প্যারালাল
যুগের নাম প্যারালাল। পরিধেয় ট্রাউজার এখন প্যারালালে নেমে এসেছে। বেলবটস আর দেখা যায় না। প্যারালাল কাকে বলে? দুটি পাশাপাশি রেখা যা নাকি একমাত্র মহাদূরত্বে গিয়ে মেশে।
সেই প্যারালালের যুগে আমরা কি দেখছি?
প্রথম, প্যারালাল শাসন ব্যবস্থা। নগর কোটাল ইনভ্যালিড। চাপরাশ আছে, পাইক, বরকন্দাজ আছে। কুরসি আছে, শিলমোহর আছে। কিছু করার ক্ষমতা বড় সীমিত। মহল্লায়, মহল্লায় ভুঁইফোঁড় হিরোরা টহল দিচ্ছে। পাইপ, পেটো, পটকা, সমভিব্যাহারে কুচকাওয়াজ। এর মুণ্ডু ধড় থেকে খসিয়ে দাও। ওকে আধমরা করে ফেলে রাখো। তাকে নুলো করে দাও। অজ্ঞ মানুষ হঠাৎ যদি প্রশ্ন করে ফেলে, ‘তুমি কে হে বাপু?’ উত্তর হবে, ‘তোর বাপ।’ ঠিক সময়ে প্রশ্নকারীকে সামাল দিতে না পারলে, পরের দিনই বেচারা অদৃশ্য। ধরে নাও বৃদ্ধ বিকাশ বোম্বে গেছেন জিনাত আমানের বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে। রাস্তাজুড়ে বাজার বসবে। সাধারণ মানুষ পথ চলতে ত্রাহি মধুসূদন ডাক ছাড়বে। প্রতিকার? অসম্ভব। প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা মেনে নিতে হবে। শহরতলীর বাসস্টপেজে ন্যাজে-ন্যাজে রিকশা লেগে থাকবে। সিটের ওপর ঠ্যাং তুলে চালক বসে ধূমপান করবে। অফিসের সময়ে বিশাল জ্যাম তৈরি হবে। দিশাহারা মানুষের ফাঁক দিয়ে গলতে গিয়ে চামড়া গুটিয়ে যাবে। অসন্তোষ প্রকাশ করা চলবে না। করছেন কী মশাই? প্রতিবাদ? ‘এরা সব হাবুদার প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পদ্মফুল। বেশি ট্যাঁ ফোঁ করলে গৃহিণী বিধবা হবে।’
‘আসল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কোথায়?’
‘আছে, আছে। মাঝে-মাঝে একটা জিপ চলে যায়। ভেতরে ওয়্যারলেস যন্ত্র ঝাঁঝাঁ শব্দ করে। লিকলিকে অ্যান্টেনা গতির ছন্দে থিরথির করে কাঁপে। কী তার ভাষা? এই আছি, এই নেই। আছি বটে, কিন্তু নেই।’
রিকশা থেকে নেমে যাত্রী রিকশাচালককে সসম্মানে বারো আনা পয়সা দিয়ে মাথা উঁচু করে চলে যাচ্ছিলেন। যা ভাড়া তাই দিয়েছেন। রিকশাচালকের কর্কশ প্রশ্ন, ‘অ্যাই যে, কত দিলেন?’
‘কেন যা ভাড়া তাই দিয়েছি।’
‘দেড় টাকা ছাড়ুন।’
‘কেন ভাই দেড় টাকা কবে থেকে হল?’
‘হয়েচে।’
‘কে করেছে? মিউনিসিপ্যালিটি?
‘সে আবার কী?’
তাও তো বটে। সে আবার কী? একটা ভবন মাত্র। দুটি মাত্র কাজ, করবৃদ্ধি আর কর আদায়। একটা সময় ছিল যে সময় পৌর-প্রতিনিধি কে কেমন কাজ করলেন, তার ওপর নির্ভর করত পরবর্তী নির্বাচনে ফিরে আসা। এখন? রাজনীতির টিকিটে একটা ল্যাম্পপোস্ট দাঁড়ালেও বিজয়ী হবে। কী কাজ করলেন আপনারা, এ প্রশ্নের অধিকার নেই। প্যারালালের যুগের পাশাপাশি প্যারালালে চলেছে সার্জারির যুগ। পাশ করা, অদৃশ্য লাইসেন্স-প্রাপ্ত সার্জেনরা ছোরাছুরি নিয়ে ঘুরছে। পিংপিং-এ শরীর হলে কী হবে! পাকা হাত। চোখ সরষের তেলের মতো লাল, ‘বেশি বাতেলা!’ দে ব্যাটার কণ্ঠনালী ওপন করে। তাই হাবুদাকেই সেলাম বাজাতে হয়। তকমাপরা আসল প্রভুরা প্রশাসন ফুলদানির শোভামাত্র।
প্যারালাল আদালতের নাম গণ আদালত। দিকে-দিকে গণধোলাই। ব্যাটাকে চিৎ করে ফেলে বুকে বাঁশ ডলে, চোখ দুটো উপড়ে নিয়ে এসো। এক ধরনের জন্তু আছে, যার নাম—চোখ-খাবলা। অনেকটা গিরগিটির মতো দেখতে। মানুষই এখন চোখ-খাবলা। বলা যায় না, কালের রূপান্তরের নিয়ম অনুসারে মানুষের শরীরও হয়ত গিরিগিটির মত হয়ে যাবে।
প্যারালাল শিক্ষাব্যবস্থা তো চালু আছে। কেতাবে যত বস্তাপচা জ্ঞান। আসল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বড় প্রাচীন হয়ে গেছে। কোঁদলে ভরা। গুরুমুখী জিনিস কি আর কাগজে কলমে হয়। হাতেনাতে অভ্যাস করতে হয়, হাবুদার ইউনির্ভাসিটিতে। একজন ইঞ্জিনিয়ার, কী ডাক্তার সারা জীবনে কত আর রোজগার করবেন? একটা ব্যাঙ্ক খালি করতে মিনিট পনেরো সময় লাগে। সন্ধের মুখে রাস্তায় দাঁড়ালে একঝুড়ি ঘড়ি পাওয়া যায়।
প্যারালাল হাসপাতাল চালু হয়ে গেছে। আর ভাবনা নেই। আসল হাসপাতালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্লেদ। সেখানে ডিস্টিলারি হোক। রাতের আমোদ-প্রমোদ চলুক। প্রাচীনকে বিদায় জানিয়ে নতুনের আবাহন। নার্সিংহোম তো আছেই। যাঁদের বাঁচা-মরায় দেশের পাল্লা হেলে পড়ে, তাঁদের ক’জন আর হাসপাতালে পায়খানার পাশে মেঝেতে শুয়ে কাতরাতে যান। তাঁদের জন্যে নার্সিংহোম। এ ক্লাস সিটিজেনরা সব নার্সিংহোমের আঁতুড়েই ট্যাঁ করে ওঠেন।
বড়-বড় দোকানের প্যারালাল ফুটপাত। সাবেককালের কমলালয়, বিমলালয় চোখে পড়ে না। ফ্রন্টলাইনে সারসার প্ল্যাস্টিকের চাদর ঘেরা পথ বিপণী।
প্যারালাল ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা এখন বেশ জমজমাট। সরকারি পরিবহণ ব্যবস্থা এখন গর্দভের নাকের ডগায় ঝুলে থাকা লাল গাজরের মতো। ছোটা যায়, ধরা যায় না। প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির ঢাউস গাড়ি এখন অগতির গতি। ছেলেকে দুধে মেরে সেই গাড়িতে চেপে পিতা ছোটেন চাকরি বাঁচাতে।
প্যারালাল টাঁকশালও এবার চালু হল। যারযার কারেনসি নিজেরাই তৈরি করে নাও। সরকারি ছাপ মারা পয়সা কোথায় গেল কে জানে? গলে গয়না হল? না কোনও যক্ষ মাটির তলায় যক্ষাগার তৈরিতে বসল। গণতন্ত্রের একটাই সুবিধে, কিচ্ছু জানার উপায় নেই। ভোটের তারিখটি ছাড়া সবই অপ্রকাশিত।
বিমানবাবু ক্যালসিয়াম ল্যাকটেট কিনলেন। ফেরত পাবেন পঁচিশ পয়সা। কমলা মেডিকেলের মালিক একটি লেমোনেডের বোতলের ছিপি ধরিয়ে দিলেন। নিজস্ব কারেনসি। ভেতর দিকে লেখা কে—পঁচিশ। এরপর যখন অম্বলের ওষুধ কিনতে আসবেন, তখন একটা টাকা আর এই ছিপিটি দেবেন।
প্যারালাল জিন্দাবাদ। ফাদারের প্যারালাল গডফাদার।