1 of 2

পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক

পোড়ো মন্দিরের আতঙ্ক

কলকাতা থেকে আমার কলেজের তিনজন সহপাঠী বন্ধু এসেছিল আমাদের গাঁয়ে বেড়াতে। তাঁদের নিয়েই আমি সেদিন বিকেলে গিয়েছিলাম গাঁ ছাড়িয়ে মাইলদেড়েক দূরে ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে। ওখানকার ময়ূরাক্ষীর দুই তীরের শোভা বড়োই নয়নমুগ্ধকর। ভেবেছিলাম, সন্ধ্যার কোল অবধি নদীর ধারে বসে গল্পগুজব করে তারপর বাড়ি ফিরব। অন্ধকারে মাঠের মধ্যে আসতে পথে সাপ-খোপের সম্মুখীন হতে পারে, এই ভয়ে বাবার পাঁচ সেলের টর্চটা সঙ্গে এনেছিলাম।

গরমকাল। সাড়ে ছ-টাতেও তখন অনেক বেলা। প্রায় সাড়ে ছ-টাই হবে তখন। আমরা চারজনে কবিগুরুর একটা গান নিয়ে আলোচনা করছি। আলোচনায় আমরা এতই মশগুল ছিলাম যে, পশ্চিমদিক থেকে কালো মেঘ উঠে কখন যে প্রায় অর্ধেকটা আকাশ ঢেকে ফেলেছে খেয়ালই হয়নি। হঠাৎ ঝড় উঠতে খেয়াল হল। আমরা ধড়মড় করে উঠে পড়ে এরকম ছুটতে-ছুটতেই বাড়ির পথে হাঁটা দিলাম। আমি জানি এই দেড়মাইল পথের মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি নেই— অর্থাৎ বৃষ্টির হাত থেকে শরীর বাঁচাবার মতো কোনো আশ্রয় নেই।

বরাত মন্দ। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই দৈত্যের মতো কালো মেঘটা সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল এবং মুষলধারে বৃষ্টি নামল। সেইসঙ্গে ঝড়ের সে কী বেগ!

প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম আমরা চারজনে। ছুটতে-ছুটতেই আমার খেয়াল হয়ে গেল যে, আর একটু এগোলেই আমাদের ডানপাশে পড়বে একটা পোড়ো কালীমন্দির। সেখানে গিয়ে উঠলে ঝড়-বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচা যেতে পারে। কিন্তু সন্ধ্যার পর ওই মন্দিরের ধারে কাছে কেউ ঘেঁষে না, আমারও মন চাইছিল না ওদিকে যাওয়ার। গাঁয়ের অন্য সকলের মতো ওই মন্দিরের প্রতি আমার মনেও ভয় আছে। অবশ্য ভয়ের কোনো কারণ আজ পর্যন্ত কিছু ঘটেনি কারও ক্ষেত্রে। ভয়টা কেবল সংস্কারবশেই। তবু আমি যদি একা থাকতাম, তাহলে হয়তো একা থাকার জন্যেই ওই মন্দিরে যেতে ভয় পেতাম। কিন্তু আমরা রয়েছি চারজন, সঙ্গে পাঁচ সেলের টর্চ। অযথা ভয় পাওয়ার কোনো কথাই নয়। তাই মনে সাহস পেয়ে আমি বন্ধুদের নিয়ে ভিজে গোবর হয়ে ওই পোড়ো মন্দিরটার চাতালে গিয়ে উঠলাম।

বেশ বড়োসড়ো মন্দির। মন্দিরের দুই পাশে ও পিছনে আরও খান চারেক ঘর আছে। এই মন্দির ছিল একজন তান্ত্রিকের। ঘরগুলির মধ্যে একটাতে নাকি মায়ের ভোগ রান্না হত, অন্য ঘরগুলিতে চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে তান্ত্রিক বাস করত।

মন্দির ও ঘরগুলির কিছু কিছু অংশ এখন ভেঙে পড়েছে। দেওয়ালের ছাদে গাছপালা গজিয়েছে, মন্দির-প্রাঙ্গণ লতাগুল্মের ঝোপেঝাড়ে আবৃত। এমন মুষলধারে বৃষ্টি না নামলে আমি কখনোই এই পোড়ো মন্দিরে আশ্রয় নিতাম না।

এখন মাত্র সন্ধ্যা রাত। কিন্তু জায়গাটার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যেন এখন মাঝরাত।

বন্ধু শ্যামল বলল, ‘আচ্ছা জায়গায় আমাদের নিয়ে এলি বটে, সাপ-খোপে কামড়াবে না তো?’

আমি টর্চটা জ্বেলে চারিদিকে দেখে নিয়ে বললাম, দেখে তো সেইরকমই মনে হচ্ছে। কী করব ভাই, যা বৃষ্টি নামল, বাড়ি যে এখনও অনেক দূরে। এই বৃষ্টিতে এতখানি রাস্তা ভিজলে সবাইকেই জ্বরে পড়তে হত।

আরেক বন্ধু রতন বলল, ‘সে-কথা সত্যি। কী মন্দির ছিল রে এটা? দেখে তো মনে হচ্ছে এককালে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে পুজো-আচ্চা হত এখানে।’

বললাম, ‘হ্যাঁ, মারাত্মক রকমের জাঁকজমক সহকারেই এখানে কালীপ্রতিমার পুজো হত শুনেছি। সে জাঁকজমক এতই মারাত্মক ছিল যে, কোনো লোক পুজো দেখা তো দূরের কথা, কোনোদিন প্রতিমা দেখতেও এখানে আসত না।’

এ কথা শুনে শ্যামল, রতন ও অজয় সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার দিকে তাকাল।

আমি বললাম, ‘শোন তবে এই মন্দিরের ইতিহাস, যেটুকু আমি জানি। আমার ঠাকুরদার বয়স যখন ছিল চব্বিশ-পঁচিশ, সেই সময় এই মন্দিরে কালীসাধনা করত একজন তান্ত্রিক কাপালিক। শুনেছি সেই কাপালিকের চেহারা এতই ভয়ঙ্কর ছিল যে, কোনো সাধারণ মানুষ তার ধারে কাছে যেত না। সাত-আটজন চেলা ছিল তার, তাদের চেহারাও ছিল ভয়ঙ্কর। ওই যে বেদিটা দেখেছিস, ওই বেদির ওপর থাকত কালীমূর্তি। তখন কেউই জানত না যে, ওই মূর্তিটা নকল কী আসল মূর্তি। অর্থাৎ নীচেকার একটা গোপন কক্ষে মন্দিরের পিছনদিকে একখানা ঘর আছে। সেই ঘরের মেঝের মধ্যে দিয়ে নীচেকার ঘরে যাওয়ার সিঁড়ি আছে। এই ব্যাপারটা আকস্মিকভাবে টের পেয়ে যায় আমাদেরই গাঁয়ের একদল ছেলে। দলে তারা ছ-জন ছিল। সেদিন তারা গিয়েছিল পাশের গাঁয়ে এক বউভাতের নিমন্ত্রণ খেতে। খেয়েদেয়ে যখন তারা ফিরছিল, রাত তখন এগারোটা।

আমরা আজ যে কারণে মন্দিরে ঢুকলাম, সেদিন তারাও ঠিক একই কারণে এই মন্দিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। আজকের মতো সেদিন রাতেও এমন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। তারা এই মন্দির-চাতালে উঠে দেখে, প্রতিমার দরজা বন্ধ। মানুষের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা ভাবল, কাপালিক ও তার চেলা-চামুণ্ডারা সবাই বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এমন সময় তাদের কানে পৌঁছায় পুজোর ঘণ্টাধ্বনি। কিন্তু ঘণ্টার যে আওয়াজ তাদের কানে আসছিল, সে আওয়াজটা ছিল খুব চাপা ও ক্ষীণ। প্রথমটা তাদের মনে হয়েছিল, খানিকটা দূর থেকে বোধ হয় আওয়াজটা আসছে, তাই এমন চাপা মনে হচ্ছে। তারপরই তাদের খেয়াল হল যে, এই মন্দিরের চারিপাশের প্রায় মাইল খানেক জায়গার মধ্যে কোনো বাড়িঘর, লোকবসতি নেই। তবে… তবে ওই ঘণ্টার শব্দ! তাহলে নিশ্চয় এই মন্দিরের মধ্যেই অন্য কোনো ঘরে পুজো হচ্ছে। এই কথা মনে হতেই ওই ছ-জন ছেলে উঠে দাঁড়াল। ওদের মধ্যে তিনজনের টর্চ ছিল। একজন বলল, চল-না, ভেতরের দিকটা একবার চুপিচুপি ঘুরে দেখে আসি, কোথায় কী পুজো হচ্ছে!

যতগুলো ঘর ওই মন্দিরের ভেতরে ছিল, সব ঘরের দরজাই তালা বন্ধ দেখল। ছেলেরা প্রত্যেকটি দরজার গায়ে কান দিয়ে বুঝল না, এসব ঘরের মধ্যে কোনো আওয়াজ নেই। তবে ঘণ্টার শব্দ আসছে কোত্থেকে? তারপর তারা মন্দিরের পিছনদিকে যেতেই তাদের মনে হল, যেন ঘণ্টার আওয়াজটা এখানে স্পষ্ট। টর্চের আলোয় দেখল, সেখানে একটা ঘর রয়েছে এবং ঘরের দরজাটাও আধখোলা অবস্থায় রয়েছে।

ছেলেরা এবার আরও হুঁশিয়ার হল। ঘরটার মধ্যে কোনো লোকজন থাকতে পারে বলে তাদের মনে সন্দেহ হওয়ায় তারা অন্ধকারের মধ্যে গা মিশিয়ে নিশ্চুপে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু ওই ঘরটাও জনশূন্য রয়েছে, এ ব্যাপারে শেষপর্যন্ত নিশ্চিন্ত হয়ে তারা সকলে ধীরে ধীরে ওই কক্ষে প্রবেশ করল। ভেতরে কী আছে এটাই তারা দেখতে চায়। কিন্তু ঘরটার মধ্যে ঢুকতেই ঘণ্টার শব্দ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। এবার তারা বুঝল, ওই ঘরের মধ্যেই ঘণ্টাধ্বনির রহস্য লুকিয়ে আছে। টর্চের আলোয় তারা মেঝেতে একটা বিরাট চৌকো ভারী লোহার পাত দেখতে পেল। লোহার পাতটা দেখে তাদের মনে কেমন যেন সন্দেহ জাগল। খুব সন্তর্পণে পাতটার দিকে এগিয়ে একজন সেটা টেনে সরাবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা এত ভারী একজনের পক্ষে টেনে সরানো সম্ভব নয়। তখন তারা করল কী, চারজনে ধরে সেটাকে এমন সাবধানে টানতে লাগল যাতে কোনোরকম শব্দ না-হয়। খানিকটা টানতেই একটা গর্তের মুখ তারা দেখতে পেল এবং সেই ঘণ্টার শব্দ একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। বুঝল, এই ঘরের নীচেকার কোনো চোরা-কুঠুরিতে ঘণ্টা বাজছে এবং সেই ঘরে যাওয়ার এটাই হল গুপ্তদ্বার।

ছেলেরা রহস্যের গন্ধ পেল। এমন গুপ্তকক্ষে পূজা-আচ্চা করার কারণ কী? নিগূঢ় কারণ নিশ্চয় কিছু একটা আছে এবং সে-কারণ জানবার জন্য তাদের সকলকার ডানপিটে মন আনচান করে উঠল। তারা সেই লোহার পাতটাকে আরও খানিকটা সরিয়ে গুপ্তদ্বার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে ফেলল। তাদের নজরে পড়ল, কয়েক ধাপ সিঁড়ি সোজা নীচের দিকে নেমে গিয়ে ডানদিকে বেঁকে গেছে। গুপ্তকক্ষে যে আলো জ্বলছে, তারই আলোয় আলোকিত হয়ে আছে সিঁড়ির বাঁকের মুখটা। ফলে সমস্ত সিঁড়িটাই মোটামুটিভাবে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

অতঃপর ছেলেরা মুহূর্তকালের জন্য একবার চুপিচুপি যুক্তি করে স্থির করে নিল যে, তারা নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে খানিকটা নীচে নেমে দেখে আসবে কী ধরনের পুজো ওখানে হচ্ছে, যে পুজোর জন্যে এত গোপনীয়তার প্রয়োজন।

সিঁড়ির সেই বাঁক অবধি নেমে ছেলেরা সন্তর্পণে ডানদিকে দৃষ্টিপাত করে যা দেখতে পেল, তাতে তারা ভয়ে-বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল! তারা দেখল, দরজা-জানালাবিহীন মাঝারি আকারের একখানি ঘর, ঘরখানার একপাশে হাততিনেক লম্বা এক কালীপ্রতিমার সামনে একজন ভয়ঙ্কর দর্শন তান্ত্রিক কাপালিক পূজায় মগ্ন। তার আশেপাশে কয়েক জন চেলা-চামুণ্ডা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে দু-জন একটি দশ-বারো বছরের বালককে ধরে আছে, আর একজনের হাতে রয়েছে একটি তীক্ষ্নধার খড়গ। এ ছাড়া ঘরখানার একটি কোণে জড়ো করা ছিল কয়েকটি সুতীক্ষ্ন বর্শা এবং আরও গোটাচারেক খড়গ।

ছেলেরা বুঝল, এই মন্দিরের আসল পূজা এখানেই হয় এবং নরবলি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

ইতিমধ্যে কাপালিক পূজা শেষ করে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এবং ঘাতকের দিকে চেয়ে ইশারায় বলির নির্দেশ দিল। ইশারা পেয়ে ঘাতক খাঁড়াটাকে শক্ত করে বাগিয়ে ধরল, আর সেই চেলা দুজন বালকটিকে নিয়ে এগিয়ে গেল প্রতিমার সামনে।

এর পরের অমানুষিক মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখবার জন্যে গাঁয়ের সেই ছেলেরা আর সেখানে অপেক্ষা করেনি। কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষেই এ-দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখা সম্ভব নয়। ওই অসহায় বালকটিকে বাঁচাবার জন্য সেসময় ছেলেগুলোর মনে প্রচণ্ড একটা উত্তেজনা জেগে উঠেছিল বটে, কিন্তু তারা বুঝেছিল যে, বাধা দিতে গেলে ওই সশস্ত্র দুর্ধর্ষ, কাপালিকগণের হাতে তাদের মৃত্যুবরণ করতেই হবে। তাই তারা আবার চুপিচুপি ওপরে উঠে এসে লোহার পাতটা আগেকার মতোই চাপা দিয়ে রেখে গাঁয়ে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু ওই হিংস্র নরঘাতক কাপালিকদের কথা তারা ভুলতে পারল না। ওই কাপালিকরা ইতিপূর্বে কত যে শিশুহত্যা, নরহত্যা করেছে, তার হয়তো ইয়ত্তা নেই। তবে ওইসব বলি ওরা ছেলে চুরি যাওয়ার অপবাদের জন্য আশেপাশের গাঁ থেকে জোগাড় করত না। তা যদি করত, তাহলে আমাদের গাঁয়ের মধ্যে ভীষণ একটা হইচই পড়ে যেত। কিন্তু সেরকম কিছু শোনা যায়নি কোনোদিন। ওরা নিশ্চয় কোনো দূরদেশ থেকেই বলি জোগাড় করত।

যাই হোক, ভবিষ্যতে আর যাতে তারা কোনো মানুষ খুন করতে না-পারে, ছেলেরা তার যথাযথ প্রতিকার করবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠল। নির্জনে অনেকক্ষণ ধরে যুক্তি করে তারা স্থির করল যে, ওই কাপালিক ও তার চেলাদের সকলকে তারা হত্যা করবে। এবং কীভাবে হত্যা করবে, তারও একটা সাংঘাতিক উপায় স্থির করে ফেলল।

দিন ছয়-সাত পরই একদিন রাত দশটা নাগাদ তারা আবার এই মন্দিরের নিকটে এসে পৌঁছোল। তাদের সঙ্গে বড়ো বড়ো টিনের দু-টিন পেট্রোল। এসব ব্যাপার তখনও পর্যন্ত তারা গাঁয়ের কোনো লোককেই জানায়নি। জানিয়েছিল কাপালিকদের হত্যা করার পরে।

মন্দিরের নিকটবর্তী বড়ো একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত তারা মন্দিরটার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখেও কোনো জনমনিষ্যির সাড়াশব্দ পেল না। তখন তারা নিঃশব্দে মন্দিরের চালাতে গিয়ে উঠল। তারপর পিছন দিকের সেই ঘরখানার নিকট হতেই তাদের কানে ঘণ্টার চাপা আওয়াজ ভেসে এল। এতক্ষণে তারা নিশ্চিন্ত হতে পারল। যাক, পুজো হচ্ছে এবং কাপালিকেরা তাহলে এই পুজোর ঘরেই আছে।

অতঃপর তারা এসে হাজির হল সেই গুপ্তদ্বারের নিকট। তাদের এর পরের কার্যকলাপ অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে শেষ হল। একজন একটু তফাতে সরে গিয়ে দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে একটা কাগজ ধরাল, আর অন্যদিকে অন্য ছেলেরা লোহার পাতটা সরিয়ে ফেলেই সেই গুপ্ত গহ্বরের মধ্যে দু-টিন পেট্রোল সম্পূর্ণ ঢেলে দিল। তারপর সেই জ্বলন্ত কাগজের টুকরোটা ভেতরে ফেলে দিতেই দপ করে গহ্বরের মধ্যে করাল অগ্নি জ্বলে উঠল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে গুপ্তকক্ষের দরজাটাও তারা আবার বন্ধ করে দিল সেই লোহার পাতটা দিয়ে।

ততক্ষণে গুপ্তকক্ষের মধ্যে কাপালিকদের বীভৎস অন্তিম চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সে চিৎকার অতি অল্পকালের মধ্যেই থেমে গেল। প্রচণ্ড নিঃস্তব্ধতা নেমে এল তারপর।

শত্রু ধ্বংস করে ছেলের দল বীরবিক্রমে গাঁয়ে ফিরে গিয়ে সকলের কাছে প্রকাশ করেছিল তাদের দুঃসাহসিক কাণ্ডকারখানার কথা। শুনে গাঁয়ের লোক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই মন্দিরের ধারেকাছে আগেও যেমন কেউ আসত না, কাপালিকদের মৃত্যুর পরও কেউ কোনোদিন শখ করে এদিকে আসেনি। সেদিন সেই ছেলেরা যেমন এসেছিল, আমরা আজ যেমন এলাম, তেমন নিতান্ত দায়ে পড়ে হয়তো কেউ কদাচিৎ এদিকে এসে থাকতে পারে।

গল্প শেষ করে আমি চুপ করতেই অজয় বলল, ‘এমন কাণ্ড!’

অপর দুই বন্ধু নীরব।

হঠাৎ ভয়ে আমার সারা দেহ শিউরে উঠল। সর্বশরীর কুঁকড়ে গেল আমার। হ্যাঁ, বেশ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছি ঘণ্টার শব্দ! যদিও খুব চাপা তথাপি সাংঘাতিক রকমের স্পষ্ট যেন! সেই বহুকাল আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনি এই মন্দিরের চারিপাশে প্রায় মাইল খানেক জায়গার মধ্যে কোনো ঘরবাড়ি নেই। তবে? তবে কোত্থেকে আসছে এই ঘণ্টার শব্দ? সেই গোপন কক্ষে আবার কি কোনো নতুন কাপালিক আশ্রয় নিয়েছে? উঁহু, মন্দিরের যা পোড়ো অবস্থা, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায় এখানে কোনো লোক বাস করে না। মন্দিরের সর্বত্র ধুলো বালি, শুকনো পাতা, কাঠিকুটিতে ভরতি। দেওয়ালের ফাটলে ফাটলে গাছপালা জন্মেছে। লোক বাস করলে মন্দির-চাতালে এমন এক ইঞ্চি পুরু ধুলো-বালিও জমে থাকত না— শুকনো কাঠিকুটিও পড়ে থাকত না। তবে? এই ঘণ্টার আওয়াজ আসছে কোথা থেকে? এই মন্দিরের মধ্যে থেকেই আসছে— তা ছাড়া আবার কোথা থেকে আসবে?

শ্যামল, অজয় আর রতন এদের কানেও পৌঁছেছে ঘণ্টার শব্দ।

অজয় দুই ভ্রূ কুঁচকে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘ঘণ্টার আওয়াজ আসছে না?’

আমি বললাম, ‘হুঁ!’

সেই অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পেলাম, অপর বন্ধু জ্বলজ্বলে চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

অজয় হচ্ছে পয়লা নম্বরের ডানপিঠে ছেলে— অত্যন্ত সাহসী। সে আমাকে শুধাল, ‘এ-ঘণ্টার আওয়াজ কোত্থেকে আসছে বলে মনে হয় তোর? আগে তো কাছাকাছি কোনো ঘরবাড়ি ছিল না শুনলাম, এখন?’

‘না, এখনও তেমনি; মাইল খানেকের মধ্যে বাড়িঘর কিছু নেই।’ বললাম।

‘তা হলে?’ ক্ষণকাল ভাবল অজয়। তারপর পুনরায় বলল, ‘তাহলে কি আবার কেউ বা কারা সেই ঘরে ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করে পুজো করছে? অবশ্য দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে না, বিশ বছরের মধ্যেও এখানে কোনো লোক বাস করছে। যাই হোক, ব্যাপারটা না-দেখে ছাড়ছি না। আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে, এই মন্দিরের মধ্যে থেকেই আওয়াজটা আসছে। চল তো, সেই ঘরটার মধ্যে নিয়ে চল আমাকে, যে ঘরটায় বলছিলি লোহার পাতে ঢাকা গুপ্তপথ আছে।’

বললাম, ‘সে-ঘর তো আমি জানিনে; তবে শুনেছি পিছন দিকে— দেখি চল।’

আমার সেদিকে যাওয়ার মোটেই ইচ্ছে ছিল না! কিন্তু পাছে শহরের বন্ধুদের কাছে আমি ভীরু কাপুরুষ প্রতিপন্ন হই, সেই ভয়েতেই আমাকে ওদের নিয়ে যেতে হল। মন্দিরের পিছন দিকে পৌঁছাতেই ঘণ্টার আওয়াজ স্পষ্ট হল।

ভয়ে থরথরিয়ে কেঁপে উঠলাম আমি। কম্পিত গলায় বললাম, ‘হ্যাঁ, সেই ঘরেতেই ঘণ্টা বাজছে, কোনো ভুল নেই। আবার কারা এল?’

আমি ভীত হয়ে পড়েছি, অজয় বোধ হয় হয় টের পেয়ে বলল, ‘কী রে বিপিন, তুই কী ভয় পাচ্ছিস?’

‘না-না-না, ভয় পাব কেন? তবে… তবে… ভাবছি কোনো নরবলি-টরবলি হচ্ছে না তো?’

অজয় বলল, ‘দেখা যাক না কী হচ্ছে?’

আমি বুঝতে পারলাম, রতন বা শ্যামলেরও এসব ব্যাপারে উৎসাহের অভাব রয়েছে। ওরা দুজনও কেমন যেন মিইয়ে রয়েছে। আমার মতোই অবস্থা আর কী! ভীতু কাপুরুষ প্রতিপন্ন হতে চায় না বলেই নিরুত্তরে এগিয়ে চলেছে।

অজয় আমার কাছ থেকে আগেই টর্চটা নিয়েছিল। টর্চের আলোয় দুই পাশ দেখতে দেখতে সে এগিয়ে চলেছিল। যে ক-টা ঘর দেখলাম, কোনো ঘরেরই দরজা-জানালা নেই। সব উই-এ নষ্ট করেছে আর ভেঙেচুরে পড়েছে। সর্বত্র ধুলো-বালি, নোংরা ইত্যাদিতে ভরা। এখানে কোনো লোকের যাওয়া-আসা থাকলে এই পুরু ধুলোর ওপর পায়ের দাগ নিশ্চয় থাকত। কোনো পদচিহ্ন নেই— এমনকী কোনো জন্তু-জানোয়ারের পর্যন্ত না। শুধু আমরাই ক-জন সুস্পষ্ট পদচিহ্ন ফেলে এগিয়ে চলেছি।

‘অসম্ভব, এখানে কোনো মানুষ থাকতে পারে না!’ কথাটা আচমকা বলল অজয়।

‘তবে?’ আমি আর শ্যামল দু-জনে একই সঙ্গে প্রশ্ন করে বসলাম।

অজয় বলল, ‘তবেটা যে কী, সেটাই তো জানতে যাচ্ছি।’

আমরা সেই ঘরটার মধ্যে এসে হাজির হলাম। মুখে-চোখে মাকড়সার জালের স্পর্শ পাওয়া গেল। এ-ঘরে লোকের যাওয়া-আসা থাকলে কি এমন মাকড়সার জাল ছড়িয়ে থাকত?

এবার উজ্জ্বল টর্চের আলোয় মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, একটা বিরাট মরচে ধরা লোহার পাত পড়ে রয়েছে। ঘরের মেঝে ও লোহার পাতটার ওপর আধ-ইঞ্চি পুরু ধুলোর আস্তরণ জমে রয়েছে। এখানে ঘণ্টার শব্দ আরও স্পষ্ট। একটানা ঘণ্টা বেজে চলেছে— মনে হচ্ছে যেন আরতি হচ্ছে।

আমরা প্রত্যেকেই উপলব্ধি করতে পারলাম যে, এই ঘরের নীচে থেকেই ঘণ্টার আওয়াজ আসছে। যেখানে লোকজনের কোনো অস্তিত্ব নেই, সেখানে ঘণ্টা বাজে কী করে? এ কী অলৌকিক কাণ্ড! আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল! ভীষণ একটা বিপদের ইঙ্গিত পাচ্ছি যেন।

‘আশ্চর্য! অদ্ভুত!’— অজয় নির্নিমেষ দৃষ্টিতে লোহার পাতটার দিকে তাকাতে তাকাতে কথাটা বলল।

শ্যামল বলল, ‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, বহুকাল এ ঘরে কোনো মানুষের পদার্পণ হয়নি, অথচ নীচেকার ঘরে ঘণ্টা বাজছে। ঘণ্টাটা আপনাআপনি বাজছে না নিশ্চয়ই, মানুষেই বাজাচ্ছে তো! তবে কি সে মানুষ হাওয়ায় মিশে নীচেকার ঘরে গেছে— যার জন্য তার পায়ের ছাপ পড়েনি!’

অজয় বলল, ‘সত্যিই ভাববার কথা! এ-রহস্যের কারণ জানতেই হবে!’

এবার আমরা সকলে মিলে লোহাটা টেনে সরাতেই গুপ্তপথ নজরে পড়ল। আর সেইসঙ্গে ঘণ্টার আওয়াজটাও একেবারে কানের কাছে এগিয়ে এল।

কিন্তু কী অন্ধকার গর্তটা! সিঁড়ির একটা ধাপও নজরে পড়ছে না। নীচেকার ঘরে নিশ্চয় কোনো আলো জ্বলছে না। ছোটো একটা প্রদীপ জ্বললেও তার আলোর রেখা নিশ্চয় আমাদের নজরে পড়ত। এবং সিঁড়ির নীচেকার দিকটাও অন্তত আবছাভাবে আলোকিত হয়ে থাকত। তবে কি অন্ধকারে বসেই পুজো করছে? এ কী অস্বাভাবিক ব্যাপার!

অজয় চুপিচুপি বলল, ‘আমার পিছু পিছু আয় তোরা। খুব সাবধানে নামবি, টর্চ জ্বালব না। কোনোরকম শব্দ-টব্দ হয় না যেন!’

দু-পাশের দেওয়াল ধরে ধরে নিঃশব্দে সিঁড়ির বাঁক পর্যন্ত নেমে দাঁড়ালাম। সঙ্গে-সঙ্গে ঘণ্টার আওয়াজ থেমে গেল। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমরা। অস্বাভাবিক অন্ধকারে আমরা চারজনে যেন অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি! এত নিরেট অন্ধকার জীবনে কোনোদিন দেখিনি।

আমরা সকলে গায়ে গা ঠেকিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো মানুষ জনের তো দূরের কথা একটা আরশোলার অস্তিত্ব পর্যন্ত টের পেলাম না।

হঠাৎ অজয়ের হাতের পাঁচ সেলের টর্চটা জ্বলে উঠল। টর্চটায় ছিল নতুন ব্যাটারি। উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চারিদিক। দেখতে পেলাম, সেই গুপ্তকক্ষের মেঝের ওপর কতকগুলো নরকঙ্কাল পড়ে রয়েছে। প্রতিমা যেখানে ছিল, সেখানে পোড়ো প্রতিমারও কিছু অংশ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঘরের একটা কোণে সেই বর্শা আর খাঁড়াগুলোও রয়েছে। আর একটা খাঁড়া পড়ে রয়েছে প্রতিমার কাছাকাছি জায়গায়। পূজার ঘণ্টা এবং কয়েকটা থালা কোশাকুশী ইত্যাদি প্রতিমার সামনে পড়ে রয়েছে। এ-সমস্ত জিনিস আগুনে পুড়ে এবং তার ওপর ধুলোর আবরণ জমে এমন চেহারা হয়েছে যে, বোঝবার উপায় নেই কোনটা লোহার তৈরি, কোনটা তামার বা কোনটা পিতলের জিনিস।

বেশ কিছুক্ষণ ঘরটা দেখে নিয়ে অজয় গলায় বেশ জোর দিয়ে বলে উঠল, ‘অসম্ভব! এ ঘরে কখনোই ঘণ্টা বাজছিল না! ঘণ্টার শব্দ অন্য কোথাও থেকে আসছিল। আমাদের সকলকারই শোনার ভুল হয়েছে। আর এখানে নয়— ওপরে যাওয়া যাক।’

আমি বেশ স্পষ্টই বুঝতে পারলাম, কথা বলার সময় অজয়ের গলা কাঁপছিল। আর আমার নিজের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কী যে এক নিদারুণ ভয়ে আমি ঘেমে উঠলাম।

যাই হোক, আমরা ওপরে উঠতে শুরু করলাম। সবার আগে আছি আমি, আর সবার নীচে টর্চ হাতে অজয়।

অকস্মাৎ অজয়ের আর্ত চিৎকারে আমরা ভীষণভাবে চমকে উঠলাম। আঁ-আঁ-আঁ করে চিৎকার করতে করতে অজয় বসে পড়ল সিঁড়ির ওপর। তার হাত থেকে টর্চটা খসে পড়েই নিবে গেল। অজয়ের চিৎকার শুনলাম— ‘ওরে তোরা আমাকে বাঁচা— বাঁচা—’

তারপরই চুপ।

আমরা হুড়মুড় করে নেমে গেলাম অজয়ের কাছে। টর্চটা কোথায় পড়েছে কে জানে, আমরা তো সেই অন্ধকারের মধ্যেই অজয়কে ধরাধরি করে কোনোরকমে নিয়ে এলাম ওপরে। বুঝলাম, অজয়ের জ্ঞান নেই।

তারপর কীভাবে কত কষ্ট করে যে অচৈতন্য অজয়কে নিয়ে সে-রাতে বাড়ি পৌঁছেছিলাম, সে কথা এখানে না বললেও চলবে।

ডাক্তারকে খবর দেওয়া হয়েছিল। তিনি দেখে-শুনে ওষুধ দিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু-একটা দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।’

ডাক্তারের কথা সত্য প্রমাণিত হল অজয়ের জ্ঞান ফেরার পর তার মুখ থেকে সব কথা শুনে। জ্ঞান অবশ্য ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই ফিরেছিল; কিন্তু সে মোহাচ্ছন্নের মতো ছিল পরদিন বেলা প্রায় আটটা অবধি। বেলা দশটা নাগাদ তাকে বেশ খানিকটা সুস্থ মনে হতে আমরা গত রাতের ঘটনাটার কথা তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে সে বলেছিল যে, তার মনে হয়েছিল একজন ভীষণ দর্শন কাপালিক এক হাতে তাকে চেপে ধরে অন্য হাতে ধারালো খাঁড়া তুলে তার গলায় একটা কোপ বসিয়ে দিয়েছিল! তাই অমনভাবে সে চিৎকার করে উঠেছিল।

তার মুখে এ-কথা শুনে তখনই গাঁয়ের প্রায় বিশ-পঁচিশজন যুবক সেই পোড়ো মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হয়ে পড়ল। শ্যামল, রতন আর আমি আগে আগে চললাম। সকলের মনেই সেই ঘরটা দেখার তীব্র আগ্রহ। দিনের বেলা বেশ ভালোভাবেই দেখাশোনা যাবে। এতকাল কারও মনে কোনো আগ্রহ জাগেনি। আজ এত বছর পর একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যাওয়ায় গাঁয়ের আজকালকার তরুণ যুবকেরা কৌতূহল দমন করতে পারল না।

দিনের বেলা হলেও সেই পাতাল-কক্ষ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকবে অনুমান করে নিয়ে আমি গোটা চার-পাঁচ টর্চ নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল প্রায় জনা দশেক টর্চ নিয়ে এসেছে।

গুপ্তদ্বারের সামনে এসে দেখা গেল, সত্যই ভেতরটা বেশ অন্ধকার। যাই হোক, আমরা টর্চগুলো জ্বেলে একে একে নামতে লাগলাম নীচে।

সিঁড়ির শেষ প্রান্তে নেমে আমার টর্চটা পেয়ে গেলাম। কিন্তু একী! এখানে একটা নরকঙ্কাল এল কী করে? দেখেই শিউরে উঠলাম। বেশ মনে আছে, এখানে সিঁড়ির গোড়ায় তো কোনো কঙ্কাল ছিল না। কঙ্কালগুলো তো সবই দেখেছিলাম ঘরের মেঝের ওপর এদিক-ওদিক পড়ে ছিল। আরে, পায়ের কাছে বিরাট একখানা খাঁড়া পড়ে রয়েছে দেখছি! কঙ্কাল, খাড়া— না কখনো না, এসব মোটেই এখানে ছিল না। ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখি, প্রতিমার কাছে যে খাঁড়াটা পড়ে ছিল, সেটা তো সেখানে নেই!

সবগুলো টর্চের আলোয় ঘরখানা প্রায় সাদা হয়ে গেছে। অন্য সকলে অবাক চোখে ঘরের মধ্যে যা যা রয়েছে সেইসব লক্ষ করছে। কিন্তু আমার নজরে যা পড়ছে তা আশ্চর্য— অতি আশ্চর্য— একেবারে অলৌকিক ব্যাপার! প্রতিমার কাছে যে খাঁড়াটা পড়ে ছিল, সেখানে খাঁড়াটা নেই বটে, কিন্তু সেই জায়গাটায় খাঁড়ার ছাপটা জ্বলজ্বল করে যেন জ্বলছে। বহুকাল ধরে ঘরের মেঝে ও জিনিসপত্রের ওপর বেশ পুরু একটা ধুলোর আস্তরণ জমেছিল। কাজেই সেখান থেকে খাঁড়াটা উঠে আসার জন্যই অমন সুস্পষ্ট ছাপটা দেখা যাচ্ছে। আর ওখানকার ওই খাড়াটাই যে এখানে এসে পড়েছে, এ বিষয়ে আমার মনে কোনোরকম সন্দেহ রইল না। শুধু খাঁড়াটাই নয়, ওই একই রহস্যজনক উপায়ে কঙ্কালটাও যে ঘরের মেঝে থেকে উঠে এসেছে এখানে, সে বিষয়েও আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মাল। কিন্তু এই অলৌকিক কাণ্ডকারখানার মূলে কোনো অলৌকিক রহস্য যে অন্তর্নিহিত রয়েছে, তার মীমাংসায় পৌঁছোনোর মতো বুদ্ধিবৃত্তি আমার নেই।

অত লোকজনের মধ্যে থেকেও কী যেন এক দারুণ ভয়ে আমার সারাদেহ শক্ত কাঠ হয়ে গেল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *