পোড়ো খনির প্রেতিনী – কিশোর কর্নেল সমগ্র ৪ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
চিৎপুরে প্রচণ্ড ট্রাফিকজটে আমার গাড়ি আটকে গিয়েছিল। কেন যে … শর্টকাট করার জন্য এই ঘিঞ্জি রাস্তায় ঢোকার দুর্বুদ্ধি হল, তাই ভেবে নিজের ওপর খাপ্পা হয়ে উঠছিলুম ক্রমশ। হঠাৎ চোখে পড়ল, ডানদিকের একটা দোকান থেকে লম্বাচওড়া এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। তার মুখে আমার অতিপরিচিত ঋষিসুলভ সাদা দাড়ি। তিনি পা বাড়াতেই ফুটপাথের একটা ব্যস্তবাগীশ লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মাথার ছাইরঙা টুপিটা পড়ে গেল। টুপি কুড়োবার সময় তাঁর বিখ্যাত টাকও দেখতে পেলুম। আমি চেঁচিয়ে ডাকলুম,–কর্নেল!
আমার বৃদ্ধ বন্ধু শুনতেই পেলেন না। ভিড়ের ভেতর মিশে গেলেন। এবার সেই দোকানের সাইনবোর্ডে চোখ পড়তেই চমক লাগল।
টি এন গুপ্ত অ্যান্ড কোং
সুলভে যাত্রা-থিয়েটারের পোশাক
ভাড়া পাওয়া যায়। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
উত্তর কলকাতার এক প্রাচীন মন্দির থেকে কয়েক লক্ষ টাকার সোনাদানা চুরির খবর আনতে গিয়েছিলুম। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য। বেলা পড়ে এসেছিল। তাই খুব তাড়া ছিল। পত্রিকার অফিসে ফিরে খবরটা লেখার পর ফোন করলুম কর্নেলকে। ভেবেছিলুম, এতক্ষণে নিশ্চয় বাড়ি ফিরেছেন।
ওঁর ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ ফোন ধরেছিল। বলল,–বাবামশাই সেই কখন বেইরেছেন, এখনও ফেরেননি দাদাবাবু। বলে গেছেন, ফিরতে অনেকটা রাত্তির হবে।
মনে একটা চাপা উত্তেজনা রয়ে গেল। বাড়ি ফিরে রাত দশটা নাগাদ আবার ফোন করতেই যথারীতি ষষ্ঠীচরণের সাড়া পেলুম। সে খিকখিক করে হেসে বলল,–কাগুঁজে দাদাবাবু নাকি? ইদিকে এক কাণ্ড!
কী কাণ্ড, ষষ্ঠী! কর্নেল ফেরেননি!
ফিরেছেন আজ্ঞে। কিন্তু বললুম না–ইদিকে এক কাণ্ড হয়েছে!
কী মুশকিল! কাণ্ডটা কী?
আজ্ঞে, কাটামুণ্ডু।
কাটামুণ্ডু! তার মানে? কার কাটামুণ্ডু?
আবার কার? বাবামশাইয়ের। খি খি খি …।
ভড়কে গেলুম। কর্নেলের কাটামুণ্ডু মানেটা কী? আর ষষ্ঠী এমন হাসছে কেন? শিউরে উঠলাম। কর্নেলের কাটামুণ্ডু … ষষ্ঠীর অমন পাগলাটে হাসি!
সর্বনাশ! তাহলে কি কর্নেলকে কেউ খুন করে গেছে আর তাই দেখে ষষ্ঠী পাগল হয়ে গেছে?
তক্ষুনি ফোন রেখে ঝটপট বেরিয়ে পড়লুম। রাস্তায় গিয়ে মনে হল, থানায় খবর দেওয়া উচিত হবে কি না। কিন্তু কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের মতো ধুরন্ধর এবং শক্তিমান মানুষ খুন হবেন, কিংবা গলায় নির্বিবাদে কাউকে কোপ বসাতে দেবেন, ভাবাই যায় না। আগে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখা দরকার।
কিন্তু ইলিয়ট রোডে কর্নেলের বাড়ির সামনে কোনো ভিড় নেই। রাস্তা সুনসান খাঁ-খাঁ। হন্তদন্ত তেতালায় উঠে কলিং বেলের সুইচ টিপলুম। আমার হাত কাঁপছিল। শরীর ভারী হয়ে উঠেছিল। দরজা খুলে গেলে ষষ্ঠীচরণের মুখ দেখতে পেলুম। আমাকে দেখে সে চাপা খিকখিক হেসে ফিসফিস করে বলল,–ভারি মজার কাণ্ড, দাদাবাবু। দেখুন গে না।
তাকে ঠেলে হন্তদন্ত ঢুকে পড়লুম। ড্রইংরুমের পর্দা তুলেই থমকে দাঁড়াতে হল। টেবিলের ওপর সত্যি সত্যি একটা কাটামুণ্ডু রয়েছে এবং সেটা কর্নেলেরই বটে। টাক এবং সাদা দাড়ি সবই ঠিকঠাক আছে। কিন্তু সেই কাটামুণ্ডের সামনে যিনি ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন, তিনি সম্ভবত কর্নেলের ভূত নন। কারণ তিনি চোখ তুলে আমাকে দেখলেন এবং মৃদুহাস্যে যথারীতি সম্ভাষণ করলেন, হ্যাল্লো ডার্লিং!
পাশে বসে আমি হো হো করে হেসে উঠলুম। তারপর বললুম,–আপনার ষষ্ঠীচরণটি এক অপূর্ব জিনিস! বলে কী, বাবামশাইয়ের কাটামুণ্ডু …
কর্নেল কথা কেড়ে বললেন,–ষষ্ঠী যে ভুল বলেনি, তা তো দেখতেই পাচ্ছ, জয়ন্ত! এখন বলো তো মুণ্ডুটা দেখে আমার বলে মনে হচ্ছে কি না?
আপনার ছাড়া আর কার? মুণ্ডুটা দেখতে দেখতে বললুম। একেবারে অবিকল। ওটা যদি রাস্তায় পড়ে থাকে, কেউ সন্দেহ করবে না যে ওটা নকল মুণ্ডু। এমনকি পোস্টমর্টেমের টেবিলে ডাক্তার যতক্ষণ না ছুরি চালাচ্ছেন, ততক্ষণ তিনিও ধরতে পারবেন না কিছু! তাছাড়া টাকটিও নিখুঁত হয়েছে।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে সহাস্যে বললেন,–ঠিক এমনটিই চেয়েছিলুম।
বললুম,–এটা কি চিৎপুরের টি এন গুপ্ত কোং থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছেন?
কর্নেল আমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা দোলালেন। তুমি আজ বিকেলে চিৎপুরে ট্রাফিকজটে আটকে গিয়েছিলে এবং আমাকে ডেকেছিলে, ঠিকই। কিন্তু তখন আমার বেজায় তাড়া ছিল। আশা করি, তুমি কুমোরটুলির প্রখ্যাত মৃৎশিল্পী দেবেন পালের নাম শুনেছ। দেবেনবাবু ইদানীং পোশাকের দোকানের জন্য ডামি তৈরিতে খুব নাম করেছেন। চৌরঙ্গি এলাকার বহু পোশাকের দোকানে লাইফসাইজ মূর্তিগুলো ওঁরই তৈরি। আগে এসব জিনিস বিদেশ থেকে আনা হত। তবে সেসব মূর্তি অবশ্য সায়েব-মেমদের। এ যুগে সায়েব-মেম চলে না।
আপনার এই কাটামুণ্ডুটা কি মাটির?
মোটেও না। প্লাস্টার অফ প্যারিস দিয়ে তৈরি। দোকানের ডামিগুলোও তাই। মাটির মূর্তি ভেঙে যাবার চান্স থাকে।
কিন্তু ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো! গুপ্ত কোম্পানিতে কি আপনি পরচুলো কিনতে ঢুকেছিলেন? আর এই কাটামুণ্ডুরই বা উদ্দেশ্য কী?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন,–পরচুলো জিনিসটা বরাবর আমার চক্ষুশুল। বিশেষ করে যাত্রা-থিয়েটারের জন্য যে সব পরচুলো ভাড়া দেওয়া হয়, তাতে অসংখ্য উকুন থাকা সম্ভব। আর জয়ন্ত, সত্যি বলতে কি, টাক মানুষের চেহারায় জ্ঞানীর ব্যক্তিত্ব এনে দেয়। আমার টাক আমার বড় গর্বের জিনিস। তবে কাটামুণ্ডুর কথা জিজ্ঞেস করছ, এটা আমাকে ভালোবেসে উপহার দিয়েছেন কুমোরটুলির দেবেনবাবু। পুরো প্রতিমূর্তি গড়ে দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলুম,–অত পরিশ্রমের দরকার নেই। বরং আমার মাথাটা উপহার দিলেই আমি খুশি।
বুঝলাম। কিন্তু টি এন গুপ্তের দোকানে তাহলে কেন ঢুকেছিলেন?
কর্নেল সে-কথার জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানলেন। তারপর বললেন,–কাল থেকে দিন-চারেকের ছুটি নিতে পারবে জয়ন্ত?
পারব। কেন?
আমরা বেড়াতে যাব একজায়গায়।
কোথায়?
কর্নেল চোখ বুজে গল্প বলার সুরে বললেন,–ধানবাদের ওদিকে ভৈরবগড় নামে একটা জায়গা আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ওই এলাকায় অনেক খনি ছিল। এখন সবই পোড়ো হয়ে গেছে–যাকে বলে অ্যাবাভান্ড মাইন। অর্থাৎ ভূগর্ভ থেকে ভোলার মতো কোনো জিনিস আর নেই। নিয়ম হল, পোতখনির মুখ সিল করে দিতে হয়। কিন্তু কজনই বা নিয়ম মানে? অনেক খনির মুখ সিল করা হয়নি। কোনোটাতে জল জমে আছে, কোনোটায় গভীর গর্ত। ঝোঁপজঙ্গল গজিয়ে গেছে। গত শীতে ভোলা খনিমুখগুলো থেকে জন্তু জানোয়ার বেরুতে দেখেছিলুম। তবে শেষ পর্যন্ত একটা দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।
ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে গেল। পেয়ালায় কফি ঢালতে ঢালতে বললুম,–হুঁ। বলুন।
কর্নেল একটু হাসলেন। জয়ন্ত, তুমি কি কখনও এমন অদ্ভুত প্রাণীর কথা শুনেছ-যার পায়ের পাতা উলটো, চোখ দুটো সাপের মতো নিষ্পলক, যার চিৎকার শুনলে দুঃসাহসীরও শরীর আতঙ্কে হিম হয়ে যায়?
জোরে মাথা নেড়ে বললুম,–না।
বলছি বটে প্রাণী, কিন্তু দেহাতি লোকেরা বলে পেত্নি। তুমি বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ হিমাচলের যেখানেই যাবে, দেহাতি লোকেদের কাছে এই সাংঘাতিক পেত্নির কথা শুনতে পাবে। উলটো দিকে পায়ের পাতা বলে এই পেত্নিকে মনে হবে পিছু হেঁটে তোমার দিকে ক্রমাগত এগিয়ে আসছে। চোখে পলক পড়ে না। ঠাণ্ডা-হিম সেই চোখে তাকিয়ে তোমার দিকে আসতে আসতে হঠাৎ সে বিকট চেঁচিয়ে উঠবে। সেই রক্ত-হিম-করা চিৎকার শুনলে তুমি তক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। তখন পেত্নি তোমার মুণ্ডটি মুচড়ে ছিঁড়ে নিয়ে রক্ত চুষে খাবে।
রাত সাড়ে দশটার কলকাতায় এই বিবরণ শুনতে শুনতে হেসেই ফেলতুম, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ললাডশেডিং হয়ে গেল। অন্ধকারে মনে হল আমার খুব কাছেই পেত্নিটা দাঁড়িয়ে আছে। ঝটপট লাইটার জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে ব্যস্ত হলুম। একটু চুপ করে থাকার পর কর্নেল বললেন, কিন্তু তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, পোড়োখনি এলাকায় জটাজুটধারী এক সাধুবাবাও নাকি থাকেন। যাই হোক, ভৈরবগড়ের পোড়োখনির ভেতর থেকে পেত্নিটা যদি আজ রাতে বেরিয়েও থাকে, কলকাতা পৌঁছুতে তার ভোর হয়ে যাবে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, ডার্লিং।
হৈ-চৈ করে বললুম,–কী যা-তা বলেন! আমি কি ভয় পেয়েছি নাকি?
ষষ্ঠীচরণ একটা বাতি রেখে গেল। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন,–বিহার থেকে হিমাচল পর্যন্ত এই পেত্নির খুব নামডাক। ওরা বলে চুরাইল। কোথাও চুড়ৈলও বলে। বাংলার গ্রামে যাকে বলে শাঁখচুন্নি, সে আসলে ওই চুরাইলেরই বাঙালি রূপ। পেত্নির হাতে থাকে শাঁখের চুড়ি। তাই ওই নাম। বাংলায় শাঁখের চুড়ি-পরা পেত্নি অপভ্রংশে শাঁখচুন্নি হয়ে গেছে।
ভৈরবগড়ে আপনি তাহলে চুরাইল দেখেছিলেন?
হ্যাঁ। জ্যোৎস্না ছিল। স্পষ্ট দেখতে পাইনি তার চোখ দুটো নিস্পলক কিনা, কিংবা তার পায়ের পাতা সত্যি উলটো দিকে ফেরানো কি না। তবে তার চিৎকারটা শুনেছিলুম। চেরা গলার সেই চিৎকার টেনে-টেনে হিপিয়ে কখনও কান্নার মত, কখনও তীব্র বিপদজ্ঞাপক সাইরেনের মতো। আমি ভীষণ হকচকিয়ে গিয়েছিলুম। ব্যস্ততার মধ্যে টর্চটাও বিগড়ে গিয়েছিল। যখন আবার জ্বলল, তখন সে অদৃশ্য।
কিন্তু এতদিন পরে চুরাইল-রহস্য উদ্ধারে বেরুনোর কারণ কী? পেত্নিটা কি কারুর মুণ্ডু ছিঁড়ে রক্তপান করেছে?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন,–করেছে। তারপর উঠে গিয়ে কোণার টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা ইনল্যান্ড লেটার এনে বললেন,–পড়ে দেখো।
আলোর দিকে ঝুঁকে চিঠিটাতে চোখ রাখলুম। তাড়াহুড়ো করে লেখা। হরফগুলো বাঁকাচোরা।
প্রিয় কর্নেল,
ভৈরবগড়ে আবার চুরাইলের আবির্ভাব ঘটেছে। আগে মাঝেমাঝে যেমনটি দেখা গেছে, এবারও তেমনটি। দুজনের কাটামুণ্ডু আর ধড় পাওয়া গেছে। একফোঁটা রক্ত ছিল না। পুলিশ বলছে ডাকাতের কীর্তি। কিন্তু আমি জানি তা নয়। গত রাতে আমাদের পেছনের বাগানে চুরাইলের ডাক শুনেছি। তখন রাত প্রায় একটা। আমার অনিদ্রার কথা তো জানেন। ডাক শুনেই জানালা খুলে উঁকি দিয়েছিলুম। বন্দুক ছিল হাতে। কিন্তু লোডশেডিং চলছিল তখন। টর্চের আলোয় একপলক তার চেহারা দেখলুম। বুক কেঁপে উঠল। বন্দুক ছুঁড়তে পর্যন্ত পারলুম না ভয়ের চোটে। জানালা বন্ধ করে দিলুম। আমার খুব ভয় হচ্ছে, ওই দুজনের বাড়ির পেছনেও এমনি করে সে এসেছিল। দয়া করে আপনি শিগগির আসুন। ইতি,
যদুনারায়ণ দেব।
কর্নেলের কাছ থেকে যখন বেরোলুম, তখন রাত প্রায় এগারোটা বেছেছে। তখনও ওই এলাকা জুড়ে লোডশেডিং! গাড়ির হেডলাইটের ছটায় অসংখ্য চুরাইল ভেসে উঠছিল যেন। আলোকিত এলাকায় পৌঁছে দেখি, ঘন কুয়াশা জমেছে। মার্চেও এবার শীত পিছু ফিরে দাঁড়িয়েছে। সঙ্গে প্রচুর কুয়াশা। কুয়াশার ভেতর পেত্নিটা যেন আমাকে অনুসরণ করছিল। নিষ্পলক চোখে পিছু হেঁটে হেঁটে সে এগোচ্ছিল। গাড়ির গতি বাড়িয়েও তাকে যেন ফেলে যেতে পারছিলুম না। বাড়ি পৌঁছে। গাড়ি গ্যারেজে ঢুকিয়ে যখন বেরুচ্ছি। তখনও মনে হল সে গেটের বাইরে নিস্পলক ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে গিয়ে ঘরে ঢোকার পর কতক্ষণ কান পেতে থাকলুম, কিন্তু তার ডাক শুনতে পেলুম না। তখন নিজের মিথ্যে ভয়ের কথা ভেবে খুব লজ্জা হল। …
.
দুই
খনি এলাকা যতটা রুক্ষ দেখায়, ভৈরবগড় ততটা রুক্ষ নয়। শহর আর গ্রামে মেশানো একটা জনপদ। খনিগুলো অ্যাবান্ডা হয়ে ভৈরবগড়ের জৌলুস পড়ে গেছে কবে। রেলস্টেশন আছে। বটে, তার চেহারাও খাঁ খাঁ। ঢেউখেলানো মাটি, ছোটবড় আর পাহাড়, বনজঙ্গল নিয়ে কেমন একটা আদিম পরিবেশ।
যদুনারায়ণ দেবের বাড়িটা বেশ পুরনো। তিনপুরুষ আগে ওঁরা বাংলা থেকে এ মুল্লুকে এসেছিলেন খনি-ব্যবসা করতে। এখন অবস্থা আগের মতো জমকালো নয়। বাড়িতে আছেন যদুনারায়ণ, তার ছোটভাই রুদ্রনারায়ণ, যদুবাবুর সাত-আট বছর বয়সী মেয়ে পিঙ্কি, আর যদুবাবুর মা করুণাময়ী। যদুবাবুর স্ত্রী বেঁচে নেই। রুদ্রবাবু এখনও বিয়ে করেন নি। ধানবাদে একটা কোম্পানিতে চাকরি করেন। রোজ ট্রেনে যাতায়াত করেন।
পেছনে বাগানের দিকের একটা ঘরে আমরা উঠেছি, বাগান অবশ্য নামেই। তিন একর জায়গা জুড়ে গাছপালা ঝোঁপঝাড় গজিয়ে আছে। একটা প্রকাণ্ড আর চ্যাপটা টিলার মাথায় বাড়িটা। বাগানের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে অনেক দূর দেখা যায়। ওই দিকটায় সেইসব পোড়োখনি আছে।
কর্নেল যদুবাবুকে নিয়ে বেরিয়েছেন কোথায়। রাত জেগে ট্রেনে এসেছি। ক্লান্তিও বটে, চোখ দুটোও জ্বালা করছে। তাই ওঁদের সঙ্গে যাইনি। বাগানের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে বেড়া ডিঙিয়ে কঁকা জায়গায় গিয়ে একটা পাথরে বসে ছিলুম।
দিন-দুপুরে পেত্নির ভয় থাকার কথা নয়। কিন্তু পোড়োখনি এলাকার দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি হচ্ছিল। সেইসময় কোথকে সাদা রঙের একটা ছোট্ট কুকুর দৌড়ে এসে আমার পা শুঁকে জ্বলজ্বল চোখে আমাকে দেখতে থাকল। অবাক হয়ে ভাবছি, কুকুরটা কার, এমন সময় ওপাশের ঝোঁপ থেকে যদুবাবুর মেয়ে পিঙ্কি ডাক দিল,–কুকি! কুকি!
কুকুরটার সারা গায়ে লোম। গা ঝাড়া দিয়ে সে মুখ ঘোরাল। পিঙ্কি তার কাছে এসে ধমক দিল, –কী? কথা কানে যাচ্ছে না বুঝি? চাটি খাবি বলে দিচ্ছি? চলে আয়!
বললুম,–তোমার কুকুর বুঝি? ভারি সুন্দর তো কুকুরটা!
পিঙ্কি আমার কথায় কান দিল না। সে কুকুরটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে ঢাল বেয়ে দৌড়তে শুরু করল। তারপর নীচের সমতলে গিয়ে কুকুরটাকে নামিয়ে দিল। দেখলুম, এবার কুকুরটা অর্থাৎ কুকি তার পেছন-পেছন হাঁটছে। একটু পরে পিঙ্কি ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।
মেয়েটা তো বড্ড সাহসী দেখছি! এসেই শুনেছি, চুরাইলের আতঙ্কে লোকে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ঢুকে পড়ে। বাজার-এলাকা শিগগির নিশুতি সুনসান হয়ে যায়। এমনকি দিনের বেলাতেও কেউ একাদোকা মাঠেঘাটে পা বাড়ায় না। আর অতটুকু মেয়েটা দিব্যি একা ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই এলাকায়!
কিছুক্ষণ পরে উঁচু একটা জায়গায় ফ্রক পরা পিঙ্কির মূর্তি ভেসে উঠল। তার পায়ের কাছে কুকি। দুজনে খুব মন দিয়ে কী যেন দেখছে।
তারপর কুকিকে লাফাতে লাফাতে ওপাশে চলে যেতে দেখলুম। পিঙ্কিও তার পেছনে ছুটল। সিগারেট ধরিয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ করতে থাকলুম। কখনও ওরা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার ওদের দেখতে পাচ্ছি। তারপর কতক্ষণ আর দুটিকে দেখতেই পেলুম না।
কেমন একটা অস্বস্তি লাগল। লম্বা পায়ে ঢাল বেয়ে নেমে গেলুম। ওদের শেষবার যেখানে দেখেছি, সেইদিকে হাঁটতে থাকলুম। জায়গাটা উঁচুনিচু, এবড়ো খেবড়ো। অজস্র খানাখন্দ, কোথাও গভীর গর্ত, নানা গড়নের পাথর পড়ে রয়েছে। মধ্যে-মধ্যে বোপঝাড় বা কিছু গাছ। এপাশে-ওপাশে টিলা। একটা পাথরে উঠে ওদের খুঁজলুম। তারপর দেখলুম, একখানে দাঁড়িয়ে পিঙ্কি একটু ঝুঁকে কী করছে। কুকিকে দেখতে পেলুম না।
চেঁচিয়ে ডাকলুম,–পিঙ্কি! পিঙ্কি!
পিঙ্কি আমার দিকে ঘুরে হাত নেড়ে কী বলল। তখন দৌড়ে ওর কাছে চলে গেলুম। গিয়ে দেখি, পিঙ্কির সামনে একটা স্কুপের কিনারায় গুহার দরজার মতো প্রকাণ্ড একটা খোঁদল। সেইদিকে হাত বাড়িয়ে পিঙ্কি কঁদো-কঁদো মুখে বলল,–কুকি ওর ভেতর ঢুকে গেল। আর বেরুচ্ছে না–এত ডাকছি!
খোঁদলের কাছে গিয়ে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলুম। ফুট-চারেক গভীর একটা গর্ত–তারপর সুড়ঙ্গের মতো ভেতরে চলে গেছে খোঁদলটার। গর্তে ঘাস আর সামান্য ঝোঁপঝাড় গজিয়ে আছে। পিঙ্কি ব্যাকুলভাবে ডাকছিল,– কুকি! কুকি! সে শাসাচ্ছিল। আওি কুকি’ বলে ডাকাডাকি করলুম। কিন্তু কুকুরটার পাত্তা নেই।
এইসব গর্তের ভেতর নেকড়ে, চিতাবাঘ বা হায়না থাকাও সম্ভব। তাদের পাল্লায় পড়ল না তো বোকা কুকুরটা? বললুম,–দেখো তো কী বিপদ হল! ওকে নিয়ে কেন এখানে এসেছিলে!
পিঙ্কি চোখ মুছতে মুছতে কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল,–রোজই তো আসি। কুকির সঙ্গে লুকোচুরি খেলি।
কুকি ওখানে ঢুকতে গেল কেন?
পিঙ্কি মাথা নেড়ে বলল,–জানি না। হঠাৎ ঢুকে গেল।
খোঁদলটাতে মানুষের পক্ষেও ঢোকা সম্ভব। নিশ্চয় একটা পোড়োখনির মুখ এটা। ভেতরে ঘন অন্ধকার থমথম করছে। টর্চ থাকলে ঢুকতে পারতুম। তাই বললুম,তুমি এক কাজ করো বরং। দৌড়ে গিয়ে বাড়ি থেকে একটা টর্চ নিয়ে এসো। তোমার কুকিকে উদ্ধার করা যাবে।
পিঙ্কি তখুনি দৌড়ল। আমি পাশের একটা ঝোঁপ থেকে লাঠির মতো একটা ডাল ভেঙে নিলুম। সঙ্গে রিভলবারটা নেই। থাকলে ভালো হত। অগত্যা লাঠি ভরসা করেই ঢুকতে হবে।
লাঠিটা হাতে নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তোক খুঁজছিলুম, যদি দৈবাৎ কোনো দেহাতি লোক পেয়ে যাই, সেও মন্দ হবে না। পয়সার লোভে তাকে ওই খোদলে ঢুকিয়ে কুকিকে উদ্ধার করার চেষ্টা করা যায়। নাহলে অগত্যা নিজেকেই ঢুকতে হবে।
হঠাৎ একটু দূরে উঁচু পাথরের আড়াল থেকে কাউকে বেরুতে দেখলুম। সে ফাঁকায় পৌঁছুলে অবাক হয়ে দেখি, লাল কাপড়পরা এক সন্ন্যাসী। চেঁচিয়ে ডাকলুম,–সাধুবাবা! সাধুবাবা!
সাধুবাবা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর আমাকে দেখেই সাঁৎ করে আবার উঁচু পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিল। তারপর আর তাকে দেখতে পেলুম না। ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত তো! কর্নেল এই সাধুবাবার কথা বলেছিলেন না?
একটু পরে হাঁপাতে হাঁপাতে পিঙ্কি ফিরে এল। টর্চ এনেছে। ওর সঙ্গে ওদের চাকর দশরথও এসেছে। দশরথের সঙ্গে সকালে আলাপ হয়েছে। লোকটার বয়স হয়েছে বটে, এখনও চেহারাটি শক্তসমর্থ। হাসতে হাসতে বলল,–কুকি কেন ঢুকেছে, হামার মালুম হয়েছে স্যার! ভৈরবগড়ের কুত্তাদের কাছে কুকি শুনেছে কী, ইয়ে সব গুহার অন্দরে করাড়ি রোটি মিলতে পারে।
জিজ্ঞেস করলুম,–করাড়ি রোটি কী দশরথ?
দশরথ বলল,–ইয়ে সব গুহার অন্দরে ভালুকের ডেরা আছে। ভালুক মৌচাক ভেঙে মধু খায়। ঔর জঙ্গলের ফলভি খায়। খেয়ে সেইসব চিজ উগরে দেয়। যখন শুখা হয়, তখন তা রোটি হয়ে যায়। আদমিলোগভি ওহি রোটি পছন্দ করে। হামিভি একদফা খায়া স্যার! বহুত মিঠা।
তা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু ভেতরে ভালুক থাকলে যে বিপদ!
দশরথ হাসল। ভালুক অন্দরে আছে কিনা কুত্তার মালুম আছে, স্যার! ভালুক থাকলে কুত্তা অন্দরে ঘুসবে না।
ঠিক এইসময় খোঁদল থেকে একলাফে কুকি বেরিয়ে এল। মুখে একটুকরো কালচে রঙের পাঁউরুটির মতো জিনিস। দশরথ লাফিয়ে উঠল,–দেখিয়ে, দেখিয়ে! হাম ঠিক বোলা কি না!
পিঙ্কি কুকিকে কোলে তুলে নিয়ে আলতো দুটো চাটি মারল। তারপর তার মুখ থেকে করাড়ি রোটির টুকরোটা কেড়ে ছুঁড়ে ফেলল। দশরথ সেই টুকরোটা তুলে নিয়ে বলল,–ফেকো মাত্ দিদি। ইয়ে রোটি যে খাবে, সে তাকওয়ালা পালোয়ান হয়ে যাবে।
দশরথ আমাকে অবাক করে কুকুরের এঁটো সেই বিচিত্র বস্তুটি মাথায় ঠেকাল প্রসাদের মতো। তারপর ঝেড়েমুছে পকেটে ঢোকাল। তার মুখে খুশি উপচে উঠছিল।
হাঁটতে-হাঁটতে দশরথকে বললুম,–আচ্ছা দশরথ, ওখানে একজন সাধুবাবাকে দেখলুম। কিন্তু যেই আমি ওঁকে ডেকেছি, উনি লুকিয়ে পড়লেন কোথায়। ব্যাপারটা কী?
দশরথ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আমার মুখের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,–সা?
হ্যাঁ। একজন সাধুবাবাকে সত্যি দেখেছি, দশরথ।
দশরথের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। বলল,আপনি বহত্ পুণ্যবান স্যার, তাই দেখা পেলেন। ওখানে একজন সাধুবাবা থাকেন। লেকিন কেউ তার দেখা পায় না। যারা পায়, তারা বহুত পুর্ণবান আদমি।
তুমি কখনও দেখা পাওনি?
না স্যার! শুনা কি, সাধুবাবার ওমর দোশো বরষ আছে।
বলো কী? দুশো বছর বয়স!
জি হাঁ। ভৈরবগড়ে যাকে পুছ করবেন, সে বলবে।
তাহলে দশরথ, সেই চুরাইলটা কি সাধুবাবার পোষ্য পেত্নি?
আমি হাসতে হাসতে বললুম কথাটা। দশরথ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠে দু-কানে আঙুল ঢুকিয়ে বলল, রাম রাম! এই মুলুকে যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ উও নাম মুখে লিবেন না স্যার!
বলে সে চলার গতি বাড়িয়ে দিল। তার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠেছিল।
কর্নেল ও যদুবাবু বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। দশরথ কুকির কীর্তি বর্ণনা করল এবং ফতুয়ার পকেট থেকে ভালুকের বানানো রুটির টুকরোটাও দেখাল। যদুবাবু পিঙ্কিকে একটু বকাবকি করলেন। তারপ বললেন,–ওকে নিয়ে এই সমস্যা। যতক্ষণ স্কুলে থাকে, চিন্তা করি না। কিন্তু বাড়িতে থাকলেই কুকুর নিয়ে পোড়োখনির ওদিকে চলে যাবে। অথচ ইদানীং ভুলেও ভৈরবগড়ের লোকেরা ওদিকে পা বাড়ায় না।
কর্নেল দশরথের কাছ থেকে করাড়ি রোটির টুকরো নিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। ফেরত দিয়ে বললেন,–করাড়ি রোটির কথা দক্ষিণ ভারতের জঙ্গল এলাকায় গিয়ে শুনেছিলুম। এবার স্বচক্ষে দেখলুম।
যদুবাবু বললেন,–করাড়ি কেন বলে কে জানে!
কর্নেল বললেন,–তামিল ভাষায় ভালুককে বলে করাড়ি!
দশরথ সবার মুখের দিকে তাকিয়ে উসখুস করছিল। চাপা গলায় যদুবাবুর উদ্দেশে বলল, বড়বাবু, এই কলকাতার স্যারকে খনির সাধুবাবা দর্শন দিয়েছেন।
যদুবাবু চমকে উঠে বললেন,–তাই নাকি জয়ন্তবাবু?
বললুম,–হ্যাঁ। কয়েক সেকেন্ডের জন্য লাল কাপড় পরা জটাধারী এক সাধুবাবাকে দেখেছি।
যদুবাবু কর্নেলকে বললেন, আপনি কথাটা আমল দিচ্ছিলেন না কর্নেল। তাহলে দেখুন, যা রটে তা সত্যি বটে।
কর্নেল একটু হাসলেন। আমল দিইনি, তা নয়। বলছিলুম,–বিশ্বাস করা যায় এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী কাউকে পেলে ভালো হয়। যাই হোক, জয়ন্ত যখন দেখেছে, তখন গুজবটা সত্য প্রমাণিত হল।
কর্নেলের বুকে বাইনোকুলার ঝুলছিল। কথাটা বলার পর বাইনোকুলারটা চোখে রেখে পোড়োখনি এলাকার দিকে কী যেন দেখতে থাকলেন। যদুবাবু খুব আগ্রহে চাপা গলায় বলে, উঠলেন,–কিছু দেখতে পাচ্ছেন কি কর্নেল?
কর্নেল বললেন,–লাল ঘুঘু।
লাল ঘুঘু মানে? যদুবাবুর গলায় নৈরাশ্য ফুটে উঠল। আমি ভাবলুম বুঝি সাধুবাবাকে দেখতে পেয়েছেন!
কর্নেল বললেন,–এই লাল ঘুঘুপাখির ঝক সচরাচর দেখা যায় না। এরা ঊষর মরু অঞ্চলের বাসিন্দা। শীতের শেষদিকে চলে আসে উর্বর এলাকায়। বর্ষা পর্যন্ত কাটিয়ে আবার ফিরে যায়। বলে কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে এক-পা এক-পা করে হাঁটতে শুরু করলেন। বুঝলুম এবেলার মতো উধাও হতে চলেছেন। যদুবাবু একটু হেসে বললেন,–যার যা হবি! আসুন, জয়ন্তবাবু। আমরা ঘরে বসে গল্পগুজব করি ততক্ষণ।
যে ঘরে উঠেছি, সেই ঘরে গিয়ে বসলুম দুজনে। দশরথ চা আনতে গেল। পিঙ্কি তার কুকুর নিয়ে বাগানে খেলে বেড়াচ্ছে দেখতে পাচ্ছিলুম। যদুবাবু বললেন,–জয়ন্তবাবু, আপনি তো খবরের কাগজের লোক। এমন ঘটনা কখনও ঘটতে দেখে?
কী ঘটনা বলুন তো?
ভূতপ্রেতের হাতে মানুষ খুন! যদুবাবুর কণ্ঠস্বরে আতঙ্ক ফুটে উঠল। পুলিশ বলছে স্রেফ ডাকাতি। কিন্তু বলুন তো মশাই, ডাকাত কি মানুষের মুণ্ডু কেটে রক্ত খায়?
তা খায় না বটে।
যদুবাবু জানালার বাইরেটা দেখিয়ে বললেন,–আজ রবিবার। গত বুধবার রাত একটায় ওইখানে স্পষ্ট দেখেছি চুরাইল দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ি পরা কালো চেহারা। হাতে শাঁখা পরা, চোখ দুটো নীল। টর্চের আলোয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও তাকে স্পষ্ট দেখে নিয়েছি। মুখের চেহারা দেখলে রক্ত হিম হয়ে যাবে, মশাই! এই দেখুন না, গায়ে কাঁটা দিচ্ছে!
চুরাইলের পায়ের পাতা নাকি উলটো দিকে থাকে?
হুঁ। ঠিক তাই। টর্চের আলো ছিল খুব জোরালো। পা-দুটোও দেখে নিয়েছি না?
যে দুজন লোক চুরাইলের হাতে মার পড়েছে, তারা কে?
যদুবাবু হতাশভাবে একটু হাসলেন। তাদের বাড়িতে তো নিয়ে গিয়েছিলুম কর্নেলকে। একজনের নাম মাধব পাণ্ডে। বাজারের সেরা ব্যবসাদার ছিলেন পাণ্ডেজি। মহাজনি কারবারও ছিল। সুদে টাকা ধার দিতেন অভাবী লোককে। দ্বিতীয়জন হলেন রামনাথ মিশ্র। লোকে বলত মিছিরজি। উনি ছিলেন বড় ভালোমানুষ। পাণ্ডেজিরই কর্মচারী উনি।
ওঁরা খুন হয়েছেন কীভাবে?
বোঝা যাচ্ছে না, কেন পাণ্ডেজি অত রাতে বেরিয়েছিলেন। ঘরের দরজা খোলা ছিল। ভোরবেলা স্টেশনের কাছে মুণ্ডুকাটা লাশ পাওয়া যায়। তবে রাতে বাড়ির লোকে তো বটেই, পাশের বাড়ির লোকেরাও চুরাইলের ডাক শুনেছিল। মিছিরজি খুন হন তার পরের রাতে। মিছিরজিও স্টেশনের কাছে একটা বস্তিতে থাকতেন। তাঁরও ঘরের দরজা বাইরে থেকে আটকানো ছিল পেছনের জঙ্গলে তার মুণ্ডুকাটা লাশ পাওয়া গেছে। তাছাড়া সে-রাতেও ওই বস্তির লোকেরা চুরাইলের ডাক শুনেছিল।
কর্নেল কী বলছেন?
কিছু বলেননি এখনও। ঘটনা সম্পর্কে খোঁজখবর নিলেন। লাশ পড়ে থাকা জায়গাটাও দেখলেন। তারপর বললেন,–চলুন ফেরা যাক।
বুঝলুম যদুবাবু খুব হতাশ হয়ে গেছেন কর্নেলের হাবভাব দেখে।
.
তিন
লাল ঘুঘুর পেছনে সারা দুপুর ঘোরাঘুরি করে কর্নেল ফিরে এলেন বেলা গড়িয়ে। আমার খাওয়াদাওয়া সারা। অবেলায় কর্নেল খেতে বসলেন। বললুম, এরকম অনিয়ম করলে কিন্তু বেঘোরে মারা পড়বেন। আপনি কি ভাবছেন এখনও বুড়ো হননি?
কর্নেল সহাস্যে বললেন,–বৎস, সাদা দাড়ি মোটেও বার্ধক্যের লক্ষণ নয়। তোমার মতো অনেক যুবকেরও চুলদাড়ি সাদা হয়ে যেতে দেখেছি। ভেবো না; জীবনে দু-একটা দিন দেরি করে খেলে স্বাস্থ্যমশাই তত বেশি চটেন না। যাই হোক, তুমি তৈরি হয়ে নাও। বেরুব।
যদুবাবুর অনিদ্রার রোগ আছে। রাতে ঘুম হয় না বলে দিনে ঘুমোবার চেষ্টা করেন। দশরথ খাবার এনেছিল। যদুবাবুর মা করুণাময়ী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একবার তদারক করে চলে গেছেন। খাওয়ার পর কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন,–আচ্ছা দশরথ, তোমাদের ছোটবাবু কোথায় গেলেন? আজ ছুটির দিনে তো তার বাড়ি থাকার কথা!
দশরথ বলল,– ছোটবাবুর খোবর ছোটবাবুরই মালুম আছে স্যার! উহি ওই রোকম আছেন।
কী রকম?
দশরথ এদিক-ওদিক তাকিয়ে চাপা গলায় বলল,–রাতমে বড়বাবুর সঙ্গে বহুত কাজিয়া কোরেছিলেন। সুবেমে চাও-উও পিয়ে চলে গেলেন তো আভিতক আসলেন না। মাইজির সঙ্গেভি কাজিয়া কোরেন ছোটবাবু!
কেন বল তো?
দশরথ হাসল। রুপেয়াকে লিয়ে। হরঘড়ি রুপেয়া চাইলে কেত্তো রুপেয় দেবেন বড়বাবু? মাইজিই বা কোথা রুপেয় পাবেন বলুন স্যার?
রুদ্রবাবু তো চাকরি করেন। মাইনের টাকাতেও কুলোয় না নাকি?
দশরথ মুখ বেজার করে বলল,–ছোড়িয়ে দিন স্যার! ছোটবাবু জুয়াড়ি হোয়ে গেছেন।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন,–তাই বল! জুয়া খেললে মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি আর থাকে না। কই, এসো জয়ন্ত। আমরা বেরোই।
যদুবাবুর ভাই রুদ্রবাবুর সঙ্গে সকালে আমাদের সৌজন্যমূলক পরিচয় হয়নি। তবে ওঁকে দেখেছিলুম। রোগা গড়নের যুবক। রাগী চেহারা। গায়ে লাল রঙের গেঞ্জি, পরনে ছিল নেভি-ব্লু প্যান্ট। হাতে স্টিলের বালা। গলায় সরু চেনও দেখেছিলুম।
পোড়োখনি এলাকার দিকে পা বাড়িয়ে কর্নেল বললেন,–যদি রাত্রি পর্যন্ত এদিকে কাটাই, আমার বিশ্বাস চুরাইলের দর্শন পাব। কিন্তু তুমি ভয় পাবে না তো জয়ন্ত?
অবাক হয়ে বললুম,–আপনি কি চুরাইল দেখতেই বেরুলেন? কর্নেল আস্তে বললেন,–বলা যায় না, যদি দৈবাৎ তার দেখা পেয়ে যাই গতবারের মতো।
মার্চ মাসের এমন সুন্দর বিকেলে চুরাইলের ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। সত্যি বলতে কী, ভূতপ্রেতে আমার কস্মিনকালে বিশ্বাস নেই, যদিও ভূতের ভয় আমার আছে। কিন্তু কর্নেল গতবছর স্বচক্ষে পাোড়োখনির পেত্নিটাকে দেখেছেন বলছিলেন। ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যায় না।
কর্নেল মাঝেমাঝে বাইনোকুলার তুলে এদিকে-ওদিকে কী দেখছেন। এখনও দিনের আলো আছে। কাজেই নিশ্চয় লালঘুঘুর ঝক দেখছেন। একখানে হঠাৎ থেমে বললেন,–জয়ন্ত, করাড়ি রোটি কোন গুহায় ছিল চিনতে পারবে কী?
বললুম,–মনে হচ্ছে, বাঁদিকে যেতে হবে। ওই যে ঝোঁপগুলো দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত তার কাছাকাছি।
কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দেখলুম, পিঙ্কি হাতে একটা প্রকাণ্ড রঙিন বল নিয়ে একটা ঢিবির ওপর উঠে দাঁড়াল। তারপর বলটা ছুঁড়ে দিল। তখন ওর কুকুরটাকেও দেখতে পেলুম। অবাক হয়ে গেলুম ওর সাহস দেখে। কুকি বলটাকে কামড়ে ধরে ওর কাছে বয়ে আনার চেষ্টা করছে। বলটা বারবার মুখ থেকে পড়ে যাচ্ছে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন,–মেয়েটি সত্যি খুব সাহসী।
ডাকলুম, পিঙ্কি! পিঙ্কি!
পিঙ্কি একবার ঘুরে দেখল। তারপর একহাতে বল, অন্যহাতে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে দৌড়তে শুরু করল। একটু পরে দুজনেই কোথাও উধাও হয়ে গেল। বললুম,–মেয়েটির জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে, কর্নেল! কখন না কোন্ বিপদে পড়ে!
কর্নেল সেকথায় কান না দিয়ে বললেন,–করাড়ি রোটির গুহাটা খুঁজে বের করো, জয়ন্ত!
খুঁজে পেতে দেরি হল না। কর্নেল পকেট থেকে টর্চ বের করে বললেন,–তুমি এখানে বসে অপেক্ষা করো জয়ন্ত। আমি ভেতরটা দেখে আসি।
আঁতকে উঠে বললুম,–সে কী! আপনি ওর ভেতর ঢুকে কী করবেন?
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন,–করাড়ি রোটি খেলে মানুষ পালোয়ান হয়ে যায়, ডার্লিং!
কিন্তু ভেতরে যদি ভালুকটা থাকে?
তার সঙ্গে ভাব জমাবার মন্ত্র আমার জানা আছে। এই বলে কর্নেল কুয়োর মতো গর্তটাতে নেমে গেলেন। তারপর টর্চ বাগিয়ে সুড়ঙ্গের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলেন।
হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। প্রতি মুহূর্তে আশঙ্কা হচ্ছে, এক্ষুনি হয়তো দেখব কর্নেল ভালুকের আঁচড় খেয়ে রক্তারক্তি হয়ে এবং কোনোমতে প্রাণ নিয়ে ফিরেছেন। না, ভালুকের হাতে ওঁর মারা পড়ার কথা ভাবছি না। কারণ ওঁর কাছে রিভলবার আছে। কিন্তু ভালুকমশাই রুটিচোরকে একটু শিক্ষা না দিয়ে কি ছাড়বে?
তারপর আর কর্নেলের ফেরার নাম নেই। বেলা পড়ে এল। টিলাগুলোর ওধারে সূর্য অস্ত গেল। কুয়াশা ঘনিয়ে এল চারদিকে। ক্রমে আঁধার জমল। কর্নেল ফিরছেন না। অস্বস্তিতে বুক কাঁপছে।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে পিঙ্কিকে খুঁজলুম। কোথাও দেখলুম না। নিশ্চয় মেয়েটা এতক্ষণ তার কুকুরটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে। দুরুদুরু বুকে ভাবছি কী করব। আমার সঙ্গেও টর্চ, রিভলবার আছে। ঢুকব নাকি ভেতরে? কিন্তু ঠিক তখনই বাঁদিকে খুব কাছেই এক বিকট চিৎকার শুনতে পেলুম।
ঘুরে কিছু দেখতে পেলুম না। অন্ধকারে কেউ ওই বিদঘুঁটে আর্তনাদ করে চলেছে। কাঁপাকাঁপা একটানা চেরা গলার চিৎকার–বিপদজ্ঞাপক সাইরনের মতো। অমনি শরীর হিম হয়ে গেল। এ তো চুরাইলেরই চিৎকার! কর্নেল ঠিক এমনি একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন।
আড়ষ্ট হাতে টর্চের বোতাম টিপলুম। একঝলক আলো ছড়িয়ে গেল। তারপর দেখতে পেলুম পোতখনির পেত্নিটাকে। কালো কুচকুচে গড়ন। মানুষের মতো কিংবা আদতে মানুষের মতো নয়ই, আমার চোখের ভুল হতেও পারে। কী হিংস্র তার মুখ আর নিষ্পলক নীলচে দুটো চোখ! তার পায়ের পাতা সত্যি উলটো ঘোরানো কিনা দেখার চেষ্টা করতেই সে আবার চেঁচিয়ে উঠল –আঁ আঁ আঁ আঁ … ইঁ ইঁ ইঁ ইঁক! এমন অমানুষিক চিৎকার কোনো প্রাণীর নয়, তা আমি হলফ করে বলতে পারি।
টর্চের আলোয় তাকে এগিয়ে আসতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে রিভলবার বের করলুম। তার দিকে তাক করে ট্রিগারে চাপ দিলুম। রিভলবারটা অটোমেটিক। কিন্তু আশ্চর্য গুলি বেরুল না। ঘাবড়ে গিয়ে আবার ট্রিগারে চাপ দিলুম। এবারও গুলি বেরুল না। অমনি মনে পড়ল, অটোমেটিক বলে রিভলবারে গুলি ভরে রাখিনি। কারণ দৈবাৎ গুলি ছুটে যাবার ভয় থাকে।
ততক্ষণে চুরাইলটা কাছাকাছি এসে পড়েছে। পকেট থেকে গুলি বের করতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে টর্চটা হাত থেকে পড়ে গেল এবং নিবে গেল। এবার মনে হল অন্ধকারে ডুবে গেছি। কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে গুলিগুলো ভরে ট্রিগারে চাপ দিলুম। এবার রিভলবারটা গর্জে উঠল। পর পর দুটো গুলি ছোড়ার পর চুরাইলের চিৎকার থেমে গেল। মারা পড়েছে ভেবে সাহসী হয়ে পা বাড়াচ্ছি, কেউ শিস দিল কোথাও। সেই সময় আমার পিছনে কর্নেলের ডাক শুনতে পেলুম,–জয়ন্ত! জয়ন্ত!
চেঁচিয়ে বললুম,–টর্চ জ্বালুন শিগগির। পেত্নিটাকে আমি গুলি করে মেরেছি।
কর্নেলের হাসি শোনা গেল। পেত্নিকে কখনও গুলি করে মারা যায় না ডার্লিং!
আঃ! টর্চ জ্বালুন না কেন?
তোমার টর্চ কী হল?
কোথায় পড়ে গেছে।
আমার টর্চটা কেউ খনিগুহার ভেতর কেড়ে নিয়েছে।
কর্নেল কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললুম,–সে কী! কেড়ে নিয়েছে মানে?
কর্নেল চুরুট ধরালেন লাইটার জ্বেলে। তারপর বললেন,–খনিটা ছিল ডলোমাইটের। ভেতরটা বেশ চওড়া। এপাশে-ওপাশেও অনেক খোঁদল আছে। করাড়ি রোটি খুঁজছি, হঠাৎ কে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে আমাকে ফেলে দিল। টর্চটা ছিটকে পড়ে নিবে গেল। উঠে আর খুঁজেই পেলুম না। লাইটারের আলোয় কোনোরকমে বেরিয়ে এলুম। এসে দেখি, চুরাইলের সঙ্গে তোমার যুদ্ধ চলছে।
আমিও সিগারেট ধরালাম। তারপর লাইটারের আলোয় কয়েক পা এগিয়ে টর্চটা খুঁজে পেলুম। টর্চের আলোয় নিরাশ হয়ে দেখলুম কোথাও গুলিবিদ্ধ চুরাইল পড়ে নেই। একফোঁটা রক্তও নেই। ভূতপেত্নিদের হয়তো রক্ত থাকার কথা নয়। গুলি তাদের গায়ে লাগার কথা নয়। তবে আওয়াজে তারা ভয় পেতেও পারে। বললুম,–ব্যাপারাটা কী হতে পারে বলুন তো কর্নেল?
কোন্ ব্যাপারটা?
চুরাইল?
কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন,–নিছক পেত্নি ছাড়া কিছু নয়, সে তো বুঝতেই পারছ।
কিন্তু আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে, ভূতপেত্নি বলে সত্যি কিছু থাকতে পারে।
স্বচক্ষে দেখেও? কর্নেল হঠাৎ গলাটা নামিয়ে বললেন,–যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে যে আমাদের এ-তল্লাটে ঘোরাঘুরি করাতে চুরাইলের ভীষণ আপত্তি আছে। তাই সে ভয় দেখাতে এসেছিল।
চারদিকে ভয়ে-ভয়ে আলো ফেলে আমরা হাঁটছিলুম। হাতে রিভলবারও তৈরি। কর্নেলের কথার জবাবে কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না।
কর্নেল টর্চের আলোয় একটুকরো লাল রঙের ছেঁড়া কাপড় দেখিয়ে বললেন, আমাকে ধাক্কা মারতেই আমিও তাকে ধরার চেষ্টা করেছিলুম। তার পরনের কাপড়ের এই টুকরোটা আমার হাতে থেকে গেছে। তুমি বলেছিলে, সাধুবাবার পরনে লাল কাপড় দেখেছ। কাজেই সে সেই সাধু ছাড়া আর কে হতে পারে? সম্ভবত অন্য কোনো সুড়ঙ্গ দিয়ে ওখানে যাওয়া যায়। সে আমাকে ফলো করেছিল অন্যদিক থেকে।
আমার মাথায় চমক খেলে গেল। বললুম,–কর্নেল! অনেক তান্ত্রিক সাধু প্রেতসিদ্ধ হন শুনেছি। তাদের নাকি পোষা ভূতপ্রেত থাকে। চুরাইল বা শাঁখচুন্নিটা ওই সাধুর পোষা নয় তো?
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে এতদিনে তুমি স্বীকার করলে যে ভূতপ্রেত সত্যি আছে?
কী জানি। কিন্তু আপনিও তো ওসবে বিশ্বাস করেন না!
কর্নেল হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললেন,–আলবাত করি। কে বলল করি না?
তারপর ডানদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে তেমনি চড়া গলায় বলে উঠলেন, কী রুদ্রবাবু! এখানে কী করছেন–অন্ধকারে?
টর্চের আলো সেদিকে ফেলে দেখি,যদুবাবুর ছোটভাই রুদ্রনারায়ণ একটা পাথরের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। খেঁকিয়ে উঠলেন একেবারে,–আঃ! আলো নেবান তো মশাই!
টর্চ নিবিয়ে দিলুম। কর্নেল বললেন,আসুন! বাড়ি যাবেন না?
না।
আহা! খামোকা বাড়ির লোকের ওপর রাগ করে আর কী হবে রুদ্রবাবু? তাছাড়া এখানে অন্ধকারে বসে থাকাও তো বিপজ্জনক। একটু আগে আপনি কি চুরাইলের ডাক শোনেননি?
রুদ্রবাবু আরও খেঁকিয়ে উঠলেন,–যান মশাই! আপনাদের আর ভালোমানুষি করতে হবে না! আমাকে চুরাইল দেখাচ্ছেন! নিজেদের মাথা বাঁচান আগে–তারপর কথা বলতে আসবেন!
কর্নেল আর কথা বাড়ালেন না। বললেন,–চলো জয়ন্ত! রুদ্রবাবু ভীষণ চটে আছেন মনে হচ্ছে ।
ওঁদের বাগানের কাছাকাছি যেতেই লণ্ঠন হাতে দশরথকে দেখা গেল। আমাদের দেখে সে আশ্বস্ত হল। তার হাতে একটা বল্লমও দেখতে পাচ্ছিলুম। বলল,–বড়বাবু আপনাদের লিয়ে বহত শোচ করছেন স্যার। পিঙ্কিদিদি বলল কী, কর্নিল স্যারদের খনির অন্দরে ঘুসতে দেখেছে। ঔর আপনারা এত্তা দেরি করলেন!
বুঝলুম, দশরথের ইচ্ছে ছিল না আমাদের খুঁজতে যাওয়ার। কর্তাবাবুর চাপে পড়ে তাকে বেরুতে হয়েছে। সে যে ভীষণ ভীতু মানুষ, তাতে সন্দেহ নেই।
যদুবাবু অপেক্ষা করছিলেন ব্যস্তভাবে। বললেন,–খুব ভাবছিলুম কর্নেল! এদিকে এক কাণ্ড হয়েছে শুনুন। মায়ের আলমারি থেকে একটা পুরনো দলিল চুরি গেছে। আপনি আমার বাবার খনির দলিল দেখতে চেয়েছিলেন। ওই দলিলটাও তার মধ্যে ছিল। মা বলছেন, এ নিশ্চয় রুদ্রের কাজ। রুদ্রের সঙ্গে এ-নিয়ে আমারও একচোট হয়ে গেল। বাবু রাগ করে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল বললেন,–রুদ্রবাবুকে মাঠে বসে থাকতে দেখে এলুম।
যদুবাবু বাঁকা মুখে বললেন,–চুরাইলের পাল্লায় পড়লেই বাছাধন টের পাবে! তারপর দশরথকে চায়ের হুকুম দিয়ে কর্নেলের মুখোমুখি বসলেন।
কর্নেল বললেন,–ও দলিল রুদ্রবাবু কী করবেন?
যদুবাবু চাপা গলায় বললেন, আপনাকে বলেছিলুম, ওই দলিলটা আনরেজিস্টার্ড। নন্দলাল ওঝা নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন বাবার খনিব্যবসার পার্টনার। নন্দবাবু নিজের একার নামে একটা পোড়োখনি কিনেছিলেন আরেকজনের কাছে। কেন কিনেছিলেন জানি না। পরে যখন সব খনি অ্যাবান্ডান্ড হয়ে গেল, বাবার মাথায় কেন কে জানে ঝোঁক চাপল, নন্দবাবুর কেনা, সেই প্রাচীন অ্যাবান্ডান্ড খনিটা কিনতে চাইলেন। নন্দবাবু কিছুতেই বেচতে রাজি নন। বাবাও ছাড়বেন না। অবশেষে পঞ্চাশ হাজার টাকা দাম হাঁকলেন নন্দবাবু। বাবা তাই দিলেন। ব্যাপারটা আমার কাছে আজও রহস্য। যাই হোক, পরদিন রেজেস্ট্রি হওয়ার কথা। রাতে হঠাৎ নন্দবাবু ভেদবমি হয়ে মারা গেলেন। দলিল আর রেজেস্ট্রি করা হল না। কিন্তু এ দলিল চুরি যে রুদ্রই করেছে, তাতে ভুল নেই। সে বরাবর মায়ের ওই দলিলটা চাইত। বলত, তার দরকার আছে। কী দরকার সেই জানে। আমার সঙ্গে তো ভালো করে কথাবার্তাই বলে না।
নন্দবাবুর ছেলেপুলে আছে কি?
নন্দবাবু ছিলেন উড়নচণ্ডী স্বভাবের লোক। বেশি বয়সে বিয়ে করেছিলেন। ওঁর মৃত্যুর পর সেই ভদ্রমহিলা কলকাতায় দাদার কাছে চলে যান। যতদূর জানি, তার কোনো ছেলেপুলে নেই।
নন্দবাবুর আর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল না ভৈরবগড়ে?
এক পিসতুতো না মাসতুতো দাদা ছিলেন। তিনি তো বছর আষ্টেক আগে নিরুদ্দেশ।
কী নাম ছিল ভদ্রলোকের?
যদুবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন,–পান্নাবাবু।
কর্নেল বললেন,–সেই পোড়োখনিটা কোথায় আপনি কি জানেন?
যদুবাবু মাথা দোলালেন,–না। বাবার এক উদ্ভট খেয়াল ছাড়া আর কী বলব? নিজেদের সব খনি অ্যাবন্ডা হয়ে গেল। আবার একটা অ্যাবান্ডা খনি কিনে বসলেন পঞ্চাশ হাজার টাকায়। কী । অদ্ভুত ব্যাপার,?
খনিটা কোথায়, দলিলটা দেখতে পেলে জানা যেত। কর্নেল চিন্তিতভাবে বললেন। সমস্যা হল যে দলিলটা আনরেজিস্টার্ড। কাজেই রেজেস্ট্রি অফিসে তার কপি মিলবে না।
এতক্ষণে বললুম,–পোড়োখনির ভেতর কোনো দামি জিনিস–ধরুন গুপ্তধন লুকোনো ছিল না তো?
যদুবাবু নড়ে বসলেন। ঠিক, ঠিক। কী আশ্চর্য! এ-কথাটা তো আমার মাথায় আসেনি! আপনি হয়তো ঠিকই বলেছেন জয়ন্তবাবু! ইশ, কেন যে দলিল থেকে ওই পোড়োখনির সীমানা-চৌহদ্দি টুকে রাখিনি!
দশরথ চা এনে দিল। তারপর গাল চুলকে কর্নেলের দিকে তাকিয়ে বলল,–করাড়ি রোটি মিলা হ্যায় স্যার?
কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে সত্যি সত্যি একটুকরো করাড়ি রোটি বের করে ওকে দিলেন। দশরথ সেটা ভক্তিভরে দুহাতে নিয়ে মাথায় ঠেকাল। তারপর খুশি হয়ে বেরিয়ে গেল । যদুবাবু বললেন, এখানকার লোকের এই এক অদ্ভুত বিশ্বাস! ওই কুৎসিত পদার্থটা খেলে নাকি বুড়োরাও যুবকের শক্তি ফিরে পায়। তবে দশরথ করাড়ি রোটি খেলে কী হবে? গাঁজা খায় যে! গাঁজা ওটার সব গুণ নষ্ট করে দেবে।
দশরথ বাইরে থেকে প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল,–রামজির কিরিয়া বড়বাবু! হামি কভি গাঁজা পিই না।
যদুবাবু ধমক দিয়ে বললেন,–খাস না! তাই রাতে ডাকলে তোর সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না!
একটু পরে চা খেতে খেতে বললুম,–কর্নেল, নন্দবাবুর সেই পোড়োখনিটাতে গুপ্তধন থাকার ব্যাপারে আপনার কী মতামত, এখনও বলেননি কিন্তু!
কর্নেল কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করেছিলেন, সেই সময় বাইরে পায়ের ধুপধাপ শব্দ শোনা গেল। তারপর কেউ দৌড়ে বারান্দায় উঠল। যদুবাবু বললেন,–কে? কে? বাইরের লোকটা সশব্দে আছাড় খেল যেন। কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। এই সময় দশরথের চাপা আর্তনাদ শোনা গেল, হায় রাম! এত্তা খুন!
বাইরের আলোটা মিটমিটে। আমরা হন্তদন্ত বেরিয়ে দেখি, বারান্দায় রুদ্রবাবু পড়ে আছেন। তার গলার কাছে ক্ষতচিহ্ন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে। যদুবাবু হুমড়ি খেয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, রুদ্র! রুদ্র! কে তোর এ দশা করল রে? তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন ছেলেমানুষের মতো।
কর্নেল রুদ্রবাবুর দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, রুদ্রবাবু! কে আপনাকে মেরেছে?
রুদ্রবাবু অতিকষ্টে বললেন,–বিশ্বাসঘাতক! তারপর তাঁর শরীর স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে স্থির হয়ে গেল। বুঝলুম, বেচারার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল। আর ঠিক তখনই বাগানের গাছপালার
ওদিকে কোথাও সেই চুরাইলের ডাক শোনা গেল … আঁ—আঁ—আঁ–ইঁ—ইঁ–ইঁক!
একটা প্রচণ্ড বিভীষিকার রক্ত-হিম-করা আতঙ্ক আমাদের কয়েক মুহূর্তের জন্য নিঃসাড় করে ফেলল।
.
চার
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। পুলিশ এসে প্রাথমিক তদন্ত করে মর্গে লাশ চালান দিয়েছিল। পুলিশের হাবভাবে বুঝেছিলাম, দায়সারা করে চোর-ডাকাতের ওপরই ব্যাপারটা চাপাতে চায়। কর্নেলকে মোটও পাত্তা দেয়নি পুলিশ। সকালে দশরথ চা এনে যখন আমার ঘুম ভাঙাল, তখন আটটা বেজে গেছে। উঠে দেখলুম, কর্নেল নেই। দশরথ বলল,–কর্নেল স্যার সুবেসে বেরিয়েছেন। কুছু বোলেননি।
কর্নেল ফিরলেন ঘন্টাখানেক পরে। জিজ্ঞেস করলে বললেন,–মর্গে গিয়েছিলুম। মর্গের ডাক্তারের মতে, পাণ্ডেজি আর মিছিরজির মতো কেউ রুদ্রবাবুর মুণ্ডু কাটার চেষ্টা করেছিল।
বললুম,–রুদ্রবাবু মৃত্যুর আগে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছেন কর্নেল। ব্যাপারটা রহস্যময় নয়?
কর্নেল সায় দিয়ে বললেন,–তা তো বটেই! তবে পুলিশ বলছে, খুনী রুদ্রবাবুর পরিচিত লোক। আর খুনের উদ্দেশ্য হল ছিনতাই।
অবাক হয়ে বললুম,–ছিনতাই! উনি কি ওই মাঠে টাকাকড়ি নিয়ে বসেছিলেন?
হ্যাঁ। কারণ আজ ভোরে পুলিশ ইন্সপেক্টর পরমজিৎ সিং পোড়োখনির ওখানে কোথায় রক্তমাখা একশো টাকার নোটের বান্ডিল কুড়িয়ে পেয়েছেন। ছিনতাই করে পালাবার সময় খুনীর হাত থেকে পড়ে গিয়ে থাকবে।
অত টাকা নিয়ে ওখানে কী করছিলেন রুদ্রবাবু? পেলেনই বা কোথায় অত টাকা?
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন,–এমনও তো হতে পারে, খুনীরই টাকা ওগুলো। অর্থাৎ রুদ্রবাবু সেই দলিলটা চুরি করে তাকেই বেচতে গিয়েছিলেন। দলিল হাতিয়ে এবং টাকা মিটিয়ে হঠাৎ খুনী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রুদ্রবাবু আহত অবস্থায় কোনোরকমে পালিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু টাকার বান্ডিলটা পড়ে যায়।
তাও হতে পারে বৈকি।
কর্নেল কিছুক্ষণ গুম হয়ে সাদা দাড়ি টানতে শুরু করলেন। বুঝলুম, সূত্র হাতড়াচ্ছেন। তারপর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–এসো জয়ন্ত, আমরা একবার পাণ্ডেজির গদি থেকে ঘুরে আসি।
রাস্তায় যেতে যেতে বললুম,–কিন্তু একটা রহস্য কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। রুদ্রবাবুর পিছন পিছন চুরাইল বা শাঁখচুন্নিটাও ছুটে এসেছিল। তার চিৎকার আমরা শুনতে পেয়েছিলুম। এখন কথা হল …
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,–আরও জট পাকিয়ে যাবে, ডার্লিং! এখন সবচেয়ে দরকারি কাজ হল মাথা ঠাণ্ডা রাখা। চুরাইল-রহস্য নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আপাতত শুধু হত্যাকাণ্ডের দিকে লক্ষ্য রেখে এগোতে চাই।
ভিড়ে ভরা বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আমরা স্টেশনে পৌঁছলুম। পাণ্ডেজির গদি স্টেশনের ওধারের। ওদিকটায় চুন-সুরকির আড়ত, কাঠগোলা, ছোট কলকারখানা। আর কিছু চা-সিগারেটের দোকান আছে। এখানে প্রকাণ্ড তরাজুতে খন্দের বস্তা বোঝাই হচ্ছে। কর্নেলকে দেখতে পেয়ে একজন ফর্সা সুশ্রী চেহারার ভদ্রলোক উঁচু তক্তপোশ থেকে নেমে এসে নমস্কার করলেন। কর্নেল পরিচয় করিয়ে দিলেন, পাণ্ডেজির জামাই মোহনবাবু। মোহনবাবু পরিষ্কার বাংলা বলেন। খুব খাতির করে বসালেন। চা-সন্দেশ এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
কর্নেল বললেন,–মোহনজি, আপনাকে পুরনো খাতাপত্র দেখতে বলেছিলুম গতকাল। দেখেছেন কি?
মোহনজি পেছনের তাক থেকে একটা প্রকাণ্ড পুরনো খাতা নামিয়ে বললেন,–দেখেছি কনের্ল। শ্বশুরমশাই নিজে এই খাতাটা লিখতেন। এটা ওঁর মহাজনি কারবারের খাতা। এই দেখুন, এই পাঁচজন খাতকের নাম আমি খুঁজে বের করেছি। এঁরা প্রত্যেকেই মোটা টাকা ধার নিয়েছিলেন। এখনও কারুর কারুর বাকি আছে।
খাতার ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করে দিলেন মোহনজি। কর্নেল সেটা দেখতে থাকলেন। উঁকি মেরে দেখলুম, নামগুলো ইংরেজিতে লেখা। সাত নম্বর নামটা দেখে চমকে উঠলুম। রুদ্রনারায়ণ দেব–তিন হাজার টাকা। সুদের হার শতকরা মাসে তিরিশ টাকা। পুরোটাই বাকি।
কর্নেল বললেন, হ্যান্ডনোটগুলো পেয়েছেন মোহনজি?
মোহনবাবু বললেন,–হ্যাঁ। ছখানা পেয়েছি। একখানা পাইনি। মনে পড়ছে, ওই হ্যান্ডনোটখানার জন্য শ্বশুরমশাই মিছরজিকে খুব বকাবকি করছিলেন। মিছরজিকে উনি খুব বিশ্বাস
করতেন তো! আলমারির চাবি অনেক সময় মিছিরজির কাছেও থাকত।
কর্নেলের চোখ দুটো উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। বললেন,–কবে বকাবকি করছিলেন মনে আছে?
এই তো–যে-রাতে শ্বশুরমশাই খুন হলেন, তার আগের দিন।
মিছিরজি খুন হল তার পরের রাতে। তাই না?
হ্যাঁ। মোহনবাবু একটু অবাক হলেন যেন। বললেন, আপনি কি মনে করছেন হ্যান্ডনোট হারানোর সঙ্গে ওঁদের খুন হওয়ার সম্পর্ক আছে?
কর্নেল একটু হেসে বললেন,–উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
মোহনবাবুকে উত্তেজিত দেখাল। কিন্তু আমিও যে সে-রাতে চুরাইলের ডাক শুনেছিলাম, কর্নেল! কাল রাতে যদুবাবুর ভাইয়ের বেলাতেও শুনলুম নাকি চুরাইল ডেকেছিল!
হ্যাঁ। ডেকেছিল। আমিও শুনেছি।
মোহনবাবু আরও উত্তেজিতভাবে চাপা গলায় বললেন,–তাছাড়া শ্বশুরমশাইয়ের ডেডবডিতে যেমন, তেমনি মিছিরজির ডেডবডিতেও একফোঁটা রক্ত ছিল না। মর্গের রিপোর্টেও সেকথা উল্লেখ করা হয়েছে। আপনি স্থানীয় বুড়োবুড়িদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, চুরাইল নাকি মানুষের মুণ্ডু ছিঁড়ে গলা থেকে রক্ত চুষে খায়। রুদ্রবাবুর বেলায় অবশ্য মুণ্ডু ছিঁড়ে রক্তচোষার সুযোগ পায়নি শুনেছি। তবে গলায় নখ বসিয়ে মুণ্ডু ছিঁড়তে চেষ্টা করেছিল। তাই কিনা বলুন?
কর্নেল আস্তে বললেন,–ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এবার বলুন, এই তালিকার কোন্ খাতকের হ্যান্ডনোট পাওয়া যায়নি।
মোহনবাবু তালিকার একটা নামে ডটপেনের চিহ্ন দিয়ে বললেন,–এঁর। কিন্তু সমস্যা হল, ইনি পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়েছেন বছর দশেক আগে। সুদে-আসলে এখন দাঁড়িয়েছে … মাই গুডনেস! হিসেবে ভুল হয়নি তো?
কর্নেল দেখে নিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,–না। মাসেই যদি শতকরা তিরিশ টাকা সুদ হয়, তাহলে একমাসে পাঁচ হাজার টাকার সুদ হবে পনেরোশ টাকা। বছরে আঠারো হাজার টাকা। দশ বছরে দাঁড়াবে একলক্ষ আশি হাজার টাকা। সুদসহ ১,৮৫,০০০ টাকা। সহজ হিসেব।
মোহনবাবু হতাশ মুখে হাসলেন। কিন্তু খাতক ভদ্রলোকই তো সেই থেকে নিরুদ্দেশ।
আমার মাথায় গতরাতে যদুবাবুর কাছে শোনা একটা নাম ঝিলিক দিল। বলে ফেললুম,–সেই খনিমালিক নন্দনবাবুর পিসতুতো না মাসতুতো দাদা পান্নাবাবু নন তো?
মোহনবাবু বললেন,–ঠিক, ঠিক। পান্নালাল ওঝা। আমি তাঁকে কখনও দেখিনি। কারণ আমার বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আগে। তাছাড়া থাকতুম ধানবাদে। গতবছর শ্বশুরমশাইয়ের অনুরোধে ওঁর ব্যবসার দেখাশুনা করতে এসেছি।
ওপাশে একজন বৃদ্ধ কর্মচারী খাতা লিখতে-লিখতে আমাদের কথা শুনছিলেন। বললেন, –পান্নাবাবুর কনট্রাকটারি কারবার ছিল। লেবার সাপ্লাই করতেন। সেবার কারবারে লস খেয়ে বিপদে পড়েছিলেন। পাণ্ডেজি সেদিন ওঁকে পাঁচ হাজার টাকা না দিলে লেবাররা ওঁকে মেরে ফেলত। মজুরি মেটাতে পারছিলেন না।
কর্নেল বললেন,–পান্নাবাবুর চেহারা কেমন ছিল?
বৃদ্ধ কর্মচারীটি বাঙালি। বললেন,–রোগা, ঢ্যাঙা মতো। রঙটা বেশ ফর্সা। চোখ দুটো ছিল খয়রা–যাকে বলে বেড়ালচোখো।
কর্নেল মোহনবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন,–পাণ্ডেজি টাকা আদায়ের জন্য মামলা করেননি?
সেই বাঙালি কর্মচারী ভদ্রলোক বললেন,–জামাইবাবু জানেন না। মামলা করেছিলেন পাণ্ডেজি। দেওয়ানি মামলা, তাতে অন্যপক্ষ গরহাজির। শেষে পাণ্ডেজি প্রতারণার মামলা করেছিলেন। পান্নাবাবুর নামে হুলিয়া জারি হয়েছিল। কিন্তু ওঁকে পুলিশ খুঁজে পায়নি।
মোহনবাবু বললেন,–আশ্চর্য, শ্বশুরমশাই এ-কথাটা তো বলেননি! কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,–চলি মোহনজি! দরকার হলে আবার আসব।
স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসে কর্নেল বললেন,–এসো তো জয়ন্ত, আমরা রেললাইন ধরে পোড়োখনি এলাকায় যাই। দিনদুপুরে আশা করি চুরাইলটার আবির্ভাব ঘটবে না।
পোড়োখনির উত্তর-পূর্বে জঙ্গল আর টিলার ভেতর দিয়ে রেললাইনটা ঘুরে গেছে ধানবাদের দিকে। কিছুক্ষণ পরে আমরা রেললাইন থেকে নেমে একটা টিলার পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকলুম। এদিকটায় অজস্র খানাখন্দ, বড়-বড় পাথর, লালমাটির ঢিবি আর ঝোঁপঝাড়। এক জায়গায় গিয়ে কর্নেল হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। বললাম,–কী?
কর্নেলকে উত্তেজিত মনে হল। চাপা গলায় বললেন,–আরে! সাধুবাবা যে!
চমকে উঠে বললুম–কই, কই?
কর্নেল আচমকা হ্যাঁচকা টানে আমাকে বসিয়ে দিলেন এবং নিজেও বসলেন। ফিসফিস করে বললেন,–এসো, আমরা গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাই। সাবধান, যেন সাধুবাবা দেখতে না পায়।
সাধুবাবাকে আমি দেখতে পাইনি। কর্নেলের পেছনে-পেছনে ছোটবড় পাথর, ঝোঁপঝাড় আর ঢিবির আড়ালে অন্ধের মতো প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। প্রকাণ্ড একটা পাথর দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পাথরটার একপাশে ঘন ঝোঁপঝাড়। সেখানে হাঁটু দুমড়ে বসে। কর্নেল ঝোঁপের ভেতর উঁকি দিলেন। দেখাদেখি আমিও উঁকি দিলুম। একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল।
লাল-কাপড়-পরা সেই সাধুবাবা যেন পিঙ্কির কুকুর কুকির সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। কিন্তু ধারেকাছে কোথাও পিঙ্কি নেই।
পিঙ্কি নেই। অথচ কুকি আছে। ব্যাপারটা আমার গোলমেলে মনে হল। কিন্তু ওকি সত্যি লুকোচুরি খেলা? কুকি পাথরের আড়ালে লুকোতেই সাধুবাবা একটুকরো পাথর তুলে ছুঁড়ে মারলেন। কুকি আবার আরেকটা পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। সাধুবাবার মুখের চেহারা দেখে চমকে উঠলুম। রাগে খেপে গেছেন যেন। আবার পাথর কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলেন। অল্পের জন্য কুকি বেঁচে গেল। এবার সে আমাদের দিকে দৌড়তে শুরু করল। সাধুবাবা তাড়া করে আসতেই একটা খাদে আছাড় খেয়ে পড়লেন। খাদটা গভীর বলে মনে হল। ততক্ষণে কুকি যেন আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়েছে। সে সোজা এসে ঝোপে ঢুকল। কর্নেল মৃদু শিস দিলেন। কুকি থমকে দাঁড়াল। এতক্ষণে দেখলুম, তার মুখে একটা ছোট্ট হ্যান্ডব্যাগ রয়েছে। কর্নেল আবার শিস দিলে সে কাছে চলে এল। কর্নেল তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মুখের হ্যান্ডব্যাগটা ছাড়িয়ে নিলেন। বললেন,–শিগগির জয়ন্ত! সাধুবাবাকে এখনই ধরে ফেলতে হবে।
ঝোঁপ থেকে বেরিয়ে গেলুম। কর্নেল আমার পিছনে। তার কোলে কুকি। সাধুবাবা এতক্ষণে গর্ত থেকে উঠেছেন। কিন্তু আমাদের দেখেই থমকে দাঁড়ালেন। আমি রিভলবার বের করে চেঁচিয়ে বললুম,–খবরদার সাধুবাবা! পালাবার চেষ্টা করলে গুলি ছুঁড়ব।
সাধুবাবা অমনি দৌড়ে গিয়ে একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন। আমিও দৌড়লুম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আর তার পাত্তা পেলুম না। আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করে হন্যে হয়ে কর্নেলকে ডাকলুম। একটু তফাতে কর্নেল কোনো অদৃশ্য জায়গা থেকে সাড়া দিয়ে বললেন, এখানে চলে এসো জয়ন্ত!
একটা পোড়োখনির মুখই হবে। বিরাট গর্ত। সেই গর্তে কি কর্নেল সাধুবাবার মতো পা হড়কে পড়ে গেছেন? কাছে গিয়ে দেখি, আরও অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। গর্তের ভেতর বেচারি পিঙ্কির মুখ একটুকরো লাল কাপড়ে বাঁধা। দু’হাত এবং পা-দুটো লতা দিয়ে বাঁধা। কুকি তার দিকে যেন অবাক চোখে তাকিয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কর্নেল তার বাঁধন কেটে দিচ্ছেন ছুরি দিয়ে।
কর্নেল বললেন, আমরা না এসে পড়লে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হত, ভেবে শিউরে উঠছি জয়ন্ত!
পিঙ্কি কিন্তু মোটেও ঘাবড়ে যায়নি। দিব্যি উঠে দাঁড়াল। তারপর কুকিকে কোলে নিয়ে দুবার তার গালে চড় মারল,আর যদি কখনও গুহায় ঢুকিস, তোকে মেরে ফেলব বলে দিচ্ছি!
কর্নেল তাকে ওপরে তুলে ধরলেন। আমি টেনে নিলুম। তারপর কর্নেলকে উঠতে সাহায্য করলুম। কর্নেল পিঙ্কির কাঁধে হাত রেখে বললেন, তোমাকে সাধুবাবা কেন বেঁধে রেখেছিল, পিঙ্কি?
পিঙ্কি বলল,–কুকি সাধুবাবার ব্যাগ নিয়ে এসেছিল গুহার ভেতর থেকে। সাধুবাবা ওর পেছন-পেছন এসে আমাকে বলল, পিঙ্কি, তোর কুকুর আমার ব্যাগ চুরি করেছে। পিঙ্কি হাসতে লাগল। আমি বললুম, সাধুবাবা! তুমি পারো তো ওর কাছে চেয়ে নাও। তখন সাধুবাবা রেগে গেল। গিয়ে চোখ কটমট করে বলল–তোকে চুরাইল দিয়ে খাওয়াব। তারপর আমার মুখ বেঁধে দিল।
তুমি বাধা দাওনি?
পিঙ্কি খিলখিল করে হাসল। কেন? সাধুবাবার সঙ্গে আমার খুব ভাব যে! রোজ দেখা হয়। কত গল্প বলে। আমার সঙ্গে তো জোক করেছে সাধুবাবা!
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন,–জোক্ নয়, পিঙ্কি! সাধুবাবা তোমাকে সত্যি চুরাইলের সমানে ঠেলে দিত। আর কখনো সাধুবাবার কাছে এসো না।
পিঙ্কি মুখে অবিশ্বাস ফুটিয়ে বলল,–যাঃ!
কর্নেল বললেন,–সাধুবাবা কোন গুহায় থাকেন তুমি জানো?
পিঙ্কি মাথা দুলিয়ে বলল,–হুঁ। বলে সে চেঁচিয়ে ডাকল, সাধুবাবা! সাধুবাবা! কোথায় তুমি?
অমনি আমাদের সামনে একটা পাথর এসে পড়ল। কর্নেল বললেন,–শিগগির এখান থেকে কেটে পড়াই ভালো, জয়ন্ত। পিঙ্কি, চলো! সাধুবাবা পাথর ছুঁড়তে শুরু করেছে।
পিঙ্কিকে টানতে টানতে কর্নেল দৌড়লেন। কুকি তার কোল থেকে লাফিয়ে পড়ার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু পিঙ্কি কুকিকে ছাড়ল না। এদিকে দুমদাম করে পাথর এসে পড়ছে ঢিবির আড়াল থেকে। ফাঁকা মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় পৌঁছে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে এবার পিঙ্কিদের বাড়ির পথ ধরলুম। কর্নেল বললেন,–পিঙ্কি, ওবেলা তোমাকে নিয়ে আসব। তখন সাধুবাবার গুহাটা দেখিয়ে দেবে। এখন সাধুবাবা বড় চটে গেছে। পিঙ্কি মাথা দুলিয়ে সায় দিল …
.
পাঁচ
সাধুবাবার হ্যান্ডব্যাগটার দশা জরাজীর্ণ। খুলতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। প্রথমে বেরুল নন্দবাবুর সেই পোড়োখনি বিক্রির আন রেজিস্টার্ড দলিল। দলিলে রক্তের ছোপ লেগে আছে। কাল রাতে, রুদ্রবাবুর কাছ থেকে এটা নেওয়া হয়েছিল।
তারপর বেরুল পাণ্ডেজির হারানো হ্যান্ডনোট। পান্নালাল ওঝার সই করা। পাঁচ হাজার টাকা কর্জ নিচ্ছেন পান্নাবাবু শতকরা মাসিক তিরিশ টাকা সুদে। আর বেরুল কিছু কাগজপত্র। বললুম, –তাহলে পোড়োখনির সাধুবাবাই দেখছি পান্নালাল ওঝা।
কর্নেল বললেন,–আবার কে? দেনা আর প্রতারণার মামলায় ফেরার হয়ে পান্নালাল পোড়োখনির ভেতর কোনো গুহায় আত্মগোপন করেছিল,আমার ধারণা …
কথায় বাধা পড়ল। যদুবাবা আর মোহনজি এলেন। মোহনজি ঘরে ঢুকে বললেন, –শ্বশুরমশাইয়ের একটা নোটবইয়ের ভেতর এই চিঠিটা হঠাৎ পেয়ে গেলুম। চিঠিটা পড়ে মনে হল, এটা একটা ক্ল হতে পারে। দেখুন তো কর্নেল।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন,–হা, ঠিক। এমনটি অনুমান করেছিলুম। চিঠিতে পান্নাবাবু । ইংরেজিতে লিখেছেন, ৫ মার্চ রাত বারোটা নাগাদ স্টেশনে পাণ্ডেজি গেলে পান্নাবাবু তাঁকে দলিলটা দেবেন।
যদুবাবু চমকে উঠে বললেন,–কীসের দিলল?
নন্দবাবুর দলিল। অথচ আমরা জানি, তখনও দলিল আপনার মায়ের আলমারিতে ছিল। মাত্র গতকাল সেটা রুদ্রবাবু চুরি করেছিলেন। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, পাণ্ডেজিকে মিথ্যা লোভ দেখিয়ে অত রাতে বাড়ির বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পান্নাবাবু। উদ্দেশ্য হল, তাকে খুন করা।
মোহনজি মৃদু স্বরে বললেন,–কীসের দলিল?
কর্নেল বললেন,–যদুবাবুর কাছে শুনবেন। তবে বোঝা যাচ্ছে, পাণ্ডেজিরও দলিলটার ওপর লোভ ছিল। প্রচণ্ড লোভই বলব। নইলে অত রাতে বাড়ি ছেড়ে যাবেন কেন? তাছাড়া দলিলের বদলে নিশ্চয় পান্নাবাবু কিছু দাবি করেছিলেন। কী দাবি হতে পারে সেটা? নিশ্চয় কর্জ শোধ। এক লক্ষ পঁচাশি হাজার টাকার বদলে ওই দলিলটা খুব দামি মনে হয়েছিল পাণ্ডেজিব কাছে। কেন, বুঝতে পারছ কি জয়ন্ত?
আমি কিছু বলার আগেই যদুবাবু বলে উঠলেন,–পোড়োখনির ঠিকানা দলিলেই ছিল। দেখা যাচ্ছে, পাণ্ডেজিও জানতে পেরেছিলেন, নন্দবাবুর ওই পোড়োখনির ভেতর বহুমূল্য কিছু জিনিস আছে। ভারি আশ্চর্য তো!
কর্নেল বললেন,–মিছিরজিকে দিয়ে পান্নাবাবুই হ্যান্ডনোটটা চুরি করিয়েছিলেন বোঝা যায়। ওটা না থাকলে পাণ্ডেজি বা তার জামাই কেউই পান্নাবাবুর কাছে আইনত টাকা দাবি করতে পারছেন না। পান্নালাল ওঝা অতি ধূর্ত লোক দেখা যাচ্ছে।
মোহনজি বললেন, কিন্তু মিছিরজিকে কেন খুন করবেন পান্নাবাবু!
যে উদ্দেশ্যে রুদ্রবাবুকে খুন করেছেন, সেই উদ্দেশ্যেই অর্থাৎ জিনিস হাতিয়ে নিয়েছেন যে টাকা দিয়ে, সেই টাকা আবার পান্নাবাবুর পকেটে ফিরে আসতে পারে–যদি ওঁদের তিনি খুন করেন। নির্বোধ মিছিরজি টাকার লোভে পান্নাবাবুকে হ্যান্ডনোট ফেরত দিতে গেলেন। টাকাও পেলেন। কিন্তু তাকে খুন করে সেই টাকাগুলো কেড়ে নিলেন পান্নাবাবু। রুদ্রবাবুর বেলাতেও একই ব্যাপার।
বলে কর্নেল একটু হাসলেন। যদুবাবু, আপনাদের হারানো দলিল আমার হাতে ফিরে এসেছে।
যদুবাবু লাফিয়ে উঠলেন। বলেন কী! কোথায় পেলেন?
সময়ে জানতে পারবেন। তবে একটা কথা, আপনার মেয়ে পিঙ্কির কি স্কুলের ছুটি আজ?
না তো। বাড়িতে অমন একটা ঘটনা ঘটল, তাই ওকে স্কুল যেতে দিইনি। কেন?
পিঙ্কি যেন একা কোনোভাবে বাড়ির বাইরে না যেতে পারে। খুব সাবধান। বিকেলে আমি একবার অবশ্য ওকে নিয়ে বেরুব। কিন্তু একা যেন ও না বেরোয়।
যদুবাবু উদ্বিগ্নমুখে বললেন, ঠিক আছে, কিন্তু কেন?
কর্নেল হাসলেন। বললুম তো। সময়ে সবই জানতে পারবেন।
মোহনজি বললেন,–সবই ধাঁধা থেকে গেল, কর্নেল। আপনি বলছেন, পান্নাবাবুই খুনী। কিন্তু ওরকম বীভৎসভাবে খুন–মুণ্ডু কাটা এবং রক্তহীন বডি। আর এই ভয়ঙ্কর চিৎকার।
যদুবাবু বললেন,–ঠিক ঠিক। চুরাইলের ব্যাপারটা তাহলে কী?
কর্নেল হাই তুলে বললেন,আশা করি, আজ রাতেই চুরাইলের রহস্য ফাঁস হয়ে যাবে।
যদুবাবু ও মোহনজি বেরিয়ে গেলেন। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে বারোটা বাজে প্রায়। কর্নেল আরামকেদারায় চিত হয়ে চোখ বুজে চুরুট টানতে থাকলেন।
একটু পরে বললুম,–আচ্ছা কর্নেল, নন্দবাবুর পোড়োখনির ঠিকানা তো পাওয়া গেছে। ওর ভেতর যদি সত্যি গুপ্তধন থাকে, তাহলে যদুবাবুই তো তার মালিক হবেন?
কর্নেল চোখ বুজে ছিলেন। চোখ খুলে বললেন,–না জয়ন্ত! তুমি ভাবছ, ওখানে সোনাদানা হিরে-জহরত লুকনো আছে। সাধুবাবা ওরফে পান্নাবাবুর হ্যান্ডব্যাগে বিদেশের এক কোম্পানির লেখা একটা চিঠি আছে। একপলক চোখ বুলিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। পান্নাবাবু গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল করে বেড়াচ্ছিলেন। না–সোনাদানা লুকনো নেই। ওটা আসলে একটা ইউরেনিয়ামের খনি। পান্নাবাবু ওই বিদেশি কোম্পানিকে গোপনে ইউরেনিয়াম বেচতে চেয়েছিলেন। কোম্পানি তাদের প্রতিনিধি পাঠাতে চেয়েছে। তাই পান্নাবাবু হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন।
অবাক হয়ে বললুম–তাহলে আইনত সরকার এর মালিক হবেন, তাই না?
হ্যাঁ। খনিটা ছিল ব্রিটিশ আমলের কোন্ সায়েবের। নিছক অভ্রের খনি। অভ্র তোলা শেষ হলে দৈবাৎ ইউরেনিয়ামের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল নীচের স্তরে। কিন্তু সেই সায়েবকে কোনো কারণে দেশে ফিরতে হয়। যাবার সময় নন্দবাবুকে বেচে দিয়েছিলেন। কর্নেল তাঁর প্রকাণ্ড ব্যাগের দিকে আঙুল তুলে ফের বললেন,–ওই ব্যাগে একটা বই আছে। পড়ে দেখো। ওতে নন্দবাবুর কথা নেই। কিন্তু এদেশের খনির ইতিহাস আছে। প্রচুর তথ্য আছে। ভৈরবগড়ের খনির কথাও আছে। ব্রিটিশ আমলে খনিবিজ্ঞানীরা ভৈরবগড় অঞ্চলে ইউরেনিয়াম থাকার সম্ভাবনা স্বীকার করেছিলেন।
ব্যাগ থেকে বইটা বের করে পাতা উলটে বললুম,–এসব পড়ার ধৈর্য আমার নেই। কিন্তু আপনার ব্যাগের ভেতর প্যাকেট-করা প্রকাণ্ড বস্তুটি কী?
কর্নেল হাসলেন। কুমোরটুলির ভাস্কর দেবেন পালের আশ্চর্য ভাস্কর্য।
আপনার সেই কাটামুণ্ডু! সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দেখছি! ব্যাপার কী?
কর্নেল চোখ বুজে বললেন,আজ রাতে ম্যাজিক দেখাব, ডার্লিং! কাটামুণ্ডু কথা বলবে।
.
ছয়
দুপুরে আমার চিরদিন বাঙালির প্রিয় ভাতঘুমের অভ্যাস। গতকাল ভাতঘুমের সুযোগ পাইনি। আজ আমাকে সে লম্বা করিয়ে ছাড়ল। দশরথের ডাকে উঠে দেখি, পাঁচটা বাজে! চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলুম, কর্নেল কোথায় গেলেন?
দশরথ বলল,–কর্নিল স্যার পিঙ্কিদিদিকি সাথ ঘুমতে গেছেন।
মনে পড়ল, সাধুবাবার গুহা দেখাতে নিয়ে যাবার কথা ছিল পিঙ্কির। চা খেয়ে বাগানের শেষপ্রান্তে গিয়ে পোড়োখনি এলাকার দিকে কর্নেল ও পিঙ্কিকে খুঁজলুম। কিছুক্ষণ পরে দুজনকে দেখতে পেলুম। কুকি কর্নেলের কাঁধে চেপেছে। পিঙ্কি হাত নেড়ে কথা বলতে বলতে আসছে। কর্নেল তার কাঁধে একটা হাত রেখে হেঁটে আসছেন।
মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে মুখোমুখি হলুম ওঁদের। কর্নেল বললেন, তুমি ঘুমোচ্ছ বলে ডাকিনি ডার্লিং! আশা করি, তোমার রাতের ঘুমটা পুষিয়ে গেছে।
বললুম,–সাধুবাবার আস্তানায় ঢুকেছিলেন নাকি?
কুকিকে পাঠিয়েছিলুম ওঁর হ্যান্ডব্যাগ ফেরত দিতে।
সে কী!
হ্যাঁ। দলিল, হ্যান্ডনোট, যা কিছু ছিল, সব ফেরত দিয়েছি।
পিঙ্কি কুকিকে নিয়ে বাগানে খেলতে ব্যস্ত হয়েছে। সেইসময় যদুবাবু বেরিয়ে এসে ওকে টানতে-টানতে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
বললুম,–এগুলো তো পান্নাবাবুর কীর্তির প্রমাণ। ওগুলো ফেরত দিলেন কেন?
পুলিশ ওঁকে যাতে বমাল ধরতে পারে, তার জন্য। কারণ ওগুলো আমার কাছে থাকলে পান্নাবাবু ধরা পড়ার পর আদালতে বলতেই পারেন, ওগুলো যে তার কাছে ছিল, তার প্রমাণ কী? অর্থাৎ উনি হ্যান্ডনোটটা মিছিরজির কাছে হাতিয়েছিলেন, কিংবা দলিলটা রুদ্রবাবুর কাছে, এর তো প্রমাণ নেই। আদালতে কুকুরের প্রমাণ গ্রাহ্য হবে না। বেচারা কুকি তো আর বলতে পারবে না যে সে সাধুবাবার ডেরা থেকে করাড়ি রোটি ভেবে হ্যান্ডনোটটা কামড়ে নিয়ে এসেছিল! আর পিঙ্কি তো দেখেনি এর ভেতর কী আছে। হা–বলবে হ্যান্ডব্যাগটা সে দেখেছিল কুকির মুখে। কিন্তু ওটা যে পান্নাবাবুর, তা তো প্রমাণ করা যাবে না।
কেন? বিদেশি কোম্পানির সেই চিঠিটা?
কর্নেল হাসলেন। লোকটা মহা ধড়িবাজ। চিঠিতে যে নাম ঠিকানা আছে, তা পান্নাবাবুর নয়। জনৈক এম এম বোসের নাম-ঠিকানা। তাও কলকাতার। পান্নাবাবু কলকাতার ওই ঠিকানায় নাম ভড়িয়ে কিছুদিন ছিলেন সম্ভবত। যাকগে, এসো ডার্লিং! এবার রাতের জন্য প্রস্তুত হওয়া যাক।
এরপর কর্নেল যা সব করলেন, তার মাথামুণ্ডু খুঁজে পেলুম না। যদুবাবুর সঙ্গে চুপিচুপি কী কথাবার্তা বললেন। তারপর দেখলুম, যদুবাবু দশরথকে ডেকে তেমনি চুপিচুপি কী সব বললেন। দশরথ বেরিয়ে গেল। আমার প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শুধু বললেন,–একটু পরই বুঝবে জয়ন্ত! ধৈর্য ধরো।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দশরথ ফিরে এল একবোঝা খড় নিয়ে। যদুবাবু ভাইয়ের শোকে মুহ্যমান। অথচ তাঁর মুখেও একটু হাসির রেখা দেখা যাচ্ছিল। দশরথ ঘড়ে দড়ি জড়িয়ে একটা কিছু বানাচ্ছিল। একটু পরেই বুঝলুম, সে একটা মানুষ তৈরি করছে।
চুপচাপ দেখতে থাকলুম। মুণ্ডুকাটা একটা মানুষের আদল তৈরি হলে দশরথ তাতে ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ তাগড়াই করে ফেলল। এবার কর্নেল তার ব্যাগ থেকে নিজের প্যান্ট-শার্ট বের করে মূর্তিটাকে পরালেন। তারপর গলার ওপর সেই কাটামুণ্ডুটা চেপে বসিয়ে দিতেই মুর্তিটা একেবারে কর্নেল নীলাদ্রি সরকারে পরিণত হল।
সন্ধ্যা সাতটায় কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। বললেন,–এক্ষুনি ফিরে আসছি।
যদুবাবু ও দশরথের মুখে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছিল। কর্নেলের ডামি তৈরি করে কাকে ফাঁদে ফেলার আয়োজন হচ্ছে, কে জানে! পান্নালাল ওঝা যদি অত ধূর্ত লোক হন, এই ফঁদে কি তিনি পা দেবেন? যদুবাবু যেন আমার মনের কথা আঁচ করে মাথা নেড়ে বললেন,–খামোকা চেষ্টা করা। লোকটা খুব ঘড়েল বলে মনে হয় না জয়ন্তবাবু?
সায় দিলুম। দশরথ বলল,–হামার বহুত্ ডর বাজছে বড়বাবু! আমার না কুছ গড়বড় হয়ে যায়।…
কর্নেল আধঘণ্টা পরে ফিরে এসে বললেন,–দশরথ! ডামিটা ওঠাও। বাগানে নিয়ে চলো। যদুবাবু, আপনি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন। বেরুবেন না যেন।
যদুবাবু চলে গেলেন। মনে হল ভয় পেয়েছেন খুব। দশরথ ডামিটা নিয়ে চলল। বাগানে অন্ধকার জমে আছে। কিন্তু টর্চ জ্বালতে বারণ করলেন কর্নেল। শেষপ্রান্তে গিয়ে ডামিটা একটা গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা হল। কর্নেল ফিসফিস করে বললেন,–দশরথ, তুমি বাড়িতে গিয়ে দরজা আটকে দাও। আর শোনো, বাইরের দিকের সব আলো নিবিয়ে দাও এখুনি।
দশরথ পালিয়ে বাঁচল। কর্নেল আমার হাত ধরে একটা ঝোঁপের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর টেনে বসিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললেন,–যে-কোনো মুহূর্তে চুরাইলের আবির্ভাব হবে। যেন ভয় পেও না।
কোনো কথা বললুম না। উত্তেজনায় এবং অজানা আতঙ্কে আমার অবশ্য বুক কাঁপছিল। রিভলবার আর টর্চ নিয়ে বসে রইলুম। কর্নেলের চাপা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনছিলুম। বুঝতে পারছিলুম, উনিও খুব উত্তেজিত।
বাড়ির বাইরের আলোগুলো নিবে গেল। অন্ধকার আরও জমাট মনে হল এবার। কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়েছে বলে চাঁদ উঠতে দেরি হবে। দৃষ্টি একটু স্বচ্ছ হলে মিটার কুড়ি দূরে কর্নেলের ডামিটা অস্পষ্টভাবে টের পাওয়া গেল। বাতাসও কেন কে জানে, বইছে না আর। অন্ধকার রাতটা ক্রমশ বিভীষিকার আসন্ন আবির্ভাবে ঝিম মেরে যাচ্ছে। যদুবাবুর বাড়ির সব জানালা বন্ধ। অন্ধকারে বাড়িটা কালো হয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কুকির ডাক শুনলুম। কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করছিল।
তারপরই চুরাইলের চিৎকার শুনতে পেলুম। আগের সন্ধ্যায়ও পোড়োখনিতে তার চিৎকার শুনেছিলুম। কিন্তু আজকের চিৎকার তার চেয়ে ভয়াবহ। যেন পোড়োখনির রক্তচোষা প্রেতিনী রক্তের গন্ধ পেয়ে খেপে গেছে। ভয়ঙ্কর আর অমানুষিক ওই চিৎকারে বুকের স্পন্দন যেন থেমে যাবে। তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু টের পাচ্ছি, সে উটো পায়ে পিছু হেঁটে ক্রমশ এগিয়ে আসছে আর এগিয়ে আসছে। তার সাপের মতো চোখে পলক পড়ে না। একটানা বিকট চিৎকার করে চলেছে সে।
চিৎকারটা থেমে গেল হঠাৎ। তারপর কার কাশির শব্দ শুনলুম। তারপর কেউ অদ্ভুত কণ্ঠস্বরে ইংরেজিতে বলল,–আসুন। আপনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
যে গাছে কর্নেলের ডামি দাঁড় করানো, তার কাছে মাটির ওপর টর্চের আলো পড়ল। আবছা আলোয় কর্নেলের ডামিটা দেখে মনে হল, অবিকল কর্নেল দাঁড়িয়ে আছেন।
লোকটা টর্চ নিবিয়ে চাপা গলায় ইংরেজিতে বলল,–তাহলে আপনি ব্যুগবো কোম্পানির প্রতিনিধি?
হ্যাঁ। আশা করি, আমার চিঠি পেয়েছেন।
কিন্তু বিশ্বাসঘাতকার শাস্তি মৃত্যু, জানেন তো?
সে কী! ও কথার মানে?
মানে এখনই বুঝিয়ে দিচ্ছি! তারপর লোকটা বাংলায় বলে উঠল, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি। চুরাইল তোমার মুণ্ডু ছেঁড়ার আগে সেকথা জেনে যাও। বলে সে তিনবার শিস দিল।
অমনি চুরাইলটা আবার বিকট চিৎকার করে উঠল। তারপর ধপাস করে একটা শব্দ হল। কর্নেল আমাকে ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং টর্চ জ্বাললেন। আমিও টর্চ জ্বাললুম। বাগানের অন্যদিক থেকেও কয়েকটা টর্চ জ্বলে উঠল।
সেই আলোয় দেখলুম, কাল পোড়োখনিতে দেখা সেই ভয়ঙ্কর প্রাণীটা অথবা প্রেতিনী কর্নেলের ধরাশায়ী ডামির ওপর ঝুঁকে গলায় কামড় বসিয়েছে এবং লাল কাপড়-পরা সেই সাধু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রেতিনীর মাথায় মেয়েদের মতো চুল, হাতে শাঁখা!
সাধু পালাবার চেষ্টা করতেই বুটের শব্দ তুলে পুলিশ অফিসার আর কনস্টেবলরা দৌড়ে এলেন। তাকে ধরে ফেললেন।
এদিকে পোড়োখনির প্রেতিনী তখন ফড়ফড় করে খড় আর কাপড় ছিঁড়ছে। রক্ত না পেয়ে খেপে গেছে যেন। মুহুর্মুহু বিকট চিৎকার করে সে ডামিটা ফর্দাফাই করে ফেলছিল। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে তার মুখে টর্চ ফেললেন। তখন সে মুখ তুলল। নীল জ্বলজ্বলে নিষ্পলক হিংস্র চোখ তার। মাথায় বড় বড় চুল। শাঁখা পরা হাতে ধারালো বাঁকানো নখ। বিকট গর্জন করে উঠে দাঁড়াতেই কর্নেল পর পর দুবার গুলি ছুড়লেন। প্রেতিনী নেতিয়ে পড়ে গেল। আমি দৌড়ে গেলুম কর্নেলের কাছে।
কর্নেল চুরাইলের মাথার চুল ধরে টান দিতেই উপড়ে গেল। কর্নেল হো হো করে হেসে বললেন,–স্ত্রীলোকবেশী এবং হাতে শাঁখা-পরা এই প্রাণীটিকে আশা করি, চিনতে পেরেছ জয়ন্ত!
কী আশ্চর্য! এটা একটা ভালুক না?
হ্যাঁ। ভালুকই বটে। তবে খুব শিক্ষিত ভালুক। ওকে পান্নাবাবু মানুষের রক্ত খাইয়ে রক্তলোভী করে তুলেছিলেন। কর্নেল একজন পুলিশ অফিসারকে বললেন,–মিঃ সিং! তাহলে আসামীকে আপনারা নিয়ে যান! আমি একটু পরে যাচ্ছি থানায়।
পুলিশ অফিসার হাসতে হাসতে কর্নেলের কাটামুণ্ডুটা কুড়িয়ে বললেন, আপনার কাটামুণ্ডু কিন্তু চমৎকার কথা বলছিল। আপনি যে এত চমৎকার ভেন্ট্রিলোকুইজম্ জানেন, ভাবতে পারিনি। নিন আপনার কাটামুণ্ডু।
কর্নেল তার কাটামুণ্ডু দেখে নিয়ে বললেন,–একটু রং চটে গেছে মাত্র। আবার কুমোরটুলি গিয়ে পালমশাইকে দেব।
ততক্ষণে বাড়ির বাইরের আলোগুলো আবার জ্বলে উঠেছে। যদুবাবু, দশরথ, পিঙ্কি আর তার কুকুর বেরিয়ে এল। পুলিশ সাধুবাবা ওরফে পান্নালাল ওঝাকে থানায় নিয়ে গেল। সর্বনাশা মরা ভালুকটা বাগানে পড়ে রইল। কুকি বারান্দা থেকে সেইদিকে লক্ষ্য করে খুব ধমক দিতে থাকল। পিঙ্কি কিছু বুঝতে না পেরে তাকে তুলে নিয়ে চাটি মেরে বলল,খুব হয়েছে।
কিন্তু চুরাইল-রহস্য এভাবে ফাঁস হওয়াতে দশরথ খুশি হয়নি বুঝি। একপ্রস্থ চা এনে দিয়ে বলল,–লেকিন করাড়ি রোটি ইয়ে বদমাস ভালুর না আছে, রামজির কিরিয়া। যো ভালু খুন পিতা, উও কভি রোটি বানানে নেহি জানতা। রোটি ঔর কৈ ভালু বানিয়েছে।
অতএব করাড়ি রোটি খেয়ে তার ক্ষতি হবে না। কর্নেল আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হেসে বললেন,–কী ডার্লিং, কাটামুণ্ডুর কথা বলার ম্যাজিক দেখালুম কি না বলো?
ভেন্ট্রিলোকুইজম্ কবে শিখলেন?
সম্প্রতি কলকাতার বিখ্যাত এক হরবোলার কাছে শিখতে হয়েছে। তোমার পাশে বসে দিব্যি কথা বলছিলুম সাধুবাবার সঙ্গে। সাধুবাবা ভেবেছিল, গাছে হেলান দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছি। তবে মহাধড়িবাজ লোক। বিকেলে হ্যান্ডব্যাগ ফেরত পাঠানোর সময় সেই বিদেশি কোম্পানির নামে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলুম। লিখেছিলুম,–আমিই ঝগবো কোম্পানির প্রতিনিধি। রাত ন’টা নাগাদ যদুবাবুর বাগানে এসে দেখা করুন। সাধুবাবা চালাকিটা ধরে ফেলেছিল। আমিও জানতুম, সে আমার চালটুকু ধরে ফেলবে। কিন্তু তাহলেও সে আসবে। আমাকে খতম করার জন্য তাকে চুরাইল’ নিয়ে আসতেই হবে। আমি তার সব প্ল্যান ভেস্তে দিতে চলেছি কি না।
হুঁ, বুঝলুম। কিন্তু চিৎপুরে গুপ্ত কোম্পানিতে যাওয়ার রহস্যটা কী?
কর্নেল হাসলেন। তোমার মনে পড়ল তাহলে? হ্যাঁ–তুমি শুধু আমাকে গুপ্ত কোম্পানির দোকানে ঢুকতে দেখেছিলে। কিন্তু আমাকে ওদিন অন্তত সারা চিৎপুর এলাকার অসংখ্য দোকানে ঢুকতে হয়েছিল।
কেন?
দুটো জিনিসের তদন্তে। জটাজুট আর অস্বাভাবিক গড়নের একটা পরচুলো সম্প্রতি এক বছরে একইসঙ্গে কেউ কিনেছে কিনা। গত শীতে ভৈরবগড়ে গিয়ে চুরাইলটাকে দেখামাত্র ভালুক বলে সন্দেহ হয়েছিল। তুমি কি ভালুকের মাথা লক্ষ্য করেছ, জয়ন্ত? ওই মাথায় স্ত্রীলোকের পরচুলো আটকাতে হলে বিশেষ অর্ডার দিয়ে পরচুলা বানাতে হবে। যাই হোক, খোঁজ পেয়ে গেলুম শেষপর্যন্ত। এক পরচুলা ব্যবসায়ী কথায়-কথায় বলে ফেলল,–এক ভালুকওয়ালার অদ্ভুত অর্ডার পেয়েছিল। সে নাকি নিজে জটাজুটধারী সাধু সাজবে এবং তার ভালুককে স্ত্রীলোক সাজিয়ে শাড়ি-শাঁখা পরিয়ে খেলা দেখাবে। তাই …
বাধা দিয়ে বললুম,–ভালুকটার হাতে শাঁখা দেখেছি। পরনে শাড়িও আছে নাকি?
আছে। গণ্ডগোল এবং আতঙ্কের চোটে লক্ষ্য করো নি। এখন গিয়ে দেখে এসো, লালপেড়ে শাড়িও আছে।
দেখে আসার জন্য তক্ষুনি উঠে দাঁড়ালুম বটে, কিন্তু অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে পা বাড়াতে অস্বস্তি হল। সত্যিকার শাঁখচুন্নি যে নেই, তা কে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারে?
আমাকে বসে পড়তে দেখে কর্নেল হো-হো করে হেসে উঠলেন। পিঙ্কিও ব্যাপারটা টের পেয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। এবার কুকি সুযোগ পেয়ে তাকে ধমক দিল নিজের ভাষায়। পিঙ্কি গম্ভীর হয়ে গেল সঙ্গে-সঙ্গে।