পোড়োবাড়ির রহস্য – নলিনী দাশ
সেদিন যা সাংঘাতিক ভয় পেয়েছিলাম, মনে পড়লে এখনও বুক ঢিপঢিপ করে, হাত-পা হিম হয়ে আসে। ভূতের সন্ধানে হানাবাড়িতে ঢুকে শেষে গুন্ডার কবলে পড়ব, এমন আশঙ্কা করিনি, কিন্তু তাই-ই ঘটল। প্রাণ নিয়ে যে অক্ষত ফিরতে পেরেছিলাম, সেটাই যথেষ্ট। আমরা তিনটি স্কুলের মেয়ে, আমাদের সঙ্গে আছে কেবল এক-একটা লাঠি আর একটামাত্র ছুরি। গুন্ডাদের কাছে নিশ্চয় বন্দুক, পিস্তল, ছোরা, বোমা—আরও কত কিছুই আছে! কী করি, এখন কী যে করি? পালাবার পথ বন্ধ দেখে আমরা পা টিপে টিপে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম, বটগাছের ঝুঁকে পড়া ডাল-পাতার আড়ালে মার্টিতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। সংখ্যার ওরা ক’জন ছিল জানি না, পায়ের শব্দ আর কথাবার্তা শুনে মনে হয়েছিল অন্তত তিনজন। একজন বিশ্রী ফ্যাঁসফেসে গলায় কী বলছিল, আর একজন সরু গলায় ক্যানক্যান করে যেন কৈফিয়ত দিচ্ছিল। তৃতীয়জনের প্রচণ্ড রাগী হেঁড়ে গলা। কিন্তু একজনেরও কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পাইনি।
এর পরেই ওদের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার পায়ের শব্দ শুনলাম। কী হবে! নন্দা নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল আর অরু বরফের মতো ঠান্ডা হাতে আমার হাত চেপে ধরল। আমারও প্রাণ ওষ্ঠাগত, গলা শুকিয়ে গেছে! নন্দা ফিসফিসিয়ে বলল, “আমাদের খুন করলেও কেউ টের পাবে না।”
অরু মুখে সাহস দেখিয়ে কানে কানে বলল, “গায়ের জোরে তো ওদের সঙ্গে পারব না, বুদ্ধির জোরে পালাতে হবে।”
রুদ্ধশ্বাস আতঙ্কে অপেক্ষা করতে লাগলাম, এই বুঝি ওরা হানা দেয়। কিন্তু আশ্চর্য, ওরা ছাদ পর্যন্ত এল না। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শব্দ শুনলাম, কিছু খুটখাট শব্দ পেলাম, তারপর সব চুপচাপ! কিছুক্ষণ পরে মনে হল যেন নীচে নেমে যাওয়ার শব্দ পেলাম। আবার কিছুক্ষণ সাড়াশব্দ নেই। নন্দা কাঁপা গলায় বলল, “ওরা মানুষ তো? এটা কি সত্যিই হানাবাড়ি? ওদের পায়ের শব্দ, কথা বলার আওয়াজ শোনা যায় কিন্তু চোখে দেখা যায় না।”
অরু আর আমি অবশ্য ভুতে বিশ্বাস করি না, আমাদের মনে হয়েছিল ওরা গুন্ডা, তাই ভয় পেয়েছিলাম।
এই গল্পটা ঠিকভাবে বুঝতে হলে আমাদের পরিচয় জানা দরকার। আমরা তিন বন্ধু, নন্দা, অরু আর আমি (মিতু)— সুনন্দা, অরুন্ধতী আর মিতালি— ছেলেবেলা থেকে দক্ষিণ কলকাতার এক নামী স্কুলে একসঙ্গে পড়ি। আমরা অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পড়তে খুব ভালবাসি, কিন্তু একসঙ্গে কোনও অ্যাডভেঞ্চার করবার সুযোগ আগে পাইনি, কারণ আমরা থাকতাম নিউ আলিপুরে, নন্দারা পার্ক সার্কাসে আর অরুরা দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে, এই পাড়ায়। সম্প্রতি নন্দার আর আমার বাবা এই পাড়ায় পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট কিনেছেন, গতকাল আমরা এখানে চলে এসেছি। এর মধ্যেই অরুদের বাড়ি যাওয়া-আসা হয়ে গেছে, আর একসঙ্গে বেড়াবার অনেক প্ল্যান করে ফেলা হয়েছে। আগামীকাল, রবিবার সকালে অরু পাড়ার সব ইন্টারেস্টিং জিনিস চিনিয়ে দেবে বলেছে।
এর মধ্যে অরুদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে এই বিপত্তি। সন্ধ্যায় হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে আমাদের কেমন যেন দিকভ্রম হল। আচমকা একটা লোক আমাদের পথ আটকে ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, “যাস না, যাস না বলছি! বিপদে পড়বি, সাংঘাতিক বিপদ!”
নন্দা বেজায় ভিতু। মৃদু আর্তনাদ করে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কানে কানে বলল, “এগিয়ে কাজ নেই, চল, অরুদের বাড়িই ফিরে যাই।”
আমিও প্রথমে একটু হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু, বাড়ির কাছে এসে ফিরে যাওয়াটা বোকার মতো কাজ হবে। বুড়োকে বললাম, “কোথাও যাচ্ছি না, বাড়ি ফিরছি।” একটু যেন ঠান্ডা হয়ে বুড়ো বলল, “বেশ, বেশ, তাড়াতাড়ি বাড়ি যা!”
ব্যাপারটা কী? পাগল নাকি? তাড়াতাড়ি এখান থেকে সরে পড়াই ভাল। পাগলে কী করে-না-করে বিশ্বাস নেই! ঠিক তখনই আলো এসে গেল, লোকটাকে ভাল করে দেখে নিলাম, কাঁচাপাকা ঝাঁকড়া চুল, লাল-কালো চকরাবকরা চাদর গায়ে।
রবিবার সকালেই অরুর সঙ্গে বেরোলাম। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা নতুন আর বেশ চওড়া। দু’ ধারের বাড়িগুলোও প্রায় সবই নতুন। পশ্চিমে একটু এগোলেই অনেক দোকানপাট, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, এইসব। পুবে গিয়ে রাস্তাটা সরু হয়ে গেছে, ওটা পুরনো পাড়া, ওখানেই অরুদের বাড়ি। আমাদের বাড়ির কাছ দিয়ে দক্ষিণে একটা কাঁচা রাস্তা গেছে, তার ধারে অনেক খালি জমি, গাছপালা আর ডোবা-পুকুর আছে। মোড়ের মাথায় একটা মস্ত ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ, তার তলায় বেশ আড্ডা জমেছে দেখলাম, একটা লোক বসে তোলা-উনুনে চা করছিল। ক’টা ইটের ওপর ফেলা একটা নারকোল গাছের গুঁড়িতে বসে দু’-চারটি লোক চা খাচ্ছিল। সেই বুড়োকে আবার দেখলাম, আবার সে ভাঙা গলায় বলে উঠল, “যাস না, সাংঘাতিক বিপদে পড়বি।”
দিনের আলোয় নন্দা ভয় পেল না। অরু ফিসফিস করে বলল, “কমবয়সি মেয়ে দেখলেই লোকটা তাদের সাবধান করে দেয়।” ‘বুড়ো’ বলেছি বটে, কিন্তু লোকটির বয়স বোঝার কোনও উপায় নেই। চল্লিশ-পঞ্চাশ বা ষাট-সত্তর যা হোক হতে পারে। রোগা শুঁটকো চেহারা, কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল, মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি-গোঁফ। আজ তার গায়ে ছিল একটা খুব ময়লা সবুজ চাদর।
আমরা তেঁতুলতলা ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে চললাম। ডানদিকে গাছপালা আর বাঁদিকে পেলাম কিছুটা ফাঁকা জমি। তারপর বাঁয়ে একটা মজা পুকুর আর ডানদিকে পাঁচিল-ঘেরা একটা পোড়োবাড়ি। আরও দূরে ডানদিকে পাঁচিল-ঘেরা আমবাগান আর বাঁয়ে অনেকটা খালি জমি। দূরে অনেক নতুন বাড়ি উঠছে দেখলাম। বেশিদিন এসব জমি আর ফাঁকা থাকবে না।
পোড়োবাড়ির চারধারে ঘন জঙ্গল দেখে আমরা অবাক। অরু বলল যে বাড়িটা কার কেউ জানে না, সবাই বলে যে ওটা হানাবাড়ি। নন্দা ভয় পেয়ে বলল, “তা হলে এখানে আবার দাঁড়ালি কেন? ভূতপ্রেত থাক বা না থাক, ওই বাড়িতে নিশ্চয় দেদার সাপ আছে। পা চালিয়ে সামনে এগোই চল।”
অরুর অনেকদিনের শখ যে, ওই হানাবাড়িতে ঢুকে দেখবে কী আছে। আমি বললাম, “অ্যাডভেঞ্চার করতে হলে তো এখানেই এবং আজকেই শুরু করা যায়।”
নন্দা বলল, “যাস না রে। ও-বাড়িতে নিশ্চয় কোনও রহস্য আছে, আমি মাঝরাতে ওখানে আলো জ্বলতে দেখেছি।”
আমরা তার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলাম, “গুল মারিস না, তুই মাঝরাতে হানাবাড়িতে গিয়েছিলি বললেই বিশ্বাস করব?”
নন্দা বেগে বলল, “যেতে হবে কেন? আমাদের বাড়ির দক্ষিণের বারান্দা থেকে তো এখানটা স্পষ্ট দেখা যায়।”
আমাদেরও ততক্ষণে রোখ চেপে গেছে। নন্দাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে তিনজনে হানাবাড়ির ভাঙা পাঁচিলের ফোকর দিয়ে ঢুকলাম। তারপরে কিন্তু এক পা এগোনোও কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। বড় বড় গাছ বেয়ে মোটা লতা উঠেছে আর তলায় এত ঝোপঝাড় যে, পা ফেলার জায়গা নেই। নন্দা একটা ছুরি দিয়ে ডালপালা কাটতে লাগল, আর আমরা দু’জন চার হাতে সেগুলো সরিয়ে এক পা এক পা করে এগোতে লাগলাম। মনে হল বাড়িটায় কেবল পাশাপাশি দুটো ছোট ঘর, একটা বটগাছ বাড়ির গা ঘেঁষে উঠেছে, ঝুরি নামিয়ে বাঁদিকের ঘরটা প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে। আমরা ডানদিকের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। তালাচাবি দূরে থাক, একটা দরজাতেও খিল বা ছিটকিনি লাগানো ছিল না। একটা খাটিয়ায় ময়লা বিছানা পাতা রয়েছে দেখলাম। দড়িতে ঝুলছে দু’-চারটে ময়লা জামাকাপড়; কোণে রাখা আছে একটা জলের কুঁজো আর খানদুই বাসন। আরে? দড়িতে টাঙানো ওই লাল-কালো চক্করবক্কর চাদরটা গতকাল তেঁতুলতলার বুড়োর গায়ে দেখেছিলাম না? এটা কি তা হলে বুড়োরই আস্তানা? খাটের তলায় একটা পুরনো কিন্তু দামি ব্রিফকেস দেখলাম— এ-ঘরে যেন সেটা নিতান্তই বেমানান। ঘরে আর কিছুই নেই। বুড়ো এ ঘরে ঢোকে কোন পথ দিয়ে? আমাদের তো ঝোপজঙ্গল কেটে বহু কষ্টে ঢুকতে হল।
হঠাৎ পাশের ঘরে একাধিক লোকের পায়ের শব্দ শুনে আমরা ঘরের পেছন দিয়ে বেরোলাম। ও বাবা! পায়ের শব্দও যে সেদিকেই আসছে। তাড়াতাড়ি ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠলাম। বুঝলাম যে পায়ের শব্দও ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠছে। কী হবে?
এরপরের ঘটনার কথা তো আগেই বলে নিয়েছি। পায়ের শব্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠল। কিছুক্ষণ থামল, তারপর আবার নেমে চলে গেল। রুদ্ধশ্বাসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমরাও নামলাম। ধারেকাছে কাউকে দেখতে না পেয়ে বাইরে বেরোলাম। ঝোপজঙ্গল আগেই অনেক কেটেছিলাম, তাই এখন বেরোতে কোনও অসুবিধে হল না। তারপর পা চালিয়ে ছুটলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে।
তেঁতুলতলায় বেশ মেলা জমেছে দেখলাম। তিন-চারটে চোঙাপ্যান্ট আর গুরু পাঞ্জাবি পরা ছেলে চায়ের খুরি হাতে বিস্তর রাজা-উজির মারছিল। দুটি লোক একপাশে বসে বাজারদর আলোচনা করছিল। বুড়ো চুপ করে বসে ছিল, কিন্তু আমাদের দেখেই বলে উঠল, “ওরে তোরা চলে যা, ভয়ানক বিপদে পড়বি!”
আমরা বললাম, “বাড়ি ফিরছি।” খুশি হয়ে বুড়ো বলল, “তাড়াতাড়ি যা।”
ইতিমধ্যে দুটি ষণ্ডা লোক এসে চা চাইল, তাদের গলার স্বর শুনে আমরা বেজায় চমকে গেলাম— একজনের ফ্যাঁসফেসে গলা, অন্যটির বিশ্রী সরু ক্যানকেনে। এরাই না কিছুক্ষণ আগে হানাবাড়িতে কথা বলছিল? ফ্যাঁসফেসের মুখে পাঁচ-সাতদিনের না-কামানো দাড়ি-গোঁফ, ঝাঁকড়া চুল আর থ্যাবড়া নাক। ক্যানকেনের মাথাজোড়া টাক আর খাঁড়ার মতো নাক, তা আবার ডগাটা একদিকে বাঁকা। ওরা চা খেতে-না-খেতে আর একটি দারুণ লম্বা-চওড়া লোক এল, তার হেঁড়ে গলার আওয়াজ শুনেই আমাদের মনে হল যে, এই তবে তৃতীয় ব্যক্তি। এরা পোড়োবাড়িতে গিয়েছিল কী মতলবে? কোথা দিয়েই বা ঢুকেছিল? সিঁড়ি দিয়ে উঠল, অথচ ছাদে গেল না কেন? তবে কি ওই সিঁড়িটাই ওদের যত গোপন ফন্দি আঁটার জায়গা?
একদিনের অভিজ্ঞতার ফলেই আমরা বুঝে গেছি যে, হানাবাড়ি হোক বা না হোক, ওই পোড়োবাড়িতে নিশ্চয় রীতিমতো রহস্য আছে! কার বাড়ি ওটা, খোঁজ নিতে হবে। প্রথমেই এ-বিষয়ে অরুর ছোট বউদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে। ছোট বউদি আমাদের চেয়ে বেশি বড় না। তাঁরও গোয়েন্দা-গল্প পড়ার নেশা। অ্যাডভেঞ্চার করার শখ। আমাদের সঙ্গে তাই খুব ভাব। অরুদের সঙ্গেই থাকেন ছোড়দা-ছোটবউদি। খুব মিশুক দু’জনেই, পাড়ার সব খবর ওঁদের নখদর্পণে। তা ছাড়া ছোড়দার একটা নিজস্ব গাড়ি আছে। মাঝে মাঝে ছোটবউদি আমাদের তিনজনকে নিয়ে বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যান। ছোড়দা আর ছোটবউদিকে আমরা সব খবরই বললাম। বুড়োর কথা, চা-ওলা, চোঙাপ্যান্ট ছোকরারা আর গুন্ডা তিনটি, সবার বিষয়ে খুলে বললাম। নন্দা ভারী চমৎকার মানুষের প্রতিকৃতি আঁকতে পারে। সে কাগজ-পেনসিল নিয়ে খসখস করে সেই বুড়োর আর গুন্ডা তিনটির এমন চমৎকার ছবি এঁকে ফেলল যে, তার কাছে ফোটোগ্রাফ হার মানে।
ছোটবউদিও সমস্ত ব্যাপারটায় উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলেন। ছোড়দা খবর নিয়ে জানালেন যে, পোড়োবাড়ির আসল মালিক কে সেটা কেউ জানে না, কিন্তু বাড়ির ট্যাক্স নাকি নিয়মিত জমা পড়ে। পাগলাবুড়ো যে সারাদিন ওই তেঁতুলতলায় বসে থাকে, এটা সবাই জানে, কিন্তু তার বাসার খবর কেউ জানে না। গুন্ডাদের নামধামও কারও জানা নেই, যদিও তাদের দেখেছে অনেকেই। আমরা যে বুড়োর বাসা দেখে এসেছি সেটা কেবল চুপিচুপি ছোটবউদিকে বললাম।
আমাদের কৌতূহল ক্রমেই বেড়ে চলছিল। পরের রবিবার খুব সকাল সকাল আবার পোড়াবাড়িতে গেলাম। বুড়োর ঘর তো আগের দিন দেখেছিলাম, তাই এবার ঘর পেরিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে বেরোলাম। দক্ষিণে একটা ছোট্ট ঘর, আর উত্তরে ছাদে ওঠার সিঁড়ি, মাঝে পেছনের দরজা, তার একটা পাল্লা ভাঙা। বাইরে অনেক ঝোপ-জঙ্গল, কিন্তু তার মধ্য দিয়ে একটা যাতায়াতের পথ তৈরি করা হয়েছে। ভাঙা পাঁচিলের গায়েও বিশাল ফোকর। নিশ্চয় বুড়ো নিজে আর গুন্ডাগুলো ওই পথেই যাতায়াত করে। ওদের পরস্পরের মধ্যে কোনও যোগ আছে কি?
যদিও জানি যে, বিনা অনুমতিতে পরের জিনিস দেখা উচিত নয়। কিন্তু বুড়ো বেচারা পাগল। কী আছে তার, নিজেই জানে না সম্ভবত, তাই আমরা আবার বুড়োর ঘরে ঢুকলাম আর দ্বিধা কাটিয়ে খাটের তলা থেকে ব্রিফকেস বের করে খুলে ফেললাম। আমরা কী দেখতে পাব আশা করেছিলাম জানি না, কিন্তু খুলে দেখলাম যে তার ভেতরে রয়েছে কেবল কিছু কাগজপত্র, পুরনো চিঠি, খবরের কাগজের কাটিং এইসব। সবই পুরনো, হলদে হয়ে যাওয়া। কৌতূহলী হয়ে চিঠিগুলো পড়লাম। একটা নামকরা বইয়ের দোকান থেকে কমলাকান্ত বসুকে বলছে যে, তাঁর প্রাপ্য সব টাকা চুকিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু তারা অনুরোধ করছে যে, তিনি যেন আবার তাঁর কাজে ফিরে আসেন। খবরের কাগজের সম্পাদকও কমলাকান্ত বসুকেই চিঠি লিখেছেন, চুক্তি অনুসারে তিনবার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু একটারও উত্তর আসেনি, মণিমালার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞাপনের কপিও দেখলাম। ‘মণিমালা’ নামে ছোট্ট একটি মেয়ের বর্ণনা আর ফোটো দিয়ে বলা হয়েছে, কেউ কোনও খবর পেলে যেন কমলাকান্ত বসুকে জানান। ওই বুড়োই কি তা হলে কমলাকান্ত বসু? নিজের মেয়ে হারিয়ে গিয়েছিল বলেই কি সব মেয়েকে সাবধান করে দেয়! খুব মায়া লাগছিল বুড়োর জন্য।
হঠাৎ ঘরের বাইরে কথাবার্তা আর পায়ের শব্দ শুনে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে একেবারে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম। আগেই অবশ্য বইয়ের দোকানের আর খবরের কাগজের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়েছিলাম, অনেক কাটিংয়ের মধ্যে থেকে একটা কাটিংও নিয়েছিলাম।
তেঁতুলতলায় গিয়ে প্রতিদিনের মতোই ভিড় দেখলাম। নিজেরা এগিয়ে বুড়োকে মৃদুস্বরে বললাম, “আমরা এবার বাড়ি যাচ্ছি।”
বুড়ো নিশ্চিন্তমনে হেসে বলল, “বেশ, বেশ, খুব ভাল কথা।”
হঠাৎ একটি ছোকরা এগিয়ে এসে ধমকের সুরে বলল, “পাগল মানুষের পেছনে লেগেছেন কেন?”
আমরাও তেমনই তেড়ে উত্তর দিলাম, “বিরক্ত করব কেন? আলাপ করছি। এতে তাঁর উপকারই হবে।”
ততক্ষণে গুন্ডাগুলোও এসে গেছে। বুড়োর দু’ পাশে গিয়ে বসে তারা কী যেন বলল আর বুড়ো ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগল।
আমাদের অনুসন্ধানের পরিধি এবার আরও বাড়াতে হল। বুড়োর ব্যাপারে অরুর ছোটবউদি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সব কথা শুনে তিনি গাড়ি করে আমাদের নিয়ে প্রথমেই সেই বইয়ের দোকানে গেলেন। দোকানের কর্মচারীরা কেউই কমলাকান্ত বসুর বিষয়ে কিছু বলতে পারলেন না। অবশেষে এক বৃদ্ধ কর্মচারী জানালেন যে, কুড়ি বাইশ বছর আগে এক কমলাকান্ত এই দোকানে কাজ করতেন বটে, কিন্তু তাঁর পদবি বসু ছিল কি না তা মনে নেই। একটা কিছু পারিবারিক বিপদের পর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। এখন তিনি কোথায় আছেন, তা কারও জানা নেই।
খবরের কাগজের অফিসেও একই ধরনের কথা শুনলাম, কুড়ি-বাইশ বছর আগে কমলাকান্ত বসু মণিমালা নামে একটি ছোট্ট মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, কিন্তু তার কোনও উত্তর আসেনি। কমলাকান্ত খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তারপর কী হল? তারপরের কোনও কথা কারও জানা নেই। একটা বাড়তি খবর পাওয়া গেল খবরের কাগজের অফিসে, ছোট্ট মণিমালা তাদের বাড়ির নিকট আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে গঙ্গাসাগর মেলায় গিয়েছিল। এক শোচনীয় নৌকোডুবিতে তারা অনেকে ভেসে গিয়েছিল। আর সকলকেই জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু মণিমালার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। বুড়োর জন্য সমবেদনায় আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। পরদিন তেঁতুলতলায় গিয়ে চুপিচুপি বুড়োকে বললাম, “কমলাকান্তবাবু ভাল আছেন? মণিমালার কোনও খোঁজ পেলেন?”
কেমন যেন চমকে উঠল বুড়ো। বলল, “মণি কোথায়? মণি-মা তোমাদের সঙ্গে ফিরে এসেছে? বেঁচে থাকো মা, ভাল থাকো!”
হঠাৎ চা-ওলা কেমন যেন তেড়েমেড়ে বলল, “রোজ রোজ তোমরা বুড়োমানুষকে বিরক্ত করো কেন বলো তো?”
বললাম, “বিরক্ত করি না মোটেই। ভালভাবে কথা বলতে বলতে ওঁর অবস্থার উন্নতি হবে মনে হয়।”
এতক্ষণ গুন্ডাগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুড়োকে দেখছিল। এবার তারা দু’জন এসে বুড়োর দু’ পাশে বসল, তাকে প্রায় টেনে তুলে কোথায় যেন নিয়ে চলে গেল।
চাওলা গায়ে পড়ে আমাদের বলল, “বেচারি পাগল মানুষ। ওই দয়ালু লোক দুটি ওকে দু’বেলা হোটেলে নিয়ে না খাওয়ালে এতদিনে হয়তো না খেয়ে মরেই যেত।”
আমরা মনে মনে বললাম যে, নিশ্চয় এর মধ্যে ওদের খুব বড় স্বার্থ জড়িয়ে আছে। ওরকম গুন্ডা প্যাটার্নের লোক কি শুধু দয়া করে কারও উপকার করতে পারে? বিশ্বাস হয় না।
এর মধ্যে অরুর ছোড়দা খবর আনলেন যে, ওই পোড়োবাড়ির মালিকের নাম কমলাকান্ত বসু। তাঁর নামেই নিয়মিত ট্যাক্স জমা পড়ে। রহস্য আরও জটিল হল। পাগলাবুড়োই যে কমলাকান্ত বসু তাতে আর এখন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাঁর পক্ষে বাড়ির ট্যাক্স জমা দেওয়া কি সম্ভব? তা হলে কে জমা দেয় ওই ট্যাক্স?
ইতিমধ্যে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে সবকিছু ভুলিয়ে দিল। পাগলাবুড়ো আর পোড়াবাড়ির রহস্য চাপা পড়ে গেল। শনিবার বেলা দুটোয় আমাদের পাড়ার ব্যাঙ্কে একটা সাংঘাতিক ডাকাতি হয়ে গেল। স্কুল থেকে ফিরে সকলের মুখেই কেবল সেই কথাই শুনতে লাগলাম। একটা পুরনো কালো অ্যামবাসাড়ার গাড়ি চড়ে কয়েকটি লোক আচমকা ব্যাঙ্কে ঢুকে পড়েছিল। তাদের হাতে পিস্তল, মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। সবাইকে ভয় দেখিয়ে প্রায় তিন লক্ষ টাকা লুট করে তারা কয়েক মিনিটের মধ্যেই পালিয়েছিল, আর যাওয়ার আগে কয়েকটা বোমা ফাটিয়ে সবাইকে বিভ্রান্ত করেছিল। কেউ কিছু ভাল করে বুঝবার আগেই তারা হাওয়া। কাজ শেষ।
অরুদের বাড়ি যেতেই ছোটবউদি চুপিচুপি তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে আমাদের বললেন যে, তিনি স্বচক্ষে ডাকাতদের পালাতে দেখেছেন। ডাকাতি করার পর কালো গাড়িটা তাঁদের বাড়ির সামনে দিয়ে পালাবার সময়ে একটা ঠেলা এসে পড়ায় ওরা বাধ্য হয়ে বাড়ির সামনে গাড়ির গতিবেগ কমিয়েছিল, তখন ছোটবউদি সামনের ঘরের জানলা থেকে স্পষ্ট ডাকাতদের মুখ দেখতে পেরেছিলেন। আমাদের কাছে বর্ণনা শুনে আর নন্দার আঁকা ছবি দেখে তাঁর গুন্ডাদের চিনতে বাকি ছিল না। অমন নাক কি আর কারও থাকতে পারে? ডাকাতরা আর কেউ নয়, তেঁতুলতলার সেই গুন্ডাগুলো!
বউদির কথা শুনে আমরা দারুণ উত্তেজিত, “এখনই পুলিশে খবর দেওয়া দরকার।” কিন্তু ছোটবউদি বললেন, “লোকগুলোর নাম-ধাম কিছুই তো আমরা জানি না, পুলিশকে কী বলব?” কথাটা আমাদের মেনে নিতে হল। কয়েকজন লোক, গুন্ডার মতো দেখতে, মাঝে মাঝে তেঁতুলতলায় আসে, এইটুকু বললেই তো আর পুলিশ ওদের পাত্তা পাবেন না। আরও নির্ভরযোগ্য সূত্র পেতে হবে।
আমি বললাম, “এখন হয়তো ওরা কিছুদিন তেঁতুলতলায় আসবে না।”
অরু বলল, “পোড়োবাড়িতে নিশ্চয় ওদের একটা ঘাঁটি আছে, না হলে ঘনঘন সেখানে যায় কেন? সেখানেই তদন্ত করতে হবে।”
পরদিন সকালেই আবার সেই পোড়োবাড়িতে গেলাম। বুড়োর ঘরে কী আছে না আছে সেসব তো আগেই দেখেছি। দক্ষিণের ঘরটায় ঢুকতে সাহস করলাম না, ছাদ ফুটো করে বটের ঝুরি এমনভাবে নেমেছে যে, ভয় হয় কখন বুঝি ভেঙেই পড়বে। পেছনের দিকে গেলাম। আগেই দেখেছি যে, দক্ষিণে একটা ছোট্ট ঘর আছে আর উত্তরে ছাদের সিঁড়ি। ছোট্ট ঘরে উঁকি মারলাম, একেবারে ফাঁকা। সিঁড়ির ধাপগুলো ভাঙা ভাঙা। দেওয়ালে তক্তা লাগানো। ছাদ পর্যন্ত উঠে আবার নেমে এলাম। হঠাৎ অরু চিৎকার করে উঠল, “কী বোকা রে আমরা, কী বোকা! ছোট্ট ঘরটা এত নিচু, অথচ বাড়ির ছাদ আগাগোড়া সমান। তা হলে মাঝের ফাঁকটা গেল কোথায়?”
ততক্ষণে আমরাও ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছি। ছোট্ট ঘরের ওপরে নিশ্চয় একটা চোরাকুঠরি আছে। আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠে দক্ষিণের কাঠের দেওয়ালটা ভাল করে লক্ষ করলাম, কিন্তু কোনও সূত্র খুঁজে পেলাম না। কোনও ছিটকিনি বা কড়া দেখলাম না। নিশ্চয় কোনও গোপন ব্যবস্থা আছে। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।
হঠাৎ সিঁড়ির মুখে পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ালাম। গুন্ডাদের বদলে দেখলাম তেঁতুলতলার সেই ছোকরা দুটি। আমাদের দেখে তারা তেড়ে এল প্রায়, “এখানে কী করছেন আপনারা? জানেন না এটা ভূতের বাড়ি? তা ছাড়া দেদার সাপখোপও আছে।”
আমরা তেমনই তেড়ে ধমক লাগালাম, “আপনারাই বা এখানে কী করছেন?”
গুন্ডাদের না দেখে আমাদের সাহস বেড়ে গিয়েছিল। ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে অরু বলল, “কান দিস না ওদের কথায়। বেশি চালাকি করতে এলে লাঠিপেটা করব।”
হাতের লাঠিগুলো ঠকঠকিয়ে আমরা বেরিয়ে গেলাম। ছোকরারা আর কিছু বলতে সাহস করল না। ওরা পোড়োবাড়িতে এসেছিল কেন কে জানে? সত্যিই কি ওরা গুন্ডাদের দলের লোক?
তেঁতুলতলায় বেশ ভিড় ছিল। যদিও সেখানে গুন্ডাদের অথবা সেই ছোকরাদের দেখলাম না। দুপুরে আমাদের লেটার বক্সে একটা হাতচিঠি পেলাম, খামের ওপর কাঁচা হাতে আমাদের তিনজনের ডাকনাম লেখা আর ভেতরে সেই কাঁচা হাতেই লেখা, “সাবধান করে দিচ্ছি, এখনই যদি অনধিকার চর্চা বন্ধ না করো, তা হলে প্রাণের মায়া ছেড়ে দাও!”
ওরা নিশ্চয় আমাদের ভয় দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার বদলে আমরা উল্লসিত হয়ে উঠলাম। চিঠিটা যে গুন্ডাদলের কারও লেখা সে-বিষয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল না। মনে হল, যেন এতদিনে আমরা প্রমাণ পেলাম যে পোডড়াবাড়িটা ওদের কুকীর্তির ঘাঁটি। গুন্ডারা এবং চোঙাপ্যান্ট ছোকরারা সবাই এর মধ্যে জড়িত। ছোটবউদি ওদের দেখেও ফেলেছেন।
এতদিন আমরা সমস্ত কথা নিজেদের মধ্যে গোপন রেখেছিলাম। বাবা-মাকে পর্যন্ত কোনও কথাই বলিনি। এখন মনে হল যে, বাবার সাহায্য ছাড়া পুলিশ হয়তো কেবলমাত্র আমাদের কথাকে গুরুত্ব দেবেন না। অবশ্য বাবাও সব কথা বিশ্বাস করবেন কি না সে-বিষয়ে আমাদের কিছুটা সন্দেহ ছিল। কাজে দেখা গেল যে, আমাদের মুখে সব কথা শুনে বাবাও আমাদের মতো উৎসাহিত হয়ে পড়লেন। মা অবশ্য আমাদের কিছুটা বকলেন, ওরকম ঝুঁকি নিয়ে বারবার পোড়োবাড়িতে যাওয়ার জন্য, গুন্ডাদের আড্ডায় তদন্ত করতে যাওয়ার জন্য।
বাবা উত্তেজিত হয়ে লালবাজারে ফোন করলেন, পুলিশের আর গোয়েন্দা বিভাগের বড় কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বিশেষ জোর দিয়ে বললেন যে, ওরা নিশ্চয় ব্যাঙ্ক লুটের টাকা তাড়াতাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে, সুতরাং অবিলম্বে ওদের ধরা দরকার। আমরা আশা করেছিলাম যে, এমন দারুণ একটা খবর পাওয়ার পরেই দলে দলে গোয়েন্দা আর পুলিশ এসে গুন্ডাদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করবেন আর সমস্ত চোরাই মাল উদ্ধার করবেন। কিন্তু সেরকম নাটকীয় কিছু ঘটল না। মনে হল যেন বাবা সঙ্গে থাকা সত্বেও ওঁরা আমাদের কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না। পুলিশের বড় কর্তাদের সে কী জেরা! তাঁরা বোধহয় ধরেই নিয়েছেন যে, অতিরিক্ত গোয়েন্দাকাহিনি পড়ার ফলে আমরা এসব কল্পনা করেছি।
আমরা বললাম, “চলুন আমাদের সঙ্গে, তেঁতুলতলার সেই পাগলাবুড়ো আর চা-ওলা থেকে শুরু করে গুদল আর চোঙাপ্যান্ট পরা ছোকরা, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেব।” নন্দা চটপট গুন্ডাদের ছবি এঁকে ফেলল, পাগলাবুড়ো, চা-ওলা আর ছোকরা দুটো, কারও ছবি আঁকতে বাকি রাখল। পোড়োবাড়িটার ছবিও এঁকে দিল। এতক্ষণে পুলিশ অফিসারদের কিছুটা বিশ্বাস জন্মেছে মনে হল। তাঁদের নির্দেশে দুই গোয়েন্দা তেঁতুলতলায় গিয়ে পাগলাবুড়োর সঙ্গে একটু কথা বললেন, চা-ওলার কাছে চা কিনে খেলেন। নন্দার আঁকা ছবির সঙ্গে চা-ওলা আর বুড়োর চেহারা হুবহু মিলছে দেখে ওঁরা ভরসা করলেন যে, গুন্ডাদের আর ছোকরাদেরও এইভাবেই চিনে ফেলতে পারবেন।
তারপর আবার সব চুপচাপ, সাড়াশব্দ নেই। আমাদের এতদিনের পরিশ্রমকে কি তা হলে ওঁরা কোনও গুরুত্বই দিলেন না? ভারী দুঃখিত হলাম।
পরে বুঝেছিলাম যে, পুলিশ ঠিক কাজই করেছিলেন। ভান করলেন যেন ওঁরা চলে গেলেন, তদন্ত চুকে গেল। কিন্তু কয়েকজন গোয়েন্দাকে গোপনে পোড়োবাড়ির আশেপাশে মোতায়েন রাখলেন। অস্ত্রধারী পুলিশ রইলেন কিছুটা দূরে, ডেকে পাঠালেই আসবেন। সত্যি সত্যিই চোরাই মাল সরিয়ে ফেলার চেষ্টায় গুন্ডারা রাতদুপুরে পোড়াবাড়িতে এসেছিল, গোপন সংকেতের সাহায্যে চোরাকুঠুরি খুলেছিল। ঠিক তখনই গোয়েন্দাদের ইঙ্গিত পেয়ে পুলিশবাহিনী এসে ওদের হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন। সেই তিনটি গুন্ডা আর চোঙাপ্যান্ট ছোকরা দুটি, সবাই একসঙ্গে জালে পড়েছিল। ওদের মধ্যে দুটি গুন্ডা নাকি সাংঘাতিক কুখ্যাত, বহুদিন চেষ্টা করেও পুলিশ তাদের ধরতে পারেননি। পোড়োবাড়ির সেই গোপন কুঠরিতে ব্যাঙ্ক লুটের পুরো টাকা পাওয়া তো গেলই, আরও অনেক চোরাই জিনিস পাওয়া গেল— সেসব কোনওদিন উদ্ধার হবে না ভেবে পুলিশ হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। গুন্ডারা সবই স্বীকার করল। বুড়োর বন্ধু সেজে তারা তাকে রোজ হোটেলে খাওয়াত আর তার বাড়ির দলিলটা হাতিয়ে তারই নামে ট্যাক্স জমা দিত।
বুড়োর প্রতি আমাদের বিশেষ মমতা জন্মেছিল। গুন্ডারা গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় সে-বেচারা একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। অরুর ছোড়দা আর ছোটবউদি তখন তাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে এসে সব ভার নিয়েছিলেন। নিজেদের একটা ঘরে রেখেছিলেন, ভালভাবে খাওয়াপরার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমরা কমলদা বলে ডাকতাম, এসে নানা গল্প শুনতাম, বিশেষ করে মণিমালার ছেলেবেলার গল্প। ক্রমে সে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল, স্মৃতিশক্তি ফিরে পাচ্ছিল, কথাবার্তা বলছিল।
ব্যাঙ্ক ডাকাত ধরা পড়ার খবর সব কাগজে বেরিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কৃতিত্বের কথাও ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। কমলাকান্ত বসু আর মণিমালার কথাও অনেক পত্রিকায় বেরিয়েছিল।
এইখানেই সমস্ত ব্যাপারটার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত, কিন্তু এর পরেও এমন একটা কিছু ঘটল যাতে আমরা যেমন চমৎকৃত, তেমনই উল্লসিত হয়ে পড়লাম। হঠাৎ ডায়মন্ডহারবার থেকে বড়মামা এলেন, সঙ্গে মামি, ছেলেমেয়েরা আর তাঁদের বাড়ি থাকেন এমন এক মহিলা যাঁকে আমরা মণিদি বলতাম। কাগজে ডাকাত ধরার খবর পড়ে কলকাতায় এসেছেন বললেন মামা, প্রথমেই আমাদের অভিনন্দন জানালেন। তারপরেই তিনি কমলাকান্ত বসুর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলেন। এখন তো কমলদার কথাবার্তা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক, দু’জনে আলাপ-পরিচয় হল। অবাক হয়ে মামার কাছে শুনলাম যে, মণিদি তাঁদের কোনও আত্মীয়া নয়। কুড়ি-বাইশ বছর আগে কাকদ্বীপের কাছে একটি ছোট্ট মেয়েকে গঙ্গার তীরে কুড়িয়ে পাওয়া গিয়েছিল। দাদুর কাছে মেয়েটিকে আনা হয়েছিল। দাদু নানাভাবে কথাবার্তা বলতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু মেয়েটি নিজের নামটুকু ছাড়া ঠিকানা বা পরিচয় কিছুই বলতে পারেনি। অনেক খোঁজ করেও তার বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজনের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। তখন সে দাদুর কাছেই থেকে গেছিল। এখন মামার মনে হচ্ছে যে, এই মহিলাই কমলাকান্ত বসুর মেয়ে মণিমালা নয় তো? হয়তো সে নৌকাডুবির পরে কাকদ্বীপের কাছে ভেসে এসেও আশ্চর্যভাবে বেঁচে গিয়েছিল। সেই ছোট্ট মণি পুরো নাম-ঠিকানা কিছুই বলতে পারেনি, কিন্তু বয়স আর সময় হিসেব করে মনে হয় যে, সেটা সম্ভব। কমলদা এত বছর পরেও মণিদিকে দেখে নিজের মেয়ে বলে চিনে নিলেন। বাঁ গালের একটা মস্ত বড় গোল তিল আর বাঁ কাঁধের পেছনে লম্বাটে একটা লাল জড়ুল দেখে প্রায় বাইশ বছর পরেও নিজের হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে সঠিক শনাক্ত করতে পারলেন।
তারপর? তারপর সে যে কী আনন্দ, সব কথা বর্ণনা করার মতন ভাষা আমার নেই। আমাদের বারবার মনে হচ্ছিল যে, ব্যাঙ্কের চুরি যাওয়া তিন লক্ষ টাকা উদ্ধারের চেয়ে অনেক মূল্যবান, এত বছর পরে কমলদার হারানো মণি আবার ফিরে পাওয়া।
২৪ জুন ১৯৯২
অলংকরণ: দেবাশিস দেব