পেশা – ভবানী মুখোপাধ্যায়
টিনের ওপর আলকাতরা দিয়ে অসমান হস্তাক্ষরে লেখা আছে ‘নেতাজী কেবিন’।
মফস্বলের শহর। আদালত, হাসপাতাল, বাজার সবই পাশাপাশি, তাই টিনের চেয়ার ও ভাঙা বেঞ্চিতে সমৃদ্ধ এই হোটেলটি চলে ভাল। সকালের দিকে অবশ্য তেমন ভিড় নেই, অল্প কয়েকজন চায়ের খদ্দের। আমার টেবিলের অপর দিকে যে বেঁটে লোকটি বসেছিল, যেমন তার আকৃতি, তেমনি তার পরিচ্ছদ। একবার তার দিকে চাইলে দ্বিতীয়বার সেদিকে তাকাতে প্রবৃত্তি হয় না। আপনমনে তাই ধোঁয়া-গন্ধওলা চা’টুকু শেষ করছিলাম। সহসা সামনের লোকটি বলে উঠল, আমাদের কি বাবা, সরকারী চাকরি, আর দুটো বছর কাটলেই বাড়িতে বসে পায়ের ওপর পা দিয়ে পেনশন পাব। এইবার লক্ষ্য করলাম লোকটার কাঁধের ওপর একটা চামড়ার বেল্ট চাদরের মত ফেলা আছে, তার পেতলের চারপাশে সরকারী হাসপাতালের নাম লেখা। ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করলাম, তুমি বুঝি হাসপাতালে কাজ কর ?
চায়ে ভেজা গোঁফ বাঁ হাত দিয়ে মুছতে মুছতে লোকটি বললে, হাসপাতালের জমাদার—তা জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব কাজই নিজের হাতে করতে হয়। হুজুর বুঝি এ জেলায় নতুন এসেছেন ?
মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, একটা মামলার তদারকি করতে এসেছি। এখানে তো শুনেছি একটা মেডিকেল স্কুল আছে, কতগুলি ছাত্র ?
আছে, দু-চারটি—তবে এখন গরমের ছুটি, হুজুর বুঝি উকিল ? তারপর একটু থেমে বললে, মফস্বলের স্কুল—হাসপাতাল, কী বা আছে ? কতকগুলি যন্ত্রপাতি, দু-চারটে পাড়াগেঁয়ে ম্যালেরিয়া রোগী আর লাশঘর।
লাশঘর ! মড়া রাখা হয় বুঝি ? দেখতে হয় ! আমি কখনও লাশঘর দেখিনি।
আপনার কি আর ভাল লাগবে ? লোকটি বিনয়ের ভঙ্গিতেই বলে। এখানে তো আর বরফের ঘর নেই। অ্যাসিডে ভিজিয়ে রাখা হয়।
বললাম, লাশ এগজামিন করতে কি দেরি হয় ?
দেরিও হয়, তাছাড়া ছেলেদের কাটাকুটির জন্য দু-একটি রাখতেও হয়।
অদ্ভুত কথা। বললাম, কখন আসব ?
আজও আসতে পারেন, কিম্বা কাল ন’টার সময়। যা হুজুরের খুশি।
এইভাবে হাসপাতালের লাশঘরে ঢোকবার আমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম। একরকম অতি সহজেই বলা চলে। লোকটিকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য হাতে আট আনা পয়সা দিয়ে দিলাম।
পরদিন লোকটির নির্দেশ মত সকাল ন’টা নাগাদ হাসপাতালের পাশে ছোট্ট একটি গুমটি ঘরে গিয়ে কড়া নাড়লাম। কোন সাড়াশব্দ নেই। ভাবলাম, হয়তো বাজারে গেছে। কিন্তু এই সময় আমায় আসতে বলেছিল বলে কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে থেকে আবার কড়া নাড়লাম। খানিকক্ষণ পরে খটাং করে দরজা খুলে গেল। একটা পাল্লা অল্প ফাঁক করে কালকের দেখা সেই মুধটা বেরিয়ে এল।
লোকটির চোখে বিস্ময়ের রেখা ফুটে উঠল। আমি বললাম, একটু তাড়াতাড়ি এসেছি বুঝি ? ন’টা কিন্তু বেজে গেছে।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, না, না, তা নয় হুজুর, আমি ভেবেছিলাম আপনি রাত্রি ন’টায় আসবেন। যাক, যখন এসে গেছেন—আর যখন হয় এলেই হল।
দরজাটি খুলে দিয়ে লোকটি সরে দাঁড়াল।
আমার পেছন থেকে সহসা কে যেন বলে উঠল, এই যে অনন্তচরণ।
আমি পেছন ফিরে দেখলাম, খাকি পোশাক পরা একজন সম্ভ্রান্ত কর্মচারী।
জমাদার সসম্মভ্রমে বলল, নমস্কার হুজুর।
আমি বললাম, হাসপাতালের সিভিল সার্জন বুঝি ?
মাথা নেড়ে অনন্তচরণ বলে, না, না, উনিই তো বড় দারোগাবাবু। আমাকে ভারি ভালবাসেন। বউ পালাবার পর অনেক খোঁজ-খবর করেছেন। ভারি ভাল লোক।
দরজাটি ভাল করে বন্ধ করে দেয় অনন্তচরণ। দরজা বন্ধ করতে মনে হল, ভাদ্রের সেই ভ্যাপসা সকাল যেন সহসা শীতল হয়ে গেল। ভেতরটা বেশ অন্ধকার আর ঠাণ্ডা।
অনন্তচরণ বলে, ভেতরে আসুন হুজুর। আপনার কি আর ভাল লাগবে ?
আমি অন্ধকার গলিপথ ধরে অনন্তচরণের অনুসরণ করে চললাম। টবেতে দু-চারটে পাতা-বাহারে গাছ বসানো আছে, আলো আর হাওয়ার অভাবে বোধ হয় তারা বেশি বাড়তে পারেনি। ভেতর থেকে বাইরের কোলাহল কিছুই কানে আসে না। আর একটু এগিয়ে যাওয়ার পর অনন্তচরণ আর একটা দরজা খুলল। দরজা খোলার আওয়াজটা ভেতর থেকে ফাঁকা আওয়াজের সুরে প্রতিধ্বনিত হল। মনে হল লোকজন কেউই এখানে থাকে না।
বললাম, তুমি এখানে একা থাক নাকি ? মনে মনে ভাবলাম কি বিশ্রী জায়গা।
অনন্তচরণ বলে, বউ চলে যাওয়ার পর একরকম একাই হুজুর। আর কোথায় যাব ? এখানে। তবু আলো আছে, পাখা আছে। সরকারী খরচে এত আরাম তো আর কোথাও মিলবে না।
এই বলে এত জোরে দরজাটি বন্ধ করল, মনে হল যেন, সেই প্রাচীন ঘরটি কেঁপে উঠল। বলে চলে, তবে অনেক হাঙ্গামা হুজুর, ঝাড়ুদারেরা পর্যন্ত ভেতরে আসতে চায় না, সবই আমায় করতে হয়। ওরা বলে, ভেতরে আসতে ভয় হয়। তারপর ধরুন লাশগুলো রয়েছে—সে আর এক বিপদ। তিন রকমের লাশ। পুলিশের চালানী মুদ্দো, হাসপাতালের বেওয়ারিস মড়া আর ছুরি চালানোর জন্য লাশ। সবই মনে করুন, আপনাদের কৃপায় আমারই ঘাড়ে। এই কথা বলে অনন্তচরণ গম্ভীরভাবে গোঁফে হাত বুলিয়ে নেয়। বলে, ছাত্র বেশি হলে তখন তো আর দু’একটা লাশে শানায় না হুজুর। তখন এই শর্মার ওপর হুকুম হয় লাশ জোগাড় করবার।
ওর ওপরেই একটা বড় ঘর। কাচের শো-কেশে, বড় বড় জারে নানাবিধ অদ্ভুত আকৃতির মাথা বা দেহের অন্যান্য অংশ ডোবানো আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। সেদিকে হাত দেখিয়ে অনন্তচরণ বলে, কেউ কেউ এসব দেখতে ভালবাসে, আবার অনেকে ভয় পায়। আমার কাছে ওসব ইট কাঠের সমান। হুজুর যদি দেখতে চান তো ভাল করেই দেখুন।
দেখছিলাম একটা অত্যন্ত বিশ্রী রকমের শিশুর জড়ীভূত দেহ আরকে ভাসছে। এমন সময় অনন্তচরণ বলে, লাশ কি পাওয়া সোজা কথা—মনে করুন, হাসপাতালে কেউ মরছে না, পুলিশের মুদ্দো নেই, অথচ ছেলেদের জন্য লাশ চাই। কোথায় পাই বলুন দেখি ? সেই জন্যই তো আমার এত খাতির হুজুর। আমার মত মুদ্দো জোগাড় করতে কেউ পারবে না।
আমি সবিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম, বললাম, তাই নাকি ? কোথায় পাও ?
অনেকেই আমাকে জানে আর ভালবাসে কিনা। পথে ঘাটে যদি পড়ে থাকে তো খবর ঠিক এসে যায় হুজুর। তখন রাত্তিরে ঠেলা গাড়ি করে নিয়ে আসতে হয় আর কি। এসব জানাজানি হয়ে গেলে লোকে ভয় পায় কিনা।
তা তো বটেই।
যতসব চাষাভুষোর কাণ্ড তো। কেউ বোঝে না লাশ যদি কাটা না হয়, তবে কোথা থেকে ডাক্তারি শিখবে। আর মরা না কেটে কি জ্যান্ত রুগী লোকে কাটবে। এইখানেই তাদের শেষ করে দেবে।
আমার অত্যন্ত বিশ্রী লাগছিল। শুধু বললাম, হ্যাঁ।
লোকটি দোর গোড়ায় পথ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। ঘরের ভেতরেই তার দৃষ্টি।
একটু চিন্তাকুল থেকে বলল, জানেন, বউ এই ঘরটায় থাকতে ভালবাসত। এই ঘরটি ছিল ওর ভারি পছন্দ। এইগুলো দেখেই ও অর্ধেক সময় কাটিয়ে দিত। ছেলেরা যখন ছুটিতে থাকে, তখনই ওর আরও ভাল লাগত। চারদিক বেশ ঠাণ্ডা ও চুপচাপ হয়ে যেত।
আমি বললাম, এতই যদি ওর এসব ভাল লাগত, তবে ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে চলে গেল কেন ?
উত্তর না দিয়ে অনন্তচরণ আর একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল। আমি এগিয়ে যেতে মৃদু গলায় বলল, ছোটটার জন্যে মন কেমন করত কিনা।
সেটি আবার কে ?
আমাদের ছোট খুকি। দশ বছরেরটি হয়েছিল। এই সেদিন মারা গেল। মাঝে মাঝে মনে হয়, ওর হাসি যেন শুনতে পাচ্ছি।
আমি বললাম, হয়তো তোমার মেয়েটি মারা যেতে তার মনে কষ্ট হয়েছিল, তাই আর এখানে একলা থাকতে পারল না। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তো নিজে এখানে হাজার টাকা দিলেও থাকতে পারি না। এখানে যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।
গোঁফটায় হাত বুলোতে বুলোতে অনন্তচরণ বলে, কে জানে, হবেও বা। তবে ছেলেরা যখন এখানে থাকে, তখন এর অন্যরকম চেহারা। ডাক্তারেরা থাকেন, হট্টগোল, কত লোকজন আসে যায়। সে ভারি মজার। তখন এলে আর আপনার এরকম মনে হত না।
বারান্দায় বেরিয়ে কোমর থেকে আর এক গোছ চাবি বের করে আর একটি দরজা খোলে অনন্তচরণ। চারদিকে চেয়ার টেবিল ছড়িয়ে আছে। ঘরটি দারুণ অন্ধকার। দেয়ালে দুটো কঙ্কাল ঝুলছে। ঘরটিতে বেজায় দুর্গন্ধ। লাশকাটা টেবিলের ওপর একটা কাটা পা পড়ে আছে। সহসা আমার পায়ের ওপর দিয়ে কি যেন চলে গেল।
আমি লাফিয়েউঠলাম। বললাম, কি কাণ্ড, ওটা কি গেল ?
কি বললেন, হুজুর ? ওঃ কি আশ্চয্যি, আজ ক’দিন ধরে ওটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভাবলাম গেল কোথায়। ব্যাটা এখানেই আটকে পড়েছিল।
বিড়ালটা অদ্ভুত ধরনের। অত্যন্ত কৃশ। পেটটা একেবারে ঢুকে গেছে। সাদা রং, তাতে কালো ডোরা কাটা। এমনভাবে বেরোল, মনে হল অন্ধকারে থাকতেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বেশ লম্বা, সোজা চেহারা। মনে হল, পা টিপে টিপে গুঁড়ি মেরে চলতে ও অভ্যস্ত। এ বাড়িতে ঢোকার সময় আমিও এইভাবে এসেছিলাম। বেড়ালটার কান দুটো খাড়া। দেখলে মনে হবে যেন ভয় পেয়েছে বা ও কিছু শোনার জন্য উৎকর্ণ হয়ে আছে। বেড়ালের যদি বুদ্ধিভ্রংশ হওয়া সম্ভব হয়, তাহলে বলব যে বেড়ালটার তাই হয়েছে। ওই বৈচিত্র্যহীন চোখে যেন পাগলামির ছাপ রয়েছে।
একটা কল্পিত বল নিয়ে যেন ও খেলছে। থাবাটা শূন্যে ছুঁড়ছে। ডান দিকের থাবা দিয়ে বাঁ দিকের টিকে ঘা দিচ্ছে। শূন্যে কাঠবেড়ালীর মত লাফাবার চেষ্টা করছে। মনে হবে যেন শূন্যে চুপ করে ঝুলে আছে। তারপর সহসা সেই ঘরটিতে পাক দিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল। দেখে মনে হবে যেন খুব উত্তেজিত হয়েছে।
অনন্তচরণ বলল, আমাকে দেখে ও খুব উত্তেজিত হওয়ার ভাব দেখাচ্ছে। অথচ খুবই খুশি হয়েছে, তাই ওরকম করছে।
আমার কিন্তু মনে হল বেড়ালটি আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কি জানি কেন বেড়ালটিকে দেখে আমার সেই নিঃসঙ্গ শিশুটির কথা মনে পড়ে গেল। এই মৃতদেহ আর বীভৎস দ্রব্যগুলির মধ্যে তো তার দিন কাটত।
সহসা ফতুয়ার পকেট থেকে খুব মলিন ভাঁজকরা এক কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে অনন্তচরণ বলে, এই দেখুন তার চিঠি।
আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লেখা সেই চিঠি দেখলাম :
আমার এখানে থাকতে ভয় করে। খুকি এভাবে মারা যাওয়ার পর আর থাকতে পারি না…আমি দুঃখীরামের সঙ্গে চলে যাচ্ছি। ও নেশাখোর। হয়তো আমাকে ধরে মারবে…কিন্তু তবু আমি এখানে থাকব না। এখানে ভূত আছে।
আমি মুখ তুলে দেখি, অনন্তচরণ লক্ষ্য করছে আমার দেহ। সহসা এভাবে ধরা পড়ে গিয়ে একটু অপ্রস্তুতের ভঙ্গিতে সে গোঁফে হাত বুলোতে লাগল।
নীরবতা ভাঙার জন্যই বললাম, তোমার মেয়েটি কিসে মারা যায় ?
একজন ছাত্র দেখতে পায়, বারান্দায় ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে। ঘাড় একদম ভেঙে গিছল। আর পাশে মাটিতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গিছল একটা ছোট ফুলগাছের টব।
একটু থেমে অনন্তচরণ বলে, এই যে নতুন ওষুধ বেরিয়েছে, তাতে দু-চার মাস মাল ঠিক থাকে। সে আরও বলে, ডাক্তারবাবু শিখিয়ে দিয়েছেন, লাশ পেলেই ওষুধটা দিয়ে দিই, সব ঠিক থাকে।
আমার মাথাটা কেমন গুলিয়ে গিয়েছিল। বললাম, ঘাড়টা তাহলে কি করে ভাঙল?
কি জানি হুজুর, ডাক্তারেরা বলে, হয়তো যখন ঘুমুচ্ছিল, তখন টবটি পড়েছিল। ঘাড়ে সামান্য আঁচড় ছাড়া তো আর কিছু দেখা গেল না।
আমি অনন্তচরণকে চিঠিটা ফেরত দিলাম।
পুনরায় টেবিলের দিকে তাকিয়ে বলে, এই যে নতুন দাওয়াই—হুজুর, এ এক অদ্ভুত জিনিস।
ওষুধের কথা আমার জানা ছিল না। তবু কেন জানি না, এই কথায় আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম। আমি বললাম, তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায় ?
শ্বশুরবাড়ি শুনেছি বাংলা দেশে। তা ওদের আর বড় কেউ নেই। বার বছর আগে কুড়ি গণ্ডা পণ দিয়ে ওকে এনেছিলাম।
আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। অনন্তচর দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর গা ঘষতে ঘষতে বেড়ালটাও বেরিয়ে এল।
অনন্তচরণ বলে, হুজুর, এইবার লাশঘরটাই দেখতে বাকী। আর তো কিছুই নেই এখানে। আপনার ভয় করবে না তো ? আমার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ও।
বললাম, খুব খারাপ নাকি ?
যার যেমন লাগে হুজুর। অনেক নতুন ছাত্র ওর ভেতর গিয়ে ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়েছে, হুজুর। আমার অবশ্য অভ্যেস হয়ে গেছে। আপনি তো বলেছেন, আপনার তেমন ভয়ডর নেই।
আমার মুখের দিকে আবার করুণার দৃষ্টিতে তাকায়। দম্ভ করেই বললাম, আমার অতশত নেই, যখন এসেছি সব কিছুই দেখব।
অনন্তচরণ একগাল হেসে বলে, এই তো কথার মত কথা, হুজুর। ওই যে কথায় বলে, মরদ কা বাত, আর হাতি কা দাঁত। এই সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে হুজুর।
সিঁড়িগুলো বড় সোজা, আর একধারে ধরবার রেলিং দেওয়া আছে। অনন্তচরণ আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সামনে দিয়ে বেড়ালটা তরতর করে নেমে গেল যেন কুয়াশার ভেতর ঢিল ছোঁড়া হল।
ভেতরটা ভীষণ অন্ধকার—ঘুলিঘুলির ফাঁক দিয়ে একটু আলো আসছে। আমি বললাম, এখানে আলো কই ?
অনন্তচরণ জিভ কেটে বলে, ওই দেখুন, এমন ভুলো মন। খেয়ালই ছিল না, হুজুর। এই বলে সুইচ টিপে দেয়। অনন্তচরণ বলে, দুঃখীরামকে দেখার পর বউ কিছুতেই আর নিচেতে নামতে চাইত না, হুজুর। কোনদিনই অবশ্য এই ঘর ওর ভাল লাগত না। কিন্তু ইদানীং ও একদমই আসত না। আমার মেয়েটা এই নিয়ে ওকে ঠাট্টা করত। ভারি আমুদে মেয়ে ছিল, হুজুর।
লোহার সেই ঘোরানো সিঁড়িটা লোহাচুর আর ধুলো জমে লাল হয়ে গেছে। আমার পেছন থেকে অনন্তচরণ সাবধান করে দেয় : হুঁশিয়ার হুজুর, একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে পড়ে যাবেন। ‘পড়ে যাবেন’ কথাটার ওপর একটা অস্বাভাবিক জোর দেয়। আমি আবার সচকিত হয়ে উঠলাম।
নিচে ধূসর প্রেতের মত সেই বিড়ালটা যেন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। এতক্ষণে ওর স্পূর্তি হয়েছে বলে মনে হয়। কোন হেতু না থাকলেও কেন জানি না সহসা পূর্বজন্মের কথা আমার মনে হয়।
অনন্তচরণ বলে, এই কি কম হাঙ্গামা, হুজুর ! এই আমার এক মহা ভাবনা ! কোথা থেকে যে মুদ্দো জোগাড় করি। একসময়ে ভারি টান পড়ে যায়। অথচ স্কুলের কাজ তো চলা চাই। ডাক্তারবাবু বলেন, এ হল সমাজের মঙ্গলের কাজ—এ কাজ তো থামিয়ে রাখা চলে না। অথচ কোথা থেকে আসে বলুন !
যেন এই গুরুতর সমস্যায় অভিভূত হয়ে পড়ে সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অনন্তচরণ।
আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখি এই ঘরটি অস্বাভাবিক রকমের বড়, প্রাচীনকালের জমিদার বাড়ির মালখানার মত একটু মাটির নিচে। আর ছাদ এত উঁচুতে যে সেইখানে ঝোলানো অল্প-শক্তির বৈদ্যুতিক আলো নিচ থেকে তারার মত ক্ষীণ দেখায়। ঘরটার ভেতর স্পষ্টভাবে কিছু দেখা যায় না।
দেওয়ালগুলির গায়ে সাদা বালি লাগানো, মেঝেটা লাল আর ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। অনন্তচরণ পুনরায় তার পলাতক বউটির কথা উত্থাপন করে। বলে, লাল সবুজ ওই যে সিল্কের ফিতে উঠেছে আজকাল, বউয়ের ভারি পছন্দ ছিল, দাম কম ছিল বলে আমিও কোনদিন কিছু বলিনি। তবে আমরা গরীব-গুরোব মানুষ, ওসব আমাদের মানায় না। মাথায় ওইরকম লাল ফিতে বা জরি দেওয়া ফিতে দিলে অবশ্য বউকে চমৎকার দেখাত। থাকগে ওসব কথা, আসুন, এইবার লাশ দেখুন।
একধারে একটা লোহার চৌবাচ্চা, তারই ভেতর অ্যাসিডে মৃতদেহগুলো রয়েছে।
অনন্তচরণ বলে, দু-চারদিন এইখানেই রেখে দিই ওদের। তারপর যেমন যেমন দরকার পড়ে ওদের পাঠিয়ে দিই। ওর গলার আওয়াজ সহসা কেমন গাঢ় হয়ে আসে। অন্ধকারে আবছা আলোয় কিছু চট করে নজরে আসে না। অনন্তচরণের গলার আওয়াজে মনে হয় ও সহসা যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। বলে, এর ভেতরেই চারটে লাশ রয়েছে হুজুর। একটা বাচ্চা আর তিনটে ধাড়ী। বেশ বোঝা যায় ওর গলার আওয়াজ ক্রমেই চড়ছে। একটা বাঁশের খুঁটি নিয়ে সেই ময়লা ঘোলা জল ও নাড়তে থাকে, মনে হয় যেন কোন পিশাচ পরমানন্দে খেলা করছে। অ্যাসিড-জলের ভেতর থেকে যুবক, বৃদ্ধ, তরুণী ও শিশুর দেহ পর্যায়ক্রমে ভেসে ওঠে।
বেশ পা টিপে আমার কাছে এসে সহসা অনন্তচরণ বলে, হুজুর, এর মধ্যে সবচেয়ে কাকে বেশি ভালবাসি জানেন ? এই বলে আমার জবাবের অপেক্ষায় না থেকে সে পুনরায় সেইভাবে বাঁশের খোঁটাটা নাড়তে থাকে। বলে, কইরে, নটবর, একবার মুখখানা দেখাও বাপধন। এত লুকোচুরি কিসের বাবা। বেরিয়ে পড়, বেরিয়ে পড়। আ ! এই যে ? বাঁশের সেই খোঁটাটা সহসা ফেলে দিয়ে সেই মড়ার চুলগুলি বাগিয়ে নিয়ে আমার দিকে তুলে ধরে দেখায়। কোনরূপ দ্বিধা নেই। অবলীলাক্রমে তার মাথাটা নিজের হাতের ওপর শুইয়ে দিয়ে মুখটা যাতে আমি ভাল করে দেখতে পারি তার ব্যবস্থা করে দেয়।
এরকম বীভৎস পৈশাচিক দৃশ্য আমি জীবনে কখনো দেখিনি। অনন্তচরণের মুখ-চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সে যেন সহসা পুলকিত হয়ে ওঠে। আমার দিকে তাকিয়ে মাতালের মত ভঙ্গি করে বলে, বেশ দেখতে না ! চট করে ওকে ওপরে পাঠাচ্ছি না, সত্যি ছোকরাকে দেখতে ভাল ছিল। মেয়েছেলেরা ওকে পছন্দ করত। বোতল-টোতলও চলত। দেখি কতদিন আটকানো যায়। এই বলে সে দেহটাকে ছেড়ে দেয়। অ্যাসিড-জলে একটা আন্দোলন জাগে।
হুজুর বোধ হয় ভাবছেন, সব চুলই লাল কেন ! অ্যাসিডে ওরকম হয়ে গেছে।
আমি শুধু প্রশ্ন করলাম, ওদের কিভাবে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয় ?
কপি-কলে দড়ি টেনে।
একটা দেবদারু কাঠের প্রকাণ্ড বাক্স দড়িতে ঝোলান রয়েছে দেখলাম। দড়ি ধরে একটু টেনে দেখায় অনন্তচরণ। কপি-কলের আওয়াজটা একটা করুণ আর্তনাদের মত শোনায়।
ক্রমে আমার গায়ের প্রতিটি লোম খাড়া হয়ে ওঠে। ভয়ে বুক দুরু দুরু করতে থাকে। আরও একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি, সেই কাঠের বাক্সের ভেতর মলিন চাদর চাপা কি যেন রয়েছে। আমি অনন্তচরণকে বললাম, ওর ভেতরে ওটা কি রয়েছে বল তো ?
দেখা গেল, একটি অল্পবয়সী স্ত্রীলোকের সম্পূর্ণ নগ্ন দেহ শোয়ানো রয়েছে। মাথার তলায় একখানি ইট দেওয়া, তাতেই মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। খোঁপার ভেতর থেকে একটা জরির ফিতে চকচক করছে।
ঠিক এই সময়েই সহসা আলো নিভে গেল। আমার পকেটে টর্চ ছিল। দেখি, সে হিংস্র দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার হাতে টর্চটা দেখে সে যেন একটু হতভম্ব হয়ে গেছে। তাই একটু অপ্রস্তুতের ভঙ্গিতেই বলে, দেখছেন, আলোটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। কী কেলেঙ্কারি !
অনন্তচরণের গলার স্বর আবার নরম হয়ে এসেছে। আমি লজ্জা ত্যাগ করে বলে উঠি, সত্যি কথা বলতে কি, আমার গা ছমছম করছে। এ সব দেখা আমার অভ্যেস নেই।
পকেট হাতড়ে দুটো টাকা তার হাতে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠে এলাম। অনন্তচরণও ছাড়বার পাত্র নয়। সেও আমার পিছু নিয়েছে। অন্ধকারে সেই ক্ষেপা বেড়ালটার চোখ দুটো জ্বলছে।
সেই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে অনন্তচরণের বাড়িছাড়া বউয়ের জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা খোঁপা আর অসহায় চোখ দুটি ভেসে উঠল। আমি কোন রকমে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে পথে এসে দাঁড়ালাম।
অনন্তচরণ কি আমাকে তাড়া করেছে !