পোয়ারো ইনভেস্টিগেটস
একরাশ প্রভাতী সংবাদপত্রের মধ্যে ডুবে আছে পোয়ারো। ড্রইংরুমের জানালা থেকে বাইরের দিকে অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। এখান থেকে নিচের রাস্তাটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায় বলে কাজকর্ম না থাকলে মাঝে মাঝে এসে এখানে দাঁড়াই।
সহসা নিজের অজান্তেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, আজ অতি সকালেই দেখছি একটা কাণ্ড ঘটবে। দেখো কী সাংঘাতিক ব্যাপার-–
পোয়ারোর দিকে একপলকে তাকালাম বলতে বলতে। কাগজের স্তূপ থেকে মুখ তুলে সে চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছে।
আমি বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ওকে বিবরণ শোনাতে লাগলাম—কী সাংঘাতিক ব্যাপার। মনে হয় কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরেরই, সুন্দরী এক মহিলা সামনের রাস্তা দিয়ে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে আসছেন আর তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির নাম্বার প্লেটগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছেন।
এদিকে ভদ্রমহিলাকে পেছনে অনুসরণ করে চলেছে তিনজন পুরুষ আর একজন মাঝবয়সি স্ত্রীলোক।
একটা বালকও ছুটে এসে এইমাত্র এই দলের সঙ্গে যোগ দিল। সে ভদ্রমহিলার দিকে আঙুল দেখিয়ে উত্তেজিতভাবে কী বলছে।
আশ্চর্য, ভদ্রমহিলার এসব দিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র নেই—মনে হচ্ছে মহিলা টের পাননি। দেখি, তোমার গোয়েন্দা-বুদ্ধির দৌড়।
অনুসরণকারী লোকগুলো ভদ্রমহিলাকে কী কোনো গুপ্ত অপরাধীদলের নেত্রী বলে চিনতে পেরে আক্রমণ করবার তাল করছে না, অন্য কিছু?
বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়ালাম পোয়ারোর মুখোমুখি।
—প্রিয় বন্ধু হেস্টিংস, গোয়েন্দারা কখনও পরের মুখে ঝাল খায় না—স্বচক্ষে দেখার পরেই তারা কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত করে।
বলতে বলতে পোয়ারো আমার পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরের দিকে একপলক তাকিয়েই মুখে চুকচুক শব্দ করে ফের নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল।
পোয়ারোর দু-চোখে কৌতুকের ঝিলিক। বলল, তোমার কল্পনার দৌড় দেখে আমি হাসতেও ভুলে গেছি বন্ধু। ভদ্রমহিলার পরিচয় বলছি শোনো, ইনি হচ্ছেন বিখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী শ্রীমতী মেরী মার্ভেল।
এই শিল্পীর বিশেষ অনুরাগীদেরই তুমি তাঁকে অনুসরণ করে আসতে দেখেছ। তিনি যে পেছনের দৃশ্য সম্বন্ধে পূর্ণ সচেতন এবিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই।
—তোমার ধারণাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম, কিন্তু এতে তোমার কোনো কৃতিত্ব নেই বন্ধু, ভদ্রমহিলাকে আগে থেকে চিনতে বলেই তুমি বলতে পারলে।
পোয়ারোর ঠোটে হাসির রেখা ফুটল। বলল, তাই বুঝি। আচ্ছা বলো তো, ভদ্রমহিলার ক-খানা ছবি তুমি আগে দেখেছ?
—তা, গোটা দশেক তো হবে।
—তবেই ভেবে দেখো, তুমি তাঁকে চিনতে পারলে না আর আমি মাত্র একখানা ছবি দেখেছি এবং এক পলকেই তাঁকে চিনতে আমার ভুল হয়নি।
এবারে আমাকে থমকে যেতে হল। বিরস গলায় বললাম, যাই বলো, পর্দায় দেখা ছবির সঙ্গে আসল চেহারার যথেষ্ট পার্থক্য—
এবারে পোয়ারো খেদোক্তি করল, বলিহারি তোমার বুদ্ধি। শ্রীমতী মার্ভেল নায়িকার বেশে লন্ডনের খোলা রাস্তায় ঘুরে বেড়োবেন, এটাই তুমি আশা করেছিলে নাকি? তবে, তোমার আর দোষ কী, তুমি তো আর এরকুল পোয়ারো নও—তবে এটা ঠিক যে শ্রীমতী মার্ভেল এই অধমের কাছেই আসছেন।
খোঁচাটা সহজে হজম করে বিস্মিত স্বরে বললাম, কী করে জানতে পারলে সে কথা?
—অতি সামান্য সহজবুদ্ধি প্রয়োগ করেই তা জানা সম্ভব, বন্ধু। খুবই সাধারণ পারা এটা—কোনো নামি ডাক্তার কিংবা নামডাকওয়ালা ধনী ব্যক্তি এখানে বাস করেন না। তবু বিশ্ববন্দিতা চিত্রতারকা শ্রীমতী মার্ভেলের যখন নগণ্য এই পাড়ায় পদার্পণ ঘটেছে তখন বুঝতে হবে পৃথিবীতে অতুলনীয় গোয়েন্দা প্রবরের কাছেই আসছেন। যশ, খ্যাতি বড়ো ভয়ানক বস্তু ভায়া—আজকাল কারো পিকনিক কুকুর কিংবা সোনার কলম হারিয়ে গেলেও লোকে এরকুল পোয়ারোর কাছে ছোটে। ব্যাপারটা যেন একটা ফ্যাশানে দাঁড়িয়ে গেছে।
ফিল্মজগতে শ্রীমতী মার্ভেলের চাহিদা যে সর্বাধিক তা আমার অজানা নয়। তাঁর স্বামী গ্রেগরী রলফও একজন চিত্রাভিনেতা।
গতবছর আমেরিকায় তাঁদের বিয়ে হয়েছে। সম্প্রতি এই শিল্পীদম্পতি ইংলন্ডে বেড়োতে এসেছেন বলে জানি।
এখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের সংবর্ধনাও জানানো হয়েছে। জনসাধারণ তো শ্রীমতী মার্ভেলের নামে একবারে পাগল।
প্রচার মাধ্যমের দৌলতে তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি আর বেশবাস, হাঁটাচলা, বিশেষ বিশেষ অলঙ্কারাদির বিষয়ও সকলের ঠোটের আগায়।
তাঁর একটা বড়ো নীলকান্ত হীরের বিষয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। এমন বড়ো হীরে নাকি পৃথিবীতে দুর্লভ।
হীরেটার নাম রাখা হয়েছে ওয়েস্টার্ন স্টার। আবার পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে সেটা নাকি বীমাও করা আছে।
এসব কথা যখন আমার মনে পড়ল, ততক্ষণে ভদ্রমহিলা নিচের ঘণ্টি বাজিয়ে পোয়ারোর ড্রইংরুমে এসে ঢুকেছেন।
কোনো বিশ্ববন্দিতা চিত্রতারকার মুখোমুখি হওয়া আমার জীবনে এই প্রথম। সত্যিই, এমন কমনীয় দেহবল্লরীর কোনো তুলনা হয় না। মুহূর্তে মনের মধ্যে যেন নেশা ধরিয়ে দেয় এই রূপ লাবণ্য।
পোয়ারোর নির্দেশমতো একটা চোয়ারে বসলেন শ্রীমতী মার্ভেল। যথারীতি প্রাথমিক আলাপ পরিচয়ের পালাও চুকল।
আমি অবাক বিস্ময়ে রূপসী মহিলাটির ডাগর নীল দুই চোখের দিকেই তাকিয়েছিলাম। মনে হল কোনো একটা গভীর বিষয়ে তাঁর ভেতরে তোলপাড় চলছে।
সেকেন্ড কয়েকের মধ্যে ইতস্তত ভাবটা কাটিয়ে উঠে মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠে ভদ্রমহিলা বলতে শুরু করলেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, গতকালই লর্ড ক্রনশর সঙ্গে আলাপ হল, আপনার কর্মদক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।
তাঁর ভাইপোর মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। তারপর থেকেই একটা বিষয়ে আপনার পরামর্শ নেবার কথা আমার মনে হল।
ব্যাপারটা খুবই সাধারণ অবশ্য, গ্রেগরীরও তাই ধারণা, তবে কী জানেন, আমি ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছি না—
বলতে বলতে তিনি তাঁর হাতব্যাগ খুলে তিনটে নীল রঙের খাম পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, এই চিঠিগুলো পাবার পর থেকে বড়ো বিভ্রান্ত বোধ করছি—ব্যাপারটা কোনো রসিকতা না। এর মধ্যে কোনো চক্রান্ত লুকিয়ে আছে বুঝে উঠতে পারছি না।
পোয়ারো খামগুলো উলটে-পালটে খুঁটিয়ে দেখল। বেশ দামি কাগজ, নাম-ঠিকানাও টাইপ করা। একটা খাম খুলে চিঠি বার করে চোখের সামনে তুলে ধরল পোয়ারো। পাশে থেকে আমিও টাইপকরা লেখাগুলো পরিষ্কার দেখতে পেলাম।
কোনো সম্বোধন নেই, শেষেও লেখকের পরিচয়জ্ঞাপক কিছু নেই। মাত্র দু-লাইনের কথা- বিধাতার বামচক্ষু নীলকান্ত হীরেটি তাঁর কাছেই প্রত্যার্পণ করা সঙ্গত।
দ্বিতীয় চিঠির বক্তব্য একই। তবে তৃতীয় চিঠির কথা নিঃসন্দেহে ভীতিপ্রদ।
আপনার প্রতি নির্দেশ আপনি অগ্রাহ্য করেছেন তাই ঈশ্বর তাঁর জিনিস নিজেই গ্রহণ করবেন। দুটো হীরেই আবার তার কাছে ফিরে যাবে আগামী পূর্ণিমার রাতে।
চিঠি পড়া শেষ হতেই শ্রীমতী মার্ভেল বললেন, প্রথম চিঠিটাকে কোনো রসিক লোকের ঠাট্টা বলেই মনে করেছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় চিঠিটা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। ইঙ্গিতবহ তৃতীয় চিঠিটা গতকাল সবে এসেছে, আমি বড়ো শঙ্কিত হয়ে পড়েছি মঁসিয়ে পোয়ারো।
চিঠিগুলো খামে ভরে টেবিলে রাখতে রাখতে পোয়ারো বলল, চিঠিগুলো নিশ্চয়ই হাতে পাঠানো হয়েছে, ডাকঘরের কোনো ছাপ নেই।
—একজন চীনেম্যান আমার ডাকবাক্সে চিঠিগুলো ফেলে দিয়ে যায়। সেই কারণেই বেশি ভয় পাচ্ছি। সানফ্রান্সিসকোর এক চীনে ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে বছর তিনেক আগে মূল্যবান হীরেটা কেনা হয়েছিল।
পোয়ারো ধীরে ধীরে ঘাড় নেড়ে বলল, চিঠিতে কি এটার কথাই উল্লেখ করেছে?
—হ্যাঁ। ওয়েস্টার্ন স্টার ওটারই নাম। হীরেটা সম্পর্কে প্রচলিত একটা গল্প গ্রেগরীর জানা ছিল। কিন্তু সেই চীনা ব্যাবসায়ী এ-সম্পর্কে কিছুই জানাননি।
নামমাত্র মূল্যে তিনি এটা এমনভাবে গ্রেগরীকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন যে দেখে মনে হয়েছিল, যেন তিনি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন।
বিয়ের রাতে গ্রেগরী আমাকে এটা উপহার দিয়েছিল।
পোয়ারো গম্ভীর মুখে বলল, ব্যাপারটা একটু যাচাই করে দেখা দরকার।
এরপর ইঙ্গিতে আমাকে বুক সেলফ্ থেকে এ-বছরের দিন পঞ্জিকাটা দিতে বলল। উঠে গিয়ে সেটা এনে তার হাতে দিলাম
পাতা উলটে পোয়ারো বলল, পূর্ণিমা হচ্ছে আগামী শুক্রবার–মাত্র তিনটে দিন হাতে। এরপর সরাসরি শ্রীমতী মার্ভেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ব্যাপারটা আকর্ষণীয় হলেও ইঙ্গিতপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ম্যাডাম, আপনি যখন আমার উপদেশ চাইছেন, তখন আমার রক্তব্য হল, সব দিক থেকে নিরাপদ থাকা।
আগামী শুক্রবার পর্যন্ত হীরেটা আমার হেফাজতে রেখে যাওয়াই নিরাপদ মনে করছি। পরে অবস্থা বুঝে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে।
শ্রীমতী মার্ভেলের চোখেমুখে ভাবান্তর নজরে পড়ল। দ্বিধা জড়ানো শুষ্ককণ্ঠে বললেন, তা হয়তো সম্ভবপর হবে না মঁসিয়ে-
দৃষ্টি স্থির রেখেই পোয়ারো বলল, হীরেটা আপনার সঙ্গেই আছে নিশ্চয়?
শঙ্কিত চোখ তুলে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকালেন শ্রীমতী মার্ভেল। পরে গাউনের ভেতরের পকেট থেকে মুঠো করে হীরেটা বার করে আনলেন।
মুহূর্তে তীব্র নীল দ্যুতিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা যেন তাঁর সুকোমল হাতের তালুতে এক টুকরো নীল আগুন ধরে আছেন –
পোয়ারো সযত্নে হীরেটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে বলল, সত্যিই মোহনীয়, একেবারে নিখুঁত। কিন্তু এমন দুর্লভ জিনিস আপনি সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়োচ্ছেন!
শ্রীমতী মার্ভেল বললেন, আপনাকে দেখাবার জন্যই আজ সঙ্গে এনেছি। সাধারণত এটা জুয়েলকেসেই অন্যান্য মণিমুক্তোর সঙ্গে থাকে।
—এনেছেন যখন, এটা আমার কাছে রেখে যাবার পরামর্শই আমি দেব।
একমুহূর্ত ইতস্তত করে শ্রীমতী মার্ভেল বললেন, মুশকিল হচ্ছে, আগামী শুক্রবার আমরা ইয়ার্ডলি প্রাসাদে যাচ্ছি। দু-চারদিন থাকতে হতে পারে, লর্ড এবং লেডি ইয়ার্ডলি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
লর্ড ইয়ার্ডলির প্রসঙ্গ উঠতে আমার একটা পুরানো প্রসঙ্গ মনে পড়ল। ব্যাপারটা গুজব কিনা বলতে পারব না। বছর কয়েক আগে লর্ড ইয়ার্ডলি সস্ত্রীক আমেরিকা ভ্রমণে গিয়েছিলেন। সেখানে দু-জনের মধ্যে ঘোরতর অশান্তি দেখা দেয়। লর্ড ইয়ার্ডলি তাঁর অন্যান্য মহিলা বন্ধুদের সঙ্গেই বেশিরভাগ সময় থাকতেন। ক্যালিফোর্নিয়ার এক চিত্রতারকা, যতদুর মনে পড়ছে তার নাম গ্রেগরী রলফ, শ্রীমতী ইয়ার্ডলির সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে নানারকম রসালো গল্পও ছড়িয়ে পড়েছিল।
পোয়ারো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শ্রীমতী মার্ভেলের দিকে তাকিয়েছিল। তিনি পূর্বকথার রেশ টেনে অন্তরঙ্গ সুরে বললেন, আপনাকে বলতে অবশ্য বাধা নেই। লর্ড ইয়ার্ডলির সঙ্গে আমাদের একটা ব্যাবসায়িক কথাবার্তা চলছে। ইয়ার্ডলি বংশের অতীত ইতিহাস নিয়ে একটা ছবি করার কথা আমরা ভাবছি
আমি উৎসাহের সঙ্গে বললাম, হ্যাঁ, ছবি করবার মতো অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা ইয়াৰ্ডলি বংশের সঙ্গে জড়িত। ব্যাপারটা ভালোই হবে।
শ্রীমতী মার্ভেল বললেন, অর্থনৈতিক দিকটা নিয়েই আমরা ভাবছি আপাতত। তবে কাজটা যদি মনমতো হয়, তাহলে লাভালাভের কথা আমরা বিশেষ ভাবব না। সেটা খতিয়ে দেখার জন্যই লর্ড পরিবারের আমন্ত্রণ আমাদের রক্ষা করা উচিত।
—কিন্তু হীরেটা কি সঙ্গে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি, অবশ্য বিষয়টা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত।
—হীরেটা সেখানে আমার পরে নিয়ে যাবার ইচ্ছে। শ্রীমতী মার্ভেলের ডাগর নীল চোখের দৃষ্টি আমার মুখে স্থির হল।
নারী চরিত্রের বিশেষ দুর্বলতার কথা চিন্তা করে আমি ফের বললাম, তা মন্দ নয়। শুনেছি লেডি ইয়ার্ডলির অনেক মণিমুক্তা আছে, একটা বিখ্যাত হীরার কথা তো অনেকেই জানে।
আমার কথায় শ্রীমতী মার্ভেল মিষ্টি করে হাসলেন কেবল।
পোয়ারো মাথা নিচু করে কী ভাবছিল। মাথা তুলে আচমকা প্রশ্ন করল, লর্ড বা লেডি ইয়ার্ডলির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় কত দিনের?
—গ্রেগরীর সঙ্গে লেডি ইয়ার্ডলির পরিচয় হয়েছিল, আমেরিকায়, বছর তিনেক আগে।
খানিক বিরতির পর শ্রীমতী মার্ভেল হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, সোসাইটি গসিপ পত্রিকাটা আপনারা পড়েন কিনা জানি না। দিন কতক আগে সেই পত্রিকায় পৃথিবীর মূল্যবান মণিমুক্তা সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে। তাতে ইয়ার্ডলি পরিবারের হীরের প্রসঙ্গও আছে।
সোসাইটি গসিপ পত্রিকার আমরা নিয়মিতো গ্রাহক। কিন্তু সময়াভাবে সব সংখ্যা দেখা হয়ে ওঠে না। লজ্জিতভাবে সেকথা আমরা স্বীকার করলাম।
শ্রীমতী মার্ভেলের কথা শুনে কৌতূহল বাড়ল। কাগজের স্তুপ থেকে নির্দিষ্ট সংখ্যাটি তুলে আনলাম। সাগ্রহে সেটি হাতে নিয়ে শ্রীমতী মার্ভেল নিবন্ধের খানিকটা অংশ আমাদের পড়ে শোনাতে লাগলেন—
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রত্নরাজির মধ্যে একটি হল ইস্টার্ন স্টার। সেটি আছে সুপ্রাচীন ইয়ার্ডলি পরিবারে। বর্তমান লর্ড ইয়ার্ডলির এক পূর্বপুরুষ বহুকাল পূর্বে এই অমূল্য হীরেটি চীন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
এই প্রাচীন হীরেটির সম্বন্ধে একটি কিংবদন্তি শোনা যায়। সে দেশের এক মন্দিরে দেবতার ডান চোখে বসানো ছিল হীরেটি। একই আকারের অপর একটি হীরে ছিল দেবতার বাম চোখে দুটি হীরেকেই দেবতার চক্ষু হিসাবে গণ্য করা হত।
কিংবদন্তি এই যে কালের নিয়মে এই দৈব রত্ন দুটি অপহৃত হবে, একটি পূর্ব দিকে যাবে অপরটি যাবে পশ্চিম দিকে।
তেমনই কালের গতিতেই রত্ন দুটি আবার পূর্বস্থানে এসে মিলিত হবে। দেবতা নিজেই নাকি রত্ন দুটি নিজের কাছে টেনে নেন।
সুখ্যাত চিত্রাভিনেত্রী শ্রীমতী মার্ভেলের কাছে একটি বহুমূল্য হীরে আছে, তার নাম ওয়েস্টার্ন স্টার। ইয়ার্ডলি পরিবারের হীরেটির সঙ্গে এই হীরেটির যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়।…
শ্রীমতী মার্ভেল পড়া শেষ করে পোয়ারোর দিকে তাকালেন। পোয়ারো উৎসাহের সুরে বলে উঠল, খুবই চিত্তাকর্ষক ব্যাপার সন্দেহ নেই
কিংবদন্তির যে কাহিনি জানা গেল তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে দেবতার ইচ্ছার কথাই চিঠিগুলোতে ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু ম্যাডাম, আপনি কী বুঝতে পারছেন না, হীরে দুটো পরস্পর পাশাপাশি এলে একটা অঘটন অবশ্যম্ভাবী?
জনশ্ৰুতি কি আপনি মোটেই আমল দিচ্ছেন না?
শ্রীমতী মার্ভেল বললেন, ইয়ার্ডলি পরিবারের হীরেটি ওয়েস্টার্ন সমতুল্য বলে আমি মনে করি না। অবশ্য এবারে তা চাক্ষুষ করা যাবে।
আমাদের কথার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠল। পরক্ষণেই দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন ধোপদুরস্ত পোশাকের এক সুদর্শন পুরুষ। রোমান্টিক নায়কের মতো চেহারা দেখেই বুঝতে দেরি হল না যে ইনিই গ্রেগরী রলফ।
আগন্তুক শ্রীমতী মার্ভেলের দিকে তাকিয়ে সহাস্যমুখে বললেন, দেখলে তো, ঠিক সময়েই চলে আসতে পেরেছি। মঁসিয়ে পোয়ারো নিশ্চয়ই আমার কথাই সমর্থন করেছেন, উড়ো চিঠিগুলো স্রেফ ভাঁওতা, তাই তো?
পোয়ারো মিঃ রলফের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। পরে স্বাভাবিক স্বরে বলল, ভাঁওতা হলেও তুচ্ছ করা হচ্ছে না। শ্রীমতী মার্ভেলকে আমি হীরেটা ইয়ার্ডলি প্রাসাদে না নিয়ে যাবার পরামর্শই দিয়েছি।
মিঃ রলফ বললেন, আমারও তাই মতো। বারবার বারণ করছি। কিন্তু আমার গিন্নি তা হতে দেবেন না কিছুতেই। নারী চরিত্র মশাই নারী চরিত্র, অঙ্গের অলংকার দেখিয়ে অন্যকে টেক্কা দিয়েই ওঁদের তৃপ্তি। ইনিও-
—আজেবাজে কথা কেন বলছ গ্রেগরী? ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করলেন শ্রীমতী মার্ভেল।
—তাহলে ম্যাডাম, বলতে বলতে পোয়ারো উঠে দাঁড়াল, আমি যা ভালো বিবেচনা করেছি আপনাকে জানিয়েছি, এর বেশি আর কিছু করবার নেই।
রলফ দম্পতি বিদায় নিলেন। আমরা এবারে পাশাপাশি চেয়ারে বসলাম। পোয়ারো নিজে থেকেই বলতে শুরু করল, চিরন্তন নারী চরিত্র, বুঝলে হেস্টিংস। স্বামীটি ভালোই বলতে হবে—স্ত্রী সম্পর্কে সর্বদাই সজাগ।
পোয়ারোর কথার সূত্র ধরেই লর্ড ইয়ার্ডলির প্রসঙ্গ উঠল। তাঁর আমেরিকা ভ্রমণ বৃত্তান্ত যতটা মনে ছিল পোয়ারোকে বললাম।
পোয়ারো উৎসাহিত হয়ে উঠল। বলল, তাহলে ঠিকই ভেবেছি দেখছি—একটা গূঢ় রহস্য রয়েছে গোটা ব্যাপারটার পেছনে। নাঃ-
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল।—তুমি কিছুক্ষণ বই-পত্তর কিছু নাড়াচাড়া করো, আমি একটু ঘুরে আসছি।
.
পোয়ারো বেরিয়ে যাবার মিনিট কয়েক পরেই বাড়ির কাজের লোকটি এসে জানাল এক ভদ্রমহিলা জরুরি প্রয়োজনে পোয়ারোর দর্শনপ্রার্থী।
পোয়ারো উপস্থিত নেই। মনে হল, তার হয়ে আমিই তো ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলতে পারি। শোনাই যাক না, উনি কী বলতে চান। ভদ্রমহিলাকে পাঠিয়ে দিতে বললাম।
ভদ্রমহিলা যখন ঘরে ঢুকলেন, একপলক তাকিয়েই চিনতে পারলাম। লেডি ইয়ার্ডলির ছবি এর আগে অনেকবারই পত্র-পত্রিকায় দেখেছি। পরিচিত মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে সানন্দে অভ্যর্থনা জানালাম।
—আসুন, আসুন। পোয়ারো তো এইমাত্র বাইরে গেল, তবে এখুনি ফিরে আসবে।
ভদ্রমহিলা ধন্যবাদ জানিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। শান্ত সৌন্দর্যের আনন্দময় রূপ। বেশ সংযত, তুলনায় শ্রীমতী মার্ভেল ছিলেন অনেকটাই উচ্ছ্বাসপ্রবণ।
বন্ধুবর পোয়ারোর অনুপস্থিতিতে আচমকা মনে হল, তার ভূমিকাটা আমার নিতে বাধা কোথায়। তার তুলনায় বিশ্লেষণী ক্ষমতো আমার কিছুমাত্র কম নয়। তার সদ্ব্যবহার করার সুযোগ পোয়ারোর উপস্থিতিতে পাই না। আজ ওকে তাক লাগিয়ে দেব।
ভদ্রমহিলা মুখোমুখিই বসেছিলেন। তাঁর দিকে চোখ তুলে বললাম, লেডি ইয়ার্ডলি, আমি জানি আপনি কেন এসেছেন-
জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন। আমি ফের বললাম, হীরেটার সম্বন্ধে কয়েকটা উড়ো চিঠি আপনি পেয়েছেন—
বিস্ময় শঙ্কা ভয় একসঙ্গে ছায়া ফেলল ভদ্রমহিলার চোখেমুখে। অস্ফুটে বললেন—আপনি কী করে জানলেন?
মৃদু হেসে গম্ভীর স্বরে বললাম, শ্রীমতী মার্ভেলও এরকম ভয় দেখানো চিঠি পেয়েছেন -আপনাদের দু-জনের সঙ্গেই তো দুটো দৈব হীরা রয়েছে—
—শ্রীমতী মার্ভেলও এখানে এসেছিলেন নাকি?
—এই তো কিছুক্ষণ আগেই বিদায় নিলেন। উড়ো চিঠি পেয়ে তিনি খুবই ভয় পেয়ে গেছেন—ওয়েস্টার্ন স্টারের জুড়ি হীরে ইস্টার্ন স্টার তো আপনার কাছেই, উড়ো চিঠি আপনারও পাবার কথা, বলুন ঠিক বলছি কিনা—
লেডি ইয়ার্ডলি কয়েক মুহূর্ত কী ভাবলেন। তারপর সহজ গলায় বললেন, হ্যাঁ, আপনার কথাই ঠিক।
—একজন চীনেম্যান চিঠিগুলো ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে যায়?
—না, আমার সব চিঠি ডাকেই এসেছে। শ্রীমতী মার্ভেলের ব্যাপারটা খুলে বলুন না- আমি সকালের সমস্ত ঘটনা খুলে জানালাম। মনোযোগ দিয়ে নীরবে শুনলেন তিনি। পরে বললেন, আমি যে চিঠিগুলো পেয়েছি তার ভাষাও প্রায় একই রকম।
তবে সব চিঠিই ডাকে এসেছে। কিন্তু সবই যে আমার কাছে ধাঁধাঁ লাগছে—কিছুই তো বুঝে উঠতে পারছি না।
গম্ভীরভাবে হেসে বললাম, হ্যাঁ, এই অজানা ব্যাপারটাই আমাদের জানতে হবে। আচ্ছা, চিঠিগুলো নিশ্চয়ই সঙ্গে এনেছেন? ডাকঘরের ছাপ থেকেও অনেক সময় রহস্যের আঁচ করা যায়।
লেডি ইয়ার্ডলি দুঃখের সঙ্গে জানালেন, চিঠিগুলোকে তামাশা মনে করে তিনি সব পুড়িয়ে দিয়েছেন।
—আচ্ছা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, এর পেছনে কি সত্যিই কোনো গুপ্ত চীনে দলের হাত আছে বলে আপনি মনে করেন?
গোটা ব্যাপারটা নিয়ে আরও কিছুক্ষণ আমাদের দু-জনের আলোচনা হল। কিন্তু রহস্য সমাধানের কোনো সূত্র উদ্ধার করা গেল না
বিদায় নেবার সময় লেডি ইয়ার্ডলি অনুরোধ জানিয়ে গেলেন, তাঁর সমস্যার কথাটা যেন পোয়ারোকে আমি খুলে জানাই।
.
আমি একরকম উদ্গ্রীব হয়েই ছিলাম। পোয়ারো ফিরে আসতেই সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে তাকে জানালাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, খুশি হতে পারেনি। আমার কর্মদক্ষতা যে ওর অহমিকায় আঘাত করেছে তা আন্দাজ করতে পারলাম। আত্মঅহমিকায় বড্ড ভোগে পোয়ারো। তবু সে আমার প্রিয় বন্ধু, আমার গর্ব।
আমার আর লেডি ইয়ার্ডলির কথোপকথন সম্বন্ধে বারবার নানা প্রশ্ন করল পোয়ারো। উপস্থিত না থাকার ক্ষোভটা যেন এভাবেই পুষিয়ে নিতে চাইছে।
পোয়ারোর হাবভাব আমার পরিচিত। চিন্তাকুটিল হয়ে উঠেছে তার চোখ-মুখ। একসময় গুরুগম্ভীর গলায় বলল, খেলাটা ভালোই জমে উঠেছে যা হোক।
বলতে বলতে নিজেই উঠে গিয়ে সেলফ্ থেকে লর্ড পরিবারের রেকর্ডবুকটা বার করে আনল। পাতা উলটে বলল—এই দেখো হেস্টিংস…পাওয়া গেছে…লর্ড ইয়ার্ডলি…হ্যাঁ দশম ভাইকাউণ্ট,… দক্ষিণ আফ্রিকার যুদ্ধে ছিলেন… এই তো… বিবাহ মার্চ, ১৯০৭… ব্যারন কটোরিলের চতুর্থ কন্যা… দুই কন্যা সন্তান… না যা খুঁজছিলাম পাওয়া গেল না।
তারপর বইটা বন্ধ করে বলল, দেখা যাক কাল তো ভদ্রলোক আসছেনই। চমকে উঠলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, ভদ্রলোক আসছেন মানে—
—ভদ্রলোককে একটা তার করে দিয়ে এসেছি, আগামীকাল সকালে আমার সঙ্গে দেখা করবার অনুরোধ জানিয়ে।
—তাহলে দেখছি ব্যাপারটা নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাতে শুরু করেছ… কিন্তু তোমার অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল এর মধ্যে ঢুকবার ইচ্ছে নেই তোমার
—মাথা ঘামাচ্ছি, তবে কারোর হয়ে নয় ব্রাদার—নেহাতই নিজের কৌতূহল মেটাবার জন্য। রহস্যসন্ধানী এরকুল পোয়ারো এই রহস্যের শেষ দেখতে চায়
—ব্যাপারটা কি ঠিক হল? কেবল তোমার কৌতূহল চরিতার্থ করবার জন্য লর্ড ইয়ার্ডলিকে এখানে টেনে আনছ! এতে উনি খুব প্রীত হবেন বলে তো মনে হয় না।
পোয়ারোর চোখে-মুখে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়ল। বলল, আমার কৌতূহল মেটাতে গিয়ে তো ওঁর পারিবারিক হীরেটা চোরের হাত থেকে রক্ষা পেয়েও যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমার এই অযাচিত সাহায্যের জন্য তিনি বরং কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করবেন।
—ইয়ার্ডলি পরিবারের হীরেটা চুরি যাবার সম্ভাবনা আছে বলে তুমি মনে করছ?
—চুরি যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সমস্ত ঘটনা সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
এরপর আর কোনো কথা বার করতে পারা গেল না পোয়ারোর মুখ থেকে। ভাবসাব দেখেই বুঝলাম এখন একটু একা থাকতে চায়। মাথায় চিন্তার জট পাকিয়েছে।
পরদিন সকালবেলাই লর্ড ইয়ার্ডলিকে আমরা অভ্যর্থনা জানালাম। রীতিমতো লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যবান পুরুষ। চেহারা ভারিক্কে হলেও বেশ খোলামেলা মেজাজের মানুষ। গল্প করতে ভালোবাসেন।
সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বললেন, অদ্ভুত একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার স্ত্রী কয়েকটি ভয় দেখানো উড়ো চিঠি পেয়েছেন শুনলাম।
শ্রীমতী মার্ভেলের কাছেও নাকি একই ধরনের চিঠি পাঠানো হয়েছে। পেছনের রহস্যটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।
সোসাইটি গসিপ পত্রিকার সংখ্যাটা হাতের কাছেই ছিল। পোয়ারো সেটা লর্ড ইয়ার্ডলির দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, কাহিনিটা পড়ুন, সত্যমিথ্যা আপনি হয়তো কিছুটা বলতে পারবেন।
ভদ্রলোক মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল মুখে। কাগজটা পোয়ারোর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, আজগুবি গালগল্প ছাড়া কিছু নয়। ইস্টার্ন স্টারের সঙ্গে এই ধরনের কোনো কাহিনির যোগ নেই।
এই মূল্যবান হীরেটা আমাদের পূর্বপুরুষ ভারতবর্ষ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। চীনের ব্যাপারটা আমি এই প্রথম শুনলাম। পুরুষানুক্রমেই ওটা আমাদের পরিবারে রয়েছে এবং ওই নামেই আমাদের কাছে পরিচিত
পোয়ারো যেন তার সিদ্ধান্তেরই সমর্থন পেল ইয়ার্ডলির বক্তব্যে। সেভাবেই বলে উঠল, এ-ব্যাপারে ভাবনা চিন্তা যা করবার আমিই করতে চাইছি অবশ্য যদি আমার ওপর আপনার পরিপূর্ণ আস্থা রাখা সম্ভব হয়। আশা করছি কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে আমি তা ঠেকাতে পারব। লর্ড ইয়ার্ডলির চোখে-মুখে শঙ্কার ছায়া পড়ল। বললেন, তাহলে ওই উড়ো চিঠিগুলোর পেছনে কোনো চক্রান্ত কাজ করছে বলেই আপনি মনে করছেন?
—আমার পরামর্শমতো কাজ করতে আপনি রাজি আছেন কিনা, এখন বলুন।
–হ্যাঁ… হ্যাঁ… নিশ্চয়ই, তবে—
—তাহলে আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন।
শুনলাম আপনাদের ইয়ার্ডলি প্রাসাদকে নিয়ে আপনার মিঃ রলফের সঙ্গে একটা ছবি তৈরির কথা চলছে, সেটা কি স্থির হয়ে গেছে?
সোফায় নড়ে চড়ে বসলেন লর্ড ইয়ার্ডলি। বললেন, মিঃ রলফ নিশ্চয়ই আপনাকে এসব কথা বলেছেন…. পাকাপাকি কথা কিছু হয়নি এখনও
কয়েক মুহূর্ত থেমে লর্ড ইয়ার্ডলি যেন নিজেকে প্রস্তুত করে নিলেন। তারপর থমথমে বিষণ্ণ সুরে বললেন, মনে হচ্ছে, আপনাকে সব কথা খুলে জানানো ভালো। মঁসিয়ে পোয়ারো, সবটাই আমার দুর্ভাগ্যের কথা।
কিছুদিন থেকে খুবই আর্থিক সঙ্কট চলছে, দেনার দায় আকণ্ঠ—পরিত্রাণ পাবার মতো কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না। বাধ্য হয়েই… গ্রেগরী রলফ অবশ্য আমাকে অনেক টাকার আশ্বাস দিচ্ছে।
কিন্তু আমাদের এই ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাসাদে সিনেমার লোকজন ঘুরে বেড়াবে একথা ভাবতেও আমার কষ্ট হচ্ছে। সেজন্যই অবশ্য আর একটা উপায় মাথায় এসেছে—
—হীরেটা বিক্রি করবেন বলে ভাবছেন?
লর্ড ইয়ার্ডলি পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। বললেন, ঠিকই ধরেছেন। অবশ্য হীরেটা আমাদের পরিবারের শোভা হয়েই আছে। তবু বিক্রি করার কথা ভাবলে বুকের ভেতরে যন্ত্রণা হয়।
অমন দামি হীরে বিক্রি করার ঝক্কিও কম নয়—উপযুক্ত মূল্য দেবার ক্ষমতো খুব কম লোকেরই আছে।
অবশ্য একজন দালাল নিযুক্ত করেছি। দু-চারদিনের মধ্যে এটার কোনো ব্যবস্থা করতে না পারলে শেষ পর্যন্ত মিঃ রলফের প্রস্তাবেই বাধ্য হয়ে রাজী হতে হবে। এ ছাড়া উঠে দাঁড়াবার মতো আর কোনো অবলম্বন নেই।
—লেডি ইয়ার্ডলির মতোামতোও কি তাই?
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, আমার স্ত্রী তো হীরেটা বিক্রির কথাই শুনতে পারেন না। মিঃ রলফের প্রস্তাবকেই তিনি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।
—ধন্যবাদ লর্ড ইয়ার্ডলি, আমার আর কোনো কথা জানবার নেই।
বলতে বলতে চিন্তিতভাবে পোয়ারো চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। নিশ্চুপ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। মুহূর্তের জন্য চিন্তার গভীরে ডুব দিয়েছে তার মন। এই ভঙ্গি আমার বিশেষ পরিচিত।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল পোয়ারো। বলল, লর্ড ইয়ার্ডলি, এবার আপনি আপনার প্রাসাদে ফিরে যান। একটা অনুরোধ, আমাদের এই সাক্ষাৎকারের কথা ভুলেও কারো আছে প্রকাশ করবেন না। আর একটা কথা—আজ বিকেলে আমরা আপনার প্রাসাদে যাব-
—অবশ্যই অবশ্যই—এ তো আমার আশাতীত সৌভাগ্য। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো-
—আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, ইয়ার্ডলি বংশের গৌরব ইস্টার্ন স্টার অপহৃত হোক, নিশ্চয়ই এটা কাম্য হতে পারে না। আমার উপদেশ, আমার কথামতো চলুন।
.
বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ আমরা লন্ডন থেকে ইয়ার্ডলি প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছলাম। প্রাসাদ-ভৃত্য আমাদের হলঘরের সামনে নিয়ে এলো।
ঘরের ভেতরে লর্ড এবং লেডি ইয়ার্ডলি বসে আছেন। তাঁদের সুন্দর দুটি শিশুপুত্র নিজেদের মধ্যে খেলা করছে।
আমাদের দোরগোড়ায় দেখেই লেডি ইয়ার্ডলি চমকে উঠলেন। লর্ড ইয়ার্ডলির মুখেও অস্বস্তির ছায়া। তিনি পোয়ারোর চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন যদি কোনো নির্দেশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
পোয়ারো তৎপরতার সঙ্গে বলে উঠল, মাপ করবেন, আমি শ্রীমতী মেরী মার্ভেলের পক্ষ হয়ে একটা তদন্তের বিষয়ে এসেছি।
আগামী শুক্রবার তাঁর তো এখানে আসবার কথা, তার আগে আমি জায়গাটা একবার দেখে নিতে এলাম।
কোনো বিপদ-আপদ যাতে না ঘটে তার জন্যই এই সাবধানতা অবলম্বন করতে হচ্ছে— মক্কেলের হয়ে এই কাজটা আমাদেরই করতে হয়। তাছাড়া লেডি ইয়ার্ডলির কাছ থেকেও আমার একটা বিষয় জানবার আছে।
শুনলাম তিনিও নাকি কয়েকটা ভয় দেখানো উড়ো চিঠি পেয়েছেন। চিঠিগুলোর গায়ে ডাকঘরের ছাপ সম্বন্ধে কিছু হদিশ দরকার।
লেডি ইয়ার্ডলি বিমর্ষভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমি খুবই লজ্জিত মঁসিয়ে পোয়ারো, এ-বিষয়ে আগে সতর্ক হতে পারিনি। বিষয়টাকে যে এরকম গুরুত্ব দিতে হবে আগে ভাবতে পারিনি। কাজটা যে বোকার মতো হয়ে গেছে এখন বুঝতে পারছি।
লর্ড ইয়ার্ডলি আপ্যায়নের সুরে বললেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, আজ রাতটা দয়া করে আমাদের এখানেই কাটিয়ে যান।
—সে সব আবার কেন, অযথা ঝামেলা বাড়ানো বৈ তো নয়। স্টেশনেই একটা সরাইখানায় আমাদের সঙ্গের জিনিসপত্র রেখে এসেছি।
—ছিঃ, ঝামেলা বলছেন কেন, আপনারা অতিথি হবেন এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য। আপনি ভাববেন না, এখুনি লোক পাঠিয়ে সরাইখানা থেকে সব আনিয়ে নিচ্ছি।
পোয়ারো একটা সোফায় আসন নিল। আমিও গা এলিয়ে দিলাম তার পাশে। ইতিমধ্যে পর্দা সরিয়ে একটি পরিচারিকা ঘরে ঢুকল এবং লেডি ইয়ার্ডলির দুই শিশুপুত্রকে নিয়ে চলে গেল। পোয়ারো শিশু দুটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল।
এ-কথা সে-কথা গালগল্পে দিব্যি আধঘণ্টা কেটে গেল। একসময় এক ভৃত্য একটি টেলিগ্রাম এনে লর্ড ইয়ার্ডলির সামনে রাখল। টেলিগ্রামটা পড়তে পড়তে তাঁর মুখ মুহূর্তের জন্য বিবর্ণ হয়ে গেল, পরে একটা কাঠিন্য ছায়া ফেলল।
টেলিগ্রামটা তিনি স্ত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পোয়ারোকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বিষয়টা আপনাকেও জানিয়ে রাখা ভালো মনে হচ্ছে। হীরেটা বিক্রি করবার জন্য একজন দালাল নিযুক্ত করেছিলাম, সে একজন খদ্দেরের সন্ধান জানিয়েছে।
এক আমেরিকান ভদ্রলোক, হীরেটাকে যাচাই করবার জন্য আজই সন্ধ্যায় আমাদের এখানে একজন জহুরী পাঠাচ্ছে। খদ্দের ভদ্রলোক আগামীকালই দেশের দিকে রওনা হবেন।
বলতে বলতে কেমন অন্যমনস্কভাবে দীর্ঘশ্বাস মোচন করলেন। পরে সখেদে বললেন, শেষ পর্যন্ত পারিবারিক হীরেটা হাতছাড়া করা ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না।
টেলিগ্রামটা হাতে ধরেই ছিলেন লেডি ইয়ার্ডলি, অন্যমনস্কভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। ধীরে ধীরে স্বামীর দিকে মুখ ফেরালেন। বিষণ্ণ বিনীত স্বরে বললেন, ওটা বিক্রি না করলেও তো তুমি পারো, জর্জ। ইস্টার্ন স্টার প্রাচীন ইয়ার্ডলি পরিবারের গৌরব
লর্ড ইয়ার্ডলি স্ত্রীর কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না। কয়েক মুহূর্ত তিনি উদ্গ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর দিকে, হয়তো কোনো প্রত্যুত্তর আশা করছিলেন লেডি। পরে হতাশ হয়ে বললেন, তোমরা বোসো, ডিনারের পোশাকটা পরে আসি। ভদ্রলোককে যখন হীরেটা দেখাতেই হবে, ভাবছি আজ নেকলেসটা পরব। শেষ সাধটুকু আমারও মিটবে। বলে লেডি ইয়ার্ডলি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে আমাদের ঘর প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। আমি আর পোয়ারো পোশাক বদল করে ফের এসে বসলাম। খানিকবাদে ড্রইং রুমে ডিনারের ঘণ্টা বাজল। কিন্তু তখনও লেডি ইয়ার্ডলি এসে পৌঁছননি।
আমরা তিনজন এটা সেটা নিয়ে গল্প জুড়লাম। মিনিট কয়েক এভাবে কাটল।
হঠাৎ পর্দা সরিয়ে লেডি ইয়ার্ডলি ঘরে প্রবেশ করলেন। তাঁর পরনে শ্বেতশুভ্র ডিনার গাউন। সর্বাঙ্গ ঘিরে একটা উজ্জ্বল দীপ্তি। চলনে ধীর মন্থর মরাল-গতি। শুভ্র কোমল গ্রীবা ঘিরে একটা আগুনের শিখা যেন জ্বলছে। একপলক তাকিয়েই বুঝলাম, ওটাই এই বংশের ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রাচীন নেকলেস।
লেডি ইয়ার্ডলি তাঁর বুকের মাঝখানে এমনভাবে হাত দিয়ে রেখেছেন যে নেকলেসের একটা অংশ আমাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে রয়েছে।
এগিয়ে আসতে আসতে ভদ্রমহিলা মিষ্টি কোমল স্বরে বললেন, সাবেকি ধাঁচের নেকলেসটা বড়ো বেশি জবরজং, মঁসিয়ে পোয়ারো বা ক্যাপ্টেন হেস্টিংস কারোই হয়তো পছন্দ হবে না। মনে হয় এটাই ইংলন্ডের কুশ্রীতম নেকলেস। একমিনিট-
বলতে বলতে থমকে থেমে দরজার দিকে পা বাড়ালেন। কৃত্রিম কুণ্ঠার স্বরে বললেন, দাঁড়ান, বড়ো আলোটা জ্বালিয়ে দিই,—
বিদ্যুতের আলোর সুইচটা দরজার বাইরের দেওয়ালে। এগিয়ে গিয়ে লেডি ইয়ার্ডলি পর্দা সরিয়ে সুইচের দিকে হাত বাড়ালেন।
সেই মুহূর্তেই অকস্মাৎ প্রাসাদের সমস্ত আলো দপ করে নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ড্রইংরুমের কাঠের দরজাটাও শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। পর মুহূর্তেই দরজার বাইরে থেকে নারীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ ভেসে এলো।
এমন ঘটনার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সকলেরই চূড়ান্ত বিপর্যস্ত অবস্থা।
অন্ধকারের মধ্যেই লর্ড ইয়ার্ডলির ব্যাকুল কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম।
—গড গড! এ যে আমার স্ত্রীর গলা, কী ঘটল ওখানে?
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে আমরা সকলে ঘর ছেড়ে বাইরের বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। আকাশে জ্যোৎস্নার আলো ছিল।
তারই একঝলক পাশের দালানের গায়ে এসে পড়েছে। সেই আলোতে যে দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ল তার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।
শ্বেতপাথরের বারান্দার মেঝের ওপর লেডি ইয়ার্ডলির নিঃসাড় দেহে পড়ে আছে।
দৌড়ে কাছে গিয়ে দেখি গলার একপাশে লাল রক্তের দাগ, খানিক আগের চোখ ঝলসে দেওয়া নেকলেসটা যথাস্থান থেকে অদৃশ্য।
ভয়ে আশঙ্কায় হাত-পা হিম হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। ভদ্রমহিলা বেঁচে আছেন কিনা বুঝতে পারছিলাম না।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, আমাদের শঙ্কার নিরসন ঘটালেন তিনি নিজেই।
যন্ত্রণাকাতর অস্ফুট স্বরে লেডি ইয়ার্ডলি বলে উঠলেন, নিয়ে গেল—সেই চীনেম্যানই— ওই ছোটো দরজা দিয়ে পালিয়েছে-
ক্রুদ্ধ শব্দ করে লর্ড ইয়ার্ডলি সঙ্গে সঙ্গে ছুটলেন বারান্দার প্রান্তের দিকে। আমিও ছুটলাম তাঁর পেছনে।
বারান্দার শেষে বিশ-পঁচিশ গজ দূরে ছোট্ট খিড়কির দরজা। বুঝতে পারলাম, এটার কথাই বলেছেন লেডি ইয়ার্ডলি।
দরজার কাছে পৌঁছেই ম্লান চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বলে জড়োয়া নেকলেসটা একপাশে নজরে পড়ল। আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলাম—এই তো… পাওয়া গেছে।
শেষ পর্যন্ত নিশ্চয় সামলাতে পারেনি চোর। আমাদের হই-হট্টগোলে ভয় পেয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পালিয়েছে।
লাফিয়ে পড়ে নেকলেসটা হাতে তুলে নিলাম। কিন্তু ভালো করে তাকিয়েই থমকে যেতে হল। সর্বনাশ।
মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁক। ইস্টার্ন স্টার নিশ্চয় ওখানেই ছিল। চোর তার কাজ হাসিল করেছে যথারীতি।
লর্ড ইয়ার্ডলি পাশে দাঁড়িয়ে হতাশাসূচক শব্দ করলেন। তাঁর মুখে কোনো কথা সরল না।
বললাম, কেবল এই হীরেটার জন্যেই এসেছিল চোর। বেশ বোঝা যাচ্ছে, কোনো সাধারণ চোরের কাজ নয় এটা। কোনো গুপ্ত দলেরই চক্রান্ত রয়েছে পেছনে।
—কিন্তু প্রাসাদের ভেতর ওরা ঢুকল কী করে?
—ওই তো, খিড়কির দরজা পথে—
—অসম্ভব, সব সময় চাবি দেওয়া থাকে এই দরজায়।
সন্দেহ আমারও খানিকটা ছিল। এগিয়ে গিয়ে দরজা ধরে টানলাম, সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল। আর দরজার গা থেকে কি একটা নিচে পড়ল মনে হল।
দু-পা সরে গিয়ে হাতে তুলে দেখি জিনিসটা এক টুকরো সিল্কের কাপড়। চিনতে অসুবিধে হল না। চীনেরা এই ধরনের কাপড়েরই পোশাক ব্যবহার করে।
চোর যে কোনো চীনেম্যানই তাতে আর সন্দেহ রইল না। পালাবার সময় দরজার গায়ে লেগে ছিঁড়ে আটকে ছিল।
ব্যর্থ চেষ্টা জেনেও এরপর তন্ন তন্ন করে চোরের সন্ধান করা হল। কিন্তু কোনো হদিশ পাওয়া গেল না। হতাশ হয়ে দু-জনে ফিরে এলাম।
লর্ড ইয়ার্ডলি আর কালক্ষেপ না করে একজন ভৃত্যকে ডেকে তখুনি পুলিশে খবর দিতে পাঠালেন।
পোয়ারো লেডি ইয়ার্ডলির কাছেই ছিল। তার যত্নে তিনি অনেকটা সুস্থতা ফিরে পেয়েছেন। তিনি একটা চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে আছেন। আমরাও তাঁর পাশের আসনে বসলাম।
কয়েক মিনিট পরে ভদ্রমহিলা নিজেই ক্লান্ত স্বরে অনতিপূর্বের দুর্ঘটনার বিবরণ শোনালেন।
লেডি ইয়ার্ডলি বললেন, বড়ো আলোটা জ্বালাবার জন্য সুইচের দিকে হাত বাড়িয়েছিলাম।
সঙ্গে সঙ্গে একটা লোক যেন শূন্য থেকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চিৎকার করবার অবসরও পেলাম না—নেকলেসটা খামচে ধরে এমন হ্যাঁচকা টান দিল যে সামলাতে না পেরে ছিটকে পড়ে গেলাম।
পড়তে পড়তে অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ল একটা কালো ছায়া দরজাটার দিকে ছুটছে। তার গায়ে একটা ওড়না মতো ছিল। মাথায় চীনেম্যানদের মতো লম্বা বেণী। তারপর আর মনে নেই কিছু।
লেডি ইয়ার্ডলি তাঁর বিবরণ শেষ করে ক্লান্তিতে ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন।
এমন সময় একজন ভৃত্য এসে জানাল, লর্ড ইয়ার্ডলির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন এক ভদ্রলোক। তিনি নাকি আগেই টেলিগ্রাম করে তাঁর আসবার কথা জানিয়েছেন।
বিব্রত বিষণ্ণ লর্ড ইয়ার্ডলি অসহায় দৃষ্টি তুলে তাকালেন। কোনোক্রমে কাঁপাকাঁপা স্বরে ভৃত্যকে বললেন, ভদ্রলোককে লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও। আমি যাচ্ছি একটু পরেই।
এই অবসরে পোয়ারোকে খানিকটা আড়ালে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বললাম, আর কী হবে এখানে থেকে, চলো লন্ডনে ফিরে যাই।
পোয়ারো জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তুলে আমার চোখের দিকে তাকাল। বললাম, তুমি তো সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে লর্ড ইয়ার্ডলিকে নিশ্চিন্ত থাকবার আশ্বাস দিয়েছিলে জোর গলায়। এখন তোমার নাকের ডগাতেই চোর অক্লেশে হীরেটা নিয়ে চম্পট দিল। এরপর থাকা মানে লর্ড ইয়ার্ডলির ব্যঙ্গ বিদ্রূপ সহ্য করা। সময় থাকতে থাকতে এখান থেকে সরে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
বুদ্ধিমান পোয়ারো আমার কথা সমর্থন করল। নীরবে মাথা নেড়ে বলল, যথার্থ বলেছ। এখানে ছিঁচকে চোরটাই আমাকে টেক্কা মেরে গেল। চলে যেতেই বলছ… কিন্তু…
স্বাভাবিকভাবেই যথেষ্ট বিব্রতও দেখাল পোয়ারোকে। ওর কথার মাঝখানেই গম্ভীর স্বরে বলে উঠলাম, আর কিন্তু না। রাজপ্রাসাদের অভিজাত ডিনারের লোভ আর করো না। এই অবস্থায় লর্ড ইয়ার্ডলির কাছে বিদায় চাইতে যাওয়াটাও শোভন হবে না।
তাঁকে আর না ঘাঁটিয়ে মানে মানে কেটে পড়াই শ্রেয়। পরে কোনো একটা অজুহাত জানিয়ে দিলেই হবে।
পোয়ারো মাথা ঈষৎ নত করে বড়ো বড়ো চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি কণ্ঠে মৃদু শ্লেষের স্বর মিশিয়ে বললাম, তোমার দূরদৃষ্টি কি ভোঁতা হয়ে গেল। লন্ডনেও এই মুহূর্তে আমাদের জরুরি কাজ রয়েছে, সেটা বুঝতে পারছ না?
পোয়ারো ঠান্ডা স্বরে বলল, কী কাজ বলো তো?
চাপা স্বরে বললাম, শ্রীমতী মার্ভেলের হীরেটার কথা ভুলে গেলে চলবে কেন? অনতিবিলম্বে তাঁকে এই রোমহর্ষক ঘটনাটার কথা জানিয়ে সতর্ক করে দেওয়া দরকার-
—অঃ হ্যাঁ, তাই তো-
আত্মঅহমিকায় ডগমগ পোয়ারোর যে সাময়িকভাবে বুদ্ধিবৈকল্য ঘটেছে তা বুঝতে পেরে মুখে মৃদু চুকচুক শব্দ করে বললাম, জোড়া হীরের একটা গুপ্ত দলের হাতে গিয়ে পড়েছে, অপরটাও তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংগ্রহ করবার চেষ্টা করবে।
এতক্ষণে যেন পোয়ারো নিজের মধ্যে ফিরে এলো। সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করল। পরে বলল, এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা আমার মাথায় এলো হেস্টিংস। তোমার দূরদৃষ্টির কোনো তুলনা হয় না!
যথার্থ বলেছ, শ্রীমতী মার্ভেলকে যথা শীঘ্র সজাগ করে দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তবে পূর্ণিমার তো এখনও দু-দিন দেরি আছে।
বলল বটে, আমার উপদেশ কিন্তু অবহেলা করল না। যথার্থ বুদ্ধিমানের মতোই লর্ড ইয়ার্ডলির নামে একটা চিঠি লিখে রেখে বলল, সুটকেসপত্র গুছিয়ে নাও।
.
লন্ডনে পৌঁছে পোয়ারোকে নিয়ে আতান্তরেই পড়তে হল। কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল। শ্রীমতী মার্ভেলকে সমস্ত ব্যাপারটা জানাবার জন্য খুবই অস্থির বোধ করছি যখন ও কেমন গা ছেড়ে দিল। বলল, অত হুটোপাটার দরকার কী। কাল একসময় জানালেই হবে’খন।
এরপরে আর তাকে তাগিদ দেই কী করে? বাধ্য হয়েই চুপ করে থাকতে হল।
সকালে উঠে পোয়ারোর হাবভাব দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আগের দিনের কথাটা যেন বেমালুম ভুলে গেছে। শ্রীমতী মার্ভেল সম্বন্ধে একটা কথাও নিজে থেকে উত্থাপন করল না।
বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকেই শ্রীমতী মার্ভেলের বিপদের আশঙ্কার কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতে হল।
পোয়ারো অলসভাবে হাত নেড়ে বলল, অযথা আর হয়রান হবার দরকার কী, আজ কাগজেই তো সব ঘটনা বেরিয়ে গেছে। নতুন করে কিছু জানাতে যাবার কোনো অর্থ হয় না, ওরা নিজেরাই সাবধান হয়ে যাবেন।
পোয়ারোর কথাটা অযৌক্তিক নয়। তাই আমিও তখনকার মতো চেপে গেলাম।
বেলা দুটো নাগাদ টেবিলের ওপরে টেলিফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো রিসিভার তুলে নিল।
বড়ো জোর মিনিট দুই কথাবার্তা বলল। ওর উত্তেজিত গলার স্বর আমার কানে এলো। কথা শেষ করে রিসিভার রেখে আমার কাছে এসে দাঁড়াল পোয়ারো। চাপা উত্তেজনার সঙ্গে বলল, শেষ পর্যন্ত তোমার আশঙ্কাই সত্যি হল হেস্টিংস।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলাম। বুঝতে পারলাম মার্ভেল পরিবারের কোনো দুর্ঘটনার ইঙ্গিত করছে বন্ধুবর।
মুখে কিছু না বলে সকৌতুকে ওর মুখের দিকে তাকালাম!
—শ্রীমতী মার্ভেলের ওয়েস্টার্ন স্টারও দুর্বৃত্তদের হস্তগত হয়েছে।
—কখন চুরি হল।
—আজ সকালেই।
—তবেই দেখো, তুমি পূর্ণিমার দোহাই তুলে থিতিয়ে পড়েছিলে। ঘটনাটা যে পূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা করবে না, তা আমার দূরদৃষ্টি আমাকে বলে দিয়েছিল। তুমি যদি আমার কথাটা আমল দিতে, তাহলে হয়তো… আমি সঠিক পথেই চিন্তা করেছিলাম।
পোয়ারো মৃদুস্বরে বলল, তবে কী জান ব্রাদার। বাইরে থেকে দেখে তোমার আশঙ্কাটাকে যথার্থ মনে হচ্ছে বটে, তবে মনে রেখো, ওটুকুই সব নয়। যাক গে, চল, বেরোনো যাক।
তক্ষুনি আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। একটা ট্যাক্সি ধরে মিঃ রলফের হোটেলের দিকে রওনা হলাম।
পোয়ারো চুপচাপ বসে আছে সিটে হেলান দিয়ে। শূন্যদৃষ্টি বাইরের রাস্তায় প্রসারিত। ওই ভঙ্গি আমার অপরিচিত নয়—গভীর চিন্তায় নিমগ্ন। তবে ঠোঁটের রেখায় যেন কোমল একটা রহস্যময় হাসির ছোঁয়া।
গুপ্ত দলটার নিখুঁত চক্রান্তের ব্যাপারটা ঘুরছিল আমার মাথায়। পূর্ণিমার রাতের ধারণাটা দিয়ে কী চমৎকারভাবে সকলকে ধোঁকা দিল। তারা জানত আমাদের সকলের মনোযোগ আকৃষ্ট থাকবে ওই দিনটার প্রতি—সেই সুযোগে তারা নির্বিবাদে কাজটা হাসিল করে নিতে পারবে, করলও তাই।
ধ্যান ভঙ্গ করে প্রথম কথা বলল পোয়ারো। আমার মনের কথাটা বোধহয় আঁচ করতে পেরেছিল। ক্লান্ত স্বরে বলল, কিছু করার ছিল না। একটা মানুষের পক্ষে তো আর সব দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়।
ওর ক্লান্ত স্বর আমার মনে সহানুভূতির উদ্রেক করল। ব্যর্থতাকে পোয়ারো কখনওই সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। তাকে উৎসাহ দিয়ে বললাম, অত ভাবছ কেন এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এমন দু-একটা ঘটনা ঘটতেই পারে।
হোটেল ম্যাগনিফিসিয়েন্টের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামলাম আমরা। হোটেলে ঢুকে প্রথমে ম্যানেজারের ঘরে গেলাম।
মিঃ রলফ সেখানেই ছিলেন। তিনি কথা বলছিলেন স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দু-জন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে। তাঁদের সামনে শুকনো মুখে বসে আছে একজন হোটেল-ক্লার্ক।
ঘরে ঢুকতেই বিমর্ষ মুখে মিঃ রলফ আমাদের দিকে তাকালেন। চাপা উত্তেজনার স্বরে বলে উঠলেন, একেবারে অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটে গেল মঁসিয়ে পোয়ারো। সবার চোখের ওপর থেকে হীরেটা নিয়ে চলে গেল।
খানিক পরে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানা গেল। বাস্তবিকই অভাবিত সেই ঘটনা।
আজ সকাল এগারোটা নাগাদ মিঃ রলফ ব্যক্তিগত কাজে হোটেল ছেড়ে বেরিয়েছিলেন। তাঁর বেরিয়ে যাবার ঠিক আধঘণ্টা পরেই হুবহু মিঃ রলফের মতোই দেখতে এক ভদ্রলোক হোটেল-ক্লার্কের কাছে আসেন।
তিনি নিজেকে মিঃ রলফ বলেই পরিচয় দেন এবং কর্মরত ক্লার্ককে হোটেলের ভল্টে রাখা তাঁর জুয়েল কেসটি বার করে দিতে বলেন।
ক্লার্ক ভদ্রলোকের কিছুমাত্র সন্দেহ হয়নি। তিনি হোটেলের নিয়ম অনুযায়ী রিসিপ্ট ভাউচার এগিয়ে দেন ভদ্রলোকের দিকে সই করবার জন্য।
ভদ্রলোক সই করতে করতে বলেন যে গাড়ির দরজায় সামান্য চোট লেগেছে আঙুলে। তার জন্য হয়তো সইটা কিছু অন্যরকম মনে হতে পারে।
হোটেল ক্লার্কের অবশ্য তেমন কোনো ফারাক নজরে পড়েনি। তিনি সৌজন্য দেখিয়ে সবিনয়ে সে-কথা জানাতেও ভোলেন না।
ভদ্রলোক তখন কৌতুক-তরল কণ্ঠে বললেন, কিছুদিন থেকে এক চীনা গুপ্ত দলের ভয় দেখানো উড়ো চিঠি পাচ্ছি। সেটাই হল শঙ্কার ব্যাপার, আমার চোখেও খানিকটা প্রাচ্য-ঢং রয়েছে কিনা। কারোর মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়া বিচিত্র নয়।
পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে হোটেল ক্লার্ক বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ভদ্রলোকের কথা শুনে তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, কথাটা ঠিক, তাঁর চোখে চীনেম্যানদের চোখের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে ভালো করে না তাকালে বোঝার উপায় নেই।
এই সময় মিঃ রলফ উত্তেজিত স্বরে প্রায় গর্জন করে উঠলেন, মূর্খ। তাকিয়ে দেখুন তো, এখনও কি আমার চোখ সেরকম মনে হচ্ছে?
হোটেল ক্লার্ক মিঃ রলফের চোখের দিকে তাকিয়ে বিনীত বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, না স্যার, কিন্তু …
পুলিশ অফিসার দু-জন পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। একজন বললেন, ঝানু মাথার কাজ।
চোখের বৈসাদৃশ্য পাছে ক্লার্কের মনে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে সেজন্য গোড়াতেই উপযাচক হয়ে প্রসঙ্গটার অবতারণা করেছে।
বোঝা যাচ্ছে, হোটেলের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিল তারা। সুযোগ পাওয়া মাত্রই নিশ্চিন্তে তার সদ্ব্যবহার করেছে।
আমি প্রশ্ন করলাম, জুয়েল কেসটা কি পাওয়া গেছে?
—হ্যাঁ, সেটা হোটেলের লনেই ফেলে রেখে গেছে। নেকলেসটা যেমনকার তেমনই রয়েছে, কেবল মাঝখান থেকে ওয়েস্টার্ন স্টার উধাও হয়েছে।
পুলিশ অফিসারের কথা শুনে আমি আর পোয়ারো দৃষ্টি বিনিময় করলাম। চোরের এমন দুঃসাহস কল্পনা করাও কষ্টকর।
পোয়ারো আর কথা বাড়াল না। সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিঃ রলফকে বলল, এখানে আমার আর প্রয়োজন হবে না, বুঝতে পারছি। যাবার আগে একবার শ্রীমতী মার্ভেলের সঙ্গে দেখা করে যেতে চাই।
মিঃ রলফ কুণ্ঠিত স্বরে বললেন, প্রিয় হীরেটার শোকে তিনি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলেন। এখনও পর্যন্ত পুরোপুরি ধাতস্থ হয়ে ওঠেননি। এই অবস্থায় তাঁকে বিব্রত করা বোধহয় ঠিক হবে না মঁসিয়ে।
পোয়ারো দৃঢ়স্বরে বলল, তাহলে মিঃ রলফ, দয়া করে এক মিনিট আসুন, ওই ওপাশটা নিরিবিলি আছে, আপনার সঙ্গেই দরকারি কথাটা ওখানে বসেই সেরে নিতে চাই।
—অবশ্যই… অবশ্যই… আসুন।
.
পোয়ারো ফিরে এলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। তাকে দেখে বিস্মিত হলাম, চোখে-মুখে খুশির ভাব স্পষ্ট। বলল, চলো হেস্টিংস, এখানকার কাজ মিটেছে।
পথে নেমে ফের বলল, একটা টেলিগ্রাম করতে হবে।
জিজ্ঞেস করলাম, কাকে?
—লর্ড ইয়ার্ডলিকে। পা টেনে চলো ব্রাদার।
একরকম আমাকে তাড়িয়ে নিয়েই চলতে লাগল যেন। চলতে চলতে ফের বলল, অঘটনটা আটকানো যেত, যদি সময়মতো তোমার পরামর্শ মেনে চলতাম। কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। তুমি দেখছি খুবই মুষড়ে পড়েছ ভায়া। চলো চলো–লাঞ্চটা কোথাও সেরে নিতে হবে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে আমাদের বেলা সাড়ে চারটা হল। ঘরে ঢুকে দেখি, লর্ড ইয়ার্ডলি আমাদের প্রতীক্ষাতেই বসে আছেন।
ভদ্রলোককে দেখে চিনবার উপায় নেই। এই এক দিনেই চোখ-মুখ বসে গিয়ে বড়ো করুণ হয়ে গেছে তাঁর চেহারা।
আমরা ঘরে ঢুকতে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আপনার টেলিগ্রাম পেয়ে এক মুহূর্ত আর সময় নষ্ট করিনি।
আপনাকে দেবার মতো একটা খবর আছে মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনাদের সামনেই সেদিন বিকেলে যে টেলিগ্রামটা এসেছিল, সেটা একেবারেই ভুয়ো।
দালালকে ফোন করতেই ব্যাপারটা জানা গেল। তারা বলল, এখনও পর্যন্ত কোনো খদ্দেরের সঙ্গেই তাদের যোগাযোগ হয়নি।… কী রকম সব ধাঁধাঁর মতো লাগছে—
সোফায় বসতে বসতে পোয়ারো বিনীত কণ্ঠে বলল, মাপ করবেন লর্ড ইয়ার্ডলি, টেলিগ্রামটা আমিই পাঠিয়েছিলাম। আর আমার নিযুক্ত লোকই গতকাল আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
লর্ড ইয়ার্ডলির চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসার মতো হল। স্তম্ভিতভাবে বললেন, আপনি…কিন্তু…
—হ্যাঁ, আমিই। পরিকল্পনাটা অভিনব সন্দেহ নেই, কিন্তু তার অবতারণা করতে হয়েছিল অঘটনটা সম্পূর্ণভাবে ঘটাবার জন্য।
লর্ড ইয়ার্ডলি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বিহ্বলভাবে বললেন, হায় ভগবান…এসব আপনি কী বলছেন…
নিস্পৃহ কণ্ঠে পোয়ারো বলল, আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়েছে। আর সেইজন্যই এটা… বলতে বলতে উঠে দাঁড়িয়ে পোয়ারো কোটের পকেট থেকে একটা উজ্জ্বল নীলাভ হীরা বার করে লর্ড ইয়ার্ডলির দিকে বাড়িয়ে দিল।
—দেখুন চিনতে পারছেন কিনা। আমার পদ্ধতি সার্থক হয়েছে বলেই এটা আজ আপনাকে ফিরিয়ে দিতে পারার গর্ব অনুভব করতে পারছি।
—ইস্টার্ন স্টার!!
প্রবল বিস্ময়ে হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করলেন লর্ড ইয়ার্ডলি। হীরাটা হাতে নিয়ে কোনো মতে উচ্চারণ করলেন, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো।
রহস্যময় স্বরে পোয়ারো বলল, খুবই স্বাভাবিক। তবে এতে কিছু আসে যায় না। কেবল বিশ্বাস করুন যে ফিরে পাবার জন্যই এটা ওভাবে চুরি যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। বুঝতে পারছি, সবই আপনার কাছে গোলমেলে ঠেকছে।
এ-বিষয়ে সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়ে আপনাকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেছিলাম, আমি আমার কথা রাখতে পেরেছি।
এখন একটা অনুরোধ আপনাকে করব, ইস্টার্ন স্টার রহস্য বিষয়ে অনুগ্রহ করে আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না। লেডি ইয়ার্ডলিকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাবেন। বলবেন, এটা তাঁকে ফেরত দিতে পারার জন্য আমি আনন্দিত এবং গর্বিত।
হতচকিত ভাব নিয়েই লর্ড ইয়ার্ডলি উঠে দাঁড়ালেন এবং হাসিমুখে বিদায় নিলেন।
অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছিলাম এতক্ষণ। পোয়ারোর অবিশ্বাস্য কার্যকলাপ মাথার ভেতরে আমার তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছিল।
এবারে একরকম চিৎকার করে উঠলাম, তুমি কি আমাকে পাগল করে দেবে ঠিক করেছ, পোয়ারো? এসব কী?
শান্ত ধীর কণ্ঠে পোয়ারো বলল, আমি কী করতে পারি তোমার দেখার দৃষ্টি যদি স্বচ্ছ না হয়-
—কিন্তু হীরেটা তুমি পেলে কী করে?
—কেন, মিঃ রলফের কাছ থেকে—
—রলফ-
আমাকে যেন কেউ আকাশ থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিল।
—হ্যাঁ ব্রাদার, রলফ। খুলেই এবার তোমাকে বলছি শোনো, ভয় দেখানো উড়ো চিঠি, চীনেম্যানের যোগসাজস, তাছাড়া সোসাইটি গসিপ ম্যাগাজিনে মণিরত্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা—সবই মিঃ রলফের কীর্তি।
দুটো যমজ হীরের কাহিনিটি নিছকই তার কপোলকল্পিত, বাস্তবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। হীরে একটিই এবং সেটি ইয়ার্ডলি পরিবারেই ছিল। বছর তিনেক আগে ঘটনাচক্রে সেটা মিঃ রলফের হস্তগত হয়।
আজ সকালে এই ধুরন্ধর মানুষটি নিজেই নিজের হীরেটি চুরি করেন। এজন্য কেবল তাকে হোটেল-ক্লার্কের সামনে সামান্য অভিনয় করতে হয়েছে।
—এ-ও তো একটা ঘোলাটে ব্যাপার-
—হ্যাঁ, তাঁর এই অদ্ভুত কাণ্ডটার পেছনে গূঢ় কারণ বর্তমান। তবে সবচেয়ে বড়ো কারণ হল, লেডি ইয়র্ডালি খুবই অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন—
—লেডি ইয়ার্ডলি!!
—হ্যাঁ। তুমি তো সে কাহিনি জানো, স্বামীর সঙ্গে আমেরিকা ভ্রমণে ভদ্রমহিলাকে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেকদিন একা থাকতে হয়েছিল।
লর্ড ইয়ার্ডলি সেই সময় তাঁর অন্য বান্ধবীদের নিয়ে খুবই মেতে উঠেছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই নিয়ে চরম ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল।
ঠিক এমনি সময়েই মিঃ রলফের সঙ্গে লেডি ইয়ার্ডলির পরিচয় হয়। পরিচয় ক্রমশ ঘনিষ্ঠতর হয়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভদ্রলোকের সুপুরুষ চেহারাটি বাইরে থেকে আকর্ষণীয় সন্দেহ নেই, কিন্তু অন্তরে ততটাই কুটিল।
একসময় লর্ড ও লেডি ইয়ার্ডলির মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি মিটে গিয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আর তখনই মিঃ রলফের ভেতরের চেহারা আত্মপ্রকাশ করে। তিনি সুযোগ বুঝে লর্ড ইয়ার্ডলিকে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেন।
–এতসব কথা তুমি জানলে কীভাবে?
—গতকাল। তুমি আর লর্ড ইয়ার্ডলি যখন অদৃশ্য চোরের সন্ধানে ব্যস্ত হয়েছিলে সেই সময় কৌশলে লেডি ইয়ার্ডলির কাছ থেকে সব কথা বার করে নিয়েছি।
মিঃ রলফের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একটা সাধারণ হৃদয়াবেগ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তিনি আমাকে শপথ করে বলেন অবৈধ কোনো সম্পর্ক দু-জনের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি। তাঁর এই কথা আমি অবিশ্বাস করি না।
মুশিকল ঘটিয়েছিল কয়েকটি চিঠি। লেডি ইয়ার্ডলি লিখেছিলেন মিঃ রলফকে। তার মধ্যে এমন কিছু চিঠি ছিল যা লর্ড ইয়ার্ডলির হাতে পড়লে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাও অসম্ভব ছিল না। ফলে দুই শিশুপুত্রের সঙ্গেও বিচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠত।
লেডি ইয়ার্ডলি খুবই অসহায় অবস্থায় পড়ে গিয়েছিলেন। মিঃ রলফের মুখ বন্ধ করবার মতো যথেষ্ট অর্থ তাঁর হাতে ছিল না। সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন মিঃ রলফ, ইস্টার্ন স্টারটা তিনি কবজায় নিয়ে নিয়েছিলেন।
তার বদলে লেডি ইয়ার্ডলিকে দিয়েছিলেন একটা নকল পাথর। গোটা ব্যাপারটা নিরুপায় হয়েই মেনে নিতে হয়েছিল তাঁকে।
এবারে ওয়েস্টার্ন স্টারের কথাটা মনে কর। হীরেটার সন্ধান জানা যায় মাত্র তিন বছর আগে, অর্থাৎ যখন থেকে দু-জনের সম্পর্কের ছাড়াছাড়ি।
বুক ভেঙ্গে গেলেও মহামূল্যবান হীরেটার শোক সংবরণ করতে হয়েছিল লেডি ইয়ার্ডলিকে। সব নারীই চায় সর্বস্ব দিয়ে কলঙ্কের হাত থেকে রক্ষা পেতে। নারী জীবনে কলঙ্কের কালিমা চিরজীবন থেকে যায়।
হীরেটা হাতছাড়া করে কলঙ্কের সম্ভাবনাকে মুছে ফেলতে পেরেছিলেন লেডি ইয়ার্ডলি। জীবনের এক দুর্বল মুহূর্তের সামান্য ভুলের জন্য কম মূল্য দিতে হয়নি তাঁকে।
কিন্তু বিপদ ঘনিয়ে এলো অন্য দিক থেকে। ইতিমধ্যে লর্ড ইয়ার্ডলির আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠল। তিনি দেনার দায় মেটাবার জন্য হীরেটা বিক্রি করে দিতে চাইলেন। এমনটা যে ঘটতে পারে লেডি ইয়ার্ডলি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
তাঁর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বিক্রির প্রশ্ন দেখা দিলে নকল হীরের কথা ফাঁস হয়ে পড়বে।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেলেন লেডি ইয়ার্ডলি। তিনি ঘটনা জানিয়ে রলফকে গোপনে টেলিগ্রাম করলেন। ভাগ্যক্রমে সেই সময়েই মিঃ রলফ ইংলন্ডে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি নিজেও এবারে প্রমাদ গুণলেন। তাঁর ব্ল্যাকমেলের ঘটনাটা জানাজানি হয়ে গেলে বেসামাল অবস্থায় পড়ে যেতে হবে।
ধরা পড়ে গেলে যে লেডি ইয়ার্ডলি সব কিছু ফাঁস করে দেবেন অনুমান করতে তার কষ্ট হল না। তিনি লেডি ইয়ার্ডলিকে আশ্বস্ত করে বেশ জুতসই একটা মতোলব ভেজে ফেললেন যাতে হীরেটাও খোয়াতে না হয়, আবার তার কুকীর্তিও চিরতরে চাপা পড়ে যাবে।
দুটো হীরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে চুরি গেলে লোকের মনে সন্দেহ উদ্রেক করবে না—ঘটনার মধ্যে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।
এ-ব্যাপারে পথ প্রশস্ত করতেও বিলম্ব করলেন না। তিনি ফ্যামিলি গসিপ পত্রিকায় পৃথিবীর বিখ্যাত মণিরত্ন নিয়ে একটা জুতসই প্রবন্ধ ফেঁদে বসলেন।
মিঃ রলফের নিজের হীরেটি পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডে ইন্সিওর করা ছিল। কাজেই এই পরিকল্পনায় তার হারাবার কিছুই ছিল না। এক ঢিলে দুই পাখি মারবার এ এক চমৎকার মতোলব।
গোটা ব্যাপারটা আঁচ করে আমি নিজেও পাশাপাশি একটা প্যাঁচ কষে ফেলেছিলাম। তার করে লর্ড ইয়ার্ডলিকে একজন হীরে বিশারদের আগমনের কথা জানিয়ে দেওয়া হল।
খবরটা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই মুশকিল আসানের জন্য যে লেডি ইয়ার্ডলি একটা নকল চুরির অভিনয়ের আশ্রয় নিতে পারেন, সেই সম্ভাবনাও আমার হিসেবে ছিল।
প্রত্যাশিত ঘটনাই তিনি ঘটালেন। যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করে হীরে চুরির ব্যাপারটা সকলের বিশ্বাসযোগ্য করে তুললেন।
কিন্তু সকলের চোখে ধুলো দেওয়া সহজ হলেও এরকুল পোয়ারোকে বোকা বানানো সহজ নয়। সত্যটা তার চোখে সহজেই ধরা পড়ে
—তাহলে কী—
—হ্যাঁ ব্রাদার, গোটা প্রাসাদের আলো নেভানো, হলঘরের দরজা বন্ধ করা, নেকলেসটা গলা থেকে ছিঁড়ে নিয়ে খিড়কির দরজার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সবই তাঁর চতুর অভিনয়। খিড়কির দরজা খুলে রেখে তার গায়ে সিল্কের টুকরো আটকে রাখার কাজটাও তিনিই আগেভাগে সুযোগমতো করে রেখেছিলেন।
—কিন্তু হীরেটা তো নেকলেসের মধ্যেই ছিল।
—নকল হীরে। সেটা তিনি আগেই খুলে রেখেছিলেন। লক্ষ্য করে থাকবে, তিনি যখন ডিনার গাউন পরে ঘরে ঢোকেন তখন নেকলেসের যে অংশে ইস্টার্ন স্টার থাকার কথা সে অংশ হাত দিয়ে আড়াল করে রেখেছিলেন। এদিককার ঘটনার এখানেই ইতি।
খবরের কাগজে এই ডাকাতির সংবাদ পড়বার পর মিঃ রলফ পূর্ব পরিকল্পনা মতো তাঁর নিজের খেলা শুরু করলেন। তাঁর অভিনয়ের মধ্যে কোনো খুঁত ছিল না।
পোয়ারোর বিবরণ যত শুনছিলাম ততই অভিভূত হচ্ছিলাম। কৌতূহল বাগ মানছিল না। আমি নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে বলে উঠলাম, মিঃ রলফের কাছ থেকে নিশ্চয় স্বীকারোক্তি আদায় করেছ তুমি?
—নিশ্চয়ই। জরুরি কথা বলার ছল করে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সরাসরি বললাম, লেডি ইয়ার্ডলি সমস্ত ঘটনা তাঁর স্বামীকে বলে দিয়েছেন। হীরেটা উদ্ধার করার দায়িত্ব তিনি আমাকেই দিয়েছেন। আপসে যদি আপনি সেটা ফেরত না দেন তাহলে বাধ্য হয়েই আমাকে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে।
এমনই আরও কিছু কথা বলে ভদ্রলোককে রীতিমতো ঘাবড়ে দিলাম। বেগতিক বুঝতে পেরে তিনি আর বেগরবাই করার চেষ্টা করেননি। ধীরে ধীরে সবকিছুই স্বীকার করেন।
সমগ্র ঘটনার প্রতিটি পর্যায় এমন আকস্মিক ও অভাবনীয় যে, তার জের কাটিয়ে উঠতে কয়েক মিনিট সময় লাগল আমার।
এর সব কিছুই ছিল আমার চিন্তারও অগোচর। নিজের বৃদ্ধির এ হেন অস্বচ্ছতার জন্য মনে মনে পীড়িত না হয়ে পারছিলাম না।
তবু কোনোক্রমে বললাম, এই ভদ্রলোকই তাহলে সমস্ত উড়ো চিঠি পাঠিয়েছিলেন লেডি ইয়ার্ডলিকে?
পোয়ারো তাঁর গোঁফের ফাঁক দিয়ে মৃদু হাসল। গায়ে জ্বালা ধরানো সেই হাসি। বলল, এক বান্ধবীর কাছে আমার নাম শুনেছিলেন লেডি ইয়ার্ডলি। তারপরই তিনি পরামর্শের জন্য এসেছিলেন, কিন্তু সেই সময় আমি বাইরে বেরিয়েছিলাম। তোমার মুখ থেকে শ্রীমতী মার্ভেলের নাম শুনেই সজাগ হয়ে যান তিনি।
শ্রীমতী মার্ভেলকে তিনি শত্রুপক্ষ বলেই গণ্য করতেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই আসল ব্যাপার চেপে গেলেন।
তুমি আগ বাড়িয়ে নানা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে লেডি ইয়ার্ডলিকে মিথ্যা বলার সুযোগ করে দিয়েছিলে। সেই সুযোগ তিনি চতুরভাবে কাজে লাগালেন। উড়ো চিঠির ভাঁওতা দিয়ে চলে গেলেন। তুমি কিছুই সন্দেহ করতে পারলে না।
সেদিন ফিরে এসে সব শোনার পর বারবার খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে তোমার কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম, শ্রীমতী মার্ভেলের উড়ো চিঠি পাবার খবরটা তুমিই লেডি ইয়ার্ডলিকে দিয়েছিলে। তার আগে পর্যন্ত এ-বিষয়ে তিনি কিছুই জানতেন না।
আমার অবস্থা আর কহতব্য রইল না। হতবুদ্ধি অবস্থায় চিৎকার করে বললাম, এ হতেই পারে না, তুমি ঠিক কথা বলছ না।
পোয়ারো শান্ত কণ্ঠে বলল, ব্যাপারটা খুবই দুঃখের যে তুমি কখনও মানুষের মনস্তত্ত্ব তলিয়ে দেখবার চেষ্টা করো না।
চিঠিগুলোর কথা জানতে চাইলে ভদ্রমহিলা তোমাকে বললেন যে সেগুলো তিনি পুড়িয়ে ফেলেছেন।
তুমি গোয়েন্দা মানুষ, কিন্তু নির্দ্বিধায় তাঁর কথা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিলে। ব্রাদার, নারীপ্রকৃতি মূল্যায়নে এখানেই মস্ত ভুল তুমি করেছিলে। মনে রেখো কোনো মহিলাই নিজের চিঠি পারতপক্ষে নষ্ট করতে চান না। এজন্য তাঁরা বিপদের ঝুঁকি নিতেও পেছ পা হন না। এটাই মেয়েদের চিরন্তন স্বভাব।
পোয়ারোর কথা উড়িয়ে দেওয়া গেল না। কিন্তু আমার মাথায় তখন রক্ত চড়ে গেছে।
জেনেশুনেও আমাকে আগাগোড়া অন্ধকারে রেখে বোকা বানানোটা ওর ইচ্ছাকৃত। পাছে তার নিজের বাহাদুরি কমে যায় তাই গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত সূত্র নিজের মুঠোয় রেখে দিয়েছে।
ক্ষোভে অপমানে চিৎকার করে বললাম, আমাকে এরকম করে বোকা বানানো আর কিছু নয়, এ তোমার ঈর্ষা-
পোয়ারো হাসি মুখেই আমার অভিযোগটা গ্রহণ করল। বলল, কী করব, দেখলাম নিজের গোয়েন্দাগিরিতে তুমি একেবারে ডগমগ, তোমার আনন্দে বাধা দিতে বড়ো মায়া হল আমার।
—ওসব বাজে কথা। এর আগেও তুমি অনেকবার আমাকে এভাবে হেনস্থা করেছ। এবারে সমস্ত কিছু জেনেশুনে যেভাবে আমাকে ভুল পথে চিন্তা করতে মদত জুগিয়েছে, তাতে লেডি ইয়ার্ডলির কাছে একটা নির্বোধ প্রতিপন্ন হতে হল আমাকে। তুমি একেবারে মাত্রা ছাড়িয়ে গেছ পোয়ারো-
আমার কাঁধে মৃদু চাপড় দিয়ে পোয়ারো বলল, আমার ওপর অনর্থক রাগ করছ বন্ধু, পুরোনো কথা ভুলে যাবার চেষ্টা করো-