছে।

‘ইন্দ্রনি কো রঙ্গ চোরি জীবন রঙ্গাই দিউ ল
আকাশ কো তারা টিপি মালা গাঁথি দিউ ল।

আজ় এখন মহাকালের মন্দির নেই। তারা দু’জনেই হয়ত মহাকালের ডাক শুনতে পাচ্ছে। আজ এখন বৃষ্টি নেই। দু’জনের চোখ দিয়েই অশ্রুর ধারা তাদের অজান্তে গড়িয়ে দু’জনের বুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।

১৯

অমিতা যেন একটা দিগন্ত পেরিয়ে এল। দিন সমাপন হল তার। অমিতার সামনে আরেকটা দিগন্ত। আরেকটা ‘রাত। চন্দ্রমায়া চলে গিয়েছে। মন্টুর মাও কাজকর্ম সেরে চলে গিয়েছে। আরেকটা অন্তহীন উপশমবিহীন রাত্রি। অমিতার আরেকটা সমস্যা। আজ ক্লান্তি আসছে না অমিতার। কাজ নেই, ক্লান্তিও নেই। তবে কোন ক্লান্তিকে মুছে ফেলার জন্য ঘুম আসবে অমিতার? মনের ক্লান্তি? মনের ক্লান্তি দূর করার জন্য, মনের ভার মুক্ত করার জন্য ঘুম আসে না। এক সময় সে ঘুমের বড়ি খেত। ডাক্তারেরা যা বলতেন, তাই খেত। ভ্যালিয়াম, ইথোব্রাল, আরও কত কি ছাইভস্মই তো খেয়ে দেখেছে রাতের পর রাতে। ফল তো যথাপূর্বং তথাপরং। রাতে কোনও এক সময় ঘণ্টাতিনেক ঘুম। আর তার আগে আর তার পরে স্মৃতি, দুশ্চিন্তা, বিষাদ, বিবমিষা সব কেমন ভিড় করে আসে। কেমন বমি-বমি লাগে।

আজ সন্ধেটা চন্দ্রমায়ার আকস্মিক আবির্ভাবে কেমন অসাধারণ হয়ে উঠেছিল। ‘ইন্দ্রনি কো রঙ্গ চোরি জীবন রঙ্গাই দিউ ল।’ দার্জিলিং মানেই অমিতার কাছে একটা অখণ্ড আলোর ঝরনা, দার্জিলিং অমিতার কাছে মুক্তির এক বার্তা যেন। দার্জিলিং ‘অমিতার জীবনে একটা সুখস্বপ্ন। অমিতা শিক্ষা দফতরে চাকরিটা পাবার পরেই দার্জিলিংয়ে পোস্টেড হয়। তখন অমিতার মনের অবস্থা খুবই খারাপ। যোগমাগা কলেজের পার্ট টাইম-এ আর কতটা সময় লাগত তার! কোনও দিন দু ঘণ্টা কোনও কোনও দিন তাও না। সারা দিন অমিতার হাতে এত সময় সে নিয়ে তখন করবে কি? অথচ সময়ের অভাবের জন্যই না সে তার খোকার আবদার মেটাতে পারেনি। খোকার অভিমান-ভরা কচি মুখটা তখন যেন অমিতাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে ফিরত। মা মা ও মা ও মা। অষ্টপ্রহর খোকার এই আর্ত ডাকটা অমিতার মনের মধ্যে গুমরে গুমরে উঠত। অমিতা বাড়িতে যখন থাকত, মাঝে মাঝে দু’হাতে কান চেপে ধরে বসে থাকত। রাতে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শুত। যোগীশ্বর তার জীবনে এই একটা সলিড উপকার করে দিয়েছিল। শিক্ষা রিভাগে চাকরি খালি আছে, পত্রিকা এনে সেই বিজ্ঞাপনটা তাকে দেখিয়েছিল। অমিতাকে দিয়ে জোর করে দরখাস্ত লিখিয়ে সেটা নিজেই রাইটার্সে গিয়ে যথাস্থানে জমা করে দিয়ে এসেছিল যোগী। যোগমায়া কলেজে যোগী তার শুভানুধ্যায়ী শিক্ষা দফতরের চাকরিটা, যোগীর তদবিরের জন্যই হয়ত অমিতা পেয়ে গিয়েছিল। রাইটার্সে তাকে সে যাত্রায় তিন মাসের বেশি থাকতে হয়নি অমিতাকে। কাজ পেয়ে বর্তে গিয়েছিল অমিতা। মা মা মা দেখ মা শোন মা ও মা ও মা, অমিতা তার মনের ভেতর থেকে উঠে আসা এই ডাকটাই বন্ধ করতে চাইছিল। রাইটার্সে এসে সে বেঁচে গেল। সেখানে কেউ কাজ করে না। ফাইল পাহাড়ের মতো জমে আছে। সে ছিল শিক্ষকদের পেনসন বিভাগে। আড়াই তিনি মাস অমিতা দিনের পর দিন, সকাল থেকে সন্ধে সেইসব ফাইলে ধুলো ঝেড়ে, সেগুলোকে নড়িয়েছে। অমিতার রাইটার্সের সহকর্মীরা কত রকম কথাই না বলেছে আড়ালে আবডালে। সামনেও যে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে অন্যকে শোনাবার ছলে অমিতাকে ঠাট্টা বিদ্রূপ করেনি তা নয়। কিন্তু অমিতা জানত, কাজ মানেই ভুলে থাকা। একটা অভিমানী বালকের মুখকে প্রাণপণে মন থেকে সরিয়ে দেবারই চেষ্টা। পারলে ভোরেই অফিসে চলে আসত অমিতা, আর ক্লান্ত হলে গভীর রাতে অফিস থেকে তার সে সময়কার আস্তানায় ফিরত। কিন্তু অফিসের নিয়ম হচ্ছে দশটায় সেখানে যাওয়া, আর পাঁচটায় ফেরা। আর সারাদিন কাজ ফাঁকি দিয়ে রাজাউরির মারা। তিন মাসও টিকতে পারনি অমিতা কলকাতায়। তাকে দার্জিলিং-এ পোস্টিং দেওয়া হল। অমিতা দার্জিলিং-এ এসে যেন বেঁচে গেল। সহকর্মীরা যে এত সুন্দর হয়, এটা দেখে অমিতা অবাক হল। যোগীশ্বর স্টেশনে এসেছিল ঢাউস একটা ফুলের তোড়া নিয়ে। ‘ভুলে যাবেন না ম্যাডাম। কলকাতাতেও দু’একজন বন্ধু আছেন, এটা মনে রাখবেন।’ ট্রেন ছাড়ার সময় যোগী জানালায় রাখা অমিতার হাতের উপর আলতো চাপ দিয়ে বলেছিল। তখন অমিতার মনে হয়েছিল যোগীশ্বরের মতো আপনজন তার আর কেউ নেই।

‘দিদি, সুবলের আওয়াজ শুনতে পেয়ে অমিতা সত্যিই চমকে উঠেছিল। অমিতা ধড়মড় করে উঠে বসল বিছানায়। কিন্তু সুবলকে দেখতে পেল না। ‘দিদি’। এ তো সুবল! কিন্তু সুবল তুমি তো মরে গিয়েছ? তোমার ক্যান্সার হয়েছিল সবুল! আজ চন্দ্রমায়া এসেছিল সন্ধ্যার সময়। তোমার তো কোলনে ক্যানসার হয়েছিল সুবল, চন্দ্রমায়া বলছিল। কোলনে ক্যানসার হলে কি এত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়! অমিতা চোখ বুজে সুবলের যন্ত্রণা অনুভব করার চেষ্টা করল। ‘দিদি! অমিতা চোখ খুলেই দেখে সুবল। লাজুক লাজুক হাসছে।

সুবলবাবু যে, কি খবর? চন্দ্রমায়া কোথায়? আপনি কি একা এসেছেন?

‘দিদি, আমাকে আপনি টাপনি বললেন না। তুমিই ভাল। না, চন্দ্রমায়া একটা কাজে গিয়েছে। আপনিই তো ওকে পাঠিয়েছেন দিদি।’

চন্দ্রমায়া তো গিয়েছে আলাগড়ায়। একটা ইস্কুল দেখতে হবে। আজ দুপুরেই তো ফেরবার কথা।

‘দিদি, চন্দ্রমায়া একটা কথা আপনাকে বলতে বলে গিয়েছে। বলব সে কথা?’

বলবে বইকি ভাই? কি বলেছে চন্দ্রমায়া?

‘চন্দ্রমায়া বলেছে, এদের আদি কবি ভানু ভক্ত, তাঁর জন্মদিন এবার এরা একটু ঘটা করে পালন করবে। প্রতিবারই এরা করে আসছে। কিন্তু এবার সরকারি লেভেল থেকে এটা করা হোক, এটাই ওদের ইচ্ছে। ভানু ভক্তের ব্যাপারে সরকারের নিস্পৃহ ভাবটা এদের ক্ষোভের কারণ হয়ে উঠছে দিদি। চন্দ্রমায়ার ধারণা আপনার ইনিশিয়েটিভ থাকলে ওদের ক্ষোভের কারণ দূর হতে পারবে।

ভানু ভক্ত সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানত না অমিতা। এইটুকু শুধু জানত যে, আচার্য ভানু ভক্ত নেপালি ভাষায় যে স্থানে আছেন আমাদের কৃত্তিবাস বাংলা ভাষায় সেই একই রকম জায়গায় আছেন। ভানু ভক্তও নেপালি ভাষায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন। নেপালি ভাষায় আরও কবি আছেন, কিন্তু আদি কবি বলতে নেপালিরা একমাত্র ভানু ভক্তকেই বোঝে। এবং নেপালিরা তাঁকে নিয়ে গর্ব করে।

‘আপনার আগে যিনি ছিলেন, এঁরা গতবার তাঁর কাছেই এই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। কিন্তু এক কথায় এমনভাবে এঁদের প্রস্তাবটা খারিজ করে দিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক, যেটাতে এঁরা অপমান বোধ করেছিলেন। নেপালিদের মধ্যে বাঙালিদের সম্পর্কে যে তিক্ততার সৃষ্টি হচ্ছে তার মূলে রয়েছে দিদি আমাদের খামোকা এই উন্নাসিক মনোভাব। আমি নেপালিদের জানি দিদি। এঁদের মধ্যে আমার অনেক বন্ধুও আছেন। এঁরা খুবই সহজ লোক। সহজে এঁদের অভিমান হয় আবার সহজে এঁরা পরকে আপন করে নিতে পারেন। যদি আপনি চেষ্টা করেন দিদি, তবে এটা হয়ে যেতে পারে। অন্তত চন্দ্রমায়ের তাই বিশ্বাস।’

সুবল চলে যাবার পর অমিতা ভানু ভক্তের জন্মদিবস পালনের ব্যাপারটা দিয়ে ভাবতে লেগেছিল। এমন সময় শুনল, প্রফুল্লচন্দ্র সেন আর অতুল্য ঘোষ দার্জিলিং-এ আসছেন। তাঁরা ক’দিন তাগদায় থাকবেন। ডি পি আই ও আসছেন ওঁদের সঙ্গে। অমিতা চন্দ্রমায়াকে বলে তার বাসায় একদিন দার্জিলিংয়ের নেপালি সাহিত্যকদের নিয়ে বসল। কবিতা পাঠ, গান। ভারী সুন্দর একটা অনুষ্ঠান চন্দ্রমায়ার জন্য হয়ে গেল। অমিতা তখন ওঁদের জানাল যে, তাগদায় অতুল্যবাবু এবং প্রফুল্ল সেন এলে ওঁরা যেন সরাসরি তাঁদের কাছে ভানু ভক্ত জন্মজয়ন্তীর প্রস্তাবটা পাড়েন। কবি এবং সাহিত্যিকরাই এই প্রস্তাব নিয়ে যাবেন। অমিতা তাঁদের জন্য সময় নিয়ে রাখবে। সেন ছিলেন তখন ডি পি আই। দার্জিলিংয়ে তাঁকে সব কথা খুলে বলেছিল অমিতা। এবং অমিতা আশ্চর্য হয়ে দেখল, তিনি অমিতার প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। তিনি একটা সময় দিলেন সাহিত্যিক এবং কবিদের তাগদায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেখানে ভানু ভক্তের জন্মজয়ন্তী সরকারি স্তরে পালনের সিদ্ধান্ত এক কথায় হয়ে গেল। ভানু ভক্তের জন্মতারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। প্রচলিত মত এই যে, বৈশাখেই ওঁর জন্ম। কিন্তু তারিখ নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল, রবীন্দ্রজয়ন্তীর পরদিনই ভানু ভক্ত জয়ন্তী পালিত হবে।

সেদিন তাগদা থেকে ওরা দার্জিলিংয়ে ফেরেছিল গান গাইতে গাইতে। সে কী হইহই! সুবল আর চন্দ্রমায়া ছিল ওদের কোরাস লিডার। এ যেন সেদিনের কথা। অমিতা হাত বাড়ালেই যেন সেদিনটাকে ছুঁতে পারবে। অমিতা আর চন্দ্রমায়া মিলে ভানু ভক্তের রামায়ণ থেকে রাম লক্ষ্মণের মিথিলা দর্শন এবং হরধনু ভঙ্গ, এই বিষয়ের উপর একটা গীতিআলেখ্য লিখে ফেলেছিল। এবং তাতে নৃত্যও যোগ করেছিল। এবং সেইটাই প্রধান অনুষ্ঠান ছিল সেদিন। অনেকটা বাল্মীকিপ্রতিভার আদলে অমিতা সেই গীতিআলেখ্য রচনা করেছিল। কিশোর রাম এবং লক্ষ্মণ বনপথ দিয়ে চলেছেন। বনদেবীরা তাঁদের বন্দনা গাইছেন। পাখিরা ডালে ডালে এসে ভিড় করছে, তাদের চাপে ডালগুলো নুয়ে নুয়ে পড়ছে, যেন রাম এবং লক্ষ্মণের মুখে চুমু দিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। ভ্রমরকুল গুনগুন করে লতায় লতায় ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভ্রমেরর শরীরের ভারে লতাগুলো দুলে দুলে উঠছে, সেই দোলার নাচনে ফুলগুলো উৎফুল্ল বালাদের মতো রাম লক্ষ্মণকে যেন আরতি করছে। এই রকমই থিমটা বোধ হয় নিল।

অমিতা ভানু ভক্তের বন-বর্ণনায় গারা রাগিণীর সঙ্গে একটা পাহাড়ি ধুন মিশিয়ে সুর করেছিল। গানের কলিগুলো সঙ্গে সঙ্গে অমিতার মনে গুনগুন করে বেজে উঠল। অমিতা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, তবে কি কিছুই হারায় না এ জীবনে? ‘ভরি পরি তহিম তিরৈমা পনী বৃক্ষ ফল ফুল’, ভানু ভক্তের বনবর্ণনা। কিছুই ভোলেনি অমিতা। তাঁর ঠোঁট কাঁপছিল। কোনও আওয়াজ ছিল না। কিন্তু অমিতার সমস্ত সমস্ত মনে তখন গানটা ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।

‘ভরি পরি তহিম তিরৈমা পনী বৃক্ষ ফল ফুল
ভরিছ ছ যাউন বনমা গর্দছ পখসিলে গুল
ভ্রমরহরু লতাকা ফুলমা হল্লি হল্লি
ঘুনুন ঘুনুনু গরদৈ হিজঁদছন বল্লি বল্লি ॥ ‘

সুবল আর চন্দ্রমায়া ছোট ছোট বাচ্চাদের জোগাড় করে এনে তাদের কাউকে বনদেবী কাউকে বনলতা কাউকে পাখি কাউকে ফুলবালা কাউকে ভ্রমর সাজিয়ে তাদের গলায় গান তুলে দিয়েছিল। অমিতা দিয়েছিল নাচের তালিম। কিন্তু কি অপূর্ব অনুষ্ঠানই না হয়েছিল সেটা। ওরা অমিতাকে মনে রেখেছে। তার জন্য মহাকালের মন্দিরে পূজা দিয়েছে। চন্দ্রমায়ার হাত দিয়ে মহাকালের আশীর্বাদ তার কাছে পাঠিয়েছে। এত বছর পরে। এমন সময় যখন সে আছে কি নেই, সে খবরটা নিতেও কেউ আসে না। কি এমন করেছে ওদের জন্য অমিতা! কত অল্পেই না এই পাহাড়ের লোকগুলো সন্তুষ্ট হয়েছে তখন। অমিতা ওদের ভালবেসেছিল। আর সেই পাহাড়ে কি না আগুন জ্বালিয়ে দিলাম আমরা! আমরা যদি মানুষকে মানুষ বলে জ্ঞান না করি, যেখানে যেখানে শ্রদ্ধা ভালবাসা প্রাপ্য সেখানে সেটা যদি না দিই, তবে তো ফল এই রকমই হবে। ভানু ভক্তের ব্যাপারেই দেখেছে অমিতা, কী ব্যবহারই না আমরা করেছি ওদের সঙ্গে! কেন আমরা সকলকে এমন অবজ্ঞার চোখে দেখি? কাকে অমিতা বলবে এই কথা? অমিতার সামনে এখন কেউ নেই। আছে লোড শেডিংয়ের নিশ্ছিদ্র তমসা। সেই গাঢ় তমসাকে কি সে এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল?

থেকে থেকেই এখন চন্দ্রমায়ার মুখটা মনে পড়তে লাগল তার। চন্দ্রমায়া কলকাতায় এসেছিল সুবলের অন্তিম চিঠি পেয়ে তাকে দেখতে। কে সুবল? যে সুবলকে চন্দ্রমায়া গভীরভাবে ভালবেসেছিল। সুবল সে ভালবাসার মান রাখেনি। কিন্তু চন্দ্রমায়া? সে জীবনে আর বিয়েই করল না। সে কি সুবলের কারণে? সুবল তো বাঙালি। আর চন্দ্রমায়া? সে তো নেপালি। মানুষকে কি এমন ভাগে ভাগে বিচার করা যায়? কে অমিতা? অমিতা তার চাকরিজীবনের শেষ দিকেই জেনে গিয়েছিল, দার্জিলিংয়ে বাঙালি আর নেপালির সম্পর্ক দাঁড়িয়ে গিয়েছে সাপে নেউলে। এ বলে ওকে মার। সে বলে একে মার। বাঙালি নেপালিকে মারছে। নেপালির হাতে বাঙালি মরছে। বাঙালি নেপালিকে ভয় করছে। নেপালি বাঙালিকে ভয় করছে। তাহলে চন্দ্রমায়া কেন এল তার দিদিকে দেখতে? মহাকালের মন্দিরে পূজা দিয়ে, তাঁর আশিস বয়ে নিয়ে কেন এসেছিল চন্দ্রমায়া? সে যদি বাঙালি আর চন্দ্রমায়া যদি নেপালি, শুধু যদি এই মাত্র পরিচয় হয়, তবে নেপালি আর বাঙালির এখন যা সম্পর্ক, চন্দ্রমায়ার তো বিষ আনারই কথা। সে তবে তার দিদির জন্য আশীর্বাদ আনল কেন?

মনে আছে চন্দ্ৰমায়া, আমরা একবার সন্দকফুতে গিয়েছিলাম।

‘মনে আছে দিদি। একদল নেপালি ছাত্রের সঙ্গে আমরা ট্রেকিং করছিলাম। তোমার জন্য আমার ভয় লাগছিল দিদি!’

আমার জন্য ভয়! কেন রে?

‘রাত হয়ে যাচ্ছিল। ও রকম রাস্তার চলা তোমার অভ্যাস নেই। তাই।’

কি আর হত চন্দ্রমা, তোর দিদি হার্ট-ফেল করে মরে যেত কি পা পিছলে খাদে পড়ে যেত। তোরা বরফ চাপা দিয়ে রেখে আসতিস।

‘না। না, দিদি না। অমন কথা বলতে নেই।’ চন্দ্ৰমায়া কেঁদে ফেলেছিল।

অমিতা চন্দ্রমায়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, তুই এখনও ছেলেমানুষ আছিস চন্দ্ৰমায়া। তিমি য়তী সানী থিয়ৌ।

অমিতা যখন দার্জিলিংয়ের গ্রামে গ্রামে ঘুরত, চন্দ্রমায়া তার সঙ্গে থাকত। অমিতা জিপে করে দুর্গম সব গ্রামে যাচ্ছে। সঙ্গে চন্দ্রমায়া। মিরিকে জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে গিয়েছিল। তাদের জিপ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে চন্দ্রমায়া। সাদা বরফে ঢাকা রাস্তা, চারিদিকে রডোড্রেনডন লাল হয়ে ফুটে বনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, ড্রাইভারের নির্দেশমতো সে আর চন্দ্রমায়া চড়াই ভাঙছে। হাজার ফুট উপরে একটা গ্রামে তাদের পৌঁছুতে হবে। সন্ধ্যা হতেই শেষ ফেব্রুয়ারির শীত কামড় মারছে তাদের শরীরে। অমিতার চশমা বারেবারে আবছা হয়ে আসছে। বারবার চশমা খুলে মুছে নিতে হচ্ছে। সন্ধ্যের কিছু পরে তারা সেই গ্রামে গিয়ে পৌঁছেছিল। সেই গরিব গ্রামটিকে ভুলতে কি পারে অমিতা? কি অভ্যর্থনা পেয়েছিল অমিতা! কী করে ভুলবে! ভালবাসা ভোলা যায় না।

গৃহস্বামী ইতস্তত করে কোদো এনেছিল গরম করে। চন্দ্রমায়া বলেছি, ‘খাও দিদি। গরম হয়ে উঠবে।’

অমিতা চন্দ্রমায়ার কথায় পান করেছিল সেই মাদক।

অমিতা বুঝতে চেষ্টা করেছে, যে ভালবাসা তার দার্জিলিংয়ের জীবনে ওদের সকলের কাছ থেকে পেয়েছে, সে কি অমিতা অফিসার বলে? অমিতা বাঙালি বলে? না, অমিতা মানুষ, সেই কারণে?

‘দিদি, তুমি আমার সঙ্গে দার্জিলিংয়ে যাবে?’ অমিতা চন্দ্ৰমায়া কথা বুঝতে পারেনি প্রথমে।

দার্জিলিং, বেশ তো? অন্যমনস্কভাবেই অমিতা চন্দ্রমায়ার কথার জবাব দিয়েছিল।

‘যাবে দার্জিলিং দিদি, তুমি আমার কাছে থাকবে!

আপনি মনে হচ্ছে, দার্জিলিংয়ের মায়ায় বন্দী হয়ে পড়েছেন। তাই কি কোনও সাড়াশব্দ নেই। দার্জিলিং নিশ্চয়ই ভাল জায়গা। কিন্তু অন্য জায়গাতেও কোনও কোনও হতভাগাকে ফেলে রেখে গিয়েছেন, অনুগ্রহ করে তার কথাও মাঝে মাঝে স্মরণ করবেন। সে কৃতার্থ হবে। যোগীশ্বর ততদিনে অমিতাকে নিয়মিত চিঠি লিখতে শুরু করেছে।

অমিতা যে ঘোরটায় ছিল, সেটা কেটে গেল।

আচ্ছা চন্দ্রমা, এখন দার্জিলিংয়ে নেপালিরা বাঙালিদের ঘৃণা করে। সত্যি

‘রাজনীতির কথা আমি তো বুঝিনে দিদি। যত গণ্ডগোল ওরাই পাকাচ্ছে। কিন্তু তুমি আমাদের দিদি, তোমাকে ঘৃণা করবে, দার্জিলিংয়ে এমন একটা মানুষও তুমি খুঁজে পাবে না।

আপনার চিঠি পড়ে মনে হল, দার্জিলিং যেন সব পেয়েছির দেশ। আপনি এমন দেশের সন্ধান পেয়ে গিয়েছেন। ভাল। কিন্তু এ কী সর্বনেশে ইচ্ছে আপনার? আপনি লিখেছেন, দার্জিলিংয়ে আপনি এত ভালবাসা পাচ্ছেন, তা আপনি জীবনে কোথা পাননি। এটা অবশ্য ভালই অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটা আবার কি রকম কথা? ওখানে ভালবাসা পেয়েছেন বলে, দার্জিলিংয়ের কোলে মাথা রেখে আপনি মরতে পারলে সেটা ভাগ্য বলে বিবেচনা করবেন। দার্জিলিং এবং আপনার সহকর্মীদের সম্পর্কে এমন সব মোহময় বর্ণনার পরেই মরার কথা কেন? মরে গেলে অবশ্যই আপদ চুকে যায়, কিন্তু জীবনটা ক্লেশকর হলেও বেঁচে থাকার মধ্যে নিয়ত যে সংগ্রামটা থাকে সেটা অভিজ্ঞতা হিসাবে নিতান্ত ফেলনা নয়, মিতা? ভেবে দেখবেন?

‘তুমি বাঙালি কি নেপালি, তোমাকে কেউ দার্জিলিংয়ে এমন চোখে দেখেনি দিদি।’

আমি তবে কি?

‘আমরা জানি তুমি আমাদের দিদি। তুমি আমাদের বুঝতে পেরেছিলে, তুমি আমাদের ভালবেসেছিলে দিদি। তুমি বাঙালি নও, তুমি দিদি অমিতা। ব্যস। আমরাও কেউ তোমার কাছে নেপালি নই দিদি, আমি চন্দ্রমায়া। তোমার চন্দ্রমা।’

অমিতা যেন স্বপ্নের ঘোরে চন্দ্রমায়ার সঙ্গে কথা বলে চলেছে।

হ্যাঁ, চন্দ্রমা, আমি তোর সঙ্গে দার্জিলিং যাব।

আপনার দুঃসাহসিক সব অভিযানের খবর পেয়ে যুগপৎ অবাক হয়েছি এবং আনন্দ লাভ করেছি। কিছুটা যে ভয় পাইনি, তাও নয়। দার্জিলিং তেনজিংয়ের দেশ। অতএব ওখানে গেলে পঙ্গুর ও পর্বত লঙ্ঘনের ইচ্ছা হবে, এ আবার বড় কথা কি? কিন্তু আমরা তো ভেতো বাঙালি, তক্তপোশই আমাদের তৈলা ঢালা তনুকে স্নিগ্ধ রাখবার অভিযানের পক্ষে প্রকৃষ্ট স্থান। আপনার চিঠি পেয়ে মনে হয়, এই পোড়া বাংলায় আপনার যেন জন্মই হয়নি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় মিতা, আপনি ভুলক্রমেই এই পোড়া দেশে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। এখন আপনি আপনার নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছেন। আনন্দে থাকুন। শুধু মিনতি, এ অভাজনদের সরি, অভাজনকে বিস্মৃত হবেন না।

দার্জিলিংয়ে তোর সঙ্গেই যাব চন্দ্রমা। তোর কাছেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। আবার আমরা দল বেঁধে ট্রেক করব। করব তো?

‘হাঁ দিদি, তুমি গেলে আমাদের পুরনো দিনগুলো ফিরে আসবে। জানো, আজও ভানু ভক্তের জন্মজয়ন্তীতে তোমার নাম সবাই করে। যারা তখন যুবা ছিল, তারা অবশ্য এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছে। সেই কবিকে মনে আছে দিদি, সূর্যকান্ত। সূর্যকান্ত ছেত্রী। সে এখন টিবিতে ধুঁকছে। সেই সবচাইতে তোমার নাম বেশি করে দিদি। সে বলে, চন্দ্রমায়া দিদি যেমন ভানু ভক্তকে শ্রদ্ধা জানিয়েছিল, তেমন আজও কেউ পারেনি। তোমার দেওগা সুরে ভরি পরি তহিম তিরৈমা, এই গানটা বুড়োরা এখনও গায়। ওরা বলে ভানু ভক্তের প্রতি তোমার ওইটাই শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে আছে।’

অমিতার যেন ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল।

বেশ হবে চন্দ্রমা, আমরা সবাই আবার সান্দকফু যাব। তুই ওদের সবাইকে জোগাড় করতে পারবি তো, চন্দ্রমা?

‘পারব দিদি, আমার কাছে ওদের নামের লিস্টি আছে।’

মিতা, তোমার সন্দকফু অভিযানের বিবরণ পড়লাম। দারুণ থ্রিলিং বিশেষ করে ওই জায়গাটায় আমার যখন চোদ্দো হাজার ফুট চড়াই পার হয়ে সন্দকফুতে পৌঁছলাম, তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। ডাকাডাকি করে চৌকিদারকে হাজির করবার চেষ্টায় ওরা তখন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। আমি তখন আর আমাতে নেই। চন্দ্রমাও খুবই শ্রান্ত ছিল, কিন্তু সে নিজের কষ্ট ভুলে আমাকে নিয়ে পড়ল। ফ্লাসকে বার্লির জল খানিকটা ছিল। আমাকে তাই আস্তে আস্তে করে খাইয়ে দিল। একটু পরেই ধাতস্থ হলাম। ধীরে ধীরে চোখ মেললাম। দেখি চন্দ্রমার ব্যগ্র চোখদুটো আমার পানে স্থির হয়ে আছে। চোখ মেলতেই একফালি হাসি ওর ঠোঁট থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। চন্দ্ৰমা বলল, ভয় নেই দিদি, পাহাড়ে সকলেরই এমন হয়। ততক্ষণে সুবলের তৎপরতায় চৌকিদার এসে উনুনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সুবলকে মনে হচ্ছিল, সে যেন আলাদিনের জিন। যা দরকার, মুহূর্তে সে হাতের কাছে হাজির করে দিচ্ছে। এক মগ গরম চায়ে ছাতু মিশিয়ে আমাকে দিয়ে সুবল বলল, দিদি খান। পাহাড়ে পরিশ্রমের পর এর চাইতে ভাল টনিক আর নেই। যদিও আমি জীবনে ছাতু খাইনি। আমি ভাবতাম, ওটা পাখিদেরই বরাদ্দ। সন্দকফুর অভিজ্ঞতা সকলের জীবনেই একবার না একবার হওয়া উচিত। পুরুষদেরর জীবনে তো বটেই। তোমার এই চিঠিতে সাহিত্যগুণ এত বেশি মিতা, পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল এ চিঠি বিভূতিভূষণই বুঝি লিখেছেন। ‘পুরুষ’ বেচারিদের কথা ভেবে চিন্তা বাড়ছে। এত প্রেরণাদায়ক চিঠি একটা ভেতো বাঙালি ‘পুরুষ’কে পায়ে পায়ে আবার সন্দফুতে না ওঠায়!

চন্দ্ৰমা!

‘কি দিদি?’

তোর লিস্টিমতো সকলকে জোগাড় করতে পারবি তো?

‘তুমি দার্জিলিং যাবে, আর আমি সবাইকে তোমার কানে এনে জড়ো করতে পারব না দিদি! খুব পারব।

চন্দ্ৰমা!

অমিতা ইতস্তত করতে লাগল।

‘কিছু বলছ দিদি!

সুবলকে তুই কোথায় পাবি চন্দ্ৰমা?

‘সুবলের জন্য ভেবো না দিদি। ও ঠিক জুটে যাবে। সেবারও তো সুবল আসতে পারবে না, বলেছিল। ওর বস্ ওকে ছুটি দিতে চায়নি। কিন্তু দেখলে তো, যাত্রা মুখে ঠিক এসে হাজির হয়েছিল। কেন এসেছিল দিদি? সুবল আমাকে ভালবাসত, সুবল তোমাকেও ভালবেসেছিল দিদি। ওর ভালবাসায় খাদ ছিল না তো। তখনই যদি সুবল আমাদের সঙ্গে এসে থাকে, তবে সেই ভালবাসার টানে এখন তো আরও আসবেই। এখন সুবলের তো অনন্ত ছুটি। আমরা, আমি, তুমি, সুবলের ভালবাসার লোকেরা সন্দকফুতে যাচ্ছে, আর সুবল আসবে না, এ কী হয়? এখন ও তো সর্বক্ষণই আমাদের সঙ্গে আছে দিদি।’

সুবল মহায়শকে তুমি আলাদিনের জিন হিসাবে পাইয়াছ, এ সংবাদে আশ্বস্ত হইলাম। কিন্তু ভেকান্সি কি একটাই? হৃদয়তার সহিত এই প্রশ্নটি বিবেচিত হইলে এক বেচারির প্রাণে জল আসে।

মানুষের মন মোমের মতো, তা সে পুরুষেরই হোক আর মেয়েদেরই হোক, উষ্ণতার স্পর্শ পেলেই গলতে শুরু করে। অমিতার জীবনে বারবার এই অভিজ্ঞতা ফিরে ফিরে এসেছে। মমতা প্রেম ভালবাসা থেকেই সেই উষ্ণতা পাওয়া যায়। সুবল মরে গিয়েছে, কিন্তু চন্দ্রমায়ার মনে সুবলের স্পর্শে যে ভালবাসা নিয়েছিল, কই সেটা তো মরেনি? চন্দ্রমায়া বিশ্বাস করে, সেই ভালবাসার টান সুবল কাটাতে পারেনি। পারবে না। যতদিন চন্দ্রমায়া বেঁচে থাকবে, ততদিন সেই প্রেম বেঁচে থাকবে। চন্দ্রমায়ার মনে। এই সুন্দর পৃথিবীতে। আর অমিতার মনে? সেখানে কি ভালবাসার মৃত্যু ঘটেছে? শামিমকে সে ভালবেসেছিল, শামিম তাকে ছেড়ে গিয়েছে। অমিতার মনে শামিমের প্রতি প্রেম কি মরে গিয়েছে? কই না। সমীরেন্দ্রকে তো অমিতা ভালবেসেই বিয়ে করেছিল। সমীরেন্দ্র চলে গিয়েছে। সমীরেন্দ্রের প্রতি অমিতার মনে যে ভালবাসা জন্ম নিয়েছিল, সেই ভালবাসা কি জীবিত আছে? কই না। যোগীশ্বরকেও সে ভালবাসা দিয়েছিল। বিয়ে করেছিল তাকে। যোগীশ্বরের সঙ্গেও অমিতার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। যোগীশ্বরের প্রতি তার ভালবাসা কি জীবিত আছে? না। তবে কি, যে ভালবাসা জীবনে স্বপ্ন হয়ে থাকে, তাই শুধু টিকে থাকে? বাস্তবে তাকে নামিয়ে আনলেই সে মরে যায়? অন্তত ভালবাসা যে মলিন হয়ে যায়, সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই। এ এক রহস্য। অমিতা যার তল খুঁজে পায় না।

রাত তিনটে নাগাদ সুবল আর চন্দ্রমায়ার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অমিতার। পথশ্রমের ক্লান্তি তখনও কাটেনি অমিতার। চোখ মেলতে পারছিল না সে। তার চোখ জ্বলছিল, তার খুব শীত লাগছিল। ঘুম চাইছিল অমিতা। শুধু ঘুম। কিন্তু চন্দ্রমায়ার দৌরাত্ম্যে ঘুমোয় সাধ্য কি অমিতার। চোখ মেলেই দেখে চন্দ্রমায়ার হাতে মগ, ধোঁয়া উঠছে। চন্দ্রমায়া বলেছি, ‘শিগগির খেয়ে নাও দিদি, শরীর গরম হবে। গরম পানি করছে সুবল। চট করে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। এখনই দেখবে খেলা। আজ আকাশ খুব ভাল পরিষ্কার আছে।’ চন্দ্রমা আর সুবলের জন্যই এক অবিস্মরণীয় অপার্থিব দৃশ্য দেখেছিল অমিতা সেবার সন্দকফুতে। সূর্যোদয়। মাত্র সূর্যোদয় বলে কিছু বোঝানো যায় না। ওরা হন্তদন্ত হয়ে ডাকবাংলোর কাঁচে ঢাকা সেই বিরাট জানালায় এসে দাঁড়াল! অন্ধকার ক্রমে ক্রমে সরতে লেগেছে। মহান গিরিরাজগণ ধীরে ধীরে প্রকট হচ্ছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা, কুম্ভকর্ণ, থ্রি সিস্টার্স—একজন নেপালি সাথী, মোহন থাপা, গম্ভীর কণ্ঠে গিরিশৃঙ্গের নামগুলো বলে যাচ্ছে। অমিতার মনে হয়েছিল, সে যেন ঋকবেদের মন্ত্র শুনছে। চোমোলাংমা মাকালু। অন্ধকারের পর্দা যত নেমে যাচ্ছে নিচের দিকে ততই নগাধিরাজদের চেহারা স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে। হঠাৎ অমিতা চমকে উঠল। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া লক্ষ্য করে কে যেন তক্ষুনি একটা সিঁদুরের টিপ ছুড়ে দিয়েছে। অব্যর্থ লক্ষ্যে সেটা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় গিয়ে বিধে রইল। তারপর ঘটতে থাকল সেই অবিশ্বাস্য কাণ্ড। জাদুর খেলা বলাই ভাল। ক্রমেই টকটকে সেই লাল ফোঁটা কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া গলে গলে নামতে থাকল তা গা বেয়ে। যতই নামছে অতই সেই ছোট লাল টকটকে ফোঁটা ছড়িয়ে পড়ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার চারদিকে। লাল থেকে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর স্বর্ণবর্ণ হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ পরেই একই কাণ্ড ঘটতে লাগল কুম্ভকর্ণের শরীরে। মুহূর্তে সেটা সোনা হয়ে উঠল। এবার সোনা যেন লাফ দিয়ে পড়ল ‘তিন বোনের’ শরীরে। তিনি বোন একে একে সোনালি হয়ে উঠল। মুহূর্তে যা ছিল সোনা, সেটা রূপা হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে অমিতার চোখের উপর সব পাহাড়গুলো রুপোলি হয়ে চকচক করতে লাগল। পাহাড়ে পাহাড়ে আলোর এমন মাতন যে লাগতে পারে, এ জিনিস স্বপ্নেও ভাবেনি অমিতা। সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে এই মাতন দেখতে লাগল। তার মনে তখন আকুলতার ঝড় বইতে শুরু করেছে। সেই অপার্থিব রূপালি কার্পেট, হ্যাঁ, তাকে কার্পেট বলেই মনে হয়েছিল অমিতার, পাহাড়গুলোর গা বেয়ে গড়াতে গড়াতে নামছে, হঠাৎ অমিতা দেখল উল্টো দিকের অন্ধকার ভেদ করে লাফ দিয়ে সূর্য উঠে পড়ল আকাশে। তার প্রখর তেজে চোখ ঝলসে উঠল অমিতার। অমিতা অস্থির হয়ে উঠেছিল। তার মনের আকুলি-বিকুলি ভাব অস্য হয়ে উঠেছে। এখনই কিছু করতে চায় অমিতা। না হলে তার বুঝি বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

এমন সময় বাঁচিয়ে -দিল সুবল। সুবল গেয়ে উঠল, ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।’ ঠিক এমনতরো কিছু চাইছিল অমিতা। কোনও কিছু ভাবার আগেই অমিতা দেখল, সে সুবলের গলার সঙ্গে তার গলা মিশিয়ে দিয়েছে। ‘কাহার অভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে, ঊষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার।’ ক্রমে সমস্ত ঘরটাই যেন তাদের এই বন্দনা-গীতিতে ভরে যেতে লাগল। গলার সঙ্গে গলা এসে জুড়ল, সুরের সঙ্গে সুর। বাংলা, নেপালি, হিন্দি সুরগুলো মিলে মিশে এক হয়ে উঠল। এ এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা। তাদের সকলের মনের দরজাই যেন হাট করে খুলে গেল। গানের ঝরনাধারায় ওরা স্নান করে শুচি হয়ে উঠল। চন্দ্রমায়া গান গাইতে গাইতে অমিতার কাছে আসতেই সে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে জলের ধারা নামল অঝোরে। অমিতার মনে হতে লাগল তার মন থেকে ক্ষোভ গ্লানি দুঃখ নীচতা সংকীর্ণতা সব যেন গলে গলে অশ্রুর স্রোতে বেরিয়ে যাচ্ছে। কী শান্তি। কী শান্তি।

যাব চন্দ্রমা, তোর সঙ্গেই চলে যাব। সেই স্বপ্নের দেশে, যেখানে জ্বালা নেই যন্ত্রণা নেই, সেখানেই তো যেতে চাই। যেখানে ভালবাসা আছে, সেখানে যাবার চেষ্টাই তো করছি রে চন্দ্রমা, সারা জীবন ধরে। বাঙালি নেপালি, এইসব উঁচু উঁচু বাধা ডিঙিয়ে তুই কত সহজেই না চলে এলি আমার কছে। সেই ভালবাসার পথ ধরেই তো তুই এলি। তোর হাত ধরে যাব না, তোর আর কার হাত ধরে যাব, চন্দ্ৰমা।

চন্দ্ৰমা!

অমিতা কোনও সাড়া পেল না, লোডশেডিংয়ে সেই নিশ্চিদ্র অন্ধকারে। সাড়া পাবে না সে জানে। চন্দ্রমা, মন্টুর মা, ওরা তো কখন চলে গিয়েছে। এই ঘরে এখন সে অমিতা আর তার সঙ্গী প্রায় অন্তবিহীন রাত। আবার একটা ভোরের জন্য আকুল প্রতীক্ষায় তাকে থাকতে হবে। অধীর হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *