প্রজেক্ট জামাই
দাদি (কিংবা নানির) ঘরে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হচ্ছে। মিটিং না বলে এটাকে বিচার বলা উচিত। নালিশ করছে ছোটাচ্চু এবং তার নালিশ এই বাসার বাচ্চাদের বিরুদ্ধে। কে বিচারক ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, ছোটাচ্চু নালিশ করেছিল দাদি (কিংবা নানির) কাছে, কিন্তু মনে হচ্ছে দাদির বদলে ঝুমু খালাই এখন বিচার করার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে।
ছোটাচ্চু প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “মা, তুমিই বলো, সবকিছুর একটা মাত্রা থাকবে না? আমি মানলাম, বাচ্চারা থাকায় অফিসটা কাফী ব্যাটার কাছ থেকে উদ্ধার করেছে কিন্তু তাই বলে এখন আমাকে অফিসে ঢুকতে দিবে না?”
একজন বলল, “কে বলেছে ঢুকতে দিবো না?”
“দিচ্ছিস না তো—চাবিটা পর্যন্ত আমার কাছে নাই।”
ঝুমু খালা দাদির পায়ের কাছে বসে ছিল এখন গম্ভীর গলায় বলল, “ছোডু ভাইজান, আপনার অফিস এত বছর কাফী ব্যাটা দখল করে রাখছিল! আপনি অফিস ছাড়া ছিলেন, আরো কয়টা দিন থাকলে সমস্যা কী?”
ছোটাচ্চু প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, “সমস্যা কী মানে? আমি অফিস চালু করার কথা সব জায়গায় জানিয়ে রেখেছি। নতুন অফিস স্টাফ নেওয়ার জন্য ইন্টারভিউ নিব, লোকজন অফিসে আসতে শুরু করেছে। অফিসে এসে তারা কী দেখে? তারা দেখে ফ্যানের হুক থেকে দোলনা ঝুলছে, সেখানে সবাই দোল খাচ্ছে। চাকাওয়ালা চেয়ারকে গাড়ি বানিয়ে একজন সেই চেয়ারে বসে অন্যরা সেইটা ধাক্কা দিয়ে বেড়ায়। আমার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর বিছানা-বালিশ। অফিস ভরতি চিপসের প্যাকেট—আরো না-জানি কত কিছু আছে, যেগুলো আমি জানি না।”
মুনিয়া গম্ভীর গলায় মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, আছে। আরো অনেক কিছু আছে।”
বাচ্চারা সবাই তখন মুনিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল, যেন সে কিছু বলে না ফেলে।
মুনিয়া কিছু বলল না। ছোটাচ্চু বলল, “ক্লায়েন্টরা ফোন করছে, আমাকে জিজ্ঞেস করছে অফিসে আসবে কি না। আমি হ্যাঁ-না কিছু বলতে পারছি না! কবে আসতে বলব সেটাও জানি না। এরা একেবারে সন্ত্রাসীদের মতো আমার অফিস দখল করে বসে আছে।”
শান্ত গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “তিন মাস পরে আসতে বলো।”
ছোটাচ্চু একেবার দুই হাত ওপরে তুলে নাচের ভঙ্গিতে বলল, “তিন মাস? তিন মাস? ঢং পেয়েছিস? আমার সাথে তামাশা করিস?”
শান্ত বলল, “আমি তোমার অফিসটা মাঝে মাঝে ভাড়া দেওয়ার কথা চিন্তা করছিলাম।”
“ভাড়া! কার কাছে ভাড়া দিবি?” ছোটাচ্চু রীতিমতো আর্তনাদ করে উঠল, “কার কাছে ভাড়া দিবি?”
“দিনের বেলা তোমার অফিস—রাত্রে হোটেলের মতন।”
ছোটাচ্চু এত রেগে গেল যে তার গলা থেকে শব্দ বের হলো না। কেমন জানি মুখ হাঁ করে মাথা নাড়তে লাগল।
টুনি এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এবারে বলল, “ঠিক আছে ছোটাচ্চু, আমরা তোমার অফিস তোমাকে ফিরিয়ে দেবো। কিন্তু তার আগে আমাদের নিজেদের ভিতর কথা বলতে হবে।”
ঝুমু খালা মাথা নাড়ল, বলল, “সেইটা ঠিক আছে। বলো, নিজেদের ভিতরে কথা বলো। বেশি দিরং কইরো না।”
বাচ্চারা তখন লাইন ধরে বের হয়ে গেল।
প্রায় আধা ঘণ্টা পরে তারা ফিরে এলো। ছোটাচ্চু দেখল তাদের হাতে কয়েক পৃষ্ঠা কাগজ এবং সেখানে গুটি গুটি লেখা। ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “এইগুলা কী কাগজ?”
মুনিয়া বলল, “চুক্তিপত্র।”
ছোটাচ্চু গলা উঁচিয়ে বলল, “চুক্তিপত্র? কিসের চুক্তিপত্র?”
টুম্পা বলল, “তোমাকে অফিসের চাবি বুঝিয়ে দেওয়ার চুক্তিপত্র।”
ছোটাচ্চু হুংকার দিলো, “আমার অফিসের চাবি নেওয়ার জন্য আমার তোদের সাথে চুক্তিপত্র সাইন করতে হবে? ঢং পেয়েছিস? খুন করে ফেলব আমি।”
ঝুমু খালা অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “ছোডু ভাই, শুনে দেখেন না চুক্তিপত্র কী লেখা। পোলাপাইনের লেখা কী আর থাকবে?” তারপর গলা নামিয়ে বলল, “আর এই চুক্তিপত্র না মানলে কি হেরা মামলা করব?”
ছোটাচ্চু তখন একটু শান্ত হলো, বলল, “ঠিক আছে। পড় তোদের ছুটি পত্র।”
টুনি গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করল, “ইহা দি আলটিমেট ডিকেটটিভ এজেন্সির স্বত্বাধিকারীর সাথে নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের চুক্তিপত্র। দুই পক্ষ এই চুক্তি মানিতে বাধ্য থাকিবে।”
ছোটাচ্চু মুখ বাঁকা করে বলল, “সাধু ভাষায় লেখার বুদ্ধি কে দিলো?”
শান্ত গম্ভীর মুখে বলল, “চুক্তিপত্র সবসময় সাধু ভাষায় লিখতে হয়।” টুনি পড়তে থাকে, “এই চুক্তি মাফিক জানানো যাইতেছে যে—পরের লাইনটা পড়ে হঠাৎ করে সে থেমে গেল। তার মুখে একটু বিব্রত হাসি ফুটে ওঠে। সে একবার তার মাথা চুলকায় তারপর কাগজটা প্রমির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “প্রমি আপু, তুমি পড়ো।”
প্রমি কাগজটা হাতে নিয়ে একটুখানি পড়ে ইতস্তত করে টুম্পার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নে টুম্পা, তুই পড়–”
টুম্পা অবাক হয়ে বলল, “আমি?”
প্রমি বলল, “হ্যাঁ। তুই—”
বোঝাই যাচ্ছে চুক্তিপত্রে এমন কিছু ব্যাপার আছে যেটা কেউই পড়তে চাইছে না। তখন শান্ত বিরক্ত হয়ে কাগজটা টেনে নিয়ে বলল, “তোদের ঢং দেখে বাঁচি না। দে আমার কাছে দে। আমি পড়ি।”
শান্ত টুম্পার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে জোরে জোরে পড়তে লাগল, “এই চুক্তি অনুযায়ী ডিটেকটিভ শাহরিয়ার ওরফে ছোটাচ্চু তার উপার্জনের তিরিশ শতাংশ এই বাসার ছোট ছেলেমেয়েদের হাতে তুলিয়া দিবেন অথবা তাহাদের পিছনে ব্যয় করিবেন।”
ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “অ্যাঁ? অ্যাঁ? কী বললি? উপার্জনের তিরিশ শতাংশ তোদের দিতে হবে? তোরা নিজেদের কী মনে করিস? সন্ত্রাসী? চাঁদাবাজ নাকি পরিষ্কার ডাকাত?”
ঝুমু খালা বলল, “ছোডু ভাই, আপনি আগেই এত উত্তেজিত হইবেন না। আগে পুরাটা শুনি।”
ছোটাচ্চু থামল এবং শান্ত পড়তে শুরু করল, “দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসটি সপ্তাহে এক দিন নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য তাহাদের হাতে তুলিয়া দিতে হইবে।”
যদিও ঝুমু খালা ছোটাচ্চুকে বলেছে পুরোটা না শোনা পর্যন্ত শান্ত থাকতে কিন্তু ছোটাচ্চু মোটেও নিজেকে শান্ত করতে পারল না, প্ৰায় লাফিয়ে উঠে বলল, “অ্যাঁ? কী বললি? সপ্তাহে এক দিন তোদেরকে অফিসটা ছেড়ে দিতে হবে?”
শান্ত বলল, “হ্যাঁ। প্রথমে ভেবেছিলাম দুই দিন, শেষে এক দিন করলাম।” ছোটাচ্চু চিৎকার করে বলল, “কী করবি অফিসটা দিয়ে?”
শান্ত বলল, “নানা রকম অর্গানাইজেশন আছে, এনজিও আছে, তাদের ভাড়া দিবো।”
“আমার অফিস তোরা এনজিওদের ভাড়া দিবি? ঢং করার আর জায়গা পাস না?”
ঝুমু খালা আবার ছোটাচ্চুকে থামাল, বলল, “ছোডু ভাই। আপনি থামেন, আগে পোলাপাইনের কথা শুনি।”
ছোটাচ্চু থামল, শান্ত আবার গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করল, “যখনই নূতন কোনো কেস আসিবে তখন কেসটি গ্রহণ করিবার আগে নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের সহিত কেসটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আলোচনা করিতে হইবে।”
ছোটাচ্চু কিছু একটা বলতে চাইছিল ঝুমু খালা হাত তুলে আগেই শান্ত করে দিলো।
শান্ত আবার পড়তে শুরু করে, “কেস গ্রহণ করিবার পর সেই কেস নিয়া নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের কেহ যদি সমাধান বাহির করিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে তাহা হইলে তাহাকে সুযোগ দিতে হইবে এবং তাহার জন্য প্রয়োজনীয় সম্মানী এবং খরচ প্রদান করিতে হইবে।”
ছোটাচ্চু একই সাথে হতাশা আর ক্রোধের ভাব দেখিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলল কিন্তু ঝুমু খালার জন্য কিছু বলতে পারল না।
শান্ত আবার পড়তে থাকে, “সরফরাজ কাফীর কবল হইতে আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সি মুক্ত করা হইয়াছে এই মর্মে নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের উদ্দেশ্যে একটি লিখিত কৃতজ্ঞতা বার্তা প্রকাশ করিতে হইবে। এই বার্তায় ডিটেকটিভ শাহরিয়ার নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের নিকট আনুগত্য প্রকাশ করিবে।”
ছোটাচ্চুর কথা বলা নিষেধ তার পরেও তার গলা দিয়ে বিদঘুটে একটা শব্দ বের হলো। শান্ত সেটা না শোনারই ভান করে পড়ে যেতে থাকে, “নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের যে কেউ যখন ইচ্ছা আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিসে গিয়া সেই অফিসের যেকোনো সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিতে পারিবে।”
ছোটাচ্চুকে দেখে মনে হলো সে এবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাই শুধুমাত্র চোখ ওল্টানোর ভঙ্গি করে থেমে গেল। শান্ত এবারে চুক্তিপত্রের শেষ চুক্তিটি পড়ল, “এই চুক্তি স্বাক্ষর করিবার পর সেইটি ছয় মাস পর্যন্ত বহাল থাকিবে। তাহার পর আবার নূতন করিয়া চুক্তি করিতে হইবে।” শান্ত পড়া শেষ করে সবার দিকে তাকাল।
ছোটাচ্চু বলল, “তোরা পুরা ব্যাপারটাকে একটা তামাশা পেয়েছিস। চাবিটা দে আমি যাই। না দিলে কানে ধরে এমন একটা ঝাঁকুনি দিবো”
মুনিয়া তার রিনরিনে গলায় বলল, “এইটাও চুক্তিতে লেখা উচিত ছিল যে ছোটাচ্চু আমাদের বকতে পারবে না।”
অন্য অনেকেই মুনিয়ার কথা শুনে মাথা নাড়ল। ঝুমু খালা বলল, “ছোডু ভাই। চুক্তিতে সাইন কইরা দেন—পোলাপাইন শখ কইরা এত কিছু লিখছে। দুই দিন পরে এরা সব ভুইলা যাইব।”
ছোটাচ্চু হুংকার দিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিল তখন দাদি (কিংবা নানি) হাসি গোপন করে বললেন, “চুপ। সবাই চুপ। আমার কথা শোন।”
সবাই চুপ করল। দাদি বললেন, “বাচ্চারা যখন কাফী না খাফী কোন মানুষের হাত থেকে এই অফিস উদ্ধার করেছিস তখন তোদের সাথে ঝুমু ছিল না?”
বাচ্চারা একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, তারপর আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ ছিল।”
“তাহলে নিম্ন স্বাক্ষরকারীদের মাঝে ঝুমু আছে?”
বাচ্চারা আবার একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, কয়েকজন মাথা চুলকাল, তারপর বলল, “না, নাই।”
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “সেটা হবে না। এই চুক্তির মাঝে ঝুমুর কথা থাকতে হবে। চুক্তির একেবারে প্রথমে একটা লাইন ঢুকিয়ে দে, তাহলে হবে।”
বাচ্চারা জিজ্ঞেস করল, “কী লাইন ঢুকাব?”
দাদি বললেন, “চুক্তির প্রথম লাইন হবে, ঝুমুর সম্মতিসাপেক্ষে—’ শান্ত মুখ হাঁ করে বলল, “ঝুমু খালার সম্মতিসাপেক্ষে? তার মানে? তার মানে?”
দাদি বললেন, “তার মানে যেটা সেটাই। নে চুক্তির প্রথমে লিখে ফেল, তারপর চাবি দিয়ে দে শাহরিয়ারকে।”
“দিয়ে দেবো চাবি?”
দাদি বললেন, “হ্যাঁ। তোদের চুক্তিও থাকল, ঝুমুও থাকল; অফিসের চাবিও থাকল। ব্যস, কেস কমপ্লিট।”
“কেস কমপ্লিট?”
“হ্যাঁ।”
মুনিয়া বলল, “কেস কমপ্লিট হলে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দিতে হয়। দাদি তুমি হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি দাও। আমি সিনেমায় দেখেছি।”
দাদি (কিংবা নানি) বললেন, “এখন আমি হাতুড়ি পাব কোনখানে? কাছে আয়, হাতুড়ির বদলে তোর মাথায় একটা গাট্টা দিয়ে দিই।”
গাট্টা ঠিক কী জিনিস বাচ্চারা ভালো জানে না, তাই সবাই তাদের মাথা এগিয়ে দিয়ে দাদিকে ঘিরে ধরল। দাদি হাসি চেপে তাদের মাথায় একটা করে টোকা দিয়ে কেস কমপ্লিট করে দিলেন
দুই মিনিটের ভিতর ছোটাচ্চু তার চাবি পেয়ে গেল এবং পুরো ব্যাপারটার মাঝে যে আসলে ছেলেমানুষি অংশটা আছে সেটা ছোটাচ্চু প্রথমবার টের পেল।
* * *
ছোটাচ্চু শেষ পর্যন্ত চাবি দিয়ে অফিস খুলে ভিতরে ঢুকেছে। অফিস পরিষ্কার করে ঠিকঠাক করার জন্য দুইজন মানুষ নিয়ে এসেছে। তারা চেয়ার-টেবিল ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে অফিসটাকে ঠিক করছে। এমনভাবে অফিসটাকে পরিষ্কার করছে যে মনে হচ্ছে সরফরাজ কাফীর ছোঁয়া পুরোটা ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে হবে।
ছোটাচ্চু তার নিজের ঘরে টেবিলের ওপর সব কাগজপত্র নিয়ে বসে সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। এ রকম সময় দরজায় মানুষের ছায়া পড়ল। ছোটাচ্চু চোখ তুলে দেখল ফারিহা দাঁড়িয়ে আছে।
ফারিহাকে দেখেই ছোটাচ্চুর মুখটা হাসিতে ভরে যায়। বলল, “আরে! ফারিহা তুমি?”
“হ্যাঁ। আমি কি আসতে পারি না!”
“পারবে না কেন? অবশ্যই আসতে পারো। আমি বলতে চাচ্ছিলাম ঠিক যখন মনে হচ্ছিল তুমি থাকলে ভালো হতো তখন তুমি চলে এসেছো।”
ফারিহাপু মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল তারপর বলল, “কেন? আমাকে কেন দরকার? তোমার অফিস পরিষ্কার করার জন্য?”
ছোটাচ্চু বলল, “না, পরামর্শ করার জন্য।”
“কী পরামর্শ?”
“এই যে অফিসে সরফরাজ কাফীর কাগজপত্র, এইগুলি কী করব? ফেলে দিবো?”
ফারিহা মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। ফেলা ঠিক হবে না। রেখে দাও। মানুষটা যেহেতু বদ, তার কাগজপত্রে অনেক রকম দুই নম্বুরি জিনিসপত্র পাবে। পরে কাজে লাগতে পারে।”
ছোটাচ্চু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “কিন্তু কাফী ব্যাটার কোনো কিছু রাখতে চাচ্ছিলাম না—সবকিছু ফেলে দিয়ে মনে হচ্ছে ফিনাইল দিয়ে ধুয়ে ফেলি!”
ফারিহা হাসল, বলল, “কাগজপত্র মনে হয় ফিনাইল দিয়ে ধোয়া ঠিক হবে না! বড়জোর ন্যাপথালিন দিয়ে রাখতে পারো।”
ছোটাচ্চু অফিসের চারিদিক তাকিয়ে বলল, “তুমি যখন এসেই গেছো, আরেকটা কাজ করে দিয়ে যাও।”
“কী কাজ?”
“আমার অফিসটা একটু সাজিয়ে দিয়ে যাও। দেখে যেন মনে হয় মডার্ন।
“এসব কাজের জন্য প্রফেশনাল লোকজন আছে—”
ছোটাচ্চু দাঁত বের করে হেসে বলল, “তারা তোমার নখের যুগ্যি না!”
“তুমি কেমন করে জানো?”
“তুমি শুধু তোমার চুল দিয়েই যত রকম কেরদানি করতে পারো আর কেউ সেই রকম পারে? কোনোদিন লাল, কোনোদিন নীল, কোনোদিন বেগুনি, কোনোদিন লম্বা, কোনোদিন ছোট, কোনেদিন উঁচু, কোনোদিন নিচু—”
ফারিহা বলল, “হয়েছে হয়েছে আর টিটকারি করতে হবে না।”
ফারিহা চারিদিকে তাকিয়ে কাজ শুরু করল এবং বিকেলের ভিতর অফিসের চেহারা পাল্টে গেল। আজকের মতো যখন ছোটাচ্চু অফিস বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হলো তখন অফিসের সামনে একটা গাড়ি থামল এবং একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ নেমে ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকল।
বয়স্ক মানুষটি খুবই সন্দেহের চোখে এদিকে-সেদিকে তাকাতে ছোটাচ্চুর কাছে এসে থামল। ছোটাচ্চুর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দুইবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করল, “এইটা ডিটেকটিভ অফিস?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, “ডিটেকটিভ মানে যেটাকে টিকটিকি বলে সেইটা?”
ফারিহা কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, তার পক্ষে হাসি আটকানো কঠিন হয়ে গেল, নাক দিয়ে বিদঘুটে একটা শব্দ করে হাসি চেপে কোনোমতে বলল, “শাহরিয়ার আমি গেলাম।” তারপর ছোটাচ্চুকে কিছু বলতে না দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করতে করতে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে গেল।
ছোটাচ্চু মুখ কালো করে মানুষটার দিকে তাকল, বলল, “আপনি টিকটিকি বলতে কী বোঝাচ্ছেন আমি জানি না।” আসলে ছোটাচ্চু খুব ভালো করে জানে ডিটেকটিভদের সবাই ঠাট্টা করে টিকটিকি ডাকে। মুখ শক্ত করে বলল, “এটা একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি। আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”
মানুষটি এদিক-সেদিক তাকাল, তারপর জিজ্ঞেস করল, “এইখানে টিকটিকি কে?” তারপর থতমত খেয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে বলল, “মানে ডিকেটটিভ কে?”
এই মুহূর্তে দি আলটিমেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ছোটাচ্চু ছাড়া আর কেউ নেই, কিন্তু সেটা বললে ভালো দেখায় না, তাই ছোটাচ্চু বলল, “আমি হচ্ছি এজেন্সির সিইও। কেসের ওপর নির্ভর করে আমি টিম মেম্বরদের দায়িত্ব নেই। আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?”
মানুষটা খুবই সন্দেহের চোখে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল, তারপর অফিসের চারিদিকে দেখল। অফিসটা ফারিহা এত সুন্দর করে সাজিয়ে গেছে যে মানুষটটা সেটা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। তারপর মুখটা মোলায়েম করে বলল, “আমার নাম জামশেদ। আমি রিয়েল এস্টেটের বিজনেস করি।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল। মানুষটা বলল, “আমি আমার ব্যক্তিগত একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই।”
ছোটাচ্চু বলল, “আসেন, আমার অফিসে আসেন।”
ছোটাচ্চু বহু দিন পর তার সুইভেল চেয়ারে বসল। টেবিলের ওপর তুলে দেওয়ার জন্য পা দুটি নিশপিশ করছিল, কিন্তু একজন ক্লায়েন্টকে সামনে রেখে তার মুখের ওপর তো পা তুলে দেওয়া যায় না। তাই পা দুটো নিচে রেখেই টেবিলে কনুই রেখে সামনে ঝুকে পড়ে বলল, “বলেন, কী বলতে চাইছেন।”
মানুষটা ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার একটা মাত্র মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে। আমি বলেছি তোমার কেন চাকরি খুঁজতে হবে? আমার এত বড় বিজনেস, তুমি এই বিজনেসের দায়িত্ব নাও। আমার মেয়ে রাজি না।” মেয়ে রাজি না সেই দুঃখেই মনে হয় মানুষটা ওপরের দিকে তাকিয়ে বিশাল একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
ভদ্রতা করে কিছু একটা বলতে হয় তাই ছোটাচ্চু বলল, “জি আজকালকার মেয়েরা সবসময় নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়।”
“যাই হোক তখন আমি ভাবলাম মেয়েটাকে যদি রাজি করাতে না পারি তাহলে অন্তত ভালো একটা বিয়ে দেই। যদি ভালো একটা জামাই পাই তাহলে সেই জামাই হয়তো আমার পার্টনার হয়ে কাজ করতে রাজি হবে।”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, তাকে কী করতে হবে এখনও সেটা বুঝতে পারছে না, তাই ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগল, বলল, “জি জি। খুবই ভালো আইডিয়া।”
ছোটাচ্চুর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে মানুষটা ঝুঁকে পড়ে বলল, “ভালো জামাইয়ের জন্য আমি বেশ কয়েকটা এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করেছি, আমার নাম কিংবা আমার মেয়ের নাম বলি নাই। শুধু বলা হয়েছে বড় বিজনেসের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের পর শ্বশুরের বিজনেস দেখতে হবে। যারা আগ্রহী যেন সিভি জমা দেয়।”
ছোটাচ্চু এই প্রথমবার হালকাভাবে অনুমান করতে পারল রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী জামশেদ নামের মানুষটা কেন তার কাছে এসেছে। তার অনুমান সঠিক কি না বোঝার জন্য জিজ্ঞেস করল, “সিভি জমা দিয়েছে?”
জামশেদ নামের মানুষটা দাঁত বের করে হাসল। বলল, “দিবে না কেন? খুবই উৎসাহ নিয়ে দিয়েছে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কয়টা সিভি জমা পড়েছে?”
“ছয়শ বিয়াল্লিশটা।”
ছোটাচ্চু আঁতকে উঠল, “ছ-ছয়শ বিয়াল্লিশটা? আপনার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ছয়শ বিয়াল্লিশজন ক্যান্ডিডেট?”
“হ্যাঁ।”
ছোটাচ্চু ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, “এখন আমাকে কী করতে হবে? এই ক্যান্ডিডেটদের খোঁজখবর নিতে হবে?”
“না, আপনাকে ছয়শ বিয়াল্লিশ জনের সিভি দেখতে হবে না। আমি সেগুলো প্রফেশনালদের দিয়ে শর্ট লিস্ট করিয়েছি। এখন আমার হাতে আছে মাত্র দশজনের সিভি।”
ছোটাচ্চু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মানুষটা বলল, “আমি এখন এই দশজনের একেবারে হাঁড়ির খবর বের করতে চাই। লেখাপড়া, ফ্যামিলি, আদবকায়দা, বুদ্ধিমত্তা, চেহারাসুরত—এক কথায় সবকিছু। তারপর যে সবচেয়ে বেশি নম্বর পাবে তাকে আমি জামাই বানাব।”
ছোটাচ্চু বলল, “বুঝতে পারছি।”
“আমি সেই জন্য একজন টিকটিকি—মানে একজন ডিটেকটিভ খুঁজছিলাম। ভালোই হলো আপনাকে পেয়ে গেলাম।” মানুষটা দাঁত বের করে হাসল।
ছোটাচ্চু বলল, “আমাকে এই দশজন মানুষের প্রোফাইল বের করে দিতে হবে?”
“ঠিক বলেছেন। আপনি যাকে বেশি নম্বর দেবেন, সে হবে আমার জামাই!” কথা শেষ করে মানুষটি তার ব্যাগ খুলে একটা ফাইল বের করে টেবিলে রাখল। বলল, “এই যে এই ফাইলে আমার দশজন জামাই ক্যান্ডিডেটের সিভি আছে, আপনি আপনার কাছে রাখেন।”
ছোটাচ্চু ফাইলটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে সেটা খুলল, ভেতরে দশটা সিভি সাজানো। সিভির সাথে জামাই ক্যান্ডিডেটদের ছবি, নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, ই-মেইল সবকিছু আছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, দুই পৃষ্ঠার একটা হাতে লেখা রচনা, যার শিরোনাম, ‘কেন আমি এই মেয়েকে বিবাহ করিতে চাই’।
মানুষটি হাসি হাসি মুখে বসে ছোটাচ্চুর দিকে তাকিয়ে রইল। ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “আপনি কতদিনের মাঝে আমার রিপোর্ট চান?”
মানুষটা বলল, “দুই সপ্তাহ। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনার পারিশ্রমিক আমি পুরোপুরি বুঝিয়ে দেবো।” কথা শেষ করে আবার ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একটা পেট মোটা খাম বের করে টেবিলে রাখল। তারপর বলল, “এইখানে আপনার কাজ শুরু করার জন্য একটু ফান্ড দিয়ে গেলাম। কাজ শেষ করার পর বাকিটুকু দেবো।”
ছোটাচ্চু খামটার দিকে তাকাল, যথেষ্ট মোটা খাম। ভিতরের নোটগুলো একশ টাকার নাকি পাঁচশ টাকার, নাকি হাজার টাকার, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন।
মানুষটা চলে যাবার পর ছোটাচ্চু খাম খুলে দেখল নোটগুলো সবগুলো হাজার টাকার!
তার চোয়াল ঝুলে পড়ল।
***
ছোটাচ্চু এক হাতে একটা বড় চকলেট কেক, অন্য হাতে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীর দেওয়া ফাইল এবং মুখে একটা বড় হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকল। দাদি (কিংবা নানি) টেলিভিশন দেখছেন এবং দাদির পায়ের কাছে বসে ভুরু কুঁচকে ঝুমু খালা টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে হতাশভাবে মাথা নাড়ছে, বাচ্চারা সবাই লাফঝাঁপ দিয়ে চেঁচামেচি করছে। ছোটাচ্চুকে দেখে সবাই লাফঝাঁপ থামিয়ে কেকের বাক্সটার দিকে তাকাল, তারপর আরো জোরে চিৎকার করে লাফঝাঁপ দিতে লাগল।
ছোটাচ্চু কেকটা নিচে নামানো মাত্র সবাই কেকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাচ্চাদের একজন বলল, “থ্যাঙ্কু ছোটাচ্চু। পরের বার আরেকটু বড় কেক আনবে।”
ছোটাচ্চু বলল, “এইটাই সবচেয়ে বড় কেক।”
আরেকজন বলল, “তাহলে দুইটা আনবে।”
আরেকজন বলল, “কিংবা তিনটা।”
ছোটাচ্চু হতাশভাবে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “তোদের হয়েছেটা কী! লোকজন তোদের দেখলে মনে করবে কেউ তোদের কিছু খেতে দেয় না।”
সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল। টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, কেক কেন এনেছো? কোনো কারণ ঘটেছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “ছোট একটা ঘটনা ঘটেছে বলতে পারিস।”
সবাই চিৎকার করতে লাগল, “কী ঘটনা? কী ঘটনা?”
ছোটাচ্চু ফাইলটা কোলে নিয়ে একটা চেয়ারে বসল। বলল, “বহু দিন পরে আজকে প্রথমবার অফিসে গেলাম। প্রথম দিনেই একটা কেস পেয়ে গেলাম। অ্যাডভান্স পেমেন্ট পর্যন্ত করে গেছে।”
সবাই আনন্দে চিৎকার করল।
মুনিয়া জিজ্ঞেস করল, “মার্ডার কেস? মার্ডার?”
শান্ত জিজ্ঞেস করল, “কত টাকা অ্যাডভান্স দিয়েছে?”
ছোটাচ্চু শান্তর দিকে তাকিয়ে বলল, “সবসময় তুই টাকা টাকা করিস কেন?”
তারপর মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “না, এইটা মার্ডার কেস না।”
সবাই তখন জিজ্ঞেস করল, “তাহলে এইটা কী কেস?”
ছোটাচ্চু তখন সবাইকে তার কেসটা বোঝানোর চেষ্টা শুরু করল কিন্তু যখনই বাচ্চারা বুঝতে পারল এটা একজনের বিয়ের জন্য জামাই খোঁজার কেস তখন তাদের কৌতূহল পুরোপুরি উবে গেল। তাদের কারো এ রকম ম্যাদম্যাদা কেসে কোনো আগ্রহ নাই।
বাচ্চারা আবার যখন তাদের আগের চেঁচামেচি-হইচইয়ের মাঝে ফিরে গেল তখন টুনি ছোটাচ্চুর পাশে বসে তাকে জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তোমার এই ফাইলে কি সবগুলো জামাইয়ের ছবি আছে?”
ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। শুধু ছবি না, তাদের পুরো জীবন বৃত্তান্ত আছে। কী করে না করে সবকিছু।”
টুনি বলল, “আমাকে একটু দেখাবে?”
“তুই দেখে কী করবি?”
“এমনি দেখব।”
ছোটাচ্চু টুনিকে ফাইলটা দিলো, টুনি তখন ফাইলটা খুলে জামাই হতে চাওয়া মানুষগুলোর ছবি এবং বর্ণনা দেখতে লাগল।
টুনিকে ফাইল দেখতে দেখে একজন একজন করে অন্যরাও টুনির পাশে এসে ফাইল ঘাঁটতে থাকে এবং ছবিগুলো দেখে অকারণেই হি হি করে হাসতে থাকে। তাদের কথাগুলো হলো এ রকম :
“দেখ, দেখ, এই জামাইটার চেহারা দেখ! মনে হয় এর পেট ব্যথা করছে।”
“হায় খোদা! এই মানুষটাকে দেখ। গোঁফটা কত চিকন দেখেছিস? এত চিকন গোঁফ কেমন করে বানায়?”
“এই মানুষটাকে দেখ। নির্ঘাত সিরিয়াল কিলার। এর মাঝে নিশ্চয়ই এক ডজন মার্ডার করেছে।”
“হি হি হি! এই জামাইটাকে দেখ! মনে হচ্ছে অলরেডি বিয়ে করে ফেলেছে। সবগুলো দাঁত বের করে হাসছে। কী আনন্দ!”
“এই মানুষটা দেখ। নিশ্চয়ই টিবি। কাশতে কাশতে এক্ষুনি মরে যাবে।”
“এইটা সবচেয়ে মজার। এক চোখ বড় একটা ছোট! হি হি হি…”
ছোটাচ্চু বিরক্ত হয়ে বাচ্চাদের হাত থেকে ফাইলটা কেড়ে নিয়ে বলল, “সবকিছু নিয়ে ইয়ারকি করিস না। এখানে যাদের সিভি আছে সবাই ওয়েল এস্টাবলিস্ট। জীবনে সাকসেসফুল। যাকে-তাকে নিয়ে যা কিছু বলার অভ্যাসটা ছাড়—”
টুনি বলল, “ছোটাচ্চু, তোমার এদের সবার ওপর রিপোর্ট লিখতে হবে?”
“হ্যাঁ। খোঁজখবর নিতে হবে আর রিপোর্ট লিখতে হবে।”
“তুমি চাইলে আমরা তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”
ছোটাচ্চু চোখ কপালে তুলে বলল, “তোরা আমাকে কীভাবে সাহায্য করবি?”
“আমরা এই ফাইলের সবগুলো মানুষের সবকিছু পড়ে তোমাকে একটা রিপোর্ট দিই। তুমি দেখো সেই রিপোর্ট কেমন হয়।”
“তোরা রিপোর্ট দিবি?” ছোটাচ্চু খ্যাকখ্যাক শব্দ করে হাসার ভান করল। বলল, “তোরা আন্ডা বাচ্চা, আবার কী রিপোর্ট দিবি! যা ভাগ।”
টুনি হাল ছাড়ল না। বলল, “ছোটাচ্চু, এই দেখো, সিরিয়াল কিলারের মতো লোকটা নিজের সম্পর্কে কী লিখেছে।”
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী লিখেছে?”
“লিখেছে—” তারপর টুনি পড়ে শোনল, “আমি সাহিত্য অনুরাগী, কবিতা পড়তে ভালোবাসি। আমার প্রিয় কবিতার বই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা শেষের কবিতা—”
ছোটাচ্চু চোখ বড় বড় করে বলল, “তাই লিখেছে?”
টুনি বলল, “শেষের কবিতা মোটেও কবিতার বই না।”
ছোটাচ্চু বলল, “জানি। আমার মোস্ট ফেবারিট।” তারপর ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, “শেষের কবিতা আমার লাইন লাইন মুখস্থ।”
“তার মানে বুঝতে পেরেছো?”
“কী?”
“এই সিরিয়াল কিলার হচ্ছে মিথ্যুক। একশতে পাবে গোল্লা।” ছোটাচ্চু মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস। এই মানুষটা খালি মিথ্যুক না, গাধা প্রকৃতির।”
টুনি বলল, “তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“আমাদের ফাইলটা দাও, আমরা তাদের নিজের সম্পর্কে রচনাগুলো পড়ে তোমাকে রিপোর্ট দিবো। কে সত্যি কথা বলছে, কে মিথ্যা কথা বলছে, কে চালবাজ, কে অহংকারী—সব বের করে ফেলব।”
পাশে দাঁড়িয়ে শান্ত টুনি আর ছোটাচ্চুর কথা শুনছিল, এবারে বলল, “খুবই কম ফি’তে করে দেবো। তাই না টুনি?”
ছোটাচ্চু হংকার দিয়ে বলল, “কী? এখানে ফিয়ের কথা আসছে কেন?” টুনি বলল, “না ছোটাচ্চু, তোমাকে ফি দিতে হবে না। আমরা এমনিতেই করে দেব।”
শান্ত একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল।
***
টুংটাং শব্দ শুনে টুনি গিয়ে দরজা খুলল, দরজার বাইরে ফারিহাপু দাঁড়িয়ে আছে। টুনি আনন্দে চিৎকার করে বলল, “ফারিহাপু, তোমাকে দেখতে আজকে মারাত্মক লাগছে!”
“মারাত্মক?”
“হ্যাঁ ফারিহাপু। তোমাকে সবসময় মারাত্মক লাগে!”
“কপালের ওপর রুপালি চুলের ব্যান্ডটা ফাটাফাটি। আর চে গুয়েভারার কুর্তাটা অসাধারণ!”
ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, তোমার সাইজের চে গুয়েভারা কুর্তা পেলে নিয়ে আসব একটা।”
“এনে লাভ নাই ফারিহাপু। আমাকে বোকা বোকা লাগবে। তুমি যেটা পরো সেটাতেই ডেঞ্জারাস লাগে!”
ফারিহাপু হাসল, বলল, “শাহরিয়ার আছে?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “উঁহু। একটু আগে বের হয়ে গেছে।” ফারিহাপু জিভ দিয়ে শব্দ করে বলল, “ফোন করে আসা উচিত ছিল। ভাবলাম একটা সারপ্রাইজ দিই—”
“ভিতরে আসো ফারিহাপু। তুমি দরজায় দাঁড়িয়ে কেন কথা বলছো?”
ফারিহাপু বলল, “না, ভিতরে আসব না। দেখি তোমার ছোটাচ্চুকে কোথায় পাই।”
“ছোটাচ্চু ইন্টারভিউ নিতে গেছে।”
“কার ইন্টারভিউ?”
“যে কেসটা পেয়েছে সেইটার ইন্টারভিউ।”
ফারিহাপু হঠাৎ হি হি করে হাসতে লাগল। টুনি বলল, “হাসো কেন ফারিহাপু?”
“সেদিন একজন এসে তোমার ছোটাচ্চুকে টিকটিকি ডেকেছে! তার কী রাগ—পরে কিন্তু কেসটা ঠিকই নিয়েছে!”
টুনি মুখটা একটু গম্ভীর করে বলল, “ফারিহাপু, তুমি একটু ভেতরে আসবে? পাঁচ মিনিট?”
ফারিহাপু ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “কেন?”
“ছোটাচ্চুর এই কেসটা নিয়ে তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করব।” ফারিহাপু একটু অবাক হয়ে বলল, “তোমার ছোটাচ্চুর কেস নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করবে? কী জিজ্ঞেস করবে?”
ফারিহাপু সোফায় বসল, টুনি তার কাছে বসে বলল, “ছোটাচ্চু একটা কেস নিয়েছে তুমি তো জানো। একটা অনেক বড়লোক মানুষ তার মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য জামাই খুঁজছে। প্রথমে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সবাই অ্যাপ্লাই করেছে। ছোটাচ্চুকে দায়িত্ব দিয়েছে যারা জামাই হতে চায় তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে।”
ফারিহার মুখটা কেমন জানি শক্ত হয়ে গেল। বলল, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ ফারিহাপু। আমি তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে চাই।”
“কী জিনিস?”
“এই মেয়েটার নিজের কোনো মত নাই? তার বাবা বিজ্ঞাপন দিয়ে তার জামাই ঠিক করবে?”
ফারিহাপু একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, “তুমি ঠিকই বলেছো টুনি। আসলে মেয়েটার মত হচ্ছে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট।”
“তার মানে ছোটাচ্চুর এই মানুষগুলোর ইন্টারভিউ নিয়ে কোনো লাভ নাই। ছোটাচ্চুর উচিত এই মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করা সে এদের কাউকে বিয়ে করতে চায় কি না।’
ফারিহাপু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, তোমার ছোটাচ্চুর কাজ খুবই সোজা। এই মেয়েটার সাথে দেখা করবে তারপর জিজ্ঞেস করবে তার কাকে পছন্দ—যাকে পছন্দ করবে তোমার ছোটাচ্চু তার নামটা দিয়ে দেবে।”
“যদি কাউকে পছন্দ না হয়?”
ফারিহাপু বলল, “পছন্দ হওয়ার কথা না? কোন মেয়ে এইভাবে বিয়ে করতে চাইবে? মাথা খারাপ।”
ফারিহাপু ঘড়ি দেখল, এরপর দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাই। শাহরিয়ারকে খুঁজে বের করে তাকে একটা ধাতানি দিয়ে আসি—এই রকম উল্টাপাল্টা কেস যেন না নেয়। মেয়ে জাতির অপমান।”
ফারিহাপু বের হতে হতে বলল, “আমার কাছে যদি এই মেয়েটার ঠিকানা থাকত তাহলে তাকে ফোন করে সাবধান করে দিতাম!”
টুনি বলল, “ফারিহাপু, আমার কাছে এই মেয়ের নাম আর ফোন নম্বর আছে।”
ফারিহাপু অবাক হয়ে বলল, “তোমার কাছে আছে? তুমি কীভাবে পেয়েছো?”
টুনি একটু লাজুক মুখে বলল, “ছোটাচ্চুর ফাইলটা আমাকে দিয়েছিল, সেইখানে একটু ঘাঁটাঘাঁটি, একটু খোঁজখবর করে বের করে ফেলেছি!”
ফারিহাপু চোখ বড় বড় করে বলল, “ওহ! তাই তো! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি হচ্ছ বিখ্যাত ডিটেকটিভ টুনটুনি!”
টুনি বলল, “তোমাকে দিবো ফারিহাপু? তুমি তার সাথে কথা বলবে?”
“হ্যাঁ, দাও। এখনই কথা বলি।” ফারিহাপু তখন আবার ফিরে এসে সোফায় বসল। টুনি ভেতরে গিয়ে একটা কাগজে লেখা মেয়েটার নাম আর ফোন নম্বরটা নিয়ে এলো।
ফারিহাপু কাগজটা দেখে তার ফোনে ডায়াল করল, দুটো রিং হওয়ার পরই ফোনের অন্য পাশ থেকে একটা মেয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “হ্যালো।”
ফারিহাপু বলল, “আমার নাম ফারিহা। আপনি আমাকে চিনবেন না। আপনি কি সায়মা?
“জি। আমি সায়মা।”
“আপনার বাবা হচ্ছেন জামশেদ সাহেব?”
“জি, আমার বাবা জামশেদ চৌধুরী।”
ফারিহাপু কীভাবে কথাটা বলে দেখার জন্য টুনি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে।
ফারিহাপু খুব সহজভাবে বলল, “আপনি একজন মেয়ে, আমিও একজন মেয়ে। দুজন মনে হয় কাছাকাছি বয়সের। এই জন্য আপনাকে একটা বিষয় জানানোর জন্য ফোন করছি।”
অন্য পাশে সায়মার গলায় এবারে একটু ভয় ফুটে উঠল, জিজ্ঞেস করল, “কী বিষয়?”
“আপনি যদি বিষয়টা অলরেডি জানেন তাহলে আমার বলতে হবে না। যদি না জানেন তাহলে মনে হয় বিষয়টা জানা ভালো।”
“একটু বললে বুঝতে পারব।”
“আপনার বাবা আপনার জন্য পাত্র খুঁজছেন। সে জন্য দশজনকে শর্টলিস্ট করে তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।”
অন্য পাশ থেকে সায়মা চিৎকার করে উঠল, “হোয়াট?”
ফারিহাপু বলল, “জি। আপনি কি এটা জানেন?”
“না জানি না! কী আশ্চর্য! কী ভয়ংকর ব্যাপার—কী লজ্জা—কী অপমান—” হঠাৎ করে থেমে গিয়ে বলল, “আপনি কীভাবে জানেন?”
ফারিহাপু হঠাৎ করে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলো, নরম গলায় বলল, “আপু, তুমি সেটা না-ই জানলে! আমি তোমাকে চিনি না তুমিও আমাকে চিনো না। আমি যেহেতু খবরটা জানি তাই ভাবলাম তোমাকে জিজ্ঞেস করে দেখি তুমি জানো কি না— কারণ ব্যাপারটা তোমার জানা দরকার—”
সায়মা বলল, “আপু, আমি তোমার সাথে সামনাসামনি কথা বলতে পারি? প্লিজ! প্লি-ই-জ।”
ফারিহাপু বলল, “কখন?”
“এই এখন?”
“কোথায়?”
“কোনো একটা ক্যাফেতে—তোমার যেখানে সুবিধা।”
ফারিহাপু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে। এলিফ্যান্ট রোডে একটা ক্যাফে আছে, নাম ক্যাফে ক্যাফিওকা।”
“পারফেক্ট। আমি তার কাছাকাছি আছি।”
ফারিহাপু টেলিফোনটা রেখে টুনির দিকে তাকাল, তারপর বলল, “দেখলে, কেস এখন আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে!”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “যত জটিল তত ইন্টারেস্টিং।”
ফারিহাপু বলল, “তোমার ছোটাচ্চু শুনলে কী করবে?”
টুনি বলল, “মনে হয় চিৎকার করবে। দাঁত কিড়মিড় করবে।”
ফারিহাপু বলল, “হ্যাঁ, টেবিলে থাবা দিয়ে বলবে, তোমাদের জন্য আমি কিছু শান্তিমতো করতে পারি না। তোমরা সবসময় আমার কাজকর্মে নাক গলাও—” ফারিহাপু তারপর ঠিক ছোটাচ্চুর মতো অঙ্গভঙ্গি করে হাত-পা নাড়তে লাগল এবং সেটা দেখে টুনি হি হি করে হাসতে লাগল।
টুনি হাসি থামিয়ে বলল, “তুমি খুবই ফানি ফারিহাপু! খুবই ফানি!”
ফারিহাপু বলল, “ঠিক আছে, আমি তাহলে গেলাম, সায়মা মেয়েটার সাথে কথা বলে আসি।”
টুনি বলল, “কী কথা হয়েছে আমাকে একটু জানাবে ফারিহাপু?”
ফারিহাপু এক সেকেন্ড কিছু একটা চিন্তা করল, তারপর বলল, “তোমার কোনো কাজ আছে? না থাকলে তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও? আমি তোমাকে আবার পৌঁছে দেবো।”
টুনির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে যেতে চাই। যেতে যেতে আমি তোমাকে জামাইগুলোর কথা বলতে পারি। তুমি একটু দাঁড়াও আমি আম্মুকে বলে আসি।”
একটু পরেই টুনি একটা বই নিয়ে ফারিহাপুর সাথে বের হলো। যখন বড় মানুষদের কথাবার্তা সে শুনতে চায় তখন সে এ রকম বই নিয়ে বের হয়ে, বড় মানুষেরা যখন কথা বলে তখন সেগুলি শুনতে শুনতে সে গভীর মনোযোগ দিয়ে বইটা পড়ার ভান করে।
.
কিছুক্ষণের মাঝেই ফারিহাপু টুনিকে নিয়ে ক্যাফে ক্যাফিওকাতে হাজির হলো। গাড়ি পার্ক করে টুনি আর ফারিহাপু সিঁড়ি বেয়ে ভিতরে ঢুকল। ছোট ছোট টেবিলে ছেলেমেয়েরা চা, কফি, স্ন্যাকস খেতে খেতে গল্প করছে। টুনি কিংবা ফারিহাপু কেউই আগে সায়মা নামে মেয়েটাকে দেখেনি, তাই এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল, তখন একটা মেয়ে তাদের কাছে এসে ফারিহাকে জিজ্ঞেস করল, “আপু, তুমি কি ফারিহা? একটু আগে তুমি কি আমাকে ফোন করেছিলে?”
ফারিহাপু মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। তুমি নিশ্চয়ই সায়মা!” তারপর টুনিকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে টুনি। সাথে ছিল তাই নিয়ে আসতে হয়েছে।”
সয়মা বলল, “কোনো সমস্যা নেই। আসো আমরা বসি। কী খাবে? কফি, কোল্ড ড্রিঙ্কস?” তারপর টুনির দিকে তাকিয়ে বলল, “আইসক্রিম?”
টুনি মাথা নাড়ল, বলল, “খেতে পারি। চকলেট আইসক্রিম।”
কিছুক্ষণের মাঝেই তারা দুই কাপ কফি এবং একটা চকলেট আইসক্রিম নিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলে বসল। টুনি তার কান খাড়া করে আইসক্রিম খেতে খেতে গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ার একটা অনবদ্য অভিনয় শুরু করল।
সায়মা আর ফারিহাপুর কথা শুরু হল এভাবে। সায়মা বলল, “আপু, তুমি আমার সাথে কথা বলতে এসেছো সে জন্য তোমাকে অনেক থ্যাঙ্কু।”
ফারিহাপু বলল, “আমাকে থ্যাঙ্কু দিয়ে কী হবে! আমি যেহেতু ব্যাপারটা জানতে পেরেছি ভাবলাম তোমাকে জানাই। যেহেতু তুমি অ্যাডাল্ট এবং এটা তোমার জীবন—তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”
“আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”
ফারিহাপু বলল, “সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
“কী সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”
“আমি আমার ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক কেটে ফেলব। কোনো সম্পর্ক রাখব না।”
ফারিহাপু কফি খেতে খেতে একটু বিষম পেল, টুনি বিষম না খেলেও একটু চমকে উঠল। ফারিহাপু বলল, “সম্পর্ক রাখবে না?”
“না। আমি একটা চাকরি পেয়েছি। নিব কি নিব না চিন্তা করছিলাম, এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি চাকরিটা নিব। তারপর প্রথমে একটা হোস্টেলে উঠে যাব।”
ফারিহাপু বলল, “এইটা কি একটু বেশি কঠিন সিদ্ধান্ত হয়ে গেল না? তোমার আব্বু-আম্মুর সাথে বুঝিয়ে বললে—”
সায়মা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, বলল, “কোনো লাভ নাই। আমার বাবা টাকা ছাড়া আর কিছু বুঝে না। আমি চেষ্টা করেছি, লাভ হয় নাই। আমি বলে দিতে পারি আমার আব্বু আমার জন্য যে জামাইগুলি ঠিক করেছে সবাই টাকার কুমির! নানা রকম আইনি-বেআইনি ব্যবসা—ঠিক কি না?”
ফারিহাপু মাথা নাড়ল। টুনি গাড়িতে আসতে সেটাই বলেছে।
“খোঁজ নিয়ে দেখো, তাদের কেউ কালচারের ধারেকাছে নাই। কোনো বই পড়ে নাই, কোনো গান শুনে নাই, কোনো কবিতা আবৃত্তি করে নাই।”
ফারিহাপু আবার মাথা নাড়ল।
“একজন বড় লেখক না-হয় শিল্পীর নাম বলতে বললে বলতে পারবে না। নির্ঘাত যখন সময় পায় তখন বসে বসে হিন্দি সিনেমা দেখে না-হয় ফেসবুক করে।”
ফারিহাপু মাথা নাড়াবে কি না বুঝতে পারল না। সায়মা এত কিছু খেয়াল করল না, বলে যেতে লাগল, “আমার বাবা-মা যদি একই রকম একজন মানুষের সাথে বিয়ে দিতে চায় তাহলে আমি কেমন করে আমার ফ্যামিলির সাথে সম্পর্ক রাখব? আপু তুমিই বলো, আমার কি সম্পর্ক রাখা উচিত?”
ফারিহাপু তার মাথা চুলকাল। বলল, “কিন্তু আপু, সিদ্ধান্ত যেটাই নাও, একটু মাথা ঠান্ডা করে নাও। কয়েক দিন সময় দাও। তুমি বড় হয়েছো, লেখাপড়া করেছো, কেউ তো আর তোমাকে জোর করে বিয়ে দিতে পারবে না—”
সায়মা তবুও ঠান্ডা হলো না, চিৎকার দিতে লাগল, হুংকার দিতে লাগল।
***
রাত্রিবেলা দাদির ঘারে বাচ্চারা যখন হুটোপুটি করছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। একটা চেয়ারে বসে তার গাল চুলকাতে চুলকাতে ওপরের দিকে উদাসভাবে তাকিয়ে রইল।
টুনি ছোটাচ্চুর পাশে বসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ইন্টারভিউ কেমন হচ্ছে?”
ছোটাচ্চু বলল, “ইন্টারভিউ? অ্যাঁ? অ্যাঁ? ইন্টারভিউ?”
“হ্যাঁ।”
“বুঝতে পারছি না। খুবই জটিল। কেউ ঘুস দিতে চায়, কেউ ভয় দেখায়। কেউ আবার—” ছোটাচ্চু থেমে গেল।
টুনি জিজ্ঞেস করল, “কেউ আবার কী?”
“নাহ্, কিছু না।” ছোটাচ্চু একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “বুঝতে পারছি না কাজটা ঠিক হলো কি না।”
“কোন কাজটা?”
“এই যে কাজটা। একটা মেয়েকে চিনি না জানি না, তার জন্য আজব উজবুক একটা জামাই ধরে আনছি!”
টুনি কোনো কথা বলল না। ছোটাচ্চু আবার বিশাল একটা নিশ্বাস ফেলল। “রিয়েল এস্টেটের মানুষটাকে বলে কাজটা মনে হয় ছেড়ে দিতে হবে। দেখি দুই দিন।”
ছোটাচ্চু আবার লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলল। টুনি সেটা দেখে মুখ টিপে একটু হাসল।
* * *
ছোটাচ্চুকে দুই দিন দেখতে হলো না। তার আগেই মোটামুটি ভয়ংকর নাটকীয় একটা ঘটনা ঘটে গেল।
ছোটাচ্চু তার অফিসের জন্য লোকজন নেবে সেই জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে এবং সেই বিজ্ঞাপন দেখে অনেকে আবেদন করেছে। তাদের মাঝ থেকে বেছে বেছে বেশ কয়েকজনকে ডেকে পাঠিয়েছে। ছোটাচ্চু তাদের ইন্টারভিউ নিচ্ছে।
হঠাৎ দড়াম করে দরজা খুলে একজন মানুষ পাগলের মতো অফিসের ভিতর ঢুকল, তার পিছনে মোটাসোটা একজন মহিলা, দুইজনেরই আলুথালু অবস্থা। দুইজন হুড়মুড় করে ছোটাচ্চুর অফিসে ঢুকে গেল। ছোটাচ্চু দেখল একজন জামশেদ সাহেব, অন্যজন নিশ্চয়ই তার স্ত্রী। জামশেদ সাহেব টেবিল ধরে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে বলল, “ডিকেটটিভ সাহেব, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
পিছনে নাদুসনুদুস স্ত্রী কোনো কথা না বলে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে।
ছোটাচ্চু যে মেয়েটির ইন্টারভিউ নিচ্ছিল সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে এই নাটকীয় ঘটনাটি দেখতে লাগল। ছোটাচ্চু তাকে বলল, “তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা করো। আমি এই দুইজনের সাথে একটু কথা বলি।”
মেয়েটি বাইরে যাবার পর ছোটাচ্চু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনারা বসেন। একটু শান্ত হন। বলেন কী হয়েছে?”
জামশেদ সাহেব হাহাকার করে বলল, “মেয়ে, আমার মেয়ে–”
জামশেদ সাহেবের স্ত্রী হাহাকারের সাথে মিল রেখে ডুকরে কেঁদে উঠল ।
ছোটাচ্চু জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আপনার মেয়ের?”
“বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।”
জামশেদ সাহেবের স্ত্রী এই প্রথম কথা বলল, জামশেদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, “তোমার জন্য! তোমার জন্য আমার জানের টুকরা মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।”
ছোটাচ্চু বলল, “আপনারা একটু শান্ত হন। একটু শান্ত হয়ে কথা বলেন, তা না হলে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ।”
জামশেদ সাহেব একটু শান্ত হলো। তার স্ত্রী শান্ত হলো না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকল। ছোটাচ্চু তখন জিজ্ঞেস করল, “আপনার মেয়ে কেন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে?”
জামশেদ সাহেব তার পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে ছোটাচ্চুর দিকে এগিয়ে দিলো। বলল, “এইটা পড়েন, তাহলেই বুঝবেন।”
ছোটাচ্চু ভাঁজ খুলে চিঠিটা পড়ল। সেখানে লেখা—
প্রিয় আব্বু এবং আম্মু
তোমরা আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে কিছু আজব মানুষ জোগাড় করেছো। যাদের শিক্ষা নাই, কালচার নাই, রুচি নাই—এক কথায় টাকা ছাড়া আর কিছু নাই। তোমরা কি একবারও চিন্তা করে দেখো নাই যে, যে মানুষ বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ে করতে আসে তার বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান নাই? তোমরা কেমন করে ভাবলে এই রকম মানুষকে বিয়ে করতে আমি রাজি হব?
তাই আমি বাসা ছেড়ে চলে গেলাম। আমি নিজে নিজে থাকব, কেউ আমাকে জ্বালাতন করতে পারবে না। তোমরা আমাকে খোঁজার চেষ্টা কোরো না, কারণ খুঁজে পাবে না।
ইতি তোমাদের
সায়মা
ছোটাচ্চু চিঠিটা জামশেদ সাহেবের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “আপনার মেয়ের কথা কিন্তু খুব ভুল না। আপনি আমাকে যে লিস্ট দিয়েছেন, সেই লিস্টের কয়েকজনের সাথে আমি কথা বলেছি। মানুষগুলি সুবিধার না।”
জামশেদ সাহেব জাপটে ছোটাচ্চুর হাত ধরে ফেলল, ভাঙা গলায় বলল, “ডিটেকটিভ সাহেব, আপনি যেভাবে পারেন আমার মেয়েকে খুঁজে বের করেন। আপনার যত টাকা লাগে আমি দিবো।”
জামশেদ সাহেবের স্ত্রী তাল মিলিয়ে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল, “সায়মা আমার সায়মা গো…।”
ছোটাচ্চু এবারে একটু বিরক্ত হলো। বলল, “আপনারা যেভাবে কান্নাকাটি করছেন তাতে অফিসের কাজকর্ম করা সম্ভব না। একটু চুপ করেন, প্লিজ। তা ছাড়া আপনার মেয়ে মারা যায়নি, রেগে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে—এটা এমন কিছু ব্যাপার না!”
ছোটাচ্চুর কথা শুনে এইবারে জামশেদ সাহেব আর তার স্ত্রী একটু শান্ত হলো। ছোটাচ্চু তাদেরকে একটা আস্ত টিস্যুর বাক্স ধরিয়ে দিল। তারা সেখান থেকে মুঠি মুঠি টিস্যু বের করে চোখ এবং নাক মুছতে লাগল।
ছোটাচ্চু বলল, “ভালোই হয়েছে আপনারা এসেছেন। আমি নিজেই আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতাম। আপনাদেরকে আমি বলতাম আপনার সিভি দেখে জামাই বের করার প্রজেক্ট কাজ করবে না।”
জামশেদ সাহেব মাথা নাড়ল, বলল, “না, না করবে না। ভুল হয়েছে। অনেক বড় ভুল হয়েছে।
“আপনারা চাইলে আমি আপনাদের মেয়ে খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু আপনাদের কথা দিতে হবে আপনারা আপনাদের মেয়েকে স্বাধীনভাবে থাকতে দিবেন। উল্টাপাল্টা মানুষের সাথে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।”
জামশেদ সাহেব বললেন, “না, না, না চেষ্টা করব না। চেষ্টা করব না। মরে গেলেও চেষ্টা করব না।”
জামশেদ সাহেবের স্ত্রী সবকিছু ভুলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠল, “সায়মা আমার সায়মা গো…”
ছোটাচ্চু এই কান্নাকাটির মাঝে অনেক কষ্ট করে জামশেদ সাহেবের মেয়ের নাম, টেলিফোন নম্বর, এক কপি ছবি, ই-মেইল অ্যাড্রেস, তার পরিচিত এক-দুইজন বন্ধুর নাম-ঠিকানা এইসব নিয়ে নিল।
* * *
সেদিন রাত্রিবেলা দাদির ঘরে যখন বাচ্চারা হুটোপুটি করছে তখন ছোটাচ্চু এসে ঢুকল। আজকে তার চেহারায় একটা খুশি খুশি ভাব। বাচ্চারা কিছুক্ষণের জন্য হুটোপুটি থামিয়ে ছোটাচ্চুর দিকে তাকাল। একজন জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু! আজকে কিছু আনো নাই?”
“কী আনব?”
“চকলেট কেক। না-হয় আইসক্রিম, না-হয় পিতজা।
ছোটাচ্চু গরম হয়ে বলল, “প্রত্যেকদিন কিছু আনতে হবে? তোদের হয়েছেটা কী?”
টুনি জিজ্ঞেস করল, “ছোটাচ্চু, তোমার জামাই ইন্টারভিউ কেমন হচ্ছে?” ছোটাচ্চু হাসি হাসি মুখে বলল, “জামাই প্রজেক্ট বাদ। শেষ।”
“শেষ?” বাচ্চারা কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসে।
“হ্যাঁ।”
টুনি মুচকি হেসে বলল, “কেন ছোটাচ্চু?”
“রিয়েল এস্টেট টাইকুন আর তার ওয়াইফ আজকে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে অফিসে এসেছে। জামাই প্রজেক্টের কথা শুনে তাদের মেয়ে রেগেমেগে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।”
বাচ্চারা আনন্দে চিৎকার করে বলল, “সত্যি?”
“তবে রহস্যের ব্যাপার হচ্ছে, মেয়েটা খবর পেল কেমন করে? তার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছিল। সে জানল কেমন করে? খুবই অবাক ব্যাপার।”
টুনি মুখ টিপে হাসল, কেউ আলাদা করে সেটা লক্ষ করল না! একজন জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করবে ছোটাচ্চু?”
“এখন নূতন প্রজেক্ট। মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে। জামশেদ সাহেব আমাকে ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছে—যত টাকা লাগে দেবে।” ছোটাচ্চু খুবই গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, “তবে এটা কঠিন প্রজেক্ট। ঢাকা শহরের দুই কোটি মানুষের মাঝ থেকে একজনকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন।”
টুনি বলল, “তুমি চিন্তা কোরো না ছোটাচ্চু, আমি মেয়েটাকে বের করে দেবো।”
ছোটাচ্চু মাথা ঘুরিয়ে টুনির দিকে তাকাল, ভুরু কুঁচকে মেঘ স্বরে বলল, “তুই? তুই কীভাবে বের করবি?”
টুনি দাঁত বের করে হাসল, বলল, “আমি আর ফারিহাপু!”
ছোটাচ্চুর চোখ দুটো বড় হতে থাকে, হতেই থাকে!