পোড়া মোমবাতির রহস্য – সুভদ্রকুমার সেন
পার্ক স্ট্রীট থানার অফিসার-ইন-চার্জ লালমোহন দাসের ঘরে বসে সোমনাথ গল্প করছিল। গল্পের বিষয় অবশ্যই ক্রাইম বা খুন-খারাপ নয়। ময়রা যেমন সব সময়েই মিষ্টি খায় না, তেমনি গোয়েন্দা ও পুলিশ কর্মচারী দেখা হলেই খুন জখম রাহাজানি নিয়ে মাথা ঘামায় না! বিশুদ্ধ রাজা উজির মারতে মারতে ও অল্প স্বল্প নিদের্ষপরচর্চা করতে করতে আড্ডা যখন বেশ জমে উঠেছে, তখনই লালু দারোগার টেলিফোন বেজে উঠল।
লালু দারোগা টেলিফোন তুলে নিয়ে বললে, হ্যালো, পার্ক স্ট্রীট থানা। বলুন। কথা বলছি।
কথাবার্তার ধরণ দেখে সোমনাথের মনে হল, ফ্রি স্কুল স্ট্রীট অঞ্চলে অঘটন একটা কিছু ঘটেছে। তবে লালু দারোগার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল গোলমালটা বড় রকমের কিছু নয়।
ঠিক আছে। আমি এখুনি যাচ্ছি।
লালু দারোগা ফোনটা নামিয়ে রাখলে। সোমনাথ লালুর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালে।
ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর ক্যাশ থেকে টাকা চুরি গেছে। দেখছেন তো আমাদের অদৃষ্ট। আপনার সঙ্গে বসে দু-চারটে মনের কথা কইছিলুম, তা আর বরাতে সহ্য হল না। ওই যে বলে না, অভাগা যেদিকে চায়···ভাল কথা, চলুন না, একটু ঘুরে আসবেন।
সোমনাথ বললে, বেশ তো চলুন!
পুলিশের জীপে চড়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দশ মিনিটও লাগল না। একটা পুরোন তিনতলা বাড়ি। বাড়িটার সব ঘরই ভাড়া। হয় দোকান, নয় ছোটখাটো আপিস। ফুটপাথ থেকে দুটো উঁচু উঁচু ধাপ।ধাপের পরেই জরাজীর্ণ একটা কোলাপসিবল গেট। তারপর একটা প্রায়ান্ধকার ছোট প্যাসেজ। প্যাসেজের দু-পাশে দুটো ঘর। একটা ঘরে টেলারিং শপ আর অন্যটায় স্কুটারের পার্টসের দোকান। প্যাসেজের শেষে একটা সিঁড়ি। সিঁড়িটা কাঠের, উঠেছে তিনতলা পর্যন্ত। দোতলায় রাজ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী।
লালু দারোগার পিছু পিছু সোমনাথ অতি সন্তর্পণে উঠে এল। সিঁড়িটা নড়বড়ে। একটা বড় ঘর নিয়ে ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর আপিস! আপিসের দরজা খোলা। দরজার সামনে রঙিন হাওয়াই শার্ট আর সাদা ট্রাউজার পরা এক মাঝবয়সী পাঞ্জাবী ভদ্রলোক উত্তেজিত ভাবে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দুটি প্রায়-বৃদ্ধ ভদ্রলোক—একজন বাঙ্গালী আর একজন হিন্দুস্থানী! সোমনাথ বুঝতে পারলে যে ওই পাঞ্জাবী ভদ্রলোকটিই মিঃ রাজ—ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর মালিক। পরে জানতে পারলে যে বাঙ্গালী ভদ্রলোকটি রাজ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর যাবতীয় টেবল ওয়ার্ক করেন। নাম যদুবাবু—যদুনাথ বসাক। আর হিন্দুস্থানী ভদ্রলোকটি—নাম শ্যামলাল উপাধ্যায়—ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর আউটডোর কাজকর্মের তদারকি করেন।
মিঃ রাজ লালু দারোগাকে যা বললেন, তা হল এই, গতকাল মিঃ রাজের একটা বিয়ের নেমন্তন্ন থাকায় তিনি সকাল সকাল আপিস থেকে বাড়ি চলে যান। সন্ধ্যে বেলায় আপিস বন্ধ করে যদুবাবু বাড়ি যান। অন্যদিন আপিসের চাবি মিঃ রাজের কাছেই থাকে। তিনিই সকলের শেষে চাবি দিয়ে বাড়ি যান। তবে কোন কারণে মিঃ রাজ যদি আপিসে না আসতে পারেন বা আপিস থেকে সকাল সকাল বাড়ি চলে যান, সেদিন যদুবাবু আপিস বন্ধ করে চাবিটা মিঃ রাজকে তাঁর ওয়েলিংটন স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আসেন। কাল অবশ্য মিঃ রাজ সপরিবারে বিয়ের নেমন্তন্ন রাখতে যাবেন বলে তিনি আপিসের চাবি যদুবাবুকে নিজের কাছে রেখে দিতে বলেছিলেন।
আজ সকালে যদুবাবু আপিসে এসে দেখলেন শ্যামলাল আর মিঃ রাজ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। যদুবাবু চাবি খুললেন। যদুবাবুর পিছনে পিছনে মিঃ রাজ আর শ্যামলাল আপিসে ঢুকলেন।
যদুবাবু আর শ্যামলাল নিজের নিজের চেয়ারে বসতে যাবেন, এমন সময় মিঃ রাজ ওঁদের ডাকলেন। মিঃ রাজের চেম্বারে ঢুকে ওঁদের চক্ষু স্থির হয়ে গেল। মিঃ রাজের চেম্বারে যে স্টিল আলমারিতে কোম্পানীর দরকারী কাগজপত্র আর টাকা-পয়সা থাকে, তার পাল্লাদুটো আধ ভেজানো।
মিঃ রাজ যদুবাবুকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কাল আলমারি বন্ধ করেননি?
হ্যাঁ, করেছিলুম তো—, আমতা আমতা করে যদুবাবু বললেন।
তাহলে এটা খুললে কে?
হয়তো মনের ভুলে—
মনের ভুলে? তো মনের ভুলেই বোধ হয় ক্যাশ বাক্সর টাকাটাও বাড়ি নিয়ে গেছেন?—মিঃ রাজের গলায় ব্যঙ্গের সুরটা চাপা থাকে না।
না,না! —যদুবাবু কাতর ভাবে বলে উঠলেন।
তবে টাকা কই?
টাকা নেই?
না। আমি এখুনি পুলিশে খবর দিচ্ছি। চালাকি?—রাগে উত্তেজনায় মিঃ রাজের মুখ থমথম করছে।
মিঃ রাজের সব কথা শুনে লালু দারোগা সরাসরি প্রশ্ন করলেন, মিস্টার রাজ, আপনি কি টাকা চুরি যাওয়ার ব্যাপারে যদুবাবুকে সন্দেহ করছেন?
না, ঠিক তা নয়। তবে কি জানেন, অনেকগুলো টাকা তো—
কত টাকা ছিল?—সোমনাথ এই প্রথম কথা বললে।
সাত হাজার।
এত টাকা রাখেন?
সাধারণত রাখা হয় না, তবে ব্যাঙ্ক বন্ধ হয়ে যাবার পর টাকা পেলে বাধ্য হয়েই রেখে যেতে হয়।
হুঁ।—সোমনাথ আর কোন কথা বললে না।
সোমনাথ আপিস ঘরটা ভাল করে দেখলে। একখানা বেশ বড় ঘর নিয়ে রাজ ট্রান্সপোর্টের আপিস। ঘরটার মাঝখানে পার্টিশান। পার্টিশানের একদিকে দুটো মাঝারি সাইজের কাঠের টেবিল। টেবিলের দু-দিকে দুটো চেয়ার। আর একটা কাঠের আলমারি। আলমারিটায় কড়া লাগানো। কিন্তু তালা লাগানো নেই। পার্টিশানের এই দিকে যদুবাবু আর শ্যামলাল বসেন। পার্টিশানের অপর দিকে মিঃ রাজের চেম্বার। মিঃ রাজের ঘরে একটা গোদরেজের টেবিলের একপাশে একটা রিভলভিং চেয়ার। অন্যদিকে তিনটে স্টিলের সাধারণ চেয়ার। দেওয়ালের কাছে গদরেজের একটা স্টোরওয়েল আলমারি। সোমনাথ আলমারিটা খুব ভাল করে লক্ষ করলে। আলমারিটা চাবি দিয়েই খোলা হয়েছে। সোমনাথ চাবিটা চেয়ে নিলে। চাবি লাগাতে আলমারির লকটা সহজেই খোলা বন্ধ করা গেল।
চাবিটা মিঃ রাজকে ফেরত দিয়ে সোমনাথ লালু দারোগাকে বললে, যদুবাবুকে দু-একটা প্রশ্ন করতে চাই।
করুন না।
লালু দারোগা মিঃ রাজ আর শ্যামলালকে বাইরে যেতে বললেন। মিঃ রাজের চেম্বারে এখন সোমনাথ, লালু দারোগা আর যদুবাবু।
যদুবাবুকে একটা চেয়ার দেখিয়ে সোমনাথ বললে, বসুন, যদুবাবু। কাল সারাদিন ঠিক কি কি হয়েছিল বলুন তো?
যদুবাবু বললেন, অন্যান্য দিনের মত আমি আদায়ের বিলগুলো তৈরি করে দিই। সেগুলো নিয়ে শ্যামলাল পার্টির কাছে যায়। লাঞ্চের আগে শ্যামলাল এক দফা আদায় সেরে আসে। তারপর আবার তিনটের সময় ও আবার আদায়ে বেরিয়ে যায়। আমি লেজারের কাজ সেরে কয়েকটা চিঠি টাইপ করছিলুম। সাড়ে চারটে নাগাদ মিঃ রাজ চলে গেলেন। ওঁদের কার বিয়ের নেমন্তন্ন ছিল। তখন আমার কাছে সকালের আদায় বাবদ তিন হাজার টাকা ছিল। আমি বললাম, স্যার, টাকাটা কি আপনি নিয়ে যাবেন?—উনি বললেন, না, থাক। কাল সকালে এখান থেকেই ব্যাঙ্কে জমা করে দেব।
মিঃ রাজ চলে গেলেন। প্রায় সাড়ে পাঁচটার সময় শ্যামলাল ফিরে এল। ওর কাছ থেকে টাকা পয়সা সব বুঝে নিয়ে সব টাকাটা আলমারিতে তুলে রাখি। তারপর ওরই সামনে আলমারি বন্ধ করে, দরজা জানলা বন্ধ করে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়ি। শ্যামলাল থাকে ভবানীপুরে। আমি থাকি নেবুবাগানে। ও চৌরঙ্গীর দিকে গেল আর আমি সার্কুলার রোডের দিকে গেলাম ···আপনারা বিশ্বাস করুন, এই চুরির ব্যাপারে আমি বিন্দু বিসর্গ কিছুই জানি না।
সোমনাথ বললে, দ্বিতীয় দফায় শ্যামলাল কত টাকা এনেছিল?
চার হাজার।
তা হলে মোট কত টাকা ছিল?
সাত হাজার।
সোমনাথ পকেট থেকে সিগারেট বের করে পকেট চাপড়ে বললে, এই যা, দেশলাইটা ফেলে এসেছি। যদুবাবুর কাছে দেশলাই আছে নাকি?
আজ্ঞে না, আমি সিগারেট খাই না।
যাকগে। আচ্ছা, কাল এখানে কখন লোডশেডিং হয়েছিল?
আজ্ঞে কাল তো সারাদিনে লোডশেডিং হয়নি।
ঠিক আছে। আপনি এখন যান।
যদুবাবু চলে গেলে লাল দারোগা বললে, কিছু বুঝতে পারলেন?
দাঁড়ান, তার আগে শ্যামলালকে একবার ডাকুন।
শ্যামলাল এল। সোমনাথ তাকে মোটামুটি একই রকম প্রশ্ন করলে। যদুবাবুর কথার সঙ্গে শ্যামলালের কথার প্রায় সবই মিল হল। অমিল হল টাকার অঙ্কের পরিমাণে। দু’ খেপে সে সাত হাজার টাকা এনেছিল বটে, তবে ক্যাশবাক্সে কত টাকা ছিল তা সে বলতে পারলে না। কেননা, ক্যাশ নিয়ে সে নাড়াচাড়া করে না।
ঠিক আছে, আপনি যান।
শ্যামলাল চলে গেল।
এবার বলুন।—লালু সোমনাথের মুখের দিকে তাকালে।
একটি জিনিস দেখলে আপনিও বুঝতে পারবেন।
একটা ছোটো আধপোড়া মোমবাতি। সোমনাথ লালুর দিকে এগিয়ে দিলে। বললে, এটা আপিসে ঘরের দরজার কাছে পড়েছিল।
তাতে কী হল?
অনেক কিছুই হতে পারে, আবার কোনও কিছুই নাও হতে পারে। তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর চাই। কাল এখানে কখন লোডশেডিং হয়েছিল?
এ প্রশ্নের জবাব আমিই আপনাকে দিতে পারি। সাড়ে দশটার আগে হয়েছিল। চলেছিল সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত।
ভেরি গুড। ডাকুন মিঃ রাজকে। ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলা যাক।
মিঃ রাজ এলেন।
সোমনাথ সিগারেটটা হাতের আঙুলের মধ্যে রেখে বললে, যদি কিছু মনে না করেন তো দেশলাইটা—
উইথ প্লেজার।—মিঃ রাজ গ্যাস লাইটার এগিয়ে দিলেন।
ধন্যবাদ।—সোমনাথ লাইটারটা মিঃ রাজকে ফিরিয়ে দিলে। তারপর লালু দারোগাকে বললে, আপনি মিঃ রাজের সঙ্গে আলাপ করুন, আমি এখুনি আসছি!
মিঃ রাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে যদুবাবুকে জিজ্ঞেস করলে, এ বাড়িতে নাইট গার্ড আছে?
আছে।
সে কোথায় থাকে?
স্কুটার পার্টসের দোকানের পিছনে একটা ঘর আছে, সেইখানে থাকে।
ঠিক আছে।
সোমনাথ সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। কেয়ারটেকার ঘরেই ছিল। সোমনাথ তাকে দু-চার কথা জিজ্ঞেস করে ওপরে উঠে গেল।
মিঃ রাজের ঘরে মিঃ রাজ আর লালু দারোগা দুজনেই গম্ভীর মুখ করে বসে আছেন।
সোমনাথ ঘরে ঢুকে লালু দারোগাকে বললে, সব চুকে গেছে তো? তাহলে চলুন ওঠা যাক।
লালু দারোগা কিছু বলার আগেই মিঃ রাজ বললেন, চুকে গেছে মানে! টাকাটা উদ্ধারের বা চোর ধরার কি হল?
টাকাটা কি সত্যিই চুরি গেছে মিস্টার রাজ?
আপনি কী বলতে চান?—উত্তেজনায় মিঃ রাজ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
অযথা উত্তেজিত হবেন না। সামান্য কয়েকটা ভুলের জন্যে ধরা পড়ে গেলেন। ক্যাশে যে সাত হাজার টাকা ছিল আপনি জানলেন কি করে? আপনি যখন আপিস থেকে চলে যান, তখন তো ক্যাশে তিন হাজার টাকা ছিল। আর আজ সকালে আপনি টাকার অঙ্কটা যদুবাবুকে জিজ্ঞেস করেননি। যদি জিজ্ঞেস করতেন, তাহলে শ্যামলালও জানতে পারত। কত টাকা ছিল শ্যামলাল জানে না। কত টাকা যে ছিল, তা যদুবাবু ছাড়া কারোরই জানার কথা নয়। কিন্তু দেখলুম, আপনি জানেন। কী করে জানলেন?
দ্বিতীয়ত, লোডশেডিং ছিল বলে আপনাকে···থুড়ি, চোরকে মোমবাতি জ্বালাতে হয়েছিল। চোর মোমবাতিটা ফেলে যায়। ঘরের মেজেতে কিন্তু একটাও দেশলাই কাঠি নেই। তাহলে চোর মোমবাতি জ্বাললে কী করে? সে নিশ্চয়ই দেশলাই ব্যবহার করেনি। হ্যাঁ, সে লাইটার ব্যবহার করেছিল। যদুবাবু বা শ্যামলাল যদি মোমবাতি জ্বালত, তাহলে দেশলাই কাঠি অবশ্যই পড়ে থাকত। কেননা, মোমবাতি জ্বালাবার জন্যে ওঁদের দেশলাই সঙ্গে করে আনতে হত। ওঁদের কাছে দেশলাই থাকে না, কেননা, ওরা কেউই ধুমপান করে না।
যদুবাবুর মাথায় কাঁটাল ভাঙার বন্দোবস্ত করেছিলেন ভাল। পুলিশের বুড়ি ছুঁয়েই ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কাছে ক্লেম পাঠাতেন। তবে চালাকিটা বেশি করতে গিয়েই ধরা পড়লেন।···আচ্ছা, চলি।চলুন লালুবাবু—
লালু দারোগাকে সঙ্গে নিয়ে সোমনাথ বেরিয়ে পড়ল।