পোসাইডন

পোসাইডন 

নীলসমুদ্র। আত্মাহুতি দিতে চাওয়া ঢেউদের তীরে আছড়ে পড়া। সাদা বালির ওপরে আকাশে উড়তে থাকা শংখচিলদের ছায়া। তারপর সমুদ্রের জলে ভেসে আসা রঙিন শামুক ঝিনুকের মৃতদেহ। এগুলো পার হয়ে ঠিক দক্ষিনে একটা ভাগাড়। সম্ভ্রান্ত আবাসিক হোটেলগুলো এই ভাগাড় থেকে মানুষ নিয়ে যায়। তারপর রঙ মাখিয়ে সম্ভ্রান্ত মানুষদের সামনে উপস্থাপন করে। এই ভাগাড়ের শেষ মাথায় একটা মরা শিমুল গাছ। এক সময় বহু শিমুল ফুটে থাকত গাছটাতে। এখন শতশত কাকের আবাস এই শিমুলগাছের লাশ। দূর থেকে দেখলে কাপড় ঝোলানো হ্যাঙার বলে মনে হয়। আর কাকগুলোকে মনে হয় হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রাখা কালো ওড়না। ওই গাছটা পার হলেই পর্তুগীজ কলোনি। সেই কলোনির সত্তরভাগ মানুষই মৎসজীবি। 

এই কলোনিরই সতের বাই তিন নম্বর বাড়িটাতেই বিকাশরা থাকত। কোন এককালে বিকাশের প্রপিতামহ বাঙালি মেয়ে বিয়ে করে এখানে থেকে গিয়েছেন। আর ফেরেননি। বিকাশের বাবা জাতে খ্রিস্টান, মা মুসলিম। তবে সে ওই জাত পর্যন্তই। দরিদ্রের ঘরে ধর্ম ঢুকতে পারলেও ধর্মবিশ্বাস ঢুকতে পারে না। বিকাশদের ঘরেও ঢুকতে পারেনি। বাবা সারাদিন মাছ ধরে এসে আর মা সারাদিন হোটেলে কাজ করে এসে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করার সময় পায় না। 

বিকাশের একটাই ছোটবোন। জ্যোতি। খুব ছোট বয়সেই তাকে দুরের শহরের খ্রিস্টান মিশনারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। খ্রিস্টান এতিম ছেলেমেয়েদের থাকা, খাওয়া এবং লেখাপড়া করার ব্যবস্থা আছে। অভাবে পড়ে বিকাশের বাবা নিজের মেয়েকে এতিম পরিচয় দিয়ে সেখানে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসে। ফিরে এসেই বিকাশের বাবা একটা মাছধরা নৌকা কিনে মাছ ধরা শুরু করে। মেয়েটা পরিবার থেকে প্রায় সাত বছর বিচ্ছিন্ন। প্রথম প্রথম বিকাশের মা খুব কান্নাকাটি করত। পেটে ধরা মেয়েটাকে দুর শহরে ফেলে আসলো পাষাণ বাপটা। বিকাশের বাবা সান্ত্বনা দিত- “ম্যালা টাকা হইলা পারে আবার নিয়া আব। বিয়্যা দিয়া দিব রাজপুত্তুরের সাত। কান্দিস নাইক।” এই কথাটা বিকাশের কানে আজীবনের মত লেগে গিয়েছিল। 

বাড়ির পাশের সমুদ্র বিকাশকে টানেনি। বিকাশ বাড়ি থেকে অদুরে সইবাজারের ওখানে একটা সাইকেল সারাইয়ের দোকানে কাজ নিয়ে নিয়েছিল। ক্ষীণকায় ছোটখাট গড়নের বিকাশ সাইকেল মেকানিকের কাজটাকে খুব পছন্দ করত। পরিশ্রমী ছিল। সমুদ্রতীরে নৌকার মত সাইকেলেরও বেশ ভালোই চাহিদা ছিল। খদ্দেরের অভাব হতো না। কিন্তু বিকাশের তেমন কোন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে অনেক টাকা হলে বোনটাকে রাজপুত্তুরের সাথে বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবত। ওই ভাবনা পর্যন্তই। তারপর আবার কাজে ডুবে যেত। 

সবকিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিল। যতক্ষন পর্যন্ত না মন্টুর সাথে তার পরিচয় হয়। মন্টু আগে একটা কামারের দোকানে কাজ করত। লোহা চুরির অপরাধে দোকানের মালিক তাকে বের করে দিলে সে এসে সাইকেল সারাইয়ের দোকানে জুটে যায়। সেখান থেকেই বিকাশের সাথে মন্টুর পরিচয়। 

বিকাশের কোন উচ্চাকাঙ্খা না থাকলেও মন্টুর ছিল। মন্টু স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতো। তার কাজই ছিল কাজ ফাঁকি দিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখা। বিকাশ যেমন চুপচাপ ছিল, মন্টু ছিল তেমনই বাচাল আর চঞ্চল। এক সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফেরার পথে মন্টু বিকাশকে বলল যে এইভাবে কাজ করে সবার ওপরে ওঠা যাবে না। সবাই কাজ করে। তারা কি সবাই শহরে হোটেলের মালিক হতে পারে? সবার ভেতরে একজন হতে গেলে সেই একজনের মত কাজ করতে হবে। এমন কাজ যা অন্য কেউ করার চিন্তা করতেও ভয় পাবে। 

“কি সেই কাজ?” 

মন্টু বলল, “তুই শহর থেকে সাইকেল চুরি করে আনবি। আমি বেঁচব আমি জানি তুই পারবি। বিকাশ রাজি হয়ে যায়। সাইকেল সারাইয়ের দোকানের কাজটার ইস্তফা দিয়ে দেয়। এক অভিনব উপায়ে সাইকেল চুরি করতে থাকে।” 

ভোরবেলা একবস্তা লোহালক্কড় ভাঙা নিয়ে বের হয় বিকাশ। ভটভটি ধরে চলে যায় শহরে। তারপর দেখে শুনে একটা সাইকেল ঠিক করে। সাইকেলে তালা লাগানো থাকলে তালার ভেতরে এক ফোঁটা গ্রিজ দিয়ে একটা মাথা বাঁকানো লোহার পাত দিয়ে কয়েকবার চাড় মারে। ব্যস, তালা খুলে যায়। তারপর বিকাশ সেই সাইকেলের পেছনে লোহার বস্তাটা চাপায়। কখনও পুলিশ তাকে সন্দেহের বশে ধরলেও, শুধু সাইকেলের পেছনে ঝুলতে থাকা লোহালক্কড়ের বস্তাটায় তল্লাশী চালায়। তারপর ছেড়ে দেয়। সাইকেলের দিকে লক্ষই করে না। 

বাহাত্তরটা সাইকেল সে এইভাবে শহর থেকে চুরি করে আনে। পুলিশ ঘুনাক্ষরেও টের পায় না। তাদের সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে ওই লোহালক্কড়ের বস্তাটা। ওদিকে মন্টু চোরাই সাইকেলগুলো বেঁচতে থাকে। পুলিশ মাঝে মাঝে চোরাই সাইকেল খুঁজতে আসলে পুরো সাইকেল আর বিক্রি করা হত না মন্টুর। তখন সাইকেলের পার্টসগুলো খুলে ফেলা হত। টায়ার, চেইন, চেইনকভার, রিম, স্পোক। তারপর সস্তায় সেগুলো বিক্রি করে দিত। প্রতি সপ্তাহে দুইজনের পকেটে মোটা অংকের টাকা আসতে শুরু করল। 

এরইমধ্যে বিকাশের বাবা একদিন সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরল না। বিকাশের বাবার কয়েকজন মাছ ধরার সঙ্গী এসে জানালো, দমকা বাতাসে নৌকা উল্টে গিয়েছিল। অনেক খোঁজাখোজি করেও লোকটাকে আর খুঁজে পায়নি তারা। বিকাশের মা আর বিকাশ- কেউই কাঁদেনি লোকটার জন্য। পরিবারে একটা মুখ কমেছে, এটা শুধু তাদের কাছে সান্ত্বনাই ছিল না, ছিল একটা খুশির খবর। 

সাইকেল চুরির ব্যাপারটা অবশ্য বেশিদিন চাপা থাকল না। পুলিশ সাইকেল চোরের খোঁজে শহরে রীতিমত অভিযান চালাতে শুরু করে দিল। মন্টু বলল- সাইকেলে আর হবে না। এইবার মোটরসাইকেল। 

বিকাশ তাতেই রাজি হয়ে গেল। 

মোটরসাইকেল চুরি করা সাইকেল চুরির থেকেও সহজ। তেলের ট্যাংকের কাছে স্পার্ক প্লাগ থাকে। ওটাতে কোনভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ করাতে পারলেই ব্যস। হয়ে গেল। ঝামেলা হত তখন যখন মটরসাইকেলের চাকায় তালা লাগানো থাকত। বিকাশ সেটাকেও সহজ করে ফেলল তালার ভেতরে এসিড ঢেলে। ধরা পড়া ঠেকাতে চোরাই মোটরসাইকেলটা চুরির পরে দুইদিন বড় কোন সারাইয়ের গ্যারেজে ফেলে রাখত। তারপর বের করে নিয়ে সোজা সইবাজার চলে যেত সে। মন্টু মোটরসাইকেলটা বেশ চড়াদামে বেঁচে দিত। 

চুরির অভিজ্ঞতা বিকাশের সমস্যা সমাধানের দক্ষতাকে এক অন্য মাত্ৰায় নিয়ে গেল। 

টানা দুইবছর এইভাবেই চলল। তারপর দুই কিশোর মিলে একটা ছোটখাট মোটরসাইকেলের শোরুমই দিয়ে ফেলল শহরে। সেই শহর, যেই শহরের খ্রিস্টান মিশনারীতে দশবছর ধরে বন্দী আছে বিকাশের ছোট বোন। বিকাশ ঠিক করল, ছোট বোনকে খ্রিস্টান মিশনারী স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনবে। এতদিনে নিশ্চয় তার লেখাপড়া শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেবে। দুই একবার খ্রিস্টান মিশনারী স্কুলে গিয়ে খোঁজও নিয়ে এসেছে সে। দশ বছর আগে যারা এখানে এসেছিল তাদের অনেকে এখন এই স্কুলের শিক্ষিকা হয়ে গিয়েছে। অনেকে মিশনারী হাসপাতালের নার্সের কাজ করছে। শুধু আরও কিছু টাকা জমার অপেক্ষা। বোনকে নিয়ে সোজা বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেবে বিকাশ। 

এক সন্ধ্যায় এক মোটরসাইকেল কোম্পানির ডিলারের সাথে মিটিং ঠিক করা হল। নতুন শোরুমে নতুন মোটরসাইকেল লাগবে। মন্টু বলল, “তার আগে চল রঙিলা মহল থেকে একটু ঘুরে আসি।” এই প্রস্তাবে বিকাশ রাজি হয়নি। ছোটবেলা থেকেই সে সাদা কালো। রঙিলা মহলে তার আগ্রহ নেই। 

না গেলে নাই- মন্টু রঙিন মানুষ, বিকাশের জন্য তো সে মনের রঙ বিসর্জন দিতে পারবে না। মন্টু একাই গেল। সবুজ রঙের কাঠের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বিকাশ বাইরের একটা চায়ের দোকানে অপেক্ষা করতে থাকে। প্রায় একঘণ্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও মন্টু ফিরছে না দেখে বিকাশ সবুজ রঙের কাঠের দরজায় নক করে। বেশ কয়েকবার নক করার পরে মন্টু বের হয়ে আসে। পেছন পেছন ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে আসে এক কিশোরী। পান খেয়ে লাল হওয়া ঠোঁট হাসি মাখা হলেও চোখজোড়া গভীর বিষাদে ডোবা। 

বিকাশ পাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকল। এই কিশোরীর মুখটা সে চেনে। এই মুখটাকে সে কতদিন দেখেনি! তাও চেনে। ছোটবোনকে এইখানে দেখতে পাবে ভাবেনি সে। কিশোরীও বিকাশের মুখের ওপরে দরজা আটকে দিয়েছে। তার বড় ভাই কখনওই এইখানে আসবে না। দৃষ্টিভ্রম হয়েছে হয়ত। 

মন্টুর সামনে বিকাশ সেদিন কিছুই বলেনি। মন্টুকে একাই পাঠিয়ে দিয়েছে মিটিং-এ। দারিদ্রের কষাঘাতে দুমড়ে মুচড়ে পাথর হয়ে যাওয়া ভেতরটাতে এখনও কিছুটা স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিল বিকাশ। আজ সেই স্বপ্নটাও শেষ হয়ে গেল। তার বাবা কোথা থেকে মাছ ধরা নৌকা কেনার টাকা পেয়েছিল তা আর বুঝতে বাকি থাকে না বিকাশের। এক বোবা ক্রোধে জ্বলতে থাকে সে। ঠিক করে, বোনকে সে বাড়ি নিয়ে যাবে। যেভাবেই হোক, বিয়ে দেবে বোনকে। ছাড়ানোর জন্য যত টাকা লাগে সে জোগাড় করবে, ব্যাপার না। 

পরদিন সকালে ডিলারের অফিসে যায় বিকাশ। কিছু টাকা এডভান্স চায় ডিলারদের কাছ থেকে। ডিলাররা অবাক হয়ে বিকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা বিকাশকে জানায়, শোরুমের মালিক তো মন্টু চাকলাদার আর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আলফাজ আলী, আপনি কে? সহজ সরল বিকাশ ডিলারদেরকে কোনভাবেই বোঝাতে পারে না যে সেও এই শোরুমের মালিকানার অংশীদার। মন্টুকেও ডেকে আনা হয় ডিলারের অফিসে। মন্টু বিকাশকে হাসিমুখে টানতে টানতে অফিসের বাইরে আনে। ধীরে সুস্থে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বলে, “দোস্ত, আমাকে মাফ কর। আলফাজ আলী এমন কইরা ধরল বুজছ। আর রাজনীতিক মানুষ মানে তো বোঝোই। আমারে বলল তারে অংশীদার করলে ডিলার পার্টি আরও ফাইভ পার্সেন্ট বেশি কমিশন দেবে। তুমি চিন্তা কইরো না। কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর। আমি তোমারে ব্যাংক থেকে লোনের ব্যবস্থা করে দেব। তুমি আমার পাশেই একটা শোরুম দিও। দুই দোস্ত মিলে একসাথে চুটায়ে ব্যবসা করব।” 

বিকাশ কিচ্ছু বলেনি। হাসিমুখে মেনে নিয়েছে মন্টুর কথা। কমিশনের টাকা তোলার দিন বিরিয়ানীর খাওয়ার আবদারও করেছে। মন্টু বিকাশকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, “বিরিয়ানী ক্যান? যা খাইতে চাস তাই খাওয়াব তোকে। পরশুদিন চইলে আসবি ডিলার অফিসে।” 

বিকাশ ততদিনে মানুষ চিনে গিয়েছে। সে পরশুদিন না, পরদিন ডিলার অফিসের সামনের একটা দোকানে অপেক্ষা করতে থাকে। মন্টুকে ডিলার অফিসে ঢুকতে দেখে ঘৃণা মিশ্রিত থু থু ফেলে সে। মন্টুকে একটা সাইড ব্যাগ হাতে বেরিয়ে আসতে দেখে বিকাশ। পিছু নেয় সে মন্টুর। বিকাশ অনুমান করল, এই ব্যাগ নিয়ে সে ব্যাংকে যাবে। মন্টুকে ব্যাংক পর্যন্ত যেতে দেওয়া যাবে না। 

মনোরমা পার্কের দক্ষিণ দিকের গেটের কাছে মন্টুর রিক্সা থামায় বিকাশ। মন্টু ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেয়। বিকাশ প্যান্টের পেছন থেকে সাইকেলের চেইন বের করে। ছুঁড়ে মারে মন্টুর পা বরাবর। মন্টু পড়ে যায়। এলোপাতাড়ি চাপাতির কোপে মুহূর্তেই মন্টুর শরীর হয়ে যায় এক নির্জীব জড় পদার্থ। টাকার ব্যাগটা নিয়ে সে চলে যায় রঙিলা মহলে। সর্দারনীকে প্রাপ্য টাকার চাইতেও দ্বিগুণ টাকা দিয়ে বোনকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। সোজা চলে যায় পর্তুগিজ কলোনির সেই বাড়িতে। উপযুক্ত পাত্র খোঁজা শুরু করে। 

আলফাজ আলী কোন প্রতিশোধ নেননি। মেধার মূল্যায়ন করেছিলেন। বিকাশকে নিজের ডান হাত বানিয়ে নিলেন। বিকাশও স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটেনি। আলফাজ আলী বিকাশকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়ে সেই পুরনো শোরুমে বসিয়ে দিলেন একজন অংশীদার হিসাবে। যেই চেয়ারে মন্টুর বসার কথা ছিল, সেখানে গিয়ে বসল বিকাশ। 

দুই বছরের ভেতরে বিকাশ হয়ে গেল আলফাজের ত্রাসযন্ত্র। জমি দখল, চর দখল এর মত সামান্য ব্যাপার থেকে পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ানো যে কোন লোককে বিকাশ সরিয়ে দিত অবলিয়ায়। বিকাশের যেমন ছিল দ্রুত সমস্যা সমাধানের অসাধারণ দক্ষতা, তেমনই ছিল তার নির্দয় হৃদয়। উপকুলে আলফাজের মাদক চোরাচালানের একমাত্র হাতিয়ার ছিল বিকাশ। বিকাশ আতঙ্কে কোস্টগার্ড পর্যন্ত পানিতে ভেসে আসা কোন লাশ স্পর্শ করত না। 

আলফাজ আলীর লোভে পড়েই মন্টু নিজের বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছিল। বিকাশ সেই বন্ধুত্ব ভোলেনি। সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে। আশফাক চৌধুরী তখন উদীয়মান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আলফাজ আলীর মত ধুরন্ধর লোকের কাছে নিতান্তই শিশু। তিনি একদিন বিকাশকে ডেকে পাঠালেন। আলফাজকে সরিয়ে দিতে পারলে বিকাশ যা চায় তাই পাবে। বিকাশ নিজের বৃদ্ধ মা আর বোনের জন্য শহরে একটা ফ্ল্যাট চেয়েছিল। আশফাক চৌধুরী দুই ঘণ্টার ভেতরে একটা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে ফেললেন। আর বিকাশ পরের দুই ঘণ্টার ভেতরে ব্যবস্থা করে ফেলল আলফাজ আলীর। বিকাশ পুলিশের হাতে ধরা পড়ল। 

আশফাক চৌধুরী এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন। যে কুকুর অন্যের কথায় নিজের প্রভুকে কামড়াতে পারবে সেই অন্যের কথায় তাকে কামড়াবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। ভুয়া ফ্ল্যাটের কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। 

পরদিন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ ছাপা হল, “উপকূলের ত্রাস বিকাশের মৃত্যুঃ এনকাউন্টার নাকি হত্যা?” 

বিকাশকে পাহাড়ি কারাগারে বাকি কুখ্যাত বারজনের সাথে জায়গা দেওয়া হয়। শর্ত একটাই, যতদিন সে রাজনীতিকে সাহায্য করবে, ততদিন রাজনীতি তাকে সাহায্য করবে। বিকাশ আর কলোনিতে ফিরতে পারল না। 

বিকাশের বোনটা শিমুল গাছে গলায় দড়ি দিয়েছিল। তারপরেই শিমুল গাছটা মারা গেল। হয়ে গেল চিরস্থায়ী কাকের আবাস। 

.

আশফাক চৌধুরী এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। জীবিত এবং অরক্ষিত। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *