পোড়োবাড়ি
খবরটা প্রথম কে দিয়েছিল বা কেমন করে এল সে গবেষণায় না গেলেও, কাঞ্চনপুরের একটা পুরোনো বাড়িতে যে ভূতের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে সে-খবরটা কিন্তু মিথ্যে নয়। গাঁয়ের অনেকেই নাকি সেই ভূতকে স্বচক্ষে দেখেছে— তবে ভূত না পেতনি সেটাই হচ্ছে কথা, কারণ যারা দেখেছে তারা সবাই একবাক্যে বলেছে, ভূত পুরুষ নয়, নারী।
যাই হোক; এমন একটা রগরগে খবর আগেভাগে ছাপাবার কৃতিত্বের অধিকারী কোন পত্রিকাই না হতে চায়! ‘বার্তা সমাচার’ আর ‘প্রভাতী বার্তা’র মধ্যে দীর্ঘকালের রেষারেষি। পাশাপাশি তাদের আপিস, দুই মালিকের মধ্যে দূর সম্পর্কের একটা আত্মীয়তাও আছে, আর দুই সম্পাদকের মধ্যে পরিচয় ও বন্ধুত্ব ইস্কুলের নীচু ক্লাস থেকে। কিন্তু তা হলে কী হবে, কাগজের ব্যাপারে তাদের মধ্যে দারুণ রেষারেষি। কে কাকে টেক্কা দেবে, চমকপ্রদ খবরে কে কাকে মাত করবে, এই নিয়ে দুই পত্রিকার মধ্যে যেন যুদ্ধ লেগেই আছে।
‘বার্তা সমাচার’-এর প্রবীণ সম্পাদক ঘোষাল মশাই খবরটা পেয়েই রথীনকে ডেকে পাঠলেন। মাত্র সাতাশ বছর বয়স রথীনের, কিন্তু এর মধ্যেই সাংবাদিক হিসাবে বেশ নাম করেছে, বিশেষ করে চমক লাগাবার মতো খবরে ওর হাতটা খোলে ভালো। যেমন লেখার ভঙ্গি, তেমন ভাবের বিন্যাস।
রথীনকে ঘটনা খুলে বললেন ঘোষাল মশাই। আরও বললেন, ‘প্রভাতী বার্তা’ খবরটা পাবার আগেই ‘বার্তা সমাচার’-এ সবিস্তার ওই ভূতুড়ে কাহিনি প্রকাশ করা চাই-ই।
কাঞ্চনপুর যেতে হলে ট্রেনে যাওয়াই ভালো; বাসে অনেক ধকল, সময়ও নেবে বেশি। জায়গাটা সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করেই রথীন রওনা দিয়েছিল। বিকেল তিনটে নাগাদ ছোট্ট স্টেশনে ও নেমে পড়ল। ভূতুড়ে বাড়িটা স্টেশন থেকে হাঁটাপথে মিনিট পনেরো কুড়ি বলেই ও শুনেছিল। রথীন হেঁটে যাওয়াই স্থির করল।
ভূতুড়ে বাড়িটার নাম ‘দি রিট্রিট’। শহর থেকে দূরে প্রায় অজ পাড়াগাঁয়ে বাড়িটার অমন নামের সার্থকতা অস্বীকার করা যায় না। বাড়ির মালিকের যে রসবোধ ছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
বাড়িটার এবং বাড়ির মালিকের সম্বন্ধে খোঁজখবর করে রথীন যা জানতে পেরেছে তা হল এই—
প্রায় কুড়ি বছর আগে রাজেশ সরকার নামে এক ভদ্রলোক মিলিটারি থেকে অবসর নেবার পর সদ্য বিয়ে করা বউকে নিয়ে এখানে বসবাস শুরু করেন। মিলিটারিতে অবসরের বয়স পঞ্চাশ। ভদ্রলোক একা মানুষ ছিলেন তাই বেশ মোটা টাকা জমিয়েছিলেন। অবসর নেবার মুখে হঠাৎ তাঁর অধীনস্থ এক হাবিলদারের সুন্দরী, তরুণী মেয়েকে তিনি বিয়ে করে বসেন। এত জায়গা থাকতে কাঞ্চনপুরে কেন যে তিনি এসেছিলেন তার সঠিক কারণ অবশ্য জানা যায়নি। হয়তো ছোটোবেলায় এখানে তাঁর কোনো স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। যাই হোক, ছোট্ট একটা দোতলা বাড়ি বানিয়ে সুন্দরী বউকে নিয়ে তিনি এখানে কায়েম হয়ে বসলেন। কিছুকাল বেশ সুখেই কেটেছিল, তারপরই ঘটল বিপত্তি। বাড়ি থেকে খানিকটা দূর দিয়ে বয়ে গেছে একটা নদী। গ্রীষ্মকালে সেটাকে দেখায় একটা খালের মতো, কিন্তু বর্ষায় সেটাই ফুলেফেঁপে ভীষণ মূর্তি ধরে। এক বর্ষার রাত্তিরে রাজেশ সরকারের তরুণী স্ত্রী ইন্দুমতী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে গেল। পরদিন সকালে নদীর পাড়ে পাওয়া গেল তার চটিজোড়া। ইন্দুমতী নদীর ধারে মাঝে মাঝে বেড়াতে যেত। সেদিনও নিশ্চয় তাই গিয়েছিল, কিন্তু যেমন করেই হোক রাক্ষুসী নদী তাকে গ্রাস করেছে। খানিকটা দূরে তার শাড়িটাও পাওয়া গেল। জেলেরা মাছ ধরার জন্য কয়েকটা খুঁটি পুঁতেছিল, তাইতে আটকে ছিল শাড়িটা, ইন্দুমতীর দেহটা কিন্তু কাছেপিঠে পাওয়া যায়নি। যাই হোক, দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু সম্বন্ধে গাঁয়ের লোকের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। রাজেশ সরকার সেদিন অসুস্থ ছিলেন তাই সারাদিন বাড়ির বাইরে বেরোননি, শুয়েই কাটিয়েছিলেন। বাড়িতে যে লোকটি রান্নাবান্না করত তার মুখেই একথা শোনা গিয়েছিল।
ইন্দুমতীকে হারিয়ে একেবারে ভেঙে পড়লেন রাজেশ সরকার। আকস্মিক এই দুর্ভাগ্যকে কিছুতেই তিনি মানিয়ে নিতে পারলেন না। একা একা বসে থাকতেন, কেউ এলে কথাবার্তা বলতেন না, খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারপরই একদিন কড়িকাঠে তাঁর ঝুলন্ত দেহটা আবিষ্কৃত হল। ইন্দুমতীরই একটা প্রিয় শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
ব্যস, তারপর থেকেই ওই বাড়িটা পরিত্যক্ত। এমনিতেই বাড়িটা লোকালয়ের কিছুটা বাইরে, নিরিবিলি জায়গা, রাত্তিরে গা ছম ছম করা আশ্চর্য নয়। তার ওপর দু-দুটো অস্বাভাবিক মৃত্যু। সন্ধের পর ও বাড়ির ধার কাছ দিয়েও যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল। ফলে চারপাশে জঙ্গল হয়ে বাড়িটা সত্যিকার পোড়োবাড়ি হয়ে উঠেছে। তবে এতদিন কিন্তু কেউ ভূত-টুত দেখেনি। মাত্র দিনকতক হল কয়েকজন পথচারী প্রকাশ্য দিনের আলোয় ও বাড়ির দোতলার একটা জানলায় একজনকে দেখেছে। যে ঘরে রাজেশ গলায় দড়ি দিয়েছিলেন, সেই ঘরের জানলায় দূর থেকে একটা মুখই শুধু তারা দেখতে পেয়েছিল, মেয়েমানুষের মুখ, তাও অল্পক্ষণের জন্য। হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছিল সেই মুখ। ওটা যে, নদীতে ডুবে মরা ইন্দুমতীর মুখ সে-বিষয়ে কারু সন্দেহ ছিল না। ওখানকারই কোনো লোকের মুখ থেকে ঘটনাটি কেমন করে জেনেছিলেন ‘বার্তা সমাচার’-এর সম্পাদক, হরিপদ ঘোষাল।
শীতের পড়ন্ত বিকেল। চারদিক খোলামেলা, উত্তুরে হাওয়াটা বেশ মালুম দিচ্ছিল রথীনকে।
পোড়োবাড়ির ঠিক অবস্থানটা জেনে নেবার জন্য রথীন বুড়ো মতো একজন মানুষকে পথের নিশানা জিজ্ঞাসা করল। বুড়ো লোকটি ওর মুখের দিকে একটুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ওই বাড়িতে কী দরকারটা পড়ল আপনার বাবুমশাই? ওটা যে ভূতের বাড়ি জানেন না?’
‘সেজন্যই তো যাচ্ছি,’ রথীন হেসে জবাব দিল। ‘আমি খবরের কাগজের লোক, ওই বাড়িটা সম্বন্ধে কাগজে লিখব বলে এসেছি। ছবিও তুলব।’ কাঁধের ক্যামেরাটা ও দেখাল।
‘অ,’ লোকটি একটু ভুরু কুঁচকাল, ‘এই পথ ধরে সিধে চলে যান। একটা মস্ত অশত্থ গাছ দেখবেন, সেই গাছটা ছেইড়ে বাঁ-দিকে ঘুরবেন। নাকবরাবর চলে যাবেন, তাহলেই বাড়িটা চোখে পড়বে। দেখলেই চিনতে পারবেন। চারদিকে জঙ্গল। ধারেপিছে ঘর বাড়ি নাই। হ্যাঁ বাবু, একটু সাবধানে থাকবেন। ক-দিন ধরে তেনাকে দেখা যেতেছে, তাই গাঁয়ের লোকজন ওই পথে এখন আর হাঁটে না। দিনে দিনেই ফিরে আসবেন, আঁধার করবেন না।’
বুড়ো লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে রথীন হাঁটা শুরু করল। পথ যতটা কম মনে করেছিল কিংবা শুনেছিল, তা কিন্তু নয়। গাঁয়ের লোকের পথের দূরত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান চিরকালই একটু অস্পষ্ট। ‘ওই হোথা,’ ‘আট্টু আগুলেই,’ এসব কথার আক্ষরিক অর্থ ধরতে গেলে ঠকতে হয়। প্রায় কুড়ি মিনিট হাঁটার পর তবেই অশ্বত্থ গাছটা চোখে পড়ল রথীনের। বুড়ো লোকটির কথামতো এবার ও বাঁ-দিকের রাস্তা ধরল। আরও কতক্ষণ হাঁটতে হবে কে জানে! গ্রামটা স্টেশন থেকে বেশ দূরেই।
পথ ক্রমেই নির্জন হয়ে আসছে। এদিকটায় ঘরবাড়িও কম। হঠাৎ কীসের একটা অনুভূতিতে রথীন ফিরে তাকাল। এ পথের সে একাই পথিক নয়, আরও একজন তার পেছনে পেছন আসছে। ঋজু খাড়া চেহারা, রগের দু-পাশের চুলে পাক ধরেছে, টুথব্রাশের মতো ছাঁটা গোঁফ। স্মার্ট চেহারা। একটা জলপাই রঙের প্যান্ট আর ঘি রঙের শার্টে ভদ্রলোককে মানিয়েছে ভালো। চেহারা দেখে বয়স অনুমান করা মুশকিল। পঁয়ত্রিশও হতে আবার পঞ্চান্নও হতে পারে।
এই নির্জন পথে একজন সঙ্গী পেয়ে রথীন মনে মনে খুশিই হল। পরমুহূর্তে একটা সন্দেহ উঁকি দিল ওর মনে। ভদ্রলোক ‘প্রভাতী বার্তা’র রিপোর্টার নয় তো? তারই মতো খবর পেয়ে ছুটে এসেছে তাদের কাগজের ওপর টেক্কা দেবার আশায়। কিন্তু ভদ্রলোককে আগে দেখেছে বলে মনে পড়ল না। ‘প্রভাতী বার্তা’র সব রিপোর্টারকেই সে অল্প-বিস্তর চেনে। তবে কি নতুন লোক!
ভদ্রলোকের মুখের দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল রথীন, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনাকে এতক্ষণ দেখিনি তো! কোথা থেকে আসছেন?’
‘এখানেই থাকি আমি,’ ভদ্রলোক সংক্ষেপে জবাব দিলেন।
‘ও,’ মনে মনে হাঁপ ছাড়ল রথীন। ‘ভালোই হল, আপনাদের এখানে যে ভূতুড়ে বাড়ি আছে আমি সেখানেই যাচ্ছি। কুড়ি বছর আগে ওই বাড়ির মালিকের তরুণী স্ত্রী নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন, তাঁকে নাকি আবার দেখা গেছে!’
‘হ্যাঁ, আমিও তাই শুনেই আসছি,’ ভদ্রলোক জবাব দিলেন।
রথীন ভুরু কোঁচকাল। ভদ্রলোক এখানেই থাকেন অথচ খবরটা শুনেই আসছেন, তার মানে কী।
ভদ্রলোক বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝলেন, মৃদু হেসে বললেন, ‘আমি এখানে ছিলাম না, খবরটা পেয়ে আজই আসছি।’
‘ও, তা ভালোই হল,’ রথীন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘একজন সঙ্গী পাওয়া গেল।’
হাঁটতে হাঁটতে ওরা বাড়ির কাছে এসে পড়ল। সত্যিই বাড়িটা অনেক দিনের পরিত্যক্ত, বাইরে থেকে অন্তত তাই মনে হয়। এখানে ওখানে চুন-বালি-সিমেন্ট খসে পড়ে ইট বেরিয়ে পড়েছে, কার্নিশ থেকে গোটা কয়েক বট না অশ্বত্থ গাছ গজিয়েছে। চারপাশে বুনো গাছগাছড়া, ঝোপঝাড়। ওরা দু-জন একটা বড়ো ঝোপের পেছনে দাঁড়াল, অনেকটা নিজেদের আড়াল করে। দিনের বেলা যদি ইন্দুমতীর প্রেতাত্মা দেখা দেয় তবে এখান থেকে দেখাই ভালো। নিরাপদ দূরত্ব তো বটেই, তা ছাড়া রথীন জেনে নিয়েছিল যে ঘরে তেনাকে দেখা গিয়েছিল তার জানলাটা পশ্চিমমুখো অর্থাৎ ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার নাকবরাবর দোতলায়।
কিছুক্ষণ কেটে গেল। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলছে। বাড়িটার দেওয়ালে, জানলায় পড়ন্ত রোদ এসে পড়েছে। আর বড়োজোর ঘণ্টাখানেক, তারপরই সূর্য অস্ত যাবে। নেমে আসবে অন্ধকার, রথীন উশখুশ করছিল, অন্ধকার নামার আগেই ওকে স্টেশনে ফিরতে হবে। এই অচেনা, অজ পাড়াগাঁয়ে রাত কাটাতে ও রাজি নয়। হোটেল থাকলেও নয়, অবশ্য আছে কি না সে-বিষয়ে ঘোর সন্দেহ আছে ওর মনে।
দোতলার পশ্চিমমুখো একটা ঘরের জানলাগুলো খোলা। একটা জানলায় আবার পর্দার মতো কী-একটা কাপড় ঝুলছে। বাড়িতে কেউ যদি বাসই না করে তবে পর্দা এল কোথা থেকে?
হঠাৎ একটা হিম শিহরন বয়ে গেল রথীনের সারা অঙ্গে। জানলার পর্দাটা একটু সরে গেছে, আর সেই ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে একটা মুখ। একজন মহিলার মুখ। রোদ পড়েছে সেই মুখে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বয়স চল্লিশ পঁয়তাল্লিশের কম হবে না। এককালে হয়তো সুন্দরী ছিলেন, কিন্তু এখন শীতের পড়ন্ত বেলার মতোই ম্লান, চোখ-মুখই তা বলছে।
একটা অস্ফুট উক্তি কানে যেতেই রথীন চমকে পাশ ফিরে তাকাল। সঙ্গীর কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। ভদ্রলোকের দু-চোখ বিস্ফারিত, মুখটা হঠাৎ যেন ঝুলে পড়েছে। আপন মনেই তিনি বলে উঠলেন, ‘ওর যে এত বয়স হতে পারে তা আমার মনে ছিল না। আমি ভাবতেই পারিনি।’
‘কী বলছেন আপনি!’ রথীন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
‘না, মানে,’ ভদ্রলোক একটু থতোমতো খেয়ে বললেন, ‘আমি ওকে কুড়ি বছর আগে দেখেছিলাম কিনা তাই সে-চেহারার কথাই মনে ছিল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যে চেহারা বদলায় সেটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।’
ভূতের আবার বয়স আছে নাকি! মানুষের মতো তাদেরও চেহারা বদলায়! ভদ্রলোকের কথায় রথীন মনে মনে না হেসে পারল না। ও আবার জানলার দিকে ঘাড় ফেরাল। কিন্তু জানলার মুখ অদৃশ্য হয়েছে, পর্দাটাও যথাস্থানে শোভা পাচ্ছে। উত্তেজনার বশে ও ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। হয়তো ইন্দুমতীর প্রেতাত্মা ওকে দেখে ফেলেছে তাই মিলিয়ে গেছে।
অসম সাহসী না হলেও রথীন ভীতু নয়। তা ছাড়া মাথার ওপর সূর্য, স্পষ্ট দিনের আলো। অন্ধকার হলে নয় কথা ছিল, কিন্তু এই দিনে দিনে ভূতের ভয়ে পালাবার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না, বরং ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখার এমন সুবর্ণ সুযোগ আর হয়তো ওর জীবনে আসবে না। সঙ্গীর দিকে ফিরে ও বলল, ‘চলুন, আমরা বাড়ির ভেতর ঢুকে ইন্দুমতীর প্রেতাত্মার মোলাকাত করি। দিনের বেলা ভূত-পেতনির দেখা পাওয়া যায় বলে কখনো শুনিনি। ব্যাপারটা কেমন যেন রহস্যজনক মনে হচ্ছে।’
ভদ্রলোকের দিক থেকে তেমন উৎসাহ কিন্তু দেখা গেল না। তিনি হঠাৎ যেন চুপসে গেছেন।
‘চলুন,’ উদাসীনভাবে তিনি বললেন।
বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছে ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘আমি আর ভেতরে যাব না।’
রথীন মনে মনে চটল, ভাবল ভদ্রলোকের চেহারা অ্যাথলিটদের মতো হলে কী হবে, ভীষণ কাপুরুষ।
‘ঠিক আছে, আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন, আমি একাই যাচ্ছি,’ বীরদর্পে ও ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে ঢুকে ও কিন্তু অবাকই হল। ঘরটা পোড়োবাড়ির মতো নয়, যেন হালে ধোয়া মোছা হয়েছে। দোতলার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে ওর বুকের ভেতরটা হঠাৎ লাফাতে শুরু করল। একা একা উপরে উঠবে! একটু বেশি হঠকারিতা হয়ে যাবে না! কিন্তু কোথা থেকে সিঁড়ির ওপর এসে পড়া এক ঝলক রোদ ওর মনে সাহস ফিরিয়ে আনল। তারপরই ওর নজর পড়ল সিঁড়ির মুখে এক জোড়া মেয়েদের জুতোর ওপর। আবার ভুরু কোঁচকাল ও। ভূত জুতো পরে নাকি! এ নিশ্চয়ই একটা জাল-জুয়োচুরির ব্যাপার! সমস্ত ঘটনাটাই হয় সাজানো নয় মস্ত একটা ধাপ্পা। বুক ঠুকে ও ওপরে উঠে গেল।
দোতলার ডান দিকের ঘরের দরজাটা বন্ধ। রথীন আস্তে আস্তে ধাক্কা দিল সেই দরজায়। কোনো সাড়া-শব্দ নেই, দরজাও খুলল না। আবার ধাক্কা দিল রথীন, এবার একটু জোরে।
‘কে?’ কাঁপা কাঁপা মেয়েলি কণ্ঠে প্রশ্ন হল।
‘খুলুন দরজা,’ রথীন বলল, ‘ভয় নেই;;আমি আপনার কোনো অনিষ্ট করব না।’ সঙ্গেসঙ্গে ওর মনে পড়ল যাকে ও অভয় দিচ্ছে, আসলে তার একজন ভূত বা পেতনি হবার কথা। তাকেই সে ভরসা দিয়ে বলছে, ‘ভয় নেই’ কথাটা মনে হতেই ওর ভীষণ হাসি পেল।
ভেতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হল। রথীন দেখল ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে জানালায় দেখা সেই মহিলা। মুখটা তাঁর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
‘কে আপনি? এখানে কী করছেন?’ বেশ একটু রুক্ষ স্বরেই প্রশ্ন করল রথীন।
‘আমার বাড়ি এটা,’ মিন মিন করে ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন। খুব ভয় পেয়েছেন মনে হল।
‘আপনার বাড়ি!’ রথীন ঠিক বুঝতে পারে না।
‘হ্যাঁ, মানে তাই ছিল আগে। আমার স্বামী তৈরি করেছিলেন এই বাড়িটা।’
‘আপনার স্বামী!’ রথীন অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলল।
‘হ্যাঁ, আমার স্বামীর নাম রাজেশ সরকার। মিলিটারি থেকে অবসর নেবার পর এই বাড়িটা উনি বানিয়েছিলেন।’
‘আপনিই তবে ইন্দুমতী দেবী?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু আমি শুনেছিলাম আপনি নদীতে ডুবে মারা গিয়েছিলেন।’
‘না,’ ভদ্রমহিলা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘আসল ঘটনা তা নয়। আপনাকে তবে খুলেই বলি। বিয়ের সময় আমাদের বয়সের অনেক তফাত ছিল। ওঁর পঞ্চাশ আর আমার মাত্র কুড়ি। আমাকে উনি সুখী করার জন্য সবরকম চেষ্টাই করেছিলেন, কিন্তু তখন আমার অল্প বয়স, তাই কিছুতেই আমার মন উঠছিল না, ভাবতাম বুড়ো স্বামী। তা ছাড়া এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসে সারাজীবন কাটাবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না আমার। এখানে আনন্দ-ফুর্তি নেই, হইচই নেই, যেন বনবাস। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে উনি আমার কথায় কান দেননি। ওঁর ধারণা হয়েছিল শহরে থাকলে ছেলে-ছোকরারা আমার দিকে নজর দেবে, আমিও হয়তো বিগড়ে যাব। এসব ভেবেই এ জায়গাটা ওঁর পছন্দ হয়েছিল।
কিছুদিন পর আমার অসহ্য লাগতে লাগল, জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। উনি ছাড়া দ্বিতীয় কারু সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর্যন্ত লোক নেই, দিন আর কাটতে চায় না। শেষ পর্যন্ত আমি এক মতলব আঁটলাম। এক বিকেলে ছোট্ট একটা পুঁটুলি আর একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ওঁর অসুখ করেছিল, ঘুমুচ্ছিলেন, কাজের লোকটাকে আমি স্টেশনের দিকে পাঠিয়েছিলাম। দেখছেন তো এদিকটা কেমন নিরিবিলি, তবু এখন কিছু ঘরবাড়ি উঠেছে, তখন তাও ছিল না। কিছু কেনাকাটা করতে হলে সেই স্টেশনের দিকেই যেতে হত। নদীর ধারে এসে আমি পুঁটুলি খুলে পুরোনো একজোড়া চটি ফেলে দিলাম, একটা শাড়ি নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। গাঁয়ের পথ ছেড়ে অনেকটা ঘুরপথ হেঁটে আমি স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলাম। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল, তার ওপর একটু বড়ো করে ঘোমটা দিয়েছিলাম, তাই কেউ আমার মুখ দেখতে পায়নি। সোজা চলে গেলাম কলকাতায়, মা-বাবাকেও কিছু জানালাম না। কলকাতায় একটা মেয়ে হস্টেলে আমার এক বন্ধু ছিল। টেলিফোন আপিসে কাজ করত। আমি ওর কাছে গিয়েই উঠলাম, সব খুলে বললাম। ও আমাকে শুধু আশ্রয়ই দিল না, আমার একটা কাজও জুটিয়ে দিল। আমি অন্য নাম নিলাম, ইন্দুমতী হয়ে গেল বাসন্তী। যে জীবন আমি চেয়েছিলাম তাই হাতের মুঠোয় এসে গেল। হইহুল্লোড়ে দিনগুলি বেশ কেটে যাচ্ছিল। তারপর আবার আমি বিয়ে করলাম। এক বড়োলোকের ছেলেকেই আমি বেছে নিয়েছিলাম। কিছুদিন বেশ সুখেই কাটল। কিন্তু তারপরই আমার দ্বিতীয় স্বামীর গুণের পরিচয় পেতে লাগলাম। স্বভাবচরিত্র খারাপ। এ নিয়ে প্রায়ই আমাদের তুমুল ঝগড়া হত। শেষ পর্যন্ত আমরা ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলাম। আমার দ্বিতীয় স্বামী ছাড়াছাড়ির শর্ত হিসাবে ব্যাঙ্কে আমার নামে মোটা টাকার একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। সেটার ওপর ভরসা করে আবার আমি চাকরি খুঁজে নিলাম।
এর পরেও কয়েকজন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে এসেছিল, কিন্তু আমি রাজি হইনি। বিয়ের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। ক্রমে যতই বছর কাটতে লাগল, প্রথম স্বামীর কথা মনে করে অনুশোচনা হতে লাগল আমার। তিনি আমাকে সত্যিই ভালোবাসতেন, সুখী করার জন্য অনেক চেষ্টাই করেছিলেন, কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে অবিশ্বাসের কাজ করেছি। অনেকবার ভেবেছিলাম চিঠি লিখব, কিন্তু কেন যেন সাহসে কুলোয়নি। এখন মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়েছি। দিন কয়েক হল যা হয় হবে ভেবে এখানে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি ঘরবাড়ির কী ছিরি, যেন একটা পোড়োবাড়ি। কর্তার সঙ্গেও এ ক-দিনে দেখা হয়নি। তিনি এখানে আছেন নাকি চলে গেছেন তাও জানি না। গাঁয়ের লোকের কাছে যেতেও সাহস হচ্ছে না। আমি যে ডুবে মরেছি তা এখানকার সবার নিশ্চয়ই জানে, সেইরকম ফন্দিই আমি এঁটেছিলাম। এখন নিজের পরিচয় দিলে সবাই আমাকে হয় মিথ্যেবাদী নয় ভূত ভাববে। এমনিতেও ভয়ে ভয়ে সিটিয়ে আছি। কর্তা এসে আমাকে দেখলে কীভাবে নেবেন জানি না তো।’
রাজেশ সরকারের আত্মহত্যার খবরটা যে ভদ্রমহিলা জানেন না তা এতক্ষণে বুঝতে পারল রথীন। এই তবে ঘটনা! হঠাৎ একটা কথা মনে করে ও জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু এ-কদিন আপনি এখানে আছেন, খাওয়া-দাওয়ার কী করছেন? বাড়িতে কেউ যদি না-ই থাকে তবে সেসবের পাটও নিশ্চয় নেই।’
‘আমি আসার সময় রামকে মানে আমার ছোকরা চাকরকে সঙ্গে এনেছি। একা আসার সাহসও ছিল না। সে-ই স্টেশন থেকে বাজার করে আনে, রান্না করে। ঘরদোর আমরা দু-জন এ ক-দিনে যতটা পেরেছি পরিষ্কার করেছি, যা নোংরা হয়েছিল।’
‘কই ওকে তো দেখছি না?’ রথীন বলল।
‘কেনাকাটা করতে গেছে। ওকে আমি বলে দিয়েছি আমার সম্বন্ধে কাউকে কিছু না বলতে, এ বাড়িতে আমরা যে আছি তাও যেন না বলে। খুব চালাক ছেলে।’
‘হ্যাঁ !’ রথীন স্বগতোক্তি করল। ব্যাপারটা এখন ওর কাছে জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে। অনুতপ্তা ইন্দুমতী ফিরে এসেছে তার প্রথম স্বামীর কাছে, কিন্তু তিনি যে তারই শোকে আত্মঘাতী হয়েছে সে-খবরটা বেচারি জানে না। এদিকে জানলায় তাকে দেখে গাঁয়ের লোক ভূত ভেবেছে আর সেটা যেমন করেই হোক গিয়ে পৌঁছেছে ‘বার্তা সমাচার’-এর সম্পাদকের কানে। রাজেশ সরকারের মর্মান্তিক খবরটা এখন দেওয়া উচিত হবে কি না তাই ও ভাবছিল। ভদ্রমহিলার কথায় ওর চমক ভাঙল।
‘একটা কথা আমি বুঝতে পারছি না,’ ভদ্রমহিলা অনেকটা যেন আপন মনেই বললেন।
‘কী কথা?’ রথীন কৌতূহলী হয়ে উঠল।
‘এতদিন পরেও ওঁর চেহারা কিন্তু একটুও বদলায়নি, ঠিক সেইরকমই আছেন দেখতে। আশ্চর্য!’
‘কার কথা বলছেন আপনি!’ রথীনের বিস্ময়ের যেন শেষ নেই।
‘ওঁর কথাই বলছি,’ ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘আপনারা যখন ঝোপের আড়াল থেকে জানলার দিকে তাকিয়েছিলেন, আমি আপনাদের দেখতে পেয়েছিলাম।’
‘কী বলছেন আপনি!’ রথীন হতবুদ্ধির মতো প্রশ্ন করল।
‘ঠিকই বলছি,’ ভদ্রমহিলা একটু মুচকি হাসলেন। ‘আপনারা ভেবেছিলেন আমি আপনাদের দেখতে পাইনি, কিন্তু তা নয়। রাস্তা দিয়ে আপনারা যখন কথা বলতে বলতে আসছিলেন, তখন আমি আপনাদের দেখেছিলাম। এতদিন পর কীভাবে ওঁর মুখোমুখি হব সেই ভেবেই আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তাই দরজা খুলতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু উনি নীচে কী করছেন?’
রথীনের সমস্ত শরীরে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। মুহূর্তকাল, তারপরই ও একছুটে সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে এল। দরজার কাছে কাউকে সে দেখতে পেল না। আশেপাশেও কেউ নেই। দূরেও কাউকে দেখা যাচ্ছে না— ফাঁকা, খাঁ খাঁ করছে চারদিক।
সূর্য পশ্চিমে আরও হেলে পড়েছে। হিমেল হাওয়ায় সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল রথীনের। আসলে ভূত কে এখন সেটা ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে।