প্রতিনিধি

অ্যাক্‌ওয়ার্থ্‌ সাহেব কয়েকটি মারাঠি গাথার যে ইংরাজি অনুবাদগ্রন্থ 
প্রকাশ করিয়াছেন তাহারই ভূমিকা হইতে বর্ণিত ঘটনা গৃহীত । 
শিবাজির গেরুয়া পতাকা ‘ ভগোয়া ঝেণ্ডা' নামে খ্যাত । 
  
  
বসিয়া প্রভাতকালে                 সেতারার দুর্গভালে 
                         শিবাজি হেরিলা এক দিন — 
রামদাস গুরু তাঁর                  ভিক্ষা মাগি দ্বার দ্বার 
               ফিরিছেন যেন অন্নহীন । 
ভাবিলা , এ কী এ কাণ্ড !           গুরুজির ভিক্ষাভাণ্ড — 
               ঘরে যাঁর নাই দৈন্যলেশ ! 
সব যাঁর হস্তগত ,                    রাজ্যেশ্বর পদানত , 
                তাঁরো নাই বাসনার শেষ ! 
এ কেবল দিনে রাত্রে               জল ঢেলে ফুটা পাত্রে 
                        বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে । 
কহিলা , ‘ দেখিতে হবে            কতখানি দিলে তবে 
              ভিক্ষাঝুলি ভরে একেবারে ।' 
তখনি লেখনী আনি                 কী লিখি দিলা কী জানি , 
              বালাজিরে কহিলা ডাকায়ে , 
‘ গুরু যবে ভিক্ষা - আশে             আসিবেন দুর্গ - পাশে 
               এই লিপি দিয়ো তাঁর পায়ে ।' 
  
গুরু চলেছেন গেয়ে ,                সম্মুখে চলেছে ধেয়ে 
                কত পান্থ কত অশ্বরথ !— 
‘ হে ভবেশ , হে শংকর ,               সবারে দিয়েছ ঘর , 
                আমারে দিয়েছ শুধু পথ । 
অন্নপূর্ণা মা আমার                  লয়েছ বিশ্বের ভার , 
                সুখে আছে সর্ব চরাচর — 
মোরে তুমি , হে ভিখারি ,           মার কাছ হতে কাড়ি 
                করেছ আপন অনুচর ।' 
সমাপন করি গান                    সারিয়া মধ্যাহ্নস্নান 
                দুর্গদ্বারে আসিলা যখন — 
বালাজি নমিয়া তাঁরে               দাঁড়াইল এক ধারে 
                পদমূলে রাখিয়া লিখন । 
গুরু কৌতূহলভরে                  তুলিয়া লইলা করে , 
                 পড়িয়া দেখিলা পত্রখানি — 
বন্দি তাঁর পাদপদ্ম                  শিবাজি সঁপিছে অদ্য 
                 তাঁরে নিজ রাজ্য - রাজধানী । 
  
পরদিনে রামদাস                   গেলেন রাজার পাশ , 
               কহিলেন , ‘ পুত্র , কহো শুনি , 
রাজ্য যদি মোরে দেবে             কী কাজে লাগিবে এবে — 
               কোন্‌ গুণ আছে তব গুণী ? ' 
‘ তোমারি দাসত্বে প্রাণ              আনন্দে করিব দান ' 
               শিবাজি কহিলা নমি তাঁরে । 
গুরু কহে , ‘ এই ঝুলি               লহ তবে স্কন্ধে তুলি , 
                        চলো আজি ভিক্ষা করিবারে ।' 
  
শিবাজি গুরুর সাথে                ভিক্ষাপাত্র লয়ে হাতে 
               ফিরিলে পুরদ্বারে - দ্বারে । 
নৃপে হেরি ছেলেমেয়ে             ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে , 
               ডেকে আনে পিতারে মাতারে । 
অতুল ঐশ্বর্যে রত ,                 তাঁর ভিখারির ব্রত ! 
               এ যে দেখি জলে ভাসে শিলা ! 
ভিক্ষা দেয় লজ্জাভরে ,           হস্ত কাঁপে থরেথরে , 
                 ভাবে ইহা মহতের লীলা । 
  
দুর্গে দ্বিপ্রহর বাজে ,                 ক্ষান্ত দিয়া কর্মকাজে 
                বিশ্রাম করিছে পুরবাসী । 
একতারে দিয়ে তান                রামদাস গাহে গান 
                আনন্দে নয়নজলে ভাসি , 
‘ ওহে ত্রিভুবনপতি ,                 বুঝি না তোমার মতি , 
                কিছুই অভাব তব নাহি — 
হৃদয়ে হৃদয়ে তবু                   ভিক্ষা মাগি ফির , প্রভু , 
                সবার সর্বস্বধন চাহি ।' 
  
অবশেষে দিবসান্তে                 নগরের এক প্রান্তে 
               নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি — 
ভিক্ষা - অন্ন রাঁধি সুখে              গুরু কিছু দিলা মুখে , 
               প্রসাদ পাইল শিষ্য তাঁরি । 
রাজা তবে কহে হাসি ,            ‘ নৃপতির গর্ব নাশি 
               করিয়াছ পথের ভিক্ষুক — 
প্রস্তুত রয়েছে দাস ,                 আরো কিবা অভিলাষ — 
                গুরু - কাছে লব গুরু দুখ ।' 
  
গুরু কহে , ‘ তবে শোন্‌ ,             করিলি কঠিন পণ , 
                অনুরূপ নিতে হবে ভার — 
এই আমি দিনু কয়ে                মোর নামে মোর হয়ে 
                রাজ্য তুমি লহ পুনর্বার । 
তোমারে করিল বিধি               ভিক্ষুকের প্রতিনিধি , 
                 রাজ্যেশ্বর দীন উদাসীন । 
পালিবে যে রাজধর্ম                 জেনো তাহা মোর কর্ম , 
                 রাজ্য লয়ে রবে রাজ্যহীন ।' 
  
‘ বৎস , তবে এই লহো             মোর আশীর্বাদসহ 
                 আমার গেরুয়া গাত্রবাস — 
বৈরাগীর উত্তরীয়                   পতাকা করিয়া নিয়ো ' 
                 কহিলেন গুরু রামদাস । 
নৃপশিষ্য নতশিরে                  বসি রহে নদীতীরে , 
                 চিন্তারাশি ঘনায়ে ললাটে । 
থামিল রাখালবেণু ,                 গোঠে ফিরে গেল ধেনু , 
                 পরপারে সূর্য গেল পাটে । 
  
পূরবীতে ধরি তান                  একমনে রচি গান 
                  গাহিতে লাগিলা রামদাস , 
‘ আমারে রাজার সাজে              বসায়ে সংসারমাঝে 
                 কে তুমি আড়ালে কর বাস ! 
হে রাজা , রেখেছি আনি              তোমারি পাদুকাখানি , 
                 আমি থাকি পাদপীঠতলে — 
সন্ধ্যা হয়ে এল ওই ,               আর কত বসে রই ! 
                তব রাজ্যে তুমি এসো চলে ।' 
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *