প্রজাপতি রহস্য

প্রজাপতি রহস্য

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কৃতান্তকুমার হালদার, আমাদের প্রিয় হালদারমশাই খবরের কাগজ পড়ছিলেন। তার ডান হাতের দুই আঙুলে এক চিমটে নস্যি। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন–আঁ? কয় কী? বেড়ালের শোকে মাইনষের মৃত্যু!

বিস্ময় প্রকাশের পর তিনি নাকে নস্যি ওঁজে প্যান্টের বাঁ পকেট থেকে নোংরা রুমাল বের করে যথারীতি নাক মুছলেন। তারপর আমার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বললেন–জয়ন্তবাবু! আপনাগো সাংবাদিকগো লইয়া এই এক প্রবলেম!

জিজ্ঞেস করলুম–কী প্রবলেম হালদারমশাই?

গোয়েন্দাপ্রবর বললেন–যা শোনবেন, তাই লেইখ্যা ফেলবেন! মশায়! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি! কখনো এমন কথা শুনি নাই যে কারও পোষা বেড়াল মরলে তার শোকে সে-ও মারা যায়। কী কাণ্ড!

একটু হেসে বললুম–হালদারমশাই। খবরটা আমি পড়িনি। তবে এমন কিছু ঘটনা অসম্ভব বলেও মনে হয় না। পোষা পশুপাখির প্রতি কিছু মানুষের প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকতেই পারে। তাদের কোনো কারণে মৃত্যু হলে কেউ মনে প্রচণ্ড শোক পেতেও পারে। আর সেই শোকের প্রচণ্ড শকে হার্ট ফেল করে তার মৃত্যুও হতে পারে।

হালদারমশাই খি খি করে হেসে উঠলেন। — কর্নেলস্যার! জয়ন্তবাবুরে প্রচণ্ডের ভূতে পাইচ্ছে। তিনখান প্রচণ্ড কইলেন। শোনলেন তো?

-হ্যাঁ। শুনলাম। কর্নেল একটা বইয়ের পাতায় রঙিন প্রজাপতির ছবি আতস কাচের সাহায্যে খুঁটিয়ে দেখতে বললেন। –তবে সত্যি বলতে কী, জয়ন্ত নিজের অজ্ঞাতসারে সম্ভবত একটা সত্য কথাই বলে ফেলেছে!

হালদারমশাই অবাক হয়ে বললেন–অ্যাঁ? জয়ন্তবাবু সইত্য কইছেন? কী সইত্য?

–ওই প্রচণ্ড শব্দটার কথাই বলছি।

তার মানে?

-খুব সরল মানে হালদারমশাই। খবরটার আড়ালে তিনটে নয়, তিন দুগুণে ছটা প্রচণ্ডতা লুকিয়ে আছে।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বললেন–খবরটা আপনি পড়ছেন কর্নেলস্যার?

কর্নেল বইটা আর আতস কাচ টেবিলে রেখে ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে

বসলেন। তারপর বললেন–আপনি খবরটা খুটিয়ে পড়েননি। এমনকী, হেডিংটাও খুঁটিয়ে পড়েননি। না, না। তার জন্য আপনাকে দোষ দিচ্ছি না। করনগড়ের বৃদ্ধা রানিমা প্রকৃতপক্ষে একজন মানুষ তো বটেই।

হালদারমশাই এবার খবরের কাগজের সেই খবরের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তারপর অভ্যাসমতো প্রতিটি লাইনের তলায় তার লম্বা তর্জনী রেখে বিড়বিড় করে খবরটা পড়তে থাকলেন। একটু পরে তিনি সোজা হয়ে বসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন–হেভি মিস্ত্রি!

কর্নেল হাসলেন। –বরং জয়ন্তর প্রচণ্ডটা এর সঙ্গে জুড়ে দিন হালদারমশাই। প্রচণ্ড হেভি মিস্ত্রি! আমি আপনাকে বলছিলুম ছটা প্রচণ্ডতা লুকিয়ে থাকার কথা। খবরে এবার পড়লেন, করনগড়ের বৃদ্ধা রানিমার মোট ছটা পোযা বেড়াল ছিল। তাই না?

–হঃ! ছয়খান বেড়াল। কিন্তু ছয়খান বেড়ালের সঙ্গে ছয়খান প্রচণ্ডতা লুকাইয়া আছে। এট্ট বুঝাইয়া কন।

–এই বেড়ালগুলোর প্রত্যেকটার গায়ের রং আলাদা। একটার গায়ের রং ধূসর। একটার ফিকে কমলা। একটার কালো। একটার দুধ সাদা। একটার গায়ের রং মেটে। আর বাকি বেড়ালটার গায়ের রং ময়লা সাদা। ইংরেজিতে ডার্টি হোয়াইট বলা যায়। অবশ্য এই ছটা বেড়ালের পেটের রং সাদাই বলা যায়। কোনোটার পায়েও সাদা ছোপ আছে।

অবাক হয়ে বললুম–আপনি বেড়ালগুলো দেখেছেন?

কর্নেল আমার কথার পাশ কাটিয়ে গিয়ে বললেন–আমরা অনেকসময় ছাপা হরফে যা লেখা আছে, তা খুঁটিয়ে লক্ষ্য না করেই বাক্যের সাবস্ট্যান্স অর্থাৎ সারপদার্থ মনে মনে পড়ে ফেলি। এটা একটা সাধারণ মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা। হালদারমশাইয়ের ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছিল। যাই হোক, ঠাকুরঘরে পুজো শেষ করে এসে করনগড়ের বৃদ্ধা রানিমা তার বেডরুমে ঢুকে দেখেছিলেন, তাঁর আদরের প্রাণীগুলো ঘরের মেঝেয়, এমনকী, তার পালংকের তলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। রানিমার পরনে তখনও পুজোর পোশাক। হাতের রেকাবে প্রসাদ। প্রত্যেকদিন ভোরবেলা স্নান করার পর তিনি তিনতলার ঠাকুরঘরে পুজোয় বসতেন। তারপর গৃহদেবতাকে পায়েস আর কাটা ফল নিবেদন করে দোতলার বেডরুমে আসতেন। বেড়ালগুলো তার দিকে ছুটে আসত। তখন তিনি রুপোর রেকাবে রাখা প্রসাদ-মেঝেয় রাখতেন। বেড়ালগুলো চেটেপুটে সব খেয়ে ফেলত। কিন্তু এদিন রানিমা বেড়ালগুলোর ওই অবস্থা দেখেই মূৰ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। রেকাব পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনে তার পরিচারিকা ছুটে আসে। তার ডাকাডাকিতে বাড়ির লোকেরা এসে রানিমাকে আগে তার পালংকে শুইয়ে দেয়। তারপর চোখে-মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনে। কিন্তু কী একটা কথা বলেই আবার জ্ঞান হারান। এরপর ডাক্তার ডাকা হয়। কিন্তু ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলেন, রানিমা আর বেঁচে নেই।

হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে কর্নেলের কথা শুনছিলেন। উত্তেজনায় তার সরু গোঁফের দুটি ছুঁচোলো ডগা যথারীতি তিরতির করে কঁপছিল। তিনি এবার বলে উঠলেন–খবরে তো এত কথা লেখা নাই!

কর্নেল একটু হেসে বললেন–ঠিক বলেছেন হালদারমশাই। মফস্সলের সংবাদদাতার পাঠানো খবরে এত কিছু ডিটেলস লেখা নেই। কিন্তু যতটা লেখা আছে আমি তা বিশ্লেষণ করে শোনালুম।

-কিন্তু কর্নেলস্যার, ছয়খান বেড়ালের গায়ের রঙের ডেসক্রিপশন দিলেন ক্যামনে?

আমি মুখে গাম্ভীর্ষ এনে বললুম–কর্নেলকে কেউ-কেউ বলেন অন্তর্যামী পুরুষ। সম্ভবত সেটা ওঁর মুনিঋষিসুলভ সাদা দাড়ির মাহাত্ম্য। কেউ কেউ বলেন, কর্নেলের মাথার পিছনেও নাকি একটা চোখ আছে। এখন আমি বলতে চাই, কর্নেলের মাথার পিছনের অদৃশ্য চোখটা ওঁর বাইনোকুলারের মতো। অর্থাৎ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এতই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যে তিনি অনেক দূরের কোনো করনগড় অবধি দেখতে পেয়েছেন।

কর্নেল আমার রঙ্গব্যঙ্গ কানে নিলেন না। মৃদু হেসে তিনি বললেন বেড়ালগুলোর গায়ের রং আমি ওই খবর থেকে বিশ্লেষণ করে বর্ণনা দিলুম জয়ন্ত!

আমি কিছু বলার আগে গোয়েন্দাপ্রবর বলে উঠলেন–খবরে কি তা লেখছে? পড়লাম না তো কর্নেলস্যার!

–হালদারমশাই! খবরে লেখা আছে ছটা ছয় রঙের বেড়াল। তাই না?

 –হঃ! তা লিখছে।

–আমাদের দেশে এ যাবৎকাল নানা জায়গায় যত বেড়াল দেখেছি, তাদের গায়ের রং ওই ছটা রঙের বাইরে নয়। আপনারা কি কেউ লাল সবুজ নীল এই তিন রঙের বেড়াল কোথাও দেখেছেন?

– প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটু ভেবে নিয়ে বললেন– কর্নেলস্যার ঠিক কইছেন। জয়ন্তবাবু! কর্নেলস্যার রানিমার বেড়ালের গায়ের রঙের যে ডেসক্রিপশন দিচ্ছেন, তার বাইরে কোনোও রঙের বেড়াল কি দ্যাখছেন কোথাও?

একটু ভেবে নিয়ে বললুমনাঃ! আর কী রং হতে পারে মাথায় আসছে না।

এইসময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল যথারীতি হাঁক দিলেন–যষ্ঠী! তারপর তিনি দেয়াল ঘড়ি দেখে নিলেন। লক্ষ্য করলুম, দশটা পাঁচ বাজছে।

 কর্নেলের তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টের এই জাদুঘর সদৃশ বিশাল ড্রয়িং রুমের বাঁ দিকে দরজার পর ছোট্ট একটা ঘর আছে। সেটা ডাক্তারদের চেম্বারে রোগীদের ওয়েটিংরুমের মতো এবং আয়তনে অপ্রশস্ত। সেই ঘরের বাইরের দরজাই কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের সদর দরজা। ষষ্ঠী ওই অপ্রশস্ত রুমে ঢোকে ডাইনিং ও কিচেনের করিডর দিয়ে। কারও নির্দিষ্ট সময়ে আসবার কথা ষষ্ঠীকে কর্নেল বলে থাকলে সে আগন্তুকের সঙ্গে ড্রয়িংরুমে ঢোকে না। করিডর দিয়ে সোজা কিচেনে চলে যায়।

তাই একটু পরে এক ভদ্রলোককে একা এ ঘরে ঢুকতে দেখেই বুঝলুম, ষষ্ঠী জানত ইনি আসবেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। গায়ের রং ফর্সা। পরনে হাফহাতা বুশশার্ট আর প্যান্ট। হাতে একটা ব্রিফকেস। _ তিনি ঘরে ঢুকেই প্রথমে আমাদের তিনজনকে দেখে নিয়েছিলেন। এবার কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বললেন–আপনিই কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আপনি মিঃ তীর্থব্রত সিংহ।

ভদ্রলোক সায়েবি কেতার মানুষ, তা বোঝা গেল। তিনি কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তার সঙ্গে করমর্দন করার পর বললেন–আপনার পাওয়ার অব অবজারভেশন সম্পর্কে অনেক আশ্চর্য ঘটনা শুনেছি ক্যাপ্টেন এইচ সি পাণ্ডের কাছে।

–প্লিজ আগে বসুন মিঃ সিংহ।

সিংহসায়েব সোফায় বসে ব্রিফকেসটা পাশে রাখলেন। তারপর বললেন এঁদের পরিচয় পেলে খুশি হতুম কর্নেল সরকার।

জয়ন্ত চৌধুরি। আমার এই তরুণ বন্ধু এই বয়সেই বহুল প্রচারিত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক। ইনি মিঃ কে কে হালদার। জাঁদরেল পুলিশ ইন্সপেক্টর ছিলেন। রিটায়ার করার পর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি খুলেছেন। এঁরা দুজনেই আমার বিশ্বস্ত সহযোগী।

তীর্থব্রত সিংহের কাছ থেকে আমরা একটু দূরে বসেছিলুম। সে-কারণেই আমরা নমস্কার বিনিময় করলুম। তারপর তিনি মৃদু স্বরে বললেন কলকাতা এলে আমি হোটেল এশিয়াতে উঠি। ওখানে একটা বিশেষ সুবিধা আছে। ওঁরা দরকার হলে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। গতরাত্রে আপনার কাছে তাই আসবার কোনো অসুবিধে ছিল না। কিন্তু রাত্রি দশটায় আপনাকে বিব্রত করার ইচ্ছে ছিল না বলেই ফোন করেছিলুম। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সকালে গাড়ি পেতে দেরি হওয়ার জন্য পঁয়ত্রিশ মিনিট দেরি করে ফেলেছি। আপনি কর্মব্যস্ত মানুষ। জানি না এতে আপনার কোনো অসুবিধে করে ফেলেছি কি না। করে থাকলে আমি দুঃখপ্রকাশ করছি কর্নেল সরকার!

কর্নেল সহাস্যে বললেন–ক্যাপ্টেন পাণ্ডে যদি আপনাকে বলে থাকেন আমি কর্মব্যস্ত মানুষ, তা হলে তিনি আমার পুরোনো জীবনের কথা ভেবেই বলেছেন। কাজেই আপনার দুঃখপ্রকাশের কারণ নেই। প্রকৃত ঘটনা হল, আমি এখন প্রায়ই কর্মহীন হয়ে পড়ি। বিশেষ করে এই অগাস্ট মাসে। আমার হাতে করার মতো কিছু কাজ এখন নেই। তবে–প্লিজ একটু অপেক্ষা করুন। কফি আসুক। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে। আপনি নার্ভ চাঙ্গা করার পর যা কিছু বলার বলবেন। কই ষষ্ঠী?

ষষ্ঠীচরণ শিগগির ট্রেতে কফির পট আর কাপ প্লেট রেখে গেল। কর্নেল একটা কাপে কফি ঢেলে মিঃ সিংহকে দিলেন। তারপর হালদারমশাই এবং আমাকে দেওয়ার পর তাঁর নিজস্ব লম্বাটে কাপে কফি ঢেলে চুমুক দিলেন। তীর্থব্রত সিংহ কফি খেতে খেতে বললেন–বাঃ! আপনার লোকটি চমৎকার কফি করে তো। সত্যি বলতে কী, আমাদের দেশে কোথাও অমি এতকাল প্রকৃত কফির স্বাদ পাইনি। আমার যা প্রফেশন, মাঝে মাঝে বিদেশে যেতে হয়। সাউথ আফ্রিকার ডারবানে ঠিক যে-স্বাদের কফি খেয়েছিলুম, অবিকল সেই স্বাদ!

কর্নেল হাসলেন–ধন্যবাদ মিঃ সিংহ! আমার সংগৃহীত এই কফি সাউথ ইন্ডিয়ার।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কফিপানের পর মিঃ সিংহ বললেন–ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বলছিলেন, তিনি নাকি আপনাকে কেসটার মোটামুটি একটা ব্যাকগ্রাউন্ড জানিয়েছেন!

জানিয়েছেন। তবে যা-ই বলুন উনি একজন বাইরের লোক। তা ছাড়া মূল ঘটনার সময় তিনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। উনি যা কিছু আমাকে বলেছেন, সবটাই অন্যের মুখে শোনা।

-আমারও অবশ্য কতকটা তা-ই। ঘটনার সময় আমি ফ্যাক্টরিতে ছিলুম।

–কিন্তু আপনিই নাকি ভদ্রমহিলার মুখ থেকে লালা ঝরতে দেখেছিলেন? লালায় রক্তের ছিটেও ছিল?

মিঃ সিংহ সোজা হয়ে বসলেন। একজ্যাক্টলি! আমিই এটা লক্ষ করেছিলুম। আর তা কখন জানেন? যখন মামিমাকে চিতায় শোওয়ানো হয়েছে, ঠিক তখন। হা, অনেক সময় মৃতের নাক দিয়ে ওই জাতীয় তরল কিছু গড়িয়ে পড়বে জেনেই নাকে তুলো খুঁজে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠোঁটের বা কোনা দিয়ে লালাগড়ানো ব্যাপারটা আমার অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল।

–আপনার মামিমা মারা যান সাড়ে ছটা থেকে সাতটার মধ্যে। তাই না?

-হ্যাঁ। ডাক্তারবাবু সওয়া সাতটায় যান। তিনি পরীক্ষা করে বলেন, মামিমা হার্টফেল করে মারা গেছেন।

–আপনি তখন ফ্যাক্টরিতে ছিলেন বললেন। আপনি কি ভোরবেলায় সেখানে যান?

মিঃ সিংহ একটু বিব্রতভাবে বললেন না। কোনোদিনই ওইসময় আমি যাই না। ঘটনা হল, সেদিন ভোর সাড়ে পাঁচটায় টেলিফোনের বিরক্তিকর শব্দে ঘুম ভেঙেছিল। রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই শুনি, কেউ হিন্দিতে বলছে, সিনহা সাব! আপনার ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। শিগগির সেখানে চলে যান।

– কর্নেল নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। বললেন–তারপর আপনি কী করলেন?

–তখনই দমকলে খবর দিয়ে নিচে এসে গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করে বেরিয়ে গেলুম। পোশাকও বদলাইনি। নাইটড্রেস পরেই বেরিয়েছিলুম। শেষ রাত্রে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। যে গতিতে যাচ্ছিলুম, গাড়ির চাকা পিছলে গিয়ে পাহাড়ি খাদে পড়ে মারা যেতুম।

-ফ্যাক্টরির দূরত্ব কত?

প্রায় আট কিলোমিটার। ওদিকটায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন।

–গিয়ে কী দেখলেন

-ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগেনি। ওই জোনেই দমকল আফিস। দুটো দমকল আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। দমকলকর্মী আর অফিসাররা ফ্যাক্টরিতে চারদিক ঘুরে পরীক্ষা করে বেড়াচ্ছিলেন, কোথায় আগুন লেগেছে। বাইরের মেইন গেট অবশ্য দারোয়ানরা খুলে দিয়েছিল। তবে ফ্যাক্টরিতে চাবি এক সেট থাকে ম্যানেজার সিদ্ধেশ নারায়ণের কাছে। তিনি ফ্যাক্টরিতে যান ঠিক নটায়। যাই হোক, আমার চাবির সেট বুদ্ধি করে নিয়ে গিয়েছিলুম। ফ্যাক্টরি খুলে আলো জ্বেলে দিলুম। আশ্চর্য ঘটনা!

–আগুন লাগেনি কোথাও?

–নাঃ।

তারপর আপনি কী করলেন?

লন?

 –অফিস খুলে ম্যানেজারকে ফোন করে সব জানালুম। তাকে তখনই চলে আসতে বললুম।

–তিনি কখন এলেন?

–সাতটা থেকে সওয়া সাতটার মধ্যে। যাই হোক, অফিসে বসে দুজনে এরকম সাংঘাতিক একটা উড়ো ফোনের কথা নিয়ে আলোচনা করছি, সেই সময় আমার স্ত্রী অরুণিমার ফোন এল। মামিমা হার্টফেল করে মারা গেছেন। এই পরিস্থিতিতে আমার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে, একটু চিন্তা করুন কর্নেল সরকার।

কর্নেল আস্তেসুস্থে কফি পান করছিলেন। এতক্ষণে কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। তারপর একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে বললেন–আপনার মামিমার বডি চিতায় তোলা হয়েছিল কখন?

–তখন বিকেল প্রায় পাঁচটা। এলাকায় মামিমা খুব জনপ্রিয় ছিলেন। মামাবাবু তো ছিলেনই। ওই এলাকায় জাতপাতের অবস্থা কী রকম, তা আপনার জানবার কথা। আমার মামা অবশ্য উত্তররাঢ়ী কায়স্থ ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজের জাতপরিচয় দিতেন ক্ষত্রিয় হিসেবে। এদিকে মামিমা রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। তার বাবা দর্পনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই ছিলেন পুরুষানুক্রমে রাজা পদবিধারী জমিদার। তিনি মামিমার অসবর্ণ বিয়ে মেনে নিয়েছিলেন। জামাইকে ঘরে তুলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তাকে তার জমিদারির উত্তরাধিকারী করেছিলেন। আমার মামা প্রসন্নকুমার সিংহ তার শ্বশুরের মৃত্যুর পর প্রজাদের কাছে রাজাসায়েব হয়ে উঠেছিলেন। অবশ্য এলাকাটা তাঁর আমলে আদিবাসী প্রধান ছিল। কালক্রমে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও করনগড়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখনকার দিনে হলে ওই অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে কী ঘটত বুঝতেই পারছেন। রাজ্যটা বিহার।

করনগড় শব্দটা শুনেই চমকে উঠেছিলুম। হালদারমশাইয়ের দিকে তাকালুম। তিনি চোখের ভাষায় আমাকে কিছু বললেন যেন। বুঝতে পারলুম না। তবে এতক্ষণে বুঝে গেছি যে এটা সেই ছটা বেড়ালের শোকে রানিমার মৃত্যু-র কেস। কর্নেল কি তা হলে ইচ্ছে করেই তার পড়া খবরের কাগজটা এমনভাবে ভাঁজ করে রেখেছিলেন, যাতে হালদারমশাইয়ের সরাসরি চোখে পড়ে?

কর্নেল আবার বললেন–তারপর কী হল বলুন।

মিঃ সিংহ বললেন– শ্মশানে উপস্থিত অনেকেই ডেডবডির মুখ দিয়ে লালা গড়ানোর ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মাথায় একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধতে শুরু করেছি। আমি শেষ পর্যন্ত আমার এক বন্ধু কুন্দলাল শর্মাকে থানায় পাঠালুম। পুলিশ এল। স্থানীয় হাসপাতালের একজন ডাক্তারকে সঙ্গে এনেছিল কুন্দলাল। সেই ডাক্তারও সন্দেহ প্রকাশ করলেন। তখন অ্যাম্বুল্যান্স আনিয়ে মামিমার ডেডবডি মর্গে চালান দিল পুলিশ। সেদিনই রাত একটার মধ্যে মর্গের রিপোর্ট থানায় পৌঁছেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বডির কাঁধের কাছে ইঞ্জেকশনের চিহ্ন আছে এবং সাংঘাতিক কোনো বিষই মামিমার মৃত্যুর কারণ। কী বিষ, তা জানার জন্য কাঁধের কাছে ইঞ্জেকশনের জায়গার মাংস কেটে পাটনায় ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। পরদিন শুক্রবার সকালে মামিমার বডি ফেরত দিল পুলিশ। বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে দাহ হয়ে গেল।

-বেড়ালগুলোর পোস্টমর্টেম করা হয়নি?

-বেড়ালগুলোকে রাজবাড়ির এককোণে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হয়েছিল। পুলিশ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বেড়ালের বডিগুলো তুলে মর্গে পাঠিয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ বলা হয়েছে, সাংঘাতিক কোনো বিষ। পাটনার ফরেনসিক এক্সপার্টরাও কীসের বিষ তা এখনও বুঝতে পারেননি।

পুলিশ কি কাউকে অ্যারেস্ট করেছে?

–মামিমার পরিচারিকা নন্দরানি আর আমাদের রাজবাড়ির সরকারজি সুখলাল দুবেকে।

মোটিভ?

মিঃ সিংহ গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে বললেন–মোটিভ আমার কাছে অস্পষ্ট। কিন্তু পুলিশের বক্তব্য, ওরা দুজনে কারও কাছে প্রচুর টাকা নিয়ে এই জঘন্য কাজ করেছে। কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা, নন্দরানির বিছানার তলা থেকে দশহাজার টাকা পাওয়া গেছে। আর সরকারজির ঘরের কুলুঙ্গিতে বজরঙ দেবের মূর্তির তলা থেকেও দশহাজার টাকা পুলিশ উদ্ধার করেছে।

টাকার ব্যাপারে আসামিদের কী বক্তব্য?

–তারা কান্নাকাটি করে বলেছে, এই টাকার কথা তারা জানে না। কেউ তাদের মিথ্যা করে সানোর জন্য টাকা তাদের ঘরে পাচার করেছে।

–টাকাগুলো পিনআঁটা ছিল? অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকার নোটের বান্ডিল যেভাবে দেওয়া হয়?

–না। খোলা অবস্থায় গোছানো ছিল।

কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন–রানিমা স্বর্ণময়ী সিংহের পোপাটি তাঁর মৃত্যুর পর তো আপনিই পাবেন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বলেছেন, তাঁর সন্তানাদি নেই।

লক্ষ করলুম, কর্নেলের অতর্কিত এবং সরাসরি এই প্রশ্নে তীর্থব্রত সিংহের মুখে ঈষৎ ক্ষোভ কিংবা রোষের আভাস ফুটে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে তা মিলিয়ে গেল। তিনি হেসে উঠলেন। কর্নেল সরকার। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে কি আপনাকে একথা বলেননি যে মামিমার প্রোপার্টির যা বাজারদর, তার চেয়ে তার স্বামী অর্থাৎ আমার মামাবাবুর দেনার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ?

কর্নেল আবার একটু চুপ করে থাকার পর বললেনক্যাপ্টেন পাণ্ডে আমাকে শুধু একটা আভাস দিয়েছেন, রাজাসায়েব প্রসন্নকুমার সিংহের সঙ্গে এলাকার একজন ব্যবসায়ীর অনেক বছর ধরে একটা মামলা হয়েছিল। সেই মামলা সুপ্রিম কোর্ট অবধি উঠেছিল। রায় তার পক্ষে গেলেও সেই মামলার খরচ জোগাতে শুধু রাজবাড়িটা ছাড়া তার হাতে আর কিছুই ছিল না।

মিঃ সিংহ মৃদুস্বরে বললেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে মামাবাবুকে সেই মামলার খরচ ফিরিয়ে দেওয়ার কোনো শর্ত ছিল না। কারণ হাইকোর্টের রায়ে হেরে গিয়ে মামাবাবুই জেদের বশে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। আপিল গ্রাহ্য হয়। হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়ে যায়। তা না হলে মামাবাবুকে রাজবাড়িটাও বেচতে হত।

–কী নিয়ে মামলা?

-মামাবাবু নাকি মনমোহন সুখানিয়া নামে এক ব্যবসায়ীর কাছে লক্ষাধিক টাকা অ্যাডভান্স নিয়েছিলেন।

-কোনো দামি জিনিসের জন্য অ্যাডভান্স?

–হ্যাঁ। বলে মিঃ সিংহ মুখ নামিয়ে তার বাঁ হাতের আঙুলে তিনটে রত্নখচিত আংটি নাড়াচাড়া করতে থাকলেন।

কর্নেল বললেন–কিন্তু সেই দামি জিনিসটা কী?

তীর্থব্রত সিংহ মুখ তুলে বললেন–পূর্বপুরুষের কী সব জুয়েলস এবং সেই জুয়েলসের নিজস্ব দাম ছাড়াও ঐতিহাসিক দাম নাকি অনেক বেশি। আসলে সেই মামলা চলার সময় আমি বয়সে বালক। থাকতুম বীরভূমের রাজনগরে ঠাকুর্দার কাছে। আমার বাবা-মাকে শৈশবেই হারিয়েছিলুম। যাই হোক, ঠাকুর্দার মৃত্যুর পর মামাবাবু আমাকে নিয়ে যান। সেই সময় মনমোহন সুখানিয়ার সঙ্গে তাঁর মামলা চলছিল। তো আমি শুধু এইটুকু জানি যে, হিস্টোরিক্যালি ইমপর্ট্যান্ট কিছু ধনরত্ন মামাবাবু বিক্রি করার জন্য টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো তিনি দিতে পারেননি সময়মতো।

-কেন?

মিঃ সিংহ আস্তে বললেন–মামিমার কাছে শুনেছিলুম, সেই জুয়েলস রাজবাড়ি থেকে কেউ চুরি করেছিল। তাই মামাবাবু কথা রাখতে পারেননি। কর্নেল সরকার, এর বেশি আর কিছু আমার জানা নেই।

এতক্ষণে হালদারমশাই বলে উঠলেন–সিংহসায়েবের একটা কথা জিগাই!

তীর্থব্রত সিংহ তার দিকে শুধু তাকালেন।

 হালদারমশাই বললেন–কোনো ব্যবসায়ী লেখাপড়া না কইর‍্যা টাকা দেয় না। আপনার মামাবাবু নিশ্চয় কোনো কাগজে সই করেছিলেন। এখন কথা হইল গিয়া, সুপ্রিম কোর্ট কীসের বেসিসে হাইকোর্টের রায় ডিসমিস করছিল?

মিঃ সিংহ একটু হেসে বললেন–আপনি প্রাক্তন পুলিশ অফিসার এবং বর্তমানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ, আপনার প্রশ্নের মূল্য আছে। কিন্তু এই ধরনের কেনাবেচার কথা কার সঙ্গে হয়েছিল একটু ভেবে দেখুন। করনগড়ের রাজাবাবুর সঙ্গে! তা ছাড়া ঐতিহাসিক জুয়েলসের ব্যাপারে। সবটাই হয়েছিল মৌখিক কথার ভিত্তিতে।

তা হলে কোর্ট ক্যাস লইল ক্যান?

সাক্ষী ছিল। তা ছাড়া সে আমলে এ ধরনের লেনদেন ওইভাবেই হত। আপনি কি চোপড়ি কথাটা জানেন? ওড়িশায় এই মৌখিক লেনদেনব্যবস্থা এখনো চালু আছে। একে বলে চোপড়ি। চোপা অর্থ মুখ। মুখে মুখে লেনদেনের ব্যাপারটা সাক্ষীদের সাক্ষ্যেই আইনত গ্রাহ্য হয়।

গোয়েন্দাপ্রবর নড়ে বসলেন। সহাস্যে বললেন–হঃ! আমাগো পূর্ববঙ্গে মুখেরে চোপা কয়। রাগ হইলে মাইনয়ে কয়, চোপাখান ভাইঙ্গা দিমু!

মিঃ সিংহ বললেন–জুয়েলস চুরির পর মামাবাবু থানায় ডায়রি করেছিলেন। তার কপি বাদী-বিবাদী দু-পক্ষেরই কাজে লেগেছিল। যাই হোক, ওসব পুরনো কথা আলোচনা করে লাভ নেই। কর্নেল সরকার। আপনার অজস্র প্রশ্ন থাকতে পারে। এখানে বসে সবকিছুর উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে যেন ধ্যানস্থ ছিলেন। মুখে কামড়ে ধরা চুরুট। এবার সোজা হয়ে বসে চুরুট অ্যাশট্রেতে রেখে বললেন–আপনি ঠিক বলেছেন মিঃ সিংহ। আমি শুধু বিষয়টার একটা আউটলাইন এঁকে দেখার চেষ্টা করছিলুম। এখন মনে হচ্ছে, কেসটা আপাতদৃষ্টে নিছক প্রতিহিংসামূলক হত্যাকাণ্ড মনে হলেও আদতে তা নয়। একটা ব্যাকগ্রাউন্ডের পিছনে আরও কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। আপনি কবে করনগড় ফিরছেন?

–আজ রাতের ট্রেনেই ফিরব।

–ক্যাপ্টেন পাণ্ডেকে বলবেন, আমি যে-কোনো দিন করনগড়ে পৌঁছব। ঠিক কবে পৌঁছুব, তা অবশ্য টেলিফোনে জানিয়ে দেব।

তীর্থব্রত সিংহ ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কর্নেলের সঙ্গে করমর্দন এবং আমাদের নমস্কার করে বেরিয়ে গেলেন….

.

তীর্থব্রত সিংহ বেরিয়ে যাওয়ার পর হাসতে হাসতে বললুমবাস। মাথা ঝিমঝিম করছে আমার। এ যে দেখছি অ্যারাবিয়ান নাইটসের কারবার। ঘটনার ভিতরে ঘটনা। তার ভিতরে ঘটনা।

হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন–আমি একটা পয়েন্ট ভাবতাছি। খুনি রানিমারে বিষের ইঞ্জিকশন দিয়া মারছে! কিন্তু সে বেড়ালগুলিরে কী কইর‍্যা মারল? বিষের ইঞ্জেকশন দিয়া অতগুলি বেড়ালেরে মারতে তো সময় লাগনের কথা! হেভি টাইম লাগব। তাই না কর্নেলস্যার?

কর্নেল তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। তারপর সাড়া পেয়ে ইংরেজিতে বললেন–আমি ম্যানেজার মিঃ শর্মার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার!

একটু পরে মিঃ শর্মার সাড়া পেয়ে তিনি বললেন–মর্নিং মিঃ শর্মা। একটা সামান্য গোপনীয় কথা জানতে চাইছি। গত রাত্রে আপনাকে ফোন করে জেনেছিলুম, সুইট নাম্বার সিক্স টু ওয়ানে যিনি উঠেছেন, তার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছিলেন। …হা মনে আছে। মিঃ রঘুবীর আচারিয়া! তো আজ মর্নিংয়ে কি তিনি আবার এসেছিলেন? …না। এটা নিছক কৌতূহল মিঃ শর্মা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনো ঝামেলার ব্যাপার নেই। নিছক একটা প্রশ্ন। …এসেছিলেন। তারপর? দুজনে কি একসঙ্গে বেরিয়েছিলেন তার মানে, আপনাদের ভাড়ার গাড়িতে চেপে …থ্যাংকস। তো মিঃ শর্মা, আপনাদের হোটেলের নিয়ম অনুসারে ভিজিটারের নাম ঠিকানা লেখার কথা। কাল রাত্রে আমি ঠিকানা চাইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঠিকানাটা আমার জানা দরকার। …না, না। কোনো ঝামেলা নয়। সব দায়িত্ব আমার। আপনি বরাবর আমাকে সহযোগিতা করেছেন বলেই …হ্যাঁ। বলুন।

কর্নেল টেবিলের পাড় আর কলম টেনে নিয়ে লিখতে থাকলেন। তারপর লেখা শেষ হলে মিঃ শর্মাকে ধন্যবাদ দিয়ে রিসিভার রাখলেন।

বললুম–হোটেল এশিয়ার ম্যানেজার সুরেশ্বর শর্মার সঙ্গে এসব কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে, গতরাত্রি থেকে আপনি তীর্থব্রত সিংহের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করছেন! কী ব্যাপার কর্নেল? আরব্য রজনী যে ঘোরতর অন্ধকার হয়ে উঠল।

আমার কথার পর গোয়েন্দাপ্রবরও বলে উঠলেন-কর্নেলস্যার! ভদ্রলোকেরে দেইখ্যা আর ওনার কথাবার্তার টোন লইক্ষ্য কইর‍্যা আমারও য্যান খটকা বাধছিল।

কর্নেল আমাদের কথায় কান্ দিলেন না। হাঁক দিলেন–যষ্ঠী! আরেকবার কফি চাই। তারপর তিনি টেবিল থেকে সেই প্রজাপতির বইটা টেনে নিয়ে চিহ্নিত পাতাটা খুললেন এবং আগের মতো আতস কাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।

ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে যাওয়ার পর হালদারমশাই বললেন–আর কফি খামু? সাড়ে এগারোটা বাইজ্যা গেছে।

বললুম–খান হালদারমশাই। নার্ভ ঝিমিয়ে পড়েছে প্রচণ্ড হেভি মিস্ত্রির ধাক্কায়। চাঙ্গা হওয়া দরকার।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ একটু হেসে বললেন–আপনি যখন কইতাছেন, তখন খাই। বলে তিনি অভ্যাসমত ফুঁ দিয়ে কফিতে চুমুক দেওয়ার পর সম্ভবত বেশিরকম চাঙ্গা হয়ে বললেন–কর্নেলস্যারেরে একখান কথা জিগাই।

কর্নেল ছবি দেখতে দেখতে বললেন–বলুন হালদারমশাই।

ইচ্ছা করে আমি সিংহসায়েবেরে ফলো কইর‍্যা রাত্রের ট্রেনে করনগড় যাই।

কর্নেল ছবি থেকে মুখ তুলে কফিতে চুমুক দিলেন। তারপর সহাস্যে বললেন–পকেটের পয়সা খরচ করে গোয়েন্দাগিরি করবেন হালদারমশাই? আপনি বলতে পারেন, আমি মাঝেমাঝে এই কাজটা করি। কিন্তু আমার দ্বিগুণ পুষিয়ে যায়। কীভাবে যায়, তা জয়ন্ত জানে। ওকে জিজ্ঞেস করুন।

গোয়েন্দাপ্রবর আমার দিকে তাকালেন। বললুম–ব্যাপারটা আপনারাও অজানা নয় হালদারমশাই। কর্নেল করনগড়ে ট্যাকের কড়ি খরচ করে যাবেন। গোয়েন্দাগিরি যা করার তা করবেন। সেই সঙ্গে বিরল প্রজাতির পাখি বা প্রজাতির ছবি তুলবেন। পাহাড়ি অর্কিড সংগ্রহ করবেন। এইসব করার পর কলকাতা ফিরে সচিত্র প্রবন্ধ পাঠাবেন বিদেশি কোনো বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত পত্রিকায়। এক কাড়ি টাকা পাবেন। এছাড়া এ দেশের মেট্রোপলিটন শহরগুলোতে আজকাল প্রকৃতি-পরিবেশ সংক্রান্ত সংস্থা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়েছে। প্লেনভাড়া আর ফাইভস্টার হোটেলে থাকার সুবিধেসহ একেকটা লেকচারে কমপক্ষে দশহাজার টাকা দক্ষিণা। অবশ্য স্লাইড সহযোগে লেকচার দিতে হবে। তা-ও কর্নেলের আছে।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত একটু বাড়িয়ে বলছে হালদারমশাই। তবে আপনার যা প্রোফেশন, একজন ক্লায়েন্ট থাকা দরকার। আইনসম্মত পদ্ধতিতে দু-পক্ষের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। একটু অপেক্ষা করুন। আপনার যেমন ক্লায়েন্ট দরকার, আমারও তেমনই আপনাকে দরকার।

অবাক হয়ে বললুমকরনগড়ের রানিমার মৃত্যুরহস্য, বেড়ালগুলোর কথা ছেড়েই দিচ্ছি, সেই রহস্যভেদে ক্লায়েন্ট বলতে তো মিঃ তীর্থব্রত সিংহ। অথচ আপনি তার পিছনেই গোয়েন্দাগিরি করছেন। আমি বুঝতে পারছি না কর্নেল, কলকাতায় বসে হালদারমশাইকে করনগড়ের কেসের ক্লায়েন্ট কীভাবে জোগাড় করে দেবেন?

কর্নেল হাসলেন। জয়ম্ভ। তুমি বলেছ অ্যারাবিয়ান নাইটসের কথা। ঘটনার ভিতরে ঘটনা। হাতোমার উপমা প্রচণ্ড লাগসই। তোমার সেই তিনখানা প্রচণ্ডের চেয়েও। তবে আগে আমাকে কফিটা শেষ করতে দাও।

প্রজাপতির বইটা আতস কাচ সমেত টেবিলে রেখে তিনি ড্রয়ার থেকে একটা খুদে নোট বই বের করলেন। তারপর কফি খেতে খেতে পাতা ওলটাতে থাকলেন। কিছুক্ষণ পরে একটা পাতায় আঙুল রেখে আস্তেসুস্থে তিনি কফি শেষ করলেন এবং চুরুট ধরালেন। তারপর টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নম্বর ডায়াল করতে করতে বললেন–কথাটা আমিই হালদারমশাইয়ে কাছে কোনো এক সময়ে তুলম। উনি নিজেই সময়টা এগিয়ে দিলেন। এটা বরং ভালোই হল। তদন্তের শুরু থেকেই গতি বাড়তে থাকবে…সোহিনী? আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। …হ্যাঁ, আমি জানি আজ তুমি বাড়িতেই থাকবে। …শোনো! তোমার তো গাড়ি আছে। এখনই একবার আমার এখানে আসতে পারবে? …হ্যাঁ। তোমারই ইন্টারেস্টে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে কি তোমার সঙ্গে আর যোগাযোগ করেছিলেন কর্নেল হেসে উঠলেন। উনি বুদ্ধিমান মানুষ। ভালোই জানেন, আমি তোমার স্বার্থে কতদূর এগোব। এনিওয়ে। এখনই চলে এসো…রাখছি।

রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন–যে মেয়েটি একটু পরে এসে যাবে, তার নাম সোহিনী রায়। করনগড়ের রানিমা স্বর্ণময়ীর দূরসম্পর্কের নাতনি। সোহিনীর বাবা মা বেঁচে থাকতে সে তাদের সঙ্গে প্রতিবছর পুজোর সময় করনগড় বেড়াতে যেত। সোহিনী আজ সকাল সাতটায় খবরটা পড়ে আমাকে রিং করেছিল। তার আগে অবশ্য তার ঠাকুর্দার বন্ধু ক্যাপ্টেন পাণ্ডে রানিমার মৃত্যুর পরদিনই তাকে খবর দিয়েছিলেন। সে কনগড় যেতে পারেনি। আমার কাছে এসেছিল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডেরই পরামর্শে। অবশ্য সোহিনীর ঠাকুর্তা মেজর অরবিন্দ রায় আমারও বন্ধু ছিলেন। দুর্দান্ত অ্যাডভেঞ্চারার ছিলেন ভদ্রলোক।

হাঁ করে কর্নেলের দিকে তাকিয়েছিলুম। এবার বললুম–বাঃ! করনগড়ের আরব্য রজনী ঘোর অন্ধকার হলেও কোনো যুবতী তাতে ছিল না। যুবতী ছাড়া আরব্য রজনী একেবারে অচল। ইলিউসন সৃষ্টি হয় না। কর্নেল! আমার প্রচণ্ডের সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

হালদারমশাই ক্লায়েন্টপ্রাপ্তির খবরে খুশি হয়েছিলেন। তিনি বললেন– এতক্ষণে একটা কথা বোঝলাম। কর্নেলস্যার আগে হইতেই করনগড়ের ঘটনার লগে-লগে ছিলেন।

কর্নেল বললেন–হালদারমশাই কিছুটা ঠিক কথাই বলেছেন। তবে আমার আসল আগ্রহ ছিল আগস্ট মাসে করনগড় এলাকায় একটা বিশেষ প্রজাতির প্রজাপতি দর্শন। হঠাৎ এই প্রজাপতির খবর পেয়েছিলুম।

বললুম–যে প্রজাপতির ছবিটা আতসকাচ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন, সেটাই কি?

-ঠিক ধরেছ, জয়ন্ত! আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন হরিচরণ পাণ্ডের করনগড়ে একটা ফার্ম হাউস আছে। তিনি সেখানে গত জুলাইয়ে এই অদ্ভুত গড়নের প্রজাপতি আবিষ্কার করে আমাকে খবর দিয়েছিলেন। গড়নটা এত বেশি অদ্ভুত বলেই তার কৌতূহল জেগেছিল। তিনি অনেক চেষ্টার পর প্রজাপতিটার একটা রঙিন ছবি তুলে পাঠিয়েছিলেন। তার প্রায় দু-সপ্তাহ পরে এ মাসের গোড়ার দিকে করনগড়ের রানিমার মৃত্যুসংবাদ তাঁর কাছ থেকেই পেয়েছিলুম। তীর্থব্রত সিংহকে তিনি আমার সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তা তোমরা আজ জেনেছ।

হালদারমশাই বললেন–কিন্তু কাগজে খবর এত দেরিতে ছাপল সার?

জয়ন্তকে জিজ্ঞেস করুন! সে কাগজের লোক।

বললুম–খবরটা পাঠিয়েছিলেন ওই এলাকার নিজস্ব সংবাদদাতা। তিনি খবরটা নিশ্চয় ঘটনার দিনই পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু কলকাতার কাগজে নিজস্ব সংবাদদাতার খবর পৌঁছোয় দেরিতে এবং ছাপাও হয় আরো দেরিতে। কাগজে মফস্সলের খবর ছাপা হয় সেদিন, যেদিন কাগজে কোনো কারণে বাড়তি জায়গা থাকে। অসংখ্য খবর মফসল থেকে আসে। সেগুলো ফেলে দেওয়া হয় আবর্জনার ঝুড়িতে। দৈবাৎ কোনো চমকপ্রদ খবর এলে বিভাগীয় সম্পাদক তা রেখে দেন। যেদিন জায়গা পান, সেদিন ছাপতে দেন। বিড়ালের শোকে রানিমার মৃত্যু খবরটাতে একটু চমক ছিল। আমার ধারণা, আমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা ছাড়া আর কোনো কাগজ খবরটা ছাপেনি।

কর্নেল সায় দিয়ে বললেন–হ্যাঁ। দৈনিক সত্যসেবক ছাড়া কলকাতার কোনো কাগজই ছাপেনি। তবে আমার ধারণা পাটনা থেকে প্রকাশিত স্থানীয় কাগজে খবরটা সম্ভবত ফলাও করে ছেপেছে। পরবর্তী ঘটনাও ফলো-আপ হিসেবে ছেপেছে। কারণ ঘটনাটা হত্যাকাণ্ড।

পরবর্তী ঘটনা আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা হয়ঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। বিভাগীয় সম্পাদক তপেশদার টেবিলে এখনো হয়তো রাখা আছে। স্থানাভাবে ছাপা হচ্ছে না।

এইসময় ডোরবেল বাজল। কর্নেল হাঁক দিলেন–ষষ্ঠী।

একটু পরে ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে উঁকি মেরে বলল–বাবামশাই! সেদিন যে মেয়েছেলেটি এয়েছিলেন, উনি।

কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন–সোহিনীকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস হতভাগা?

ষষ্ঠীচরণের মুখ অদৃশ্য হল। তারপর ড্রয়িংরুমের পর্দা তুলে একজন তরুণী ঢুকল। তার পরনে জিনসের প্যান্ট, গায়ে ধূসর টি শার্ট। চেহারায় তীক্ষ্ণ সৌন্দর্য এবং স্মার্টনেস। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ। ছোট করে ছাঁটা চুল। ধরেই নিয়েছিলাম, সে বাংলায় কথা বলবে না। কিন্তু একটু হেসে সে কর্নেলের উদ্দেশে বলল–স্বর্ণদিদিমার কেস আপনি নিতে আগ্রহী, এ কথা ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু আজ টেলিফোনে আপনার কথা শুনে মনে হল, হঠাৎ আপনি কোনো কারণে আমার প্রত্যক্ষ সাহায্য চান। তাই না?

কর্নেল আস্তে বললেন–বসো সোহিনী। আলাপ করিয়ে দিই।

সোহিনী সোফায় বসে আমাকে একটুখানি দেখে নিয়ে বলল-কর্নেল। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, এই ভদ্রলোক সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। নমস্কার জয়ন্তবাবু।

প্রতি নমস্কার করলুম। কর্নেল একটু হেসে বললেন–তা হলে ওই ভদ্রলোককে তোমার চেনা উচিত।

সোহিনী হালদারমশাইকে দেখে নিয়ে বলল–এক মিনিট! ওঁর হাতে নস্যির কৌটো। খুঁটিয়ে ছাঁটা চুল। আগাথা ক্রিস্টির ডিটেকটিভ এরকুল পোয়ারোর মতো গোঁফের দুই ডগা ছুচোলো। যেন মোম মাখানো আছে। মাই গুডনেস! উনিই সেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার!..

হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে ছিলেন। বলে উঠলেন-আশ্চইর্য! ম্যাডাম আমারে চিনলেন ক্যামনে?

সোহিনী হেসে ফেলল।–বাঃ! নিজে থেকেই ধরা দিলেন আপনি।

 আমি বললুম–মিস রায় তা হলে নিয়মিত দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা পড়েন?

-পড়ি। তবে গত এক বছরে আপনার কেস স্টোরির ভাষা বড় ডাল হয়ে যাচ্ছে জয়ন্তবাবু। আগের মতো সাহিত্যগুণ থাকছে না।

কর্নেল তাঁর বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন–জয়ন্তর দোষ নেই সোহিনী। ওর কাগজে চিফ অফ নিউজব্যুরোর কড়া নির্দেশ, খবরের কাগজের কেস স্টোরি হবে অবজেক্টিভ। পাঠকরা নাকি গাদাগাদা চিঠি লিখে অভিযোগ করেছে, খবরের কাগজে তারা সাহিত্য আশা করে না। যাইহোক তোমাকে বেশিক্ষণ আটকাব না। শুরুতেই তোমার স্বর্ণদিদিমার কেসে, ইংরেজিতে যাকে বলে স্মেলিং আ ডেড র‍্যাট সামহোয়্যার। হ্যাঁ-আই স্মেল!

সোহিনীর মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। সে বলল–আমারও তাই মনে হয়েছে।

-বলো কী! কেন মনে হয়েছে?

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আমাকে টেলিফোনে বলেছিলেন, এই কেসে তীর্থকাকুর যেন বড্ড বেশি মাথাব্যথা। তা ছাড়া উনিই নাকি স্বর্ণদিদিমার সব প্রোপার্টির মালিক হবেন। অথচ বাবার কাছে শুনেছিলুম, এদিকে ক্যাপ্টেন পাণ্ডেও আমাকে আভাসে বলেছেন, স্বর্ণদিদিমার উইলে প্রোপার্টির টু-থার্ড আমার নামে আর বাকি ওয়ান-থার্ডের অর্ধেক তার কর্মচারীদের নামে দেওয়া আছে। বাকি অর্ধেক দেওয়া আছে তীর্থকাকুর নামে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে উইলের অন্যতম সাক্ষী।

কর্নেল হাসলেন। আজ তোমার তীকাকু আমার কাছে এসেছিলেন। প্রায় ঘণ্টাদুই ছিলেন। উনি উঠেছেন হোটেল এশিয়াতে।

–আশ্চর্য! কলকাতা এলে উনি আমাকে রিং করেন। আমাদের বাড়িতেও এসে দেখা করে যান।

এবার শোনো! কথায় কথায় আমি ইচ্ছে করেই ওঁকে যখন বললুম, আপনিই তো আপনার মামিমার সব প্রোপার্টির মালিক, উনি তাতে সায় দিলেন। আচ্ছা সোহিনী, বাই এনি চান্স তুমি কি কোনো রঘুবীরকে চেনো? তিনি নিউ আলিপুরে থাকেন।

সোহিনী ঠোঁট কামড়ে ধরে কথা শুনছিল। বলল–রঘুবীর আচারিয়া?

–হুঁ।

–নাঃ! ও নামে আমি কাউকে চিনি না। কে উনি?

–এখনও জানি না। হোটেল এশিয়ায় উনি তোমার তীর্থকাকুর সঙ্গে দেখা। করতে গিয়েছিলেন। শুধু এটুকু বুঝেছি, উনি তীর্থবাবুর বন্ধু। অবশ্য এমনও হতে পারে ওঁর সঙ্গে তীর্থবাবুর ব্যবসাবাণিজ্যের সম্পর্ক আছে। যাই হোক, আমি ভদ্রলোকের ঠিকানা জানি। খোঁজ নিয়ে দেখব। এবার কাজের কথাটা বলি।

বলুন।

তুমি তোমার স্বর্ণদিদিমার হত্যাকাণ্ডের রহস্য সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে অধিকার দাও। একটু ফর্মালিটির ব্যাপার আছে। মিঃ হালদার তার প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কন্ট্রাক্ট পেপার নিয়ে তোমার কাছে যাবেন। তুমি ওতে সই করে দেবে। তুমি সই করলে মিঃ হালদার আইনসম্মতভাবে তদন্তের অধিকার পাবেন।

সোহিনী একটু চুপ করে থাকার পর বলল–আমার আপত্তি নেই। কিন্তু যতদূর জানি, এটা ওঁর প্রফেশন। কাজেই টাকাকড়ির ব্যাপারটা….

কর্নেল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–ওটা তোমার পক্ষে সামান্য ব্যাপার। তোমার স্বর্ণদিদিমার প্রোপার্টির লোভ তোমার নেই, তা আমি বুঝি। কিন্তু তুমি তো অপরাধীর শাস্তি চাও।

–নিশ্চয় চাই। এ কথা তো আপনাকে আমি বলেছি। মিঃ হালদার কখন যাবেন বলুন?

–এখনই ওঁকে তোমার সঙ্গে যেতে বলতুম। কিন্তু ওঁর কাগজপত্র সঙ্গে নেই। গণেশ অ্যাভেনিউয়ে ওঁর অফিস।

গোয়েন্দাপ্রবর উসখুস করছিলেন। এবার বলে উঠলেন–ম্যাডামের তো গাড়ি আছে। উনি যদি আমার অফিসে যান, কাম হইব স্পিডিলি। আজ রাত্রেই আমি তীর্থবাবুরে ফলো কইরা যামু।

সোহিনী কর্নেলের দিকে তাকাল। দৃষ্টিতে প্রশ্ন ছিল।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। তীর্থবাবু আজ রাতের ট্রেনেই করনগড়ে ফিরবেন।

সোহিনী ঈষৎ দ্বিধার সঙ্গে বললেন–আমি আসলে মিঃ হালদারকে অ্যাডভান্স দেওয়ার কথা ভাবছি।

হালদারমশাই হাত নেড়ে বললেন–সেটা তেমন কিছু না। যা আপনার ইচ্ছা হয়, দেবেন। জাস্ট ফর্মালিটি। পুলিস আমার ইনভেস্টিগেশনে বাধা দিলে আমারে কন্ট্যাক্ট পেপার আর ফি-এর অ্যামাউন্ট দেখান লাগব।

–কোনো অসুবিধে নেই। আমি আপনার অফিস হয়ে আপনাকে নিয়ে আমার সার্কাস অ্যাভেনিউয়ের বাড়িতে যাব। পেমেন্ট করব।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। এটাই ঠিক হবে। তুমি দুটোর মধ্যে আমাকে রিং করে জানাবে। আর হালদারমশাই! আপনি যদি ফোনে আমাকে না পান, ষষ্ঠীকে জানিয়ে দেবেন কখন করনগড় যাত্রা করছেন!

সোহিনীর সঙ্গে প্রাইভেট ডিটেকটিভ হৃষ্টচিত্তে বেরিয়ে গেলেন। একটু পরে বললুম–সোহিনী রায় কী করে জানতে ইচ্ছে করছে কর্নেল!

কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন–সোহিনী টেনিসে দু-বার এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তা ছাড়া রাইফেল শুটিংয়েও ওর সুনাম আছে। ওর ব্যবসায়ী বাবা প্রচুর টাকাকড়ি রেখে গেছে। ওর মা ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপিকা। চিন্তা করো জয়ন্ত। স্বামী তুঘোড় ব্যবসায়ী আর স্ত্রী অধ্যাপিকা। এঁদের একমাত্র সন্তান সোহিনী।

বললুম–সোহিনী তাই নিজস্ব পথে হাঁটতে চেয়েছিল।

এবং সে-পথে সে সাকসেসফুল!

–কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। এমন একটি মেয়ে করনগড়ে একা যেতে ভয় পেয়েছিল কেন? তার স্বর্ণদিদিমা তাকে স্নেহ করতেন। তার প্রমাণ, উইলে দুই-তৃতীয়াংশ সম্পত্তিদান। অথচ সোহিনী…..

কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন–তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। ওর স্বর্ণদিদিমার মৃত্যুর খবর দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে। যখন সহিনী যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে, তখন কেউ উড়ো ফোনে ওকে ভয় দেখায়, ওখানে গেলে তার অবস্থা হবে রানিমার মতো। কথাটা সোহিনী ক্যাপ্টেন পাণ্ডেকে জানিয়েছিল। তাই উনি ওকে যেতে নিষেধ করেছিলেন। আমার কাছে আসতে বলেছিলেন। আমি ওকে বলেছিলুম, কিছুদিন অপেক্ষা করো। তারপর বরং আমিই তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাব।

–এ যে দেখছি আরব্য উপন্যাস নয়, মহাভারতের মতো জটিল উপাখ্যান।

কর্নেল হাসলেন।–আপাতদৃষ্টে জটিল। কিন্তু কাঠামোটি সরল। সেটা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে।

–আচ্ছা কর্নেল, সোহিনীর বাড়িতে গার্জেনের মতো কেউ নিশ্চয় আছেন?

–তুমি বুদ্ধিমান। ওর পিসিমা আছেন। ভদ্রাহিলা বালবিধবা। তবে ওঁকে রায়বাঘিনী বলতে পারো। বলে তিনি দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালেন। মাই গুডনেস! একটা বেজে গেছে। জয়ন্ত! তুমি স্নান করে নাও। আজ আমার স্নানের দিন নয়। ঠিক দেড়টায় আমরা খেয়ে নেব। একঘণ্টা বিশ্রাম করে একসঙ্গে বেরুব।

-কোথায়?

যথাসময়ে জানতে পারবে।

দুটো তিরিশে বেরুনোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই হঠাৎ ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। কর্নেল বলেছিলেন–বৃষ্টিটা বেড়ে গেলে সমস্যা। রাস্তায় জল জমে যাবে। তোমার পেট্রোলকারের ওপর ভরসা করা যাবে না। দেখা যাক।

বৃষ্টিটা ক্রমশ বেড়ে গিয়েছিল। প্রায় একঘণ্টা পরে যখন থামল, তখন কর্নেল ষষ্ঠীচরণকে রাস্তার অবস্থা দেখতে পাঠালেন। কিছুক্ষণ পরে ষষ্ঠী ফিরে এসে খবর দিল, রাস্তায় একহাঁটু জল।

কর্নেল বিরক্ত হয়ে বললেন–প্রতি ব্যায় ইলিয়ট রোড এলাকা ছেড়ে তোমার মতো সল্টলেক কিংবা অন্যত্র চলে যাব ভাবি। কিন্তু বর্ষা চলে গেলে কথাটা ভুলে যাই। আসলে এ একটা অচ্ছেদ্য মায়া। যেখানে জন্মেছি এবং অবসর নেওয়ার পর এত বছর ধরে বাস করছি, সেখান ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে মনে শান্তি পাব না।

জানালার পর্দা তুলে আকাশ দেখে নিয়ে বললুম–আর বৃষ্টির চান্স নেই। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। রাস্তার জল কি একঘন্টার মধ্যে নেমে যাবে না?

কর্নেল আমার পাশে এসে উঁকি মেরে রাস্তা দেখে বললেন–ন্তত চারটের আগে তোমার গাড়ি বের করার ঝুঁকি আছে।

–চারটেতে বেরুলে কি আপনার অসুবিধে আছে?

কর্নেল কী যেন একটা চিন্তা করলেন। তারপর এগিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করলেন। সাড়া এলে বললেন–কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ সোমের সঙ্গে কথা বলতে চাই। মিঃ সোম? না। না। নিছক আলস্য। আমার এ বয়সে আলস্যকে প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু আলস্য। সিন্দবাদ নাবিকের গল্পের সেই বুড়ো। কাঁধে চেপে বসলে নামানো ঘায় না। হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন। তো আপনাদের ওখানে বৃষ্টির অবস্থা কি? এখানকার অবস্থা সাংঘাতিক …না। বৃষ্টির খবর জানবার জন্য ফোন করিনি। আচ্ছা মিঃ সোম, একটা কথা জানতে চাই। প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল। …হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন। এবার শুনুন। আপনাদের পারিজাত হাউজিং কমপ্লেক্সের সি ব্লকে অ্যাপার্টমেন্ট সি-১৭ তে রঘুবীর আচারিয়া নামে ভদ্রলোক থাকেন। আপনি না চিনতেই পারেন। বরং তা হলে ওই ব্লকে আপনার আত্মীয় ভদ্রলোককে ফোন করে জেনে নিন। প্লিজ মিঃ সোম। ওঁকে একটু জানিয়ে দেবেন, আপনার কোনো ক্লায়েন্টের স্বার্থে মিঃ আচারিয়া সম্পর্কে এই ইনফরমেশনগুলো আপনার দরকার। …হ্যাঁ, আমি বলছি। আপনিও নোট করে নিন। এক– মিঃ আচারিয়া কী করেন? দুই ওঁর কোনো কাজ-কারবার থাকলে, সেটা কোথায়? তিন– ওঁর বিশেষ কোনো হবি আছে কি না এবং থাকলে সেটা কী? চার– উনি কি অ্যাপার্টমেন্টে সপরিবারে থাকেন, নাকি একা? আপাতত এই চারটেই যথেষ্ট। আপনি এখনই যোগাযোগ করে জেনে নেবেন। তারপর আমাকে টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। ….আমি বাড়িতেই থাকছি। …আপনার কৌতূহল স্বাভাবিক। তবে সব কথা সময়মতো বলব। মুখোমুখিই বলব। রাখছি। …

কর্নেল রিসিভার রেখে ইজিচেয়ারে বসলেন।–সহাস্যে বললেন–আমাকে সত্যিই বাহাত্তুরে ধরেছে জয়ন্ত! হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট মিঃ শিলাদিত্য সোমের কথা ভুলে গিয়েছিলুম। উনি রঘুবীর আচারিয়ার ডেরায় গিয়ে আমাকে একরাশ মিথ্যে অজুহাত তৈরি করতে হত। তাছাড়া রিস্কও ছিল। কী ধরনের লোক এই আচারিয়া, তা জানি না। করনগড়ের তীর্থব্রত সিংহের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক তাও জানি না। আশা করছি, ওই চারটে ইনফরমেশন থেকেই রঘুবীর আচারিয়ার মোটামুটি একটা আদল পেয়ে যাব।

বললুম–আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। তীর্থব্রত সিংহের সঙ্গে কেউ হোটেল এশিয়ায় দেখা করলে তিনি আপনার সন্দেহভাজন কেন হবেন?

–নিজেই জানি না জয়ন্ত, রঘুবীর আচারিয়া সম্পর্কে আমার কেন এত তীব্র কৌতূহল।

— হাসতে হাসতে বললুম–বরং বলুন আপনার সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া সেই ইনটুইশন। আপনি নিজেই নিজের এই ইনটুইশন সম্পর্কে সাতকাহন করে বলেন।

–না ডার্লিং! কর্নেল মৃদুস্বরে বললেন। আমার করনগড়ের বন্ধু ক্যাপ্টেন হরিচরণ পাণ্ডে আমাকে শুধু একটা আভাস দিয়েছেন তীর্থব্রত সিংহ সম্পর্কে আমি যেন সতর্ক থাকি। তাই এটা নিছক সতর্কতা।

–কী আশ্চর্য! মিঃ সিংহ যদি করনগড়ের রানিমাকে হত্যার চক্রান্ত করে থাকেন, তা হলে কেন তিনি শ্মশানের চিতা থেকে ওঁর ডেডবডি তুলে পুলিশকে পোস্টমর্টেম করতে বলবেন? মিঃ সিংহই তো তার মামিমার ঠোঁটের পাশে রক্তের ছিটেলাগা লালা গড়াতে দেখেছিলেন!

–করনগড়ে না পৌঁছুনো অবধি আমার কাছে ঘটনাটা আগাগোড়া অস্পষ্ট থেকে যাচ্ছে জয়ন্ত। আমি এখনও কোনো বিষয়ে সিওর নই। এটা ইজিচেয়ারে বসে অঙ্ক কষার কেস নয়।

ষষ্ঠীচরণ কফি নিয়ে এল। সঙ্গে একটা চিনেমাটির থালাভর্তি পাপরভাজা। সে মুচকি হেসে বলল–বাবামশাই! আবার বর্ষাবে মনে হচ্ছে। আবার আকাশ কালো করে মেঘ উঠে আসছে।

সে চলে গেলে পাঁপরভাজা তুলে নিয়ে বললুম–মিঃ সিংহের হাওড়া স্টেশন পৌঁছুতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু হালদারমশাই থাকেন ডুবো এলাকায়। উনি মিঃ সিংহকে ফলো করতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না।

কর্নেল বললেন–সোহিনী ফোনে কী বলছিল ভুলে যেও না জয়ন্ত। জোর করে সে প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোককে এক হাজার টাকা অ্যাডভান্স গছিয়ে দিয়েছে। কাজেই হালদারমশাই তাঁর ডুবো এলাকা থেকে দরকার হলে সাঁতার কেটে পাড়ি দেবেন। তা ছাড়া ভুলে যেও না, উনি পূর্ববঙ্গের মানুষ এবং নিজেকে জলপোকা বলেন।

ঠিক সেই সময় কাকতলীয় ব্যাপারটা ঘটে গেল। টেলিফোন বেজে উঠল এবং কর্নেল সাড়া দিয়েই বললেন–বলুন হালদারমশাই! …বাঃ! আপনার বুদ্ধির প্রশংসা করছি। …আঁ? বলেন কী! দাড়ি-পরচুলা? …ঠিক করেছেন। ছদ্মবেশ না ধরলে মিঃ সিংহের চোখে পড়ার চান্স ছিল। কিন্তু সাবধান! ফাস্টক্লাসের একই কুপে যেন উঠবেন না। যদি দেখেন, রিজার্ভেশন একই কু্যপের বার্থে হয়েছে, তখনই আপনি চেকারকে ম্যানেজ করে নেবেন। …হা সোহিনীর চিঠি দেখলে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আপনার ইচ্ছে অনুসারে থাকবার ব্যবস্থা করে দেবেন। …ঠিক আছে। উইশ ইউ গুড লাক।

রিসিভার রেখে কর্নেল বললেন–জয়ন্ত। হালদারমশাইকে তুমি যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করো না কেন, উনি একজন প্রাক্তন পুলিস অফিসার। উনি বৃষ্টি শুরু হতেই ট্যাক্সি করে হাওড়া স্টেশনে চলে গেছেন। রাত দশটা পঁচিশে ট্রেন। ফার্স্ট ক্লাসের কম্পার্টমেন্ট প্রায় ফাঁকাই যায়। কাজেই ওঁর রিজার্ভেশন পেতে অসুবিধে হয়নি। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি এঁটেছেন। মাথায় মানানসই পরচুলা। নেকটাই এঁটেছেন। হাতে ব্রিফকেস। পরচুলার ওপর টুপি। মূর্তিটা কল্পনা করো জয়ন্ত!

হেসে ফেললুম। –কিন্তু ওঁর মুখের ভাষা?

ভাষা কোনো ব্যাপার নয়। তবে আমার ধারণা, উনি ইংরেজিতেই কথাবার্তা বলবেন। তুমি তো জানো, ইংরেজিতে কাজ চালানোর মতো স্পিকিং পাওয়ার ওঁর আছে।

–বাজি রেখে বলতে পারি, উনি দৈবাৎ মুখ ফসকে পূর্ববঙ্গীয় ভাষার একটা শব্দ উচ্চারণ করলেই তীর্থব্রত সিংহের কাছে ধরা পড়ে যাবেন।

–করনগড়ে কিছুদিন মিঃ সিংহকে উনি এড়িয়ে চলবেন। তারপর যথাসময়ে ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজমূর্তিতে দেখা দেবেন।

–আপনাকে হালদারমশাই তা-ই বললেন বুঝি?

–হ্যাঁ। উনি রীতিমতো প্ল্যানপ্রোগ্রাম করে পা বাড়িয়েছেন।

ষষ্ঠীচরণের পূর্বাভাস ব্যর্থ করে বৃষ্টি আর এল না। আবহাওয়া কদিন থেকে ছিল বিরক্তিকর। ভ্যাপসা গরমে মানুষজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। বিকেলে টানা প্রায় একঘণ্টার বৃষ্টি এবং তারপর স্নিগ্ধ ঠাণ্ডা বাতাস শরীরকে প্রচুর আরাম দিচ্ছিল।

সন্ধ্যা ছটায় ষষ্ঠী কী কাজে বেরিয়েছিল। ফিরে এসে বলল–দাদাবাবু। রাস্তার জল নেমে গেছে।

কর্নেল চোখ পাকিয়ে বললেন–তোর দাদাবাবুর গাড়ি বেরুবে না।

সেই সময় আবার টেলিফোন বাজল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন–বলছি। …হ্যাঁ, বলুন মিঃ সোম! ..আমার এলাকায় জল নেমে গেছে। কেন একথা…তা হলে তো আমার পরম সৌভাগ্য! আপনারা আসুন। অনেকদিন আড্ডা দেওয়া হয়নি। এই সুন্দর সন্ধ্যায় আপনারা সুস্বাগত।

তিনি রিসিভার রেখে বললেন–জয়ন্ত! অ্যাডভোকেট মিঃ শিলাদিত্য সোম তার আত্মীয় অভিষেক বসুকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসছেন। টেলিফোনে নাকি সব কথা বলা যাবে না।

–তার মানে রঘুবীর আচারিয়া নামক বিষয়টি একটু জটিল?

–দেখা যাক! অবশ্য আমাকে চর্মচক্ষে দর্শনের আগ্রহ অভিষেক বসুর নাকি তীব্র।

নিউ আলিপুর থেকে কর্নেলের পরিচিত অ্যাডভোকেট শিলাদিত্য সোম আর তার আত্মীয় অভিষেক বসু এসে পৌঁছলেন সন্ধ্যা সাতটায়।

মিঃ সোম বললেন–অভিষেকদা! ইনিই সেই কিংবদন্তি পুরুষ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। তারপর তিনি আমার দিকে ঘুরে সহাস্যে বললেন–কর্নেল পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই আমি চিনেছি। অভিষেকদা চিনেছে কিনা দেখা যাক।

অভিষেক বসু ভুরু কুঁচকে মিটিমিটি হেসে বললেন–অবশ্যই চিনেছি।

যেখানে কর্নেলসায়েব, সেখানেই সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। নমস্কার! দুজনকেই নমস্কার!

কর্নেল বললেন–বসুন মিঃ সোম! মিঃ বোস! বসুন! আপনিও যে মিঃ সোমের সঙ্গে আসছেন, তাই-ই শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরে ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। তার চেয়ে বড় কথা, মিঃ সোমের মাধ্যমে আপনার বক্তব্য শোনার চাইতে সরাসরি আপনার মুখ থেকে শোনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশি। তবে আগে কফি। তারপর অন্যকিছু।

মিঃ সোম হাসলেন।–কর্নেলসায়েবের ওই এক মন্ত্র অভিষেকদা। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।

দুই প্রৌঢ়কে দেখে আমার কৈশোরে দেখা সিনেমা লরেল হার্ডির কথা মনে পড়েছিল। তবে আচার ব্যবহারে নয়, চেহারায়। মিঃ সোম প্রায় কর্নেলের মতো তাগড়াই। আর মিঃ বসু রোগা। উচ্চতা সওয়া পাঁচ ফুট হবে কি না সন্দেহ। মিঃ সোমের পরনে প্যান্ট আর স্পোর্টিং গেঞ্জি। মিঃ বসুর পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। তবে তাঁর গোঁফ দেখার মতো লম্বা।

ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন–মিঃ বোসের সঙ্গে আপনার আত্মীয়তা আছে মিঃ সোম। আমার ধারণা, আত্মীয়তার সম্পর্কটা সুমিষ্টধরনের।

অভিষেক বসু হেসে উঠলেন।–এইজন্যই কর্নেলসায়েব আমার কাছে কিংবদন্তি পুরুষ। দ্যাখো হে সোম। কেমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। দুজনকে দেখেই ধরে ফেলেছেন আমরা পরস্পর কিসে বাঁধা আছি।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–সম্ভবত আপনাদের শ্বশুর-শাশুড়ি একই ভদ্রলোক ও একই ভদ্রমহিলা!

–ব্রাভো! শীর্ণকায় মিঃ বসু প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন!-কর্নেলসায়েব। আপনি হয়তো সোমের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই একদফা গোয়েন্দাগিরি করে নিয়েছেন।

–না মিঃ বোস! নিছক অনুমান!

–অসম্ভব! সোম হয় তো আগে কোনো সময়ে আমার কথা আপনাকে বলে থাকবে।

মিঃ সোম বললেন–নাঃ! কর্নেলের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের। কিন্তু তোমার প্রসঙ্গ ওঠার কোনো চান্স ছিল না। তো কর্নেলসায়েবকে জিজ্ঞেস করছি। বলুন তো কোন সূত্রে আপনি অভিষেকদার সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক টের পেলেন?

কর্নেল বললেন–স্মৃতির সূত্রে।

তার মানে?

–বেঙ্গল ক্লাবে মহাবীর আগরওয়ালের পার্টিতে আপনি আপনার স্ত্রী মিসেস মালবিকা সোমের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সকৌতুকে বলেছিলেন, এর পর কোথাও যদি প্রায় এই চেহারার কোনো মহিলাকে দেখতে পান, সাবধান। তাঁকে যেন মিসেস সোম বলে আলাপ করতে যাবেন না। মালবিকার সঙ্গে তার দিদি পারমিতাকে অনেকেই গুলিয়ে ফেলে। এর একটা বড় কারণ ওর দিদিও থাকে একই হাউজিং কমপ্লেক্সে। আমি এই স্মৃতির সূত্রেই কতকটা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়েছিলুম।

দুই ভদ্রলোক একসঙ্গে হেসে উঠলেন। তারপর মিঃ বোস বললেন–এই একটা সমস্যা সত্যি আছে। পারমিতা মালবিকার চেয়ে মাত্র এক বছরের বড়। কিন্তু দেখলে মনে হবে দুই যমজ বোন।

কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। অভিষেকবাবু পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করে বললেন–সোম আর দুই বোন মিলে আমার সিগারেট খাওয়ার জন্য ভয়ংকর সব ভয় দেখায়। অথচ কর্নেলসায়ের এই বয়সেও চুরুট খান।

তিনি সিগারেটের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। আমি বললুম– আগে প্রচুর সিগারেট খেতুম। জোর করে ছেড়ে দিয়েছি।

–পেরেছেন? আশ্চর্য! আমি পারলুম না।

মিঃ সোম ঘড়ি দেখে বললেন–এবার কাজের কথা তোক অভিষেকন্দা। কর্নেলসায়েবের মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত হবে না। কর্নেলসায়েব! আপনিই প্রশ্ন করুন।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–আমার প্রথম প্রশ্ন মিঃ বোস সম্পর্কে। বাই এনি চান্স আপনি কি শিক্ষকতা করতেন? ধরা যাক, অধ্যাপনা?

মিঃ সোম বললেন–অভিষেকদা। কী বুঝছ বলো?

মিঃ বোস বললেন–বুঝেই তো এসেছি। হা কর্নেলসায়েব। আমি অধ্যাপনা করতুম। বছর পাঁচেক আগে রিটায়ার করেছি। আমি পড়াতুম রাষ্ট্রবিজ্ঞান।

মিঃ সোম বললেন–শুধু অধ্যাপনা নয়। অভিষেকদা ছাত্রদের জন্য অনেক টেক্সটবুকও লিখেছে। অধ্যাপক এ বোস নামে টেক্সটবই দেখলেই বুঝবেন, এই সেই অধ্যাপক। বই থেকে ওর আয় আমার দ্বিগুণ।

কর্নেল বললেন–এবার বলুন রঘুবীর আচারিয়া কী করেন?

মিঃ বোস বললেন–ব্র্যাবোর্ন রোডে আচারিয়ার এক্সপোর্টের ইমপোর্ট কারবার আছে। মেক্যানিকাল পার্টসের কারবার। আমি অবশ্য ওঁর অফিসে কখনও যাইনি। তবে আমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের কারণ আমরা একটা চওড়া করিডরের দুই প্রান্তে মুখোমুখি থাকি। আপাতদৃষ্টে বিনয়ী, ভদ্র, অমায়িক।

–ওঁর বিশেষ কোনো হবি লক্ষ করেছেন কি?

–হ্যাঁ। ওঁর হবি দেশবিদেশের প্রাচীন জিনিস সংগ্রহ। ওঁর সংগ্রহশালা আমাকে উনি দেখিয়েছেন। ধাতু ও পাথরের মূর্তি, পানপাত্র, বর্শার ফলা ব্রোঞ্জের! চিন্তা করুন, প্রাক-লৌহযুগের অস্ত্র। এছাড়া অজানা ভাষার হরফে খোদাই করা। পাথরের ফলক, রঙিন ছবি আঁকা মাটির পাত্রের খানিকটা অংশ। আমাকে উনি বলেছিলেন, বিদেশে কোথাও গেলেই এইসব জিনিস তিনি সংগ্রহ করে আনেন।

–মিঃ আচারিয়ার ফ্যামিলি? মিঃ বোস চোখে হেসে চাপা স্বরে বললেন–একজন মেমসায়েব মাঝেমাঝে এসে আচারিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে থাকে। আমার সঙ্গে একবার আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মেমসায়েব নাকি তার স্ত্রী। নাম ন্যান্সি আচারিয়া। অ্যামেরিকার মহিলা। আমি বিশেষ কৌতূহল দেখাইনি। কিন্তু আচারিয়া নিজেই বলেছিলেন মিসেস আচারিয়া বিহারে কোনো একটা জায়গায় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত আছেন। জায়গাটার নাম আজই কাগজে বেরিয়েছে সোম! তুমিই সেদিন বলছিলে বেড়ালের শোকে সেখানকার এক বৃদ্ধা রানিমা নাকি মারা গেছেন।

মিঃ সোম বললেন–কর্ণগড়। তবে কাগজে করনগড় লিখেছে!

আমি চমকে উঠলেও মুখ খুললাম না। কর্নেল বললেন–মিঃ সোম কি করনগড়ে কখনও গেছেন?

শিলাদিত্য সোম বললেন–যাইনি। তবে কর্ণগড়ের রাজার সঙ্গে স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর পুরোনো একটা কেস হিস্ট্রি অর্থাৎ একটা মামলার পুরো প্রসিডিং আমার লাইব্রেরিতে আছে। আপনি নিশ্চয় জানেন, আমার প্রোফেশনে এইসব প্রসিডিং এবং কোর্টের জাজমেন্ট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্টের অনেক জাজমেন্ট একই ধরনের কেসে প্রিসিডেন্স হিসেবে কাজে লাগে। যাই হোক খুব ইন্টারেস্টিং কেস।

কর্নেল বললেন করনগড় আসলে কর্ণগড়ই। হিন্দিভাষীদের উচ্চারণ পদ্ধতি বাংলার মতো নয়। মিঃ বোস কি করনগড়ের রানিমার মৃত্যুর খবর নিয়ে আজ মিঃ আচারিয়ার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেছিলেন?

অভিষেক বসু বললেন–সোমের কাছে খবরটা অদ্ভুত মনে হয়েছিল। তাই টেলিফোনে আমাকে ওটা পড়তে বলেছিল। খবরটা পড়ায় আমি ভেবেছিলুম মিঃ আচারিয়াকে জানাব। কারণ তাঁর স্ত্রী ন্যান্সি আচারিয়া সেখানে থাকেন। কিন্তু ওঁর অ্যাপার্টমেন্টের কাজের লোক গুণধর বলল, সায়েব বেরিয়েছেন। তারপর আর অবশ্য ওটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। কর্নেলসায়েব। খবরটা নিশ্চয় পড়েছেন?

–পড়েছি।

জয়ন্তবাবুদের কাগজেই বেরিয়েছে। অদ্ভুত খবর নয়?

–কেন অদ্ভুত?

–ছ-টা বেড়াল পুষতেন ভদ্রমহিলা। হঠাৎ ছ-টা বেড়ালই একসঙ্গে মারা গেল। আর তাই দেখে তিনিও শোকে হার্টফেল করে মারা গেলেন। নিশ্চয় কেউ বিষ খাইয়ে বেড়ালগুলোকে মেরে ফেলেছিল। কর্নেলসায়েব! এতে এক রহস্যের ঝাঁঝ আছে না?

কীসের রহস্য বলে আপনার ধারণা?

–যে বেড়ালগুলো মেরেছে, সে জানত বৃদ্ধা রানিমা এতে ভীষণ শোকাহত হবেন এবং সেই শোক সামলাতে পারবেন না।

মিঃ সোম একটু নড়ে বসলেন।মাই গুডনেস! ইনি নিশ্চয় কর্নগড়ের সেই রাজার স্ত্রী, যার মামলার ইতিহাস আমি পড়েছি। তা হলে কি রাজাসায়েবের প্রতিপক্ষ এতকাল পরে এভাবেই প্রতিশোধ নিল? কিন্তু এক বৃদ্ধাকে এভাবে মেরে ফেলে প্রতিশোধ নেওয়াটা আমার যুক্তিগ্রাহ্য ঠেকছে না। প্রতিশোধের স্পৃহা বংশপরম্পরায় কি থাকে?

 মিঃ বোস বললেন–মিঃ আচারিয়াকে জিজ্ঞেস করলে তিনি প্রকৃত ঘটনা তার স্ত্রীর কাছে জানতে পারবেন।

কর্নেল বললেন–প্লিজ মিঃ বোস। আমার অনুরোধ আপনি এ বিষয়ে মুখ বুজে থাকবেন। মিঃ সোম! আপনিও হাউজিং কমপ্লেক্সে কারও সঙ্গে এই নিয়ে কোনো আলোচনা করবেন না।

দুজনে পরস্পর তাকাতাকি করলেন। তারপর মিঃ সোম বললেন, বুঝতে পেরেছি। আপনি কর্নগড়ের রানিমার কেস হাতে নিয়েছেন। আপনি এ কেসে অভিষেকদার সাহায্য পাবেন।

মিঃ সোমের কথা শোনার পর কর্নেল একটু হেসে বললেন–মিঃ বোসকে আমি কখনই তার প্রতিবেশী ভদ্রলোকের পিছনে গোয়েন্দাগিরি করতে বলছি না। সেটা ওঁর পক্ষে অশোভন ব্যাপার হবে।

অভিষেক বোস চোখে একটা কৌতুকের ভঙ্গি করে বললেন–আমি এখন নিষ্কর্মা কেঁকি। তবে কর্নেল যদি ধান ভানতে বলেন ভানব। তা কাজটা যত অশোভন হোন না কেন!

কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এগিয়ে গিয়ে ড্রয়ার-আলমারি থেকে ওপরসারির একটা ড্রয়ার টেনে একটা ফাইল বের করলেন এবং ফাইলটা নিয়ে এসে ইজিচেয়ারে বসলেন। বললেন–আপাতত একটা ব্যাপারে আমি মিঃ বোসের সাহায্য চাইছি।

মিঃ বোস সাগ্রহে বললেন–বলুন কী সাহায্য করব?

কর্নেল ফাইলটা খুলে বললেন–এতে আমি আমার হবিসংক্রান্ত খবরের কাটিং সাদা কাগজে এঁকে রাখি। এই যে কাটিং দেখছেন, এগুলো পাঁচ বছর আগেকার একটা ইংরেজি দৈনিক থেকে নেওয়া। খবরের ডেটলাইন ১০ আগস্ট। তার মানে ১১ আগস্টের কাগজ। ডেটলাইন সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক।

মিঃ বোস উঁকি মেরে কাটিং দেখার চেষ্টা করে বললেন–খবরটা কীসের?

কর্নেল হাসলেন। খবরটা তো বলেছি, আমার হবিসংক্রান্ত। আগে আপনাকে সংক্ষেপে খবরের বিষয়টা বলি। পি টি আই সূত্রে পাওয়া এই খবরে বলা হয়েছে, সিকিমের ইউকসম অঞ্চলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্ক নামে সংরক্ষিত অভয়ারণ্যের রক্ষীরা ৩০ জুলাই তিনজন বিদেশিকে গ্রেফতার করেছিল। তারা ১৯৭২ সালে ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন আইন লঙ্ঘন করে প্রায় কুড়ি কিলোগ্রাম প্রজাপতি আর নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ ধরেছিল।

দুই ভায়রাভাই একসঙ্গে বলে উঠলেন–কুড়ি কিলোগ্রাম?

–হ্যাঁ। তো তাদের মধ্যে দুজন রুশ নাগরিক ছিল। তাদের নাম আমোসোভ ওলেগ এবং সিনিয়ায়েভ ভেতার। এরা দুজনে পুরুষ। তৃতীয় জন মহিলা এবং মার্কিন নাগরিক। তার নাম ন্যান্সি বার্নার্ড। বাড়ি লস অ্যাঞ্জেলসে। কোর্টে হাজির করানো হলে রুশ নাগরিকরা বলেন, তাঁরা আণবিক জীববিজ্ঞানী। গবেষণার প্রয়োজনে এ কাজ করেছেন। তারা ওই আইনের কথা জানতেন না। ন্যান্সি বার্নার্ড বলেন, তিনি একজন লেপিডপটারিস্ট অর্থাৎ প্রজাপতি বিশেষজ্ঞ। তিনি ওই পাহাড়িজঙ্গলে দুর্লভ প্রজাতির প্রজাপতি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের উত্তরে ন্যান্সি জানান, ইউকসাম জঙ্গলে তিনি প্যাপিলিও অ্যাস্টিমাচুস প্রজাতির দুটি প্রজাপতি দেখতে পান। তার বিস্মিত হওয়ার কারণ ছিল। এই প্রজাতির প্রজাপতি আফ্রিকার জঙ্গলের অধিবাসী। তবে প্রজাপতিদের আয়ু কম হলেও এই ধরনের কিছু প্রজাতি পরিযায়ী। এরা সাধারণত জাহাজের মাস্তুলে বা কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে থেকে দেশান্তরে পাড়ি দেয়। পাড়ি দিতে স্বভাবত দুই-তিন বা চার প্রজন্মও সময় লাগে। পরিযায়ী প্রজাপতিরা পুরুষ ও স্ত্রী একত্রে থাকে।

মিঃ সোম বললেন–ভেরি ইন্টারেস্টিং! তারপর ম্যাজিস্ট্রেট কী করলেন?

মিঃ বোস বললেন–আমার যে ন্যান্সি নামে খটকা বেধেছে!

কর্নেল বললেন–ম্যাজিস্ট্রেট ন্যান্সি বার্নার্ডকে নিঃশর্তে মুক্তি দেন। রুশ নাগরিকদের শাস্তি হয়েছিল, নাকি পরে তারা মুক্তি পেয়েছিল, জানি না। কারণ এই খবরের আর ফলোআপ করা হয়নি।

মিঃ বোস বললেন–সেই ন্যান্সি পরে মিসেস আচারিয়া হয়েছিল কিনা আমাকে গোয়েন্দাগিরি করে জানতে হবে। এই তো কর্নেলসাহেব?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তার আগে জানতে চাই, আপনি পড়াশোনা করতে চশমা ব্যবহার করেন কি না?

–হ্যাঁ। চশমা লাগে। চশমা পকেটেই আছে। আমার লং সাইট ভালো। শর্ট সাইট খারাপ।

–অবশ্য আমার কাছে উৎকৃষ্ট ম্যাগনিফাইং গ্লাস আছে। তার আগে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় আপনি এই খবরের সঙ্গে দেওয়া ছবিটা দেখুন। ধারে বনরক্ষী আর সশস্ত্র পুলিশ। মাঝখানে বাঁ দিক থেকে দুই রুশ নাগরিক। ডান দিকে ন্যান্সি বার্নার্ড।

বলে কর্নেল টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিয়ে খবরের কাটিং আঁটা কাগজটা ফাইল থেকে খুলে মিঃ বোসকে দিলেন। মিঃ বোস চশমা পরে নিয়ে ছবিটা দেখতে দেখেতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তিনি শ্বাসপ্রশ্বাসের মধ্যে বললেন–এবার ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা দিন তো প্লিজ!

কর্নেল তাকে টেবিলের ড্রয়ার থেকে তাঁর আতস কাচটা বের করে দিলেন।মিঃ বোস আতস কাচ দিয়ে ছবিটা দেখার পর চাপা স্বরে বলে উঠলেন–হ্যাঁ। এই সেই মেমসায়েব।

মিঃ সোম ধমকের সুরে বললেন– অভিষেকদা! সিয়োর হয়ে বলো। আমাদের চোখে সব মেমসায়েবকেই একইরকম লাগে!

–কী বলছ তুমি সোম? অভিষেক বোস সোজা হয়ে বসলেন।

আমি সিয়োর। টল ফিগার। ঝুঁটিবাঁধা চুলের স্টাইল। পাতলা ঠোঁটের হাসি। খবরের কাগজে আজকাল স্পষ্ট ছবি ছাপা হয়।

–অভিষেকদা! এই ছবিটা কিন্তু পাঁচ বছর আগে তোলা।

–তাতে কী হয়েছে? আমিও তো মিসেস আচারিয়াকে প্রায় তিনবছর ধরে দেখে আসছি। মেমসায়েবদের চেহারা বা ফিগার আমাদের মেয়েদের মতো অত শিগগির বদলায় না।

কর্নেল বললেন–তা হলে আপনি সেন্ট পারসেন্ট সিয়োর? নাকি একটু দ্বিধা থেকে যাচ্ছে?

–নো দ্বিধা। কর্নেলসায়েব! আমি হান্ড্রেড পারসেন্ট সিয়োর। তা ছাড়া আমি জানি, রঘুবীর আচারিয়ার কারবারের একটা ব্রাঞ্চ গ্যাংটকে আছে। আমাকে কতবার উনি বলেছেন, গ্যাংটকে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছে হলে আমাকে বলবেন। সেখানে তার একটা রেস্টহাউস আছে।

মিঃ সোম মিটিমিটি হাসছিলেন। এবার বললেন–ইস্! কথাটা আমাকে জানাওনি কেন? খামোকা একগাদা টাকা খরচ করে গতবার গ্যাংটক ঘুরে এলুম!

মিঃ বোস তাঁর কথায় কান না দিয়ে বললেন–কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কর্নেলসায়েব। আপনি এই খবরের কাটিং রেখেছিলেন কেন?

কর্নেল বললেন–আপনি আমার হবির কথা তো জানেন মিঃ বোস। আমিও যে একজন লেপিডপটারিস্ট! প্রজাপতি সম্পর্কে আমারও প্রচণ্ড বাতিক আছে। বিশেষ করে ওই আফ্রিকান প্রজাতির প্রজাপতি রেয়ার স্পিসিজের মধ্যে পড়ে। বিশ্বে আর কোনো প্রজাপতির ডানার মাপ এত লম্বা নয়। এক ডানার প্রান্ত থেকে অন্য ডানার প্রান্ত অবধি মাপ দশ ইঞ্চি। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এটা জানা গিয়েছিল। তবে সেটা ছিল পুরুষ প্রজাপতি। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ইংলন্ডের লর্ড রথসচাইল্ড এই প্রজাতির স্ত্রী প্রজাপতিকে আবিষ্কার করেছিলেন।

মিঃ সোম সহাস্যে বললেন–আমার আইনের বই পড়ার চেয়ে কর্নেলসায়েবের প্রজাপতির বই পড়া অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

মিঃ বোস ঘড়ি দেখে বললেন–এই রে! পৌনে নটা বাজছে! ওহে সোম! তোমারও তো নেমন্তন্ন! কর্নেলসায়েব! এবার আমাদের উঠতে হচ্ছে। আমাদের গিন্নিরা এতক্ষণে সেজেগুজে তৈরি হয়ে যে-যার ব্যালকনিতে বসে বেলুনফোলা হয়ে ফুলছে।

মিঃ সোম বললেন–পার্টি তো রাত দশটায়। তা ছাড়া আমাদেরই পারিজাত আবাসনের কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠান। তবে এখনই ওঠা উচিত।

মিঃ বোস বললেন–কর্নেলসায়েব! অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হচ্ছে। তবে এর পর যদি আমাকে আপনার প্রয়োজন হয়, টেলিফোনে জানাবেন। আর যাওয়ার সময় আবার বলে যাচ্ছি, ওই মেমসায়েবই মিঃ রঘুবীর আচারিয়ার স্ত্রী মিসেস ন্যান্সি আচারিয়া!

দুই ভায়রাভাই চলে যাওয়ার পর বললুম–আজ আপনি সকালে বই খুলে যে প্রজাপতির ছবি আতসকাঁচে খুঁটিয়ে দেখছিলেন, সেটা ওই প্রজাপতি। তাই না?

কর্নেল কাটিং আঁটা কাগজটা ফাইলবন্দি করে ড্রয়ারে রেখে এলেন। তারপর ইজিচেয়ার বসে বললেন–তুমি ঠিকই ধরেছ।

–কিন্তু এ-ও তো একটা অদ্ভুত রহস্য! কেন আপনি ওই প্রজাপতির দিকে আজ মনোযোগ দিয়েছিলেন?

কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন–তোমার স্মরণশক্তি এত কম কেন জয়ন্ত? তোমাকে কি বলিনি করনগড়ে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে ওঁর ফার্মের এলাকায় খুব লম্বা ডানাওয়ালা অদ্ভুত গড়নের প্রজাপতি দেখেছিলেন?

অগত্যা বলতেই হল–হয়তো বলেছিলেন। এত সব রহস্যের পর রহস্যের স্কুপে তা ঢাকা পড়েছে।…

পরদিন সোমবার কী কী ঘটেছিল, তা আমার নোটবই থেকে অবিকল তুলে দিচ্ছি।

* সকাল ১০টা ১৫ মিনিটের সোহিনীর টেলিফোন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে প্রাঃ ডিঃ– কে তার নতুন বাংলোতে রেখেছেন। বাঙালিটোলার রাজবাড়ির পশ্চিমে। নৈনি নদীর ব্রিজ পেরিয়ে টিলার গায়ে ক্যাঃ পাণ্ডের নতুন বাংলো। কেয়ারটেকার আছে। চৌকিদার আছে। প্রাঃ ডিঃ-র অসুবিধে হবে না।

* ১১টা ৫মিনিটে কর্নেল একা বেরিয়েছিলেন। ফিরে এলেন ১২টা ১৫ মিনিটে। কোথায় গিয়েছিলেন তা খুলে বললেন না। কোথায় নাকি কী একটা জরুরি কাজ ছিল।

*১২টা ২০ মিনিটে কর্নেলের সোহিনীকে টেলিফোন। কথাবার্তা শুনে বুঝলুম, আজ রাতের ট্রেনে করনগড় যাবেন। সোহিনীকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে তৈরি হয়ে আসতে বললেন।

* ১টা ৩০ মিনিটে খাটের ওপর অভ্যাসমতো ভাত-ঘুমের টানে শুয়ে পড়েছিলুম। দেখছিলুম, কর্নেল সেই প্রজাপতির বইটা থেকে তার নোটবইয়ে কী সব লিখছেন। ঘুম ভেঙেছিল ষষ্ঠীচরণের ডাকে। সে চায়ের জন্য ডাকছিল উঠে দেখলুম, কর্নেল নেই। ষষ্ঠী বলল, বাবামশাই তিনটেতে বেরিয়েছেন। কোথায় গেছেন, বলে যাননি।

* ৫টা ২০ মিনিটে বৃষ্টি এল। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা আধঘণ্টা পরে থেমে গেল। ৬টা ৫ মিনিটে টেলিফোন বাজল। কর্নেলের টেলিফোন। তিনি বললেন, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে একটা বাড়িতে আছেন। ফিরতে দেরি হতে পারে।

* ৬টা ৩০ মিনিটে আবার টেলিফোন বাজল। নিউ আলিপুর থেকে অভিষেক বোসের ফোন। কর্নেল নেই শুনে তিনি বললেন, কর্নেল ফিরে এলে যেন তাকে রিং করেন। আমি জানতে চাইলুম, কোনো বিশেষ খবর আছে কি না। মিঃ বোস বললেন, একটা ছোট্ট খবর আছে। তবে তিনি তা সরাসরি কর্নেলকে জানাতে চান। ক্ষুব্ধ হয়ে রিসিভার রেখে জানালার কাছে গেলুম। পর্দা খুলে দেখলুম, আবার বৃষ্টি পড়ছে। তবে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। জোর হাওয়া দিচ্ছে। আলোর শরীর জুড়ে বৃষ্টিকণার আঁকাবাঁকা ছুটোছুটি দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হল, আমি এবার থেকে কবিতা লেখার চেষ্টা করব।

* ৭টায় টেলিফোন বাজল। প্রাঃ ডিঃ হালদারমশাই করনগড় থেকে ফোন করছেন। কর্নেলস্যার নেই শুনে তিনি বললেন, কর্নেলস্যারের শিগগির করনগড় আসা দরকার। আজ বিকেলে রাজবাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে তিনি একখানে গভীর গর্ত আবিষ্কার করেছেন। টাটকা গর্ত। আর একটা খবর যেন কর্নেলস্যারকে আমি দিই। রাজবাড়িতে তীর্থব্রত সিংহের শ্যালকও থাকেন। তার নাম শ্যামল মজুমদার। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বলেছেন, শ্যামলবাবুর সঙ্গে স্থানীয় একটা জঙ্গি আদিবাসী গোষ্ঠীর যোগাযোগ আছে। জঙ্গি গোষ্ঠীটার নাম ব্ল্যাক প্যান্থার। তীর্থব্রত সিংহ কর্নেল স্যারকে শ্যামলের কথা জানাননি। কেন জানাননি, এটা হালদারমশাইয়ের কাছে সন্দেহজনক ঘটনা। আমি হালদারমশাইকে শুধু জানালুম, আজ রাতের ট্রেনে কর্নেল করনগড় যাচ্ছেন।

* ৭টা ১৫ মিনিটে কর্নেল ফিরলেন। তার সঙ্গে সোহিনী রায়। তার কাঁধে একটা ব্যাগ এবং হাতে একটা ব্যাগ। কাঁধের ব্যাগটা প্রকাণ্ড। কর্নেলকে অভিষেকবাবুর কথা বললুম। হালদারমশাইয়ের খবরও দিলুম। কর্নেল তখনই অভিষেকবাবুকে ফোন করলেন। তারপর শুনলুম, কর্নেল ক্রমাগত হুঁ দিয়ে যাচ্ছেন। ষষ্ঠীচরণ কফি আর স্ন্যাক্স রেখে গেল। সোহিনী বলল, আই মাস্ট টেক দ্য চান্স টু সার্ভ দ্য লেজেন্ডারি হিরোজ! সে কর্নেল ও আমাকে কফি তৈরি করে দিয়ে নিজে শুধু লিকার আর একটু চিনি নিল। তারপর প্রেমে পড়ার মতো হাসি হেসে (আমার ভুল হতেও পারে) বলল, জানেন জয়ন্তদা? মাই বিলাভেড গ্র্যান্ডপা বলতেন নীলাদ্রি সরকারের মতে দুধছাড়া কফিপান অ্যামেরিকানিজম! কর্নেল বললেন, ঠিকই বলি। এই যে জয়ন্ত সিগারেট ছেড়েছে, এ-ও অ্যামেরিকানিজম! কফির লিকারে ক্ষতিকর কেম্যিাল পদার্থ আছে। দুধ তা নষ্ট করে। আর স্মোকিং? নন-স্মোকারদের মধ্যেই ক্যান্সারের রোগী বেশি। মার্কিনরা তাদের নিজস্ব লাইফস্টাইলকে গ্লোবালাইজ করতে চায়। মাই গুডনেস! গ্লোবাল ভিলেজ কথাটা আমি ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকায় প্রথম শুনেছিলুম। সোহিনী হেসে উঠল। হাসলে ওকে এত সুন্দর দেখায়, ওই শ্যামবর্ণ তরুণীটি কি তা জানে?

* ৮টা ৩০ মিনিট। কর্নেল ভিতর থেকে এসে বললেন, তাঁর গোছ-গাছ শেষ। আমার জন্য তিনি একটা বাড়তি রেনকোট সঙ্গে নিয়েছেন। সোহিনী আবার সেই প্রেমেপড়ার মতো হাসি হাসি হেসে বলল, জানেন জয়ন্তদা? বৃষ্টিরাতের ট্রেনে যেতে আমার অসাধারণ লাগে! বললুম, আমারও। কর্নেল রসভঙ্গ করে বললেন, বৃষ্টিরাতের ট্রেনে ওই লাইনে প্রায় ডাকাতি হয়। সোহিনী বলল, কী নেবে ওরা? আমি তো গয়না পরি না। মনে মনে বললাম, তুমি নিজেই এক অসামান্য গয়না। হা ঈশ্বর! আমি কি ওর প্রেমে পড়ে গেলুম?

* জাপানি ওয়ালক্লকে পিয়ানোর সুরে ৯টা বাজল। কর্নেল বললেন– এগারোটা পঁচিশে ট্রেন। দশটায় ডিনার খেয়ে বেরুব। পাঁচ মিনিট পরে টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে হুঁ হুঁ করে গেলেন। তারপর রিসিভার রেখে মিটিমিটি হেসে আমার দিকে তাকালেন। বললেন, নিউ আলিপুর থেকে আবার মিঃ বোসের ফোন। জয়ন্তের আগ্রহের কারণ আছে। আজ সকালে ন্যান্সি আচারিয়া হঠাৎ এসেছিলেন। মিঃ আচারিয়া তাই অফিসে যাননি। মিঃ বোস যেচে পড়ে মিঃ আচারিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে আড্ডা দিতে গিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত, এই সেই ন্যান্সি বার্নার্ড। এইমাত্র মিঃ বোস আড়ি পেতে শুনেছেন, ন্যান্সি আজ রাতের। ট্রেনে আবার তার কর্মস্থল করনগড় ফিরে যাচ্ছেন। ব্যাপারটা নাকি সন্দেহজনক। সোহিনী জানতে চাইল, হু ইজ দ্যাট ন্যান্সি? কর্নেল তাকে সংক্ষেপে সিকিমের ঘটনাটা শোনালেন। সোহিনী বলল, বিদেশিরা আদিবাসী এলাকায় রাজনীতি করছে। স্বর্ণদিদিমার কাছে সে শুনেছিল, করনগড় অঞ্চলে একটা মিলিট্যান্ট দল। গড়ে উঠেছে। করনগড়ের রাজাসায়েব বেঁচে থাকতে এসব ছিল না। তবে রানিমা-র প্রতি তাদের ভক্তি আগের মতোই ছিল। ১০টায় ডিনারে বসে আমি সোহিনীর কাছে জানতে চাইলাম, সে করনগড় রাজবাড়িতে তার দূরসম্পর্কের কাকু তীর্থব্রতবাবুর শ্যালক শ্যামল মজুমদারকে দেখেছে কি না। সোহিনী বলল, অরুণিমা কাকিমার এই ভাইটিকে সে একবারমাত্র দেখেছিল। স্বর্ণদিদিমা তাকে তার সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেছিলেন। শ্যামল মজুমদার নাকি বিহারের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। শুধু তীর্থব্রতের খাতিরে স্বর্ণদিদিমা তাকে রাজবাড়ি থেকে চলে যেতে বলতে পারছেন না। আমি বললুম, সোহিনী! আপনার প্রাইভেট ডিটেকটিভ খবর দিয়েছেন, ব্ল্যাক প্যান্থার নামে একটা জঙ্গি আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে শ্যামলবাবুর যোগাযোগ আছে। সোহিনী শক্ত মুখে বলল, স্বর্ণদিদিমার প্রোপার্টিতে আমার অধিকার আছে। আমি তাকে ফেস করব। কর্নেল বললেন, সোহিনী! এখনও তোমার ফেস করার সময় হয়নি। নাও উই আর জাস্ট প্রসিডিং টোয়ার্ডস দ্য পয়েন্ট জিরো ফ্রম দা পয়েন্ট ওয়ান জিরো জিরো। সোহিনী একটু হেসে বলল, কাউন্ট ডাউন কি শুরু হয়েছে? কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, খাওয়ার সময় কথা বলতে নেই। এতে খাদ্যের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না এবং শ্বাসনালীতে খাদ্য আটকে যাওয়ার সাংঘাতিক সম্ভাবনা থাকে।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ আমরা করনগড় স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা রেখেছিলাম। ফার্স্টক্লাসের একটামাত্র কম্পার্টমেন্ট। কোনো মেমসায়েব সেই কম্পার্টমেন্টের কোনো কুপেতে ওঠেনি। সোহিনীই বারবার উঁকি মেরে চারটে কুপেতে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। প্ল্যাটফর্মে নেমে সে ভিড়ের মধ্যে একজন মেমসায়েবকে খুঁজছিল, তা লক্ষ্য করেছিলুম। কিন্তু যত লোক ট্রেন থেকে নেমেছিল, তার দ্বিগুণের বেশি ট্রেনের প্রতীক্ষায় ছিল। ভিড় ঠেলে গেটের দিকে আমরা এগিয়ে গিয়ে দেখেছিলুম, তীর্থব্রত সিংহ দাঁড়িয়ে আছেন। তা হলে কর্নেল তাঁকে আগে থাকতেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন। গেট পেরিয়ে যাওয়ার পর তিনি কর্নেলকে সম্ভাষণ করে সোহিনীর কাঁধে মৃদু থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন–তা হলে শেষপর্যন্ত তুই এলি সোহিনী? তুই আসবি শুনে তোর কাকিমা আমার সঙ্গে এসেছেন। আয়!

তার পাশে একজন তাগড়াই চেহারার গুফো ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। কর্নেলকে করমর্দন করে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ইংরেজিতে বললেন–গত বছর নভেম্বর থেকে আমি প্রতীক্ষা করছি। আমার মাননীয় বন্ধু জীবন সম্পর্কে কি ক্রমশ নিরাসক্ত হয়ে পড়েছেন?

মিঃ সিংহ বললেন–কর্নেলসায়েবের চেয়ে আমার এই ভ্রাতুস্পুত্রী অনেক বেশি নিরাসক্ত। শুধু নিরাসক্ত নয়। জীবন সম্পর্কে প্রচণ্ড শীতল। ক্যাপ্টেন। পাণ্ডে। সোহিনী মামিমার মৃত্যুসংবাদ শুনে আপনাকে কী যেন বলেছিল?

–মানুষ মরণশীল। বলে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে হেসে উঠলেন।

সোহিনী ভুরু কুঁচকে একটু হেসে বলল কী আশ্চর্য! এই সাংঘাতিক জংলি জায়গায় আমি একা আসব কী করে, তা আপনারা কেউ ভাবলেন না। শুধু খবর দিলেই দায়িত্ব শেষ?

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–ওসব কথা থাক। সোহিনী এখন পুরোপুরি পরিণত এবং প্রকৃত মহিলা হয়ে উঠেছে দেখে আমি খুশি। প্রথমে তোমাকে দেখে চিনতেই পারিনি।

কথা বলতে বলতে আমরা নিচের চত্বরে হেঁটে যাচ্ছিলুম। কর্নেল আমার সঙ্গে ক্যাপ্টেন পাণ্ডের আলাপ করিয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আমার হাতে হাত আঁকড়ে ধরে হাঁটছিলেন। এতেই মানুষটিকে আমার খুব ভালো লাগল। এর ফাঁকে জিজ্ঞেস করলুম–এই ট্রেনে এখানে এত ভিড় কেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে?

 তিনি বললেন–ওরা সব ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনের কর্মী। একটা বড়ো দল চলে গেছে ভোর পাঁচটার ট্রেনে। এটা দ্বিতীয় দল। এরা নটার শিফটে কাজ করবে। একটা অ্যামবাসাড়ার গাড়ির পাশে একজন বাঙালি মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলেন। সোহিনী গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতে নত হয়েছিল। কিন্তু তিনি সোহিনীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। বুঝলুম, ইনিই তীর্থব্রতবাবুর স্ত্রী অরুণিমা। তার চেহারায় মাতৃত্বের আদল ফুটে উঠেছিল। মিঃ সিংহ বললেন–জয়ন্তবাবু! আপনি সামনের সিটে আমার পাশে বসুন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের জিপে যেতে হলে আপনাকে পেছনে উঠতে হবে।

পাশেই জিপগাড়িটা দাঁড় করানো ছিল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে সহাস্যে বললেন ঠিক বলেছ তীর্থ। আমাদের দুই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের আয়তন কালক্রমে বেড়ে গেছে। এজন্য অবশ্য আমাদের নিজেদের কোনো দোষ নেই।

তীর্থবাবু নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছিলেন। তার বাঁ পাশে বসলুম। আমাদের তিনজনের লাগেজ এই গাড়ির ডিকিতে ঢোকানো হয়েছিল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের জিপ আগে চলল। তার পিছনে অ্যামবাসাডার। রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। ধারে ঘন জঙ্গল। চড়াই-উতরাই হয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল। পিছনে অরুণিমা ও সোহিনীর মধ্যে চাপা স্বরে কী কথা হচ্ছিল, স্পষ্ট বুঝতে পারছিলুম না। বারবার শুধু কানে আসছিল একটা কথা চক্রান্ত।

কিছুক্ষণ পরে বাঁকের মুখে বাঁ দিকে একটা ছোট্ট পাহাড়ি নদী দেখতে পেলুম। নদীটা কানায় কানায় ভরা। কোথাও পাথর মাথা উঁচিয়ে আছে। তীব্র খাত বইছে। মিঃ সিংহ বললেন–জয়ন্তবাবু! এই নদীটার নাম নৈনি। এখন জল দেখছেন, ওটা গত রাত্রে প্রচণ্ড বৃষ্টির জল, পাহাড় ধুয়ে নেমেছে। সকলের মধ্যে আর বৃষ্টি না হলে অন্যরকম রূপ দেখতে পাবেন। ছোটোনাগপুর ফাউন্টেন রেঞ্জের একটা শাখা করনগড় পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে। পাহাড় আর জঙ্গল এলাকায় আগের যুগের সামন্ত রাজারা দুর্গ তৈরি করে বাস করতেন। দিল্লি বা পাটনা থেকে তুর্কি-মোগল পাঠান কোনো শক্তিই এঁদের জব্দ করতে পারত না। অবশ্য আমার মামিমার বাবা তার পূর্বপুরুষের সূত্রে রাজা খেতাব পেয়েছিলেন। আপনার মনে থাকতে পারে, ওঁরা ছিলেন রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। আকবরের আমলে রাজা মানসিংহ বাংলা বিহার সীমান্তে বিদ্রোহ দমনে এসেছিলেন। তখনই রাঢ়ী ব্রাহ্মণ পরিবার তাঁকে নানাভাবে। সাহায্য করেছিলেন। তার পুরস্কার হিসেবে কর্ণঠাকুর নামে পরিচিত এই পরিবারের প্রধান পুরুষ একটা বিশাল এলাকা জায়গির পান। কর্নঠাকুর সম্পর্কে এলাকায় অদ্ভুত সব গল্প চালু আছে। মূলত আদিবাসীরাই তার প্রজা ছিল। একটু পরেই নদীর বাঁ দিকে তাঁর কর্ণগড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাবেন। ওটাই কর্ণগড়। তা থেকে করনগড়।

ডানদিকে তরঙ্গায়িত প্রান্তর কোথাও সবুজ ঘাসে ঢাকা, কোথাও নিরাবরণ। কাছে ও দূরে টিলার গায়ে আদিবাসীদের গ্রাম দেখা যাচ্ছিল। ঘাসের জমিতে রাখাল ছেলেরা গোরু চরাচ্ছিল। আবার চড়াইয়ে ওঠার পর মিঃ সিংহ বললেন, জয়ন্তবাবু। ওই দেখুন নদীর ওপারে কর্ণগড়ের ধ্বংসাবশেষ। কাছে না দেখলে মনে হবে নিছক পাহাড়ি জঙ্গল। কিন্তু ওদিকটায় হাতির উপদ্রব আছে।

মিনিট দশেক পরে সমতল রাস্তার ডানদিকে উঁচু জমির ওপর পুরোনো এক তলা বাড়ি চোখে পড়ল। মিঃ সিংহ বললেন–এসে গেছি। এটা বাঙালিটোলার দক্ষিণ প্রান্ত। রাজবাড়ির অবস্থা দেখছেন?

বলে তিনি হেসে উঠলেন। বাঁ দিকে নদীর ওপারে গাছপালার ফাঁকে ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্ট হাউস খুঁজছিলুম। একটু পরেই সেটা দেখতে পেলুম। খানিকটা দূরে একটা সবুজ টিলার গায়ে ছবির মতো সুন্দর রঙিন বাংলো বাড়ি। গোয়েন্দাপ্রবরকে এতদূর থেকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। বাঁ দিকে একটা পাথরের ব্রিজ, নদীর ওপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিজের ওধারে সংকীর্ণ একটা লাল মাটির রাস্তা টিলার দিকে এগিয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডের জিপ ডাইনে ঘুরে উঁচু জমিতে উঠছিল। লক্ষ্য করলুম সামনে রাজবাড়ির দেউড়ি। দেউড়িটা মেরামত করে অক্ষত রাখা হয়েছে। একজন দারোয়ানও আছে। সে সেলাম ঠুকে দেউড়ির বিশাল গরাদ দেওয়া দরজা খুলে দিল।

ভিতরে প্রশস্ত লনের দুধারে পামগাছ। বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে দেশি-বিদেশি গাছ বর্ষার আমেজে যথেচ্ছ শ্যামলতা ছড়াচ্ছে। একপাশে ভাঙা ফোয়ারা এবং ফুলের বাগান। অন্য পাশে ঘাসে ঢাকা জমির মাঝখানে একটা ঢাকা ইঁদারা। তার পাশে পাম্পিং মেশিনের ঘর। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের জিপ গাড়ি-বারান্দার নীচে থামল। তার পিছনে থামল আমাদের অ্যামবাসাডার।

আমরা গাড়ি থেকে নামলুম। সোহিনী বলল-কাকু! ডিকি খোলো! আমার ব্যাগ বদলে গেলে কেলেংকারি! জয়ন্তদার ব্যাগে কী আছে জানি না। কিন্তু আমার ব্যাগে সাংঘাতিক জিনিস আছে।

তীর্থব্রত হাসলেন। রাইফেল টুকরো করে এনেছিস না কি রে?

–আনব না? সামনের মাসে শুটিং কম্পিটিশন। প্র্যাকটিসের জন্য এত বেশি স্পেস কোথায় পাব? বলে সে একটুখানি জিভ কাটল। কাকিমা। একসঙ্গে এলুম। অথচ এই ভদ্রলোকের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিইনি। কাকু না হয় ফর্মালিটির ধার ধারে না। কাকিমা। ইনি বিখ্যাত সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি। তোমাদের এখানে তো বাংলা কাগজ আসে না।

একবার ভাবলুম, ভদ্রমহিলাকে প্রণাম করব। কিন্তু তার আগেই উনি নমস্কার করলেন। কিন্তু কী জানি কেন, অরুণিমা সিংহকে দেখার পর থেকে তাঁর স্নেহবৎসল দৃষ্টি আমাকে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।

সোহিনী তার ছোট ও বড় দুটো ব্যাগ দু-কাঁধে নিয়ে অরুণিমার একটা কাঁধ আঁকড়ে দরজার ভিতরে অদৃশ্য হল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন কর্নেল সরকারকে আমার ফার্মহাউসে রাখব ঠিক করেছিলুম। তীর্থ বাদ সাধল। যাই হোক, আপাতত তীর্থের আতিথ্যে থাকাই ওঁর উচিত হবে।

কর্নেল হঠাৎ চাপা স্বরে বললেন–মিঃ সিংহ! আপনার কাকিমার ঘরের দরজা এখনো কি পুলিস সিল করে রেখেছে?

তীর্থব্রত বললেন–হ্যাঁ। পাটনা থেকে আর একটা ফরেন্সিক এক্সপার্ট টিম আসবার কথা। কিন্তু বারোদিন হয়ে গেল। তাদের পাত্তা নেই।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–চলো তীর্থ। দেখি, এঁদের থাকার ব্যবস্থা কেমন করেছ।

তীর্থব্রত ডাকছিলেন–ভজুয়া! ভজুয়া!

একজন হাফপ্যান্ট-গেঞ্জি-পরা তোক জিপের পাশ দিয়ে এসে সেলাম ঠুকল। সে হিন্দিতে বলল, ভজুয়াকে মাইজি বাজারে যেতে বলেছিলেন। এখনও সে ফেরেনি স্যার!

–ঠিক আছে। তুই এঁদের জিনিসপত্র নিয়ে আয়।

এ ধরনের রাজবাড়ি কর্নেলের সান্নিধ্যে অনেক দেখেছি। বিশাল হলঘর। দেওয়ালে রাজবেশ পরা পুরুষ ও মহিলাদের বিশাল অয়েলপেন্টিং টাঙানো। ডিম্বাকৃতি প্রকাণ্ড টেবিল ঘিরে গদিআঁটা চেয়ার। একপাশে বিবর্ণ সোফাসেট। ইতস্তত টুলে বড়ো চিনেমাটির ফুলদানি। মাথার ওপর ঝোলানো ঝাড়বাতি। একপাশের কয়েকটা আলমারি বোঝাই বাঁধানো বই। তা ছাড়া দেওয়ালে হরিণ, চিতাবাঘ এবং নেকড়ের স্টাফ করা মাথা আটকানো আছে। হলঘর থেকে কাঠের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। মেঝে এবং সেই সিঁড়িতে পুরোনো লাল কার্পেট পাতা।

দোতলায় উঠে দেখলুম, ডানদিকে টানা বারান্দার শেষ প্রান্তে সোহিনী একটা থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে ঘরের দরজার পাশে অরুণিমা দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তাকে বারবার আঁচলে চোখ মুছতে দেখলুম। এক বৃদ্ধা পরিচারিকা বারান্দার মেঝেয় বসে সম্ভবত কত্রীকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। _ তীর্থব্রত আমাদের নিয়ে গেলেন বাঁদিকে। সিঁড়ির মাথার ওপর প্রশস্ত গোলাকার বারান্দার একটা অংশ ঘুরে তিনি হঠাৎ দাঁড়ালেন। বললেন–এই ঘরে মামিমা থাকতেন। পুলিস সিল করে রেখেছে।

কর্নেল বললেন–আপনার মামিমার ঠাকুরঘর কোথায়?

–এই ঘর থেকে ওদিকে একটা ছোট্ট বারান্দায় যাওয়া যায়। সেখান থেকে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠলে এই ঘরের উপরেই তার ঠাকুরঘর। সে ঘরটাও সিল করা আছে।

এরপর বাড়িটা ডাইনে ঘুরেছে। ইংরেজি এল হরফের মতো। এদিকটায় তিনটে ঘর। শেষপ্রান্তের ঘরের দরজা খোলা ছিল। তীর্থব্রত বললেন–বুধুয়া!  জিনিসগুলো ঘরে রেখে তুই ননীঠাকুরকে গিয়ে বল, আগে কফি আর স্ন্যাক্স এখনই যেন নিয়ে আসে।

বুধুয়া আমাদের ব্যাগগুলো ঘরের ভিতরে রেখে চলে গেল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–তীর্থ! আমার জুতো খোলার সমস্যা আছে!

তীর্থব্রত হাসলেন। কী আশ্চর্য! আপনি জুতো পরেই ঢুকুন। আমরাও জুতো পরে ঢুকব।

ঘরে ঢুকে দেখলুম, বেশ চওড়া ঘর। পশ্চিমে একটা জানালা। দরজার দুপাশে উত্তরে দুটো এবং ঘরের ভিতরে দক্ষিণে দুটো জানালা। সব জানালায় নতুন পর্দা ঝুলছে। মেঝেয় কার্পেট পরানো হলেও পরিচ্ছন্ন। দুপাশে দুটো নিচু গাছ। তীর্থব্রত দক্ষিণের দরজা খুলে দিয়ে বললেন–এখানে ব্যালকনিতে বসলে কর্নেলসায়েব আনন্দ পাবেন।

সোফাসেট, সেন্টার টেবিল ছাড়াও ওয়াড্রোব, লেখার জন্য চেয়ার টেবিল এবং একটা ইজিচেয়ারও আছে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে সোফায় বসে বললেন–কী আশ্চর্য! আমি ভুলেই গিয়েছিলুম, এই গেস্টরুমে একসময় মন্ত্রী বা আমলাদের সঙ্গে দেখা করতে আসতুম। যাই হোক, তুমি ফ্যানদুটো চালিয়ে দাও। আজ সকাল থেকে কদর্য গরম পড়েছে। করনগড়ে আগস্ট মাসে এ যাবৎকাল গরম আবহাওয়া ছিল না।

ইতিমধ্যে কর্নেল দক্ষিণের ব্যালকনিতে গিয়ে বাইনোকুলারে সম্ভবত পরিবেশ দর্শন করছিলেন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে তীর্থব্রত সিংহের দিকে তাকিয়ে বললেন তীর্থ! দাঁড়িয়ে কেন? বসো। আমাকে এখনই ফার্মে যেতে হবে। প্রথামিক কথাবার্তা : আলোচনা করে নিই। কর্নেল সরকার! আগে কফি পান করে প্রকৃতি দর্শন। করবেন। কফির গন্ধ পাচ্ছি।

তীর্থব্রত সোফার এক কোণে বসলেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন–সোহিনী আসায় ভালো হয়েছে। উইল প্রবেট করানোর কাজটা সেরে ফেলা যাবে। পাওনাদাররা মামিমার মৃত্যুর পর থেকে আমাকে উত্ত্যক্ত করছে।

এইসময় সেই বধুয়া বারান্দার দিকের দরজার পর্দা সরিয়ে দিল। শীর্ণকায় একজন পৈতে ও টিকিধারী ঢ্যাঙা মানুষ দুহাতে প্রকাণ্ড ট্রে ধরে ঘরে ঢুকলেন। তিনিই যে ননীঠাকুর তা বুঝতে পারলুম। সেন্টারটেবিলে ট্রে রেখে তিনি ক্যাপ্টেন পাণ্ডে ও আমাকে নমস্কার করলেন। কর্নেলকে ঘরে ঢুকতে দেখে তিনি তাকেও নমস্কার করলেন। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে তাকে বাংলায় বললেন–ঠাকুরমশাই। আপনার এই অতিথিরা কিন্তু নিরামিষ খান না। আপনি নিজে নিরামিষাশী। তা হলে কী হবে?

ননীঠাকুর মৃদু হেসে বসলেন–আপনি ভুলে যাচ্ছেন পাণ্ডেজি। আমার হাতে আপনি রাজবাড়িতে কি আমিষ রান্না খাননি? আমি নিজে না খেলেও অতিথিদের আমিষ পরিবেশনে আমার কোনো দোষ হয় না!

কর্নেল সোফায় বসে বললেন–কিন্তু ঠাকুরমশাই! শাস্ত্রে আছে ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম।

ঠাকুরমশাই রসিক মানুষ, তা বোঝা গেল। মুচকি হেসে তিনি বললেন–স্যার! এই রাজবাড়িতেই জন্মেছিলুম। এখানেই দেহরক্ষা করব। আমার দশবছর বয়স থেকে আমিষের ঘ্রাণ পেতে পেতে এই চল্লিশ বছরে আমিষের ঘ্রাণ ভুলে গেছি। আর যদি বলেন, স্পর্শদোষ হয় কিনা। চল্লিশবছর ধরে যা স্পর্শ করে আসছি, তা আমিষ না নিরামিষ, সেটা চিন্তা না করলেই হল! স্যার চিন্তার দোষই আসল দোষ।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে এবং কর্নেল হেসে উঠলেন। মিঃ সিংহ বললেন–ননীদা! এবার এঁদের জন্য ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করোগে।

কর্নেল বললেন–ব্রেকফাস্ট করব দশটায়। আপনার ব্যস্ত হবার কারণ নেই।

ননীঠাকুর এবং বুধুয়া চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন–রাজবাড়ির কেয়ারটেকার আর রানিমার পরিচারিকাকে পুলিশ জামিন দিচ্ছে না। মিঃ সিংহ কি আপনাকে লইয়ারের মাধ্যমে এ ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছেন?

তীর্থব্রত বললেন–ওদের ঘরে দশহাজার করে টাকা খুঁজে পাওয়াটাই পুলিশের সন্দেহের একটা গ্রাউন্ড। পাণ্ডেজির সঙ্গে অফিসার-ইন-চার্জ রাজকুমার প্রসাদের ভালো জানাশোনা আছে। পাণ্ডেজি চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এই ওড়িয়া লোকটি বড্ড গোঁয়ার।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–হ্যাঁ। প্রসাদজি ওই একটা পয়েন্টে স্টিক করে আছেন। আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, এমন তো হতেই পারে, প্রকৃত খুনি টাকাগুলো ওদের ঘরে কোনো সুযোগে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু প্রসাদজির এক কথা। তা হলে তো রাজবাড়ির সব কর্মচারীকে অ্যারেস্ট করতে হয় এমনকী তীর্থকেও বাদ দেওয়া যায় না।

তীর্থব্রত একটু হেসে বললেন–ওসি লোকটির এই মার্ডারের মোটিভ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণাই নেই।

কর্নেল বললেন–আচ্ছা মিঃ সিংহ, বৃদ্ধা এক মহিলাকে এমনভাবে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে মেরে ফেলার মোটিভ কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?

–প্রতিহিংসা চরিতার্থ।

–কী ব্যাপারে?

-মোহনলাল সুখানিয়ার গ্র্যান্ডসন প্রকাশ সুখানিয়ার কুখ্যাতি আছে। বছর দুই আগে তাকে পুলিশ নিষিদ্ধ মাদকপাচারের দায়ে গ্রেফতার করেছিল। কিন্তু শেষাবধি সে রেহাই পেয়ে যায়। আমার নিজস্ব সোর্স থেকে জানি, তার সেই নার্কোটিকসের কারবার এখনও চালু আছে। ব্যবসার আড়ালে এই গোপন কাজ সে করে যাচ্ছে।

–প্রকাশ সুখানিয়া কীসের ব্যবসা করেন?

ইলেকট্রনিক গুডসের। আশ্চর্য ব্যাপার, পুলিশ দেখেও দেখে না প্রকাশের গোডাউনে বিদেশি টিভি, ভি সি আর, টেপরেকর্ডার থেকে ক্যামেরা পর্যন্ত দেশি জিনিসের সঙ্গে মিশিয়ে রাখা আছে।

–কিন্তু প্রতিহিংসা চরিতার্থ বলতে কি আপনি আপনার মামাবাবুর সঙ্গে মামলায় হেরে যাওয়ার ব্যাপারটা বোঝাচ্ছেন?

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে, একটু হেসে বললেন–হিস্টোরিক্যাল জুয়েলস নাকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিশপ্ত হয়ে যায়। আমি তীর্থকে বলেছি, সুখানিয়া ফ্যামিলি রাজাসায়েবের তথাকথিত জুয়েলস পেলে অভিশাপের পাল্লায় পড়ত। পায়নি বলে সুখে-স্বচ্ছন্দে বেঁচে আছে। আর রাজবাড়ির ওপর যেন অভিশাপের কালো ছায়া। তীর্থের ফ্যাক্টরির অবস্থাও ভালো নয়। লেবার ট্রাবল লেগেই আছে।

তীর্থব্রত বললেন–অনেকদিন থেকে ভেবেছি, আমি অন্য জায়গায় বাড়ি তৈরি করব। কিন্তু মামিমার কথা ভেবে সেটা করতে পারিনি। পাণ্ডেজি ঠিক বলেছেন। রাজবাড়ি না ছাড়লে আমার ভাগ্যেও কি আছে, কে জানে?

কর্নেল বললেন–রানিমার মৃত্যুর দিন ভোরবেলায় যে আপনার ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার খবর দিয়েছিল। পুলিশ এ ব্যাপারে কী তদন্ত করছে না?

কী করছে তা পুলিশ জানে। এটা তো স্পষ্ট, মামিমার বেড়ালগুলোকে বিষ খাইয়ে কেউ তাকেও বিষাক্ত ইঞ্জেকশনে মেরে ফেলবে বলেই আমাকে ওইভাবে রাজবাড়ি থেকে বেশ কিছুক্ষণের জন্য সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল।

–আপনার স্ত্রী ওই সময় কোথায় ছিলেন?

–অরুণিমা নিচে ছিল। ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার খবর শুনে সে নিচে নেমে এসেছিল। তখন তার মানসিক উদবেগের কথা বুঝতেই পারছেন। রাজবাড়ির সরকার, তাকে কেয়ারটেকারও বলতে পারেন, তাকে খুঁজছিল দুবেজি তখন নাকি ঠাকুরবাড়িতে ছিলেন।

রাজবাড়িতে ঠাকুরবাড়ি থাকা স্বাভাবিক। সেটা কোথায়?

–উত্তর-পূর্ব কোণে। ওখানে একটা পুকুর আছে। সেই পুকুরের পারে ঠাকুরবাড়ি। শুনলে অবাক হবেন, রাজবাড়ির গৃহদেবতা চণ্ডীমা। আর মামিমা নিজস্ব ঠাকুরঘরে গৃহদেবতা শিব। মামিমা নাকি বিয়ের পর তার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে অনুমতি নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে কষ্টিপাথরে তৈরি শিবলিঙ্গ এনে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে সহস্যে বললেন–এই রাজবাড়ির সবকিছুই বিচিত্র কর্নেল সরকার ননীঠাকুরকে দেখলেন। তার ঘরে আছেন রাধামাধব।

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে বললেন–জয়ন্ত তুমি পোশাক বদলে বিশ্রাম করো। পৌনে নটা বাজে। আমি একবার ক্যাপ্টেন পাণ্ডের ফার্ম থেকে আসি। ঠিক দশটায় এসে ব্রেকফাস্ট করব। দেরি হবে না।

তীর্থব্রত বললেন–আমি গিয়ে দেখি, ননীঠাকুর কী করছে। অরুণিমা সোহিনীর পাল্লায় পড়েছে।

দেখলুম, কর্নেল যথারীতি ক্যামেরা আর বাইনোকুলার গলায় ঝুলিয়ে এবং পিঠে কিটব্যাগ এঁটে বেরিয়ে যাচ্ছে। কিটব্যাগের কোনা দিয়ে প্রজাপতিধরা থলের স্টিক বেরিয়ে আছে। ওঁকে সতর্ক করে দেওয়ার ছলে সকৌতুকে বললুম করনগড় অঞ্চলে কি ওয়াল্ড লাইফ প্রোটেকশন আইন চালু নেই?

কর্নেল হাসলেন।–তুমি তো দেখেছ জয়ন্ত! আমি প্রজাপতি যদি দৈবাৎ করতে পারি, সেটাকে পরীক্ষা করেই মুক্তি দিই!

গেস্টরুমের সংলগ্ন বাথরুমে প্রাতঃকৃত্য এবং দাড়ি কামানোর পর পোশাক বদলে নিলুম। তারপর দক্ষিণের ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলুম-সেখানে দুটো চেয়ার আছে। তীর্থব্রত সিংহ অতিথিসৎকারে কোনো ত্রুটি রাখেননি। চেয়ারে বসে এক মনোরম ল্যান্ডস্কেপ দেখছিলুম। রাজবাড়ির দক্ষিণের বাউন্ডারি দেয়ালের পর একটা তরঙ্গায়িত প্রান্তর কোথাও ঘাসে ঢাকা, কোথাও নগ্ন, আর কোথাও ছোট বড় নানা গড়নের কালো পাথর ছড়িয়ে আছে। প্রান্তরের শেষে ইতস্তত কয়েকটা জঙ্গলে ঢাকা টিলার পিছনে নীল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু পাহাড়। বাঁ দিকে পূর্বে নিবিড় জঙ্গল। ওই জঙ্গলেই কি হালদারমশাই টাটকা বড় গর্ত দেখেছিলেন? ডানদিকে পশ্চিমে রাজবাড়ির নিচে এবড়োখেবড়ো ওধারে নৈনি নদী সারবন্দি গাছের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্টহাউসটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলুম। হালদারমশাই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি আর পরচুলা পরে সায়েব সেজে ওখানে এখন কী করছেন কে জানে? একটু পরে পিছনে ঘরের ভিতরে সোহিনীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম। আশ্চর্য! রাজবাড়ির গেস্টরা কি সবাই ভ্যানিশ হয়ে গেল?

সাড়া দিয়ে বললুম–একজন ভ্যানিশ হতে পারেনি!

সোহিনী এসে পর্দা তুলে আমাকে দেখে বলল–জয়ন্তদা! আপনাকে ফেলে ওঁরা কেটে পড়েছেন দেখছি!

বসুন।

সোহিনী বলল–আপনি-টাপনি ছাড়ুন তো।

–ঠিক আছে। বসো।

–এখানে বসে দেখার মতো কিছু নেই। তার চেয়ে চলুন, পিছনে বাড়ির পুকুরের ধারে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।

–আপত্তি নেই। কিন্তু এ ঘরে একটা তালা দরকার।

–তালা কী হবে? আপনারা হাজার হাজার টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে তো আসেননি।

একটু হেসে বললুম টাকাকড়ির কথা ভাবছি না। আমার ওই ব্যাগে একটা। ফায়ার আর্ম আছে।

সোহিনী হাসল।– হ্যাঁ। ফায়ার আর্মস্ থাকা একটা প্রব্লেম। আমার রাইফেলটা কাকিমার জিম্মায় রেখেছি। আপনার নিশ্চয় স্মলগান?

পয়েন্ট টোয়েন্টি টু ক্যালিবারের সিক্সরাউন্ডার রিভলভার।

 –কী সর্বনাশ! সাংবাদিকদেরও এসব দরকার হয়?

–তুমি তো জানো আমি আসলে ক্রাইম রিপোর্টার।

-হ্যাঁ। মনে পড়েছে। একটা কেসস্টোরিতে পড়েছিলুম, আপনি কর্নেলের বাধাসত্ত্বেও এক রাউন্ড ফায়ার করে ক্রিমিন্যালকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন কর্নেলের প্রচণ্ড বকুনি খেয়েছিলেন। দেখবেন, পুকুরপাড়ের পিছনে ঘন জঙ্গল আছে। সেই জঙ্গলে নাকি দিনদুপুরেও ভূতের উৎপাত হয়। সাবধান জয়ন্তদা। ভূত দেখে যেন ফায়ার করবেন না। খামোক একটা গুলি খরচ হবে। মরবে না।

রিভলভারটা লোডেড ছিল। ওই অবস্থায় পাঞ্জাবির ঝুলপকেটে রুমালে মুড়িয়ে রাখলুম। তারপর সোহিনীকে অনুসরণ করলুম।

হলঘরে নেমে সোহিনী পিছনের একটা দরজা খুলল। একটা ভোলা বৃত্তাকার বারান্দা থেকে কয়েকটা ধাপ সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা লাইমকংক্রিটে জড়ানো চত্বর। তারপর একটা মন্দির। নিচে হাড়িকাঠ দেখে বুঝলুম, এখানে মা চণ্ডীর উদ্দেশে পাঠা বলি হয়। মন্দিরের দরজায় তালা আঁটা। বাঁ পাশ দিয়ে শীর্ণ পথে এগিয়ে বাউন্ডারি ওয়াল, সেখানে একটা দরজা। দরজা খুলে এগিয়ে গিয়ে দেখি একটা চৌকো পুকুর। পুকুরে প্রচুর পদ্ম। সবে কুঁড়ি ধরেছে। গাছপালা আর ঝোঁপঝাড় আছে। দরজার নিচেই বাঁধানো ঘাট এবং অনেকটা জায়গা পরিষ্কার। আছে। জল স্বচ্ছ। সোহিনী বলল-পুকুরে প্রচুর মাছ থাকত। এখন অত মাছ আছে কি না জানি না। জানেন জয়ন্তদা, একটা আশ্চর্য ব্যাপার। ঠাকুরপুকুরের জল কিন্তু গ্রীষ্মেও শুকোয় না। স্বর্ণদিদিমার কাছে শুনেছিলুম, পুকুরের তলায় একটা প্রস্রবণ আছে। সেটা কিন্তু সত্যি। ওই কোণের দিকে দেখছেন একটা খাল কাটা আছে, ওখান দিয়ে বাড়তি জল বেরিয়ে যায়। নিচের জমিতে তাই ধানখেত। দেখতে পাচ্ছেন?

বললুম–পাচ্ছি। কারা ধানচাষ করেছে?

–জমিগুলো রাজবাড়িরই। আদিবাসীরা চাষ করে। ফসলের ভাগ দেয়। আর ওই মরচেধরা তারের জাল দেখছেন, পুকুরের মাছ যাতে জলের সঙ্গে পালিয়ে না যায়, তাই খালের মুখে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।

পুকুরপাড়ে পায়ে চলা পথে পা বাড়িয়ে বললুম—চলো জঙ্গলে ভূতদর্শন। করে আসি।

সোহিনী হাসল। –আপনি বা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু রাজবাড়ি কেন, আদিবাসী চাষিরাও বিশ্বাস করে ওটা ভূতের ডেরা। দিনদুপুরেও ওদিকে কেউ যায় না।

এসো আমরা যাই। অন্তত একটা ভূত দেখতে পেলে অসাধারণ একটা অভিজ্ঞতা হবে।

পুকুরের পূর্বপাড় ঘুরে পায়ে চলা রাস্তাটা নিচে নেমে গেছে। আমরা সোজা জঙ্গলে ঢুকে গেলুম। দেখলুম এটা একটা শালবন। নিচে ততবেশি ঝোঁপঝাড় নেই। কোথাও-কোথাও নগ্ন পাথুরে মাটি। একখানে একটা প্রকাণ্ড কালো গ্রানাইট পাথর লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলুম। তারপর থমকে দাঁড়ালুম। সোহিনী পিছনে ছিল। ঘুরে ঠোঁটে আঙুল রেখে তাকে চুপচাপ থাকতে ইশারা করলুম।

অদ্ভুত একটা চাপা শব্দ আমার কানে এসেছিল। সোহিনীও শব্দটা শুনে চমকে গিয়েছিল। তাকে ফিসফিস করে বললুম–ভূত!

সোহিনীও ফিসফিস করে বলল–ভূত দেখব। চলুন।

পা টিপে টিপে পাথরটার ডানদিকে গিয়ে হাঁটু মুড়ে মেরে বসলুম। তারপর গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেলুম। সামনে শালগাছের গুঁড়ির ওধারে একটা হাফপ্যান্ট গেঞ্জিপরা বেঁটে লোক কোদাল দিয়ে নরম মাটি খুঁড়ে পিছনে ছুঁড়ে ফেলছে। গর্তে জল জমে আছে। তাই মাটি খোঁড়ার শব্দটা সত্যি ভূতুড়ে শোনাচ্ছে। লোকটার গায়ে পোশাকে জলকাদা লেগে ভূতের মতো দেখাচ্ছে। ওদিকে গর্তের পাড়ে বসে আছে আরেকটা লোক। সে ইঙ্গিতে মাটিখোঁড়া লোকটাকে নির্দেশ দিচ্ছে। তার পরনেও হাফপ্যান্ট আর গেঞ্জি। এক হাতে একটা শাবল।

আমি বাধা দেওয়ার আগেই সোহিনী উঠে গিয়ে চার্জ করল। এই! কে তোমরা! কেন এখানে গর্ত খুঁড়ছ?

লোকদুটো যেন বাঘের দৃষ্টিতে সোহিনীকে দেখছিল। আমি কিছু না ভেবেই পকেট থেকে রিভলভার বের করে এক লাফে সোহিনীর পাশে গেলুম। তারপর তাদের মাথার ওপর দিয়ে এক রাউন্ড ফায়ার করলুম। অমনি লোকদুটো কোদাল আর শাবল ফেলে জঙ্গলের ভিতরে উধাও হয়ে গেল। …..

গুলি ছুঁড়েই বুঝতে পেরেছিলুম, বড্ড বেশি হঠকারিতা করে ফেলেছি। গুলি ছোঁড়ার মতো কোনো অবস্থাই ছিল না। কোদাল ও শাবল ফেলে কালো কুচকুচে লোকদুটো যেভাবে পালিয়ে গেল, তাতে বোঝা যায় তারা নিরস্ত্র এবং আশা করেনি যে তারা গর্ত খুঁড়ছে বলে কেউ তাদের গুলি করে মারতে পারে।

সোহিনী প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর খিলখিল করে হেসে উঠল। জয়ন্তদা। আপনি কি ভেবেছিলেন লোকদুটো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে?

কাচুমাচু হেসে বললুম–ওদের চোখদুটো দেখে মনে হচ্ছিল যেন হিংস্র চোখে তোমাকে দেখছে। আমি ভেবেছিলুম, যে কোনো মুহূর্তে ওরা তোমাকে আক্রমণ করবে। কারণ ওরা দেখছে, তুমি একা। আমাকে তো ওরা দেখতে পায়নি।

সোহিনীর পায়ের হাত তিনেক দূরে গর্ত। সোহিনী ঝুঁকে গর্তটা দেখে সকৌতুকে বলল–ওরা কি গুপ্তধনের খোঁজ পেয়ে এখানটা খুঁড়ছিল? কিন্তু গর্তটা তো তত বড় নয়। মাটিটা খুব শক্ত বলে ওদের খুঁড়তে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু যা-ই বলুন জয়ন্তদা, আপনি অকারণ একটা গুলি খরচ করে ফেললেন।

স্বীকার করছি সোহিনী! সত্যিই আমি হঠকারিতা করে ফেলেছি। বলে গর্তটার অন্যদিকে গেলুম। তারপর শাবলটা তুলে নিলুম।

সোহিনী চোখ বড় করে বলল–এবার নিজেই কি গুপ্তধন খুঁড়ে বের করবেন?

 বললুম–না। শাবলটা দেখছি, বেশ ভারী। শক্ত মাটি কাটার পক্ষে উপযুক্ত।

সোহিনী চোখে সুন্দর একটা ভঙ্গি করে বলল–তা হলে আসুন। আমরাই গুপ্তধন খুঁড়ে বের করি।

এবার চাপা স্বরে বললুম–এই গর্তটার একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে। তা হলেই বুঝতে পারবে, কেন আমি এমন হঠকারিতা করে ফেলেছি। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার গতকাল টেলিফোনে জানিয়েছিলেন, রাজবাড়ির পিছনে সদ্য খুঁড়ে রাখা একটা গর্ত তিনি আবিষ্কার করেছেন। তার কথার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল, সম্ভবত তিনি এই শালবনে ঢুকেছেন, তা টের পেয়েই যারা গর্ত খুঁড়ছিল তারা পালিয়ে গেছে। তিনি অবশ্য বলেছিলেন, টেলিফোনে সব কথা বলা যায় না। তো এবার চিন্তা করো, কেন আমি তোমাকে নিয়ে শালবনে ঢুকেছিলুম।

সোহিনী এবার সিরিয়াস হল। সে বলল–তার মানে, গতকাল লোকদুটো গর্ত খুঁড়ে কিছু খুঁজছিল। মিঃ হালদার এসে পড়ায় পালিয়ে যায়। গতরাত্রে এখানে বৃষ্টি হয়েছে। তাই ভিজে মাটিতে গর্ত খোঁড়া সহজ হবে বলে তারা সকাল সকাল এসে আবার খোঁড়া শুরু করেছিল।

বললুম–এখানে নিশ্চয় এমন কিছু পোঁতা আছে বলে তারা জানতে পেরেছে। রাজবাড়ি সংলগ্ন এই জঙ্গলে গুপ্তধন থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আমার এইসব আলোচনা করছি, এমন সময় পাথরটার পিছনে পায়ের শব্দ হল। এবার রিভলভার নয়, শাবলটা মুঠোয় ধরে সোহিনীর পাশে গিয়ে জোরে বললুম–কে?

পাথরের পাশ দিয়ে বুধুয়া এসে বলল–আমি স্যার।

সোহিনী বলল তুমি এখানে কী করতে এসেছি বুধুয়া।

সে হাসল। –দিদি! আমি পুকুরপাড়ে গাইগোরু বাঁধতে এসেছিলাম। তারপর কারা কথা বলছে কানে এল। আরে! এখানে গর্ত খুঁড়ল কে?

সোহিনী বলল–দুটো লোক চুপিচুপি গর্ত খুঁড়ছিল। আমাদের দেখে পালিয়ে গেল। তুমি এখনই গিয়ে কাকুকে ডেকে আনে।

বুধুয়া গর্তটা দেখে উলটোদিকে গেল। তারপর কাছেই একটা উঁচু গাছের দিকে তাকাল। গাছ থেকে প্রচুর লতাপাতার ঝালর মাটিতে নেমে এসেছে। সে তার পায়ের কাছ থেকে একটা মোটা লতা ওপড়ানোর চেষ্টা করছিল। জিজ্ঞেস করলুমকী ব্যাপার বুধুয়া?

বুধুয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত ঝেড়ে নোংরা ফেলে দিয়ে হাসল। স্যার! এই যে গাছ দেখছেন, এটাকে আমরা বলি চিহড়গাছ। এই গাছে খুব মোটা লতাপাতা দেখতে পাচ্ছেন। গাছ থেকে আসল লতাটা ঢুকেছে এই গর্তের ধারে। দেখতে পাচ্ছেন তো?

সোহিনী হাসতে হাসতে বলল–জয়ন্তদা! টার্জনের ছবিতে এইরকম মোটা লতা ধরে টার্জন ঝুলতে ঝুলতে একগাছ থেকে আরেক গাছে যায়। নিশ্চয় দেখেছেন?

বললুম–দেখেছি! কিন্তু বুধুয়া কী বলতে চাইছে?

বুধুয়া বলল–এই লতার শেকড় মাটির তলায় চলে গেছে। আর সেই শেকড়ে বড় বড় আলুর মতো কন্দ আছে। একেকটা করে ওজন কমপক্ষে দশ কিলো। আমরা বলি কানালক। এক কিলোর দাম তিন-চার টাকা। পাহাড়িরা খায় স্যার। আমি একবার খেয়ে দেখেছিলুম। সুন্দর স্বাদ।

সোহিনী দু-কাঁধ নেড়ে এবং দুই হাত চিতিয়ে একটা সুন্দর ভঙ্গি করে বলল কোনো মানে হয়? কানা আলু নাকি একটা কন্দ-এসে গুপ্তধনের সম্ভাবনা বাতিল করে দিল। খামোকা একটা গুলি গচ্চা গেল জয়ন্তদার! ওদিকে দুই হতভাগা হয়তো এখন জঙ্গলের মধ্যে হার্টফেল করে মারা পড়েছে! দু-দুটো মার্ডারের দায়! ও মাই গড!

ওর কথা শুনে হেসে ফেললুম–সোহিনী! ওরা পাহাড়-জঙ্গলের মানুষ। এত সহজে মারা পড়বে না। তবে হতভাগাদের রুজির হাতিয়ার এখানে ফেলে গেছে। এটাই প্রবলেম।

সোহিনী বলল–আমি কিন্তু প্রাইভেট ডিটেকটিভদ্রলোকের সঙ্গে কন্ট্যাক্ট বাতিল করব। উনিই আপনাকে মিসগাইড করেছেন। বুধুয়া। এই শাবল আর কোদাল কাদের, তা কীভাবে জানা যাবে বলো তো?

বুধুয়া বলল–দিদি! শাবল আর কোদাল এখানেই পড়ে থাক। যারা গর্ত খুঁড়ছিল, তারাই এসে নিয়ে যাবে।

সোহিনী বলল–কিন্তু তোমার এই স্যার যে ওদের ভয় দেখাতে রিভলভারের গুলি ছুঁড়েছেন। এর পর ওরা কি আর ওখানে আসতে সাহস পাবে?

বুধুয়া কী বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছে, এমন সময় শালবনের ভিতরে কাদের কথাবার্তা শোনা গেল। একজনের কণ্ঠস্বর চড়া আর ঝঝাল। সে কী ভাষায় কথা বলছে, বুঝতে পারলুম না। বুধুয়া এগিয়ে গিয়ে একটা ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি দিল। তারপর সতর্ক পা ফেলে আমাদের কাছে এল। সে চুপিচুপি বলল আপনারা এখানে থাকবেন না দিদি। শ্যামলবাবু একদল পাহাড়িকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন।

তখনই বুঝলুম, এই শ্যামলবাবু মিঃ সিংহের শ্যালক সেই শ্যামল মজুমদার।

সোহিনী বাঁকা মুখে আস্তে বলল–সেই বিপ্লবী মিলিট্যান্ট লিডার! ঠিক আছে। সে আসুক।

বুধুয়া ভীত মুখে বলল–দিদি! শ্যামলবাবুকে আপনারা বুঝিয়ে বললে উনি বুঝবেন। কিন্তু ওঁর সঙ্গে যারা আসছে, তারা গোঁয়ার। স্যার! আপনারা চলে আসুন। শিগগির!

বলে বুধুয়া দ্রুত কালো পাথরটার আড়ালে অদৃশ্য হল। সোহিনী ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অগত্যা একটা হাত ধরে টেনে বললুম–পাগলামি কোরো না সোহিনী। আমরাই দোষী। চলে এসো। পরে ওই বিপ্লবী ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে যা বলার, তা বলা যাবে। এ মুহূর্তে আদিবাসীদের ফেস করা বিপজ্জনক।

সোহিনীকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে এলুম। তারপর পুকুরপাড়ের রাস্তা দিয়ে রাজবাড়িতে ঢুকে পড়লুম। তীর্থব্রত সিংহ ছাড়া আপাতত ওই লোকগুলোকে কেউ বুঝিয়ে শান্ত করতে পারবে না।…

রাজবাড়ির দোতলায় উঠে সোহিনী ডান দিকে সবেগে চলে গেল। আমি বাঁ দিকে এগিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকলুম। কর্নেল নেই। তাই উদ্বেগ বোধ করছিলুম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মনে হল, আমি কি নিজের অজ্ঞাতসারে সত্যিই সোহিনীর প্রেমে পড়ে গেছি। তা না হলে নেহাত অকারণে তার আক্রান্ত হওয়ার কথা আমার মাথায় এসেছিল কেন? যেন শিভালরি দেখাতেই লোকদুটোকে ভয় পাইয়ে দিতে রিভলভারের একটা দামি বুলেট খরচ করে ফেললুম। আমি কল্পনাও করিনি ব্যাপারটা এতদূর গড়াতে পারে।

দক্ষিণের এই ঘর থেকে দোতলার উত্তরদিকের বারান্দা ও ঘরগুলো দেখা যায়। বাতাসে দরজার পর্দা সরে যাচ্ছিল। দেখলুম, তীর্থব্রত সিংহ হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। তার পিছনে সোহিনী। অরুণিমা তাকে বারবার ডাকছেন। কিন্তু সে পিছু ফিরে তাকাল না।

সোহিনী কলকাতায় বলেছিল, সে শ্যামল মজুমদারকে ফেস করবে। কর্নেল তাকে নিষেধ করেছিলেন। সোহিনীও দেখছি বড় গোঁয়ার মেয়ে।

কী হয়, তা আড়াল থেকে দেখব কি না ভাবছিলুম। হঠাৎ মনে পড়ল, দক্ষিণের ব্যালকনি থেকে উত্তর-পূর্বের শালবনটা দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমে রিভলভারের বুলেটকেস থেকে ফায়ার্ড বুলেটের খোলসটা বের করে ব্যাগের ভিতরে আরো ছটা তাজা থ্রি নট থ্রি বুলেটের সঙ্গে মিশিয়ে রাখলুম এবং একটা তাজা বুলেট রিভলভারের খালি বুলেটকেসে ঢুকিয়ে ব্যাগে ভরে রাখলুম। দরকার হলে মিথ্যা কথা বলব ভেবেই এই কাজটা করলুম। অর্থাৎ সোজা জানিয়ে দেব, আমি গুলি ছুড়িনি। ওরা রিভলভার দেখেই পালিয়েছিল।

দক্ষিণের ব্যালকনিতে বসে দেখলুম, প্রকাণ্ড কালো পাথরের একটা অংশ চোখে পড়ছে। সেখানে একজন রোগাটে গড়নের যুবক দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে কিছু বলছে। তার পরনে হাফহাতা নীল হাওয়াই শার্ট এবং ছাইরঙা প্যান্ট। কাঁধে একটা কাপড়ের ব্যাগ ঝুলছে। সম্ভবত সে-ই শ্যামল মজুমদার। এপাশে সে মুখ ঘোরালে দেখলুম, মুখে একটুখানি এলোমলা গোঁফদাড়ি আছে।

এক পলকের জন্য মিঃ সিংহ এবং সোহিনীকে দেখতে পেলুম। তারপর গাছপালার আড়ালে শ্যামল মজুমদার ঢাকা পড়ল। পুকুরপাড়ে একটা গলায় দড়ি বাঁধা গোরু ঘাস খাচ্ছে। তার বাছুরটাও যেন ঘাস খাওয়ার ভঙ্গি করছে। আবার দৌড়ে ঝোপের আড়ালে চলে যাচ্ছে। বুধুয়াকে দেখতে পেলুম না। সম্ভবত সে তার স্যারের সঙ্গে গেছে।

দীর্ঘ পনেরো মিনিট পরে পুকুরপাড়ে সোহিনীকে দেখতে পেলুম। সে হন হন করে এগিয়ে আসছিল। আরও কয়েকমিনিট পরে তীর্থব্রত ও বুধুয়াকে দেখতে পেলুম। বুধুয়া পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে রইল। তীর্থব্রত আস্তেসুস্থে হেঁটে আসছিলেন। মুখটা বেজায় গম্ভীর।

কিছুক্ষণ পরে পশ্চিমে রাস্তার দিকে গাড়ির শব্দ কানে এল। ব্যালকনি থেকে ঘরে ঢুকে দরজার কাছে গেলুম। দেখলুম, ক্যাপ্টেন হরিচরণ পাণ্ডের জিপ থেকে কর্নেল নেমে গেটের দিকে আসছেন। তখনই আমার সব উদ্বেগ কেটে গেল।

যেন কিছুই ঘটেনি, এমন নির্বিকার মুখে বসে রইলাম। তারপর তীর্থব্রত কর্নেলের সঙ্গে কথা বলছেন কানে এল। সোহিনীর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর শুনলুম-শালবন রাজবাড়ির প্রপার্টি। কেন সেখানে যেমন খুশি ঢুকে খোঁড়াখুঁড়ি করবেন কাকু। আমার স্ট্রেটকাট কথা। আপনার শ্যালক এভাবে আমার বিরুদ্ধে লোকেদের উত্তেজিত করলে আমি চুপ করে থাকব না।

তারপর কর্নেল এবং তীর্থব্রত ঘরে ঢুকলেন। কর্নেল সহাস্যে বললেন জয়ন্ত! তুমি সোহিনীর পাল্লায় পড়ে প্রব্লেম বাধিয়ে বসে আছো! সোহিনী রাইফেলশুটার! সে যা পারে, তুমি তা পারো না।

একটু হেসে বললুম কর্নেল ভুলে যাচ্ছেন! আমিও একসময় রাইফেল ক্লাবের মেম্বার ছিলুম।

কর্নেল ক্যামেরা-বাইনোকুলার এবং পিঠের কিটব্যাগ খুলে কোনার দিকে একটা টেবিলে রাখলেন। তারপর মুচকি হেসে বললেন–ভাগ্যিস আদিবাসীদের সঙ্গে মিঃ সিংহের সম্পর্ক ভালো। জোর বেঁচে গেছ!

মিঃ সিংহ বললেন–না, না। তেমন কিছু না জয়ন্তবাবু। আপনি এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবেন না।

বললুম–শ্যামলবাবুর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। বুধুয়া আমাদের তাঁর সম্পর্কে ভয় পাইয়ে দিয়েছে।

বুধুয়া একটা বুদ্বু! আর শ্যামলেরও ক্রমশ মাথার গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। ওকে আর আমি আশ্রয় দিতে পারব না। জানেন? আমার খাতিরে পুলিশ ওকে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে চলছে। ওর নামে দ্বারভাঙা জেলায় কয়েকটা মামলা ঝুলছে!

শ্যামলবাবু কয়েকজন আদিবাসীকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন দেখে বুধুয়ার পরামর্শে আমি ও সোহিনী কেটে পড়েছিলুম। কিন্তু চিন্তা করুন, শালবনের মধ্যে দুটো লোক গর্ত খুঁড়ছে। তারপর সোহিনী একা ব্যাপারটা যে দেখতে গেছে, অমনই….

আমাকে মিথ্যা কথা বলার দায় থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে মিঃ সিংহ বললেন– সোহিনী আফটার অল মেয়ে। তার ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। ফিলিপ আর যোশেফ দুই-ভাই ওখানে কন্দ খুঁড়তে এসেছিল। তারা সোহিনীকে তখনই বললেই পারত, তারা কী করছে। যাক গে। ছেড়ে দিন ওসব কথা। আমি ননীঠাকুরকে ব্রেকফাস্টের টেবিল সাজাতে বলি। দশটা বেজে গেছে।

কর্নেল বাথরুমে ঢুকেছিলেন। তীর্থব্রত সিংহ চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এসে বললেন– ন্যান্সি আচারিয়াকে কাল ট্রেনে বা প্লাটফর্মে আমরা খুঁজে পাইনি। কিন্তু একই ট্রেনে এসেছেন, মেমসায়েব।

জিজ্ঞেস করলুম-মেমসায়েবের সঙ্গে আলাপ করে এলেন বুঝি?

নাহ। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের ফার্মহাউস থেকে সার্ভিস টু দ্য ম্যানকাইন্ড প্রতিষ্ঠানের দূরত্ব মাত্র আধ কিলোমিটার। আমার বাইনোকুলারে মেমসায়েবকে দেখে এলুম।

–হালদারমশাইয়ের কাছে যাননি?

গিয়েছিলুম। উনি চুপচাপ বসে নেই। একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র উনি পেয়ে গেছেন।

হাসতে হাসতে বললুম–রাজবাড়ির পিছনে শালবনের মধ্যে একটা গর্ত খোঁড়ার মতো সূত্র?

কর্নেলও হাসলেন। –না। এটা অন্যরকম। তবে উনি যে শাবলনের মধ্যে দুটো লোককে কাল চুপিচুপি গর্ত খুঁড়তে দেখেছিলেন, তাতে মনে সন্দেহ জাগা স্বাভাবিক। সেই ঐতিহাসিক জুয়েলসের কথা মাথায় রাখলে সন্দেহ তো আরও তীব্র হবে। বিশেষ করে হালদারমশাইকে দেখামাত্র যদি লোকদুটো তখনই গা-ঢাকা দেয়। তবে হালদারমশাই অভিজ্ঞ প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। উনি তোমার মতো রিভলভার বের করেননি বা গুলিও ছোড়েননি।

কর্নেলকে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে শোনালুম। এ-ও বললুম, সোহিনী একা থাকলে ওরা নিশ্চয় তার উপর হামলা করত। ওদের হিংস্র চোখগুলো দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলুম।

–হ্যামলা বলতে তুমি কি কদর্য কিছু বোঝাতে চাইছ?

–হ্যাঁ। জঙ্গলে একা এক যুবতী। ওদিকে দুটো আদিম প্রকৃতির মানুষ।

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–স্বীকার করছি ওদের মধ্যে এখনও আদিম মানুষের কিছু স্বভাব থেকে গেছে। কিন্তু তুমি সাংবাদিক। কখনো কি শুনেছ ওরা আমাদের সুসভ্য মানুষের মতো কোনো মেয়েকে একা পেয়ে ধর্ষণ করেছে? কোনো-কোনো আদিবাসী গোষ্ঠীকে চুরি-ডাকাতি করে বলে ব্রিটিশ আমলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু মেয়েদের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে এদেশের আদিবাসী গোষ্ঠীর সচেতনতার প্রশংসা করতেই হবে। আমাদের মতো সভ্যদের সংস্পর্শে ওরা ব্যক্তিগতভাবে খারাপ হতেই পারে। কিন্তু সেজন্য তাদের সমাজ তাকে কঠিন শাস্তি দেয়।

কর্নেলের এই গুরুগম্ভীর লেকচারকে খগুনের জন্য আমি ওদের জানগুরুর বিচারে ডাইনি বলে মেয়েদের হত্যার ঘটনা শোনাতে চাইছিলুম। কিন্তু একটা ষণ্ডামার্কা প্যান্ট-হাওয়াই শার্ট পরা গুফো লোক এসে পর্দা তুলে সেলাম দিল এবং বিনীতভাবে বলল-সায়েবদের ব্রেকফাস্ট রেডি!

কর্নেল বললেন–তুমিই কি ভজুয়া?

লোকটা হাসবার চেষ্টা করে বলল–স্যার! আমি ভজনলাল। তবে সবাই আমাকে ভজুয়া বলে ডাকে।

লোকটাকে অনুসরণ করে কর্নেল বললেন–যেদিন ভোরে রানিমা মারা যান, তখন তুমি কোথায় ছিলে?

এই আকস্মিক প্রশ্নে ভজুয়া থমকে দাঁড়াল। তারপর মৃদু স্বরে বলল–পুলিশ আমাকে অনেক জেরা করেছে। তা আপনি স্যার যখন একই কথা জিজ্ঞেস করছেন, আমার জবাব, একরকম ছাড়া দুরকম হবে না। স্যার! আমি সেদিন ভোরবেলা রাজবাড়ির পুকুরের ওদিকে মাঠে গিয়েছিলুম। আগের রাত্রে রানিমা বলেছিলেন, দোতলা থেকে উনি দেখতে পেয়েছেন ধানখেতে খুব বেশি জল জমে গেছে। যারা জমিগুলোতে চাষ করে, তারা আসছে না। আমি যেন গিয়ে আল কেটে জল বের করে দিই। তাই কোদাল নিয়ে মাঠে গিয়েছিলুম। পনেরো বিঘে জমি আছে স্যার। পাঁচ জায়গায় আল কেটে নিচের খালে জল নামিয়ে দিচ্ছিলুম। জল কমে গেলে আবার আলগুলোর কাটা জায়গা কাদা দিয়ে বন্ধ করতে হবে। এই কাজ সেরে রাজবাড়ি ফিরে কান্নাকাটি শুনতে পেলুম। বুধুয়া বলল, রানিমার বেড়ালগুলো মারা গেছে। সেই শোকে রানিমা হার্টফেল করে মারা গেছেন। বাঙালিটোলার অবনীবাবু ডাক্তার এসেছিলেন, তা-ও শুনলুম।

কর্নেল বললেন–চলল! যেতে যেতে আরেকটা কথা জেনে নিই।

ভজুয়া বলল–যা জিজ্ঞেস করবেন, ঠিক জবাব দেব স্যার। এই রাজবাড়িতে আমার জন্ম। আমার চৌদ্দোপুরুষ এই রাজবাড়ির লোক।

হলঘরের সিঁড়িতে নামতে নামতে কর্নেল বললেন–নন্দরানি আর সরকারজির ঘর সার্চ করে পুলিশ যখন টাকা খুঁজে পেয়েছিল, তুমি তখন কোথায় ছিলে?

–আমাকে আমার সায়েব রানিমার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে বলেছিলেন। তাই আমি সেখানেই ছিলুম। পরে পুলিশ এসে দরজা আটকে দিয়েছিল।

–তুমি রানিমাকে তখন কোথায় দেখেছিলে?

–উনি পালংকে শুয়েছিলেন। বডির ওপরে চাদর ঢাকা ছিল।

–আর বেড়ালগুলো?

—বেড়ালগুলোকে তখন কারা নীচে নিয়ে গিয়েছিল।

–বেড়ালগুলোকে তুমি তাহলে দেখতে পাওনি?

–না স্যার। পরে শুনলুম, বুধুয়া দু-জন মজুর ডেকে এনে রাজবাড়ির ভিতরে পূব-দক্ষিণ কোনায় বেড়ালগুলোকে কবর দিয়েছে। তারপর সন্ধেবেলায় পুলিশ এসে গর্ত খুঁড়ে সেগুলোকে বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়েছিল।

–প্রকাশ সুখানিয়াকে তুমি চেনো নিশ্চয়?

–ভজুয়া বলল–তাকে সবাই যেমন চেনে, আমিও তেমনি চিনি। কেন স্যার?

–রানিমার মৃত্যুর আগের দিন বিকেলে তুমি খ্রিস্টান মিশনের হাসপাতালে গিয়েছিলে। তাই না?

ভজুয়াকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল। সে বলল–আমি মিশনারি হাসপাতালে ওষুধ আনতে গিয়েছিলুম। আমার কিছুদিন অন্তর মাথায় যন্ত্রণা হয়। অবনীডাক্তারের ওষুধে সারেনি। তাই….

–সেখানে প্রকাশ সুখানিয়া ছিল। তার গাড়িতে চাপিয়ে সন্ধ্যাবেলায় প্রকাশ তোমাকে রাজবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল।

ভজুয়া হাসবার চেষ্টা করে বলল–এসব কথা আপনাকে কে বলেছে জানি না স্যার! আপনিই বা কেন আমাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন তা-ও বুঝতে পারছি না।

কর্নেল হাসলেন। তোমার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। প্রকাশ সুখানিয়া তোমার চেনা লোক। তুমি তাকে অনুরোধ করলে তার গাড়িতে চাপিয়ে আনতেও পারে। কারণ বর্ষার সময় সন্ধ্যাবেলা অন্ধকারে আসতে তোমার অসুবিধে হওয়ারই কথা!

–ঠিক বলেছেন স্যার! তবে আমার সায়েবকে যেন দয়া করে একথা বলবেন না। আমাকে তাহলে তিনি তাড়িয়ে দেবেন। কাচ্চাবাচ্চা আর বউ নিয়ে আমি কোথায় দাঁড়াব, বলুন স্যার? বলে সে কর্নেলের পা ছুঁতে নিচু হল।

-না। না। আমি ওঁকে বলব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।

–কিন্তু এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন, বুঝতে পারছি না স্যার।

–পরে পারবে। আমি আজ খ্রিস্টান হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখানে এক মেমসায়েবের সঙ্গে আলাপ হল। আমি রাজবাড়ির ঘটনা নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বলছিলুম। তখন, মেমসায়েবই তোমার কথাটা বললেন।

হলঘরে ভিতরের দরজা দিয়ে আমরা প্রশস্ত ডাইনিংরুমে ঢুলুম। ভজুয়া আমাদের পৌঁছে দিয়েই বাঁ দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ডাইনিং টেবিলে সোহিনী আর মিঃ সিংহ অপেক্ষা করছিলেন। সোহিনীর মুখে গাম্ভীর্য দেখে বুঝলুম শ্যামল মজুমদারের উপর তার রাগ এখনও পড়েনি।

তীর্থব্রত বললেন–দশটায় ব্রেকফাস্ট করার কথা। দশটা পঁচিশ বাজে। ভজুয়া কি কর্নেলসায়েবকে তার ভালুক মারার গল্প শোনাচ্ছিল?

কর্নেল হাসলেন। ভজুয়া ভালুক মেরেছিল নাকি?

তীর্থব্রত একটু হেসে বললেন–মেরেছিল। তবে সবাই যখন আহত ভালুকটাকে তাড়া করে একটা খাদে ফেলেছে, তখন সে ভালুকটার মাথায় কুড়লের কোপ বসিয়েছিল। এই বীরত্বের গল্প সে সবাইকে শোনায়। আপনার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি ভেবেছিলুম সে তার সেই বীরত্বের গল্প শোনাচ্ছে। আসলে ভজুয়ার চেহারা দেখে যা মনে হবে, প্রকৃতপক্ষে সে তার উল্টো।

কর্নেল বললেন–সোহিনী! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, শালবনে গর্ত খোঁড়ার ঘটনাটা তুমি মেনে নিতে পারোনি। না পারারই কথা। জয়ন্ত ভজুয়ার মতো বীরত্ব দেখাতে গিয়ে অকারণ একটা ঝামেলা বাধিয়েছিল।

সোহিনী হাসল না। সে আস্তে বলল-ঝামেলা কীসের? আমি এসব ব্যাপারে গ্রাহ্য করি না। অকারণে একজন আউটসাইডার সামান্য একটা ব্যাপারকে পলিটিক্যাল ইস্যু করবে। তা করুক না।

তীর্থব্রত বললেন–আঃ সোহিনী! আমি তো বলেছি, শ্যামল নিজের দোষে নিজেই বিপদে পড়বে। তা ছাড়া আমি এবার ঠিক করেছি, ওইসব পাগলামি না ছাড়লে ওকে প্রোটেকশন দেওয়া আর আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

বললুম–আসল দোষটা কিন্তু আমার।

কর্নেল বললেন–খাওয়ার সময় কথা নয়। আমার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। এসময়ে তোমাদের কথা দৈবাৎ কানে গেলে আমি কিছু বলার চেষ্টা করব। আর তখনই আমার শ্বাসনালিতে লুচির টুকরো আটকে যাবে। এর জন্য দায়ী হবে জয়ন্ত আর সোহিনী।

সোহিনীর মুখে এতক্ষণে একটু হাসি ফুটল।

ব্রেকফাস্টের পর তীর্থব্রত বললেন–কর্নেলসায়েবের গাড়ির দরকার হলে বলুন। আমি ফ্যাক্টরিতে ফোন করে ম্যানেজারের গাড়িটা আনতে বলব। আমার গাড়িটা কর্নেলসায়েব নেবেন। ড্রাইভার শাকিলের বাড়ি বাঙালিটোলার শেষে। ওকে এগারোটায় আসতে বলেছি। কারণ ফ্যাক্টরিতে যেতেই হবে। শাকিল আপনাদের সার্ভিস দেবে।

কর্নেল বললেন–এবেলা আমার গাড়ির দরকার নেই। বিকেল চারটেতে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে গাড়ি পাঠাবেন। আর একটা কথা। আপনি ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার আগে আপনার ল-ইয়ারকে টেলিফোনে জানিয়ে দিন, নন্দরানি আর দুবেজির জন্য আবার জামিনের দরখাস্ত যেন তিনি পরবর্তী শুনানির দিন আদালতে পেশ করেন।

–আগামীকাল বুধবার নেক্সট হিয়ারিংয়ের তারিখ পড়েছে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ওদের সাতদিনের জন্য পুলিশ হাজতে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। গোড়া থেকেই আমি চেষ্টা করে আসছি, যাতে ওরা জামিন পায়। কিন্তু ও সি রামকুমার প্রসাদ পাবলিক প্রসিকিউটরকে কী মন্ত্র জপিয়েছেন জানি না। তিনি অনবরত বাগড়া দিচ্ছেন। আমার ল-ইয়ার বাঙালি। প্রদীপ্ত চ্যাটার্জি। এস ডি জে এমের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক আছে। জে এম প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন, ঘরে মাত্র দশ হাজার টাকা রাখাটা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩০২ নম্বর ধারা প্রয়োগের ব্যাপারে তত মজবুত পয়েন্ট নয়। পি-পি-বক্তব্য, যারা রানিমার কাছের লোক, তাকে খুন করার সুযোগ তাদেরই বেশি।

ওঁরা কথা বলতে থাকলেন। সোহিনী আমার কাছে এসে আস্তে বলল–চলুন জয়ন্তদা! আমরা নৈনি নদীর ধারে বেড়িয়ে আসি।

ভজুয়া যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল, আমরা দুজনে সেখান দিয়ে বেরিয়ে দেখি নীচের তলাতেও টানা বারান্দা এবং প্রকাণ্ড সব থাম। দোতলাতেও এমন থাম আছে। বারান্দা থেকে ঘাসে ঢাকা প্রাঙ্গণে নেমে বললুম–রাজবাড়িটা ইতালিয়ান স্থাপত্যের ধাঁচে তৈরি। এ ধরনের থামকে করিন্থিয়ান পিলার বলা হয়। শুধু ডাইনে বেঁকে এল প্যাটার্নের ব্যাপারটা একটু বেখাপ্পা।

সোহিনী বলল–আমি স্থাপত্য-টাপত্য বুঝি না। শুধু এটুকু জানি, আপনি যেটা এল প্যাটার্ন বলছেন, ওটা স্বর্ণদিদিমার বাবা পুরোনো রাজবাড়ির সঙ্গে জুড়ে। দিয়েছিলেন। স্বর্ণদিদিমা বলতেন, রাজবাড়ির দক্ষিণ দিকের বিশাল উপত্যকার মতো খোলামেলা জায়গাটা দেখার জন্য তিনি তৈরি করেছিলেন।

বললুম–বাঃ! তার সৌন্দর্যবোধের প্রশংসা করা উচিত।

সোহিনী গেটের কাছে গিয়ে বলল-ওখানে আমি টার্গেট শু্যটিং প্র্যাকটিস করব। রাজবাড়ির মধ্যে তত স্পেস নেই। তা ছাড়া দৈবাৎ কর্মচারীদের কাচ্চাবাচ্চারা গিয়ে পড়লে বিপদ। তাই না?

-হ্যাঁ। তুমি ঠিকই বলেছ।

উঁচু জমি থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে নিচের এবড়োখেবড়ো পিচরাস্তায় গেলুম। তারপর দক্ষিণে কিছুটা এগিয়ে সোহিনী বলল-চলুন! ওই ব্রিজের কালভার্টে বসা যাক। ব্রিজের ওপর গাছের ছায়া পড়েছে। রোদ্দুর বিরক্ত করবে না।

কোন মান্ধাতার আমলের পাথরের ব্রিজের ওপর গিয়ে বললুম–সোহিনী! তুমি কি জানো তোমার প্রাইভেট ডিটেকটিভ ওই টিলার গায়ে সুন্দর রেস্টহাউসে বাস করছেন?

সোহিনী প্রথমে অবাক হল। তারপর হেসে উঠল। কী আশ্চর্য! আমি আমার গোয়েন্দামশাইয়ের কথাই একেবারে ভুলে গেছি। বাংলোটা কার?

-ওটা ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্টহাউস।

–তাই বলুন! ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আমাকে তার নতুন একটা রিসর্টের কথা বলেছিলেন। ওখানেই আপনাদের ওঠার কথা ছিল। কিন্তু কর্নেলসায়েব রাজবাড়িতে থাকতে চেয়েছিলেন। আপনারা ওখানে থাকলে আনন্দ পেতেন। আমি যখন তখন গিয়ে হাজির হতুম।

সোহিনী! ভুলে যেয়ো না। কর্নেল আনন্দ পেতে আসেননি। তার একমাত্র উদ্দেশ্য, তোমার স্বর্ণদিদিমার হত্যাকাণ্ডের রহস্যভেদ।

–ওঃ জয়ন্তদা! আপনি বড্ড সিরিয়াস।

হেসে ফেললুম। –ঠিক বলেছ সোহিনী। আজ সকালে বড্ড সিরিয়াস হতে গিয়েই খামোকা একটা বুলেট খরচ করে ফেলেছি। এখন অবশ্য সঙ্গে অস্ত্র-টা নেই। কিছু ঘটলে তোমাকে ফেলে লেজ তুলে পালিয়ে যাব।

সোহিনী হেসে অস্থির হল। তারপর বলল-এই প্রকৃতি-ট্রকৃতি আমার কিন্তু বড্ড একঘেয়ে লাগে। বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না। বরং চলুন না, ক্যাপ্টেনদাদুর রেস্টহাউসে আমার গোয়েন্দামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

–চলো। তবে তাকে প্রথম দর্শনে চিনতে পারবে না।

–কেন?

–তিনি ছদ্মবেশে আছেন। কল্পনা করো সোহিনী! মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মাথায় পরচুলা। তার ওপর টুপি। নেকটাই–স্যুটপরা হালদারমশাইয়ের হাতে ছড়ি এবং মুখে পাইপ থাকাও সম্ভব। যদিও উনি নস্যি নেন।

সোহিনী হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল–আচ্ছা জয়ন্তদা, কর্নেলসায়েব আর আপনি ওঁকে হালদারমশাই বলেন কেন? উনি তো একজন রিটায়ার্ড পুলিশ ইন্সপেক্টর।

বললুম–ঘটনাটা কর্নেলের কাছে জেনে নিয়ো। কারণ আমি তখনো কর্নেলের সান্নিধ্যে আসিনি।

–যেটুকু জানেন, বলুন।

কোনো বড়োলোকের বাড়িতে মেয়ের বিয়ের আসরে বরযাত্রীদের ভিড়ে মিশে একদল ডাকাত হানা দেবে, এরকম একটা খবর। মেয়ের মামার কানে এসেছিল। তিনি কর্নেলের বন্ধু ছিলেন। কর্নেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদারকে পাত্রীপক্ষের কর্তা সাজিয়ে নিয়ে যান। স্থানীয় থানার কিছু পুলিশও সাদা পোশাকে রাখা হয়। কথা ছিল, কর্নেল বরযাত্রীদের দিকে নজর রাখবেন এবং সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই বলে উঠবেন, হালদারমশাই! হালদারমশাই! আপনার ভাগনির চোখে পোকা! অমনি অ্যাকশন শুরু হবে। গেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। তো মিঃ হালদারকে কর্নেল যে-ই ওই কথাটা বলেছেন

তার মানে কর্নেল ডাকাত বলে কাউকেও চিনতে পেরেছিলেন?

–সন্দেহ করেছিলেন। তো কর্নেল কথাটা বলা মাত্র মিঃ হালদার পাঞ্জাবির ঝুলপকেট থেকে রিভলভার বের করে পর-পর তিন রাউন্ড ফায়ার করে বসলেন!

বরযাত্রীদের দিকে?

–না। মাথার ওপরে দোয়ার দিকে। অনেক বা গুড়ো হয়েছিল। শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে গিয়েছিল সামিয়ানায়। সেই সুযোগে ডাকাতের দল পিঠটান দিয়েছিল। আর তারপর থেকে মিঃ হালদার হয়ে গেলেন হালদারমশাই।

সোহিনী আবার হেসে অস্থির হল। রেস্ট হাউসের দূরত্ব আধ কিলোমিটারেরও কম। সংকীর্ণ মোরামবিছানো রাস্তাটা রোদে শুকিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দু-ধারে গাছ থাকায় ছায়াও পাচ্ছিলুম। টিলার নিচে গিয়ে দেখলুম, একজন মধ্যবয়সী ধুতি পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোক গেট থেকে আমাদের লক্ষ করছেন। রাস্তাটা বাঁক নিয়ে টিলার দক্ষিণ দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে। গেট অব্দি সামান্য চড়াইটুকু পিচে ঢাকা এবং দুধারে রঙিন ইটের কেয়ারি করা। গেটের কাছে গিয়ে বাংলায় জিজ্ঞেস করলুমক্যাপ্টেন পাণ্ডের গেস্ট ভদ্রলোক কি আছেন?

ভদ্রলোক জবাব দিলেন হিন্দিতে। হালদারসাব ন-টায় বেরিয়েছেন। বলে গেছেন ফিরতে একটা বেজে যাবে।

রাজবাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে সোহিনী বলল–আমার গোয়েন্দামশাই যে চুপচাপ বসে নেই, তা বোঝা গেল। কিন্তু হাঁটিহাঁটি করে আমি এখন টায়ার্ড জয়ন্তদা। ঘরে গিয়ে সটান শুয়ে পড়ব।

বললুম–আমিও ক্লান্ত। আমিও শুয়ে পড়ব।

গেটের একটা অংশ খোলা ছিল। দারোয়ান গেটের পাশে তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদের দেখে সে সেলাম দিল। সে বলল–দিদিজি! এই রোদে কোথায় গিয়েছিলেন?

তোমাদের পাগলি নৈনিমাকে দর্শন করে এলুম।

দারোয়ান অবাক হয়ে বলল–নৈনি মাইজি পাগলিই বটে। কিন্তু মাইজির মন্দির তো গড়ের জঙ্গলে। আপনারা অতদূর গিয়েছিলেন? ওখানে হাতির উৎপাত আছে দিদিজি।

রামু! তুমিও দেখছি পাগল! নৈনিমাইজির দর্শন তো রাস্তার ওধারে গেলেই পাওয়া যায়।

দারোয়ান হেসে ফেলল।–তা ঠিক দিদিজি। আমি ভাবলুম আপনারা মন্দিরে গিয়েছিলেন।

সোহিনী বলল–সাদা দাড়িওয়ালা সায়েব, মানে কর্নেলসায়েব কি বেরিয়েছেন?

-না দিদিজি। একটু আগে দেখলুম উনি রাজবাড়ির পিছনে প্রজাপতির ছবি তুলছেন।

বললুম–চলো সোহিনী! আমরা দুজনেই ক্লান্ত। কিন্তু কর্নেলের প্রজাপতির ছবি তোলার দৃশ্য দেখলে ক্লান্তি ভুলে যাব।

সোহিনী লনে হাঁটতে হাঁটতে বলল–কেন বলুন তো?

কর্নেলের এই ব্যাপারটা দেখলে হাসির চোটে ক্লান্তি পালিয়ে যাবে। কখনও গুঁড়ি মেরে, কখনও কুঁজো হয়ে, কত অদ্ভুত ভঙ্গিতে ক্যামেরা তাক করবেন কর্নেল। এগিয়ে যাবেন। আবার পিছিয়ে আসবেন। কখনও মুখটা এত উঁচু করবেন যে ওঁর মাথার টুপি খুলে পড়ে যাবে। আর চকটকে টাকে রোদ্দুর পড়ে তোমার চোখ ঝলসে যাবে। আর প্রজাপতিগুলোও যেন কর্নেলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলায় মেতে ওঠে।

সোহিনী চোখে হেসে বলল–চলুন। তাহলে চুপিচুপি গিয়ে ঝোপের আড়াল থেকে দেখব। আমাদের দেখতে পেলে উনি পোজ বদলে ফেলতে পারেন।

–ঠিক বলেছ।

বলে সোহিনীকে অনুসরণ করলুম। কিছুটা এগিয়ে বাড়িটার দক্ষিণে রঙ্গনা আর জবাফুলের ঝোপের আড়ালে সোহিনী বসল। আমিও বসলুম। তারপর দেখলুম, কর্নেল বাড়ির পূর্বের দেওয়ালের নীচে ঘন ঘাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে উপরে তাকাচ্ছেন। আবার নীচে তাকাচ্ছেন। সোহিনী আমার দিকে তাকাল। আমি ফিসফিস করে বললুম–প্রজাপতিটা হয়তো উপরে উড়ে গিয়ে কার্নিশে বসেছে।

তারপর দেখলুম কর্নেল এগিয়ে গিয়ে পূর্বের খোলা চত্বরে উঠলেন। তারপর যে দরজা দিয়ে অদৃশ্য হলেন, সেটা হলঘরের পিছনের দরজা। ওখান দিয়েই সকালে সোহিনী আমাকে শালবনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল।

সোহিনী উঠে দাঁড়িয়ে বলল–ব্যাড লাক! চলুন। ক্লান্তিটা বেড়ে গেল।

আমরা সোজা এগিয়ে গাড়িবারান্দার তলা দিয়ে হলঘরে ঢুকলুম। তারপর দোতলায় উঠে সোহিনী ডান দিকে এবং আমি বাঁ দিকে এগিয়ে উত্তরের বারান্দা দিয়ে হেঁটে আমাদের ঘরে ঢুকলুম। দেখলুম, কর্নেল কিটব্যাগের মধ্যে হাত ভরে কী যেন খুঁজছেন। আমাকে দেখে তিনি কপট গাম্ভীর্যে বললেন–সোহিনীর সঙ্গে বড্ড বেশি মেলামেশা করছ। সাবধান!

আমিও কপট ক্ষোভের সঙ্গে বললাম কী আশ্চর্য! সোহিনী আমাকে তার গোয়েন্দা ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে বলেছিল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্টহাউসে গিয়ে শুনলুম তিনি নেই।

–কিন্তু কিছুক্ষণ আগে রাজবাড়িতে ঝোপের আড়ালে বসে দুজনে প্রেম করছিলে না?

হেসে ফেললুম। ওঃ কর্নেল! আপনার সর্বাঙ্গে চোখ আছে। তবে আপনি যা ভাবছেন, তা নয়। আমরা আপনার প্রজাপতি ছবি তোলার খবর পেয়েছিলুম দারোয়ান রামুর কাছে। ওইসব আপনি যে-সব অদ্ভুত ভঙ্গি করেন, সোহিনী তা উপভোগ করতে চাইল। তাই তাকে নিয়ে ঝোপের আড়ালে বসেছিলুম। কিন্তু আপনি একবার উপর, একবার নিচে তাকিয়ে কী প্রজাপতি দর্শন করছিলেন?

কর্নেল কিটব্যাগে চেন টেনে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসলেন। তারপর মিটিমিটি হেসে বললেন–ডার্লিং! যুবক-যুবতীদের প্রেম করতে দেখলে এ বৃদ্ধের মনে হয়, পৃথিবীটা তা হলে এখনও গলে পচে ক্ষয়ে যায়নি। তবে সোহিনী সম্পর্কে তোমাকে বলার কথা হল, তার একজন বয়ফ্রেন্ড আছে।

বললুম–কী অদ্ভুত কথাবার্তা। হাঁটাহাঁটি করে প্রচণ্ড ক্লান্তির সময় প্রেম? বলে জুতো খুলে আমি এ পাশের বিছানায় শুয়ে পড়লুম।

কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন–ঘুমিয়ে পোড়োনা যেন। একটু পরে স্নান করে নেবে। একটায় আমরা খেয়ে নেব। তারপর …।

বলে কর্নেল চুপ করলেন। জিজ্ঞেস করলুম-তারপর?

–তারপর দেখবে কী হয়।

–কী হবে?

 –যথাসময়ে দেখতে পাবে।

–কী দেখতে পাব বললে কি আপনার মহাভারত অশুদ্ধ হবে?

কর্নেল চোখে হেসে বললেন–তুমি আর সোহিনী যা দেখার জন্য ঝোপের আড়ালে বসেছিলে।

না হেসে পারলুম না। প্রজাপতির ছবি তোলার সময় আপনি যে সব অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করেন, তা-ই দেখতে পাব?

–ঠিক বলেছ।

–অর্থাৎ আপনি আবার প্রজাপতির ছবি তুলতে মাঠে নামবেন?

উঁহু। মাঠে নয়। অন্যত্র। যাই হোক, আর কথা নয়। তুমি স্নান করে ফেলল। সাড়ে বারোটা বাজে।

একটা পাঁচে বুধুয়া আমাদের খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছিল। কর্নেল ও আমি তার সঙ্গে ঘর থেকে বেরুচ্ছিলুম। বুধুয়া বলল-স্যার! আপনাদের ঘরে তালা এঁটে দিয়ে চলুন। ভজুয়ার একটা ছেলে আর একটা মেয়ে আছে। ওরা এতক্ষণে। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে। ভাই-বোন খুব বিচ্ছু আর ধড়িবাজ। ভোর সাড়ে ছটা থেকে সাড়ে বারোটা মুন্না আর তিন্নি স্কুলে থাকে। বাড়ি ফেরার পর ওরা রাজবাড়ির সব ঘরে উঁকিঝুঁকি মেরে বেড়ায়।

কর্নেল বললেন–জয়ন্ত! আমার কিটব্যাগের পাশে একটা তালা-চাবি দেখেছি! তালাটা আটকে দাও।

বুধুয়া বলল–আমিই দরজা খুলে ওখানে তালা চাবি রেখেছিলুম স্যার। আমিই তালা আটকে দিচ্ছি!

সে ঘরে ঢুকে, দক্ষিণের দরজা বন্ধ করল। তারপর ভিতর থেকে এই বারান্দার দিকের দুটো জানালাও বন্ধ করে দিল। দরজায় তালা এঁটে সে চাবিটা কর্নেলকে দিল।

বললুম–আমরা কতক্ষণ ধরে বাইরে কাটিয়েছি। ভাগ্যিস মুন্না-তিন্নি তখন বাড়িতে ছিল না।

কর্নেল বললেন–ভজুয়ার ছেলে-মেয়ে কোন স্কুলে পড়ে বুধুয়া?

-স্যার! ওরা মিশন স্কুলে পড়ে।

তার মানে, খ্রিস্টান মিশন স্কুলে? যেখানে হাসপাতাল আছে, সেখানে?

–হ্যাঁ স্যার। এখান থেকে বেশি দূর নয়।

–ওখানে একজন মেমসায়েবও আছেন শুনেছি। ডাক্তারি করেন। আবার মাস্টারিও করেন। তাকে তুমি নিশ্চয় দেখেছ?

বুধুয়া চাপা স্বরে বলল–আমার সায়েবের এক বন্ধু আছেন কলকাতায়। তিনি মেমসায়েবকে বিয়ে করেছেন। আমার তাজ্জব লাগে স্যার। সেই ভদ্রলোক জাতে ব্রাহ্মণ। বিলিতি সায়েব নন।

–দিশি সায়েব! কর্নেল হেসে উঠলেন।– তা বুধুয়া, মেমসায়েব আর তার স্বামী রাজবাড়িতে নিশ্চয় এসেছেন। তোমার সায়েব কি ওঁদের নেমন্তন্ন না করে পারেন?

–গত বছর বাঙালিটোলায় ওঁরা পুজোর সময় এসেছিলেন। বলে বুধুয়া থমকে দাঁড়াল। আবার চাপা স্বরে বলল-বউদিরানির ছেলেপুলে নেই। তাই সায়েব তাকে মেমসায়েবের কথায় ওঁদের হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করেছিলেন। কিন্তু রানিমা এজন্য খুব রাগ করেছিলেন। রানিমা কতবার বউদিরানির জন্য পুজোআচ্চা আর মানতের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর তাঁকে লুকিয়ে খ্রিস্টান হাসপাতালে রাখার জন্য রানিমা কিছুদিন তার ভাগনে-মানে, আমার সায়েবের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। শেষে যদি বা তার সঙ্গে রানিমা কথা বলতেন, বউদিরানিকে এড়িয়ে চলতেন। তাকে রানিমা নিজের কোনো জিনিস পর্যন্ত ছুঁতে দিতেন না। বউদিরানি আড়ালে রানিমাকে গালমন্দ করতেন, তাও শুনেছি।

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন–চলো! তোমাদের ননীঠাকুর এতক্ষণ মনে মনে আমাদের মুণ্ডুপাত করছেন।

সিঁড়িতে নামতে নামতে বুধুয়া বলল–বউদিরানিও খাওয়ার ঘরে আছেন। কলকাতার দিদিও আছেন।

জিজ্ঞেস করলুম একতলায় নামবার জন্য আরও সিঁড়ি আছে মনে হচ্ছে।

–আছে স্যার! বউদিরানির পাশের ঘর দিয়ে একতলায় নামা যায়।

ডাইনিং রুমে গিয়ে দেখলুম, সোহিনী স্নান করে সতেজ হয়েছে। পরনে গাঢ় লাল স্পোর্টিং গেঞ্জি আর জিনসের প্যান্ট। তার পাশে চেয়ারের হাতল ধরে অরুণিমা দাঁড়িয়েছিলেন। নমস্কার করে তিনি বললেন–কর্নেলসায়েবের উপযুক্ত খাবার এখানে পাওয়া যায় না। সোহিনীর কাকুর কাছে শুনেছি, আবার পাণ্ডেজিও বলছিলেন, কর্নেলসায়েবের লাইফ-স্টাইল নাকি একেবারে ইউরোপিয়ান।

কর্নেল বললেন–সোহিনী! এই সাংঘাতিক মিথ্যা রটনার প্রতিবাদ তোমারই করা উচিত।

সোহিনী শুধু হাসল। আমি বললুম–কর্নেল বাইরে-বাইরে ইউরোপিয়ান, ভিতরে একেবারে নিখাদ ভেতো বাঙালি। ভাবতে পারেন? বৃষ্টিসন্ধ্যায় কর্নেল তেলেভাজা না পেলে তার পরিচারক ষষ্ঠীচরণকে ঘরে ঢুকতে দেন না!

সোহিনী বলল–কাকিমা! তুমি কাকুর বদলে আমার সঙ্গে বসে পড়ো।

অরুণিমা বললেন–ঠাকুরমশাইকে জিজ্ঞেস করে জেনে নে, আমি দুটোর পরে খাই। তোদের খাইয়ে তবে স্নান করব। তারপর খাওয়া।

কিছুক্ষণ পরে অরুণিমা বাইরের দরজায় গিয়ে কর্কশ কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন– লছমি! এই লছমি। তোর বাঁদরদুটো আবার কালকের মতো ফুল ছিঁড়ে তছনছ করছে দেখতে পাচ্ছিস না? এবার আমি ওদের চাবকে ছাল ছাড়িয়ে নেব বলে দিচ্ছি! লছমি! শুনতে পাচ্ছিস কী বলছি?

বলে তিনি বারান্দায় চলে গেলেন। সোহিনী চাপা স্বরে বললকাকিমার সব ভালো। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ কেমন গ্রাম্য মহিলা হয়ে যায়।

ননীঠাকুর বললেন–বউদিরানির দোষ নেই। ভজুয়ার ছেলে-মেয়েদুটো সুন্দর সাজানো কিছু দেখতে পারে না। স্নান করে আমি কাপড় মেলে দেব। তো ওরা তাতে ধুলোকাদা মাখিয়ে দেবে। বুধুয়া। তুমি গিয়ে মুন্নি-তিন্নিকে থাপ্পড় মেরে ওদের ঘরে রেখে এসো। নইলে বউদিরানির স্নানখাওয়া আর হবে না।

বুধুয়া তখনি একই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

বললুম–ভজুয়া ছেলেমেয়েকে শাসন করে না?

ননীঠাকুর বললেন–করে। তবে তার ওপর বাড়ির হাজারটা কাজের ভার। জমি দেখাশোনা থেকে বাজার করা, ওষুধ আনা–কতকিছু। সে এখন নেই মনে হচ্ছে।

বললুম–তোমাদের বউদিরানির ফুলের বাগান করার খুব শখ। তাই না?

–তা স্যার, ওইসব নিয়েই তো আছেন। ভগবান কোলেপিঠে একটা এখনো দিলেন না। এসব দুঃখ মেয়েরা যতটা বোঝে, অন্যে কী বুঝবে, বলুন স্যার?

সোহিনী ভুরু কুঁচকে বাঁকা হেসে বলল-শালুক চিনেছে গোপালঠাকুর। সরি–ননীঠাকুর।  

 খাওয়া শেষ হয়ে গেল। অরুণিমা আর এলেন না। আমরা হলঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, সেই সময় সোহিনী আমাদের পিছনে এসে বলল–চলুন। আপনার ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ আড্ডা দিই। কাকিমার এইসব অদ্ভুত স্বভাবের জন্য করনগড়ে আমার আসতে ইচ্ছে করে না। স্বর্ণদিদিমা বেঁচে থাকতেও কাকিমা তুচ্ছ কথায় হইচই বাধাতেন। আবার পরে কান্নাকাটির বন্যা বইয়ে দিতেন।

হলঘরের সিঁড়িতে ওঠার সময় বললুম–জানো সোহিনী? কর্নেল বলেছেন, তখন ঝোপের মধ্যে কর্নেলের যে অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি দেখার জন্য আমরা বসেছিলুম, এবার নাকি উনি তা আমাদের দেখাবেন?

সোহিনী অবাক হয়ে বলল–ও মাই গড! কর্নেলের কি সর্বাঙ্গে চোখ আছে?

কর্নেল হাসলেন।–বাঃ! এতদিন পরে এতক্ষণে তুমি জয়ন্তের মতো শুধু কর্নেল বললে। এমনকী, জয়ন্তের মতোই আমার সর্বাঙ্গে চোখ আছে বললে। অতএব তুমি আমার কাছে এখন জয়ন্তের তুল্য হয়ে উঠলে। আমি জয়ন্তকে যেমন সস্নেহে ডার্লিং বলি, তোমাকেও বলব।

সোহিনী সিঁড়ি বেয়ে প্রায় নাচতে নাচতে উঠছিল। ও কর্নেল! আই অ্যাম সো হ্যাপি।

আমাদের ঘরের বারান্দা থেকে দেখলুম, ফুলবাগানের কাছে কেউ নেই। আমাদের নীচের বারান্দায় সম্ভবত লছমির চাপাগলায় গালমন্দ শোনা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে কাচ্চাবাচ্চার কান্নাকাটি।

ঘরে ঢুকে সোহিনী সোফায় হেলান দিয়ে বসল। কর্নেল ততক্ষণে ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরিয়ে চোখ বুজে টানছেন। দক্ষিণের দরজা দিয়ে বাইরের হাওয়া আর সিলিং ফ্যানদুটোর হাওয়া চুরুটের ধোঁয়াকে ছত্রভঙ্গ করে ফেলছে। সোহিনী আমার মতো চুরুটের ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করতে পারছে কি না জানার জন্য বললুম সকালে ননীঠাকুর বলছিলেন আমিষের ঘ্রাণশক্তি উনি হারিয়ে ফেলেছেন। সোহিনীরও মনে হচ্ছে ঘ্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছে!

সোহিনী বলল–মোটেও না। আমি শুধু কষ্ট করে প্রতীক্ষা করছি, কখন কর্নেল তাঁর সার্কাস দেখাবেন!

বললুম–দারুণ বলেছ তো! সার্কাস। তবে আমি বলব জোকারের সার্কাস।

কর্নেল চোখ বুজেই বললেন–সোহিনী! জয়ন্ত আমাকে জোকার বলছে।

সোহিনী কী বলতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে গেটের দিকে গাড়ির জোরালো হর্ন শোনা গেল। অমনি কর্নেল উঠে গিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালেন। তারপর বললেন ঠিক দুটোয় এসে গেছে ওরা। কে বলে পুলিশ সময় মেনে চলে না?

পুলিশ শুনেই চমকে উঠেছিলুম। সোহিনীও উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে বলল –পুলিশ কেন? তারপর বেরিয়ে গিয়ে কর্নেলের পাশে দাঁড়াল। আমি গিয়ে দেখলুম, বুধুয়া একজন পুলিশ অফিসার এবং দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে আসছে।

বললুম–কী ব্যাপার কর্নেল? হঠাৎ পুলিশ কেন?

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন–ওয়েট অ্যান্ড সি।

কিছুক্ষণ পরে বুধুয়া পুলিশের দলটিকে নিয়ে এই বারান্দায় আসল। অফিসার করজোড়ে কর্নেলকে নমস্কার করে বললেন–ও সি আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু একটা জরুরি কাজে তাকে অন্যত্র যেতে হল, আমি সাব-ইন্সপেক্টর অজিত বার্মা। চলুন কর্নেলসাব। ঘরদুটো খুলে দিচ্ছি। আপনি এই কাগজে একটা সই করে দেবেন।

বুধুয়া এগিয়ে গেল। তারপর বাঁ দিকে ঘুরে সিঁড়ি থেকে ওঠার পর যে ঘরটা আছে, সেটার দরজা দেখিয়ে বলল- হুজুর! এইটে রানিমার ঘর।

এস আই অজিত বার্মা তাকে প্রায় ধমক দিয়ে বললেন তোমাকে চেনাতে হবে না। এই সিলকরা হ্যান্ডকাফ আমিই আটকেছিলুম।

বলে তিনি খাকি ফুলপ্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা হাতুড়ি বের করে গালার সিলটা ভেঙে ফেললেন। তারপর চাবি দিয়ে হ্যান্ডকাফ খুলে তিনি একজন কনস্টেবলকে দিলেন। কর্নেল বললেন–দরজা আমিই খুলি। কী বলেন?

অজিত বার্মা একটু হেসে বললেন–খুলুন না স্যার। এখন সবই আপনার চার্জে।

এ ঘরের দরজায় পর্দা নেই। কপাটদুটো বেশ বড় এবং কাঠের ওপর সুন্দর নকশা খোদাই করা আছে। কর্নেল কপাটদুটো যখন খুললেন, কেন কে জানে ভিতরে গাঢ় অন্ধকার থেকে গা ছমছম করে উঠল। কী একটা গন্ধ ভেসে এল ঘরের ভিতর থেকে। মৃত্যুর গন্ধ কি? জানি না। তবে পরে সোহিনী বলেছিল, সে-ও কেমন একটা গন্ধ পেয়েছে।

কর্নেল বললেন–বুধুয়া! এ ঘরের সুইচবোর্ড কোথায় আছে?

বুধুয়া ভীতমুখে বলল–কপাটের বাঁদিকে আছে স্যার!

কর্নেল ভিতরে ঢুকে বাঁ দিকে হাত বাড়িয়ে কয়েকটা সুইচ টিপে দিলেন। ঘরে আলো জ্বলে উঠল। পাখাও ঘুরছিল। কর্নেল পাখার সুইচ অফ করে দিলেন।

ঘরটা নীচের হলঘরের চেয়েও প্রশস্ত। সামনের দেওয়াল থেকে একটু তফাতে বিশাল মেহগনি কাঠের নকশাদার উঁচু পালংক। পালংকে ওঠার জন্য দুধাপ সিঁড়ি আছে। বিছানাটা রেশমি বেডকভারে ঢাকা। পালংকের পিছনে কালো আয়রন চেস্ট দেওয়ালে গাঁথা আছে। দরজার ডান দিকে দুটো স্টিলের আলমারি। বাঁ দিকে একটা কারুকার্যখচিত প্রকাণ্ড সিন্দুক। তার ওপাশে একটা টেবিল ও গদিআঁটা চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা পঞ্জিকা, লেখার সরঞ্জাম, প্যাড, কিছু বই এবং দুটো মোটা-মোটা ফাইল। উপরে কুলুঙ্গিতে সিদ্ধিদাতা গণেশের লাল মূর্তি। ঘরের মেঝে পুরু লাল কার্পেটে ঢাকা। দেওয়ালে হলঘরের মতো কয়েকটা পেন্টিং। একটা দেখে মনে হল, রাজদম্পতির ফটো। কিন্তু কর্নেল দরজার সামনে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে কার্পেটের উপর কিছুটা জায়গা নোংরা হয়ে গেছে। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন–মিঃ বার্মা! আপনি তো সেদিন এ ঘরে এসেছিলেন।

–হ্যাঁ স্যার।

–এইখানে সম্ভবত রানিমার হাতের রেকাবি আর পুজোর প্রসাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই না?

–ঠিক বলেছেন স্যার। ফরেন্সিক এক্সপার্টরা সেগুলো তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেঝে আর পরিষ্কারের ব্যবস্থা হয়নি।

–এবার ঠাকুরঘরে যাওয়া যাক, কনস্টেবলদের এখানে থাকতে বলুন।

অজিত বার্মা বাঁ দিকে একটা দরজা খুলে দিলেন। দরজাটা ভিতর থেকে আটকানো ছিল। সেখানে একটা সংকীর্ণ করিডর। তারপর ওপরে ওঠার সিঁড়ি। সিঁড়িটা ঢাকা। কর্নেলকে অনুসরণ করতে গিয়ে দেখি, সোহিনী রানিমার পালংকের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলুম, সে নিঃশব্দে কাঁদছে।

আমি আর উপরের ঠাকুরঘরে গেলুম না। সোহিনীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। ডাকলুম–সোহিনী?

সোহিনী অমনই সংযত হয়ে রুমাল বের করে চোখ মুছল। তারপর ভাঙাগলায় আস্তে বলল–আমি এই খাটে স্বর্ণদিদার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তুম। আমি সব ভুলে গিয়েছিলুম। এই ঘরটা আমার স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। এখন আমার কষ্ট হচ্ছে কেন জানেন? আমি স্বর্ণদিদার মৃত্যুর খবর পেয়ে আসতে পারিনি। আমাকে। আসতে নিষেধ করেছিলেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে। অথচ আমার একটা রাইফেল আছে।

ওকে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। একটু পরে বললুম–যা ঘটে গেছে, ভুলে যাও।

কর্নেল ওপরের ঠাকুরঘর থেকে নেমে এলেন। অজিত বার্মা বললেন–তাহলে রানিমার ঠাকুরঘর আর এই শোওয়ার ঘরের তালার চাবি আপনার কাস্টডিতে থাকল। আপনি অনুগ্রহ করে এই কাগজে সই করে দিন।

কর্নেল রানিমার টেবিলে কাগজটা রেখে সই করে দিলেন। অজিত বার্মা ও কনস্টেবলরা তখনি নমস্কার করে চলে গেলেন। কর্নেল এবার বুধুয়াকে জিজ্ঞেস করলেন–ছ-টা বেড়াল কোথায় পড়েছিল তুমি দেখেছ?

বুধুয়া বলার আগে সোহিনী বলে উঠল–এই গোল চিহ্নগুলো কীসের? খড়ির দাগ মনে হচ্ছে!

কর্নেল বললেন তোমার দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করছি। এক মিনিট। সবগুলো জানালা খুলে দিই। তারপর আমি একবার আমাদের ঘরে যাব। তোমরা এখানে। থাকো। বুধুয়া! কেউ যেন এ ঘরে ঢোকে না। তুমি দরজার বাইরে থাকো।

জানালাগুলো খুলে দিয়ে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। সোহিনী বলে উঠল– জয়ন্তদা! এই দেখুন। খড়ির দাগ কোথাও কোথাও মুছে গেলেও বোঝা যাচ্ছে, স্বর্ণদিদা এই নোংরা জায়গার ওপাশে পড়ে গিয়েছিলেন।

খড়ির দাগ পরীক্ষা করে বুঝলুম, রানিমা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই বেড়ালগুলোর অবস্থা দেখে মূৰ্ছিত হয়েছিলেন। তিনি লম্বালম্বি পালংকের দিকে মুখ করে পড়ে গিয়েছিলেন। পা দুটো ছিল দরজার চৌকাঠ থেকে মাত্র দেড়ফুট দূরে।

সোহিনী ছ-টা বেড়াল কোথায় কোথায় মরে পড়েছিল, তা খুঁজতে থাকল। পুলিশের দেওয়া খড়ির দাগ দেখে দেখে আমিও জায়গাগুলো শনাক্ত করছিলুম। একটু পরে কর্নেল এসে গেলেন। তাঁর একহাতে ছোট্ট অথচ জোরালো টর্চ, অন্যহাতে একটা ইঞ্চি তিনেক লম্বা খুদে কাচের কৌটো, সূক্ষ্ম একটা চিমটে এবং আতস কাচ। তিনি এসেই খড়ির গণ্ডিগুলোতে একে একে আতস কাচ রেখে পরীক্ষা করলেন। তারপর বললেন–জয়ন্ত! তুমি টর্চটা নাও। যেখানে বলব, সেখানে আলো ফেলবে।

এরপর তিনি সারা ঘরের মেঝে টেবিলের তলা থেকে খাটের তলা এবং আলমারিদুটোর তলা থেকে সূক্ষ্ম চিমটে দিয়ে কী সব তুলে কাচের কৌটোতে ভরতে থাকলেন। এখন তার অঙ্গভঙ্গি দেখে কৌতুক বোধ করার মতো মনের অবস্থা আমার ছিল না। সোহিনীরও ছিল না। অবাক হয়ে ভাবছিলুম, কাচের কৌটোতে কর্নেল কী কুড়িয়ে ভরছেন?

কর্নেল তাঁর কাজ শেষ করে রানিমার ঘরের দরজায় তালা এঁটে বেরিয়ে এলেন। সেই সময় অরুণিমাকে বারান্দা দিয়ে আসতে দেখলুম। রানিমার ঘরের দরজার দিকে তিনি বললেন–সোহিনী! পুলিশ এসে দরজা খুলে দিয়ে গেছে শুনলুম। আমি তখন স্নান করছিলুম। পুলিশকে তোমার একটু অপেক্ষা করতে বলা উচিত ছিল।

সোহিনী গম্ভীরমুখে বলল–এ ব্যাপারে তোমার কিছু করার নেই কাকিমা।

কর্নেল বললেন–ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তা ছাড়া রানিমার মৃত্যুর কেসে মিঃ সিংহ আমাকে তদন্তের সব দায়িত্ব দিয়েছেন। পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করার দায়িত্বও আমার। আপনি এ নিয়ে অকারণ উদ্বিগ্ন না হয়ে আপনার স্বামীকে টেলিফোনে জানান।

–জানিয়েই আসছি। কিন্তু এ ঘরের চাবি?

–চাবি পুলিশ আমাকে দিয়ে গেছে। কারণ, আমার আরো তদন্তের কাজ বাকি আছে।

অরুণিমা আর কথা না বলে চলে গেলেন। আমরা আমাদের ঘরে ঢুকলুম। বুধুয়া একটু দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে গেল। কর্নেল তার কিটব্যাগে কাচের কৌটো এবং চিমটে ঢুকিয়ে রাখলেন। আতসকাচটা ঢোকালেন প্যান্টের পকেটে।

বললুম– কর্নেল! মিঃ সিংহ বলছিলেন, ফরেন্সিক এক্সপার্টরা আবার এসে রানিমার ঘর পরীক্ষা করবেন। কিন্তু তার আগেই পুলিস আপনাকে ঘর খুলে দিয়ে গেল। এমনকী, যা বুঝলুম, পুলিশ আপনাকে রানিমার বেডরুমে আর ঠাকুরঘরেরও দায়িত্ব দিয়ে গেল। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

সোহিনী বলল–আমি ভাবছি, স্বর্ণদিদার ঘরের তালার ডুপ্লিকেট চাবি যদি কারও কাছে থাকে? ঘর থেকে কিছু চুরি গেলে কর্নেলের উপরই দোষ চাপাবে পুলিশ।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন–আর আধঘণ্টার মধ্যেই ক্যাপ্টেন পাণ্ডের জিপ এসে যাবে। কিন্তু এখনই আমার একটা টেলিফোন করা দরকার। সোহিনী! টেলিফোন তো তোমার কাকিমার ঘরে। তাই না?

সোহিনী বলল–হ্যাঁ। কিন্তু স্বর্ণদিদার ঘরেও তো টেলিফোন আছে। দেখতে পাননি?

পেয়েছি। কিন্তু পালংকের তলায় টেলিফোনের তার কেউ ছিঁড়ে রেখেছে।

–সে কী! পুলিস এটা জানে না?

জানে!

 –তাহলে তারটা জোড়া দিলেই টেলিফোন চালু হবে।

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হবে না। তারের বাকি অংশ জানালার চৌকাঠের নীচে দিয়ে বেরিয়ে হলঘরের ভিতরে টেলিফোন বক্স পর্যন্ত টানা ছিল। তোমরা আমাকে যখন ঝোপের আড়াল থেকে দেখছিলে, তখন আমি টেলিফোনের তারের একটা লম্বা অংশ খুঁজছিলুম। রানিমার ঘরের ভিতর থেকে তারটা ছিঁড়ে বাকি লম্বা অংশটা বাইরে ঠেলে দিয়েছিল কেউ। এ অবস্থায় তারটা একতলার ছাদ পর্যন্ত ঝুলছিল। এরপর সে পাইপ বেয়ে উঠে তারের অনেকটা অংশ ছিঁড়ে কোথাও ফেলে দিয়েছে। তারে ক্লিপ আঁটা ছিল। নিচে ঘাসের মধ্যে রোদে কয়েকটা ক্লিপ আমার চোখে পড়েছিল। আমি তাই খুঁজছিলুম এসব ক্লিপ কীসের? তবে ক্লিপ কুড়োতে গিয়ে আমার একটা বড়োরকমের লাভ হয়েছে।

সোহিনী বলল– কী লাভ?

কর্নেল ঠোঁটে আঙুল রেখে বললেন–চুপ। ও সব প্রশ্ন এখন নয়। এখন দরকার একটা টেলিফোন।

বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বারান্দায় গিয়ে ডাকলেন–সোহিনী! শোনো!

সোহিনী বাইরে গেল। বলল–বলুন কী করতে হবে।

কর্নেল বললেন–তোমাকে একটা নাম্বার লিখে দিচ্ছি। তুমি তোমার কাকিমার ঘরে গিয়ে যেভাবে পারো, এই নাম্বারে ফোন করে বলবে কর্নেল সরকার ডক্টর গুপ্তকে বলেছেন, তিনি যেন এখনি ক্যাপ্টেন পাণ্ডের সঙ্গে দেখা করেন। কথাগুলো কিন্তু চাপা স্বরে বলবে। সাবধান।

–যদি ডঃ গুপ্ত না থাকেন?

–ওঁর থাকার কথা। উনি আমার ফোনের প্রতীক্ষা করছেন। বলে কর্নেল তাকে পকেট থেকে খুদে নোটবই বের করে পাতা ছিঁড়ে নাম্বার লিখে দিলেন। সোহিনী তখনি চলে গেল।

বেরিয়ে গিয়ে বললুম–আমার ধারণা, আপনি এখন একটা নাটকের মধ্যে পা বাড়িয়েছেন।

কর্নেলে আস্তে বললেন–প্রকৃত নাটক শুরু হয়েছে অন্যত্র।

–প্লিজ কর্নেল! একটু আভাস অন্তত দিন।

–তখন পুলিশের এস আই অজিত বার্মার মুখে শুনলে না? ও সি মিঃ রামকুমার প্রসাদ একটা জরুরি কাজে বেরিয়ে গেছেন। তা না হলে তিনি নিজেই। আসতেন।

-বুঝলুম না।

–ও সি মিঃ প্রসাদ যে কোনো পুলিস অফিসার এবং ফোর্স পাঠিয়ে যে কাজটা করতে পারতেন, তা নিজেই করতে গেছেন। তার মানে কাজটার গুরুত্ব তিনি পরে বুঝেছেন। আমি যখন ক্যাপ্টেন পাণ্ডের ফার্ম থেকে তাকে টেলিফোনে এই কাজটার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলুম তখন তিনি অত তলিয়ে কিছু চিন্তা করেননি।

হতাশ হয়ে বললুম–এক বর্ণও বুঝলুম না।

-তা হলে চুপ করে থাকো। যথাসময়ে নিজেই বুঝতে পারবে।

মিনিট পাঁচেক পরে সোহিনী ফিরে এল। তার মুখে হাসি। সে বলল– কাকিমাকে আপনার বিরুদ্ধে যাচ্ছেতাই বলে এলুম। কাকিমার এক কথা। সোহিনী, তুই বাধা দিলি না কেন পুলিশকে? আমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বললুম। কাকিমা প্রায় কেঁদে ফেললেন। আমি গার্জেন না, কে এক দাড়িওয়ালা বুড়ো কর্নেল গার্জেন?

কর্নেল বললেন–টেলিফোন?

–আহা! শুনুন না! কাকিমা শান্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন। বললেন, তোর কাকু এখনই এসে পড়বেন। তাকে লাইনে পাইনি তো কী হয়েছে? ম্যানেজার খবর দেবে। বলেছি, বাড়িতে সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।

–সোহিনী! টেলিফোন?

সোহিনী মুখ টিপে হাসল।–ডঃ গুপ্ত সত্যিই ওয়েট করছিলেন।

–তিনি কিছু বললেন?

–শুধু বললেন, ও কে। তারপর পি পি।

 কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল–সোহিনী! তুমি তৈরি হয়ে এসো। যে কোনো সময় ক্যাপ্টেন পাণ্ডের গাড়ি এসে যাবে।

সোহিনী বলল–আমি রেডি হয়েই আছি। সঙ্গে আমার টুকরো করা রাইফেলভর্তি ব্যাগটা নিতে হবে না তো?

কর্নেল হাসলেন। নাঃ! তোমার রাইফেল চুরি করে এ বাড়ির কেউ বিপদে পড়ার রিস্ক নেবে না।

আমি বললুম–শ্যামল মজুমদারের কথা ভুলে যাচ্ছেন কর্নেল!

 আমার কথা শুনে সোহিনী চঞ্চল হয়ে উঠল। সে চাপা স্বরে বলল-হ্যাঁ। সে জানে, আমি রাইফেলশুটার। এখন সে বাড়িতে নেই। কিন্তু যে-কোনো সময় বাড়ি ফিরতে পারে। কর্নেল। আপনি যা-ই বলুন। আমি রিস্ক নেব না।

বলে সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। কর্নেল মুচকি হেসে বললেন–আপাতত আমরা এখানে থাকা অবধি শ্যামলবাবু রাজবাড়িতে আসবেন না। মিঃ সিংহ তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ আমি এখানে থাকা মানেই পুলিশের আনাগোনা। মিঃ সিংহ এটা বোঝেন বলেই তার শ্যালককে সতর্ক করেছেন।

–একথা মিঃ সিংহ আপনাকে জানিয়েছেন?

 –হ্যাঁ। তুমি শিগগির রেডি হয়ে নাও। আমি আসছি।

বলে কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন কে জানে। আমি প্যান্টশার্ট পরে রিভলভারটা রুমালে জড়িয়ে প্যান্টের পকেটে রাখলুম। কয়েকমিনিট পরে কর্নেল ফিরে এলেন। তার হাতে একটা ডায়রি। তিনি সেটা তার কিটব্যাগে ঢুকিয়ে বললেন কোনো প্রশ্ন কোরো না।

কর্নেল পিঠে কিটব্যাগ এঁটে গলায় বাইনোকুলার ও ক্যামেরা ঝুলিয়ে বললেন এসো। দরজায় তালা এঁটে দেব।

আমরা হলঘরের সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়ালুম। তারপর সোহিনী কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এসে গেল। সোহিনী আমাদের আগে চঞ্চল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। সে বুধুয়াকে ডেকে হলঘরের দরজা বন্ধ করতে বলল। রাজবাড়ির গেটের বাইরে গিয়ে আমরা দাঁড়ালাম।

বুধুয়া আমাদের অনুসরণ করে এসেছিল। সে বলল–সায়েব এলে যদি আপনাদের কথা জানতে চান, তাকে কী বলব স্যার?

কর্নেল বললেন–বলবে, আমরা ক্যাপ্টেন পাণ্ডের ফার্মে যাচ্ছি। আর একটা কথা। আজ রাত্রে আমরা সেখানেই খেয়েদেয়ে ফিরব। তোমার সায়েবকে কথাটা টেলিফোনে জানাতুম। আর তোমার সায়েবের যদি ফ্যাক্টরি থেকে ফিরতে দেরি হয়, তুমি বউদিরানি আর ননীঠাকুরকে কথাটা জানিয়ে দেবে। পাণ্ডেজি আমাদের নেমন্তন্ন করেছেন।

বুধুয়া ভিতরে চলে গেল। একটু পরেই দক্ষিণ দিক থেকে একটা সাদা অ্যামবাসাড়ার গাড়ি এসে নিচের রাস্তায় থামল। তারপর ড্রাইভার গাড়িটা ঘুরিয়ে নিয়ে নেমে দাঁড়াল এবং কর্নেলকে সেলাম ঠুকে বলল-ক্যাপ্টেনসাবের জিপগাড়িতে যেতে আপনাদের অসুবিধা হবে বলে উনি আমাকে ডাক্তারসাবের গাড়ি নিয়ে যেতে বললেন।

কর্নেল বললেন–তুমি কি ডাক্তার গুপ্তের ড্রাইভার?

–জি সাব!

–ডাক্তার গুপ্ত পাণ্ডেজির ফার্মে আছেন নাকি খ্রিস্টান হাসপাতালে গেছেন?

–ডাক্তারসাব ফার্মে আছেন।

আমি ও সোহিনী পিছনে বসলুম। কর্নেল সামনে ড্রাইভারের বাঁ পাশে বসলেন। গাড়ি এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে কিছুটা চলার পর বাঁ দিকে সেই বিশাল তরঙ্গায়িত মাঠের দিকে বাঁক নিল। সেখানে পিচরাস্তাটা মসৃণ। নতুন তৈরি বলেই মনে হল। ডাইনে জঙ্গলে ঢাকা একটা লম্বাটে টিলা। টিলার গায়ে কালো গ্রানাইট পাথর ঝোঁপ থেকে মাথা উঁচিয়ে আছে। সোহিনী বলল–এই টিলায় একসময় শম্বর হরিণ থাকত। স্বর্ণদিদার কাছে শুনেছি, রাজাসায়েব–মানে আমার দাদামশাই একটা শম্বর মেরেছিলেন। শম্বরটার স্টাফ করা মাথা হলঘরে আছে।

কর্নেল বাইনোকুলারে বাঁ দিকের উপত্যকার মতো বিস্তীর্ণ প্রান্তরে কিছু দেখতে দেখতে যাচ্ছিলেন। বাইনোকুলার নামিয়ে বললেন–খুব মেঘ জমেছে। পাহাড়ের মাথায়। বৃষ্টি হতে পারে।

সোহিনী বলল–এখানে এসে বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি না। বৃষ্টি হলে এনজয় করা যাবে। ক্যাপ্টেন দাদুর ফার্মের বাংলোটা–যতটুকু মনে পড়েছে, এই টিলারই দক্ষিণপিঠে। তাই না কর্নেল?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–হ্যাঁ। তবে সন্ধ্যার দিকে বাংলোর পিছনে কাঁটাতারের বেড়া গলিয়ে বাঘ-ভালুক হানা দিলে তুমি রাইফেল ছুড়বে তো?

সোহিনী হাসল। রাইফেল আর বুলেট তৈরি রাখব। কিন্তু বাঘ বা ভালুক মারলে সেই মেমসায়েবের মতো আমাকে ফরেস্টগার্ডরা অ্যারেস্ট করবে। তখন আপনি বাঁচাতে পারবেন তো?

-নাঃ। ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট এখন আরো কড়া করা হয়েছে।

 –তাহলে বাঘ-ভালুক আপনাদের মাংস খাবে। আর আমি এনজয় করব।

 কর্নেল তার বিখ্যাত অট্টহাসি হাসলেন। আমি বললুম–তা কেন? আমি সকালে যেভাবে দুজন আদিবাসীকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলুম, তুমি তা-ই করবে। বাঘ-ভালুকের মাথার ওপর দিয়ে ফায়ার করবে। দেখবে, ওরা লেজ তুলে পালাবে।

সোহিনী চোখে হেসে চাপা স্বরে বলল–আমার বুলেটগুলো তো আপনার মতো রিয়্যাল বুলেট নয়। এগুলো টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্য নিরামিষ বুলেট। গর্জনও করে না।

-সত্যিকার বুলেট তোমার রাখা উচিত।

–আছে কিনা বলব কেন আপনাকে?

 এবার পিচরাস্তাটা দক্ষিণ-পূর্ব কোণে এগিয়ে গেছে। সেদিকে একটা টিলার গায়ে চার্চ এবং নিচে অনেকগুলো বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। বুঝলুম, ওটাই খ্রিস্টান মিশন স্কুল এবং সার্ভিস টু দ্য ম্যানকাইন্ড হাসপাতাল।. ডাইনে মোরামরাস্তার দুধারে ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। তারপর গেট। উপরে অর্ধবৃত্তাকার সাইনবোর্ডে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা রোহিনী এগ্রিকালচারাল ফার্ম।

গেটের কাছে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে এবং স্যুট পরা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার গলায় স্টেথিসকোপ দেখেই বুঝলুম, ইনি সেই ডাক্তার গুপ্ত, কর্নেল যাঁকে ফোন করতে বলেছিলেন সোহিনীকে। সোহিনী নেমে গিয়ে ডাক্তার গুপ্তের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল–আপনি অবনীকাকু না?

সে প্রণাম করতে ঝুঁকলে ডাঃ গুপ্ত বললেন–কী আশ্চর্য! তুমি একেবারে লেডি হয়ে উঠেছ সোহিনী। তিনবছরেই একটা রোগাটে গড়নের মেয়ের এই পরিবর্তনের হার এগিয়ে গেলে কী ঘটবে বুঝেছ?

সোহিনী বলল–অবনীকাকু আমার খবর রাখেন না, সেটা আমার দোষ নয়।

কর্নেল বললেন–ডাক্তার গুপ্ত শুনেও তুমি বুঝতে পারোনি কাকে ফোন করতে যাচ্ছ!

ডাঃ গুপ্ত সহাস্যে বললেন–সোহিনী ফোন করেছিল? আমি ভাবলুম ভজুয়ার বউ লছমি।

সোহিনী কপট রোষে বলল–আপনি মেডিসিনের ডাক্তার। শিগগির এন টি ডাক্তারকে আপনার কানদুটো দেখিয়ে নিন অবনীকাকু।

ডাঃ গুপ্ত হাসতে হাসতে গাড়িতে চেপে বসলেন খ্রিস্টান মিশন হাসপাতালে যাচ্ছি। কান দেখিয়ে নেব। কর্নেলসায়েব। পাণ্ডেজির সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা করে নিয়েছি। আমি মিশন হাসপাতাল থেকে এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।

ডাঃ গুপ্তের ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে নিল। তখন কর্নেল ডাঃ গুপ্তের কাছে গিয়ে তার সঙ্গে কী সব কথা বললেন। তারপর ফিরে এলেন। আমরা ফার্মে এলুম। দক্ষিণের সমতল মাঠে ধানখেত, অড়হরখেত, এবং আরো কী সব ফসলের খেত। অনুমান করলুম, অন্তত ২৫ একর চৌকো জমিতে ক্যাপ্টেনও চাষ করেছেন। সবটাই ছ-ফুট ইটের পাঁচিল এবং পাঁচিলের উপর অনেকটা কাঁটাতারের বেড়া। বেড়ার গায়ে নানারকমের লতার ঝালর। বাংলোর ফুলবাগিচা, ক্যাকটাস, গোলাকার ঝাউ এবং আরো বিচিত্র গড়নের উদ্ভিদ। ফুলের ছাদের বাগানের কথা মনে পড়ে গেল। এই দুই অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারের মতো সম্ভবত গোপন যোগসূত্রটা এতক্ষণে আবিষ্কার করে ফেললুম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বাংলোর অর্ধবৃত্তাকার কংক্রিট চত্বর। তারপর আরো একধাপ সিঁড়ি বেয়ে বাংলোর বারান্দায় উঠলুম। বারান্দায় বেতের চেয়ার ফেলে সাজানো। একজন উর্দি-পরা  পরিচারক সেলাম দিল। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে সকলের মতোই তার দিকে তাকিয়ে বললেন–কফি!

লোকটা ভেতরে চলে গেল। বেতের চেয়ারে বসে এবার নিচে ডানদিকে গোডাউন এবং আটচালা ঘরে কৃষিযন্ত্রপাতি দেখতে পেলুম। গোডাউনের ওধারে একতলা তিনটে ঘর। বারান্দায় বন্দুকহাতে একজন গার্ডও চোখে পড়ল। অন্যপ্রান্তে উঁচু একটা চত্বরে আরেকজন গার্ড দাঁড়িয়েছিল। তার দু-পাশে দুটো কুকুর। কুকুরদুটোর চেন গার্ডের হাতে।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে চাপা স্বরে বললেন–আধঘন্টা আগে ওসি মিঃ রামকুমার প্রসাদ ফোন করেছিলেন। অপারেশন সাকসেসফুল। তিনি এস পি-কে খবর নিলেন। এস পি কলকাতা পুলিশের সঙ্গে থু প্রপার চ্যানেল যোগাযোগ করবেন। কিছু ঠিকঠাক চললে আজ রাত্রেই আচারিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে পুলিশ হানা দেবে।

কর্নেল বললেন–মিঃ সিংহের রিঅ্যাকশন কী, তা জানতে পেরেছেন?

–ডাঃ গুপ্ত থাকার সময় তীর্থ ফোন করেছিল। সে কিছু বুঝতে পারছে না। তাছাড়া এই ঘটনায় তার ফ্যাক্টরির উপর আঘাত আসবে। আচারিয়া প্রোডাকশনের একজন ডিস্ট্রিবিউটর। আমি বললুম, এটা সম্ভবত অন্য। আমি ও সি-কে ফোন করে জেনে নিচ্ছি, কী ব্যাপার।

–আমার ধারণা, মেমসায়েব কেটে পড়েছে।

–আমার ধারণা অন্যরকম। তার একটা শক্ত অ্যালিবাই আছে। সে হাসপাতালের প্যাথোলজিস্ট। স্বামীর সঙ্গে তার দেখাসাক্ষাৎ হয় কদাচিৎ। তার মাথার উপর ফাদার রুমফিল্ড এবং ফাদার হারিংটন আছেন। ফাদার হ্যাঁরিংটন এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এখানে সরকারি নীতি হল, প্রশাসন যেন এমন কিছু না করে, যাতে আদিবাসীরা গোলমাল বাধানোর সুযোগ পায়। এই পরিস্থিতিতে মেমসায়েব কেটে পড়তে চাইবে না। বরং মিশনেই সে নিরাপদ।

পরিচারক কফি আর স্ন্যাক্স ভর্তি ট্রে রেখে গেল। কর্নেল বললেন–সোহিনী। তোমাকে আড়ষ্ট দেখাচ্ছে। হয়তো আমাদের কথাবার্তার অর্থ বুঝতে পারছ না। কফি খাও। নার্ভ চাঙ্গা করো। তারপর সব বুঝবে।

সোহিনী একমুঠো চানাচুর তুলে নিয়ে বলল–হয়তো বুঝেছি। তারপর কফির পেয়ালা তুলে নিল।

কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন–ডাঃ গুপ্তের কথা শুনে আপনার কী হল?

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–ওঁকে নিজের পয়েন্টে স্টিক করে থাকতেই হবে কারণ শ্মশানে আমি ছাড়াও অনেক ভদ্রলোক উপস্থিত ছিলেন। ডাঃ গুপ্ত যে পুলিশকে খবর দিতে ইনসিস্ট করেছিলেন, তার সাক্ষীও আমরা। এই অবস্থায় পুলিশকে খবর দিতে বাধ্য হয়েছিল। তা না হলে তার উপরই এসে যেত। তাই না?

–ঠিক। কিন্তু উনি আমার কাছে ঘটনাটা অন্যভাবে বলেছেন কেন? ওঁর উচিত ছিল, প্রকৃত ঘটনা আমি জানতে পারবই।

তীর্থ আপনাকে সরাসরি চেনে না। আমার সূত্রে চেনে। কাজেই আপনার সম্পর্কে তার কতটা সতর্ক থাকা উচিত, তা সে বুঝতে পারেনি।

একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল বললেন–কাল বুধবার জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে মিঃ সিংহকে নন্দরানি আর দুবেজির জামিনের দরখাস্ত জন্য তৈরির তার ল-ইয়ার প্রদীপ্ত চ্যাটার্জিকে বলতে বলেছি। জানি না, উনি চ্যাটার্জির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–তীর্থ না বললেও কিছু আসে যায় না। আমি তাকে টেলিফোনে বলে দেব। তাকে বাড়িতে পাওয়া যাবে সন্ধ্যা ৭টায়। নিজেই কোর্টে যাব। কোর্টে পেশাদার জামিনদার পাওয়া যায়। তারা হাজার টাকার ওপর শতকরা তিরিশ টাকা হারে চার্জ নেয়।

দু-জনের ঘরে পুলিশ দশ হাজার করে মোট কুড়ি হাজার টাকা পায়। সেই টাকাটাও তো কোর্ট জামিনের টাকা হিসেবে গণ্য করতে পারে। কী বলে তা অবশ্য আমি জানি না।

–দ্যাটস দ্য ডিসক্রিশন অব দ্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। যাই হোক, দেখা যাক তীর্থ কী করে।

–একটা কথা ক্যাপ্টেন পাণ্ডে। আপনার ল্যাবরেটরিতে মাইক্রোস্কোপ আছে। আমি একবার সেখানে যেতে চাই।

কোনো অসুবিধে নেই। কফি শেষ করে নিন।

 কর্নেল দ্রুত কফি শেষ করে উঠলেন। বললেন–সোহিনী! জয়ন্ত! তোমরা ততক্ষণ গল্প করো। আমরা আসছি।

 ক্যাপ্টেন পাণ্ডে এবং কর্নেল বাংলোর ভিতরে ঢুকে গেলেন। বললুম– সোহিনী! কী ঘটেছে তা কি বুঝতে পেরেছ?

সোহিনী বলল–এটুকু বুঝেছি, কলকাতায় কর্নেল আমাকে এক আচারিয়ার কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাকে করনগড় থানার অফিসার-ইন-চার্জ সম্ভবত তীর্থকাকুর ফ্যাক্টরিতে, অ্যারেস্ট করেছেন।

রঘুবীর আচারিয়া?

–মেমসায়েব ন্যান্সির স্বামী তো সেই আচারিয়া?

— হ্যাঁ।

রঘুবীর আচারিয়ার কলকাতার অ্যাপার্টমেন্টে ওখানকার পুলিশ যাতে হানা দেয়, পুলিশ সুপার থ্রু চানেল তার ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু বুঝতে পারছি না, কী আছে তার অ্যাপার্টমেন্টে?

একটু ভেবে নিয়ে বললুম–আচারিয়ার অ্যাপার্টমেন্টে নানারকমের অ্যান্টিক আর ঐতিহাসিক জিনিসের সংগ্রহশালা আছে।

সোহিনী চমকে উঠেছিল। সে বলল–রাজাসায়েবদাদুর সঙ্গে এখানকার এক ব্যবসায়ীর মামলা হয়েছিল। কী একটা হিস্টোরিক্যাল জুয়েল কিংবা ওইরকম দামি জিনিস বিক্রির জন্য দাদামশাই নাকি অ্যাডভান্স টাকা নিয়েছিলেন।

তার কথার ওপর বললুম–জিনিসটা নাকি হারিয়ে গিয়েছিল রাজবাড়ি থেকে। তাই রাজাসায়েব মোহনলাল সুখানিয়া নামে ব্যবসায়ীকে সেটা দিতে পারেননি। সোহিনী! আমার মনে হচ্ছে, সেই দামি জিনিসটা কিনেছিল রঘুবীর আচারিয়া।

সোহিনী আস্তে বলল–তীর্থকাকুর সঙ্গে তার ট্রেডসংক্রান্ত সম্পর্ক আছে শুনলেন না?

বন্ধুত্বও আছে।

–দাদামশাই থানায় ডায়েরি করেছিলেন, তা স্বর্ণদিদার কাছে শুনেছিলুম।

–সোহিনী। তা হলে ঘটনার একটা দিক এবার স্পষ্ট হল।

এইসময় দেখলুম, নীচের গেটের কাছে একটা অটোরিকশা এসে থামল। তারপর অবাক হয়ে দেখলুম অটোরিকশা থেকে হালদারমশাই নামছেন। কিন্তু এখন তার মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নেই। মাথায় পরচুলা এবং টুপি নেই। গোয়েন্দাপ্রবর স্বমূর্তিতে অটোরিকশার ভাড়া মেটাচ্ছেন। কাঁধে তার সুপরিচিত কালো ব্যাগটা ঝুলছে।

কিন্তু দারোয়ান তাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। তখন তিনি ইংরেজিতে তাকে ধমক দিতে থাকলেন। অগত্যা আমি নিচের চত্বরে নেমে গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম–

দারোয়ানজি! সাবকো আনে দো! সাব হামারা আদমি হ্যায়। ক্যাপ্টেন সাবকা বন্ধু হ্যায়। বন্ধু সমঝতা?

আমার হিন্দি শুনে সোহিনী হেসে উঠল। দারোয়ান এবার গোয়েন্দাপ্রবরকে আসতে দিল। তিনি ভেতরে ঢুকে তাকে নিজের চিবুকে আঙুল রেখে বললেন

–আমার দাড়ি ছিল। মাথায় টুপি ছিল। টাই পরেছিলাম। এখন দাড়ি কাইট্যা আইতাছি। বোঝলা ঝাব্বু সিং?

দারোয়ান অবাক হয়েছিল। তারপর কী ভেবে সেলাম দিয়ে বলল–যাইয়ে সাব! যাইয়ে!

হালদারমশাই উঠে এসে বললেন–জয়ন্তবাবু! কর্নেলস্যার কোথায়?

বললুম–বারান্দায় চলুন। কর্নেল ভিতরে আছেন।

প্রাইভেট ডিটেকটিভ তার মক্কেল সোহিনীকে দেখে সহাস্যে বললেন–জাল গুটাইয়া আনছি মিস রায়! খুব ছোটাছুটি করছি। বয়েন জয়ন্তবাবু! কফি খামু। তারপর কথা হইব।

উর্দিপরা পরিচারক কফির ট্রে নিতে এসেছিল। সে একটু ইতস্তত করার পর সেলাম ঠুকে একটু হাসল। তারপর বলল–চিনেছি স্যার! আপনি চুল দাড়ি কেটে ফেলেছেন। তাই প্রথমে চিনতে পারিনি।

হালদারমশাই বললেন কফি! কফি! গলা ব্যাবাক শুকাইয়া গেছে।….

.

গোয়েন্দাপ্রবর কফি শেষ করে যখন নস্যি নিচ্ছেন, তখন কর্নেল এবং ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বাংলোর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন–্যালো হালদারমশাই! ওয়েলডান!

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে অবাক হয়ে বললেন–মিঃ হালদার কি চুলদাড়ি কেটে ফেলেছেন?

হালদারমশাই বললেন–না ক্যাপ্টেনসায়েব! আমি ছদ্মবেশে ছিলাম।

–আশ্চর্য! আমি একটুও বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলুম, ওটাই আপনার আসল চেহারা।

–হঃ! মিঃ সিংহের ফ্যাক্টরির কাছে কতক্ষণ ঘুরছি। তিনিও আমারে দ্যাখছেন। কিন্তু ট্যার পান নাই।

কর্নেল এবং ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বসলেন। তারপর কর্নেল বললেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে! রবিবার সকালের কাগজে খবরটা পড়েই আমার যা সন্দেহ হয়েছিল, ঠিক তা-ই। সেইজন্যই এখানকার পুলিশ সুপার রাঘবেন্দ্র সিনহাকে টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলুম, পাটনা থেকে ফরেন্সিক এক্সপার্ট টিম আর ডেকে আনার দরকার নেই। অন্তত মঙ্গলবার পর্যন্ত রানিমার ঘরের দরজা যেন পুলিশ কারো অনুরোধে না খুলে দেয়।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–আমি আপনার মতো এক্সপার্ট নই। কিন্তু আমার ফার্মে এই প্রজাতির প্রজাপতি দেখে অবাক হয়েছিলুম। এখানে এই প্রজাতি কীভাবে এল? নিশ্চয় বাইরে থেকে কেউ এনে ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর কয়েকটা প্রজন্মের প্রজনন ঘটেছে।

–এটা আমার হিসেবে থার্ড জেনারেশন।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে রুষ্ট মুখে বললেন–এতো মানুষের বসতিহীন আফ্রিকার জঙ্গল নয়। এখানে এর অস্তিত্ব বিপজ্জনক। এখন বুঝতে পারছি, এই অঞ্চলে গত দু-বছরে আদিবাসীদের অনেক কুকুর অদ্ভুত রোগে মারা পড়েছে কেন? বন দফতরের আইন নিয়ে এ ব্যাপারে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি বিষ স্প্রে করে আগে আমার ফার্মকে এই ভয়ংকর প্রজাপতির কবল থেকে মুক্ত করব। তারপর বন দফতর এবং স্বাস্থ্য দফতরের উপরমহলে ব্যাপারটা জানাব। এদের প্রজনন বন্ধ না হলে এর পর অনেক সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে।

কর্নেল গেটের দিকে তাকিয়ে বললেন–ডাঃ গুপ্ত শিগগির ফিরে এলেন দেখছি।

একটু পরে ডাঃ গুপ্ত এসে চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন–কর্নেলসায়েব। অপারেশন সাকসেসফুল। আপনি কিছুক্ষণ আগে রাজবাড়ি থেকে আসার পর যে জিনিসটা আমাকে দেখিয়েছিলেন, আমি ঠিক সেই জিনিসই মিশন হাসপাতালের প্যাথোলজিরুমে কাল বিকেলে মেমসায়েবের হাতে দেখেছিলুম। এখন গিয়ে দেখলুম, মেমসায়েব নেই। ফাদার ব্লুমফিল্ড বললেন, ফাদার হ্যাঁরিংটন তাঁকে নিয়ে কোথায় বেরিয়েছেন। তো আমি একজন রোগীর যে রক্তের স্যাম্পেল বুদ্ধি করে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম, সেটা দেখিয়ে ফাদারকে অনুরোধ করলুম, এই রক্তটা এখনি পরীক্ষা করা জরুরি। তিনি যদি অনুগ্রহ করে প্যাথোলজি রুমে ঢোকার অনুমতি দেন, উপকৃত হব।

–উনি অনুমতি দিলেন?

–হ্যাঁ। আমি প্রতিদিন বিকেলে মিশন হাসপাতালকে ভলান্টারি সার্ভিস দিই। কাজেই ফাদার আমাকে না করবেন কোন মুখে? উনি আমাকে নির্দ্বিধায় ওই রুমের চাবির গোছা দিলেন।

-তারপর?

–আমি প্যাথোলজি রুমে ঢুকে রক্তপরীক্ষার ছলে মেমসায়েবের টেবিলের ড্রয়ার সাবধানে খুলে ফেললুম। তারপর দেখলুম, খুদে একসেট কালো অ্যামপিউল রাখা আছে। একটা অ্যামপিউলের তলায় আপনার নির্দেশমতো একটু চাপ দিতেই উপর দিয়ে সূক্ষ্ম সিকি ইঞ্চিটাক সূচ বেরিয়ে পড়ল। বুঝলুম, আপনার কথা ঠিক। তখন সেইটা যেমন ছিল, তেমনই রেখে নিঃশব্দে ড্রয়ারে তালা এঁটে দিলুম। কর্নেলসায়েব! মেমসায়েব ফিরে আসার আগেই তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে বিষাক্ত অ্যামপিউল-কাম-ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জগুলো পুলিশ যাতে সিজ করে, তার ব্যবস্থা করা দরকার।  

কর্নেল বললেন–ক্যাপ্টেন পাণ্ডে। বরং আপনিই থানায় টেলিফোন করে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে আসুন। ও সি মিঃ প্রসাদকে পেলে ভালো। নয়তো ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ রাজীব সিনহার সঙ্গে কথা বলবেন। একটুও দেরি করা চলবে না কিন্তু।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে তখনি বাংলোর ভিতরে ঢুকে গেলেন। সেই উর্দিপরা পরিচারক ডাঃ গুপ্তের জন্য কফি দিয়ে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে ডাঃ গুপ্ত হালদারমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন–এঁকে কোথায় যেন দেখেছি?

কর্নেল প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিলেন। হালদারমশাই সহাস্যে বললেন–কাইল বিকালে মিশন হাসপাতালের কাছে আপনাকে দেখেছিলাম। আপনি আমারে ইংরাজিতে কইলেন, আমি খ্রিস্টান মিশনের লোক কি না। আমিও ইংরাজিতে কইলাম, আমি মিশনের লোক।

–আপনি দাড়ি আর চুল কেটে ফেললেন কেন?

ডাঃ গুপ্ত! তখন আমি ছদ্মবেশে ঘুরতাছিলাম।

ডাঃ গুপ্ত হেসে উঠলেন। বললেন–বুঝেছি। আসলে তখন আপনার হাতে নস্যির কৌটো ছিল। এখনও নস্যির কৌটো আছে। তা ছাড়া আপনার টল ফিগার! আর ওই খাড়া নাক। তাই চেনা মনে হচ্ছিল।

কর্নেল বললেন–এবার জিনিসটা সবাইকে দেখাচ্ছি। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে ফিরে আসুন। বলে তিনি তার বুকপকেট থেকে কালো ইঞ্চিটাক টুকরো পেনসিলের মতো কী একটা জিনিস বার করলেন।

একটু পরে ক্যাপ্টেন পাণ্ডে ফিরে এসে বললেন–ও সি মিঃ প্রসাদের সঙ্গে কথা বললুম। উনি এখনই নিজে ফোর্স নিয়ে মিশন হাসপাতালে যাচ্ছেন। উনি আমাকে একটা সুখবরও দিলেন। ফাদার হ্যাঁরিংটন রেলস্টেশনে মেমসায়েবকে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। পুলিশ প্ল্যাটফর্মেই মেমসায়েবকে অ্যারেস্ট করেছে। (মমসায়েবের বিরুদ্ধে পুলিশের পুরনো অভিযোগ আছে। উনি এলাকার জঙ্গি ব্ল্যাক প্যান্থারদের সাহায্য করেন। কিন্তু প্রশাসনের উচ্চস্তরে ফাদার হ্যাঁরিংটনের প্রভাবের জন্য তা বটেই, তা ছাড়া আদিবাসীদের মধ্যে মেমসায়েব জনপ্রিয়তাই পুলিশ এতদিন চুপচাপ ছিল। কিন্তু এবার রঘুবীর আচারিয়াকে গ্রেফতারের সূত্রে তার স্ত্রী ন্যান্সিকেও পুলিশ একই অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চক্রান্ত করে রাজবাড়ি থেকে ঐতিহাসিক দামি জিনিস হাতিয়েছিল। পুলিশের অভিযোগ এটাই। এতে আদিবাসীদের মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ রাজাসায়েব তাদের প্রিয় মানুষ ছিলেন।

কর্নেল বললেন–বাঃ! মিঃ প্রসাদ বুদ্ধিমান। কিন্তু একটা কথা। মিঃ সিংহ তাহলে কি পুলিশের সন্দেহভাজন? কী বললেন মিঃ প্ৰসাদ?

–তীর্থ সম্পর্কে আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি। তবে আপনি যেমন জানেন, আমি তেমনই জানি, রঘুবীর আচারিয়ার সঙ্গে তীর্থের কারবারি সম্পর্ক আছে। বন্ধুত্বও আছে। মোট কথা, তীর্থ সন্দেহের উর্ধ্বে নয়।

কর্নেল এবার সেই ছোট্ট কালো টুকরো পেনসিলের মতো এক ইঞ্চি লম্বা জিনিসটা দেখিয়ে বললেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে! ডাঃ গুপ্ত মেমসায়েবের টেবিলের ড্রয়ারে এই জিনিসই দেখে এসেছেন। এটাই মার্ডার উইপন! এটা দিয়েই রানিমাকে হত্যা করা হয়েছিল।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডাঃ গুপ্ত বললেন–তখন আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি। এখন জিজ্ঞাসার সুযোগ পেয়েছি। এইটা আপনি কোথায় পেলেন?

কর্নেল বললেন–আজ রাজবড়িতে রানিমার ঘরের পিছনে দেওয়ালের নিচে ঘন ঘাসের ফাঁকে কয়েকটা ক্লিপ পড়ে থাকতে দেখেছিলুম। ক্লিপগুলো কীসের তা জানার জন্য দোতলার দিকে তাকিয়ে দেখি, রানিমার ঘরের জানালার কোনা থেকে টেলিফোনের তারের খানিকটা অংশ ছেঁড়া। ক্লিপগুলো তাই খুলে পড়েছে। কেন রানিমার টেলিফোনের তার ছেঁড়া, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বুঝলুম, কেউ যাতে রানিমার ঘর থেকে বাইরে টেলিফোন করতে না পারে, তাই তার ছিঁড়ে রাখা হয়েছে। কেন? একটা দৃশ্য মনে ভেসে উঠল। ঘরে ছটা বেড়ালের মৃত্যু দেখে রানিমা মূৰ্ছিতা। খুনি একলা হওয়ার সুযোগ চায়। তাই সে কাউকে মিঃ সিংহের ঘরে গিয়ে ডাক্তার গুপ্তকে টেলিফোন করতে বলেছিল।

ডাঃ গুপ্ত বললেন–নন্দরানি আমাকে ফোন করেছিল। সে শুধু বলেছিল, রানিমা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি যেন শিগগির যাই।

কর্নেল বললেন–অর্থাৎ খুনি একটু সময় ও সুযোগ চেয়েছিল। নন্দরানি রানিমার ঘরের ফোন ডেড দেখে মিঃ সিংহের ঘরে ছুটে যায়। সেই সময় খুনি মূৰ্ছিতা রানিমার বাঁ কানের নীচে গলায় এই অ্যামপিউল-কাম-ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বিধিয়ে দেয়। তারপর সে এটা জানালার বাইরে ছুঁড়ে ফেলে। সে ভেবেছিল, ঘন ঘাস আর আগাছার ঝোপে এটা কেউ খুঁজে পাবে না।

বলে কর্নেল সেই কালো এক ইঞ্চি খুদে অ্যামপিউলের তলায় চাপ দিলেন। অমনি উপর দিকে সিকি ইঞ্চিটাক সূক্ষ্ম সূচ অর্থাৎ সিরিঞ্জ বেরিয়ে পড়ল। কর্নেল ওটা টিপে বললেন–বিষটুকু রানিমার শরীরে ঢুকে গেছে। তাই এটা টিপলেও কিছু বেরুচ্ছে না।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–কিন্তু আপনি এটা কীভাবে পেলেন, শুনতে ইচ্ছে করছে।

কর্নেল বললেন–আজ আমি রাজবাড়ির পিছনে ঘাস ও ঝোপের মধ্যে প্রজাপতির ছবি তোলার ছলে প্রকৃতপক্ষে একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জই খুঁজছিলুম। কারণ রানিমার গলায় বিষ ইঞ্জেক্ট করেই তাকে মারা হয়েছে। সিরিঞ্জটা খুনি জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। যাই হোক, খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে ঘাসের মধ্যে এই জিনিসটা কুড়িয়ে পেয়েছিলুম। পরীক্ষা করতে গিয়ে দৈবাৎ আঙুলে চাপ লেগেছিল এটার তলায়। চমকে উঠে দেখি, এই খুদে সূচ অর্থাৎ সিরিঞ্জ বেরিয়ে পড়ল। আতস কাচ দিয়ে পরীক্ষা করে সূচের মাথায় ছিদ্র দেখলুম। ওমনি সব স্পষ্ট হয়ে গেল।

সোহিনী বলল–আমি আর জয়ন্তদা তখন ফুলের ঝোপের আড়ালে বসে ভাবছি, কর্নেল প্রজাপতির ছবি তোলার জন্য লুকোচুরি খেলছেন।

ডাঃ গুপ্ত বললেন–তা হলে নন্দরানিই বলতে পারে, মূৰ্ছিতা রানিমার কাছে কে ছিল?

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। কিন্তু খুনি এমন কেউ, যাকে সে ভাবতেই পারেনি রানিমাকে হত্যা করবে। এমন অদ্ভুত ইঞ্জেকশনের কথা সে কেন, আমি উপস্থিত থাকলেও কল্পনা করতে পারতুম না। কাজেই নন্দরানি তার উপস্থিতির কথা পুলিশকে বললেও পুলিশ তাকে সন্দেহ করেনি।

ক্যাপ্টেন পাণ্ডে একটু হেসে বললেন–কর্নেলসায়েব! এবার বলুন। রানিমার হত্যা রহস্যের পর্দা কখন খুলবেন? কোথায় খুলবেন?

কর্নেল বললেন–আগামিকাল বুধবার রাজবাড়ির ল-ইয়ার মিঃ প্রদীপ্ত চ্যাটার্জি কোর্টে নন্দরানি আর দুবেজির জামিনের জন্য আবার দরখাস্ত করবেন, এটা তো আপনি জানেন। আমার সিদ্ধান্ত কাল বিকেল তিনটেতে রাজবাড়ির হলঘরে রহস্যের পর্দা তুলব। পুলিশ সুপার কথা দিয়েছেন, সদলবলে ওই সময় উপস্থিত থাকবেন। রাজবাড়ির সবাই উপস্থিত থাকবে। এবার আমার ইচ্ছা, ক্যাপ্টেন পাণ্ডে এবং ডাঃ গুপ্ত করনগড়ের গণ্যমান্য কয়েকজন লোককে যেন ওইসময় হলঘরে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেন।

ওঁরা দুজনে একবাক্যে বললেন– করব।

 কর্নেল বললেন–স্থানীয় গণ্যমান্যদের উপস্থিত থাকা দরকার অন্তত একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে। ল-ইয়ার মিঃ চ্যাটার্জি রানিমার উইল পড়ে শোনাবেন। সোহিনী উইলের একজিকিউশনার। তাকে উইল কোর্টে প্রোবেট করতে হবে। সোহিনী রানিমার প্রপার্টির দুই-তৃতীয়াংশ পাবে। যাই হোক, সেটা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

সোহিনী বলল–আমার শেয়ার আমি করনগড় বাঙালিটোলার সরোজিনী স্মৃতিসংঘ-কে দান করব। সরোজিনী দেবী আমার স্বর্ণদিদার শাশুড়ি ছিলেন।

আমরা সবাই হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানালুম। ততক্ষণে ফার্মে আলো জ্বলে উঠেছে। বাংলোর বারান্দায় বসে আমরা আরেক দফা কফি আর। পকৌড়া খেলুম।

সে রাতে ডিনার খাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বললেন–মিঃ হালদার আজ রাত্রে এখানেই থাকুন। কর্নেলেসায়েব কাল সকালে বরং জয়ন্তবাবুকে নিয়ে রাজবাড়ি ছেড়ে আমার রেস্টহাউসে যাবেন। তীর্থকে কোনো একটা কৈফিয়ত দেবেন কর্নেলসায়েব। বিকেলে রাজবাড়ির হলঘরে একটা মিটিং হওয়ার কথা তীর্থকে বলাই যথেষ্ট। উইলসংক্রান্ত মিটিং। আমিও ফোনে তীর্থকে জানাব।

হালদারমশাই বললেন–কিন্তু আমার ক্লায়েন্ট মিস সোহিনী রায়ের রাজবাড়িতে থাকা কি ঠিক হইব?

সোহিনী শক্তমুখে বলল–আমি রাজবাড়িতেই থাকব।

কর্নেল বললেন–হ্যাঁ। সোহিনী আমাদের সঙ্গে রাজবাড়ি ছেড়ে ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্টহাউসে থাকলে মিঃ সিংহের মনে কোনও সন্দেহ জাগতে পারে।….

সে রাতে ডাঃ গুপ্তের বাড়িতে কর্নেল, সোহিনী আর আমি রাজবাড়িতে ফিরেছিলুম। বুধুয়া বলেছিল, তার সায়েব ফ্যাক্টরি থেকে তখনো ফেরেননি। পরদিন ভোর ছটায় কর্নেল আমাকে বিছানা থেকে প্রায় জবরদস্তি উঠিয়েছিলেন। কারণ ক্যাপ্টেনের জিপ রাজবাড়ির গেটে হর্ন দিচ্ছিল। প্রাতঃকৃত্যের সুযোগ দেননি কর্নেল। আমরা যখন আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে হলঘরে নেমেছি, তখন ভজুয়া এসে জানতে চেয়েছিল, আমরা কোথায় যাচ্ছি। কর্নেল তার কথার জবাব দেওয়ার পর সে কাচুমাচু মুখে বলেছিল, অনেক রাত্রে সায়েব ফিরে এখনও ঘুমোচ্ছন। বউদিরানি তাকে বলেছেন, কর্নেলসায়েব যেন রানিমার শোওয়ার ঘর আর ঠাকুরঘরের চাবি তাকে দিয়ে যান। কর্নেল তাকে বলেছিলেন, চাবিদুটো পুলিশ তাঁর কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে। আর তার সায়েব উঠলে ভজুয়া যেন তাকে বলে, বিকেল তিনটেয় আমরা রাজবাড়িতে আসব। আর যা বলার কথা, কর্নেলসায়েবকে ক্যাপ্টেন পাণ্ডের রেস্টহাউসে ফোন করে মিঃ সিংহ যেন বলেন।

এরপর আমি এবার সরাসরি বিকেল তিনটেতে রাজবাড়ির হলঘরে মোটামুটি বড়রকমের একটা সমাবেশ প্রসঙ্গে আসছি। কারণ মধ্যবর্তী সময়ে কর্নেলের টেলিফোনে মিঃ সিংহের সঙ্গে কী সব কথাবার্তা ছাড়া, তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই ঘটেনি। হাসোহিনী আমাকে ফোন করে বলেছিল, সে খুব নিঃসঙ্গবোধ করছে। তার সময় কাটতে চাইছে না। কিন্তু কর্নেল নাকি তাকে ফোন করে রাজবাড়ি ছেড়ে বেরুতে নিষেধ করেছন।…

বুধবার বিকেল তিনটের সময় রাজবাড়ি গিয়ে দেখেছিলুম, পুলিশে-পুলিশে একেবারে যাকে বলে ছয়লাপ। হলঘরে সেই ডিম্বাকৃতি টেবিলটা খুলে এককোণে রাখা হয়েছে। চেয়ারগুলো ভর্তি। সোফাতেওঁ কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন। হলঘরের সিঁড়ির উপরদিকে একদল কনস্টেবল বসে আছে। নিচের ধাপগুলোতে দারোয়ান, রামু, ভজুয়া, বুধুয়া এবং ননীঠাকুর বসে আছেন। সিঁড়ির পাশে ভজুয়ার বউ লছমি আর তার দুটি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে এক প্রৌঢ়া আছে দাঁড়িয়ে। সিঁড়ির শেষ ধাপের পাশে একটা চেয়ারে একজন প্রৌঢ় বসে আছেন। তার পরনে ধুতি পাঞ্জাবি। কর্নেলের দু-পাশে পুলিশ সুপার রাঘবেন্দ্র সিংহ আর ও সি রামকুমার প্রসাদকে চিনিয়ে দিলেন ক্যাপ্টেন পাণ্ডে–অবশ্য আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে তিনি কথাটা বললেন। সামনের দিকে দেওয়াল ঘেঁষে চেয়ারে বসে আছেন তীর্থব্রত সিংহ। তার পাশে অরুণিমা সিংহ। সোহিনীকে খুঁজে বের করতে হল। সে সোফার এদিকে গোয়েন্দাপ্রবরের পাশে বসে আছে।

সামান্য গুঞ্জন চলছিল হলঘরে। হঠাৎ ও সি মিঃ প্রসাদ বললেন–সাইলেন্স প্লিজ!

অমনি হলঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এবার কর্নেল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন মাননীয় ভদ্রমহিলাবৃন্দ এবং ভদ্রমহোদয়গণ। আমি প্রথমে আপনাদের একটা প্রজাপতির ছবি দেখাব। তারপর মূল প্রসঙ্গে যাব।

বলে তিনি তার কিটব্যাগ থেকে একটা বড় সাইজের রঙিন প্রজাপতির ছবি বের করে সামনে এবং ডাইনে-বাঁয়ে সবাইকে কিছুক্ষণ ধরে দেখালেন। তারপর বললেন–এই প্রজাতির প্রজাপতিটির নাম লাতিন ভাষায় পাপিলিও আন্তিমাচুস। রবার্ট স্টিলার নামে একজন প্রজাপতিবিশারদ লিখেছেন, এই প্রজাপতির শরীরে একরকম গন্ধ বেরোয়। তাতে কুকুর-বেড়ালজাতীয় প্রাণীরা আকৃষ্ট হয়। কিন্তু এই একটা প্রজাপতির শরীরে যে বিষ আছে, তাতে ছ-টা বিড়ালের মৃত্যু হতে পারে। এই বিষয়টি বাস্তব। Robert Goodden–এর Butter flies বই (Hamlyn, London) থেকে নেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের সংস্করণ। ১৩২ পৃষ্ঠায় এই বিবরণ আছে।

হলঘরে গুঞ্জন উঠেছিল। কর্নেল আবার কথা শুরু করলে থেমে গেল। সম্প্রতি এই অঞ্চলে এই প্রজাতির আবির্ভাব ঘটেছে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডের ফার্মেও এই প্রজাপতি আমি দেখেছি। তার মানে, কেউ এই প্রজাতির পুরুষ এবং স্ত্রী প্রজাপতি এনে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর তারা বংশবৃদ্ধি করেছে। আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, এই অঞ্চলে আদিবাসীদের কয়েকটা কুকুর বিভিন্ন সময়ে মারা পড়েছিল। যাই হোক, এবার আমি মূল প্রসঙ্গে আসি।

কর্নেল একটু দম নিয়ে বললেন–আমার এবার প্রশ্ন রানিমার বিশ্বস্ত পরিচারিকা নন্দরানিকে। আজ তিনি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। বলে তিনি সিঁড়ির বাঁ পাশে সেই প্রৌঢ়ার দিকে ঘোরেন।নন্দরানি। ভোরে রানিমা স্নান করে যখন সিঁড়ি বেয়ে দোতলার উপরে ঠাকুরঘরে যেতেন, তখন কি আপনি রানিমার ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখতেন?

নন্দরানি বললেন। –হ্যাঁ। আমি রানিমার সঙ্গে গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতুম।

–তখন বেড়ালগুলো কি রানিমাকে অনুসরণ করত?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। সেইজন্য তাদের ঘরে বন্দি রেখে ভিতরের দরজা বন্ধ করে রাখতুম। রানিমার শরীর ইদানীং দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পাছে তিনি পড়ে-টড়ে যান, তাই সারাক্ষণ তার কাছাকাছি থাকতুম।

–ঘটনার দিন রানিমা পুজো করে যখন দোতলায় নিজের ঘরে ঢুকেছিলেন, তখন বেড়ালগুলো কী অবস্থায় ছিল?

নন্দরানি চোখ মুছে বললেন–সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিল। তাদের মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছিল। দেখামাত্র রানিমা কেঁদে উঠে বলেছিলেন, এ সর্বনাশ কে করল রে? বলেই তিনি পড়ে গেলেন। হাতের রেকাবিতে পুজোর প্রসাদ ছিল। রেকাবি ঝনঝন শব্দে পড়ে গেল। সেই সময় দরজা খুলে আমি দেখলুম, বউদিরানি ছুটে আসছেন।

-বউদিরানি মানে মিসেস অরুণিমা সিংহ? মিঃ তীর্থব্রত সিংহের স্ত্রী?

–আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। উনি দৌড়ে আসছিলেন। রেকাবি পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মাসি? আমি বললুম, দেখে যান কী হয়েছে। উনি ঘরে ঢুকে রানিমার পাশে বসে বললেন, এখনি ডাক্তারবাবুকে ফোন করো। আমি রানিমার টেলিফোন তুলে দেখি, টেলিফোন ডেড। কথাটা বউদিরানিকে বললুম। তখন উনি বললেন আমার ঘরে গিয়ে ফোন করো। তোমাদের সায়েবের ফ্যাক্টরিতে নাকি আগুন লেগেছে। তাই শুনে উনি সেখানে ছুটে গেছেন।

–আপনি তাহলে আপনার বউদিরানির ঘর থেকে ডাক্তার অবনী গুপ্তকে ফোন করেছিলেন?

–হ্যাঁ স্যার।

ফোন করে এসে কী দেখলেন?

–বউদিরানি রানিমার পাশে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

রাজবাড়ির কর্মচারীরা তখন কোথায় ছিল?

–তারা তখনো কেউ তো জানে না কী হয়েছে। আমার ডাকাডাকিতে ভজুয়া, দুবেজি, বুধুয়া, তারপর ননীঠাকুর দৌড়ে এসেছিলেন। তার কিছুক্ষণ পরে ডাক্তারবাবু এলেন।

-তখনো কি রানিমা মেঝেয় পড়েছিলেন?

–না স্যার! আমরা তাকে ধরাধরি করে পালংকে শুইয়ে দিয়েছিলুম।

কর্নেল ডাঃ গুপ্তের দিকে ঘুরে বললেন–ডাঃ গুপ্ত! আপনি এসে রানিমাকে কী অবস্থায় দেখেছিলেন?

ডাঃ গুপ্ত বললেন–আমি পরীক্ষা করে দেখলুম শি ওয়াজ অলরেডি ডেড।

–হার্টফেল করে মৃত্যু?

–তখন তা-ই ভেবেছিলুম। বিকেলে শ্মশানে গিয়ে চিতায় ওঠানোর পর আমি লক্ষ করলুম, রানিমার ঠোঁটের পাশ দিয়ে রক্তমাখা লালা গড়াচ্ছে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে আর আমি তীর্থকে পুলিশে খবর দিতে বললুম। তীর্থ একটু ইতস্তত করছিল। পুলিশের ঝামেলা অবশ্য কেউ চায় না। তীর্থের আপত্তির কারণ ছিল।

কর্নেল বললেন–এবার রানিমার ছটা বেড়ালের মৃত্যুর প্রসঙ্গে আসছি।

বলে তিনি কিটব্যাগ থেকে কাচের একটা কৌটো বের করলেন। ওমনি ক্যাপ্টেন পাণ্ডে বলে উঠলেন কর্নেল রানিমার ঘরের কার্পেট থেকে যে জিনিসগুলো কুড়িয়ে ওই কৌটোতে রেখেছেন, তা আমার ল্যাবরেটরিতে মাইক্রোস্কোপে দু-জনেই পরীক্ষা করে দেখেছি। বলুন কলে, ওগুলো কী?

কর্নেল বললেন–যে প্রজাপতির ছবি আপনাদের দেখিয়েছি, তারই ডানার কুচি এগুলো। সূক্ষ্ম চিমটে দিয়ে আতস কাচের সাহায্যে আমি কাল বিকেলে রানিমার ঘরের মেঝে থেকে তুলে রেখেছি। সাংবাদিক জয়ন্ত চৌধুরি আমাকে টর্চ দেখিয়েছিল। রানিমার নাতনি মিস সোহিনী রায়ও তখন ও-ঘরে উপস্থিত ছিল। যাই হোক, তাহলে এটা স্পষ্ট যে বেড়ালগুলো রানিমার ঘরে এক বা একাধিক বিষাক্ত প্রজাপতির গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে সেগুলো খেয়ে ফেলেছিল এবং তারপরই মারা পড়েছিল। এখন প্রশ্ন রানিমার ঘরে এই প্রজাতির প্রজাপতি কীভাবে ঢুকেছিল? রানিমার ঘরের জানালা নিশ্চয় খোলা ছিল। বলুন নন্দরানি?

নন্দরানি বললেন–হ্যাঁ স্যার। জানালা খোলা ছিল। কিন্তু পর্দাগুলো টানা ছিল।

–তাহলে এক বা একাধিক প্রজাপতি, আমি একাধিকই বলছি, তারা নিজেরা কী করে ঘরে ঢুকেছিল? এই প্রশ্নের সোজা জবাব, কেউ তাদের জানালার পর্দা তুলে ঘরের ভিতর উড়িয়ে দিয়েছিল। কীভাবে সে প্রজাপতিগুলো নিয়ে গিয়েছিল? তার জবাব, একটা প্ল্যাস্টিকের সচ্ছিদ্র প্যাকেটে ভরে সে, মোট তিনটে প্রজাপতি নিয়ে এসে জানালার ভিতর প্যাকেটটা ঝেড়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। প্যাকেটটা আমি রাজবাড়ির পিছনে কুড়িয়ে পেয়েছি। প্রজাপতি তিনটের তত বেশি ওড়ার ক্ষমতা ছিল না। দশ ইঞ্চি ডানাওয়ালা প্রকাণ্ড প্রজাপতি। তাদের দেখামাত্র ছটা বেড়াল ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা সছিদ্র কালো প্যাকেট বের করে দেখালেন। তারপর বললেন–এখানে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ হালদার উপস্থিত আছেন। সোহিনী তার ক্লায়েন্ট। মিঃ হালদারকে আমি হালদারমশাই বলি। হালদারমশাই! এবার আপনি বলুন।

গোয়েন্দাপ্রবর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–খ্রিস্টান মিশন হাসপাতালের এক কর্মীর লগে নস্য দিয়ে ভাব করছিলাম। তার নস্য ফুরাইয়া গিছল। সেই কর্মীরে আমি আইজ লইয়া আইছি। তার লগে ম্যামসায়েবের কথা আলোচনা করছিলাম। কথায় কথায় সে কইয়া দিল, ম্যামসায়েব রাজবাড়ির একটা লোকেরে তিনখান বড় বড় প্রজাপতি দিছিল। ক্যান দিছিল সে জানে না। এবার ভাইটি দাঁড়াইয়া কও, কী দেখছিলা?

একজন আদিবাসী তার পিছন থেকে সামনে এল। তার পরনে হাফপ্যান্ট আর শার্ট। সে বলল–আমার নাম কানু মুর্মু স্যার! রানিমা মারা যাওয়ার আগের দিন সন্ধ্যার একটু আগে রাজবাড়ির একটা লোক মিশন হাসপাতালে গিয়েছিল। মেমসায়েব তার হাতে ওই প্ল্যাস্টিক প্যাকেটে তিনটে প্রজাপতি ভরে দিয়েছিলেন। আমি জানালা দিয়ে দেখেছিলুম। বুঝতে পারিনি কিছু। তবে প্রায়ই দেখতুম, মেমসায়েব প্রজাপতি ধরে এনে প্যাথলজি রুমে কাটাছেঁড়া করছে।

কর্নেল বললেন–মেমসায়েব কেন কাটাছেঁড়া করতেন তা ডাঃ গুপ্ত জানেন। থানার ওসি মিঃ প্রসাদও ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। তার আগে কানু মুমুকে জিজ্ঞেস করছি, রাজবাড়ির সেই লোকটা এখানে আছে কি? তাকে তুমি দেখিয়ে দাও।

কানু মুর্মু হলঘরের সিঁড়ির দিকে আঙুল তুলে বলল–ওই লোকটা স্যার!

কথাটা বলামাত্র ভজুয়া যেন নিজে থেকেই ধরা দিল। সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। তারপর ওসি মিঃ প্রসাদের ধমক খেয়ে বলল–আমি কিছু জানি না স্যার। আমি বিকেলে মাথার যন্ত্রণার ওষুধ আনতে গিয়েছিলুম। মেমসায়েব আমাকে বসিয়ে রেখে বলেছিলেন, একটু বসো। তারপর সন্ধ্যা হয়ে আসছে দেখে আমি তাকে কাকুতি মিনতি করলুম। তখন উনি ওষুধ দিলেন। তারপর ওই কালো প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট দিয়ে বললেন, এটা তোমার সায়েবকে দিও।

তীর্থব্রত সিংহ রুষ্টমুখে বললেন–মিথ্যে কথা। আমাকে ভজুয়া কোনো প্যাকেট দেয়নি।

ভজুয়া বলল–তখন আপনি ফ্যাক্টরি থেকে আসেননি। তাই বউদিরানিকে ওটা রাখতে দিয়েছিলুম।

অরুণিমা ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন–ওতে কী ছাইপাঁশ ছিল, আমি কেমন করে জানব? আমি ওটা টেবিলের তলায় রেখেছিলুম। অনেক রাতে তীর্থ বাড়ি ফিরেছিল। তখন আমার ওটার কথা মনে ছিল না।

তীর্থব্রত বললেন–ভোর রাতে পাঁচটার সময় কে ফোনে বলেছিল, আপনার ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে। তাই শুনে আমি তখনই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কী হয়েছিল, তা কর্নেল সায়েব জানেন। দমকল অফিস জানে। ও সি মিঃ প্রসাদও জানেন। বলুন আপনারা।

কর্নেল তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–আবার আমি মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। তা হল রানিমার মৃত্যু। না–মৃত্যু নয়, হত্যাকাণ্ড। আপনারা এই অদ্ভুত জিনিসটা আগে দেখে নিন।

বলে তিনি বুকপকেট থেকে সেই খুদে অ্যামপিউল-কাম-ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বের করলেন। তার তলায় তিনি চাপ দিতেই সূক্ষ্ম সূচটা বেরিয়ে পড়ল। সোফা থেকে রাশভারি চেহারার এক বাঙালি ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন–ওটা কী?

কর্নেল বললেন–মেমসায়েব ন্যান্সি আচারিয়া প্রজাপতি কাটাছেঁড়া করতেন, তা কানু মুর্মু দেখছেন। হ্যাঁ-যে বিষাক্ত প্রজাপতির ছবি আপনাদের দেখিয়েছি, সেই প্রজাপতির শরীর থেকে মেমসায়েব বিষটুকু বের করে নিয়ে একটা অ্যামপিউলে রাখতেন। তারপর এই খুদে অ্যামপিউলে ঢোকাতেন। এটা রবারের তৈরি। এতে প্রজাপতির বিষ ভরে মেমসায়েব এটার মাথায় জুড়ে দিতেন এই সিকি ইঞ্চি মাপের সিরিঞ্জ। এই খুদে অ্যামপিউল-কাম-সিরিঞ্জ তাইওয়ান-হংকং অঞ্চলে চিনারা নেশার জন্য ব্যবহার করে। মেমসায়েব এগুলো সম্ভবত হংকং থেকে এনেছিলেন। শত্রুবিনাশের উদ্দেশ্যে ধনী লোকেরা এগুলো তার কাছ থেকে কিনে নিত। এখানে পুলিশ সুপার মিঃ রাঘবেন্দ্র সিনহা উপস্থিত আছেন। তিনিই জানেন, সারা বিহার অঞ্চলে অনেক ধনী ব্যক্তি রানিমার মতো গত দু-তিন বছরে মারা পড়েছেন। কিন্তু সেইসব মৃত্যুরহস্যের কিনারা করা যায়নি। এতদিনে সেই রহস্যের পর্দা আমি তুলে ধরতে পেরেছি।

পুলিশ সুপার বললেন–কাল বিকেলে ন্যান্সি আচারিয়াকে করনগড় রেলস্টেশনে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর সবটুকু কৃতিত্ব কর্নেল সরকারেরই প্রাপ্য। তাকে আমরা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কর্নেল বললেন–এই অদ্ভুত অ্যামপিউল-কাম-সিরিঞ্জটা আমি উদ্ধার করেছি। রানিমার ঘরের পিছনদিকে ঘন ঘাসের জঙ্গলে এটা পড়েছিল। রানিমার খুনি কল্পনাও করেনি এটা কারও চোখে পড়বে। মুছিত রানিমার বাঁ কানের নীচে গলায় খুনি এটা ঢুকিয়ে দিয়ে অ্যামপিউলটা চাপ দিতেই প্রজাপতির বিষটুকু রক্তে মিশে তখনি তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। তারপর খুনি এটা পিছনের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিল।

সোফা থেকে সেই বাঙালি ভদ্রলোক বললেন–এবার আপনি বলুন কে এই সাংঘাতিক কাজ করেছিল?

কর্নেল একটু হেসে বললেন–তার আগে আমি আপনার পরিচয় জানতে আগ্রহী।

–আমি বাঙালিটোলার রানি সরোজিনী স্মৃতিসংঘের প্রেসিডেন্ট অরিন্দম রায়চৌধুরি।

কর্নেল নন্দরানির দিকে ঘুরে বললেন–তাহলে নন্দরানি, আপনি যখন রানিমার টেলিফোন ডেড দেখে তীর্থব্রত সিংহের ঘরে ডাঃ গুপ্তকে ফোন করতে যান তখন রানিমার ঘরে মূৰ্ছিতা রানিমার কাছে কে ছিলেন?

নন্দরানি বললেন–বলেছি তো স্যার! বউদিরানি ছিলেন।

কর্নেল বললেন–মিসেস অরুণিমা সিংহ! আপনিই দীর্ঘকালের আক্রোশের বশে বিশেষ করে রানিমার উইলে মাত্র এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তির অর্ধেক আপনার স্বামীর প্রাপ্য তা জানার পর রানিমাকে হত্যার চক্রান্ত করেছিলেন। আপনার স্বামীর বন্ধু রঘুবীর আচারিয়ার স্ত্রী ন্যান্সি অর্থাৎ মার্কিন মেমসায়েবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ এবং বন্ধুতার পর এই সাংঘাতিক মরণাস্ত্র হাতে পেয়েছিলেন। এই সছিদ্র কালো রবারের প্যাকেটে মরণাস্ত্রের সঙ্গে মেমসায়েব ভজুয়ার হাত দিয়ে আপনাকে তিনটে বিষাক্ত প্রজাপতিও পাঠিয়েছিলেন। রানিমা ঘর বন্ধ করে উপরের ঠাকুরঘরে গেলে আপনিই জানালা দিয়ে প্রজাপতিগুলোকে ফেলে দিয়েছিলেন। তারপর কী ঘটেছিল, আমরা নন্দরানির মুখে শুনেছি। হ্যাঁ– আপনিই রানিমার খুনি।

 তীর্থব্রত উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলুম, সিঁড়ির উপর থেকে চারজন মহিলা দ্রুত নেমে আসছে। তারা অরুণিমার কাছে আসতেই একটা আকস্মিক ঘটনা ঘটে গেল। অরুণিমা তার হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখা একটা খুদে অ্যামপিউল-কাম সিরিঞ্জ তার স্বামীর গলায় ঢুকিয়ে দিলেন। তীর্থব্রত সিংহ আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন। কর্নেল চেয়ারের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে অরুণিমাকে বাধা দেওয়ার আগেই অরুণিমা এবার আরেকটা খুদে অ্যামপিউল-কাম-সিরিঞ্জ নিজের গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে কর্নেলের ওপর আছড়ে পড়লেন।

মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এই শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল। হলঘরে কোলাহল শুরু হল। মহিলা পুলিশ এবং কয়েকজন কনস্টেবল ও সি মিঃ প্রসাদের নির্দেশে ভিড় হটিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে কার্পেটে শুইয়ে দিল। ডাঃ গুপ্ত উঠে গিয়ে দুজনকে পরীক্ষা করে বললেন–ডেড।

এরপর রানিমার উইল পড়ে শোনানোর অবস্থা ছিল না। কর্নেল হালদারমশাইকে ইঙ্গিত জানালেন, তাঁর মক্কেল সোহিনীকে নিয়ে যেন এখনি বেরিয়ে আসেন।

কর্নেল, ক্যাপ্টেন পাণ্ডে, ডাঃ অবনী গুপ্ত, পুলিশ সুপার মিঃ সিনহা, ও সি মিঃ প্রসাদ, এবং রানি সরোজিনী স্মৃতি সংঘের প্রেসিডেন্ট অরিন্দম রায়চৌধুরি সেদিনই রাত্রে বাঙালিটোলায় অরিন্দমবাবুর বাড়িতে বসে রানিমার সম্পত্তি রক্ষার জন্য একটা ট্রাস্টিবোর্ড গঠন করেছিলেন। রানিমার বেডরুম এবং ঠাকুরঘরের তালার চাবি কর্নেল ও সি মিঃ প্রসাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালের ট্রেনে সোহিনী আমাদের সঙ্গে কলকাতা ফিরে এসেছিল।

শুক্রবার বিকেলে আমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে যখন এই ঘটনা লিখছি, তখন কর্নেলের ফোন এসেছিল। কর্নেল বলেছিলেন–জয়ন্ত রঘুবীর আচারিয়ার ঘরে রাজাসায়েবের সংরক্ষিত সেই ঐতিহাসিক দামি জিনিসটা পাওয়া গেছে। যেটা করনগড় রাজপরিবারের পূর্বপুরুষ কর্ণঠাকুরকে আকবরের সেনাপতি রাজা মানসিংহ উপহার দিয়েছিলেন।

জিজ্ঞেস করলুম-কিন্তু জিনিসটা কী তা-ই বলুন।

কর্নেল বললেন–সোনার খাপের মধ্যে ভরা একটা নিতান্ত ইস্পাতের ছোরা। কিন্তু ছোরাটার বাঁট আর খাপ নিরেট সোনার। তাতে অজস্র হিরে, মুক্তো, বৈদূর্যমণি ইত্যাদি নানারকমের মূল্যবান রত্ন বসানো আছে। রঘুবীর আচারিয়া স্বীকার করেছেন করনগড়ের তীর্থব্রত সিংহ তার অনেক বছরের বন্ধু। একসময় করনগড়ে রঘুবীর আচারিয়ার একটা ট্রেডিং এজেন্সি ছিল। তীর্থব্রত তার মামা। রাজাসায়েব প্রসন্নকুমার সিংহের ঘর থেকে চুরি করে ওই ঐতিহাসিক ছোরাটা রঘুবীর আচরিয়াকে বিক্রি করেছিলেন। দশ বছর আগের ঘটনা এটা। রঘুবীরের এসব জিনিস কেনার বাতিক বরাবর ছিল। ছোরাটার বিনিময়ে তিনি তীর্থব্রতকে আড়াই লক্ষ টাকা দেন। সেই টাকায় তীর্থব্রত মেশিনপার্টস তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন। তবে এটা তিনি রাজাসায়েবের মৃত্যুর পর করেন। টাকা তিনি করনগড়ের একটা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছিলেন স্ত্রীর নামে। সুদে আসলে তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় দ্বিগুণ। আর একটা কথা জয়ন্ত!

-বলুন।

–রানিমার মৃত্যুর আগের দিন অরুণিমা ব্যাংক থেকে তিরিশ হাজার টাকা তুলেছিলেন। সেই টাকাই নন্দরানি আর দুবেজির বিছানার তলায় রাখা ছিল। বাকি দশ হাজার টাকা ভজুয়ার মারফত ন্যান্সিকে পাঠিয়েছিলেন। অরুণিমা নিজেই একাজ করেছিলেন তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি। ওদিকে ভজুয়া পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে, অরুণিমা দশ হাজার টাকা মেমসায়েবকে পাঠিয়েছিলেন।

-কিন্তু কর্নেল, আমি বুঝতে পারিনি, রঘুবীর আচারিয়ার ঘরে মানসিংহের উপহার দেওয়া ছোরার খোঁজ কে দিয়েছিল পুলিশকে?

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার ছাড়া আর কে দেবে?

–আপনি কী করে ওটার খোঁজ পেয়েছিলেন? আপনি তো রঘুবীর আচারিয়ার ঘরে একবারও ঢোকেননি!

কর্নেলের হাসি ভেসে এল! জয়ন্ত! নিউ আলিপুরের অভিষেক বসুকে ওই ছোরাটার ইতিহাস শুনিয়েছিলেন স্বয়ং রঘুবীর আচারিয়া। মিঃ বসু পরে আমাকে টেলিফোনে ঘটনাটা জানান। তারপর রানিমার ঘর থেকে ডায়ারি চুরি করে এনেছিলুম, তাতে ওই ছোরার ইতিহাস লেখা ছিল। তখনি আমি ও সি মিঃ প্রসাদকে ফোন করে খবর দিয়েছিলুম। ডায়ারিতে তীর্থব্রত আর অরুণিমার বিরুদ্ধে রানিমা অনেক অভিযোগ লিখে রেখেছিলেন।

–ডায়ারিটা কি দেখতে পাব?

দুঃখিত জয়ন্ত! ওটা করনগড়ে পুলিশকে আমি দিয়ে এসেছি। বাই দ্য বাই, সোহিনী তোমাকে টেলিফোন করেনি?

–না তো!

যে কোনো মুহূর্তেই করবে। প্রতীক্ষায় থাকো।

কর্নেলের লাইন কেটে গেল। কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইলুম। হ্যাঁ–আমি সোহিনীর টেলিফোনের প্রতীক্ষায় অনন্তকাল বসে থাকতে রাজি।