প্যারির বালক বিভীষিকা
এক
টেট ডি-ওর হচ্ছে এক গাঁটকাটার ছেলে। তার মা সার্কাসে খেলা দেখাত। জাতে সে ফরাসি। টেটকে দেখতে ছিল ভারি সুন্দর। যেমন মুখ-চোখ, মাথায় তেমনি একরাশ সোনালি চুলের গোছা। তার মিষ্টি চেহারা দেখলেই লোকে আদর না করে পারত না।
দিনরাত সার্কাসের খেলোয়াড়দের সঙ্গে থেকে সে খুব কম বয়সেই হরেকরকম কায়দা শিখে ফেললে। লম্বা বাঁশ বেয়ে বানরের মতো সড়সড় করে উপরে উঠে যেতে পারত। কেউ ধরতে এলে তার পায়ের তলা দিয়ে ফস করে গলে পালিয়ে যেতে পারত। কেউ হাতে চেপে ধরেও তাকে বন্দি করতে পারত না–সে মাছের মতন হাত থেকে পিছলে সরে পড়ত। তারের খেলা, দড়ির খেলা, এসব কিছুই তার অজানা ছিল না। এই দুষ্টু খোকাটির দৌরাত্ম্যে সার্কাসের সমস্ত লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল।
একদিন টেটের গাঁটকাটা বাপ তাকে একটা টাকা দেখিয়ে বললে, টাকা নিবি?
টেট খুশি হয়ে বললে,–হুঁ, নেব বইকী!
এই নে তবে। কিন্তু দেখিস কেউ যেন কেড়ে নেয় না।
টেট টাকাটা সাবধানে পকেটে রেখে বললে, ইশ, কেড়ে নেবে বইকী! আমি তেমন বাচ্চা নই।
তার বাপ বললে, তুই তো ভারি অসাবধানী দেখছি! টাকাটা এর মধ্যেই হারিয়ে ফেললি?
টেট মাথা নেড়ে বললে, কখখনো না। টাকা আমার পকেটেই আছে।
বাপ একটা টাকা দেখিয়ে হাসতে হাসতে বললে, এই দ্যাখ তোর সেই টাকাটা।
টেট তাড়াতাড়ি পকেটে হাত দিলে,–পকেট ফোক্কা। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে সে হাঁ করে বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বাপ বললে, কেমন করে তোর টাকাটা আমার হাতে এল, বুঝতে পারছিস না? আয় তোকে পাঁচটা শিখিয়ে দিই!
তারপর থেকে টেট সকলকার পকেট মারতে শুরু করলে তার বাপ-মায়ের পকেটও বাদ গেল না। যেসব ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সার্কাস দেখতে আসত, প্রায়ই তাদেরও পকেট থেকে জিনিস হারাতে লাগল।
টেটের বয়স যখন দশ বৎসর, তখন এক অগ্নিকাণ্ডে তার আর বাপ পুড়ে মারা পড়ল। সার্কাসের লোকেরা তাকে এক অনাথ-আশ্রমে ভরতি করে দিলে। কিন্তু অনাথ-আশ্রম তার ভালো লাগল না। কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে টেট একদিন পালিয়ে গেল।
একখানা গাড়িতে লুকিয়ে উঠে সে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারি শহরে এসে হাজির হল।
.
দুই
প্যারি শহরে এসেই টেট, এক মেয়ে-দোকানির টাকার ব্যাগ নিয়ে সরে পড়ল।
সেই টাকায় নতুন জামাকাপড় কিনে সে ভদ্রলোকের ছেলে সাজলে। তারপর একটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে আলাপ করে এই আত্মপরিচয় দিলে ।
আমি এক মস্ত সন্ত্রান্ত ও ধনী লোকের একমাত্র ছেলে। আমার মা নেই। আমার বাবা ভয়ানক মাতাল। মদ খেয়ে রোজ বিনাদোষে মেরে আমার হাড় ভেঙে দেন। সে অত্যাচার আর সইতে না পেরে আমি পালিয়ে এসেছি। আমার বাবা এক সাংঘাতিক অসুখে ভুগছেন, তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। তখন তাঁর সমস্ত সম্পত্তির মালিক হব আমি। আপাতত আমাদের এক পুরোনো চাকর লুকিয়ে আমাকে টাকা পাঠাবে।
স্ত্রীলোকটি বালক টেটের সুন্দর মুখ দেখে, তার সব কথায় বিশ্বাস করে তাকে আশ্রয় দিলে।
টেট পুরোনো জামার দোকানে গিয়ে এমন একটা লম্বা জামা কিনলে, যা পরলে তার পা পর্যন্ত ঢাকা পড়ে। তারপর বসে বসে নিজের হাতে জামার ভিতরদিকে অনেকগুলো নতুন ও বড়-বড় পকেট তৈরি করলে। জামার বাইরেকার দুই দিকে দুই পকেটে দুটো এমন লম্বা ছাদা করলে, যাতে পকেটের ভিতর থেকে ইচ্ছা করলেই সে হাত বার করতে পারে!
এই অদ্ভুত জামা পরে সে শহরের পথে-পথে শিকার করতে বেরিয়ে পড়ল।
কিছুদিন পরেই পুলিশের কাছে খবর এল যে, শহরে গাঁটকাটার সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে উঠেছে! তখনি এদিকে চোখ রাখবার জন্যে একজন ডিটেকটিভ নিযুক্ত হল। তার নাম ডুবইস।
ডুবইস খুব চালাক ডিটেকটিভ। ভেবে-চিন্তে সে পাড়াগেঁয়ে ভদ্রলোকের বেশ ধরে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। মাঝে মাঝে পকেট থেকে ব্যাগ বার করে খেলে–তার ভিতরে একতাড়া নোট। ব্যাগটা আবার পকেটে রেখে দেয়। কিন্তু ব্যাগটা যে একগাছা সুতো দিয়ে পকেটে বাঁধা আছে, এ গুপ্তকথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না!
ডুবইস পথের এক জায়গায় ভিড়ের ভিতরে গিয়ে ঢুকতেই তার পকেটে টান পড়ল। তৎক্ষণাৎ ফিরেই সে একটি ছোকরাকে চেপে ধরলে। সে হচ্ছে, টেট। মাথায় কঁকড়া-ঝাকড়া লম্বা চুলগুলো সে এমনভাবে সামনের দিকে ঝুলিয়ে দিয়েছে যে, তার মুখ প্রায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে।
এক মুহূর্তেই অদ্ভুত কৌশলে ডিটেকটিভের হাত ছিনিয়ে টেট সুতো ছিঁড়ে, ব্যাগ নিয়ে তিরের মতো দৌড় মারলে। ডুবইসও তার পিছনে-পিছনে ছুটল। একটি গলির মোড় ফিরেই টেট অদৃশ্য হল।
সে চটপট উপরকার জামাটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। একখানা চিরুনি বার করে মাথার চুলগুলো অন্যরকমভাবে আঁচড়ে নিলে।
ডুবইস সেখানে এসে ছোকরা গাঁটকাটার বদলে দেখলে, একটি ফিটফাট পোশাক-পরা ইস্কুলের ছেলে পাশের এক দোকানের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডুবইস হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, হ্যাঁ খোকা, একটা লম্বা কোর্তাপরা আঁকড়া চুলো ছোকরাকে এইদিক দিয়ে যেতে দেখেছ?
অত্যন্ত নির্দোষের মতো টেট বললে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সে ওইদিকে দৌড় মেরেছে।
তার নির্দেশ মতো ডুবইস অন্যদিকে ছুটল!
সুতোসুদ্ধ ব্যাগটা পরীক্ষা করে টেট বুঝলে, এইবারে পুলিশের টনক নড়েছে। সেও সাবধান হল।
টেট তার বয়সি অনেকগুলো ছেলের সঙ্গে ভাব করলে। তারপর তাদেরও হাতের কায়দা শেখাতে লাগল।
টেটের উপদেশে তারা প্রথমে আত্মীয়স্বজনের পকেট মেরে হাত পাকাতে আরম্ভ করলে। তারপর রাস্তার ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েদের পকেট লুণ্ঠন! তারপর ভিড়ের ভিতরে গিয়ে তারা দাস-দাসীদের পকেট পরীক্ষা করতে লাগল।
এইভাবে তাদের হাত যখন বেশ সাফ হয়ে উঠল, টেট তখন তাদের গুরুতর কার্যে নিযুক্ত করলে।
এই ছোকরা-গাঁটকাটারা টেটকে নিজেদের সর্দার বলে মেনে নিলে। তাদের লাভের আধাআধি অংশ টেটের পাওনা হত।
.
তিন
প্যারি শহরের চারিদিকে মহা হইচই পড়ে গেল–ছোকরা গাঁটকাটাদের অত্যাচারে টাকাপয়সা নিয়ে পথে বেরুনো দায় হয়ে উঠেছে। এমন পকেটমারের উপদ্রব শহরে আর কখনও হয়নি!
ডুবইস তখনও হাল ছাড়েনি। সে একজন স্ত্রীলোককে নিযুক্ত করলে। সে পকেটে টাকা বাজাতে-বাজাতে পথে-পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। কিন্তু তার পকেটের গায়ে যে অনেকগুলো বড়শি লাগানো আছে, একথা জানত কেবল সে নিজে।
হঠাৎ এক জায়গায় তার পকেটে কে হাত দিলে সঙ্গে-সঙ্গে আর্তনাদ। সে ফিরে দেখলে, তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোকরা যন্ত্রণায় ছটফট করছে!
ছোকরা বললে, উঃ! আপনার পকেটে আমার হাত আটকে গেছে! উঃ!
আমার পকেটে? কী আশ্চর্য! এসো, এদিকে এসো, হাত খুলে দিচ্ছি। আড়ালে ডুবইস অপেক্ষা করছিল। ছোকরাকে দেখে সে বললে, কি হে, তুমি হাতকড়ি পরে থানায় যেতে চাও, না, আমাকে নিয়ে তোমার আড্ডায় ফিরে যাবে?
ছোকরা, ডুবইসকে তাদের দলের সর্দারের ঘর দেখিয়ে দিলে।
রাত্রে টেট নিজের ঘরে ফিরে এল। হঠাৎ এক পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ডুবইস তার সোনালি চুলগুলো বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরলে। তার হাতে হাতকড়ি পরিয়ে দুই পায়ে দড়ি বেঁধে তাকে মাটির উপরে শুইয়ে রাখলে। তারপর ঘরের চারিদিকে চোরাই মাল খুঁজতে লাগল।
ডুবইস অবাক হয়ে দেখলে, টেট ছোকরার পড়াশুনায় মন আছে। কারণ, ঘরের দেওয়ালে তাকে-তাকে অগুন্তি বই সাজানো রয়েছে। প্রত্যেক বই, পুস্তকের দোকান থেকে চুরি করা।
খানিক পরে একটা শব্দ শুনে ডুবইস ফিরে দেখলে যে, টেট জানলার ভিতর দিয়ে বাইরে লাফিয়ে পড়ছে!
ডুবইস বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল! ঘরের এবড়ো-খেবড়ো দেওয়ালে টেট পায়ের দড়ি ঘষে ছিঁড়ে ফেলেছে।
.
চার
কিন্তু সেই বিশ্বাসঘাতক ছোকরাই কিছুদিন পরে টেটকে আবার ধরিয়ে দিলে।
আদালতে তার বিচার হল। বিচারক গম্ভীরভাবে বললেন, ছোকরা তোমাকে এক বৎসর জেল খাটতে হবে। টেট অবহেলাভরে বললে, এক বছর? মোটে বারোটা মাস! ভারি তো!
আচম্বিতে কাঠগড়া থেকে সে একলাফে বিচারকের টেবিলের উপরে গিয়ে উঠল। সেখান থেকে বিস্মিত পাহারাওয়ালাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে বাইরে পালিয়ে গেল। তারপর অনেক কষ্টে আবার তাকে ধরা হল। তার সাহস ও কৌশল দেখে সকলেরই চক্ষু স্থির!
তার কিছুকাল পরে আর-একবার সে পালাবার চেষ্টা করলে–টেটের শেষ-চেষ্টা।
জেলখানার উঁচু ছাদে উঠে সে দেখলে, খানিক নীচে একটা কার্নিশ রয়েছে, সেখানে পৌঁছোতে পারলে পলায়নের অত্যন্ত সুবিধা।
টেট লাফ মারলে। কিন্তু লক্ষ্যচ্যুত হয়ে কার্নিশে গিয়ে পৌঁছোতে পারলে না! একেবারে মাটির উপরে গিয়ে পড়ে তার ঘাড় ভেঙে গেল।
মোটে বারো বছর বয়সে টেটের মৃত্যু হয়। ফরাসি পুলিশের মতে, আরও কিছুকাল বেঁচে থাকলে, মানুষ খুন করে তাকে ঘাতকের হাতেই মরতে হত।
যত বুদ্ধি থাক, যত সাহস থাক, অসৎ পথের পরিণাম চিরদিনই ভয়াবহ। ভালো ছেলে হলে টেট আজ নিশ্চয়ই মস্ত লোক হতে পারত।