প্রজাপতি – ৪
দু বছর, তারপরে আরো তিন বছর, পাঁচ বছরেও যখন ডিগ্রি কোর্সের গটি পার হতে পারিনি, তখন আমিই স্সাহ্, হাঁপিয়ে পড়েছিলাম। তখন আর কলেজের চার দেওয়ালের মধ্যে আমার আর তেমন জমছিল না। সেখানে দলাদলি মারামারি করতে করতে বাইরে একটা নাম ছড়িয়ে গিয়েছিল। তখন বাইরেও আমাকে ডাকাডাকি করতো। আর কলেজের যে দলটা আমার সঙ্গে থেকে মারামারি করতো, সেই দহ্মটার অনেকেই আমার সঙ্গে থাকতো, অনেকেই আজও আমাকে ছাড়েনি।
সেই যা বলছিলাম, কলেজে সেটাই আমার শেষ বছর। কত বছর আর হবে। চার-পাঁচ বছরের বেশী না। সেবার কলেজের গভনিং বডির বিরুদ্ধে আমরা সব দল কয়টা এক হয়েছিলাম। যেমন স্সাহ্, গভর্নিং বড়ি, গোটা তিনেক লোককে তো চিনতাম, শহরের সেরা ঘুঘু, চুরি ছিচকেমি, মেয়েমানুষের দোষ, কোন গুণে ঘাঁট নেই, বাইরে নিপাট ভদরলোক। ওদের বিরুদ্ধে আবার ভদ্রলোকের ছেলেরা আন্দোলন করবে, সে কথা ভাবলেও তো আমার গা ঘিন ঘিন করে! মন্ত্রী হয়, বড় বড় অফিসার হয়, তার না হয় একটা কথা আছে, তবু বোঝা যায়, হ্যাঁ একটা কিছু হচ্ছে। আর ওগুলো কী, বনগাঁয়ে শেয়াল রাজা, মফস্বল শহরের একটা কলেজ পেয়েছে, তাতেই যতখানি কেরদানি আর কিছু গাঁড়া মারা যায়। লেগেছিল তিন চারটে ব্যাপার নিয়ে। একজন প্রফেসরকে তাড়ানো নিয়ে, সে আবার মেজদাদের দলের স্যার, আর কলেজের সামনে খানিকটা জায়গা ছিল, সেটি কোন কর্তার দরকার হয়েছিল, তাই অন্যদিকে মেইন গেট করা হবে, তার মানে, একটা সরু গলির ভিতর দিয়ে আমাদের অনেকখানি ঘুরে গিয়ে ঢুকতে হবে, আর কতটি সেখানে একখানি বিল্ডিং হাঁকিয়ে কারবার করবেন, এমনি সব। আরও কী সব ছিল, আমার মনে নেই। আমাকে বলেছিল, হাঙার স্ট্রাইক করতে হবে। রাজী হয়ে গিয়েছিলাম।
তখন তো সব দল এককাট্টা। বড়দা মেজদা তো আমার ওপর খুব। খুশি। আমিও যে হাঙার স্ট্রাইক করব, এটা যেন ওদের একেবারে বিশ্বাসই হয়নি। মেজদা তো ভুরু কুঁচকে অবাক হয়ে বলেই উঠেছিল, ‘তুই হাঙার স্ট্রাইক করবি?
ভারী খচ্চর ও, সব সময় নিজেকে বড় ভাববার তালে আছে। বলেছিলাম, ‘দেখে নিস।
আবার বলেছিল, ‘একটা কেলেঙ্কারি করবি দেখছি।’
বলেছিল, কিন্তু গা জ্বালানো ভাবে বলেনি, যেন কতই দুশ্চিন্তা, আমার জন্যে যেন ওদের মহাযুদ্ধটাই পণ্ড হয়ে যাবে।
বড়দা বলেছিল, ‘পারবি তো?’
আমার বাবা এলেন! সব কথাতেই একটা ভারিক্কি ভাব, যেন কী একটা হয়ে পড়েছে। তবে এটা ঠিক, বড়দা তখন একটু একটু করে, ওদের দলের বেশ একটা চাই হয়ে উঠেছিল। ও যেন একটু গভীর জলে খেলে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু আমার রাগ হয়ে গিয়েছিল ওরা কথা শুনে। বলেছিলাম, ‘তুই পারবি?
ও এমন করে হেসেছিল, যেন আমি একটা কচি খোকা। অথচ ওর চোখের মধ্যে যে সব সময়ে একটা খারাপ মেয়েদের মতন চোরা হাসি লেগে থাকতো, বুঝতে পারতাম। যেন বেশ্যাটা সমাজের মধ্যে এসে পড়েছে, আর সকলের দেখাদেখি হরি হরি বলতে আরম্ভ করেছে। খারাপ কথা আমি জানি না! বলেছিল, ‘পারব মানে কী রে, কলেজে তো আমরাই ফাস্ট ব্যাচ, যারা হাঙার স্ট্রাইক করেছিল। আমিও তার মধ্যে ছিলাম।’
আমি বলেছিলাম, ‘তুই কি করেছিলি, না করেছিলি, সেসব আমি দেখতে যাইনি। আমি পারব কি না, সেটা গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসিস।’
কলেজ গেটের সামনেই অনশন ধর্মঘটের ক্যাম্প হয়েছিল। পোস্টার-টোস্টার তো প্রচুর মারা হয়েছিল। তিনটে গ্রুপ থেকে, সবসুদ্ধ ছ’ জন হাঙার স্ট্রাইক করেছিলাম। খেলাটা জমেছিল মন্দ না। এখন অবিশ্যি আমি ভাবতেই পারি না, ওরকম না খেয়ে চিত্তির দিয়ে পড়ে থাকব। তাও কিনা, শহরের সেই ঘাগী খচ্চরগুলোর জন্যে। স্লাদের ধরে কয়েক ঘা রদা মেরে দিলেই তো হত! তা না, উপোস করে শুকিয়ে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে। যেন আমরা না খেলে শহরের সেইসব ইয়েদের কিছু যায়-আসে। সে ব্যাপারে দেখেছি আমার ফাদারকে, না না, হটাও ওসব ঝুট-ঝামেলা, ওসবের মধ্যে নেই। থাকবার দরকারও ছিল না। ওতে থেকে এমন কিছু আমদানির সুযোগ ছিল না। যেটুকু থাকে, তাও কয়েকজনের মধ্যে থাকে। বাকীদের খালি মনের শান্তি। বাবার কাছেও প্রস্তাব এসেছিল কি না পরে, রিটায়ার করার পরে, গভর্নিং বডিতে যাবার জন্যে।
প্রথমটা মাইরি ঘাবড়ে খুবই গিয়েছিলাম। পারব তো! কিন্তু ভিতরে এমন একটা একসাইটমেন্ট ছিল, নেমে পড়েছিলাম। হয়তো মারামারি ফাটাফাটি না, তবু প্রায় সেইরকমই একটা উত্তেজনা। শুরু করবার আগে সভা হয়েছিল, আমাদের, আমরা যারা অনশন করেছিলাম, তাদের মালা চন্দন দিয়ে আবার সংবর্ধনা করা হয়েছিল। জীবনে ওই শেষবার, আর একবারই, আমার গলায় মালা পরানো হয়েছিল, মানে ওরকমভাবে মালা পরানোর কথা বলছি। তখন তো কোন ঝগড়াঝাটি নেই, আমার গলায় যে মেয়েটা মালা পরিয়েছিল, কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়েছিল, সে আবার বড়দাদের দলের মেয়ে। মেয়েটা তার আগে কোনদিন আমার মুখের দিকে তাকায়নি। তাকাতো ঠিকই, তবে সামনাসামনি কোনদিন না। আমি কিন্তু তখন মেয়েটার অন্য কিছুর দিকে তাকিয়ে দেখিনি, যেদিকে তাকনো-টাকানো যায় আর কি! তখন যেন কেমন অন্যরকম একটা ভাব এসে গিয়েছিল। আমাদের দলের একটা মেয়ে মেজদাদের দলের একটা ছেলেকে মালা পরিয়ে দিয়েছিল। সব—কী বলে—বাঙলা কথাটাও নসহ ভুলে যাই, সেই—হ্যাঁ ঐক্যবদ্ধ, তখন তো সবাই ঐক্যবদ্ধ, তাই সব উলট-পালটা কারবার হয়েছিল। সবাই হাতে হাত দিয়ে আমরা চীৎকার করে উঠেছিলাম, ইনকিলাব জিন্দাবাদ। গভর্নিং বডির স্বৈরাচার, মানব না মানব না। ছাত্ৰ-ঐক্য জিন্দাবাদ!’ তখন প্রায় আমিও বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম, সে ঐক্য আর ভাঙবে না। রক্তের মধ্যে, স্সাহ্, এমন একটা রণরণানো ভাব এসেছিল, মনে হয়েছিল, একটা অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে চলেছে ..অ-মাগো, তখন কি জানতাম, আমন কত ঐক্য হয়েছে, কত ভাঙছে। জানতাম না, তা ঠিক না, তবে আমার বেলায় মনে হয়েছিল, এই যে জোড়া লাগলো, এ আর কস্মিনকালেও ভাঙবে না। আমি আছি কিনা! তবে আর কি, তুমি যখন আছ, এ চিরদিন টিকে যাবে। বাবা এর নাম দলাদলি, জান না তো!
তা সে যাই হোক গে ছাই, আমি শিখার ছোঁয়া লাগার প্রথম দিনটার কথাই ভাবছি। শিখাকে যে ধর্মঘটের দিনই প্রথম দেখেছিলাম, তা না। আরো আগেই দেখেছি, তবে এ তো সেই শিখা, তখনো কোন দলে ছিল না, অথচ সকলের সুঙ্গেই ওর ভাব ছিল। চিনতাম ওকে অনেককাল আগে থেকেই। ওর দাদাদের সঙ্গে কয়েকবার ওদের বাড়িতেও গিয়েছি। যেমন অনেক বন্ধুর বাড়িতেই গিয়েছি বা যাই, কিন্তু তাদের বোনদের সম্পর্কে তখন আমার কোন মাথাব্যথা ছিল না। শিখাকে দেখে তখন কিছু মনে হয়নি। কলেজে যখন এসেছে, তখনো কিছু মনে হয়নি। ওর ওপর অনেকের নজর আছে, এটা জানা ছিল। সব দলের ছেলেরাই শিখা শিখা করতো। শুনে শুনে, আমিও যে দু-চার বার নজর করিনি তা না। কই বাবা, তেমন একটা মার-কাটারি কিছু তো মনে হয়নি। হাবলা গোবলা মেয়ে, আছে না একরকমের ভাল গোছের মেয়ে—দেখতে খারাপ না, অথচ যারা,প্রেম-ট্রেম করে না, হেসে ঢলে নাচিয়ে খুঁচিয়ে চলে না—যেন একেবারে রাস্তার সব প্রাণ জাগিয়ে চলে, সেরকম ভাবের। যেসব মেয়েকে দেখলেই মনে মনে খিস্তি করে উঠতে ইচ্ছা করে, আর যাদের নিয়ে ছেলেদের বেশী মাথাব্যথা, যাদের দেখলেই অন্য সব কথা মনে হয়, খারাপ খারাপ ইচ্ছা হয়, তাদের নিয়েই তো ছেলেদের রেষারেষি বেশী।
শিখাকে ঠিক সেরকম মনে হত না। তা বলে ও যে ভাল ছিল, তা বলছি না। হয়তো তখনো ও প্রেমও করতো, সবই করতো, রাতারাতি তো আর শহরে দুনাম রটেনি যে, শিখা অনেকের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে। এখন যেমন শোনা যায়, শহরে কান পাতা যায় না। তখন এত নামডাক হয়নি, বা কলেজের অমুক ছেলের সঙ্গে ওর আছে, তাও শোনা যায়নি। অথচ দেখলেই খারাপ কিছু ভাবতে ইচ্ছা করে, খারাপ কিছু করতে ইচ্ছা করে, খারাপ খারাপ কথা বলতে ইচ্ছা করে, তাও ছিল না। তার মানে এই না যে, ও দেখতে ভাল ছিল না। তা হলে আজকের এই শিখা, এই-ই শিখা হত না। তবু এক একটা মেয়ে কীরকম থাকে না, সেই যে কী বলে—একটা ইয়ে ভাব—আহ, আমরা বলি না এক এক সময়, পিওর! হ্যাঁ পিওর ভাব, লক্ষ্মী লক্ষ্মী, প্রতিমা প্রতিমা –ওই সেই আবার ‘ওর মধ্যে কী যেন একটা আছে ভূতুড়ে চিন্তাটাই ঘুরে ফিরে আমার মনে আসছে, হাজার ফ্যাকড়া বের করেও যা বোঝা বা বলা আমার দ্বারা হবে না। মোটের ওপর দেখতে ভাল, অথচ মেয়েলি মেয়েলি একরকমের গুমোর যেমন থাকে, সেরকম কিছু ছিল না। সকলের সঙ্গেই সহজে হেসে কথা বলতো, যেন সকলের সঙ্গেই তার বেশ ভাব। ওরকম মেয়ের দিকে আমার আবার তেমন ঝোঁক-টোক লাগতো না, অনেকের যেমন শিখা শিখা বাতিক ছিল। শিখা তো সেরকম ছিল না, শুটকা যেমন যেমন মাঝে মাঝে বলে, ‘রঙ্গিলা ছেমড়ি।’
অথচ শিখা আবার কোন দলেরও ছিল না। দলাদলি করার যে একটা মেজাজ থাকে, লড়ে যাওয়া ভাবের, সেটা একদম ওর ছিল না। সেটা যে কেমন করে হয়, জানি না। ওর সম্পর্কে ছেলেদের এত মাথাব্যথা অথচ ও কোন দলে নেই আর তাতেও ছেলেরা ওর ওপরে রেগে যেত না, সেটাই তো কেমন একটু যেন আশ্চর্য ও যে একলাই সেরকম ছিল তা না, অনেক মেয়েই ওরকম দলের বাইরে ছিল, কেবল ইলেকশনের সময় ভোট দিয়েই তারা খালাস। কিন্তু সেই অনেকের মধ্যে শিখাকে ঠিক ফেলা যেত না যেন। কারণ, অনেক মেয়েদের মত ও ঠিক ছিল না, ছেলেরাও ওকে ঠিক অনেক মেয়ের মতন দেখতো না। এতে কীরকম মনে হয়, ও যেন কলেজ—শিখা যেন কলেজটা। আমরা সবাই দলাদলি করছি, আগের ছেলেরাও করে এসেছে, পরেও ছেলেরা করবে, তবু কলেজটা কলেজই থেকে যাচ্ছে। আর না হলে বলতে হয়, ও যেন এই দেশটা, মানে বাঙলা দেশটা। দেশটা তো আর কোন দলে যেতে পারে না, দলাদলিও করতে পারে না, মারামারি কাটাকাটি করতে পারে না। দেশটা যেন নিজের মনেই থেকে যাচ্ছে আর বাকীরা নানান কিছু করছে। এরকম ভাবলে আবার আমার মনে হয়, দেশটা যেন জ্যান্ত মতন কিছু, সবই দেখতে পাচ্ছে। এক এক সময় মনে হয়-না, নীল আকাশটা, মেঘগুলো, গাছের পাতা-চিকচিকনো ঝাড়, সবই যেন কেমন জ্যান্ত জ্যাস্ত, কেউ যেন সেখানে রয়েছে, চেয়ে চেয়ে দেখছে সব | কাউকে বললে, আমাকে ঠিক ঠ্যাঙাবে, ‘স্লা ভূত দেখছ। কিন্তু সত্যি বলছি, মাইরি, অনেকদিন এমন হয়েছে, হয়তো কোন মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে আছি, সেই দূরে গাছপালাগুলো বাতাসে দুলছে, আর না হয় তো হঠাৎ দেখলাম, একটা মেঘ, কালো মতন মেঘ, দূর থেকে খচ করে খুঁচিয়ে উঠলো আকাশে, তারপরে সেই খোঁচাটা বাড়তে লাগলো, বড় হতে লাগলো, বড় বড় বড়, হঠাৎ মার খ্যাচ, চিক চিক করে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো, গুর গুর করে দূর থেকে যেন বাঘ ডেকে উঠলো, তারপরেই গাছের মাথাগুলো মুচড়ে দিয়ে ধুলো উড়িয়ে তাল পাকিয়ে গোঁ গেী করে ছুটে আসতে লাগলো, ঠিক মনে হয়, সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে জ্যান্ত একটা কিছু রয়েছে। আর না হয় তো ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল, আকাশটা তখনো ভাল করে নীল হয়নি, ঘাস পাতা ফুল সবকিছুর ওপরে শিশির পড়ে রয়েছে, বাড়িঘরের দেয়ালগুলোও কেমন যেন ঘুম ঘুম ভাব করে রয়েছে, যাহ, কেউ শুনলে কী বলবে—কিন্তু সত্যি এরকম মনে হয়, হয়তো এক-আধটা পাখী চিরিক-পিরিক করে হঠাৎ ডেকে উঠলো, তখনো কী রকম মনে হয়-না, সব কিছুতেই একটা বেঁচে থাকা জ্যান্ত ভাব। রাত্রের তো কথাই নেই। অন্ধকার রাত্রে খোলা জায়গায় দাঁড়ালেই মনে হয়, সব কিছু আরো ভীষণ জ্যান্ত। এরকম মনে হয়, মাটি গাছপালা ঘাস একেবারে চেয়ে আছে, অথচ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ফট করে কথা বলে উঠতে পারে, ‘কী রে টুকু, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস।’ উহ্রে স্সাহ্ ভ্যাট, ভাবতেই আমার গায়ের মধ্যে কীরকম করে উঠছে। না, ঠিক ভয়ে না, একটা কীরকম অদ্ভুত শিউরোনি লাগা ভাব, কিন্তু সত্যি’ আমার সেরকম মনে হয়। কাউকে বললে সে ভাববে, সুখেন মাল চড়িয়ে এসেছে। সে কথা আমি কাউকে বলতে যাচ্ছি না। মোটের ওপর, আমার মনে হয় দেশটা, যেটার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা নেত্য করছি, দলাদলি মারামারি বল, আর যাই বল, যত রপোট, সেটা যেন একটা জ্যান্ত কিছু। এমন কি, এক এক সময় আমার মনে হয়, আমি যেন কোন এক জায়গায় রয়েছি, আর দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, মাটি গাছপালা আকাশ, মানুষ—অনেক মানুষ, সব মিলিয়ে গোটা একটা জিনিস চলছে। সবাই সব কিছু করছে, কিন্তু যার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, সে যেন কিছুই করছে না—সেই রাস্তাঘাট মাঠ গাছ বন, কারণ, তারা মারামারি করতে পারছে না, দলাদলি না, কিন্তু জ্যান্ত, বাকীরা সবই করে যাচ্ছে, আর সে দেখে যাচ্ছে .এই দ্যাখ সুখেন, খচড়ামি করিস না। এ সব ভেবে, আমার নিজেরই এরকম বলে উঠতে ইচ্ছা করছে। মোটের ওপর, আমরা আর শিখা, যেন এরকমই। আমার এরকম বলতে ইচ্ছা করে। ও কোন দলেই নেই, অথচ সবাই ওর কাছে আছে।
যা-ই হোক—প্রথম শিখার ছোঁয়া যেদিন লাগলো, তারপরে তো সভা শেষ করে মালা-চন্দন পরা অবস্থাতেই, কলেজ গেটের সামনে, যেখানে ক্যাম্প করা হয়েছিল, সেখানে আমাদের বসতে দেওয়া হল। ক্যাম্প মানে, একটা সামিয়ানা মতন খাটিয়ে চারপাশে একটু ঢাকনা-টাকনা দিয়ে, ভিতরে দুটো তক্তপোষ পেতে দেওয়া হয়েছিল। কারা কারা যেন আবার বালিশ চাদর সব এনেও পেতে দিয়েছিল। যাতে আমরা শুয়ে-বসে থাকতে পারি। আমাদের গায়ে যাতে রোদ না লাগে, সেই জন্যেই কাপড়চোপড় দিয়ে, সেই ছেলেবেলায় থিয়েটার করার মত, একটা ঘেরাটোপ মতন করে নিতে হয়েছিল। তা ছাড়া রাত্রে মশা কামড়াবে, সেজন্য ধূপ-ধূনার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছিল। সেখানে আর মশারি টাঙিয়ে, ঘরের মত করে তো থাকবার দরকার ছিল না। আমাদের সব দলের বন্ধুরাই কেউ কেউ সারা রাত আমাদের কাছে থাকতো। সকলের বাড়ির লোকেরা আসতো, বাবা মা ভাই বোন, বাড়ির ছেলে না মেয়ে আছে, কী জানি বাবা, টেসে ফেসে গেলে, তারপর? তারপর আবার কী, গভর্নিং বডির জ্যান্ত চিন্তা | একমাত্র সেই সময়েই কলেজে আমার বাবা এসে উপস্থিত। প্রথমটা তো আমার খুব লজ্জাই করছিল বাবাকে দেখে, তা ছাড়া কে একজন যখন বলে উঠেছিল, ‘সুখেনের বাবা আসছে, তখন
৫৯ পেজ মিসিং
প্রথম দুদিন একটু বেশী কষ্ট হয়েছিল, বিশেষ করে যেদিন শুরু তার পরের দিন সকালে তো মনে হয়েছিল, উহ, এ্যাবসার্ড। দুপুরে মনে হয়েছিল, কাঁউ কাঁউ করে ভাত গিলে আসি, ঝামেলা হটাও। কিন্তু মনের কথা কাউকে বলতে পারছিলাম না। যদি স্সাহ্, মুখ ফসকে বলেই ফেলতাম, তা হলে নিশ্চয় দেয়ালীর রাত্রে কুকুরের ল্যাজে ফুলঝুরি বেঁধে, জ্বালিয়ে ছোটাবার মত অবস্থা করা হত আমার। ভাতের কথা, ডাল তরকারি মাছের কথা মনে হতেই মুখের মধ্যে এত জল কেটেছিল, আর পেটের মধ্যে কীরকম জ্বালা করছিল। তবে বন্ধুরা সবসময়ে গল্প করছিল, লেবুর জল চলছিল, সিগারেট চলছিল, তাই কোনরকমে ভুলে থাকা যাচ্ছিল। তবু আমি—অন্যদের মনের কথা ঠিক জানি না, দ্বিতীয় দিনে বিকেলের সময় মনে মনে সত্যি ভগবানকে ডাকতে আরম্ভ করেছিলাম। আমি এক পাশ ফিরে চুপ করে শুয়ে শুয়ে যেন নিজেকে সামলাচ্ছিলাম, আর ভীষণ ভয় করছিল, গেল বুঝি আমার কাপ ছটকে। একটা সময় এসেছিল, কারুর কথাবাত ভাল লাগছিল না, কেউ কাছে এলে ভাল লাগছিল না। মেয়েরাও কেউ কেউ ছিল, সারাদিনই কেউ না কেউ থাকতোই। রাত্রে কেউ থাকতো না, তখন শুধু ছেলেরাই থাকতো। দিনের বেলা মেয়েদের মধ্যে শিখাকেও কয়েকবার দেখেছি, ও আমাকে লেবুর জল-টলও দিয়েছে, বিশেষ কিছু মনে হয়নি। সবাইকেই যেমন দিচ্ছিল, আমাকেও তেমনি, অন্যান্য মেয়েদের মতই। কোন মেয়েকেও যেন কাছে ভাল লাগছিল না।
তার পরের দিন, তিনদিনের দিন সকালে যখন আমার ঘুম ভাঙলো, আমি দেখলাম, কাপড় ঢাকার ফাঁক দিয়ে একটা বড় নিম গাছ দেখা যাচ্ছে। তার আশ্লেপাশে আরো কয়েকটা কী গাছ। সেখানে রোদ পড়েছে, গাছের পাতাগুলো চিকচিক করছে, কিন্তু আমার যেন চোখের পাতাগুলো কেমন টনটন করছিল, চেয়ে থাকতে পারছিলাম না, আর চোখ দিয়ে যেন জল আসছে। এমন সময় কার একটা হাত আমার গায়ে এসে পড়লো, পাশ ফিরে দেখলাম, বিজয়, সেও অনশন করেছিল। ও আমার মুখের দিকে চেয়ে হাসলো একটু, আর আমাকে জড়িয়ে ধরলো, আমিও সেইরকম ওকে জড়িয়ে ধরলাম, আর দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন যে ওরকমভাবে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়েছিলাম জানি না, আর একটু একটু হাসছিলাম, অথচ কেউ কোন কথা বলছিলাম না। বাকী চারজন তখন ঘুমোচ্ছিল। তখন কিন্তু একটা আশ্চর্য, সেরকম খিদেটিদে লাগছিল না। অনশনের আগের দিন রাত্রে তো পারগেটিভ নিয়ে পেটটি একেবারে ফাঁকা করে নিয়েছিলাম। তিনদিনের দিন সকালে মনে হয়েছিল, পেট বলে ব্যাপারটা নেই, ওখানে কোন কিছুই হচ্ছে না। কেমন একটা নিঝুম ভাব, আমি যেন অন্য কোথায় কীভাবে রয়েছি, একেবারে একলা একটা ঘরের মধ্যে। অথচ সবাই রয়েছে, সবাইকেই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু একলা থাকাতে অনেক সময় যে সেই একটা ভূতুড়ে ভয়, বুকের মধ্যে গুরগুরিয়ে ওঠা ভাব, সেটা একেবারেই হচ্ছিল না। তবু যেন মনে হচ্ছিল, আমি একটা আলাদা কিছু—মানে, আলাদা কিছুর মধ্যে আছি, যেখানে কেউ পৌছুতে পারবে না, খিদে না, ভয় না, আমাকে কেউ ছুতেও পারবে না। ঠিক বোঝাতে পারি না ব্যাপারটা, এক এক সময় মনে হয়-না, কে কি বলছে না বলছে, আমি জানি না, শুনতে চাই না, সরে যাও, আমি একলাই পারি | একলার মধ্যেও যে একটা খুর-জের আছে, সেটাই যেন আমি বুঝতে পারছিলাম, অথচ তখন তো আমি বেশ দুর্বল, তবু যে ওরকম কেন মনে হচ্ছিল, জানি না।
অনেকক্ষণ পরে আমি বিজযকে বলেছিলাম, তোর গা-টা একটু গরম গরম লাগছে। বিজয় বলেছিল, ‘তোর গা-টাও।’ ভলান্টিয়ারদের মধ্যে একজন বলেছিল, ‘এখন ওরকম একটু হয়।’
একটু পরেই ডাক্তার এসেছিল, আমাদের শহরেরই এক ছোকরা ডাক্তার। ছোকরা হলেও বেড়াল যেমন মাছের গন্ধ চেনে; সেও তেমনি পয়সার গন্ধ চেনে, আর বাঘ যেমন রক্তের গন্ধ পায় আর চায়, মেয়েমানুষের ব্যাপারেও সে ঠিক তাই, তবে শহরের এসব ব্যাপারে লোকটা সব সময়েই হাজির থাকে, আর তাতেই লোকটাকে বেধড়ক খচ্চর জেনেও কেউ বিশেষ পেছনে লাগে না। এখন তো সে আমার বিনা পয়সার ডাক্তার। একটু-আধটু শরীর খারাপ হলে ওকেই দেখাই, ওষুধও দেয় বিনা পয়সাতেই। সেই একই ব্যাপার, গুণ্ডাটাকে হাতে রাখার জন্যে। সবাইকে হাতে রাখার জন্যে যা যা করা দরকার, সবই করতে হয়, ওটাও বোধহয় বিজনেস ট্যাকটিকস, কিন্তু এদিকে হাতে রাখতে গিয়ে কাদের ঘাড়ে যে কাঁঠাল ভাঙা হচ্ছে, তাও তারাই জানে, যারা কোমরের কষি থেকে ঘামের গন্ধ লাগা চটচটে টাকাগুলো তুলে দিচ্ছে। পাঁচের জায়গায় দশ, দশের জায়গায় কুড়ি নিচ্ছে, নেবেই, ওদিকে দাতব্য করতে গেলে, এদিকে টান না মারলে চলবে কী করে। ঘর থেকে তো আর বের করবে না, বরং ঘরের জমাতে কোন ফাঁকি রাখলে চলবে না, সেটা আগেই ঠিক রাখতে হবে।
বুঝতে পারি, এখন যে আমাকে, অসুখ-বিসুখ হলে দেখতে হয়, ওষুধ দিতে হয়, তাতে দাঁতে দাঁত পিষে, নিজেরই মাড়িতে ব্যথা হয়ে যায়, কিন্তু বল হরি, কী করি উপায়! গুণ্ডাটাকে না সামলে রাখলে, কোনদিন একটা কী কাণ্ড ঘটিয়ে ছাড়বে, বলা তো যায় না। তা সে যাক গে, আমাদের দেখতে এসেছিল ডাক্তার, দেশের আর দশের সেবা করা যাকে বলে। সকলেরই নাড়ি টিপে, বুকে নল বসিয়ে, ব্লাড প্রেসার দেখে, লেবুর জলের সঙ্গে কিছু গ্লুকোজের জলের ব্যবস্থা দিয়ে গিয়েছিল। আমাদের সকলের শরীরই নাকি বেশ ভাল ছিল, একজন ছাড়া। সে ছিল বড়দাদের দলের। সে যে কেন উপোস করতে রাজী হয়েছিল, কে জানে, কারণ তার তো পাখীর মতন শরীর, লগবগে রোগা, চশমা চোখে, তার ওপরে স্সাহ্ দাঁতগুলো উঁচু ফাঁক ফাঁক। মাথায় একগাদা চুল, সেই খ্যাংরা কাটির ডগায় আলুর মত মনে হত। দেখলেই মনে হত ওর পেটে সব সময়ে কুলকুল গোঁ গোঁ হুটর পাটোর শব্দ হচ্ছে, পেটের অসুখে ভুগছে। ব্যাটা, এমনিতেই না হয় তোর খাওয়াটা কম, হজম করতে পারিস না, তা বলে অনশনের রমজানি কেন। নাম করতে হবে, না? তাহলেও ডাক্তার তাকে ওষুধ দিয়েছিল। ওদিকে ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটু-আধটু কথাবাত চালাবার চেষ্টা করছিল গভনিং বড়ি। বাছাধনদের ব্যাপারটা খুব সুবিধার মনে হচ্ছিল না। শোনা যাচ্ছিল, এস ডি ও নাকি আসচে, কারণ গভর্নিং বডির উনিই তো আবার প্রেসিডেণ্ট—সেই কী বলে কথাটা –মানে খুটোর জোরে—ভাল কথায়, পদাধিকার বলে।
কিন্তু সে সবে কিছুই আমার যাচ্ছিল না। তোমরা যা খুশি তাই করতে পার, আমাকে ছুতে পার না, আর আমাকে ভয় দেখাতে পার না। ছেলে আর মেয়েরা সবাই আমাদের মাঝে মাঝে মুখে লেবুর জল-টল তুলে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে ওরা গান গেয়ে উঠছিল, ‘সংকোচের বিহুলতা নিজেরে অপমান | সংকটের কল্পনাতে হয়ে না ম্রিয়মাণ ‘…আগেও তো কতবারই ও গানটা শুনেছিলাম, পরেও অনেকবাব শুনেছি, শুনছি, শুনব আরো, শুনে শুনে কান পচেও যাবে, কারণ এই তো বোধহয় কয়েকদিন আগেই শুনলাম, একটা গলির মধ্যে কয়েকটা বাচ্চ ল্যাংটো হয়ে, রাস্তার ধারের নর্দমায় পেছন ঝুলিয়ে বসে, এক কাজে দু কাজ চালিয়ে যাচ্ছিল। ওদিকে এক কাজ, সেটা শরীরের ব্যাপার, এদিকে প্রাণ খুলে ছংকোচের বিবভলতা নিজেলো অপমান, চীৎকার করে যাচ্ছিল। তাই বলছি, এখন ওই শোনা পর্যন্তই, আর কিছু মনে হয় না। অথচ সেই সময়, সেই উপোসের দিনে, গানটা শুনতে শুনতে, আমার বুকের মধ্যে কীরকম করে উঠেছিল। ওরা তুড়ি দিয়ে হাততালি দিয়ে তালে তালে গেয়েছিল, আর আমিও যেন সেই তালে তালে মনে মনে বলেছিলাম, না না না, কখনো না, কোন কিছুতেই মানব না। শরীরে তো একরত্তি জোর ছিল না বলতে গেলে, অথচ ভিতরটা যেন ফুলে ফুলে উঠেছিল। তারপরে কৃষ্ণা, সেই বড়দাদের দলের মেয়েটা, যাকে ও বাড়িতে ঘরের মধ্যে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে হাবড়ে চুমো খাচ্ছিল, সেই কৃষ্ণা গেয়েছিল, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে নোয়াই মাথা। আবার গেয়েছিল, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে। আহ, মাইরি, আমার কেন জানি না, ফোঁড়া ফেটে গেলে যেমন পুজ রক্ত গলে যায়, আর শরীরের মধ্যে কী রকম একটা হতে থাকে, চোখের জলটা যেন সেভাবেই গলে গলে পড়ছিল। সে সময়ে ছুঁড়িটাকে আমার কীরকম যেন একটা ফুল ফুল মতন মনে হয়েছিল, ভোরবেলার টাটকা ফুল যেমন থাকে না, সেইরকম। সুন্দর তাজ আর মিঠে মিঠে গন্ধ। তখন অন্য সব কথা মনই আসেনি। আমি পাশ ফিরে চোখ বুজে শুয়েছিলাম, যাতে আমার চোখের জল পড়া কেউ দেখতে না পায়। ওর গলাটাও অদ্ভুত মিষ্টি ছিল—এখন যে মেয়েটা কোথায় বেপাত্তা হয়ে গেছে, বিয়েই হয়েছে না কি, খালি নিকা চালিয়ে যাচ্ছে, কে জানে। বড়দার সঙ্গে তো আর নেই, কতদূর এগিয়েছিল, কে জানে, এখন হয়তো অন্য কোন ঘরের দরজার পাশে, অন্য কারুকে খাওয়াচ্ছে, তবু গলাটা দারুণ লেগেছিল, ঠিক যেন তারের বাজনায় আওয়াজ দেবার মতন। নাহ, ছুঁড়ির গলাতে আওয়াজ ছিল।
এখন অবিশ্যি সমস্ত ব্যাপারটা আমার অনারকম লাগে, যেন থিয়েটারের একটা জমজমাট সিন। সিনেমার একটা বেশ লাগদার জায়গা, কাঁদানে কাঁদানে এক একটা জায়গা থাকে যেমন সিনেমা থিয়েটারে, বাজনা বাজছে, ওয়েীয়েী, ওয়েীয়েী, আর লোকটা বা মেয়েটা কেঁদে ভেসসা যাচ্ছে, সেইরকম। তবে আমার মনে হয়, আমার চোখের জলটা একজন দেখতে পেয়েছিল, শিখা দেখতে পেয়েছিল, কারণ সে সময়ে ও আমাকে জল বাড়িয়ে দিয়েছিল মুখের দিকে, আমি ঘাড় নেড়ে জানিযেছিলাম খাব না, আর শিখা, যেন কিছুই হয়নি, এইভাবে হঠাৎ আঙুল দিয়েই আমার নাকের পাশে, চোখের কোলটা মুছে দিয়েছিল। বড়দা মেজদা অনেকবারই যাতায়াত করেছিল, আর বোধ হয় সেই একবারই দেখেছিলাম, ওরা আমাকে খাতির করেছিল, কেননা, ওটা ওদের ঠোঁট-বাঁকানো আর ভারিক্কি চালের একটা জোর জবাব হয়েছিল। তবু মেজদা ওর সেই বাঁকা হাসিটা ছাড়েনি, বলেছিল, টুকু তা হলে কামাল করলি। না করলেই যেন ওর মনের মতন হত। এমন পাজী না, ওর চোখের চাউনি দেখেই বুঝতে পারতাম, ব্যাপারটা যেন একটা কিছুই না, খুবই সামান্য, সেইটা বোঝাবার চেষ্টা করত। আর বড়দার সেই গাঁয়ে মনে না আপনি মোড়ল, কীরে টুকু, কষ্ট হচ্ছে?—-যেন কী এল, তবু যদি তোকে না জানতাম—যাকগে, সব থেকে খারাপ লেগেছিল, আমার যখন ঘুম আসছিল, তিনদিনের দিন, দুপুরের দিকে, তখন প্রতিনিধি নিয়ে ওরা ক্যাম্পের মধ্যেই তর্কবিতর্ক আরম্ভ করেছিল। এমন খিস্তি করতে ইচ্ছা করে, সকলেই হঠাৎ যেন আসল ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিল। মেজদাদের দলের একটা ছেলে, সব সময়ে প্রায় ঘুষি পাকিয়ে কথা বলে—ওটাকে একবার আমি মাথা ফাটিয়েছিলাম, প্রায় চেচিয়ে উঠে বলেছিল, তা হলে আমরা আলাদা ক্যাম্প করব, আমরা ইউনাইটেড থাকব না ‘ অবিশ্যি, অন্য দলগুলোরও পেয়াজি ছিল, সকলেই বলে, “আমায় দ্যাখ। আমি তো ভেবেছিলাম, যাহ স্সাহ্, সব ভণ্ডল হয়ে গেল বোধহয়।
তারপরে জানি না, কীভাবে ওদের মিটমাট হয়েছিল, তবে হয়েছিল একটা কিছু। আমি জানতে পারিনি, কারণ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর ঘুম যখন ভেঙেছিল, চোখ তাকাবার আগেই আমি ঝিঝির ডাক খুব আস্তে শুনতে পেয়েছিলাম। যেন অনেক দূর থেকে শব্দটা আসছিল। আস্তে আস্তে চোখ তাকিয়েছিলাম, কেন না, হঠাৎ তাকাতে গেলেই যেন চোখের পাতা টনটুনিয়ে ব্যথা করে উঠবে মনে হচ্ছিল। অবিশ্যি সে রকম একটা কিছু না যে, একেবারে চোখের পাতা ভেঙে যাবে। চোখ তাকাতে বুঝতে পেরেছিলাম, আমি পাশ ফিরে শুয়ে আছি। কারা যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছিল, তার মধ্যে কয়েকটা কথাই ঘুরে ফিরে শুনতে পাচ্ছিলাম, “নিশ্চয়ই কেউ তার কেটে দিয়েছে। যে-ই কাটুক, তাকে ছাড়া হবে না …এখন বিরিজের দোকান থেকে একটা কানেকশন লাগিয়ে নিলেই হবে।’
তার মানে, কলেজের ইলেকট্রিক লাইন থেকে টেনে, ক্যাম্পে একটা আলো জ্বালানো হয়েছিল। সেই তারটাই কেউ কেটে দিয়েছিল—কে জানে, কার এত সাহস হয়েছিল। কাছেই বিরিজের মুদি দোকান ছিল, সেখান থেকেই আবার লাইন টানার কথা হচ্ছিল। তাই পাশ ফিরে শোয়া অবস্থায় আমি যখন চোখ মেলেছিলাম, অন্ধকার মতন দেখেছিলাম, অথচ একটা আলো কোথা থেকে এসে যেন আমার চোখের পাশে পড়ছিল। তেমন জোরালো আলো না, কিন্তু আলো, বুঝতে পারছিলাম, আলোর রেশটা যেন আমার গালের ওপরেও পড়েছিল। রাস্তার আলো নিশ্চয়ই না, কারণ মনে ছিল, রাস্তার দিকটা একটা পুরো শতরঞ্চি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামনে অন্ধকার, পাশে একটা আলো, আর ধূপ-ধূনার গন্ধ পাচ্ছিলাম, মশার জন্যে যেগুলো জ্বালানো হয়েছিল। পাশের আলোটা দেখবার জন্য, আমি আস্তে আস্তে চিত হয়েছিলাম, আর চিত হতেই, ইস্, ঠিক মনে হয়েছিল, আমার চোখের সামনে প্রায় গোল একটা লাল আলো ঝুলছে। প্রথমটা এমন হকচকিয়ে গিয়েছিলাম যে, জিনিসটা কী, তা হঠাৎ বুঝতেই পারিনি। তারপরে দেখি কি, ওটা চাঁদ—গোল তাঁবার থালায় আলো পড়লে যেরকম দেখায়, ঠিক সেইরকম দেখাচ্ছিল। প্রথমে চোখের সামনে মনে হলেও আসলে ওটা অনেক দূরেই ছিল, কাপড় ঢাকার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে আরো বুঝতে পেরেছিলাম, নিমগাছটার প্রায় মাথার কাছেই চাঁদটা রয়েছে, কারণ গাছটার মগডালের একটুখানি যেন চাঁদটার গায়ে লেগেছিল। আলোটা প্রায় সরাসরি আমার গায়ের আর মুখের ওপর পড়েছিল। তাতে আমার যেন মনে হচ্ছিল, আমি কোথায় একটা জায়গায় যেন রয়েছি। মনটা কেমন একরকম হয়ে যাচ্ছিল—এখন ভাবলে মনে হয়, পেটে ইদুরে ডন মারলে চাঁদকেও বোধ হয় ওরকমই লাগে, একটা কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত ভাব। ভূতুড়েই বলতে হয়, আর মনও ওইরকমই হয়ে যায়। এই যে আমি, এই আমি যেন মোটেই সেই আমি না, স্সাহ্, এর চেয়ে খোয়াব দেখা আর কাকে বলে। একমাত্র মালের ঝোঁকেই ওরকম মনে হতে পারে। যাই হোক, আমি যখন একরকম দেখছিলাম, তখনই শুনতে পেয়েছিলাম, জেগেছে? কোন মেয়ে বলেছিল, তাতে একটা কথা বোঝা গিয়েছিল, সন্ধ্যারাত্রই হবে তখন, কারণ মেয়েরা ক্যাম্পে রয়েছে। মেয়ে তো : বেশী রাত্র অবধি থাকলে, তারপরে নিজেদের মধ্যে মাখোমাখোটি করে কাজ সরো, সিটি হবার লয়। অনশন কর, আর যা-ই কর বাবার, ও সব ছোঁড়াছুঁড়ি একত্রে রাত্রে থাকবে, তা হবে না, মেয়েদের সবাইকেই বাড়ি চলে যেতে হত। কে যে বলেছিল জেগেছে, বুঝতে পারিনি, কিন্তু চাঁদকে আড়াল করে কে যেন দাঁড়িয়েছিল। কাচের গেলাস আর চামচের শব্দ আমার কানে এসেছিল। যে দাঁড়িয়েছিল, সে একটা মেয়ে, এটা আমি বুঝতে পারছিলাম, মাথা চুল গলা কাঁধ শরীরের ভাবটা, শাড়ির আঁচল, এ সব দেখে বুঝতে পারছিলাম, কোন মেয়ে। তারপরে সে চাঁদকে পাশ কাটিয়ে, আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখন তার মুখে তাঁবায় আলো পড়া লাল আভা লেগেছিল, চিনতে পেরেছিলাম, ওটা শিখা ৷ কিন্তু শিখা হলেও যেন শিখা না, একটা অন্য কেউ, একটা অন্য ভাব, মাইরি—ওর চোখগুলো কীরকম, অন্যরকম লাগছিল, যেন কত বড়, কুমোরদের আঁকা মূর্তির চোখের মত সেই যেন কান পর্যন্ত টানা, আর সাদা বলে কিছু নেই, চোখের সবটাই কালো, অথচ একটা চিকচিকে ভাব, আর গালটা লাল লাল, নাক ঠোঁট লাল লাল, কাপড়টা লাল লাল—যে কাপড়টা খানিকটা আমার গায়ের কাছেই লুটিয়ে পড়েছিল, কারণ শিখা নিচু হয়েছিল, আমার ওপর ঝুঁকে পড়েছিল, আমি ওর গায়ের একটা হালকা গন্ধ পেয়েছিলাম—কিসের গন্ধ তা বলতে পারব না, হয়তো গায়ের না, চুলের, বা কী জানি, আর কিছু মেখেছিল কিনা, আর ওর নিশ্বাসের হাওয়াও আমার মুখে লেগেছিল, বলেছিল, ‘সুখেনদা, একটু গ্রকোজের জল খান।
জলের কথা শুনেই, আমার কিন্তু একটা অন্যরকম ফিলিঙস হয়েছিল, আশ্চর্য, গলাটা তো বেশ কাঠ-কাঠই লাগছিল, তবু মনে হয়েছিল, আমার তলপেটটা ভার আর জলে ভরতি হয়ে আছে যেন, তাই আমি প্রথমটা শব্দ করেছিলাম, ‘অ্যাঁ?’
শিখা আবার বলেছিল, ‘একটু গ্লুকোজের জল খান।
আমি বলেছিলাম, না, আমি একটু পেচ্ছাব করতে যাব।’
ধূর স্সাহ্, আমি একটা কী মাইরি, এখন তো ভাবলেই অবাক লাগে, আমি কিনা একটা মেয়েকে বলেছিলাম সেই কথা। আরে, ‘বাথরুমে যাব’ বা ‘বাইরে যাব’ বল, তা না, একেবারে খোকনের মতন—কেন, ‘হিসি’ বললেই পারতে, বুদ্ধ! কিন্তু কথাটা যে তখন কারুর কানে খারাপ লেগেছিল এমন মনে হয়নি, আমারও মোটেই কিছু মনে হয়নি, যেন খুব সাধারণ কথাই বলেছি। কথাটা বলেই আমি উঠতে যাচ্ছিলাম, শিখা তাড়াতাড়ি বলে উঠেছিল, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি ধরি, তা নইলে পড়ে যেতে পারেন। ছেলেরা কেউ নেই তো, সব আলোর জন্যে গেছে, লাইন কেটে দিয়েছে কিনা।’
সেটা তো আমি অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। কিন্তু শিখার ধরবার কোন দরকার ছিল না, উঠে দাঁড়াবার বা চলবার শক্তি আমার ছিল, তাই ওর কথা না শুনে উঠতে উঠতেই বলেছিলাম, ‘আমি পারব।’ কিন্তু শিখা শোনেনি, কোনরকমে হাতের গেলাসটা একদিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘কৃষ্ণাদি, ধরুন তো গেলাসটা।’
তখন জানতে পেরেছিলাম, কৃষ্ণাও ছিল। সে হাত বাড়িয়ে গেলাসটা নিতেই শিখা আমার হাত ধরেছিল। ওর সেই হাতটাও লাল লাল দেখাচ্ছিল, ওর হাতটা ঠাণ্ডা ছিল, ঠিক যেমন মনে হচ্ছিল লাল আলোটাও যেন ঠাণ্ডা সেইরকম আর শিখাকেও যে কারণে শিখা বলে মনে হচ্ছিল না, সেই আমার অদ্ভুত মনের ভাবের মতই। ও যখন হাতটা ধরেছিল, আমার ডানাটা, তখন যেন সেই ভূতুড়ে ভূতুড়ে ভাবটাই আরো বেশী হয়েছিল, অথচ আমি যেরকম বলা উচিত, সেইভাবেই বলেছিলাম, ‘আমি পারব যেতে। শিখা সে কথার কোন জবাবই দেয়নি, খালি বলেছিল, “ঠিক আছে। ঠিক আছে। তার মানে কী, ওর নিজের কথা বলতে চেয়েছিল যে, “আমার জন্যে ভাববেন না, ঠিক আছে? আমার সেরকমই মনে হয়েছিল, তবে আমার তখন ওসব নিয়ে বেশী কথা বলতে ইচ্ছে করছিল ন। আমি উঠে দাঁড়াতে শিখা আমাকে এমনভাবে ধরেছিল, ওর গাটা আমার গায়ের সঙ্গে লাগছিল, ওর বুকটা আমার ডানার সঙ্গে লাগছিল, আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম, আর আমার কীরকম একটা অদ্ভুত লাগছিল, আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। তখন ওর মুখে ছায়া পড়েছিল, মুখটা দেখতে পাইনি, কিন্তু আমার তো এখনো ভাবলে অবাক লাগে, উল্লুক তোর পেটে তিন রোজ ভাত নেই, শিখার গায়ের সঙ্গে ছোঁয়াছুয়িতে তোর ওরকম লাগছিল কেন। সেটা যে ঠিক কোন মেয়ের সঙ্গে লবজবানি করার মত একটা ব্যাপার, তা না, একটা অন্যরকম ভাবের, সেই অনেকটা গান শুনে যেমন হয়েছিল না, সেইরকম যেন চোখে জল এসে পড়বে, অথচ আমার উপোসী শরীরে রক্ত যেন কেমন করে উঠেছিল—মানে গরম আর কী। হ্যাঁ, একসাইটমেন্টই যাকে বলে—কী বলব, মার তোর মুখে লাথি, কিন্তু কী যে হয়েছিল না সত্যি, আমি অনশন করছি, প্রতিবাদ করছি,
অদ্ভুত মনে হচ্ছিল, যেন কেঁদে ফেলি, আর শিখার সেই নরম বুকের মধ্যে মুখটা ডুবিয়ে দিই, ডুবি—য়ে দিই। একে শয়তান বলে না তো কী, কিন্তু কী করব, আমার যা সত্যি মনে হয়েছিল, তাই ভাবছি। তা বলে শিখাকে সেসব জানতে দিইনি, সে জ্ঞানটা টনটনে ছিল। ও আমার ডানা ধরে ক্যাম্পের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের বাইরে কয়েক পা গেলেই তো একটা নর্দমা ছিল, সেটাই তখন আমাদের ইউরিনাল হয়েছিল। বাইরে যেতে, সেই তাঁবাটে আলোটা আরো বেশী করে গায়ে পড়েছিল, আমার আর শিখার দুজনেরই। আমারটা আর কে দেখছিল, ওরটাই আমি একটু একটু দেখছিলাম, কিন্তু যে কাজের জন্য বাইরে যাওয়া, আশ্চর্য, তার কোন চাপই আর ছিল না। একটু আগেই যে আমার মনে হয়েছিল, গলা শুকিয়ে গেলেও জল খাবার আগে, আমাকে নর্দমার ধারে যেতে হবে সেটা বেমালুম গায়েব হয়ে গিয়েছিল, বরং সেই উত্তেজনায় সব ব্যাপারটা একেবারে উলটে গিয়েছিল। তবু আমি নর্দমার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন শিখা আমার হাত দুয়েক পিছনে দাঁড়িয়েছিল। অতটা তো আর পারে না যে, তখনো আমাকে ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে। জানি না, অবিশ্যি এখন হলে কী হবে, যদি আমি উঠে দাড়াতে না পারি, আর আমাকে সেই কর্মটি করতে হয়, শিখা হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে কিনা।
এ আবার একটু খচড়ামি হয়ে গেল, তাই হাসিও পায় ভাবতে এখন আর বাবা অত চাপাচাপি করার কী আছে। একবার তো ফিতে কাটা নিয়ে কথা, কুচ—তারপরে সসুভ উদ্বোধন হয়ে গেল, মন্ত্রী মশাই চলে গেলেন, এবার ভি আই পি-এরা, আর জনগণ চলে আসুন। যত সংকোচের বিহুলতা তো সেই পর্যন্তই। কিন্তু নর্দমার কাছে গিয়ে আমার দাঁড়ানোই সার হয়েছিল, একেবারে একটু কিছু না। জানি না, কী করে শরীরের এসব ব্যাপারে এমন ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। কী রে বাবা, সেই যে বলে না, যৌবন কুরকুরোয় না পেট কুরকুরোয়? ধুকতে ধুকতেও ও আবার কী ৷ জানি, আমাকে ফিরতে হয়েছিল, ওকে ধরেই ফিরেছিলাম, আর তখন, সব মিলিয়ে মনটার মধ্যে কেমন একটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। গোলমাল মানে, মনের ভিতরটা যেন কেমন একরকম তলতলিয়ে উঠেছিল—হয় না একরকম, যেন মনটা তলতল করছে, দুলছে, ঠিক যেমন জলে হাওয়া লাগলে দোলে, সেইরকম এদিকে ওদিকে ধাক্কা লেগে লেগে যেন বেড়ে যেতে চায়, উপচে উপচে পড়তে চায়—সেটা কীরকম ভাব জানি না, সেরকমই আমার মনে হয়েছিল, অথচ তার সঙ্গে একটা কষ্ট, যেন ভিতর থেকে কিছু একটা ঠেলে ঠেলে উঠতে চাইছে, অথচ আবার শরীরের মধ্যে এমন একটা ভাব, একটা সুখের মত, মনে হচ্ছিল, উনুনের কয়লাগুলো সব জ্বলে উঠলে যেমন একটুও ধোঁয়া থাকে না, একটাও শিস থাকে না, একেবারে লাল গনগনে আগুন, আমার শরীরের ভিতরটা যেন সেইরকম হয়েছিল। তার একটু আগেই তো সব যেন কেমন আসার আসার লাগছিল, আর তখন মনে হচ্ছিল, শরীরের সবখানে এত বেশী সার, একটু সামান্য ছুঁয়ে গেলেও ঠিক টের পাব।
এই সব ব্যাপারকে ভালবাসা বলে কিনা জানি না, তবে সব মিলিয়ে আমার কেমন যেন মনে হয়েছিল, শিখাকে আমি ভালবাসি, ওকে আমার ভালবাসতে ইচ্ছে করছে। ফেরবার সময়ও আমাকে, আমার পিঠের ওপর দিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরেছিল, খুব সাবধানে, যাতে আমি পড়ে গেলে ও সামলাতে পারে, তাতে আমার শরীরের মধ্যে ওকে আরও বেশী টের পাচ্ছিলাম। তবু সেই ঘটনার আগেও তো, মেয়েদের সঙ্গে মিশেছি—মানে সঙ্গ করা যাকে বলে, গায়ে গায়ে জড়াজড়ি, যেমন দোকানের পিছনে বা অন্য কোথাও, কিন্তু সেসব ব্যাপারের সঙ্গে, শিখার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা মনে হয়েছিল। এমন কি, নিজেকে কেমন একটু খারাপ লেগেছিল, ছোটলোক ইতরের মতন। এটা বুঝতে তো কোন অসুবিধা ছিল না, শিখা খুব ভাল মনেই আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, আমার ভিতরের কথা কিছুই জানতে পারেনি, অথচ আমার ব্যাপারটা কী জঘন্য। কিন্তু আমি তো ওসব চাইনি, ভাবিওনি। ফেরবার পথে আমি চোখ তুলে তাঁবার থালার মতন চাঁদটার দিকে তাকিয়েছিলাম, সেটা তখন নিম গাছের মগড়ালটাকে একটু পার হয়ে গেছে। ক্যাম্পের মধ্যে ঢুকে আমি শুইনি, চৌকির ওপর বসেছিলাম, শিখা বলেছিল, ‘শুয়ে পড়ুন না, আমি আপনাকে জল দিচ্ছি।’
আমি বলেছিলাম, বসতেই ভাল লাগছে। তখনো আলো জ্বলেনি, কিন্তু ছেলেদের দু-একজন ক্যাম্পে ফিরে এসেছিল, বলেছিল, এখুনি আলো জুলবে। একজন এসে আমার পাশে বসেছিল, আমার গায়ে হাত রেখেছিল, আমি চুপ করে ছিলাম। বসা অবস্থায় চাঁদটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার বুক আর পেটের কাছে আলো পড়ছিল, পরের দিন নাকি এস ডি ও আসবে, কিন্তু আমি কিছুই যেন শুনছিলাম না, দেখছিলাম না, কেমন একরকম হয়ে গিয়েছিলাম। গ্লুকোজের জল খেয়েছিলাম শিখার হাত থেকে! গেলাসটা ও আমার হাতে দেয়নি, মুখের কাছে ধরে ধরে খাইয়ে দিয়েছিল, আর কী আশ্চর্য, আমি তখন শিখার মুখের দিকে তাকাইনি অথচ ওর মুখটাই যেন আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আর সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, এমন একটা সুন্দর মুখ আমি জীবনে কোনদিন দেখিনি, মাইরি। আসলে কথাটা তো একদম বাজে, শিখার থেকে অনেক সুন্দর মুখ আমি দেখেছি, কিন্তু সেই সময়ে মনে হয়েছিল, শিখার মুখটা কী অদ্ভুত সুন্দর। জল খাওয়াতে ওর একটা হাত আমার গলার কাছে কাঁধের ওপর রেখেছিল, সেটা যেন আমি টেরই পাচ্ছিলাম না, অথচ ইচ্ছা হচ্ছিল শিখা আমাকে একটু জড়িয়ে ধরুক, একটু আমার গায়ে হাত দিক। ওর মুখটা যেন চোখের সামনে ভাসছিল, সুন্দর মুখ, আর সুন্দর মুখ হলেই, মুখের ভাবটাবগুলোও কেমন একরকম অদ্ভুত হয়, যেন চোখে হাসি হাসি ভাব, ঠোঁটের কোণেও সেইরকম, হাসছে না অথচ হাসি হাসি ভাব, এইরকম দেখছিলাম। পৃথিবীর যে কেউ এলেও যেমন আমাকে অনশন থেকে ফেরাতে পারতো না, দাবী না মেটা পর্যন্ত খাওয়াতে পারতো না, ঠিক তেমনি মনে হচ্ছিল, শিখার মুখটা কেউ আমার চোখ থেকে সরাতে পারবে না। জল খেতে খেতেই আলো জ্বলে উঠেছিল। দেখেছিলাম, কৃষ্ণাও একজনকে জল খাওয়াচ্ছিল। আমি তখন শিখার মুখের দিকে তাকাইনি, ইচ্ছা থাকলেও পারিনি, অথচ ভীষণ দেখতে ইচ্ছা করছিল। জল খাওয়া হয়ে যাবার পরে, গেলাসটা সরিয়ে নিয়েছিল, একজন একটা সিগারেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, কিন্তু আমার খেতে ইচ্ছা করছিল না, বলেছিলাম, ভাল লাগছে না। হাতের পিঠ দিয়ে মুখ মোছবার সময়, শিখার দিকে আমি তাকিয়েছিলাম, শিখাও তাকিয়েছিল, জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আর একটু খাবেন? আমি মাথা নেড়েছিলাম, চোখ ফেরাব ভেবেও ওর দিকে তাকিয়েছিলাম, শিখা এমনভাবে চোখটা নামিয়ে নিয়েছিল যেন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ওর হঠাৎ কেমন হয়ে গিয়েছিল। সেটা আমি বলতে পারব না, কেমন হয়ে গিয়েছিল—না, রাগ বা বিরক্ত না, অন্যরকম, যেটা দেখলেই মনে হয়, ও বুঝি একটু কেমন অবাক হয়ে গেছে, একটু লজ্জা পেয়ে গেছে। স্সাহ্, কত কীই মনে হয়েছিল, যত্তো এলেবেলে ভাবনা, বলে কত হাতী গেল তল, মশা বলে কত জল, আ বে লে লে যাহ!