প্যান্ডোরার ‘ব্যাগ’
আষাঢ়ের সন্ধ্যা। উত্তর বহরমপুর।
“একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি…… একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি….. আজ দুপুর তিন ঘটিকার সময় বহরমপুর বাস টার্মিনাল থেকে একটি কালো রঙের ব্যাগ হারাইয়া গিয়াছে। যদি কোন সহৃদয়বান ব্যক্তি ব্যাগটি পেয়ে থাকেন…… তবে অতি সত্বর হোটেল সুকর্ণে যোগাযোগ করতে বলা হইল। মোবাইল নম্বর শূন্য এক তিন এক চার…… দুই শুন্য…… সাত নয় পাঁচ তিন। সন্ধানকারীকে পুরস্কৃত করা হইবে। একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি……… একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি….”
মাইকিং করতে করতে রিক্সাটা তৈমুর লেনে ঢুকে পড়ল। সন্ধ্যা নামা প্রায়-নিশ্চুপ শহরতলিতে মাইকিং-এর আওয়াজ চট করে মিলিয়ে গেল না। সরু গলির দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে অনেকটা আকাশবাণীতে প্রচারিত পুরনো দিনের গানের মত বাজতে থাকল।
তৈমুর লেনের সামনের মোড়টাতে অটো পার্ক করে জামিল অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে আছে। সামনের বুড়ো ল্যাম্পপোস্ট থেকে আঠালো সাদা আলো তার চেক লুঙ্গির নিচটুকু আলোকিত করে আর ওপরে উঠতে পারেনি। গাঢ় অন্ধকারে তার মুখটা ঢেকে গেছে।
জামিল পা নাচাচ্ছে। কপাল আর নাকের ডগায় শিশিরের মত জমছে ঘাম। প্রতি সেকেন্ডের সাথে দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতা বাড়ছে। আকাশে মেঘ করেছে। সরু লেনগুলোতে যেন গুমোট গরম জমাট বাঁধছে একটু একটু করে। জামিল ঘামছে। ঘামছে তৈমুর লেন।
বিকেল থেকে এক অসহ্য অস্থিরতা তার ভেতরে কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। অস্থিরতার কারণ পেছনের সিটের নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটা।
ব্যাগের মালিক একজন কমবয়সি মেয়ে। মেয়েটা বহরমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে জামিলের অটোতে ওঠে বিকাল সাড়ে চারটায়। পোষাক পরিচ্ছদে গোছানো হলেও মেয়েটার চাহনি ছিল কিছুটা উদভ্রান্তের মতো। যেন নিজের ভেতরের অস্থিরতা লুকানোর জন্য নিজের সাথে নিজেই যুদ্ধ করছে। মেয়েটা অটোতে উঠে আবাসিক হোটেলের খোঁজ করছিল। জামিল মেয়েটাকে হোটেল সুকর্ণে নামিয়ে দিয়েছিল। এই দূরত্বের ভাড়া বিশ টাকা। মেয়েটা ভুল করে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়েছিল। তারপর সরি বলে আবার বিশ টাকার একটা নোট বের করে দিয়ে কোন দিকে না তাকিয়েই রাস্তা পার হয়ে চলে গেল।
ভুল করে ফেলে গেল ব্যাগটা।
জামিল যখন ব্যাগটা খেয়াল করল ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
জামিল বাগবাজারের মোড়ে যাত্রী খুঁজছিল, তখনই রিয়ারভিউ মিররে ব্যাগটা চোখে পড়ে। নীল রঙের বর্ডার দেয়া কালো ব্যাগ। তাড়াতাড়ি নেমে ব্যাগটা নেড়ে চেড়ে দেখে সে। মনে হল বেশ দামি। অনেকগুলো ট্যাগ লাগানো আছে ব্যাগের হ্যান্ডেলে। তারমানে ব্যাগের মালিক প্রবাসী। বিদেশ থেকে ফিরেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র একটা ব্যাগ নিয়ে কেউ বিদেশ থেকে দেশে আসতে পারে দেখে সে অবাক হয়। বিদেশ থেকে মানুষ স্যুটকেস নিয়ে আসে। বড় বড় ক্যানভাস ব্যাগ নিয়ে বিমান থেকে নামে। শুধু একটা মাঝারী সাইজের হ্যান্ড ব্যাগ নিয়ে সে এর আগে কাউকে বিদেশ থেকে ফিরতে দেখেনি।
ব্যাগটা আবার সিটের নিচেই রেখে দেয় জামিল। আরেকটু ভেতরের দিকে ঠেলে দেয় যেন বাইরের কেউ দেখতে না পারে। শুরু হয় অন্তর্দ্বিধা।
তারপরে যাত্রী পেলেও আর যাত্রী তোলেনি সে। মূল শহর ছেড়ে হাউজিং এলাকায় চলে গিয়েছে। হাউজিং পার হয়ে ঢুকে পড়েছে তৈমুর লেনে।
হঠাৎ হর্নের কর্কশ শব্দে জামিল চমকে উঠল। একটা অটো। চাপা শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে অটোটা বাম দিকের গলিতে ঢুকে পড়ল। পার্কিং লাইটের লাল আলো লেনের পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে দেয়ালে লেগে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর মিলিয়ে গেল।
সিনথেটিক শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছল সে। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে মাথার ভেতরে। সময় যত যাবে, তত বেশি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে
ব্যাগটা নিলে অনেকগুলো ঘটনা একসাথে ঘটে যাবে। প্রথমেই ব্যাগের মালিক থানায় জিডি করবে। যেহেতু ব্যাগটা ফিরে পাওয়ার জন্য মাইকিং শুরু হয়ে গিয়েছে, সেহেতু সকালের ভেতরে ব্যাগ খুঁজে না পেলে মেয়েটা থানায় জিডি করবে। সত্যি সত্যি প্রবাসী হলে থানার পুলিশগুলো অতিরিক্ত খাতির দেখাবে। ছোটখাট তদন্ত হবে। তারপর সব অটোওয়ালার সাথে তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। স্থানীয় অটো গ্যারেজগুলোতে পুলিশি তল্লাশি চলবে। তবে দু’তিন সপ্তাহ পরে সব ঠাণ্ডা মেরে যাবে। তাছাড়া মেয়েটা বাদে আর কোন সাক্ষী নেই। কেউ জানে না যে মেয়েটা তার অটোতেই ব্যাগটা ফেলে গিয়েছে। জামিল অস্বীকার করলে কি করবে মেয়েটা? যদি জামিল বলে আপনি আমার অটোতে উঠলেন কখন!
জামিল পেছনে তাকিয়ে আরেকবার ব্যাগটা দেখে নিল। সিটের নিচে গাঢ় অন্ধকার। ব্যাগটাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার প্রতিটা হৃৎস্পন্দন জানান দিচ্ছে সেটার উপস্থিতি।
যদি সে ব্যাগটা না নেয়? যদি মেয়েটার কাছে ফিরিয়ে দেয়? মেয়েটা তাকে কিছু টাকা দেবে। রাখো ভাই। বাচ্চাদের জন্য কিছু কিনে নিয়ে যেয়ো। এ যুগে তোমার মত লোক পাওয়া যায় না। বাড়ি কোথায় তোমার? পরিবারে কে কে আছে?
কিন্তু টাকা দেবেই তারই বা নিশ্চয়তা কী? তাছাড়া যদি ব্যাগের ভেতরে আরও দামি কিছু থাকে? এমন দামি কিছু যা জামিলের ভাগ্যটাই বদলে দিতে পারে? আর্থিক লোভ লালসা তার নেই। কিন্তু ঝুঁকি নেওয়ার লোভ সে কোনদিন সংবরন করতে পারেনি। ঢোঁক গিলে শুকনো গলাটাকে ভিজিয়ে নিল সে। সবার আগে অস্থিরতা লুকাতে হবে। কোনভাবেই অস্থির হওয়া যাবে না। আর আপাতত পুলিশ এড়িয়ে চলতে হবে।
জামিল লুঙ্গির কোচর খুঁজে সিগারেট পেল না। সিগারেট পেলে কিছুটা অস্থিরতা লুকানো যেত। সিগারেট কিনতে হবে। তারপর এই ব্যাগটার একটা গতি করতে হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না। এই পৃথিবীতে সব থেকে বড় ভুলগুলো হয়েছে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে। নিজেকে বোঝাল সে, কিচ্ছু হয়নি। সব ঠিক আছে।
জামিল অটো চালু করল। তৈমুর লেন পেরিয়ে হাউজিং রোডে এসে পড়ল অটোটা। আষাঢ়ের ভেজা বাতাস অটোর উইন্ডশিল্ডে ধাক্কা খাচ্ছে। হাউজিং-এর এই দিকটা নির্জন। শহুরে আলোগুলো কমতে কমতে এখন শুধু রোডসাইড ল্যাম্পগুলোই আছে। এখনও অনেক প্লটে বাড়ি হয়নি। প্লটের পর প্লট ফাঁকা পড়ে আছে। আর যে কটা বাড়ি আছে সেগুলো যেন ভারী নিঃশ্বাস ফেলে রাতের বাতাসকে আরও ভারি করে তুলেছে।
কয়েকটা ফাঁকা প্লট পেরিয়ে জামিল একপাশে অটোটা থামালো। দক্ষিণ দিকে খাঁ খাঁ করছে মাঠ। আর উত্তরে রাজধানী-বহরমপুর মহাসড়ক। সেদিক থেকে একটু পর পর ভেজা ঠাণ্ডা বাতাস আসছে।
মহাসড়কের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল সে। দু একটা বাস আর ট্রাক বেপোরোয়াভাবে ছুটে যাচ্ছে। দুর থেকে শুধু জোনাকির মত আলোর আসা যাওয়া বলে মনে হচ্ছে। কোনটা বাস কোনটা ট্রাক বুঝবার উপায় নেই।
পেছনের সিটের নিচ থেকে টেনে ব্যাগটা বের করল জামিল। সম্ভা মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলো ফেললো ব্যাগের ওপরে। ব্যাগের তিনটা চেইন। দুটো বড়, একটা ছোট।
সবার আগে মাঝখানের চেইনটা খুলল।
জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার কিছুক্ষণ পরেই জামিল হতাশ হল। কাপড়চোপড় আর তোয়ালে ছাড়া বিশেষ কিছুই নেই।
তারপরেও মোবাইলের আলো ব্যাগের এখানে ওখানে ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষণ। কখনও ভাঁজ ভাঙা জিন্স আর ইংরেজি বইয়ের ওপর। কখনও নীল রঙের একটা ট্রাউজারের ওপরে। কখনও গোল গলা গেঞ্জি আর নীল রঙের সালোয়ার কামিজের ওপরে। কখনও কয়েকটা ভাঁজ ভাঙা অন্তর্বাসের ওপর। তারপর আলো একটা ফটোফ্রেমের ওপরে গিয়ে পড়লে কাঁচের প্রতিফলিত আলোতে জামিলের চোখ কুঁচকে গেল।
একটা কমবয়সী ছেলের ছবি। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখল ছবিটা। গায়ের রঙ শ্যামলা। কালো চুল, মুচকি হাসি। সে কাঁপা হাতে ফ্রেমটা নামিয়ে রাখল। ফটোফ্রেম দিয়ে কোন কাজ নেই। দামি কিছু লাগবে তার
ধুর! বিদেশ থেকে আসা একটা মানুষের ব্যাগে দামি কিছু তো থাকবে? একটা স্মার্টফোন, অথবা কোন ল্যাপটপ। দামি কিছু না পাওয়াতে জামিলের অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। তারপরও আরও কিছুক্ষণ চলল এলোমেলো তল্লাশি।
মনে মনে ব্যাগের মালিককে গাল দিলো জামিল। সময়টাই নষ্ট। এতক্ষণে ব্যাগটা ফিরিয়ে দিয়ে আসলে তারও টেনশন কম হত, ওই মহিলাকেও মাইকিং করতে হত না। হঠাৎ অনেক দূরে এক জোড়া লাইটকে ডান দিকে মোড় নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেখল সে। এখানে বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। হাইওয়ে পুলিশগুলো রাস্তা ছেড়ে মাঝে মাঝে এদিকে চলে আসে। ঝামেলা বাড়ানো উচিত হবে না।
শার্টের হাতা দিয়ে জামিল আরেক দফা কপালের ঘাম মুছলো। এত কষ্ট করার কোন মানে ছিল না। ব্যাগটা মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে হবে। সিদ্ধান্ত নিল সে। ব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে যদি কিছু পাওয়া যায়। এটা ভেবে জামিল কেন জানি শান্তি বোধ করল। জামিলের শক্ত হয়ে থাকা মাংসপেশীগুলো শিথিল হতে শুরু করল।
এতক্ষণ দেরি করলে কেন ভাই? টেনশনে আমার যায় যায় অবস্থা। আর একটু হলেই আমি থানা পুলিশ করতে যাচ্ছিলোাম। উফ। দেখি? হ্যাঁ হ্যাঁ এটাই তো আমার ব্যাগ!
খেয়াল করেছিলাম না আপা। হাউজিং-এ এক যাত্রী নামাতে গিয়ে চোখে পড়ল।
ভাগ্য ভালো যে কেউ হাতে করে নিয়ে নেমে যায়নি। থ্যাংক্স আ লট। আই ক্যান মেয়ারলি রিপে ইয়োর অনেস্টি। আই ডোন্ট ডেয়ার টু। এই নাও একশোটা টাকা রাখো……
জামিল কল্পনাতেই যেন হাত বাড়িয়ে একশো টাকা নিল। অংকটা একশো না হয়ে পাঁচশও হতে পারে, বলা যায় না। প্রবাসী বলে কথা। অন্তত থানা পুলিশের ঝঞ্ঝাটের চেয়ে তো ভালো। এইসব ভাবতে ভাবতে তার আঙুলগুলো স্বাভাবিক হয়ে আসল। স্বাভাবিক হয়ে আসল নিঃশ্বাস।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, আকাঙ্খাই সকল কষ্টের মূল। জামিল আর আকাঙ্খা করবে না। যা ভুল হওয়ার হয়ে গিয়েছে, আর না।
ভেতরের কাপড়গুলো মোটামুটি গুছিয়ে জামিল ব্যাগটা ঠেলে সিটের নিচে ঢুকিয়ে দিল। ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল।
কিসের শব্দ? ফটোফ্রেমটা ভেঙে গেল নাকি? সর্বনাশ।
তাড়াতাড়ি সে ব্যাগটা বের করে খুলল। এবার ব্যাগটা হাতড়াতে হাতড়াতে জামিলের আঙুল একটা ধাতব স্পর্শ পেল, যেটা আগেরবার পায়নি। জিনিসটা বের করে আনল সে। একটা চাবির গোছা। ফ্ল্যাশলাইটের আলো চাবিগুলোতে পড়ে ঝিকমিক করে উঠল।
চাবির গোছাটা হাতে নেড়েচেড়ে দেখল জামিল। অনেকগুলো পুরনো চাবি আছে। দেখলেই বোঝা যায়। অন্যগুলোর চাইতে বেশ বড় বড় নতুন চাবিগুলোর থেকে পুরনো চাবিগুলোই বেশি আকর্ষণ করল। আহ্ পাওয়া গিয়েছে!
হঠাৎ ডান দিকে খস্থস্ শব্দ হল। জামিল সেদিকে তাকাতেই রাস্তা পেরিয়ে কি যেন একটা ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেল। হয়ত শিয়াল।
চাবি জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগের ভেতরে আরেক দফা খোঁজাখুঁজি শুরু করল জামিল। চাবি থাকলে ঠিকানাও থাকবে। মুহূর্তের ভেতরে তার সিদ্ধান্ত বদলে গেল। ব্যাগ সে ফিরিয়ে দেবে না। যেভাবেই হোক সে এই চাবির তালা পর্যন্ত পৌঁছাবে।
একটা ধাতব পাত চাবিগুলোর সাথে লাগানো। সেই পাতে খোদাই করা একটা ঠিকানা চোখে পড়ল জামিলের।
তাকিয়া মহল
১৩/৩, পানির ট্যাঙ্কের পাশের গলি
মানিকপুকুর রোড,
বহরমপুর।
খুব ছোটখাট ঠিকানা। কিন্তু জামিল এই ঠিকানা চিনে। মানিকপুকুর বহরমপুরের উপজেলা। আধা শহর আধা গ্রাম মত জায়গা। বহরমপুর থেকে মানিকপুকুর যাওয়ার যে হাইওয়ে আছে তারই তের নাম্বার রাস্তা। হোল্ডিং নাম্বার তিন। বাড়ির নাম তাকিয়া মহল।
দক্ষিণ দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস এসে কাঁপিয়ে দিলো ওকে। তারপর চাবি আর ঠিকানাটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকিয়ে ব্যাগটা রাস্তার একপাশে ফেলে দিল। দামি কিছু পাওয়া যায়নি, কিন্তু দামি কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা পাওয়া গিয়েছে। এটাই যথেষ্ট। ব্যাগটার আর কোন প্রয়োজন নেই।
সময় সংক্ষিপ্ত।
অটো স্টার্ট করে জামিল অনেকদূর চলেই গিয়েছিল। কিন্তু কি মনে করে আবার ফিরে আসল। ব্যাগটাকে এভাবে রাখা যাবে না। পুলিশের হাতে পড়লে বিপদ হবে।
ম্যাচ জালিয়ে ব্যাগটায় আগুন ধরিয়ে দিল সে। ভেতরে জামা কাপড় থাকায় কিছুক্ষণের ভেতরেই দাও দাও করে সম্পূর্ণ ব্যাগটা হলুদ হয়ে গেল। জ্বলতে থাকা ব্যাগটা পেছনে ফেলে অটোর লাল পার্কিং লাইটটা অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
জামিলের মোবাইলের সবুজ স্ক্রিনে তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে।
বহরমপুর স্টেশনের পাশের অটো গ্যারেজে অটো রেখে বের হতে হতে বেজে গেল রাত এগারটা। স্টেশন বাজার তখন সরগরম। একটু আগেই রাত দশটার ডাউন ট্রেন আধ ঘণ্টা লেটে বেরিয়ে গেছে।
ভ্রররর ভ্রররর। মোবাইলটা বাজছে শার্টের পকেটে। জামিল মোবাইলটা হাতে নিল। বউ ফোন দিচ্ছে। বাড়ি ফিরতে এত রাত কেন হচ্ছে এই প্রশ্ন করবে। ফোন ধরা যাবে না। মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখল। রাতের খাওয়াটাও হয়নি। ভাতের হোটেল থেকে ভাজা কাবাবের গন্ধ আসছে। খাওয়াদাওয়া করে একবারে গেলে হত না?
স্টেশনের সামনে পেঁয়াজ বোঝাই একটা পিকআপ ভ্যানকে স্টার্ট নিতে দেখে জামিল সিদ্ধান্ত বদলাল। পিকআপের ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল যে পিকআপটা ঢাকা যাচ্ছে।
ভালো কথা! জামিল পিকআপ ভ্যানে উঠে পড়ল।
পিকআপে চড়ে প্রথমেই জামিল কয়েকটা ভুয়া ফোন করল।”কি? নজিব আসে নাই? ক্যান, ওরে বেতন দিতেছি না আমি? কাস্টমারের মাল ডেলিভারি যখন লাগব তখনই দিতে হবে। সেইটা রাত দুইটা তিনটা ব্যাপার না।”
এমন জনহিতকর ব্যবসায়ী কয়জন থাকে!
পিকআপ ড্রাইভার বলেই ফেলল, “আমিও এককালে হোটেল চালাইনের কথা ভাবিছিলাম বোজলেন ভাই সাহেব। কিন্তু সৎলোকের খুব অভাব। কেউ চাইল মারে। কেউ ডাইল মারে। সালাদের শশা পইয্যন্ত পাচার করে। আট মাসে লসে চালাইছি হোটেল।”
জামিলকে দেখে মনে হয় না সে ড্রাইভার সাহেবের কথা শুনছে। ব্যবসায়ীরা সব কথায় কান দেয় না। বিশেষ করে একটা সামান্য পিকআপ ড্রাইভারের কথায় তো সে কান দেবেই না।
মানিকপুকুরের কাছে এসে হঠাৎ মোবাইলে কিসের একটা ভুয়া দুঃসংবাদ আসল।” আমি আসতেছি। এখনি আসতেছি। ভাই আমারে সামনে নামায়ে দেন তো।” বলে জামিল নেমে গেল। পিকআপ ড্রাইভার যখন সালাম দিয়ে হাসিমুখে বিদায় নিল তখন জামিল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ড্রাইভার সাহেব তাকে ব্যবসা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। মানুষ যেটা মনে মনে বিশ্বাস করে নেয় তা নিয়ে তার কোন কৌতূহল থাকে না। যত কৌতূহল অবিশ্বাসে। জামিল এই পিকআপ ড্রাইভারকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে সে একজন ভোক্তাসেবী বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী। নিতান্ত বিপদে পড়ে এই গভীর রাতে তাকে ঢাকা যেতে হচ্ছে। হঠাৎ একটা কারণে তাকে আবার বহরমপুর ফিরে যেতে হবে। তাই সে মাঝপথে নেমে পড়েছে।
নীরব নিস্তব্ধ মহাসড়ক। আশপাশের আকাশমডু গাছগুলো রাস্তার ওপরে নুয়ে পড়েছে। যেন প্রচণ্ড ঘুমে ঢুলছে। একটু একটু বাতাস দিচ্ছে। আকাশে তেমন মেঘ নেই। কিন্তু তারা দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে হয়ত। বাতাসটা ভেজা ভেজা।
জামিল তার রংচটা মোবাইলটা বের করে সময় দেখল। রাত একটা। ভোর হতে এখনও চার ঘণ্টা বাকি।
রাস্তা পার হয়ে জামিল একটা রোডসাইড সাইন খুঁজতে লাগল। আশেপাশেই কোথাও আছে সাইনটা। এই রাস্তায় বেশ কয়েকবার এসেছে সে। ডেইরি ফার্মের রোড সাইন লাগানো রাস্তাটাই তেরো নম্বর রাস্তা।
বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। একটু দূরেই রাস্তার পাশে একটা মাঝারি সাইজের পুরনো সাইনবোর্ড দেখতে পেল সে তারেক ডেইরি ফার্ম’। যতদূর মনে পড়ছে এটাই সেই তেরো নম্বর রাস্তা।
জামিল অন্ধকারে সাবধানে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করল। একটা লাঠি হলে ভালো হত। বর্ষাকালে সাপখোপের উপদ্রব বেশি হয়। তাছাড়া এদিকটা বেশি জংলা। পিচ করা রাস্তা নেই। হেরিং রাস্তা। এখানে ওখানে ইট উঠে গিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার এক পাশে রাস্তা থেকে একটু দূরে কিছু ভবনের অবয়ব দেখতে পেল সে। এটা তারেক ডেইরি ফার্ম। হাইওয়ে থেকে কিছুটা দেখা যায় এটা। তারমানে একটু হাঁটলেই সামনে তিন নম্বর হোল্ডিং-এর বাড়ি। তাহলে আর দুটো হোল্ডিং কোথায় গেল? জামিল জানে না।
আরও কিছুদূর হাঁটার পরে তার মনে হল, কেউ যেন তাকে অনুসরণ করছে। খুব মন দিয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। তারমানে কি সে অপরাধবোধে ভুগছে? অচেনা অজানা মেয়েটার সাদাসিধে মুখটাই কি তার কারণ? মেয়েটার মুখটায় যদি একটু কাঠিন্যভাব থাকত তাহলে কি জামিল অপরাধবোধে ভুগতো? নাকি ভাড়া কম দিলে, অশিক্ষিতের জাত বলে গালি দিলে অপরাধবোধটা কমত?
একটা জায়গায় এসে হেরিং রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। শুরু হল পায়ে চলা মেঠো পথ। বিকালের বৃষ্টিতে মাটি বেশ নরম হয়ে গিয়েছে। নরম মাটিতে জামিলের স্যান্ডেল বসে যেতে লাগল।
ঘন অন্ধকারে ডুবে থাকা একটা মরচে পড়া গেটের সামনে এসে সে অনুমান করল এটাই সেই বাড়ি। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটাও এই অন্ধকারে ডুবে যেন কালো হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ যেন এই অন্ধকারই তাকে অনুসরণ করে এসেছে এতটা রাস্তা।
ফ্ল্যাশলাইটের আলো একটা শ্বেতপাথরের ফলকের ওপরে পড়ল। অনেক পুরনো ফলক। ফলকের কোণাগুলো ভেঙে গিয়েছে। ফলকের ওপরে লেখা, তাকিয়া মহল।
জামিলের গায়ে শিহরণ বয়ে গেল। এটাই সেই বাড়ি। আর সদর দরজার সামনেই সে দাঁড়িয়ে। এই দরজার ওপাশেই হয়ত তার জন্য পুরস্কার অপেক্ষা করছে। হয়ত কোন পুরনো সিন্দুক, অথবা কোন আলমারী। ফ্ল্যাশলাইটের আলোটা আরও কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে গেটের ওপরে দৌড়াদৌড়ি করে একটা জায়গায় এসে থেমে গেল।
তালা, দুটো বড় বড় তালা। একটা সাপের মত কালো মরচে পড়া শিকল তালা দুটোকে জড়িয়ে ধরে আছে। একটা পুরনো তালা, আরেকটা নতুন তালা। নতুন তালার ওপরে ফ্ল্যাশ লাইটের আলো পড়লে জামিলের মুখটা চকচক করে উঠল। গেটের বাইরে তালা লাগানো। এর মানে ভেতরে কেউ নেই।
কাঁপা হাতে মোবাইলটা মুখে নিল সে। তারপর শার্টের পকেট থেকে চাবির গোছাটা বের করল। পুরনো তালাটা সে খোলার চেষ্টা করল। প্রথম দুটো চাবি ঢুকলই না। তৃতীয়টা ঢুকল। কিন্তু তালা খুলল না। ছয়টা পুরনো চাবির চতুর্থ চাবিটা আস্তে করে ডানে ঘুরাতেই খট করে তালাটা খুলে গেল।
জামিল জামার হাতা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নেয়। এবার নতুন তালাটা। চাবির গোছাটায় বেশির ভাগই নতুন চাবি। কিন্তু আফসোস, নতুন তালাটা কোন চাবিতেই খুলল না। সে পুরনো চাবি দিয়েও নতুন তালাটা কিছুক্ষণ খোলার চেষ্টা করল। যদি খোলে? কিন্তু খুলল না।
অনেকক্ষণ কুঁজো হয়ে থাকার ফলে তার কোমর ব্যথা করতে শুরু করল। পুরনো তালাটা যখন খুলেছে তখন নতুনটাও খুলবে। আরেকবার চেষ্টা করা যাক। কিন্তু না। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরে জামিল নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হল। ব্যাগটা এত আগে আগে ওভাবে পুড়িয়ে ফেলার কোন মানেই হয়নি। এখন যদি তালাটা না খোলে? ব্যাগটা থাকলে এতক্ষণে অন্তত ফিরে যাওয়ার রাস্তা থাকত। সকালে থানায় গিয়ে ব্যাগটা জমা দিয়ে একটা না একটা অজুহাত দেখানো যেত।
কিন্তু, ফেরার পথ সব সময় থাকে না।
জামিল চাবিটা আবার লুঙ্গির কোচরে গুঁজলো। রাত বাড়ছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের রাত। হুতুম প্যাঁচাদের রাত। ইনসোমনিয়ায় ভোগা বাদুড়দের
রাত। রহস্যময় ছায়াদের রাত।
ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছাপিয়ে দূরে কোথাও একটা পাখি ডেকে উঠলো। জামিল কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকল।
অন্ধকারেও বোঝা যায় বাড়িটার ভেতরে কেউ নেই। ভারি ভারি গাছের ছায়া অন্ধকারটাকে আরও গাঢ় করেছে। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তার গা শিউরে উঠল। গেটের শিক ধরে ভেতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল সে। কিন্তু গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না।
জামিল শিক বেয়ে উপরে ওঠারও অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু নিচে পা রাখার জন্য কোন জায়গা নেই। শুধুমাত্র হাতের শক্তি দিয়ে নিজেকে ওপরে ওঠানোর মত শক্তি তার নেই। এভাবে অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরে হঠাৎ তার মাথায় আসল প্রাচীরের কথা। বাড়িটার প্রাচীর বেয়ে ওঠার চেষ্টা করা যেতে পারে।
জামিল ঘুমস্ত অজগরের শরীরের মত শীতল প্রাচীরটা ধরে হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল। খেয়াল করতে লাগল কোথাও কোন ভাঙা অংশ দেখা যায় কিনা। বৃষ্টির পানি জমা প্যাঁচপ্যাঁচে নরম মাটিতে পা বসে গেলেও সে সেদিকে খেয়াল করল না। পরণের লুঙ্গিটা মালকোচা মেরে নিল। জোঁক সাপের ভয়ও যেন এখন আর তেমন একটা ভাবাচ্ছে না তাকে। অন্ধকারে জামিলের মনে হল এই প্রাচীরের মাথা যেন আকাশে গিয়ে মিশেছে।
পায়ের নিচের জমি হঠাৎ যেন উঁচু মনে হল জামিলের কাছে। একটা গাছ। প্রাচীরের গা ঘেঁষে একটা গাছ। জামিল দুই হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করল গাছটা বেয়ে ওঠা যাবে কিনা। বৃষ্টিতে ভিজে গাছের কাণ্ডটা অজগরের শরীরের মত ঠাণ্ডা। হাতের কাছে কোন ডালপালা আছে কিনা দেখার জন্য সে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালালো। কিন্তু নিকষ অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। একটা টর্চের তীব্র অভাব অনুভব করল। আরও একবার তার মনে ফিরে যাওয়ার কথা উঁকি দিল। কিন্তু, পেছনে একটু আগে করা ভুলগুলো যেন লকলকে জিভ বের করে বসে আছে। বারবার তাকে সামনের দিক ঠেলছে। এই মুহূর্তে ফিরে গেলে অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব সে দিতে পারবে না। ব্যাগটা কোথায়? চাবিটা কোথা থেকে পেল? এত রাতে সে বাড়ি না ফিরে তাকিয়া মহলে কি করতে গিয়েছিল?
জামিল মোবাইলটা দুই ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরল। তারপর ঘামে ভেজা হাতটা লুঙ্গিতে মুছে আছড়েপাছড়ে গাছে ওঠা শুরু করল।
গাছটাকে জড়িয়ে ধরে মাটি থেকে একটু ওপরে ওঠার পরেই মনে হল কেউ যেন তাকে গাছ থেকে টেনে নামিয়ে আনার জন্য এগিয়ে আসছে। কেউ আসল না। কারও না আসাটাই যেন প্রমাণ করল কেউ কোথাও নেই। এই বর্ষা রাতের ভেজা আকাশের নিচে জামিল একেবারে একা
জামিলের পেশীগুলোর গাছে ওঠার অভিজ্ঞতা নেই অনেকদিন। সেই কবে ছোটবেলায় লিচু গাছের সব চেয়ে নিচু ডালটায় উঠেছিল। ওইটুকু। তাও মায়ের চোখ এড়িয়ে। ছোটবোন রুবা শিশু গাছ পড়ে শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলেছিল। দুদিন খুব ভুগে মারা গেল। তারপর থেকে জামিলের মা জামিলকে কোনদিন আর গাছে উঠতে দেননি।
আজ অনেকদিন পরে আবার গাছে উঠতে গিয়ে পেশীগুলো যেন বিদ্রোহ করে বসল। আঙুলগুলো যেন গাছের বাকল কামড়ে ধরছে। একবার ফসকে গেলেই সোজা নিচে গিয়ে পড়তে হবে। শিরদাঁড়া ভেঙে যাবে জামিলেরও।
সে দুই পায়ে বেশি জোর দিয়ে নিজেকে ওপরে তুলতে থাকল। হাত দুটো ব্যবহার করল গাছটাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য। মুখ দিয়ে লালা বের হয়ে মোবাইলটা অনেকখানি ভিজিয়ে দিয়েছে। নাক দিয়ে শ্বাস না নিতে পেরে তাকে শ্বাস নিতে হচ্ছে মুখ দিয়ে।
কিছুক্ষণ ওঠার পরে জামিলের হাতে একটা ডাল বাঁধল। জামিল বাম হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করল ডালটাকে। ডালের ওপরে বসে দোল খাচ্ছে ওটা কি? রুবা নাকি? নিজে মরে গিয়ে এখন আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবে হারামজাদি? জামিল ডালটা খামচে ধরল। দুই উরু ব্যবহার করে গাছটাকে জড়িয়ে ধরল। আর দুই হাত দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ ডালটার ওপরে টেনে তোলার চেষ্টা করল। হঠাৎ বাম হাতের কনুইয়ে লেগে মোবাইল ফোনটা মুখ থেকে নিচে পড়ে গেল।
মুখ থেকে একটা গালি বের হয়ে আসল জামিলের।
কোনোমতে সে শরীরের ওপরের অংশটা ওপরে তোলার সাথে সাথে গাছের ডালটা বিশ্বাসঘাতকতা করল। মড়াৎ করে ভেঙে গেল। প্রাচীরের সাথে বাড়ি খেয়ে সোজা গিয়ে নিচের শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ল জামিল। ভোঁতা একটা শব্দ হল।
কোনরকমে উঠে দাঁড়াল সে। বেকায়দায় পড়েছে বলে ব্যথাটাও বেশি পেয়েছে। বাম কাঁধটা আগে পড়েছে। তাই বাম কাঁধেই যন্ত্রণাটা বেশী অনুভব করল সে। পাঁজরের বাম দিকেও ভোঁতা একটা যন্ত্রণা। কোথাও কেটে ছড়ে গেলেও এখন বোঝা যাবে না। অন্ধকারে দেখাও যাবে না।
জামিল ঢিলে হয়ে যাওয়া লুঙ্গিটা খুলে আবার মালকোঁচা মেরে নিল। দুঃখ একটাই, গাছের অত উপরে উঠেও প্রাচীর টপকানো গেল না।
কিন্তু তার ধারণা ভুল। হঠাৎ একটা দরজা চোখে পড়ল। দরজার ওপরে জ্বলজ্বল করে একটা আলো জ্বলছে। প্রাচীরের ওপারে তো এই আলোটা ছিল না। তার দেখার ভুল নাকি?
দেখার ভুল না। কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝল, এটা প্রাচীরের অন্য দিক। সে প্রাচীর টপকাতে পেরেছে।
আশেপাশে কিছু ঝোপঝাড় ছিল। জামিল সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে সামনে এগুতে লাগল। চারপাশে কোন আলো নেই। শুধু দূরের ঐ দরজাটার ওপরে জ্বলতে থাকা মৃদু আলোটা ছাড়া। আলোটা পতঙ্গের মত তাকে টানতে থাকল।
উত্তেজনায় সে অনেক কিছু খেয়াল করল না। খেয়াল করল না, বাড়িটার ভেতরে কোন শব্দ নেই। ঝিঁঝিঁর ডাক নেই। রাত জাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ নেই। যেন কোন কিছু এই বাড়ির আশেপাশের সব শব্দ খেয়ে ফেলেছে।