পৈশাচিক

পৈশাচিক

আজকাল ভূতের গল্প কেউ লেখেন না। তার কারণ এই বিজ্ঞানের যুগে ভূতে বিশ্বাস করেন না কেউ। যদিও বা কেউ লেখেন তো গল্পের শেষে এমন করে দেন যে আসলে ভূত বলে যেন কিছুই নেই, মানুষ মনের ভ্রমে অথবা উলটোপালটা কিছু দেখে অযথা ভয় পেয়ে ভূতের অস্তিত্ব কল্পনা করে নেয়।

আমার এ গল্পটি কিন্তু সেরকম নয়। কেউ বিশ্বাস করুক আর নাই করুক ঘটনাটি ঘটেছিল। আমার মায়ের যিনি বড়মামা তিনি সেকালের একজন নামকরা ডাক্তার ছিলেন। গল্পটা তাঁর মুখেই শুনেছিলাম। তিনি এখন বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর বলে যাওয়া গল্পটি আজও বেঁচে আছে আমার কাছে। তিনি গল্পটি যেভাবে বলেছিলেন ঠিক সেভাবেই বলছি তোমাদের:

আমি তখন শিবানীপুরে থাকি। ডাক্তারি পাশ করে কলকাতায় না গিয়ে গ্রামের মানুষের সেবাতেই জীবন উৎসর্গ করেছি। ভগবানের কৃপায় আমার হাতযশও খুব হয়েছিল তখন। আর বন গাঁয়ে শিয়াল রাজার মতো ওই অঞ্চলে ডাক্তার বলতে তো আমিই ছিলাম।

তখনকার গ্রামও ছিল গ্রামের মতো গ্রাম।

একেবারে অজ গাঁ যাকে বলে ঠিক তাই। গ্রাম তখন এমনই ছিল যে, এখনকার গ্রামের ছেলেরাও তখনকার সেই গ্রামকে কল্পনা করতে পারবে না।

যাই হোক, সেই সময় আমার গ্রামের প্রায় পনেরো মাইল দূরের এক গ্রাম থেকে কল এল আমার। কলেরার কেস। না যাওয়া ছাড়া উপায়ও নেই। তাই যা যা সঙ্গে নেওয়ার নিয়ে, আমার একটা ঘোড়া ছিল সেই ঘোড়ায় চেপে রোগী দেখতে চললাম।

সন্ধের মুখে বেরিয়েছি। তাই যেতে-যেতেই রাত হয়ে গেল। কাজেই রোগী দেখার পর ওই গ্রামেই সে রাত্রে রয়ে গেলাম। রোগীর বাড়ির লোকেরা দুধ মুড়ি মণ্ডা ও মর্তমান কলা যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়াল। পেটভরে তৃপ্তি করে খেয়েদেয়ে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। গাঢ় গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে গেলাম আমি।

রাত তখন কত তা জানি না।

হঠাৎ একটা ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তারপরই শুনতে পেলাম একটা অস্পষ্ট কোলাহল। বুকটা ধড়াস করে উঠল। রোগী কি মরে গেল নাকি? কিন্তু যা ওষুধ দিয়েছি তাতে মরবার তো কথা নয়! বিশেষ করে রোগীর শারীরিক অবস্থা খুবই ভাল ছিল। কান্না শুনে তাড়াতাড়ি টর্চ জ্বেলে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম।

ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি একটা অল্পবয়সী বউ উঠোনে শুয়ে আছাড় কাছাড় করে কাঁদছে। আর চেঁচাচ্ছে, “ওগো আমার কী সর্বনাশ হয়ে গেল গো! আমার বাপুনকে খেয়ে ফেললে। আমি কোনওরকমে আমার খোকাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। তোমরা বলে দাও আমি এখন কী করব গো!”

বউটির কান্না দেখে বা তার কথা শুনে ভাবলাম হয়তো গো-বাঘ বা অন্য কিছুতে তার বাপুনকে খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু আশেপাশের লোকেদের মুখে যা শুনলাম তাতে তো নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। এও আবার হয় নাকি?

বউটির স্বামী কলকাতায় কাজ করে। প্রতি শনিবার সে বাড়ি আসে। রবিবার বাড়িতে থেকে সোমবার ভোরে সে চলে যায়। আজ শনিবার। লোকটি যথানিয়মেই রাত্রিবেলা এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু কেমন যেন উদ্ভ্রান্ত চেহারা তার। চোখ দুটো লাল। মাথার চুল উসকোখুসকো।

বউটি স্বামীকে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার! তোমার শরীর খারাপ নাকি?”

লোকটি কোনওরকমে শুধু হুঁ বলে। আর কিছু না। রাতের খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত করে না। বিছানা করে দিলে গুম হয়ে শুয়ে থাকে চুপচাপ।

বউটি আর কী করে! মনমরা হয়ে কিছুই বুঝতে না পেরে সামান্য দুটি মুড়ি চিবিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে শুয়ে পড়ে ছেলে দুটিকে নিয়ে। একটি ছেলে তিন বছরের। অপরটি ছ’মাসের।

বউটি শুয়ে থাকে। কিন্তু নানান চিন্তায় তার ঘুম আর আসে না। হঠাৎ একসময় চপাং চপাং শব্দে চমকে উঠে আড়চোখে তাকিয়েই শিউরে ওঠে সে। দেখে তার স্বামী মশারির বাইরে বসে কী যেন খাচ্ছে! দেখেই তো বুক শুকিয়ে গেল বউটির। পাশে হাত বাড়িয়ে দেখল কোলের ছেলেটি নেই। কচি ছেলে রাতবিরেতে কান্নাকাটি করলে দুধ খাওয়াবার জন্য কাঁথা পালটাবার জন্য ছোট্ট চিমনি লণ্ঠনটা অল্প করে জ্বেলে রেখেই শুত সে। তাতেই দেখল ওর স্বামী মশারির বাইরে বসে সেই শিশুটিকেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

বউটির মনে হল সে একবার চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু তা সে করল না। আবার অন্য ছেলেটিকে নিয়ে চুপিচুপি পালাবার মতো সাহসও হল না তার। কেননা পালাতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে। তাই করল কি, ইচ্ছে করেই ঘুমন্ত ছেলেটার গায়ে জোরে একটা চিমটি কেটে দিল।

যেই না দেওয়া, অমনই শুরু হয়ে গেল ম্যাজিক।

ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। আর ওর স্বামী তাড়াতাড়ি মশারির ভেতরে ঢুকে আধ খাওয়া শিশুটিকে যথাস্থানে শুইয়ে দিয়ে যেন কিছুই জানে না এমনভাবে শুয়ে পড়ল। বউটি দেখেও দেখল না। যেন ছেলের কান্নায় এইমাত্র ঘুম ভেঙে গেল এমন ভান করে ঢিপ ঢিপ করে ঘা কতক বসিয়ে দিল ছেলেটির পিঠে।

স্বামী বলল, “কী হল? রাতদুপুরে শুধু শুধু মারছ কেন ওকে?”

বউটি যেন খুবই বিরক্ত হয়েছে এমনভাবে বলল, “না। মারব না। পাপ কোথাকার! প্রত্যেকদিন রাত্রি হলেই ওনাকে মাঠে বসাতে নিয়ে যেতে হবে। ভাল লাগে?”

“তা নিয়ে যাও। নাহলে ছেলেমানুষ বিছানা নষ্ট করে ফেলবে তো।”

বউটি এই সুযোগেরই অপেক্ষা করছিল।

ছেলের নড়া ধরে তাকে হিড়হিড় করে টেনে তুলে ঘরের বাইরে এসেই শিকল তুলে দিল দরজায়। দিয়ে এখানে এসে আছাড় কাছাড় করতে লাগল।

সব শুনে তো আমার মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়। আমি বেশ বুঝতে পারলাম বউটির স্বামী হঠাৎ উন্মাদ হয়ে গিয়ে এই কীর্তি করে ফেলেছে। তাই গ্রামের অন্যান্য লোকজন নিয়ে ঘটনাস্থলে গেলাম। গিয়ে দেখলাম গোটা বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে গ্রামের লোকেরা এবং অগ্নিসংযোগও করেছে। খড়ের চালায় একবার আগুন লাগলে সে আগুন থামায় কে? ঘরের ভেতরে বউটির উন্মত্ত স্বামী তখন লাথির পর লাথি মেরে চলেছে আর দরজা খুলে দেওয়ার জন্য চিৎকার করছে।

আমি যেতে যেতেই আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আমি প্রত্যেককে ভর্ৎসনা করলাম এই অগ্নিসংযোগের ব্যাপারে। সবাইকেই বললাম, “একটা পাগলকে তোমরা এইভাবে পুড়িয়ে মারলে কেন? লোকটাকে বাইরে বের করে বেঁধে রাখতে পারতে।”

কিন্তু কাকে কী বোঝাব! গ্রামসুদ্ধু লোকের প্রত্যেকেরই ধারণা লোকটা মোটেই উন্মাদ নয়। এমনকী আসল লোকই নয়। এটা একটা পৈশাচিক ব্যাপার। পিশাচরা নাকি মাঝে মধ্যে এইরকম নকল মানুষের রূপ ধরে আসে।

যাই হোক, রাত্রি প্রভাত হলে আমি কয়েকজন লোককে পাঠালাম কলকাতায়। তাদের ভুল ভাঙাবার জন্য। কিন্তু তারা সন্ধের পর কলকাতা থেকে ফিরে এসে যা বলল তা শুনে আমার গায়ের লোমসুদ্ধু খাড়া হয়ে উঠল। তারা বলল, লোকটি দিন দুই আগে কলকাতাতেই গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছে। মৃতদেহ মর্গে আছে। এখন ওর বউ ছেলেকে নিয়ে গেলেই লাশ ফেরত দেবে ওরা। দেহটা কলকাতাতেই দাহ করা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *