১
সেদিনের কথা বেশ স্পষ্ট মনে আছে ফুলকির। না, না, না অমিতার। ফুলকি তো কবেই মরে গিয়েছে। এখন যে বেঁচে আছে, এখনও যে বেঁচে আছে, সে অমিতা। শামিম বলত, ফুলকি। অমিতা পাশ ফিরতে চেষ্টা করল। একবারে পারল না। ডান দিকে প্রচণ্ড ব্যথা। গভীর রাত। কটা বেজেছে? কেউ জবাব দিচ্ছে না কেন? হাঁফাতে লাগল অমিতা। নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল অমিতা। তার আবার জ্বর আসছে। জল তেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু জল খেতে গেলে হাত বাড়িয়ে গেলাসটা আনতে হয় মাথার কাছে রাখা ছোট টিপয় থেকে। তাও জানে না অমিতা, মন্টুর মা মনে করে জলের গেলাসটা ঠিক রেখে গিয়েছে কি না? মন্টুর মা যখন যায় অমিতা তখন জ্বরে বেহুঁশ। তাই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। আঙুলের কাছেই বেড সুইচটা আছে। সেটা টিপল। বাথরুম যাবার ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠেছে। আলো জ্বলল না। লোড শেডিং। শামিম বলত, ফুলকি। অমিতাকে এখন উঠে বাথরুমে যেতেই হবে। না হলে আজও বিছানা ভিজিয়ে ফেলবে সে। এবং সকালে মন্টুর মা এসে যথারীতি গালমন্দ করবে তাকে। শামিম ক্বচিৎ তাকে বলত মিতা, আর যখন দারুণ আদর করত তাকে, তখন বলত ফুলকি। নরম আর ভারি গলায় আচ্ছন্ন অমিতা বার কয়েক ডাকল শামিম শামিম। মন্টুর মা চোর। অমিতা জানে সেটা। একটা একটা করে অনেক জিনিস তার বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখনও নিচ্ছে, সমানে নিচ্ছে। তবুও তার চোপা কত! যেন অমিতাই চোর। যেন অমিতাই ঝি, আর মন্টুর মাই মনিব। ফুলকি নামে তাকে আর কেউ ডাকুক, সেটা এক সময় পছন্দ করত না অমিতা। ফুলকি তার বাবার দেওয়া আদরের নাম। সে নামের স্বত্বাধিকারী তার বাবা। বাবাই তাকে কেবল ওই নামে ডাকবে। আর কেউ না। ব্যস্। কেবল আরেকটি পুরুষকেই সে তাকে ওই নাম ধরে ডাকবার অধিকার দিয়েছিল। সে শামিম। ‘তোর মুখে শুনলে মনে হয়, এটা যেন জর্জকোটের রায়। এর আর নড়চড় হবার জো নেই।’ বাবা মিচকি মিচকি হাসছিলেন। বাবা তুমি এখন কোথায়? চোখের জলে বুক ভেসে যেতে লাগল অমিতার। সে আর চেপে রাখতে পারল না। বিছানাটাও ভিজে সপসপে হয়ে উঠতে লাগল। প্রথম দিকে একটু একটু উষ্ণতার ছোঁয়া পেল, কিন্তু ক্রমেই সপসপে তোশকের থেকে উঠে আসা একটা কঠিন শীতলতা বজ্রকীটের মতো নির্দয়ভাবে তার পরণের হাউসকোট ভেদ করে, সায়া ফুঁড়ে পাছার পেশীতে গিয়ে আক্রমণ করল। অমিতা অসহায়ভাবে অনুভব করতে লাগল সেই শীতলতা অনিবার্য নিয়তির মতো ছড়িয়ে পড়ছে তার পাছা থেকে জঙ্ঘায়, জঙ্ঘা থেকে জানুতে, জানু থেকে যোনিতে। অমিতা সেই গভীর রাতে, একা, তার বেঢব আর ভারি আর যন্ত্রণাকাতর শরীরটাকে প্রাণপণে ভিজে বিছানা থেকে কোথাও সরিয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল। এইসব সময়ে নিজেকে আর মানুষ বলে ভাবে না অমিতা। তাকে এখন তার মনে হয়, কোনও মুমূর্ষু সরীসৃপ। বরং মৃত বলাই ভাল। ফুলে ঢোল হয়ে ভেসে যাচ্ছে পঙ্কিল স্রোতে। তার পেটটাকে ছুঁলেই অমিতা ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। এখনও ধামার মতো পেটটা ফুলে আছে। কত ভারি। যেন পাষাণ চাপান। পেটে জল জমে জমে ফুলে ওঠে বারবার। ক্যানসার কুরে কুরে তাকে আন্তঃসার শূন্য করে ফেলেছে। এত বছর ধরে তবু সে বেঁচে আছে। হ্যাঁ, সে বেঁচে আছে। কিন্তু তার কাছে কেউ নেই। তার ন বছর বয়েসে টাইফয়েড হয়েছিল। তিন সপ্তাহ তার মা তার কাছ ছাড়া হয়নি। চোদ্দ বছর বয়সে তার গুটিবসন্ত হয়েছিল। মা তখন গত হয়েছেন। বাবা ছিলেন। এক মাস বাবা তাকে চোখের আড়াল করেননি। শিওরে বসে মেয়ের যন্ত্রণার উপশমের জন্য বাবা কত কি তখন করেছেন। কত গল্প করেছেন। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ পড়ে পড়ে শুনিয়েছেন। রাজনীতির কথা আলোচনা করেছেন। মা মারা যাবার পর থেকেই বাবা অমিতার উপর বেশী করে নজর দিতে শুরু করেছিলেন। দিদির সঙ্গে তখন বাবার বাক্যালাপ বন্ধ। ছোট বোন হস্টেলে। বাবা এই সময় তার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। শামিমকে বাবাই তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তার আগেও শামিমকে দেখেছিল ফুলকি। বাবা বাড়ি ছিলেন না, তাই সেদিন থতমত খেয়ে চলে গিয়েছিল। কী লাজুক ছিল তখন শামিম! আর কী সুন্দর! ‘শামিমের ভাল দিকটা কি জানিস ফুলকি, ওর মনটা বড় বিশুদ্ধ। শামিমকে দেখে মনেই হয় না ও মুসলমান।’ শামিম তার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই কেমন জড়সড় হয়ে পড়ত। কিন্তু বাবার সঙ্গে কথা বলত প্ৰায় সমবয়সীর মতো। কোনও জড়তা থাকত না তখন।
শরীরটা নড়াতে গিয়েই যন্ত্রণাটা তীব্র হয়ে উঠল। অমিতা হাত বাড়িয়ে বালিশের তলা থেকে পেনকিলারের বড়িটা বের করে নেবে, প্রথম চেষ্টায় সেটাও পারল না। ওর ডান হাতটা বাঁ দিকের বুকের উপর খপ করে পড়ে গেল। পড়ল একেবারে বুকের পাঁজরার হাড়ে। বাঁ দিকের স্তনটা কেটে ফেলতে হয়েছিল তিন বছর আগে। ক্যানসার।
এই সময়ে ওল্ড হোমে যাবার ইচ্ছেটা জেগে ওঠে প্রবল হয়ে। অমিতা ভিজে সপসপে বিছানায় শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে এমন একটা আশ্রয়ের যেখানে একা থাকতে হবে না তাকে। কেউ, সে যে কেউই হোক, একজন থাকবে তার ঘরে, তার কাছে। যার উষ্ণতা সে অনুভব করবে। ওল্ড হোম, নবনীড়, মাদার টেরিজা, যেখানে হোক, যে আশ্রয়েই হোক, অমিতাকে চলে যেতেই হবে। এ অসহ্য, এ জীবন অসহ্য। অসহ্য অসহ্য অসহ্য। সকাল হলেই দাঁত খিঁচুনি শুনতে হবে মন্টুর মার। ‘পাগল করে দেবে গ, আমাকে একেবারে পাগল করে দেবে।’ অমিতাকে টেনে হিঁচড়ে নামাবে তার বিছানা থেকে। ‘বাচ্চা মেয়ে তো আর লও মা, যে শুয়ে শুয়ে বিছানা ভিজিয়ে যাচ্ছ, গতর লাড়তে কি হয়! পাশেই তো বাথরুম। সেটা লজরে পড়ে না।’ সোফাটায় রাগের চোটে অমিতাকে ঠেলে দেবে মন্টুর মা। অমিতার শরীরে আপাদমস্তক ব্যথা। সে কেঁদে উঠবে যন্ত্রণায়। সোফাটা ছিঁড়ে ভিতরের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছে। এখানে খোঁচা লাগে ওখানে খোঁচা লাগে। কোনও ভ্রূক্ষেপ করে না মন্টুর মা। তারপর অমিতা ধীরে ধীরে আহত বাঘিনীর মতো হিংস্র হয়ে ওঠে। হারামজাদি, বদমাস, চোর! এই কটা কথা বলতে বলতেই হাঁফিয়ে ওঠে অমিতা। ছেঁড়া, অত্যন্ত অস্বস্তিকর সোফাটায় বসে সে শুধু হাঁফাতে থাকে, কেবলই হাঁফাতে থাকে। আর এই রকম সময় যে কাণ্ডটা করে মন্টুর মা, অমিতা সেই পরিস্থিতিকেই সর্ব থেকে ভয় পায়। মন্টুর মা দড়াম করে উত্তরের জানলাটা খুলে দেয়। তারপর জানলা দিয়ে মুখ বের করে তারস্বরে চেঁচাতে থাকে। ‘অ গ ভালমানুষের বিটিরা তোমরা শোন। আমাকে হারামজাদি বলেছে এই বুড়ি, আমাকে বলেছে বদমাস, চোর।’ ততক্ষণে প্রতিবেশীরা জানলায় জানলায় এসে হাজির হয়ে গিয়েছে। ‘শোন গ তোমরা শোন, শুনে লাও, আমি নাকি শয়তান?’ অমিতার মনে হয়, অসুখে ওর এত অঙ্গ একের পর এক নষ্ট হয়ে গেল, কিন্তু ওর শ্রবণশক্তিটা গেল না কেন? প্রাণটাই বা যায় না কেন? ‘শয়তান কে, আমি না এই বুড়িটা? আপনারাই বিচার করুন। সকালে এসে দেখি, বিছানা ভিজিয়ে রেখেছে, বাচ্চারও যে-টুকুন লজ্জাশরম আছে এ বুড়ির তাও লাই গা। আবার বলে শয়তান!’ যতই ভোর হতে লাগল অমিতা ততই ভয়ে কুঁকড়ে উঠতে লাগল। কি হয়, এ রাত যদি তার জীবনে আর ভোর না হয়? যামিনী তুমি দীঘল হয়ো, ওগো রজনী তুমি পোহায়ো না রে। অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে এই গানটা অমিতাকে শিখিয়েছিলেন। এক কালে গান করত সে! লোকে তাকে বলত মেয়ে কেষ্টো। অমিতার প্রথম গানের গুরু তিনিই। সে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তালিম পেয়েছিল নীহারবিন্দু সেনের কাছে। নীহারদার সুরে এবং তালিমে তার কয়েকখানা রেকর্ডও বেরিয়েছে এক সময়। লোবো সাহেব তাকে পিয়ানো আর ভায়োলিনে তালিম দিয়েছিলেন। বেহালা কথাটা পছন্দ করতো না অমিতা। ভায়োলিন বলতে অমিতা বুঝত সুরের মূর্ছনা। পৃথিবীর নাভিমূল ছিঁড়ে যে আর্তি, যে বেদনা উঠে আসত, ভায়োলিনের মূর্ছনায় হত তারই প্রকাশ। বেহালা শব্দে অমিতা সে মহিমার সন্ধান পেত না। ‘খাক্ খাক্ তোরে বাঘে ধরে খাক্’—বেহালার গত্ বলতে অমিতা এই ধরনের ব্যাপারই বুঝত। কিন্তু ভায়োলিন অন্য জিনিস! এখন ভিজে বিছানায় শুয়ে অমিতা বুঝতে পারল তার শরীর ছাপিয়ে নামতে শুরু করেছে জ্বরের প্লাবন। সে ক্রমেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে লাগল। আর সেই অবস্থায় তার কানে এসে বাজতে লাগল পৃথিবীর নাড়িছেঁড়া কান্নার অপার্থিব মূর্ছনা। তার আবছা চোখে ভেসে উঠতে লাগল সেইসব যুবকের ছবি যারা কোনও না কোনও সময়ে ছিল তার অন্তরঙ্গ সঙ্গী। কখনও বা প্রেমিক। পৃথ্বীশ সেই লাজুক পটুয়া, অরুণ সেই মুখচোরা কবি, অমিতা দেখতে লাগল প্রবল জ্বরের তাড়সে, যেন বন্যার প্রবল স্রোতে, মুখগুলো সব একে একে ভেসে চলেছে। জীবন, ক্লাসে যাকে সবাই বলত হোঁৎকা জীবন, যে তাকে না পেলে সায়োনায়েড খাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছিল, মাঝে মাঝে বুক পকেট থেকে হোমিওপ্যাথির শিশি বের করে দেখাত, বঙ্কু, যে তাকে লেকের ধারে নিয়ে গিয়েছিল হুড খোলা বেবি অস্টিনে চাপিয়ে, বঙ্কুর সঙ্গে তার সেই বেবি অস্টিনকেও ভেসে চলে যেতে দেখল অমিতা, প্রতাপ, যার মতো সুপুরুষ তার জীবনে দেখেনি অমিতা, যে রেডিওর রিহার্সাল রুমে অতর্কিতে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে দিয়েছিল, শশীকুমার, যে বলে বেড়াত অমিতার পেটটা দেখেছিস কখনও, একেবারে পিচবোর্ডের মতো টানটান, গোপী, কি সুন্দর গানের গলা ছিল যার, গায়ক না হয়ে ব্যারিস্টার হয়েছিল যে, একে একে সব মুখগুলো ভেসে চলে গেল। তারপর অন্ধকারে অমিতা একা। ভিজে বিছানায় একেবারে একা। এই মুখগুলো এক একটা প্রদীপের মতো ভাসছিল তার চোখে। কিন্তু আশ্চর্য, অমিতা এই মুখগুলোর মধ্যে চারটে মুখ তো দেখতে পেল না! কোথায় গেল সমীরেন্দ্র, তার প্রথম স্বামী? কোথায় গেল যোগীশ্বর, তার দ্বিতীয় স্বামী? লোকনাথ, লোকনাথও কেন অনুপস্থিত? লোকনাথ তার তৃতীয় স্বামী। তারা তিন বোন। সুমিতা অমিতা নমিতা। সুমি অমি নমি। ঝুমরি, ফুলকি আর চুমকি। আর ঘটনাচক্র এমনই যে, তাদের তিন বোনেরই তিন বার করে বিয়ে করতে হয়েছে। লোকে শেষের দিকে বলতে আরম্ভ করেছিল, ‘সুধাকরবাবুর তিন মেয়ে কিন্তু নটা জামাই। ভাগ্য করে এসেছিলেন বটে ভদ্রলোক!’ পরিচিত সেই অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মুখের মিছিলে তার তিন স্বামীর মুখ দেখতে পায়নি অমিতা। সেই মিছিলে আর ছিল না শামিমের মুখ। শামিম, আজও যে তার প্রিয়তম। শামিমই একদিন বলেছিল, সে সেদিন শামিমের পাশে শুয়ে, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে তখন তার অনাবৃত শরীর, শামিম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল তার দুটো কুমারী স্তনের পানে। অমিতা তখন চাইছিল শামিমকে, মনে মনে মিনতি করছিল আর দেরি নয়, আর দেরি করো না আমাকে নাও, আমাকে নাও, আমাকে গুঁড়িয়ে দাও, আর পারছি না শামিম, দয়া করো, দয়া করো, দয়া করো। এক সময় নিজের তাগিদেই অমিতা থরথর হাতে শামিমের হাতখানা তার বুকের উপর টেনে এনেছিল। বোবা মুখে চেয়েছিল শামিমের মুখপানে, মনে মনে অমিতা তখন মিনতি করছিল, শামিম শামিম, আর দেরি না। সেই তখন শামিম তার দুটো নিটোল স্তনে আলতো ভাবে চুমু খেয়ে ফ্যাঁসফেঁমে গলায় অমিতাকে বলেছিল, ‘ফুলকি, তোমার স্তনদুটো দুটো শুভ্র ফুলের স্তূপ। কঠিন হাতে ও দুটোকে পিষ্ট করতে আমি পারব না ফুলকি। আমার বড় মায়া লাগে।’
সে ফুলের স্তূপ আর নেই শামিম। শামিম যেন তার পাশে এসে শুয়ে আছে। ডুকরে হঠাৎ কেঁদে উঠল অমিতা। সাজি সয়েত তার বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। উঁচু পেটের উপর থেকে হাতটাকে বাঁ দিকের বুকের উপর তুলে নিল। এই দ্যাখ, এই দ্যাখ শামিম, এখানেই তোমার সেই স্তূপের একটা ছিল। আজ সেখানে নেই, কিছুই নেই। ক্যানসারের কালগ্রাসে সেটা আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। হাহা করে কাঁদতে থাকল অমিতা। কি আছে আজ আমার এই দেহটার? শশীকে তুমি কখনও দেখনি শামিম। ও আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু, শশী বলত, আমার পেটটা পিচবোর্ডের মতো টানটান। আমার পেটে মুখ রাখবার তার বড় শখ ছিল। শশী সেখানে চুমু এঁকে দিতে চেয়েছিল। তাকে পাত্তা দিইনি কোন দিন। কত অশ্লীল তখন মনে হয়েছিল তার প্রস্তাব! শশী মরে গিয়েছে অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে। আর আমি বেঁচে আছি আমার সেই শুচিবাইয়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে। বেঁচে আছি আজকের এই জলে ভরা ধামার মতো পেট নিয়ে। কেন বেঁচে আছি? কী অস্বস্তি কী যন্ত্রণা! তোমরা কেউ বুঝবে না। জ্বর যেমন এসেছিল তেমনি আবার নেমে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু এই সময়টাই সব থেকে খারাপ লাগে অমিতার। কী ক্ষতি, কতটুকু ক্ষতি হত সেদিন শশীর আবদার পূরণ করে দিলে? আদপেই কোনও ক্ষতি হত কি? বল না,বল না, বল না, তোমরা কেউ? ছটফট করতে লাগল অমিতা। পাগলের মতো সে দু হাত দিয়ে পেটটাকে খামচে ধরল। যেন পেট্টা চিরে ফেলে নিজের হাতেই সব জলটুকু বের করে দেবে। এই সময়, যখন জ্বরটা ছেড়ে যেতে থাকে, তখন পেটটা যেন জগদ্দল পাথর, তলায় চাপা পড়ে আছে তারই এমনি মনে হতে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার। হাঁসফাঁস করতে থাকে সে। আর এই সময়, যত পুরুষ এসেছে তার জীবনে, প্রেমিক, স্বামী, বন্ধু তাদের সকলের বিরুদ্ধে এক ক্ষমাহীন আক্রোশ ফণা মেলে প্রবল বিক্রমে জেগে ওঠে তার শরীরের ঝাঁপিতে, আর নির্বিচারে সবাইকে ছোবল মারতে থাকে। মজা লুটে তোমরা সব পালিয়ে গিয়েছ। ভেবেছ তোমাদের আমি ক্ষমা করব। কাউকে ছেড়ে দেব না। না শামিম, তোমাকেও না। কাওয়ার্ড! তোমার কি উচিত হয়েছে আমাকে এই অবস্থায় ফেলে রেখে পালিয়ে যাওয়া? তুমিই তো ছিলে শামিম, আমার কুমারী জীবনের প্রথম পুরুষ! চুপ করে থেকো না। জবাব দাও। আমি তোমার কাছে কোনও অপরাধ করেছিলাম? বল? কি অপরাধ করেছিলাম শামিম? বাবার সঙ্গে তোমার কি হয়েছিল, আমি তা জানিনে। বাবা সে কথা আমাকে কোনও দিন বলেননি। তুমি শামিম, তুমিও কিন্তু বলনি? তোমার সম্পর্কে বাবার মনোভাবের ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছিল। সেটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। কি হয়েছিল তোমাদের? তোমরা আমাকে কেউ কিছু বলনি। কিন্তু আমার মনে অস্বস্তি জেগে উঠছিল। সেটা কি তুমি টের পেয়েছিলে? তুমি কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তে। তোমার মুখ দিন দিনই গম্ভীর হয়ে উঠছিল, তুমি ক্রমেই বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিলে। বাবার সঙ্গে তোমার তখন অবিরাম তর্ক চলেছে। এবং সেটা যে গুরু-শিষ্যের মধ্যে তর্ক নয় তাও বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে যে, তোমরা তখন আর এক নৌকার সওয়ার নও। তোমরা দুজনে তখন দুটো আলাদা নৌকায় চড়ে বসেছ। অবশ্যই রাজনীতির নৌকা। রাজনীতি যেহেতু আমার মন টানত না, যদিও বাবা এবং তুমি, তোমরা দুজনেই চাইতে আমি তোমাদের আলোচনার শরিক হই। আমি বাবাকে ভালবাসতাম শামিম, আর তোমাকেও। এক সময় বাবার কথাই আমার কাছে বেদবাক্য বলে মনে হত। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আসবার পর থেকে আমি তোমার কথাকেই শেষ কথা বলে মনে করতাম। মনে আছে তোমার শামিম, বাবা একদিন তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে ডাকলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ তখন সবে বাজার গরম করতে শুরু করেছে। বাবা এসেই প্রথমে দিদিকে ডাকলেন। দিদি বাড়ি ছিল না নমিও না। আমিই সেদিন বাড়ি ছিলাম। যদিও সেদিন আমার বাড়ি থাকবার কথা নয়। দিদিরা এক নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছিল। আমার সেইখানেই যাবার কথা। কেন জানিনে সেদিন আমার যাবার গরজ ছিল না। দিদি অনেক সাধাসাধি করে, শেষ পর্যন্ত নমিকে নিয়েই চলে গেল। তাই তোমার সঙ্গে আমার সেদিন দেখা হল। তারপর থেকে তুমি আমাদের বাড়িতে আসতে শুরু করেছিলে। তখন তুমি বাবার ডান হাত। নিশ্চয়ই সেই কারণে। বাবা তখন রাজনীতিতে একেবারে ডুবে গিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিতে আমার কোনও আগ্রহ ছিল না। কিন্তু তবুও আমি তোমাদের বৈঠকে নিয়মিত যোগ দিতে আরম্ভ করেছিলাম। সে শুধু তোমার কারণে শামিম। আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম। সেই তুমি, হ্যাঁ তুমি শামিম, তুমি, সেই তুমিই আমাকে একদিন ছেড়ে চলে গেলে! কাওয়ার্ড! তুমি যদি ভেবে থাক শামিম, তোমাকে আমি ভালবেসেছিলাম বলে তোমাকে ক্ষমা করে দেব, তাহলে তুমি ভুল বুঝেছ। তুমিও আমাকে এক্সপ্লয়েট করেছ। ওদের সকলের মতোই। তোমাদের কাউকেই আমি ক্ষমা করব না। না না না। আমি কি বিড়াল ছানা! তোমাদের খুশিমতো আমাকে বস্তায় বন্দি করে যেখানে সেখানে ফেলে দিয়ে যাবে! আর আমি পড়ে থাকব একা। একা! একেবারে একা! এমন এক জায়গায় যেখানে উষ্ণতা নেই, ভালবাসা নেই, কোনও সহানুভূতি নেই। কারও সমবেদনা নেই।
তবুও অমিতা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। এতক্ষণ আক্রোশের রশিটা ধরে সে উঠতে চেষ্টা করছিল। সে বাঁচতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু খানিকক্ষণ চেষ্টা করে সে নিজেই এত ক্লান্ত বোধ করতে লাগল যে, সে হাল ছেড়ে দিল। আর অমনি সড়সড় করে সে পিছলে পড়তে শুরু করল যন্ত্রণার, বিরক্তির, একটা বোবা অনুভূতির অতলস্পর্শী গহ্বরে।
২
সেবক বৈদ্য রোডের বাড়িতে ওরা উঠে এসেছিল গোয়াবাগানের ঘিঞ্জি একটা বাসা থেকে। বাবা অনেক ভেবেচিন্তে এই বাড়িটা কিনে ফেললেন। মাকে বাবা বলেছিলেন, ‘বেশ ধার হয়ে গেল বাজারে। মা বলেছিলেন, ‘তা হোক, দেখো এ টাকা তোমার শোধ হয়ে যাবে। মেয়েরা বড় হয়ে উঠছে। এখন একটু ভাল পরিবেশে থাকাই ভাল।’ বাড়িটা ওদের সকলেরই পছন্দ হয়েছিল। একটা কম্পাউন্ড ছিল। একটা লিচু গাছ ছিল, গোটা দুই আমের গাছ আর ছিল একটা বেশ বড়সড় কাঁঠাল গাছ। যেদিন সকালে ওরা এসে পৌঁছাল, সেদিনই যখন মালপত্র নামান হচ্ছে তখন দিদি সড়সড় করে কাঁঠাল গাছটায় উঠে পড়ল। মায়ের সেদিন কী রাগ! মা খুব বকাঝকা করতে লাগলেন দিদিকে। ‘এটা ভদ্দরলোকের পাড়া, ঝুমরি! এ কী অসভ্যতা! নেমে এসো। নেমে এসো শিগগির!’ দিদির বয়স তখন নয়, তার সাত দিদি এমনই পাজি মেয়ে, মগডালে বসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতে লাগল, ‘মা, আমার মাথা ঘুরছে, আমি নামতে পারছি না। তুমি আমাকে কোলে করে নামিয়ে নিয়ে যাও। ও মা এসো, এসো। আমি কিন্তু পড়ে যাব।’ মা সত্যই ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। হন্তদন্ত হয়ে বাবাকে ডাকতে গেলেন। ‘ওগো ওগো শুনছ। দ্যাখ এসে তোমার ধিঙ্গি মেয়ে কী কাণ্ড বাধিয়েছে!’ দিদি ততক্ষণে হাসতে হাসতে গাছ থেকে নেমে এসেছে। বাবাও তাই দেখে হাসতে লাগলেন। শান্ত ভাবে মাকে বললেন, ‘তুমি বরং মালপত্রগুলো সামলাও গিয়ে। আমি এদের সামলাচ্ছি।’ মা চলে যেতেই বাবা বললেন, ‘কি রে ঝুমরি, বাড়িটা পছন্দ হয়েছে তো?’ দিদি বাবার গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ল। বলেছিল, ‘বাবা বাবা তুমি কী ভাল!’
সেবক বৈদ্য রোডে তেরাত্তির না পেরতেই দিদি প্রেমে পড়ল পাশের বাড়ির একটা ছেলের সঙ্গে। বেশ শান্তশিষ্ট ছেলেটা। তার নাম, দিদি বলত, ভ্যাবল। বোধ হয় দিদির সুন্দর মুখের দিকে সর্বক্ষণ হাঁ করে চেয়ে থাকত, তাই দিদি ওর নাম দিয়েছিল ভ্যাবল। এবং সেই ভ্যাবল নামটাই শেষ পর্যন্ত চালু হয়ে গেল। ভ্যাবল ছিল দিদির সর্বক্ষণের ছায়া। যত ফাইফরমায়েশ দিদির ভ্যাবলই খাটত। ফাঁক পেলেই দিদি ভ্যাবলকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ত। আর সারাটা পাড়া টো টো করে ঘুরে বেড়াত। মা বিস্তর বকাঝকা করতেন। দিদি ভ্রূক্ষেপও করত না। দিদির এমনি ছিল সাহস। মা বলতেন, ‘এত বড় মেয়ে, তোর কি হায়া লজ্জা বলতে কিছু নেই! একা একা রাস্তার মেয়ের মতো টো টো করে বেড়াস। তোর বাবা কিছু বলে না বোলে সিংঘির পাঁচ পা দেখেছিস!’ দিদি ভালমানুষের মতো মুখ করে বলত, ‘ওমা ওমা, তুমি দেখেছ সিংঘির পাঁচ পা? ওমা বল না, সিংঘির এই পঞ্চম পা কোথায় থাকে?’ মা রেগে কাঁই হয়ে যেতেন। বলতেন, ‘দেখ ঝুমরি, মেয়ে লোকের এত বাড় ভাল না। তুই একা একা ঘুরিস, তোর ভয় করে না?’ ‘ভ্যাবল যে ঘোরে, কই ওর মা তো ওকে সেজন্য কিছু বলে না।’ মা বলত, ‘ভ্যাবল হল পুরুষ ছেলে। ওর কথা আলাদা।’ দিদি এক গাল হেসে বলতেন, ‘ভ্যাবল পুরুষ তো? তাহলে মা, লক্ষ্মী মা, তুমি আমার জন্য আর বৃথা চিন্তা কর না। আমি সব সময় ভ্যাবলের সঙ্গে ঘুরি। এই ভ্যাবলা, মুখ বুজে আছিস কেন? বল না মাকে, আমি একা একা ঘুরি, না তোকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। অমন হ্যাবা গঙ্গারামের মতো দাঁড়িয়ে থাকবি তো এক তামেচা মেরে তোর মুণ্ডু উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেব।’ ভ্যাবল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলত, ‘আমার কোনও দোষ নেই মাসীমা, ওই আমাকে টেনে টেনে নিয়ে যায়।’ দিদি ভ্যাবলের গালে টেনে একটা চড় কষিয়ে বলত, ‘যা কাল থেকে তোর সঙ্গে আর কোথাও বেরুব না। তুই আবার পুরুষ! থুঃ। তোর সঙ্গে আমার আড়ি। যা বাড়ি যা।’ হরিকিশোরমেসোর ছেলে সেই ভ্যাবল পরে হয়ে দাঁড়াল মিঃ বি কে রয়। বিলাত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসে বাবার বন্ধু সান্যালকাকার জুনিয়ার হল। দিদির ততদিনে ভালোবাসার অন্য লোক এসে গিয়েছে জীবনে। দিদি যখন এম-এ পড়ে তখনই নিরঞ্জনের সঙ্গে গভীর ভালোবাসার পালা চলেছে দিদির। যদিও কেউ বিশেষ জানত না।
কী দুর্জয় সাহসই না ছিল দিদির! সেই ছোটবেলা থেকেই। গোয়াবাগানে ডালিমতলায় তারা যখন থাকত, তখন যত গোয়ালাদের সঙ্গে দিদির ছিল ভাব। তাদের ছেলেরাই দিদির বন্ধু ছিল। তাদের মুখের কথাই দিদি বলত। দিদিকে নিয়ে মায়ের উদ্বেগের আর অন্ত ছিল না। মায়ের হাতের কিল চড় সব দিদির পিঠেই পড়েছে। তবুও দিদিকে মা মানুষ করতে পারেননি। দিদি মরবার সময় বলেছিল, ‘ফুলকি, সারা জীবনই তো আমি তোদের আগে আগে হেঁটেছি, তোরা আমার পিছনে পিছনে এসেছিস। ঝড়ঝাপটা সব আমাকেই পোয়াতে হয়েছে। তোদের গায়ে আঁচটি লাগেনি। এবারও আমি আগে আগে চললুম। তোদের জন্য জায়গাটায়গা দেখে রাখি। তোরা ধীরেসুস্থে আয়।
দিদি সেবক বৈদ্য রোডের সব লোককেই বোধ হয় চিনত। অন্তত সেবক বৈদ্যের সব লোকই যে ‘সুধাকরবাবুর গেছো ‘মেয়েটাকে’ চিনত, সে বিষয়ে কোনও ভুল নেই। কী সুন্দর দেখতে ছিল দিদি! ফর্সা টকটকে গায়ের রঙ। নাক চোখ টানা টানা। কোঁকড়া কোঁকড়া ঘন চুল। বাবার মতোই লম্বাটে গড়ন ছিল দিদির। বাবার মতোই পাতলা পাতলা চেহারা। লোকে বলত, ভগবান ছেলে গড়তে গিয়ে দিদিকে ভুল করে মেয়ে বানিয়ে দিয়েছে। বাবা বলতেন, ‘ঝুমরি আমার ছেলেই তো। আমি তো ওকে আমার ছেলে বলেই ভাবি।’ আসলে বাবাদের এইসব কথা যে নেহাতই কথার কথা, অনেক পরে ফুলকি সেটা টের পেয়েছিল। বাবা-মায়ের কাছে ছেলেদের জন্য এক রকম মাপ আর মেয়েদের জন্য অন্য রকম মাপ। দিদি বড় হয়ে বলত, ‘ও সব ছেঁদো কথায় কান দিবিনে ফুলকি। আমি তো জানি, আমি ছেলে নই, মেয়ে। মা এক সময় আমাকে ছেলের পোশাকে সাজাতে ভালবাসত। কেন জানিস? আমি ছেলে হয়ে জন্মাইনি, সেই দুঃখে।’ সেই পোশাকগুলো মা শেষ দিন পর্যন্ত যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন। মা বলতেন, ‘তোর দিদি সারা জীবন আমাকে জ্বালিয়ে মেরেছে। যেসব কাজ মেয়েদের করার নয়, তোর দিদি তাই করে গিয়েছে।’ দিদি বলত, ‘ছেলের কাজ আলাদা মেয়েদের কাজ আলাদা, এটা কে ঠিক করে দিল?’ মা বলতেন, ‘ভগবান।’ দিদি বলত, ‘ভগবান অত একচোখো বলে আমার মনে হয় না।’ মনে হতে পারে, এ সব বুঝি আজকের কথা। কিন্তু এ সব তক্কো দিদি যখন মার সঙ্গে করত তখন তার বয়স তেরো কি চোদ্দো। দিদি এটা মানত, সে ছেলে নয় মেয়ে। কিন্তু এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারত না যে, ছেলেরা যা পারে মেয়েরা তা পারে না। বা ছেলেরা যা করে, মেয়েদের তা করা উচিত নয়। দিদির ছোটরেলার খেলার সঙ্গীরা সব ছেলে। বস্তির ছেলে। সেই জন্যই দিদির মুখে কোনও কথা আটকাত না। দিদির মুখে মা যেদিন বানচোত কথাটা শোনেন, সেদিন কী হুলুস্থুলু কাণ্ড ঘটেছিল তাদের ডালিমতলার বাড়িতে। মা পাগলের মতো দিদির চুল এক হাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে তাকে সমানে বেলুন পেটা করে যাচ্ছেন আর বলছেন, ‘বল বল আর কখনও ও কথা মুখে আনবি?’ আর দিদি সমানে বলে চলেছে, ‘কেন, ও কথা বললে কি হয়?’ দিদির তখন আট-ন’ বছর বয়স। ‘ঝুমরি, ছোটলোকদের সঙ্গে মিশো না।’ দিদি বলত, ‘ওদের ছোটলোক তোমরা কেন বল মা? আমি তো দেখি ওরা ভাল লোক। তবে কেন মিশব না ওদের সঙ্গে?’ ‘ফের মুখে মুখে তকো!’ অমনি শুরু হয়ে গেল দিদির পিঠে ঢিপঢাপ কিল চড় পড়া। নিত্য দিন দিদিকে নিয়ে অশান্তি চলত বাড়িতে। সেবক বৈদ্যতে এসে দিদির সঙ্গীসাথী কিছুটা বদল হল। এবার দিদি ভদ্দরলোকের ছেলেদের সঙ্গে খেলতে লাগল। ওর প্রাণের বন্ধু হল ভ্যাবলা। বিন্দু মাসির ছেলে। ভ্যাবলার বাবা হরিকিশোর মেসোমশাই আর বাবা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস্ করতেন। বাবা অ্যাডভোকেট আর হরিকিশোর মেসোমশাই অ্যাটর্নি। বাবা সেবক বৈদ্যতে যে বাড়িটা কিনেছিলেন, সেই বাড়িটা ছিল হরিকিশোর মেসোমশাইয়েরই এক মক্কেলের। ভ্যাবলার আসল নাম ছিল ব্রজকিশোর। দিদি ওকে ভ্যাবল বলত কেন, কে জানে? তবে ওদের বাড়িতে ভ্যাবলা নামটাই চালু হয়ে গিয়েছিল।
ভ্যাবলা দিদির চাইতে বয়সে খানিকটা বড়ই ছিল। তবে কেন যে সে দিদির সামনে এসে জড়সড় হয়ে থাকত, কে জানে! হয়ত সেই জন্যই দিদি ওর নাম ভ্যাবলা দিয়েছিল। কাঁচপোকা যেমন তেলাপোকাকে টেনে নিয়ে যায়, দিদি তেমনই ভ্যাবলাকে যেন টেনে নিয়ে যেত। দিদি একদিন বললে, ‘ভেবে দেখলাম ফুলকি, ভ্যাবলাকে বিয়েই করে ফেলব। ও বেচারি বড্ড কষ্ট পাচ্ছে।’ দিদি তখন ক্লাস এইটে পড়ছে। ‘আজ ইশকুল থেকে ফিরেই ছাতনাতলাটা সাজিয়ে ফেলব, বুঝলি। কাল সন্ধেতেই বিয়ে। ভ্যাবলাকে বলেছি। ও রাজি আছে।’ দিদি ইশকুলে যেতে যেতে গাড়িতেই ফিসফিস করে বলতে লাগল, ‘তুই হবি পুরুত।’ উত্তেজনায় ফুলকির গা সিরসির করতে লেগেছিল। সেদিন ক্লাসে তার ফলে ফুলকির খুব হেনস্তা হয়েছিল। বিশেষত ভূগোলের পিরিয়ডে। বারে বারে ফুলকি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল। তাকে সেদিন নিলডাউন হতে হয়েছিল। রমলাদির হাতে কানমলাও খেতে হয়েছিল। কিন্তু ফুলকি দিদির মুখ চেয়ে সবই সহ্য করেছিল সেদিন।
বাড়িতে এসে কিছু না খেয়েই দিদি ওকে নিয়ে চিলেকোঠার দিকে রওনা দিতে যাচ্ছিল। মা এসে পড়ায় দিদি ভালমানুষের মতো মুখ করে মাকে বলল, ‘মা আজ খেতে ইচ্ছে করছে না। আমরা একটু আসছি।’ মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কোন রাজকার্য করা হবে এখন? খেয়ে দেয়ে যে চুলোয় যাবার যেয়ো। যাও জামাটামা ছেড়ে এস।’ দিদি আর ঝামেলা না পাকিয়ে নিতান্ত বাধ্য মেয়ের মতো ইকুলের পোশাক বদলাতে চলে গেল। পরে যখন দুই বোনে চিলেকোঠায় গিয়ে ছাতনাতলাটা কোথায় হলে ভাল হয়, সেটা সরেজমিনে তদন্ত করতে লেগেছে, এমন সময় ভ্যাবল এসে হাজির হল। দিদি ভ্যাবলাকে দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। ‘বেহায়া কোথাকার! তুই এখানে এসেছিস কেন? আমি তোকে আসতে বলেছি? তোকে না পই পই করে বলে দিলাম, বিয়ের আগে তোতে-আমাতে দেখাশোনা করতে নেই! সেই বিয়ের সময় ছাদনাতলায় চারি চক্ষুর মিলন হবে! এত করে বলে দিলাম রাস্কেল, তা তোর আর তর সইল না! দিলি তো সব ভেস্তে! যা তোকে আর বিয়েই করব না। ফুলকি চল! ভ্যাবলার মুখচোখ দেখে খুবই মায়া হচ্ছিল ফুলকির। কিন্তু বিয়েটা দিদির, ও আর কি করবে? ভ্যাবলা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল দিদির মুখের দিকে। ওরা চিলে কোঠা থেকে নেমে এল। দিদি ভ্যাবলার দিকে একবারও চাইল না। রাতে পাশাপাশি শুয়ে ফুলকি ফিসফিস করে বলেছিল, বিয়েটা ভেস্তে দিলি কেন দিদি? ভ্যাবলা না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছে। ওকে মাপ করে দিলেই পারতিস। দিদি বলেছিল, ‘এ সব বড়দের ব্যাপার তুই বুঝবিনে। বিয়ের আগে বর-বউয়ের মুখ দেখাদেখি হতে নেই। ওতে অমঙ্গল হয়। ভ্যাবলা বলে তো আর অশৈরণ কিছু করতে পারিনে। আমার ভবিষ্যৎটা দেখতে হবে তো।’ ফুলকি তবুও বলেছিল, কাল না হয় না হত, কিন্তু পরেও তো হতে পারত? দিদি হাই তুলতে তুলতে বলেছিল, ‘ভ্যাবলাটা যেমন হাঁদা, ওর জীবনেও বিয়ে হবে না, তুই দেখে নিস।’ দিদির ভবিষ্যদ্বাণী ফলেছিল। ভ্যাবলার বিয়ে হয়নি। ও দিদিকেই বিয়ে করতে চেয়েছিল। ভ্যাবল যখন বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এল ততদিনে মা মারা গিয়েছেন। বাবা-মায়ের ইচ্ছে ছিল ভ্যাবলার সঙ্গেই দিদির বিয়েটা হয়। হরিকিশোরমেসো বিন্দুমাসিরও সেই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কেউই রাজি করাতে পারেনি দিদিকে। বিন্দুমাসি ফুলকিকে বলেছিলেন, ‘রাজি করা না তোর দিদিকে। না হলে আমার ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আমি জানি।’ ফুলকি এ কথা বলেছিল দিদিকে। দিদি বলেছিল, ‘ভ্যাবলা! ধ্যাৎ, ও আমার বর হবে কি করে! ওকে দেখলেই তো আমার হাসি পায়। এখনও সেই আগের মতো আমার মুখের দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে দেখেছিস? যেই আমার ও কথা মনে হয় অমনি আমার সেই ভ্যাবলাকে মনে পড়ে যায়। আর আমার বেজায় হাসি পায়। আমি কি করব বল?’ ভ্যাবলা তাই জীবনে বিয়েই করল না। দিদি তিন তিনবার বিয়ে করেছিল। তবুও ঘর বাঁধা আর ওর হয়নি। ঘর কি অমিতাই বাঁধতে পেরেছিল? তারও তো তার দিদির মতন তিন তিনটে বিয়ে হয়েছিল।
ঘর কোথায় ফুলকির, না না অমিতার? চারতলার ঘরে এখন, এই ভোর রাতে শুয়ে আছে অমিতা। একা, একেবারে একা। পায়ের তলায় মাটি নেই তার। সে কেবলই তলিয়ে যাচ্ছে। কেবলই ঘুরতে ঘুরতে পড়ছে এক অতলস্পর্শী কূপের মধ্যে। সারা জীবন ধরে ঘর বাঁধতে চেয়েছে অমিতা। এই কি তার পরিণাম? এক অশান্ত পিপাসা সারা জীবন ছুটিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে অমিতাকে। অমিতার দিদিকে। সেই পিপাসার নামই কি ভালবাসা?
৩
সেই সেবক বৈদ্য রোড। সেই দিদি। স্মৃতি সততই নাছোড়। দিদি একদিন গরমের দুপুরে দড়াম করে ঘরে ঢুকে উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘জানিস ফুলকি, আজ পঙ্কজ মল্লিককে দেখে এলাম। উনি এই পাড়াতেই থাকেন।’ দিদির চোখে স্বপ্ন নেমে এসেছে। ওর গাল দুটো রোদ্দুরে না উত্তেজনায়, কে জানে, লাল টকটক করছে। ফুলকি অবাক হল না। নিশ্চয়ই দিদির নতুন কোন প্রেমিক হবে। হঠাৎ ফুলকিকে জড়িয়ে ধরে গুন গুন করে গেয়ে উঠল, ‘যেন লগনে জনম আমার আকাশে চাঁদ ছিল রে।’ দিদি বলেছিল, ‘মুক্তির গান।’ নিউ থিয়েটার্সের মুক্তি তখন রমরম করে চলছে কলকাতায়। মা দিদিকে নিয়ে তাদের পুরনো পাড়ায় গিয়েছিল মুক্তি দেখতে। দিদি প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিল মুক্তি দেখে। ওর মুখে তখন দিনরাত গুনগুনিয়ে মুক্তির গান ফিরছে। ‘ওগো সুন্দর, মনের গহনে তোমার মুরতি খানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে যায় মুছে যায় বারে বারে।’ দিদি যেন পাগল হয়ে উঠত, খাওয়া দাওয়া ভুলে যেত, কেবল গানই গাইত। বলত, ‘কার গান জানিস? কাননবালার।’ সঙ্গে সঙ্গে গাইতে থাকত, ‘বাহির বিশ্বে তাই ত তোমারে টানি।’ দিদি বলেছিল, ‘পঙ্কজ মল্লিককে শুনিয়ে দিয়েছি রে ফুলকি। ওর চোখ ট্যারা করে দিয়েছি। ভ্যাবলাদের চেনা। ওদের বাড়িতেই দেখা। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কার কাছে গান শিখেছ। আমি বললাম শিখতাম, এখন ছেড়ে দিয়েছি। দিদি উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে অমিতাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
দিদিকে কোনও জিনিস চর্চা করে শিখতে হয়নি। সবই যেন ওর সহজাত ব্যাপার। ফুলকি আশ্চর্য হয়ে যেত। একটা গান, যে কোনও গান, অবিশ্যি দিদির যদি ভাল লাগত সেটা, একবার শুনলেই অবিকল ঠিক সুরে গেয়ে দিতে পারত। তাল লয় বজায় রেখে। অথচ কোনও দিন গান শেখেনি দিদি। বাবা অনেক চেষ্টা করেছিলেন। দিদিও এক ছোকরা ওস্তাদের কাছে গান শিখতে কয়েক দিন বসেছিল। তারপর কি হল? ওস্তাদ, যথারীতি, দিদিকে গান শেখানো ভুলে গিয়ে দিদির মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগল। তারপর একদিন উধাও হয়ে গেল। দিদি বলেছিল, ‘হারামির বাচ্চাটা আমার সঙ্গে মাজাকি করার চেষ্টা কেরছিল। ঝেড়েছি তামেচা। সেবক বৈদ্যে ও শালা আর কোনও দিন পা মাড়াবে না দেখিস।’ এটা দিদির গোয়াবাগানের ভাষা। এখনও উত্তেজিত হলে দিদি এই ভাষাতেই কথা বলে। সেই থেকে গান শেখা ছেড়ে দিল দিদি। কিন্তু শুনে শুনেও দিদি যেসব গাই গাইত, আমি অনেক শিখেও তার ধার কাছে পৌঁছুতে পারিনি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল অমিতার বুক চিরে। দিদি ফুলকিকে বলেছিল, ‘দেখ ফুলকি, তোকে যদি পুরুষ লোকেরা একবার মেয়ে বলে ধরে নেয়, তবে ওরা তোকে জ্বলিয়ে মারবে। এত অসভ্য ওরা, সেটা আর কহতব্য নয়।’ পুরুষ সম্পর্কে দিদির জ্ঞান বারো তেরো বছরেই টনটনে হয়ে উঠেছিল। গানের ওস্তাদের সম্পৰ্কে দিদি এমন সব কথা এমন এমন করে বলত যে ফুলকির হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেত। ‘বুঝলি ফুলকি, একদিন ওস্তাদ ব্যাটা বললে, সুমিতা’, দিদি ওস্তাদের গলা চোখ মুখের ভাব এমন ভাবে নকল করতে পারত যে পারত যে পাশের ঘর থেকে ওস্তাদের মার পক্ষেও বোঝা সহজ হত না যে, সেটা তার ছেলের গলা নয়, সুমিতা, গান বাজনাকে অতটা লঘু ভাবে নিয়ো না। একটু সিরিয়াস হতে তোমাকে অনুরোধ করছি।’
‘সুমিতা, নগানাৎ পরতরং। অর্থাৎ কিনা গানের উপরে আর কিছু নেই।’
‘সুমিতা, গুরু গান, দেবে, শিষ্যা সেই গান নেবে। গুরুকে অন্তরঙ্গ ভাবে গ্রহণ না করতে পারলে তো গান তোমার অন্তরঙ্গ হবে না।’
‘সুমিতা, এস এস কাছে এস, উঁহু উঁহু, আর একটু কাছে, হচ্ছে না, একটা ব্যবধান থেকেই যাচ্ছে। আজ তোমাকে একটা কঠিন জিনিস দেব। শুদ্ধ রে থেকে গা-কে স্পর্শ না করে কি করে কোমল নিখাদে পৌঁছুতে হয়, সেই সিলসিলাই আজ তোমাকে বাতলে দেব। তুমি বরং আমার কোলের উপর রস। গুরু শিষ্যে ফাঁক থাকলে সিলসিলাতেই ফাঁক থেকে যায়।’
‘আমি বসলাম গুরুর কোলের উপর।’
দিদি বলেছিল, ‘ওস্তাদ গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজতে লাগল। তারপর চক্ষু দুটো বুজে আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে আরম্ভ করল, তারপর আমার গায়ে। আমার সারা শরীর সিরসির করে উঠছিল। মিথ্যা বলব না ফুলকি, প্রথম দিকে একটু অস্বস্তি লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যে আমার কেমন ঘোর লেগে গিয়েছিল। তারপর গুরু আমার বুক টিপে দিল। তখন বুঝলাম, শুদ্ধ রেখাব থেকে গান্ধার না ছুঁয়ে কোমল নিখাদে আসবার সিলসিলা হচ্ছে এই।
দিদি বলেছিল, ‘গুরুর কোলে বসেই সপাটে একটা তামেচা ঝাড়তেই ওস্তাদ আমার বাপ বলে ঢলে পড়লেন। আমি বললাম, এটা তামেচার সিলসিলা। মনে থাকবে? গুরু আমার পা জড়িয়ে ধরল রে ফুলকি! বলে কি তুমি আমার মা। এই কান মলছি। দোহাই এ কথা কাউকে বল না।’ দিদির সে কি হাসি। হাসতে হাসতে দিদির চোখে জল এসে গিয়েছিল। হাসলে দিদির গালে সুন্দর টোল পড়ত। টোল দিদির চিবুকেও পড়ত। দিদির সে মুখের তুলনা একমাত্র দুর্গাপ্রতিমার মুখের সঙ্গেই করা চলে। আর একজন লোকের মুখেই মাত্র এই উপমাটা শুনেছিল অমিতা। সে হচ্ছে ভ্যাবল। দিদিকে দাহ করে ওরা সেবক বৈদ্য রোডের বাড়িতে সেদিন সবাই ফিরে এসেছিল। ওরা মানে কি? ফুলকি আর চুমকি। চুমকিকেই বাবা বাড়িটা দিয়ে গিয়েছিলেন। দিদির মতো বাবা অমিতাকেও ত্যজ্য করেছিলেন। ভ্যাবলের বয়স তখন পঞ্চান্ন। কিন্তু সে শ্মশান থেকে নিজের বাড়ি না গিয়ে সোজা চুমকিদের বাড়িতেই চলে এসেছিল। আর অমিতাকে সামনে দেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠেছিল। ‘প্রতিমা বিসর্জন হয়ে গেল অমিতা। ক্রিমেটেরিয়ামের চুল্লিতে ঢোকাবার আগে ও যেন হাসতে লেগেছিল। টোল পড়েছিল ওর গালে, টোল পড়েছিল ওর চিবুকে। আমি ওর চিবুকের টোলটার দিকে অবাক হয়ে চেয়েছিলাম। হ্যাঁ অমিতা, আমার মনে হল, ও হাসছে। যেমন ও হাসত ছোটবেলায় আমার হাবাগোবা মুখের দিকে তাকিয়ে। ও ঠোঁট টিপে টিপে হাসত। আর বলত, অ্যাই ভ্যাবলা, ফের যদি আমার মুখের দিকে অমন তাকিয়ে থাকবি তবে এক তামেচায় তোর মুণ্ডু ঘুরিয়ে দেব। তুই বড় হতে পারিস না ভ্যাবল? তুই যেদিন বড় হবি, পুরুষ হবি, সেইদিন তোকে বিয়ে করব। হ্যাঁ, অমিতা, তোমার দিদি ক্রিমেটেরিয়ামের ট্রেতে শুয়ে, ট্রে-টা যখন ধীরে ধীরে আগুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, আগুনটা ওকে গিলে ফেলার আগের মুহূর্তে তোমার দিদি আমার মুখের দিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসতে হাসতে এ কথা বলেছিল।’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে ভ্যবল সেদিন বলেছিল, ‘আমি বলতে গেলাম ঝুমরি, আমি কি এখনও বড় হইনি, ঝুমরি আমি কি এখনও পুরুষ হইনি, কিন্তু আমার কথা শোনার আগেই আগুন এক লাফ দিয়ে ওকে ঢেকে ফেলল। আমি একা এখন কি করে থাকব ফুলকি!’ ভ্যাবল কালেভদ্রে তাকে ফুলকি বলত। সেইদিন, সেই শোকের মধ্যেও, অমিতার দিদির প্রতি ঈর্ষা হল। আর তার তখন মনে হয়েছিল, ভ্যাবল তুমি আমার প্রেমে কেন পড়লে না? সেদিন অমিতার কি মনে হল, সে ভ্যাবলের হাতখানা নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিয়ে নিজেও কাঁদতে লাগল। ভ্যাবল অমিতাকে তার বুকে টিনে নিয়ে উন্মাদের মতো চুমু খেয়ে যেতে লাগল। অমিতা একটুও বাধা দিতে পারেনি। দেবার ইচ্ছেও হয়নি তার। ভ্যাবলের প্রতি সহানুভূতিতে সেদিন সেই মুহূর্তে অমিতার মন কানায় কানায় ভরে উঠেছিল। এমন কি সেই সময় অমিতার এ কথাও মনে হয়েছিল, দিদি ঠিক করেনি। দিদি লোক চিনতে পারেনি। দিদি তো সারা জীবন ধরে ঘর বাঁধার লোক খুঁজে বেড়িয়েছে। পায়নি। অথচ এ লোক তার তো হাতের নাগালেই ছিল।
বছর কতক আগে এক কবি সম্মেলনে অমিতা নীরেন্দ্রনাথের আবৃত্তি শুনেছিল রবীন্দ্রসদনে। ‘আঁচলে কাঁচ বাঁধে সবাই চেনে না কেউ সোনা, এখানে মন বড় কৃপণ এখানে থাকব না।’ শুধু দিদিই কি আঁচলে কাঁচ বেঁধেছে? সে অমিতা? সে কি করেছে? সেও কি এই একই কাজ করেনি?
ভ্যাবল অমিতাকে কেন ভালবাসেনি? ও দিদির খেলার সঙ্গী ছিল, এটা ঠিক। দিদি ওকে কোনদিন পাত্তা দেয়নি। এটাও ঠিক। এবং ভ্যাবল বরাবর দিদির তল্পী বহন করে গিয়েছে। এটাও ঠিক। ভ্যাবল দিদিকে নিয়েই এত ব্যস্ত ছিল যে, দিদির আশে পাশে যারা ছিল, অমিতা ছিল, দিদির থেকে মাত্রই সে দু বছরের ছোট। তাকে ভ্যাবল কোনদিন পাত্তা তো দেয়নি? কেন? সে দিদির মতো অত সুন্দরী নয় বলে? হাসলে তার গালে আর চিবুকে টোল পড়ত না বলে? অমিতা এমন কোনও একদিনের কথা মনে করতে পারে না, যেদিন ভ্যাবল অমিতার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে কথা বলেছে বা চেষ্টা করেছে। কেন? দিদির ভয়ে? ভ্যাবল যেদিন দিদির শোকে ওকে জড়িয়ে ধরেছিল শ্মশান থেকে এসে, উন্মাদের মতো চুমু খেয়ে যাচ্ছিল তার গালে ঠোঁটে, চিবুকে, বিশেষ করে চিবুকে, অমিতা জানত, সে দিদিকে প্রকসি দিচ্ছে। ভ্যাবল তার শরীরে তন্ন তন্ন করে দিদিকেই খুঁজছে। না হলে ভ্যাবল তার চিবুকে বারবার তার ঠোঁট ঠেকাতে যাবে কেন? তার চিবুকে তো দিদির মতো টোল পড়ে না। অমিতা সেই দিন তার মধ্যে ঘন ঘন অনুভূতির পরিবর্তন লক্ষ্য করে অবাক হয়ে যাচ্ছিল।
দিদির মৃত্যুর খবর পেয়ে সব প্রথমে ছুটে এসেছিল ভ্যাবল। চুমকিই তাকে খবরটা জানিয়েছিল। ভ্যাবল সেই ভোরেই গাড়ি নিয়ে ছুটে গিয়েছিল নার্সিং হোমে। ভ্যাবলই গাড়ি নিয়ে অমিতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভ্যাবলই ফোন করে দিদির প্রাক্তন স্বামীদের খবর দিয়ে নার্সিং হোমে এনে জড় করেছিল। শঙ্কর সেন, দিদির দ্বিতীয় স্বামী, বিজনেসম্যান। ফুলকির শঙ্করকে মনে হত একটা এপ ম্যান। সেই সাত সকালেই খানিকটা মদ গিলে হাজির হয়েছিল সে। ভ্যাবল কেবল সুযশ কাপুরকেই, দিদির তৃতীয় স্বামীকে, খবর দিতে পারেনি। কাপুর রোধ হয় দিল্লিতে ছিল। ভ্যাবলকে দেখামাত্র ছোবল মেরে দিল শঙ্কর, ‘এই যে ব্রাদার এঁটুলি, এখনও ভদ্রমহিলার গায়ে সেঁটে রয়েছ বাপ। তুমি যে কাবুলিকেও টেনাসিটিতে হার মানিয়ে দিলে! মিসেস্ মুখোটি তিন তিনটে হাজব্যাণ্ডকে হাপিস্ করে দিলে। কিন্তু মিঃ এঁটুলিকে ছাড়াতে পারলে না! তা কি স্থির করছে, এবার সহমরণে যাবে? যদি পার, তবে একটা কীর্তি রাখবে ভবে। লাভারের সঙ্গে সহমরণ, বেশ একটা নতুন জিনিস হবে। বেড়ে জমবে।’ অমিতা বেজায় রেগে গিয়েছিল সেদিন। ভ্যাবল, যদিও তার গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে উঠেছিল, তবু সে শান্ত ভাবে, বলেছিল, ‘ওর দিকে তোমার লক্ষ্য দেবার দরকার নেই অমিতা। তুমি তোমার দিদির কাছে থাক।’ শঙ্করের মুখের ‘মিসেস মুখোটি’ কথাটা অমিতার কানে ঠক করে বাজল। দিদির বর বদলেছে কিন্তু নিরঞ্জনের পদবীটা ছাড়েনি। সেটা এই প্রথম খেয়াল পড়ল অমিতার।
নিরঞ্জন, এসে পড়ায় নার্সিং হোমে শঙ্করের নাটক বেশি দূর গড়াতে পারেনি। নিরঞ্জনকে দেখেই শঙ্কর বলে উঠল, ‘এই যে ব্রাদার, মিঃ ঢোঁড়া সাপ, কি খবর? অ্যাঁ, এত ফুল এনেছ কেন? ওহ, হো শোক। আমাদের তো আজ আবার শোক পালন করতে হবে। হ্যা হ্যা হ্যা। আমরা তো আজ বিধবা হলুম, না কি?’ নিরঞ্জন কিছু বলল না শঙ্করকে, ও তার ছেলেকে সঙ্গে করে এনেছিল, তাকেই বলল, ‘নিলু বাবা, তুমি তোমার ফুলকি মাসির সঙ্গে বড় মাকে দেখে এসো। ফুলগুলো তার পায়ে দিয়ো।’ শঙ্করকে বলল, ‘শঙ্কর, চল তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি। বড্ড আপ সেট হয়ে পড়েছ দেখছি। এখন বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও গে।’ নিরঞ্জনই শঙ্করকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। ভ্যাবল বলল, ‘আমতা তুমি এখানে থাক। আমরা এখান থেকেই ঝুমরিকে ক্রিমেটেরিয়ামে নিয়ে যাব। আমি আর নমি ব্যবস্থাগুলো সেরে ফেলি।’ তারপর একটুক্ষণ অমিতার দিকে চেয়ে থাকল ভ্যাবল, বিড় বিড় করে বলল, ‘শি ওয়াজ এ কুইন। সেই মর্যাদা ওকে ওর অন্ত্যেষ্টিতে দিতে হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে এখানেই ফিরে আসব।
ভ্যাবল হঠাৎ নিরঞ্জনের ছেলের সামনে থমকে দাঁড়াল। বলল, ‘তুমিই তাহলে নিলু? তোমার বাবার কথা আর তোমার কথা, বিশেষ করে তোমার কথা, তোমার বড় মা খুব বলত। তোমাদের দেখতে চেয়েছিল খুব।’ ভ্যাবলের গলা ভারী হয়ে এল। আর ওরই মধ্যে অমিতার চোখে পড়ে গেল, ভ্যাবলের চোখ দুটো টলটল করছে। নীলাঞ্জনকে বুকের মধ্যে আলতোভাবে চেপে ধরে ভ্যাবল ছেড়ে দিল। ‘তোমাকেই দেখতে চেয়েছিল তোমার বড় মা।’
নিরঞ্জন ভেতরে ঢুকেই বলল, ‘শঙ্করটা বরাবরের বাঁদর। আমারই দোষ, আমিই ওকে আমাদের পরিবারে এনে ঢুকিয়েছিলাম। খাল কেটে কুমির এনেছিলাম। সব তচনচ করে দিয়েছে ও।’
কত বুড়োটে হয়ে গিয়েছে নিরঞ্জন। গাল দুটো চুবসে গিয়েছে। উপরের পাটির গোটা কয়েক দাঁত পড়ে গিয়েছে। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে মুখটা ভরে আছে। নিরঞ্জন চারিদিকে তাকিয়ে বলল, ‘মউ? মউ কোথায়?’ ভ্যাবল বলল, ‘আমার মুহুরিকে গাড়ি দিয়ে বহরমপুর পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করি দুপুরের মধ্যে এসে পড়বে ওরা।’ নিরঞ্জন একটা সিগারেট ধরাতে যেতেই নিলু বলল, ‘বাবা তুমি আর সিগারেট খেয়ো না এখন। এরই মধ্যে দু প্যাকেট শেষ করে ফেলেছে। এর পরই আবার কাশি শুরু হবে।’ নিরঞ্জন অদ্ভুতভাবে হাসল। জীবনের যত ব্যথাকে নিংড়ে যেন হাসিটা মুখে ফুটিয়ে তুলল নিরঞ্জন। ‘দেখলে ব্রজকিশোর, কেমন কড়া গার্জেন আমার! একটু এদিকে ওদিক হবার উপায় নেই।’ তারপর অদ্ভুত কোমল সুরে ছেলেকে বলল, ‘আজ আমাকে তোর শাসন থেকে ছুটি দে, নিলু। শুধু আজকের দিনটা, কেমন?’ নিরঞ্জন এমন রিক্ত স্বরে কথাটা ছেলেকে বলল, সেই রিক্ততা অনেকক্ষণ ধরে ঘরময় ছড়িয়ে যেতে লাগল। অমিতার মনের একেবারে ভিতরে ঢুকে গেল নিরঞ্জনের সেই স্বর এবং সারাদিন ধরে অমিতার নাভিমূল থেকে কণ্ঠার দিকে ঠেলে ঠেলে উঠতে লাগল। নিরঞ্জনকে দেখলে অমিতার খুব দুঃখ লাগে। কী স্মার্ট ছিল নিরঞ্জন! ভ্যাবলের ঠিক উলটো। এক জায়গায় শুধু দুজনের মিল। দুজনেই দিদিকে প্রচণ্ডভাবে ভালবাসত।
সেবক বৈদ্য স্ট্রিটের ওদের সেই বাড়িটার যে ঘরে দিদি থাকত, যদিও সে ঘরটার অনেক পরিবর্তন হয়েছিল, নমি বাড়িটায় একটা নার্সিং হোম গড়ে তুলছিল, সেই ঘরটাতে তাই দিদির কোনও স্মৃতিচিহ্ন ছিল না, তবুও ভ্যাবল আর অমিতা সেই ঘরে তাদের স্মৃতির ভগ্নাংশগুলো জুড়ে জুড়ে দিদিকেই যেন নতুন করে গড়ে তুলতে চাইছিল। ভ্যাবল কাঁদছে আর তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে চলেছে, ভ্যাবলের চোখের লোনা জল চুঁইয়ে, অমিতার ঠোঁটে গড়িয়ে পড়ছে। ভ্যাবলের ঠোঁটের নোনা স্বাদ প্রথম দিকে অমিতাকে কেবলই উন্মনা করে তুলেছিল। এই সেবক বৈদ্যতেই দিদির সঙ্গে ভ্যাবলের পরিচয় হয়। ভ্যাবল দিদির প্রেমে পড়ে। এটা একদিনে হয়নি। একটু একটু করেই ভ্যাবলের মনে ভালবাসা দানা বেঁধেছে। দিদিও এই সেবক বৈদ্যতেই নিরঞ্জনের প্রেমে পড়ে। দিদি যাকে বলে হুড়মুড় করে প্রেমে পড়েছিল। অমিতার হৃদয়েও প্রেমের উন্মেষ হয় এই সেবক বৈদ্য রোডের বাড়িতেই। শামিম। হ্যাঁ শামিম। বাবার পলিটিক্যাল জীবনের মন্ত্রশিষ্য ছিল শামিম। দিদি তখন নিরঞ্জনের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করছে। যদিও কাকপক্ষীতে তা টের পায়নি। ভ্যাবলের তো কোনদিনই বোধ শোধ ছিল না। ও দিদির প্রেমে মশগুল। তাই নিয়েই তুষ্ট হয়ে রয়েছে। বেচারা, এখন কেমন চুমু খাচ্ছে দেখ। কোনও মেয়ের মুখে ও কখনও ঠোঁট ঠেকিয়েছে বলে তো মনে হয় না। দিদির স্মৃতি ওর মনে দাউ দাউ করে জ্বলছে, অন্তত ভ্যাবলার লোনা ঠোঁটের চুমু খেতে খেতে অমিতার তাই মনে হল। দিদিকে ও কোনদিন চুমু খেতে পারেনি। দিদিও ওকে কোনদিন একটা চুমুও খায়নি। দিদি একদিন গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘দেখ ফুলকি, আজ আমি ভ্যাবলকে চুমু খেয়ে দেখব, ও কি কাণ্ড করে।’ যদিও চুমু তখনও কাউকে খায়নি ফুলকি, দিদি কাউকে খেয়েছে কিনা বলতে পারে না। বোধ হয় দিদিও তখনও কাউকে চুমু খায়নি। তবে বিলিতি সিনেমায় ও চুমু খাওয়াখাওয়ির অনেক দৃশ্য দেখে ফেলেছে। দিদি ভ্যাবলকে চুমু খাবে, এই ঘোষণা দিদির মুখে শোনা ইস্তক অমিতার দেহে এমন উত্তেজনা ভর করেছিল যেন সেই কাউকে চুমু খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। দিদি আর ও ব্যাপারে উচ্চবাচ্য করছে না দেখে অমিতার প্রায় দম বন্ধ হবার অবস্থা। অবশেষে থাকতে না পেরে দিদিকে রাত নিশুতি হবার পর জিজ্ঞাসাই করে বসল সে, দিদি তুই খেয়েছিস? দিদি বিস্মিত হয়ে বলল, ‘তোর সঙ্গেই তো খেলাম।’ অমিতা কি বলল আর দিদি কি বুঝল। অমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার চেষ্টা করল। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল চাপতে পারল না। সরাসরিই জিজ্ঞাসা করে বসল, দিদি তুই যে বলেছিলি, ভ্যাবলকে এই ইয়ে খাবি। খেয়েছিস? দিদি সঙ্গে সঙ্গে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বলল, ‘দুর ভ্যাবল কি মানুষ যে ওকে চুমু খেতে যাব।’ হঠাৎ দিদি অমিতাকে জড়িয়ে ধরল। ‘ফুলকি, আজ আমি তোকে চুমু খাব। ওঠ আলোটা জ্বালি নইলে ঠিক বোঝা যাবে না।’ দিদি বিছানা থেকে সড়াক করে উঠে পড়েছিল। তারপর আলো জ্বালল। তারপর ড্রেসিং আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘আয় ফুলকি! আমার সামনে এসে দাঁড়া। দেরি কচ্ছিস কেন?’ দিদির কথা শুনে অমিতার বুক ততক্ষণে ঢিপ ঢিপ করতে লেগেছে। সে বিছানা ছেড়ে উঠল না। বলল, না। ‘না কিরে বোকা? উঠে আয়, দেখবি মজা হবে। রুডল্ফ ভ্যালেনটিনো কেমন করে গ্রেটা গার্বোকে চুমু খেয়েছিল তোকে দেখিয়ে দেব। ক্লার্ক গেবল মিরনা লয়কেও খুব স্টাইল করে চুমু খেয়েছে রে। ক্লার্ক গেল ভ্যালেনটিনোর থেকে বেশি প্যাশনেট। নে ওঠ ওঠ।’
দিদি সেদিন তাকে ঠেলেই বিছানা থেকে তুলে দিয়েছিল। তারপর হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটার সামনে। দুই বোনের ছায়া পড়েছিল সেই আয়নায়, এই দৃশ্য অমিতা এখনও ভুলতে পারেনি। এমন কত স্মৃতিই ভুলতে পারেনি অমিতা। সেদিন যেন গত কাল। ভ্যাবলের আনাড়ি ঠোঁট দিদির সেই দিনের ঠোঁটের কথা মনে পড়িয়ে দিল অমিতার। দিদি ওর দিকে অমিতার মুখটা ঘুরিয়ে এনে বলল, ‘মুখটা অল্প একটু কাত কর ফুলকি, তুই এখন গ্রেট গার্বো আর আমি ভ্যালেনটিনো। হ্যাঁ এইবার আমার মুখের দিকে তোল তোর ঠোঁট, ও কি, মুখ বুজে আছিস কেন হাঁদারাম, ঠোঁটটা অল্প ফাঁক কর। মুখটা আর একটু ত্যারচা কর। হ্যাঁ, এইবার হয়েছে।’ দিদি যেন থিয়েটারের মোশন মাস্টার হয়ে উঠেছিল সেইদিন। দিদি মুখটাকে ত্যারচা করে ওর ঠোঁট আস্তে আস্তে নামিয়ে এনেছিল অমিতার মুখের কাছে। দিদির নিঃশ্বাস এসে লাগছিল তার গালে। যেমন একটু আগেই ভ্যাবলের নিঃশ্বাস তার গালে এসে লাগছিল। তারপর দিদির শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত তালে বইতে লেগেছিল। দিদির চোখে অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতা, ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে তখন। দিদি ওর ঠোঁট দুটো দিয়ে অমিতার ঠোঁটদুটোকে ধীরে ধীরে চেপে ধরল। সেইদিন অমিতার শরীর সিরসির করে উঠেছিল। একটু পরেই দিদি মুখটা তুলে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠল, ‘এই হল রুডল্ফ ‘ভ্যালেনটিনো বুঝলি।’ দিদির ওই রকম মুখের চেহারা আর কোনওদিন দেখেনি অমিতা। একটু পরেই দিদি একেবারে স্বাভাবিক হয়ে এল। তারপর তার খিলখিল হাসি। সে হাসি আর থামেই না। হাসতে, হাসতে বলল, ‘তোতে আর ভ্যাবলাতে কোনও তফাত নেই। ফুলকি, জীবনেও তুই গ্রেটা গার্বো হতে পারবিনে। তোর ঠোঁট নড়েই না। ও ঠোঁটে কে চুমু খেয়ে মজা পাবে?’
সেদিন ওরা যখন আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল তখন অমিতার মনে দুঃখ হয়েছিল। তার মনে হয়েছিল, সে একটা অপদার্থ। দিদির শোকে উন্মত্ত হয়ে ভ্যাবল যখন তাকে চুমু খাচ্ছিল তখনই সে ‘ভ্যাবলের আনাড়িপনা ধরে ফেলেছিল। কিন্তু তাতে ভ্যাবলের প্রতি সহানুভূতি বেড়েই গিয়েছিল। সে পরম আদরে ভ্যাবলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে ওর ঠোঁটে গভীর চুমু এঁকে দিয়েছিল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভ্যাবলকে বলেছিল, ‘তুমি এখন বাড়ি যাও ভ্যাবল।’ ভ্যাবল কি একটা বলবে বলে মুখ তুলতেই অমিতা বলেছিল, ‘তুমি আজ খুবই ক্লান্ত। সারাদিন তোমার উপর দিয়ে কি যে গিয়েছে, আমি তা বুঝতে পেরেছি। আর একটি কথাও এখন নয়। তুমি বাড়ি গিয়ে এখন ঘুমোতে চেষ্টা করো।’ ভ্যাবল একটি কথা না বলেই সেদিন চলে গিয়েছিল। ভ্যাবল যে কত বুদ্ধিমান আর কত ভাল, এ-সব সময়েই সেটা বোঝা যায়। ভ্যাবল চলে গেলে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে অমিতা মনে মনে বলে উঠল, তুই ভ্যাবলকে চিনতে পারিসনি দিদি। একটুও চিনতে পারিসনি। ভ্যাবলকে না হয় তুই ভালবাসতে পারিসনি, বিয়ে করিসনি, ঠিক আছে। কিন্তু নিরঞ্জনকে তো তুই ভালবেসেছিলি? তাকে তুই এমন হেনস্থা করলি কেন? তাকে তো তুই ভালবেসেই বিয়ে করেছিলি। তবে? নিরঞ্জন প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট খেয়েছে সারাদিন। সন্ধ্যায় দিদির শরীর যখন দাউ দাউ করে পুড়ছে তখন মউ এসে নিরঞ্জনের হাত থেকে শেষ প্যাকেটটা টেনে নিয়ে বলল, ‘বাবা তুমি এটা আমাকে দিয়ে দাও।’ মউ কাঁদছিল। তবে সংযত ছিল। দিদি আর দিদির মেয়েতে এইখানে এক মস্ত তফাত দেখেছে অমিতা। দিদিকে তার মনে হত যেন সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ। আর মউ? অমিতা বেশ কয়েকবার সাংদাকফুতে গিয়েছে। সাংদাকফুর সরকারি বাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা গিরিশ্রেণী দেখতে তার ভাল লাগত। ১৪ হাজার ফুট উঁচু থেকে দেখা যেত সার সার বরফে মোড়া কতকগুলো পাহাড়ের চূড়া। সাদা সাদা চূড়াগুলোকে তার মনে হত, ওগুলো সব সাগরেরই ঢেউ ছিল এক কালে। যেন কোনও দুর্বাসার শাপে এখন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনও চঞ্চলতা নেই। মউ যেন ওই রকমেরই নিথর ঢেউ।
৪
মউ বলেছিল, তারা তখন শ্মশানে, ‘বাবা বোধ হয় আর বেশি দিন বাঁচবে না। বাবার চোখ দুটো দেখেছ ফুলকি মাসি, বাঁচার কোনও ইচ্ছেই ও চোখে নেই। নিলুর কি হবে ফুলকি মাসি·?’ মউ নীলাঞ্জনকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ‘ভাই, আমাদের দুই মা, কিন্তু বাবা এক। আমাকে তুই দেখিসনি। আমার মাও তোকে দেখেনি। কিন্তু তোর সব খবরই মা রাখত। তুই আজ এখানে এসে খুব ভাল কাজ করেছিস ভাই। মা তোকে দেখলে খুব খুশি হত।’ নীলাঞ্জন বলেছিল, ‘তোমাকে আমি দেখিনি দিদি, কিন্তু তুমি আমার খুবই চেনা। আজ তুমি আসবে বলে আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি যখন গাড়ি থেকে নামলে, তোমাকে চিনতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি।’ ‘কেমন করে তুই আমাকে চিনলি নিলু?’ নীলাঞ্জন মউয়ের মুখের দিকে অপলক চেয়ে থেকে বলেছিল, ‘তোমার ফটোতে আমাদের বাড়ি যে ভরা দিদি।’ বাবার কাছে দুটো তিনটে অ্যালবাম আছে তোমার ছবিতে একেবারে ঠাসা। জ্ঞান হওয়া অবধি শুনছি, এইসব ফটো যার সে আমার দিদি। তোমাকে আমি চিনব না!’ মউ নিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ‘তোমার প্রতিটি জন্মদিনে বড় মা তোমার একখানা করে ফটো বাবাকে পাঠাত। তা ছাড়া তুমি পাস করলে কি প্রাইজ পেলে, তোমার ফটো আসত বাবার কাছে। পিছনে বিবরণ লেখা থাকত। বড় হয়ে আমি সেসব পড়েছি দিদি। তোমার বিয়ের কার্ডও আমাদের বাড়িতে এসেছে। বড় মার নামে সে কার্ড ছাপা। তাতে লেখা ছিল, আমার আর নিরঞ্জন মুখোটির একমাত্র মেয়ে মউমাছি…’
‘বাবা আমার বিয়েতে যায়নি।’ মউয়ের গলা ভারি হয়ে এল।
‘হ্যাঁ। বাবা সেদিন খুব ছটফট করেছিল। মা বাবাকে যেতে বলেছিল বারবার। মাও তোমাকে খুব ভালবাসে দিদি।’
‘দেবযানী! দেবযানী আমাকে তো দেখেইনি কোনওদিন।’
‘মা বাবাকে বলেছিল তোমার বিয়েতে যেতে। বলেছিল, তুমি যদি না যাও, তোমার মেয়ে সে দুঃখ জীবনেও ভুলবে না।’
‘হ্যাঁ নিলু, দেবযানী ঠিকই বলেছিল। বাবা আমার বিয়েতে যায়নি, সে কষ্ট এখনও আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। বাবা-মার মধ্যে কি ঘটনা ঘটেছিল, কেন তাদের অটুট ভালবাসা ভেঙে খান খান হয়ে গেল, সেটা বাবা আর মায়ের ব্যাপার। আমি কোনওদিনই মাকে সে কথা জিজ্ঞাসা করিনি। কিন্তু আমি মনে করি, যখন কেউ কারও বাবা কি মা হয়েই পড়েছে, তাদের উচিত নয় তাদের ছেলেমেয়েদের উপেক্ষা করা। তাদের কি দোষ বল?’
‘মা ঠিক এই কথাটাই বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল দিদি। আমার সে ঘটনা মনে আছে। কিন্তু বাবা বলেছিল, তুমি শঙ্করকে চেন না দেবযানী। ওটা একটা বাঁদর। ওটা আমার জীবনে একটা শনি। ও আমাকে দেখলে, সেই বিয়ে বাড়িতেই একটা সিন্ ক্রিয়েট করবেই। আমি চাই না মউয়ের বিয়েতে এমন একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটুক।’
‘কিন্তু শঙ্কর আমার বিয়েতে বিশ্রী কাণ্ড ঘটাবে কি করে? তাকে তো মা এ ব্যাপারে মাথা গলাতেই দেয়নি। আমার বিয়ের খরচও সম্পূর্ণ মায়ের টাকাতেই করা হয়েছে নিলু। তুই বাবাকে সেটা কোনওদিন জানিয়ে দিস। আর শঙ্কর বাবার সঙ্গে কি অসভ্যতা করেছে তা আমি জানিনে, জানতেও চাইনে। মায়ের সঙ্গে যেসব দুর্বব্যহার করেছে, সেটার সাক্ষী আমি নিজেই আছি। মাকে পাগল করতে বাকি রেখেছিল শঙ্কর। সে যাই হোক, শঙ্কর কিন্তু আমাকে খুব ভালবাসত। সত্যিই ভালবাসত। কি আমার অবস্থা একবার বুঝতে চেষ্টা কর। আমি তখন যদিও ছোট তবুও এত ছোট নই যে, কোনও কিছু বুঝতে পারিনে। ওই বয়সেই আমার মতন অবস্থায় যেসব ছেলেমেয়েরা বড় হয়, তারা একটু পেকে যায়।’
অমিতা সেই ক্রিমেটেরিয়ামের বাগানে পাতা লম্বা বেঞ্চিতে তখন বসে। তার এক পাশে নিরঞ্জনের ছেলেমেয়ে, একজনের বয়েস পনেরো আরেক জনের বয়েস পঁচিশ, তার আরেক পাশে নিরঞ্জন আর ভ্যাবল, দিদি তখন পুড়ছে, অমিতা বিহ্বল হয়ে পড়ছিল। সে কি তখন দিদির জীবনটার মানে খুঁজছিল সেইখানে সই পরিবেশে বসে? ‘মা যখন শঙ্করকে বিয়ে করল নিলু তখন আমার বয়েস তেরো। মা বেশ কিছুদিন থেকেই একটা উদ্বেগের চাপে ভুগছিল। কি কারণে এই উদ্বেগ আমি বলতে পারব না। মা কি বুঝতে পেরেছিল যে, জেদের বশে সে যে এই বিয়েটা শঙ্করের সঙ্গে করতে যাচ্ছে, সেটা টিকবে না। শঙ্করের মুখের কথা আমার কানে যতটা এসে পৌঁছত তখন, তার থেকে আমার মনে হয়েছিল, বাবা কিছুতেই এ বিয়ে হতে দেবে না। বাবা ডাইভোর্স দেবে না। শঙ্কর যখন তখন বাবাকে গালমন্দ করত। যাচ্ছেতাই বলত বাবাকে। বলত, জেলে পাঠাব। মায়ের উদ্বেগের কারণ কি সেটাই ছিল? নিলু মায়ের অবস্থা তখন অসহ্য হয়ে উঠেছিল। মা তখন বাবাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ঘৃণার আগুনে মায়ের নরম মনটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আমি বুঝেও সেটার কিছুই করতে পারছিনে। বুঝে দেখ, বুঝতে চেষ্টা কর নিলু, আমি কেবল তোকেই এ কথা বলছি, আর হয়ত তোর সঙ্গে দেখা হবে না।’ নিলু আঁকুপাঁকু করে বলে উঠল, ‘না দিদি না। তুমি আর আমাদের ছেড়ে যেয়ো না। তুমি না থাকলে বাবাকে এখন কেউ বাঁচাতে পারবে না।’ নিলু নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। মউ নিঃশব্দে নিলুর চোখ মুখ ওর শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিতে লাগল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে নিলু বলতে লাগল, ‘আমার এই বয়েসেই আমি কম যন্ত্রণা পাচ্ছিনে দিদি, আমার কিছু ভাল লাগে না। আমি এদের কিছু বুঝতে পারিনে। আমার কেবল কষ্ট হয়। কষ্ট হয়। কাউকে কিছুই বলতে পারিনে। বলতে পারিনে, আমি বাবাকে ভালবাসি; আমার মাকে ভালবাসি, বড় মাকে, যাকে কোনওদিন দেখিনি, তাঁকে ভালবাসি।’ মউ ভিজে গলায় বলে উঠল, ‘আর আমাকে; আমাকে তুই ভালবাসিসনে নিলু?’ নিলু দুই হাতে তার দিদিকে জড়িয়ে ধরল। ‘তোমাকে আমি স্বপ্নে দেখি দিদি। প্রায়ই তোমাকে দেখি। যখন মন খারাপ হয় তখন তুমিই তো আমাকে ভরসা দাও। তবে তোমার জন্যও একবার খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। মউ অবাক হয়ে বলল, ‘আমি কষ্ট দিয়েছি নিলু?’ নিলু মাথা নিচু করে বলল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছ।
‘তুই তো আমাকে আগে দেখিসইনি। আমি কি করে তোকে কষ্ট দিলাম।’
‘তোমার বিয়ের চিঠিতে বড় মা লিখে দিয়েছিল, আমার এবং নিরঞ্জন মুখোটির এক মাত্র মেয়ে। সে চিঠিটা যখন আমার হাতে পড়ল, তখন তো আমি আরও ছোট, তবুও আমার মনে হয়েছিল, তাহলে আমি কে? আমি কি তোমাদের কেউ নই। আমার মনে হয়েছিল, আমার বুকে কেউ যেন ছুরি বসিয়ে দিল। কী ভীষণ যে সেই কষ্ট দিদি, আমি তোমাকে সেটা বোঝাতে পারব না। প্ৰথমে মনে হল চিঠিটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলি। ছিঁড়েই ফেলতাম, কিন্তু মা তক্ষুনি আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে বাবার হাতে দিয়ে দিল। বাবা কোথায় তোমার বিয়েটা হচ্ছে সেই ঠিকানাটা জানবার জন্য চিঠিটা চেয়েছিল।’ সে চিঠিটা পরে আমার বাসে আমি তুলে রেখেছি।’
‘তোর খুব রাগ হয়েছিল নিলু?’
‘হ্যাঁ দিদি।’
‘কার উপর রাগ হয়েছিল?’
‘এখন আর ঠিক করে বলতে পারব না। বাবার উপর, মায়ের উপর, বড় মায়ের উপর। এই পৃথিবীর উপর।
‘আমার উপর তোর রাগ হয়নি।’
নিলু চুপ করে বসে থাকল।
‘এই ছেলে, আমার উপর তোর রাগ হয়নি? সত্যি কথা বলবি।’
নিলু মাথা নিচু করে বলল, ‘তোমার উপর সব চেয়ে বেশি রাগ হয়েছিল আমার।’
নিলুকে কোলে টেনে নিয়ে মউ ওর হাত দিয়ে নিলুর মুখটা তুলে দেখল অভিমানে নিলুর মুখটা থমথম করছে।
‘তুমি তো বড় মাকে মনে করিয়ে দিতে পারতে দিদি যে, তুমি একমাত্র মেয়ে নও। তোমার একটা ভাইও আছে।’
মউয়ের চোখও তখন জলে টলটল করছে। বলল, ‘নিলু, তুই দেখছি আমার চাইতেও বোকা। কি বোকা রে তুই নিলু? চিঠিটা পড়ে তার মানে টানে না বুঝেই তুই আমাদের উপর রাগ করে বসে আছিস। চিঠিতে কি লেখা আছে? এই আছে যে, আমি নিরঞ্জন মুখোটির একমাত্র মেয়ে। সত্যিই তো আমি তাই। নয় কি? তুই হলি নিরঞ্জন মুখোটির একমাত্র ছেলে। তাই না? তা এতে রাগ করার কি আছে?’
নিলু হাঁ করে মউয়ের মুখের দিকে চেয়ে বসে রইল। ‘কি রে, ঠিক তো? ঠিক বলেছি? তোর রাগ ভাঙল।’ নিলু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না। তুমি আমার খোঁজখবর তো নিতে পারতে? একদিনও নিয়েছ, বল?’ মউ বুঝল, চিঠির রাগটা কাটিয়ে উঠেছে নিলু, এটা তার নতুন অভিমান। আর এখন যে অভিযোগটা নিলু করল, এটা সহজে নিলুকে বোঝানো যাবে না। বেচারা ছেলেমানুষ। দুনিয়ার এত ঘোরপ্যাঁচ ও কি করে বুঝতে পারবে। দুনিয়ার রাস্তা কি সোজাসুজি যায় যে, নিলুর অভিযোগের কোনও সোজা উত্তর মউ দিতে পারবে?
মউয়ের সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। বাবা তাকে কি ভালই না বাসত! মাও তাই। কিন্তু মউয়ের ছোটবেলার দিনগুলো সর্ব পুষ্ট না হওয়া পোকা ধরা ফলগুলোর মতো ঝরে গিয়েছে। বাবা মায়ের ভিতর ঝগড়া। এত ঝগড়া যে ওরা কি কারণে করত, মউ কিছুতেই বুঝতে পারত না। একটু বড় হতেই বাড়িতে ঢোকার নাম শুনলেই মউ কুঁকড়ে যেত। মউয়ের এক সময় পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। বাড়িতে ঢুকলেই রাগ ঘৃণা তাকে ক্ষতবিক্ষত করত। খুব ছোটবেলায়, মাই তাকে বলেছে, তার মা আর বাবা যখন ঝগড়া করত, মউ নাকি একবার বাবার কোলে আর একবার মায়ের কোলে উঠবার জন্য খুব বায়না করত। তারপর বাবার কোলে উঠে বাবার মুখে চুমু খেতে খেতে বলত, ছি ঝগলা কলে না ছি। তারপর আবার মায়ের কোলে উঠে মায়ের মুখে চুমু খেতে খেতে বলত, যাও মিতিয়ে ফ্যালো। ভাব কলো ভাব কলো। এখন কোথায় মা? দীর্ঘশ্বাস ফেলল মউ। ‘দিদি তোমার মউমাছি নাম কে দিয়েছিল? বাবা না বড় মা?’ মউ বলল, ‘মউমাছি নাম বাবাই দিয়েছিল। মা নামটা শেষ পর্যন্ত রেখেই দিল।’ নিলু বলল, ‘বাবা ওই রকমই মজার লোক এখনও রয়ে গিয়েছে দিদি। বাবা আমার নাম দিয়েছিল ক্যাঙারু। মা নাম পালটে নিরঞ্জনের সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম রেখেছে নীলাঞ্জন।’
মউ বলল, ‘আমার মা আমার নামটা আর বদলাল না। ইস্কুলে মেয়েরা আমাকে খুব খ্যাপাত। আমি মাকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসে কতদিন বলেছি, মা, আমার নামটা যদি না বদলাও তবে আমি কাল থেকে আর ইস্কুলে যাবই না 1 মা জিজ্ঞেস করেছিল, কি তোকে বলে ইস্কুলের মেয়েরা? আমি বলেছিলাম, ওরা বলে মানুষের নাম মউমাছি হয় নাকি? হাত তালি দিয়ে ওরা ছড়া কাটত, মউমাছি মউমাছি কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই। ইশকুলে আমার দিন যে কি ভাবে কেটেছে নিলু, তোকে তা আর কি বলব? একদিন তো ইস্কুলেই গেলাম না। মা সেদিন বলল, ঠিক আছে, কাল গিয়ে তোর নামটা বদলে দিয়ে আসব। শঙ্করও আমার পক্ষে ছিল। সেও বলত, মেয়েটা বলছে, যাও না, ওর নামটা বদলে দিয়ে এস গে। যেমন নিরঞ্জন তেমনি তার নাম দেবার ছিরি। স্টুপিড! আমার সামনেই শঙ্কর মাকে বাবার সম্পর্কে এমন একটা মন্তব্য করল। মা গুম হয়ে গেল। শঙ্কর বড্ড বদমেজাজি ছিল। তবু বাবার সঙ্গে মায়ের ডাইভোর্স হয়ে যাবার পর মা শঙ্করকেই বিয়ে করেছিল। আমি শঙ্করকে কোনদিন বাবা বলতে পারিনি নিলু। কিন্তু শঙ্করের কাছে আমার ছিল সাত খুন মাপ। শঙ্কর আমাকে ভালবাসত। আমার জন্য অনেক কিছু করতে চাইত সে। ভাল ভাল পোশাক কিনে দিতে চাইত। খেলনা, দামি দামি খেলনা এনে দিত। মা সেসব আমাকে নিতে দিত না। যেদিন আমার নাম নিয়ে শঙ্কর আমার আর মায়ের সামনেই বাবাকে খোঁটা দিল, সেই দিন রাতে মা আমার বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মা হঠাৎ আমাকে বলল, মউ তোর বাবাকে মনে পড়ে না? মায়ের গলার স্বরে কি যে ছিল, আমি একেবারে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। তোর বাবা তোকে কি ভালই না বাসত মউ! মা বলেই চলল। কত আদর করত। তোর মনে পড়ে না? তোকে তোর বাবা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। কত চুমু খেয়েছে তোর গালে। মউ, সে সব তোর একটুও মনে পড়ে না? আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম। বাবার চেহারাটা আমার চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠল নিলু। সেইদিনের সেই বাবা নিলু, যে দিন মা আর বাবা দুজনেই দুজনকে ভালবাসত। ওঃ কি সোনার দিন ছিল সে সব! সে সবই আমার মনে স্বপ্ন হয়ে আছে। মা বলল, তোর বাবা তোর নাম দিয়েছিল মউমাছি। ওই নামে ডেকে ডেকে তোর বাবার যেন তৃষ্ণা মিটত না। তোর মনে পড়ে না মউ? আমি মায়ের বুকে পাগলের মতো মুখ ঘষতে ঘষতে বলেছিলাম, হ্যাঁ মা পড়ে পড়ে পড়ে। মা বলল, তাহলে তুই ভাল করে ভেবে দেখ মউ, তোর ইস্কুলের কয়েকটা বোকা মেয়ে আর শঙ্করের মতো থার্ড ক্লাশ লোকের কথা শুনে তোর বাবার দেওয়া এমন আদরের নামটা তুই ইস্কুলের খাতায় বদলে দিবি? তোর বাবার কানে যদি কোনওদিন কথাটা যায়, তোর বাবা কত দুঃখ পাবেন বল দিকি। মায়ের কথা শুনে তখন আমার আকেল হল নিলু। আমি বললাম, না মা, আমি এ নাম বদলাব না। নিলুকে কথাটা বলতে বলতে মউয়ের চোখ টলটল করতে লাগল।’
নিলু বলল, ‘তোমাকে বাবা ভীষণ ভালবাসে দিদি। তোমার বিয়ের চিঠিটা যেদিন এল, জানো, বাবা সারাদিন কিছু খায়নি। বাবার এমনিতেই তখন শরীর খারাপ। কত বলা হল। বাবার এক কথা। আজ আমাকে তোমরা কেউ কিছু বল না। আজ আমার মউয়ের বিয়ে। আমি থাকলে তো আমাকে সম্প্রদান করতে হত। আমি রাতে খাব।’
মউ বলল, ‘শোন কথা! বাবা আমাকে সম্প্রদান করবে কি? বাবারা তো খ্রিস্টিয়ান। আর আমারও তো হিন্দু বিয়ে হয়নি। রেজিস্ট্রি বিয়ে হয়েছে।’
নিলু বলল, ‘মা তো সেই কথাই বাবাকে বলেছিল। কিন্তু বাবা শোনেনি। বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে আর বলেছে, শঙ্করটার তো বোধ ভাষ্যি হয়নি। আমাকে দেখে একটা সিন্ ক্রিয়েট করবে, মউ বিব্রত হবে, তাই আমি যাব না। মা বলেছিল, তোমার মেয়ে, তুমি বাড়িতে থাকলেই বরং বেশি কষ্ট পাবে। এখনই তো পাচ্ছ। তার চাইতে তুমি যাও না। বাবা বলেছিল, তুমি জান না, শঙ্কর কি চিজ। ওটা একটা বাঁদর।
মউ বলল, ‘সেদিন আমরা অনেক রাত পর্যন্ত বাবার অপেক্ষা করেছিলাম। মা শেষ পর্যন্ত বলল, তোরা শুতে যা মউ। ও আসবে না। তোর বাবা ভেবেছে, এখানে বুঝি শঙ্কর মোড়লি করছে। কিন্তু বাবা ভুল বুঝেছিল নিলু। আমার বিয়েতে শঙ্করকে একদম নাক গলাতে দেয়নি মা। মা নিজের রোজগারের টাকায় আমার বিয়ে দিয়েছে। শঙ্কর আমার বিয়েতে প্রচুর খরচ করতে চেয়েছিল। মায়ের জন্য সেটা পারেনি বলে তার কি রাগ। আমার বিয়ের পরেই মা আর শঙ্করের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমার বিয়ের সমস্ত ঝক্কি মা ভ্যাবল মামার ঘাড়ে তুলে দিয়েছিল। শঙ্করের রাগের সেটাও একটা মস্ত কারণ।’
ক্রিমেটেরিয়ামের বেঞ্চিতে বসে বসে অমিতা মউ আর নিলুর কথা শুনছিল। এক সময় অমিতা বলল, মউ, তুই আর নিলু, তোদের বাবার কাছে এসে বোস্।’
নিরঞ্জন মকে দেখে বলল, ‘একটা সিগারেট দিবি মা? একটা। আর চাইব না।’
মউ বলল, ‘বাবা, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে আজ সারাদিন সিগারেটের উপরেই আছ। তোমার এই শরীরে তুমি বেদম সিগারেট খাও নিলু বলছিল। আজ আর না খেলে। তোমার শরীরটাকে কি করে ফেলেছ বাবা। তোমার কি নিলুর উপর মায়া হয় না। তোমার কি, একটু ইতস্তত করে মউ বলল, ‘নিলুর মার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। কেন তুমি শরীরটাকে নষ্ট করছ বাবা? ওরা তোমাকে তো খুব ভালবাসে।’
নিরঞ্জনকে বুড়োটে চেহারায়, খোঁচা খোঁচা দাড়িতে, আধ ফোকলা মুখে একেবারে ভ্যাগাবন্ডের মতো লাগছিল। মউয়ের দিকে ঘোলা ঘোলা চোখ দুটো তুলে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘ভালবাসে ভালবাসে ভালবাসি ভালবাসি ভালবাসা ভালবাসা অহ্ অহ্ অহ্। নিলু আমাকে ভালবাসে নিলুর মা আমাকে ভালবাসে আমি নিলুকে ভালবাসি আমি নিলুর মাকে ভালবাসি আমি মউকে ভালবাসি আমি মউয়ের মাকে ভালবাসি। মউয়ের মাকে আমি·ভা ল বা সি ম উ য়ের মা। হ্যাঁ মউয়ের মা-ই তো। নিলুর মা আমার বউ। হাতে আছে। মউয়ের মা? ফসকে গেছে। মউয়ের মাও আমার বউ ছিল। হাত থেকে ফসকে গেছে। নিলুর মা আমার হাতে আছে। যোগ আর বিয়োগের অঙ্ক, ব্রজকিশোর। স্রেফ যোগ বিয়োগের অঙ্ক। ইজিকটু ভালবাসা? পুড়ছে ব্রজকিশোর। পুড়ছে। কি ব্রজকিশোর, কোনও গোল ঠেকছে আঙ্ক? অঙ্কুর মুখুজ্জে জানি জীবনের বন্ধ্যা মহীরুহে সবুজ ডাবের এক তৃষাবহ ছবি এঁকেছিল। আমাদের বন্ধু অরুণ, কবি অরুণকুমার সরকার হে, বাগদাই এই কবিতাখানা লিখেছিল। সবুজ ভাবের তৃষাবহ ছবি শুধু অঙ্কুর মুখুজ্জেই আঁকেননি, নিরঞ্জন মুখোটিও এঁকেছিলেন। কিন্তু কি হল নিরঞ্জন মুখোটির।’ নিরঞ্জন সুন্দর আবৃত্তি করত পারত। ওর গলায় জোয়ারি ছিল। হঠাৎ ক্রিমেটেরিয়ামের বেঞ্চিতে সেই অনেক দিনের হারিয়ে যাওয়া নিরঞ্জন মুখোটি কোথা থেকে তাজা শরীরে এসে হাজির হল। অন্তত অমিতার তাই মনে হতে লাগল। নিরঞ্জন আবৃত্তি করতে লাগল, ‘উইথ অ্যাপলজি টু অরুণকুমার সরকার। নিরঞ্জন মুখোটি জানি জীবনের বন্ধ্যা মহীরুহে সবুজ ডাবের এক তৃষাবহ ছবি এঁকেছিল, ভেবেছিল দুই আর দুইয়ে চার হয়, খুঁজেছিল বৈজ্ঞানিক ঐতিহাসিকের চোখ নিয়ে ভূগোলের হৃদপিন্ড এবং ফুসফুস। সে ডাবেতে জল নেই, সে যোগেতে মিল নেই দেখে নিরঞ্জন মুখোটি এবে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত মানুষ বনে গেল, বুঝে নিল পৃথিবীর পথগুলি চলে এঁকেবেঁকে। নি র ঞ্জ ন মু খো টি এ বে সি গা রে টা স ক্ত মা নু ষ। দে মা দে। একটা সিগারেট দে। ভয় নেই। নিরঞ্জন মুখোটি অত সহজে মরবে না। সে তো নিরাসক্ত। সে তো ঝুমরি নয় যে, সারা জীবন বুকে অভিমান পুষে পুষে নিজেকে ফতুর করে ফেলবে। একটা সিগারেট দে মা।’
অমিতা আর থাকতে না পেরে বলেছিল, ‘দে মউ, তোর বাবাকে একটা সিগারেট দে। এমন কিছু ক্ষতি হবে না।’
মউ বাবাকে একটা সিগারেট দিয়েছিল।
নিরঞ্জন বলেছিল, ‘এখন জীবনের স্পন্দন ঠোঁটে সিগারেট চেপে ধরেই একমাত্র মালুম করতে পারি। থ্যাংক ইউ ফুলকি, তোমার ইনটেলিজেন্সের আমি বরাবরই অ্যাডমায়ারার।’
নিরঞ্জন চুপ করে একমনে সিগারেট টেনে যেতে লাগল। তারপর যেন তার হঠাৎ তন্দ্রা ভাঙল। ‘বুঝলে ব্রজকিশোর, আমি তখন বিলাত থেকে একটা ফুলটাইম ভ্যাগাবন্ড হয়ে ফিরে এসেছি। তুমি তখনও বোধ হয় লিংকস্ ইনে ঢুঁ মেরে চলেছ। নিউ থিয়েটার্সের এক নম্বর স্টুডিওতে আমি ঝুমরি কে প্রথম দেখি। তখন বিমল রায় মশাই ‘উদয়ের পথে’ তোলবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে এনেছেন। আমি তাঁর সঙ্গেই লেগে আছি। সেইখানেই সেইদিনই আমার সঙ্গে ঝুমরির প্রথম দেখা। আমাদের কেস্টা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইটের ক্লাসিক উদাহরণ। আবার আমাদের কেস্টা লস্ অ্যাট ফার্স্ট স্লাইটেরও একটা ক্লাসিক উদাহরণ বটে।’
নিরঞ্জনের গলাটা অকস্মাৎ ভারী হয়ে এল। ‘আমি ঝুমরিকে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালবেসেছি। ঝুমরিও আমাকে পাগলের মতো ভালবাসত। ভালবাসা কিসে ঢেঁকসই হয়? কারও কি জানা আছে সেটা? তুমি জানো ব্রজকিশোর? ফুলকি, তুমি জানো? মউমাছি, তুই জানিস? তুই কি বলতে পারিস মা?’