প্রতিকৃতি
রঞ্জন পুরকায়স্থ কলকাতার একজন নামকরা চিত্রকর। শুধু কলকাতা কেন, তাঁর খ্যাতি পশ্চিমবাংলার বাইরে সারা ভারতবর্ষেই ছড়িয়ে পড়েছে—বোম্বাই, মাদ্রাজ, দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদে তাঁর আঁকা ছবির প্রদর্শনী হয়ে গেছে। ছবি বিক্রি করেই পুরকায়স্থ মশাইয়ের রোজগার, এবং সে রোজগার রীতিমতো ভালো। গতমাসেই বোম্বাইতে তাঁর একখান অয়েল পেন্টিং পঁয়ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
পুরকায়স্থ মশাইয়ের আঁকার ঢং যাকে বলে আধুনিক, তার সঙ্গে বাস্তব জগতের সাদৃশ্য সামান্যই পাওয়া যায়। তাঁর মানুষগুলিকে মনে হয় অক্ষম কারিগরের হাতের তৈরি পুতুল, গাছগুলিকে মনে হয় খ্যাংড়া কাঠির ঝাঁটা, আকাশের মেঘগুলিকে মনে হয় ভাসমান মাংসপিণ্ড, আর তার পশুপক্ষীর সঙ্গে প্রকৃতি বা চিড়িয়াখানার মিল নেই। কিন্তু আজকাল এই রীতিতে শিল্প রসিকরা অভ্যস্ত, তাই এমন ছবি এঁকেও পুরকায়স্থর রোজগারে কোনও খামতি নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও জুড়ি যে মানুষের প্রতিকৃতি বা পোর্ট্রেট আঁকার ব্যাপারেও পুরকায়স্থের জুড়ী মেলা ভার। এখানে তিনি আধুনিক রীতি ব্যবহার করেন না, ছবি দেখলে মানুষ বলেই মনে হয়, এবং যাঁর ছবি আঁকা হয় তাঁর সঙ্গে চমৎকার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এই পোর্ট্রেট আঁকতেও রঞ্জনবাবুকে মাঝে সাঝে হিল্লি দিল্লি করতে হয়, এবং এতেও তাঁর রোজগার হয় ভালই। প্রমাণ সাইজের একটি অয়েল পেন্টিং-এ তিনি পনেরো হাজার টাকা করে নেন। ইচ্ছে আছে আগামী বছর থেকে সেটা পঁচিশে তুলবেন। ফটোগ্রাফির যুগেও যে কোনও কোনও ধনী ব্যক্তিরা নিজেদের ছবি আঁকাতে ভালোবাসে সেটা রঞ্জনবাবুর ক্ষেত্রে বার বার প্রমাণ হয়ে গেছে।
এক রবিবার সকালে রঞ্জনবাবুর রিচি রোডের সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে এক ব্যক্তির আগমন হল। দেখেই বোঝা যায় ইনি অর্থবান, লম্বা দশাসই চেহারা, পরনে র’সিল্কের স্যুট, হাতের পাঁচ আঙুলে আংটি। চেহারায় ব্যক্তিত্বের ছাপ পরিষ্কার। ভদ্রলোক বললেন তাঁর নাম শ্রীবিলাস মল্লিক। মল্লিক মশাইয়ের শখ রঞ্জন পুরকায়স্থকে দিয়ে নিজের একটি পোর্ট্রেট আঁকান, এবং সেটি হবে লাইফ-সাইজ পূর্ণাঙ্গ পোর্ট্রেট। তার জন্য যা খরচ লাগে তা তিনি দিতে রাজি আছেন। রঞ্জনবাবু ভদ্রলোকের নাম শুনে চিনলেন তিনি কলকাতার সবচেয়ে অর্থবান ব্যবসায়ীদের অন্যতম। ‘কত মূল্য লাগবে?’ জিজ্ঞেস করলেন শ্রীবিলাস মল্লিক। ‘পঞ্চাশ হাজার,’ সোজাসুজি বললেন রঞ্জন পুরকায়স্থ। খদ্দের এক কথায় রাজি।
রঞ্জনবাবুর হাতে একটা অসমাপ্ত ছবি ছিল—একটা বড় পেন্টিং—যেটা শেষ করতে লাগবে আরও সাতদিন। সেই হিসেব করে মল্লিক মশাইকে দিনক্ষণ বলে দিলেন শিল্পী। রোজ সকালে ন’টায় এক ঘণ্টার জন্য সিটিং দিতে হবে।
‘ছবি শেষ হবে কতদিনে?’ জিজ্ঞেস করলেন শ্রীবিলাস মল্লিক।
‘দিন পনেরো,’ বললেন রঞ্জনবাবু।
‘ভেরি ওয়েল,’ বললেন মল্লিকমশাই, ‘সেটল্ড।…ইয়ে, আপনার আগাম কিছু লাগবে কি?’
‘আজ্ঞে না।’
কোনও বড় কাজে হাত দেবার আগে রঞ্জনবাবু তাঁর গুরুর কাছ থেকে আশীবাদ নিতেন। বাবাজীর নাম সরলানন্দ স্বামী, দশ বছর আগে রঞ্জনবাবু এনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন, অনেক ব্যাপারেই এঁর পরামর্শ নেন, স্বামীজিও তাঁর শিষ্যকে খুবই স্নেহ করেন। ভদ্রলোকের অনেক ক্ষমতা, তার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণী একটি।
শিষ্যের কাছে সব শুনে টুনে মিনিট তিনেক ধ্যানস্থ থেকে স্বামীজি বললেন, ‘সংকট আছে।’
‘কী সংকট, স্বামীজি?’
‘অনেক বিপত্তি। এ কাজটা নিয়ে তুই ভালো করিসনি।’
‘তবে কি ভদ্রলোককে বারণ করে দেব?’
‘দাঁড়া।’
বাবাজী আবার চোখ বুঁজলেন, আর বসে বসে আগুপিছু দুলতে লাগলেন।
প্রায় পাঁচ মিনিট এই ভাবে চলার পর বাবাজী আবার চোখ খুললেন। রঞ্জনবাবু উৎকণ্ঠিত চিত্তে গুরুর দিকে চেয়ে আছেন। গুরু বললেন, ‘শেষ পর্যন্ত সব বিপত্তি উৎরে সাফল্যই দেখতে পাচ্ছি! না, লেগে পড় কাজে।’
রঞ্জন পুরকায়স্থ পরম নিশ্চিন্তে বাবার পদধূলি নিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন।
শনিবার সাতই মাঘ শ্রীবিলাস মল্লিকের পোর্ট্রেট আঁকার কাজ শুরু হল। মল্লিকমশাই আমুদে মানুষ—আগেই জেনে নিলেন মাঝে মাঝে কথা বলা চলবে কি না। সচরাচর এ ব্যাপারে পুরকায়স্থ অনুমতি দেন না, কিন্তু এত বড় খদ্দেরের বেলা তাঁকে হ্যাঁ বলতে হল। ‘তবে ঘাড় ঘোরানো চলবে না। কথা বললে এক দিকে, অর্থাৎ আমার ডান কাঁধের দিকে চেয়ে বলতে হবে।’
ক্যানভাসে চারকোলের প্রথম টান যখন পড়ল তখন সকাল সোয়া ন’টা।
দিনে দিনে ক্যানভাসে শ্রীবিলাস মল্লিকের চেহারা ফুটে উঠতে লাগল। অত্যন্ত নিপুণ শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই, তবে এই অবস্থায় তাঁর কাজ দেখার লোক একমাত্র শিল্পী নিজেই। যাঁর ছবি আঁকা হচ্ছে তিনি দেখবেন ছবি একেবারে শেষ হলে। এই শর্তটার কথা আগে বলা হয়নি। মল্লিকমশাইও এই শর্তে আপত্তি করেননি।
বারোদিনের দিন পোর্ট্রেট যখন প্রায় হয়ে এসেছে তখন সিটিং দেবার মাঝখানে আধ ঘণ্টার মাথায় শ্রীবিলাস মল্লিক বলে উঠলেন তাঁর মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। রঞ্জনবাবু কাজ থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনি তা হলে বাড়ি চলে যান। আর ত প্রায় হয়েই এসেছে, কাল সুস্থ বোধ করলে আবার আসবেন।’
কিন্তু পরদিনও সুস্থ বোধ করলেন না শ্রীবিলাস মল্লিক। শুধু তাই নয়, তাঁর জ্বর এল প্রায় ১০৩ ডিগ্রি।
তিনদিনের দিন বোঝা গেল ব্যারাম গুরুতর, নার্সিংহোমে চালান দিতে হবে রুগীকে। রঞ্জন পুরকায়স্থ ইজেল থেকে পোর্ট্রেট নামিয়ে পাশে সরিয়ে রেখে একটা আনকোরা নতুন ক্যানভাস চাপিয়ে তাতে আধুনিক ঢঙে একটি ল্যান্ডস্কেপ শুরু করলেন।
দেড়মাস নার্সিংহোমে থেকে ব্যারাম মুক্ত হয়ে শ্রীবিলাস মল্লিক যখন বাড়ি ফিরলেন তখন তাঁর চেহারার সঙ্গে আগের চেহারার কোনও মিলই নেই। ওজন ৯০ কিলো থেকে নেমে হয়েছে ৭২ কিলো। গাল বসে গেছে, চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। রঞ্জন পুরকায়স্থকে খবর পাঠালেন—ছবি এখন থাক। চেহারা আরেকটু ভালো হলে আবার নতুন করে সিটিং দেওয়া যাবে।
এক মাস পরে শ্রীবিলাস মল্লিকের চেহারা আরেকটু ভদ্রস্থ হল। তবে আগের চেহারার সঙ্গে এখনও কোনও মিল নেই। মল্লিক বললেন, ‘এই অবস্থাতেই আবার নতুন করে ছবি আঁকা হোক।’ ডাক্তারেরা তাঁকে ডায়াট কন্ট্রোল করতে বলেছেন, তাই আশি কিলোর চেয়ে ওজন আর তাঁর বাড়বে না।
রঞ্জন পুরকায়স্থ ইজেলে আবার নতুন ক্যানভাস লাগালেন। মল্লিকমশায়ের জামা কাপড় আবার সবই নতুন করে খাটো করে করতে হয়েছে। তবে এটা ঠিকই যে মানুষটাকে এখন দেখলে আর অসুস্থ বলে মনে হয় না।
চারদিন আঁকার পর একদিন বিকেলে রঞ্জনবাবু তাঁর ফিয়াট গাড়িতে করে নিউমার্কেট গিয়েছিলেন একটু বাজার করতে। বাড়ি ফেরার পথে পার্ক স্ট্রিটের মোড় ছাড়িয়ে খানিকদূর যেতেই একটা মিনি বাস দ্রুত বেগে বেপরোয়াভাবে এসে তাঁর গাড়ির ডান দিকে মারল ধাক্কা। গাড়িত ড্যামেজ হলই, সেই সঙ্গে রঞ্জনবাবুর ডান হাতটা গুরুতর ভাবে আঘাত পেল।
হাসপাতালে গিয়ে এক্সরে করে দেখা গেল, কুনুই গেছে, কবজি গেছে আর বুড়ো আঙুলটা গেছে।
প্লাস্টারে দু মাস থেকে যা দাঁড়াল তাতে এইটুই বোঝা গেল যে রঞ্জন পুরকায়স্থ তাঁর অঙ্কনের দক্ষতা আর কোনওদিন ফিরে পাবেন না। যত গোলমাল ওই বুড়ো আঙুলে। তর্জনী আর মাঝের আঙুলে তুলি বেঁধে ছবি এঁকে মডার্ন আর্ট হয়, কিন্তু স্বাভাবিক পোর্ট্রেট হয় না।
রঞ্জনবাবু এতই ঘা খেলেন যে তিনি কাজকর্ম ছেড়ে কিছু কালের জন্য তীর্থ ভ্রমণে চলে গেলেন। তিন মাস কাশী হরিদ্বার হৃষিকেশ লছমনঝুলা ঘুরে বাড়িতে ফিরে ওই দুই আঙুলেই আবার ছবি আঁকা শুরু করলেন। তার ফলে কাজ ঢিমে হয়ে এল, ছবির চেহারাই পালটে গেল। এ ছবির জন্য আর ত্রিশ পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা চাওয়া যায় না। রঞ্জনবাবু বুঝলেন যে তাঁকে আবার নতুন করে বাজার তৈরি করতে হবে। ইতিমধ্যে শ্রীবিলাস মল্লিক তাঁর খোঁজ নিয়েছেন, তাঁকে সমবেদনা জানিয়েছেন, এবং আক্ষেপ জানিয়েছেন যে পুরকায়স্থমশাই-এর করা একটি পোর্ট্রেট তাঁর বাড়িতে রইল না।
আরও তিন মাস পরিশ্রম করে দু আঙুলে তুলি চালিয়ে রঞ্জন পুরকায়স্থ মোটামুটি একটা নিজস্ব স্টাইল উদ্ভব করেছেন, এবং ক্রমে তাঁর আঁকার কদর বাড়ছে। এর মধ্যে একদিন রবিবার সকালে চাকর এসে তাঁর স্টুডিওতে খবর দিল যে একজন ভদ্রলোক পুরকায়স্থ মশাই-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
‘এঁকে আপনি চেনেন,’ বলল চাকর।
রঞ্জনবাবু নীচে নেমে এলেন। বৈঠকখানায় ঢুকে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর সেই দশাসই বপু এবং হুবহু আগের সেই চেহারা নিয়ে শ্রীবিলাস মল্লিক।
‘কী ব্যাপার বলুন ত?’ জিজ্ঞেস করলেন রঞ্জন পুরকায়স্থ।
‘কিছুই না, বললেন শ্রীবিলাস মল্লিক, ‘আমি অত্যন্ত ভোজন প্রিয় মানুষ। ডাক্তারের কথা রাখতে পারলাম না—ডায়াট কন্ট্রোল আমার দ্বারা হল না, তাই দেখতে দেখতে আগের চেহারায় এসে গেছি। আমার সেই ছবিটা নষ্ট করে ফেলেননি ত?’
‘মোটেই না। তবে তাতে দু একটা আঁচড় দিতে হবে—সেটা আমি দু আঙুলেই পারব। আপনি একবার কাল সকালে ঘণ্টাখানেকের জন্য আসতে পারেন কি?’
‘বিলক্ষণ, বিলক্ষণ। আর ইয়ে, আপনার রেটটাও এতদিনে নিশ্চয়ই বেড়েছে। ওই পোর্ট্রেটের জন্য যা দর ধরা হয়েছিল, আমি এখন তার চেয়ে কিছু বেশি দিতে চাই। আশাকরি আপনার কোনও আপত্তি হবে না।’