প্রতিদিনের ঘটনার ধারাবাহিকতা
চন্দ্রগ্রহণের পর দ্বিতীয় চন্দ্ররাতে এগারো হাজার তিনশো চুয়াত্তরটি পাথর স্থাপন করা হলো।
পাথরগুলো বসাতে যদিও আগের পিরামিডগুলো থেকে বেশ কিছু সময় বেশি লাগলো। অনেক মৃত্যুও সংঘটিত হলো। সময় মতো পাথরগুলো নিয়ে না আসলে হয়তো এর পূর্ববর্তীদের চেয়ে আরো বেশি ভয়ানক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। পাথরগুলো নিয়ে এসে বসানোর সময়কার দুর্ঘটনায় পাথরস্থপতি মুম্বা, আরইউসহ তাদের সাথে আরো অনেক নাম না জানা কৌশলী মারা গেলো। শুধু তাই নয়, কোনো ঘোষণা ছাড়াই পাথরগুলো যখন পিছল খেয়ে ছুটে আসতে শুরু করলো তখন এর সামনে যে সমস্ত লিবিয়ান কর্মীরা ছিলো তারাসহ জমজ ‘তুরতুর’ ভ্রাতৃদ্বয় ও আরো চৌদ্দজন পাথর কর্মী চোখের নিমিষে ছাতু হয়ে গেলো। পাথরগুলো ছুটে বেড়িয়ে জায়গামতো বসার আগেই সহকারী তত্ত্বাবধায়ক এবং আরো তিনজন নুবিয়ান মিস্ত্রি মারা গেলো।
ভয়ানক এই দুর্ঘটনার পর শ্রমিকরা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল তখন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক চাবুক হাতে শ্রমিকদের দিকে এগিয়ে এলো তাদেরকে শাস্তি দিতে। তাদের অপরাধ কেন তারা কাজ ফেলে দীর্ঘক্ষণ বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। তাকে দেখে শ্রমিকদের বুকের ভেতরে ভয়ের একটু ধাক্কা লাগলো। তাদের শ্বাস প্রশ্বাস কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেলো।
এগারো হাজার তিনশো সাতাত্তর নাম্বার পাথর খণ্ড পরবর্তীতে হাতে গোনা কয়েকজনের মৃত্যু ছাড়াই স্থানান্তর করা হলো। তবে এ পাথরগুলো স্থানান্তর করতে গিয়ে প্রধান মিস্ত্রিকে বরখাস্ত করা হলো। তাকে পাথর উত্তোলনের খাদে স্থানান্তর করা হলো। কারণ পাথর বহনের সময় সে দু জন শ্রমিকের পা কেটে যাওয়ার বিষয়টা ইচ্ছে করেও ঠেকাতে পারে নি।
নতুন যে প্রধান মিস্ত্রি নিয়োগপ্রাপ্ত হলো সে মহান এ পিরামিড তৈরিতে এ সমস্ত ছোট-খাটো ভুলগুলো বেশ গুরুত্বের সাথে তত্ত্বাবধান করবে বলে প্রতিজ্ঞা করলো।
তবে স্থানান্তরিত এগারো হাজার তিনশো একাশিটি পাথরের স্তুপ থেকে এক ধরনের বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। লোকজন বলাবলি করছিলো যে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে আগত নানা ধরনের শ্রমিকদের বিভিন্ন রকমের রোগ-জীবাণু এই পাথরগুলোকে আক্রান্ত করেছে।
বিষয়টা সত্যিও হতে পারে। কারণ যে এই পাথরগুলো স্পর্শ করেছে তার শরীরে এক প্রকারের চুলকানিসহ ফুসকুঁড়ি দেখা দিয়েছিলো।
পরবর্তীতে এগারো হাজার তিনশো তেরাশিতম পাথর যখন নিয়ে আসা হলো আর এটা বসানোর কাজ শুরু হলো তখন পাথর স্থাপন নিয়ে আগের মৃত্যু ঘটনাগুলো পুরোপুরি মুছে গেলো।
তবে পাথর স্থাপন নিয়ে নতুন আরেকটা দুর্বিপাক দেখা দিলো। অনেকেই অতিরিক্ত সুর্যতাপে মারা গেলো।
এগারো হাজার তিনশো চৌরাশি নং পাথরটা যখন আনা হচ্ছিলো তখন পথিমধ্যেই পাথরটা মরুভূমিতেই থাকা অবস্থায় এটা নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লো। বলা হলো এই পাথরটাসহ আরো যে ছয়টা পাথর আবুসির পাথরখাদ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে সেগুলোর উপর অশুভ চোখের দৃষ্টি পড়েছে।
পাথরগুলো যতোই কাছে আসছিলো স্বাভাবিক একটা আতঙ্ক ততোই তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছিলো।
সাধারণ যে সমস্ত লোকেরা পাথরগুলো দেখেছিলো তারা বলাবলি করছিলো যে প্রথম দর্শনে পাথরগুলো বেশ স্বাভাবিক মনে হলেও একটু গভীরভাবে পাথরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে, এর ভেতরে খুব গাঢ় অন্ধকার একটা শিরার মতো কিছু একটা ছোটাছুটি করছে। মনে হয় যে কেউ একজন তার কপালে অশুভ কিছু একটার চিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
কিন্তু সবশেষে পাথরগুলো যখন সত্যিকার অর্থেই সবার সামনে আনা হলো আর এর থেকে যেমনটা ভয়ের আশা করা হচ্ছিলো তেমন কোনো কিছুই ঘটলো না তখন সবাই বেশ স্বস্তি পেলো।
পাথরগুলো সংগ্রহ করতে গিয়ে মৃত্যুর ধারাবাহিকতা থেমে থাকলো না। যদিও শ্রমিক মারা যাওয়ার অনুপাত আগের চেয়ে কমে আসছিলো।
এগারো হাজার তিনশো বিরানব্বইতম পাথর সংগ্রহ করা হলো এলবারশির পাথরখাদ থেকে। এ পাথরগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করে পিরামিডের প্রধান পরিদর্শক এবং তার সহকারী ও পশ্চিম ভূমির গভর্নর যখন উপস্থিত হলেন তখন তাদের সামনে মূল জায়গায় স্থাপন করা হলো। তবে কাজের ধীরগতির জন্য অনেককেই শাস্তি দেওয়া হলো। তাদের এ শাস্তি ছিলো কঠিন।
এর সাথে আরো জানা গেলো যে একই কারণে আরো তিনটি স্থানে সমপরিমাণ শাস্তি ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু কাজের এই অস্বস্তিকর মন্থর গতির জন্য আরো একটি বিষয় জানা জানি হয়ে গেলো। সবাই জেনে গেলো যে, প্রধান ফারাও হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে আর তাই তিনি হয়তো রাজকীয় এ সমাধিটি দেখে যেতে পারবেন না। এ অপরাধে অনেক শ্রমিককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। অনেককে বড় শাস্তির মুখোমুখি হতে হলো। তাদের এ শাস্তি ছিলো অনেক লম্বা সময়ের।
যার ফলে উদ্ভুত এ পরিস্থিতিতে যখন এগারো হাজার তিনশো তিরানব্বইতম পাথর এবং চুরানব্বইতম পাথর বসানোর সময় এলো, এই উভয় পাথরগুলোই এলফানতিন পাথর খাদ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো তখন লোকজন বুঝতে পারছিলো না তারা কী করবে। আর এটা কী কাজেই বা লাগে।
তারা কি ফারাওকে নিয়ে যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সেটার উপর ভিত্তি করে দ্রুত কাজ করে যাবে নাকি মন্থর গতিতে কাজ করবে।
এদিকে আবার ধীরে ধীরে কাজ করার অপরাধে কর্তৃপক্ষের কোপানলে পড়ে তাদের পিঠের চামড়া চাবুকের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিলো।
কেউ কেউ পরামর্শ দিলো যে তারা কিছু জানে না এটা ভেবে তাদের উচিৎ দ্রুত কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তবে একদল এর বিরোধিতা করলো। তাদের কথা হলো দ্রুত কাজ করতে গেলে আবার কোনো সমস্যা হয়। তার চেয়ে ভালো আস্তে আস্তে কাজ করা। অধিকাংশই এ মতটাকে সমর্থন করলো।
ফলে মরুভূমি থেকে পাথর আনার কাজে বেশ মন্থর গতি দেখা দিলো। যেটা প্রভাব ফেললো পাথর স্থাপনের উপর। তাই মন্থর গতিতে যখন এগারো হাজার তিনশো পঁচানব্বইতম পাথরটি আনা হলো তখন এটা পরিচিত পেয়ে গেলো কুঁড়ে পাথর হিসেবে।
কোনো সন্দেহ নেই তত্ত্বাবধায়ক এবং তার সহকারী বিষয়গুলো খুব হতাশ হয়ে লক্ষ্য করছিলো। কিন্তু তাদের কারোরই সাহস হলো না কোনো শ্রমিকের উপর চাবুক তুলতে।
ফলে কাজের গতির এ মন্থরতার ধারাবাহিকতা বজায় থাকলো। লোকেরা বলতে থাকলো যে আগের পিরামিডগুলোর চেয়ে এই পিরামিডের আকৃতি, প্রকৃতি আর বিশালতা শ্রমিকদের ক্লান্ত করে তুলেছে।
মিশরের প্রত্যেকেই এমন কি পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলোতেও সবাই জানে এই পিরামিডের পাথর সংগ্রহ করতে গিয়ে কী পরিমাণ মৃত্যু সংঘটিত হয়েছে। প্রায় দশ হাজার শ্রমিককে এ সমাধি তৈরি করতে আত্মবলি দিতে হয়েছে। এখানে যারা কাজ করতে এসেছে তাদের মাঝে ছিলো এক অনিশ্চিত ক্ষোভ আর হতাশা। অনেক সন্তানই মার কাছে খবর পাঠাতো যে ‘প্রিয় মা একটা সমাধি তৈরি করার পেছনে আমার জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমাকে ব্যয় করতে হবে।’
কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতো, ‘এই পিরামিড নির্মাণ শেষ হওয়ার পর কী ঘটবে?’
এর প্রতিউত্তরে অনেকে চুপ থাকতো। আবার কেউ বলতো, ‘তুমি একটা মূর্খ। এই প্রশ্ন করে তোমার কোনো লাভ নেই। কারণ, পিরামিড যখন নির্মাণ শেষ হয়ে যাবে তখন এটা দেখার সৌভাগ্য তোমার হবে না। তার আগেই তুমি মারা যাবে।’
কেউ কেউ বিষয়টা ব্যাখ্যা করতো এভাবে যে, এই পিরামিডটা নির্মাণ শেষ হলে তারপর আমরা আরেকটা পিরামিড তৈরির কাজে নেমে পড়বো। তারপর আরেকটা, তারপর আরেকটা। এভাবে চলতেই থাকবে। পরবর্তী সেই পিরামিডগুলো হয়তো হবে ফারাও খুফুর ছেলের কিংবা নাতির কিংবা তার নাতির।
যা হোক। লোকজন যা বলাবলি করছিলো তার সমস্ত রিপোর্ট এবং সমসাময়িক পরিস্থিতির সব খবরই ফারাও এর কাছে পৌঁছানো হচ্ছিলো। সবাই অপেক্ষা করছিলো কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটা জানার জন্য। কিন্তু কেউ জানতেও পারলো না এর বিপরীতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
একদিন এক চক্ষু এক যাদুকর এসে বললো, ‘ফারাও অবশ্যই দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। তার খুব শীঘ্রই মারা যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই পিরামিডের কাজে যে শ্লথ গতি। এতে কোনো সমস্যা নেই। ‘
তখন কর্তৃপক্ষের অন্য আরেকজন সদস্য বললো, ‘যে কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে ফারাও আজীবন বেঁচে থাকবেন, যদি দিতে পারেন তাহলে পিরামিড তৈরির যে মন্থর গতি তা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। ‘
যথাসময়ে পিরামিড তৈরিতে এগারো হাজার তিনশো সাতানব্বইতম পাথরটি পিরামিড তৈরির স্থানে নিয়ে আসা হলো। এগারো হাজার তিনশো আটানব্বইতম পাথরটা আনা হলো সাকারা পাথরখাদ থেকে। এ পাথরটা বহনের সময় অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটলো। পাথরটা বসানোর একদিন পূর্বে এর নির্দিষ্ট জায়গায় একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে ঘুমিয়েছিলো। সবাই মরুভূমির এ বিষাক্ত সাপটা দেখে একটা অশুভ কিছু নিয়ে ভয় পাচ্ছিলো। অবশ্য সেটা তেমন কোনো সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় নি।
পাথরটা আগের পাথরগুলোর মতো তার নির্দিষ্ট স্থানে রাখার পর আবার মরুভূমির বালির রাস্তায় ধুলির মেঘ দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে আরো পাথর আসছে।
আরো পাথর। অসংখ্য পাথর। কেবল পাথর আর পাথর।
এগারো হাজার তিনশো নিরানব্বইতম পাথর, তারপর আরো, তারপর আরো।
কোনো রকম বিশ্রাম ছাড়াই যেনো কিয়ামত পর্যন্ত এগুলো আসতেই
থাকবে।
হ্যা প্রভু!
চারদিকে কেবল পাথর আসছে। আসছে। আসছে। বিরামহীনভাবে এ পাথর চলমান। বহমান।