প্যাঁচ
‘যাঃ, প্যাঁচ ঘুরে গেছে।’
এই প্যাঁচ ঘুরে যাওয়া যে কি জিনিস, সে যে জানে সে জানে। ভিটামিনের শিশি খোলার চেষ্টা হচ্ছিল। নিয়মটা এতদিনে সকলেরই জানা হয়ে গেছে। শ্বাস বন্ধ করে, মনকে শান্ত, সংযত, যোগারূঢ় অবস্থায় এনে, আঙুলে শাঁড়াসির শক্তি নিয়ে, এক দমে ছিপিটাকে দাঁত তোলার কায়দায় পটাস করে ঘুরিয়ে দিতে হবে। পুটপুট করে শব্দ, গলার মালা নেমে গেল গলায়, ছিপি চলে এল হাতে। দর্শক হয়ে উদ্বিগ্ন মুখে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘কি, গেছে তো? ঘুরে গেছে তো?’ মানুষ খারাপটাই আগে ভাবে। অন্তত কয়েকটা ব্যাপারে, পরীক্ষার ফল, ইন্টারভিউ, পকেটের টাকা আর ছিপি।
প্রশ্নের উত্তরে যিনি ছিপি খুলছিলেন, তিনি বিজয়ীর হাসি হেসে উইম্বলডন থালা তুলে দেখাবার কায়দায়, ছিপিটাকে তুলে সকলকে দেখালেন। টেনসান কাটল। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হল। সবাই বললেন, ‘উ:, অসাধ্য সাধন করেছে। এক চান্সে ছিপি খোলা! মুখের কথা!’
এক চান্সে সি-এ, কি আই. এ. এস. কি কস্ট অ্যাকাউন্টেনসি পাশ করা, এক চান্সে বউয়ের কাছ থেকে টাকা বের করা, আর এক চান্সে সিল করা ছিপি খোলা একই ব্যাপার। একশোটায় একটা এক চান্সে খোলে কিনা সন্দেহ। আর সন্দেহ, যে খোলে, তাকে। সকলেই ভাবেন, ও পারবে না, পারলে একমাত্র আমিই পারব।
আরে দেখি-দেখি ও তোমার কম্মো নয়। এর একটা টেকনিক আছে।
বেশ বাবা, দেখান আপনার টেকনিক। টেকনিক হল দু-হাঁটু একত্র করে দুহাতে শিশিটাকে ধরে ঘাড় মটকানোর কায়দায় ঘুরিয়ে যাও। দেখতে-দেখতে গলার শিরা ফুলে উঠল, মুখ করমচার মতো লাল মেরে গেল। প্রায় খুন চেপে যাওয়ার মতো অবস্থা। শেষে হুঙ্কার। ‘জয় রামচন্দ্রজি কি জয়।’ জয় পবনসূত হুঁড়ুমাঁড় চন্দ্রজি কি জয়। প্যাঁচের অহঙ্কার আর যিনি খুলছেন তাঁর অহঙ্কারের দ্বৈরথ। এই সময় ছোট ছেলে এসে জিগ্যেস করলে, ‘বাবা, মা জিগ্যেস করল, আলমারির চাবি কোথায় রেখেছ?’
সঙ্গে-সঙ্গে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উত্তর, ‘যমের বাড়ি।’
এগিয়ে এলেন দ্বিতীয় যোদ্ধা। তিনি গীতা পড়েন। স্থিতধী। উত্তেজিত হন না। যেন এইমাত্র শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে কুরুক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি শিশিটাকে হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিতে-নিতে বললেন, ‘উত্তেজিত হলে চোখ থেকে চশমাটা পর্যন্ত খোলা যায় না। দাও দেখি আমাকে।’
তিনিও মরণপণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। বললেন, ‘এই কোম্পানির পরমায়ু বেশিদিন নেই। শিশির ছিপিই যদি খোলা না গেল তো, রোগী ওষুধ খাবেই বা কী ভাবে, আর আরোগ্যই বা হবে কী করে।’
শিশি চলে গেল আর এক হাতে। তিনি আবার সাধনমার্গের মানুষ। যা করেন, সবই করেন মনে, বনে আর কোণে। তিনি ঘরের নির্জন কোণে উঠে গেলেন। সেখানে দেওয়ালের দিকে মুখ করে ছিপির ঘাড় ঘোরাতে লাগালেন। যখনই সামনে ঝুঁকে কুঁজো মতো হয়ে যাচ্ছেন, তখনই বুঝে নিতে হচ্ছে, তিনি শক্তি ঢালছেন। শেষ ফোঁটাটুকু ঢেলে তিনি সোজা হচ্ছেন। মুখ ওপর দিকে তুলে বুক ভরে দম নিয়ে প্রার্থনা করে আবার একটু-একটু করে সামনে নুয়ে পড়ছেন। একেই বলে, সেই স্বদেশি যুগের ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’র মতো নিষ্ঠা। শেষে ধীরে-ধীরে তিনি ঘুরে গেলেন চাকার মতো। মুখে পরাজয়ের গ্লানি। শিশি-ধরা হাত কাঁপছে। নিস্তেজ হয়ে বসে পড়লেন। মন্তব্য করলেন—’শিবেরও অসাধ্যি।’
এইবার একজন এগিয়ে এলেন, যিনি ইংরেজি মতে বিশ্বাসী। বললেন, লেট মি সি। তিনি চোখ বুজে ঝাড়া তিন মিনিট প্রার্থনা করে মারলেন উলটে প্যাচ। হায়, উলটো বুঝলি রাম—ছিপি খোলার বদলে খুলে গেল কাঁধের খিল। যার ওষুধ তিনি এতক্ষণ বালিশে মাথা রেখে সব দেখছিলেন, চিঁচিঁ করে বললেন, ‘ছেড়ে দাও না, বাপু, পরপর এতগুলো ক্যাজুয়্যালিটি হয়ে গেল। শিশিটা আমার চোখের সামনে রাখো। বিশ্বাসেই কাজ হয়ে যাবে।’
তা তো আর হয় না। ব্যাপারটা তো আর ব্যবহারিক জগতে নেই। উঠে গেছে হারজিৎ-এর জগতে। শিশি এবার হাজির হল নারীদের কেল্লায়। ‘মুখপোড়া শিশি। এইবার যদি কাজ হয়। দাও দিকি আমার হাতে। যার যা দাওয়াই। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না।’ তিনি চলে গেলেন দরজার কাছে। পাল্লা আর ফ্রেমের খাঁজে ছিপিটাকে চেপে ধরে মারলেন প্যাঁচ। তার পরেই মন্তব্য—’যা:, ঘুরে গেছে।’ মুখপোড়া নয়, শিশি ফিরে এল মুখবাঁকা করে। ‘ঝাড়ু মার অমন প্যাঁচের মুখে।’ মেয়েদের জগতের সহজ সমাধান। সমস্যার মুখে ঝাড়ু মারল ও সবেগে পলায়ন।
শুরু হল সহিংস পদ্ধতি। প্রথমে এল লগবগে ছুরি। ছুরি মানুষের গলা কাটতে পারে, শিশির প্যাঁচ কাটার ক্ষমতা নেই। যিনি কেরামতি করছিলেন, তাঁর আঙুলের মাথাটা উড়ে গেল। একজন বললেন, ‘আমি জানতুম, ও যে ভাবে করছে, দ্যাট ইজ নট দি ওয়ে। ভেরি ডেঞ্জারাস।’ এল একটা সরু বাটালি। ‘দিস ইজ দি ওয়ে’ বলে তিনি তলা থেকে যেই একটু ওপর দিকে উসকেছেন, হড়কে গেল। সিলের একটু অংশ সামান্য উঁচু হল মাত্র। বদলে যিনি খুলছিলেন তার নখের মাথার দিকটা উড়ে গেলে। শিশি আর সরু বাটালি হাতে-হাতে ঘুরতে লাগল। মুখে-মুখে ঘুরতে লাগল একটি মাত্র বাক্য—’সাবধান, খুব সাবধান। ভেরি ডেঞ্জারাস। রিস্কি গেম। ‘মাঝে-মাঝেই যন্ত্র হড়কে যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদ, —’গেছে গেছে।’ পরমুহূর্তেই প্রশ্ন—’আঙুলটা আছে, না গেছে।’