প্যাঁকাও

প্যাঁকাও

আমার মায়ের মাসতুতো দাদাদের মামাতো ভাইয়ের নাম প্যাথা বোস৷ প্যাথা বোস-এর আবার সবেধন নীলমণি এক ছেলে৷ তার নাম ম্যাথা৷ এক ছেলে বলে বড়মামার ভীষণই আদুরে৷ প্যাথামামাদের অবস্থাও খুব ভালো৷ বালিগঞ্জে বিরাট লনওয়ালা বাড়ি৷ দেখবার মতো বাগান৷ কত গাছপালা, পাখি, কত রকমের গাড়ি৷ প্রতি বছর The Statesman কাগজের Vintage Ralley-তে বড়মামা যাত্রাদলের সং-এর মতো মেকআপ নিয়ে এক একবার এক একরকম সেজে মান্ধাতার আমলের বেইন্টলি চালিয়ে র‍্যালি করেন৷ আমরা আমাদের গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিই আর পাড়ার ছেলেদের কাছে রেলা নিই৷ আর এ পাড়ার কোনো ছেলের মায়েরই মাসতুতো দাদার এমন মামাতো ভাই নেই৷ গর্বে আমার পা পড়ে না সেদিন মাটিতে৷

মায়ের সঙ্গে গত সপ্তাহে ম্যাথাদের বাড়িতে গেছিলাম৷ এ তো আমাদের মতো বাড়ি নয় যে কড়া নাড়লাম বা বেল টিপলাম, অমনি কেউ এসে দরজা খুলল৷ বাইরের গেট বন্ধ৷ অনেক দারোয়ান৷ তারা জেরাতে জেরাতে জেরবার করে দিল৷ শেষে ওখান থেকে ফোন করে আমাদের, মানে আমার মা আর আমার চেহারার বর্ণনা আর নামধাম জানাতে ভিতর থেকে বলা হল, আসতে দেওয়া হোক৷

প্যাথামামিমা মাকে দেখে মুখ ভেটকে বললেন, কী ব্যাপার! কী মনে করে?

না, কিছু মনে করে নয়৷ এই মিটকু তোমাদের পাখিগুলো দেখার জন্যে বড় বায়না ধরেছিল৷

তারপরই বলল, সেদিন তোমাকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছিল কী বলব!

কোথায়?

অবাক হয়ে বললেন, গয়নায় মোড়া শরীর আর খুব দামি শাড়ি পরা প্যাথামামিমা৷

আরে গাড়িতে৷ স্টেটসম্যান কাগজের র‌্যালিতে৷ রানি সেজেছিলেন আপনি৷ রানিদের রানি সাজাটা মানায় না, ঘুঁটেকুড়ুনি সাজলেন না কেন?

তুমি না! ঘুঁটেকুড়ুনিরা কি রুপোর কাজ করা বেইন্টলি চাপে?

তা বটে! ভুলেই গেছিলুম৷

আমি বললাম, ম্যাথাও কোথায়?

সে তো রাত জেগে ওয়ার্লড কাপ দেখছে৷ ফুটবল৷ এখন ঘুমোচ্ছে৷

অ৷

নতুন কোনো পাখি এসেছে? মামিমা?

কে জানে! ওসব আমি জানি না৷ তবে দাঁড়াও৷

বলেই, বাগান থেকে একজনকে ডাকলেন, ডেকে বললেন, তোমার বাবু কি নতুন কোনো পাখি এনেছেন?

এঁজ্ঞে বৌরানি৷ এনেছেন বটে এক গাছা নতুন পাকি!

কি পাখি? কোথায়? যাও৷ একে নিয়ে দেখাওগে যাও৷

ম্যাকাও৷

ম্যাকাও৷

নাম শুনেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম৷

আমি জানি, দক্ষিণ আমেরিকার পাখি এরা৷ আরও নানা দেশেও হয়৷

লোকটা আমাকে নিয়ে গেল পাখির সামনে৷

মস্ত বড় ঘর পাখির৷ ম্যাকাওরই জন্যে আলাদা৷ আমাদের শোওয়ার ঘরের মতো প্রায়৷ তার মধ্যে ইয়া ইয়া ঠোঁট নিয়ে ম্যাকাও বসে আছে৷ ঘন নীল আর কমলা তার গায়ের রং৷ মোহিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷

তারপর ফিসফিস করে বললাম লোকটিকে, ভাই! ছোট ম্যাকাও কি পাওয়া যায়?

ছোট ম্যাকাও?

হ্যাঁ৷ মানে গরিবের বাড়ি রাখা যায়৷ টিয়ার মতো খাঁচায়৷

তা পাওয়া যাবে না কেন! ম্যাকাও অনেক রকমের হয়৷ তবে এ পাখির দাম কত জানো?

কত?

তিন লাখ টাকা৷

একটা পাখির দাম তিন লাখ টাকা? আমার বাবা পঞ্চাশ হাজার টাকার জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন৷

কীসের জন্যে?

গুমো হাবড়াতে দাদুর দেড় কাঠা জমি ছিল, তাতে মাথা গোঁজার মতো বাড়ি করবেন বলে৷

লোকটা হাসল৷ তারপর দু-হাতের তেলোতে মেরে খৈনি খেল৷ একটু হেসে বলল, ঐ বাড়িটা দেখছ?

কোনটা?

আরে ঐ যে৷ গারাজগুলার পাশে৷

হ্যাঁ৷ ছাই রঙের তো!

হাঁরে বাবা হাঁ৷

ওইটা হচ্ছে আমাদের বাথরুম আর পাইকানা৷ ও করতেই মালিকের আড়াই লাখ খরচ পড়েছে৷ তোমরা কি খাটা পাইকানাতে থাকবে গুমো হাবড়াতে বাড়ি করে!

আমার খুব রাগ হয়ে গেল৷ মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, চলো৷

মামিমাকে দেখলাম না৷

মা বললেন, চল রে খোকা, আমরা চলেই যাই৷ বৌদিদের বাড়ি আজ বিকেলে পার্টি আছে৷ অনেক লোক যাবেটাবে৷ সাজানো গোছানো হচ্ছে৷ এখন আমরা যাই৷ পরে অফিস ছুটি হয়ে গেলে বাসে অনেক ভিড়ও হয়ে যাবে৷ বাস থেকে নেমেও তো হাঁটতে হবে অনেকখানি৷ আজ না রথ! তোর জন্যে তো রথ কিনতে হবে একখানা৷

আর পাঁপড়ভাজা, ফুলুরি?

হবে, হবে৷





ছোটকাকু অফিস থেকে ফিরলে ম্যাকাও-এর গল্প বললাম চোখ বড় বড় করে৷ দাম শুনে ছোটকাকুর গলাতে রুটি আর আলুর তরকারি আটকে গেল৷ ছোটকাকুর সাইকেলের সঙ্গে একটি ব্যাগ থাকে, আর সাইকেলটা বাইরের ঘরের ভিতরে তুলে রাখা থাকে রোজ৷ সাইকেলটা ঘরে ঢোকাবার আগে রাস্তার গঙ্গার জলের কলে তার চাকা দুটি ভাল করে ধুয়ে নেয়, যাতে মা বকাবকি না করে, তাই৷

ছোটকাকু বলল, তোকে তো ম্যাকাও দিতে পারব না৷ আজ তোর জন্যে একটা প্যাঁকাও এনেছি৷

সেটা কী?

ছোটকাকু ব্যাগ থেকে বের করল, একটা ছোট্ট কাবলি বেড়ালছানা—সাদা, বড় বড় লোম, দারুণ দেখতে৷

আমি বললাম, বাঃ৷ কিন্তু এত ঠান্ডা কেন? মরে গেছে নাকি?

মরে যায়নি৷ গায়ে ময়লা ছিল বলে পথের কলের জলে আচ্ছা করে চান করিয়ে নিয়ে এসেছি৷

মা শুনে বললেন, করেছ কী? বেড়াল এমনিতেই জলকে এড়িয়ে চলে৷ মরে যাবে যে!

ছোটকাকু বলল, তোমার হাতে আছাড় খেয়ে মরত ময়লা অবস্থাতে নিয়ে এলে৷ সাইকেল পরিষ্কার করা সাবানও ছিল সঙ্গে৷ ওকে আচ্ছা করে সাবান দিয়ে চান করিয়ে এনেছি৷ প্যাঁকাও৷

মা বললেন, কী যে করো৷ দাঁড়াও একটু দুধ গরম করে আনি৷

ততক্ষণে আমি প্যাঁকাওকে কোলের মধ্যে নিয়ে খুব আদর করছি৷ ওর চোখ দুটো গোলাপি গোলাপি৷ ভাবলাম কে জানে! ছোটকাকু হয়তো জানে না—আসলে প্যাঁকাও রেওয়ার বাঘের বাচ্চা নয়তো!

ছোটকাকু বলল, কীরে! তোর ম্যাকাও-এর চেয়ে খারাপ? বৌদির মাসতুতো দাদাদের, বড়মামাদের বাড়ির ম্যাকাও-এর চেয়ে এই প্যাঁকাও কি খারাপ?

না৷ খুব পছন্দ আমার৷





প্যাঁকাও অনেক বড় হয়েছে৷ আমার বন্ধুদের সঙ্গেও ওর বন্ধুত্ব হয়েছে৷ আমরা ওকে কালীঘাট পার্কে নিয়ে যাই৷ একদিন লেকেও নিয়ে গেছিলাম সকালে সাঁতার কাটার সময়ে৷ জল দেখে ভয় পেয়ে ও দূরে বসেছিল৷ কুকুরগুলো ভারী পেজোমি করে ওকে দেখলেই৷

একদিন আমি প্যাঁকাওকে নিয়ে আমাদের বাড়ির সামনের রকে বসে আছি৷ এমন সময়ে একটা মস্ত গাড়ি এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে৷ গাড়িটার সামনেটা রইল ফণেদাদার পানের দোকানের সামনে আর পেছনটা রইল কালোবাবুর মনোহারি দোকানে৷ গাড়ি থেকে নামলেন প্যাথামামা৷

গর্বে আমার বুক ফুলে উঠল৷ পাড়ার সবাই দেখল যে আমাদের বাড়িতেও এত বড় গাড়ি-চড়া মানুষে আসে৷ পটলা, পেঁচি সব জানালার পর্দার ওপর দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল৷

প্যাথামামা বললেন, কী রে ছোঁড়া! তোর ছোটকা আছে?

এই তো এল৷ মা নেই৷

চল দেখি৷ তোর মায়ের সঙ্গে দরকার নেই কোনো৷

আমি উত্তেজনায় দৌড়ে গেলাম ভেতরে৷

ছোটকা সবে এসে লুঙ্গি গেঞ্জি পরে তক্তপোশে লম্বা দিয়েছিল৷ আমি ধাক্কা দিয়ে ওঠালাম, বললাম, ছোটকা! ছোটকা!

প্যাথামামাও আমার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলেন৷

বললেন, তোমার নাম খগেন নয়?

হ্যাঁ৷

তুমিই তো এই মিটকুর ছোটকা? আমাদের যোগেনের ভাই৷ তুমি সেলস ট্যাক্সে কাজ করো না?

হ্যাঁ, স্যার৷

ছোটকা তক্তপোশে উঠে বসে বলল৷

তোমাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে৷ তোমার ওয়ার্ডে আমার সেলস ট্যাক্সের ফাইল আছে৷ আমার একটা সাহায্যের দরকার৷ ভয় পেও না৷ তোমার দিকটাও দেখব আমি৷ চলো একটু আমার সঙ্গে আমার উকিলের কাছে—তিনি সব বুঝিয়ে দেবেন৷ তোমাদের সঙ্গে আমার ‘আত্মীয়তা গড-সেন্ট’৷ চলো৷

ছোটকা অফিস থেকে এসে কিছু খায়ওনি৷ মা পাশের বাড়ির মানী মামিমার বাড়িতে গেছে৷ এসে খেতে দেবে৷ কিন্তু ছোটকা কিছু না বলে, আবার প্যান্ট আর শার্টটা পরে নিল৷

হঠাৎ ছোটকা বলল, প্যাঁকাওকে কোথায় ফেলে এলি?

তাই তো! উত্তেজনাতে আমি প্যাঁকাওকে রকের উপরেই ছেড়ে চলে এসেছি৷ তখনও রোদ ছিল৷ গরমের দিন৷ ওর গরম লাগাতে কোনো ছায়া খুঁজে সেখানে গিয়ে বসে আছে নিশ্চয়ই৷

ছোটকা আর প্যাথামামা গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল৷ উর্দিপরা গুঁফো ড্রাইভার এসে দরজা খুলে ওদের বসাল৷ ছোটকাকে সামনে বসাল তার পাশে৷ তারপর প্যাথামামা বললেন, চলো, বালিগঞ্জ৷

এদিকে আমি প্যাঁকাও৷ প্যাঁকাও৷ বলে ডাকতে ডাকতে চারপাশে খুঁজতে লাগলাম৷ না, প্যাঁকাও কোথাও নেই৷ ফণেদার দোকানে খাকি হাফ প্যান্ট পরে বসে যে ছেলেটা সুপুরি কাটে, নাটু, তাকেও শুধোলাম, সেও বলল দেখেনি৷

মস্ত গাড়িটা স্টার্ট করল৷ প্রচণ্ড আওয়াজ হয় ইঞ্জিনে এইসব বড় গাড়ির৷ এমন সময়ে গাড়ির নীচে সাদা মতো কী একটি দেখলাম আমি৷ চিৎকার করে উঠলাম আমি ‘‘প্যাঁকাও’’ বলে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়িটা এক ঝাঁকি দিয়ে এগিয়ে গেল৷ আমি দেখলাম পেছনের চাকাটা প্যাঁকাও-এর মাথাটা গুঁড়িয়ে দিয়ে চলে গেল৷ রক্তে ভেসে গেল পথ৷

ছোটকা বলল, পট করে কি একটা আওয়াজ হল না?

প্যাথমামা বললেন, মাটির ভাঁড়-ফাঁড় কিছু ছিল একটা৷ চাকার নীচে পড়ে ভেঙে গেল৷

আমি দৌড়ে গিয়ে প্যাঁকাওকে কোলে তুলে নিলাম৷ মাথাটা চেপ্টে গেছে—গোলাপি চোখ দুটোও৷

আমি দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বললাম, দেখো প্যাথামামা! বড় হয়ে আমি তোমার ম্যাকাও-এর গলাটা যদি নিজে দু-হাতে মুচড়ে না ভাঙি তাহলে আমার নাম মিটকু নয়৷ তোমার দেনা আমি সুদসুদ্দ মিটিয়ে দেব৷ তুমি দেখো৷ প্যাঁকাও-এর মৃত্যুর বদলা আমি নেবই৷ তুমি তো তোমার বাবার টাকাতে বড়লোক৷ আমি নিজে মেহনত করে বড়লোক হব৷ দেখো তুমি৷ কিন্তু বড়লোক হলেও আমি অসভ্য হব না৷ মানুষকে মানুষ জ্ঞান করব৷ দেখো৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *