প্যালেস্টাইন
০১.
গোড়ার দিকে ইহুদি-আরবে প্যালেস্টাইন সম্পর্কে তর্ক উপস্থিত হইলেই প্রথম প্রশ্ন এই উঠিত, সে দেশটা কাহার। ইহুদিরা বলিত, এই পবিত্র দেশ আমাদের পিতৃভূমি, মুসা (মোজেস) আমাদিগকে এই দেশে পথ দেখাইয়া আনেন; আমাদের গর্বস্থল রাজা সুলেমন (সলমন), দায়ূদ (ডেভিড) এই দেশে রাজত্ব করিয়াছেন, আমাদের প্রপিতামহ ইব্রাহীমের (আব্রাহামের) কবর এই মাটিতে। এই দেশ আমাদের পুণ্যভূমি, এখন এ দেশকে আমাদের কর্মভূমিতে পরিণত করিতে চাহি। (সত্যেন দত্তের তীর্থসলিলে রাজা সুলেমন ও দায়ুদের গীতি দ্রষ্টব্য)।
উত্তরে আরব বলে, তোমাদের মতো আমরাও সেমিটি, যেসব মহাপুরুষদের নাম করিলে তাহারা আমাদেরও পূর্বপুরুষ। তাঁহাদের গোর আমাদের তীর্থস্থল-দরগাহ। ইহাদের মহৎ কার্যকলাপ কোরানে বর্ণিত হইয়াছে। উপরন্তু জেরুজালেম (বয়ত উল-মুদ্দস পবিত্রালয়) আমাদিগের কাছে মক্কার পরেই সম্মানিত। কিন্তু এসব ধর্ম-সম্বন্ধীয় হার্দিক আলোচনা উপস্থিত স্থগিত রাখো। আসল কথাটা এই, তোমাদের স্বাধীনতা লোপ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই (খ্রিস্টের বহুপূর্বে) তোমরা এ দেশ ত্যাগ করিতে আরম্ভ কর; খ্রিস্টের পর তোমাদের অধিকাংশ জাতভাই খ্রিস্টান হইয়া যায়– তাহারা আজ আমাদের দলে, পরবর্তী যুগে তাহাদিগের অধিকাংশ আবার মুসলমান হইয়া যায় এবং সর্বশেষে ক্রুসেডের আমলে যখন যুদ্ধ, অরাজকতা, ও অনাসৃষ্টির ফলে দেশটা উচ্ছন্ন গেল, তখন তোমরা সকলেই পোড়া দেশকে ছাড়িয়া কারবারে পয়সা করিবার জন্য পৃথিবীর সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িলে। আমরা এই দেশের মাটিকে ভালোবাসিতাম সেই মাটিকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া আটশত বৎসর কাটাইলাম, এখন পয়সার জোর হইয়াছে বলিয়া আমাদিগকে ভিটা-ছাড়া করিতে চাও? তোমাদের বেশভূষা বিজাতীয়, তোমাদের আচার-ব্যবহার এদেশের প্রাচীন ইহুদি পন্থানুযায়ী নহে (অর্থাৎ যে কয়টি ইহুদি দুর্দিনে। এদেশ ত্যাগ করিয়া যান নাই, তাঁহাদের আচার-ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের আজ মিলে বেশি), তোমরা বার্লিন-প্যারিসের নৈতিক চরিত্র ও দুষ্ট রোগ সঙ্গে আনিয়াছ, আর সর্বশেষ কথা, আমাদের দুশমন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে তোমরা বন্ধুত্ব করিয়াছ।
এই তর্কাতর্কি আমি ছয় মাসকাল উদয়াস্ত শুনিয়াছি–লিখিতে গেলে একখানা ছোটখাটো বই লেখা যায়। কিন্তু এসব তর্ক আজকাল কম হয়।
১৪-১৮ যুদ্ধের সময় ইংরেজ প্যালেস্টাইনের আরবকে কথা দেয় তখন যেখানে ইহুদির সংখ্যা নগণ্য যে, তোমরা যদি তুর্কির হইয়া না লড়ো তবে যুদ্ধের পর তোমাদিগকে স্বরাজ (সেলফ ডিটারমিনেশন) দিব। সঙ্গে সঙ্গে আরবদের অজানাতে, প্রধানত মার্কিন ইহুদিদিগকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইল যে, তাহারা যদি কাইজারকে অর্থসাহায্য করা বন্ধ করিয়া সেই অর্থ ইংরেজকে দেয় ও বিশ্ব-ইহুদি (ওয়ার্লড জিউয়ারি) অন্যান্য সাহায্য প্রদান করে, তবে যুদ্ধের পর ইহুদিদিগকে প্যালেস্টাইনে ন্যাশনাল হোম নির্মাণ করিতে দেওয়া হইবে। (ন্যাশনাল হোম কথাটার বাঙলা আর করিলাম না, ইংরেজিতেই তাহার অর্থ কী, সে লইয়া বাগবিতণ্ডার অন্ত নাই। নিরক্ষর আরব ইংরেজির এক বর্ণ বোঝে না, কিন্তু ন্যাশনাল হোম যে ন্যাশনাল স্টেট নয় সে কথা বুঝাইতে তাহার তৎপরতার অন্ত নাই। বারে বারে আরবি কথাতে শুধু চারিটি ইংরেজি শব্দ শুনিতে পাওয়া যায়, ন্যাশনাল হোম আর ন্যাশনাল স্টেটআমি। যদি ন্যাশনাল হোমের অনুবাদ জাতীয় ভবন বা জাতীয় সদন দিয়া করি, তবে ইহুদিরা আমাকে খুন করবে, আরবরা আমাকে খয়রাতি দিবে।)
যুদ্ধের পর যখন ন্যাশনাল হোমের খবরটা বাহির হইল, তখন আরবরা হুঙ্কার দিয়া উঠিল। অতিকষ্টে তাহাদিগকে বুঝান হইল যে, এ বস্তুটি অত্যন্ত নিরীহ তেঁড়া সাপ। জনকয়েক ইহুদি প্যালেস্টাইনে বসবাস করিবার জন্য আসিতেছে, বিস্তর পয়সা সঙ্গে আনিবে, নিজের খাইবে পরিবে, ধর্মচর্চা করিবে, কলচর করিবে, আরবের আপত্তি করিবার কী আছে? ২৬ সেপ্টেম্বরে (৪৫) প্রকাশিত বাইৎসমান সাহেবের এই মর্মে বুলি যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে জুইশ মেজরিটি ও জুইশ স্টেট চায়। সেকথা তখনকার দিনের ইংরেজ সরকার মানেন নাই- লেবার পার্টি লাকি প্রভৃতি ইহুদিদের প্রতাপে আজ মানেন।
সে যাহাই হউক, যুদ্ধাবসানে যখন এইসব আলোচনা হইতেছে, তখন হঠাৎ দেখা গেল যে, যেসব ইংরেজ সৈন্য আরবদের সহায়তায়, লরেন্সের ধূর্তামিতে, জেরুজালেমে একটি বুলেটমাত্র খরচ না করিয়া প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা সেখানে থাকিবার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করিতেছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে ইহা এক স্মরণীয় ও অভিনব বস্তু। ১৯১৪ সালের পূর্বে কোনও রাজা গায়ের জোরে বা অন্য কোনও কায়দায় কোনও দেশ জয় করিলে সে-রাজা দুনিয়ার লোককে ডাকিয়া বলিতেন না যে, তোমরা সকলে আমাকে আশীর্বাদ করিয়া রাজ্যটি সোনার থালাতে করিয়া তুলিয়া দাও, আমি গ্রহণ করিয়া তোমাদিগকে কৃতার্থম্মন্য করিব। এ কায়দাটা আবিষ্কার করিলেন ইংরেজ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীরা। লিগ অব নেশনস গড়িয়া তামাম দুনিয়ার দেশপতিদের ডাকিয়া বলা হইল যে, তাহারা যেন ইংরেজকে রাজনৈতিক পূতজলে বাপ্তিস্ম করিয়া প্যালেস্টাইন, ইরাক, মিশরের মেনডেটরি প্রভু বা অছি নিযুক্ত করে। বিশ্বজন যেন স্বস্তিবচন ঝাড়িয়া বলে, তুমি ন্যায়ত ধৰ্মত আইনত দেশটা পাইলে। পৃথিবীর নৈতিক ইতিহাসের ক্রমবিকাশ লইয়া যাহারা নাড়াচাড়া করেন, তাহারা যেন এই পর্যায়ে নতুন পরিচ্ছেদ পাড়েন।
অছি কথাটি শুনিলে আমাদের মতো প্রাচীনপন্থিদের ধর্মপিতা সমাসটি মনে পড়ে। তুর্কি ভাষায় অছি অর্থ জ্যেষ্ঠভ্রাতা। নাবালক শিশুর জন্য যখন অছি নিযুক্ত করা হয় তখন এই কথা অছিকে মানিয়া লইতে হয় যে, সে নিঃস্বার্থভাবে শিশুর তত্ত্বাবধান করিবে। আইনকানুন ভালো জানি না, তবে শুনিয়াছি যে, অছি নিয়োগের পূর্বে দেখিতে হয় যে, ওই শিশুর স্বার্থে যেন অছির লোভ না থাকে– থাকিলে অমিত্ব রদ-বাতিল। লিগের কর্তারা স্বকায়দায় এই প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করিতে বিস্মৃত হইলেন। ইংরেজ তখন বলেন নাই। কিন্তু হালে পরিষ্কার বুঝাইয়া দিয়াছেন যে, প্যালেস্টাইন আইসা পাক আর রহিম নিক, সেখানে ইংরেজ স্বার্থ বরাবর অচল-অটুট থাকিবে– সেখানে বিমানঘাঁটি, পল্টন-গোয়াল থাকিবেই। লিগ-কর্তারা শুধু তম্বি করিয়া অছিদের বলিয়াছিলেন যে, তাহাদিগকে কয়েক বৎসর অন্তর অন্তর শাসিত দেশের কার্য-প্রতিবেদন পেশ করিতে হইবে। সে ব্যঙ্গ-নাট্যের কথা আরেক দিন স্মরণ করাইয়া দিবেন। আসল কথা, বিশেষ লক্ষমান প্রাণীকে মোড়শোপচারে কদলীবৃক্ষের অছি নিযুক্ত করা হইল।
সেই অছিত্বের আওতায় তার পর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে ইহুদি বুলবুলির পাল আসিয়া আরবের গমক্ষেতে পড়িল। কিন্তু ছেলে ঘুমাইল না, পাড়া জুড়াইল না। আরবরা এক হাতে ঠেকায় ইংরেজকে, আরেক হাতে মারে ইহুদিকে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন ঠেকাইতে পারিল না। খাজনা দেব কিসে? শ্মশান হইতে মশান হইতে ঝোড়ো হাওয়ায় হা হা করিয়া তখন উত্তর আসিল, আবু দিয়া, ইজ্জত দিয়া, ইমান দিয়া, বুকের রক্ত দিয়া। (কর্তার ভূত, লিপিকা, রবীন্দ্রনাথ)
কিন্তু সে সমস্যা অর্থনৈতিক। বুলবুলিরা কি সঙ্গে কিছুই আনে নাই? তাহার আলোচনা আরেকদিন হইবে।
.
০২.
ইহুদিদের পক্ষে যাহারা যুক্তিতর্ক উপস্থিত করেন, তাঁহাদের প্রধান সাফাই এই যে, ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে আসিবার সময় প্রচুর অর্থ সঙ্গে আনিয়াছে ও এখনও মাসে মাসে সমস্ত পৃথিবীর ইহুদি ধনপতিরা সে দেশে টাকা-পয়সা ও অন্যান্য নানা তৈজসপত্র পাঠাইতেছেন।
কথাটা সম্পূর্ণ সত্য। কিন্তু তলাইয়া দেখিবার মতো। উপনিষদের ঋষি বলেন, হিরন্ময় পাত্র মধ্যে সত্য লুক্কায়িত আছেন। অধিকাংশ লোক সেই পাত্র দেখিয়াই আনন্দে আত্মহারা হয়, বলে না, হে পূষণ, পাত্রটি উন্মোচন করিয়া দেখাও ভিতরে কী আছে।
শ্রীহট্ট বা উত্তর আসামের ভিতর দিয়া যাইবার সময় দেখিবেন, দুই দিকে ঘন সবুজ টিলার গায়ে গায়ে সারি সারি, কাটাছটা, সযত্নে বর্ধিত চায়ের গাছ। মাঝে মাঝে সরস সতেজ গোলমোহরের গাছ, শ্যামাঙ্গী কুলি মেয়েরা কাজ করিতেছে, দূরে ছবির মতো সুন্দর কলকারখানা, ঝকঝকে তকতকে সায়েবদের বাঙলো, ক্লব হৌস, গলফ লিনক। এমনকি দূর হইতে কুলিদের ব্যারাকগুলি পর্যন্ত সুন্দর দেখায়।
ইংরেজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়া বলে, দেখ, দেশের ধনদৌলত কীরকম বাড়াইয়াছি।
ইহুদিরা যে অর্থ আনিল, তাহা দিয়া চাষের অনুপযুক্ত কোনও কোনও জলাভূমির জলকর্দম নিকাশ করিয়া সোনা ফলাইয়াছে। কিন্তু আসামের চা-বাগিচায় ও এইসব স্বর্ণভূমিতে পার্থক্য এই যে, যদি আসামের চা-বাগানে কুলিরা এক বেলা খাইবার মতো পয়সা রোজগার করিতে পারে, প্যালেস্টাইনের স্বর্ণভূমিতে আরব চাষা-মজুরকে কাজ করিতে দেওয়া হয় না। ট্রাক্টর পাঠাইয়াছে মার্কিন ইহুদিরা, চালাইতেছে জর্মন ইহুদিরা, ফসল কাটিতেছে পোল ইহুদিরা, বাজারে লইয়া যাইতেছে অস্ট্রিয়ান ইহুদিরা। আরব অপাঙক্তেয়। কিন্তু তাহারা আপত্তি-ওজর জানায় না, বলে, নিষ্কর্মা জমি যদি কাজে লাগাইতে পারো, তাহলে আমার আপত্তি কী?
কিন্তু মার খায় যখন ইহুদি সেই ফসল, সেই জাফা কমলালেবু বাজারে ছাড়ে। ইহুদি ক্ষেতখামার করিয়াছে, জাতভাই মার্কিন ধনপতিদের অফুরন্ত পয়সায়। জায়োনিস্টদের চাপে ও কিছুটা স্বেচ্ছায় তাহারা আরও পঞ্চাশ বৎসর ধরিয়া পুঁজি ঢালিতে প্রস্তুত। সে টাকার প্রতি প্যালেস্টাইনি ইহুদির বিশেষ দয়ামায়া নাই টাকাটা তো দিতেছেন গৌরী সেন। কাজেই ফসল নেবু বিক্রয় করিয়া যাহাই উঠে তাহাই তাহার লাভ। প্রচুর অর্থ ব্যয় করিয়া যে জমি প্রস্তুত করা হইয়াছে, ফ্যাশেনবল ইহুদি মজুরকে বিস্তর অর্থ দিয়া যে ফসল ফলানো হইয়াছে, তাহা দিয়া লাভ করিতে হইলে বাজারের দর অপেক্ষা তাহার দর হইবে চারিগুণ, ছয়গুণ বেশি। সে দর তো ইহুদি কখনও পাইবে না, কাজেই বাজার দর অপেক্ষা আরও দুই পয়সা সস্তা করিয়া আরব চাষিকে ঘায়েল করিতে ক্ষতি কী?
আপাতদৃষ্টিতে মনে হইবে অর্থের অপব্যয়, কিন্তু দূরদৃষ্টি দ্বারা জায়োনিস্ট দল হৃদয়ঙ্গম করিয়াছে, ইহাই প্রশস্ততম পন্থা। বাজারে যদি আরব চাষিকে ক্রমাগত বৎসরের পর বৎসর ফসল কম দরে বেচিয়া কাবু করা যায় তবে সে আর জমি আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিবে কয়দিন? পেট ভরিতে হইবে তো? বাবু যখন মনস্থির করিয়াছেন জমিটা লইবেনই, তখন উপেন ঘ্যান ঘ্যান করিয়া বাবুর পয়সা নষ্ট করেন ক্যান!
নিরুপায় হইয়া আরব জলের দরে ইহুদিকে জমি বেচিয়া আণ্ডাবাচ্চাসহ জেরুজালেম শহরে উপস্থিত হয়– দুর্ভিক্ষপীড়িত নরনারী যেমন কলিকাতায় উপস্থিত হইয়াছিল–ভাবে সেখানে গেলে রোজগারের ধান্দা জুটিবে। সেখানেও সেই অবস্থা। মার্কিন পুঁজির জোরে ইহুদি দোকানিরা আরব ব্যবসায়ীকে ঘায়েল করিতেছে আরও অল্পায়াসে, আরও কম খরচায়।
ইহুদিরা বলে, আরব চাষিরা জমি বেচে স্বেচ্ছায়, আপন খুশিতে, জমির বাজারদর কী তাহার তত্ত্ব-তাবাশ, তদ্বির-তদন্ত করিয়া। সত্যই তো আমরাও পাট বেচি স্বেচ্ছায় বাজারদর জানিয়া শুনিয়া, আমরাও ৩২-৩৩ সালে অধিকাংশ স্থলে ধান বেচিয়াছিলাম বহাল তবিয়তে, খুশমর্জিতে। দুনিয়ার তাবৎ পাট আমাদের, তবু পাটের চাষি না খাইয়া মরে! ৩২-৩৩ সালে আঠারো আনা ফসল ফলাইয়াও চাষি না খাইয়া মরিল!
আরেক বিপদ, প্যালেস্টাইনে প্রজাস্বত্ব আইন নাই। আরব, তথা তুর্কি জমিদার মহাপ্রভুরা কাইরো, প্যারিসের বিলাস-বাসরের সর্দার। তালুকের পর তালুক বিক্রয় করিতেছেন পরমানন্দে, দুই পয়সা বেশি পাইয়া। যে জমিদার দেশে থাকে না, গরিব চাষার বেদনা সে বুঝিবে কী করিয়া, দরদ আসিবে কোথা হইতে? তার পর আরবদিগকে পুলিশের জোরে ভিটাজমি-ছাড়া করা হয়, যে মাটি তাহারা চাষ করিয়াছে বারো শত বৎসর ধরিয়া।
এতদ্বেশীয় সদাশয় সরকারও ব্যাপকভাবে এমন কর্মটি করেন নাই। তবু সাঁওতাল প্রজা বিদ্রোহের করুণ কাহিনী যাহারা জানেন তাহাদের কাছে অবস্থাটা সরলই প্রতীয়মান হইবে।
তাই আরব লিগ, পিপলস্ পার্টি সকলেই একবাক্যে কাতর ক্রন্দন অনুনয়-বিনয় করিতেছে, আইন করা হউক ইহুদি যেন আরবের জমি কিনিতে না পারে। সর্বশেষে ভয় দেখাইয়াছে।
ইহুদিরা প্যালেস্টাইনে এক অদ্ভুত অভিনব অর্থনৈতিক করর্দো সানিতের (আরব ঠেকাইয়া রাখিবার বেড়া) সৃষ্টি করিয়াছে। আরব মজুরকে ডাকে নিতান্ত কালেভদ্রে অত্যন্ত মুশকিলে পড়িলে, জিনিসপত্র কিনে ছয়গুণ মূল্যে জাতিভাইয়ের কাছ থেকে, বেচে আরবকে, আরবের হোটেলে যায় না, আরব কোম্পানির বাসে চড়ে না, সমস্ত টেল আভিভ শহরে (প্যালেস্টাইনের ইহুদিদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় শহর) দশটি আরব খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অর্থাৎ বিদেশ হইতে যে লক্ষ লক্ষ পৌন্ড ডলার মাসে মাসে অকৃপণভাবে প্যালেস্টাইনে ঢুকিতেছে, সে অর্থ ইহুদিদিগের ভিতরই চক্রবৎ পরিবর্তন্তে। যেটুকু বাহিরে যায়, সে আরবের জমি কিনিতে ও গলা-কাটা কারবারে আরবের ব্যবসা বাণিজ্য নষ্ট করিতে। সেই টাকাটাও সুচ হইয়া ঢোকে, মুষল হইয়া বাহির হয়। আরবরা প্রায়ই ইহুদিদিগকে বলে, বিদেশের পুঁজি না লইয়া আসো না একবার পাল্লা দিতে। আমরা যেরকম গরিব অবস্থায় সস্তায় কমলালেবু ফলাইতে পারি, তোমরা বাবুরা পারিবে? শুধু রুটি আর পেঁয়াজ খাইয়া কতদিন বাঁচিবে?
অথচ যে অজস্র অর্থ আসিতেছে তাহা দিয়া ব্যাপকভাবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান করিবার উপায় নাই- কাঁচামালের অভাবে। ভারতবর্ষে কাঁচামাল আছে, তাহার বহু পুঁজি লন্ডন, নিউইয়র্কে পড়িয়া আছে, তবুও দুর্বোধ্য কারণে আমরা কারখানা-কারবার করিতে পারিতেছি না। ঠিক সেই দুর্বোধ্য কারণেই ইহুদিদিগকে প্যালেস্টাইনে ব্যাপকভাবে কলকারখানা করিতে যাহারা দিতে চায় না, মধ্যপ্রাচ্যে আজ তাহাদেরই প্রতাপ।
প্যালেস্টাইনে ধন বাড়িয়াছে, কিন্তু সে-ধন আরবের শ্যাম নহে, তাহার শূল।
বারান্তরে অদ্যকার পরিস্থিতি লইয়া আলোচনা করিব।