প্রজন্ম
বেশ বাড়িটা পেয়েছিস যা-হোক। যেমন সুন্দর জঙ্গুলে জায়গা, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পলিউশান বলে কিছু নেই আর তেমনই বাংলোখানা। তিমির বলল অর্ণবকে।
হয়ে গেল যোগাযোগ। জামশেদপুর থেকে গাড়িতে চলেও আসা যায় ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে। সঙ্গের পারক্যুইজিটসও খারাপ নয়। বলে, মুণ্ডা মালির বউ-এর দিকে তাকাল।
সমীর বলল, এসব এম সি সি-র এরিয়া। খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। বিয়ার পেঁদিয়ে খিচুড়ি খেয়ে নিজের বউ-এর বুকে হাত দিয়ে শুয়ে থাকো লক্ষ্মীছেলের মতো। ওসব এদিক-ওদিক তাকিয়ো না। ধড় থেকে মুন্ডু আলাদা করে দেবে। তোমাদের মতো শহুরে বাবুদের নানারকম অত্যাচারেই তো আজ ওরা এত মিলিট্যান্ট হয়ে উঠেছে।
তা হোক। ফিগারখানা দেখেছিস। আর কী টরসো। আফ্রিকানদের মতো।
এ হচ্ছে, মুণ্ডাদের ‘সোনা লুকানো রূপা লুকানো’ দেশ। এখানের সবই ভালো। তার পর বলল, এ মেয়েটি মালির দ্বিতীয় মেয়ে। বিয়ে হয়েছে টেবোতে। বেড়াতে এসেছে মা-বাবার কাছে ক-দিনের জন্যে। বড়োমেয়েটি বিধবা। তার একটি বাচ্চা মেয়ে আছে। মেয়েটার খুব জ্বর দু-দিন হল। কেমন একটা হেঁচকি তুলছে আর বেড়ালের মতো কাঁদছে।
ডাক্তার দেখিয়েছে?
না মনে হয়।
তুই তো দেখাতে পারতিস।
দেখাব। দেখাব ভেবেছি। এখানে তো ডাক্তার নেই। নিয়ে যেতে হবে, গাড়িতে করে খুঁটি কিংবা চাঁইবাসা। তা তোরা এতজনে আসছিস তোর বিয়ের দশ বছরের পার্টির জন্যে, এ ক-দিন সময় পেলাম কই? রাঁচি গেছিলাম তোদের সকলের খাদ্যপানীয়, সব আনতে। মেয়েরা কে কে জিন খায়? তিন বোতলে হবে তো? নইলে বিয়ার অবশ্য অনেক আছে, শ্যাণ্ডি করেও খেতে পারে।
ভদকা আনিসনি?
আনবনা? জানো তো শীলা শুধু ভদকাই খায়।
আর আমাদের হুইস্কি?
হুইস্কি আর রাম-এর অভাব নেই। চান করতে পারিস। মেয়েদের জন্যে ওয়াইন পেলে ভালো হত, রাঁচিতে ভালো পেলাম না।
জয় নিয়ে এসেছে রেড ওয়াইন। হোয়াইট ওয়াইন তো আবার ঠাণ্ডা করে নিতে হয়। তোর এই জঙ্গুলে ডেরাতে তো আর ফ্রিজ নেই। সমীর বলল।
কে বলেছে নেই? ডিপ ফ্রিজও আছে। পবিত্রও ওয়াইন নিয়ে এসেছে। হোয়াইট ওয়াইন চলে গেছে ডিপ ফ্রিজে। রেড ওয়াইন তো রুম টেম্পারেচারে খেতে হয় তাই রেড ওয়াইন নিয়ে চিন্তা নেই।
কী ওয়াইন এনেছে?
রিভিয়েরা। এখন তো দেশেই নানারকম ভালো ওয়াইন হচ্ছে। রিভিয়েরা, বসকা। সেদিন ক্যালকাটা ক্লাব-এ একটা ওয়াইন খেলাম। নামটা ভুলে গেছি। রেড। খুব ভালো ওয়াইন।
পবিত্র কলকাতা থেকে এত সব বয়ে নিয়ে এসেছে?
ওর নতুন মাহিন্দ্র স্করপিয়ন গাড়ি। অনেক জায়গা। তা ছাড়া ও হাঁড়িতে করে কইমাছও এনেছে। সালামি, ককটেইল সসেজ, বেকন, হ্যাম এবং ফ্রস্টেড চিকেন, আইস বক্সে করে।
চিকেনের এখানে অভাব কী? ফ্রেশ মুরগি। স্বাদও ভালো।
পবিত্ররা কখন এসে পৌঁছেছে?
কাল রাতে। অরবিন্দও এসেছে। একইসঙ্গে ওর হণ্ডা সিটি গাড়িতে।
তারা সব কোথায়? এ তো নরক গুলজার দেখছি।
তারা সব গেছে টেবো ফলস দেখতে। তবে তুই বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস। জামশেদপুরে নেমে ট্যাক্সিতে আসাই ভালো। গাড়ি খারাপ হওয়ার ঝামেলা বা রিস্ক নেই। এয়ারকণ্ডিশানড ক্লাস-এ জামশেদপুরে এসে, ট্যাক্সিতে। আজকাল এ সি ট্যাক্সিও পাওয়া যায়। তবে এখন তো শীতকাল, প্লেজেন্ট ওয়েদার— ড্রাইভটিও খুব সুন্দর।
সবসুদ্ধু ক-জন এসেছে সবমিলে?
তোর ফ্যামিলি, মানে তোর বউ, শালি, ভায়রাভাই, আর রাজীবকে নিয়ে আমাদের ছাড়া এগারো জন। সন্ধেবেলা বার-বি-কিউ হবে বাংলোর সামনে বাইরে।
এমন সময়ে সত্যিই বেড়ালের কান্নার মতো একটা কান্না ভেসে এল মালির কোয়ার্টার থেকে, নীচু গ্রামে। কিন্তু কান্নাটা ভারি ডিপ্রেসিভ। মন খারাপ হয়ে যায়।
অর্ণব বলল, শুনলি তো। মুড নষ্ট করে দিচ্ছে। আমি কি নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে?
তুই তো এদিকের কিছু চিনিস না। গেলে, আমারই যেতে হত। আজ রাতটা ভালোয় ভালোয় পোয়াক। তোর অ্যানিভার্সারির পার্টিটা হয়ে যাক তার পর কাল সকালে দেখা যাবে। আসলে মালির বউ ও দু-মেয়েই তো কিচেনে রান্না নিয়ে ব্যস্ত। এতজনের রান্না করে তো অভ্যস্ত নয় ওরা। তা ছাড়া মালির বউ ভালো রাঁধুনি তার মেয়েগুলো হেল্পার। হেল্পেরও তো দরকার। মালি বলেছিল গতকাল, বাসে করে ওকে নিয়ে যাবে খুঁটিতে। আমিই বললাম, একটু ধৈর্য ধরো কাল আমি নিজে গাড়িতে নিয়ে যাব।
অসুখ তো করেছে দু-তিন দিন হল বললি।
তাইতো। কিন্তু কী করা যাবে। তোদের কোনো কষ্ট তো হতে দিতে পারি না। এই প্রথম বার এলি আমার বাংলোতে।
২
টেবো ঘাট থেকে ওরা সকলে যখন হইহই করে ফিরল বারোটা নাগাদ ততক্ষণে তিমির এবং ওর পার্টির সকলের চান-টান হয়ে গেছে। তারা চেরি গাছতলাতে বিয়ার খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। মাঝে মাঝেই সেই বেড়াল-কান্নার মতো আওয়াজটা ভেসে আসছে আর মধ্যে মধ্যে হিক্কা।
তিমিরের ভায়রাভাই শ্যামল বলল, এত ভালো ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক-এর বন্দোবস্ত করেছে অর্ণবদা। কিন্তু কান্নাটা Eerie। মেজাজ খারাপ করে দেয়।
শোন এই নতুন ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক।
লাঞ্চ-এর পরে সকলেই ঘুম লাগাল। সকলেই জার্নি করে এসেছে তার পর রাতে তো লেট নাইট হবেই।
মালির বউকে অর্ণব একবার জিজ্ঞেস করে এল, গুণিন-এর ওষুধ খেয়ে একটুও উন্নতি হয়নি কি তোমার নাতনির?
না সাব। উন্নতির তো কিছু দেখছি না। এদিকে আমরা তো কেউ ওর কাছেও থাকতে পারছি না।
দেখো, রাতটা পেরোক।
তিন দিন হয়ে গেল। না-দানা না-পানি। এ যে কী অসুখ হল কে জানে!
অর্ণব মনে মনে বলল, গরিবের প্রাণ কচ্ছপের মতো। অত সহজে প্রাণ যায় না।
মুখে বলল, কাল সকাল দশটা নাগাদ নিয়ে যাব। তোমরা দুজনও যেয়ো আমার সঙ্গে, ভালো ডাক্তার দেখিয়ে দেব।
৩
বিকেলে চা খাওয়ার সময় শীলা বলল, তোমার বাড়িতে কি পেতনি আছে নাকি অর্ণবদা? মাঝে মাঝেই পেতনির ডাকের মতো ডাক শুনছি। অন্যরাও সকলে বলল, সত্যিই তাই।
শীলা বলল, আমি তো ঘুমোতেই পারলাম না।
একটা ফিক্সড ইনটারভ্যালে হচ্ছে আওয়াজটা।
এবং অনবরত। কোনো পজ নেই।
অর্ণব বলল, মালির নাতনিটার অসুখ করেছে। তিন দিন হল এই ন্যাগিং কান্না। মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।
শীলা বলল, আজ মেজাজ খারাপ কোরো না।
তিমিরদা আর ঝিঙ্কু বউদি মনে কষ্ট পাবেন।
তবে এই কান্নাটা যে ন্যাগিং তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মনে হয় বেড়ালবাচ্চা কাঁদছে।
৪
সন্ধে হতে না হতেই, পার্টি একেবারে জমে গেল। বাইরে মালি আরও দুজন লোককে নিয়ে এসেছিল। বার-বি-কিউ-এর সব বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করে ফেলেছে ওরা। রাত আটটাতে শুয়োর ছানাটাকে শিকে ফুঁড়ে আগুনে ঝলসানো হবে। চামাররা যেভাবে শুয়োর মারে, পেছন দিকে গরম শিক ঢুকিয়ে, তেমন করেই মারবে ওরা। সেইসময় শুয়োর ‘ত্রাহি ত্রাহি’ চিৎকার করে, তাই অর্ণব তার ড্রাইভারকে বলেছে, ওদের নিয়ে, শুয়োর নিয়ে গাড়িতে জঙ্গলের মধ্যে মাইল খানেক গিয়ে সেখানেই যেন মারে শুয়োরটাকে নইলে শুয়োরের কান্না অতিথিদের আপসেট করবে। তারা ঠিক সাতটাতে বনে যাবে গাড়ি নিয়ে।
ওরা গাড়ি নিয়ে ফিরে আসতে আসতে এদিকে সকলেই তৈরি।
ঝিঙ্কু বলল, এরকম ঠাণ্ডা না-হলে কি ড্রিঙ্ক করে আরাম হয়?
যা বলেছিস ঝিঙ্কু।
শীলা বলল।
তখনই শীলার তিনটে ভদকা হয়ে গেছে। মিউজিক সিস্টেমে মাইকেল জ্যাকসন-এর গান বাজছে। পার্টি একেবারে জমজমাট।
মলিনা বলল, এবার আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইব। কোরাস।
কী গান?
বনে যদি ফুটল কুসুম নেই কেন সেই পাখি নেই কেন?
দুস। ওটা তো বসন্তের গান।
আসলে ঝিঙ্কু ওই গানটাই কেবল জানে কিনা।
অর্ণব বলল।
ঝিঙ্কু বলল, ভালো হবে না কিন্তু।
তাহলে পুরোনো সেই দিনের কথা। সকলেই জানে ও গান।
আরে গানটা তো বড়ো কথা নয়। ফুর্তিটাই আসল।
সকলেই কি আর সুরে গাইবে? ফুর্তি হলেই হল।
রবীন্দ্রসংগীতই যদি গাইবে তাহলে ইন্দ্রাণী সেনকেই নিয়ে আসতে পারতাম আগে বললে।
ওর স্বামী, যোগেশের খুব বন্ধু।
প্রমিতা মল্লিককেও আনা যেত।
তপনদা খুব হুল্লোড়ে মানুষ। তবে শুয়োরের মাংস খেয়ে কী একটা অসুখ করেছিল— খুব ভুগে উঠল। এখন আর একেবারেই ড্রিঙ্ক করে না। আর ড্রিঙ্ক ছেড়ে দেওয়াতে পার্সোনালিটিই বদলে গেছে। আগের মতো হুল্লোড় আর করতে পারে না।
যাকগে। সেলিব্রিটিরা যখন নেই-ই তখন, আমরা শুরু করি। কী বল?
মাধবী বলল, উঃ সেই বেড়াল-কান্নাটা কি একটুক্ষণের জন্যেও বন্ধ হবে না?
কন্টিনিউয়াসলি হয়েই চলেছে।
রেসপাইট নেই কোনো।
ডিসগাস্টিং।
তার পরই গান শুরু হল।
বেড়াল-কান্না আর শোনা গেল না, সেই তুমুল হইহল্লায়।
গান শেষ হল। বার-বি-কিউও আরম্ভ হল।
একটা গাছের ডালের সঙ্গে শুয়োরটাকে বেঁধে আগুনের ওপরে আস্তে আস্তে ঘোরাতে লাগল, মালি আর তার সঙ্গীঁরা। ভালো করে তৈরি হলে মালির বউ প্লেট আর ফর্ক নিয়ে আসবে—মালি কেটে কেটে স্লাইস তুলে দেবে প্রত্যেকের প্লেটে। মাস্টার্ড, নুন, গোলমরিচ এবং টাবাসকো সস দিয়ে সকলেই খাবে আর বলবে ‘ডিল্লিসস’।
শীলা বেশ হাই হয়ে গেছিল। বলল, আমি একটা সোলো গাইব।
তিমির গলা তুলে বলল, সাইলেন্স সাইলেন্স—
এবার শীলা একটা সোলো গাইবে।
কী গান?
বাংলা ব্যাণ্ডের গান।
কী গান?
‘গান ভালোবেসে গান।’
ইতিমধ্যে আবার সেই কান্নাটা ভেসে এল।
শীলা বলল, ইম্পসিবল। কী গানের সঙ্গে কী ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক!
সকলে হো হো করে হেসে উঠল।
ঝিঙ্কু বলল, গাও গাও, শুরু করো শীলা।
শীলা গান শুরু করে ঘুরেঘুরে হাতে তালি দিয়ে গাইতে লাগল। সকলেই হাতে তালি দিতে লাগল। দু-একজন ড্রাঙ্ক হয়ে যাওয়াতে সোলোর শর্ত লঙ্ঘন করে সঙ্গে গাইতে লাগল।
শীলার গান থামলে হাততালির ঝড় উঠল। এরইমধ্যে মানসী বলল, এবারে আমি গাইব।
যা পেসিমিস্টিক ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক—বেড়াল-কান্না। আমি একটা দুঃখের গান গাইব।
প্রতিমা বলল, এত আনন্দের মধ্যে দুঃখের গান কেন?
আই ফিল লাইক। আমার ইচ্ছা করছে।
আবার অর্ণব বলল, কোয়াইট কোয়াইট।
সোলো গান হবে।
সকলে নিস্তব্ধ হতেই প্রতিমা বলল, কই ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক কই? থেমে গেল কেন?
সকলেই উৎকর্ণ হয়ে পর পর বলে উঠল, সত্যিই বন্ধ হয়ে গেছে। বাবা:। বাঁচা গেল। এমন একটা পার্টিকে বড়োই খারাপ করে দিচ্ছিল একান্নাটা।
মালির বউ ঝিঙ্কুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি কোয়ার্টারের দিকে গেল। এবং একটু পরেই ফিরে এসে বলল, বন্ধ হয়ে গেছে।
যাক তাহলে ভালো হয়ে গেল। কাল সকালে হ্যাংওভার নিয়ে আমাকে খুঁটি বা চাঁইবাসা যেতে হবে না আর তাহলে।
মালির বউ-এর দু-গাল বেয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল ওপরের ঠোঁটটা নীচের ঠোঁট দিয়ে কামড়ে ধরে ঝিঙ্কুকে বলল, ঔর আপলোগোঁকি তনক নেহি করেগি ও।
কী হয়েছে?
চলি গ্যয়ি।
মরে গেছে?
বলেই, অর্ণবকে বলল, শুনছ, মরে গেছে। কী ইনকনসিডারেট। এইরকম একটা পার্টির মধ্যে কেউ মারা যায়?
সবাই বলল, হাউ স্যাড। মেয়েটা মরে গেল?
যতীন গলা তুলে বলল, লেটস ড্রাউন দ্য সরো বাই ড্রিঙ্কিং। চলো, আজ সকলে আমরা ওর অনারে ডান্স করব। কী নাম ছিল তোমার নাতনির?
দুখিয়া।
চলো সকলে মিলে দুখিয়ার অনারে ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গাই। চলো, প্লিজ লেণ্ড ইয়োর ভয়েসেস টু শো রেসপেক্ট টু দ্য ডিপার্টেড।