গৌড়ানন্দ কবি ভনে

পোড়া বাড়ির রহস্য

পোড়া বাড়ির রহস্য

সেনট্রাল ব্যাংকের আগুন সমগ্র ডালহৌসি এলাকাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতে ব্যর্থ হওয়ায় কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের সদস্যদের মনে গভীর হতাশার সৃষ্টি হয়েছে।

সত্যি বলতে কী, কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের জনৈক মুখপাত্র আমাকে গতকাল বলেন, আমরা এটা আশা করিনি। এত বড় একটা আগুন মাত্র একটা বাড়িকে পুড়িয়েই যে তার কর্তব্য শেষ করবে, এ আমরা বুঝতে পারিনি।

বুঝতে পারলে কী করতেন?

আমার এই প্রশ্নের উত্তরে কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের উক্ত মুখপাত্র বিষণ্ণভাবে জবাব দিলেন, আমরা তাহলে এমন প্রিকশান, নিতাম যে অন্তত ৫ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে একটা বাড়িও আস্ত না থাকে।

আমরা ভস্মীভূত সেন্ট্রাল ব্যাংক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। চারিদিকে পুলিশ পাহারা। কয়েকদল লোককে দেখা গেল, তাঁরা হেঁট হয়ে হয়ে ছাইয়ের গাদা থেকে কী-সব যেন খুঁটে খুঁটে তুলছেন।

কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের মুখপাত্র একটু সরে এসে নিচু স্বরে আমাকে বললেন, ওঁরা সব এস্পার্ট। কেন এত বড় একটা আগুন এই রকম অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও মাত্র একটা বাড়িকে পুড়িয়ে থেমে গেল, সে সম্পর্কে আমরা তদন্ত করতে চাই।

উই উইল গো দি হোল হগ্। ভদ্রলোককে একটু উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা গেল। বললেন, আমরা অল্পে ছাড়ব ভেবেছেন? মোটেই না। ট্যাক্‌স্ পেয়ারদের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে? একটা বাড়ির আগুন অন্তত একটা মহল্লাকে শেষ করে দেবে, কলকাতার আগুনের কাছে লোকের এইটেই হচ্ছে ন্যূনতম প্রত্যাশা। কিন্তু কেন সেই আশা পূর্ণ হল না? কেন? কেন? আমাদের তরফ থেকে তো ত্রুটি ছিল না। আগুনকে অবাধে বেড়াতে দেবার জন্য আমাদের নগর উন্নয়ন পর্ষদের পক্ষ থেকে যা করবার দরকার অনেক দিন থেকে আমরা তা করে রেখেছি। তা সত্ত্বেও কেন এত পুওর রেজাল্ট হল, এটা মশাই সত্যিই একটা রহস্য।

ভদ্রলোক ডান হাতের মুঠি দিয়ে বাঁ হাতের তালুতে ঘুষি মেরে বললেন, আমরা সেই রহস্যের তল দেখতে পাই। দরকার হলে আমরা বিলাত থেকে এপার্ট আনব। স্কটল্যানড ইয়ারড থেকে ডিটেকটিভ আনব। জেমস বন্ড, জাদুকর ম্যানড্রেক, অরণ্যদেব কাউকে আর বাদ রাখব না। বুঝেছেন!

আচ্ছা, আমি প্রশ্ন করলাম, সেন্ট্রাল ব্যাংকের এই আগুন সমগ্র ডালহৌসি এলাকাকে পুড়িয়ে ছাই না করেই যে নিভে গেল, এর মধ্যে কি কোনও ফাউল প্লে আছে বলে আপনি সন্দেহ করেন?

অফিসিয়ালি আমি এ ব্যাপারে কোনও কিছুই এখন বলতে চাই না। ফোরেনসিক রিপোর্ট পেলে সে-কথা বলাই ভালো। কিন্তু অ্যাজ এ ম্যান, ভদ্রলোক এদিক ওদিক চেয়ে গলা নামিয়ে বললেন, আমি শুধু সন্দেহই করি না, মনে প্রাণে বিশ্বাসও করি।

বৃহস্পতিবার রাত্রে, কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের মুখপাত্র বললেন, রাত্রি তখন তিন কি সাড়ে তিন পর্ষদের চেয়ারম্যান টেলিফোনে আমার ঘুম ভাঙালেন। বললেন, মুখুজ্জে গুড্‌ নিউজ। এই মাত্তর খবর পেলাম ডালহৌসিতে আগুন লেগেছে। আশায় বুক দুলে উঠল। আনন্দে লাফিয়ে উঠতে ইচ্ছে হল, জানেন। বললাম, বলেন কি স্যর, এতদিনে তবে লাগল। এ যে বিশ্বাস হয় না। খবরটা জেনুইন তো। চেয়ারম্যান বললেন, পুলিশের সোর্স। এক্ষুনি অফিসে চলে এস। সবাইকেই ডেকেছি। পড়ি কি মরি, অফিসে গিয়ে পৌঁছালাম। চেয়ারম্যান, সেকরেটারি, মেমবারগণ, সবাই এসে হাজির। সেকরেটারি নিজেই টেলিফোন নিয়ে প্রোগ্রেস জানতে বসলেন। বলতে লাগলেন, সেনট্রাল ব্যাংকের তলায় তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ছে।

চেয়ারম্যান বলেন, বেশ জোর আগুন?

সেক্রেটারি : খুবই জোরদার আগুন স্যর। এর উপর ব্যাংক করা যায়। আমাদের এপেরিমেন্ট এতদিনে বোধ হয় ফল দেবে।

হ্যা-ল্লো! কী, দমকল এসেছে?

চেয়ারম্যান : এই এক উৎপাত! ও মুখুজ্জে, দমকল এলো যে?

আমি বললাম, মুখপাত্রটি বললেন, আসতে দিন না স্যর। ভয় কি? একফোঁটাও জলও তো রাখিনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা নাড়ুক শুধু।

চেয়ারম্যান : ওদের বিশ্বাস নেই। দেখি হাইড্রেনটের চারট।

নগর স্থপতি বললেন, ভয় নেই স্যর! ওগুলো সব বুজে গেছে। এত পলি জমেছে যে ও দিয়ে জল আর বেরবে না। অধিক ফলনশীল চাষ বরং হতে পারে।

চেয়ারম্যান : দেখবেন, এতদিন পরে নগর উন্নয়নের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবার যে চান্স্টা পাওয়া গেল তা আবার ভেস্তে না যায়। হ্যাঁ, আগুন কদ্দূর? পাশের বাড়িতে লাফিয়ে পড়েছে? সেক্রেটারি : হ্যাল্লো! আগুন পাশের বাড়িতে লাফিয়ে পড়েছে? পড়েনি, ওই একটা বাড়িই জ্বলছে? এখনও ওই একটা বাড়িই জ্বলছে! রাবিশ!

কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের মুখপাত্র নাটকীয়ভাবে সেই রাত্রের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে দিতে হতাশায় প্রায় ভেঙে পড়লেন। ধরা-ধরা গলায় বললেন, যে দেশের আগুন এত সুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে পারে না সেখানে কোনও উন্নতি আশা করা যায় বলুন! আগুনের পক্ষে অনুকূল কলকাতার মতো এমন জায়গা আর পাবেন না, এ যদি আমি তামা তুলসী গঙ্গাজল নিয়েও বলি, কেউ এখন বিশ্বাস করবে সে কথা! বলুন?

আমি ওঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললাম, আচ্ছা, দমকল আপনারা নিষিদ্ধ করে দিচ্ছেন না কেন?

কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের জরুরি বৈঠকে গতকাল ওই কথা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। মুখপাত্রটি জানালেন। আপনার সঙ্গে আমরাও এখন একমত। ঐ বিষয়ে আমরা প্রস্তাবও নিয়েছি। তবে কি জানেন, দমকল নিষিদ্ধ করতে সময় লাগবে। সংবিধান সংশোধন করতে হবে। ততদিন তো হাত তুলে আমরা বসে থাকতে পারিনে। আমরা একটা আগুন কাজে লাগাতে পারিনি সত্যি, আমাদের ব্যর্থতা আমরা স্বীকার করছি। তা বলে ভাববেন না, আরেকটা আগুনকেও আমরা বিফলে যেতে দেব। এবারের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতাই আমাদের আগামীবারের সাফল্য এনে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

কী করে আপনাদের সাফল্য আসতে পারে? আমার প্রশ্ন।

আমরা, উনি গর্বের সঙ্গে বললেন, আমরা কালবিলম্ব না করে রাস্তা উন্নয়নের কাজে হাত দিচ্ছি। এবার আমরা একটা ইনটিগ্রেটেড প্ল্যান বা নিবিড় প্রকল্প অনুযায়ী কাজ শুরু করছি। যে অঞ্চলকে পোড়াব, সেই অঞ্চলের রাস্তা উন্নয়নকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। দমকলের বাবারও সাধ্য হবে না সে অঞ্চলে ঢোকে। তাছাড়া আগুনের দাহিকাশক্তি প্রবলতর করার প্রকল্পও কলকাতা নগর উন্নয়ন পর্ষদের পক্ষ থেকে রচনা করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে এবার আর কোনও ত্রুটি থাকবে না স্যর। এবার আগুন লাগলে কলকাতাকে দেখব কে বাঁচায়।

৯ জানুয়ারি ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *