পোট্রেট

পোট্রেট

অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের বাসায় আমি মাঝে মাঝে যাই। তাঁর স্ত্রী খুব ভাল বেগুনভাজা রান্না করেন। বেগুনভাজার লোভে যাই বললে ভুল বলা হবে। খাদ্য হিসেবে বেগুন আমার তেমন প্রিয় নয়। তবে এই দম্পতির সঙ্গ প্রিয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনই নিতান্ত ভালমানুষ। আমার যে-কোন রসিকতায় এঁরা হো হো করে হাসেন। তাদের বাড়িটা ছোটখাটো একটা মিউজিয়ামের মত। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ধরনের শিল্পকর্ম। দেয়ালে ঝুলছে অপূর্ব সব পেইনটিং। কিছু কিছু অতি বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা। ছবিগুলোও আমার বাড়তি আকর্ষণ। পেইন্টিং পুরোনো হয় না। একই ছবি বারবার দেখা যায়। আমি মাঝে মাঝে ছবি দেখার লোভেও যাই।

সেদিন তাদের বাসায় গিয়ে দেখি, দেয়ালে দাড়িওয়ালা এক বুড়োর পোট্রেট। সেই বুড়োর একটা চোখ বন্ধ, একটা চোখ খোলা। মনে হয়, বুড়ো চোখ টিপ মারছে। পোট্রেটের মানুষটিকে পরিচিত লাগছে। এর ছবি যেন আগেও কোথায় দেখেছি।

আমি নূরকে বললাম, ভাই এটা কার ছবি?

নূর এক বিখ্যাত শিল্পীর নাম করে বললেন, উনার আঁকা পোট্রেট। উনি পোট্রেট করেন না। এই প্রথম করলেন। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেছি। সুন্দর না?

বিখ্যাত কারো আঁকা ছবি দেখলে বলতে হয়, খুব সুন্দর। না বললে বেকুব প্রমাণিত হবার ভয় থাকে। কাজেই আমি নূরের উত্তর এড়িয়ে জানতে চাইলাম, পোট্রেটটা কার?

নূর অবাক হয়ে বললেন, কি আশ্চর্য! রবীন্দ্রনাথের ছবি। চিনতে পারছেন না কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে আছি। এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের এমন এক ছবি দেখছি যেখানে তিনি চোখ টিপ মারছেন। আমি বললাম, নূর, আমি কি ভুল দেখছি? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, পোট্রেটের রবীন্দ্রনাথ চোখ টিপ মারছেন। ব্যাপারটা কি তাই, না আমার মনের ভুল?

আপনি ঠিকই ধরেছেন।

বিখ্যাত একজন শিল্পী ছবিটি এঁকেছেন। নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তে এঁকেছেন। চোখ টেপার ভেতর দিয়ে হয়তো তিনি মহা কোন ব্যাপার ধরে ফেলেছেন, যা আমি আমার। স্বল্প বুদ্ধির কারণে ধরতে পারছি না। আমার সীমিত শিল্পবোধ আমাকে বলছে, এটি নিতান্তই অরুচিকর একটা ছবি। এই রসিকতা রবীন্দ্রনাথের প্রাপ্য নয়। মহারথী। শিল্পীর রসিকতা হলেও নয়।

স্বয়ং পিকাসো যদি রবীন্দ্রনাথের চোখ টিপ-মারা ছবি আঁকেন তারপরেও আমি বলব, অসুন্দর একটি ছবি। ছবিতে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়েছে। নূরের বাসা থেকে আমি মন খারাপ করে ফিরলাম। একবার ভাবলাম, আমার মন খারাপের ব্যাপারটা তাকে বলি। তাকে বলি যে, রবীন্দ্রনাথের সবচে সুন্দর জিনিস হল তার স্বপ্নময় চোখ। একজন বড় শিল্পীর চেষ্টা থাকবে সেই চোখের স্বপ্নকে ক্যানভাসে ধরা। তারপরই মনে হল, কি হবে বলে? নূর এই ছবি রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্যে ঘরে ঝুলিয়ে রাখেননি। ছবিটি রেখেছেন একজন বড় শিল্পীর শিল্পকর্মের নিদর্শন হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ চোখ টিপি দিক কিংবা জিহ্বা বের করে থাকুক কিছু যায় আসে না।

আমি ঠিক করলাম, আর কোনদিনই নূরের বাসায় যাবো না। তার বাসায় গেলেই ছবিটির দিকে চোখ যাবে, মনটা হবে খারাপ। কি দরকার?

এই পৃথিবীতে অল্প কিছু মানুষ আছেন যাঁরা অন্ধকার রজনীতে আলো জ্বেলে সবাইকে পথ দেখান। মানুষ যখন হতাশাগ্রস্ত হয়, তাঁরা বলেন, সম্মুখে শান্তি পারাবার, যখন সে পরাজয়ের মুখোমুখি হয় তখব তারা কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপি চুপি বলেন, Man can be destroyed but not defeated, এঁদের প্রতি সামান্যতম অশ্রদ্ধাও আমাকে পীড়া দেয়।

সমস্যা হল, আমরা কোন এক বিচিত্র কারণে সম্মানিত মানুষের সম্মানহানি করে এক ধরনের আনন্দ পাই। এক রবীন্দ্র গবেষক আমাকে ফিসফিস করে বলেছিলেন, আমার কাছে সিরিয়াস মেটেরিয়েল আছে। প্রকাশ হলে কবিগুরু ফ্লাট হয়ে মাটিতে পড়ে যাবেন। তিনি বিয়ে করেছিলেন তাদের এক কর্মচারীর মেয়েকে। চিন্তা করে দেখুন, জমিদারের ছেলে বিয়ে করেছেন তাদের এক কর্মচারীর মেয়েকে। সেই মেয়ের না আছে রূপ, না আছে গুণ। তাহলে কেন এই বিয়ে? আমি প্রমাণ করে দিতে পারি যে, তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার উপায় ছিল না। কেলেংকেরিয়াস ব্যাপার।

গবেষকের আনন্দোজ্জল চোখ দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছি, হায় রে! আমরা। এমন কেন? চন্দ্র দেখলেই আমরা কেন কলঙ্ক দেখার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ি? কি আছে কলঙ্কে?

মজার ব্যাপার হল, এই আমরাই আবার বাড়াবাড়ি ধরনের ভক্তি দেখাতেও ভালবাসি। সেই ভক্তিও অশ্রদ্ধার মতই। উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করি। ২২শে শ্রাবণ উপলক্ষে বাংলা একাডেমীতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপূর্ব সব গান শুনছি। গভীর আবেগে চোখ ভিজে উঠেছে। এমন সময় এব ভদ্রলোক আমার কাছে এগিয়ে এলেন। (তার নাম বললে আপনারা তাঁকে চিনে ফেলতে পারেন, কাজেই নাম বলছি না) তিনি আমাকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, হুমায়ূন, আপনি কি জানেন রবীন্দ্রনাথ হলেন আমার ঈশ্বর। আমি তাঁর আরাধনা করি।

আমি ভদ্রলোকের কথায় চমৎকৃত হলাম। তিনি আবেগকম্পিত গলায় বললেন, আমার যাবতীয় প্রার্থনা তার কাছে। ভদ্রলোকের কথা শুনে আমি গেলাম হকচকিয়ে। সহজ গলায় বললাম, ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে খুব বিরক্ত হতেন।

তিনি অবাক হয়ে বললেন, আপনার এই কথার মানে কি?

আমি বললাম, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান একজন মানুষ। মানুষের বোকামিতে তিনি সবসময়ই বিরক্ত হতেন।

আপনি কি আমাকে বোকা বলার চেষ্টা করছেন?

আমি হাসতে হাসতে বললাম, ইয়েস স্যার।

তিনি রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, রবীন্দ্রনাথের রচনা আপনি পড়েননি। আর পড়লেও তার মর্ম বোঝার ক্ষমতা আপনার নেই। থাকলে আপনিও তার আরাধনা করতেন।

ভদ্রলোকের রাগ আর বাড়াবার সাহস আমার হল না। একটা কথা মুখে প্রায় এসে গিয়েছিল, প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম–রবীন্দ্রনাথের রচনার সঙ্গে যাদের পরিচয় সবচেয়ে কম, শুধু তারাই তাঁকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এতে তাকে বড় করা হয় না, ছোট করা হয়।

আমি কিছু বললাম না। মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।

আমাদের পরম সৌভাগ্য, এত বড় মাপের একজন মানুষকে আমরা নিজেদের মধ্যে পেয়েছি। যিনি তাঁর প্রতিভার যাদুস্পর্শে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে একাই ১০০ বছর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। জীবনের গভীরতম বোধকে আমাদের উপলব্ধির কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন অবলীলায়। সেই তাকে সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হিসেবে কাছে না টেনে ঈশ্বর হিসেবে দূরে সরিয়ে দেয়াটা হাস্যকর ব্যাপার নয় কি? হাস্যকর ব্যাপারগুলি

আমরা এত আগ্রহ নিয়ে কেন করি?

আমি একবার মজা করে লিখেছিলাম, মানুষ হচ্ছে এমন এক বুদ্ধিমান প্রাণী যে বেশিরভাগ কাজই করে বোকার মত। আজকাল প্রায়ই মনে হয়, এটাই বোধহয় সত্যি। বোকার মত কাজ করার জন্যেই হয়তো বুদ্ধিমান এক প্রাণী সৃষ্টির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

 

————-

** পত্রিকায় দেয়ার আগে নূরকে আমি রচনটা পড়ে শোনালাম। শুরুতে তার মুখ খুব হাসি হাসি

থাকলেও, শেষটায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, নন্দনতত্ত্ব ব্যাখ্যায় হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্য গ্রহণ করতে হবে, তা কে বলল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *