প্রতিকার-পন্থা
অন্যায়ের প্রতিকার-পন্থা, হৃত-অধিকার আদায়ের উপায় ও পীড়ন-শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির নানা রীতি-নীতি ও পদ্ধতি সম্পর্কে হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ নানা চিন্তা-ভাবনা করেছে। এবং বিচিত্র পথে এই প্রতিকার-প্রয়াস বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রত্যেকটা উপায় ও নীতি আপাতদৃষ্টে যৌক্তিক। কেবল দেশ-কাল ও ব্যক্তি ভেদে সেগুলোর উপযোগ ভেদ ঘটেছে মাত্র। এক গোষ্ঠীর মতে যে-নীতি বাঞ্ছিত ও প্রযোজ্য, অপর গোষ্ঠীর ধারণায় তা অবাঞ্ছিত ও পরিহার্য। এমনি করে কাল এবং কর্তা ভেদেও পরিবর্তিত হয়েছে নীতি-পদ্ধতি। ক্রমবিবর্তন ও ক্রমউকর্ষ-ধারায় এই নীতি-পদ্ধতি আজ যে-স্তরে উন্নীত তাও সন্তোষজনক নয়, সবার মনঃপুত তো নয়ই। এখনো তা উন্নয়ন ও বিকাশ সাপেক্ষ। এই নীতি-পদ্ধতি দৈশিক, গৌত্রিক, কিংবা জাতিক সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিকবোধ বিকাশের অন্যতম পরিমাপক হলেও তা দেশ-গোত্র-জাতির সব মানুষের বোধ-বুদ্ধি সংস্কৃতির আনুপাতিক মান নির্ণয়ের মাপকাঠি যে নয়, তাও উল্লেখ্য। কেননা, এ নীতি-পদ্ধতি নির্ধারিত ও প্রযুক্ত হয় দেশ, গোত্র বা জাতির নেতা বা কর্তৃপক্ষের দ্বারা। নেতা বা কর্তাগণের মন বিদ্যা-বুদ্ধি ও নীতিবোধই থাকে এর পশ্চাতে ক্রিয়াশীল, অন্যমানুষের সম্পর্ক নিতান্ত গৌণ। আবার ব্যক্তিগত প্রতিকার- নীতি ও গোষ্ঠী বা জাতিগত প্রতিকার-পদ্ধতিতে পার্থক্যও সামান্য নয়। এখানেও উপযোগ ও প্রয়োগভেদ স্বীকৃত।
ব্যক্তিগত প্রতিকার-প্রয়াসে কেউ প্রতিহিংসা নীতিতে আস্থাবান, কেউ ক্ষমার মাহাত্মে মুগ্ধ, কেউবা স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনোবা শাস্তি, কখনোবা ক্ষমার পক্ষপাতী। কিন্তু গোত্রীয়, জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রায় সবাই প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নীতিকেই মোক্ষম বলে মানে। তাই হন্তা ও যোদ্ধাই বীর ও মহাপুরুষরূপে পরিকীর্তিত।
এক্ষেত্রে বিষে বিষ ক্ষয় বুনো কচু ও বাঘাতেঁতুল এবং শঠে শাঠ্যাং সমাচরেৎ –এই সুপ্রাচীন নীতির তত্ত্বগত সত্য ও তথ্যগত যাথার্থ্য বহু পরীক্ষিত। বহুলপ্রযুক্ত এই নীতি বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ বলে নির্ভরযোগ্য। কেননা, মানুষ শক্তের ভক্ত, নরমের যম। এ পন্থা বাহুবল ভিত্তিক এবং দ্বন্দ ও সংঘাতপ্রসূ। এক্ষেত্রে কুশলী দুর্বলের নীতি হচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা কিংবা হাতী দিয়ে হাতী বাঁধা।
শামীয়জগতে প্রতিকার-নীতির ক্রমবিকাশের ধারায় তিনটি সুস্পষ্ট পদ্ধতি দেখতে পাই। হযরত মুসা বলেন, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ উপড়াও। অর্থাৎ বাহুবলে প্রতিরোধ কর, প্রতিশোধ নাও, কিন্তু অপরাধ ও শাস্তির সমতা রক্ষা করো তথা অন্যায় ও তার প্রতিকার আনুপাতিক হওয়া চাই।
হযরত ঈসা বলেন– একগালে থাপ্পড় পেলে তো অপর কপোলও থাপ্পড় নেয়ার জন্যে উন্মুক্ত কর। অর্থাৎ প্রতিরোধ করো না, প্রতিশোধ ব্যবস্থা মনে ঠাই দিয়ো না, বরং মহত্ত্ব ও ক্ষমা দিয়ে অন্যায়কারীর হৃদয় জয় করো–যাতে সে চিরকালের জন্যেই অপকর্ম থেকে নিবৃত্ত হয়–ক্ষমা ও মহত্ত্বের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে।
হযরত মুহম্মদ বললেন– পারো তো ক্ষমা করো, নইলে শাস্তি দাও। অর্থাৎ স্থান-কাল পাত্রভেদে ক্ষমা বা শাস্তির উপযোগ ও প্রয়োগসাফল্য নজরে রেখো।
এদেশে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম কর্মবাদে আস্থা রাখে। পাপ-পুণ্যের শাস্তি ও পুরস্কার অমোঘ। গীতায় দুষ্কৃতিদমনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত। কিন্তু গৌতমবুদ্ধ প্রতিকারের চেয়ে অন্যায়-বিরতিতে গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। তার দশশিক্ষা Precautionary ও Preventive ব্যবস্থারূপে পরিগণিত। পার্থিব সবকিছুকে নশ্বর ও তুচ্ছ জেনে মায়া ও তৃষ্ণা তথা আকাক্ষা ও মোহমুক্ত হতে উপদেশ দিয়েছেন তিনি। এমনি রীতি ও সংযমের কথা অবশ্য সব ধর্মেই রয়েছে। মহত্ত্ব, সহিষ্ণুতা ও ক্ষমাকেই তিনি উত্তম ও শ্রেয় বলে জেনেছেন। রাজোবাদ জাতকের কাহিনীতে তার এ মনোভাব সুপরিব্যক্ত। কাহিনীটি সংক্ষেপে এই :
বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তকুমার এবং কোশলরাজ মল্লিক উভয়েই সমসাময়িক এবং আদর্শ ধার্মিক রাজা। প্রজারা তাদের শাসনে-পালনে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করছে। একদিন এই দুইরাজ্যের দুইরাজার রথ একই রাস্তায় এসে মুখোমুখি দাঁড়াল। এখন কে কাকে পথ ছেড়ে দিয়ে নিজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবেন, সে হল সমস্যা। উভয় রাজাই সমবয়স্ক। কাজেই বয়সের দাবীও টেকে না। এমনকি তাঁদের কুলগৌরব, রাজ্যপরিমাণ, সেনাবল, ঐশ্বর্য, যশ এবং জনপ্রিয়তাও সমান। এখন উপায়? অবশেষে স্থির হল, চরিত্রবলে যিনি মহত্তর, তাকেই পথ ছেড়ে দেয়া হবে।
প্রথমে কোশলরাজ মল্লিকের গুণপনা বর্ণিত হল : তিনি কঠোরে কঠোর এবং কোমলে কোমল; আর সাধুজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং শঠের সঙ্গে শাঠ্যনীতি অনুসরণ করেন।
আর বারাণসীরাজ ব্রহ্মদত্তকুমার অক্রোধের দ্বারা কুদ্ধকে, সাধুতার দ্বারা অসাধুকে দানের দ্বারা কৃপণকে এবং সত্যের দ্বারা মিথ্যাবাদীকে শিক্ষাদানের নীতির মাধ্যমে শাসন করেন।
এমনি কাহিনী মহাভারতেও রয়েছে। সেখানেও কৌরব সুহোত্র এবং উশীনর-পুত্র শিবির রথ মুখোমুখি হলে চরিত্রগুণে শিবিই পথের অধিকার পান। কেননা, তিনিও দানের দ্বারা কৃপণের ক্ষমার দ্বারা কুরকর্মার, সত্যবাদিতার দ্বারা মিথুকের এবং সাধুতার দ্বারা অসাধুর চরিত্র সংশোধনের আদর্শ অনুসরণ করতেন।
বায়জিদ বিস্তামীকে যে মাতাল আঘাত করে রক্তাক্ত করে দিল তাকে পরদিন তিনি বললেন, ভাই, আমার মাথায় ঠেকে যে তোমার বীণাটি ভেঙে গেল তাতে আমি দুঃখিত।
কিংবা চৈতন্যদেবকে যে জগাই-মাধাই লাঞ্ছিত ও আহত করল, তাদেরও তিনি বলেলেন, ভাই মেরেছ কলসির কানা, তাই বলে কি প্রেম দেব না? –গৌতমবুদ্ধ বায়জিদ কিংবা চৈতন্যদেবের এসব মহত্ত্ব আদর্শের ক্ষেত্রে মানুষ অত্যন্ত মূল্যবান বলেই জানে, কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে শ্রদ্ধেয় বলে মানে না।
এ পর্যন্ত যে-সব নীতি-পদ্ধতির কথা বলা হল সবগুলোই পুরোনো কালের। তবে এ-যুগেও সে-সব মূল্য-মর্যাদা হারায়নি।
এ-যুগে বিশেষ করে ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক জীবনে পীড়ন-প্রতিকার নিয়ে মানুষ বিশেষ মাথা ঘামায় না। একালে সব-সমস্যা জাতিক ও রাষ্ট্রিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই সমাধান প্রয়াসও চলছে যৌথপ্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং প্রতিকারনীতিও তাই জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে নির্মিত ও প্রযুক্ত হয়।
গ্যারিবল্ডী বাহুবল-নির্ভর হিংসাত্মক সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি স্বাজাত্য ও স্বদেশপ্রেমের প্রেরণায় ক্ষুধার, যন্ত্রণার ও মৃত্যুর পথেই আহ্বান জানিয়েছিলেন দেশবাসীকে।
মাও সে-তুঙও আপোষহীন রক্তক্ষরা সংগ্রামে আস্থাবান। তিনি বলেন : Political power grows out of the barrel of a gun–মার্কস লেনিনেরও ছিল এ মত।
নিগ্রো মনস্তত্ববিদ Frantz Fanon তাঁর The wretched of the Earth গ্রন্থে বলেছেন :
Violence is a cleansing force. It frees the native from his inferiority complex and from his despair and inaction, it makes him fearless and restores his self-repect.
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—
ক্ষমা যেথা হীন দুর্বলতা বলে অপব্যাখ্যাত হয়, সেখানে কঠোর হতে হবে। এই কঠোরতা নিশ্চয়ই হিংসাত্মক বা শাস্তি সমর্থক।
প্রতিকার পদ্ধতিটা কবিসুলভ হলেও এব্যাপারে তার আরো স্পষ্ট উক্তি রয়েছে :
অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।
গান্ধী অহিংস প্রতিরোধ ও অসহযোগকেই প্রতিকার পদ্ধতিরূপে বরণ করেছিলেন।
জওয়াহেরলাল নেহেরুর আস্থা ছিল Co-existence নীতিতে। এটি মূলত নৈতিকবোধের প্রীত আবেদন।
জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নীতি-পদ্ধতি হয়েছে সালিশির মাধ্যমে বিরোধের মীমাংসা। এটিও সদিচ্ছা ও শান্তিপ্রিয়তা সাপেক্ষ।
L. B. Johnson এক বক্তৃতায় বলেছেন, আজকের প্রতিকার পদ্ধতি হবে–To convert hostility into negotiation, bloody violence into politics and hate into reconciliation.
কেউ কেউ বলেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক অন্যায় এবং পীড়নের ক্ষেত্রে ক্ষমা ও নিরস্ত্র প্রতিরোধ কার্যকর। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধ এবং শাসন ও শান্তির জন্যে সশস্ত্র শক্তির প্রয়োজন। যে গান্ধী অহিংস অসহযোগ ভিত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়েছেন, তিনিই স্বাধীন ভারতে প্রতিরক্ষা ও অভ্যন্তরীণ শাসন-শান্তির জন্যে সহিংস-সশস্ত্র বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেছেন। জাতিপুঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কিংবা জনসনের উক্ত নীতিতে নতুন কিছু নেই। প্রতিকার ব্যবস্থায় বাহুবল ও জনবলহীন মানুষ চিরকালই আশ্রয় নিয়েছে আইন আদালতের। আর ধনবলহীন মানুষ প্রতিকার খোঁজে সালিশে। এ দুটোই শক্তিমান লোকের কাছে অবজ্ঞেয়।
আসলে ধর্মের দোহাই দিয়ে, আল্লাহর কাছে গোহারী করে কিংবা নালিশে-সালিশে-ক্ষমায় প্রতিকার চেয়ে নির্বলই প্রবোধ এবং সান্ত্বনা খোঁজে। সবল চিরকালই নিজ হাতে স্বশক্তি প্রয়োগে প্রতিকার করেছে বা প্রতিকারের চেষ্টা করেছে। অস্ত্রাভাবেই গান্ধী ছিলেন অহিংস প্রতিরোধ প্রতিকারের প্রবক্তা, অস্ত্রাধিকার লাভের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সশস্ত্র শক্তিতে আস্থাবান হয়ে ওঠেন। কাজেই বাহুবল-ধনবল-জনবল যার আছে, সে কখনো সালিশে-নালিশে, দোহাই-গোহারীতে কিংবা শাপে-বরে বিশ্বাস করবে না। বোঝা যাচ্ছে দুর্বল ও অক্ষমই কেবল মহৎ আদর্শের বুলি কপচিয়ে আত্মরক্ষা ও আত্মসম্মান রক্ষার উপায় খোঁজে। সবল ও পরাক্রান্ত ব্যক্তির কাছে ওসব হাস্যকর বালভাষণ।
তবু মনে হয়, মহৎ আদর্শে কোনো অপ্রতিরোধ্য শক্তি নিহিত রয়েছে। নইলে প্রবল পরাক্রমশালীও একে প্রকাশ্যে সোজাসুজি তাচ্ছিল্য করতে সংকোচ ও লজ্জাবোধ করে কেন? কেন তারা অপকর্মের জন্যে ছলচাতুরীর আবরণ খোঁজে? কেন তাদের অন্যায় অপকর্মকে যুক্তিগ্রাহ্য করে তুলতে চায়? কেন আজ অস্ত্রবল সঞ্চয়ে তৎপর হয়েও তারা অস্ত্রসংবরণ ও অস্ত্রবর্জনের কপট বুলি আওড়াতে বাধ্য হচ্ছে?
কাজেই আপাত অকেজো ও অশ্রদ্ধেয় সহিষ্ণুতা সালিশ, ক্ষমা ও নিরস্ত্র প্রতিরোধও যে মানুষের মানবিক বোধ-বুদ্ধির বিকাশের সহায়ক, নৈতিক চেতনা বৃদ্ধির অনুকূল, তা অস্বীকার করবার উপায় নেই।
আজ আর রাষ্ট্রপতি-রাষ্ট্রনায়কেরা আগেকার রাজা-বাদশার মতো প্রভু ও শাসক নন। এখন তারা একাধারে শাসক ও সেবক। সেজন্যে গণসমর্থন ব্যতীত তাঁদের স্থিতি অসম্ভব। নাগরিক মনে নৈতিক-চেতনা ও আদর্শানুগত্য থাকলে তা রাষ্ট্রপতির চিন্তা ও কর্মকে প্রভাবিত করেই। কেননা তাঁর হুকুম অমান্য করবার লোক তাঁর রাষ্ট্রেই থাকে এবং তারা নিরস্ত্র হয়েও সশস্ত্রবাহিনীর চেয়ে প্রবল। এই জনমত-রূপ আদর্শের প্রেরণা-পুষ্ট মনোবলের মতো বল আর নেই। ভিয়েতনামের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরোধী জনমতে সে ইশারাই পাওয়া গেছে। এমন দিনও হয়তো আর দূরে নয় যখন সৈন্যেরাও প্রাণের প্রেরণা ছাড়া কেবল হুকুমের চোটে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করবে। অথবা যুদ্ধের কারণই হবে অপগত। এ মনোবল আসে বিশ্বাস-মুক্তি ও মুক্তবুদ্ধি থেকে। আগের যুগে মানুষের জীবন ছিল বিশ্বাস-নির্ভর ও সংস্কার-ভিত্তিক; এখনকার অনেক মানুষের জীবনই বুদ্ধি ও যুক্তিনিষ্ঠ। তাই আত্মবিশ্বাস ও আত্মজ্ঞান এবং তজ্জাত সাহস বেশি। ভয় ও সন্দেহ-সংশয়ের স্থলে আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন ব্যক্তিই সাহস করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে আসে। অন্যেরা যখন ভয়ে ও সংশয়-সংকোচে জড়বৎ অচল, তখন সাহসীই প্রথমে কদম বাড়ায়। আর এই পয়লা কদমই পৌরুষ ও কাপুরুষতার পরিমাপক। নামৰ্দমী-মর্দমী কাদমে ফাসেলা দারাদ। –মদামী না মদামীর মধ্যে ওই এক-কদমেরই ব্যবধান। কিন্তু সেই ব্যবধান কত ব্যাপক গুরুতর ও তাৎপর্যময় আর কী যুগান্তকারী পরিণামপ্রসূ! মরদের এই বাড়তি কদমই লক্ষ হৃদয়ে শক্তি ও সাহস যোগায়। এই বাড়তি কদমই নেতৃত্ব-কর্তৃত্বের অধিকারী-মানবভাগ্যের নিয়ন্তা, দেশ-দুনিয়ার মানুষের শক্তির ও ভরসার আকর। এখনকার দিনে ভয়-সংশয় জয় করে পা বাড়ানোর লোক অনেক। তাই জনতা শক্তিমান, তাই জনতা ও জনমত প্রবলতম শক্তিরও বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী।
জার্মান দার্শনিক Riechl বলেছেন, মানুষই একমাত্র প্রাণী যে মেরুদণ্ডের উপর শির উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। মানুষ তা পারে, কারণ মানুষের জীবনে আদর্শ আছে, উদ্দেশ্য আছে, আছে মহৎ লক্ষ্যে উত্তরণের আগ্রহ। এ মহৎ লক্ষ্য হচ্ছে মানবতার মানবমনীষার ও মানবসংস্কৃতির পূর্ণবিকাশ। প্রতিকার-বাঞ্ছা যুক্তি ও প্রয়োজনবুদ্ধি সাপেক্ষ। বিশ্বাসের সঙ্গে যেহেতু নিয়তিবাদ যুক্ত সেহেতু বিশ্বাসের আনুগত্যের চেয়ে বড় কারাগার নেই। বিশ্বাসের কবল-মুক্তির চেয়ে বড় মুক্তিও তাই নেই। আগের যুগে অজ্ঞ অসহায় মানুষের জীবনযাত্রা ছিল বিশ্বাস-ভিত্তিক। তাই তারা বিশ্বাসীর চোখে গরুকেও দেখেছে দেবতারূপে আর বিশ্বাসের অভাবে হযরত নুহকে করেছে বিদ্রূপ। এবং হযরত ঈসাকে চড়িয়েছে শূলে, তাড়িয়েছে মুসা ও মুহম্মদকে। মনে যুক্তিবোধের উদয় হলেই কেবল মানুষ শ্রেয়সকে ও কল্যাণকে সহজেই বরণ করতে পারে, তা যতই নতুন ও অভাবিত হোক না কেন। মনে যুক্তি-বুদ্ধির ঐশ্বর্য থাকলেই তবে মানুষ পরিহার্য পুরাতনে আস্থা ও আকর্ষণ হারাবার যোগ্যতা অর্জন করে। এ-কথাটা বুঝতে চাননি বলেই হাকিম ইবনে সীনা বৃথা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন :
গাও-রা দারান্দা বাওর দর খোদায়ে আমিয়া
নুহরা বাওর না দারান্দ আজ পে পয়গম্বরী।
–গরুকে খোদা বলে মানতে তোমাদের বাধে না, নুহকে পয়গম্বর বলে মানতেই তোমাদের যত আপত্তি!
একালে মানুষ বিশ্বাস-সংস্কার ও যুক্তি-বুদ্ধির দ্বান্দ্বিক টানাপড়েনে উদ্বস্ত। তাই তারা কখনোবা বিশ্বাস চালিত, কখনোবা সন্দেহতাড়িত, আবার কখনোবা যুক্তিনিষ্ঠ। এ কারণেই কখনো তাঁরা আদিম ও স্থূল আবার কখনো শীলবান ও পেলবচিত্ত।
বস্তুত বাহুবল ও সশস্ত্র প্রতিকার-পদ্ধতি আজো real এবং বিবেক-বুদ্ধির কাছে নিরস্ত্র নিবেদন আজো ideal পাণঘাতী ও রক্তক্ষরা শাস্তিই শায়েস্তা করার মোক্ষম প্রতিকার-নীতি –এটি আজো real; আর প্রীতি, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা ও যুক্তিপ্রয়োগ প্রভৃতি এখনো ideal প্রতিকার-পদ্ধতি।
অতএব একটি real, অপরটি ideal. Real-এ আপাত কার্যসিদ্ধি হয়, কিন্তু পরিণাম নিষ্ফল। Ideal-এ আপাত ব্যর্থতা অবধারিত, কিন্তু পরিণাম ফলপ্রসূ। Ideal-এ পৌঁছতে সময় লাগে, real-এর ফল তাৎক্ষণিক। Ideal ভুললে আমাদের জীবন অর্থহীন হয়ে পড়বে, আর real-কে অস্বীকার বা অবহেলা করলে আমরা পথে দাঁড়াব। Ideal-হীনতা মনের নিঃস্বতা ও মানবিকবোধের নির্লক্ষ্যতার পরিচায়ক, আর real-এর প্রতি ঔদাসীন্য চলমান জীবনকে অগ্রাহ্য করার নামান্তর। Real-এর উপযোগ বর্তমানে, আর ideal ভবিষ্যতের পুঁজি। Real প্রাণে বাঁচায়, ideal মন গড়ে তোলে। প্রাণে না বাঁচলে মন অস্তিত্ব পায় না, আবার মনের পরিচর্যা না হলে প্রাণে বাঁচা অসার্থক।
তাই আমাদের আপাতকর্তব্য শোভন ও পরিশ্রুত পদ্ধতিতে real-কে বরণ করা যাতে তা ideal–এর পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায়। বস্তুত মানুষের মানবিক বোধের ও কর্মের তথা সংস্কৃতির ও সভ্যতার বিকাশ এভাবেই হচ্ছে। নতুবা যুদ্ধ ও যুদ্ধবাজ ঘৃণ্য হল কী করে? শান্তির সপক্ষে এত মানুষ উচ্চকণ্ঠ কেন? অথবা নিরস্ত্রীকরণের কথাই বা ওঠে কী করে? কাজেই মানুষ ideal-এর দিকে মন্থর গতিতে হলেও–এগুচ্ছে, এটিই আশা ও আশ্বাসের কথা। নইলে কত বর্বরতা ও বর্বরনীতি মানুষ পরিহার করল কী করে!