রাজনীতি
অভিযান ও পর্যটন
সমাজসেবা
জ্ঞান ও শিক্ষা
2 of 2

প্যাট্রিস লুমুম্বা (১৯২৫-১৯৬১) – কঙ্গোর মুক্তিদাতা পুরুষ

প্যাট্রিস লুমুম্বা (১৯২৫-১৯৬১) – কঙ্গোর মুক্তিদাতা পুরুষ

সভ্যতার ধ্বজাধারী পাশ্চাত্যের অনেক দেশই একদা তাদের শোষণ-শাসনের থাবা বিস্তার করার লক্ষ্য নিয়ে ঢুকে পড়েছিল আফ্রিকার কৃষ্ণমানুষদের দেশের পর দেশে। তারপর বসিয়েছিল নিজেদের, সাম্রাজ্যবাদের হাট স্থাপন করেছিল উপনিবেশ।

ইউরোপের অন্যতম সভ্য দেশ বেলজিয়ামেরও এরকমেরই অনেকগুলি উপনিবেশ ছিল আফ্রিকায়। কঙ্গো (বর্তমানে জায়ার) তাদের মধ্যে একটি

কৃষ্ণাঙ্গরা সাম্রাজ্যবাদের হাতে মার খেতে খেতে অবশেষে রুখে দাঁড়িয়েছিল এই শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে—একদিন প্রতিষ্ঠিত করেছিল জন্মভূমিতে নিজেদের শাসন। যেসব কৃষ্ণাঙ্গ নেতা এই ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বিলিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জীবন, কঙ্গোর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা প্যাট্রিস এমার্জি লুমুম্বা (Patrice Fmergy Lumumba) তাঁদের অন্যতম।

তিনি বেলজিয়ামের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে ছিনিয়ে এনেছিলেন নিজের দেশের স্বাধীনতা। তিনি হয়েছিলেন কঙ্গোর প্রথম প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি শেষরক্ষা করতে পারেননি। যে পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলেন, সেই শক্তির হাতেই তাঁকে দিতে হয়েছিল নিজের অমূল্য জীবন। মৃত্যুর সময় তিনি পেয়েছিলেন দেশবাসীর অফুরন্ত ভালোবাসা আর আফ্রিকার জাতীয় বীরের মর্যাদা।

এই মহান জাতীয় বীর প্যাট্রিস এমার্জি লুমুম্বার জন্ম ১৯২৫ সালের ২ জুলাই, বেলজিয়ান কঙ্গোর কাসাই প্রদেশের ওনালুয়া নামক একটি গ্রামে—স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যাটেটেলা উপজাতি গোষ্ঠীর একটি পরিবারে।

কঙ্গোতে ব্যাটেটেশসহ পরস্পরেরবিরোধী বা প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকগুলি কৃষ্ণাঙ্গ উপজাতীয় গোষ্ঠীর বসবাস। এগুলোর মধ্যে অন্যতম কাতাঙ্গা প্রদেশের মোসে শোম্বের নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী এবং জোসেফ কাসাবুভু নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠী উল্লেখযোগ্য। এই কাসাবুভুই স্বাধীন কঙ্গোর প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন লুমুম্বার প্রধান প্রতিপক্ষ এবং লুমুম্বার হত্যাকাণ্ডেরও নেপথ্য নায়ক।

লুমুম্বার বাবা রোমান ক্যাথলিক হলেও ১৩ বছর বয়সে তাঁকে একটি স্থানীয় প্রোটেস্টান্ট মিশনারি স্কুলে ভর্তি হতে হয়েছিল। তিনি সেখানে পুরুষ নার্সের প্রশিক্ষণ নেন। কিন্তু পড়া শেষ করতে পারেননি। ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট পাওয়ার আগেই তাঁকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। এরপর তিনি চাকরির সন্ধানে আসেন কিন্তুপোর্ট ইম্পেইনে। এখানেই তিনি সর্বপ্রথম ইভোলুস নামে একটি ক্লাবের সদস্য হন। এই সময়ই লুমুম্বার মধ্যে আরও একটি গুণের বিকাশ ঘটে। তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ।

সেখান থেকে তিনি চলে আসেন লিওপোল্ডভিলে (বর্তমানের কিসাসা)। এখানে তিনি ডাক বিভাগে কেরানির পদে চাকরি নেন এবং কিছুদিন পরেই প্রমোশন পেয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে বদলি হয়ে আসেন ওরিয়েন্টাল প্রদেশের রাজধানী স্ট্যানলিভিলে (বর্তমানের কিসাংগানি।)। এখানেই তিনি স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৫৪ সালে তিনি কঙ্গো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু তিনি বিবাহিত হওয়ার কারণে তাঁর সেই আবেদন নাকচ হয়ে যায়।

১৯৫৫ সালে তিনি ওরিয়েন্টাল প্রাদেশিক কঙ্গোনিজ ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা সবাই সরকারি কর্মচারী হলেও ট্রেড ইউনিয়নটি সরকার অনুমোদিত ছিল না।

এ ছাড়াও তিনি কঙ্গোর বেলজিয়ান লিবারেশন পার্টিরও সদস্য মনোনীত হন।

১৯৫৬ সালে লুমুম্বা বেলজিয়ামে একটি শিক্ষা সফরের জন্য আমন্ত্রিত হন। কিন্তু সফরশেষে দেশে ফিরে আসার মুহূর্তে বিমান বন্দর থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ডাক বিভাগের তহবিল তসরুপের অভিযোগ আনা হয়। বিচারে তাঁর নগদ অর্থদণ্ডসহ এক বছরের কারাদণ্ড হয়।

এক বছর পর জেল থেকে বের হয়ে তিনি আরও বেশি করে দেশপ্রেমিক হয়ে পড়েন। ঔপনিবেশিক সরকাররের প্রতি তাঁর মনে জেগে ওঠে প্রবল ঘৃণা। দেশকে ঔপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য, দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য তিনি ১৯৫৮ সালে গঠন করেন কঙ্গো ন্যাশনাল মুভমেন্ট নামে একটি রাজনৈতিক সংগঠন, এটাই ছিল সারা কঙ্গোব্যাপী বৃহত্তম জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠন।

কঙ্গোতে শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলন। অবশেষে বেলজিয়াম সরকার কঙ্গোকে নীতিগতভাবে স্বাধীনতাদানের একটি পরিকল্পনাও ঘোষণা করে ১৯৫৯ সালে। এই উদ্দেশ্যে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয়তাবাদী সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করা হয়। যদি তারা সুষ্ঠুভাবে সরকার পরিচালনা করতে পারে, তবে পর্যায়ক্রমে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেওয়া হবে—এই ছিল বেলজিয়ামের প্রস্তাব। কিন্তু লুমুম্বার নেতৃত্বে গঠিত কঙ্গো ন্যাশনার মুভমেন্ট দল এ ধরনের জগাখিচুড়ি মার্কা প্রস্তাব মেনে নিতে অস্বীকার করে এবং প্রস্তাবিত নির্বাচন ও বয়কট করে। ফলে নির্বাচন করা আর সম্ভব হয় না। শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫৯ সালের ৩০ অক্টোবর স্ট্যানলিভিলে জনতা ও পুলিশের মধ্যকার সংঘর্ষে ৩০ ব্যক্তি নিহত হয়। দাঙ্গার প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করা হয় লুমুম্বাকে।

এই ঘটনার পর এম এন সি পার্টি তাদের আন্দোলনের কৌশল পরিবর্তন করে। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে লুমুম্বার দলই শতকরা ৯০ ভাগ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। লুমুম্বাকে জেল থেকে মুক্তি দিতে হয়। এরপর স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার জন্য বেলজিয়ামের ওপর চাপ দিতে থাকেন লুমুম্বা। এরপর তাঁর চাপের মুখেই বেলজিয়াম নতি স্বীকার করে এবং ১৯৬০ সালের ৩০ জুন দেশের স্বাধীনতার তারিখ ঘোষণা করা হয়। এই স্বাধীন দেশের সরকার গঠনের জন্যও ওই একই বছরের ৩০ মে ঘোষণা করা হয় নির্বাচনের তারিখও।

এই নির্বাচনেও কঙ্গো ন্যাশনাল মুভমেন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ১৯৬০ সালের ২৩ জুন কঙ্গোতে প্রথম স্বাধীন সরকার গঠন করেন এবং তিনি হন এর প্রথম প্রধানমন্ত্রী, আর বেলজিয়াম সরকার মনোনয়ন দেয় লুমুম্বার প্রতিদ্বন্দ্বী ও তাদের বিশ্বস্ত দেশি দালাল বলে কথিত কাসাবুভুকে। কিন্তু স্বাধীন সরকার গঠিত হবার কিছুদিনের মধ্যে বেলজিয়ামের কারসাজিতে সেনাবাহিনীতে শুরু হয়ে যায় গোলোযোগ। দেশের প্রশাসনেও কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। আর এই সুযোগে বেলজিয়াম তাদের নাগরিকদের রক্ষার অজুহাতে কাতাঙ্গাতে বিপুলসংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। সব ঘটনা ছিল বেলজিয়ামেরই সাজানো।

লুমুম্বা তখন বাধ্য হয়ে জাতিসংঘের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। কিন্তু জাতিসংঘের তরফ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি আফ্রিকার সকল স্বাধীন দেশের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাহায্য চাইলেন পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকেও। কিন্তু কোনো পক্ষ থেকেই তেমন সাড়া মিলল না। এরপর নিরুপায় হয়ে তিনি নিজের অস্ত্রহীন, শক্তিহীন, প্রশিক্ষণবিহীন সৈন্য নিয়েই বেলজিয়ান সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত হলেন।

ঠিক সেই মুহূর্তেই আর একটা আঘাত এল বিশ্বাসঘাতক প্রেসিডেন্ট কাসাবুভুর তরফ থেকে। তিনি বেলজিয়ামের ইশারায় দেশের গোলযোগের অজুহাতে লুমুম্বা সরকারকে বরখাস্ত করলেন। এ ছাড়া কর্নেল জোসেফ মতুকে দিয়ে ঘটানো হল সামরিক অভ্যুত্থান।

১৯৬১ সালের ১৭ নভেম্বর, লুমুম্বা লিওপোল্ডভিল থেকে ফেরার পথে কাসাবুভুর বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। কাসাবুভু লুমুম্বাকে হস্তান্তর করেন তাঁর নেপথ্য প্ৰভু বেলজিয়াম সরকারের হাতে। তারপর ওই একই বছরের ১৮ জানুয়ারি বেলজিয়ান সৈন্যরা লুমুম্বাকে কাপুরুষের মতো হত্যা করে। আর এমনি করে অবসান ঘটে কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের কাছে জাতীয় বীরের মর্যাদার অধিকারী লুমুম্বার সংগ্রামী জীবনের। কিন্তু আজও তিনি সারা কঙ্গোর কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা হিসেবে অমরহয়ে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *