প্যাঁচ
প্যাঁচ যে কী জিনিস, যিনি কখনও না কখনও প্যাঁচে পড়েছেন তিনি বিলক্ষণ জানেন। এমনকী রবীন্দ্রনাথও প্যাঁচ ব্যাপারটা জেনেছিলেন। উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টা প্রণিধানযোগ্য হবে।
‘যিশু চরিতের’ প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বাউল সম্প্রদায়ের একজন লোককে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমরা সকলের ঘরে যাও না?’
সে কহিল ‘না’।
কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে কহিল, ‘যাহারা আমাদের স্বীকার করে না, আমরা তাহাদের ঘরে যাই না।’
আমি কহিলাম, ‘তারা স্বীকার না করে নাই করিল, তোমরা স্বীকার করিবে না কেন?’
সে লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সরলভাবে কহিল, ‘তা বটে, ঐ জায়গাটাতে আমাদের একটু প্যাঁচ আছে।’”
কবি অজিত দত্ত তাঁর ‘নইলে’ নামক এক বিখ্যাত কবিতায় লিখেছিলেন,
‘প্যাঁচ কিছু জানা আছে কুস্তির?
ঝুলে কি থাকতে পারো সুস্থির?…
…দাঁত আছে মজবুত সব বেশ?
পাথর চিবিয়ে আছে অভ্যেস?
নইলে
রইলে
ভাত না খেয়ে
চালে ও কাঁকরে আধাআধি থাকে হে।’
কবি কুস্তির প্যাঁচের কথা লিখেছেন। কিন্তু সে তো খুবই মোটা দাগের ব্যাপার। আসল প্যাঁচ হল বুদ্ধির, সে অনেক সূক্ষ্ম ব্যাপার।
এমন অনেক ব্যক্তি আছেন, তাঁদের বুদ্ধি এতই প্যাঁচালো যে বলা হয় যে তাঁদের মগজের মধ্যে পেরেক ঢুকিয়ে দিলে সেটা স্ক্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে। এবং তখন সেই স্ক্রু দিয়ে তিনি যাকে ইচ্ছে তাকে টাইট দেবেন, যত ইচ্ছে টাইট দেবেন।
শুধু টাইট দেয়ার জন্যেও লোক রীতিমতো বিনা কারণেও বুদ্ধির প্যাঁচ কষে। নানা জনকে নানাভাবে জব্দ করে।
গোপাল ভাঁড়ের রেলগাড়ি-সংস্করণের একটি পুস্তিকার প্রচ্ছদের কথা আমি আগে বলেছি। প্যাঁচালো কথার চমৎকার উদাহরণ।
প্রচ্ছদের ছবিতে আছে, হাতে হাতঘড়ি পরা এক ভদ্রলোক, তাঁর কাছে অন্য এক ভদ্রলোক সময় জানতে চাইছেন, ‘দাদা, আপনার ঘড়িতে ক’টা বাজে?’
ঘড়িওলা এর যা উত্তর দিলেন তা অভাবনীয়। তিনি উলটে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার ক’টা চাই।’
প্যাঁচালো কথার সবচেয়ে বেশি বিনিময় হয় আদালত কক্ষে, রাজনৈতিক আলোচনায়, হাটে-বাজারে।
বাজারের গল্পটা খুব পুরনো, কিন্তু চিরনতুন। বিশেষ করে বৎসরান্তের এই আমের সিজনে।
অনেকের যেমন অভ্যাস থাকে, এক ভদ্রলোক আমের বাজারে পাকা আম টিপে টিপে দেখছেন। বলা বাহুল্য, আমের দোকানদার তাঁকে মানা করে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি অবিচল। অবশেষে আমের দোকানি উঠে দাঁড়ালেন, দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগলেন, আশেপাশের আমওলাদের বলতে লাগলেন, ‘ওরে, তোরা আর চিন্তা করিস না। আমের ডাক্তার এসে গেছে, ডাক্তারবাবু সব খারাপ আম টিপে টিপে দেখে চিকিৎসা করবেন। তোদের সব আম নিয়ে আয়।’
দাম্পত্য কলহের প্যাঁচ অবশ্য এত স্থূল সাধারণত হয় না।
গ্রীষ্মের দুপুরে সারা দুপুর কষ্ট করে, রান্নাঘরে ঘামে নেয়ে নীলিমা তাঁর স্বামীর জন্যে মাটন বিরিয়ানি রান্না করেছেন। প্রতিদিন তাঁর স্বামী অফিস থেকে এসে সন্ধ্যাবেলা খাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁত করেন, আজ তাঁকে চমকে দেবেন।
বিরিয়ানি রান্না শেষ করে খাওয়ার টেবিলে সেটা রেখে নীলিমা স্নান করতে গেছেন, ফিরে এসে দেখেন যে তাঁর প্রিয় কুকুর লোভা টেবিলে উঠে সেই বিরিয়ানি গবগব করে খাচ্ছে।
একটু পরে স্বামী অফিস থেকে ফিরে আসতে তাঁকে সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে নীলিমা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। স্বামী নীলিমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘লোভা মরে গেছে তাই কী হয়েছে, তোমাকে কালকেই আরেকটা লোভার মতো কুকুর এনে দেব।’ এই প্যাঁচের কথার সোজা মানে হল, ‘বেঁচেছি, তোমার বিরিয়ানি খেলে বাঁচতাম না।’
প্যাঁচালো বুদ্ধি যে শুধু বড়দেরই থাকে তা নয়। অল্প বয়েসিদের মধ্যেও এর অভাব নেই।
স্কুলের ক্লাসে মাস্টারমশায় ছেলেদের বাসা থেকে রচনা লিখে আনতে বলেছিলেন। মোটামুটি তিন পৃষ্ঠার মধ্যে রচনা লিখতে হবে, বিষয় ‘আলস্য’।
নির্দিষ্ট দিনে অন্যান্য ছাত্রেরা ক্লাসে এসে তাদের রচনার খাতা জমা দিল। প্রত্যেকেই যে যেমন পারে তিন পৃষ্ঠার মতো করে রচনা লিখেছে।
শুধু একটি ছেলে ব্যতিক্রম।
তার রচনার খাতায় প্রথম পৃষ্ঠার মাথায় লেখা আছে, ‘আলস্য’। তারপর পরপর তিন পৃষ্ঠা সাদা। তৃতীয় পৃষ্ঠার নীচে বড় বড় হরফে লেখা আছে—
‘এর নাম আলস্য।’
অবশ্য এর চেয়েও প্যাঁচালো বুদ্ধি ছিল সেই ছেলেটির যাকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘তুমি সাঁতার কাটতে পারো?’ সে বলেছিল, ‘সময়—সময়।’ আমি অবাক, ‘সময়—সময় মানে?’ ছেলেটি অম্লানবদনে বলল, ‘সময় সময় মানে ওই যখন জলে নামি তখন।’