প্যারিস

প্যারিস

প্রাতরাশ খেতে খেতে থিয়ো জিজ্ঞাসা করল—তাহলে আমার শেষ চিঠিটা পাওনি?

মনে তো হয় না, ভিনসেন্ট বললে—কী লিখেছিলে সে-চিঠিতে?

বাঃ, মস্ত সুখবর যে! গুপিলসের চাকরিতে আমার উন্নতি হয়েছে।

তা-ই নাকি? আচ্ছা তো তুমি থিয়ো? কাল এ সম্বন্ধে একটা কথাও তুমি বলনি!

যেরকম উত্তেজিত ছিলে তুমি কাল, বলবার ফুরসত পেলাম কোথায়? জান, মোমার্তে বুলেভার্দের দোকানটার ম্যানেজার হয়েছি আমি।

অ্যাঁ! এ যে দারুণ খবর! আলাদা একটা আর্ট গ্যালারি এখন তোমার!

আমার বললে বেশি কথা বলা হবে। কেননা গুপিলসের পলিসি আমাকে মেনে চলতেই হবে। তবে কিছুটা স্বাধীনতা রইল আমার। ইম্প্রেশনিস্টদের ছবি কিছু কিছু আমি রাখতে পারব। যেমন ধরো, মনে, ডেগা, পিসারো আর মানে…

নামই শুনিনি আমি এঁদের!

বেশ তো, চলো তাহলে আমার গ্যালারিতে। ছবি দেখবে এঁদের। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। কফি দেব আর-একটু?

হাত থেকে কফির শূন্য পেয়ালা নামিয়ে ভিনসেন্ট বললে—যা-ই বলো থিয়ো, আবার এক টেবিলে বসে তোমার সঙ্গে খাচ্ছি, ভারি ভালো লাগছে।

থিয়ো বললে—আমি তো কতদিন থেকে বলে আসছি প্যারিসে তোমাকে আসতেই হবে। তবে জুন মাসটা পার করে এলেই ভালো হতো। এত ছোটো জায়গায় কাজের তোমার খুব অসুবিধে হবে। জুন মাসের পর আমি রু লেপিকে উঠে যাব। ফ্ল্যাট ঠিক করাই আছে সেখানে, বড়ো বড়ো তিনটে ঘর।

থিয়োর এই ফ্ল্যাটটা বলতে একখানা ঘর আর আলাদা একটা রান্নাঘর। সঙ্গে বাজে জিনিসপত্র রাখার একটা কুঠরি। সুন্দর আসবাবপত্রে ঘরটি সাজানো, কিন্তু হাঁটাচলার জায়গাটুকু বিরল।

ভিনসেন্ট বললে—এর মধ্যে আবার যদি আমাকে ইজেল পাততে হয়, তাহলে তোমার এমন চমৎকার আসবাবগুলো যাবে। কিছু-কিছুর ঠাঁই অবশ্য হবে নীচের উঠোনে।

সত্যি, এগুলোর বড়ো ভিড়। কিন্তু এত সস্তায় পেলাম, লোভ সামলাতে পারিনি। চলো, নতুন ফ্ল্যাটে গেলে মানাবে ভালো।

হ্যাঁ, সে তো বটেই।

এবার তাড়া দিল থিয়ো—ওঠো, তাড়াতাড়ি চলো এখন। প্যারিসের ভোর বেলাকার সুরভিই যদি নাকে না নিলে, তাহলে এখানে এসে করলে কী?

ভারী কালো কোটটা গায়ে চড়িয়ে নিল থিয়ো, ঠিক গলার নীচে বুকের ওপর ফুটে রইল কড়া ইস্ত্রি করা ধবধবে সাদা বো-টা। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে কোঁকড়া চুলে ক-বার পরিপাটি করে বুরুশ চালিয়ে আর গোঁফটা একবার পাকিয়ে নিয়ে মাথায় চড়াল কালো সিল্কের টুপি, হাতে দস্তানা আর রুপো-বাঁধানো ছড়ি।

কী হল? অ্যাঁ, এই নাকি তুমি তৈরি? সর্বনাশ, এ-জামাকাপড় পরে প্যারিসের রাস্তায় হাঁটাচলা করলে তোমাকে যে পুলিশে ধরবে!

ভিনসেন্ট ফ্যালফেলে চোখে নিজেকে দেখে নিল দু-বার। তারপর বললে—কেন? হয়েছেটা কী? এই জামাকাপড় পরে আমি পুরো দুটো বছর কাটালাম, একটা কথাও কেউ তো বলেনি কোনোদিন!

বলেনি? হো-হো করে হেসে উঠল থিয়ো—তা বেশ, চলো। প্যারিসের যারা বাসিন্দে, সবকিছু দেখবার অভ্যেস তাদের আছে। বিকেলে গ্যালারি বন্ধ হবার পর তোমার নতুন জামাকাপড় কেনবার ব্যবস্থা করা যাবে।

ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেট পার হয়ে তারা পড়ল রু লাভাল রাস্তায়। বেশ চওড়া রাস্তা, দু-ধারে নানা রকমের বড়ো বড়ো দোকান, কোনটা ওষুধপত্রের, কোনটা ছবি বাঁধাইয়ের, কোনটা মনোহারী।

থিয়ো হাত তুলে দেখাল—আমাদের বাড়ির মাথার মূর্তি তিনটে দেখছ?

বুক পর্যন্ত তিনটি নারীমূর্তি, প্লাস্টার অব প্যারিসের। প্রথমটির নীচে লেখা স্থাপত্য, দ্বিতীয়টির নীচে ভাস্কর্য, তৃতীয়টির নীচে অঙ্কনকলা।

ভিনসেন্ট বললে—বাঃ! কিন্তু অঙ্কনকলা মেয়েটি অমন কুৎসিত দেখতে কেন?

তা বাড়িওয়ালাই জানে। কিন্তু এটা তো বুঝতে পারছ যে বেশ পাকা জায়গাতেই এসে উঠেছ!

সে আর বলতে! শিল্পলক্ষ্মীরা তো সব মাথায় চড়ে বসে আছেন দেখছি!

মনোরম আঁকাবাঁকা রাস্তাটি রু মোমার্ত। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠেছে আভেন্যু ক্লিচি পর্যন্ত, তারপর গড়িয়ে গিয়েছে একেবারে শহরের কেন্দ্রস্থলে। রাস্তাভরতি জ্বলজ্বলে রোদ, ধারে ধারে কাফেতে বসে লোকে প্রাতরাশ খাচ্ছে, মাংস, সবজি আর পনিরের দোকানগুলোর পাল্লা খুলছে। সত্যি, সকাল বেলাকার গন্ধটি চমৎকার।

সাধারণ লোকের পাড়া, সারি সারি ছোটো ছোটো দোকানপাট। কারিগররা চলেছে দিনের কাজে রাস্তার মাঝখান দিয়ে ভিড় করে। গৃহিণীরা বেরিয়েছে বাজার করতে।

লম্বা একটা নিশ্বাস নিল ভিনসেন্ট—প্যারিস, শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছোলাম!

থিয়ো বললে—হ্যাঁ, এই প্যারিস, সারা ইয়োরোপের রাজধানী, শিল্পীর স্বর্গ।

পাহাড়ের গায়ে চড়াই-উতরাইয়ের রাস্তা বেয়ে প্যারিসের জীবনস্রোত বয়ে চলেছে, ভিনসেন্ট যেন ভূষিত কণ্ঠ ভরে পান করছে এই তরঙ্গ। লাল কালো পোশাকের পুলিশ, শৌখিন পোশাক পরা তরুণ চাকুরে আর ব্যাবসাদার, বড়ো বড়ো রুটি বগলদাবা-করা মোটাসোটা গিন্নি, নরম চটি পায়ে রাত্রি-জাগা ঢুলুঢুলু চোখে কয়েকটি তরুণী… অসংখ্য দোকান আর পানশালা আর ঠেলাগাড়ি। পাহাড়ের উতরাই বেয়ে রু মোমার্ত এসে পৌঁছোল প্লেস চাতুদুনে। ছ-রাস্তার একটা মোড়। মোড় পার হয়েই পুরোনো একটি গির্জে—নতারদাম দ্য লোরেত। গির্জের দরজায় খোদাই করে লেখা ফরাসি বিপ্লবের বিখ্যাত বাণী—সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা।

ভিনসেন্ট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেখাটা পড়ল। জিজ্ঞাসা করলে থিয়োকে—এ–বাণীর কোনো দাম আছে আজকাল? বিশ্বাস করে কেউ?

করে বই কী। তৃতীয় রিপাবলিক টিকে যাবে বলেই মনে হয়। রয়ালিস্টরা সব ফৌত হয়ে গেছে, সোশ্যালিস্টদের শক্তি বাড়ছে। এমিল জোলা আমাকে সে-দিন বলেছিল, এবার যে-বিপ্লব হবে তা আর রাজারাজড়ার বিরুদ্ধে নয়, পুঁজিবাদীদের বিরুদ্ধে।

জোলা! তুমি তাকে চেন? আলাপ আছে তোমার সঙ্গে?

পল সেজান আমার সঙ্গে জোলার আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। সপ্তাহে একদিন করে আমরা একসঙ্গে বসি কাফে ৰাতিনোলসে। এবার যেদিন যার তোমাকে নিয়ে যাব সঙ্গে।

প্লেস চাতুদুন পার হবার পর থেকেই রু মোমার্ত-এর মধ্যবিত্ত চেহারাটা ঘুচল, দেখা দিল বনেদিয়ানা। বড়ো বড়ো দোকান, উঁচু উঁচু বাড়ি, জমকালো কাফে আর হোটেল। লোকজনের গায়ের পোশাকও অনেক দামি, ঝকঝকে, গাড়িরও ইয়ত্তা নেই।

জোরে পা চালাল দু-ভাই। হাঁটতে হাঁটতে থিয়ো বললে—বাড়িতে যখন তোমার কাজ করবার সুবিধে হবে না তখন মনে হয় করম্যানের স্টুডিয়োতে কাজ করাই তোমার ভালো।

কেমন জায়গাটা?

শিল্পের গুরুমশাই তো করম্যান, অতএব খুব রক্ষণশীল। তবে নিজের মতো একলা একলা যদি কাজ করে যেতে চাও তাহলে তোমাকে ঘাঁটাবে না।

কিন্তু খরচ তো লাগবে?

থিয়ো হাতের ছড়িটা দিয়ে ভিনসেন্টের ঊরুতে একটা টোকা মারল, বললে—বলিনি আমার চাকরিতে উন্নতি হয়েছে? জোলার মতে, আসছে বিপ্লবে যেসব লোক গিলোটিনে যাবে, আমি এখন তাদেরই একজন।

শেষ পর্যন্ত রু মোমার্ত এসে মিশল মোমার্ত বুলেভার্দে। বিরাট রাজবÁ, মস্ত মস্ত দোকান, লম্বা লম্বা গাড়িবারান্দা। কয়েক পা এগিয়েই ইতালিয়ান বুলেভার্দ আর তার পরেই রাজধানীর সেরা রাস্তা প্লেস দ্য লা-অপেরা। চারদিক ফাঁকা, এখনও ঘুমিয়ে আছে রাজকীয় এলাকা। দোকানগুলোর মধ্যে মধ্যে কেরানিরা দিনের কাজের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। জ্বলজ্বলে রৌদ্রে সামান্য শীতের মেজাজি আমেজ।

গুপিল গ্যালারির যে-শাখাটির থিয়ো ম্যানেজার তার নম্বর ১৯, রু মোমার্তের ঠিক এই মোড়ে, ডানদিকে একখানা বাড়ির পরেই।

ভিনসেন্ট আর থিয়ো রাস্তা পার হয়ে গ্যালারির দরজায় এসে পৌঁছোল।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাজগোজ-পরা কেরানিরা উঠে দাঁড়িয়ে সশ্রদ্ধভাবে থিয়োকে অভিবাদন করতে লাগল। ভিনসেন্টের মনে পড়ল সেও যখন এমনি কেরানি ছিল কেমন করে ঘাড় হেলিয়ে সে টারস্টিগ আর ওবাককে প্রাত্যহিক অভিবাদন জানাত। সারা দোকান জুড়ে কেমন একটি যেন গন্ধ, গন্ধটা আভিজাত্য, ভব্যতা আর সংস্কৃতির, এই গন্ধটাকেও আবার তার মনে পড়ল। সালোঁর দেয়ালে বুর্গেরু, হেনার আর ডেলারোকের নানা পেন্টিং। প্রধান সালোঁটির ওপরে ছোট্ট একটি বারান্দা, পেছনদিকের সরু সিঁড়ি দিয়ে সেখানে ওঠা যায়।

থিয়ো চাপা হাসি হেসে বললে—যে-ছবিগুলো তোমাকে দেখাব বলে এনেছি সেগুলো ওই বারান্দায়। আগে দেখে নাও, তারপর আমার আপিসে এসো। কেমন লাগল শুনব।

চুপি চুপি হাসছ কেন থিয়ো?

হাসিটা প্রকট হয়েই পড়ল। থিয়ো বললে—দেখেই এসো না!

কোথায় এলাম! পাগলাগারদে?

ধাঁধা লেগে গেল দেখে। কোনো রকমে বারান্দার একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল ভিনসেন্ট। দু-চোখ কচলাল কিছুক্ষণ। তারপর আবার সাহস করে চোখ খুলে হাঁ করে তাকাল দেয়ালের দিকে। বারো বছর বয়েস থেকে ছবি দেখা তার অভ্যাস—বনেদি ছবি, গভীর-গম্ভীর রং, তুলির একটি রুক্ষ আঁচড় পর্যন্ত যার গায়ে খুঁজে পাওয়া যায় না, একটা রঙের সঙ্গে আর-একটা রং আস্তে আস্তে মিশে রঙে রঙে একাকার হয়ে যায়।

কিন্তু এসব কী? দেয়ালে দেয়ালে এসব যেগুলো ঝুলছে যেন দাঁত বার করে তার দিকে চেয়ে হাসছে, স্বপ্নেও সে এমনি ছবির কল্পনা করতে পারেনি! কোথায় গেল রঙের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে রং মিলিয়ে দেবার রীতি, কোথায় গেল সেই বনেদি গাম্ভীর্য! যুগের পর যুগ ধরে যে ঘন বাদামি রঙে ইয়োরোপের সব ছবি নিত্য স্নান করেছে, সেই অতি পরিচিত রংটাই-বা কোথায় গেল? যে-শিল্প ছিল চিরকাল ছায়ার আশ্রয়ে মেদুর ধূসরতায়, সেই ছায়ার আস্তরণ টুকরো টুকরো করে কে ছিঁড়ে দিল? পলাতকা সেই চিরবিষণ্ণ মেঘমায়া, তার জায়গায় মাথা তুলে হাসি ঝিলকিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সূর্যপাগল রংমাতাল সব ক্যানভাস। এরা কি ছবি? একটা ক্যানভাসে সে দেখল স্টেজের পেছনে দাঁড়ানো কয়েকটা ব্যালেনাচের মেয়ে। লজ্জা নেই ওদের! লাল সবুজ আর নীল রং আলাদা আলাদা হয়ে নির্লজ্জ স্পষ্টতায় আসর জমিয়েছে ওদের ঘিরে। লজ্জা নেই শিল্পীর। সে আবার নাম সই করেছে ক্যানভাসটার তলায়। নামটা পড়ল ভিনসেন্ট। ডেগা

নদীতীরের কয়েকটি বহির্দৃশ্য। সূর্যকরোজ্জ্বল উষ্ণ বসন্ত-আকাশের সমস্ত আলো আর রং আর প্রগল্ভতা ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি ছবির অঙ্গে অঙ্গে। শিল্পীর নাম—মনে। জ্বলন্ত প্রভাতের ছবি, সে-প্রভাতে কত সুগন্ধ কত গান, বাতাসে কত দোলা! হল্যান্ডের সারা মিউজিয়ামে যত ছবি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে পাতলা রংটি যেখানে লাগানো হয়েছে, ঠিক সেইটিই মনের সবচেয়ে গভীর রং। তুলির প্রত্যেকটি রেখা নিলাজ নগ্নতায় স্পষ্ট হয়ে ফুটে ফুটে আছে, প্রকৃতির বলিষ্ঠ নির্লজ্জ আত্মপ্রকাশের মতো। পাকা ঘন ডেলা ডেলা রং কোনো পাগল শিল্পী ছুঁড়ে মেরেছে ক্যানভাসের ওপর, মোটা চটচটে চেহারা নিয়ে তারা ফুটে ফুটে আছে!

আর-একটি ছবির সামনে দাঁড়াল ভিনসেন্ট। ছোট্ট একটি নৌকোয় একটি লোক, গায়ে পশমের শার্ট, হাতে নৌকোর দাঁড়, মুখে কেমন একটা নিবিষ্ট ভাব। পাশে চুপটি করে বসে রয়েছে তার স্ত্রী। সারা ছবিকে ঘিরে ছুটির দিনের বিকেল বেলাকার অনায়াস আলস্য। শিল্পীর নামটা পড়ল ভিনসেন্ট।

মনে? একই শিল্পী? বাঃ কী আশ্চর্য! বহির্দৃশ্যের ছবিগুলোর সঙ্গে এ-ছবিটার কোনো মিল নেই তো!

আবার নামটা দেখল। না, ভুল হয়েছে। মনে নয়, মানে। এই মানের ‘প্রান্তরে পিকনিক’ আর ‘অলিম্পিয়া’ ছবির কাহিনি সে শুনেছে। লোকে উন্মাদ হয়ে ছুরি হাতে নিয়ে এ-ছবি দুটোকে কেটে টুকরো টুকরো করতে ছুটেছিল, পুলিশ এসে ছবি দুটোকে রক্ষা করে।

কী জানি কেন, মানের আঁকা ছবি দেখতে দেখতে জোলার রচনাবলি মনে পড়ল ভিনসেন্টের। একজন চিত্রশিল্পী আর-একজন কথাসাহিত্যিক। অথচ দুজনের মধ্যে মস্ত মিল যেন রয়েছে, একই নির্ভীক অনুসন্ধিৎসা, একই সত্যনিষ্ঠা, পঙ্ক–কলঙ্কের মধ্যেও সৌন্দর্য আবিষ্কারের একই সাধনা। মানের ছবি আঁকার পদ্ধতিটা সে ভালো করে লক্ষ করতে লাগল। দেখল মৌলিক রংগুলি বলিষ্ঠ আত্মপ্রকাশে পাশাপাশি উপস্থিত, এক রং নিজেকে বিলীন করেনি অপর রঙের মধ্যে, আঁকার মধ্যে নির্বিশেষ থেকে বিশেষে যাবার ক্লান্তিকর প্রচেষ্টা নেই। সব জায়গাতেই, কি রং কি রেখা, কি আলো কি ছায়া, শুধু আভাসে পৌঁছেই থেমে গিয়েছে, চূড়ান্ত সম্পূর্ণতায় পৌঁছোবার আয়াস নেই কোথাও।

ভিনসেন্ট মনে মনে বললে—ঠিক তো, প্রকৃতি সব কথা একসঙ্গে বলে না, সব মানে একেবারে বুঝিয়ে দেয় না, শুধু আভাসটুকু দিয়েই তো তার ক্ষান্তি।

মনে পড়ল মভের কথা—একটা রেখা সম্পূর্ণ করে আঁকা, এটুকু পর্যন্ত তুমি পার না ভিনসেন্ট?

চুপ করে সে বসে রইল কিছুক্ষণ। ডুবুক, আস্তে আস্তে ডুবুক ছবিগুলো মনের মধ্যে। কী এগুলোর বৈশিষ্ট্য, কী করে চিত্রশিল্পের তার এতদিনের ধ্যানধারণায় এগুলো এমন ভয়ংকরভাবে নাড়া দিল, যে-বৈপ্লবিক নতুন ধারা এদের মধ্যে বেগবতী, তার উৎস কোথায়? হঠাৎ মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল ভিনসেন্টের, মূল তথ্যটি সে যেন আঁকড়ে ধরতে পারল। চিত্রশিল্পবিশারদ যাঁরা, তাঁদের ছবির মধ্যে আবহাওয়া নেই বাতাস নেই, কেননা আবহাওয়া যে চর্মচোখের বাইরে। তাঁদের ছবির মধ্যে স্থান আছে আর স্থির বস্তু আছে। বস্তুর স্থাণুত্ব দিয়ে স্থানের পরিসরকে ভরতি করে করে ছবিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। আলো আছে কিন্তু রৌদ্র নেই, ছায়া আছে কিন্তু নেই ছায়ার রং। কিন্তু এইসব শিল্পীরা তাদের ছবিকে মেলে ধরেছে খোলা আকাশের নীচে সূর্যের জ্বলজ্বলে আলোর তলায়, যেখানে বাতাসের এলোমেলো লীলা। এ-বাতাস জীবন্ত, উচ্ছলতায় ভরপুর। এ-আলো প্রত্যক্ষ সূর্যরশ্মির।

আলো আর বাতাস যেন কোনো একটা জীবন্ত তরল তরঙ্গ, সেই তরঙ্গের এ কী বিচিত্র রূপ! ভিনসেন্টের মনে হল—চিত্রশিল্পের এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে কেউ আর ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, কিছুতে বাধা পড়বে না এই বিপুল তরঙ্গলীলা। এ যেন এক নতুন শিল্প!

টলতে টলতে নেমে এল সিঁড়ি বেয়ে। মাঝখানে সালোঁতে থিয়ো দাঁড়িয়ে। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল—কী হল ভিনসেন্ট, কেমন দেখলে?—ও, থিয়ো! এই অস্ফুট উচ্চারণটির বেশি আর-কিছু ভিনসেন্টের মুখ দিয়ে বার হল না।

গ্যালারি থেকে নিজেই সে ছুটে বার হয়ে গেল রাস্তায়।

সারাদিন সে প্যারিসের অচেনা পথে পথে ঘুরে বেড়াল। কোথাও বড়ো বড়ো রাস্তা, কোথাও-বা গলিঘুঁজি। পথের ধারে বসল কিছুক্ষণ কখনও-বা।

সন্ধে বেলা পুলিশকে প্রশ্ন করে পথ খুঁজে সে ফিরে এল থিয়োর বাড়িতে। সারা শরীরে ক্লান্তি, বুকের মধ্যে অত্যন্ত যন্ত্রণা। বান্ডিল খুলে নিজের আঁকা এতদিনের ছবিগুলো সে ছড়িয়ে দিল মেঝেতে

কী সে করছে এতদিন? এত ক্যানভাস, এত রং, সব অপব্যয়। এত শ্রম, এত যন্ত্রণা, সব শুধু ব্যর্থতা। বিগত শতাব্দীর মৃত অন্ধকারে সে ডুবে ছিল এতদিন, খোঁজই পায়নি কোথায় বয়ে চলেছে নতুন যুগের বিপুল আলোকবন্যা।

থিয়ো আপিস থেকে ফিরে এসে দেখে, তেমনি বসে আছে ভিনসেন্ট চারিদিকে ছড়ানো নিজের ছবির মাঝখানে প্রস্তরীভূত হয়ে। থিয়ো তাড়াতাড়ি এসে চুপ করে বসল তার পাশে।

একটু পরে বললে—ভিনসেন্ট, তোমার যা মনে হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। সাংঘাতিক লাগছে, তাই না? যা ভেবেছ সবচেয়ে বড়ো, যা ভেবেছ অটল অনড়, ছবি আঁকার এতদিনের আইনকানুনের পবিত্র বিধিব্যবস্থা, সব যেন চুরমার–হয়ে গেল। ঠিক বলেছি কি না বলো?

আর্ত আহত চোখে স্থির দৃষ্টিতে ভিনসেন্ট তাকাল থিয়োর চোখের দিকে। বললে—থিয়ো, তুমি আগে কেন আমাকে দেখাওনি? আগে কেন আমাকে আননি এখানে? আমার জীবনের ছ-ছটা বছর একেবারে নষ্ট হয়ে গেল!

নষ্ট হয়ে গেল? পাগল নাকি! তোমার যা শিল্পরীতি তা তুমি নিজে হাতে গড়ে তুলেছ। তুমি যে-ছবি আঁক তা কেবল ভিনসেন্ট ভ্যান গকই আঁকতে পারে, দুনিয়ার আর দ্বিতীয় কেউ তা পারে না। এখানে আসবার আগে তোমার নিজস্ব প্রকাশরীতিকে খুঁজে পাওয়াটা দরকার ছিল বই কী!

বাজে কথা থিয়ো, সব বাজে কথা। আমার আর কোনো উপায় নেই! বড়ো কালো একটা ক্যানভাসে পায়ের ধাক্কা মেরে ভিনসেন্ট করুণ গলায় বলে উঠল—কী করেছি আমি এতদিন! যত সব মৃত আবর্জনার স্তূপ!

শোনো ভিনসেন্ট। করেছ তুমি অনেককিছু। বাকি কিছুটা কাজ কেবল এখন বাকি। শুধু আলো আর রং, এইটুকু এবার শুধু তোমাকে ইম্প্রেশনিস্টদের কাছ থেকে নিতে হবে। এর বেশি কিন্তু নয়। অনুকরণ তুমি করবে না, প্যারিসের কাছে বশ্যতা স্বীকার তুমি করবে না। আগে যদি আসতে, তাহলে নিজস্বতা বলে তোমার একবিন্দুও থাকত না।

কিন্তু থিয়ো, আমাকে যে আবার গোড়া থেকে শিখতে হবে! যা-কিছু আমি এ পর্যন্ত করেছি, সব যে ভুল!

না। সব ঠিক, কেবল আলো আর রং ছাড়া। এর বেশি ইম্প্রেশনিস্টদের কাছ থেকে নেবার তোমার কিছু নেই। তুমি নিজেই যে তা-ই। বরিনেজে প্রথম যে-দিন তুমি পেনসিল ধরেছিলে, ইম্প্রেশনিস্ট তুমি সে-দিন থেকেই। তোমার ড্রয়িং দেখো, তুলির আঁচড় দেখো। মানের আগে এমনি আর কেউ আঁকেনি। মুখ দেখো, গাছ দেখো, মাঠের মূর্তিগুলি দেখো। প্রকৃতির অন্ধ অনুকরণ তুমি করনি, প্রকৃতি যে-স্পর্শ রেখেছে তোমার মনে, তা-ই তুমি প্রকাশ করেছ। তোমার কাজে সূক্ষ্ম অনুকৃতি নেই, প্রকাশের তথাকথিত সম্পূর্ণতা নেই, আছে তোমার চেতনার তোমার অনুভূতির স্পর্শ, তোমার ব্যক্তিত্বের পরিচয়। এই তো ইম্প্রেশনিস্ট হওয়া, চিরাচরিত ব্যাকরণের বেড়াজাল ভেঙে ফেলে নিজের চেতনাকে উদ্ঘাটিত করা। কে বলে তুমি পিছিয়ে পড়ে আছ?

সত্যি বলছ থিয়ো?

প্যারিসের সমস্ত তরুণ আর্টিস্ট তোমার কাজের সঙ্গে পরিচিত। যারা সফল ছবিবিকিয়ে তারা নয়, যারা নতুন পথে চলেছে, ভাবছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে তারা। তারা সবাই তোমার সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক। তাদের কাছ থেকে অনেক আশ্চর্য জিনিস তুমি শিখতে পারবে।

তারা আমাকে চেনে? আমার আঁকা তারা দেখেছে?

উদ্‌গ্রীব আগ্রহে উঁচু হয়ে বসল ভিনসেন্ট। হঠাৎ কেমন থিয়োর মনে পড়ে গেল তাদের ছেলেবেলাকার কথা। বললে—নিশ্চয়, নইলে এতদিন প্যারিসে বসে আমি করেছি কী? তারা জানে দৃষ্টি তোমার তীক্ষ্ণ, জানে তোমার ড্রয়িংয়ের ক্ষমতা। এবার শুধু আলোটুকু বাকি। মুক্ত আকাশের আলো আনো তোমার ছবিতে, তারপর আর তোমাকে মারে কে? ভিনসেন্ট, জানো, সারা চিত্রকলার ওপর সূর্যের নতুন আলো ঝরে পড়ছে এ-যুগে, এ-যুগ আমাদের যুগ!

থিয়ো, থিয়ো!

আর বলতে পারল না ভিনসেন্ট। দু-হাতে ভাইয়ের ডান হাতটা চেপে ধরল নিরুদ্ধ আবেগে।

পরদিন সকালে ভিনসেন্ট ড্রয়িংয়ের জিনিসপত্র নিয়ে করম্যানের স্টুডিয়োতে গেল। তিনতলার ওপরে মস্ত হলঘর, উত্তর দিক থেকে হাঁ-করা জানলা দিয়ে আলোর প্রবেশ। একধারে দরজার দিকে মুখ করে একটি নগ্ন পুরুষ মডেল। ছাত্রদের জন্যে প্রায় তিরিশটি চেয়ার আর ইজেল ইতস্তত। ভিনসেন্ট করম্যানের কাছে নাম রেজিস্ট্রি করে একটা ইজেলের অধিকার পেল।

ঘণ্টা খানেক বোধ হয় সে ড্রয়িং করেছে, এমন সময় দরজা ঠেলে একটি মহিলা এসে ঘরে ঢুকল। কানে ব্যান্ডেজ জড়ানো, দু-হাতে মুখের থুতনিটা চাপা। একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে নগ্ন মডেলটির দিকে চোখ পড়তেই ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল মহিলাটি। তারপর সটান দৌড় দিল বাইরে।

ভিনসেন্ট পাশের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করল—ব্যাপার কী?

এ-ব্যাপার নতুন নয়। লেগেই আছে। পাশের ঘরের দাঁতের ডাক্তারের কাছে এসেছে, ভুলে ঢুকে পড়েছে এই ঘরে। হঠাৎ অমনি একটা উলঙ্গ পুরুষের ওপর চোখ পড়লেই অনেক সময় কী হয়, চট করে মেয়েদের দাঁতের ব্যথা সেরে যায়। ডাক্তার যদি আর কিছুদিন ও-ঘরে থাকে, তাহলে পসার একেবারে মাটি। আপনি আজ নতুন এসেছেন, না?

হ্যাঁ, সবে তিন দিন হল আমি প্যারিসে এসেছি।

নামটি আপনার জানতে পারি?

ভ্যান গক। আপনার?

হেনরি তুলস লোত্রেক। আচ্ছা, থিয়ো ভ্যান গক আপনার কেউ হয়?

আমার ছোটোভাই।

আঃ তাই বলুন! চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে তুলস লোত্রেক হাত বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য, আপনি তাহলে ভিনসেন্ট, না? ভারি খুশি হলাম আলাপ হতে। আপনার ভাইয়ের মতো ছবিওয়ালা সারা প্যারিসে নেই। যারা তরুণ শিল্পী তাদের জন্যে লড়াই করে চলেছে থিয়ো। আমরা যদি কখনও শিল্পমহলে ঠাই পাই, সে পাব ওই থিয়োর জন্যে।

ভিনসেন্ট বললে—আমি শুনেছি।

ভালো করে নবপরিচিতকে দেখল ভিনসেন্ট। চ্যাপটা মতো মাথা, নাক. মুখ, চিবুক সব ভারী ভারী, সামনের দিকে যেন উঁচিয়েই আছে। গালভরতি দাড়ি, নীচের দিকে ঝোলা নয়, গালের দু-পাশে শুঁড়-তোলা যেন

লোত্রেক জিজ্ঞাসা করলে—করম্যানের মতো ওঁচা জায়গায় এসে জুটলেন কেন?

ভিনসেন্ট বললে—স্কেচ করবার একটা জায়গা তো চাই। আপনিই-বা কেন এখানে?

ভগবান জানে কেন। গত মাস থেকে আছি মোমার্তের একটা বেশ্যাবাড়িতে। সবকটা মেয়ের পোর্ট্রেট এঁকেছি। সে-ই হচ্ছে আসল কাজ! স্টুডিয়োতে বসে স্কেচ করা তো শুধু ছেলেখেলা।

ছবিগুলো আমাকে দেখাবেন একদিন?

সত্যি দেখবেন!

বাঃ দেখব না কেন? নিশ্চয়!

ব্যাপারটা কী জানেন? অনেকেই আমাকে পাগল বলে, কারণ নাচঘরের মেয়ে, ভাঁড় আর বেশ্যা, ওদের আমি আঁকি। কিন্তু যে যাই বলুক, সত্যিকারের টাইপ চান তো ওদের মধ্যেই পাবেন।

আমি জানি। অমনি একটা মেয়ের সঙ্গে হেগ-এ কিছুদিন ঘরও করেছি।

বাঃ বাঃ, চমৎকার! এই নাহলে ভ্যান গক পরিবারের ছেলে! দেখি মডেলটার কেমন স্কেচ করলেন আপনি!

ভিনসেন্ট কাগজগুলো বাড়িয়ে দিলে—এই দেখুন, গোটা চারেক করেছি।

কিছুক্ষণ স্কেচ ক-টা ভালো করে নিরীক্ষণ করল লোত্রেক, তারপর পরিচয়টাকে ঘনিষ্ঠতার সূত্রে বেঁধে নিয়ে বললে—দেখো বন্ধু, তোমাতে আমাতে জমবে ভালো। আমাদের দুজনের মধ্যে মিল আছে অনেক। ভালো কথা, এগুলো করম্যানকে দেখিয়েছ?

এখনও না।

খুব ভালো। তাহলে দেখিয়ো না। করম্যানের সমালোচনা যদি একবার শোনো তাহলে দ্বিতীয় দিন আর এখানে আসতে প্রবৃত্তি থাকবে না। সে-দিন আমাকে কী বললে জান? বললে লোত্রেক, অতি রঞ্জন ছাড়া কি তুমি আঁকতে পার না? অতি রঞ্জনের ঠ্যালায় তোমার কাজ যে ভাঁড়ামিতে পৌঁছে গেছে!

লোত্রেকের তীক্ষ্ণ চোখে বিচিত্র এক আলো ফুটে উঠল। বললে—সত্যি দেখবে আমার আঁকা মেয়েদের ছবিগুলো? ভদ্রতা করছ না তো?

কী মুশকিল!

বৎস, ওঠো। চলো তাহলে আমার সঙ্গে। এই কবরখানায় আর-এক মিনিট নয়!

লোত্রেকের চেহারাটা কিম্ভূত। মোটা ঘাড়, চওড়া কাঁধ, পেশিবহুল দুই বাহু। কিন্তু আসলে সে পঙ্গু। কোমর পর্যন্ত স্বাভাবিক, তার পরেই আর-কিছু যেন নেই। শীর্ণ কয়েক আঙুল মাত্র লম্বা দুটি পা। দেহের ভার সে খেলনার পায়ে সয় না। লাঠির ওপর ভর দিয়ে সে হাঁটে। কয়েক পা চলার পরই বিশ্রাম করতে হয়।

তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, পা দুটোর আমার কী হল। তা-ই না ভ্যান গক? শোনো তাহলে।

কী দরকার লোত্রেক? না-ই বললে!

না, না, সবাই তো জানে, তুমিও জানলে। লাঠির ওপর শরীরের ওপরদিককার ভার চেপে রাস্তার এককোণে দাঁড়িয়ে বলে চলল লোত্রেক—আমি যখন জন্মাই, শরীরের হাড়গুলো সব ঠুনকো ছিল। বারো বছর যখন আমার বয়েস তখন নাচঘরের মেঝেতে পড়ে ডান ঊরুর হাড়টা ভেঙে ফেলি। পরের বছরেই আবার দুর্ঘটনা। সে-বার পড়ে যাই একটা খাদের মধ্যে, বাঁ-ঊরুর হাড়টাও ভাঙে। তারপর থেকে আমার পা আর এক ইঞ্চিও বাড়ল না।

দুঃখ আছে নাকি এজন্যে?

মোটেও না ভায়া। স্বাভাবিক যদি চেহারাটা হতো, তাহলে কি আর ছবি আঁকতে পারতাম? আমার বাবা হচ্ছেন তুলস-এর কাউন্ট। তাঁর মৃত্যুর পর খেতাবটা আমারই পাওনা। হয়তো মার্শালের দণ্ড হাতে নিয়ে ফ্রান্সের রাজার পাশে পাশে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াব, এই ছিল পূর্বজন্মের ফল! কিন্তু সে-রাজাও নেই, আর আমার পাও নেই! অতএব ছবি আঁকা আমার মারে কে? আচ্ছা তুমিই বলো, শিল্পী যদি হতে পারি তাহলে কাউন্ট হতে যাব কোন দুঃখে?

ঠিক। কাউন্টদের দিন ফুরিয়েছে, শিল্পীর দিন অফুরান।

চলো। ওই যে-গলিটা দেখছ, ওর মধ্যে ডেগার স্টুডিয়ো। লোকে বলে আমি নাকি ডেগার কপি করি, কেননা সে ব্যালেনাচিয়েদের আঁকে, আমি আঁকি মোলা রুজের মেয়েদের। যা বলে বলুক, আমার বয়েই গেছে। ওই ১৯ নং রু ফাঁতেন দেখছ? ওই আমার আস্তানা। ‘হ্যাঁ, ঠিক বুঝেছ, একতলাতেই আমি থাকি। সিঁড়ি ভাঙতে হয় না।

দরজা খুলে সমাদর করে লোত্রেক ভিনসেন্টকে ঘরে আনল। বললে—কিছু ভেবো না, আমি একলা থাকি, যেখানে খুশি জায়গা করে বসে পড়ো।

ভিনসেন্ট তাকাল চারদিকে। ঘরের কোণে কোণে গাদা গাদা ক্যানভাস, ফ্রেম, টুল, ছোটো ছোটো সিঁড়ি আর ঝলঝলে পর্দা, মাঝখানে সারা মেঝে জুড়ে দু-খানা বড়ো বড়ো টেবিল। একটি টেবিল জুড়ে দুষ্প্রাপ্য দামি দামি মদের বোতল, ডিকান্টার আর গ্লাসের মিছিল। অন্য টেবিলটার ওপর নানা জিনিস এলোমেলো, স্তূপাকার—নাচিয়ে মেয়েদের চটিজুতো, কাঁচুলি, ঘাঘরা, দস্তানা, মোজা, টুকিটাকি অলংকার, গাদা গাদা বই আর অশ্লীল ফোটোগ্রাফ, একগোছা চমৎকার জাপানি ছবির প্রিন্ট। পুঁজির পাহাড়ের এককোণে একটুখানি জায়গা। বোধ হয় লোত্রেকের কাজ করার জন্যে।

কী হল ভ্যান গক, হেঁকে উঠল লোত্রেক–আরে? বসবার একটা জায়গা পাচ্ছ না? ওই দেখো, ওই চেয়ারটার ওপর যা আছে সব ছুড়ে ফেলে দাও মাটিতে! জানলার ধারে আলোর কাছে চেয়ারটা টেনে এনে বোসো।

উত্তেজিত হাতে ছবি গোছাতে গোছাতে আবার সে বললে—এ-বাড়িতে সাতাশটা মেয়ে আছে ভ্যান গক। সবকটার স্কেচ আমি করেছি। শুধু তা-ই বললে কম বলা হবে, প্রত্যেকটার সঙ্গে আমি রাতও কাটিয়েছি। সত্যি বলো, যে-মেয়েকে আঁকতে চাও তার সঙ্গে শুতেই যদি না পারলে, তাহলে তাকে পুরোপুরি বুঝবে কী করে?

ঠিক বলেছ।

এই দেখো স্কেচগুলো। সে-দিন এক ছবিওয়ালার কাছে এগুলো নিয়ে গিয়েছিলাম। লোকটা কী বললে জান? বললে, লোত্রেক, যা কুৎসিত তার প্রতি তোমার এমনি আসক্তি কেন? অসচ্চরিত্র কদর্য সব মানুষ খুঁজে খুঁজে নিয়ে তুমি আঁক। এইসব মেয়েগুলো এত ঘৃণিত যে মুখে বলা যায় না, কুৎসিত পাপের ক্লেদ এদের মুখে মাখানো। যা কুৎসিত তাকে সৃষ্টি করার নামই কি তোমাদের আধুনিক শিল্প? তোমরা কি সব অন্ধ হয়ে গেছ? পৃথিবীতে যা মধুর যা সুন্দর, তা কি তোমাদের চোখে পড়ে না?

তারপর?

আমি বললাম—মাপ করুন মশিয়েঁ, আপনার কার্পেটটা ভারি সুন্দর, আমার বড্ড বমি আসছে, এটাকে নোংরা করা আমার পক্ষে সত্যি ঠিক হবে না!—‘দেখো, আলোটা ঠিক পাচ্ছ তো? বেশ ভালো করে দেখো। ওঃ, টানবে নাকি কিছু? না না, যা চাও তাই পাবে। মুখ ফুটে একবার হুকুম করলেই হল।

ত্বরিত গতিতে সে টেবিল-চেয়ারের ভিড়ের মধ্যে খাটো পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে দু-গেলাস মদ ঢেলে নিয়ে এল। একটা গ্লাস ভ্যান গকের হাতে তুলে দিয়ে গ্লাসভরতি নিজের ডান হাতটা উঁচু করে তুলে চেঁচিয়ে উঠল—জয় হোক, যা কুৎসিত যা কদর্য, তার জয় হোক!

আস্তে আস্তে পান করতে করতে ভিনসেন্ট লোত্রেকের স্কেচগুলো দেখতে লাগল। সাতাশটি ছবি, সাতাশজন আলাদা আলাদা মেয়ে, প্রত্যেকটি মোমার্তবাসিনী গণিকা। ছবিগুলির মৌলিক গুণ এগুলির বাস্তবতা। শিল্পী যেমন দেখেছে ঠিক তেমনই এঁকেছে, নীতি বা রুচির কৃত্রিম আবেশে এই স্বচ্ছ দৃষ্টির বাস্তবতাকে ঘোলাটে করা হয়নি। মেয়েগুলির মুখগুলি দেখবার মতো, নিরাবরণ স্বরূপে সে-মুখে ফুটে আছে অনাসক্ত কৃত্রিম কামুকতা, জান্তব লাম্পট্য, মনোবিহীন শরীরসর্বস্বতা আর অকপট দৈন্য-বেদনা।

শুধোল সে― চাষিদের ছবি তোমার ভালো লাগে লোত্রেক?

ভালো লাগে, যদি তার মধ্যে মিথ্যে ভাবালুতা না থাকে।

বটে? কথাটা কী জান, আমি এই চাষিদের শিল্পী। তাদের ছবিই এতদিন এঁকেছি। আমার মনে হচ্ছে, তোমার এইসব মেয়েরা, এরাও কৃষাণ, কৃষি করে এরা মাংসের। মাটি আর মাংস একই পদার্থের দু-রকম রূপ, তা-ই নয়? জীবন্ত মানুষের মাংসের কর্ষণ এরা করে, ফসল ফলে বই কী। সেই ফসল জীবন। জীবনকে তুমি বাদ দাওনি লোত্রেক, বাস্তবকে তুমি এড়িয়ে যাওনি। কাজের মতো কাজ করেছ।

তোমার কি মনে হয় ছবিগুলো কুৎসিত?

এরা সত্য, এরা জীবনের সুগভীর পরিচিতি। সত্য বলেই এদের সৌন্দর্য খুব উঁচুদরের। এসব মেয়েদের তুমি যদি মিথ্যে আদর্শ আর ভাবালুতা দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে আঁকতে, তাহলেই এগুলো হতো অসুন্দর অসত্য আর কাপুরুষতার কদর্য নিদর্শন। কিন্তু যে-সত্যকে তুমি দেখেছ, তাকে প্রকাশ করতে তুমি ডরাওনি। কার সাধ্য বলে সত্য অসুন্দর?

হে প্রভু! হে যিশু! এই ভ্যান গকের মতো লোক এত কম পাঠাচ্ছ কেন পৃথিবীতে?—নাও, নাও, আর-একবার গলা ভিজিয়ে নাও। আর এই ছবিগুলোও ভায়া সব তোমার। যেখানা খুশি বেছে নাও।

একটা স্কেচ উঁচু করে আলোতে তুলে ধরল ভিনসেন্ট, খানিকক্ষণ ভালো করে লক্ষ করার পর বলে উঠল—দামেয়ার! দ্যমেয়ারের কাজ মনে পড়ছে!

জ্বলে উঠল লোত্রেকের চোখ। বললে—হ্যাঁ, দ্যমেয়ার। শিল্পীর রাজা! জীবনে যা শিখেছি ওই একজনের কাছ থেকেই। ঈশ্বর! ঘৃণা করবার কী অভূতপূর্ব ক্ষমতা ছিল লোকটার!

ভিনসেন্ট বললে—এতে কিন্তু আমার আপত্তি আছে। ঘৃণাই যাকে করব, তাকে আঁকতে যাব কোন দুঃখে? যাকে ভালোবাসি তাকেই না আঁকতে মন চায়। ভুল ধারণা তোমার ভায়া, লোত্রেক উত্তর দিল—মহৎ শিল্প বলতে যা-কিছু, ঘৃণা থেকেই তার জন্ম।—কী হল? গগাঁর ছবিটা পছন্দ হল দেখছি আবার?

কার ছবি এটা বললে?

পল গগাঁ। আলাপ আছে নাকি?

না।

তাহলে তো আলাপ করতেই হবে। ছবির মেয়েটা মার্টিনিক দ্বীপের মেয়ে। গগাঁ ও-অঞ্চলে গিয়ে ছিল কিছুদিন। তারপর থেকে ওর মাথাটা একেবারে বিগড়ে গেছে, জংলি হবে, আদিম মানুষ হবে, এই ওর নেশা। তবে পাগল হলে কী হয়, শিল্পী হিসেবে অপূর্ব। স্ত্রী ছিল, তিনটি ছেলেপিলে ছিল, আর ছিল স্টক এক্সচেঞ্জে মোটা মাইনের চাকরি। বছরে তিরিশ হাজার ফ্র্যাঙ্ক আয়। পিসারো, মানে আর সিসলের কাছ থেকে ছবিই কিনেছিল পনেরো হাজার ফ্র্যাঙ্কের। বিয়ের দিন স্ত্রীর ছবি আঁকে। সবাই বলল, আহা, আহা! রবিবার ছুটির দিনে আঁকত, স্টক এক্সচেঞ্জ ক্লাবে শাঁসালো সভ্য বলে নামডাক ছিল। একবার নিজের আঁকা একটা ছবি মানেকে দেখায়। মানে প্রশংসা করে। ভদ্রতা করে মানেকে ও বলে—আমি তো নিতান্ত অ্যামেচার আঁকিয়ে।—অ্যামেচার? মানে উত্তর দেয়—যারা খারাপ আঁকে তারাই অ্যামেচার। তারা ছাড়া আবার অ্যামেচার কে? নির্জলা মদের মতো ক-টা কথা সেই যে ওর মাথায় গিয়ে চড়ল, আজ পর্যন্ত আর নামল না। চাকরি ছাড়ল, বউ-বাচ্চাদের বিদায় দিল শ্বশুরবাড়িতে, নেশা নিয়েই মেতে রইল তারপর থেকে। নেশা ছবি আঁকা।

বাঃ, আশ্চর্য লাগছে! আলাপ করতেই হবে এমন লোকের সঙ্গে।

তা করবে। তবে আগে থেকে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দিই, বন্ধুদের খেপিয়ে দিতে ওর মতো ওস্তাদ কেউ নেই। ভালোকথা ভ্যান গক, অপরের কথাই যখন উঠল, একদিন তোমাকে মোলা রুজ আর ইলিসি মোমার্ত দেখিয়ে আনি চলো। কীসব মেয়ে—কিছু ভেবো না তুমি, সবকটাকে আমি চিনি। আপত্তি নেই তো তোমার মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করতে?… হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই হল, আলাপ করতে, নাড়াচাড়া করতে, যা প্রাণ চায় সব করতে। তাহলে একটা রাত্রি ফুর্তি করা যাক একদিন, রাজি তো?

নিশ্চয় রাজি।

বহুত আচ্ছা। কিছু ভেবো না, সে-ব্যবস্থা আমার। তারপর? আবার এখন করম্যানে যেতে হবে তো? তা ওঠবার আগে আর-এক পাত্র করে হোক! নাও, মেরে দাও এটুকু একচুমুকে। এই তো চাই! আর-একটু ঢালি, কেমন? আহা, তলানি রেখে কী হবে, বোতলটা শেষ করা চাই তো! ব্যাস, নাও ওঠো এবার। দেখো সাবধান, টেবিলের গায়ে ধাক্কা খেয়ো না যেন। নাঃ, বড্ড জিনিসপত্র জমেছে। ঘরটা আমাকে ছাড়তেই হবে এবার। বুঝেছ ব্রাদার, টাকায় আমাদের মরচে পড়েছে। বাবার আমার মেজাজ দিলদরিয়া, খোঁড়া ছেলে পাছে মনে মনে অভিশাপ দেয়, তাই চাইবার আগেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠায়। আমি খাইদাই ফুর্তি করি, ছবি আঁকি। যখন নতুন একটা স্টুডিয়ো ভাড়া নিই, বিলকুল খালি ঘর। তারপর জিনিসপত্র জমে। মালের ভিড়ে যখন মানুষের ঠাঁই থাকে না, তখন আবার সব ফেলে শুধু ছবিগুলো নিয়ে নতুন ফাঁকা ঘরে উঠে যাই। আবার নতুন ঘর, নতুন জিনিসপত্র, ঠিক নতুন মেয়েমানুষের মতো। ভালোকথা, কীরকম মেয়েমানুষ তোমার পছন্দ বলো, টকটকে গোলাপি রং? তোমার মতো লালচে চুল?

এ আবার এমন একটা শক্ত কাজ নাকি? পুরোনো প্যালেটটা ফেলে দিয়ে কিছু হালকা রং কিনে নিলেই তো হল। তাহলেই তো এইসব ইম্প্রেশনিস্টদের মতো ছবি আঁকা যাবে! প্রথম দিনের চেষ্টার পরে কিন্তু কিছুটা ঘাবড়ে গেল ভিনসেন্ট। তার পরদিন মনে জাগল কেমন যেন দিশেহারা ভাব, তারপর বিরক্তি, রাগ, হতাশা। সপ্তাহ শেষ হতে-না-হতে ভয়, পিঠের শিরদাঁড়া শিরশিরিয়ে ওঠে, এমনি আতঙ্ক। রং নিয়ে বছরের পর বছর কত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, তার ফল শেষ পর্যন্ত কি এই! অবস্থা যে একেবারে প্রথম শিক্ষার্থীর মতো! ক্যানভাসের পর ক্যানভাসে রং চড়ায়, গাঢ় নিষ্প্রভ চটচটে রঙের প্রলেপ শুধু পড়ে। করম্যানের স্টুডিয়োতে বসে বসে সে আঁকে আর নিজের ব্যর্থতায় নিজেই গজগজ করে, লোত্রেক পাশে বসে বসে শুধু তার কাণ্ড দেখে, কোনো উপদেশ দিতে চায় না, চুপ করে থাকে।

থিয়োর অবস্থা আরও দুঃসহ। থিয়ো অতি ঠান্ডা প্রকৃতির লোক, আচার–ব্যবহার ও অভ্যাস সবই মৃদু কোমল। পোশাকে পরিচ্ছদে গৃহসজ্জায় অতি খুঁতখুঁতে ধরনের শৌখিন। ভিনসেন্টের দুর্দাম জীবনীশক্তির নিতান্ত সামান্য অংশেরও সে অধিকারী নয়।

রু লাভালের ফ্ল্যাটটি থিয়ো আর তার শৌখিন আসবাবগুলির পক্ষে যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি ভিড় তার সয় না। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই ভিনসেন্ট অমন সুন্দর ফ্ল্যাটটিকে পুরোনো মালের দোকানে পরিণত করে তুলল। মোটা বুট ঘষে ঘষে হেঁটে সে মেঝের কার্পেট নষ্ট করল, যে-আসবাব সামনে পড়ে লাথি মেরে এ-কোণে ও-কোণে হটাতে লাগল তাকে। ক্যানভাস, তুলি, রঙের খালি টিউব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নোংরা করল চারিদিক। টেবিলে চেয়ারে তার ময়লা জামাকাপড় জড়ো, ডিসের পর ডিস তার হাতে ভাঙে, রং ছিটিয়ে সে নোংরা করে দেয়াল। থিয়োর জীবনের প্রত্যেকটি ভব্য ধরনধারণ চুরমার করল সে।

একটি সন্ধ্যার ঘটনা।

ছোট্ট ঘরটায় লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত পায়চারি করছিল ভিনসেন্ট আর দাঁত কিড়মিড় করে আপনমনে রকবক করে চলেছিল। থিয়ো বললে—অত ছটফট করছ কেন? ডাকাতের মাঠ পেয়েছ নাকি ঘরখানা?

হালকা একটা চেয়ারে শরীরের সমস্ত ওজন ধপ করে ফেলে ভিনসেন্ট ভীষণ কাণ্ড করল, আর্তনাদ করে উঠল পায়াগুলো।

চিৎকার করে উঠল সে সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থ বেদনায়—আশা নেই, কোনো আশা নেই, বড্ড দেরি হয়ে গেছে! চেষ্টাও কি কম করেছি! পাগলের মতো খেটেছি, একটা নয় দুটো নয়, কুড়িটা ক্যানভাস, আমি শেষ করেছি। কিন্তু কোনো উপায় নেই। নতুন করে শুরু করতে হবে আবার। যা এতদিন করেছি সব বাতিল!

থিয়ো ধমকে উঠল—কী পাগলের মতো বকছ?

পাগল? পাগল হতে বাকি আছে? সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার! এখানে যা দেখলাম এরপর হল্যান্ডে ফিরে গিয়ে ভেড়ার ছবি আঁকতে আর পারব না, নতুন পথে যাবারও সময় আর নেই। হায় ভগবান, আমার কী হবে এখন?

চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে ভিনসেন্ট দরজা খুলে বাইরের বাতাসে কয়েকটা লম্বা লম্বা শ্বাস টেনে নিল বুকে। তারপর দরজাটা বন্ধ করে জানলাটা খুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হঠাৎ এমন জোরে জানলাটা বন্ধ করল যে ঝনঝন করে উঠল শার্সির কাচ। ছুটে গেল রান্নাঘরে। ঢকঢক করে জল খেল, সঙ্গে সঙ্গে খেল বিষম। ভিজে হাত-মুখ আর জামা নিয়ে আবার এসে ঢুকল বসবার ঘরে। সত্যি, বলো থিয়ো, কী করব আমি? এত আশা, এতদিনের পরিশ্রম, সব ছেড়েছুড়ে দেব? কোনো আশা আর আমার নেই, তা-ই না?

ভিনসেন্ট, এ কেমন তোমার ব্যবহার? কচি খোকা নাকি তুমি? ঠান্ডা হয়ে যদি বসতে পারো তো কথা বলব। আবার পায়চারি করছ? ইস, এমন সুন্দর চেয়ারটি ভাঙবে নাকি লাথি মেরে মেরে! খুলে ফেলো, বুটজুতো খুলে বোসো চুপ করে!

কিন্তু থিয়ো, ছ-বছর ধরে আমি তোমার ওপর আছি। বলো, কী প্রতিদান দিতে পেরেছি তার? একগাদা কালো চটচটে ছবি, যার দাম কানাকড়িও নয়! কিছু শিখিনি, কিছু করিনি, শুধু এতদিন মাসের পর মাস তোমার টাকা উড়িয়েছি। এ-লজ্জায় তো মরে যাওয়া উচিত আমার!

শোনো ভিনসেন্ট, শোনো। মাথা খারাপ কোরো না। আচ্ছা বলো দেখি, যখন কৃষাণজীবন আঁকবে ভেবেছিলে, এক সপ্তাহেই কি আঁকতে শিখে গিয়েছিলে, না পুরো পাঁচটা বছর লেগেছিল?

তা ঠিক; কিন্তু তখন সবে যে আরম্ভ করেছিলাম আমি!

ঠিক আজও নতুন একটা আরম্ভ তোমার। রঙের কাজের আরম্ভ। এবং এর জন্যে আরও পাঁচটা বছর দিতে হবে বই কী!

থিয়ো থিয়ো, এর কি আর কখনও শেষ হবে না? সারাজীবন কি এমনি শিক্ষানবিশি করেই কাটবে? তেত্রিশ বছর বয়েস হল, পরিণতি হবে আর কবে আমার?

এই তোমার শেষ শিক্ষা ভিনসেন্ট। সারা ইয়োরোপে যা-কিছু আঁকা হচ্ছে সবকিছুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ আছে। আমি জানি কোথায় আরম্ভ, কতদূরে গিয়ে শেষ। একবার যদি প্যালেটটা হালকা রঙের করতে পার—

সত্যি বলছ থিয়ো? সত্যি বলছ আমার আশা আছে? পারব আমি শেষ পর্যন্ত? ব্যর্থ তাহলে নই আমি?

না, তুমি আর-কিছু। তুমি একটা আস্ত গাধা। শিল্পের ইতিহাসে বিরাটতম একটা বিপ্লব ঘটে চলেছে, আর তুমি ভাবছ সাত দিনে তা তুমি রপ্ত করে নেবে! চলো, রাস্তায় একটু বেড়িয়ে আসি। তোমার সঙ্গে আর পাঁচ মিনিট যদি এই ঘরে আমাকে থাকতে হয়, তাহলে দম আটকে মরব আমি!

.

পরদিন প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিনসেন্ট করম্যানের স্টুডিয়োতে কাজ করল, তারপর গেল গুপিলসে থিয়োকে ডাকতে। এপ্রিল মাসের গোধূলি, পাথরের উঁচু উঁচু সারি সারি বাড়ির মাথায় মাথায় পড়ন্ত বেলাশেষের গোলাপি আভা। সারা শহর জুড়ে বসন্তদিনান্তের ছুটির আমেজ। রু মোমার্তের পথের ধারের কাফেগুলিতে আড্ডাবাজদের ভিড়, মিষ্টি মধুর সংগীত। রাস্তায় রাস্তায় গ্যাসের আলো জ্বালানো হচ্ছে, রেস্তরাঁগুলোতে টেবিলে চাদর পাতছে ওয়েটাররা, বন্ধ হচ্ছে অন্য দোকানপাট।

অলস পদক্ষেপে এগোল থিয়ো আর ভিনসেন্ট, প্লেস চাতুদুনের মোড় পার হয়ে চলল রু লাভালের পথে।

থিয়ো বললে—একটু গলা ভিজোবে নাকি ভিনসেন্ট?

হ্যাঁ, কোথাও বসলে হতো, এমন জায়গায়, যেখান থেকে ভিড় দেখা যায়।

চলো তাহলে রাতেইল রেস্তরাঁতে, সেখানে বন্ধুও কয়েকজন জুটবে।

রেস্তরাঁ বাতেইল প্যারিসের ছবি-আঁকিয়েদের অন্যতম আড্ডাক্ষেত্র। বাইরে রাস্তার ধারে চার-পাঁচখানা টেবিল, মধ্যে দু-খানা বেশ বড়ো বড়ো ঘর। একখানা ঘর মাদাম বাতেইল নির্দিষ্ট রেখেছেন শুধু শিল্পীদের জন্যে। অন্য ঘরটি সাধারণ খদ্দেরের। লোক দেখলেই তিনি চিনতে পারেন কে শিল্পী আর কে শিল্পী নয়।

থিয়ো ওয়েটারকে ডাকল—এই যে, এক গ্লাস কুমেল এইখানে।

ভিনসেন্ট বললে—আমি কী খাই বলো তো থিয়ো?

একটা কোনত্রু চেখে দেখো। এমনি চেখে-চেখেই নিজের প্রিয় মদটা খুঁজে পেতে হবে।

ডিসের ওপর গ্লাস বসিয়ে ওয়েটার টেবিলে সাজিয়ে রাখল। ডিসের গায়েই কালো হরপে দাম লেখা। থিয়ো ধরাল একটা সিগার, ভিনসেন্ট তার পাইপ সামনে কত বিচিত্র নরনারীর পথযাত্রা। বগলের তলায় ইস্ত্রি-করা জামাকাপড় নিয়ে কালো অ্যাপ্রন-পরা কয়েকটি ধোপানি, মুখে দড়ি-বাঁধা মাছ আঙুলে ঝুলিয়ে একটি শ্রমিক, ইজেলে ভিজে ক্যানভাস আটকে নিয়ে দু-একজন শিল্পী, চকচকে কালো জুতো আর ধূসর চেক-কাটা কাপড়ের কোট গায়ে ব্যাবসাদার, সওদাভরতি বাস্কেট হাতে নরম চটি পায়ে গিন্নির দল, আর কত সুদর্শনা তরুণী, সরু কোমরে লম্বা ঢেউ-খেলানো তাদের স্কার্ট, মাথায় বাঁকা করে বসানো রঙিন পালক-তোলা টুপি।

অপূর্ব শোভাযাত্রা, তা-ই না থিয়ো!

ঠিক। আপিরিটিফ পানের সময় যখন আসে, ঠিক তখনই প্যারিস জাগে।

আমি ভেবে পাই না, এই প্যারিস শহরকে এত আশ্চর্য ভালো লাগে কেন!

কে জানে! কেউ বোধ হয় জানে না। এ একটা চিরন্তন রহস্য। হয়তো ফরাসি চরিত্রের মধ্যেই কোনো একটা জাদু আছে। সত্যি, ফরাসি মেজাজ যাকে বলে তা বড়ো বিচিত্র। এর মধ্যে যেমন আছে স্বাধীনতার গোঁ, তেমনি আছে মেনে নেয়া আর মানিয়ে চলার আমেজ, বাস্তব ব্যস্ততার সঙ্গে মিশে আছে কেমন একটা ঢিলেঢালা জীবন। ওই দেখো, আমার এক বন্ধু আসছে। আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

ভিনসেন্টের সঙ্গে কথা বন্ধ করে গলা চড়িয়ে ডাকল থিয়ো—পল, এসো এসো, কেমন আছ?

ধন্যবাদ ধন্যবাদ, দিব্যি আছি, খুব ভালো আছি।

বোসো এখানে, আবসাঁত খাও একটা। আলাপ করিয়ে দিতে পারি? আমার ভাই ভিনসেন্ট ভ্যান গক। ভিনসেন্ট, আমার বন্ধু পল গগাঁ।

আবসাঁতের পাত্রে মুখ নামিয়ে জিভের ডগাটা ভিজিয়ে নিল পল গগাঁ, তারপর ভিনসেন্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—প্যারিস কেমন লাগছে মশিয়েঁ ভ্যান গক?

ভালো, খুব ভালো।

সত্যি? হুঁ! কী বলব বলুন, আপনার মতো লোক অনেকেই। আমাকে যদি এ-প্রশ্নটা আপনি করতেন, আমি কী বলতাম জানেন? প্যারিস বিরাট একটা আঁস্তাকুড়। তামাম নোংরাভরতি একটা ডাস্টবিন। নোংরাটা কীসের জানেন? আপনাদের এই সভ্যতার।

ভিনসেন্ট বললে—কোনক্রটা আর ভালো লাগছে না থিয়ো! এবার কী চাখি বলো তো?

গগাঁ বলে উঠল—আবসাঁত খান, মশিয়েঁ। শিল্পীর একমাত্র পানীয় তো এটাই।

কী বলো থিয়ো? আবসাঁত?

তোমার খুশি। চেখে দেখো কেমন লাগে। ওয়েটার! মশিয়েঁর জন্যে আবসাত আনো।—তারপর পল! আজ যে খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে, ব্যাপার কী! ছবি বিক্রি হয়েছে একটা?

কী যে বলো! ছবি বিক্রি? ও তো নিতান্ত একটা খেলো কথা বললে! আসলে আজ সকালে উঠেই চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।

ভিনসেন্টকে চোখ টিপল থিয়ো। বললে—তা-ই নাকি? বলো কী অভিজ্ঞতা, খুলে বলতেই হবে। ওয়েটার! মশিয়েঁ গগার জন্যে আর-একটা আবসাঁত লাগাও চটপট।

মুখের ভেতরটা আবসাঁত দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে গগাঁ শুরু করল—আমার বাড়ির গায়ে একটা কানাগলি আছে দেখেছ? সেখানে একটা ঘর নিয়ে থাকে ফুরেল পরিবার। পুরুষমানুষটা গাড়ি চালায়। আজ ভোর পাঁচটার সময় ফুরেল–গিন্নির আর্ত চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল—কে আছ কোথায় আছ, বাঁচাও, আমার স্বামীকে বাঁচাও! কোনো রকমে একটা ট্রাউজার্সের মধ্যে পা দুটো গলিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে দেখি ফুরেল গলায় দড়ি দিয়েছে। লাফিয়ে উঠে ছুরি দিয়ে দড়িটা কাটতেই ধড়টা ধড়াস করে মাটিতে পড়ল। সবে প্রাণটা বেরিয়েছে, গা-টা তখনও গরম। তাড়াতাড়ি বিছানায় তুলতে গেলাম, স্বামী সত্যিই মরেছে দেখে হেঁকে উঠল তার বউ—খবরদার, আর নেড়ো না, আগে পুলিশ আসুক। উলটোদিকে থাকে একটা ফলওয়ালা। আমার বাড়ির গায়েই তার বাগান। এসে লোকটাকে ডেকে বললাম—ভায়া একটা পাকা দেখে ফুটি দিতে পার? প্রাতঃকালের সময় পুরো একটা আহামরি ফুটি খেতে খেতে ফুরেলের গলায় দড়ির কথাটা স্রেফ মুছে গেল মন থেকে। অতএব দেখো, দুঃখ আছে আবার সুখও আছে, বিষ আছে আবার বিষক্ষয়ের ব্যবস্থারও অভাব নেই।

নীরবে মাথা নাড়ল থিয়ো।

গগাঁ বলে চলল—দুপুর বেলা লাঞ্চ খাবার ভালো একটা নেমন্তন্ন ছিল। বেশ চোস্ত সাজগোজ করে বার হলাম। ভোজ্য বস্তু চমৎকার, দলটি মধুর। সবাইকে একটু চমক লাগাবার জন্যে ভোর বেলাকার আত্মহত্যার ঘটনাটা বললাম। নিরুদ্‌বেগে হাসতে হাসতে সবাই একটি অনুরোধ করল—মড়াটার গলার দড়িগাছাটা জোগাড় করতে পারি কি না, যাতে তার একটু একটু করে প্রত্যেকে নিয়ে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে পারে! কেয়াবাত! কে বলে তোমার সভ্য দুনিয়ায় বৈচিত্র্য নেই?

ভিনসেন্ট একমনে দেখছিল পল গগাঁকে। বন্য লোকের মতো কুচকুচে কালো চুলেভরতি মস্ত একটা মাথা, বাঁ-চোখের কোণ থেকে মুখের ডান কিনার অবধি খাঁড়ার মতো নেমে এসেছে বিরাট একটা নাক। চোখ দুটো বড়ো বড়ো, সামনের দিকে টেনে বার হওয়া, দৃষ্টিতে কেমন একটা উন্মত্ত বেদনা। চোখের ওপরে, নীচে, গালে, থুতনিতে, চামড়া ঠেলে উঁচু উঁচু হাড়ের প্রকাশ। দানবের মতো দেহ, প্রতিটি অঙ্গে পাশবিক শক্তি আর কষ্টকৃত সংযমের পরিচয়।

মুখে মৃদু হাসি টেনে উঠে দাঁড়াল থিয়ো। বললে—পল, তোমার যা মনোবৃত্তি শুদ্ধ কথায় তাকে কী বলে জান? বলে ধর্ষকাম। নিষ্ঠুরতা তোমার এতই ভালো লাগে যে, তার মধ্যে স্বাভাবিকতা না থাকলেও তোমার এসে যায় না। যাহোক, এখন উঠতে হল। ডিনারের নিমন্ত্রণ। উঠবে নাকি ভিনসেন্ট?

গগাঁ বললে—থাকুক না আমার সঙ্গে। তোমার ভাইয়ের সঙ্গে তো আলাপই হল না ভালো করে।

আমার আপত্তি নেই। তবে কিনা অভ্যেস তো নেই, খুব বেশি আবসাঁত চলো না ওর পেটে।

বিদায় নিল থিয়ো।

ঘনিষ্ঠ হয়ে এল গগাঁ। বললে—তোমার ভাইটি, ভিনসেন্ট, ভারি চমৎকার। অবশ্য একেবারে যারা তরুণ তাদের ছবি টাঙাতে ভয় পায়। কিন্তু কী করবে বেচারা? ওপরওয়ালা তো আছে!

ভিনসেন্ট বললে—কেন? আমি তো দেখেছি ওর গ্যালারির বারান্দায় মনে, পিসারো, সিসলে, মানে—এদের ছবি আছে!

তা আছে। কিন্তু সিউরাত কই, গগাঁ কই? সেজান কই, তুলস-লোত্রেক কই? যাদের আছে, তারা তো বুড়ো, দিন ফুরিয়েছে তাদের।

ভিনসেন্ট জিজ্ঞাসা করলে– ওঃ, তুলস-লোত্রেককে চেন তাহলে?

হেনরি? নিশ্চয়ই! হেনরিকে চেনে না কে? অদ্ভুত আঁকিয়ে, কিন্তু তেমনি অদ্ভুত পাগল। আধখানা তো মানুষ—ভাবে, যদি জীবনে পাঁচ হাজার মেয়েমানুষের সঙ্গে শুতে পারে, তাহলে পুরো মানুষ না হতে পারার ক্ষতিটার উশুল হবে। পা নেই, রোজ সকালে ওঠে বুকভরা দৈন্যবোধের জ্বালা নিয়ে। প্রতি রাত্রে সেই দৈন্যবোধকে সে ডোবায় মদে আর মেয়েমানুষের শরীরে। কিন্তু পা তো গজাবার নয়, এ-জ্বালাও নেভবার নয়। পাগল যদি না হতো তো প্যারিসে ওর মতো আঁকিয়ের জুড়ি খুঁজে পাওয়া ভার হতো।

ভিনসেন্টকে গগাঁ নিয়ে গেল স্টুডিয়োয়। চারতলার ওপর একটা কুঠরি। একটা ইজেল, পেতলের একখানা খাট, একটা চেয়ার, একটা টেবিল। দরজার কাছে দেয়ালের একটা খুপরিতে কয়েকটা অত্যন্ত কুৎসিত অশ্লীল ফোটোগ্রাফ। ভিনসেন্ট বললে—এই ফোটোগুলো দেখে মনে হচ্ছে প্রেম সম্বন্ধে খুব উঁচু ধারণা তোমার নেই।

গগাঁ বললে—আরে, আগে বোসো, তারপর তর্ক জুড়ো। কোথায় বসবে, খাটে, না চেয়ারটাতে? হ্যাঁ, এই নাও, পাইপে তামাক ভরে নাও। তারপর, কী বলছিলে? ও, প্রেম? হ্যাঁ নারী আমি ভালোবাসি বই কী, কে না ভালোবাসে—তবে সেই নারী যদি দেহে হস্তিনী আর মেজাজে গৃধিনি হয়! সূক্ষ্ম বুদ্ধি আর সূক্ষ্ম দেহ—এ যাদের তারা আবার স্ত্রীলোক নাকি? তুমি জান না, কতদিন ধরে বেশ থপথপে মোটাসোটা একটা মেয়েমানুষ আমি খুঁজছি, কিছুতে পাচ্ছিনে। যদি-বা কখনও পাই তো বোকা বনে যাই, দেখি—মেয়ে তো নয়, হাঁসফাঁস পোয়াতি। জোলার পুষ্যিপুত্তুর মোপাসাঁর গল্প বেরিয়েছে গত মাসে, পড়েছ? একটা লোক, আমারই মতো মোটা মেয়ে তার পছন্দ। ক্রিসমাসের দিন বাড়িতে দুজনের মতো খুব খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করে মেয়ে খুঁজতে বার হয়েছে। দিব্যি মনের মতো একটি পছন্দ হয়েছে, বগলদাবা করে বাড়িতে এনে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসেছে। মনে কত সাধ! হলে হবে কি, খাওয়াদাওয়া শেষ হবার আগেই হঠাৎ কিনা—ওঁয়া ওঁয়া—মেয়েটার পেট থেকে পড়ল ইয়া বড়ো ধড়কড়ে বাচ্চা!

ভিনসেন্ট বললে—কিন্তু এসবের সঙ্গে ভালোবাসার সম্বন্ধ কী, গগাঁ?

গগাঁ চিত হয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়, মাথার নীচে পেশিবহুল একখানা হাত রেখে। ছাদের কড়ির দিকে ছড়াল কড়া তামাকের কয়েক ঝলক ধোঁয়া।

রূপ বলো, বলব অনুভূতি আছে, আসক্তি যত না থাক। কিন্তু প্রেম? তুমি ঠিক ধরেছ। প্রেম আমি বুঝিনে। তোমাকে ভালোবাসি, এ দুটো কথা কাউকে বলতে আমার দাঁত ভেঙে যাবে। তবে এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। যিশুখ্রিস্টের যে-কথা, আমারও সেই কথা—মাংস হচ্ছে শুধু মাংসই আর আত্মা হচ্ছে আত্মা। মাংসের ক্ষুধা যখন কয়েকটা টাকা ফেললেই মেটে, তা-ই মিটুক। আত্মা আমার শান্তিতে থাক।

বিষয়টাকে তুমি খুব সহজেই উড়িয়ে দিতে চাইছ।

মোটেই না। শয্যাসঙ্গিনী নির্বাচন করা কি সহজ কথা! যে-নারী সুখ পায়, তাকে নিয়ে ডবল সুখ পাই আমি। যে শুধু সুখের পেশাদারি ভান করে, সেই মিথ্যে ভানটুকুই আমার যথেষ্ট, দেহানুভূতির সঙ্গে হৃদয়াবেগকে আমি জড়াতে চাইনে। হৃদয় থাক আলাদা শুধু আমার শিল্পসাধনার জন্যে, সৃষ্টির জন্যে।

কথাটা ভুল নয়। সম্প্রতি আমারও ধারণা বদলাচ্ছে।—না, না, আর একটুও আবসাঁত ঢেলো না, নেশাটা একেবারে মাথায় চড়ে উঠবে। থিয়ো তোমার আঁকার খুব প্রশংসা করে। তোমার কয়েকটা স্টাড়ি আমাকে দেখাবে?

নিশ্চয়ই না। স্টাডি? সে হল আমার গোপন জিনিস, নিতান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, ঠিক ব্যক্তিগত চিঠির মতো। হ্যাঁ, তবে, ছবি কয়েকটা তোমাকে দেখাতে আপত্তি নেই।

হাঁটু গেড়ে বসে খাটের নীচ থেকে গগাঁ কয়েকখানা ক্যানভাস বার করল। আবসাঁতের বোতলগুলোর গায়ে ঠেসান দিয়ে একে একে সাজিয়ে রাখল তাদের। কিছুটা আশ্চর্য হবার জন্যে ভিনসেন্ট প্রস্তুতই ছিল, কিন্তু এ যে অভূতপূর্ব বিস্ময়! চোখের সামনে রৌদ্রজ্বলা প্রবালের রংমাতাল মরীচিকা, উদ্ভিদবিজ্ঞান কখনও আবিষ্কার করেনি এমনি সব বিচিত্র গাছের জটলা, বিচিত্র সব মানুষ আর জন্তু—অকল্পনীয় যাদের চেহারা, সমুদ্র যেন আগ্নেয়গিরি থেকে উৎসারিত, আকাশ যার সীমানা, ব্রহ্মার কল্পনার বাইরে। অদ্ভুতদর্শন আদিবাসীদের ছবি—যাদের নগ্ন আরণ্যক দৃষ্টির অন্তরালে অনন্তের অলৌকিক ইশারা, সবুজ আর বেগুনি আর ঘন লালের ছড়াছড়িতে অদেখা অধরা পরিরাজ্যের স্বপ্নদৃশ্য, বাদামি-হলুদ উত্তপ্ত সূর্যালোকে উদ্ভাসিত উজ্জীবিত বিচিত্র কত প্রাণী আর উদ্ভিদ।

অনেকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার পর বিড়বিড় করে ভিনসেন্ট বললে—হ্যাঁ, তুমিও ঠিক লোত্রেকের মতো। ভালোবাস না, ঘৃণা বর। মন-প্রাণের সমস্ত শক্তি দিয়ে সৃষ্টিকে খালি ঘৃণাই কর।

গগাঁ হেসে উঠল। বললে—তা তো হল। আমার কাজ কেমন লাগল ভিনসেন্ট?

সত্যি কথা বলতে, বুঝতে পারলাম না। ভাববার সময় দাও। তারপর আরও কয়েক বার দেখতে দাও।

বেশ তো। যখন খুশি যতবার খুশি এসে দেখো। সারা প্যারিসে আর একটিমাত্র তরুণ শিল্পী আছে যার ছবি আমারই সমান সমান ভালো। জর্জেস সিউরাত, সেও আছে আদিমকে আঁকড়ে ধরে, বন্যতা নিয়ে তারও কারবার। আর যারা, তারা সভ্য গাধার পাল।

জর্জেস সিউরাত? নাম শুনিনি তো!

শোনবার কথা নয়। শহরের কোনো ছবিওয়ালা তার ছবি টাঙাবে না। তবু, হ্যাঁ, মস্ত বড়ো শিল্পী সে!

তার সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি, গগাঁ?

বেশ তো। নিয়ে যাব তোমাকে। তার আগে চলো, রেস্তরাঁতে বসে ডিনারটা সেরে নিই। পকেটে কিছু—দাঁড়াও দাঁড়াও, দেখি। হ্যাঁ এই তো দু-ফ্র্যাঙ্ক আমার সম্বল। ওঠো। বোতলটা ফেলে দিয়ে কী হবে, নিয়ে চলো। সাবধান, আস্তে আস্তে মেব। পা ফসকালেই ঘাড়টি কিন্তু মটকাবে।

সিউরাতের বাড়ির কাছাকাছি যখন দুজনে পৌঁছোল রাত তখন দুটো।

ভিনসেন্ট স্খলিত কণ্ঠে শুধোলে—এত রাত্রে ডাকাডাকি করলে চটবে না তো?

পাগল! যেমন সারাদিন তেমনি সারারাত্রিই তো ছবি আঁকে! ঘুমোয় কখন লোকটা? এই, এই বাড়ি। বাড়িটা সিউরাতের মা-র। ভদ্রমহিলাই ছেলেকে রেখেছেন, বলেন—আঁকতে চায় আঁকুক। আমি যতদিন আছি ভাবনা নেই। সিউরাতও ভারি ভালো ছেলে, একেবারে আদর্শ যাকে বলে। মদ খায় না, তামাক ফোঁকে না, মেয়েমানুষের পেছনে ঘোরবার বাতিক নেই, ছবি আঁকার মালপত্র ছাড়া বাজে একটি জিনিসে একটি পয়সা খরচ করে না। একটি কেবল মহৎ দোষ, সে হচ্ছে ছবি আঁকা।

ভিনসেন্ট বললে—প্যারিসের তরুণ শিল্পীর পক্ষে এ যে একেবারে অবাক কাণ্ড!

গগাঁ বললে—কানাঘুষোয় শুনেছি কাছাকাছি অন্য বাড়িতে একটি রক্ষিতা আছে, একটি ছেলেও নাকি আছে তার। প্রকাশ্যে ও নিয়ে কোনো কথা নেই।

বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজন। ভিনসেন্ট বললে—সব যে অন্ধকার। ডেকে তুলবে কী করে?

গগাঁ বললে—পিছন দিকে চলো না। ওপরের জানলায় ঠিক আলো দেখবে। ইট মারলেই বেরিয়ে আসবে, তবে সাবধান, মা-র জানলায় যেন না লাগে।

জর্জেস সিউরাত নেমে এসে দরজা খুলে দিল। ঠোঁটে আঙুল দিয়ে কথা বলতে বারণ করে চুপি চুপি সিঁড়ি বেয়ে আগন্তুকদের নিয়ে গেল ওপরের ঘরে। তারপর ঘরের দরজাটা দিল এঁটে বন্ধ করে।

এতক্ষণে কথা বললে গগাঁ—তোমার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম, ভিনসেন্ট ভ্যান গক, থিয়োর ভাই। ছবি অবশ্য আঁকে ডাচম্যানের মতো, তবে বড়ো চমৎকার লোক।

বাড়ির প্রায় সারা তিনতলাটা জুড়ে বিরাট ঘরখানা। দেয়াল জুড়ে বিরাট মাথা-ছাড়ানো উঁচু অসমাপ্ত ক্যানভাস টাঙানো, তাদের সামনে কাঠের মই আর মাচা। মাঝখানে ঝুলছে গ্যাসের গনগনে আলো। তার নীচেই মস্ত একটা টেবিল। টেবিলে ভিজে একটা ক্যানভাস চিত করে শোয়ানো।

আসুন মশিয়েঁ ভ্যান গক, খুশি হলাম আলাপ করে। একটু সময় আমাকে দিন, শুকোবার আগে ছোট্ট একটা চৌখুপিভরতি করে নিই।

একটা উঁচু টুলের ওপর উঁচু হয়ে বসে সিউরাত টেবিলের ক্যানভাসটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। টেবিলের ধারে পরিচ্ছন্নভাবে সার করে প্রায় কুড়িটি রঙের বাটি। সূক্ষ্মতম একটি তুলির ডগা রঙে ডুবিয়ে নিয়ে ক্যানভাসের মাঝখানে একটি ফাঁকা চৌকো জায়গা সিউরাত বিন্দুর পর বিন্দু বসিয়ে ভরতি করতে লাগল। যন্ত্রের মতো কাজ করতে লাগল তার হাত। মুখে কোনো সৃষ্টির অভিব্যক্তি নেই, ভাবটা পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক—শিল্পী নয়, ঠিক কারিগর। সোজা করে তুলিটা ধরে ক্যানভাসের ওপর, তারপর হাত চলে, ফুটকির পর ফুটকি। রং ফুরোলে তুলির ডগাটা রঙের পাত্র একবার ছোঁয় মাত্র, তারপর আবার ঘন সন্নিবিষ্ট রঙিন ফুটকির রাশি ঝাঁকে ঝাঁকে নামে ক্যানভাসের সাদার ওপর।

ভিনসেন্ট হাঁ করে দেখতে লাগল।

একটু পরে সিউরাত মুখ ফেরাল, বললে—ব্যাস, ফাঁকাটা ঠিক ভরাট হয়েছে এবার।

গগাঁ বললে—ভিনসেন্টকে তোমার ছবিটা ভালো করে দেখাও না সিউরাত, ও যে-দেশ থেকে এসেছে সেখানে এখনও লোকে গোরু ভেড়া আঁকে, আধুনিক শিল্পের সঙ্গে ওর মাত্র দিন সাতেকের পরিচয়।

সিউরাত বললে—তাহলে টুলটার ওপর উঠে বসুন, মশিয়েঁ ভ্যান গক।

টুলের ওপর বসে টেবিলে শোয়ানো ছবিটা মন দিয়ে দেখতে লাগল ভিনসেন্ট। এমনি অদ্ভুত দৃশ্য সে জীবনে কখনও দেখেনি, না শিল্পে, না প্রকৃতিতে। গ্রান্ড জাট দ্বীপের দৃশ্য ছবিটি। গথিক গির্জের চুড়োর মতো খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা মানুষ। স্থপতি যেন তাদের সৃষ্টি করেছে অপরিমেয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বর্ণবিন্দু সাজিয়ে। প্রান্তর আর নদী, নৌকো আর বৃক্ষরাজি সবেরই যেন কেমন অস্পষ্ট দুরধিগম্য রূপ, অসংখ্য নিরবচ্ছিন্ন বর্ণোজ্জ্বল আলোকবিন্দু দিয়ে গড়া, এত তরল, এত উজ্জ্বল সব রঙের ব্যবহার যা মানে বা ডেগা বা গগাঁ পর্যন্ত ব্যবহার করতে সাহস করেনি। রঙের পর রং কেমন করে কোথায় মিশছে খুঁজে পাওয়া যায় না, বিন্দুর পর বিন্দুতে যান্ত্রিক কারুকার্যের নির্ভুল সংগতি, মনে হয় এ যেন শিল্পীমনের বিমূর্ত সমন্বয়ের নিস্পন্দ মৃত্যুরাজ্যে সক্রিয় পশ্চাদবর্তন। প্রাণ আছে, যে-প্রাণ প্রকৃতিতে নেই, সমুজ্জ্বল আলো আছে, নেই বায়ুহিল্লোল নেই একবিন্দু নিশ্বাস। প্রস্ফুট প্রকৃতির এ যেন স্তম্ভিত রূপ, চঞ্চল জীবনের মরণাহত শোভাযাত্রা।

ভিনসেন্টের পাশে গগাঁ দাঁড়িয়েছিল। ভিনসেন্টের মুখের চেহারা দেখে সশব্দে হেসে উঠল সে। বললে—হ্যাঁ, সিউরাতের ছবি প্রথমবার দেখলে এইরকমই হাঁ হয়ে যেতে হয়। বলো বলো, কী ভাবছ খুলে বলোই না।

ভিনসেন্ট বিমূঢ়ভাবে সিউরাতের দিকে তাকাল। বললে—আপনি আমাকে মাপ করবেন মশিয়েঁ, কিন্তু গত ক-দিন ধরে আমি বারে বারে এমন সব অভাবনীয় অভিজ্ঞতার ধাক্কা খাচ্ছি যে যেন আর তাল ঠিক রাখতে পারছিনে। হল্যান্ডের শিল্পরীতিতে আমি মানুষ। ইম্প্রেশনিস্ট কাদের বলে তা-ই আমি জানতাম না। এখন হঠাৎ দেখছি, এতদিন ধরে যা-কিছু বিশ্বাস করে এসেছি, সবকিছুই এখানে ধুলোয় লুটোচ্ছে।

গম্ভীরভাবে সিউরাত বললে—আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পেরেছি। আমার শিল্পকর্ম সম্বন্ধে আপনাকে কয়েকটা কথা বুঝিয়ে বলা দরকার। আমার যা রীতি তা সমস্ত চিত্রকলার জগতে প্রচণ্ড একটা বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। এমনি একটা রীতিকে একচোখ দেখেই বুঝে নেওয়া অসম্ভব। ভেবে দেখুন মশিয়েঁ, আজ পর্যন্ত চিত্রকলা যেখানে এসে পৌঁছেছে, তার মূলে রয়েছে কী? শিল্পীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, নিতান্ত নিজস্ব কল্পনা। এই ব্যক্তিগত খেয়ালের বাইরে আমি চিত্রকলাকে নিয়ে যাব, একে আমি একটা বিমূর্ত বিজ্ঞানে পরিণত করব। আমাদের নানা মুহূর্তের নানা রকমের সব ব্যক্তিগত অনুভূতি, সেসবকে সারবন্দি করে রাখতে হবে, মনটাকে বাঁধতে হবে সূক্ষ্ম অথচ নির্ভুল গাণিতিক নিয়মের মধ্যে। মানুষের যা-কিছু ইন্দ্রিয়গোচর উপলব্ধি, তার প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা করে বিচার করে দেখতে হবে, আর প্রত্যেকটির জন্যে ভিন্ন ভিন্ন শিল্পপ্রতীক তৈরি করতে হবে, রেখার প্রতীক, রঙের প্রতীক। টেবিলে এইসব ছোটো ছোটো রঙের বাটিগুলো দেখছেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। অনেকগুলো বাটি।

এই এক-একটি বাটিতে, মশিয়েঁ ভ্যান গক, মানুষের এক-একটি অনুভূতি ভরা আছে। আমার ফর্মুলা অনুসারে, এইসব বাটির আলাদা আলাদা রং কারখানায় · তৈরি হবে, দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে। এলোমেলোভাবে এ-রঙের সঙ্গে ও-রঙ মেশাবার আর কোনো দরকার হবে না। ছবি-আঁকিয়ে সোজা দোকানে যাবে, ছবির বিষয় ও অনুভূতি অনুসারে নির্দিষ্ট রঙের কৌটোগুলি কিনে নিয়ে আসবে। এটা হচ্ছে বিজ্ঞানের যুগ, আমি চিত্রকলাকে বিজ্ঞানের পথে নিয়ে আসব। তবে ছাড়ব। ছবির ঘাড় থেকে ব্যক্তিত্বের ভূতটাকে আমি নামার। শিল্পকলাকে নিয়ে যাব স্থাপত্যের সুনির্দিষ্ট রাস্তায়। আমার কথা আপনি বুঝতে পারছেন, মশিয়েঁ?

ঠিক বুঝছি বলে ভরসা হচ্ছে না।

গগাঁ সিউরাতের অলক্ষে ভিনসেন্টের হাতে একটু খোঁচা মারল। তারপর বললে—দেখো সিউরাত, এই যে রীতি, এটাকে বারে বারে তোমার আবিষ্কার বলে চালাতে যাও কেন, বলো তো? এই তো শুনি তোমার অনেক আগে হাতে–কলমে পিসারো এটা বার করে গেছে!

দপ করে জ্বলে উঠল সিউরাত—মিথ্যে কথা!

সারা মুখটা চকচকে লাল হয়ে উঠেছে। হনহন করে দু-বার পায়চারি করে এসে সে টেবিলের ওপর বসাল বিরাট একটা ঘুসি।

কে বলেছে পিসারো আমার আগে এটা আবিষ্কার করেছে? এটা আমার আবিষ্কার, এই পয়েন্টিলিজম। পিসারো শিখেছে আমার কাছ থেকে! আদি ইতালিয়ানদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত চিত্রকলার ইতিহাস আমি তন্নতন্ন করে পড়েছি। কেউ এ-জিনিস ভাবেনি আমার আগে। তোমার তো বড়ো সাহস যে আমার থিয়োরিটা

ভাঁটার মতো জ্বলতে লাগল চোখ। রাগে মুখ দিয়ে ফেনা বার হয় আর কি!

অবাক হয়ে চেয়ে রইল ভিনসেন্ট। আশ্চর্য! একটু আগে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীর মতো যার শান্ত সমাহিত নিরাসক্ত দৃষ্টি, অধ্যাপকের মতো ধীর গম্ভীর কথাবার্তা, মুহূর্তে সে-লোকটা এমনি পাগলের মতো খেপে উঠে নিজের দাড়ি চুমরোয় আর ঝাঁকড়া চুল ছেঁড়ে কী করে?

ভিনসেন্টের দিকে চোখ টিপে গগাঁ বললে—আরে থামো থামো, পাগল নাকি? বাজে লোকে কত কথা বলে! তুমি ছাড়া পয়েন্টিলিজম থাকত কোথায়! আমরা কি আর তা জানিনে?

আস্তে আস্তে ঠান্ডা হল সিউরাত, টেবিলের কাছে এসে বসল।

ভিনসেন্ট বললে—মশিয়েঁ সিউরাত, শিল্পকলার মূল কথাই হচ্ছে ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি। তাকে ব্যক্তিনিরপেক্ষ বিজ্ঞানে পরিণত করা কি সম্ভব?

নিশ্চয়ই! দাঁড়ান, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

এক বাক্স ক্রেয়ন হাতে নিয়ে সিউরাত বসে পড়ল মেঝের ওপরে। একপাশে বসল ভিনসেন্ট, আর-একপাশে গগাঁ। সিউরাতের গলায় তখনও উত্তেজিত ব্যস্ততা। বললে, আমার মতে ছবি আঁকাকে ফর্মুলার মধ্যে আনা সম্ভব। ধরুন, একটা সার্কাসের দৃশ্য আঁকছি। এখানে খালি ঘোড়ার পিঠে একজন সওয়ার, এখানে সার্কাস ম্যানেজার, আর এ-দিকে দর্শকের দল। কেমন? আচ্ছা, কী অনুভূতিটা আমি প্রকাশ করতে চাই? ফুর্তি, উত্তেজনা—তাই তো? এবার বলুন, ছবি আঁকার মূল উপাদান

উপাদান কী? লাইন, টোন আর রং। বেশ, এবার আমাকে ওই ফুর্তির অনুভূতিটি ফোটাতে হবে। এই দেখুন, সবকটি রেখাকে আমি অনুভূমিকের ওপরে তুলে দিলাম, উজ্জ্বল রংগুলিকে আমি স্পষ্ট করলাম, সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তপ্ত টোনের ব্যবহার করলাম। কী পেলাম? ফুর্তি বলে যে-জিনিসটা আমাদের উপলব্ধিগোচর, পেলাম তার একটা অমূর্ত ধারণা। পেলাম না?

তা হয়তো পেলাম, কিন্তু ফুর্তিটাকে পেলাম না।

সিউরাত মাটি থেকে চোখ তুলে তাকাল। ভিনসেন্ট ভালো করে দেখল, কী সুদৰ্শন লোকটা!

সিউরাত বললে—অনুভূতি ধরতে শিল্পীর মাথাব্যথা নেই, সে চায়, তারও পেছনে সেই অনুভূতির যে-সারাৎসার আছে, তাকে ধরতে। প্লেটো পড়েছেন?

পড়েছি বটে।

বেশ। শিল্পীরা বস্তু আঁকবে না, বস্তুর যে এসেন্স আছে, তাকে আঁকবে। আপনি যদি ঘোড়া আঁকতে চান, আর একটা ঘোড়াই আঁকেন, তাহলে চিত্রকর হয়ে ফোটোগ্রাফার হলেই তো পারতেন। আঁকতে হবে, একটা ঘোড়া দুটো ঘোড়া এমনি করে বিশ্বের সমস্ত ঘোড়ার পেছনে একটিমাত্র যে নির্বিশেষ ঘোটকচরিত্র আছে, তাকে। মানুষ যদি আঁকতে চান, তাহলে রাস্তার মোড়ের ওই পাহারাওয়ালাটাকে আঁকলে চলবে না, আঁকতে হবে চিরন্তন মানুষের নির্বিশেষ আত্মাটাকে। বুঝতে পারছেন?

বুঝতে পারছি, তবে মানতে পারছিনে।

বেশ, মানবেন পরে। মাটি থেকে সার্কাসের ছবিটা মুছে ফেলে উঠে দাঁড়াল সিউরাত।

আচ্ছা এবার ধরুন, একটা শান্ত প্রকৃতির দৃশ্য আঁকতে হবে। এই দেখুন রেখাগুলি সব অনুভূমিক আর সমান্তরাল, টোনে দেখুন গরম-ঠান্ডার কেমন সমন্বয়, রং দেখুন, গভীর রং আর হালকা রং সমান সমান। দেখতে পাচ্ছেন?

গগাঁ বললে—আজেবাজে প্রশ্ন করে বক্তৃতাটা নষ্ট কোরো না সিউরাত। বলে যাও—

আচ্ছা বেশ। এবার ধরুন, দুঃখের অনুভূতি। চিত্রে এই অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। লাইনগুলি নামবে ওপর থেকে নীচে, এইরকম। টোন হবে ঠান্ডা, গভীর রংগুলো হবে স্পষ্ট। এই দেখুন, দুঃখের যা সারাৎসার তা ধরা পড়ে গেছে!! ক্যানভাসে কীভাবে জায়গা ছাড়তে হবে, কোথায় কোন বস্তু বসাতে হবে তা একেবারে জ্যামিতিক নির্ভুলতায় মেপেজুখে ঠিক করে ছোট্ট ছোট্ট বইয়ের আকারে বার করা যেতে পারে। আমি এমনি একটা বইয়ের মালমশলা জোগাড় করেও ফেলেছি। শিল্পীর কাজ হবে কেবল বই মুখস্থ করে নেওয়া, তারপর রঙের দোকানে গিয়ে নির্দিষ্ট রঙের পাত্রগুলি কিনে আনা। তারপর নিয়মগুলি মানলেই হল। চমৎকার ছবি-আঁকিয়ে হবে সে, বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক হবে তার কাজ। রৌদ্রেই আঁকুক কি ছায়াতেই আঁকুক, সাধুই হোক কি লম্পটই হোক, বয়স হোক সাত বা সত্তর, তার হাতের কাজে স্থপতিসুলভ বৈজ্ঞানিক সম্পূর্ণতা আসবেই। চোখ পিটপিট করতে লাগল ভিনসেন্ট। হেসে উঠল গগাঁ, বললে—জর্জেস, ও ভাবছে তুমি একটা আস্ত পাগল।

তা-ই ভাবছেন নাকি, মশিয়েঁ ভ্যান গক?

না না, তা ভাবব কেন? প্রতিবাদ জানিয়ে ভিনসেন্ট বলে–আমাকেই কত সময়ে কত লোকে বলেছে পাগল। কী এসে গেছে তাতে আমার? তবে কিনা, এটা বলবই যে আপনার এসব আইডিয়া খুবই অসাধারণ।

গগাঁ বললে—ওই দেখলে তো? সোজা কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে বলল যে তুমি শুধু পাগল নও, বদ্ধ পাগল।

দরজায় ধাক্কা পড়ল। সিউরাতের মা-র ঘুম ভেঙেছে। আর আড্ডা নয়। এবার সরে পড়তে হবে।

বাড়ির সদরদরজা পর্যন্ত বন্ধুদের পৌঁছে দিতে এসে সিউরাত বললে ভিনসেন্টকে—আপনাকে হয়তো আমার সব কথা খুব স্পষ্ট করে বোঝাতে পারলাম না, মশিয়েঁ ভ্যান গক। যখন খুশি আপনি আসবেন। দুজনে একসঙ্গে কাজ করব। কাজের মধ্যে দিয়েই বোঝাপড়া হবে। আমার যা পদ্ধতি তা যদি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন তাহলে চিত্রকলা সম্বন্ধে আপনার এতদিনের যা কিছু ধারণা সব বদলে যাবে। আচ্ছা চলি, ছবিটার আর-একটা চৌখুপি ফুটকি দিয়ে ভরতি করা এখনও বাকি আছে, সেরে ফেলি গে।

আকাশে তখনও শেষ রাতের জড়িমা। ঘুমন্ত নগরী। ভিনসেন্ট আর গগাঁ খাড়াই বেয়ে মোমার্তের দিকে চলল। দু-ধারের ঘর-বাড়ি-দোকানের দরজা জানলা বন্ধ, রাস্তায় দু-একটি সবজি আর দুধের গাড়ি বার হয়েছে।

গগাঁ বললে—চলো, খাড়াইয়ের মাথায় উঠে সূর্যোদয়ে প্যারিসের ঘুম-ভাঙ দেখি।

চলো।

বুলেভার্দ ক্লিচি থেকে রু লেপিক ধরে তারা এগোল। রাস্তাটা শেষ পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে মোমার্ত পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত গিয়েছে।

বাড়িঘর বিরল হয়ে আসছে। রাস্তার দু-পাশে ফাঁকা মাঠ, গুল্মরাজি আর গাছপালা দেখা যাচ্ছে। রু লেপিক ছেড়ে পায়ে-চলা একটা কাঁচা রাস্তা নিল দুজন।

ভিনসেন্ট বললে—আচ্ছা গগাঁ, খুলে বলো তো সিউরাত সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা?

জর্জেসের কথা বলছ? আমি ঠিক ভেবেছিলাম এ-কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করবেই। রং যদি বল তো বলব, একমাত্র দেলাক্রোয়ার পর রং ওর মতো আর কেউ বোঝে না। তবে আর্টের যেসব থিয়োরি নিয়ে ও মাথা ঘামায়, সেগুলো বাজে। শিল্পী যে, সে কি বুদ্ধিজীবী? অত ভাববে কেন সে? মাস্টারি কেন সে করবে? আঁকাই তার কাজ, আঁকাই তার ধর্ম, সে শুধু আঁকবে। আর্টের যারা সমালোচক, তারা থিয়োরি কপচাক যত খুশি। রঙের দিক থেকে সিউরাতের নিজস্ব একটা অবদান থাকবে নিশ্চয়ই, আর ছবির মধ্যে স্থাপত্যের ভাবটা ওই যে ও এনেছে, আধুনিক শিল্পের আদিমতার প্রতি যে-আকর্ষণ দেখা যাচ্ছে, সেই আকর্ষণ হয়তো ওতে জোরালো হয়ে উঠবে। তবে এসব বাদ দিয়ে সোজা কথাটা যদি বলতে হয় ও হল বদ্ধপাগল, তুমি নিজেই তা দেখেছ।

খাড়াইটা কম নয়, বেশ পরিশ্রম হল চুড়োয় উঠতে। সামনে ছবির মতো বিছিয়ে রয়েছে সারা শহরটা। সার সার অসংখ্য বাড়ির মাথা। মাঝে মাঝে কালো কুহেলির আবরণ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে গির্ভের চুড়ো। বঙ্কিম আলোকরেখার মতো সিন নদীটাকে দেখাচ্ছে। শহরটাকে দু-ভাগে ভাগ করেছে এই নদী। মোমার্ত পাহাড়ের ঢালু বেয়ে বাড়িঘর নামতে নামতে সিন পার হয়ে আবার মোপার্নাসের দিকে ঠেলে উঠেছে।

সূর্য উঠল, অন্ধকার ভেদ করে আকাশে মাথা তুলে খাড়া হয়ে দাঁড়াল শহরের তিন অতিকায় প্রহরী—পুবদিকে নতেরদাম, মাঝখানে অপেরা আর পশ্চিমদিকে আর্চ অব ট্রায়াঙ্ক।

রু লেপিকের ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে শান্তি নেমেছিল ক-দিনের জন্যে। থিয়ো ভেবেছিল গ্রহভাগ্য সুপ্রসন্ন। কিন্তু নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী তা। গাঢ় গ্যালেটের বদলে উজ্জ্বলতর রঙের পথে প্রকৃত অনুশীলন ও পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে না গিয়ে একটা সোজা রাস্তা বেছে নিল ভিনসেন্ট। সে হচ্ছে নতুন শিল্পীবৃন্দদের অন্ধ অনুকরণ করা। ইম্প্রেশনিস্ট হবার মত্ত আগ্রহে সে এতদিন যা-কিছু শিখেছিল সব বিসর্জন দিল। তার নিজের আঁকা বলে আর-কিছু রইল না, যা আঁকে তা হয় সিউরাত, নাহয় গগা নাহয় লোত্রেকের বীভৎস কৃত্রিম অনুকৃতি। এতেই তার আনন্দ, ভাবে দারুণ কিছু একটা করছে, এগিয়ে চলছে জোর কদমে।

একদিন রাত্রে থিয়ো বললে–তোমার নামটা কী বলো তো ভিনসেন্ট?

কেন? ভিনসেন্ট ভ্যান গক।

ঠিক বলছ? ভুল হয়নি তো? জর্জেস সিউরাত বা পল গগাঁ নয়?

হঠাৎ এমনি ঠাট্টা কেন? কী বলতে চাও তুমি?

বলছি, ধৈর্য ধরো। সত্যিই কি তুমি ভাব তুমি দু-নম্বর সিউরাত হতে পারবে? সত্যিই কি তুমি বোঝ না যে সৃষ্টির শুরু থেকে শেষের মধ্যে তুলস–লোত্রেক ওই একটিই জন্মাবে, আর ভগবানকে ধন্যবাদ যে ওই একটির পর দুটি গগাঁ আর গজাবে না? তাহলে? ওদের নকলনবিশি করে লাভ কী?

নকলনবিশি আমি করছিনে, আমি শিক্ষানবিশি করছি।

না, নকলনবিশি। তোমার যেকোনো একটা নতুন ক্যানভাস আমাকে দেখাও, আমি ঠিক বলে দেব সেটা আঁকবার আগের দিনের সন্ধেটা কার সঙ্গে তুমি কাটিয়েছ।

কিন্তু এতে তো আমার উন্নতিই হচ্ছে। দেখো, কত হালকা হয়ে এসেছে আমার রং।

উন্নতি হচ্ছে! দিনের পর দিন গড়িয়ে গড়িয়ে রসাতলে যাচ্ছ। রোজ একখানা করে ক্যানভাসে রং বোলাচ্ছ, প্রতিটি ছবিতে ভিনসেন্ট ভ্যান গকের পরিচয়টা মুছে মুছে যাচ্ছে। অত সস্তায় বাজিমাত হয় না। অনেক বছরের কঠোর পরিশ্রম এখনও বাকি। হ্যাঁ, এই পরিশ্রমের মধ্যে দিয়েই অপরের যা ভালো তা আত্মসাৎ করে নিতে পারো; অনুকরণ করে নয়।

থিয়ো, আমি তোমাকে বলছি এ-ছবিগুলো ভালো হয়েছে।

হ্যাঁ, আমিও তোমাকে বলছি ওগুলো জঘন্য হয়েছে।

লড়াই চলল দিনের পর দিন।

রোজ সন্ধ্যা বেলা সারাদিনের কর্মক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরে থিয়ো নতুন ছবি-হাতে ভিনসেন্টের সম্মুখীন হয়। মারমুখো ভিনসেন্ট, হাতের ক্যানভাস যেন মারণাস্ত্র।

থিয়োকে মাথার টুপিটা খোলবার সে অবসর দেয় না।

নাও, দেখো এইবার। বলো এটা ভালো হয়নি? বলো রং ঠিক হয়নি, বলো সূর্যের আলোর প্রতিফলনটা ঠিক ফোটেনি, বলো–

থিয়োর দুটো পথ। হয় মিথ্যে কথায় ভাইকে শান্ত করে নিজে কিছুটা শান্তি ভোগ করা, না-হয় রূঢ় সত্যি কথা বলে সারারাত্রি পাগলের পাগলামির সঙ্গে যুদ্ধ করা।

ক্লান্ত শরীর সত্যি কথার ভার সয় না। তবু মন-ভোলানো মিথ্যে বলতে সে পারে না।

কাল বুঝি অমুক প্রদর্শনীতে গিয়েছিলে?

কেন? ও-কথা আসে কোত্থেকে?

উত্তরই দাও না।

অপ্রতিভ মুখে ভিনসেন্ট বলে—হ্যাঁ, গিয়েছিলাম, কাল বিকেলে।

সুস্পষ্ট ভাষায় দৃঢ় কণ্ঠে এবার থিয়ো বলে—তুমি জান ভিনসেন্ট, এই প্যারিসে এই মুহূর্তে অন্তত পাঁচশোটা আঁকিয়ে আছে যারা প্রাণপণ চেষ্টা করছে শুধু এডোয়ার্ড মানেকে নকল করতে। আর তাদের অধিকাংশই এই নকলের কাজটা তোমার চাইতে অনেক ভালোই পারে।

এরপর ভিনসেন্ট একটা নতুন কৌশল করল। সমস্ত ইম্প্রেশনিস্টদের এনে সে পুরল একটা ক্যানভাসে। এইবার ধরুক থিয়ো, বলুক দেখি কী বলে!

থিয়ো বললে—চমৎকার! সব পড়া মুখস্থ করে ফেলেছ দেখছি! এককথায় ছবিটার নাম দেওয়া যাক—রোমন্থন, কেমন? তারপর ছবিটার নানান জায়গায় এটা-ওটা লেবেল মেরে দিলেই হবে এখন।….এই যে গাছটা, এটা হচ্ছে গগাঁ। কোণের ওই মেয়েটা, ওটা নির্ঘাত তুলস-লোত্রেক। নদীর জলের যেখানটায় রোদ এসে পড়েছে, ওখানটায় লেবেল পড়বে সিসলের। তারপর রংটা মনে, পাতাগুলো পিসারো, আকাশটা সিউরাত আর সামনের মূর্তিটা মানে।

সে-দিন আর-একটি কথা বলল না ভিনসেন্ট।

.

নিষ্ঠুর লড়াই শুরু হল দু-ভাইয়ের মধ্যে। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম সে করে, আর সন্ধে বেলা থিয়ো এসে তাকে ধমকায় ছোটোছেলেকে শাসন করার মতো। কথায় কথা বাড়ে, তুমুল ঝগড়া চলে দুজনের। একটিমাত্র ঘর দুজনের, থিয়ো ঘুমোতে চায়, ভিনসেন্টের জ্বালা-ধরা চোখ, মাথার মধ্যে আগুন। তর্ক করতে করতে শেষ পর্যন্ত ক্লান্ত হয়ে থিয়ো গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বোজে। দপদপ করে আলো জ্বলে, ভিনসেন্টের চিৎকার আর হাত-পা নাড়া তখনও থামে না। থিয়ো ভাবে কোনদিন সে পাগল হয়ে যাবে, একটিমাত্র আশা, তার আগে হয়তো রু লেপিকে নতুন বাসাটা মিলবে, সেখানে আলাদা একখানা শোবার ঘর থাকবে তার আর দরজায় লাগাতে পারবে শক্ত মোটা একটা তালা।

নিজের ছবি নিয়ে তর্ক করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে ভিনসেন্ট, তখন সে আর্ট, আর্টের ব্যাবসা আর আর্টিস্টের জীবন নিয়ে হুহুংকৃত আলোচনায় থিয়োর নিদ্রাহীন রাত্রের ব্যর্থ প্রহরগুলোকে উত্যক্ত করে তোলে।

বলে—এটা আমি বুঝতে পারিনে, প্যারিসের একটা সেরা গ্যালারির ম্যানেজার হয়েও তুমি কিনা তোমার নিজের ভাইয়ের একটা ছবি সেখানে টাঙাবে না!

থিয়ো বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে—দেখো, আমি তো মালিক নই। আমার মতের ওপরেও মালিকের মত তো আছে?

একবারও চেষ্টা করেছ তুমি?

হাজার বার।

বেশ, স্বীকার করলাম আমার ছবি তোমার গ্যালারিতে স্থান পাবার উপযুক্ত নয়। কিন্তু সিউরাত? গগাঁ? লোত্রেক? তারাও বরবাদ?

প্রত্যেক বার তারা নতুন ছবি শেষ করে, আর প্রত্যেক বারই আমি চেষ্টা করি, কিন্তু কারুর?

বুঝেছি। একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, গ্যালারিটা কার? তোমার, না আর

মালিকের। আমি তো কর্মচারী।

তার মানে, তোমার কোনো অধিকার নেই, কোনো ক্ষমতা নেই। কী লজ্জা! আমি হলে কিছুতেই সহ্য করতাম না, লাথি মেরে চলে আসতাম!

কাল সকালে এ-আলোচনা হবে ভিনসেন্ট। আজ আমি বড়ো ক্লান্ত, ঘুমোতে দাও।

ঘুমোলেই হল? এ-ব্যাপারটার এখুনি মীমাংসা হওয়া দরকার। মানে আর ডেগা—এদের ছবি টাঙিয়ে লাভ কী? এদের নাম তো হয়েছেই। যারা নবীন, যারা অপরিচিত, তাদের জন্যেই তো এখন লড়াই করা দরকার।

সময় দাও আশকে। ধরো, আর বছর তিনেক পরে–

তিন বছর! এতদিন অপেক্ষা করবে কে? শোনো থিয়ো, এ-চাকরিটা ছেড়ে দাও, নিজের একটা গ্যালারি ধরো। তা নয়তো কিনা পরের গোলামি? ছিঃ!

নিজের গ্যালারি করতে হলে টাকা লাগে ভিনসেন্ট। মূলধন কোথায় পাব!

যেখান থেকে পারি জোগাড় করব আস্তে আস্তে!

আর ব্যাবসা? ব্যাবসা কি একদিনে হয়? বিশেষ করে ছবির ব্যাবসা জমতে কত দেরি লাগে তার কোনো ঠিক নেই।

হোক দেরি। দিনরাত্রি আমরা খাটব। তোমার গ্যালারি দাঁড় করিয়ে তবে ছাড়ব শেষ পর্যন্ত। তার জন্যে যতদিন লাগে লাগুক।

আর ততদিন পয়সা জুটবে কোথা থেকে? খাব কী?

ও বুঝেছি! আমি রোজগার করিনে, আমি তোমার গলগ্রহ, তাই বুঝি খুঁড়ছ?

দোহাই ভিনসেন্ট, শুয়ে পড়ো। আমি আর পারছিনে!

না শোব না, কিছুতে শোব না! এ-কথাটার এক্ষুনি একটা মীমাংসা হোক। আমি তোমার গলায় পাথর হয়ে ঝুলছি, আমি তোমার ভানা বেঁধে রেখেছি, এই তো? আমি যদি না থাকতাম, তুমি মুক্তি পেতে, চাকরি ছাড়তে, ব্যাবসা করে বড়োলোক হতে পারতে, এই না? বলো বলো, ঢেকে রেখো না, সত্যি কথা খুলে বলো!

নিতান্ত ক্লান্ত গলায় থিয়ো জবাব দিলে—দেখো, আমার গায়ে যদি আরও কিছুটা জোর থাকত, তোমাকে আমি আগাপাশতলা মার লাগাতাম। নিজে যখন তা পারব না, তখন গগাঁকে ডেকে তোমাকে একদিন ভালো করে পেটাব। একটা কথা কেন বোঝ না ভিনসেন্ট? তোমার আমার জীবন আলাদা, ভাগ্য আলাদা। আমি গুপিলে চাকরি করব, আজ যেমন করছি চিরদিনই তেমনি করব। তোমার কাজ ছবি আঁকা, আজ যেমন আঁকছ, চিরদিনই তেমনি আঁকবে। গুপিল থেকে যা আমি পাব, তার অর্ধেক তোমার। আর তুমি যা আঁকবে, তার অর্ধেক আমার। এই তো আমাদের মধ্যেকার চুক্তি। তা-ই নয়? বেশ, এখন লক্ষ্মীছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ো। আর যদি জ্বালাতন কর তো পুলিশ ডাকব।

.

পরদিন সন্ধ্যা বেলা থিয়ো একটা খাম দিল ভিনসেন্টের হাতে। বললে—চলো আমার সঙ্গে এই পার্টিতে।

পার্টি! কে দিচ্ছে?

হেনরি রুসো। আহা, নেমন্তন্নর চিঠিখানা খুলে দেখো একবার।

সুন্দর একটি কবিতা। কার্ডের কোণে কোণে হাতে আঁকা পুষ্পগুচ্ছ।

ভিনসেন্ট শুধোলে লোকটি কে?

এককথায় বলা মুশকিল। চল্লিশ বছর বয়েস পর্যন্ত ছিল কাস্টমস-এর কালেকটর। মফস্সলে থাকত, গগার মতো রং তুলি নিয়ে খেলা করত রবিবার রবিবার। ক-বছর আগে একবার প্যারিসে এল, আর ফিরে গেল না। এখন বাস্টিলের কাছে শ্রমিকপল্লিতে থাকে। কোনোরকম শিক্ষা পায়নি, তবু ছবি আঁকে, কবিতা লেখে, সুর বাঁধে। বেহালা আর পিয়ানোর মাস্টারি করে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের, কটা বুড়োকে ড্রয়িং শেখায়।

ছবি কী আঁকে?

অদ্ভুত অদ্ভুত জঙ্গলের জটলা থেকে কিম্ভূত কিম্ভুত জানোয়ার। আসলে লোকটা চায়া, জঙ্গল দেখুক আর না দেখুক, আর গগাঁ ওকে যতই ঠাট্টা করুক, সত্যিকারের আদিম বন্যতা ওর রক্তে।

কিন্তু আসলে আঁকে কেমন? তোমার মত কী?

বলতে পারব না, বা বলব, বুঝতে পারিনে। সবাই বলে ও মাথামোটা পাগল।

সত্যি?

আসলে লোকটার মনটা একটা আরণ্যক শিশুর মতো। গেলেই বুঝবে। তা ছাড়া ছবিও দেখতে পাবে।

কিন্তু এসব পার্টি-টার্টি দ্যায় কী করে? পয়সা আছে নিশ্চয়ই?

সারা প্যারিসে যত আঁকিয়ে আছে ওর মতো গরিব কেউ নেই। বেহালাটা পর্যন্ত ভাড়া করা, কেননা কেনবার সামর্থ্য নেই। কিন্তু পার্টি দেবার ওর উদ্দেশ্য আছে, গেলেই টের পাবে।

যে-বাড়িটাতে রুসো বাস করে সেটা একেবারে দিনমজুরদের আস্তানা। পাঁচতলার ওপরে রুসোর একখানা ঘর। রাস্তার ধারে ধারে বস্তি, বাড়িটার মধ্যে ঢুকলেই নাকে আসে রান্নাঘর আর নোংরা পায়খানার গন্ধের একাকার।

থিয়ো ঘরের দরজায় টোকা দিল। দরজা খুলল রুসো, সম্ভ্রম-ভরা মৃদু গলায় বলল—আসুন, আসুন মশিয়েঁ ভ্যান গক, আমার আমন্ত্রণটা রেখেছেন, ধন্যবাদ আপনাকে।

হৃষ্টপুষ্ট সমর্থ হেঁটে চেহারা। চৌকো মাথা, থ্যাবড়া নাক আর চিবুক। বড়ো বড়ো দুটি চোখে সরল চাউনি।

থিয়ো ভিনসেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। চেয়ার টেনে বসল দুজনে। ঘরটি দিব্যি সাজানো, ঠিক যেন পার্টিরই জন্যে। জানলায় লাল-সাদা চৌখুপি কাপড়ের পর্দা, দেয়ালভরতি ছবি। একধারে পুরোনো পিয়ানোটার পাশে চারটি ছোটো ছোটো ছেলে বেহালা হাতে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। ফায়ার প্লেসের ওপরের তাকের ওপর নানা রঙের কেক আর পেস্ট্রি-পিঠে, রুসোর নিজের হাতে তৈরি। এ-দিকে ও-দিকে কয়েকটি বেঞ্চি আর চেয়ার।

রুসো বললে—আপনারাই প্রথম এলেন মশিয়েঁ ভ্যান গক। চিত্রসমালোচক গিলুম পিলেও দয়া করে আসবেন বলেছেন তাঁর একটি দল নিয়ে

পাথর বসানো রাস্তায় গাড়ির চাকার আওয়াজ, শিশুদের কলকণ্ঠ। মান্য অতিথিরা এলেন। রুসো তাড়াতাড়ি ঘরের দরজাটা খুলল। শোনা গেল কয়েকটি চপল অস্ফুট নারীকণ্ঠ। তাদের পেছনে ভারি একটা পুরুষের গলা—ওঠো, ওঠো, দাঁড়িয়ে পোড়ো না সিঁড়িতে। একটা হাত রেলিঙে, আর-একটা হাত নাকে, তাহলেই তো হল।

খিলখিল শব্দে হাসল মেয়েরা।

ঠাট্টাটা রুসোরও কানে এসেছিল স্পষ্ট। সে ভিনসেন্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে মুচকি হাসল একটু। ভিনসেন্টের মনে হল এমনি বিদ্বেষহীন স্বচ্ছ সরল চোখ আর কারুর কখনও দেখেনি।

হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল দশ-বারোটি প্রাণী, মেয়ে-পুরুষ। পুরুষদের অঙ্গে সান্ধ্য পোশাক, মেয়েদের পরনে দামি দামি গাউন, হাতে সাদা সিল্কের দস্তানা, পায়ে নরম ভেলভেটের জুতো। ঘর ভরে গেল বিভিন্ন সুরভির সংমিশ্রণে।

চিত্রসমালোচক পিলে দাম্ভিক গুরুগম্ভীর গলায় হেঁকে উঠলেন—কী হে রুসো, এই দেখো, তোমার নেমন্তন্ন রাখতে এলাম তো! বেশিক্ষণ কিন্তু থাকতে পারব না, একটা বলনাচের আসরে আবার যেতে হবে। নাও, তাড়াতাড়ি খাতির যত্ন করো আমার বন্ধুদের।

বুকের ঊর্ধ্বাংশ খোলা সুদীর্ঘ গাউন পরা একটি পিঙ্গলকেশী তরুণী বলে উঠল—আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিন শিল্পীর। আপনি মশিয়েঁ রুসো? সারা শহরে যাঁর নাম? আমার হাতটি আপনি চুশন করবেন না?

আর কে একজন বলে উঠল—সাবধান ব্লাঞ্চ, এসব শিল্পীদের তুমি চেন না। এরা কিন্তু—

রুসো মেয়েটির করচুম্বন করল। ভিনসেন্ট সরে গেল ঘরের এক কোণে। পিলে কথাবার্তা বলতে লাগলেন থিয়োর সঙ্গে। দলের অন্যান্য সকলে জোড়ায় জোড়ায় ঘুরতে লাগল সারা ঘরে, নাড়াচাড়া করতে লাগল জিনিসপত্র। বিদ্রুপভরা কথার ফাঁকে ফাঁকে উচ্ছ্বসিত হতে লাগল কুটিল রসিকতা তীক্ষ্ণ হাসির দমকে।

রুসো বললে—ভদ্রমহোদয় ও মহিলারা, আপনারা দয়া করে বসুন। এখন অর্কেস্ট্রা শুরু হবে। আমারই একটি রচনা আপনারা শুনবেন, এটি আমি উৎসর্গ করেছি মশিয়েঁ পিলের নামে।

বোসো, বোসো সবাই, পিলে হাঁকলেন—জিনি, ব্লাঞ্চ, জ্যাকেস, আর কথা নয়, গোলমাল কোরো না কেউ, চুপ করে বাজনা শোনো।

চারটি বালক কম্পিত হাতে নিজের নিজের বেহালা বেঁধে নিল। রুসো পিয়ানোতে বসে দু-চোখ বন্ধ করল কয়েক মুহূর্তের জন্যে। তারপর বললে, রেডি।

বাজনা শুরু হল। মন-মাতানো সরল গ্রাম্য সুর। ভিনসেন্ট কান পেতে ভালো করে শুনতে চেষ্টা করল, কিন্তু অতিথিদের চাপা হাসির শব্দে ডুবে গেল সংগীত। বাজনা শেষ হওয়ামাত্র সমস্বর কোলাহলে সকলে অভিনন্দন জানাল সুরকারকে। ব্লাঞ্চ পিয়ানোর কাছে উঠে গিয়ে রুসোর দু-কাঁধে হাত রেখে গুনগুন করে উঠল—কী মধুর, কী সুন্দর মশিয়েঁ, আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেছি!

রুসো বললে—কিছুই না, আপনি আমাকে এতটা বাড়াবেন না মাদাম! খিলখিল হাসিতে ব্লাঞ্চ লুটিয়ে পড়ে আর কি।—শুনছ, শুনছ গিলুম শিল্পী কী বলছে? আহা, কী বিনয়!

রুসো ঘোষণা করলে—এবার আর-একটি সুর আপনারা শুনুন।

পিলে বললেন—না,’ শুধু বাজনা নয়, সেইসঙ্গে তোমার লেখা একটা গানও শোনাও।

শিশুর হাসিতে উদ্ভাসিত রুসোর মুখ।

বেশ, বেশ, গানও শুনুন।

টেবিল থেকে গানের খাতাটি নিয়ে একটি গান বেছে রুসো আবার গিয়ে বসল পিয়ানোতে। বাজনা শুরু হল, সেইসঙ্গে রুসোর গান। ভিনসেন্টের মনে হল সুরটি ভালোই। কিন্তু বাজনার সঙ্গে রুসোর কণ্ঠ মিশে যে-রস পরিবেশিত হল, তা প্রায় বীভৎস রসেরই সামিল। হাঁটু চাপড়িয়ে অট্টহাস্য করতে লাগল শ্রোতারা।

গান-বাজনা শেষ হবার পর রুসো রান্নাঘরে গিয়ে মোটা মোটা কাপভরতি কফি এনে অতিথিদের হাতে তুলে দিল। সঙ্গে ঘরোয়া খাবার

পিলে বললেন—কই রুসো, নতুন কী সব ছবি আঁকলে দেখাও! ল্যুভর মিউজিয়ামে চালান হবার আগে তোমার স্টুডিয়োতে বসে সেগুলো দেখে কৃতার্থ হই!

আর একজন বললে—হ্যাঁ হ্যাঁ, সেইজন্যেই তো আমাদের আসা!

রুসো বললে—নিশ্চয়! চমৎকার কয়েকটা ছবি আছে। আপনাদের দেখাব বলেই তো আলাদা করে বেছে রেখেছি।

ছবিগুলো একের পর এক সাজিয়ে রাখতে লাগল টেবিলের ধারে। সবাই ঘিরে দাঁড়াল। স্তুতিভাষণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল যেন।

ব্লাঞ্চ বললে—এইটে! হ্যাঁ এই ছবিটা! ক্লী স্বর্গীয় রূপ! এমন সৃষ্টি পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি হবে না! এটা আমার চাইই, এখনই চাই। নইলে রাত্রে ঘুমোব কী করে! কত হলে এটা আমাকে দেবেন মশিয়েঁ?

দাম? কিছু না কিছু না। পঁচিশ ফ্র্যাঙ্ক।

পঁচিশ ফ্র্যাঙ্ক মাত্র? শুনেছ, শুনেছ সবাই! এই অমর শিল্প, এর দাম পঁচিশটি ফ্র্যাঙ্ক খালি। মশিয়েঁ, আমাকে দিলেন—এই কথাটি ছবির নীচে লিখে দেবেন তো?

সে আর বলতে? এ তো আমার ভাগ্যের কথা।

পিলে বললেন—আমার প্রণয়িনীকে বলেছিলাম তার জন্যেও একটা ছবি আনব। কোনটা নিই বলো তো?

দেয়াল থেকে একটি ছবি নামিয়ে রুসো বললে—এটি কিন্তু আমি আপনার কথা ভেবেই এঁকেছিলাম। এটা আপনার ভালো লাগবেই।

সবাই ঝুঁকে পড়ল ছবিটির ওপর। রূপকথার জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে মুখ বার করা প্রাগৈতিহাসিক একটি প্রাণী।

পিলে মাথা নেড়ে বললেন—সত্যি, এত ভালো ছবি আর তুমি আঁকনি রুসো।

চিৎকার করতে লাগল অন্য সবাই।

ওটা আবার কী? ওঃ বাবা!

তাই তো? ওটা কীসের মুখ!

সিংহ নাকি ?

যাঃ! সিংহ বুঝি অমনি হয়! ওটা বাঘ!

রামো! ওটাকে আমি ঠিক চিনেছি। আমার ধোপানির মুখ ওটা।

বললেই হল? ও তো আমার পাওনাদার, গুঁড়ি মেরে আসছে!

হাত কচলিয়ে বিগলিত কণ্ঠে রুসো বললে—এটার দাম একটু বেশি হবে মশিয়েঁ পিলে। সাইজে একটু বড়ো কিনা! ধরুন, তিরিশ ফ্র্যাঙ্ক।

বেশি কী বলছ হেনরি, জলের মতো সস্তা! আমার ভবিষ্যৎ বংশধর হয়তো কোনোদিন এটাকে তিরিশ হাজার ফ্র্যাঙ্কে বিক্রি করবে!

আমি নেব, আমার একটা চাই! আরও অনেকে চেঁচামেচি করতে লাগল।

উদার ভঙ্গিতে পিলে বললেন—বেশ, বেশ, যে যা নেবে নগদ দাম দিয়ে নাও। তারপর চটপট চলো, দেরি করলে মুশকিল হবে। …আচ্ছা আজকের মতো চলি হেনরি। শিগগির আবার একদিন এমনি পার্টি দিয়ো, কেমন? সুন্দর কাটল, তা-ই না?

ভুরভুরে সুগন্ধি রুমালখানি রুসোর নাকের সামনে নাড়ল ব্লাঞ্চ, বললে—বিদায় শিল্পীপ্রবর, বিদায়! কিন্তু তোমাকে কখনও ভুলব না জীবনে। আমার স্মৃতিতে তোমার মুখটি চিরদিন জেগে থাকবে।

পুরুষদের মধ্যে একজন বললে—আর জ্বালিয়ো না ব্লাঞ্চ, রাত্রে ঘুম হবে না বেচারির।

অতিথিরা কলরব করতে করতে বিদায় নিল। বাতাসে ফেলে গেল কিছুটা বসনসুরভি।

থিয়ো আর ভিনসেন্ট তারাও এগোল দরজার কাছে। দরজার কাছে গিয়ে ভিনসেন্ট নীচু গলায় বললে–তুমি একাই যাও থিয়ো। আমি আর-একটু থাকি, আলাপ করি ওর সঙ্গে।

বিদায় নিল থিয়ো।

রুসো লক্ষ করেনি ভিনসেন্ট দরজাটা বন্ধ করে কখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে টেবিলের ওপর ছড়ানো ফ্র্যাঙ্কগুলো শুনছিল একমনে।

আশি, নব্বই, একশো, একশো পাঁচ।

মুখ তুলে তাকাতেই দেখল, ভিনসেন্ট একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। সেই শিশুসুলভ দৃষ্টিটা ফিরে এল তার চোখে। টাকাগুলো সরিয়ে বোকা বোকা হাসিমুখে ভিনসেন্টের দিকে তাকাল।

ভিনসেন্ট স্থির গলায় বললে—মুখোশটা খুলে ফেলো রুসো। আমি তোমাদের শহুরে আদমি নই। তোমার মতো আমিও চাষা, আর আমিও ছবি–আঁকিয়ে।

টেবিল থেকে ঘুরে ভিনসেন্টের সামনে এসে রুসো চেপে ধরল ভিনসেন্টের হাত।

তোমার ভাইয়ের কাছে দেখেছি তোমার আঁকা ডাচকৃষাণদের সব ছবি ভালো ছবি, মিলেটের চেয়েও ভালো। একবার নয়, বার বার ছবিগুলো দেখেছি। না চিনলেও মনে মনে শ্রদ্ধা করেছি তোমাকে।

আর তোমার ওইসব ওরা যখন ভাঁড়ামি করছিল, সেই অবসরে তোমার ছবিগুলোও আমি দেখেছি, রুসো। আমিও তোমাকে শ্রদ্ধা করি।

ধন্যবাদ। বসবে না? তোমার পাইপে আমার তামাক একটু ভরবে না? দেখো, একশো পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক জুটল। এ দিয়ে তামাক হবে, খাবার হবে, ছবি কিনবার জিনিসপত্র হবে।

টেবিলের দু-ধারে মুখোমুখি দুজনে বসে নিঃশব্দে ধূমপান করতে লাগল। নীরবে চিন্তার রোমন্থন।

কিছুক্ষণ পরে ভিনসেন্ট বললে—তুমি নিশ্চয় জান রুসো, ওরা সবাই তোমাকে পাগল ভাবে?

জানি। এও আমি শুনেছি যে হেগ-এর লোকেরাও তোমাকে পাগল বলেই জানত।

ঠিকই শুনেছ।

ভাবুক না ওরা যা প্রাণ চায়। দিন আমার আসবে। আমার ছবি লুক্সেমবুর্গ গ্যালারিতে ঝুলবে একদিন-না-একদিন।

আলবত! আর আমার ছবি ল্যুভরে।

দুজনের মনের কথা এক লহমায় দুজনেই যেন একসঙ্গে ধরতে পারল। প্রাণখোলা খুশির উচ্ছ্বাসে হেসে উঠল হো-হো করে।

ভিনসেন্ট বললে—ওদের কোনো দোষ নেই হেনরি। যাই বলো, সত্যিই আমরা পাগল।

পাগল বলে পাগল! একেবারে বদ্ধ পাগল। এসো, এই পাগলামির আনন্দে একটু মদ ঢালি।

পরবর্তী বুধবার দিন সন্ধ্যা বেলা ভিনসেন্টের দরজায় ধাক্কা দিল পল গগাঁ।

থিয়ো খবর পাঠিয়েছে গ্যালারি থেকে ফিরতে তার দেরি হবে। সোজা তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে বাতিনোলস কাফেতে। বাঃ, দেখি, দেখি ক্যানভাসগুলো!

দেখো না। এসব পুরোনো ছবি। কিছু করেছিলাম হেগ-এ, বাকি ব্রাবান্টে। গগাঁ অনেকক্ষণ ধরে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে ছবির পর ছবি দেখল। কথা বলবার জন্যে মুখ খুলেও মুখ বন্ধ করল কয়েক বার। ছবিগুলো সম্বন্ধে কোনো সিদ্ধান্তে চট করে পৌঁছোনো দুষ্কর।

শেষপর্যন্ত বললে—প্রশ্নটার জন্যে কিছু মনে কোরো না। আচ্ছা, তোমার কি মৃগীরোগ আছে?

ভেড়ার চামড়ার পুরোনো একটা কিম্ভূত ধরনের কোট কিনেছিল ভিনসেন্ট থিয়োর আপত্তি সত্ত্বেও। কোটটা সে গায়ে গলাচ্ছিল, গগাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—কী, কী রোগ?

মৃগী, মৃগী। যাতে মাঝে মাঝে ফিট হয় আর কি!

এরকম রোগ আমার আছে বলে তো জানিনে। রোগের এই উপসর্গের দেখাও কখনও পাইনি। এ-কথা কেন জিজ্ঞাসা করলে বলো তো?

মানে, কী বলব….তোমার এই ছবিগুলো দেখলে মনে হয়…এগুলো যেন ক্যানভাস থেকে ছিটকে বার হয়ে এল বলে। তোমার ছবি আমি যখনই দেখি….শুধু আজ নয়, এর আগেও যতবার দেখেছি, আমার কেমন একটা দারুণ স্নায়বিক উত্তেজনা হয়, নিজেকে যেন ধরে রাখতে পারিনে। মনে হয়, হয় ছবিটা ফেটে পড়বে, নইলে আমি ফেটে পড়ব। তোমার ছবিগুলো ঠিক কোথায় আমাকে নাড়া দেয় জান?

না। কোথায়?

একেবারে আমার পেটের মধ্যে। আমার নাড়িভুঁড়ি সব যেন কাঁপতে থাকে। এমনি উত্তেজনা হয়, নিজেকে যেন সামলে রাখতে পারিনে।

হেসে ফেলল ভিনসেন্ট। বললে—তাহলে আমার ছবিগুলো অন্তত জোলাপ হিসেবে বিকোবে বলো! পায়খানায় টাঙিয়ে রেখে দিনের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখলেই হল। নির্ঘাত ফললাভ–

ঠাট্টা কোরো না ভিনসেন্ট! সত্যি কথা বলছি, তোমার ছবির সঙ্গে যদি আমাকে ঘর করতে হয় তাহলে সাত দিনের মধ্যে আমি পাগল হয়ে যাব।

খুব হয়েছে, ভিনসেন্ট বললে—এবার চলো।

মোমার্ত থেকে বুলেভার্দ ক্লিচির মোড় পর্যন্ত দুজনে পৌঁছোল।

গগাঁ শুধোলে—ডিনার খেয়েছ?

না। তুমি?

না, আমিও খাইনি। বাতেইলে যাবে নাকি?

মন্দ হয় না—ভিনসেন্ট বললে—পকেটে কিছু আছে?

ফাঁকা মাঠ। তোমার?

আমি তো কপর্দকহীন, যথাপূর্বং। আশায় ছিলাম থিয়ো বাড়ি ফিরে খাওয়াবে।

তাহলে আজ রাত্তিরের মতো পেটে কিছু জুটবে না দেখছি!

না জুটুক। তবু বাতেইলেই চলো। সন্ধ্যে বেলাকার মেনুটা দেখতে অন্তত মন্দ লাগবে না।

মাদাম বাতেইলের হোটেলের দরজাতেই কালি দিয়ে কাঁচা হাতে লেখা মেনু ঝুলছে। ভিনসেন্ট পড়ে বললে—উম্‌ম্‌ম্! গোবৎস মাংসের কাবাব! ইস, আমার সবচেয়ে প্রিয় খাদ্য!

গগাঁ মুখ বেঁকিয়ে বললে—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওটা নাকি আবার খাবার! আমার তো ভাবতেই বমি আসে! না খেয়ে ভালোই হয়েছে আজ। চলো, ঘুরি তো আর কোথাও।

কয়েক পা এগিয়েই ছোট্ট ত্রিকোণ একটি পার্ক। গগাঁ চেঁচিয়ে উঠল—দেখছ কাণ্ড! ওই যে ওই বেঞ্চিটাতে। নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে সেজান। ও যে জুতো মাথায় দিয়ে কেন ঘুমোয় তা বুঝিনে। চলো, ডেকে তুলি ওকে।

প্যান্ট থেকে বেল্টটা খুলে গগাঁ সেটা দিয়ে সেজানের মোজা-পরা পায়ে সজোরে একটা বাড়ি মারল। হঠাৎ যন্ত্রণার চমকে চিৎকার করে লাফিয়ে উঠল সেজান।

গগাঁ? শয়তান কোথাকার, সাডিস্ট কোথাকার! এই বুঝি তোমার ঠাট্টা? তোমার মাথার খুলি ভাঙব আমি একদিন!

বেশ করেছি। পাবলিক পার্কে খালি পায়ে শুয়ে ঘুমুলে তার শাস্তি এইরকমই হয়। বাপু হে, এই কথাটা আমি কিছুতে বুঝিনে, নোংরা বুট জোড়াটা পা থেকে খুলে মাথায় পরে তোমার কী সুখটা হয়? ও দুটো কি তোমার বিছানার বালিশ?

বালিশ কে বললে? ওগুলো কি আমি মাথায় পরি না মাথায় দিই? মাথার তলায় গুঁজে রাখি, যাতে ঘুমিয়ে পড়লে কেউ না চুরি করতে পারে।

গগাঁ ভিনসেন্টের দিকে ফিরে বললে—মানুষটার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাদেরই মতো ভুখা শিল্পী, তা-ই না? আসলে বাপ হচ্ছে ব্যাঙ্কের মালিক আর প্রভেন্সের অর্ধেকটা অঞ্চলের জমিদার। পল; একে তুমি চেন না। আলাপ করো, ভিনসেন্ট ভ্যান গক, থিয়োর ভাই।

নিঃশব্দে করমর্দন করল দুজনে।

গগাঁ বললে—আহা, তোমার সঙ্গে ঠিক আধঘণ্টা আগে যদি দেখা হতো সেজান, তোমাকে নিয়ে একসঙ্গে ডিনার খেতে পারতাম। বাতেইলে আজ যা তোফা কোর্মা রান্না করেছে, কী বলব!

তা-ই নাকি? খুব ভালো?

ভালো বলে ভালো? মুখে তুলতে পারবে না হে! তার আগেই জিভের জলে প্লেট টেবিল সব একাকার হয়ে যাবে। কি হে ভিনসেন্ট, বলো–না!

সত্যি, অত্যন্ত সুস্বাদু

– তাহলে তো গিয়ে খেতেই হয় আমাকে! চলো না তোমরাও, আমার সঙ্গে

নাহয় বসবে আর একবার!

ওরে বাবাঃ! আমার পেটে আর এক গ্রাসও ঢুকবে না। তোমার চলবে নাকি ভিনসেন্ট?

মনে তো হয় না। তবু মশিয়েঁ সেজান যখন জোর করছেন:

একটু লক্ষ্মীছেলে হও না গগাঁ! জানোই তো একলা একলা খেতে আমার যাচ্ছেতাই লাগে! কোর্মা না খাও, নাহয় তো অল্পসল্প আর-কিছু খাবে। চলো, চলো–

চলো, নিতান্তই যখন ছাড়বে না। এসো ভিনসেন্ট।

কাফে বাতেইলে গিয়ে টেবিল জুড়ে তিনজন বসল। ওয়েটার প্রশ্ন করতে-না–করতেই গগাঁ অর্ডার দিল—তিনটে বাছুরের কোর্মা লাগাও।

ওয়েটার জিজ্ঞাসা করল—পান করবেন কী?

মদটাও তুমি পছন্দ করে অর্ডার দাও সেজান। ওটা তুমি আমাদের চাইতে ভালো বোঝ।

আচ্ছা। কই মেনুটা দেখি?

দু-একটা পানীয়ের নাম পড়তে-না-পড়তেই গগাঁ বাধা দিলে, বলে উঠল—পমার্ড খেয়ে দেখেছ এদের? আমার তো মনে হয় মদের মধ্যে পমার্ডই এদের সবচেয়ে ভালো।

সেজান বললে ওয়েটারকে বেশ, এক বোতল পমার্ড।

সেজানের তখন অর্ধেকও খাওয়া হয়নি। গগাঁ ডিস চেটেপুটে শেষ করে বললে—ভালো কথা পল, শুনছি নাকি জোলার ‘লে-ইভার’ বইখানা হাজার হাজার কপি বিক্রি হচ্ছে?

সেজান চমকে উঠে গগার দিকে উগ্র হিংস্র দৃষ্টিতে তাকাল। ডিসটা ঠেলে সরিয়ে দিল সামনে থেকে। খাবার অভিরুচি তার ঘুচে গেল মুহূর্তে। তারপর ভিনসেন্টের দিকে ফিরে বললে—বইটা পড়েছেন মশিয়েঁ?

না। আমি সবে ‘জার্মিনাল’ শেষ করেছি।

ক্ষুব্ধ স্বরে সেজান বলে চলল–এই যে লে-ইভার বইখানা, মশিয়েঁ এটা অতি হীন বই, সম্পূর্ণ অসত্য বই। তা ছাড়া বন্ধুত্বের নামে কত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা যে লোকে করতে পারে, এই বইটাই তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। ‘বইটা কাকে নিয়ে লেখা জানেন? একজন শিল্পীকে নিয়ে, সেই শিল্পী হচ্ছি. আমি। এমিল জোলা, বুঝলেন মশিয়েঁ, আমার সরচেয়ে পুরোনো বন্ধু। ছেলেবেলা থেকে এক্স-এ আমরা দুজনে একসঙ্গে বড়ো হয়েছি, একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি। ও প্যারিসে এল, ওরই টানে আমিও এলাম এখানে। দুজনে ছিলাম ঠিক যেন দুটি ভাই। ছেলেবেলায় একসঙ্গে খেলেছি, পড়েছি, একসঙ্গে কল্পনা করেছি বড়ো হলে কী করব, কী হবে জীবনের সাধনা। আমি হব শিল্পী আর ও হবে লেখক, এ-পরিকল্পনা আমরা দুজনে একসঙ্গে করেছি সেই কতদিন আগে থেকে!

ভিনসেন্ট বললে—তা, জোলা আপনার করেছেন কী?

করেছে? ঠাট্টা করেছে, বিদ্রূপ করেছে, সারা প্যারিসের চোখে আমার সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে দু-হাত তুলে নৃত্য করেছে! দিনের পর দিন আমি তার সঙ্গে কাটিয়েছি, কত গল্প করেছি, আমার নানা থিয়োরির বৈপ্লবিক সম্ভাবনা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছি। বলেছি আমার শিল্পীজীবনের আদর্শ-বেদনার আশা–আকাঙ্ক্ষার কথা। বন্ধুর অভিনয় সে সমানে করে চলেছে, পেট থেকে কথা টেনে বার করেছে আমার। আসলে তার মতলব কী ছিল জানেন? তার এই ঘৃণিত বইখানার উপাদান সংগ্রহ করা, জগতের সামনে আমাকে বোকা বলে তুলে ধরার অভিসন্ধির ছুরিতে শান দেওয়া!

মদের পাত্রটা এক চুমুকে শেষ করে জিঘাংসা-মাখা জ্বলজ্বলে দৃষ্টিতে ভিনসেন্টের দিকে তাকিয়ে আবার সে বলে চলল—আমাকে ব্যঙ্গ করে যে-চরিত্র সে বানিয়েছে, তার মধ্যে আবার কারসাজি কী করেছে জানেন? আমার সঙ্গে আর দুটো লোকের চরিত্র মিশিয়েছে। একজন হচ্ছে বেজিল, আর একটা হতভাগা ছেলে যার কাজ ছিল মানের স্টুডিয়ো ঝাঁট দেওয়া। ছেলেটার শিল্পী হওয়ার উদগ্র বাসনা ছিল, শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে। জোলা আমার কী পরিচয় দিয়েছে জানেন? আমি একটা মূর্খ স্বপ্নবিলাসী, কল্পনা করি আমি বুঝি বৈপ্লবিক শিল্পী, তার কারণ আসলে প্রচলিত টেকনিকে আঁকার ক্ষমতাটুকু আমার নেই। শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যর্থতাবোধের মুখোমুখি করেছে আমাকে, আমার শ্রেষ্ঠ কীর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছাদের বরগা থেকে দড়ি ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করিয়ে মেরেছে আমাকে। আমার পাশাপাশি এক্স-এর আর-একজন শিল্পীকে সে খাড়া করেছে যে প্যাঁচপেচে সেন্টিমেন্টের ফানুস, পুরোনো বস্তাপচা যার ধ্যানধারণা, আমার বিরূদ্ধে তাকেই সে খাড়া করেছে মস্ত একটা জিনিয়স করে।

গগাঁ বললে—যাই বলো, ব্যাপারটা কিন্তু ভারি মজার। এডোয়ার্ড মানের বৈপ্লবিক শিল্পরীতিকে জোর গলায় সমর্থন এই জোলাই প্রথম করে। ইম্প্রেশনিস্টদের সপক্ষে এত কথা আর কেউ বলেনি, তাদের এত সাহায্য আর কেউ করেনি।

হ্যাঁ, মানে যখন প্রাচীনপন্থীদের হটাল তখন জোলা একেবারে গদগদ হয়ে উঠল মানের ওপর। কিন্তু আমি যখন ইম্প্রেশনিস্টদেরও ছাড়িয়ে যেতে চাই, তখন সেটা আর তার সহ্য হয় না। জোলাকে আমার চেয়ে বেশি তোমরা চেন? প্রতিভা বলতে ঢু-ঢু, মানুষ বলতে ঘেন্না করে। মানেকে প্রশংসা করবে না কেন? আসলে দুজনেই যে বুর্জোয়া। দেখো না জীবনযাপনের নমুনা! বিরাট বাড়ি, মেঝেয় তুলতুলে কার্পেট, হাতে পায়ে ঝি-চাকর, আর খোদাই-করা টেবিলে বসে কাঁড়ি কাঁড়ি পয়সা কামানোর তালে শ্রমিকজীবনের কাহিনি লেখা। হুঁ, জানা আছে!

কিন্তু আমরা যে শুনেছিলাম ক-বছর আগে তোমার একটা প্রদর্শনীর ব্যাপারে তোমার ছবির একটা সুন্দর পরিচয়পত্র জোলা লিখেছিল?

…হ্যাঁ লিখেছিল বটে। কিন্তু তার পরের ইতিহাসটা জান? যেই সেটা ছাপাবার সময় এল, অমনি সে লেখাটাকে ছিঁড়ে ফেলল কুটি কুটি করে। কেন বলো তো? বন্ধুত্বের খাতিরে। ওটা ছাপা হলে পাছে বন্ধুর কিছুটা উপকার হয়, সেইজন্যে। তার বদলে সে ছাপাল লে-ইভার। আমার ছবি ছবি নয়, ঠাট্টার খোরাক। ডেগা, মনে, গিলামিনের ছবি ডুরাঁ-রুয়েল টাঙায়, কিন্তু আমার প্রবেশ নিষেধ। এই তো বন্ধুর কাজ ও করেছে! সারা প্যারিসে আমার ছবি যদি-বা কেউ কোথাও টাঙায়, সে পিয়ের ট্যাঙ্গি, তার দোকানে। কিন্তু তার হাতে একবার ছবি পড়লে বিক্রির দফা গয়া।

ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্যে গগাঁ বললে—ভালোকথা সেজান, বোতলে পমার্ড আছে নাকি কয়েক ফোঁটা? ঢালো তাহলে এ-গ্লাসে। এই জোলার বিরুদ্ধে আমার আপত্তিটা কোথায় জান? তার ধোপানি মেয়েরা ঠিক ধোপানির মতোই কথা বলে, কিন্তু তাদের কথা ফুরোবার পর জোলা ভাষাটিকে আর বদলাতে পারে না।

সেজান বললে—যাক, যথেষ্ট হয়েছে আমার প্যারিস বাস। আর এখানে নয়। এক্স-এ আমি ফিরে যাচ্ছি, একেবারে সারাজীবনের জন্য। শহর আর নয়, থাকব পাহাড়ের চুড়োয়। খোঁজ পেয়েছি, ঠিক পাহাড়ের মাথায় একটুকরো জমি বিক্রি আছে সেখানে। চারদিকে পাইন গাছের বন। সেইখানে আমি স্টুডিয়ো বানাব, আর বানাব আপেল বাগান। চারদিকে পাথরের উঁচু দেয়াল গেঁথে দেব, দেয়ালের ওপরে ভাঙা কাচ পুঁতে রাখব যাতে সারা দুনিয়ার কেউ দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ।ঢুকতে না পারে। আপনমনে নিশ্চিন্তে ছবি আঁকব সেখানে। জীবনে আর নড়ব না কোথাও।

গ্লাসে মুখ ভরিয়ে গগাঁ বললে—অ্যাঁ, একেবারে মঠবাসী সন্ন্যাসী!

হ্যাঁ, সন্ন্যাসী। মঠই ভালো।

বাঃ! একেবারে সন্ন্যাসী! কে? না আমাদের সেজান। চমৎকার লাগছে ভাবতে! নাও, ওঠো। কাফে বাতিনোলসে চলো। এতক্ষণে সবাই সেখানে জুটেছে।

সরগরম আসর। বাকি নেই আর কেউ। লোত্রেকের সামনে ডিসের এত উঁচু পাহাড় যে তার ওপর থুতনিটাকে বসিয়ে বিশ্রাম করা চলে। জর্জেস সিউরাত একধারে আঁকোয়েতিন নামে একজন রোগাপটকা চেহারার শিল্পীর সঙ্গে কথা বলছে। রুসো নিঃশব্দে গলা ভেজাতে ব্যস্ত। দুজন আধুনিক শিল্পসমালোচকের সঙ্গে দারুণ তর্ক জুড়েছে থিয়ো।

বাতিনোলসের ইতিহাস আছে। শিল্পীদের আড্ডা এখানে নতুন নয়। এডুয়ার্ড মানে সমসাময়িক ও সমভাবাপন্ন শিল্পীদের নিয়ে বসতেন এইখানেই। তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লেগ্রো, ফাতিন-লাতুর, রেনোয়াঁ প্রভৃতি শিল্পীদের প্রতি সপ্তাহের অন্তত দুটি সন্ধ্যা কাটত এখানে, শিল্পের নতুন নতুন থিয়োরি নিয়ে কত আলোচনা হতো, কত তর্কবিতর্ক। আজকাল তাঁদের জায়গা নিয়েছে একেবারে তরুণ শিল্পী আর তাদের সমর্থকরা।

ঢুকতেই সেজানের চোখ পড়ল এমিল জোলার ওপর। দল থেকে সরে গিয়ে দূরের একটা টেবিলে একলা বসে সে কফি অর্ডার দিল। গগাঁ জোলার সঙ্গে ভিনসেন্টের আলাপ করিয়ে দিয়ে লোত্রেকের পাশে গিয়ে বসল। একটি টেবিলে শুধু জোলা আর ভিনসেন্ট।

আমি লক্ষ করলাম, মশিয়েঁ ভ্যান গক, আপনি সেজানের সঙ্গে ঢুকলেন। নিশ্চয়ই আমার সম্বন্ধে ও আপনাকে কিছু বলেছে। বলেনি?

ভিনসেন্ট বললে—হ্যাঁ সেজান বলছিলেন ওঁকে নিয়ে আপনি যে-বই লিখেছেন, তাতে উনি খুবই আহত হয়েছেন।

একটু চুপ করে জোলা উত্তর দিলে—পল সেজানকে নিয়ে বইটি লিখতে আমিও মনে মনে কম ব্যথা পাইনি মশিয়েঁ। কিন্তু ও-বইয়ের প্রতিটি কথা সত্যি। ধরুন, বন্ধুর একটা ছবি আঁকছেন আপনি। তার সত্যিকারের প্রতিকৃতি দেখে সে দুঃখ পাবে, এইজন্যে আপনি মিথ্যে আঁকবেন? চমৎকার মানুষ পল। আমরা বহুদিনের বন্ধু। কিন্তু ছবি-আঁকিয়ে হিসেবে ও উপহাসের পাত্র। আমার বাড়িতে আমি ওর ছবি টাঙিয়েছি, কিন্তু জানেন মশিয়েঁ ভ্যান গক, বাড়িতে বন্ধুবান্ধব আসার কথা থাকলে ছবিগুলো আমাকে দেয়াল থেকে খুলে রাখতে হয়, নইলে তাদের ঠাট্টা আমাকে বাজে।

কিন্তু যা-ই বলুন, ওঁর কাজ অত খারাপ নিশ্চয়ই হতে পারে না।

আপনি যতটা খারাপ ভাবতে পারেন তার চাইতেও খারাপ। দেখেননি বুঝি নিজে? বুঝেছি, সেইজন্যেই। পাঁচ বছরের একটা শিশুও ওর চাইতে ভালো আঁকে। সত্যি, আমার কী মনে হয় জানেন? মনে হয় ওর মাথা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে।

কিন্তু গগাঁ তো ওঁকে খুব খাতির করে।

এইভাবে যে সেজান জীবনটা নষ্ট করছে, জোলা বলে চলল–ভাবতে আমার বুক ফেটে যায়। দেশে দেখুন কত মান সম্মান পরিবারটার, বাবার ব্যাঙ্কে গিয়ে যদি লাগে সত্যি হয়তো উন্নতি করতে পারে, কিন্তু তা নয়, ছবি-আঁকিয়ে হব! কত বড়ো পাগলামি, আর কত বড়ো ধৃষ্টতা! আপনি দেখবেন, আমি যা লিখেছি ঠিক তা-ই ওর ভাগ্যে হবে, আত্মহত্যা করবে শেষ পর্যন্ত। পড়েছেন বইটা?

আজ্ঞে না, এই তো সবে আপনার জার্মিনাল শেষ করলাম।

পড়েছেন জার্মিনাল? বেশ, বেশ! কেমন লাগল বলুন?

আমার মতে বালজাকের পরে এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আর রচিত হয়নি।

নিশ্চয়ই! এই জার্মিনালই হল আমার মাস্টারপিস। মাসিকপত্রে যখন বার হয়, তখন মন্দ সাড়া পাইনি। তারপর দেখুন, বই আকারে ষাট হাজার কপির বেশি বিক্রি হয়ে গেছে একবছরের মধ্যে। এত আয় আমার আগে কখনও ছিল না। জমিয়েও ফেলেছি অনেকটা, মেডানে আমার বাড়িটা কিছু বড়ো করব এবার ভাবছি। তা ছাড়া বইটার কী ক্ষমতা দেখুন! ওটা লেখার ফলে ফ্রান্সের খনি অঞ্চলে তিন-চারটে বড়ো বড়ো ধর্মঘট হয়ে গেছে। আপনি দেখবেন, এই জার্মিনালই বিপ্লবকে ডেকে আনবে, কবর খুঁড়বে পুঁজিবাদের। ভালো কথা, আপনি কেমন ছবি আঁকেন বলুন তো মশিয়েঁ? আহা! গগাঁ যেন কী আপনার প্রথম নামটা, বলল?

ভিনসেন্ট। ভিনসেন্ট ভ্যান গক। থিয়ো ভ্যান গক আমার ভাই। চমকে ভিনসেন্টের মুখের দিকে তাকাল জোলা। কিছুক্ষণ স্থিরদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বলল—এ তো ভারি আশ্চর্য!

আশ্চর্য হলেন কীসে?

আপনার নামটা। কোথায় যেন আগে শুনেছি!

থিয়োর কাছেই বোধ হয়।

থিয়োর কাছে? তা হবে। না, দাঁড়ান, দাঁড়ান। ব্যাপারটা জার্মিনালে নিয়েছি যেন। আচ্ছা, আপনি কখনও কয়লাখনি অঞ্চলে ছিলেন?

হ্যাঁ, প্রায় দু-বছর ছিলাম বেলজিয়ামের বরিনেজ অঞ্চলে।

বরিনেজ! ওয়ামস! মার্কাস! জোলার বড়ো বড়ো চোখ দুটো কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসে আর কি!

তাহলে, তাহলে, আপনিই সেই পুনরাগত যিশুখ্রিস্ট!

লাল হয়ে উঠল ভিনসেন্ট। বললে—তার মানে?

জোলা বললে—এই জার্মিনালের মালমশলা সংগ্রহের জন্যে আমি প্রায় পাঁচ সপ্তাহ বরিনেজে ছিলাম। লোকমুখে শুনেছিলাম, ধর্মযাজকের রূপ ধরে স্বয়ং যিশুখ্রিস্টের মতো কে একজন রিদেশি সেখানে বাস করে গেছেন। নামটা মনে পড়ল হঠাৎ, আপনিই সেই লোক, তা-ই না?

ভিনসেন্ট বললে—আস্তে, আস্তে, গলাটা একটু নামান।

কাছাকাছি এগিয়ে এল জোলা। আন্তরিকতার ভাষায় বললে—তোমাকে চিনেছি ভিনসেন্ট। কিন্তু আমার কথায় লজ্জা পাবার কী আছে? তুমি যা করতে চেষ্টা করেছিলে. সে তো মূল্যহীন নয়! কম নয় তার সার্থকতা। পথটা তুমি ভুল বেছে নিয়েছিলে, এইমাত্র। মনুষ্যত্ব যার নেই সেই মানুষই পরজন্মের ভরসার বিনিময়ে এ-জন্মের হতাশা বঞ্চনাকে স্বীকার করে নেয়।

আপনার কথা ঠিক। আমার বুঝতে দেরি হয়েছিল।

দুটি বছর তুমি বরিনেজে কাটিয়েছিলে। সর্বস্ব তুমি বিলিয়ে দিয়েছিলে, টাকাকড়ি, গায়ের জামাকাপড়, মুখের খাবারটুকু পর্যন্ত। খেটেছিলে তুমি আপ্রাণ। না না, বাধা দিয়ো না, সব আমি জানি। কিন্তু বলো, কী পেয়েছিলে বিনিময়ে? কিচ্ছু না। তোমার মতো ধর্মপ্রচারককে ওরা পাগল বলে গির্জে থেকে বিদায় করেছিল। তুমি যখন বরিনেজ থেকে চলে আস, শ্রমিকদের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো দেখে আসনি।

ভালো? তার উলটো। অনেক, খারাপ।

তাই তো বলছি ভিনসেন্ট, তোমার সাধনা ছিল, কিন্তু সে-সাধনা চলেছিল ভুল পথে। ভুল সহায় করেছিলে ধর্মকে। আমার সহায় ভাষা, আমার অস্ত্র আমার লেখনী। এই অস্ত্রেই জয় হবে। বেলজিয়াম আর ফ্রান্সের প্রত্যেকটি খনিমজুর, অক্ষর পরিচয় যার হয়েছে, আমার লেখা সে পড়েছে। এমন একটা নগণ্য কাফে বা হোটেল নেই ও-অঞ্চলে যেখানে বহুবার পড়া ছেঁড়াখোঁড়া এক কপি জার্মিনাল পাওয়া যাবে না। যারা নিরক্ষর, অপরে পড়েছে, তারা বারে বারে শুনেছে। চার-চারটে ধর্মঘট ইতিমধ্যে হয়েছে, গোটা বারো হল বলে। সমস্ত দেশ জেগে উঠছে, নতুন সমাজ সৃষ্টির পথে সর্বহারা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে জার্মিনালই। তোমার ধর্ম তা পেরেছিল? আর দেখো আমি কী পাচ্ছি!

কী পাচ্ছেন আপনি?

টাকা হে, টাকা। হাজারের ওপর হাজার ফ্র্যাঙ্ক। বুঝেছ? এসো, এক গ্লাস খাও আমার সঙ্গে।

ও-দিকে লোত্রেকের টেবিল ঘিরে আড্ডা তখন গরম হয়ে উঠেছে। সবাইয়ের কান সে-দিকে।

সিউরাতকে ঠাট্টা করে লোত্রেক বলছে—কী গো পদ্ধতিবিশারদ, খবর কী? লোত্রেকের বিদ্রূপকে উপেক্ষা করে সিউরাত বলে চলল—রঙের বিশ্লেষণ সম্বন্ধে একটা বই বেরিয়েছে। অগডেন রুড বলে একজন আমেরিকানের লেখা। বইটা তোমাদের সকলেরই মন দিয়ে পড়া উচিত।

লোত্রেক বললে—চিত্রকলা সম্বন্ধে কোনো বই আমি পড়িনে। ওটা রেখে দিই যারা শিল্পী নয় এমনি সব সাধারণ লোকদের জন্যে। আঁকে যে, সে আবার পড়বে কী?

সিউরাত সাদা কালো চেক-কাটা কোটের সামনের বোতামটা খুলে নীল টাই–এর নট-টা একটু সোজা করে নিল। বললে—যতদিন আন্দাজে আন্দাজে রং মেশাবে, ততদিন ওই সাধারণ লোকই থেকে যাবে।

আজ্ঞে না স্যার, আন্দাজে আন্দাজে আমি রং মেশাইনে, বুদ্ধি দিয়ে মেশাই। অভ্যাস আর অভিজ্ঞতা দুইয়ে মিলে এই বুদ্ধি

গগাঁ তর্কে ইন্ধন জোগাল—আমি কিন্তু বলব, বিজ্ঞান তো আর একটা অতীন্দ্রিয় ব্যাপার কিছু নয়! আমরা যেভাবে রং ব্যবহার করি তাকে অবৈজ্ঞানিক বলব কী করে? বহু বছরের শত শত শিল্পীর গবেষণা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়েই তো আমাদের পদ্ধতিটা পাকা হয়ে উঠেছে!

সিউরাত বললে—ওতেই সব হল না বন্ধু। আধুনিক যুগ চলেছে নৈর্ব্যক্তিক অথচ ত্রুটিহীন উৎপাদনের দিকে। শিল্পসৃষ্টির মধ্যেও ব্যক্তিগত অনুভূতি আর ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দিন আর নেই।

তর্কটায় পরিসমাপ্তির দাঁড়ি টানল রুসো। সে বলে উঠল—যাই বলুন আপনি, ওসব বইটই আমি পড়তে পারিনে। পড়লেই মাথা ধরে, আর সারা দিনরাত ছবি এঁকে সেই মাথা ধরাকে মাথা থেকে তাড়াতে হয়।

হেসে উঠল সবাই।

আঁকোয়েতিন জোলার দিকে গিয়ে বললে—আজকেই সন্ধে বেলাকার কাগজে আপনার জার্মিনালকে কীরকম আক্রমণ করেছে দেখেছেন?

না দেখিনি। কী বলেছে কাগজে?

সমালোচক বলেছে, ঊনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দুর্নীতিপূর্ণ লেখার লেখক হচ্ছেন আপনি।

সেই পুরোনো কান্না! আর নতুন কিছু কথা ওরা খুঁজে পায় না?

কথাটা মিথ্যে নয় জোলা, লোত্রেক বললে—তোমার লেখা সত্যিই দুর্নীতিপূর্ণ আর অশ্লীল।

অশ্লীল? অশ্লীলতা কাকে বলে দেখে তুমি চিনতে পার?

বেশ বলেছ! এইবার লোত্রেক জব্দ। তারিফ করল গগাঁ।

জোলা মেজাজি ভঙ্গিতে হাঁক দিলে—ওয়েটার, এক গ্লাস করে লাগাও সবাইয়ের সামনে।

সেজান আঁকোয়েতিনের কানে কানে বললে—ব্যাস, আর নিস্তার নেই। জোলা যখন গাঁটের পয়সা খরচ করে বন্ধুদের খাওয়াচ্ছে তখন ওর ঝাড়া একটা বক্তৃতা শুনতেই হবে।

ওয়েটার গ্লাসভরতি মদ নামিয়ে রেখে গেল প্রত্যেকের সামনে। পাইপ ধরিয়ে শিল্পীরা গোল হয়ে বসল জোলাকে ঘিরে। দেয়ালে দেয়ালে গ্যাসের দেয়ালগিরি, টেবিলের কাছটা আবছায়া অন্ধকার। অন্যান্য টেবিলে টেবিলে আড্ডার গুঞ্জন।

জোলা শুরু করল—যে-কারণে ওরা আমার লেখাকে দুর্নীতিপূর্ণ বলে, সে-কারণে ওরা তোমার ছবিকেও দুর্নীতিপূর্ণ বলে হেনরি। সাধারণ লোকের মাথায় এটা ঢোকে না যে শিল্পের ক্ষেত্রে নীতি-দুর্নীতির কোনো বিচার নেই। আর্ট নীতি-দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। জীবনও ঠিক তেমনি। আমার মতে অশ্লীল বলে কোনো ছবি বা বই নেই, দুর্বল হাতের আঁকা বা দুর্বল হাতের রচনা আছে। জীবনকে প্রকৃত উপলব্ধি না করতে পারলে জীবনকে প্রকাশের চেষ্টায় ব্যর্থতা থাকে। সেইটেই দুর্বলতা। সেইটেই নিন্দে করার। তুলস লোত্রেক বেশ্যার ছবি আঁকে, কে বলে সে-ছবি দুর্নীতিপূর্ণ যদি সে সেই বেশ্যারই রূপকে প্রকাশ করতে পারে সত্যের তুলিতে এঁকে? কিন্তু বুর্গেরুর আঁকা পবিত্র একটি গ্রাম্য মেয়ের ছবি অশ্লীল, কেননা সেই মেয়ের চেহারা এমনি নোংরা ভাবালুতার সঙ্গে চটচটে মিষ্টি করে আঁকা যে দেখেই গা-বমি-বমি করে ওঠে।

ঠিক বলেছ, অতি খাঁটি কথা—থিয়ো মাথা নাড়ল।

ভিনসেন্ট দেখল, শিল্পীরা সকলেই জোলাকে সম্মান করে। এর মানে এ নয় যে জোলা নাম করেছে, টাকা করেছে, কারণ এই সাহিত্য তার মাধ্যম। এ-মাধ্যম চিত্রশিল্প নয়, চিত্রশিল্পীর কাছে এ-মাধ্যম দুয়ে। মন দিয়ে শুনতে লাগল সবাই।

জোলা বলে চলল—সাধারণ মানুষের অনুভূতি এটা কিংবা ওটা, এইভাবে চলে। হয় এটা নাহয় ওটা, ধারণাকে সরাসরি এমনি দু-ভাগে ভাগ করতেই সে অভ্যস্ত। আলো কিংবা ছায়া, মিষ্টি কিংবা তেতো, জীবিত কিংবা মৃত, ভালো নাহয় মন্দ। কিন্তু প্রকৃতির মধ্যে এতটা সোজাসুজি ভাগাভাগি নেই, না বিশ্বপ্রকৃতিতে, না মানবপ্রকৃতিতে। পৃথিবীতে ভালোও নেই, মন্দও নেই। পাশাপাশি শুধু হওয়া আর করা। এই হওয়া আর করার মধ্যে দিয়েই জীবনের সমস্ত অভিব্যক্তি প্রতিভাত হয়ে চলেছে। এই অভিব্যক্তির গায়ে যখন আমরা ভালো কিংবা মন্দর লেবেল আঁটি, কোনোটাকে বলি সুনীতিপূর্ণ আর কোনোটাকে দুর্নীতিপূর্ণ, তখন আমরা জীবনের সত্যকে অস্বীকার করি, নিজের নিজের ব্যক্তিগত কুসংস্কারকেই বড়ো করে তুলে ধরি।

থিয়ো প্রশ্ন করল—কিন্তু এমিল, নৈতিকতার একটা নির্দিষ্ট মান যদি না থাকে তাহলে সাধারণ সামাজিক মানুষ চলবে কী করে?

লোত্রেক বললে—নীতিবাদ আসলে ঠিক ধর্মেরই মতো, আফিমের নেশায় মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে, জীবনের কুশ্রীতার দিকে যাতে নজর না পড়ে।

আমি কিন্তু বলব, জোলা, সিউরাত বললে এবার–তোমার এই নীতিকে নেতি করার যে-দর্শন, এটা নৈরাজ্যবাদ। নিহিলিস্টরাও এমনি করেই নীতিকে ঘায়েল করবার তালে ছিল, কিন্তু ধোপে টেকেনি।

জোলা বলল—ভুল বুঝো না। নীতি থাকবে বই কী। নীতি থাকবে, আইন থাকবে কানুন থাকবে—থাকবে না? সামাজিক জীবনের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত জীবনের কিছু-না-কিছু ক্ষুণ্ণ হবেই। সামাজিক জীবনে নীতিবোধ বলে যে-কথাটা আছে, তা আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু নীতির নামে বাজারে যে-ন্যাকামি আর ভাঁড়ামি চলে, যার জন্যে অলিম্পিয়ার মতো ছবির গায়ে থুতু ফেলতে লোক দৌড়োয় আর মোপাসাঁর মতো সাহিত্যিকের কণ্ঠরোধ করতে চায়, তাকে আমি মানিনে। দুঃখের কথা কী জান, এই ফরাসি দেশের নীতিবোধটা একেবারে যৌন এলাকার চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ। কোন পুরুষের সঙ্গে কোন স্ত্রীলোক শুচ্ছে তা নিয়ে আমার বয়েই গেছে। এর চাইতে অনেক উন্নততর নীতিবোধের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে।

গগাঁ বললে—বছর দুই আগেকার একটা ডিনার খাওয়ানোর কথা মনে পড়ে গেল। কাহিনিটা শোনো। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এক ভদ্রলোক আমাকে বললেন—আপনার বাড়িতে সান্ধ্যভোজ, এ তো বড়ো খুশির কথা, তবে কিনা, আপনার রক্ষিতা থাকতে আমার স্ত্রীকে তো আপনার ওখানে নিয়ে যেতে পারিনে! আমি বললাম—তাতে কী? একটা রাত্তিরের জন্যে রক্ষিতা নাহয় অন্যত্রই থাকবে। খাওয়াদাওয়া শেষ হল। ভদ্রলোকের স্ত্রীটি পার্টিতে একটি কথা বলেননি, হয় খেয়েছেন নাহয় কখনও ঢেঁকুর আর হাই তুলেছেন। ঘরে ফিরে হাই তোলা বন্ধ করে স্ত্রী স্বামীকে বললেন—এসো, দু-চারটে রসের গল্প শোনাও, তারপর ওটা করা যাবে। স্বামী বললেন—না আজ ওটা থাক। পেট বড়ো ভরতি। খালি গল্পই হোক।

সমবেত অট্টহাস্যের মাঝখানে জোলা বললে—খাসা গল্প, একেবারে আদর্শ চরিত্রবান আর চরিত্রবতীর কাহিনি।

ভিনসেন্ট এতক্ষণে কথা বললে—শ্লীলতা অশ্লীলতার কথা রাখুন। আমার ছবিকে অশ্লীল কেউ বলে না, কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এ-দুর্নীতি আরও সাংঘাতিক, এর নাম কুশ্ৰীতা।

ঠিক কথা, গগাঁ বললে—দুর্নীতির নতুন সংজ্ঞা হচ্ছে এই। মার্কুরি কাগজে আমাদের নামে কী লিখেছে জান? আমরা নাকি কুশ্রীতার উপাসক সবাই।

এ-অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেও। সে-দিন একজন কাউন্টেস আমাকে বললেন—মশিয়েঁ জোলা, এমনি অসামান্য শক্তিধর হয়ে আপনি আবর্জনার কীট ঘেঁটে ঘেঁটে বেড়াচ্ছেন কেন?

লোত্রেক পকেট থেকে পুরোনো খবরের কাগজের এক টুকরো বার করে বললে—শোনো, সালোঁ দ্য ইনডিপেন্ডেন্টস-এ টাঙানো আমার ছবিগুলোর সম্বন্ধে সমালোচকের অভিমত শোনো। ইনি বলছেন—অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দূষিত আবহাওয়ায় ঘৃণ্য আমোদপ্রমোদ আর নিম্নরুচির বিষয় নিয়েই তুলস লোত্রেকের কারবার। মার্জিত রূপ ও মনোজ্ঞ সুন্দর ভঙ্গিমার প্রতি আকর্ষণ, এককথায় প্রকৃত সৌন্দর্যের অনুভূতি তার নেই। কুশ্রী মুখ, পঙ্গু বিকল দেহ আর বীভৎস অঙ্গভঙ্গির প্রতি তার ঔৎসুক্য, বিকৃত যৌনরুচি থেকেই এই কুৎসিত বীভৎসতার প্রতি বিজাতীয় আগ্রহের জন্ম।

সিউরাত বললে—ঠিক বলেছে। বিকৃত রুচি তোমাদের হোক বা না-হোক তোমরা যে উন্মার্গগামী তাতে কোনো ভুল নেই। যা নিত্য যা মৌলিক, যেমন রং রেখা টোন, এই নিয়েই আর্টের কারবার। কুশ্রীতার অনুসন্ধান কিংবা সমাজ–বিদ্রোহের জয়গান, কোনোটাই আর্টের পর্যায়ে পড়ে-না, আর্ট দিয়ে এসব করতে যাওয়াও বাতুলতা। চিত্রশিল্প হবে সংগীতের মতো, পৃথিবীর সবকিছু বাস্তবতার অনেক উঁচুতে হবে তার স্থান।

এ-কথার উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজন স্বীকার না করে জোলা আবার শুরু করল—গত বছর ভিক্টর হিউগোর মৃত্যু হয়েছে। সেইসঙ্গে সম্পূর্ণ একটা সভ্যতার মৃত্যু হয়েছে। সরস মিথ্যাচার, ঝুটো রোমান্স আর চতুর পলায়নী বৃত্তির সে–সভ্যতা। আমার সাহিত্য নতুন এক সভ্যতার সাহিত্য, এ-সভ্যতা সুনীতি-দুর্নীতি আর সুলভ মিথ্যাচারের মোহজাল এড়িয়ে সত্যের শক্ত বনিয়াদের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তোমাদের ছবিও এই নতুন যুগেরই ছবি। বুর্গের এখনও তার মৃতদেহটাকে প্যারিসের রাস্তায় টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে, কিন্তু মানে যে-দিন পিকনিক-অন-দি-গ্রাস এঁকেছিল সেই দিনই সেই সভ্যতার মৃত্যুরোগ ধরেছিল, আর নাভিশ্বাস উঠেছিল ওই মানেই যে-দিন অলিম্পিয়া ছবিটা শেষ করে। মানে নেই, দ্যমিয়ারও নেই, কিন্তু নতুন সভ্যতার ধারা তাতে শুকিয়ে যায়নি, সেই সভ্যতার জয়পতাকা কাঁধে নিয়ে চলেছ তোমরা—ডেগা, লোত্রেক আর গগাঁ।

তুলস লোত্রেক বললে—তোমার লিষ্টিতে ভিনসেন্ট ভ্যান গকের নামটাও জুড়ে দাও।

চেঁচিয়ে উঠল রুসো—হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারে লিষ্টির মাথায়!

জোলা হেসে বললে—বহুত আচ্ছা! কী হে ভিনসেন্ট, কুশ্রীতার উপাসকদের দলে তোমার নাম প্রস্তাব করা হল। রাজি আছ নাম লেখাতে?

ভিনসেন্ট বললে—হায় হায়, কুশ্রীতা তো আমার জন্মতিলক, আমার ললাটলিখন!

চমৎকার, চমৎকার!

চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠল জোলা। দৃপ্তকণ্ঠে বললে—তাহলে ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের ঘোষণাপত্রের খসড়াটা এইখানেই হয়ে যাক। প্রথমত, আমরা বিশ্বাস করি যে সত্য মাত্রেই সুন্দর, আপাতদৃষ্টিতে এই সত্যকে যত কদর্যই লাগুক না কেন। প্রকৃতির সবকিছুকেই আমরা সমানভাবে গ্রহণ করি, পছন্দ–অপছন্দের সংস্কারে দূরে সরিয়ে রাখিনে কিছুই। আমরা বিশ্বাস করি যে মধুর মিথ্যার চেয়ে নিষ্ঠুর সত্য অনেক বেশি সুন্দর, প্যারিসের সমস্ত সালোঁর চেয়ে একমুঠো উলঙ্গ মাটি অনেক বেশি কাব্যময়। আমরা মনে করি বেদনা মনোহর, কেননা পরমতম অনুভূতির প্রকাশ এই বেদনার মধ্যেই। আমরা বিশ্বাস করি যৌন-অভিজ্ঞতা সুন্দর কেননা তা সত্য, সেই অভিজ্ঞতার আধার বাজারের বারবনিতা বা তার লম্পট প্রেমিক হোক না কেন। কুশ্রীতার ওপরে আমরা চরিত্রকে স্থান দিই, সুলভ আরামের ওপরে স্থান দিই দুর্লভ বেদনাকে, দুনিয়ার সমস্ত ধনদৌলতের চেয়ে মহান বলে গ্রহণ করি গণজীবনের রূঢ় বাস্তবকে। জীবনকে আমরা তার সমগ্রতা নিয়ে স্বীকার করি, নীতির বেড়াজাল তুলে তার কোনো অংশকে আমরা অভিজ্ঞতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখিনে। আমাদের দৃষ্টিতে সম্ভ্রান্ত মহিলা আর বারাঙ্গনায় কোনো পার্থক্য নেই, পথের পুলিশ আর জবরদস্ত জেনারেল, রাজার মন্ত্রী আর মাঠের কৃষাণ—দুইই আমাদের চোখে সমান, কেননা প্রকৃতির বিচিত্র লীলায় উভয়েরই স্থান, জীবনের রথের দড়ি উভয়েই পাশাপাশি টেনে চলেছে।

চেঁচিয়ে উঠল তুলস লোত্রেক—বন্ধুগণ, গ্লাস হাতে নিন। এই অপরূপ কুশ্রীতার আর এই নবীন সভ্যতার নামে আসুন আমরা একচুমুক পান করি। সুন্দরের নবজন্ম হোক, নবসৃষ্টি হোক পৃথিবীর

জয় কুশ্রীতার জয়!

ছোঃ—বললে সেজান।

সিউরাত বললে—ছোঃ বলে ছোঃ!

জুন মাসের গোড়ায় থিয়ো আর ভিনসেন্ট তাদের নতুন বাসায় উঠে গেল। এ-বাড়ির ঠিকানা—৫৪, রু লেপিক মোমার্ত। তিনতলার ওপরে ফ্ল্যাট। তিনখানা বেশ বড়ো বড়ো ঘর, একখানা ছোটো ঘর আর রান্নাঘর। বসবার ঘরের পাশের ঘরখানা থিয়োর শোবার ঘর হল, ভিনসেন্টের স্টুডিয়ো হল আর-একটা বড়ো ঘরে, ছোটো ঘরখানা তার শোবার। সুন্দর করে বাড়ি সাজাবার নেশা ছিল থিয়োর। তার চমৎকার আসবাবগুলি নতুন বসবার ঘরে খুব মানাল এবার

থিয়ো বললে—তোমাকে আর এবার থেকে করম্যানের স্টুডিয়োতে গিয়ে আঁকতে হবে না।

ভিনসেন্ট বললে—যা বলেছ, বাঁচলাম এতদিনে! তবু অবিশ্যি আরও কিছুটা নগ্ন নারীদেহ মকশো করার দরকার ছিল।

আসবাবপত্র নিয়ে টানাটানি করে সাজাচ্ছিল দুজনে। ভিনসেন্টের স্টুডিয়োতে একটা নরম সোফা পেতে থিয়ো বললে–অনেকদিন তুমি একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকনি, তা-ই না?

না, কী হবে এঁকে? যতদিন না ঠিকমতো রং মিশিয়ে তৈরি করতে শিখছি! তবে হ্যাঁ, এতদিন পরে যখন আমার সত্যিকারের একটা স্টুডিয়ো হল—

পরদিন ভোর বেলা সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিনসেন্ট উঠল। নতুন স্টুডিয়োতে জানলার ধারে ইজেলটা পেতে তাতে নতুন একটা ক্যানভ্যাস চড়াল। ক-দিন আগে থিয়োর কেনা নতুন প্যালেটটা বার করল, তুলিগুলো ভিজতে দিল জলে। থিয়োর ঘুম ভাঙবার সময় বুঝে সে ব্রেকফাস্ট সাজাল, জল চড়াল কফির!

প্রাতরাশের টেবিলে বসে থিয়ো সহজেই টের পেল ভিনসেন্টের বুকের মধ্যে কী তুমুল উত্তেজনা জমে উঠেছে।

থিয়ো বললে—তাহলে ভিনসেন্ট, এতদিনে তুমি তৈরি হলে, কী বলো? পুরো তিনমাস তুমি স্কুলের শিক্ষা পেলে, মানে করম্যানের স্কুলের কথা বলছিনে, প্যারিসের স্কুলের গত তিনশো বছর ধরে যা-কিছু শ্রেষ্ঠ ছবি ইয়োরোপে আঁকা হয়েছে তাও তুমি দেখলে। এবার তোমার নিজের কাজ শুরু করার পালা।

সামনের প্লেটটাকে টেনে সরিয়ে এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ভিনসেন্ট—ঠিক বলেছ, আর এক মুহূর্ত দেরি নয়, এখুনি আরম্ভ করতে হবে। আরে বোসো বোসো, খেয়ে নাও। সময় কি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি? যে-কথা বলছিলাম। প্রাণের আনন্দে এবার থেকে জোর কাজ করে যাও। কোনো ভাবনা রেখো না মনে। তোমার রং আর ক্যানভাস আমি পাইকারি হারে কিনে রেখে দেব, যাতে কোনো অভাব তোমার কখনও না হয়। শরীরটারও যত্ন এখন থেকে করবে। ডাক্তার দেখিয়ে দাঁতগুলোর একটা ব্যবস্থা করে ফেল এবার। আর সবচেয়ে বড়োকথা, ছটফট করবে না। তাড়াহুড়োর দরকার নেই, বেশ ধীরেসুস্থে কাজ করে চলো।

বাজে কথা বোলো না থিয়ো। জীবনে কোন কাজটা আজ পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা রেখে ধীরেসুস্থে আমি করেছি?

রাত্রি বেলা থিয়ো বাড়ি ফিরে দেখে, ভিনসেন্টের অবস্থা সাংঘাতিক। সুদীর্ঘ, ছ-বছরের শিল্পীজীবনে সে সুখের মুখ একদিনের জন্যেও দেখেনি, দুর্দশার চরম অবস্থার মধ্যে বসে দিনের পর দিন ছবি এঁকে গেছে। আজ তার সব দুঃখ ঘুচেছে, স্বাচ্ছন্দ্য আর সুযোগের সবকিছু চাহিদা আজ তার করায়ত্ত। তবু হঠাৎ যেন সে পঙ্গু হয়ে গেছে, মাথার মধ্যেটা খালি, আঙুলে জড়তা, সমস্ত দিনটা কেটেছে অসহায় অকর্মণ্য ব্যর্থতায়। মুখখানা পুঞ্জিত হতাশার আঘাতে পাণ্ডুর।

অনেক বুঝিয়ে সে-রাত্রে থিয়ো ভাইকে ঠান্ডা করল, ফিরিয়ে আনল তার আত্মবিশ্বাস।

কয়েক সপ্তাহ কাটল এমনিভাবেই। কোনো কাজ করতে পারে না, যা করে তা-ই ভুল হয়। শুকিয়ে উঠল শরীর, কোটরগত চক্ষু, দিনরাত্রি আগুন জ্বলছে মাথায়। থিয়ো সারাদিন পরে বাড়ি ফিরে যেন পাগল নিয়ে পড়ে। ধমক দেয়, হাত থেকে আবসাতের বোতল কেড়ে নেয়, শেষ পর্যন্ত ঘরে খিল দিয়ে নিজেকে পাগলামির হাত থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে শেষ রাতটুকুর জন্যে। তাও কি রোজ পারে!

গ্রীষ্মকাল এল। রাস্তায় রাস্তায় ঝাঁঝালো সূর্যালোক। পথের ধারে ধারে রংবাহার মৌসুমি ফুলের মেলা, সিন নদীর জল নীল থেকে আরও নীল। সময় এল পথে বার হবার। ভিনসেন্ট পিঠে ইজেল বেঁধে ছবির খোঁজে রোজ প্রত্যুষে বার হয়। এমনি সূর্য সে হল্যান্ডে দেখেনি, প্রকৃতির নতুন বর্ণাঢ্যতায় সে অবাক হয়ে যায়। সন্ধে বেলা ফিরে আসে ব্যর্থতার প্রতিমূর্তি, অপেক্ষা করে থাকে কখন থিয়ো ফিরবে। সারাদিনের রৌদ্র তার মাথায় বাসা বেঁধে থাকে, এবার থিয়ো ফিরলেই হয়!

.

একদিন গগাঁ এল তার রং তৈরিতে সাহায্য করতে। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করল—কোত্থেকে তুমি রং কেন?

জানিনে। থিয়ো একসঙ্গে একগাদা কিনে আনে।

বাঃ, পিয়ের ট্যাঙ্গির কাছ থেকে কেনে না কেন? সারা প্যারিসে ওর চাইতে সস্তায় কেউ দেবে না, আর পয়সা না থাকলে বিশ্বাস করে ধারেও দেবে না ওর মতো আর কেউ।

কে হে এই পিয়ের ট্যাঙ্গি? এর নাম তোমার মুখে আগেও যেন শুনেছি!

আরে, ওকে চেন না? আলাপ হয়নি এখনও? কী সর্বনাশ! আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। কোটটা চাপিয়ে নাও এক্ষুনি। রু ক্লজেলে যেতে হবে।

পথে যেতে যেতে গগাঁ পিয়ের ট্যাঙ্গির কাহিনি বলল।

প্যারিসে আসার আগে লোকটা প্লাস্টারের কাজ করত। প্যারিসে এসে শুরু করল রং ফেরি করার ব্যাবসা। শিল্পীপাড়ার রাস্তায় রাস্তায় রং ফেরি করে বেড়াত। আলাপ হল পিসারো, মনে আর সেজানের সঙ্গে। সকলেরই পছন্দ হল ওকে, আমরা সবাই ঠিক করলাম ওর কাছ থেকেই রং কিনব। এ-দিকে সে আবার পুলিশের চাকরি নিয়েছে। কম্যুনিস্টদের সঙ্গেও যোগাযোগ। হাতে বন্দুক, কিন্তু গুলি করে মানুষ খুন করার মতো সদ্গুণ নেই মনে। ধরা পড়ল, বিশ্বাসঘাতক বলে শাস্তি হল, দু-বছরের পাথর ভাঙার কয়েদ। আমরা সবাই মিলে অনেক চেষ্টায় ছাড়িয়ে আনি।

তারপর?

হাতে কয়েকটা ফ্র্যাঙ্ক ছিল। সেই পুঁজি নিয়ে রু ক্লজেলে ছোট্ট দোকান খুলল একটা। দোকানের সামনের নীল রংটা বুলিয়ে দিল লোত্রেক। সেজানের প্রথম ছবি সে ঝুলিয়েছে তার ওই রঙের দোকানে। তারপর থেকে আমরাও ওকে ছবি দিয়েছি। বিক্রির জন্যে অবশ্য নয়, ছবি বিক্রি ও প্রাণ থেকে করতে পারে না। রং বেচে, তাও অর্ধেকের বেশি ধারে। আসলে পিয়ের ট্যাঙ্গির মতো আর্টের ভক্ত প্যারিসে দুটি নেই। গরিব, পয়সা দিয়ে ছবি কিনতে তো পারে না, তাই সারা দোকানের দেয়াল জুড়ে ছবির একজিবিশন সাজিয়েছে, চারিদিকে ছবি নিয়ে সারাদিন বসে থেকেই ওর আনন্দ।

তার মানে? খদ্দের এলেও, ভালো দাম পেলেও বেচে না? তাহলে তো মুশকিল!

মুশকিল বই কী। আসলে ছবির ও প্রেমিক। কোনো ছবিতে একবার যদি নেশা ধরে যায়, সে-ছবি ওর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া শক্ত। একদিনকার ঘটনা বলি। আমি তখন ওর দোকানে ছিলাম। দামি পোশাক পরা এক ভদ্রলোক এল। সেজানের একটা ছবি পছন্দ হল, জিজ্ঞেস করলে—দাম কত। প্যারিসের যেকোনো ছবিওয়ালা ষাট ফ্র্যাঙ্কে ছবিটা বেচতে পারলে কৃতার্থ হয়ে যেত। ট্যাঙ্গি ছবিটার দিকে বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে হাঁকলে—ছশো ফ্র্যাঙ্ক। খদ্দের সরে পড়ল। দেয়াল থেকে ছবিটা নামিয়ে ট্যাঙ্গি কোলের ওপর দু-হাতে চেপে ধরল, চোখে ওর জল।

তাহলে ওর দোকানে ছবি টাঙিয়ে লাভ?

ওই তো মজা! রং গুঁড়োনো লোকটার পেশা, কিন্তু নজর ওর আশ্চর্য! কোন ছবি সত্যি ভালো তা ওর মতো বোঝদার দুটি নেই। ও যদি তোমার কোনো ছবি চায়, দিলে ধন্য হবে। বুঝবে প্যারিসের চিত্রশিল্পের দরজা তোমার জন্যে খুলল, এবার তুমি জাতে উঠলে।

এসে পড়ল ব্লু ক্লজেল। রাস্তাটা খুব চওড়া নয়, দু-ধারে দোতলা তিনতলা বাড়ি, একতলার ঘরগুলো অধিকাংশই ছোটো ছোটো দোকান। ওপরতলাগুলো বাসিন্দাদের। পিয়ের ট্যাঙ্গি কয়েকটা জাপানি প্রিন্ট দেখছিল। এগুলোর এখন প্যারিসের শিল্পীমহলে খুব আদর।

গগাঁ বললে—পিয়ের, আমার একজন বন্ধুকে তোমার সঙ্গে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। ভিনসেন্ট ভ্যান গক, এও তোমারই মতো দারুণ কম্যুনিস্ট।

নরম মেয়েলি গ্লায় ট্যাঙ্গি বললে—আসুন আসুন, কৃতার্থ হলাম মশিয়েঁ।

বেঁটেখাটো চেহারা, গোলগাল মুখ, পোষ-মানা কুকুরের মতো চোখের দৃষ্টি করুণ। চওড়া কিনারওয়ালা একটা খড়ের টুপি দিয়ে কপালটা ঢাকা। বেঁটে বেঁটে হাত দুখানা, মোটা মোটা আঙুলগুলো, শক্ত খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ডান চোখটা আধবোজা।

সলজ্জ স্বরে পিয়ের ট্যাঙ্গি ভিনসেন্টকে শুধোলে—সত্যি আপনি কম্যুনিস্ট, মশিয়েঁ ভ্যান গক?

কম্যুনিজম বলতে তুমি ভাই কী বোঝো আমি জানিনে। তবে হ্যাঁ, এ আমি বিশ্বাস করি যে প্রত্যেক মানুষই যে-কাজের সে উপযুক্ত সেই কাজ প্রাণপণ করবে আর তার বিনিময়ে যা-কিছু তার প্রয়োজন তা পাবে।

হেসে উঠল গগাঁ—বাঃ বাঃ, এ তো একেবারে সোজা হিসেব দেখছি!

ট্যাঙ্গি বললে—আঃ পল, তুমি তো স্টক এক্সচেঞ্জ করে এসেছ। টাকাই মানুষকে পশু করে। ঠিক কি না বলো।

হ্যাঁ, বললে গগাঁ—কিংবা টাকার অভাব।

না টাকার অভাব নয়। যে-অভাবে মানুষ পশুর সমান হয়, সে হল খাদ্যের অভাব, জীবনের সামান্যতম চাহিদাগুলির অভাব।

ঠিক বলেছ পিয়ের ট্যাঙ্গি—বললে ভিনসেন্ট।

পিয়ের ট্যাঙ্গি বললে—আমাদের বন্ধু পল যারা পয়সা করে তাদের ঘৃণা করে, আর আমরা যারা পয়সা করিনে তাদেরও ঘৃণা করে। তবে ওই পয়লা দলে না হয়ে আমি যে দোসরা দলে আছি, এই ভালো। দিনে পঞ্চাশ সেন্টিমের বেশি যে খরচ করে, সে ব্যাটা শয়তান!

গগাঁ বললে—ব্যাস, তাহলে আর আমার মতো সাধু কে, যদিও বাবা ঠ্যালায় পড়ে সাধু বনেছি। এই দেখো ভায়া, তোমার পুরোনো দেনা শোধ দিতে পারছিনে, তবু যদি আর-একটু রং ধার না দাও তাহলে ছবি আঁকা তো শিকেয় উঠবে!

দেব বই কী ভায়া, দেব বই কী! তোমাকে ধার দেব না? তবে ধরো এই দুনিয়ার মানুষকে আমি যদি একটু কম বিশ্বাস করতাম আর তুমি যদি আর-একটু বেশি বিশ্বাস করতে তাহলে তোমার আমার দুজনের অবস্থাটাই আর-একটু ভালো হতো। ছবি দেবে যে বলেছিলে, তার কী হল? তোমার ছবি দু-একটা বেচেও তো রঙের দামটা কিছু কিছু তুলতে পারি।

গগাঁ চোখ টিপল অলক্ষে ভিনসেন্টকে উদ্দেশ্য করে। উত্তরে বললে—নিশ্চয়! একখানা কেন, দুখানা ছবি আনব। পাশাপাশি ঝুলিয়ে রাখবে। বেশি রং আমি চাইনে। এই ধরো, এক টিউব কালো, এক টিউব হচ্ছে হলুদ.

হ্যাঁ হ্যাঁ, পাবে বই কী, খুব পাবে, একশো বার পাবে! পুরোনো ধারটা শোধ দাও, তবে তো?

তীব্র তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ। চমকে তিনজনেই পেছন ফিরে তাকাল। ভেতর দিকের দরজাটা দড়াম করে খুলে দোকানের মধ্যে ঢুকল পিয়ের ট্যাঙ্গির স্ত্রী। একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল গগাঁর ওপর—

বলি, ভেবেছ কী? আমরা কি ব্যাবসা করছি না দানখয়রাত করতে বসেছি? কথায় কথায় কেবল কম্যুনিজমের কচকচি! ওই কম্যুনিজম ধুয়ে খাব? পেট ভরবে তাতে? দাও দাও, পুরোনো পাওনাটা মিটিয়ে দাও দিকি, নইলে পুলিশ ডাকব!

গগাঁ একগাল মিষ্টি হেসে ট্যাঙ্গির স্ত্রীর সামনে নীচু হয়ে তার করচুম্বন করল। বললে—আঃ জানটিপে, আজ সকাল বেলায় কী মিষ্টিই না তোমাকে দেখাচ্ছে!

এই সুন্দর চেহারার শয়তানটা কেন যে তাকে সর্বদা জানটিপে বলে ডাকে তা ট্যাঙ্গির স্ত্রী বোঝে না, তবে গালভরা ডাকনামটা শুনতে তার ভালোই লাগে। বললে—ওঃ! ভেবেছ, এমনি মিষ্টি কথা বলে আমার কাছ থেকে পার পাবে, তা-ই না? সারাটা জীবন গেল আমার রং গুঁড়ো করে করে, আর সেই রং কিনা তুমি বিনিপয়সায় চুরি করে নিয়ে যাবে! ইঃ, রঙ্গ দেখে আর বাঁচিনে!

জানটিপে, আমার সোনার জানটিপে! অত নিষ্ঠুর হোয়ো না আমার ওপর। আমি জানি তোমার মনটা আর্টিস্টের মন। তোমার মুখেই তার ছাপ রয়েছে। আর্টিস্টের দুঃখ তুমি না বুঝলে বুঝবে কে?

অ্যাপ্রন নিয়ে আর্টিস্টের কল্পিত ছাপটা ঘামের সঙ্গে সঙ্গে মুছে নিল পিয়ের গৃহিণী। ঝংকার দিয়ে উঠল—আবার আর্টিস্ট? ঘরে এক আর্টিস্টেই আমার রক্ষে নেই! কী বলেছে ও তোমাদের, পঞ্চাশ সেন্টিমেই দিন চলবে—তা-ই না? বলুক তো, আমি কোমর বেঁধে রোজগার না করলে ওই পঞ্চাশটা সেন্টিমই-বা জোটে কোথা থেকে?

আহা, লক্ষ্মী, লক্ষ্মী মাদাম, তুমি যে কীরকম পটিয়সী ব্যাবসাদারনি, সারা প্যারিস তা জানে। এ কি .একটা নতুন কথা হল?

মাদাম ট্যাঙ্গির রুক্ষ কর্কশ ডান হাতটায় আবার গগী সাদরে চুমু খেল।

হাজার হোক স্ত্রীলোক তো! মাদাম ট্যাঙ্গির হৃদয় গলল—বুঝেছি, যেমন শয়তান তেমনি খোশামুদে। আচ্ছা এবারকার মতো ধারে দিচ্ছি। বেশি কিন্তু নিয়ো না। পুরোনো হিসেবটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিতে হবে, সেটা কিন্তু যেন মনে থাকে।

এই যে করুণা করলে, লক্ষ্মী জানটিপে, এর প্রতিদান তুমি পাবে। তোমার একখানা পোর্ট্রেট আমি আঁকব। সেই পোর্ট্রেট একদিন না একদিন লাভর-এ স্থান পাবে, অমর হব তুমি আর আমি দুজনেই।

সদর দরজায় ঘণ্টা বাজল। অপরিচিত একটি লোক দোকানে প্রবেশ করল। লোকটির জিজ্ঞাসা—ওই সামনে জানলার ধারে স্টিল লাইফখানা কার আঁকা?

খরিদ্দার হয়তো! ট্যাঙ্গি অল্প কথায় সারতে চাইলে, বললে—পল সেজানের।

পল সেজান? নামই তো কখনও শুনিনি! যা হোক, বিক্রি আছে?

আজ্ঞে না, মানে কিনা, দুঃখের বিষয় ওখানা আগেই—

অ্যাপ্রনটা ছুঁড়ে ফেলে ট্যাঙ্গিকে এক ধাক্কায় সরিয়ে সামনে এগিয়ে এল ট্যাঙ্গির স্ত্রী। বললে—নিশ্চয় বিক্রি আছে মশিয়েঁ! চমৎকার ছবি, তা-ই না? আপনার যদি পছন্দ হয় তো খুব সস্তায় দেব।

দাম কত?

মাদাম হাঁকল সঙ্গে সঙ্গে—কত, কত দাম ট্যাঙ্গি?

ঢোক গিলল ট্যাঙ্গি। অস্ফুট স্বরে বললে—তিনশো—

ট্যাঙ্গি!

তা, ধরুন দুশো।

ট্যাঙ্গি!

না, তবে কিনা ঠিক দাম এই একশো ফ্র্যাঙ্ক।

একশো ফ্রাঙ্ক? বিরস গলায় খরিদ্দার বললে—তাও আবার কেউ নাম জানে না এমনি লোকের আঁকা! অসম্ভব। গোটা পঁচিশ ফ্র্যাঙ্ক আমি দিতে পারি।

ট্যাঙ্গির স্ত্রী জানলা থেকে ছবিটা নামিয়ে খরিদ্দারের নাকের সামনে ধরে বললে–দেখুন মশিয়েঁ, কত বড়ো ছবিটা! চার চারটে আপেল। এক গণ্ডার দাম একশো ফ্র্যাঙ্ক, আপনি দিতে চাইছেন মোটে পঁচিশ—ওতে চারটে হবে না, একটা হবে।

লোকটা ছবিটা নিরীক্ষণ করে দেখল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললে—বেশ তাহলে একটা আপেলই দিন, তাতেই আমার চলবে।

বেশ, তা-ই দেব, আমার আপত্তি নেই। এই একটাই নিন আপনি।

কাঁচি দিয়ে কচকচ করে ক্যানভাসটা কেটে একদিকের একটা আপেল আলাদা করে নিল ট্যাঙ্গির স্ত্রী। ছবির বাকি অংশটা কাগজে মুড়ে রেখে দিয়ে আপেলটা খরিদ্দারের হাতে দিয়ে পঁচিশ ফ্র্যাঙ্ক হাত পেতে নিল।

খরিদ্দার দরজার বাইরে অন্তর্হিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল ট্যাঙ্গি—হায় হায়! আমার এত সাধের সেজানখানা!

ট্যাঙ্গির স্ত্রী ছবির বাকি অংশটা কাউন্টারের ওপর রাখল।

ইঃ, ভারি আমার সাধের সেজান! এর পরে আবার যদি কোনো এমনি খদ্দের তোমার সাধের সেজান কিনতে চায়, আর তাতেও যদি এমনি সস্তা চায়, আর-একটা আপেল কেটে দিয়ো, দাঁত বার করে হাসছ কী পল গগাঁ! তোমারও এমনি দশা হবে। তোমার ওই জংলি ন্যাংটো মেয়ের পালকে দেয়াল থেকে নামিয়ে পাঁচ ফ্র্যাঙ্ক করে এক-একটা আমি বেচব।

গগাঁ বললে—মরি মরি জানটিপে, তোমাকে যদি স্টক এক্সচেঞ্জে পার্টনার পেতাম তাহলে এতদিন সারা ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্সের মালিক হতাম দুজনে!

মাদাম অন্তর্ধান করল। পিয়ের ট্যাঙ্গি ভিনসেন্টকে জিজ্ঞাসা করল—আপনিও তো শিল্পী, তা-ই না মশিয়েঁ? আমার এখান থেকেই তাহলে রং-টং কিনবেন। দু–একটা ছবিও দেখাবেন আপনার, কেমন?

ঘাড় নাড়ল ভিনসেন্ট।

নিশ্চয়। তোমার এই জাপানি প্রিন্টগুলো কিন্তু ভারি চমৎকার। এগুলোও বিক্রির জন্যে তো?

হ্যাঁ, এগুলোর চাহিদা খুব আজকাল। জাপানি ছবির প্রভাব আমাদের তরুণ শিল্পীদের ওপরও খুব পড়েছে।

এ দুটো আমি নেব। দেখব স্টাডি। কত দাম?

এক-একটা তিন ফ্র্যাঙ্ক করে।

আচ্ছা, আমি নিচ্ছি। ওই যাঃ! পকেটে তো কিছু নেই! গগাঁ, ছটা ফ্র্যাঙ্ক ধার দেবে নাকি?

কী পাগলের মতো বলছ!

ভিনসেন্ট প্রিন্ট দুটো নামিয়ে রাখল—বড়ো দুঃখিত ট্যাঙ্গি। এখন থাক। ট্যাঙ্গি প্রিন্ট দুটো ভিনসেন্টের হাতের ওপর চেপে ধরল। ভীতু ভীতু সলজ্জ মুখে বললে—কী যে বলেন! আপনার কাজের জন্যে এগুলো দরকার, নিয়ে যান। দাম? পরে দেবেন এখন। কী হয়েছে তাতে?

১০

থিয়ো আর ভিনসেন্ট শিল্পীবন্ধুদের একদিন পার্টি দিল। চার ডজন সেদ্ধ ডিম, একগাদা কেক-পেস্ট্রি আর এক পিপে বিয়ার। বসবার ঘরটা তামাকের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল, বিরাট চেহারাটা নিয়ে হাঁটাচলা করছিল গগাঁ, দেখাতে লাগল কুয়াশার মধ্য দিয়ে একটা জাহাজ যেন সমুদ্রে ভেসে চলেছে। লোত্রেক এক কোণে বসে থিয়োর সুন্দর চেয়ারের হাতলে ঠুকে ঠুকে ডিম ফাটিয়ে কার্পেটের ওপর খোলার টুকরোগুলো ছড়াতে লাগল। রুসো অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে ঘোষণা করল, একজন মহিলাভক্ত গন্ধমাখা চিঠিতে তাকে নিমন্ত্রণ পাঠিয়েছে। সিউরাতের মাথায় আবার নতুন থিয়োরি গজিয়েছে, সেজানের সঙ্গে সে সমানে তা-ই নিয়ে বকবক করতে লাগল। ভিনসেন্ট মদ চালাতে লাগল। গগার অশ্লীল গল্প শুনে হাসল কিছুটা, তর্ক করল কিছুক্ষণ লোত্রেকের সঙ্গে, শেষপর্যন্ত সিউরাতের কবল থেকে উদ্ধার করে আনল সেজানকে।

ছোট্ট ঘরটা উত্তেজিত হইহল্লায় ফেটে পড়ছে। শিল্পী জাতটাই ভয়ংকর, ব্যক্তিত্বে সবাই এক-একজন গৌরীশংকর, পরমত অসহিষ্ণুতায় প্রত্যেকেই কালাপাহাড়। থিয়োর মতে প্রত্যেকেই আমি-উন্মাদ; তর্ক করতে, লড়াই করতে, নিজের থিয়োরিকে সদম্ভে ঘোষণা করতে আর পরের মতকে ভাঙতে-চুরতে সবাই ওস্তাদ।

গলা তাদের রুক্ষ, চেঁচাতে তাদের জুড়ি নেই। যা-কিছু অপছন্দ করে, তারই বিরুদ্ধে চ্যাচানি। অপছন্দের তো আর শেষ নেই। ঘরটা যদি কুড়িগুণ বড়ো হতো তাহলেও বোধ হয় এসব তরুণ শিল্পীদের সরব উচ্ছ্বাসের পক্ষে ছোটোই মনে হতো।

ভিনসেন্টেরও মেজাজে বান ডেকেছে। চেঁচাচ্ছে সেও, হাত পা নাড়ছে প্রাণপণ। থিয়োর অবস্থা অন্যরকম। এদের জন্যেই সে গুপিলসে নীরবে যুদ্ধ করে যাচ্ছে, এদের প্রতিষ্ঠা করাই তার লক্ষ্য। কিন্তু এদের এই ব্যক্তিত্বের ঠোকাঠুকির মাঝখানে পড়ে সে মারা যায়। স্বভাব তার শান্ত, অনেকটা মেয়েলি, এই রুক্ষ কর্কশ কোলাহলে সে কষ্ট পায়, তার মাথা ধরে ওঠে।

উদ্দেশ্যবিহীন অথচ তিক্ত বিদ্রূপ হানতে লোত্রেক মহাপটু। হঠাৎ নানা কথার মাঝখানে সে ছাড়ল—সত্যি, থিয়ো যদি ভিনসেন্টের ভাই না হয়ে বউ হতো তাহলেই হতো ভালো।

থিয়ো চুপ করে এক কোণে বসে ভাবছিল—দিন আসবে। একদিন-না-একদিন সে তার সালোঁতে একখানা সেজান ঝোলাতে পারবেই। শিল্পের এই নব জোয়ারকে কতদিন ওরা ঠেকিয়ে রাখবে? তারপর গগাঁ, লোত্রেক, শেষ পর্যন্ত ভিনসেন্ট ভ্যান গক। সফল হবে তার স্বপ্ন।

আস্তে আস্তে সে বার হয়ে গেল ঘর থেকে। নেমে গেল একলা রাস্তায়, চুপটি করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল প্যারিসের আলোকমালা।

গগাঁ তখন তর্ক জুড়েছিল সেজানের সঙ্গে। এক হাতে তার ডিম, আর-এক হাতে বিয়ারের গ্লাস, মুখে পাইপ। গগাঁর গর্ব ছিল, পাইপ মুখে দিয়ে বিয়ারের গ্লাসে চুমুক দিতে প্যারিসে সে অদ্বিতীয়।

চিৎকার করে গগাঁ বললে তোমার ছবিগুলো একেবারে ঠান্ডা সেজান, একেবারে নিষ্প্রাণ। ওগুলো দেখলে আমার রক্ত হিম হয়ে যায়। শুধু রং বুলোলেই কি চলে! রঙের সঙ্গে একটু আবেগ মিশিয়ে দিতে হয় ভায়া, নইলে কি ছবি!

সেজান ঠুকল উত্তরে—মাপ করো, আমি আবেগ আঁকিনে। আবেগ মানে ভাবালুতা। ওটা আমি ঔপন্যাসিকদের জন্যে ছেড়ে রেখেছি, আমি আপেল আঁকি, দৃশ্য আঁকি, যা আঁকবার, তা-ই।

আজ্ঞে না, ভাবালুতার কথা বলছিনে, আমি বলছি অনুভূতির কথা অনুভূতি নেই তোমার, আঁকবে কী করে? আঁক তো খালি চোখ দিয়ে।

তা, চোখ দিয়ে ছাড়া আর কী দিয়ে লোকে আঁকে?

অনেককিছু দিয়ে আঁকে। গগাঁ বলে চলল—এই যে লোত্রেক, ও আঁকে ওর পিত্তি দিয়ে। ভিনসেন্ট আঁকে হৃদয় দিয়ে। সিউরাত আঁকে তার মন দিয়ে, সেটা অবশ্য চোখ দিয়ে আঁকার মতনই খারাপ। রুসো আঁকে তার কল্পনা দিয়ে।

বটে? আর তুমি কী দিয়ে আঁক?

আমি? তা জানিনে। ভেবে দেখিনি কখনও।

বলব আমি? লোত্রেক বললে—তুমি আঁক তোমার ওইটে দিয়ে।

হো-হো করে হেসে উঠল সবাই। হাসি আর থামে না। আচ্ছা জব্দ হয়েছে!

 হাসি থামতে না থামতেই সিউরাত একটা সোফার হাতলের ওপর চড়ে বসে চড়া গলায় শুরু করল—মন দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে যে ছবি আঁকে তাকে তুমি ঠাট্টা

করতে পার, কিন্তু বুদ্ধিই পথ দেখায়। এই বুদ্ধি দিয়েই আমি আবিষ্কার করেছি ছবির আকর্ষণকে কেমন করে ডবল করে তোলা যায়।

ডুকরে উঠল সেজান—ওরে বাবা! আবার সেই বস্তাপচা বক্তৃতা শুরু হল।

চুপ চুপ, সেজান। এই গগাঁ, ছটফট করে বেড়িয়ো না, এক জায়গায় স্থির হয়ে বোসো। রুসো, তোমার ভক্তের কাহিনি দয়া করে থামাবে? লোত্রেক, একটা কেক এগিয়ে দাও তো! কই ভিনসেন্ট, কী করছ, ভরে দাও না গেলাসটা। নাও, শোনো এবার সবাই।

লোত্রেক তবু ছাড়ল না—ব্যাপার কী সিউরাত? সেই যে একবার তোমার ছবির ওপর একটা লোক থুতু ফেলেছিল, তারপর থেকে এতটা উত্তেজিত হতে তো কোনোদিন দেখিনি তোমাকে?

শোনো। আজকের দিনের চিত্রশিল্পের মূল জিনিসটা কী? আলো, তা-ই নয়? বস্তুর কোনো রং নেই। বস্তুর ওপর আলোর বিকিরণে যে-রং ফুটে ওঠে সেই রংই ছবির রং। বস্তুকে ভাগ করো বিন্দুতে, তাহলে ছবি দাঁড়াচ্ছে অসংখ্য বর্ণবিন্দুর সমষ্টি, তা-ই নয়?

ও বাবা! তোমার বিন্দুপ্রকরণ থামাও, ছবির কথা বলবে তো বলো!

ও জর্জেস, আবার পণ্ডিতি শুরু করলে! আর যে পারিনে দাদা!

চুপ চুপ, গোলমাল করো না, বলছি। আচ্ছা, ছবির কথাই যদি বললে, ধরো ছবি একটা আঁকলাম। সেটা পড়ল গিয়ে কোনো মূর্খের হাতে, সে সেটাকে বাঁধাল একটা বীভৎস সোনালি ফ্রেমে, ছবিটার যা-কিছু সৌন্দর্য ছিল তা ফ্রেমে এঁটেই খতম করে দিলে। অতএব এই কথাটা মনে রাখবে যে ছবি কখনও ফ্রেমে না বাঁধিয়ে ছাড়বে না। ফ্রেমটা রং করবে নিজের হাতে, যাতে করে ওই ফ্রেমটাও ছবিরই অঙ্গ হয়ে ওঠে।

তারপর সিউরাত, থামলে কেন? ছবিটা নিশ্চয়ই কোনো ঘরে টাঙানো হবে। দেওয়ালের রংটা যদি ঠিক না হয়, তাহলে ছবিও গেল, ফ্রেমও গেল। তাহলে ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে দেয়াল রং করাও ধরব নাকি?

সিউরাত বললে–নিশ্চয়! চমৎকার আইডিয়া!

তারপর? ঘরটা যে-বাড়ির সেই বাড়িটা?

আর-একটু এগোও। বাড়িটা যে শহরে সেই শহরটা? তাই-বা বাদ যায় কেন?

জ্বালালে জর্জেস, কী যে তোমার সব বিদঘুটে আইডিয়া!

ওই! বুদ্ধি খাটিয়ে ছবি আঁকব বললে ওইরকম বিদঘুটে খেয়ালই মাথায় গজায়!

সিউরাত আকাশে দু-হাত ছুড়ে চেঁচিয়ে উঠল—আঁকবে কোথা থেকে বুদ্ধি দিয়ে? মাথার খুলির নীচে কিছু থাকলে তো? যতসব গোমুখ্যুর দল!

দেখো দেখো, মুখখানা দেখো জর্জেসের! বুদ্ধিওয়ালার গালফুলো মুখখানা একবার সবাই দেখে নাও চট করে।

এতক্ষণে ভিনসেন্ট গলা চড়ালে—আচ্ছা, এই কথাটা আমি বুঝিনে, নিজেদের মধ্যে এমনি মারামারি করে কী লাভ হয়! আমরা কি সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করতে পারিনে?

গগাঁ বললে—ব্যাস, চুপ, এইবার সত্যি-সত্যি চুপ সবাই! ভিনসেন্ট আমাদের মধ্যে খাঁটি কম্যুনিস্ট সবাই শোনো তার কথা।

ভিনসেন্ট বললে—আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে। আসলে ভেবে দেখো, আমরা কারা? কেউ না, কোনো দর নেই আমাদের। মানে, ডেগা, সিসলে আর পিসারো আমাদের পথপ্রদর্শক। ওদের ছবি লোকে স্বীকার করেছে, বড়ো বড়ো গ্যালারিতে টাঙিয়েছে। ওরা সব বড়ো রাস্তার শিল্পী। বেশ, আমরা হলাম গলিঘুঁজির ছবি-আঁকিয়ে। তাই বলে আমাদের একজিবিশন থাকবে না কেন? আমাদের ছবির গ্যালারি আমরা নিজেরাই করে নেব, ছোটো ছোটো রেস্তরাঁয়, শ্রমিকদের কারখানায়। প্রত্যেকে আমরা ধরো পাঁচখানা করে ছবি দেব, নিত্য নতুন জায়গায় টাঙানো হবে। সাধারণ লোক যে-দাম দিতে পারে, সেই দামেই বেচব। তা ছাড়া ছবিগুলো সর্বদা লোকের চোখে পড়বে, যারা গরিব তারা ভালো ছবি দেখে প্রসন্ন হবে।

ঔৎসুক্যে রুসোর চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে উঠল, বললে—চমৎকার!

সিউরাত মুখ গোঁজ করে বললে—একটা ছবি শেষ করতে আমার এক বচ্ছর লাগে। তুমি ভাবছ পাঁচ কড়ির বিনিময়ে কোনো বোকা কারিগরকে আমি তা বেচব?

বড়ো ছবি না দাও, তোমার ছোটো ছোটো স্টাডি দিতে পার।

কিন্তু ধরো এসব রেস্তরাঁ যদি আমাদের ছবি না টাঙায়?

আলবত টাঙাবে। লোকসানটা কী তাদের? লাভই বরং, সুন্দর দেখাবে দেয়ালগুলো।

কিন্তু এসবের ব্যবস্থা করবে কে? নতুন নতুন রেস্তরাঁ জোগাড়ের ভার থাকবে কার ওপার?

উল্লসিত ভিনসেন্ট বললে—সেও আমি ভেবে রেখেছি। পিয়ের ট্যাঙ্গি হবে আমাদের ম্যানেজার। সে রেস্তরাঁ ঠিক করবে, ছবি টাঙাবে, ছবি বিক্রির টাকা আদায় করবে আমাদের হয়ে।

ঠিক বলেছ। পিয়ের ট্যাঙ্গিই এ-কাজের উপযুক্ত লোক।

রুসো, লক্ষ্মীটি, দৌড়ে গিয়ে ট্যাঙ্গিকে ডেকে নিয়ে এসো তো! বলো জরুরি দরকার।

সেজান বললে—তোমাদের এই স্কিম থেকে আমাকে বাদ দাও।

চটে উঠল গগাঁ। বললে—কেন? সাধারণ লোকের চোখ লেগে লেগে কি তোমার ছবি ক্ষয়ে যাবে?

না, তার কারণ আমি এখানে থাকব না। মাস খানেকের মধ্যেই আমি এক্স-এ চলে যাচ্ছি।

ভিনসেন্ট অনুরোধ করলে—বেশ তো, তার আগে একটি বার আমাদের সঙ্গে চেষ্টা করো। তারপর যেতে চাও তো যেয়ো।

বেশ, রাজি আছি।

পিয়ের ট্যাঙ্গি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল। রুসো তাকে ব্যাপারটার আভাস দিয়েছে মাত্র, তাতেই ঔৎসুক্যে আর উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে সে।

পরিকল্পনাটা পুরোপুরি শুনে ট্যাঙ্গি বললে—নিশ্চয়! রেস্তরাঁও আমার চেনা আছে। নরভিনস রেস্তরাঁ, মালিক আমার বন্ধু। তার খালি দেওয়ালে আমরা ছবি টাঙালে খুশি বই অখুশি হবে না। ওখানে প্রদর্শনী শেষ করে আর-একটা রেস্তরাঁয় আমরা যাব। রু পিয়েরে আর-একটাকেও আমি চিনি। সারা প্যারিসে হাজারটা রেস্তরাঁ আছে, ভাবনা কী?

গগাঁ শুধোলে—তাহলে কবে থেকে শুরু?

ভিনসেন্ট বললে—দেরি কীসের? কাল থেকে শুরু হতে আপত্তি কী?

ট্যাঙ্গি বললে—হ্যাঁ হ্যাঁ, কাল থেকেই। কাল তোমরা সবাই আমার ওখানে তোমাদের ছবি পৌঁছে দিয়ে আসবে। আমি বিকেল বেলা সেগুলো রেস্তরাঁ নরভিনসে টাঙিয়ে দেব। লোকেরা ডিনার খেতে এসে রেস্তরাঁর চেহারা দেখে অবাক হয়ে যাবে। কীরকম বিক্রি দেখো, ঠিক একেবারে যেন ইস্টারের মোমবাতির মতো!—এ কি? গ্লাসটা ধরব? কী আছে এতে? বিয়ার? চমৎকার! ভদ্রমহোদয়গণ, ভ্যান গক বলেছেন আমরা অলিগলির শিল্পী, তা-ই না? তা-ই বেশ, পেতিত বুলেভার্দের কম্যুনিস্ট আর্ট ক্লাবের জয় হোক! সফল হোক তার প্রথম প্রদর্শনী!

১১

পরদিন দুপুর বেলা ট্যাঙ্গি ভিনসেন্টের কাছে এল।

বললে—নরভিনসে ছবির প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ঠিক হয়েছে। তবে কথা আছে, ডিনারটাও ওখানেই খেতে হবে এই শর্তে। রাজি তো?

আপত্তি কী?

তোমাকে নিয়ে সকলকেই বলা হল। সকলেই রাজি। তাহলে ঠিক চারটে নাগাদ আমার দোকানে আসবে। একসঙ্গে সবাই যাব। সাড়ে চারটের মধ্যে ছবিগুলো টাঙিয়ে ফেলতে হবে।

বিকেল বেলা পৌঁছে দেখে ট্যাঙ্গি এরই মধ্যে একটা হাতগাড়ি ছবি-বোঝাই করে ফেলেছে। দলের সবাই তৈরি।

পিয়ের হাঁকল—রেডি, এবার চলো সবাই।

ভিনসেন্ট বললে—গাড়িটা আমি ঠেলব ট্যাঙ্গি!

না না, এ আমার কাজ। আমি যে ম্যানেজার!

ছবিভরতি গাড়ি ঠেলে চলল ট্যাঙ্গি, পেছনে শিল্পীর দল। প্রথমে পাশাপাশি গগাঁ আর লোত্রেক, একজন যেমন লম্বা, আর-একজন তেমনি বেঁটে। তাপের সিউরাত আর রুসো। সবার পেছনে সেজান আর ভিনসেন্ট।

বেশ কিছুটা চড়াই রাস্তা ওঠবার পর গগাঁ বললে—ওহে ট্যাঙ্গি, এবার আমি একটু ঠেলি। গাড়িভরতি সব অমর প্রতিভার নিদর্শন, হাত লাগিয়ে আমিও একটু জন্ম সার্থক করি।

খবরদার! ট্যাঙ্গি চেঁচিয়ে উঠল—ছুঁয়ো না বলছি! বিপ্লবের নিশান নিয়ে আমি চলেছি, প্রথম গুলিটা আমার বুকে এসেই বিঁধুক!

কৌতুককর শোভাযাত্রা। হাতগাড়িতে আর্টের পাজা, পেছনে পদাতিক শিল্পীর দল। হাসে হাসুক পথের লোক, লজ্জা কী তাতে? সংকোচে সংকুচিত হবার পাত্রই নয় কেউ। চলেছে হইহই করতে করতে।

চিৎকার করে বললে রুসো—ওহে ভিনসেন্ট, আজ কী পেয়েছি জান? আবার একখানা চিঠি সেই মহিলাটির কাছ থেকে! খামে ভুরভুরে গন্ধ!

দৌড়ে ভিনসেন্টের পাশে গিয়ে তার নাকের কাছে খামটা ধরল। উত্তেজনায় থরোথরো মুখখানা।

রুসো আবার ফিরে গেল সিউরাতের পাশে। লোত্রেক ভিনসেন্টকে কাছে ডাকল। কানে কানে বললে—রুসোর প্রেমিকাটি কে জান?

না। কী করে জানুর?

খুকখুক করে হাসল লোত্রেক। বললে—গগাঁ। গগাঁই ওকে প্রেমের স্বাদ জোগাচ্ছে। বেচারি আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে জোটাতে পারেনি। বুকজোড়া তৃষ্ণা নিয়ে সারাজীবন ঘুরছে। গগাঁ এখন ওর নামে কয়েকটা চিঠিপত্র ছাড়বে, তারপর অভিসারের দিন আসবে। মেয়েমানুষ সেজে রুসোকে নিয়ে তুলবে ও পাড়ার একটা খালি ঘরে। ফুটোওয়ালা জানলার ফুটো দিয়ে আমরা দেখব রুসো ভায়া কেমন প্রথম প্রেমের পাঠ নেয়।

কী কাণ্ড! ছি ছি গগাঁ, তুমি একটা শয়তান!

আরে চটো কেন? আসলে ঠাট্টা। ঠাট্টায় আবার দোষ আছে নাকি?

শেষপর্যন্ত শোভাযাত্রা পৌঁছোল নরভিনস রেস্তরাঁর সামনে। সরু গলিতে ছোট্ট ভোজনাগারটি। একপাশে মদের দোকান। নীল রঙের দেয়াল, ঘর জুড়ে গোটাকুড়ি টেবিল, তাতে লাল সাদা চেক-কাটা কাপড়ের টেবিল ক্লথ। এককোণে মালিকের বসবার জন্যে উঁচু ঘেরা একটা জায়গা।

কোনখানে কার কোন ছবিটা টাঙানো হবে তা-ই নিয়ে তুমুল তর্ক শুরু হল। পিয়ের ট্যাঙ্গির মাথা খারাপ হবার জোগাড়, রেস্তরাঁর মালিক চটেই আগুন। ডিনারের সময় ঘনিয়ে এসেছে, একটু পরেই খরিদ্দাররা আসতে শুরু করবে।

পিয়ের ট্যাঙ্গি ভিনসেন্টের কাছে এল। বললে—এই নাও দুটো ফ্র্যাঙ্ক, আর কিছু পয়সা নিয়ে এদের সব ওই মদের দোকানে টেনে নিয়ে যাও। পনেরো মিনিট হাতে পেলে আমি সব ছবি টাঙিয়ে ফেলব।

বুদ্ধিটা কাজে লাগল। মদের দোকানে গলা ভিজিয়ে যখন সবাই রেস্তরাঁয় ফিরে এল, তার মধ্যে সব ছবি দেয়ালে উঠে গেছে। আর ঝগড়ার উপায় নেই। সবাই দরজার সামনে একটা বড়ো টেবিল জুড়ে বসল। পিয়ের্ ট্যাঙ্গি দেয়ালে নোটিশ টাঙিয়ে দিয়েছে—এসব ছবি জলের দামে বিক্রি হবে। মালিকের সঙ্গে কথা বলুন।

সাড়ে পাঁচটা বেজেছে। ডিনার আরম্ভ হতে আর আধঘণ্টা দেরি। স্কুলের মেয়ের মতো মনে মনে অস্থির সকলে, কখন দরজা ঠেলে প্রথম খরিদ্দারটি আসবে। রেস্তরাঁর ছবিভরতি নতুন চেহারাটা দেখে হাঁ হয়ে যাবে না!

সিউরাতের কানে কানে গগাঁ চুপি চুপি বললে—ভিনসেন্টের অবস্থাটা দেখো! এই বুঝি প্রথম স্টেজে নামছে?

লোত্রেক বললে—একটা পুরো ডিনার বাজি রাখছি গগাঁ, তোমার ছবির আগে আমার ছবি বিক্রি হবে।

আচ্ছা, আমিও রাখলাম।

সেজান বললে—ইঃ, ভারি তো শিল্পী!

অ্যাঁ! কার গলা? সেজান নাকি? তা তোমার সঙ্গে একটা কেন, তিন–তিনটে ডিনার বাজি রাখতে রাজি আছি। তোমার এক, আমার তিন।

লাল হয়ে উঠল সেজান। হাসল আর সবাই।

ভিনসেন্ট বললে—একটা কথা সবাই মনে রেখো। বিক্রির ভারটা ট্যাঙ্গির ওপর। নিজেরা যেন কেউ দরাদরি করতে যেয়ো না।

হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু আসছে না তো কেউ! কটা বাজে?

ঘড়ির কাঁটা চলল ছ-টার দিকে। আর কোলাহল নেই। সবাইকার নিশ্চল চোখ ঘড়ির কাঁটারই মতো দরজার দিকে।

অস্ফুট স্বরে সিউরাত বললে—প্যারিসের সমস্ত সমালোচকদের সামনে ছবি মেলে ধরতেও আমার এমনিধারা লাগেনি!

চুপ চুপ, ফিসফিসিয়ে উঠল রুসো—ওই দেখো রাস্তা পার হচ্ছে একটা লোক, ঢুকবে বোধ হয়!

ঢুকল না, চলে গেল পাশ কাটিয়ে। রেস্তরাঁর গড়িতে ঢং ঢং করে ছ-টা বাজল। শেষ ঢং-টার সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে ঢুকল একজন শ্রমিক। নোংরা পোশাক, মুখের ও দেহের প্রতিটি রেখায় দিনান্তের ক্লান্তির সুস্পষ্ট পরিচয়।

ভিনসেন্ট চাপা গলায় ঘোষণা করল—এইবার!

লোকটি সোজা গিয়ে বসল কোণের একটা টেবিলে। মাথার টুপিটা ছুড়ে রাখল আর-একটা চেয়ারে। ঝোল-রুটি এল, মাথা নীচু করে চিবুতে লাগল। একবার মুখ তুলে দেয়ালগুলির দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

ভিনসেন্ট মনে মনে বললে—আশ্চর্য!

এবার ঢুকল আর-দুজন শ্রমিক একসঙ্গে। টেবিলে মুখোমুখি বসেই আর-কোনো দিকে না তাকিয়ে দিনের কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে তারা তুমুল বচসা শুরু করল।

ক্রমে ঘর ভরতি হতে লাগল। মেয়ে পুরুষ দুইই আসতে লাগল। অধিকাংশ‍ই পুরোনো খরিদ্দার, টেবিলগুলো পর্যন্ত চেনা। ক্লান্ত শরীরে চেয়ারে বসে, টেবিলের ওপর খাবার আসা মাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে, একমনে চিবোয়, খাওয়া শেষ হলে পাইপ ধরিয়ে সন্ধে বেলাকার কাগজে মুখ ঢাকা দেয়। চোখ তুলে ওপর দিকে তাকাবার সময় কোথায়?

সাতটা নাগাদ ওয়েটার এসে জিজ্ঞাসা করল—আপনাদের এখন দেব কি?

উত্তর দিল না কেউ।

একটু পরে একজোড়া স্ত্রী-পুরুষ একসঙ্গে ঢুকল। কোণের আলনায় টুপিটা রাখার সময় পুরুষটির চোখে পড়ল জঙ্গল থেকে উঁকি মারা বাঘের একটা মুখ। রুসোর সেই ছবিখানা। স্ত্রীলোকটিকে সে দেখাল। শিল্পীদের টেবিলে তখন তটস্থ অবস্থা। রুসো তো উঠে দাঁড়ায় আর কি! মেয়েটি নীচু গলায় কী যেন বলতেই দুজনে হাসল। ব্যাস, এই পর্যন্ত। তারপর মুখোমুখি টেবিলে বসে মাথা নীচু করে দুজনে খেতে শুরু করল গোগ্রাসে।

পৌনে আটটার সময় দ্বিতীয় বার আর জিজ্ঞাসা না করেই ওয়েটার সুপের পাত্র বসিয়ে গেল শিল্পীদের সামনে সামনে। স্পর্শ করল না কেউ। যখন ঠান্ডা জল হয়ে গেল তখন ওয়েটার আবার পাত্রগুলো সরিয়ে নিয়ে গেল। এবার এল মাংসের কোর্মা। একমাত্র রুসো ছাড়া কারও মুখে রুচল না এমনি সুখাদ্য। সকলেই, এমনকী সিউরাত পর্যন্ত বসে বসে মদ টানল চুমুকের পর চুমুক। তাও বিস্বাদ। চারদিকে খাবারের আর মেহনতি মানুষের ঘামের গন্ধ।

একে একে খরিদ্দাররা দাম মিটিয়ে বিদায় নিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ওয়েটার বললে—মাপ করবেন, সাড়ে আটটা বেজে গেছে কিন্তু, এইবার বন্ধ করতে হবে। ট্যাঙ্গি দেয়াল থেকে ছবিগুলো একে একে নামিয়ে বাইরে ঠেলাগাড়িতে ভরতি করল। তারপর গাড়িটা ঠেলে নিয়ে চলল ফিরতি রাস্তায়।

১২

মাড়ে মোড়ে তখন আসন্ন বিষণ্ণ অন্ধকার।

গুপিল কোম্পানির পুরোনো আদর্শবাদ আর নেই, কাকা ভিনসেন্ট ভ্যান গকের ঈন গত। এখনকার লক্ষ্য শুধু বিক্রির দিকে, বাজে ছবি বেচা আর বেশি লাভ করা। ছবি যেন আর ছবি নয়, জুতোর দোকানের বা মাছের বাজারের মাল। থিয়োর এটা লাগে সবচেয়ে বেশি।

ভিনসেন্ট বলে—থিয়ো, নতুন মনিবদের আর কত তোষণ করবে? ছেড়ে মও না তোমার চাকরি!

ক্লান্ত গলায় থিয়ো উত্তর দেয়—সব ছবির ব্যাবসাদারই সমান আজকাল। এতদিন আছি, কোথায় যাব এদের ছেড়ে?

চুলোয় যাবে। দিনের পর দিন ওদের ওখানে তুমি শুকিয়ে উঠছ। ছাড়তেই হবে তোমার এই সর্বনেশে চাকরি। আমার কথা? ভেবো না ভেবো না, ঠিক ভেসে থাকব আমি। আচ্ছা থিয়ো, সারা প্যারিসে তরুণ ছবিওয়ালাদের মধ্যে সবচেয়ে তোমার নাম! নিজে একটা দোকান করো না কেন তুমি?

নাঃ, আবার গোড়া থেকে সেই আলোচনা করতে হবে তোমার সঙ্গে!

না, শোনো থিয়ো। চমৎকার একটা আইডিয়া আমার মাথায় এসেছে। এসো আমরা সবাই মিলে একটা কম্যুনিস্ট আর্টের দোকান খুলি। আমাদের সব ছবি আমরা তোমাকে দেব, তুমি দোকান চালাবে, আর যা লাভ হবে সকলে সমান ভাগে ভাগাভাগি করে নেব। প্যারিসে একটা দোকান খোলার মূলধন শিল্পীরাই জোগাড় করে দেবে, আর গ্রামে সস্তায় সবাই এক জায়গায় বসবাস করবে। কত কম খরচে থাকা যাবে ভাবো! আর এমনি একটা দোকান খুললে নতুন নতুন ছবিবিলাসীদের খদ্দের করা যাবেই।

ভিনসেন্ট, ভয়ংকর মাথা ধরেছে আমার, শুতে চললাম এখন।

ঘুমুতে চাও তো রবিবার আছে। আজ আমার কথা মন দিয়ে শোনো। কী, জামাকাপড় ছাড়বে? তা ছাড়ো, কিন্তু কানটা আমার কথায় রাখো। গুপিলের চাকরিতে তোমার প্রাণ ওষ্ঠাগত, এ-দিকে প্যারিসের এতগুলো তরুণ শিল্পী তোমার হাতের মুঠোয়, তবুও এ-সুযোগ তুমি নেবে না?

পরদিন সন্ধ্যা বেলা লোত্রেক আর পিয়ের ট্যাঙ্গিকে নিয়ে ভিনসেন্ট বাড়ি ঢুকল। থিয়ো আসা করেছিল ভিনসেন্ট হয়তো রাত করেই ফিরবে, সে-আশায় পড়ল জলাঞ্জলি।

পিয়ের ট্যাঙ্গির ছোটো ছোটো চোখ দুটো উৎসাহে পিটপিট করছে। থিয়োর হাত চেপে ধরে সে বলে উঠল—মশিয়েঁ ভ্যান গক, মশিয়েঁ ভ্যান গক, অপূর্ব আইডিয়া! এমনটি আর হয় না! কী মহৎ, কী বিরাট! করতেই হবে আপনাকে! আমি দোকান তুলে দিয়ে আপনাদের সঙ্গে থাকব। রং গুলব, ক্যানভাস ইস্ত্রি করব, ছবি বাঁধাই করব আমি। শুধু দু-বেলা দুটি খাবার আর থাকবার আশ্রয়টুকু দেবেন। আর কিছু চাইনে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের বইটা নামিয়ে রাখল থিয়ো, বললে—আইডিয়া তো ভালো, কিন্তু টাকা কোথায় পাব? দোকান খোলা, বাড়ি ভাড়া নেওয়া, খোরাক জোগাড় করা, এসব হবে কোত্থেকে?

চেঁচিয়ে উঠল ট্যাঙ্গি—এই তো আমি এনেছি! ধরুন, ধরুন হাত পেতে। দুশো কুড়ি ফ্র্যাঙ্ক, এতদিন যা-কিছু জমিয়েছি, সব। এই দিয়ে শুরু করুন।

থিয়ো বললে—লোত্রেক, তুমি তো বেশ বিচক্ষণ লোক একজন, বলো তো, এমনি পাগলামির কোনো মানে হয়?

পাগলামি কেন? আমার তো পরিকল্পনাটা খুব ভালোই লাগছে। পুরোনো সংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই না করে এখন তো আমরা নিজেদের মধ্যেই লড়াই করছি। কিন্তু একবার যদি আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারি—

বেশ তো। তোমার তো অনেক পয়সা। আরম্ভের খরচটা তুমিই দাও।

তাহলে কী করে হবে? পরিকল্পনার মূলমন্ত্র হল সাম্য। আমি দেব, তবে ওই ট্যাঙ্গি যা দিয়েছে তা-ই, দুশো কুড়ি ফ্র্যাঙ্ক।

পরিকল্পনা না হাতি! ব্যাবসার বাজারের কিছুটা ধারণা যদি তোমাদের থাকত—

আবার থিয়োর দু-হাত চেপে ধরল ট্যাঙ্গি—মশিয়েঁ ভ্যান গক, অনুরোধ করছি আপনাকে, এমন আইডিয়াটাকে পাগলামি বলে উড়িয়ে দেবেন না। এটা আপনাকে সফল করে তুলতে হবেই হবে।

ভিনসেন্ট বললে—আর তোমার পালাবার রাস্তা নেই থিয়ো, বাঁধা পড়েছ আষ্টেপৃষ্ঠে। আমরা সবাই মিলে যতটা সম্ভব টাকা তুলে তোমার হাতে দিচ্ছি। তোমাকে কর্তা বানাচ্ছি আমাদের। গুপিলের কথা ভুলে যাও। ওখানকার কাজ তোমার খতম। এখন থেকে তুমি আমাদের কম্যুনিস্ট আর্ট কলোনির ম্যানেজার। ঘর্মাক্ত কপালটায় থিয়ো একবার হাত বুলিয়ে নিল, ভালো করে কচলে নিল চোখ দুটো।

বললে—কলোনি না চিড়িয়াখানা! মানসচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, তোমাদের মতো বুনো জানোয়ার চরিয়ে আমি বেড়াচ্ছি দিনের পর দিন।

পরদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে থিয়ো দেখে, মস্ত মিটিং বসেছে। শিল্পীদের ভিড়। তামাকের ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার, হট্টগোলে প্রায় চিড় ধরে ঘরের দেয়ালে। হালকা একটা টেবিলের ওপর চড়ে বসেছে ভিনসেন্ট, সে-ই এই সভার মূল গায়েন।

ঢুকতেই সে শুনল ভিনসেন্টের চিৎকার—না না, মাইনে আবার কী? টাকা ছোঁবে না কেউ অন্তত একটি বছর! থিয়ো শুধু ছবি বেচবে, আমরা পাব আহার, আশ্রয় আর ছবি আঁকার জিনিসপত্র।

সিউরাত হাঁকলে—আর যাদের ছবি বিক্রি হবে না কোনোকালে? কতদিন তাদের আমরা পুষব?

যতদিন তারা আমাদের সঙ্গে থাকতে চায়, একসঙ্গে কাজ করতে চায়। গগাঁ বললে—চমৎকার! সত্যিকারের চিড়িয়াখানা! সারা ইয়োরোপের যত অ্যামেচারের দল দোরগোড়ায় ভিড় করে আসবে তাহলে! এমন তোফা আরাম আর নিখরচায় মিলবে কোথায়?

থিয়োর ওপর প্রথম চোখ পড়ল পিয়ের ট্যাঙ্গির। চিৎকার করে উঠল সে—এই তো মশিয়েঁ ভ্যান গক এসে গেছেন, জয়, আমাদের ম্যানেজারের জয়!

জয়, ম্যানেজারের জয়! জয় বন্ধুপ্রবর থিয়ো ভ্যান গকের জয়!

প্রত্যেকের অত্যন্ত উত্তেজিত অবস্থা। প্রত্যেকেরই কিছু-না-কিছু বলবার আছে। রুসোর প্রশ্ন, কলোনিতে গিয়ে সেখানে সে বেহালা বাজানো শেখাতে পারবে কি না, কেননা সেটা তার উপরি আয়ের পথ। আঁকোয়েতিন বললে—তাড়াতাড়ি চলো, কেননা তার তিন মাসের বাকি ভাড়া পড়ে আছে। সেজানের মত—কারও যদি অতিরিক্ত নিজস্ব টাকা থাকে, সে-টাকা খরচ করবার অধিকারও থাকবে। ভিনসেন্ট বললে—না, এ হলে সাম্যবাদের মৃত্যু। সবাইকার ভাগ সমান, আলাদা কিছু কারুর থাকলে চলবে না। লোত্রেক জানতে চায়—কলোনিতে থাকতে হলে ইচ্ছেমতো মেয়েমানুষ আমদানি করা চলবে কি না, সেখানেও সাম্যবাদ কি না? গগাঁ বললে—প্রত্যেকের অন্তত মাসে দুটো করে ছবি আঁকা চাই-ই চাই। সিউরাত বললে—মাপ করো তাহলে আমাকে, আমার একটা ছবি শেষ করতে এক বছর লাগে।

পিয়ের ট্যাঙ্গি নতুন একটা প্রশ্ন তুলল—–আচ্ছা, রং আর ক্যানভাসও কি প্রত্যেকে হপ্তায় সমান ভাগে পাবে?

ভিনসেন্ট বললে—তা কেন? সত্যিকারের যার যতটা আঁকার জিনিসপত্র দরকার ঠিক ততটাই পাবে। খাবারের মতো আর কি।

বেশ, কিন্তু বাড়তি টাকাটা কী হবে? মানে, ছবি বিক্রি শুরু হবার পর টাকা তো আসবে, লাভ তো হবে, লাভটা পাবে কে?

কেউ না। যেই হাতে কিছু টাকা জমবে, অমনি আর-একটা বাড়ি নেব ব্রিটানিতে। আরও কিছু জমলে প্রভেন্সে। এমনি করে আমাদের কেন্দ্রের সংখ্যা

বেড়েই চলবে। ঘুরে ঘুরে বেড়াব আমরা যখন যেখানে খুশি।

আচ্ছা, রেলভাড়াটা কে দেবে শুনি?-সেও কি ওই লাভ থেকেই? তা ছাড়া কে কতটা বেড়াবে, তার হিসেব করবে কে?

ধরো, খুব ভালো সময়ে কোনো একটা কেন্দ্রে শিল্পীদের গাদাগাদি ভিড়। কে জায়গা পাবে, আর কে জায়গা না পেয়ে অন্য কেন্দ্রের সন্ধানে রেলে চাপবে এর হুকুম দেবে কে?

থিয়ো আমাদের ম্যানেজার, থিয়ো জবাব দিক এসব প্রশ্নের। এই ধরো না কেন, সভ্য হবে কারা, নতুন সভ্য নেওয়া হবে কি না, যা খুশি আঁকবার স্বাধীনতা থাকবে কি না, যার যেমন খুশি মডেল আনতে পারবে কি না—এসব এখুনি ঠিক করে নিতে হবে বই কী।

সভা ভঙ্গ হল শেষরাত্রে। থিয়ো শুতে গেল চারটের সময়, ভিনসেন্ট পিয়ের ট্যাঙ্গি প্রভৃতি সবচেয়ে উৎসাহীদের নির্দেশ কানে নিয়ে যে আগামী মাসের পয়লা তারিখেই তাকে গুপিলসয়ের চাকরিতে নোটিশ দিতে হবে।

.

দিন যায়, উত্তেজনা বাড়ে। খবরটা ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা যেমন সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠছিল, তেমনি মুখর হল তরুণ শিল্পীরা উৎসাহদীপ্ত আলোচনায়। ভিনসেন্ট দিনরাত পাগলের মতো বকতে আর খাটতে লাগল। ব্যবস্থার, আর শেষ নেই, হাজার রকমের ব্যবস্থা। কোথা থেকে টাকা আসবে, কোথায় দোকান করা হবে, কীরকম দাম ধরা হবে এক-একটা ছবির, কারা কারা সভ্য হবে, গ্রামের আস্তানা কোথায় হবে, কারা পরিচালনা করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। থিয়ো অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেও শেষপর্যন্ত এই উত্তেজনায় গা ভাসিয়ে দিল। প্রত্যেক সন্ধ্যায় তার ফ্ল্যাটে ভিড় আর ভিড়। খবরের কাগজের রিপোর্টার আসে খবর কুড়োতে, চিত্রসমালোচকরা আসে নতুন আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে, সারা ফ্রান্সের যত তরুণ শিল্পী প্যারিসে পৌঁছে আসে সভ্য হবার আবেদন জানাতে।

থিয়ো যদি এই নব-আন্দোলনের রাজা, ভিনসেন্ট তাহলে রাজমন্ত্রী। সে-ই আসল সংগঠক। অসংখ্য পরিকল্পনা, প্রচারপত্র, হিসেব, আবেদন, ইতিহাস সে বার করতে লাগল, সারা ইয়োরোপে ছড়িয়ে দিল এই নতুন কম্যুনিস্ট আর্ট কলোনির খবর।

এত কাজের মধ্যে একটি কাজ সে ভুলে গেল, সে-কাজ ছবি আঁকার কাজ।

প্রতিষ্ঠানের তহবিলে প্রায় তিন হাজার ফ্র্যাঙ্ক জমা হল। শিল্পীরা তাদের শেষ কপর্দক পর্যন্ত তুলে দিল। বুলেভার্দ ক্লিচিতে একটা শিল্পমেলা বসল, প্ৰত্যেক শিল্পী সেখানে নিজের নিজের ছবি বিক্রি করতে বসল। ইয়োরোপের সব জায়গা থেকে চিঠি আসতে লাগল, কিছু কিছু অর্থসাহায্যও। প্যারিসের শিল্পরসিকরাও অনেকেই ভিক্ষার ঝুলিতে কিছু কিছু ফেলতে লাগলেন। এত সব ব্যাপারের প্রকৃত সম্পাদক বলতে ভিনসেন্ট, কোষাধ্যক্ষ বলতেও ভিনসেন্ট।

থিয়ো জোর করল, পাঁচ হাজার ফ্র্যাঙ্ক সংগ্রহ হবার আগে সে নামতে রাজি নয়। রু ট্রঞ্চেটে একটা চমৎকার দোকানঘর সে ইতিমধ্যেই দেখে রেখেছে। মফস্সলে একটা বিরাট বাড়িও খুঁজে বার করেছে ভিনসেন্ট, স্বল্পতম ভাড়ায় যেটা মিলবে। সভ্যনামলোভীদের আবেদনের সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য ছবিও আসতে লাগল, রু লোপেকের ঘর ক-খানায় হাঁটাচলার জায়গা আর রইল না। এত স্বল্প পরিসরের মধ্যেই ওই ছোট্ট ফ্ল্যাটটিতে প্রতিদিন শত শত লোকের আনাগোনা। থিয়োর অত সাধের আসবাবগুলোর আর-কিছু রইল না। বাড়িওয়ালা এত হট্টগোল দেখে নোটিশ দিল থিয়োকে।

দিনান্তে ভিনসেন্টের তার প্যালেটের কথা মনে পড়ে না। সময় কোথায়? মুহূর্তের বিশ্রাম নেই যে! কত চিঠি লিখতে হচ্ছে, কত লোকের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে হচ্ছে, প্রতিটি নতুন শিল্পীর প্রাণে যে জাগিয়ে তুলতে হচ্ছে এই নব শিল্প–আন্দোলনের উদ্দীপনা! চিৎকার করে করে গলা তার ভেঙে গেল, চোখে ফুটে উঠল জ্বরাক্রান্তের দৃষ্টি। আহার নিদ্রা ঘুচল। কেবল কাজ আর কাজ।

বসন্তকালের গোড়ার দিকে পাঁচ হাজার ফ্র্যাঙ্ক জমল। থিয়ো ঠিক করল এবার চাকরিতে ইস্তফা দেবার সময় এসেছে। দোকানটা নেওয়া সে স্থির করল। ভিনসেন্ট গ্রামের বাড়িটার জন্যে অগ্রিম ভাড়া পাঠিয়ে দিল কিছু টাকা। থিয়ো, ভিনসেন্ট, পিয়ের ট্যাঙ্গি, গগাঁ আর লোত্রেক—এই পাঁচজনে মিলে প্রাথমিক সভ্যদের তালিকা প্রণয়ন করল। ছবির পাহাড় ঘেঁটে থিয়ো তার প্রথম প্রদর্শনীর চিত্র নির্বাচন করল। দোকানের ভেতরটা কে সাজাবে আর বাইরেটাই-বা কে—এই নিয়ে রুসো আর আঁকোয়েতিনের মধ্যে যাচ্ছেতাই ঝগড়া হয়ে গেল একদিন। থিয়োরও ঘুম নেই, ঘুম নেই বলে দুঃখও নেই। ভিনসেন্টের মতো সেও লেগেছে প্রাণপণে আহার নিদ্রা ত্যাগ করে। গরমকাল পড়তে-না-পড়তেই কলোনির প্রতিষ্ঠা হবে, সেইসঙ্গে প্যারিসের দোকানেরও।

.

একদিন সারারাত্রির পরিশ্রমের পর একান্ত ক্লান্তিতে ভিনসেন্ট ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল। থিয়ো অফিসে বার হবার সময় তাকে ডাকল না। ঘুম ভাঙল, একেবারে দুপুর বেলা। পায়ে পায়ে সে তার স্টুডিয়োতে গেল। ইজেলের ওপর কতদিন থেকে একটা ক্যানভাস লটকে রয়েছে। প্যালেটের রংগুলো শুকনো, ধুলোপড়া। রঙের টিউবগুলো ছত্রাকার হয়ে পড়ে রয়েছে ঘরের এক কোণে মেঝেতে। শুকনো রংমাখা নোংরা তুলিগুলো এদিক-ওদিক ছড়ানো

অন্তরের অন্তস্তল থেকে উঠল একটি নীরব প্রশ্ন—শোনো একটি কথা। বলো তো, কে তুমি? শিল্পী? না সাম্যবাদী সংগঠক?

গাদা গাদা ক্যানভাস সারা ঘরে। শিল্পীনামলোভী সভ্যপদপ্রার্থীদের আঁকা। সব ছবি সে কুড়িয়ে নিয়ে থিয়োর শোবার ঘরে ফেলে রেখে এল। রইল শুধু নিজের আঁকা ছবিগুলো। একটা একটা করে ছবিগুলো সে ইজেলে দাঁড় করিয়ে দেখতে লাগল নিবিষ্ট মনে, সমালোচকের দৃষ্টিতে। ব্যস্ততার তার শেষ নেই, তবু একলা ঘরে নির্জন দুপুরে বয়ে যেতে লাগল হিসাববিহীন সময়

হ্যাঁ, সত্যি সে উন্নতি করছিল বই কী, এগিয়ে চলছিল নির্ভুল পথে। রং তার হালকা হয়ে আসছিল, ক্রমে যেন তার সৃষ্টির দিগন্তে নেমে আসছিল আকাশের ঔজ্জ্বল্য। অনুকরণের চিহ্নও তো নেই। যে-লোক একদা ভেবেছিল অন্য শিল্পীদের অনুকৃতির মধ্যে দিয়েই সুলভ শিক্ষাকে সম্পূর্ণ করবে, তার সৃজনশৈলীতে একাত্ত ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট প্রকাশ। এর নবীনত্বে নিজেই সে বিস্মিত হয়ে গেল। এসব কার হাতের কাজ? তার নিজের!

ইম্প্রেশনিজময়ের যা মৌলিক গুণ তা সে নিজের মধ্যে গ্রহণ করেছে, কিন্তু নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি তারই মধ্যে। তার অঙ্কনপদ্ধতি ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে বিচিত্র একটা ধরনে, একান্ত স্বকীয় বিশিষ্টতায়।

একেবারে শেষের দিকে আঁকা ক্যানভাসগুলো ইজেলে রেখে প্রায় চিৎকার করে উঠল সে। প্রায় সে ধরে ফেলেছে নিজের একটা বিশিষ্ট পদ্ধতিকে, সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষের নীরব সাড়া যেন চুপি চুপি প্রকাশ হয়ে চলেছে ওই ছবিগুলোর মধ্যে।

অনেকদিন সে কাজ করেনি। নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি দিয়ে সে তাই তার কাজ দেখতে পারছে। বুঝতে পারছে, পথ সে পেয়েছে, হবে তার।

আরশিতে ভালো করে নিজের চেহারাটা দেখল ভিনসেন্ট। দাড়ি ছাঁটা দরকার, চুল কাটা দরকার, বদলানো দরকার ময়লা পোশাক। পরনের সুটটা সে ভালো করে ইস্ত্রি করে নিল, পরল থিয়োর একটা ফরসা শার্ট। পকেটে পাঁচটা ফ্র্যাঙ্ক নিয়ে গেল নাপিতের দোকানে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করল মোমার্ত বুলেভার্দ, একেবারে থিয়োর গুপিল গ্যালারি পর্যন্ত।

থিয়ো, আমার সঙ্গে একটু সময়ের জন্যে বাইরে আসতে পারবে?

কী হল তোমার?

কিছু না। টুপিটা নাও, বাইরে চলো। কাছাকাছি কোথাও একটা কাফে-নেই যেখানে নিরিবিলি কথা বলা যায়?

কাফের পেছন দিকের নিভৃত কোণের বেঞ্চিতে বসে থিয়ো বললে, জানো ভিনসেন্ট, বোধ হয় মাস খানেক পরে তোমার সঙ্গে এই একলা বসে কথা বলছি!

জানি, জানি। বোকা আমি!

এ-কথা কেন বললে?

থিয়ো, একটা প্রশ্নের জবাব দাও। আমি কী? শিল্পী, না সাম্যবাদী সংগঠক?

তার মানে?

শিল্পীদের এই কলোনিটা বানাতে এত আমি খাটছি যে, আমিও যে আঁকি সে-কথা ভুলে গেছি। আর, একবার যদি বাড়িটা নেওয়া হয়, তারপর তো আর

রক্ষা থাকবে না!

তা বটে, কথাটা সত্যি।

থিয়ো, আমার কথা শোনো। আমি শিল্পী, আমি আঁকতে চাই। গত ক-বছর ধরে যে-পরিশ্রম আমি করেছি, তা অপর আঁকিয়েদের মেস-ম্যানেজার হবার জন্যে নয়। নিজের রং, নিজের তুলির তৃষ্ণায় বুক আমার শুকিয়ে এসেছে। ইচ্ছে হচ্ছে কালই আমি প্যারিস ছেড়ে পালাই।

কিন্তু ভিনসেন্ট, এতটা এগিয়ে—

বলিনি তোমাকে, বোকা আমি! নিরেট বোকা। শুনবে পুরোপুরি আমার স্বীকারোক্তি?

বলো।

এই শহর আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে, এখানকার অন্য সব শিল্পীদের আমার অসহ্য লাগছে। আর একমুহূর্ত যেন আমি সইতে পারছিনে তাদের বক্তৃতা, তাদের থিয়োরি, তাদের ঝগড়াঝাঁটি, আত্মপ্রশংসা আর পরনিন্দা। হেসো না থিয়ো, জানি, আমিও এদেরই দলে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু চোখ আমার ফুটেছে। মভ একটা দামি কথা বলেছিল—কেউ হয়তো ছবি আঁকে, আর কেউ ছবি নিয়ে কথা বলে, কিন্তু দু-কাজ একসঙ্গে কেউ পারে না। থিয়ো, তুমিই বলো, এই সাতটা বছর তুমি যে আমার ভরণ-পোষণ করছ, সে কি আর্ট নিয়ে খুব মাতব্বরি তর্ক করতে আমি শিখব তাই বলে?

কিন্তু এই কলোনির জন্যে তুমি অনেক দামি কাজ করেছ ভিনসেন্ট!

হ্যাঁ, এইবার সময় এসেছে কলোনিতে উঠে যাবার। ঠিক এই মুহূর্তে আমার মনকে আমি বুঝতে পারছি। আমি যেতে চাইনে। ওই আড্ডায় থেকে আর কোনো কাজ আমি করে উঠতে পারব না। থিয়ো, আমার মনের কথা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারব কি না জানিনে….কিন্তু যে করে হোক, বুঝতে তোমাকে হবেই।…পারবে না? মনে করো আমি যখন একলা হেগ-এ বা ব্রাবান্টে থাকতাম, সঙ্গীসাথি কেউ ছিল না, নিজেকে মনে হতো একটা প্রয়োজনীয় লোক। আমি যেন একলা একটা মানুষ, সারা দুনিয়ার সমস্ত শত্রুতার বিরুদ্ধে লড়াই করছি। আমি শিল্পী, একমাত্র শিল্পী। যা-কিছু আঁকছি তার প্রত্যেকটির দাম আছে, একদিন-না-একদিন পৃথিবী আমাকে স্বীকার করতে বাধ্য হবেই, মানতেই হবে, হ্যাঁ, লোকটা অপূর্ব একটা আঁকিয়ে।

আর এখন?

হায় রে হায়! এখন আমি কোথায়? অগণিতের ভিড়ে হারিয়ে গেছি। আমার চারদিকে প্রতিমুহূর্তে একশো ছবি-আঁকিয়ের ভিড়, ওরা সবাই যেন আমাকে বিদ্রুপ করছে। ভেবে দেখো, আমাদের কলোনিতে যোগ দেবার জন্যে কত আঁকিয়ে কত গাদা গাদা ছবি পাঠিয়েছে। ওরা সবাই ভাবছে মস্ত শিল্পী হবে প্রত্যেকে। আজ আমার আর কোনো নিজস্ব সত্তা নেই, ওদেরই অন্যতম হয়ে গেছি। আমিও কি মস্ত শিল্পী হব কোনোদিন? কে জানে? আমিও তো ওদেরই একজন। ভরসা কোথায় আর আমার? এত মূর্খ যে আছে, যারা অলীক স্বপ্ন দেখে ব্যর্থ জীবনের বোঝা বয়ে চলে, আগে আমি জানতাম না। প্যারিসে এসে জানলাম। তাই এত আশঙ্কা, এত আতঙ্ক।

কীসের ভয় তোমার? ওদের সঙ্গে কী সম্বন্ধ তোমার?

কিছুই না। তবু ভয়। একবার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়েছে, সেই দুর্বলতাটা ঘুচবে না কিছুতেই। গ্রামের মধ্যে একলা যখন থাকি, ভুলে থাকি যে পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজার হাজার ছবি আঁকা হচ্ছে। ভাবি যে-ছবিটি আমি আঁকছি শুধু সেইটির কথা, মনে হয় আমার শিল্প পৃথিবীর হাতে সুন্দরতম* উপহার। যত খারাপই হোক না আমার কাজ, তবু গ্রামে বসে মায়া নিয়ে মতিভ্রম নিয়েই হয়তো কাজ করে যেতে পারতাম। কিন্তু এখন? বুঝতে পারছ না আমার কথা, থিয়ো?

বুঝছি বই কী ভিনসেন্ট।

তা ছাড়া দেখো, শহরের শিল্পী আমি নই। এখানকার কেউ আমি নই। কৃষাণজীবন নিয়ে আমার কারবার, আমার সেই দিগন্তজোড়া শস্যের খেতে আমি ফিরে যেতে চাই। সেখানকার মুক্ত আকাশের দুরন্ত রোদ আমার মনের সবকিছু আবর্জনা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেবে, শুধু শিল্পসাধনার একান্ত আগ্রহটি ছাড়া। আস্তে আস্তে থিয়ো বললে—তার মানে….তুমি….এই প্যারিস থেকে চলে যেতে চাও?

হ্যাঁ, যেতেই হবে আমাকে, থিয়ো।

আর, এই কলোনির কী হবে?

আমি নাম কাটিয়ে দেব। তুমি এটাকে গড়ে তোলো।

থিয়ো মাথা নাড়ল—না, তুমি না থাকলে আমি নেই।

কেন থিয়ো?

জানিনে। তোমার জন্যেই আমি এর পেছনে খেটে চলেছিলাম, তুমি চেয়েছিলে বলেই।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল দুজনে, একটু পরে ভিনসেন্ট বললে—তুমি এখনও চাকরিতে নোটিশ দাওনি, না?

না। পয়লা তারিখে দেব ভেবেছিলাম।

যে যে টাকা দিয়েছে, তাদের তাদের টাকা ফিরিয়ে দিলেই চলবে।

হ্যাঁ, তা চলবে। কবে তুমি যেতে চাও?

দেরি করব না, প্যালেটটা আর-একটু হালকা হলেই বিদায় নেব।

ও!

কোথায় যাব জানিনে। হয়তো দক্ষিণে। সমুদ্রের ধারে কোনো অজানা জায়গায়। যেখানে আমি আবার একলা হতে পারব, সবকিছু ছেড়েছুড়ে আবার শুধু আঁকতে পারব, সেখানে খুঁজে খুঁজে আবার ফিরে পাব নিজেকে।

ভিনসেন্ট দু-হাত বাড়িয়ে থিয়োর কাঁধ দুটো জড়িয়ে ধরল—থিয়ো, বলো, তুমি আমাকে ঘেন্না করো না? তোমাকে এতদূর টেনে এনে সব নষ্ট করে দিয়ে আমি সরে পড়ছি, বলো রাগ করবে না এতে আমার ওপর?

ম্লান করুণ হাসি হাসল থিয়ো—ঘেন্না করব! তোমাকে? রাগ করব তোমার ওপর?

ভিনসেন্টের ডানহাতটিতে ছোট্ট একটু চাপড় মেরে সে উঠে দাঁড়াল। বললে—পাগল! বুঝেছি বই কী আমি! তুমিই ঠিক। চলে যাবে বই কী। নিশ্চয়! নাও, গেলাটা শেষ করে নাও। আমাকে গুপিলসে আবার ফিরে যেতে হবে।

১৩

কোথায় যাব? কোথায় গেলে আবার ফিরে পাব আমাকে? শিল্পলক্ষ্মী কেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দূরে সরে যায় অধরা মায়াবিনীর মতো? কবে সে ধরা পড়বে আমার রেখার বন্ধনে, রঙের ইন্দ্রজালে!

ছটফট করে ভিনসেন্ট। একমাস কেটে গেল, একমাস আগে আহ্বান এসেছে, তবু সে এখনও বন্দি।

থিয়োই কথা বললে—বুঝেছি, পেয়েও হারাচ্ছ যেন, তা-ই না? কী যেন পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে, তা-ই না! আমি জানি এর কারণ

জানো? জানো থিয়ো? কী বলো তো?

যা ভেবেছিলে তা-ই। প্যারিস।

প্যারিস?

হ্যাঁ! প্যারিস তোমার আঁকা শেখার ইস্কুল। যতদিন এখানে থাকবে ইস্কুলের ছাত্র হয়েই থাকবে। আমাদের হল্যান্ডের ইস্কুলের কথা মনে আছে? সেখানে শুধু শিখেছিলাম কী করে কী করতে হয় আর লোকে কী কী করে। নিজেরা কিন্তু কিছু করিনি।

আর-একটু স্পষ্ট করে বলো।

নিজে যখন সত্যিকারের কিছু করবে তার আগে মাস্টারের সাহচর্য ঘুচিয়ে দিতে হবে। যতদিন ছাত্রবৃত্তি, ততদিন শিক্ষা, সাধনা নয়, সৃষ্টি তো নয়ই। তুমি চলে গেলে কতটা ফাঁকা লাগবে আমার সে আমিই জানি, তবু তোমাকে যেতে হবে। পৃথিবীতে তোমার নিজের একটা জায়গা তুমি পাবেই, আর সে জায়গা তোমার নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু যত শীঘ্র পারো এই পাঠশালার গলি তোমার না ভুললে চলবে না।

জান ভাই, কোন দেশের কথা আজকাল আমার কেবলই মনে পড়ছে?

বলো।

আফ্রিকা।

আফ্রিকা!

হ্যাঁ। সেখানকার আকাশে জ্বলন্ত সূর্য, কুয়াশা-জড়ানো নয় সেখানকার রোদ। এই জঘন্য দীর্ঘ শীত সেখানে অজানা। সেখানেই দেলাক্রোয়া তার রং খুঁজে পেয়েছিল, আমিও সেখানে হয়তো খুঁজে পাব আমাকে।

আফ্রিকা, সে যে অনেক দূর!

শোনো থিয়ো, সূর্যকে আমি চাই, যে-সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপ আর প্রচণ্ড শক্তি, সমস্ত সৃষ্টি সমস্ত জীবন যে-শক্তিতে নিত্য উদ্ভাসিত। প্যারিসের এই শীত, এ আমার প্যালেটে বাসা বেঁধেছে। সারা শীতকাল ধরে আমি খালি দক্ষিণ দেশের কথা ভেবেছি, বিষুবরেখা আমাকে যেন চুম্বকের মতো টেনেছে। তুমি বলছ প্যারিসে আমার আত্মবিকাশের কোনো রাস্তা নেই। জ্বলন্ত সূর্যের নীচে সূর্যমুখীর মতো বিকশিত হতে চাই আমি। আমার বুকের মধ্যে শীত জমে আছে, সেই শীতকে আফ্রিকার সূর্য ছাড়া কে তাড়াবে? আগুন লাগিয়ে কে দেবে আমার প্যালেটে?

আমার মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। দাঁড়াও, ভেবে দেখি—বললে থিয়ো।

.

পল সেজান প্যারিস থেকে বিদায় উপলক্ষ্যে বন্ধুদের একটা পার্টি দিল। বাপের আনুকূল্যে এক্সের পাহাড়ে সে কিছুটা জমি কিনেছে, সেখানে স্টুডিয়ো বানিয়ে থাকবে।

ভিনসেন্টকে সে বললে—তুমি প্যারিস ছাড়ো ভিনসেন্ট, প্রভেন্সে চলো। অবশ্য এক্স নয়, সেটা আমার এলাকা, তবে কাছাকাছি আর কোনো জায়গায়। অমন রোদ আর দুনিয়ায় কোথাও পাবে না। আমি এই যে যাচ্ছি, আর ফিরছিনে।

গগাঁ বললে–এর পরে আমার পালা। আমি আবার ট্রপিকসে ফিরে যাব। প্রভেন্সের রোদের কথা বলছ, মারকোয়েসাসের সূর্যকে তোমার ওই প্রভেন্সে বসে কল্পনাও করতে পারবে না। ওখানকার যারা অধিবাসী তারা যেমন আদিম, ওখানকার সূর্যও তেমনি আদিম।

সিউরাত বললে—আমিও তো দেখছি তোমাদের মতো সূর্য-উপাসকদের দলে যোগ দিলেই ভালো হয়!

ভিনসেন্ট বললে—আমিও চলছি, আমি যাব আফ্রিকায়।

লোত্রেক বললে অস্ফুট স্বরে—বটে, বটে! তাহলে দু-নম্বর দেলাক্রোয়া গজাবে আর কি!

গগাঁ শুধোলে—ভিনসেন্ট, সত্যি?

সত্যি। আজ না হোক, দু-দিন পরে, যাবই। সূর্যটাকে সইয়ে নেবার জন্যে ক-দিন ওই প্রভেন্সেই কোথাও গিয়ে থাকা উচিত, তা-ই না?

সিউরাত বললে—মার্সাই বাদ দিয়ে, ওটা মস্তিচেলির জায়গা।

ভিনসেন্ট বললে—ওই তো মুশকিল। এক্স বাদ দিয়ে, ওটা সেজানের। আম্ভিবিসয়ে যাবার উপায় নেই, ওটা মনে-র জায়গা বলে বিখ্যাত। কোথায় যাই তাহলে?

দাঁড়াও! লোত্রেক বলে উঠল—আমি একটা জায়গার নাম বলতে পারি। আর্লস-এর কথা ভেবে দেখেছ?

আর্লস? পুরোনো একটা রোমান জনপদ, তা-ই না?

হ্যাঁ, ঠিক রোন নদীর ওপর। মার্সাই থেকে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। আমি একবার গিয়েছিলাম। ওখানকার ল্যান্ডস্কেপের রং দেলাক্রোয়ার রংকে লজ্জা দেবে।

সত্যি বলছ? সূর্যটা কেমন?

সূর্য? তোমাকে পাগল বানাবার মতো। আর তা ছাড়া আর্লস-এর মেয়ে! আহা! সারা দুনিয়ায় এমন জবর মেয়ে আর কোথাও মিলবে না ভায়া! মুখে-চোখে সেই প্রাচীন গ্রিক ভাস্কর্য, যেন চিকন করে পাথর কুঁদে কাটা। চেহারাটা কিন্তু ঠিক রোমানদের মতো—হাত, পা, বুক–একেবারে খাসা জিনিস! এদিকে আবার গায়ের গন্ধ কেমন জান? একেবারে পূর্ব দেশের। সত্যিকারের যে ভেনাস তার দেখা আজও ওই আর্লসেই মিলবে।

খুব লোভ দেখাচ্ছ যে! ভিনসেন্ট বললে।

বাপু, তোমার আমার নয়, দেবতাদের লোভ লাগে। এর ওপর আবার যখন ঝড়ের ঝাপট খাবে, তখন তো বুঁদ হয়ে যাবে!

ঝড়ের ঝাপট! সেটা কীরকম?

আগে যাও। গেলেই টের পাবে।

তা ছাড়া থাকা-খাওয়া কেমন? সস্তা?

ওই থাকা আর খাওয়া। তা ছাড়া আর খরচ নেই। অতএব এর চাইতে সস্তা আর কী চাও?

আর্লস—বিড়বিড় করে ভিনসেন্ট বললে—আর্লস, আর আর্লসের মেয়ে মন্দ কী?

জ্বালা ধরানো মদের মতো প্যারিস, যেন উত্তেজক নেশা। আবসাঁতের পর আবসাঁত, আড্ডার পর আড্ডা, তর্কের পর তর্ক। আর, কত কাজ! প্যারিসের জীবন যেন স্নায়ুবিকার

মন বলে, পালাও, চলো কোনো নিভৃত নির্জনে যেখানে জীবনের সমস্ত আবেগকে একটি স্রোতে ঢেলে দিতে পারবে, সে-স্রোত শিল্পধারার। প্যারিসের জীবন যেন অপরিণত ফল। চলো সূর্যের দেশে, এ-ফল রসালো হয়ে উঠুক সুপক্ক পরিপূর্ণতায়। এত দীর্ঘদিনের সাধনা, এত দুঃখদৈন্যব্যথিত তপশ্চর্যা, এর প্রতিদান আর দূরে নেই, ভাগ্যের সার্থক প্রসাদ আসন্ন। তবে কেন পথভ্রষ্ট হওয়া, তবে কেন লক্ষ্যহীনতার কাছে আত্মসমৰ্পণ!

ছেড়েই যাব প্যারিস, যাব তপস্যার অরণ্যে। এখানে নিশ্চিন্ত জীবনযাত্ৰা, আছে নিৰ্ভয়, আছে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, থিয়োর কাছে একান্ত নির্ভর আশ্রয় আছে। ক্ষুধার অন্ন আর ছবি আঁকার জিনিসপত্রের অভাব কখনও হবে না। কখনও ভাটা পড়বে না থিয়োর সহানুভূতিতে।

কিন্তু প্যারিস থেকে যদি বিদায় নিই আবার জীবনের পথ হবে বন্ধুর। আবার অভাব। দু-বেলা আহার হয়তো জুটবে না, হাতে পয়সা থাকবে না রং কিনবার মতো, নোংরা হোটেলে কাফেতে যাযাবরের মতো দিন কাটবে, শুষ্ক দুটি ঠোঁট বন্ধুহীন জগতে ভাষা খুঁজে মরবে।

পরদিন লোত্রেক আবার বললে—দ্বিধা কোরো না ভায়া, সত্যিই যদি যাবে তো আর্লসেই যাও। শিল্পীর স্বর্গ ও-জায়গাটা। এই প্যারিস যদি আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে না রাখত, আমিও যেতাম।

.

সে-দিন সন্ধে বেলা দু-ভাই গেল ভাগনারের একটা কনসার্ট শুনতে। সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে এল, নিরালা ঘরে মুখোমুখি বসে গল্প করল অনেকক্ষণ। ছেলেবেলাকার কত স্মৃতি নিয়ে টুকরো টুকরো গল্প।

পরদিন ভোর বেলা উঠে ভিনসেন্ট ব্রেকফাস্ট তৈরি করল। থিয়ো খেয়েদেয়ে অফিস যাবার পর সে সারা বাড়িটাকে খুব ভালো করে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করল। সযত্নে দেয়ালে টাঙাল নিজের আঁকা কয়েকটি ছবি।

দিনের শেষে থিয়ো শূন্য ঘরে ফিরে দেখল, টেবিলের ওপর একখানা চিঠি–

ভাই থিয়ো,

আর্লসেই গেলাম। পৌঁছে চিঠি দেব আবার। দেয়ালে ক-টি ছবি টাঙিয়ে গেলাম, যাতে আমাকে না ভোল।

মনে মনে আমার আলিঙ্গনটি নাও।

ভিনসেন্ট

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

প্যারিস

প্যারিস

প্যারিস

জর্মন ভাষায় একটি গান আছে :

‘In Paris, in Paris, sind die
Maedels so suess
Wenn sie fluestern Monsieur,
ich bin Dein,-’

অর্থাৎ :

প্যারিসের মেয়েগুলো কি মিষ্টি!
যখন তারা কানের কাছে গুনগুনিয়ে বলে,
‘মসিয়ো আমি তোমারি।’
সবাই হেসে হেসে তাকায়, সবাই কথা বলবার
সময় ‘তুমি’ বলে ডাকে
আর কানে কানে বলে, ‘তোমায় ছেড়ে
আর কারো কাছে যাব না।’
কিন্তু হায়, শুধু তোমাকেই না, আরো
পাঁচজনকে তারা ঐ রকমধারাই বলে!’

ইংরেজিতে বলে, ‘কেরীং কোল টু নিউ কাসল্‌’, হিন্দিতে বলে, ‘বরেলীমে বাঁস লে জানা’ (বেরলীতে নাকি প্রচুর বাঁশ জন্মে), রাশানে বলে, ‘তুলা শহরে সামোভার নিয়ে যাওয়া’ (সেখানে নাকি পৃথিবীর বেশির ভাগ সামোভার তৈরি হয়), গুজরাতীতে বলে, ‘ভরা কলসি নিয়ে নদীতে যাওয়া’ এবং ফরাসিতে বলে, ‘প্যারিসে আপনি স্ত্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া!’

ফরাসি প্রবাদটিই মুখরোচক। কিন্তু প্রশ্ন, সত্যই কি প্যারিস-সুন্দরীরা বড়ই দিলাদরিয়া? উপরের গানটাতে তো খানিকটে হদিস পাওয়া গেল। তবু কেন তামাম ইয়োরোপবাসীর সুখস্বপ্ন অন্তত একবারের মত প্যারিসে যাওয়া? এমন কি যে জর্মন ফরাসি জাতটাকে দু’চোখের দুশমন বলে জানে, সেও ফরাসিনীর নাম শুনলে বে-এক্তেয়ার হয়ে পড়ে। হিন্দুর কাশী দর্শনাভিলাষ মুসলমানের মক্কা গমন তার কাছে নস্যি।

এ অধম ছেলেবেলায় এক ভশ্চায্যি বামুনের খপ্পরে পড়েছিল। তিনি তার মাথায় তখনই গবেষণার পোকা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্যারিসে নেবেই ভাবলুম, সত্য কোন হিরন্ময় পাত্রে লুক্কায়িত আছেন, তার গবেষণা করতে হবে।’ এবং তার নির্যাস আজ আপনাদের কাছে নিবেদন করব। এ-নির্যাস বানাতে আমাকে বিস্তর কাঠ-খড়ি পোড়াতে হয়েছে।

প্রথমত প্যারিসের মেয়েরা সুন্দরী বটে। ইংরেজ মেয়ে বড় ব্যাটামুখো, জর্মন মেয়েরা ভোঁতা, ইতালিয়ান মেয়েরা অনেকটা ভারতবাসীর মত (তাদের জন্য ইয়োরোপে আসার কি প্রয়োজন?)। আর বলকান মেয়েদের প্রেমিকরা হরবকতই মারমুখো হয়ে আছে (প্ৰাণটা তো বাঁচিয়ে চলতে হবে)। তার উপর আরো একটা কারণ রয়েছে—ফরাসি মেয়ে সত্যি জামাকাপড় পরার কায়দা জানে–অল্প পয়সায়–অর্থাৎ তাদের রুচি উত্তম।

তা না হয় হল। কিন্তু সুন্দরীরাই যে সব সময় চিত্তাকর্ষণ করেন তা তো নয়। যে-সব দেশে কোর্টশিপ করে বিয়ে হয়, সে-সব দেশে দেখেছি, মেলা সুন্দরীর বর জোটে নি। আর এস্তার সাদামাটা মেয়ে খাপসুরৎ বর নিয়ে শহরময় দাবড়ে বেড়াচ্ছে।

তবে কি মানুষ প্রেমে পড়ার বেলা সুন্দরী খোজে, বিয়ে করার সময় অন্য বস্তু? তবে কি প্ৰেম আর বিয়ে ভিন্ন ভিন্ন শিরঃপীড়া? হবেও বা।

ওয়াইনে বানচাল হয় না, অপ্রিয় সত্য এড়িয়ে চলে, পলিটিকস নিয়ে মাথা ঘামায় কম এবং জাত-ফাত, সাদা কালো, দেশী-বিদেশী সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সংস্কার বিবর্জিত। ভালো লেগেছে তাই, হামেশাই দেখতে পাবেন, দেবকন্যার মত সুন্দরী ফরাসিনী যমদূতের মত বিকট হাবশীর সঙ্গে সগৰ্বে সদম্ভে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন, নাচে খাসা, গান গায় তোফা, ছবি দেখলেই বলতে পারে কোন নম্বরী, আর ডাক্তারি পড়ে বলে এর ব্যান্ডেজ ওর ইনজেকশন হামেশাই বিনফিতে করে দেয়।

জর্মন মেয়ে বিদেশীকে প্রচুর খাতির-যত্ন করে, প্রেমে পড়ে ফরাসিনীর চেয়েও বেশি, কিন্তু তৎসত্ত্বেও আপনি চিরদিনই তার কাছে ‘আউসল্যান্ডার’ (আউটল্যান্ডার) বা বিদেশীই থেকে যাবেন-কিন্তু ফরাসিনীর মনে অন্য ভাগাভাগি। তার কাছে পৃথিবীতে দুই রকম লোক আছে—কলচরড্‌ আর আনকলচরড্‌। ফরাসি, বিদেশী এই দুই স্পৃশ্য অস্পৃশ্য বাদ-বিচার তার মনে কখনো ঢোকে না।

আপনি দিব্য ফরাসি বলছেন, ফ্রাঁস আপনি পড়েন, রোদাকে ভক্তি করেন, শোপোর। রস চাখতে জানেন, বর্দো বগেণ্ডি সম্বন্ধে ও কীবহাল, ব্যস, তবেই হল। কোনো ইংরেজ বন্ধুকে যদি আপনি ফরাসিনীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার সময় সসন্ত্রমে ভারতীয় কায়দায় বলেন, ‘ইনি অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট’, তবে ফরাসিনী অত্যন্ত গভীর মুখে শুধাবে, ‘কোন সাবজেক্ট মহাশয়? টেনিস না ক্রিকেট?’ ফরাসিনীর বিশ্বাস অক্সফোর্ডে মাত্র ঐ দুই কর্মই হয়। ভাগ্যিস প্যারিসিনী জানে না, ভারতবর্ষে কিছুই হয় না-কাজেই আপনাকে এ রকম ধারা প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করবেন না।

কিন্তু ফরাসিনীর সব চেয়ে বড় গুণ-সে ভণ্ডামি করতে জানে না। আর সব শহরে যা হয়, প্যারিসেও তাই হয়, কিন্তু ফ্রান্সের লোক ঢেকে চেপে রাখবার চেষ্টা করে না। যদি কোনো জিনিস চেপে যায়, তবে সেটা দৃষ্টিকটু রুচিবিরুদ্ধ বলে, নিজেকে ধর্মপ্ৰাণ, নীতিবাগীশ বলে প্রচার করার জন্য নয়।

অর্থাৎ ফরাসিনীর কাছে টেস্‌ট্‌ বা রসবোধ মরাল বা নীতিবোধের চেয়ে বহুৎ বেশি বরণীয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *