গ্রন্থভূক্ত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ)
গান
অগ্রন্থিত কবিতা
গল্প
চলচ্চিত্র কাহিনী ও চিত্রনাট্য
সম্পাদকীয়, গদ্য ও বক্তৃতা
সাক্ষাৎকার
1 of 2

প্রতিক্রিয়া

প্রতিক্রিয়া

মাসিক ডাইজেস্ট-এর আগস্ট ‘৯০ সংখ্যায় গ্রন্থ সমালোচনা বিভাগে আমার ‘মৌলিক মুখোশ’ গ্রন্থটি সম্পর্কে লিখেছেন আমিনুর রহমান। তাঁর উপস্থাপনায় কিছু ভ্রান্তি এবং অজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। যে কারনে আত্মপক্ষ সমর্থন কোরে এই প্রতিক্রিয়া লিখতে হচ্ছে।

তিনি লিখেছেন তিনি যেন একটি নির্দিষ্ট সীমানায় হাবুডুবু খাচ্ছেন, বেরুতে পারছেন না। ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’-এ যে ধরনের বোধ তার মাঝে কাজ করেছে ‘ছোবল’-এ তার ব্যত্যয় ঘটেনি আর ‘মৌলিক মুখোশ’-এ তো নয়ই।… কিন্তু আমরা দেখছি ‘৮৬ সালে প্রকাশিত ‘ছোবল’ এবং ‘৯০ সালে প্রকাশিত ‘মৌলিক মুখোশ’-এ মৌলিক কোনো পার্থক্য আসেনি। ঘুরে ফিরে একই বোধ কাজ করেছে।”

এই যে ঘুরে ফিরে ‘বোধ’ আসছে, এ ব্যাপারটি কি? বোধ বলতে আমিনুর রহমান ঠিক কি বোঝাতে চাচ্ছেন? কাব্য-অলংকারশাস্ত্রে কোথাও তো বোধ নামক কোনো বিচার-এককের সাথে আমার পরিচয় হয়নি। বোধ বলতে তিনি কি বিষয় বোঝাতে চাচ্ছেন, না প্রকরন বোঝাতে চাচ্ছেন? নাকি যে আদর্শ বা বিশ্বাস কবিতার ধমনীতে প্রবাহিত থাকে তাকে বোঝাচ্ছেন? তিনি কোনো উদ্ধৃতি ব্যবহার করেননি। বইগুলো থেকে তিনি উল্লেখ কোরে দ্যাখাতে পারতেন যে কোন ‘নির্দিষ্ট একটি সীমানায়’ আমি ‘হাবুডুবু’ খাচ্ছি। কাব্য আলোচনায় ‘একটি নির্দিষ্ট সীমানায়’ এই ধরনের প্রতারক শব্দবন্ধ ব্যবহারের কোনো মানে হয় না। হয় কি?

‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ আমার দ্বিতীয়, ‘ছোবল’ চতুর্থ এবং ‘মৌলিক মুখোশ’ সপ্তম কবিতার বই। পাঠকের সুবিধের জন্যে বই তিনটি সম্পর্কে সামান্য ধারনা এবং কিছু উদ্ধৃতি দিচ্ছি। ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’-এর বিষয় হলো বাঙালির প্রেরনাদায়ক ঐতিহ্য অনুসন্ধান, জাতিসত্তার স্বরূপ উদ্ঘাটন এবং সমকালীন জীবনে মানুষের মুক্তির আকাংখা। আর প্রকরনে বাংলা কবিতার প্রধান তিনটি ছন্দ— অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের ব্যবহার ছাড়াও পুঁথি কবিতার ফর্মকেও সমকালীন ভাষায় ব্যবহার করা হয়েছে। লোকজ শব্দের প্রাথমিক প্রয়োগও শুরু করেছি এই বই-এ।

যেমন-

১. গ্রাম থেকে উঠে এলো ক্ষেতের মানুষ
খরায় চামড়া পোড়া মাটির নাহান,
গতরে ক্ষুধার চিন মলিন বেবাক—

(হাড়েরও ঘরখানি)

২. আবার নবান্ন কোরো, অতিথিরে নারায়ন জেনে
শাকান্ন, শিঙির ঝোল, আমসত্ব, খেজুর পাটালি
কাসার থালায় এনে খেতে দিও শীতল পাটিতে-

(নিখিলের অনন্ত অঙ্গন)

৩. কাচের গেলাশে উপচানো মদ ব্যথিত জীবন
পান কোরে আমি ধুয়ে দিতে চাই কষ্ট আমার।

(কাচের গেলাশে উপচানো মদ)

৪. পরান দুলে উঠলো হাওয়ায়
বনে কি মৌশুম এসেছে
এই কি উদাস হবার সময়
ও মন মাঝি!

(ও মন আমি আর পারি না)

৫. বন্দনা করি ২ এদেশেরি অনার্য পিতার
শ্যাম চামড়ার শ্যামল মানুষ মাটি শ্যামলার
খাঁটি মানুষ যারা ২-

(রাস্তার কবিতা)

‘ছোবল’-এর বিষয় সম্পূর্ন রাজনৈতিক। মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারায় মানুষের মুক্তির প্রত্যক্ষ জাগরন, আন্দোলন এ সবই এ বই-এর প্রেরনা। অলংকারশাস্ত্রের প্রচলিত প্রথাগুলো বর্জন কোরে এ বই-এ সরাসরি উক্তি বা স্টেটমেন্ট ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছি। যেমন—

১. পৃথিবীতে মানুষ তখনো ব্যক্তি স্বার্থে ভাগ হয়ে যায়নি।
ভূমির কোনো মালিকানা হয়নি তখনো,
তখনো মানুষ শুধু পৃথিবীর সন্তান-

(ইশতেহার )

২. আমাদের নাগরিকবৃন্দ মলমূত্র ছাড়া
আর কোনো ত্যাগেই উৎসাহী নয়—

(ঘোষনা : ১৯৮৪)

৩. পরস্পর দ্যাখা হলে আমরা এখনো কেন জিজ্ঞাসা করছি
কেমন আছেন?
আমরা কেন জিজ্ঞাসা করছি না : লাশটা কোথায় গেল?
রাজপথে গুলি হচ্ছে কেন?

(কুশল সংবাদ)

৪. মাংশের দোকানে আজ পেয়ে যাবে পন্ডিতের কিমা;
বিশ টাকা সেরে পাবে তাজা মধ্যবিত্তের পাঁজর…..
নগরে বেশ্যার মতো পেয়ে যাবে নেতার কলিজা—

(অস্ত্র চাই)

৫. তিন জোড়া চমৎকার নিহত জয়নালের রোস্ট,
আধাসিদ্ধ গনতন্ত্র, আর তাজা মানুষের জিভ
ভয়ানক চেয়ে থাকা পুলিশের উপড়ানো চোখ—

(নৈশভোজ ‘৮৩)

কিন্তু ‘মৌলিক মুখোশ’-এ রাজনীতির উপস্থিতি সামান্য এবং তা সরাসরি নয়। ব্যক্তি মানসের টানাপোড়েন, সামাজিক অসংগতি, বিপর্যস্ত জীবন— এ সবই হচ্ছে এ বই-এর বিষয়। কিছুটা বিদ্রূপ, কিছুটা শ্লেষ এবং একেবারে ঘরোয়া মুখের কথাকে কবিতায় আনার চেষ্টা। যেমন—

১. গলাবাজ গায়কেরা গেয়ে উঠবে ‘নোতুন বাংলাদেশ…’
পাঁচ তারায় উথলে উপচে পড়বে
কৌটোবন্দি ভল্লুকের ফেনা—

(এক্সরে রিপোর্ট)

২. মানে বন্ধুর পত্নির কাঁধে হাত, আবডালে ছোঁয়াছুঁয়ি
মানে কন্যার স্বামীর সাথে মা উধাও
ব্লু-ব্লু-
তবু রমনীরা সতিসাধ্বী, পত্নিপরায়ন স্বামী।

(ময়নাতদন্ত)

৩. সহস্র শিশুর পুষ্টিহীন হাড়
বাজায় উজ্জ্বল সুরে পারমানবিক বাঁশি।

(মধ্যরাত )

৪. স্বেচ্ছায় বাড়িয়ে রেখে পশ্চাতের মাংশময় ভূমি
যে পারে প্রভুর জন্যে এনে দিতে লাথির আরাম,
‘জী হুজুর’ ছাড়া আর সব শব্দ যে গিয়েছে ভুলে—

(যোগ্যতা )

৫. তোমার দিকে ফিরবো কখন
বন্দি আমার চোখ,
পাহারা দেয় খল সামাজিক নোখ।

(পরকীয়া)

৬. তুমি বরং ঘোলা পানির মাছ শিকারে
দ্যাখাও তোমার গভীর মেধা।

(সামঞ্জস্য)

৭. আকাশের নীল কণ্ঠে দুলছে পাখির নেকলেস,
অফিস ফেরৎ সূর্যটি
দিগন্তের বাস স্ট্যান্ডে একাকি দাঁড়িয়ে আছে।

(আঁধারপুরের বাস)

৮. হাত বাড়ালেই মুঠো ভ’রে যায় ঋনে
অথচ আমার শস্যের মাঠ ভরা।

(খতিয়ান)

৯. দোলাও তোমার দুই পৃথিবী দোলাও
ভোলাও যতো ক্ষুধার্ত চোখ ভোলাও
দোলাও তোমার দালানকোঠা দোলাও

(যুগল দোলনা)

১০. মাতাল, এবার পাতালে চল,
চাতালে দ্যাখ দাঁতাল শুয়োর
সংসারে তোর বন্ধ দুয়োর বুকটা ফাঁকা—

(পলায়ন)

আলোচক শেষ পর্যায়ে একটি মাত্র উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে লিখেছেন— “মৌলিক মুখোশে’ কবি এক ধরনের নতুন কাজ করেছেন। তা হলো একটি শব্দের কাছাকাছি আর একটি শব্দ নিয়ে কাজ করা। যেমন— ‘সামরিক ক্যু হবার পর সকল কু বাজেয়াপ্ত হলো।… ঈদের নামাজ শেষে মুসল্লিরা কোলালি করলো বটে। কোলাকুলি বন্ধ হলো। কুলীন সকল লীন হলো। কু কাজ দাঁড়ালো শেষে কাজে।”

এর মধ্যে নোতুন কাজের কি হলো? ব্যাপারটা আদৌ তিনি বুঝতে পারেননি। বুঝিয়ে বলি— সাময়িক ক্যু হবার পর যখন যাবতীয় কু নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো তখন দ্যাখা গেল কোলাকুলির কু বাদ পড়েছে অর্থাৎ কোলালি। কুমীর-এর কু বাদ অর্থাৎ মীর। কুলীন-এর কু বাদ অর্থাৎ লীন। কু-কাজ কাজে এবং কু-লোক লোকে পরিনত হলো। কবিতাটির ভেতরে প্রচ্ছন্ন যে বিদ্রূপ বা শ্লেষ রয়েছে সাধারন পাঠকও তা উপলব্ধি করতে পারবে। আলোচকের কাছে প্রশ্ন— উপরের শব্দগুলোর মধ্যে কোন শব্দটি ‘একটি শব্দের কাছাকাছি আর একটি শব্দ?

ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগা প্রকাশের জন্যে তো চিঠিপত্রের বিভাগ আছে। গ্রন্থ-সমালোচনা বিভাগে কেন এ জাতীয় দায়িত্বহীন, অজ্ঞতাপূর্ন লেখা? সামরিক ক্যু-র পরবর্তী অবস্থা দেখছি এখানেও বহাল তবিয়তে চলছে। আমার বানান রীতির বিষয়ে আলোচক যে প্রশ্ন তুলেছেন তা এখানে নয়— এমনিতেই কলেবর দীর্ঘ হয়ে গেছে। অন্য পরিসরে পরে কখনো সে বিষয়ে লিখবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *