পৌষ মেলা

পৌষ মেলা

হয়তো মেলাতেই বসে আপনি এ-লেখাটি পড়ছেন। না-হলে মেলাতে আসার সময় এখনও আছে। মোটরে আসতে পারেন, অবশ্য যদি পণ্ডিতজি দুর্গাপুর থেকে শান্তিনিকেতন মোটরে এসে থাকেন। তার আসার সঙ্গে আপনার মোটরের আসার একটা অদৃশ্য সূক্ষ্ম কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। তিনি মোটরে এলে অজয় নদের উপরে কজওয়েটি তৈরি হবে, বিকল্পে তিনি যদি হেলিকপ্টারে আসেন এখানকার ফার্পো কালোর দোকানে সেই শুজোরব– তবে উড়িষ্যা ভাষায় আপনারো কপালো ভাঙিলো। সাধে কি আর মাইকেল গেয়েছেন, রাজেন্দ্রসঙ্গমে দীন যথা যায় দূর তীর্থ দরশনে– সে ব্যবস্থার পরিবর্তন এখনও হয়নি।

এসে কিন্তু কোনও লাভ নেই। কারণ, জেলা বীরভূমের অন্তঃপাতী ডিস্ট্রিক্ট রেজেস্টারি বীরভূম সবরেজেস্ট্রারি বোলপুর পরগণে সেনভূম তালুক সুপুরের অন্তর্গত হুদা বোলপুরে পত্তনীর ডৌল খারিজান মৌজে ভুবননগর ইস্তেক ভাববেন না, আমি সুকুমার রায়ের কাকালত নামা থেকে চুরি করছি, ইটি পাবেন শান্তিনিকেতন ট্রডিডের পয়লা পাতায়, সেকথা পরে হবে– সিকিটি ফেলবার জায়গা নেই। কারও না কারও মাথায় আটকে যাবে, কিংবা স্ত্রীপুরুষের পদতাড়নে যে পুঞ্জীভূত ধূলিস্তর আকাশে-বাতাসে জমে উঠেছে, তারই একটিতে। অন্য মেলার তুলনায় এখানে মেয়েদের সংখ্যা কিছু নগণ্য নয়, অথচ ভাবতে অবাক লাগে, পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে আশ্রমের মাস্টারদের গৃহিণী-কন্যারা যখন মেলা দেখার প্রথম অনুমতি পেলেন– শ্রীসদনের কল্পনাও তখন কেউ করতে পারেননি– তখন তাদের আনা হয়েছিল গোরুর গাড়িতে করে এবং তাঁরা মেলার প্রত্যন্ত প্রদেশ থেকে, গাড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেলা দেখেছিলেন।

এই মেলাটি বিশ্বভারতীর চেয়ে বয়েসে বড়। একথা বলতে হল বিশেষ করে, তার কারণ, যে-বেদির উপর বসে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাসনা করতেন, সে-বেদির পাশ দিয়ে যাবার সময় গেল মেলার সময় শুনি, এক গুণী আরেক গুণীকে বুঝিয়ে বলছেন, এই বেদির নিচে রবীন্দ্রনাথের পূত-অস্থি প্রোথিত আছে! আশ্চর্যচিহ্ন দিলুম এহেন তত্ত্ব নিতান্তই আমার কল্পনার বাইরে বলে, কিন্তু আসলে আমার আশ্চর্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বোম্বাই না কোথায় যেন রবীন্দ্রনাথের জন্মতিথি উপলক্ষে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত প্রথম ইংরেজিতে রচনা লিখে বুঝতে পারলেন, মাতৃভাষা বাংলাতেই ফিরে যাওয়া উচিত। গীতাঞ্জলি অনুবাদ করার পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজিতে বিশেষ কিছু লিখেছেন বলে জানতুম না; পরে চিন্তা করে বুঝলুম মন্ত্রীবর মাইকেল এবং রবীন্দ্রনাথে গুবলেট করে ফেলেছেন! (এবার আশ্চর্যচিহ্ন যে তাগ-মাফিক লেগেছে সে-কথা হর ব্যাকরণবাগীশই কবুল করবেন)। শতবার্ষিকী শত বার সিকি ভেবে এঁরা যদি এখন পঁচিশ টাকা খর্চা করেন তবে আমি আর বিস্মিত হব না। পাটা আমার নয়– এটা স্বয়ং কবিগুরু করে গেছেন।

তা-সেকথা এখন থাক। যে গুণী শান্তিনিকেতন ছাতিম তলার অভিনব ব্যাখ্যা দিচ্ছিল তাকে শুধু মনে মনে বলেছিলুম, সাবধানে থাকিস্, বাপ। তোকে না শেষটায় কেন্দ্রের মন্ত্রী বানিয়ে দেয়।

অতএব অতি সংক্ষেপে মেলাটির ইতিহাস বলি। এতে কোনও গবেষণা নেই।

১২৬৮ সনে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তী-যুগের বিখ্যাত লর্ড সিন্‌হা অব্‌ রায়পুর পরিবারে নিমন্ত্রিত হয়ে আসেন। রাইপুর জায়গাটি বোলপুর স্টেশনের কাছেই। মহর্ষিদেব একাধিকবার এই রাইপুরে আসা-যাওয়া করেন এবং গমনাগমনের সময় এ অঞ্চলের উঁচু-নিচু খোয়াই-ডাঙার দিগন্ত-বিস্তৃত অর্ধ-মরুভূমিসদৃশ নির্জন ভূমির গাম্ভীর্য তাঁকে আকৃষ্ট করে। আশ্রম স্থাপনার আদিযুগের ঐতিহাসিক ও প্রথম আশ্রমধারী স্বৰ্গত অঘোর চট্টোপাধ্যায় বলেন,

রায়পুর যাতায়াত করিবার সময় এই দিগন্ত প্রসারিত প্রান্তরের অপূর্ব গাম্ভীর্যে মহর্ষির চিত্ত আকৃষ্ট হয়। এই বিশাল প্রান্তরে দৃষ্টি অবারিত, অনন্ত আকাশ ব্যতীত দিয়ে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। অনন্তস্বরূপের এই উদাও সৌন্দর্যে তাহার হৃদয়মন প্লাবিত হইল, উক্ত আকাশতলে এই নির্জন প্রান্তর তপস্যার একান্ত অনুকূল বলিয়া তাহার ধারণা হইল। (শান্তিনিকেতন আশ্রম, ১৩৩৫–১৩৩৬ পৃ. ১১)।

চল্লিশ বৎসর পূর্বে আমি যখন এখানে আসি তখনও ওই দৃশ্য ছিল। এখন এত বেশি গাছপালা বাড়িঘর বাঁধ-বন লাগানো হয়েছে যে সে-দৃশ্যের কল্পনা করা কঠিন। তবে হে ভৈরব হে রুদ্র বৈশাখ ইত্যাদি কবিতায় ও গ্রীষ্ম-বর্ষার বহুশত গানে রবীন্দ্রনাথ সে যুগের শান্তিনিকেতনের বর্ণনা রেখে গেছেন। আর প্রাচীনতম যুগের বর্ণনা আছে জীবনস্মৃতিতে।

১৮ ফাঙ্গুন, ১২৬৯ সনে মহর্ষি বর্তমানে যেখানে লাইব্রেরি, শান্তিনিকেতন বাড়ি, মন্দির (গ্রাম্য লোকের কাছে এখনও এ জায়গা কাঁচা বাংলা নামে পরিচিত) এই জায়গাটি, মোট কুড়ি বিঘা জমি বার্ষিক পঁচ টাকা খাজনায়(!) মৌরসী পাট্টা নেন। ধ্যানধারণার জন্য মহর্ষি সর্বপ্রথম এখানে যে বাড়িটি তৈরি করেন সেটি মন্দিরের মুখোমুখি এবং শান্তিনিকেতন বাড়ি নামে পরিচিত।

১২৯০ সনের পর মহর্ষিদেব আর কখনও শান্তিনিকেতন আসেননি।

২৬ ফাল্গন, ১২৯৪ সনে মহর্ষি শান্তিনিকেতনের বাড়ি-বাগান জমি-জমা ধর্মচর্চা, বিদ্যালয় স্থাপন ও বাৎসরিক মেলা প্রবর্তনের জন্য ট্রাস্টডিড করে সর্বসাধারণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।

৪ঠা কার্তিক শুক্রবার, ১২৯৫, অপরাহ্নে আশ্রম প্রতিষ্ঠার পর্ব সমাধান হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও স্বৰ্গত মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায় আচার্যের কর্ম করেন।

৯ কার্তির ১২৯৫ বুধবারে এখনও প্রচলিত প্রতি বুধবারের প্রথম উপাসনা করেন প্রথম আশ্রমধারী অঘোর চট্টোপাধ্যায়।

২২ অগ্রহায়ণ ১২৯৭ সনে মন্দিরের ভিত্তিস্থাপন করেন মহর্ষিদেবের জ্যেষ্ঠপুত্র দার্শনিকপ্রবর দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়। উপাসনা করেছিলেন তিনি, তার মধ্যম ভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথ বক্তৃতা করেন এবং সঙ্গীত করেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ। একটি তাম্রফলকে তারিখ প্রভৃতি খোদিত ছিল। সেই ফলক, সেইদিনের স্টেটম্যান পত্রিকা, সেই মাসের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, পঞ্চরত্ন ও প্রচলিত মুদ্রা ভিত্তিমূলে প্রোথিত হয়। তাম্রফলকে ছিল,

ওঁ তত্সৎ। ঠক্কুর বংশাবতংসেন পরমহর্ষিণা শ্ৰীমতা দেবেন্দ্রনাথ শর্মণা ধর্মোপচয়ার্থ শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠাৰ্পিতমিদং ব্রহ্ম মন্দিরং। শুভমন্তু ১৮১২শক, ১৯৪৮ সম্বৎ, ৪৯৯১ কলা অগ্রহায়ণ ২২, রবিবাসর। (পূর্বোল্লিখিত পুস্তকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৯০)

৭ পৌষ ১২৯৮ তারিখে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠাপত্র পাঠ করে মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করেন।

 তৃতীয় বার্ষিক উৎসবে দরিদ্রের অনুদান।

 চতুর্থ বার্ষিক উৎসবে সর্বপ্রথম আতশবাজি পোড়ানো হয়।

পঞ্চম বার্ষিক উৎসবে সর্বপ্রথম মেলা ও যাত্রাগানের ব্যবস্থা হয়।

অতএব ১৩০৩ সনে পৌষমেলার আরম্ভ।

১৩০৯ সনে ব্রাহ্মচর্যাশ্রম বা স্কুল স্থাপন। ১৩২৫ সনে কলেজ বা বিশ্বভারতীর পত্তন। ১৩২৬ সনে গ্রীষ্মকাশের পর অধ্যাপনা আরম্ভ হয়। ১৩২৮/১৯২১-এ বিশ্বভারতীর (য়নিভারসিটিরূপে) উদ্বোধন।

পূর্বে মহর্ষিদেবের যে ট্রাস্টডিডের উল্লেখ করেছি তাতে আছে :

ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাস্টিগণ বর্ষে বর্ষে একটি মেলা বসাইবার উদ্যোগ করিবেন। এই মেলাতে সকল ধর্মসম্প্রদায়ের সাধু পুরুষেরা আসিয়া ধর্মবিচার ও ধর্মালাপ করিতে পারিবেন। এই মেলায় উৎসবে কোনওপ্রকার পৌত্তলিক আরাধনা হইবে না ও কুৎসিত আমোদ-উল্লাস হইতে পারিবে না, মদ্য মাংস ব্যতীত এই মেলায় সর্বপ্রকার দ্রব্যাদি খরিদ-বিক্রয় হইতে পারিবে।

আমার মনে হয় এই মেলার সময় যদি দেশ-বিদেশের সর্ব ধর্মের গুণী-জ্ঞানী সাধকপণ্ডিত সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ করে তিন দিনব্যাপী ধর্মালোচনা ধর্মাসভার পত্তন (কংগ্রেস অব অল ফেল্স) হয়, তবে আমরা যুাধর্ম অনুসরণ করে মহর্ষিদেবের শুভেচ্ছা সফলতর করতে পারব ॥

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *