১০
মন্টুর মা দেখল বুড়ি নখ কাটা কল দিয়ে নখগুলো বেশ পরিপাটি করে কেটে নিল। এবার নখে পালিশ লাগাবে। তারপর ডাকবে, মন্টুর মা, আমার কাফতানটা দিয়ে যাও। মন্টুর মা প্রথম প্রথম বুঝতেই পারত না, বুড়ি কাফতান কাকে বলে। ঘর মুছতে মুছতে মন্টুর মা কান খাড়া করে রইল, বুড়ি আবার কখন ডাকে। পান থেকে চুন খসলেই বুড়ি অনত্থ বাধিয়ে বসে। আসলে বুড়ির দয়ার শরীর, কিন্তু রেগে গিয়েছে কি, একেবারে মা মনসা। ওর ছোবলের হাত থেকে বাঁচা মন্টুর মার দায় হয়ে পড়ে। মন্টুর মাও কি ছেড়ে কথা কয়। তারও তখন মাথায় রাগ উঠে যায়। কতদিন ভেবেছে বুড়ির কাছে কাজ আর করবে না। আবার যখন ভাবে কি কপাল বুড়ির তখন মায়া লেগে যায়। বুড়ি এক মনে নখে পালিশ লাগাচ্ছে। আহা লাগাক লাগাক, ওতে মনের যন্তনা ভুলে থাকে তো থাকুক।
মন্টুর মা, আমাকে ওই কাফতানটা দাও।
মন্টুর মা গোটা তিনেক কাফতান এনে অমিতার সামনে ধরল। ওগুলো ঘাঘরা না শেমিজ, সেটা বুঝতে পারে না মন্টুর মা। বোঝার দরকারই বা কি? যার জিনিস সে যা বোঝে তাই ভাল।
এইটে পরি? কেমন?
বুড়ি মন্টুর মার হাত থেকে কাফতানগুলো নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। একটায় বড় বড় লাল সবুজ ফুল লতাপাতা দিয়ে নকশা করা। সেইটেই বার কয়েক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে বুড়ি। গায়ের কাছে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে। আহা দেখুক দেখুক। ওই নিয়েই যদি ভুলে থাকে ওর যন্তনা তো বুড়ি ওই নিয়েই থাকুক।
‘হ্যাঁ মা, তোমার ছেলে চিঠি নেখে না?’
ছেলে! বুড়ি ফ্যালফ্যাল করে মন্টুর মার দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন কথাটার মানে বুড়ি ধরতে পারে না। তারপর বুড়ি কাফতানটা কোলের উপর নিয়ে বসে থাকে। কি যেন ভাবে।
ছেলে? ছেলে চিঠি দেবে কেন খামাখা?বুড়ি বলে ওঠে হঠাৎ। তুমি কি ভাবছ আমার ছেলে সেই ছোট খোকাটি আছে। তার এখন চুল পেকে গিয়েছে। তার ছেলেরাই এখন বড় বড় হয়ে গিয়েছে। তাদের কারও বিয়ে থাও নিশ্চয়ই হয়েছে। আমার ছেলে বুড়ো হয়ে গিয়েছে। আমার চাইতেও বুড়ো। ও আবার চিঠি দেবে কি?
‘তা তোমার লাতিপুতিরাও চিঠি লিখতে পারে তো?’
তারা কি আমাকে চেনে মন্টুর মা, যে চিঠি লিখবে? আমাকে দেখেইনি তারা!
কিন্তু তুই এত খোঁজ করছিস কেন মন্টুর মা? তুই আমার উপর এত সদয় হয়ে উঠেছিস কেন? তোর কি মতলব? কি চাস তুই?
‘তা মা তোমার ছেলে না হয় বুড়ো হয়ে গিয়েছে? লাতিরা তোমাকে চেনে না, তা তোমার ব্যাটার বউ, সে তো চিঠি নিখতে পারে? না কি? ন্যাকাপড়া শিখেছে তো?’
ওরা যে সমাজে থাকে মন্টুর মা, সেখানে বেটার বউ বলে কিছু নেই।
এবার মন্টুর মা বুঝতে পারে না। হাঁ হয়ে যায়।
খোকা যে দেশে থাকে সে দেশে শাশুড়ি বউয়ে ভাব নেই। শাশুড়ি শাশুড়ির মতো থাকে, ছেলেবউরা তাদের মতো থাকে। এই যেমন আমি, আপনি আর কপনি।
মন্টুর মা অত ভাবাভাবির মধ্যে যেতে পারে না। বলে, ‘তা মা তোমার তো ছেলে নয়, মেয়েও তো আছে? সেও তো তোমার খোঁজ খবর নিতে পারে?’
সেও তো ওদেশের মেয়ে হয়ে গিয়েছে মন্টুর মা। যে যে-দেশে থাকে সেই দেশের মতোই তো তাকে হয়ে উঠতে হবে। অমিতা দেখল, মন্টুর মার কাছে সে তার ছেলে মেয়েদের হয়ে সাফাই গাইতে শুরু করেছে। খোকার কথা ছেড়েই দিয়েছে অমিতা। খোকা বরাবরই তার বাবার ছেলে। সমীরেন্দ্রর সঙ্গে যেদিন থেকে অমিতার খটাখটি শুরু হয়েছিল তখন থেকেই খোকা ছিল বাবার নেওটা। অমিতার সেদিন ফুরসত ছিল না ছেলের দিকে তেমন নজর দেবার। খোকা হবার আগেই তাকে সংসার টিকিয়ে রাখবার জন্য চাকরি করতে হত। ইশকুলে পড়াত সে। সমীরেন্দ্র তার কিছুদিন আগেই চাকরি ছেড়েছিল। সমীরেন্দ্র চাইছিল অ্যাকাডেমিক লাইনে ফিরে আসতে। বাবা মারা যাবার পর পরিবারের ভার এসে পড়েছিল স্মীরেন্দ্রের উপরই। বাধ্য হয়েই তাকে অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার গড়ে তোলার কাজ থেকে সরে আসতে হয়েছিল। অমিতা সমীরেন্দ্রের এই ক্ষোভটা বুঝতে পেরেছিল। সমীরেন্দ্র যে কত অ্যাম্বিশাস, কত স্বার্থপর সেটা তো জানতে পারেনি সেদিন। অমিতা কত সরল ছিল সেদিন, একেবারে সিম্পল্টন একটি মেয়ে। বোকার বেহদ্দ। তাই সে তার প্রথম জীবনের দিনগুলো উৎসর্গ করেছিল সমীরেন্দ্রকে। সে যাতে সফল হয়ে উঠতে পারে, অমিতার সেটাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। সেই ভোরে ঘুম থেকে ওঠা। তাদের বেনেপুকুরের এক ঘরের বাসা। অন্ধকার স্যাঁৎসেতে। রান্নার জায়গা বলতে কিছু ছিল না। রাস্তায় তোলা উনুনটাকে বের করে এনে আঁচ দিতে হত। ধোঁয়া আবার সহ্য হত না সমীরের। প্লুরিসি হয়েছিল। সমীরেন্দ্র যাতে একটুও কষ্ট না পায়, তার দিকেই নজর দিয়ে গিয়েছে অমিতা। উনুন ধরিয়ে রান্না চাপিয়ে দিতে হত ঘরের এক কোণে উনুনটাকে এনে। তার পেটে তখন খোকা। দশটার মধ্যে সালকেয় পৌঁছুতে হত অমিতাকে। ইশকুলে ঠিক সময়ে হাজিরা না দিতে পারলে চাকরি হারাবার ভয়। ফেরার পথে দুটো টিউশনি সেরে শিয়ালদহে এসে নামত ট্রাম থেকে। বৈঠকখানা থেকে বাজার করে নিয়ে যেতে হত অমিতাকে। সমীরেন্দ্র বাজার টাজার করতে পছন্দ করত না। সে শুধু বই নিয়েই ব্যস্ত হয়ে থাকত। সমীরেন্দ্র কুটোটি নাড়ত না সংসারের। বাড়ি ফিরেই সকালের এঁটো বাসন নিয়ে বসতে হত অমিতাকে। বাসন মেজে রান্না চাপাতে হৃত। কি খিদে পেত তখন অমিতার। কিন্তু নিজের জন্য পয়সা খরচ করতে গায়ে লাগত তখন। সেই অবস্থায় খোকা হল। ম্যাটারনিটি লিভ পাবার জন্য কত লড়তেই না হয়েছে ওকে। সব অমিতাকে নিজে করে নিতে হয়েছে। কেউ সাহায্য করেনি। দিনের বেলায় অমিতা খোকাকে সমীরেন্দ্রের কাছেই রেখে যেত। খোকার সব কিছু গুছিয়ে সমীরেন্দ্রর হাতের কাছে রেখে যেতে হত। পান থেকে চুন খসলেই সমীরেন্দ্র সিংহ মূর্তি ধারণ করত।
সমীরেন্দ্র ডক্টরেট করছে তখন। বাড়ি এলেই সমীরেন্দ্রর নালিশ। এটা করে রেখে যাওনি, সেটা খুঁজে পাইনি। নালিশের ফিরিস্তির আর অন্ত ছিল না। যেন সংসারটা কেবল অমিতারই। অমিতা ধরে নিয়েছিল এটাই নিয়ম। পুরুষদের কোনও কিছু করতে নেই। ভাল করে খেতে পারত না অমিতা। অথচ খিদে তাকে ছাড়ত না। সে এক অদ্ভুত অবস্থা। মুখে অরুচি। অমিতা মুখে কিছু তুলতে পারত না। পেটে সব সময় ক্ষিধের, হিংস্র কামড়। শুধু ক্যান্সারই নয়, সারা জীবন ধরেই তো অমিতা কামড় খেয়ে এসেছে। নানা দিক থেকে। আপনজনের কাছ থেকে সহানুভূতি তো সে পায়নি। তাই কি এখন যখন কেউ তাকে সহানুভূতি দেখাতে আসে, তখন সেটা তার প্রচণ্ড ভণ্ডামি বলে মনে হয়। সে কারও সহানুভূতি চায় না। কেউ তাকে যাতে কোনও রকমে সহানুভূতি জানাতে না পারে, তাই তো এমন সেজেগুজে নিজেকে সব সময় তৈরি রাখে। সে কারও করুণা চায় না। কেউ যদি আসে তবে সে দেখুক অমিতা তাদের সহানুভূতির তোয়াক্কা করে না। সে চিয়ারফুল। মৃত্যু শিওরে রেখে সে এত চিয়ারফুল। খোকা তার মাকে মনে করে না। অমিতা চিয়ারফুল। খোকা তার মাকে ভালবাসে না। অমিতা চিয়ারফুল। বিন্তি তার মাকে চিঠি লেখে না। অমিতা চিয়ারফুল। বিন্তি তার মাকে দেখতে আসেনি। অমিতা চিয়ারফুল। এই প্রসাধনের বাক্সটা যতদিন আমার হাতে আছে, বাক্সের প্রসাধন দ্রব্যগুলো যতদিন না ফুরচ্ছে, ততদিন তোরা আমার কিচ্ছু করতে পারবিনে। আমি তোদের কোনও পরোয়া করিনে। অমিতার ইচ্ছে হল তারস্বরে এই কথাটা সে ঘোষণা করে। কিন্তু ঘরে মন্টুর মা আছে। তাকে পাগল ভাববে। এখনই কি মন্টুর মা অমিতাকে পাগল বলে ধরে নেয়নি? মন্টুর মা কি দেখছে না, একটা বুড়ি রোজ রোজ সাজুগুজু করতে বসছে। নখে পালিশ লাগাচ্ছে, মুখে পাউডার ঘষছে, ঠোঁটে রঙ মাখছে?কি মনে করছে সে? একটা বুড়ি বেশ্যা? পাগল?
কুয়ালালামপুর থেকে একটা বাহারি কাফতান এনেছিল অমিতা। একবার কি একটা ডেলিগেশনে গিয়েছিল। এই কাফতানটা তার খুব পছন্দের জিনিস। খুবই কম পরেছে ওটা। সেটাই আজ বেছে নিল অমিতা। ব্রা পরার দরকার হয় না এখন। সেই ফার্ম ব্রেস্ট নেই তার। বাঁ দিকটা তো ফাঁকাই, ডানদিকেএখন ঝুলছে একটা মাংসের থলি। প্যান্টিও এখন পরতে চায় না। প্রায়ই ভিজে যায়। কতবার আর বদলারে সেটা। প্যান্টি নয়, ধীরে ধীরে অমিতার আবার ন্যাপি পরবার দিন ফিরে আসছে। ন্যাপি! বিন্তির কথা মনে পড়ল তার। কি জ্বালানোটাই তাকে জ্বালিয়েছে বিন্তি। ওর জন্য ডাঁই ডাঁই ন্যাপি তৈরি করে রাখতে হত তাকে। এই ভিজিয়ে ফেলছে, বদলে দাও, বদলাতে না বদলাতেই আবার ভিজিয়ে দিল সেটা। এক সময় অমিতা ভাবতে শুরু করেছিল,বিন্তির পেচ্ছাবের থলিটা বোধ হয় ফুটোই হয়ে গিয়েছে। তিন বছর এমনি চলেছিল। এই তিন বচ্ছর বিন্তিকে কে দেখেছিল? বিন্তির কি কখনও তা মনে পড়ে? বিন্তি তো তার কোল ছাড়তে চাইত না। কতদিন লেগেছে বিন্তিকে মাই ছাড়াতে! বিন্তির কখনও কি মনে পড়ে না? একটুও মনে পড়ে না!
আচ্ছা মন্টুর মা তুমি আমার ছেলেমেয়েকে দেখেছ?
‘শোন কথা! ওরা তো আসেই না তোমার কাছে। দেখব কি করে বল? আমার তিলয়ন আছে?’
মন্টুর মায়ের রসিকতায় অমিতা খিলখিল করে হঠাৎ হেসে উঠল। তিলয়ন! ভাল বলেছে মন্টুর মা। জবর। রস আছে বটে!
দেখবে তুমি আমার ছেলেমেয়েকে? তাদের ফটো তোমায় দেখাব।
‘দেখাবে মা? বেশ তবে রান্নাটা চাপিয়ে দিই। খাবার পরে দেখব।
তুমি তো তখন আবার কাজে বেরিয়ে যাবে।
‘না’মা আমার সে কাজটা লাই। ওরা কাল ছাইড়ে দিয়েছে। বড্ড অপমান্যি করেছে মা। আমাকে বলেছে আমি নাকি চোর।’
‘কি চুরি করেছিলে?’ অমিতার মাথায় সতর্কতার ঘণ্টা বাজতে লাগল। বোঁ বোঁ করে সাইরেন বাজছে ব্রেনে।
‘মিথ্যে বলবনি মা। আমার তাইলে জিব খসে যাবে। ও বাড়িতে নেমন্তন্ন ছিল। ওদের ছেলের জন্মদিন। খুব রান্নাবান্না হয়েছিল। মুরগির মাংস হয়েছিল। অনেক মাংস বেঁচে গিয়েছিল গো। মন্টু, আমার মন্টু গো মা, ও আবার একটু লুভিস্টির। এত বড় ছেলে হল, রোধ ভাষ্যি এখনও হলনি। প্রায়ই বায়না করে, একটু মাংস খাওয়াবে। কদিন মুরগির মাংস খাইনি। ঝি গিরি করে খাই, ছেলেকে মাংস কি করে খাওয়াব বলদিকিন। তা ও হারামজাদা সেটা কি বুঝবে? লবাবের ব্যাটা নোলাটাও লবাবের মতো হয়েছে তো? তা কাল চোখের সামনে অত মাংস বাড়তি হয়ে গিয়েছে দেখে মনটা আমার কেমন করে উঠল। মায়ের পেরাণ তো? ভাবলাম লষ্টই তো হবে। কুকুর বেড়ালকে খাওয়াবে। মন্টুর মুখটা ভেসে উঠল মা। তাইতেই মরলাম।’ মন্টুর মায়ের চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল। ‘একটা বাটিতে দু টুকরো মাংস, বেশি নিইনি মা, শুধু দু টুকরো মাংস, দুখানা ঠ্যাং আর দু টুকরো আলু এই একটা বাটিতে তুলে নিয়ে সেটা পেট কোছড়ে ঢুকিয়ে নিয়েছি, আবাগীর বেটি আয়া ত্যাক্ষুনি ঘরে ঢুকে চেঁচাতে লাগল। লোক জড় হয়ে গেল। আয়া মাগী কোমরের গিঁট খুলে মাংসের বাটি বের করে দ্যাখাল ওদের। হারামির হারামি। তা সেই খানকি হারামজাদি কি অপমান্যিটাই আমাকে করলে মা তোমাকে কি বলব? একটানে আমার কাপড়টা এক ঘর লোকের সামনে, বাবুরাও দাঁইড়ে ছিল, খুলে ফেলে বললে, আর কি নিয়ে যাচ্ছিস দেখি? আমাকে সব্বসমক্ষে ল্যাংটা করে দিলে মা। এই অপমান্যিটা আমি সইতে পারিনি।’ মন্টুর মা ভ্যাক করে কেঁদে দিল।
আমার খোকাও তোমার মন্টুর মতো বড্ড লোভী ছিল। অ্যাঁ, এ কী বলছে অমিতা? কার কথা বলছে? খোকার? কার খোকা? ‘মা আমি মাংস খাব। আজ মাংস এনো। আনবে তো মা?’ ইশকুলে যাওয়ার আগে এমন বায়না করত সে। আঁচল টেনে ধরে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার কাছে। তখন, সেই বেনেটোলার বাড়িতে ওদের খাওয়া দাওয়ার কত কষ্টই না ছিল! অমিতার একার রোজগারে তখন সংসার চলছে। সমীরেন্দ্র তখন পি এইচ ডি করছেন। আর পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটলেই খেপে উঠছেন। ‘খোকার বায়না থামাতে পার না? কেমন মা তুমি?’ সব দায়দায়িত্বই ছিল অমিতার। তখন সেও এই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি তো? সেবক বৈদ্য রোডের বাড়ি থেকে সদ্য বেনেটোলার বস্তিতে এসে ঘর পেতেছে ওরা। বস্তি, হ্যাঁ, বস্তি ছাড়া আর কি?
‘এক বাটি মাংস নে গেলে কার কি খেতি হত বল তো মা। কুকুর বেড়ালের মুখে না পড়ে তবু তো একটা মানুষের মুখে পড়ত। ততই করে থাকি, ঝি বলে আমি কি মানুষ নই। আমাকে একেবারে ল্যাংটা করে দিবি! ধমমে সইবে?’
এসো মন্টুর মা, তোমাকে আমি আমার ছেলেমেয়েকে দেখাই।
১১
মন্টুর মা বিস্মিত হয়ে বলে উঠল, ‘এই তোমার খোকা, মা?’
অমিতা বলল, হ্যাঁ, আমার খোকা, দু বছর ওর বয়েস তখন।
‘কি গোটা গোটা হাত পা। এ যে ছেনতে ইচ্ছে করে খালি।’
অমিতা পিছন ফিরে দেখতে লাগল। কিছু নজর এল না তেমন করে। বেনেপুকুরের ঘরটা দেখতে পেল না অমিতা। চল্লিশ বছর পার হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে! বেনেপুকুর বলতে অমিতার মনে এক আনাড়ি মায়ের ঘরকন্যা। কুটোটি নাড়তে হয়নি তাদের কোনও বোনকে বাপের বাড়িতে। সমীরেন্দ্রের ঘরে এসেই সে প্রথমে তোলা উনুনে আঁচ দিতে শেখে। রাঁধতে শেখে। সমীরেন্দ্র ন্যাকামি করে বলত, ‘এ সব কি তুমি পারবে মিতা, তোমাদের সুখের শরীর তো।’ অমিতার জেদ বাড়িয়ে দিত। একদিন তো হাতই পুড়িয়ে ফেলল ফেন গালতে গিয়ে। সমীরেন্দ্র তখন ইনটেলেকচুয়াল প্রোলেতারিয়েত বন্ধুর সঙ্গে সিগারেট টানতে টানতে সাম্রাজ্যবাদের কুষ্টি কাটতেই ব্যস্ত। তার দিকে তাকিয়ে সমীরেন্দ্র রসিকতা করেছিল, ‘তোমরা তো ডিক্লাস্ড ডিক্লাড বলে কপচাও অমিতাভ, আর ডিক্লাদের নিয়ে পদ্য লেখো, ডিক্লাড কাকে বলে মিতাকে দেখে শেখো। সমীরেন্দ্র আর অমিতাভ হা হা করে হেসে উঠেছিল। অমিতার বেনেপুকুরের স্মৃতি! এই লোকটার সঙ্গে তারপরও সাত বছর ঘর করেছিল অমিতা। কি করে করেছিল!
‘তোমার খোকা রাজপুত্তুর মা, রাজপুত্তুর।’
রাজপুত্তুর? হ্যাঁ, খোকার বাবা রাজার বংশেরই তো ছেলে। সমীরেন্দ্র তখন অমিতার সেই অল্প রোজগারের টাকায় সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বলত, ‘জান মিতা, আমাদের চৌধুরিদের বংশ বারো ভুইয়ার এক ভুইয়ার থেকে নেমে এসেছে। সিলেটের ওদিকে আমাদের বিরাট বিরাট সব তালুক ছিল। বাবা অবধি কি সব সনদ বাক্সবন্দী করে বয়ে বেড়িয়েছেন। দেশ ভাগ হতেই তালপুকুরটুকুও আর নেই। আমার থেকেই নীল রক্ত লাল হয়ে গিয়েছে। আমি এখন ডিক্লাড। আমি তুমি এখন মনেপ্রাণে সর্বহারা হয়ে গিয়েছি। বল মিতা, যে জীবন তুমি কাটিয়ে এসেছ, সেই পরগাছার জীবন, তোমার বাপের বাড়ির সেই আপস্টার্টের জীবন তোমার ভাল লাগে?’ অমিতার বাঁ হাতটা আপনা থেকেই যেন তার চোখের সামনে এগিয়ে এল। হাতখানা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল অমিতা । গরম ফেন পড়ে পুড়ে গিয়েছিল হাতখানা। দাগ এখনও আছে। সমীরেন্দ্র উঠেও আসেনি সেদিন। সে যখন হাতের জ্বলুনিতে দিশাহারা হয়ে উঠেছে, কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, ফোস্কা পড়ে হাতখানা ব্যাঙের মতো ফুলে উঠেছে, এমন সময় পৃথ্বীশ এসে হাজির। চিত্রকর চির খ্যাপাটে পৃথ্বীশ। তার হাতখানা দেখেই বলে উঠেছিল, ‘বাড়িতে আলু আছে অমিতা?’ বলেই ঝুড়িটা থেকে গোটা দুয়েক আলু বের করে নিয়ে শিল ধুয়ে নিয়ে তাতে আলুটা বেশ করে থেঁতলে তার হাতে প্রলেপ লাগিয়ে দিল। ‘এখন কিচ্ছু কর না। বসে থাক। যন্ত্রণা কিছুটা কমে যাবে। তারপর যা করার আমি করছি।’ পৃথ্বীশ হাঁড়ি থেকে ফেন গালতে বসে গেল। অমিতা তাকে বাধা দিতে গেল। ‘বসে থাক অমিতা। কাজ এখনও শেষ হয়নি। তোমার হাত নিয়ে ভোগান্তি যাতে কমে আগে তার ব্যবস্থা করে নিই, পরে কথা হবে। তুমি এখন দেখো, হাতটাতে কিছুতেই যেন ঘষা না লাগে। হাঁড়িটাকে কাত করে বসিয়ে রেখে পৃথ্বীশ উঠে দাঁড়াতেই সমীরেন্দ্র জিজ্ঞাসা করল, ‘কি, সিরিয়াস কিছু হয়েছে? ওই যে টোটকা লাগালেন, আপনি জানেন তো ওতে সেপটিক টেপটিক কিছু হবে না?’ পৃথ্বীশ বলেছিল, ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, অমিতা যাতে ভাতের হাঁড়ি আবার দু-চার দিনের মধ্যে নামাতে পারে, তার ব্যবস্থা করেই আমি ফিরে আসছি। যতক্ষণ না আসি ততক্ষণ এইটুকু নজর রাখবেন প্লিজ, অমিতা যেন হাতটা ঘষে না ফেলে। পৃথ্বীশ বার্নল কিনে এনেছিল।
ওটা খোকার দু বছরের ছবি, মন্টুর মা। জানো, খোকা হামাগুড়ি দেয়নি কোনদিন। পাছা হেঁচড়ে চলতে চলতে একদিন দুম করে উঠে দাঁড়াল, তার পর এটা সেটা ধরে ধরে হাঁটতে শিখে গেল। আমার মা বলত, আমিও নাকি ওই রকমভাবে হাঁটতে শিখেছিলাম। এই দেখ, এটা খোকার চার বছরের ছবি। দাঁতগুলো দেখ। সুন্দর, না?
‘ওমা, দাঁত মেলে হাসছে। কুটি কুটি দাঁত গো। কি সুন্দর দাঁত তোমার ছেলের।’
ঠিক আমার দাঁতের মতো। মানে আমার দাঁত এই সময় ওই রকম ছিল। আমাকে মা সোহাগ করে বলত ইঁদুর-দাঁতি।
‘তা ঠিক, ইঁদুরের মতো দাঁতই বটে তোমার খোকার।
খোকার মুখের আদলও আমার মতো ছিল। ছবির স্তূপ থেকে একটা ছবি বেছে নিয়ে মুখের সামনে টেনে আনল সেটা। চোখে তেমন ভাল দেখে না আজকাল অমিতা। রাতে তো একেবারেই দেখতে পায় না। ছানি পড়ছে, বলেছেন তো ডাক্তার। আবার অপটিক্ নার্ভও শুকিয়ে আসতে পারে? বাবার তো তাই হয়েছিল। ডাক্তাররা ছানি ছানি বলে অনেকদিন গড়িমসি করেছিলেন। ছানি এখন কাঁচা আছে সুধাকরবাবু। আর দিন কতক যাক। পাকুক ছানি। তখন কাটার মতো উপযুক্ত হবে। এই করে করেই দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুরা। শেষটায় বাবা মেডিক্যাল কলেজের কর্নেল কিরনান না কিরম্যান, না কিরওয়ান কাকে যেন দেখালেন। সেই বুড়ো বাবাকে দেখে বললেন, কে বলেছে তোমার ছানি হয়েছে? না, ছানি তোমার হয়নি। তোমার অপ্টিক্ নার্ভ শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন আর কিছু করার সময় নেই। তুমি লেটে এসেছ। বাবার চোখের রোগ যেমন লেটে ধরা পড়ল, অমিতারও ক্যানসার তেমন লেটেই ধরা পড়ল। ওরা সবাই লেট্। লেট লতিফ।
দেখ মন্টুর মা, আমার খোকার মুখখানা দেখ। কি, আমার মতো আদল নয়?
মন্টুর মা খোকার ছবিখানাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। কোনও মিলই খুঁজে পেল না সে। এই বুড়ির মুখের সঙ্গে এই খোকার কোনও মিলই নেই। আহা রে! বললে বুড়িটা দুঃখ পাবে।
‘তোমার যে ছবি দেওয়ালে টাঙানো আছে, এ মুখখানা তারই পারা মা। ওই মুখটাই যেন এতে বসানো।’
তাই তো হবে। তখন তো আমি ওই রকমই ছিলাম। বেশ মিল আছে তাই না?
‘খোকার মুখে তোমারই মুখ মা। আহা।’
তবু জানো তো মন্টুর মা, খোকা বললে যে, সে তার বাপেরই ছেলে। বাবা তাকে নিয়ে নিল। হ্যাঁ মন্টুর মা, আদালতে দাঁড়িয়ে আমার স্বামী বললেন, ছেলেকে মায়ের হেপাজতে রাখা ঠিক হবে না। উচিত হবে বলে আমি মনে করিনে ধর্মাবতার। আমার ছেলের এখন লেখাপড়া শিখবার বয়স হয়েছে। ওর মারের কাছ থাকলে ওর মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হবে। সমীরেন্দ্র ইংরাজিতে বলেছিল মেন্টাল হেল্থ। খোকাকেও ওর বাবা আদালতে নিয়ে গিয়েছিল। ধর্মাবতার ওইটুকু ছেলেকে, তখন খোকার আট বছর বয়েস মন্টুর মা, জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কার কাছে থাকতে চাও, খোকা মাথা নিচু করে বলেছিল, বাবার কাছে। ব্যস্, আমার খোকা তার বাবার খোকা হয়ে গেল।
‘তোমাদের ঘরের ব্যাপার বুঝি আদালত ঠিক করে দেয়, হাঁ মা? এই তোমাদের দস্তুর?’
তোমাদের ঘরে কি হয়? যখন স্বামী স্ত্রীতে বনিবনাও হয় না?
‘আমাদের ঘরে মারপিঠ হয়। মন্টুর বাপ এক এক দিন মদ গিলে আসত। কি পেটান পেটাত আমাকে। কতদিন আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছি। আমার হাড়পাঁজরা গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিয়েছে মন্টুর বাপ। রিকশো চালাত। গায়ে ছিল অসম্ভব জোর। সে একটা দৈত্যি ছিল গো। আমার রোজগারে টান দিত। তার উপর আবার ছিল সন্দ বাতিক। লিজে যা খুশি করবে, তাতে দোষ হবেনি, কিন্তু আমার বেলায় যত দোষ। মরেছে মা, হাড় জুইড়েছে। কিন্তু কোনও দিন আদালত পুলিসের ফ্যাসাদে জইড়ে পড়িনি। আমার এক বন্ধু ছিল মা, শরৎরাণী, সে ছিল আমার গোলাপফুল, তার মিনসেও তাকে ঠ্যাঙাত, খুব ঠ্যাঙাত। পাড়ার লোকেরা একদিন থাকতে না পেরে পুলিসে খপর দিল। হাবিলদার এসে ধরে নিয়ে গেল দু’জনকে। গোলাপফুলের পুলিসে খুব ডর ছিল মা। দেখতে সুন্দর ছিল গো মা। অনেকের লজর ছিল ওর উপর। কি হয়েছিল বেশি জানিনে। সেদিন তো দু’জনেই ফিরে এল। কিন্তু হাবিলদারের আসা যাওয়া কমল না। এই লিয়েও হুজ্জোৎ মারামারি বেড়েই গেল। শেষে একদিন গোলাপফুলের মিনসেকে পুলিস এসে ধরে লে গেল। আর গোলাপফুল হয়ে গেল হাবিলদারের রাখনি।’
খোকার আট বছর বয়সের ফটোখানা কোলে নিয়ে চুপ করে বসে রইল। এই ওর শেষ ফটো।
‘আমি মণ্টকে ছাড়িনি মা। খাই না খাই আমিই তো ওকে বড় করে তুলেছি।’
অথচ মজা কি জানো মন্টুর মা, খোকার বাবা একটা মেয়ে চেয়েছিল। ছেলে হলে খানিকটা বিরক্ত হয়েছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমিতা। সে যেন একটা ফ্যাক্টরি। মেয়ে চাও মেয়ে পেয়ে যাবে। যেন কল টিপলেই জল। ছেলে চাও ছেলে পাবে। এখন আবার ফ্যাশন বদলেছে। কি সব যন্ত্রপাতি বেরিয়েছে, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, গর্ভে যন্ত্র বসিয়ে জেনে নেওয়া যাবে সেখানে ছেলে আছে না মেয়ে আছে। মেয়ে যদি থাকে, তবে তাকে নষ্ট করে দাও। কোথায় যাচ্ছে দুনিয়া? হা!
সমীরেন্দ্র মেয়ে চেয়েছিল, ছেলে পেল। ছেলেকে ধর্মাবতার বললেন, তার মেন্টাল হেলথের জন্য বাবার কাছে থাকতে হবে, বাবা ছেলে নিয়ে চলে গেল! মা কেউ না। তার আশা ইচ্ছে কিচ্ছু না। সেদিন মেয়ে হয়ে জন্মাবার অসহায়তা যন্ত্রণায় পেড়ে ফেলেছিল অমিতাকে। সে অসহায়তার সে কি যন্ত্রণা! কতদিন তার এই প্রশ্ন মনে হয়েছে, এ সব আইনকানুন কে বানায়? তারা কি কেউ মায়ের পেটে জন্মায়নি? মায়ের বুকের দুধ এরা কি কেউ খায়নি?
অমিতা অসুস্থ বোধ করতে লাগল। তার পিঠের ব্যথাটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠছে। শরীরটাও কেমন গুলিয়ে উঠতে লাগল। তার মনটা খারাপ হয়ে পড়ছে বলেই কি শরীরটাও অসুস্থ বোধ করছে? নাকি শরীরের ব্যাধিই তার মনটাকে এমন নড়বড়ে করে তুলেছে? ছবিগুলোর দিকে চোখ রেখে অমিতাকে অমন চুপ করে বসে থাকতে দেখে মন্টুর মা জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হল গো মা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে? তোমাকে কি শুইয়ে দেব? একটুকখন জিরিয়ে লাও না। আজ সকাল থেকে খালি কথাই বলতে নেগেছো। শোবে?’
কেন, তুমি দেখবে না আমার ছেলেমেয়ের ছবি?
‘তোমার ভাল নাগে তো দেখাও না।’
আসলে তো আমি আমার খোকাকে তেমন যত্নটত্ন করতে পারিনি। খালি কাজ আর কাজ। এই নিয়েই তো তখন থাকতে হয়েছে আমাকে। আর কি জানো, বাচ্চারা অনাদরটা খুব বোঝে! আর ওরা তো হাকিমের চাইতেও বড় হাকিম। মনে মনে একটা রায় তৈরি করে ফেলে। মা ভাল, না বাবা ভাল। আর একবার যদি এই রকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে ওদের মনে মনে, তাহলে সেখান থেকে তাদের নড়ানো শক্ত। আমি তো সেই রাত্তির ছাড়া খোকাকে দেখাশোনা করার সময় পেতাম না। তখন ঝি রাখার পয়সাও ছিল না আমার। আমাকেই সব করতে হত। খোকা যে সময়ে আমাকে পেতে চাইত যে সময় আমি কোথায়? ছোট ছেলে তো? বাবাকেই সব সময় পেত।
‘খোকার বাবা ভালবাসত বুঝি খোকাকে? তোমাদের ঘরে এই এক সুবিধে। কেউ না কেউ ছেলেপিলেদের কাছে থাকতে পায়। তুমি একবার আমার কথা চিন্তা কর তো? আমি আমার কোনও ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করতে পারিনি। একটা তো বাস চাপা পড়ে মরেই গেল। থেতলে গিয়েছিল গো মা। একেবারে ব্যাঙ চ্যাপটা। দুদিন খুব ভেঙে পড়েছিনু। খেতে পারিনে শুতে পারিনে। কিন্তু কাজ কি বন্ধ হয়েছিল আমার? একদিন কামাই করেছো কি, গেরস্থ বাড়িতে অনথ হয়ে যাবে না!’’
আচ্ছা মন্টুর মা, তোমার ছেলেমেয়েদের কে দেখাশোনা করে?
‘কে আবার, কেউ না। কিংবা বলতে পার ভগবান? ভগবান যে কেমন দেখাশোনা করে, সে তো শুনলেই।’
কেউ দেখাশোনা করে না? ওরা আপনা আপনিই বড় হয়?
‘লয় তো কি? মন্টুকে যখন বিয়োলাম, তখন কাজে আসবার সময় মন্টুর দিদির কাছে রেখে আসতাম। সে দিদির বয়স কত, জানবে?? মন্টুর থেকে চার বছরের বড়। সেই যা করবার করত। করল তো করল, না করল তো না। আমাদের আবার জেবন মা? তোমাদের মতন কি আর? মা গেল কাজে তো কত্তা ঘরে বসে ছেলে সামাল দেবে?’
খোকার বাবা তো নিজেকে নিয়েই থাকত। খোকাকে তার কাছে রেখে যেতাম তাই। দেখা শোনা কত করত তা জানিনে, কিন্তু ঘরে ফিরলেই খোকার বাবার নালিশের চোটে কান ঝালাপালা হয়ে উঠত। তোমার খোকা এই করেছে; তোমার খোকা সেই করেছে। তোমার খোকা আমার বইয়ের উপর জলের গেলাস উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে। এমন অসভ্য ছেলে আমি আর দেখিনি। তুমি কাল যাবার আগে ওর একটা ব্যবস্থা করে যেয়ো। নইলে আমার পড়াশোনা গোল্লায় যাবে। এত ডিস্টার্ব করলে আমি পড়ব কি করে? সমীরেন্দ্রের নালিশের আর অন্ত ছিল না। আমি সামাল দিতাম কি করে? আমি ইশকুল থেকে ফিরে একদণ্ডও তোঁ ফুসরত পেতাম না। বাড়ি ফিরে আসবামাত্র আমার পায়ে পায়ে ঘুরত সে। আর কি বায়না করত! কত তার অভিমান পোষা থাকত! কাজের ফাঁকে ফাঁকে ওর দিকে সর্বদাই কান রাখতে হত খাড়া করে। প্রত্যেকটা কথারই ও জবাব চাইত। আমাকৈ তা দিতে হত।
হ্যাঁ মন্টুর মা, খোকা যত বকর বকর করত আমাকেও ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ততটাই বকর বকর করতে হত। না হলেই ছেলের ঠোঁট ফুলত। গেলাস বাটি বই যা হাতের কাছে পেত তাই ছুঁড়ে ফেলে দিত।
‘ওই মা, যা বলেছ, ওই তো ছেলেমানুষদের রোগ। ওদের কি আর বুদ্ধি আছে। দুষ্টু বুদ্ধিতে ভরা।’
তবু কি করে খোকা বলল, বলতে পারল, আমি বাবার কাছেই থাকব। তখন ওর বয়স আট। আবার নয়ও হতে পারে। এর মাঝেই ওর জীবনে মা ফুরিয়ে গেল! আবার এটাও ভাবি, মানে এক কালে ভাবতাম, হয়ত যতটা মার কাছ থেকে খোকা আশা করেছিল সেটা সে পায়নি। ফটোটা একেবারে মুখের কাছে নিয়ে এসে গাঢ় স্বরে অমিতা বলল, কি আশা করেছিলি খোকা, কি আশা করেছিলি তোর মায়ের কাছ থেকে, আর কিই বা পাসনি, কোনওদিন তো বলিসনি তোর মাকে? তোর মা তাহলে কি করে বুঝবে সেটা? তুই কি এটা বুঝতে পেরেছিলি স্বার্থপর ছেলে যে, তোর মা তোকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য সেদিন কত কষ্ট করেছে? কেন তুই আদালতে তোর মার চোখের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকাসনি? কেন তুই মাথা নিচু করে বলেছিলি, আমি বাবার কাছেই থাকতে চাই? কেউ তোকে ওটা শিখিয়ে দিয়েছিল? তোর বাবা তোকে ওই কথাটা বলতে বলেছিল,? সেই জন্য মাথা নিচু করে কথাটা বলেছিলি? ওটা তাহলে তোর কথা নয়? ওই কথাটা বললে যে, তোর মায়ের বুকে শেল বাজবে, সেই কথা ভেবেই কি তুই মাথা নিচু করেছিলি? নাকি তোর মায়ের উপর অভিমান হয়েছিল? তুই সেদিন অভিমানেই মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলি কি? নাকি তুই ভেবেছিলি মায়ের দিকে তোর নজর পড়লে তুই আর নিজেকে সামলাতে পারবিনে, ছুটে চলে আসবি আমার কাছে।তোর হাত দুটো তুই মুঠো করে রেখেছিলি। শক্ত করে। আমি এই ভঙ্গির মানেটা জানতাম। কোনও কাজ করবি না বলে তুই যখন মনে মনে কোনও জেদ ধরতিস, তখন তুই ওইভাবে মুঠো শক্ত করে রাখতিস খোকা। কতদিন অনিচ্ছায় ইশকুলে যাবার সময় মুখ গোঁজ করে, মুঠো শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকতিস, তুই কি ভাবছিস তোর মা সে সব ভুলে গিয়েছে? হা রে?
আদালতের রায়ে খোকার বাবা অমিতার কাছ থেকে খোকাকে নিয়ে চলে গেল। আর তার কয়েক মাস পরেই অমিতা যোগমায়া কলেজে মর্নিংয়ে পার্ট টাইম একটা অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেল। তার শরীর মন তখন বিপর্যস্ত। যোগমায়ার চাকরিটা তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। বেতন সালকের ইশকুলে যা পেত তারই প্রায় সমান। কিন্তু কত সময় পেল সে এবার! তার জীবন তার সঙ্গে বরাবরই এই রকম নিষ্ঠুর পরিহাস করে এসেছে। এখন খোকা নেই, সংসার নেই তার, এখন সময় তার চারদিকে থই থই করছে। কি করবে অমিতা এখন এত সময় নিয়ে? যখন খোকা ছিল, তখন অমিতার হাতে সময় ছিল না একটুও। সময়ের অভাবেই না খোকার কোনও যত্ন করতে পারেনি অমিতা? যতটা সময় ওর সঙ্গে দিতে পারত, দিতে পারেনি। ‘না, তুমি আজ ইশকুলে যাবে না। ঘুম থেকে উঠেই বায়না ধরত খোকা। তখন ওর চার বছর বয়েস। সে প্রচণ্ড বায়না ধরত। ‘তোমাকে ইশকুলে যেতে হবে না আজ, ও মা শুনছ, মা মা, শুনছ? না, তুমি ইশকুলে যাবে না। তুমি আজ আমার কাছে থাকবে। সারাদিন আমার কাছে। যাবে না যাবে না যাবে না। ব্যস। তখন ইশকুলের শাড়ি পরতে শুরু করেছে অমিতা। খোকার দুষ্টুমির মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। সিঁদুরের কৌটা কোথায় লুকিয়ে ফেলেছে। খাতাগুলো মেঝেয় ছড়িয়ে ছত্রাখান। কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কত ভোলাতে চেষ্টা করেছে অমিতা তখন। কত বোঝাতে চেষ্টা করেছে তাকে। ইশকুলে আজ আমাকে যেতেই হবে বাবা, সোনা আমার লক্ষ্মী ছেলে, তোমার জন্য কি আনব বল, বলে দাও। ‘তুমি আমার কাছে থাকবে মা। সারাদিন আমার কাছে থাকবে। শুধু আমার কাছে।’
ছেলের এ সব আবদার, এ সব বায়না আমি যদি মেটাতে পারতাম মন্টুর মা, তবে কি খোকা আমার কাছ থেকে চলে যেত? ‘বাচ্চারা তো ওই রকমই মা, ওই রকমই অবুঝ। মন্টু যে কতদিন আমার হাতে চড়চাপড় খেয়েছে, ওর খিজালতের জন্য, তা আর কি বলব? মন্টু তো বুঝত না, ওর মার দেরি হয়ে গেলে অনখ বেধে যাবে বাবুদের বাড়িতে। ওই টুকুন ছেলে বুঝবার জ্ঞানমন্যি কি হয় মা? হয় না।’
কিন্তু খোকাও গেল তার বাপের কাছে, আর তার মায়ের হাতে কত সময় এসে পড়ল। সকালে ক্লাস থাকত অমিতার, দশটার মধ্যেই তার হাত খালি হয়ে যেত। সারা দিনটা ফাঁকা ফাঁকা ফাঁকা! ঘরে টিঁকতে পারে না। আজ তো এ কথা বলার কেউ নেই, ‘তুমি সারাদিন আমার সঙ্গেই থাকবে। আর কারোর সঙ্গে না মা। এই তো সারাদিন আমার ফাঁকা। কিন্তু আজ কোথায় যে তুই তোর সঙ্গে খেলা করব! আজ কোথায় তুই দুষ্টু ছেলে? অমিতা তুলনা করতে চাইল সেদিন আর এদিনের সঙ্গে। কোন সময়টা তাকে বেশি পীড়া দিয়েছে?এই দেখ, মন্টুর মা, খোকার চার বছর বয়সের ছবি। আর এটা ওর ছয় বছর বয়সের। এটা এটা ওর আট বছর বয়সের। তারপরেই তো চলে গেল কি না। আমার কাছ থেকে ওকে ওর বাবা নিয়ে চলে গেল। আমি তো শয়তানিটা বুঝতে পারিনি। একদিন রবিবার। তখন আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। বেশ খুশ মেজাজে এসে বলল, খোকা আমার সঙ্গে যাবি। একটা সার্কাস এসেছে। খোকা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, যাব মা? বাবা বলছে সার্কাস দেখাতে নিয়ে যাবে। আমি ভেবেছিলাম, খোকাকে ওর বাবা সার্কাস দেখিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে। বাপের যে এই সুবুদ্ধিটুকু হয়েছে, ভাবলাম এই ঢের। বললাম, যাবি বই কি, খোকা। সেই বেরিয়ে গেল খোকা, আমার বাড়ি থেকে। সেদিন রাতেই লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল সমীরেন্দ্র, খোকা আমার সঙ্গে কয়েকটা দিন থাকতে চাইছে। আমি ওকে রেখে দিচ্ছি। চিন্তা কর না। খোকারও একটা চিঠি এসেছিল ওই সঙ্গে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। মা তুমি চিন্তা করিয়ো না। সুনন্দন। এক ছত্রের চিঠি। মাকে লেখা ছেলের ওই প্রথম চিঠি। অমিতা হাতড়াতে লাগল। চিঠিখানা ফটোর বাক্সে পেল না। অন্য কোথাও আছে হয়ত। খোকার ফটোগুলো একটা একটা করে বাক্সের মধ্যে রেখে দিতে দিতে আরেকটা ছবি টেনে বের করল তার মধ্য থেকে। এটাও খোকার। খোকা তখন মাস চারেকের। চোখ বুজে তার মাই চুষছে। আবেশে ভরে এসেছে অম্লিতার চোখের পাতা। ‘দেখ, ঠিক একটা ম্যাডোনার মুখ।’ পৃথ্বীশ, পাগলা পৃথ্বীশ, আর্টিস্ট পৃথ্বীশ, তার অন্তরঙ্গ বন্ধু পৃথ্বীশ, এই ফটোটা তুলেছিল। কিছুতেই মাইয়ের কাপড় খুলবে না অমিতা। না এটা ঠিক হবে না, তুমি বদ্ধ পাগল পৃথ্বীশ, পাগল ছাড়া এমন প্রস্তাব কেউ করে!
প্লিজ অমিতা প্লিজ, তুমি তো তোমার খোকাকে দুধ খাওয়াচ্ছই, তোমার স্তনটাকে আরেকটু এক্সপোজ করে দাও, কাপড়টা আর একটু তুলে দাও প্লিজ। তারপর ভুলে যাও, স্রেফ ভুলে যাও যে এখানে কেউ আছে। আমি কয়েকটা এক্সপোজার নিয়ে নিই।’
নাছোড় পৃথ্বীশ, একটা পুরো রোল ওর আর খোকার উপর খরচ করেছিল সেদিন। যেদিন পৃথ্বীশ প্রিন্টগুলো নিয়ে এল, অমিতা সত্যিই অবাক হয়ে গিয়েছিল পৃথ্বীশের কাজ দেখে। ‘কলকাতার যশোদা’। পৃথ্বীশ অমিতার সামনে প্রিন্টগুলো একটা একটা করে দেখাতে দেখাতে বলেছিল, ‘এই মুখটাকে ভাল করে চেয়ে দেখ অমিতা, এই মুখে যে আবেশ ফুটে উঠেছে, এটা কোনও রমণীর আসঙ্গলিপ্সাজনিত কোনও আবেশ নয়, এ আবেশ স্রেফ যৌনতারও নয়, এই আবেশ কেবল স্তন্যদাত্রী মায়ের মুখেই ফুটে উঠতে পারে, এটা একটা আদিম ফিলিং, দেখেছ কতগুলো ফিলিংস এর সঙ্গে কাজ করছে তোমার মুখে? তোমার ছেলে কচি মুখটা দিয়ে তোমার নিপ্প্লটা চুষছে, এতে একটা ফিজিক্যাল সেনসেশন তুমি পাচ্ছ অমিতা, এটা অ্যানিম্যাল সেনসেশন। কিন্তু এটাই তো সব নয়, তোমার স্মৃতিও সঙ্গে সঙ্গে কাজ করছে অমিতা। গর্ভযন্ত্রণার সেই অবিস্মরণীয় স্মৃতি, যা কি না মেয়েদেরই নিতান্ত একটা অনুভূতি, ভয় প্রচণ্ড ভয় অমিতা, জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে নবজাতক, জরায়ু ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে, নাড়ির টানের সেই ভয়াবহ যন্ত্রণার অভিজ্ঞতা মায়ের সুখানুভূতিতে মিশে থাকে বলেই বাৎসল্য এত সুন্দর, এই ফিলিংস, সেদিন তোমার ছেলেকে দুধ খাওয়াতে গিয়ে এমন সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছিল তোমার চোখে মুখে যে, আমার মনে হয়েছিল এই রেয়ার মোমেন্টগুলো আমি ধরে রাখতে না পারি তবে আমি মরেই যার। ভাগ্যি তুমি রাজি হয়েছিলে!’
অমিতার ভাল লেগেছিল পৃথ্বীশের বাৎসল্যের ব্যাখ্যা। পাগল, বদ্ধ পাগল ছিল পৃথ্বীশ। ও ছিল চিত্রকর। কিন্তু অ্যামেচার ফটোগ্রাফিতে ওর বেশ নাম ছিল। পৃথ্বীশের ‘কলকাতার যশোদা’ সেবারই অ্যামেচার ফটোগ্রাফার্স গিল্ডের বার্ষিক প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু তার দু’মাস আগেই পৃথ্বীশ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে আত্মহত্যা করেছিল। গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছিল সিলিং থেকে। পায়ের কাছে একটা নোট, ‘যতদিন বাঁচব, এ বিরহযন্ত্রণার আর শেষ হবে না। জানি। তাই এইখানেই দাঁড়ি টেনে দিলাম।’ এই চিরকুট কার উদ্দেশে লেখা অমিতা ভালই জানত। কিন্তু কাউকেই বলতে পারেনি সেকথা। উঃ কী যন্ত্রণা! পৃথ্বীশ কতদিন তাদের বেনেটোলার বাসায় এসে তার কত কাজ করে দিয়েছে! উনুন ধরিয়ে দিত। ভাতের ফেন গেলে দিত। বা অমিতা যখন রান্নাবান্না করত, কোনও কিছুর অভাব পড়ে গেল চট করে সেটা কিনে এনে দিত। কখনও জিরে কখনও খানিকটা তেল কখনও আটা। কয়েকবার বাড়ি ভাড়ার টাকাও, জোগাড় করে এনে দিয়েছে পৃথ্বীশ। পৃথ্বীশের এমনিতে রোজগার-পাতি তেমন ভাল ছিল না। অমিতা জানে, তার জন্য পৃথ্বীশ কয়েকবার কয়েকটা ভাল ছবি জলের দরে বিক্রি করে দিয়েছে। একবার তো পৃথ্বীশের ছবি বেচা টাকায় খোকার জীবন ফিরে পাওয়া গিয়েছিল। ‘কলকাতার যশোদা’ কেমন বিবর্ণ হয়ে এসেছে। হবে না? সে কি আজকের কথা! বছর চল্লিশ তো পার হয়ে গেল।
খোকা গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছিল, ‘তুমি চিন্তা করিয়ো না।
চিন্তা করিয়ো না। জরায়ুর বাঁধন ছিড়ে যাবার যন্ত্রণা তুই কিছু বুঝিস, হতভাগা! কখনও বুঝতে পারবি?
ছবির বাক্সের ভিতরে ‘কলকাতার যশোদা’কে উল্টে রেখে দিল অমিতা। তারপর গলার স্বর পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, এটা আমার মেয়ে মন্টুর মা। বিন্তি। ভাল নাম বিনতা। কিন্তু বিন্তি আমার দেওয়া নাম। বিন্তি খেলতে খেলতেই আমার ব্যথা ওঠে। সেইদিনই অনেক রাতে বিন্তি আমার কোলে আসে।
বিস্তির ছবি বেশি নেই। পৃথ্বীশ ছিল না তো তখন? যোগীরও ফটো তোলার শখ ছিল না। তবুও টুকটাক করে বিস্তির কয়েকটা ছবি জমে গিয়েছে অমিতার কাছে। এটা বিন্তির পাঁচ বছরের ফটো। সরু টিং টিং করছে হাত পা। ওর বাপের গায়ের রঙ পেয়েছে বিস্তি। অনেকদিন পর্যন্ত বাপসোহাগী ছিল। অথচ যোগী চেয়েছিল একটা ছেলে হোক। এই ছবিটা বিন্তি আর যোগীর। ওরা চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল যোগীর বন্ধু পরিবারের সঙ্গে। সেখানে ছবিটা তোলা। বিন্তি ভয়ে ভয়ে একটা হরিণছানার মুখে কি একটা দিতে যাচ্ছে বা হরিণছানাকে ছুঁতে যাচ্ছে। বড্ড ভীতু ছিল বিন্তি। ওর বাবুজি ছাড়া কারোর সঙ্গে বিশেষ মিশত টিশত না। বাইরের কেউ বাড়িতে এলে টুক করে ঘরে ঢুকে যেত বিন্তি। আর থেকে থেকেই অসুখে ভুগত। জন্ম থেকেই অসুখে ভুগেছে। তবে বিন্তির বেলায় ওদের সংসারে সচ্ছলতা এসেছিল। যোগমায়া ছেড়ে অমিতা শিক্ষা দফতরে ছোটখাট একটা অফিসার হয়ে গিয়েছিল। যোগী তখন নোট লিখে ঘরে দু’পয়সা আনছে।
১২
টেলিফোন বেজে উঠতেই প্রচণ্ড চমকে উঠল অমিতা। তার বুকটা ধকধক করতে লাগল। ফোনট তুলে বলল, হ্যালো!
‘অমিতা আছেন?’
হ্যাঁ, আমি অমিতা বলছি?
‘অমিতাদি? আমি সুনীতা? চিনতে পারছেন?
সুনীতা! না, চিনতে পারছিনে। রাগ হল নিজের ওপর অমিতার।
‘চিনবেন কি করে? মনে থাকার কথা নয়? আমি সালকের ইশকুলে আপনার কাছে পড়েছি। সে তো গত জীবনের কথা! ‘
সালকের ইশকুল? মানে তুমি, তুমিই বলছি ভাই, কিছু মনে করো না, সালকেয় মনোরমা গড়াই মহিলা বিদ্যানিকেতনের ছাত্রী ছিলে?
‘হ্যাঁ অমিতাদি। মনে করতে পারছেন?’
ইশকুলটার কথা আমার মনে তো থাকবেই। কিন্তু ছাত্রীদের কথা এই বয়সে কি আর মনে রাখা সম্ভব?
শরীরটার হাল্কাভাব দ্রুত কেটে যাচ্ছে অমিতার। মনে একটা বিরক্তি এসে চেপে বসছে। শুতে পারলে অমিতা বাঁচে। কিন্তু ফোনটা সে ছাড়তেও পারছে না। কেউ একজন তো কথা কইছে তার সঙ্গে।
‘শুনলাম আপনার শরীর খারাপ। তা এখন কেমন আছেন?’
ইশকুলের পুরনো ছাত্রীর মনে তার শিক্ষিকার জন্য মাই টনটন করে উঠল হঠাৎ, এ পৃথিবীতে এমন ঘটনা তো ঘটে না।
ওই চলে যাচ্ছে আর কি। কোনও রকমে দিনটা কেটে যাচ্ছে। এই বয়সে এই ধরনের কথাই তো লোকে বলে। তাই না? আমি সে কথা বলিনে। আমি বলি, শৃণ্বন্তু, আমরা অমৃতের পুত্রপুত্রী, আমরা ভালই থাকি।
কতক্ষণ আর ন্যাকামি করবে মেয়েটা? কেনই বা ফোন করছে?
‘অমিতাদি, আমাদের ইশকুলের ষাট বছর পূর্তি হচ্ছে। আমাকে সেই উৎসব কমিটির সেক্রেটারি করেছে সবাই ধরে বেঁধে। আপনারা সেই আমলের মাত্র পাঁচ জন শিক্ষিকা জীবিত আছেন। আর আমাদের সেই ক্লার্ক স্যারও বেঁচে আছেন। আমাদের ইচ্ছা, ইশকুল কমিটি আপনদের সম্বর্ধনা জানাবে। আপনাদের সবাইকে আমরা সেই উৎসবের দিনে টেনে আনব অমিতাদি, আপনাকে আসতে হবে। আপনাকে বিশেষভাবে সংম্বর্ধনা জানাব আমরা, অমিতাদি আপনি ওই ইশকুলের শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, শুধু সেই কারণেই নয়, আপনি পরবর্তীকালে যখন শিক্ষাবিভাগে কাজ করেছেন, তখন এই ইশকুলের উন্নয়নের জন্য যা করেছেন, ইশকুল আজও তা ভোলেনি? আমাদের ইশকুলে আপনার একটা স্পেশাল পজিশন আছে।’
অমিতা ভাবল, এটা কার ন্যাকামি? তার ভাগ্যই কি তাকে নিয়ে বারবার এই ন্যাকামি করে যাচ্ছে না!
হ্যালো, সুনীতা, আমার আর আজকাল, কোনও ঝামেলা ভাল লাগে না। বয়স হয়েছে তো!
‘অমিতাদি, ইশকুলের রেকর্ড আমার কাছে আছে। তদনুযায়ী আপনার বয়স এখন ৬৩ বছর ৮ মাস ১৩ দিন, যদি না আপনি বয়সে কারচুপি সে সময়ে করে থাকেন।’
অমিতা খপ করে রেগে উঠেছিল আচমকা এই কথা শুনে। কিন্তু পরক্ষণেই সে সুনীতার গলার আওয়াজে রসিকতার আভাস পেয়ে হেসে ফেলল। মুহূর্তেই অন্তরঙ্গতা জন্মে গেল সুনীতার সঙ্গে।
হ্যালো সুনীতা, তুমি কত বছরে এম এ পরীক্ষা দিয়েছ? আমি ২৩ বছরে এম এ পরীক্ষায় পাশ করে গিয়েছি। মানে এম এ পরীক্ষায় বসেছিলাম ২২ বছর ৫ মাস। সরি দিনের হিসাবটা দিতে পারছিনে। মনে নেই।
‘অমিতাদি, হ্যালো অমিতাদি, হ্যাঁ এম এ-টা আমার আর দেওয়া হল কই? বি এ পড়ার পরই তো বর জুটে গেল। বসে পড়লাম বিয়ের পিড়িতে।
যে মিস্টার তোমাকে অনুগ্রহ করলেন, তাঁর বুঝি আর তর সইছিল না!
‘ঠিকই ধরেছেন অমিতাদি, তাঁর তর সইছিল না। কেন না, তিনি ডাক্তারি পড়তে বিলেত যাবেন। তার আগে আমাকে বগলদাবা করে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।’ সুনীতার স্বর কি একটু ভারী ঠেকল
সুনীতা চাপা গলায় যেন কার সঙ্গে কথা বলছিল। অমিতা শুনতে পাচ্ছিল কে যেন কচিগলায় তার সঙ্গে কথা বলবে বলে বায়না ধরেছে।
ও কে কথা বলছে সুনীতা? তোমার নাতি?
‘ওমা, আপনি শুনতে পেয়েছেন? এত জ্বালায় না! কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলবার উপায় নেই। নাতি নয়, অমিতাদি বিচ্ছু আমার নাতনি। ছেলের মেয়ে। দাঁড়াও এখন বিরক্ত কর না দিদি, আমি আর এক দিদার সঙ্গে কথা বলছি। আমার কথা হয়ে যাক, তখন তুমি ওই দিদার সঙ্গে কথা বলো কেমন?’
হ্যাঁ, যা বলছিলাম অমিতাদি, কী কষ্টে যে আপনার টেলিফোনের পাত্তা পেয়েছি! সুরমাদিকে আপনার মনে আছে তো অমিতাদি?’
মনে থাকবে না আবার? আমরা প্রায় এক সঙ্গেই মনোরমা গড়াই মহিলা বিদ্যানিকেতনে ঢুকি। আমি মাস দুয়েক আগে, সুরমা তার পরে। সুরমা সান্যাল। সে ওই বয়সেই বিধবা হয়েছিল। সুরমা বেঁচে আছে? কোথায় আছে সুরমা?
‘আহ্ বিচ্ছু, বিরক্ত কর না দিদি, কথাটা বলে নিই, তার পরে তুমি কথা বলো। অসভ্যতা করে না ছিঃ।’
তোমার নাতনি কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে সুনীতা? তা দাও না?
‘আপনি ওকে জানেন না অমিতাদি, ও আপনাকে জ্বালাতন করে ছাড়বে।’
ছাডুক, আমাকে কেউ তো জ্বালাতন করে না। করলই বা তোমার নাতনি। তুমি ওকে ফোনটা দাও একবারটি। ছেলেমানুষ, দেখো একটু পরেই ভুলে যাবে। এক খেলা ওরা অনেকক্ষণ ধরে চালাতে পারে না।
‘তক্ষনি একটা কচি কচি গলা টেলিফোনে ভেসে উঠল। ‘হ্যালো, এটা কি লং লাম্বার।
অমিতা বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তুমি কে?
‘আমি একটা বাঘ। হালুম!’
অ্যাঁ তুমি বাঘ! ওরে বাপরে! আমি ভয় পেয়ে গিয়েছি দিদু।
‘হালুম। আমি কিন্তু কামড়ে দিই জানো। সেদিন দুটো হলিণকে না, খেয়ে ফেলেছি। আমার দাঁত
আছে কিন্তু। দাঁত আছে। সাবধান। তোমাদের বাড়ি বিড়াল আছে?’
বিড়াল তো নেই দিদু। ইঁদুর আছে। আর একটা ধেড়ে বুড়ি আছে।
‘বুড়িটা কি কামড়ায়?’
না তো। বুড়ির কি তোমার মতো দাঁত আছে যে, বুড়ি কাউকে কামড়াতে পারে।
যে বিরক্তি একটু আগেও অমিতাকে ধীরে ধীরে ছেয়ে ধরেছিল, অমিতা টের পেল, তার সে বিরক্তি কোথায় সরে গিয়েছে। ওর মনে কেমন উৎসাহ জেগে উঠেছে।
‘বুড়ির দাঁত নেই তো বুড়ি খায় কেমল কলে? আমি কিন্তু দুধ খাইনে। আমি পান খাই। আমি পান খাই আর আমাল দিদা পান খায়। তুমি পান খাও না তো। পান খায় না ছিঃ! পান খেলে দাঁত পড়ে যায়। দাঁতে পোকা হয়। তোমাল দাঁত পড়ে গিয়েছে?’
হ্যাঁ দিদু। আমার দাঁত পড়ে গিয়েছে। তোমার নাম আমাকে তো বললে না?
‘আমার নাম আলু কাবলি।’ কি অসভ্যতা হচ্ছে, নাম বলে দাও, দিদা জিজ্ঞাসা করলে নাম বলতে হয়।’
‘দিদা শুনছ তো? হ্যালো? এটা কি লং লমবর?
হ্যাঁ দিদি, এটা রং নম্বর। বুড়ির জীবনে এমন রং নম্বর এই প্রথম এল দিদু। এবার তোমার নামটা শুনিয়ে দাও তো লক্ষ্ম। মেয়ে? কি নাম তোমার?
‘বুলেট। আমার নাম বুলেট। বাবা বুলেট বলে। দিদা বলে বিচ্ছু। আমি কি দুষ্ট?’
না না। তোমাকে দুষ্টু কে বলে সোনা? তুমি তো লক্ষ্মী মেয়ে।
‘শোনো না, আমাল অনেক নাম। বাঘ আমাকে দেখে ভয় পায় জানো। আমি না বাঘের লেজ কেটে দিয়েছি। আমি সুন্দলবনে গিয়েছিলাম। বাবা গিয়েছিল মা গিয়েছিল। মাইতি দাদা নৌকো চালাচ্ছিল। আমি কুমির দেখেছি। আমাকে দেখেই না কুমির, পাঁচটা কুমির পালিয়ে গেল। আমি যেই কটমট করে চেয়েছি অমনি ওরা পটাপট জলে ডুব দিয়েছিল। খালি একটা কুমির এই অ্যা ত্তো বড় কুমির এই অ্যা ত্তো বড় হাঁ করে আমাকে তাড়া করেছিল। কিন্তু আমি ভয় পাইনি। কেন বল তো?’
কেন দিদু তুমি ভয় পেলে না? ওটা কি ভাল কুমির ছিল?
‘না, কুমিরটা না বড্ড দুষ্টু। ও তো দুধ খায় না। কিচ্ছু খায় না। খালি ক্যাডবেরি খায়। কুমিরটা ঘুমোতেও চায় না। জানো দিদা, কুমিরটার দাঁত আবার এমনি দাঁত নয় কিন্তু। বাঁধানো দাঁত। দাঁত খুললেই কুমির ফোকলা হয়ে যায়। তুমি ফোকলা কুমির দেখেছ?’
না দিদু, আমি ফোকলা কুমির দেখিনি। দেখব কি করে আমি বাড়ি থেকে তো বের হতে পারিনে। তা কুমিরের দাঁত কে বাঁধিয়ে দিয়েছিল?
‘বারিন দাদু। কুমিরটা হাঁ করে আমাকে কামড়াতে এসেছে তো। কুমিরটা দুষ্টু তো। শুশুককে কামড়াতে গিয়েছে যেই, শুশুকটা বাচ্চা তো, টুপ্ করে জলে ডুবে কুমিরটার পেটে কাতুকাতু দিয়ে দিয়েছে আর অমনি কুমিরের দাঁত জলে পড়ে গিয়েছে। আর একটা পাখি না কুমিরটাকে ঠুকরে দিয়েছে। আর বারিনদাদু কুমিরের দাঁত নিয়ে চলে গিয়েছে।’
খুব জব্দ হয়েছে তো কুমিরটা!
সুনীতা ফোনটা কেড়ে নিয়েই বলল, যাও অনেক জ্বালাতন করেছো, এখন ভাগো। শুনলেন তো অমিতাদি। জ্বালিয়ে মারে দিনরাত। কথা কইতে দেয় না। ওর গল্পের আর শেষ নেই।
সুনীতা দেখতে পেল না, মন্টুর মা ঘরে ঢুকে দেখল, অমিতার মুখটা থমথম করছে, আর ওর চোখের কোনায় জল টলটল করছে।
‘সুরমাদিই আপনার পুরনো অফিসের ঠিকানাটা দিলেন। তারই সূত্র ধরে আপনাকে ফোনে আজ পেলাম।’
সুরমা জিওগ্রাফি পড়াত।
সুরমা এখন কোথায় থাকে বলতে পারো?
‘সুরমাদি বৈষ্ণবঘাটায় থাকেন এখন। সুরমাদি বুড়ো বয়েসে বিয়ে করেছেন অমিতাদি। ওঁর স্বামী হরনাথ দাস। সুরমাদির পাশাপাশি বাড়িতে থাকতেন। সে এক অদ্ভুত রোমাণ্টিক কাহিনী অমিতাদি। সুরমাদি শোনালেন। ভদ্রলোক সুরমাদির বয়সীই হবেন। কিন্তু বেশ শক্ত-সমর্থ। রিটায়ার্ড মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার। ব্রাহ্মসমাজের লোক। সুরমাদি বেশ মজা করে বলেন ওর বিয়ের গল্প। বলেন, এটা মেঘদূতের গল্প নয়, বাস-দূতের গল্প। পর পর দুদিন নাকি ওঁরা এক বাসে করে বাজার করতে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন আবার এক বাসে করে ফিরছিলেনও। একদিন হরনাথ সুরমাদির বাড়িতে এলেন সকালবেলায়। বললেন, আমি আপনার প্রতিবেশী, ঠিক গায়ে লাগানো বাড়ি। আমি দেখেছি আপনি একলাই থাকেন। আমিও একাই থাকি। আপনার কেসটা কি? সংসারে কেউ আছে টাছে? না, আপনি আর কপনি? সুরমাদি ভদ্দরলোকের কথাবার্তার ধরনধারণ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, না, বিশেষ কেউ নেই। ভদ্দরলোক বললেন, তবে তো আমরা বিয়ে করতে পারি। বুড়ো বয়সেই সঙ্গীর অভাব বেশি বেশি বোধ হয়। আমার তো হয়। আপনার হয় না? সুরমাদি বললেন, হয় বই কি? হরনাথবাবু আর সুরমাদি নাকি একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। সুরমাদি বললেন, ওই সময়ের মধ্যেই ঠিক করে ফেললাম, আমি বিয়ে করব একে। হরনাথ বললেন, তবে বৃথা কালক্ষয় করে লাভ কি? আসুন, বিয়ে করে ফেলি। চলুন আজই রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে নোটিস দিয়ে আসা যাক। সুরমাদি বললেন, ব্যাস, এক মাস পরে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল।
ওরা বেশ ভালই আছে কি বল?
‘হ্যাঁ অমিতাদি, ওঁরা দুজনেই স্বাধীন আবার একে অপরের উপর বেশ নির্ভরশীল। আচ্ছা কৃষ্ণাদিকে আপনার মনে আছে অমিতাদি? ওঁর বয়স এখন আশি।’
যে কৃষ্ণাদি অঙ্ক পড়াতেন? মনে আছে বই কি? আচ্ছা তুমি কি আমার কাছে পড়েছ কখনও?
আপনি ক্লাস সেভেনে আমাদের ক্লাস টিচার ছিলেন অমিতাদি।’
সুনীতা, নাম সুনীতা বললে না? সুনীতা সুনীতা
‘আপনি মাঝে মাঝে আপনার ছেলেকে ইশকুলে নিয়ে যেতেন অমিতাদি, মনে আছে, আমি তখন টিফিন পিরিয়ডে তার সঙ্গে খুব খেলতাম। দিদি সেজে তার উপর খুব মোড়লি—’
আচ্ছা! তাই বল? সুনীতা পাইন। তাই না?
‘হ্যাঁ, অমিতাদি। আপনার মনে পড়েছে?’
কি কালো কোলো মেয়েটা, এক মাথা কোঁকড়ানো চুল, বুদ্ধি ফুটে বের হত জ্বলজ্বলে দুটো চোখ দিয়ে। সুনীতা। মনে পড়েছে। সুনীতা। তুমি সেই সুনীতা! তুমি তো দাঁত দিয়ে পেনসিল ছুলতে?
‘হ্যাঁ, অমিতাদি। এত মনে আছে আপনার?
তোমার জ্যেঠামশাই আমাদের ইশকুলের সেক্রেটারি ছিলেন। হরসুন্দর পাইন। তিনি বেঁচে আছেন কি সুনীতা?
‘না অমিতাদি। তিনি অনেকদিন গত হয়েছেন। আচ্ছা আপনার সেই ছেলে কোথায় এখন, যার সঙ্গে আমি ভাইফোঁটা ভাই ফোঁটা খেলতাম। কোথায় সে? কি করছে?’
সুনন্দন এখন ওহাইওতে থাকে। ওর ছেলেমেয়ে সবই ওখানে। তুমি আর কাকে কাকে খুঁজে বের করতে পেরেছ সুনীতা, আমার মতো কজনের খোঁজ পেয়েছ?
‘পাঁচ জনকে পেয়েছি। আপনাদের মধ্যে সব চাইতে সিনিয়র এখন যিনি বেঁচে আছেন তিনি কৃষ্ণাদি। ছেলের কাছে বারাকপুরে থাকেন। তাঁকে পাওয়া যাবে। হিরণ্ময়ীদির ঠিকানা পাইনি।’
উনি কি বেঁচে আছেন? দশ পনেরো বছর আগে, ওঁকে একবার দেখেছিলাম। কোচবিহারে, ওঁর ছেলে তখন সেখানকার এস ডি ও। সেই তখনই উনি খুব অথর্ব হয়ে পড়েছেন। কিন্তু তোমাদের ইশকুলটাকে উনি ভোলেননি।
‘সে তো আপনিও ভোলেননি অমিতাদি। আপনি ইশকুল ছেড়ে কলেজে যোগ দিলেন। পরে শিক্ষা বিভাগে, সরকারি চাকরিতে ঢুকলেন। কিন্তু তবু তো আপনি ভুলে যাননি। ইশকুল এত বড় হয়েছে আজ, ওই ইশকুল উচ্চ মাধ্যমিকে উঠে এসেছে, এ আপনার সহায়তা ছাড়া হতে পারত? কত গ্র্যান্ট আদায়ের পিছনে যে আপনার সহায়তা আছে, সে কথা জ্যেঠামশাই জনে জনে বলে গিয়েছেন। জ্যেঠামশাইয়ের কাজ তোমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে, সুনীতা। এই বলে জয়ন্তী উৎসব প্রস্তুতি কমিটির মধ্যে সবাই আমাকে ভিড়িয়ে দিলে। আমি এখন লিস্ট দেখে দেখে আপনাদের খুঁজে বেড়াচ্ছি।’
সুনীতা টেলিফোন ছেড়ে দেবার পর অমিতার মনে হল, তাই তো সুনীতার নম্বরটা তো রেখে দেওয়া হল না। ইশ্। খুব ভুল হয়ে গেল। পশ্চিমের জানালা দিয়ে রোদ আসব আসব করছে।একটা বেজে গিয়েছে!
মন্টুর মায়েরও স্নান সারা হয়ে গিয়েছে। এখানেই আজ চানটা সেরে নিল মন্টুর মা। অন্য দিন অন্য বাড়িতে কাজ থাকে বলে দুপুরের কাজ ভাল করে না সেরেই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় মারে। আজ তার কাজকর্ম ঠায় লয়ে চলছে। এখন খাবে অমিতা। সকালের খাবার খাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে ক্ষিধে পাচ্ছিল না। খোকার ছবিগুলো দেখতে দেখতে শরীরে কেমন কষ্ট পাচ্ছিল অমিতা। সেই সঙ্গে জ্বরটাও তার অস্বস্তিটা বাড়িয়ে তুলেছিল। সুনীতার টেলিফোন তার সারাদিনের রঙটাই বদলে দিয়ে গেল যেন। মনোরমা গড়াই মহিলা বিদ্যানিকেতন! সে তো গত জীবনের স্বপ্ন! সুরমা সান্যাল। ভূগোল পড়াত। তার ন বছরের সহকর্মী সে। সে কি না বিয়ে করেছে! কত আশ্চর্য ঘটনাই না ঘটে! সুরমার কথা মনে হলেই একটা শান্ত মুখশ্রী মনে পড়ে। তার এখন কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে। খিদে পেতে চায় না আজকাল। পেটটা সব সময় দম ধরে থাকে। সুরমা বিয়ে করেছে! বুড়ো বয়সে! বুড়ো বয়সের বিয়ে। ঠিকই তো করেছে সুরমা। এখন তাকে একা থাকতে হবে না। রাতে ভয় দেখে ঘুম ভেঙে উঠলে হাতের কাছে একটা উষ্ণ শরীর পাবে। মন্টুর মা কোথায় গেল? একবার ভাবল ডাকে। কিন্তু কেমন একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল সুনীতার আচমকা ফোনটা পাবার পর, এক ঝলক হাওয়া যেন ঢুকে গিয়েছিল বদ্ধ ঘরে। অমিতা ডাকল না মন্টুর মাকে। কৃষ্ণাদি? কৃষ্ণাদি তাদের অনেক সিনিয়র ছিলেন। এবং খুবই কোয়ালিফায়েড। এম. এ আবার বি. টি। তবুও যখন হেডমিস্ট্রেসের ভ্যাকান্সি হল, উনি শত অনুরোধেও সেই পদে যেতে চাইলেন না। এমন লোক সংসারে কটা পাওয়া যায়! কৃষ্ণাদির এক কথা, ‘হেডের দায়িত্ব অনেক। অনেক সময় দিতে হয় ইশকুলের পিছনে। আমার অত সময় নেই। আমাকে ছেলে মানুষ করতে হবে। এটাই আমার জীবনের প্রথম এবং প্রধান কাজ আমার কাছে।’
মন্টুর মা ছাত থেকে চুল শুকিয়ে এসেই বলল, ‘কি গো মা, খাবেনি? আজও কি পাকা হত্তুকি খেয়ে বসে আছ?’
অমিতা বলল, দাও না, খাবারটা দিয়ে দাও। অমিতা খাবার টেবিলে গিয়ে বসল। যে দু-একবার অপারগ হয়ে ইশকুলে খোকাকে নিয়ে যেতে হয়েছিল, সেই কবারই কৃষ্ণাদি সুরমা শান্তি, শান্তি অতি অল্প বয়সেই মারা গিয়েছে, তাদের অফ্ পিরিয়ডে খোকাকে খুব যত্ন করেছে। আর খোকাকে দেখাশুনো করতেন ওই ইশকুলের কেরানি জগবন্ধুবাবু। খোকাকে তিনি কত ছোট ছোট পেনসিল চক-পেনসিলের টুকরো দিয়ে ভুলিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে তাঁর টাইপ রাইটারের টুলটার উপর বসিয়ে রেখে দিতেন। হ্যাঁ, আর সুনীতা, সুনীতা টিফিন হলেই এসে বলত, সুনন্দনকে নিয়ে একবার যাব অমিতাদি? আমরা খেলব। সুনীতা হত খোকার দিদি। আর ভাইফোঁটা দিত। ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা। বলেই খোকার কপালে ভুসো কালির টিপ পরিয়ে দিত। অমিতা ক্লাস শেষ হলে দেখত, খোকা কেরানিবাবুর টেবিলে বসে আছে। তার সারা মুখে কপালে ফোঁটায় মাখামাখি। খোকাকে ইশকুলের ঝি বকুলবালা রোজই ধুইয়ে জামাপোশাক ছাড়িয়ে বাড়ি ফেরার সময় ভদ্রস্থ করে তুলত।
১৩
চুপ করে আছিস কেন বিন্তি, মুখটা গোঁজ করে?
‘তোমার এ মেয়েটা মা, কি রোগা ছিল ছোটবেলায়? দেখলে মনে হয় বুঝি নিখাকির দেশ থেকে এয়েছে।’
না না মন্টুর মা, বিন্তি যখন আমাদের ঘরে এসেছে, তখন তো আমাদের খাওয়াপরার কোনও দুঃখই ছিল না। তবে বিন্তি বরাবরই খেতে চাইত না।
চুপ করে আছিস কেন বিন্তি, মুখটা গোঁজ করে? হাতের চেটোয় বিন্তির ফটো। অমিতা বিন্তির দিকে চেয়ে আছে।
‘বাচ্চারা যে কতরকম রোগে ভোগে মা, একমাত্র মায়েরাই সেটা বোঝে। মা হওয়া কি মুখের কতা?’
মা হওয়া কি মুখের কথা! শুনতে পাচ্ছিস বিন্তি, মন্টুর মা কি বলছে? বুঝতে পারছিস ওর কথার মানে? তোর এখন না বোঝার কথা নয়, কিন্তু বিন্তি। তুইও তো মা হয়েছিস?
‘শাড়িটা কেমন করে পরেছে গো মা। ঠিক যেন পুতুলপারা।’
মেয়ে যে তখন ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে সদ্য। এই যে ছবিটা দেখছ, সেইদিনই বোধ হয় শাড়িটা পরে এসেছে ওর বন্ধুর বাড়ি থেকে। সেই বন্ধুর নাম বোধ হয় রূপু, রূপালি। ফটোটাও রূপালির দাদার তোলা। বিন্তির বয়স তেরো পেরিয়ে তখন চোদ্দোয় পা দিচ্ছে কি দিচ্ছে না। অমিতার যে এই দিনগুলোর কথা মনে আছে এমনভাবে তার একটা কারণ আছে। এই সময়েই বিন্তি অমিতার খুব কাছে এসে গিয়েছিল।
জানো মন্টুর মা, বিন্তি আমার কাছে শাড়ি পরতে চাইত না। ওর শিক্ষাদাতা ছিল রূপা। আমাকে বলত কি মন্টুর মা জানো, বলত মা তুমি রূপুর মতো শাড়ি পরাতে পার না। তুমি এমন করে শাড়ি পরাও যে আমার পায়ে জড়িয়ে যায়। শুনেছ মেয়ের কথা?
‘ওরা মা অমনিধারা। ওদের কি আর বোধভাষ্যি আছে? আমার ছবিও অমনিধারা ছিল মা। পেরায় ওই বয়সীই হবে। তা ভগমান লিয়ে লিলেন। তা আর কি করব? কপাল!’
তোমার ছবির কি হয়েছিল মন্টুর মা? কি রোগে মরল ছবি?
‘বালাই ষাট! ছবি মরতে যাবে কোন দুখকে মা?’
তুমি যে বললে, ভগবানে নিয়ে নিলেন ছবিকে।
‘ও তুমি বুঝি তাই ভেবেছো? না না আমার ছবি মরে লাই। সে ভগমানের ভোগে নেগেছে গো মা।’
ভগবানের ভোগে লেগেছে?
‘তান্ত্রিকটা তো তাই বলেছিল। মন্টুর বাপের সঙ্গে হুট করে একদিন আমাদের ঘরে এল। মন্টুর তখন জন্ম হয় লাই। ঢেঁপি তখন আমার পেটে। ছবি তখন ঠিক তোমার মেয়ের বয়সী। কেবলই শাড়ি পরবে। কেবলই শাড়ি পরবে। আমাদের ঘরে কি অত শাড়ি থাকে মা? এই লিয়ে অশান্তি চলছিল। বাবুদের বাড়ি থেকে কাজ চুকিয়ে ভিজে শাড়ি পরে ফিরেছি, দেখি লবাবের বিটি আমার শাড়িটা পরে খেলা করছে। কার মেজাজ ভাল থাকে বল? কতদিন ওকে মেরে ওর কাছ থেকে শাড়িটা ছিনিয়ে লিয়েছি। আহা শাড়ি পরলে ছবিকে ভাল দেখাত গো। যেন কত্ত বড়টি। কত নোকের লজর যে ওর উপরে ছিল মা। ভালই হয়েছে ভগমানের ভোগে লেগেছে। কোত্থেকে তান্ত্রিকটাকে লিয়ে এসেছিল মুখপোড়া মন্টুর বাপ। মন্টুর বাপ খুব মদ গিলে এসেছিল সেদিন। কপালে সিঁদুর মাখা। গলায় পরতে পরতে জবাফুলের মালা। মন্টুর বাপ বললে, তান্ত্রিকবাবাকে খুব সেবা করবি, খুব মান্যি করবি। ও হল কাঁচা থেকো দেবতা। পান থেকে চুন খসলেই ভস্ম করে। এই মাগি, যা ঘরদোর সাফ কর। তান্ত্রিকবাবা যজ্ঞ করবে আমাদের ঘরে। আমি সবাইকে খপর দিই। তান্ত্রিকটাকে কি দেখতে গো। এই বড় বড় চোখ, নাল টকটক করছে। ভাঁটার মত বন বন করে ঘুরছে। আমার দিকে কটমট করে চাইছে দেখে আমি তো মা ডরে সেঁদিয়ে গিয়েছি নিজের মধ্যে। মুখের বাক্যি শুকিয়ে গিয়েছে আমার। আমাকে দেখেই মা সে কি হাঁকড়ানিটাই দিলে। বললে, অ্যাই মাগি, তোকে ভস্ম করে ফেলব। তোর এত বড় আস্পদ্দা তুই ভগবানের কনের গায়ে হাত তুলিস? আমি ব্যাগ্যাতা করে বননু মা, ঠাকুর, ও তো আমার ছবি? চোপ শালি! চোপা ভেঙে দেবে ত্রিশূল মেরে। ভগবতীকে মেরেছিস তুই। হারামজাদি! এখুনি তোকে অভিশাপ দেব। কেঁচো হয়ে থাকবি সারা জীবন। আবার বলে আমার ছবি! তোর বাবার ছবি, শা-লি। তোর মেয়ে তো সাক্ষাৎ ভগবতী। পাপ চক্ষে চিনবি কি করে! গজরানি থামে না গো মা। মন্টুর বাপ ঠাকুরের হাতে পায়ে ধরে সে যাত্ৰা আমাকে রক্ষে করেছিল গো। কি ফ্যাসাদ বল দিকি? গরিবের ঘরে বিপদ যে কতদিক দিয়ে ঢোকে কি বলব। সেই রাতেই আমাদের ঘরে তান্ত্রিকটা যজ্ঞ করল। সমস্ত বস্তি ভেঙে পড়েছিল মা। সবাই আমাকে বলতে শুরু করল, ছবির মা, গত জন্মে কত পুণ্যি করেছিলি, তাই এ জন্মে একেবারে ভগমানের শাশুড়ি হয়ে গেলি। রস্তির বাঁজা মেয়েগুলো আমার পা ধোয়া জল নিয়ে চলে গেল। চন্নামেত্য খাবে। কি হচ্ছিল আমি কিছু বুঝতেই পারিনি মা। লোক ভেঙে পড়েছে। আমাদের জিনিসপত্তর সব উঠোনে ডাঁই করা। ঘরটা গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে দিতে হয়েছিল। ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতরে তান্ত্রিক আর আমার ছবি। ড্যাংসা ড্যাডাং ড্যাংসা ড্যাডাং। তাসা পাটি কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। আর আমরা সবাই বাইরে দাঁইড়ে আছি। আমার বুকটা ঢিপ ঢিপ করতেচে গো মা। কেবলই ঢিপ ঢিপ করতেচে। সকলের চোখে মুখে কি হয় কি হয় ভাব। ভিতরে জোরে মন্তর পড়ছে তান্ত্ৰিক। মাঝে মাঝে আগুনের হলকা উঠছে ভিতর থেকে। মাঝ রাতে তান্ত্রিক শান্তিজল নিতে সকলকে ডাকল। শান্তিজল ছিটোবার পরেই তান্ত্রিক হাঁকাড় মারল, সবাই কপালে যজ্ঞির ভস্ম মেখে যে যার ঘরে চলে যা। এখন এ ঘরের দরজা বন্ধ হবে। আর সকালে খুলবে। কেউ যদি টু শব্দ করবি তো তার গলা দিয়ে তক্ষুনি ভক ভক করে রক্ত উঠে সে মরে যাবে। ছবি বেরুতে যাচ্ছিল। তান্ত্রিক তাকে খপ করে ধরে ফেলল। অ্যাই তুই কোথায় যাবি! কোত্থাও যাবিনে। খবরদার। যজ্ঞির ঠাঁইতে তোকে সারারাত শুয়ে থাকতে হবে। আঁচল পেতে এক কাপড়ে। তোর উপর আজ ভগবান ভর করবে। তান্ত্রিক আমার ছবিকে লিয়ে সেই ঘরে ঢুকে গেল। সকলেই সেখান থেকে চলে গেল মা। আমাকেও পই পই করে সবাই চলে যেতে বলেছিল। কিন্তু আমি তো মা, আমি কি করে যাই বল। অত বড় একটা দত্যির হাতে আমার ওইটুকুন ছবিকে তুলে দিয়ে। তাই আমি অন্ধকারে বারান্দার এক ঠাঁই বসেছিলাম। রাতে একবার ছবি কেঁতরে উঠেছিল মা। মা গো বলে ডাকও দিয়েছিল। তান্ত্রিক বললে, চোপ। কিন্তু আমি মা আবার তার কাতরানি শুনতে পেয়েছিলাম। কেবলই কাতরাচ্ছিল ছবি। সাপে ব্যাঙ ধরে গিলে ফেলতে থাকলে যে ধরনের যন্তন্না ব্যাঙের মুখ দিয়ে বার হতে থাকে সেই আওয়াজ গো মা। আমার ভয় হয়েছিল, তান্ত্রিক বুঝি আমার ছবিকে গিলতে নেগেছে। পরদিন সকালে তান্ত্রিক ঘোষণা করলে, পাঁচ দিন পরে এসে সে ছবিকে নিয়ে যাবে। ছবি এখন ভগমানের ভোগ। ওকে যত্নে রাখবি। তান্ত্রিক বেইরে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলাম মা। ছবির কাপড় রক্তে ভাসছে। ছবি আমাকে দেখেই মা বলে আমার শরীলে এলিয়ে পড়ল। সেই তান্ত্রিক আর আসেনি মা। ছবির বাপকে বলেছিল, ছবিকে তার আশ্রমে পৌঁছে দিতে। পাঁচ দিন পরে মন্টুর বাপই মেয়েকে তান্ত্রিকের হাতে তুলে দিয়ে এসেছিল। ছবিকে আর দেখিনি।
তুই তো সেদিন খুব ভয় পেয়েছিলি বিন্তি, তাই না? যেদিন ইশকুল থেকে ফিরে এলি মুখটা চুন করে? এসেই মাথা ঘুরছে বলে শুয়ে পড়লি। আমি তোর কপালে হাত দিয়ে দেখেছিলাম, জ্বর এসেছে কি না? তোর মনে পড়ে? বিকালে কিছুই খেলি না। রাতেও না। সব কিছুতেই তখন তোর বিরক্তি। তোর বাবা তোর গায়ে হাত দিতে গিয়েছিল। তুই একটানে হাতটা ছুঁড়ে ফেলে বলেছিলি যাও, তুমি যাও এখান থেকে। আমার কিছু হয়নি? তোর সেই অস্বাভাবিক ব্যবহারে তোর বাবা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। সব কিছুতেই তখন তোর আচমকা রাগ আর বিরক্তি।
‘ভগমানের দয়া গরিবদের ঘরেই এত বেশি বেশি পড়ে কেন বলতে পার মা? ভেবেছিনু আর একটু ডাগর হলে ছবিকে বিয়ে দিয়ে দেব। পাত্তরও ঠিক করে রেখেছিনু। গণেশ ভুজায়োলা। বয়সে একটু তফাত হত। গণেশের তখন তা ধর দু কুড়িটাক বয়স হয়েছে। তা হোক, দুশ টাকা নগদ দেবে বলেছিল। আর বিয়ের খরচ। ওর খুব পছন্দ হয়েছিল ছবিকে। তা দেখ তো মা, ছবি ভগমানের ভোগে নেগে গেল।
ওই তান্ত্রিকের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি মন্টুর মা?
‘কই আর গেল! গণেশ বলে, তোর মেয়ে পাচার হয়ে গিয়েছে। তা ও সত্যি বলে কি, মিথ্যে বলে, আমি মেয়েমানুষ, বাড়ি বাড়ি কাজ করে খাই মা, পান থেকে চুন খসলে আমার কাজ চলে যায়, আমি কোথায় যাব খপর নিতে!’
অমিতা বলতে চাইল, কি আসে যায় মন্টুর মা। আমার মেয়েকে তো আর কেউ কোথাও পাচার করেনি। তো কই, সে কি আমাকে চোখের দেখাটা দেখতে আসে?
বিন্তি, তুই সে রাতে কিন্তু একান্তভাবে আমারই মেয়ে হয়ে উঠেছিলি? মনে পড়ে না তোর? তোর মেয়েরও তো সেই বয়েসটা পার হয়েছে, যে বয়সে তুই ইশকুল থেকে এসে ছটফট করছিলি? প্রথম দিকে কাউকে তোর কাছে ঘেঁষতেই দিতে চাইছিলিনে? তোর মনে পড়ে বিন্তি সেই রাতটার কথা? মা ছাড়া তখন আর তোর গতি ছিল না। আমিও তোর সেই বয়সে আমার মাকেই আঁকড়ে ধরেছিলাম। বারো তেরো বছরটা মেয়েদের পক্ষে বড় ভয়ানক সময়। শুধু মেয়েরাই সেটা বোঝে। কিংবা বোঝে না। যেমন আমি বুঝিনি। আমার মা-সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিল। যেমন তুই বুঝিসনি। আমি তোকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। তোর মেয়ে তো বিজ্ঞানের জগতেই জন্ম নিয়েছে। তার কি তোকে দরকার হয়নি সেই ভয়ঙ্কর সময়ে? সেই বিভ্রান্তিকর সময়ে? হাঁ রে তোর কাছে এসে ভেঙে পড়েনি তোর মেয়ে?
অমিতার হাতের মুঠোয় তখনও বিন্তির ছবি। বিন্তি সবে শাড়ি ধরেছে।
‘আমার মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো মা, আমার ছবি যদি সাত তাড়াতাড়ি শাড়ি পরতে না যেত, তাহলে ওর উপর ভগমানের লজর পড়তনি। কপাল গো মা, সবাই কপাল।’
তুই কিন্তু সেই রাতে এসে আমার ঘরে টোকা দিয়েছিলি। হাঁ রে, তোর সে সব একটুও মনে পড়ে না? একদিনও না? এক মুহূর্তের জন্যও মনে পড়ে না বিন্তি?
অমিতা ছবিটার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অমিতার বুকের ভিতর যন্ত্রণা হতে শুরু করল। বুকে, না কি জরায়ুতে? কোথায় ব্যথা অমিতার? ঠিক বুঝতে পারছিল না সে। অমিতার কানে বাজছে তখন, ঠক ঠক ঠক। দরজায় কে যেন টোকা দিচ্ছে। অমিতার কানে তখন বাজছে, একটা অস্পষ্ট চাপা আওয়াজ। মা মা মা। না কি অমিতা তখন শুনছে আর একটা আওয়াজ। যেমন চাপা তেমনি জরুরি। নার্স নার্স নার্স! মা মা মা! নার্স নার্স নার্স! ঠক ঠক ঠক। তুই যেমন সেই রাতে ভয় পেয়ে উঠে এসেছিলি আমার ঘরে। আমার অপারেশনের পাঁচ কি ছয় দিন পরে আমিও তেমনি ভয় পেয়েছিলাম বিন্তি। তবুও তো তুই তোর মাকে কাছে পেয়েছিলি। আমি দরজা খুলেই দেখি তুই। হ্যাঁ বিস্তি তুই দাঁড়িয়ে আছিস। তোর সেই সেদিনের চোখমুখ দেখেই বুঝেছিলাম, কি সাংঘাতিক ভয় তুই পেয়েছিলি। আমাকে দেখেই মরিয়া হয়ে তুই দু’হাতে জড়িয়ে ধরলি। তারপর টানতে টানতে আমাকে তোর শোবার ঘরে নিয়ে এসেছিলি। তোর এ সব কথা মনে পড়ে না বিন্তি? তুই বলেছিলি, দেখ, আমার কেমন মনে আছে সেই কথা, তুই বলেছিলি, মা, আমি বুঝতে পারছিনে আমার কি হচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে সাংঘাতিক কিছু হয়েছে। তুমি দেখ। তুই আঙুল তুলে, তোর বিছানাটা দেখালি। তারপর আমার কোলে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতেই থাকলি। কাঁদতেই থাকলি। চাদরে বড় একটা রক্তের ছোপ। তুই কাতর হয়ে আমাকে তলপেট দেখিয়ে বলেছিলি, ব্যথা, দারুণ ব্যথা। তোর ঊরুতের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আমি মরে যাব মা। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। আমাকে ছেড়ে যেও না। দোহাই তোমার।
‘সেদিন ভোরে তান্ত্রিক চলে গেলে ছবির ঘরে ঢুকেছিলাম মা। দেখি সে রক্তে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। আমাকে দেখেই সে আমাকে সাপটে জড়িয়ে ধরল। আর পাগলের মত বলতে লাগল, মা তুমি যেওনি, মা তুমি যেওনি। তা দু দণ্ড কি মেয়ের কাছে থাকতে পারনু মা। কি করে সেই বস্তিতে রটে গেল ভগবতীর ঘাম ঝরেছে ছবিদের বাড়িতে। আর অমনি নোকে নোকারণ্য হয়ে গেল। পালে পালে মাগিরা ছুটে এল আমাদের ঘরে। ছবি ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে কি কাঁপুনি তার! আমি ছবিকেই সামাল দেব না, ঘরে নোক ঢোকা ঠেকাব। মাগিরা রাক্ষসের মত নাপিয়ে নাপিয়ে ঘরে ঢুকতে নাগল। তারপর যেন ঝড় বয়ে গেল। মাগিরা ছবির রক্ত মাখা কাপড়টা টেনে হিঁচড়ে তার শরীল থেকে খুলে লিলে মা। তারপর সেটাকে লিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করল। পাগলের মত সেই রক্তমাখা শাড়িটাকে ওরা টানাটানি করতে করতে ফানা ফানা করে ছিঁড়ে লিল মা। বাইরে আবার কারা যেন গাজনের বাজনা বাজাতে শুরু করল। ছবির ল্যাংটা শরীলটাকে আমি আমার শরীল দে আগলে রেখেছিনু মা, নইলে বোধ হয় ওকেও ছিঁড়ে টুকরো করে দিত। বিছানায় যেখানে যেখানে রক্ত নেগেছিল মাগিরা সে সবটুকুনি ওদের আঁচল দিয়ে চেটেপুটে তুলে লিয়ে গেল গো মা। আমার আর ছবির শরীল তখন থর করে কাঁপতে নেগেছে। ছবি তো তখখুনিই মুচ্ছোই গেল।’
আমি কিন্তু এক নজরে তোর বিছানাটা দেখেই বুঝলাম, কি হয়েছে। তক্ষুনি তাকে বলেছিলাম, এতে ভয় পাবার কিছু নেই বিন্তি, এটা মেয়েদের একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। তোর মনে নেই বিন্তি, আমি তোকে কত আদর করেছিলাম সেদিন? তুই যেন আমার সেই ছোট্ট মেয়ে, একেবারে ছোট্টটি, যখন মা ছাড়া তোর একদণ্ডও চলত না। অনেকদিন পরে আবার আমার মনে হল, আমার সেই বিন্তিই আমার কোলে ফিরে এসেছে। তোকে বলেছিলাম, দিন তিনেক মেয়েদের এই ভোগান্তি সইতেই হবে পরের দিন তুই বেরুতে চাইছিলিনে। আমি তোকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম বিন্তি, কি করে এইসব সময় চলতে ফিরতে হয়। তুই বলেছিলি, মা, আমার ঘেন্না করে।
‘সারাটা দিন মা, আমার ছবি সিধে হয়ে চলতে পারেনি। পা দুটো ফাঁক করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে, আর বলেছে, ব্যথা গো মা, সারা শরীলেই ব্যথা। মাঝে মধ্যে তলপেট চেপে ধরে কঁকিয়ে কঁকিয়ে বসে পড়ছিল গো আমার ছবি। ব্যথা গো মা বড্ড ব্যথা, ছবির কাতরানি কখনও কখনও শুনতে পাই। চোকে জল এসে যায় মা, বাবুদের বাড়ির বাসন ধোয়া জলে সেটা মিশে যায়।
তুই বলেছিলি বিন্তি, মা আমার ঘেন্না করে। তোর খুব রাগ হয়েছিল। সে রাগ কি আমার উপর? তুই কি বুঝতে পেরেছিলি, তোর ওই অবস্থা দেখে আমারও গা ঘিন ঘিন করছিল। বুঝতে পেরেছিলি? তোর বিছানাটা দেখেই ঘেন্না হচ্ছিল এটা ঠিকই, কিন্তু সেটা বিন্তি, তোর উপরে নয়। কিংবা তোর উপরেও যেমন আমার নিজের উপরেও তেমন, সমগ্র মেয়ের উপরেই আমার সেই ঘেন্না ছড়িয়ে পড়ত। বিন্তি, এটাকে ঘেন্না বলছি বটে, বোধ হয় ঘেন্না না বলে এটাকে গা ঘিনঘিনে ভাবই বলা ভাল। আমার প্রথম যখন ঋতু হল বিন্তি, আমিও তোর মত ভয় পেয়েছিলাম, বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম, রক্ত দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিপদ বুঝি ঘটিয়ে ফেলেছি। অথচ বুঝতে পারছিলাম না, বিপদটা কি ধরনের? তোরই মত বিভ্রান্ত, তোরই মত ভয়ে পীড়িত হয়ে আমার মায়ের কাছে ছুটে গিয়েছিলাম আমার প্রথম ঋতুকালে। মায়েরাই এ সময়ের সবচাইতে বড় বান্ধব। তুই জিজ্ঞাসা করেছিলি, এ অসুখ সারবে মা? তোর মনে আছে? আমি বলেছিলাম, এটা কোনও রোগ নয় বিন্তি, এটা অসুখ মানে অস্বস্তি, ভয় নেই, সময় হলেই সারবে। কটা দিনের বিড়ম্বনা শুধু। তুই ভীষণ রেগে গিয়েছিলি। না মা, না আ, বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলি। আমি বলেছিলাম, শুনে রাখ বিত্তি, প্রতি মাসেই তোকে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হবে। তুই গোঁয়ারের মত কেবলই বলেছিলি, না মা, না আ আ আ। তুই তখন যেন হিস্টিরিয়ার রোগী। তোর শরীর শক্ত হয়ে উঠেছে। আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কেবলই বলে চলেছিস, না মা, না আ আ। মনে আছে বিন্তি? তুই সেদিন আমার কত কাছে চলে এসেছিলি। আহ! তুই পরদিন কেন ইশকুলে যেতে আপত্তি করেছিলি। মনে পড়ে? সেদিন তোর কি এই কথাই মনে হয়েছিল যে, এই লজ্জাজনক ঘটনাটা তোর জীবনেই বিন্তি প্রথম ঘটল? আমি তোকে বুঝিয়েছিলাম, তোর ক্লাসের প্রত্যেক মেয়েকেই একদিন না একদিন এই জিনিসের মুখোমুখি হতে হবে, কিংবা এখনই কাউকে না কাউকে হতে হয়েছে। তুই তবু বলেছিলি, না মা, না আ, আমার হবে না। আমি চাইনে চাইনে। আমি বলেছিলাম, তুই একা না বিন্তি। সমস্ত মেয়েরইএই নিয়তি। কিন্তু খুব বিব্রত লাগে তখন, যখন থেকে সর্বক্ষণ মনে হতে থাকে রাস্তার প্রত্যেকটা লোকই বুঝি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আর আমার গোপন লজ্জা ওরা সবাই টের পেয়ে যাচ্ছে। মেয়েদের জীবনে এর চাইতে অস্বস্তিকর ঘটনা আর নেই। যে মেয়েরা তাদের জীবনের ঋতুকালের প্রথম দিনে পথে হেঁটেছে, একমাত্র তারাই জানে যে, এটা কি শাস্তি। আমি দেখেছি বিত্তি, তুই আর তার পর থেকে ফ্রক পরতে চাইতিস না। তুই কি শাড়ি দিয়ে ঢেকে রাখতে চাইতিস তোর সেই বিড়ম্বনার মুহূর্তগুলো?
‘শাড়ি পরেই মা, আমার ছবি সকলের লজরে পড়ে গেল। ও যদি ইজের পরেই থাকত তাইলে তো আর ওকে অত সোমথ দেখাত না, আর তান্ত্রিকের লজরে পড়ে ওকে ভগবতী হতে হত না।’
অমিতা বিন্তির হ্যাংলা চেহারাটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর আরেকটা ফটো তুলে নিল। এটা রঙিন। বিন্তি, না না তখন আর বিন্তি নয়, ডঃ বিনোটি গুহা আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ডঃ চয়ন সিন্হা, ওর প্রেমিক। টোরোন্টো থেকে পাঠিয়েছিল এই ফটোটা। যোগী কয়েকদিনের মধ্যেই ফোন করে জানিয়েছিল, বিন্তি আর চয়ন বিয়ে করতে চায়। ‘আমি অনুমতি দিয়ে দিয়েছি। তুমি কি বল?’ অমিতা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, এই খবরে। বিস্তি বিয়ে করবে, তার বাবার কাছে অনুমতি চেয়েছে। সে খবরটাও অমিতাকে দেবার প্রয়োজন মনে করেনি বিন্তি।’ কেন রে? তোর কাছে কোনও অপরাধ করেছি? কি করেছি আমি? কখনও বলিসনি তো?
১৪
যোগীশ্বরকে সেদিন খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছিল অমিতার।
‘হ্যালো, অমিতা, শোনো, আমি আজ বিন্তির চিঠি পেয়েছি।’
বেশ, তা আমাকে কি করতে হবে?
‘অমিতা, তুমি মাঝে মাঝে এত ঠাণ্ডা স্বরে কথা বল না, আমার অস্বস্তি ঠেকে।’
এটা তো নতুন কোনও সিম্পটম নয়। তুমি কি আমাকে এই কথাটা বলবার জন্য ফোন করলে!
‘না, মানে আমি এটাই তোমাকে বলতে চাই যে, তুমি মাঝে মাঝে তোমার চারিদিকে এমন একটা অদৃশ্য দুর্ভেদ্য বেড়া রচনা করে রাখো যে, কিছুতেই সেটা ভেদ করে তোমার কাছে গিয়ে পৌঁছুতে পারা যায় না। আমার মনে হতে থাকে, তোমার কাছে আমি যেন কোনও অপরাধ করে ফেলেছি।’
এটা কি তোমার নতুন কোনও নাটকের সংলাপ। তাই যদি হয় যোগী তবে এ কথা বলতেই হবে, তুমি যথেষ্ট উন্নতি করেছ এর মধ্যে। তোমার আগের নাটকটা তো বসে দেখা যায় না।
‘তুমি আজ আমাকে অপমান করবে বলে ঠিকই করে নিয়েছ?’
সরি যোগী, আমার ধারণা ছিল, তোমার বয়স অন্তত পঞ্চাশ পার হয়েছে। কিন্তু দেখছি তুমি এখনও কচি সংসদের সদস্যই রয়ে গিয়েছ। সমালোচনাকে তুমি অপমান বলে ধরে নাও।
‘কোনটা সমালোচনা আর কোনটা অপমান করা, সেটা বোঝবার বুদ্ধি আমার যথেষ্টই আছে। স্টেটস্ম্যান পড়েছিলে?’
হ্যাঁ, যোগী পড়েছিলাম। ভালই বলেছিল। যে সমালোচনা লিখেছিল তার পাশে বসেই আমি তোমার নাটকটা দেখেছিলাম। দেখতে দেখতে যা মন্তব্যগুলো করছিল, সে সব শুনলে তুমি পাতাল প্রবেশ করতে। সেই সমালোচক মশায়ই আমাকে সেদিন বলেছিলেন, কিন্তু সমালোচনায় আমার রিয়েল মত তো দিতে পারব না। যোগীশ্বরপ্রসাদ গুহ শিক্ষাজগৎ এক রকম কন্ট্রোল করেন। আমার মেয়েকে উনি লেডি ব্রেবোর্নে ভর্তি করে দিয়েছেন। কি তিনি বলেছিলেন জানো, যোগীশ্বর আমার একজন ক্যাচ। হি ইজ্ মাচ্ বেটার এ ক্যাচ্ দ্যান এ প্লে রাইট্। যাক, যোগী, আমার এখন এ সব ব্যাপার আলোচনা করার সময় নেই। আজ আবার একটু তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। তুমি বোধ হয় বিন্তির কথা বলতে গিয়েছিল।
‘ও, হ্যাঁ বিন্তি। সে বিয়ে করছে। ওর এক সহযোগী বন্ধুকেই বিন্তি বিয়ে করছে। ১৭ সেপ্টেম্বরে বিয়ে। টোরোন্টোতেই বিয়েটা হবে। ওদের ছুটি নেই। ওরা হনিমুন করবে আলাস্কায়। এখন ওরা এ দেশে আসতে পারবে না।’
অমিতা বিন্তির আর চয়নের রঙিন ফটোগ্রাফটা দেখছিল। এরা তখন প্রেমিক ছিল। পরে স্বামী স্ত্রী হয়েছে। এবং ওদের বিয়েটা স্টেবল্ অর্থাৎ স্থায়ী হয়েছে। সুখের কথা। অমিতার কোনও বিয়েই স্টেবল হয়নি। তাই কি বিন্তি তার বিয়ে সম্বন্ধে এক ছত্র লেখা প্রয়োজন মনে করেনি তার মাকে। বিন্তি তাই কি সযত্নে পরিহার করে চলেছে তার মাকে। সেই বিন্তি, যে খুব কাছে চলে এসেছিল তার মায়ের কাছে সেই দিন, যেদিন প্রথম ঋতুস্রাব দেখে সে বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সেদিন মা-ই তো ছিল বিন্তির আশ্রয়। এখনও অমিতার কানে বাজে সেই গভীর রাতে তার দরজায় ঠক ঠক ঠক ধ্বনি। আর অস্পষ্ট একটা আর্ত কণ্ঠে মা মা মা আওয়াজ। মা মা মা। নার্স নার্স নার্স। এই দুটো আর্তস্বর কেন যে এক সঙ্গে মনে আসে অমিতার, সে বুঝতে পারে না। জানে না, একটার সঙ্গে আরেকটার সংযোগ কোথায়? সেদিন ঋতুস্রাবের আকস্মিকতায় তেরো বছরের বিন্তি মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে উঠেছিল। ‘মা আমি কি মরে যাব? মা আমি কি মরে যাব?’ বারবার প্রশ্ন করেছিল বিন্তি। প্রচণ্ড ব্যথায় সে অস্থির হয়ে পড়ছিল। অমিতার গা ঘিনঘিন করা সত্ত্বেও মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেছিল পরম স্নেহে। তার বুকে তখন মমতার ঢল নেমেছিল।
কিছুদিন থেকেই অমিতার মনে হচ্ছিল বিন্তি তার কাছ থেকে সরে যাচ্ছে। যোগীশ্বর আর অমিতার মধ্যে নিত্য বিরোধ শুরু হয়ে গিয়েছে তখন। বিন্তি তখন তার বাপের দিকে ঢলতে শুরু করেছে। ঠিক সেই সময়েই বিত্তি তার কাছে চলে এল এক রাতের আকস্মিক ভয়ে। তার বাবার কাছে গেল না কেন বিন্তি? বিন্তি তো বাপের সোহাগই বেশি পেয়ে এসেছে। কেন গেল না? কে বিন্তিকে বলে দিল, ওইটুকুন বিন্তিকে, এ সময়ে মেয়েদের বাবার কাছে যেতে নেই। সেটা হবে লজ্জার ব্যাপার। এখন মেয়েদের কাছে মা-ই একমাত্র আশ্রয়। কে বলে দিল বিন্তিকে এ কথা? বিন্তির সহজাত মেয়েলি সংস্কার? সব মাকেই এ সময়ে তার মেয়েকে হাতে ধরে পথে বের হবার কৌশল শেখাতে হয়। শিখেও যায় তারা। পরে আর এত আড়ষ্টতাও থাকে না। সবই অভ্যাস হয়ে যায়। সবই স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা অমিতা দেখেছে, মনের ভিতরে এত গভীর ভাবে ছাপ রেখে যায় যে, তার জের সারা জীবন ধরে চলতে থাকে। অনিশ্চয়তার গভীর ছায়াটা সঙ্গ ছাড়া হতে চায় না। কিছুতেই তার হাত থেকে মুক্ত হতে পারা যায় না। অমিতাকে তো এই অনিশ্চয়তার ছায়াটাই তাড়া করে ফিরেছে সারা জীবন। বিন্তি জিজ্ঞাসা করেছিল অমিতার কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে, ‘আচ্ছা মা, এমন অকারণে রক্তপাত শুধু মেয়েদেরই হয়?’ বিন্তির সেই ভয়ার্ত এবং বিভ্রান্ত মুখটায় চুমু খেতে ইচ্ছে করেছিল অমিতার। মনে হয়েছিল, যে আশ্রয় দিয়েছে সে নারী, যে আশ্রয় চেয়েছে সেও নারী। হ্যাঁ নারী। অমিতা এখন আর মা নয়, নারী। বিন্তি এখন আর মেয়ে নয়, নারী। হ্যাঁ বিন্তি এবার নারী হয়ে উঠবে। একদিন মা হবে। জননী। অমিতা আর বিন্তি আজ যে ডোরে বাঁধা পড়েছে, সেটা মাতৃত্বেরই ডোর। এই জননীত্ব আবহমান। এই জননীত্বে গৌরব কতটা মিশে আছে, অমিতা সেটা জানে না। যেটা জানে সেটার দীর্ঘ তালিকায় আছে ব্যথা, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ, বঞ্চনা, আর আর একতরফা সহিষ্ণুতা। এ সবের যোগফলই মাতৃত্ব।
হ্যাঁ বিন্তি, এমন অকারণে রক্তপাত শুধু মেয়েদেরই হয়।
‘কেন মেয়েদেরই শুধু হবে? কেন হবে, কেন কেন মা?’
অমিতা কোনও উত্তর দিতে পারেনি বিন্তির এই প্রশ্নের। সেও অনেকবার নিজেকে এই প্ৰশ্ন করেছে। কোনও’ উত্তর পায়নি সে।
‘না মা, না আ।’
কি না.বিত্তি? অমিতা মেয়ের মুখটা মুখের কাছে এনে মমতাভরে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। ভয় উদ্বেগ অনিশ্চয়তা’ বিভ্রান্তি সে মুখে জড়ানো। তার বিন্তি একদিন মা হবে। মায়েদের মুখে এইসব লক্ষণ ফুটে ওঠে। বিন্তির মুখেও সেইসব চিহ্নই দেখতে পেল অমিতা
‘এমন হওয়া উচিত নয়। এ অন্যায়। এত রক্ত ঝরবে কেন মেয়েদের?’
মেয়েদের অকারণে এত রক্ত ঝরে বলেই হয়ত, বিন্তি, মেয়েরা রক্তপাতকে এত পরিহার করে চলতে চায়। তাই মেয়েরা হানাহানি কাটাকাটি পছন্দ করে না। দাঙ্গা বাধায় না কখনও। কখনও যুদ্ধ ঘোষণা করে না, বিন্তি। রক্তের অপচয় কাকে বলে মেয়েরা ছাড়া আর কেউ সেটা বুঝতে পারে না। অন্তত মেয়েরা যেমনভাবে বুঝতে পারে তেমনভাবে পুরুষেরা পারে না।
সেদিন বিন্তি জড়সড় হয়ে ওর মায়ের কোলের মধ্যে শুয়ে ছিল সারারাত।
‘আমার ছবিও মা ওই রকম ভয়তরুসি ছিল। আমি কত বারণ তোকে করেছি হতচ্ছাড়ি, তা তুই গরিবের কতায় তখন তো কান দিলিনে। তখন কত বারণ করেছি, শাড়ি পরিসনি পরিসনি। আমার একটাই পরার মতো শাড়ি আছে ছবি, ওটা তুই লষ্ট করে ফেলবি। তা শুনলিনি তো। তুই তোর ছেঁড়া ইজের আর জামাটা,যদি পরে থাকতিস, তাইলে কি আর ভগমানের লজর তোর উপর পড়ত? পড়তনি তো।’
অমিতা, অমিতা, হ্যালো অমিতা, শুনছ?’
হ্যাঁ, শুনছি। যোগী কিছু মনে করো না, তোমাকে উত্তেজিত মনে হচ্ছে?
‘উত্তেজনা ঠিক নয় অমিতা। বিন্তিদের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিনে। অনেস্টলি বলছি।’
কেন, এত বোঝাবুঝির কি আছে? বিন্তি বিয়ে করবে ঠিক করেছে। সে তার বাপের অনুমতি চেয়েছে, অবশ্য যদি এটাকে অনুমতি বল, তার বাপ মেয়েকে তার সম্মতি জানিয়ে দিয়েছে। কি লিখলে যোগী? কনগ্রাচুলেশন?
‘তুমি এমনভাবে কথা বলছ অমিতা যে মেয়ে যেন আমারই। মেয়ে. তোমার নয়?’
দীর্ঘ সময় তো আমরা এই স্বত্ব স্বামিত্বের চুলচেরা হিসেব নিয়ে কলহ করে কাটিয়েছি। এখন জানি বিন্তি আমার মেয়ে নয়, আমার মেয়ে নেই। আর বিন্তির তো বোঝবার বয়স হয়েছে। সে যা ভাল বুঝবে তাই তো করবে?
‘এ তো তোমার রাগের কথা হল অমিতা? তুমি কোনও কারণে বিন্তির উপরে রেগে আছ?’ ফালতু কথা বলে লাভ কি যোগী? আমি তোমার কথার মর্মটা ধরতে পারছিনে। আর একটু খোলসা করে বলবে? আর প্লিজ, নাটুকেপনা থামিয়ে যা বলবার বল।
‘আমার মধ্যে নাটুকেপনা কোথায় দেখলে অমিতা? তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতেই ভয় হয়। মনে হয়, আমাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগই নেই।’
এটাও ফালতু কথা হল যোগী। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগই যদি থাকবে তাহলে তারা ডাইভোর্স করবে কেন?
‘আমি ডাইভোর্স করতে চাইনি অমিতা, সেটা তুমিই করিয়েছো।’
তার জন্য আমি একটুও লজ্জিত নই যোগী। ওই রকম জীবন আমার পক্ষে যাপন করা সম্ভব হচ্ছিল না। শুধু অপেক্ষা করেছিলাম, বিন্তির জন্য। বিন্তি লেখাপড়া শেষ করবে, তার গায়ে, আমাদের পরস্পরের প্রতি ঘৃণার যে আঁচ তখন গনগনে হয়ে উঠছিল সেটা লাগবে না, অন্তত বিন্তির গায়ে সেটা যত কম লাগে আমি তখন সেই চেষ্টাই করে গিয়েছি। আসলে আমি বিন্তিকে একটা ভাল হোম দিতে চেয়েছিলাম। পারিনি। কেন পারিনি, যোগী তুমি সেটা জান। তুমি বিন্তিকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলে।
‘তার জন্য, মাই গড়, তুমি আমাকে দায়ী করবে অমিতা!
আমার হাসি পাচ্ছে যোগী। মনে হচ্ছে আমরা যেন টেলিফোনে কথা কইছি না। মনে হচ্ছে আমাদের যেন ডাইভোর্স হয়নি। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখে টুথব্রাশ ঠুসেই আরম্ভ করেছি তিক্ত দম্পতির নিত্যকর্ম অর্থাৎ কলহ। গাল বেয়ে টুথপেস্টের ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। জিভে কখনও পেস্টের সুগন্ধী স্বাদ ঠেকছে, তুমি এখনও সেই একই পেস্ট ব্যবহার করে চলেছ তো যোগী, আগে তো মিন্ট যুক্ত পেস্ট তোমার কাছে উপাদেয় ঠেকত, যার বিজ্ঞাপনে কি যেন লেখা থাকত যোগী হ্যাঁ, ‘প্রিভেন্টস্ ব্যাড ব্রেথ’, তোমার নাটকের পক্ষে এটা ভাল সিকোয়েন্স হতে পারে কিন্তু। হতে পারে না যোগী?
‘অমিতা প্লিজ, তোমার ব্যঙ্গ বিদ্রূপ একটু থামাবে? এখন তো আমরা আর সেই তিক্ত দম্পতি নেই। সে সব তো চুকে বুকে গিয়েছে। এখন তুমিও ফ্রি উওম্যান আমিও ফ্রি ম্যান।
শুধু ফ্রি ম্যান নও যোগী, তুমি তো হিম্যান। বলতে পার ফ্রি হিম্যান।
‘অমিতা প্লিজ। তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে। শুনবে কি?
সংক্ষেপে হলে শুনতে পারি। যা বলে ফেলার বিনা ভণিতায় বলে ফেল যোগী।
তোমার সঙ্গে কথা বলে কার সাধ্যি। তুমি বিন্তির কোনও চিঠি পাওনি?
বিন্তি আমাকে চিঠিপত্র লেখে না।
‘সরি!’
তারপর যোগী? আগে কহ আর।
‘আশ্চর্য! আমি এটা জানতাম না অমিতা।’
তুমি আশ্চর্য হচ্ছ কেন যোগী? বিন্তি তো তোমাকেই ভালবাসে। তুমিও ওকে ভালবাস। বিন্তি তার মায়ের ইনফ্লুয়েন্সে পড়ে মায়ের মত যাতে না হয়ে যায় তার চেষ্টা তুমি তো কম করনি যোগী। বিন্তি তো তোমারই হাতে গড়া মেয়ে। বিন্তি তার মাকে অনেকদিন ছেড়েছে।
যোগীর দিক থেকে কোনও সাড়া পেল না অমিতা।
সমীরেন্দ্র ভেবেছিল মায়ের কাছে ছেলেকে রাখা ছেলের মেন্টাল হেলথের পক্ষে শুভ হবে না। সমীরেন্দ্র তার ছেলেকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আইনের দ্বারস্থ হয়েছিল। অনেক ক্রুড ছিল সমীরেন্দ্র। অবশ্য তাকে স্ট্রেইটও বলতে পার। আমেরিকায় গিয়ে একজন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছেন। কিন্তু তোমার পদ্ধতিকে আমি স্থুল বলতে পারিনে যোগী। তুমি বিস্তিকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছ অনেক স্বাভাবিকভাবে। বাবা মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তো ভাববেই। কোয়ায়েট ন্যাচরাল।
‘আমি বিন্তিকে হোস্টেলে দিতে চাইনি অমিতা বিশ্বাস কর। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পরই বিস্তি বলেছিল, সে কলকাতায় পড়তে চায় না। সে বাঙ্গালোরে না হলে দিল্লিতে পড়বে। বাঙ্গালোরে সেন্ট স্টিফেসে আমার এক বন্ধু ছিল।’
হ্যাঁ, ভেঙ্কটেশ্বরন্। তোমার ক্যাচ্। তোমাদের গ্রুপ থিয়েটার দলের ক্যাচ পাতা ভুবনে।
‘কিন্তু বাঙ্গালোরে গিয়ে কি দারুণ কেরিয়ার পেয়ে গেল বিত্তি, বল? কলকাতায় থাকলে এটা হত! হতে পারত?’
পিতা হিসাবে তুমি যে খুবই দূরদর্শী আমাকে সেটা মানতেই হবে। তুমি বিন্তির লেখাপড়ার দিকে য়ত নজর দিয়েছ, আমি ততটা দিতে পারিনি, এটাও সত্য। বিস্তি সম্পর্কে আমার কোনও অভিযোগ নেই। কিন্তু যত গর্বিত পিতা হিসাবে তুমি নিজেকে আমার কাছে জাহির করতে চাইছ, তোমার কণ্ঠস্বর সেটা বিট্রে করছে। কণ্ঠস্বরে বরং মনে হচ্ছে তুমি একজন বিপন্ন পিতাটিতা কিছু। যোগী তুমি তোমাব স্মার্টনেসের ভানটা ছাড়বে?
‘দেখ অমিতা, বিন্তি তোমার সঙ্গে যে ব্যবহারই করুক তুমি তার মা, এটা অস্বীকার করতে পার না।’
যোগী হোয়াটস বাইটিং ইউ?
‘বিত্তি, অমিতা। বিন্তি।’
কেন কি করেছে বিন্তি?
‘না, সে’রকম কিছু নয়। তবে বিন্তি তার বিয়ের ব্যাপারটা এত সংক্ষেপে জানিয়েছে যে, ওর থেকে মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যায় না। কি বুঝবে এই চিঠি থেকে, যে চিঠিতে শুধু এইটুকু মাত্র লেখা থাকে, বাবা আমি অমুক তারিখে অমুককে বিয়ে করছি। আরে অমুকটা কে, সেটা একটু ডিটেইল্সে লিখবি তো? এই চিঠি থেকে কি করে বুঝব ছেলেটি কেমন? ওর অ্যান্টিসিডেন্টস্ কি?’
সেটা জেনে তোমার কি হবে, যোগী? বিয়েটা তুমি করছ না তো! করছে তোমার মেয়ে। তোমার মেয়ে যাকে বিয়ে করছে, তাকে নিশ্চয়ই জেনে শুনে বিয়ে করছে। তুমি অকারণে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন?
‘তোমার কিছু চিন্তা হচ্ছে না অমিতা, অনেস্টলি বল তো?’
আমার কেন চিন্তা হবে যোগী? বিয়েটা যে হচ্ছে, সেটাই তো আমি জানিনে না?
‘এটা তো তোমার অভিমানের কথা হল অমিতা?’
যোগী জেনে রাখ, এ ব্যাপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। সত্যিই নেই। খোকা বিন্তি, সব আজ আমার কাছে পাস্ট টেন্স্। তোমার মাথাব্যথা থাকা সম্ভব।
বিত্তি আর চয়নের ছবিটার দিকে তাকিয়ে অমিতা বলল, সেদিন যখন তোর বাবাকে এ কথা বলেছিলাম বিন্তি, সেদিন ঠিক কথাই বলেছিলাম। তোর বিয়ে তুই করছিস। আমাদের তাতে মাথাব্যথা হতে যাবে কেন? অভিমানভরে আমি এ কথা তোর বাবাকে বলিনি। সত্য জেনেই বলেছিলাম। তবে তোর উপর আমার অভিমান তো হয়েছিল। তুই বাবাকে যে খবরটা দিতে পারলি, সেটা আমাকেও তো দিতে পারতিস। দিসনি কেন? দিসনি কেন, এই মেয়ে?
‘আমার ছবিও মা নিশ্চয়ই এতদিনে এত বড়টি হয়েছে?’
এত বড় বলছ কেন মন্টুর মা, তোমার ছবি এখন আরও কত বড় হয়ে উঠেছে। বিন্তিই কি আর এই ফটোর মতো আছে? এ ফটো যখন তোলা তখন তো তার বিয়েই হয়নি। তার বিয়েই হয়ে গেল কত বচ্ছর। এই যে, যে ছেলেটিকে এখানে দেখছ, ওরই সঙ্গে বিন্তির বিয়ে হয়েছে। তারপর বিন্তির ছেলেমেয়ে হয়েছে। ওর মেয়েই এখন কত বড় হয়ে উঠল।
‘কত হবে তোমার লাতিনের বয়স?’
তেরো চোদ্দো তো হবে নিশ্চয়ই। হিসেব সব ওর বাপের কাছে আছে। আমাকে তো আর দরকারে লাগে না, মন্টুর মা।
মা মা মা। ঠক ঠক ঠক। মা মা মা। অমিতা যেন ঘুমের ঘোরে শব্দগুলো শুনছে। মৃত্যুভয়ে কাতর এক দিশহারা মেয়ে অমিতার কাছে ছুটে এসেছিল আশ্রয় নিতে। মা মা মা। ঠক ঠক ঠক। নার্স নার্স নার্স। ঠক ঠক ঠক। মৃত্যুভয়ে কাতর এক নিরুপায় পেশেন্ট পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিল নার্সের রুমে। সেও অমনি এক গভীর রাতে। অমিতা সেদিন সত্যই মৃত্যুভয়ে কাতর হয়ে পড়েছিল। হ্যাঁ, মৃত্যু ভয়। আশ্চর্য, এ কথা তো মনে পড়েনি অমিতার। অপারেশনের দিন পাঁচেক পরে, সে তখন পাশ ফিরতেও পারে না, হঠাৎ সেই গভীর রাতে বমি করতে লাগল অমিতা। সে কী বমি তার। সে প্রথমে নিশ্চিন্ত ছিল.বমির শব্দে নার্সরা ছুটে আসবে। এত বড় নার্সিংহোম। যেখানে তিন শ টাকা খরচ লাগে রোজ, সেখানে কোনও পেশেন্টই আনঅ্যাটেন্ডেড থাকবে না। নার্সরা রোগীর বিপদে ছুটে আসবে। সেই বিশ্বাসে ভর করে প্রথমবার বমির দমকটা সামলে নেবার চেষ্টা করেছিল সে। পারল না। আবার বমি আবার বমি। বমির দমকে বুকের স্টিচগুলো ছিঁড়ে গেল অমিতার। নার্স নার্স! অমিতা ডাকতে চেষ্টা করল। রক্তে তার বুক তখন ভেসে যাচ্ছে। রক্ত রক্ত। মেয়েদেরই কেন রক্ত ঝরবে মা? তুই না জিজ্ঞাসা করেছিলি বিন্তি? বোকা মেয়ে! নার্সিং হোমের সেই রাতটা বিন্তি আর চয়ন সিন্হার, চয়ন না চৈন, রঙিন ফটো ভেদ করে অমিতার চোখের উপর ভেসে উঠল। রক্তে আমি তখন ভাসছি বিন্তি। আর একা।
‘ছবির শাড়িটা মা, রক্তে ভিজে লাল টগটগ করছিল।’
রক্তে ভেসে যেতে লাগল অমিতার সেই নার্সিং হোমের ধপধপে বিছানার চাদর। বুকের রক্তে ভেসে যেতে লাগল তার নাইটি, রক্তে ভেসে যেতে লাগল তার গায়ের পাতলা সুন্দর কম্বলটা। বমি। রক্ত। আরও বমি। আরও রক্ত। অমিতা বিভ্রান্ত। আরও রক্ত। অমিতা বিমূঢ়। আরও বমি। আরও রক্ত। অমিতা এবার ভয় পেয়ে গেল। সে রক্তে ভেজা নাইটিটা জড় করে বুকে চেপে ধরে সেই রক্তের বন্যা, হ্যাঁ বন্যা, রোধ করার চেষ্টা করতে লাগল। কোথায় নার্স? নার্স নার্স। গভীর রাত। এয়ার কন্ডিশন ঘর। অমিতা একা একেবারে একা। ভয় রক্ত ভয় রক্ত ভয় নার্স ভয় ভয় ভয় নার্স নার্স একা একা ভয় নার্স একা নার্স একা নার্স নার্স নার্স নার্স মা মা মা। কোথায় মা? কোথায় নার্স? নার্স বলেছিল, ঘরে কলিং বেল আছে আমরা পাশেই আছি ভয় নেই। কোথায় কলিং বেল? মৃত্যু অতর্কিতে সব সতর্কতাকে ফাঁকি দিয়ে থাবা হেনেছে বুকের স্টিচে, সেই বুক যে বুকটাকে কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। কলিং বেল পাওয়া গেল বিন্তি। টিপে ফল হল না। নাইটিটা বুকে, যে বুক দিয়ে রক্ত ঝরছে, শক্ত করে চেপে ধরে অমিতা বিছানা থেকে নেমে পড়েছিল সেদিন। হ্যাঁ বিন্তি, আমি নিজেই নেমে পড়েছিলাম বেড থেকে। মেঝেতে নামতেই মাথাটা বোঁ করে টলে গেল। বিছানার ধার ধরে সামলে নিল অমিতা। কিন্তু হেঁটে যেতে ভরসা পেল না। নার্সদের ঘরে যে করে হোক তাকে পৌঁছতেই হবে। সে রক্তমাখা নাইটিটা বুকে চেপে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে এগুতে লাগল নার্সদের ঘরের দিকে। অমিতা তখন ভয়ে উন্মাদ। অমিতা তখন প্রায় উলঙ্গিনী।
‘মাগিরা তখন খেপে উঠেছিল মা, ভগবতীর ঘাম নেবে বলে সবাই যেন খেপে উঠেছিল। আমার ছবির কাপড়ে যে রক্ত নেগেছিল তাই নাকি ভগবতীর রক্ত। তান্ত্রিক বলে গিয়েছিল গো মা, আর তাইতে সে কি কাড়াকাড়ি। আমার ছবির গা থেকে টেনে হিঁচড়ে মাগিরা সব কাপড়টা খুলে নিল মা। আমার ছবি ল্যাংটা হয়ে দাঁইড়ে দাঁইড়ে থরথর করে কাঁপতে নাগল। মায়ে বেটিতে আটকাতে পারিনি। বাইরে তখন তাসা পার্টি এসে গিয়েছে। ড্যাংসা ড্যাডাং ড্যাংসা ড্যাডাং ড্যাংসা ড্যাড্যাং। কি হুজ্জোতি গা, কি হুজ্জোতি। গরিবের ঘরে ভগমান এলে এমন হুজ্জোতই হয়।’
বিন্তি, তোর কাছে তবু তোর মা ছিল। মনে পড়ে? আমার কাছে, সেই নার্সিং হোমে কেউ ছিল না। নার্সরা তাদের ঘরের সামনে আমাকে পড়ে থাকতে দেখে বেড়ে তুলে এনেছিল। লজ্জা পেয়েছিল তারা।
অমিতা বিন্তি আর তার প্রেমিক চয়ন সিন্হার রঙিন ফটোটা বাসের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। আর তখনি একটা অস্পষ্ট ফটোগ্রাফে অমিতার নজর পড়ে গেল। সেখানা তুলে একেবারে চোখের কাছে দেখতে লাগল। এ তো বাবা, এ কি বাবা, বাবার ছোকরা বয়সের ছবি? এরা কারা? ঠিক বুঝতে পারল না অমিতা। বাবার সঙ্গে আরও দু’জন। ছবির ও-পিঠে লেখা অমিতা ঠাহর করে পড়ে ফেলল, ‘সিরাজগঞ্জ সন্মিলনী ১৯২৪। সুধাকর, তায়েব, হরিকিশোর।’