প্রকৃতির খেদ – প্রথম পাঠ

[প্রথম পাঠ]


বিস্তারিয়া ঊর্মিমালা,
বিধির মানস-বালা,
মানস-সরসী ওই নাচিছে হরষে।
প্রদীপ্ত তুষাররাশি,
শুভ্র বিভা পরকাশি,
ঘুমাইছে স্তব্ধভাবে হিমাদ্রি উরসে।


অদূরেতে দেখা যায়,
উজল রজত কায়,
গোমুখী হইতে গঙ্গা ওই বহে যায়।
ঢালিয়া পবিত্র ধারা,
ভূমি করি উরবরা,
চঞ্চল চরণে সতী সিন্ধুপানে ধায়।


ফুটেছে কনকপদ্ম অরুণ কিরণে॥
অমল সরসী’ পরে,
কমল, তরঙ্গভরে,
ঢুলে ঢুলে পড়ে জলে প্রভাত পবনে।


হেলিয়া নলিনীদলে,
প্রকৃতি কৌতুকে দোলে,
সরসী-লহরী ধায় ধুইয়া চরণ।
ধীরে ধীরে বায়ু আসি,
দুলায়ে অলকরাশি,
কবরী-কুসুম-গন্ধ করিছে হরণ।


বিজনে খুলিয়া প্রাণ,
নিখাদে চড়ায়ে তান,
শোভনা প্রকৃতিদেবী গান ধীরে ধীরে।
নলিন নয়নদ্বয়,
প্রশান্ত বিষাদময়,
ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বহিল গভীরে।


অভাগী ভারত! হায়, জানিতাম যদি,
বিধবা হইবি শেষে,
তা হলে কি এত ক্লেশে,
তোর তরে অলংকার করি নিরমাণ?
তা হলে কি পূতধারা মন্দাকিনী নদী
তোর উপত্যকা’পরে হত বহমান?
তা হলে কি হিমালয়,
গর্বে ভরা হিমালয়
দাঁড়াইয়া তোর পাশে
পৃথিবীরে উপহাসে,
তুষারমুকুট শিরে করি পরিধান।


তা হলে কি শতদলে,
তোর সরোবরজলে,
হাসিত অমন শোভা করিয়া বিকাশ?
কাননে কুসুমরাশি,
বিকাশি মধুর হাসি,
প্রদান করিত কি লো অমন সুবাসে?


তা হলে ভারত! তোরে,
সৃজিতাম মরু করে,
তরুলতা-জন-শূন্য প্রান্তর ভীষণ;
প্রজ্বলন্ত দিবাকর,
বর্ষিত জ্বলন্ত কর,
মরীচিকা পান্থদের করিত ছলন!’
থামিল প্রকৃতি করি অশ্রু বরিষন।


গলিল তুষারমালা,
তরুণী সরসী বালা,
ফেনিল নীহার-নীর সরসীর জলে।
কাঁপিল পাদপদল;
উথলে গঙ্গার জল,
তরুস্কন্ধ ছাড়ি লতা লুটিল ভূতলে।

১০
ঈষৎ আঁধাররাশি,
গোমু্‌খী শিখর গ্রাসী,
আটক করিয়া দিল অরুণের কর।
মেঘরাশি উপজিয়া,
আঁধারে প্রশ্রয় দিয়া,
ঢাকিয়া ফেলিল ক্রমে পর্বতশিখর।

১১
আবার ধরিয়া ধীরে সুমধুর তান।
প্রকৃতি বিষাদে দুঃখে আরম্ভিল গান।
“কাঁদ্‌! কাঁদ্‌! আরো কাঁদ্‌ অভাগী ভারত
হায়! দুঃখ-নিশা তোর,
হল না হল না ভোর,
হাসিবার দিন তোর হল না আগত?

১২
লজ্জাহীনা! কেন আর,
ফেলে দে-না অলংকার ,
প্রশান্ত গভীর ওই সাগরের তলে?
পূতধারা মন্দাকিনী,
ছাড়িয়া মরতভূমি
আবদ্ধ হউক পুনঃ ব্রহ্ম-কমণ্ডলে।

১৩
উচ্চশির হিমালয়,
প্রলয়ে পাউক লয়,
চিরকাল দেখেছে যে ভারতের গতি।
কাঁদ্‌ তুই তার পরে,
অসহ্য বিষাদভরে,
অতীত কালের চিত্র দেখাউক স্মৃতি।

১৪
দেখ্‌, আর্য সিংহাসনে,
স্বাধীন নৃপতিগণে,
স্মৃতির আলেখ্যপটে রহেছে চিত্রিত।
দেখ্‌ দেখি তপোবনে,
ঋষিরা স্বাধীন মনে,
কেমন ঈশ্বরধ্যানে রহেছে ব্যাপৃত।

১৫
কেমন স্বাধীন মনে,
গাহিছে বিহঙ্গগনে,
স্বাধীন শোভায় শোভে প্রসূননিকর।
সূর্য উঠি প্রাতঃকালে,
তাড়ায় আঁধারজালে,
কেমন স্বাধীনভাবে বিস্তারিয়া কর!

১৬
তখন কি মনে পড়ে-
ভারতী-মানস-সরে,
কেমন মধুর স্বরে বীণা ঝংকারিত!
শুনিয়ে ভারত-পাখি
গাহিত শাখায় থাকি
আকাশ পাতাল পৃথ্বী করিয়া মোহিত?

১৭
সে-সব স্মরণ করে, কাঁদ লো আবার।
“আয় রে প্রলয় ঝড়
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার!
স্বর্গমর্ত্য রসাতল হোক একাকার।

১৮
প্রভাঞ্জন ভীম-বল!
খুলে দাও, বায়ুদল!
ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাক ভারতের বেশ।
ভারতসাগর রুষি
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।

১৯
বলিতে নারিল আর প্রকৃতি-সুন্দরী।
ধ্বনিয়া আকাশভূমি,
গরজিল প্রতিধ্বনি,
কাঁপিয়া উঠিল বেগে ক্ষুব্ধ হিমগিরি।

২০
জাহ্নবী উন্মত্তপারা,
নির্ঝর চঞ্চল ধারা,
বহিল প্রচন্ডবেগে ভেদিয়া প্রস্তর।
মানস সরস-পরে,
পদ্ম কাঁপে থরে থরে
দুলিল প্রকৃতি সতী আসন-উপর।

২১
সুচঞ্চল সমীরণে,
উড়াইল মেঘগণে,
সুতীব্র রবির ছটা হল বিকীরিত
আবার প্রকৃতি সতী আরম্ভিল গীত।

২২
“দেখিয়াছি তোর আমি সেই এক বেশ,
অজ্ঞাত আছিল যবে মানবনয়নে।
নিবিড় অরণ্য ছিল এ বিস্তৃত দেশ,
বিজন ছায়ায় নিদ্রা যেত পশুগণে,
কুমারী অবস্থা তোর সে কি পড়ে মনে?
সম্পদ বিপদ সুখ,
হরষ বিষাদ দুখ,কিছুই না জানিতিস্‌ সে কি পড়ে মনে?
সে-এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ,
যখন মানবগণ,
করে নাই নিরীক্ষণ,
তোর সেই সুদুর্গম অরণ্যপ্রদেশ।
না বিতরি গন্ধ হায়,
মানবের নাসিকায়
বিজনে অরণ্যফুল, যাইত শুকায়ে
তপনকিরণ-তপ্ত মধ্যাহ্নের বায়ে।
সে এক সুখের দিন হয়ে গেছে শেষ।

২৩
সেইরূপ রহিল না কেন চিরকাল!
না দেখি মনুষ্যমুখ
না জানিয়া দুঃখসুখ
না করিয়া অনুভব মান অপমান।
অজ্ঞান শিশুর মত
আনন্দে দিবস যেত,
সংসারের গোলমালে থাকিয়া অজ্ঞান।
তা হলে তো ঘটিত না এ-সব জঞ্জাল!
সেইরূপ রহিলি না কেন চিরকাল?
সৌভাগ্যে হানিল বাজ,
তা হলে তো তোরে আজ
অনাথা ভিখারীবেশে কাঁদিতে হত না?
পদাঘাতে উপহাসে,
তা হলে তো কারাবাসে
সহিতে হত না শেষে এ ঘোর যাতনা।

২৪
অরণ্যেতে নিরিবিলি,
সে যে তুই ভালো ছিলি,
কী কুক্ষণে করিলি রে সুখের কামনা।
দেখি মরীচিকা হায়!
আনন্দে বিহ্বলপ্রায়!
না জানি নৈরাশ্য শেষে করিবে তাড়না।

২৫
আইল হিন্দুরা শেষে,
তোর এ বিজন দেশে,
নগরেতে পরিণত হল তোর বন।
হরিষে প্রফুল্লমুখে,
হাসিলি সরলা! সুখে,
আশার দর্পণে মুখ দেখিলি আপন।

২৬
ঋষিগণ সমস্বরে
অই সামগান করে
চমকি উঠিছে আহা! হিমালয় গিরি।
ওদিকে ধনুর ধ্বনি,
কাঁপায় অরণ্যভূমি
নিদ্রাগত মৃগগণে চমকিত করি।
সরস্বতী-নদীকূলে,
কবিরা হৃদয় খুলে
গাইছে হরষে আহা সুমধুর গীত।
বীণাপাণি কুতূহলে,
মানসের শতদলে
গাহেন সরসী বারি করি উথলিত।

২৭
সেই এক অভিনব
মধুর সৌন্দর্য তব,
আজিও অঙ্কিত তাহা রয়েছে মানসে।
আঁধার সাগরতলে
একটি রতন জ্বলে
একটি নক্ষত্র শোভে মেঘান্ধ আকাশে।
সুবিস্তৃত অন্ধকূপে,
একটি প্রদীপ-রূপে
জ্বলিতিস তুই আহা,
নাহি পড়ে মনে?
কে নিভালে সেই ভাতি ভারতে আঁধার রাতি
হাতড়ি বেড়ায় আজি সেই হিন্দুগণে।
সেই অমানিশা তোর,
আর কি হবে না ভোর
কাঁদিবি কি চিরকাল ঘোর অন্ধকূপে।
অনন্ত কালের মতো,
সুখসূর্য অস্তগত,
ভাগ্য কি অনন্ত কাল রবে এই রূপে।
তোর ভাগ্যচক্র শেষে,
থামিল কি হেথা এসে,
বিধাতার নিয়মের করি ব্যভিচার
আয় রে প্রলয় ঝড়,
গিরিশৃঙ্গ চূর্ণ কর
ধূর্জটি! সংহার-শিঙ্গা বাজাও তোমার।
প্রভঞ্জন ভীমবল,
খুলে দেও বায়ুদল,
ছিন্ন ভিন্ন করে দিক ভারতের বেশ।
ভারতসাগর রুষি,
উগরো বালুকারাশি
মরুভূমি হয়ে যাক সমস্ত প্রদেশ।

প্রতিবিম্ব, বৈশাখ, ১২৮২

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *