প্রতিবিম্ব স্মৃতি
গোলপার্কের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা যাদবপুরের দিকে গেছে, অবনীশ ফিরছিল সেই পথ দিয়ে। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারা শেষ হয়েছে, এখন ধরবে শিয়ালদার যে-কোনও বাস। তাই হাঁটছে রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর পাশ দিয়ে ফুটপাত ধরে।
জায়গাটা বেশ অন্ধকার। প্রদীপের নীচেই অন্ধকার থাকে জানা ছিল অবনীশের। সাধন ভজন-সংস্কৃতি-কেন্দ্র এই ভবনের ঠিক পাশের রাস্তাটি কেমন অন্ধকারাচ্ছন্ন, তা বুঝতে পারেনি। পারল একটু পরেই।
রাস্তার সবকটা ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভনো। ওপাশের ফুটপাতের দোকান থেকে বিচ্ছুরিত আলোর আভাস পড়েছে এদিকের ফুটপাতে। লোহার রেলিং-এ পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি তরুণী।
মেয়েটির দিকে অবনীশের চোখ আকৃষ্ট হওয়ার কারণ আছে। প্রথমত ওই রকম আঁধারঘেরা নিরালা জায়গায় মেয়েটি একেবারে একা। দ্বিতীয়ত, মেয়েটির অঙ্গে ঝলমলে পোশাক। ক্ষীণ আলোয় ঝলসে উঠছে নাকের নাকছাবি। ঝলসে উঠছে এই কারণে যে মেয়েটি একদৃষ্টে চেয়েছিল অবনীশের দিকে। চোখাচোখি হতেই এক ঝটকায় মুখখানা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে যেন দেখেও দেখছে না। পরক্ষণেই অবশ্য ঘাড় কাত করে চেয়ে রইল অবনীশের দিকে। বুকটা আরও একটু চিতিয়ে শরীরটাকে লীলায়িত ভঙ্গিমায় এনে যেন লাস্যময়ী হয়ে উঠল নিমেষ মধ্যে।
দু-হাত সামনে দিয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এগিয়ে গেছিল অবনীশ। মনের পটে ছাপ কিন্তু থেকে গেছে। ধবধবে ফর্সা রং। কাজলটানা কালো চোখ, নাসিকালঙ্কারের দ্যুতি, কর্ণাভরণের ঝিলিক এবং সব মিলিয়ে ছিপছিপে দেহবল্লরীর মধ্যে কামনা-উদ্ধত তেজীয়ান ভঙ্গিমা আর গ্রীবা বেঁকিয়ে একদৃষ্টে অবনীশের দিকে চেয়ে থাকার মানে একটাই হয়।
মেয়েটি কলগার্ল। বেশ বড় ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতায় এদের দাপটই তো এখন বেশি। লেকের মাঠে সন্ধ্যার পর একা বসা যায় না, বেড়ানো যায় না। পাশে এসে জুটবেই। বয়ঃসন্ধিকালের সমস্যা। রক্তে এদের বিদ্রোহ-প্রকাশ বিপথে কুপথে।
অবনীশ ধোয়া তুলসীপাতাটি নয়। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে সহপাঠিনী এবং নার্সদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা জমিয়েছে একাধিকবার। নিজেও দেখতে সুপুরুষ। দীর্ঘকায়। গৌরবর্ণ। টান টান চাবুকের মতো চেহারা। বন্ধুরা ওকে হিরো বলে ডাকে। বান্ধবীরা বলে লেডিকিলার।
সুতরাং সুন্দরী মহিলা সঙ্গকামনা জানালে চুঁমার্গের ধার ধারে না অবনীশ কোনওকালেই। রেলিং-এ হেলান দিয়ে বিজয়িনী ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটি অবশ্য অভিজাত বহুবল্লভ ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু চেহারার চমক, নিরালা পরিবেশ আর যৌবন-উষ্ণ রুধির ক্ষণেকের জন্য বিহ্বল করে তোলে অবনীশকে।
ক্ষণেকের জন্যেই বটে। মনোবিশারদরা একেই বলে ঝোঁকের মাথায় অসম্ভব কাণ্ড করে ফেলা। ক্ষণিক ভাবাবেগে আত্মহারা হয়ে কেউ চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কেউ গলায় দড়ি দেয়, কেউ বিষ খায়।
আদিমতম পেশায় রত এ কামিনীকে দেখেও রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল অবনীশের। মহিলাসান্নিধ্য চিরকালই প্রীতিকর তার কাছে–স্কুল কলেজে কো-এডুকেশন ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই।
এমনকী কলগার্লদের সঙ্গসুখ উপভোগ করেছে মন মেজাজ শরীফ থাকলেই। আসলে ওর মধ্যে কোনো ভণ্ডামি নেই। খোলে চোখে দুনিয়াটাকে দেখে, ভাবাবেগবর্জিত বলেই ওর ইনটেলেকচুয়াল ম্যাচুইরিটি এত ঊর্ধ্বে। ইমোশনালি ইমম্যাচিওর্ড হলে যা কখনোই সম্ভব হত না। ওর কাছে নরনারীর নিবিড় সান্নিধ্য নেহাতই প্রাকৃতিক ব্যাপার-বায়োলজিক্যাল লাভ ছাড়া কিছুই নয়।
মেয়েটিকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েও তাই থমকে দাঁড়াল অবনীশ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল ঘাড় বেঁকিয়ে এখনও সে চেয়ে আছে তার দিকে। আলো-আঁধারির মধ্যে দিয়ে অনুভব করা যাচ্ছে তার কালো চোখের আকর্ষণ–চুম্বকের আকর্ষণের মতোই যা অদৃশ্য, কিন্তু অমোঘ।
পায়ে পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেল অবনীশ। চোখ এবার রূপসীর দিকে। ষোড়শী বলেই তো মনে হয়। মাদকতা আছে বটে শরীরে। বেশবাস মূল্যবান–কিন্তু স্বল্প। দেহতটরেখাকে সযত্ন প্রয়াসে পরিমিতির মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে জানে। সংস্কৃতিসম্পন্না মেয়ে নিঃসন্দেহে।
শিকার জালে পড়েছে বুঝেছে অপরূপা। অবনীশের দিকে আর ফিরেও তাকাচ্ছে না। সটান চেয়ে আছে সামনের দিকে। গ্রীবাভঙ্গিমা কিন্তু গর্বোদ্ধত। দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে রেলিং ধরার মধ্যে বেপরোয়া মনোভাব।
অবনীশ এবার মন্ত্রমুগ্ধ। মেয়েরা বুঝি চিরকাল এইভাবেই খেলিয়ে তোলে মনের মানুষদের। যারা এই শিল্পটিকে রপ্ত করেছে, তারা পারে আরও সুচারুভাবে। সম্পূর্ণ অপরিচিতা এই মেয়েটির লালসা-মদির আচরণ তাই বিহ্বল করে তোলে অবনীশের মতো খ্যাতিমান লেডিকিলারকেও।
আবার ফিরে আসে অবনীশ। এবার দাঁড়ায় মেয়েটির সামনেই। সামনেই চেয়েছিল রাতের রূপসী। ভ্রূক্ষেপ নেই অবনীশের দিকে। সাহস সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট স্বরে অবনীশ বললে, ফ্রী আছেন?
কী বললেন? ঝট করে মুখ ফিরিয়ে অবনীশের চোখে চোখে তাকাল মেয়েটি। কালো চোখে যেন দামিনী খেলছে। নাকের পাটা স্ফীত। ঝিলিক দিয়ে উঠছে নাকছাবি। হীরের নাকি?
মুহূর্তের মধ্যে ইনটেলেকচুয়ালি ম্যাচিওর্ড অবনীশ বুঝে ফেলল, ভুল হয়ে গেছে। এ-মেয়ে সে-মেয়ে নয় কলগার্ল বলে যাদের কৃপা করা যায়। এর ধমনীতে অভিজাত শোণিত। তাই গোখরের মতো ফণা মেলে ফোঁস করে উঠেছে। ছোবল মারার আগেই চম্পট দেওয়া দরকার।
কিন্তু অবনীশের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে তখন আরও কিছু সঞ্চয়ের বাকি ছিল।
ঝটিতি জবাব দিয়েছিল অবনীশ, সরি।
বলেই আর দাঁড়ায়নি। লম্বা লম্বা পা ফেলে যেই দূরত্ব বাড়াতে গেছে মেয়েটির কাছ থেকে অমনি দুপাশের দুটি ল্যাম্পপোস্টের আড়াল থেকে তির বেগে ধেয়ে এল দুটি মূর্তি।
কী হয়েছে? কী হয়েছে?
চিৎকার শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে অবনীশ দেখলে, রেলিং থেকে সরে এসেছে রাতের রহস্যময়ী।
কিছুই বলছে না। শুধু চেয়ে আছে অবনীশের দিকে।
ছেলেদুটি ছুটে আসছে অবনীশের দিকে–ও মশাই কী বলছিলেন–
কেন ল্যাম্পপোষ্টের আলো নিভনো এবং কেন ঠিক এই জায়গাটিতে মেয়েটি নিজেকে লোভনীয় করে দাঁড়িয়ে আছে, অবনীশ তা বুঝে নিলে চকিতের মধ্যে। ল্যাম্পপোষ্টের আড়ালে গা মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মস্তান দুটি। উদ্দেশ্য একটাই। অবনীশকে টেনে-হিঁচড়ে আড়ালে নিয়ে যাওয়া, মারধর করে সর্বস্ব কেড়ে নেওয়া। সৰ্ব্ববল্লভাটি তাদের টোপ, গ্যাং-এর অন্যতম সদস্যা।
অভিনব ফাঁদ। উর্বর মস্তিষ্ক বটে এই তিনজনের।
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নিজের দশা কী হতে চলেছে কল্পনা করে নিল অবনীশ। প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কাজ দিল বিস্ময়করভাবে। মাঝ রাস্তা দিয়ে একটি বাস যাচ্ছে গোলপার্কের দিকে। ছুটে গিয়ে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ল অবনীশ। কন্ডাক্টর ধরে ফেলল একহাত বাড়িয়ে।
পেছনে মস্তান দুটো ছুটে আসছে। ধর ধর করে চেঁচাচ্ছে। এই বাসে তারা উঠবেই।
কন্ডাক্টর পাদানিতে দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখল ধাবমান দুজনকে। বাস ছুটছে, তারাও ছুটছে।
শুধলো অবনীশকে, কী হয়েছে?
বদমাস।
বাসশুদ্ধ লোক চেয়ে আছে অবনীশের দিকে। ভাবলেশহীন মুখ। কেউ যদি কাউকে তাড়া করে এবং ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে, কারও কিছু এসে যায় না। বরং নির্লিপ্ত থাকাই ভালো।
বাস থামাল না কন্ডাক্টর। পরের স্টপ গোলপার্কের সামনে। পেছনে মস্তান দুটি এসেও চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে আসছে। এই স্টপে বাসে তারা উঠবেই। তারপর কী হবে ভাবতেই আবার উপস্থিত বুদ্ধি খেলে গেল অবনীশের মাথার মধ্যে।
বাসে উঠেছিল পেছনের দরজা দিয়ে। স্টপে বাস থামতে না থামতেই নেমে পড়ল সামনের দরজা দিয়ে। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ফুটপাত ঘেঁষে। ড্রাইভার বসে সিটে ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছে কীসের এত শোরগোল।
বাস থেকে লাফ দিয়ে নেমেই ট্যাক্সির রাস্তার দিকের দরজা এক হ্যাঁচকায় খুলে ভেতরে ঢুকে গেল অবনীশ। সংযত স্বরে বললে, শিয়ালদা। ট্যাক্সি ড্রাইভার বোধহয় ওয়াকিবহাল এই ধরনের ফঁদ সম্পর্কে। তিলমাত্র কৌতূহল প্রকাশ করল না। একটা কথাও বলল না। স্টার্ট দিল ইঞ্জিনে।
মস্তান দুটি তখন ট্যাক্সির ঠিক পেছনে–বেঁধে! বেঁধে! কিন্তু বাঁধল না ট্যাক্সি ড্রাইভার। সে কারবার করতে বসেছে, শিয়ালদার প্যাসেঞ্জার ছাড়তে যাবে কেন? অথবা হয়তো কোনও ঝামেলায় জড়াতে চায় না। নয়তো স্রেফ মানবিকতা। ফঁদ কেটে সুদর্শন কিন্তু অনভিজ্ঞ একজন তরুণকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার উদারতা।
মুহূর্তে বাঁ-দিকে টার্ন নিয়ে গোলপার্ক ঘুরে গড়িয়াহাটার মোড়ের দিকে ছুটল ট্যাক্সি।
.
ডক্টর বোস ঠক ঠক করে ছাইদানিতে পাইপ ঠুকে ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে টেবিলের দিকে চোখ নামিয়েই বললেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডক্টর কাঞ্চন ঘোষকে, তুলে এনেছ?
ইয়েস স্যার।
খুব ট্রাবল দিয়েছে নাকি?
খুবই। চারজনে হিমসিম খেয়ে গেছি। গোড়ালি আর কবজি চেপে না ধরলে খাট থেকে নামানো যেত না।
কী করেছিল?
ঘুমোচ্ছিল।
ঠিক কটা বাজে তখন?
ঠিক একটা।
এই দুপুরে ঘুম। কেস-হিসট্রি অবশ্য তাই, চোখ তুললেন ডক্টর বোস।
অবসেশনাল ডিসঅর্ডার। চোদ্দো ঘণ্টা খালি স্নান আর পায়খানা। নিজেকে নোংরা বোধ করে। সন্ধে পর্যন্ত গরম লেবুর জল আর নুন খায় চারবারে চার লিটার। তারপর কলতলা। দশটা থেকে শুরু হয় খাওয়া। তিন লিটার দুধ, আমসত্ত্ব আর জোলাপ। তোমার কী মত, কাঞ্চন?
যা শুনেছি আর যা দেখলাম, তাতে মনে হয় হয় ইসিটি শক দিতে হবে–তাতেও না হলে ব্রেনের নার্ভ পাথওয়ে কেটে দিতে হবে।
হাসলেন ডক্টর বোস। পাইপ এখন দাঁতের ফাঁকে। ধোঁয়া বেরোচ্ছে নাকমুখ দিয়ে। কাঞ্চন, ইউ নো ভেরি ওয়েল, ওই দুটো পথ আমি মাড়াতে চাই না। ইসিটি শক রিমার্কেবল কাজ দেয় ঠিকই কিন্তু কীভাবে, নোবডি নোজ। ব্রেনের নার্ভ পাথওয়ে কেটে দিতে হলে ভেলোর যেতে হবে–রেজাল্ট ইজ আনোন। নো কাঞ্চন, নো সব ব্যাপারের কজ অ্যান্ড এফেক্ট আছে। মেয়েটির এই উল্কট ঘুচিবাই রোগেরও মূলে যে ঘটনা বা ঘটনাগুলো আছে–আমাদের তা জানতে হবে। যেদিন ও তা কবুল করবে, ওর ইমোশনাল টারময়েল চলে যাবে। এভরিথিং উইল বি নরম্যাল।
তা ঠিক। বিহেভিয়ার থেরাপির ম্যাজিক তো অনেকেই দেখে গেল। আমিও আপনার কাছে এসে দেখছি, হাসল কাঞ্চন। পাতলা পাকানো চেহারা। পাতলা হয়ে এসেছে মাথার চুলও। শ্যামবর্ণ। চাহনি কঠোর। মনের রুগিদের কাছে চাহনি আর কথার ম্যাজিক যে কি অদ্ভুত ফল সৃষ্টি করে, তা সে শিখেছে ডক্টর বোসের কাছে। টক থেরাপি ইদানীং পাশ্চাত্যের বহু মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে চমৎকৃত করেছে। কোনও ওষুধ না দিয়ে, শক না দিয়ে, অথবা নামমাত্র ওষুধ দিয়ে দিনের পর দিন গ্রুপ ডিসকাশন আর নানারকম কাজকর্মের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে পাগল হয়ে থাকা মানুষকেও উনি সুস্থ করে তুলেছেন।
চার্জ অবশ্য খুব বেশি। এই যে মেয়েটিকে এইমাত্র অভিজাত পল্লী থেকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এল কাঞ্চন, এর জন্যেও প্রথম মাসে দিতে হবে চার হাজার। তারপর তিন হাজার। তারপর দু-হাজার। তারপর দেড় হাজার। জটিল কেস বলেই নার্সিং হোমে আনতে হয়েছে–এখানকার রেট তো বেশি হবেই। এত ডাক্তার, নার্স, আয়া–অথচ কম পেশেন্ট–যাতে ওয়ান টু অয়ান অবজার্ভ করা যায়। চব্বিশ ঘণ্টা নানাভাবে ওয়াচ করা যায়। কম জটিল কেসে কম খরচেই টক থেরাপি এবং অ্যাডভাইস চালিয়ে যান ডক্টর বোস অন্য চেম্বারে।
বিলেতের বড় হাসপাতালে ভালো চাকরিতে ছিলেন। কেন যে ইন্ডিয়ায় এলেন। এত বেশি দক্ষিণায় ধনী পেশেন্ট ছাড়া পেশেন্ট পাওয়া যায় না। অন্যান্য মেন্টাল হোমে এক চতুর্থাংশ টাকায় চিকিৎসা হয়। নামেই চিকিৎসা অবশ্য। সমাজ থেকে একটা পাগলকে তুলে এনে অনেক পাগলের সঙ্গে খাঁচায় পুরে রাখা।
জানলা দিয়ে তাকিয়ে কি যেন ভাবছিলেন ডক্টর বোস। তাই এতক্ষণ কথা বলেনি কাঞ্চন। এবার তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। ঈষৎ লালাভ মুখখানায় অজস্র অভিজ্ঞতার ছাপ। কপালের বলিরেখা তারই পদরেখা। সামান্য ধূসর চোখের তারায় চাপা ধীশক্তির রোশনাই। মাথায় বেশ লম্বা। মেদ নেই সারা শরীরে,–সেই সঙ্গে বিস্তর চুলও অদৃশ্য হয়েছে মাথার সামনের দিক থেকে।
পাইপটা হাতে নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু আত্মনিমগ্ন চোখে কাঞ্চনের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। ডক্টর বোস। কতই বা আর বয়স। বড় জোর চল্লিশ। সে তুলনায় অনেক ভারিক্কি, আবার যখন হাসেন, প্রাণখোলা হাসিতে ঘর ফাটিয়ে দেন। জবাব নেই সেই হাসির–দমকে দমকে অট্টহাস্য যেন আর থামতেই চায় না।
ডক্টর বোসকে তাই ভয় করে, শ্রদ্ধাও করে কাঞ্চন। ওঁর কথার মধ্যে, চাহনির মধ্যে, আচরণের মধ্যে নাটকীয়তা আছে, আছে জাদুশক্তি–অ্যানিম্যাল ম্যাগনেটিজম। যেকোনো মানুষকে নিজের মতে নিয়ে আসতে পারেন অল্পসময়ের মধ্যে–কখনো ধমকে, কখনো ধারালো যুক্তি দিয়ে, কখনো হেসে, কখনো আশ্চর্য বচনমালা দিয়ে।
টক থেরাপিস্ট! ইন্ডিয়ায় ইনিই একমাত্র টক থেরাপিস্ট। সনাতনী মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের তাই বিদ্বেষ এঁর ওপর। আড়ালে বলেন, ও তো বড়লোকদের দোহন করে চলেছে ম্যাজিক দেখিয়ে–যেমন মেসমার করত মেসমেরিজম দিয়ে, কিন্তু টিকেছিল কী?
ডক্টর বোসের ভেতরের যন্ত্রণা সেইখানেই। বিয়েও করলেন না। সুস্থ মস্তিষ্কদের সুস্থ করে তোলার সমাজসেবায় ব্রতী হয়েছেন ইন্ডিয়ায় ফিরেই। বাঁধাধরা চাকরির অফার পেয়েও যাননি– রুগিদের মধ্যে একটা টোটালিটি খুঁজে পাওয়ার সুযোগ বা সময় তো সেখানে নেই। নারী মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাই তাকে অ্যাডভাইস দিয়েছেন, কি ছেলেমানুষি করছ? চেম্বারে কনসাল্টেশন ফি নিয়ে রোজ দশ-বারোটা রুগি দেখো। অর্ধেক ভালো হবে, অর্ধেক রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে। মাসে দশ-বারো হাজার টাকা তোমার এসে যাবে।
কর্ণপাত করেননি ডক্টর বোস। এও যেন তাঁর এক পাগলামি। প্রতিভাধরদের ম্যাডনেস। কাঞ্চন তাই এত ভক্ত এই অদ্ভুত মানুষটির। অনেক মাসে পুরো মাইনে পায় না–নতুন জামা প্যান্ট কিনতে পারে না–তবুও শেখবার, জানবার উদগ্র বাসনা তাকে ধরে রেখে দিয়েছে ডক্টর বোসের কাছে। যে মাটিতে গাছ বাড়ে, সেই মাটিই তো গাছকে নিজের কাছে ধরে রাখে।
চেয়ে আছেন ডক্টর বোস। মনে মনে প্ল্যান করছেন নিশ্চয়। দু-চোখের কোণ কুঁচকে গেছে। এক-একটা পেশেন্টকে তো এক-একরকমভাবে হ্যান্ডল করতে হয়।
শুধোলেন হঠাৎ, মেয়েটা কোথায়?
সেলে।
কেন? ভায়োলেন্ট? এখনও?
ভীষণভাবে।
চলো তো দেখি।
খাটের সঙ্গে চার হাত-পা বাঁধা মেয়েটির চুল ছড়িয়ে পড়েছে মুখে বুকে চারপাশে। বিস্বস্ত বেশ। ভারী গড়ন। খুব ফর্সা, কটমট করে তাকাচ্ছে এদিকে সেদিকে আর বাঁধন খোলার চেষ্টা করছে প্রাণপণে।
পাইপ টানতে টানতে লম্বা পদক্ষেপে ঠিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো ডক্টর বোস। কাঞ্চন রইল বাইরে। প্রথম অবজার্ভেশন ডাক্তারবাবু একাই করেন।
পলকহীন চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছেন ডক্টর বোস। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া উঠছে সরু ফিতের মতো।
বছর পঁচিশ বয়স হবে মেয়েটির। সুন্দরী নিঃসন্দেহে। অতিরিক্ত মেদ জমায় ভোতা হয়ে গেছে বরতনুর ধারালো অংশগুলো।
কটমট করে ডাক্তারের দিকে চেয়ে প্রথমে হিসহিসিয়ে গর্জন করে উঠেছিল সুন্দরী পেশেন্ট। পরক্ষণেই স্থির চোখে চেয়ে রইল। চোখের পাতা আর পড়ে না। দুই তারারন্ধ্রের গহনে জ্বলছে দুটি নিষ্কম্প প্রদীপশিখা।
চোখ কুঁচকে চেয়ে রইলেন ডক্টর বোসও। কী দেখছেন তিনি? অসম্ভব স্মৃতিশক্তির অধিকারী ডক্টর বোস কেন দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন?
মেয়েটির কনীনিকা আরও ছোট হয়ে এসেছে। বেড়েছে দৃষ্টির সুচাগ্রতা। করোটির মধ্যে মগজের কোষে কোষে যেন প্রচণ্ড আলোড়ন চলছে, এনার্জির বিস্ফোরণ ঘটেছে। অনিমেষ তারারন্ধ্রে তারই কেন্দ্রীভূত প্রকাশন ঘটছে…
কিন্তু এ তো চেতনার স্ফুলিঙ্গ…স্বাভাবিকতার উন্মেষ!
পরক্ষণেই অতিশয় স্মার্ট ডক্টর বোসকে হতবুদ্ধি করে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে চাপা বর্জনাদের মতো শুধু কটি কথা বলল মেয়েটি–গোলপার্ক… রাত…পালিয়েছিলে…ট্যাক্সিতে..আমি নোংরা? তাই না? বড় নোংরা? হাঃ হাঃ হাঃ! হাঃ হাঃ হাঃ!
বসবার ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর বোস। মাথার পাতলা চুলে আঙুল চালাচ্ছেন। আঙুল কাঁপছে।
কাঞ্চন দাঁড়িয়ে ছিল পেছনে। বিমূঢ় অবস্থা। ডাক্তারবাবুকে এরকম বিচলিত কখনো সে দেখেনি।
কাঞ্চন, খোলা জানলা দিয়ে শুধু মাঠ আর দূরের দিগন্তের দিকে চেয়ে বললেন ডক্টর বোস।
স্যার।
মেয়েটিকে আমি একা ট্রিট করব। বুঝেছ?
হ্যাঁ, স্যার। আর কী বুঝেছ?
সবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন ডক্টর বোস। থিরথির করে কাঁপছে মুখের পেশী। পেশেন্টের সামনে, তাদের গার্জেনদের সামনে ডক্টর বোসকে নাটক করতে আর আগেও দেখেছে কাঞ্চন। কিন্তু এখন তো ঠিক নাটক বলে মনে হচ্ছে না।
কাঞ্চন, বজ্রগর্ভ কণ্ঠস্বর ডক্টর বোসের–এর আগে তোমাদের ফটোগ্রাফিক মেমারির কথা বলেছিলাম মনে আছে?
প্রতিবিম্ব স্মৃতি?
হ্যাঁ। সোনার গয়নাভর্তি সুটকেস সমেত চলে গেছিল ট্যাক্সি পরে খেয়াল হতেই বাড়িময় কান্নাকাটি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির দিকে চেয়েছিল যে বাচ্চা মেয়েটি, সে এসে বলেছিল–মা, কাঁদছ কেন? ট্যাক্সির নাম্বার তো আমার মনে আছে। ট্যাক্সি পাওয়া গিয়েছিল। প্রতিবিম্ব স্মৃতি… প্রতিবিম্ব স্মৃতি! চোখে যা দেখে, ব্রেনে তার পারমানেন্ট ইমপ্রিন্ট পড়ে। কাঞ্চন, আজকের এই মেয়েটির আছে সেই বিশেষ ক্ষমতা।
কীভাবে বুঝলেন?
কী ভাবে বুঝলাম? হাঃ হাঃ হাঃ…হাঃ হাঃ হাঃ…হাঃ হাঃ হাঃ…সেটা না হয় তোমার কাছে সিক্রেটই থাক কাঞ্চন, ডক্টর অবনীশ বোসের অতীত আর নাই বা জানলে? হাঃ হাঃ হাঃ…হাঃ হাঃ হাঃ…হাঃ হাঃ হাঃ!
তিন মাস পরে একমনে বিয়ে বাড়ির খানা খেয়ে চলেছে কাঞ্চন। সামনে এসে দাঁড়ালেন বর-বউ।
আর কিছু চাই?
মুখ তুলল কাঞ্চন, হ্যাঁ স্যার, চাই।
কি বলো? ফ্রাই না বিরিয়ানি।
একটা প্রশ্নের জবাব।
বটে! চোখ ছোট হয়ে গেল ডক্টর অবনীশ বোসের।
কী প্রশ্ন?
প্রতিবিম্ব স্মৃতি কী ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ঘটায়?
শাট আপ!
গভীর চোখে তাকিয়ে জবাব দিলে নতুন বউ, ঘটায়।
* সুকন্যা পত্রিকায় প্রকাশিত। শারদীয়া সংখ্যা, ১৩৯৩।