পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪)

পেরোনোর কিছু নেই – হুমায়ুন আজাদ

বাঙলা কবিতা যখন দূষিত, ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছে রাজনীতি, শ্লোগান, বানোয়াট পাগলামো, বিকার, প্রতিক্রিয়াশীলতা, অশুদ্ধ গদ্য ও অকবিতার অসুস্থ আক্রমণে, তথাকথিত কবিতা হয়ে হয়েছে ছোটোবড়ো তুচ্ছ জীর্ণ পংক্তির সমষ্টি, যখন বাঙলা ভাষাই হয়ে উঠেছে দূষিত, তখন হুমায়ুন আজাদের ‘পেরোনোর কিছু নেই’ ফিরিয়ে এনেছে প্রকৃত কবিতাকে; কবিতাকে আবার কবিতা ক’রে তুলেছে। তিনি ফিরিয়ে এনেছেন ছন্দ, মিল, যা হারিয়ে গিয়েছিলো কবিতা থেকে, এবং প্রকাশ করেছেন প্রাজ্ঞ উপলব্ধি, স্মৃতিকাতর প্রশান্তি, ও তীব্র প্রেমের আবেগ ও সৌন্দর্য। এ-কাব্যগ্রন্থে আছে কবিতা ও কবিতা, কবিতার পর কবিতা, যা আপাতসরল, কিন্তু সুগভীর, যা নতুন পথ তৈরি করবে বাঙলা কবিতার জন্যে।

.

উৎসর্গ

মনে মনে কথা বলি, একা- লতা, পাতা, শুকনো ঘাস, ধুলো, শূন্য, নিরর্থক, মহৎ বা স্মরণীয় নয়; দেখি সুন্দর, জলছবি, ভুলে-যাওয়া বাল্যস্বপ্নদের মুখ, তাদের বালক স্বর বাজে ঘুমে; কুয়াশায় আজো এক স্বপ্নহত নিঃসঙ্গ বালক জবার অরুণ দেখে, জাহাজের বাঁশি শোনে, ঘাসের শিশিরে দেখে টলোমলো সুখ। তাঁতের শাড়ির মতো সরষে ক্ষেতের ঢেউ দোলে, বালকের মতো শিশ্নে হাত রাখি, সুখ পাই, কেঁপে কেঁপে উঠি ধীরেধীরে; তীব্র দয়িতারা চায় পৌনপুনিক চরম পুলক অবিরাম, আমি কাশফুলে, ঘাসে, মুখ গুঁজে রাখি; কেটে যায় রাত প্রসন্ন পাখির ডাকে; দেখি বটগাছে অপরূপ অজগর, চিল, আর রোদের ঝিলিক।

বন্ধুরা এখন বৃদ্ধ, হৃদরোগী, আমিও তো, অনেকেই মৃত, ব্যর্থ ও অত্যন্ত সফল, এখনো আমাকে ঘিরে কলকল করে সুন্দর শূন্যতা, আর জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ের ঢল।

.

.

পেরোনোর কিছু নেই

ধুধু মাঠ; পার হয়ে যেতে হবে সন্ধ্যার আগেই।
 একলা হাঁটছি, দৌড়োচ্ছি, দেখছি রাত প্রস্তুতি নিচ্ছে
 বিদ্যুতে মাটিতে; কেঁপে উঠছি, জ’মে যাচ্ছি, ভেঙে পড়ছি
 হয়তো পেরোতে পারবো না, হয়তো হারিয়ে যাবো অন্ধকারে।
তারপর দেখি সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গেছি মাঠের এপারে।

নদী পার হয়ে যেতে হবে; ঢেউ ছাড়া কোনো নৌকো
 নেই; ঢেউয়ে চ’ড়ে পার হতে হবে। পা রেখেছি ঢেউয়ে
যেমন মাঝি পা রাখে নৌকোর গলুইয়ে তারপর শুধুই সাঁতার।
 খল জল টানে দশ হাতে, অবিরল ঘূর্ণিপাক চেপে ধরে গলা,
 বাহুতে সাঁতার, তারপর তাকিয়ে দেখি নদী হয়ে গেছি পার।

পাহাড় দাঁড়ানো পথ জুড়ে, খাড়া উঠে গেছে মেঘে; পার
 হয়ে যেতে হবে। পিছলে পড়েছি, দাঁড়িয়েছি, মাঝরাতে ঝুলে
 থেকেছি শিংয়ের মতো পাথরের কোণা ধ’রে, জ’মে গেছি শীতে,
 খাঁদে কাটিয়েছি দীর্ঘ রাত, আবার উঠেছি দেহ বেয়ে,
 এক সময় দেখেছি পাহাড় থেকে নামছি সমতল সবুজ ভূমিতে।

মরুভূমি পার হ’তে হবে; আগুনই সত্য, ঢুকেছি আগুনে।
 ছিটকে পড়েছি, মাথা গুঁজে প’ড়ে থেকেছি দুপুরে মরুভূমি
জুড়ে, স্বপ্নে দেখেছি সবুজ, চোখের সামনে বয়ে গেছে মায়ানদী,
জলের তৃষ্ণায় কঙ্কাল জড়িয়ে ধ’রে পড়ে থেকেছি বালুতে।
 এক সময় দেখতে পেরেছি পার হয়ে গেছি মরুভূমি।

আজ পেরোনোর কিছু নেই, ব’সে আছি- স্তব্ধ, শুনি শূন্য বাতাসের
 শব্দ, দেখি অন্ধকার নেমে আসে মাঠে জলে শস্যে শব্জিতে।

*

নিঃসঙ্গ ছিলাম

নিঃসঙ্গ ছিলাম আফ্রিকার গণ্ডারের থেকেও; তবু মুহূর্তের জন্যেও
বুঝি নি নিঃসঙ্গ আমি। একলা, সম্পূর্ণ একলা, বান্ধব নিঃসঙ্গতা সঙ্গী ক’রে,
একলা, সম্পূর্ণ একলা, উঠেছি পর্বতে, তুষারচুড়োয়, কাঞ্চনজংঘায়,
নেমেছি ভূতলে, গুহার গহ্বরে; সাঁতার কেটেছি প্রচণ্ড সাগরে, বালুঝড়ে খালি
পায়ে দাউদাউ অগ্নিকুণ্ডের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেছি মরুভূমি।

অতিশয় দরিদ্র ছিলাম, অত্যন্ত নিঃস্ব, বস্ত্র ও গৃহহীন, কপর্দকশূন্য,
বাঙালির থেকেও গরিব; তবু তা-ই ছিলো আমার সম্পদ, সোনা ও মাণিক,
ঝলমল করতো সূর্যালোকে, চন্দ্রালোকে, পূর্ণিমার চাঁদের মতোই
 জ্বলতো অরণ্যের চুড়োয় চুড়োয়, এক কণা ধান ছিলো স্বর্ণমুদ্রার থেকেও দীপ্ত
 দারিদ্র্য আমার উদ্ধত মস্তকে শোভা পেতো জ্যোতিশ্চক্রের মতো।

অসুস্থ ছিলাম খুব, আক্রান্ত অজস্র রোগে, তীব্র রক্তচাপে কাঁপতো শরীর,
চোখ ভ’রে ছিলো অন্ধকার, কানে বধিরতা, ফুসফুস জুড়ে ছিলো
 শূন্যতা, হয়তো কর্কটও বাসা বাঁধছিলো কোনো কোষে; তবে তাই ছিলো
আমার সুস্থতা, আমার অজর স্বাস্থ্য; আমার অপূর্ব অসুস্থতা রক্ত হয়ে
প্রচণ্ড বন্যার মতো প্রচণ্ড গতিতে বইতো রক্তনালিতে,
 হৃৎপিণ্ড কখনোই ক্লান্ত হতো না।

তুমি, স্পর্শমণি, রক্তপদ্ম, স্বপ্নলোক থেকে এসে যখন আমাকে দিলে
পরম সুন্দর সঙ্গ, আমাকে দ্বিগুণ ক’রে তুললে প্রেমে- আমার অচেনা পদ্ম- আর
 তীব্রতম দেহে- আমার অচেনা নদী-, তুমি এসে যেই মুঘলদের
থেকেও আমাকে ধনী ক’রে তুললে একজোড়া ওষ্ঠ আর রক্তপদ্ম দিয়ে,
তুমি এসে যেই আঙুল ছুঁইয়ে আমাকে ক’রে তুললে সুস্থ,
স্বাস্থ্যবান, তার পর থেকে আমি হয়ে উঠলাম প্রকৃত নিঃসঙ্গ, হয়ে
উঠলাম বাঙলার একমাত্র ভিখিরি, হয়ে উঠলাম পৃথিবীর
একমাত্র অচিকিৎস্য রোগী।

*

স্তব্ধতা

যা কিছু চুপচাপ, স্তব্ধ, স্বরহীন, স্থির, তাই শুধু বন্ধু
আজ, প্রিয় সঙ্গী; দূরে থাকি যাদের রয়েছে শব্দ বাক্য স্বরব্যঞ্জন
কোলাহল তাদের নিকট থেকে; ধ্বনিত ভাষায় খুঁজে আর
 পাই না কোনোই অর্থ, তাৎপর্য, দ্যুতি, অথচ স্তব্ধতা ভ’রে দেয়
 বুক স্তরেস্তরে ব্যঞ্জনায়। জানালা পেরিয়ে শুনি গাছের স্তব্ধতা,
শাখা থেকে কেঁপে কেঁপে রোদ হয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে
অর্থ, সীমাহীন, উঠোনের কোণে ফোটা এক টুকরো ঘাসফুলে
 দেখি অভিধানের থেকেও বেশি অর্থ অন্ধকার ভ’রে
 থাকে তাৎপর্যে, নদী জুড়ে ঢেউ হয়ে দোলে অর্থ; নিজেকে নিঃশব্দ
করি, যদি কোনোদিন তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারি।

*

যদি অন্ধ হয়ে যাই

মনে হয়েছিলো যদি অন্ধ হয়ে যাই দেখতে পাবো না।
এই তো দেখছি বেশ, দেখতে পাচ্ছি, সোনা জ্ব’লে
উঠছে অন্ধকারে, জলের গভীরে কাঁপছে মাছ
রঙের ছোপের মতো;
মনে হয়েছিলো যদি বধিরতা নামে শুনতে পাবো না।
এই তো শুনছি বেশ, শুনতে পাচ্ছি বাঁশি বেজে
উঠছে সমস্ত ছিদ্রে, জ্যোৎস্নায় বাজছে বাতাস
জলের শব্দের মতো।
দেখতে পাচ্ছি শুনতে পাচ্ছি- অন্ধকারে ওড়ে পাখি
জ্যোৎস্নায় বেজে চলে বাঁশি।

*

পঙ্কিল রাজহাঁস

ঘুমে জাগরণে দেখি বিশ্ব জুড়ে এক বিশাল পঙ্কের সরোবর।
কিছু নেই পঙ্ক ছাড়া, দিকে দিকে পঙ্কের বিস্তার; তার তীরে
দাঁড়িয়ে রয়েছি- অন্ধ, শূন্য থেকে বয়ে আসে ঠাণ্ডা কালো ঝড়
অশেষ পঙ্কের; পঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বে, বয়ে চলে চাঁদতারা ঘিরে।
 কিছুই দেখি না পঙ্ক ছাড়া আমার হৃৎপিণ্ডে, নষ্ট চোখের ভেতরে
ঢোকে পঙ্কের শীতল ঢেউ, শব্দহীন কাঁদে ভারী দুষিত বাতাস,
দেখি আমি: মাটি থেকে নীলিমা পর্যন্ত বদ্ধ পঙ্কের সরোবরে
পাখা ঝাঁপটে ডুবে যাচ্ছে আমার শুভ্র স্বপ্ন- আজ পঙ্কিল রাজহাঁস।

*

কেনো শুধু কেঁপে কেঁপে

কেনো শুধু কেঁপে কেঁপে উঠতে হবে, কেনো
শুধু বেজে যেতে হবে? কেনো শুধু রক্ত
 ঢালতে হবে হৃৎপিণ্ড থেকে? কেনো শুধু
জেগে থাকতে হবে, কেনো শুধু ফুটে উঠতে হবে
 লাল নীল হয়ে? কেনো শুধু দু-হাতে আঁকড়ে
 থাকতে হবে মেঘ মাটি ঘাস রোদ ফুল বৃষ্টি
 ধুলো শিশির আগুন পাতা পাখির পালক?

*

কীরকম আছি

কী রকম আছি আমি ভেবে তুমি তাকিয়ে থাকতে পারো
শিউলি বা বকুল গাছের দিকে, পারো তুমি আরো
 নতুন মেঘের দিকে চোখ রাখতে, যেতে পারো পাখিদের কাছাকাছি,
তাহলে বুঝবে না তুমি আমি কী রকম আছি।

কী রকম আছি আমি ভেবে রাস্তায় তাকাতে পারো ভিখিরির মুখে,
ঘেন্নায় সরিয়ে নিতে পারো চোখ, তোমার অপূর্ব দুই চোখে
 জমতে পারে আবর্জনা, হৃদয়ে উড়তে পারে পৌর পোকা আর মাছি,
 তাহলেও বুঝতে পারবে না আমি কী রকম আছি।

হঠাৎ রাস্তায় কুষ্ঠরোগী তোমার সামনে বাড়াতে পারে হাত,
তুমি শিউরে উঠতে পারো, অবিরাম দুঃস্বপ্নে কাটতে পারে রাত,
কণকমণি, শয্যায় তুমি দেখতে পারো ব্যাঙ, পুঁজ, বৃশ্চিক, মাছি,
তাহলেও বুঝতে পারবে না আমি কী রকম আছি।

পাঁচটি বাস সংঘর্ষে লিপ্ত পিষে গেছে একশো পঁচিশটি লাশ,
ছিটকে পড়েছে হলদে মগজ, গন্ধে ভরা ঢাকার আকাশ,
একটুকু হাহাকার, হাতে মুখ ঢেকে তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছো কাছাকাছি,
তাহলেও বুঝতে পারবে না আমি কী রকম আছি।

*

আমাকে দিয়েছো

আমাকে দিয়েছো কালো রৌদ্র দু-বছর দশ মাস ধ’রে।
ফুলে, মেঘে, পাতায় পাতায়, জলকূপে, আর্সেনিক ভ’রে
দিয়েছে দুই হাতে সোনালি আঙুলে; পদ্মায় বছর বছর,
স্রোত রুদ্ধ ক’রে জাগিয়েছো মরুভূমি- ভয়াবহ চর।
বহু কষ্টে, শ্রমেঘামে, বাঁশে শনে তৈরি গরিব কুটিরে
ছড়িয়ে দিয়েছো গোখরো, শুয়ে আছি বিষধর সর্পদের ভিড়ে,
 তাদের চুম্বনে ঠোঁটে, হৃৎপিণ্ডে দিনরাত জমছে অমৃত;
 আরো সর্প দাও, প্রিয়মণি, যাতে আমি তোমার বদলে
পাই আরো বিষদ্রাক্ষা, কূট মদ্য, মধু অবিরত।

*

অনেক দেখেছি

বয়স হয়েছে বেশ? ছাপ্পানো পেরিয়ে সাতান্নোতে
রেখেছি পা, প্রতিদিন ছবিসহ দেখি দৈনিকে চ’লে যাচ্ছে কনিষ্ঠরা।
আধখানি মেঘ, দু-একটি ঢেউ, অর্ধেক পূর্ণিমা ছুঁতে ছুঁতে,
এক চিলতে রোদ ঠোঁটে নিতে নিতে আমাকেও ধরেছে জরা
 দু-একটি আলিঙ্গনেই? এখনো তো কতো ঠোঁট, আলিঙ্গন বাকি!
চ’লে যাবো দুঃক্ষ নেই; দেখেছি তো কোটি কোটি গাধা,
তাদের পায়ের নিচে কেটেছে জীবন; যখনি দু-চোখ রাখি
সুন্দরের দিকে, দেখি শুয়োরমণ্ডলি মঞ্চ দখল ক’রে অবিরল কাদা
ছড়াচ্ছে সুন্দরের দিকে আমার ও আমাদের মুখমণ্ডল
 ঢেকে যাচ্ছে বিষ্ঠায়, চারদিকে প্রচণ্ড গণ্ডারের পায়ের আওয়াজ,
 আমার মুখ ও চোখের ওপর পঞ্জীভূত শুয়োরের অপর্যাপ্ত মল,
 বমি, পথে পথে শুয়োর ও গণ্ডারের পায়ের কারুকাজ।
দেখে দেখে বুক ভ’রে গেছে: যদি যাই বলবো- এসেছি,
অনেক অভিজ্ঞ আমি, পৌরাণিক ঈশ্বরের
থেকেও আমি অনেক দেখেছি।

*

বাঙলাদেশের কথা

যখন আমরা বসি মুখোমুখি, আমাদের দশটি আঙুল হৃৎপিণ্ডের মতো কাঁপতে থাকে
 দশটি আঙুলে, আমাদের ঠোঁটের গোলাপ ভিজে ওঠে আরক্ত শিশিরে,
যখন আমরা আশ্চর্য আগুনে জ্বলি, যখন আমরাই আমাদের স্বাধীন স্বদেশ,
তখন ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস কোরো না;
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।

তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের কথা; তার রাজনীতি,
 অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমণ্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
 মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন করে আমাকে পীড়ন কোরো না
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনের কারণ রয়েছে।

তার ধানখেত এখনো সবুজ, নারীরা এখনো রমণীয়, গাভীরা এখনো দুগ্ধবতী,
কিন্তু প্রিয়তমা, বাঙলাদেশের কথা তুমি কখনো আমার কাছে জানতে চেয়ো না,
আমি তা মুহূর্তও সহ্য করতে পারি না, -তার অনেক কারণ রয়েছে।

*

গোলাপ ফোটাবো

ওষ্ঠ বাড়িয়ে দাও গোলাপ ফোটাবো,
 বঙ্কিম গ্রীবা মেলো ঝরনা ছোটাবো।
 যুগল পাহাড়ে পাবো অমৃতের স্বাদ,
জ্ব’লে যাবে দুই ঠোঁটে একজোড়া চাঁদ।
সুন্দরীর নৌকো ঢুকবো বঙ্গোপসাগরে,
অতলে ডুববো উত্তাল আশ্বিনের ঝড়ে।
শিউলির বোঁটা থেকে চুষে নেবো রস,
এখনো আমার প্রিয় আঠারো বয়স।
তোমার পুষ্পের কলি মধুমদগন্ধময়,
সেখানে বিন্দু বিন্দু জমে আমার হৃদয়।

*

মানুষের সঙ্গ ছাড়া

মানুষের সঙ্গ ছাড়া আর সব ভালো লাগে; আমের শাখায়
 কালো কাক, বারান্দায় ছোট চড়ুই, শালিখের ঝাঁক,
আফ্রিকার অদ্ভুত গণ্ডার, নেকড়ে, হায়েনা, রাস্তার কোণায়
মলপরিতৃপ্ত নোংরা কুকুর, বহু দূরে ডাহুকের ডাক
সুখী করে, এই সব সুখ আছে ব’লে আজো বেঁচে আছি, এবং এখনো
বাঁচতে ইচ্ছে করে, তাই হয়তো আত্নহত্যায় যাবো না কখনো।

মানুষ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে চাই না; শুধু ভাবি
এতো কুৎসিত কী ক’রে হলো এই জন্তুগুলো? প্রত্যেকের মুখে
 কী ক’রে জমলো এতো আবর্জনা? কী ক’রে সবাই এতো অস্বভাবী
হয়ে উঠলো? আজ তারা প্রত্যেকেই সংঘ, প্রত্যেকের চোখে
হিংসা, প্রত্যেকেই আগ্নেয়াস্ত্র; প্রত্যেকেই একেকটি তীব্র মতবাদ,
গ্রীবা চেপে উপভোগ করতে চায় জীবনের মনোরম স্বাদ

মানুষের সঙ্গ ছাড়া আর সব ভালো লাগে; অতিশয় দূরে বেঁচে আছি,
পথের কুকুর দেখে মুগ্ধ হই, দেখি দূরে আজো ওড়ে মুখর মৌমাছি।

*

বিক্রমপুর

জলকন্যার মতো জলের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছিলে তুমি
ধূসর অতীতে। জল তোমাকে লালন আর পালন করেছে;
 জলই তোমার রুপ, শোভা, সৌন্দর্য, তোমার স্বাস্থ্য,
 তোমার রুপোলি রক্তপ্রবাহ! রক্তনালির মতো
 তোমার শ্যামল মাংসের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে নদী,
শাখানদী। পলির প্রসাধনে তুমি অদ্বিতীয় রূপসী হয়েছো।
 চিরন্তন জল তোমাকে জন্ম দিয়েছে; আবার গ্রহণ করেছে
 নিজের গর্ভে। তোমার অন্তরে হাজার বছরের জলের কল্লোল।
উত্তরে শাঁইশাঁই ধলেশ্বরী, পূর্বে মেঘনাদ মেঘনা; আর প্রচণ্ড হৃৎপিণ্ডের মতো
তোমার বুকের ভেতরে কল্লোলিত রত্নাকর প্রবল পদ্মা।

পদ্মা আজ পশ্চিমবাহিনী। এই নদী, এই মহানদী,
 তোমাকে সৃষ্টি ও ধ্বংস করেছে বারবার। মহান এ-নদী তোমাকে কীর্তিময়
করেছে, এবং বিনাশ করেছে তোমার লোকশরুত অজস্র কীর্তি।
কতো নদী তুমি লালন করেছো, কতো জলস্রোতকে তুমি
শোষণ করেছো, বিক্রমপুর। প্রবল খালের পর খাল হয়ে বয়েছে
তোমার আত্মার বর্ষার আবেগ। তালতলা, মীরকাদিম, চুড়াইন,
কামারগাঁও, শ্রীনগর, হলদিয়ার খাল বয়ে গেছে ম’রে গেছে
তোমার শরীরে। নদীর অশান্ত স্রোতকে দমন ক’রে সৃষ্টি করেছো তুমি
 শালুক শাপলা কাঞ্চনময় বিল। তোমার শ্যামল সবুজ বক্ষস্থলে
আড়িয়ল বিল ফুটে আছে শ্বেতপদ্মের মতো।

এই জল, আর জল, আর জলের ভেতরে মৌচাকের মতো
 মধুর তোমার গ্রামগুলো। সবুজ এই গ্রাম, শ্যামল ওই গ্রাম, হলদে ওই গ্রাম,
মধুর ওই গ্রাম, সোনালি ওই গ্রাম, রুপোলি ওই গ্রাম
 মায়ের মুখের মতো ওই গ্রাম, মায়ের চোখের মতো ওই গ্রাম,
বোনের তাঁতের শাড়ির পাড়ের মতো, বউয়ের খোপার মতো ওই গ্রাম।
রাড়িখাল, কামারগাঁও, ভাগ্যকূল, কেদারপুর, মাইজপাড়া, দামলা,
 কবুতরখোলা, কয়কীর্তন, শ্যামসিদ্ধি, গাদিঘাট, বালিগাঁও, মাওয়া, শিমুলিয়া,
শ্রীনগর, শেখরনগর, হলদিয়া, দিঘলি, কণকসার, হাতারপাড়া, বাঘড়ার
 মতো ধানের গুচ্ছ আর পাটের আঁশ আর সরষের হলদে ফুল আর
রক্তিম শিমুল ফুলের মতো তোমার গ্রামগুলো।

.

তোমার মাটিতে বেড়ে উঠে দু-হাতে তোমাকে জড়িয়ে
 ধ’রে অবিরাম চুমো খেয়েছে যে, সে তোমার শ্রেষ্ঠ ও একনিষ্ঠ
মোহন প্রেমিক, সে তোমার চাষী। তুমি তার আদরে শরীর
 ভ’রে ফলিয়েছো ধান, পাট, সরষে, কুমড়ো, কলার বিস্ময়কর রূপে।
তোমার কম্পমান বুকের ওপর নৌকো ভাসিয়েছে
 তোমার আরেক নির্ভীক প্রেমিক, সে তোমার জেলে। তার জাল
ভ’রে দিয়েছো তুমি বিশ্বসুন্দরীর থেকে সুন্দর ইলিশ, রুই,
বোয়াল, শরপুঁটি, পাঙ্গাশ, রুপোলি চিতলে।
 দুই প্রেমিকের গানে মুখর তোমার নদী আর ধানখেত।

তোমার উর্বর মাটি বুকে মেখে তিব্বতের দিকে হেঁটে
গেছেন শ্রীজ্ঞান, তোমার মনন বিখ্যাত মগজে ধারণ ক’রে বিশ্বের দিকে
 এগিয়ে গেছেন জগদীশ। যে-শিশু এখন তোমার মাটির
ওপর খেলছে, শরীরে মাখছে তোমার সুগন্ধ, তার সুগন্ধে হয়তো
 একদিন ভ’রে উঠবে বিশ্ব। তুমি প্রসব ক’রে যাবে কীর্তি, মানবিকতা,
জ্ঞান, মেধা, কবিতা, সঙ্গীত, নৃত্য, শিল্পকলা; অশ্লীল ব্যবসা
আর কুটিল রাজনীতিও প্রসব করবে তুমি দশকে দশকে।

তোমাকে আমার খুব মনে পড়ে, প্রিয়তম, আমার বিক্রমপুর–
 মনে পড়লেই চোখের সামনে দুলে ওঠে কুমড়োর
হলদে ফুল, নিরাক ধানের খেত, আড়িয়ল বিলের উত্তর পাড়ে
আশ্বিনের আকাশপ্রদীপ, আর একটি কিশোর–
 তার দুই চোখে শিশির, কুয়াশা, আশ্বিনের চাঁদ, ঘাসফুল,
নদী, মেঘ, বৃষ্টি, আর অমরতা।

*

ভাঙন

বিক্রমপুর ভাঙছে, ভাঙতে ভাঙতে বিক্রমপুর ছোটো হয়ে এসেছে
শিশুর মুঠোর মতো, এবং বিক্রমপুরের দক্ষিণ জুড়ে
শিশুর মতোই কাঁদছে ঘরবাড়ি, মসজিদ, কলার সবুজ পাতা,
নারকোল গাছের সারি। শুনতে পাচ্ছি তাদের বিলাপের ঐকতান,
দেখতে পাচ্ছি নারকোল বাগান ভেসে যাচ্ছে খলখল ক’রে, শুনতে পাচ্ছি
পদ্মায় ভেঙে পড়ছে টিনের ঘরের চাল; আর সন্ধ্যায় পদ্মার পশ্চিম পারে
সূর্যটা এমনভাবে কাঁপছে যে মনে হচ্ছে দুই বিঘে আকাশ নিয়ে ভেঙে প’ড়ে
ভেসে যাবে পদ্মার পানিতে। পদ্মা সুবোধ বালক বা সুশীলা বালিকা
নয়, পদ্মা ভয়ঙ্কর আদিম আর্য রূপসী, ভাঙার সময়ও অপূর্ব সুন্দরী।
ছেলেবেলায় এক বিকেলে আমি পদ্মাপারে দাঁড়িয়ে ছিলাম,
আমাকে নিয়েই ভেঙে পড়েছিলো পদ্মার খাড়া পার; আর আমি ভাঙতে
দেখেছি ভাগ্যকূল, বাঘড়া, কেদারপুর, মাওয়া, জশিলদা, কবুতরখোলা,
কান্দিপাড়া; শুনেছি বেপারি বাড়িতে কদমা পাগলার কবরটি নিয়ে দিঘলি
 ঝাঁপিয়ে পড়েছে পদ্মায়। ভাগ্যকূলে কুমারবাহাদুরের বাড়িটা আমার
ছেলেবেলা জুড়ে বটগাছের মতো কাৎ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো
ভেঙে পড়বে ব’লে; আমি গ্রাম ছেড়ে চ’লে আসার পরই সেটিকে
সম্পূর্ণ গ্রহণ করে পদ্ম। ওই বাড়িটিকে আজো আমি দেখি।
তবু আমি পদ্মাকে কখনো ভালো না বেসে পারি নি, আমার রক্তের মধ্যে
 প্রচণ্ড গতিতে বয়ে চলে পদ্মার ঘোলা জল, ঢেউ, জলভ্রমি, রুপোলি ইলিশ,
 বোয়াল, পাঙ্গাশ, আর প্রচণ্ড ভাঙন। আমার ছেলেবেলায় বহুবার পদ্মা ঢুকে
গিয়েছিলো ভাগ্যকুল বাজারের ভেতর; কামারগাঁর বাঁশবন
কাঁপিয়ে বয়ে গিয়েছিলো পদ্ম, এবং রাড়িখালে আমি ঘরের কেবিনে ব’সে
খাটালে বর্শি ফেলে ধরেছি পুঁটি, ট্যাংরা, গোলশা, এবং একটি হলদে
 ঢোঁড়া সাপ টোপ গিলে আমাকে আধঘণ্টা ধ’রে দেখিয়েছিলো
তার জিমন্যাস্টিক্স। আমরা তখন অপেক্ষা করতাম পদ্মার জন্যে,
বোশেখ এলেই অপেক্ষা করতাম কখন আসবে পদ্মা ধানখেতে, পুকুরে,
খেলার মাঠে, আড়িয়ল বিলে; জ্যৈষ্ঠ আসতে না আসতেই পাটখেত ভ’রে,
 দলঘাস কাঁপিয়ে, সন্ধ্যার বোয়ালকে উত্তেজিত ক’রে আসতো পদ্মা
পুকুরে, মাঠে, খেতে, আড়িয়ল বিলে। আমরা অপেক্ষা করতাম,
আমরা প্রস্তুত থাকতাম, আমরা ভালোবাসতাম, আমরা কামনা
করতাম। এখন কেউ আর অপেক্ষা করে না পদ্মার জন্যে,
পদ্মাকে বন্ধ্যা করার জন্যে চক্রান্তে পাগল সবাই, পদ্মাকে সরকার এখন
 রাজা আর প্যান্থার পরতে শেখাচ্ছে। কোথায় সেই খালগুলো?
কোথায় নাগনন্দী, ভাগ্যকূলের খাল? মান্দ্রার খাল?
কান্দিপাড়া, বাঘড়ার খাল? বিক্রমপুর এখন পদ্মার প্রকাশ্য শত্রু।
 এখন আর খাল বেয়ে আসে না পদ্মার ঘোলা জল, আসে না
রুপোলি শস্যগুলো; খালের কাটাল উজিয়ে আর পদ্মার দিকে বয়ে
 চলে না ডিমভরা ছাটাচিংড়ি, খসখসে নরম বেলে; বিক্রমপুরে এখন আর
বর্ষা আসে না, জোয়ার আসে না, পদ্মা আসে না; আসে আকস্মিক
বন্যা, পদ্মার পার জুড়ে শুরু হয় তাণ্ডব, ভাঙন। এসব কি পদ্মার

প্রতিহিংসা? বন্য ক্রোধ? পদ্মা এখন ইলিশহীন, পদ্মার ভেতরে এখন ইলিশ
নেই, পদ্মার ঢেউয়ের ওপর আর ইস্টিমার নেই; এখন আর বিক্রমপুরের
কোনো বালকের শেষরাত মুখর হয় না ইস্টিমারের সুদুর সিটিতে,
 জেগে জেগে কোনো কিশোর আর স্বপ্ন দেখে না। তারা ভুলে গেছে
 পদ্মায় সাঁতার কাটতে, নৌকো বাইতে; নৌকোর থেকে ভাঙা নড়োবড়ো
বাস তাদের অনেক প্রিয়। কাশবন নয়, এখন তাদের বুকে স্বপ্ন
জাগায় কোরিয়া, জাপান, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, জেদ্দা। বিক্রমপুরকে
 শুধু পদ্মাই ভাঙছে না, ভাঙছে দিনার, ইয়েন, ডলার, আর কতো
বিচিত্র মুদ্রা। বিক্রমপুরে এখন ঠাণ্ডা ডাবের থেকে অনেক সুলভ কোকাকোলা,
 রাখালের বাঁশরির থেকে সুলভ এখন হিন্দি সিনেমার গান।
ভাঙছে বিক্রমপুর, শব্দ শুনছি, পদ্মাপারের মতো ভাঙছে বিক্রমপুর;
আমি দেখতে পাচ্ছি ভেঙে পড়ছে নারকোল গাছের সারি, টিনের রঙিন ঘর,
মমিনার মরিচ খেত, ভেঙে পড়ছে আঙিনায় কিশোরী
আর ধানখেতে দাঁড়ানো কিশোর।

*

একলা দেখতে নেই

একলা দেখতে নেই নদী,
পদ্মা দেখতে একলা যাও যদি
দেখবে শুধু ঘোলা জল,
ভাঙা নৌকো, পোড়া কাঠ, শুষ্ক বালুচর।

একলা দেখতে নেই পাহাড়পর্বত,
 বহু কষ্টে, পিছলে প’ড়ে, আঁকাবাঁকা পথ
ভেঙে গিয়ে দেখতে পাবে
প’ড়ে আছে নষ্ট ঘাস, দিকে দিকে বর্বর পাথর।

একলা দেখতে নেই পূর্ণিমার রাত,
 ডালপালা পেরিয়ে দেখতে পাবে কাৎ
হয়ে, ঝুলে, খ’সে প’ড়ে আছে
একখণ্ড মৃত পিণ্ড শুকনো মরা জনহীন মাঠে।

একলা ঘুমোতে নেই- বিছানায় থাকবে দুজন,
 জড়িয়ে ছড়িয়ে ভ’রে, ভেঙেচুরে, যদিও এখন
আমরা একই বিছানায় পাশাপাশি,
তবু দুই মেরুতে একলা শীতরাত কাটে।

*

ই-শ! ই-শ! এ-ই, আ-হ, এইখানে, প্রিয়!’

‘ইশ! ই-শ! এ-ই, আ-হ্ এইখানে, প্রিয়! এইখানে রাখো
জিভদেব! আ-হ্! ম’রে যাচ্ছি! চোষো, একটুকু ধীরে,
আহ! ডান চাঁদে ঠোঁট রেখে চিরকাল থাকো,
পান করো, খাও, গেলো, শুষে নাও, ভেঙে, ফেড়ে, ছিঁড়ে।’

‘ইশ! ই-শ! এ-ই আ-হ্ এইখানে, প্রিয়!’

‘আমার মুঠোতে দাও রাজদণ্ড! দাও! ধরি! বন্য দেবতা
এতো দৃঢ়! পেশল! শক্তিমান! উচ্চশির! দাও তারে মুখগহ্বরে!
 কী প্রচণ্ড! আ-হ! কণ্ঠের ভেতরে শুনি পৌরাণিক অপরূপ কথা,
দম বন্ধ হয়ে আসে! ভেঙে পড়ছি আশ্বিনের ঝড়ে!’

‘ইশ! ই-শ! এ-ই আ-হ্ এইখানে, প্রিয়!’

‘ইশ! ই-শ! এ-ই আ-হ এইখানে, শিউলি বোঁটায়
 রাখো ব্যাঘ্ৰজিভ, কমলোষ্ঠে, চোষো, ভাঙো! ঘন মধু ঝরে,
আহ! মধু খাও, প্রিয়! ম’-রে যাচ্ছি! ফোঁটায় ফোঁটায়
ঝ’রে যাচ্ছি, ঢোকো, মধুময় চাকের ভেতরে।’

‘ই-শ! ই-শ! এ-ই, আ-হুঁ এইখানে, প্রিয়!’

‘ঢো-কো! আ-রো! গভীর পাতালে! ই-শ! বিদ্ধ, খনন করো,
আহ্! কে ঢুকছে? পশুদেব? কবিতা? ধীরে ধীরে ধীরে,
এ-ই-বা-র দ্রু-ত, প্রিয়, ম’রে যাচ্ছি, ঢোকো, দুই হাতে ধরো,
ভেঙে যা-চ্ছি ম’-রে যাচ্ছি, গ’লে যাচ্ছি মৃত্যুর গভীরে!

‘ই-শ! ইশ! এ-ই, আ-হ এইখানে, প্রিয়!’

*

এইভাবে নয়?

এইভাবে নয়? আরো মৃদু? আস্তে আস্তে? খুব ধীরেধীরে?
জিভকে সাপের মতো পিচ্ছিল মুখের গভীরে
ঢুকিয়ে পেঁচিয়ে ধরবো জিভ পাকে পাকে? যে-রকম বনে
 কোব্রারা পেঁচিয়ে থাকে দৃঢ় আলিঙ্গনে?

গ্রীবায়? চিবুকে? ওষ্ঠে? অধরে? চোখের পাতায়? দুই টোলে
রত হবো? ভেজা? কর্মরত হবো সিক্ত ডান বাহুমূলে?
 যাবো চাঁদ থেকে চাঁদে? লাল বৃত্তে ফোটা?
চুষবো শুষবো প্রস্ফুটিত রক্তপদ্ম, তার থরোথরো বোঁটা?

আরো নিচে? ঝরনাতলে? যেখানে জমছে মধু? শিউলি বোঁটায়?
কমলোষ্ঠে ঝরছে ঘন মধু গ’লে গ’লে ফোটায় ফোটায়?
 ধীর স্রোত হয়ে? চুঁইয়ে চুঁইয়ে? যেইখানে আঙুরের খনি?
 কণ্ঠ ভ’রে পান ক’রে যাবো সারারাত বন্য মধুমণি?

প্রবেশ করবো? দৃঢ়? প্রচণ্ড? সুন্দর? এখন ফেলবো নোঙ্গর?
ভেঙে পড়ছে দুই পার? জ্যোস্নায় পদ্মবনে ঢুকছে বর্বর?
 দ্রুত? এখন আবার ধী-রে? আস্তে? খুব ধী-রে-ধী-রে?
আ-হ, আ-হ্ পুলকিত ঘুম নামে পুষ্প আর স্বর্ণখনি ঘিরে?

*

একফোঁটা জল

আমাদের বাহু আর জড়িয়ে ধরবে না আমাদের,
ঠোঁট আর ব্যাকুল হবে না আমাদের ঠোঁটে।
 একলা যাচ্ছো, তুমি জানো না মহাজগতের
কোন দিকে; আমিও জানি না সূর্য কোন দিকে ওঠে।

দাঁড়িয়ে থাকছি একা, শূন্য, নিঃস্ব, ছিন্ন, ভিন্ন ভিখিরি;
ভাঙা থালার মতো পেতে হাত ভুগছি দুরারোগ্য জ্বরে;
যদি কেউ ছুঁড়ে দেয় একটিও কানা পয়সা পথে পথে ফিরি,
 হঠাৎ মুঠোতে দেখি একফোঁটা মুক্তো টলমল করে।

*

কিছুই আগের মতো নয়

বজ্রের প্রচণ্ড শব্দে এখন কাঁপি না আর। মনে হয়
 কাছে-দূরে কিছু ভাঙছে, ভাঙুক; জানালার পাশে ফুটে রয়
শরৎ হেমন্ত জুড়ে শিউলির গাছ, কখনো সুগন্ধ পাই,
ব্যাকুল হই না; ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে একবার হয়তো তাকাই।
জল দেখে মনে মনে সাঁতার কাটি না; সন্ধ্যাতারা দেখে
দাঁড়াই না, একবার তাকিয়ে আলোর টুকরোটি পিছে রেখে
 এগোই সম্মুখে। গৃহ যে আকুল করে তেমনও নয়;
ফিরতে হবে, একটুকু আগে বা পরে, তাই ফিরতেই হয়।
 নতুন বইয়ে আর সুগন্ধ পাই না, হাতে নিয়ে সেই পাগলের মতো
পড়তে বসি না, একদিন দেখি চারপাশে ধুলো আছে যতো
জ’মে আছে, দেখে হাসি। আন্তরিক এক বন্ধু অচিকিৎস্য অসুখে
সিঙ্গাপুরে মারা গেছে, পত্রিকায় পড়ি, তবু খুব শোকে
কাতর হই না; অথচ কুকুর ছানার শোকে কতো রাত
 কেটেছে অনিদ্র কষ্টে, বিস্বাদ লেগেছে চারদিক– মাছ, ভাত,
দুধ। গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ ফোটে না আজ আর বাগানে ও বুকে;
এমনকি নদী, চাঁদ, ঘাসফুল, তারার আকাশ, দিঘি, দিগন্ত, শুকতারা
এখন দেখি না আর তাকিয়ে তোমার অতি পরিচিত মুখে।

*

আমাদের আঙুলে

আমাদের পাঁচ আঙুলে ছিলো ইন্দ্রজাল
বইয়ে দিতে তুমি মরুভূমি জুড়ে ঝর্নাধারা,
 আমি করতাম কৃষ্ণচূড়াকে রক্তলাল
তোমার ছোঁয়ায় পাথরের গায়ে জাগতো সাড়া।

তুমি চাইলেই বনভূমি হতো সবুজ সোনা
আমার চুমোয় মেঘমালা হতো কোমল নীল,
তোমার ছোঁয়ায় দিগন্ত হতো সোনায় বোনা
আমার ছোঁয়ায় নর্দমা হতো রুপোলি ঝিল।

আমরা ফোটাতাম পথে পথে শুভ্র পদ্মফুল
ছড়িয়ে দিতাম শহরের মুখে ইন্দ্রধনু,
সূর্যকে ঢেকে উড়তো আকাশে তোমার চুল
চাঁপার গন্ধ ছড়িয়ে চলতো তোমার তনু।

তুমি চাইলে হাঁসেরা ভাসতো হ্রদের জলে
আমি ভাবলেই উড়তো আকাশে বকের সারি,
গন্ধরাজের উঠতো গন্ধ বুকের তলে
আমাদের সাথে মেঘের ওপর উঠতো বাড়ি।

আমরা এখন খুইয়েছি সেই ইন্দ্রজাল
ভিখিরির মতো পথে পথে ফিরি স্বর্গচ্যুত,
আমাদের ঘিরে থাবা মেলে আছে হিংস্র কাল
 বেঁচে আছি না কি এখন আমরা দুজনই মৃত?

*

লবঙ্গের বিষ

লবঙ্গের গন্ধ আমার অচেনা ছিলো; একদিন অদ্ভুত সুগন্ধ
 ঘিরে ফেলে আমাকে ও আমার কুটির। সৌরভে অন্ধ
 হয়ে খুঁজি- এ কী? নাসিকায় নয়, গন্ধ পাই সমস্ত শরীরে,
গন্ধ জমতে থাকে মাংস, রক্ত, ওষ্ঠ, সব কিছু ঘিরে;
কেঁপে কেঁপে উঠি। কোন সুদূর, শীত অথবা মরু
 অঞ্চল থেকে এসে আঙিনায় জন্মেছে এই লবঙ্গের তরু?
 লবঙ্গের গন্ধে ভ’রে যাই ঘাস, চায়ের পেয়ালা, পাখি,
ওষ্ঠে, আলিঙ্গনে, গ্রন্থে, ঘুমে, স্বপ্নে শুধু গন্ধ পেতে থাকি।
পৃথিবীকে লবঙ্গের তরু মনে হয়; ডালপালা, সর্ব অঙ্গ
 থেকে ঘ্রাণ ঢোকে, পান ক’রে চলি আমি চুম্বনলবঙ্গ।
কোনো গাছই বাঁচে না, কোনো ফুলই থাকে না চিরদিন,
আমার লবঙ্গতরু ম’রে যায়, আমার কুটির গন্ধহীন
হয়ে ওঠে; সুগন্ধের জন্যে আমি বুক ভ’রে নিই মৃত বায়ু,
 মাংসে শুনি হাহাকার- এতো কম লবঙ্গের আয়ু?
 গন্ধ যে পাই না, তা নয়; আজো পাই- বুকে অহর্ণিশ,
জমে ভিন্ন গন্ধ, নিশ্বাসে ও রক্তে পাই লবঙ্গের বিষ।

*

আজ কটি খুন হলো?

আজ কটি খুন হলো? মাত্র ৫২৫?
বেশ। আমি একটু বেশি ভাবি, ভেবেছিলাম ২,০২০;
তাহলে কমছে খুন? বেশ। কটি নারী হয়েছে ধর্ষিতা?
মাত্র ৭৭০? বেশ, কী নাম তাদের? মনোয়ারা, মায়ারানী, গীতা,
আনোয়ারা, ঊর্মিলা? তাহলে ধর্ষণ কমছে? পরিস্থিতি
 এখন অনেক ভালো? আইনশৃঙ্খলার হয়েছে বিস্ময়কর উন্নতি?
 কটি ছিনতাই হয়েছে আজ? বেশি নয়? ঢাকাতেই মাত্র ৮১৮?
বেশ, বেশ ভালো; আমি ভেবেছিলাম বুঝি ১০,০১২।
 ততোটা হয় নি? বাসটাসট্রাক দুর্ঘটনায় মরেছে কজন?
মাত্র ১০টি বাস উল্টে পড়েছে খন্দে? এতো কম? আত্নীয়স্বজন
খুঁজছে লাশ? পাচ্ছে না? বেশ, না পাওয়াই ভালো।
লঞ্চ ডুবেছে ২খানি মাত্র? আবহাওয়া চমৎকার ছিলো? যাত্রীরা ঠাণ্ডা কালো
জল সাঁতরিয়ে ব্রজেন দাসের মতো নিশ্চয়ই উঠে গেছে পারে।
মাত্র ১,৫০০ লাশের জন্যে ভাইবোন আত্নীয়রা হাহাকারে
 নষ্ট করছে নদীর পারের স্নিগ্ধ নীরবতা? এ অন্যায়। কী দরকার বেঁচে?
কী সুখ বাঁচায়? ভালোই তো, আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে।
 ক-শো কোটি খেয়েছে আমলারা? মাননীয় দরদী মন্ত্রীরা ক-শো
 কোটি? ১০,০০০ কোটি নয়? বহু কম? বেশ, মাত্র ৬০০
কোটি? তাহলে চলবে কীভাবে গণতন্ত্র? এ কেমন কথা?
আপনি আচরি ধর্ম তারা অসৎ জনগণকে শেখাচ্ছে সততা?
হাজতে হৃদযন্ত্র থেমে গেছে কজনের? পুলিশ তাদের প্রহার না ক’রে
চুম্বন করেছে? পুলিশের দৃঢ় আলিঙ্গনে, শৃঙ্গারে, পুলকের জ্বরে
 ম’রে গেছে ১২৫জন? তবু ভালো ৫২৫জন নয়,
পুলিশের কী দোষ? ওদের দেহের যন্ত্রগুলো- বৃক্ক হৃৎপিণ্ড যকৃত হৃদয়
নিশ্চয়ই রুগ্ন ছিলো; তবে ম’রে তারা ষড়যন্ত্র ক’রে গেছে
রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যখন ওমরা ক’রে পট্টি বেঁধে দেশে গণতন্ত্র এসেছে।
 রংপুরে মঙ্গা চলছে? চলুক। মরছে? মরুক। পেঁয়াজের কেজি এখন ৪০?
এতো কম! এতো শস্তা! বেশ ভালো, হ’তে তো পারতো ১২০।
আমলারা ভালো আছে? মন্ত্রীরা? কাস্টমস? কালোবাজারিরা?
 বেশ, তারা ভালো থাকলেই ভালো থাকবো আমরা তুচ্ছ ভিখিরিরা।
 স্তব করো। কোনো কথা নয়। চুপ। গণতন্ত্র এসেছে, কথা অপরাধ,
 মসজিদ তোলো, পাড়ার মাইকে, টেলিভিশনে সম্প্রচার করো মৌলবাদ;
মানুষ মরুক, মঞ্জুরা ধর্ষিত হোক, চলুক ছিনতাই কী সুন্দর মেষে
পরিণত হয়ে সুখে আছি খালেদা, আর গোলাম আজমের দেশে!

*

অন্ধ হওয়ার পর

অন্ধ হওয়ার পর এ কী দেখি আমি? আজো আমার দু-চোখে
পাতারা সবুজ? জ্যোৎস্নাময় গন্ধরাজ? স্বর্ণচাঁপা মায়াবী সোনালি?
 কৃষ্ণচূড়া আজো দেখি তীব্র লাল? আমার অসুস্থ বুকে
ফুটতে দেখি নীলপদ্ম? পূর্ণিমার চাঁদ আজো প্রবল রুপালি?

বধির হওয়ার পর এ কী শুনি আমি? ভোরে দোয়েলের শিস আমি
 শুনতে পাচ্ছি আগের মতোই? শুনতে পাচ্ছি মধ্যদিনে কেঁদে চলে বাঁশি?
 আজো আমি শুনতে পাই তার স্বর? মেঠো পথে বারবার থামি,
 আজো শুনতে পাচ্ছি একতারার মতো বাজে ধানখেতে বোশেখের চাষী?

ঘ্রাণশক্তিহীন আমি এ কী ঘ্রাণ পাই? বাতাসে আসছে ভেসে
তীব্র বকুলের সুধা? কাঁঠালচাঁপার গন্ধে এলোমেলো বিবশ বিকেল?
হেঁটে যাচ্ছি আমন আউশ সরষে আম হিজলের দেশে?
গন্ধ পাই কাঁচাহলুদের? কে মাখছে চুলে গন্ধবতী নারকোল তেল?

স্পর্শময় ত্বক কবে খ’সে গেছে; তবু আমি বারবার উঠছি কেঁপে
কার স্পর্শে? বাতাসের? আগুনের? ফসলের? জলের? নারীর?
আমার ওষ্ঠে কেনো চুম্বনের ভেজা স্বাদ? আমার অধর কেনো লেপে
যাচ্ছে প্রবল মধুর স্পর্শে? আমি কি এখনো তবে এই পৃথিবীর?

জিভ কবে ছিন্নভিন্ন কুষ্ঠরোগে; তবু পাচ্ছি কেনো অনুপম
স্বাদ ভাত, মাছ, সবুজ শব্জির? রসের সুস্বাদে ঝলমল ক’রে ওঠে দেহ?
ঝরনার জলধারা এমন সুগন্ধি, সুখদ, কোমল? পরম
 মধুর লাগে দুধ, রস, ইলিশ, কুমড়ো, রুটি, সর, মাখনের স্নেহ?

তাহলে হই নি অন্ধ? বধিরতা জমে নি শ্রবণে? ত্বক থেকে
লুপ্ত হয় নি স্পর্শ? শুনতে পাচ্ছি ফুল থেকে ফুলে ফেরে অক্লান্ত মৌমাছি?
 কুষ্ঠরোগে ছিন্ন হয় নি জিভ? শ্রাবণ এখনো নামে বঙ্গদেশ ঢেকে?
 লুপ্ত হই নি আমি? শিহরণ ওঠে রক্তস্রোতে- আছি, আজো বেঁচে আছি।

*

একটু একলা

একটুকু ভালো লাগলো আজ একা, শুধু একলা থাকার সুখ
 ভুলে গিয়ে হয়ে উঠেছিলাম পঙ্কিল রাস্তার ভিখারি,
কোলাহল, ক্ষোভ, কলহ, দায়িত্ব, অভিযোগ, পাহারায় বুক
জুড়ে নোংরা জমেছিলো, আর হৃদয়ের আঙিনা ও বাড়ি।

কেউ নেই, বেড়াতে গিয়েছে, ছিঁড়ে রাখছি বাচাল টেলিফোন;
 দেখি দূরে দু-একটি গাছ লতা, দু-একটি পাখি আমডালে,
 আছি, একা, বহু দিন পর, একা, অবর্ণনীয় সুখে ভ’রে আছে মন,
একটু আকাশ দেখি, নীল, যখন ইচ্ছে হয়, বাইরে তাকালে।

একটু একলা থাকতে চাই;- কতো কাল কতো যুগ ধ’রে;
দূরে, হয়তো হিজল ডালে, শুনতে পাই একটি পাখি একা গান গায়,
সেও হয়তো আমার মতোই একা, একলা সুখে আছে ভ’রে;
বহু দিন পর প্রশান্তিতে ঘুমোলাম, একা, একলা, বিছানায়।

*

বহু আগে ডিস্কোতে

বহু আগে ডিস্কোতে গিয়ে এক অগ্নিগিরি স্বর্ণকেশিনীর
সোনা আর ঠোঁটের লাভায় দূর থেকে পুড়ি ধিকিধিকি;
সঙ্গিনী তার ভগ্ন নিগ্রো স্থূল ঠোঁট মেয়ে: আমার শরীর
 ছুঁতে চায় রক্ত-সোনা, জ্বলে হীরকের ঝিকিমিকি।

স্বর্ণকেশিনীরা সহজিয়া, ডাকতেই আসে, অন্ধকার হয়ে গেলে
আমরা জড়িয়ে চুমো খাই পরস্পরকে অবিরাম পিষি;
যদিও বঙ্গীয় আমি, তবুও স্বর্ণকেশিনী আমার ভেতরে ঢেলে
দিতে থাকে সোনা, একসঙ্গীতকাল অবিচ্ছেদ্য মিশি।

পরে সঙ্গীহীন নিগ্রোনী আমাকে ডাকে, হাত মেলে দেয়
 হাতে, নাচতে চায়, অতো কুৎসিতের সঙ্গে আমার
 নাচতে ঘৃণাই লাগে, কিন্তু সবলে সে আমার ঠোঁট কেড়ে নেয়
ঠোঁটে, আমি স’রে আসি, দেহে বিবমিষা প্রচণ্ড ঘৃণার।

পান করি, নাচ শেষে একসঙ্গে যাই, স্বর্ণকেশিনীর সাথে
প্রথম মিলিত হই, শিথিল কাদার মতো তার দেহে নেই অগ্নিগিরি
ঈর্ষায় নগ্ন নিগ্রো তরুণী আমাকে জড়িয়ে নিয়ে মাতে
অগ্নিনাচে; ভাঙে, ছানে, পোড়ে- দগ্ধ হয়ে আমি ঘরে ফিরি।

তারপর আরো অগ্নি, কাদা, তুষার দেখেছি; গেছি বহু বক্ষে, বাহুতে, ও ঘরে,
তার মতো কেউ ভাঙে নি, পোড়ে নি, ছানে নি; তা আজো মনে পড়ে।

*

একাদশ প্রেম

আমরা দুজন পাশাপাশি ব’সে করছি পান,
আমাদের হাত থরথর কাঁপে ব্যাকুল হাতে।
আমাদের দুই দেহের মাদলে উতল গান,
আমারাই শুধু আমাদের এই সন্ধ্যারাতে।

আমি জানি তুমি ওষ্ঠ রেখেছো অনেক ঠোঁটে
তুমি জানো আমি ওষ্ঠ রেখেছি অনেক স্তনে।
তবুও তোমার দুই নীল চোখে পদ্ম ফোটে,
 সুদূর কোকিল ডাকে বারবার আমের বনে।

আমি জানি তুমি বহুজনকেই দিয়েছো দেহ,
আমিও বেঁধেছি বহু বল্লরী আলিঙ্গনে।
কেউবা পুলক দিয়েছে তোমাকে, দেয় নি কেহ,
আমাকেও ঠিক তেমনি দিয়েছে অনেকজনে।

কিন্তু আমরা আজ সন্ধ্যায় বাসছি ভালো,
কাঁপছি দুজনে আলিঙ্গন ও আবেগে ঘেমে।
আমাদের দুই বুকের ভেতরে মেরুর আলো,
 মনে হয় আজই পড়ছি আমরা প্রথম প্রেমে।

আমরা দুজন আসি নি তো ভেসে যুগল স্রোতে,
বহুজনকেই বলেছি আমরা, ‘প্রিয়তম, ভালোবাসি।’
বহু শয্যায় গিয়েছি আমরা জড়িয়ে শুতে,
 তবুও আমরা প্রথম প্রেমে আজ যাচ্ছি ভাসি।

*

প্রেম

আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের? করি? হয়তো করি না? তুমি ভাবো
আমি আজ হয়তোবা আছি কোনো ঝলমলে অষ্টাদশী তরুণীর
 সাথে মেতে আছি ঠোঁটে, বুকে, শিহরণে; রোববার যাবো
অন্য কোনো তরুণীতে। আর আমি ভাবি অদ্বিতীয় তোমার শরীর
হয়তো পিষ্ট হচ্ছে কোনো শক্তিমান সুদর্শন দেবতার দ্বারা;
তোমার কণ্ঠের স্বরে কে না কাঁপে কয়েক সপ্তাহ? প্রথম তোমাকে
দেখেই কে না পড়ে থরোথরো প্রেমে? তোমাকে হয়তো তারা
 পাঁচতারা, অথবা প্রাচীন ক্যাসেলে বাহুতে ও বুকে ক’রে রাখে।
 হয়তো পাহাড়ে গেছো কারো সঙ্গে,- ভাবি- উদ্যানপার্টিতে
কাটছে সন্ধ্যা; শেষে আলিঙ্গনে বেঁধে, বুকে ক’রে, কেউ নেবে ঘরে;
হয়তো ভাবছো তুমি নভেম্বরের এই মনোরম কুয়াশায় শীতে
 কারো সঙ্গে আমি মত্ত মানবিক সবচেয়ে সুখকর জ্বরে।
আমাকে সন্দেহ ক’রে কষ্ট পাও? নিরন্তর? যে-রকম আমি
তোমাকে সন্দেহ ক’রে কাঁপি? দুঃস্বপ্নে ঘুমহীন থাকি?
আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের? অবিশ্বাসে দিবা আর যামি
সন্দেহকেই প্রেমে পরিণত ক’রে বুকে ভ’রে রাখি?

*

আর কী পাওয়ার আছে?

পেয়েছি অনেক; আমরা বসেছি মুখোমুখি
 একদিন, কেঁপে কেঁপে, হাতে হাত রেখে; দু-দিন বিকেলে
পাশাপাশি ব’সে, ঘাসফুল দেখে, গভীর চুম্বনে সুখী
হয়েছি আমরা; এই সব যানজট সিগন্যাল ফেলে
 দূরে গিয়ে এক দুপুরে আমরা বসেছি কাশবনে;
একটু দূরেই আমাদের দেখে সুখী হয়েছিলো আশ্বিনের নদী,
একটু একটু ঘন হয়ে না জেনেই ধীরেধীরে বাহুর বন্ধনে
বাঁধা প’ড়ে দীর্ঘশ্বাসে, কষ্টে, ভেবেছি আমরা যদি
এভাবে থাকতে পারতাম চিরকাল! তবে দীর্ঘশ্বাস
কবে আর বাস্তবায়িত হয়? শুধু হৃদয়কে হাহাকারে রাখে।
আমরাও পেয়েছি হাহাকার, আশ্বিনের বিষণ্ণ বাতাস
ঘিরে ঘিরে ঘুরে কাঁদিয়েছে তোমাকে আমাকে।
 ফেরার সময় আমার শূন্য বুকে ঘুমিয়েছো, এরকম ঘুম
 ঘুমোও নি বহুকাল; পথে পথে দুপাশের গাছে
আঁধারে দেখেছি আমি গুচ্ছগুচ্ছ উদ্বেলিত রক্তিম কুসুম।
 বলো এর বেশি আমাদের কী পাওয়ার আছে?

*

তুমি আসবে

তুমি আসবে, তাই এতো যানজট শহরের পথে।
তুমি আসবে, তাই টেন্ডার ডেকে তৈরি রেখেছি ভাঙাচোরা
রাস্তাঘাট, প্রস্তুত রেখেছি ছিনতাইকারী, শোতে শোতে
বিকলাঙ্গ ভিক্ষুক, ঘুষনিষ্ঠ পুলিশ; এদিক ভাঙছি আর খোঁড়া
 চলছে ওই দিকে; ‘আল্লার নামে চলিতেছি’ আততায়ী ট্রাক
 লেলিয়ে দিয়েছি, প্রস্তুত রেখেছি পথেপথে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র ক্যাডার;
তুমি আসবে, তাই শুক্রবারে, ছড়িয়ে দিয়েছি ঝাঁকঝাঁক
জোটবন্ধ হিংস্র মৌলবাদী, তাদের পকেটে চকচকে বেহেশতি ডলার।
চৌরাস্তায় তোমাকে দেড়ঘণ্টা আটকে রেখে একটা ডাকাত
 যাবে পতাকা উড়িয়ে রাস্তা খালি ক’রে, তুমি রিক্সায় কাঁপবে থরথর,
কাঁপতে থাকবো আমি অপেক্ষায়; লক্ষলক্ষ শয়তানের হাত
আমার হৃৎপিণ্ড ঠুকে ঠুকে পিষে পিষে বানাবে পাথর।
 তুমি আসবে;- তাই এ-নগরে বাজে এতো শিঙ্গা, ভয়াবহ বাঁশি,
আশ্চর্য, তবুও আমরা এই নরকেও ভালোবাসি।

*

ভালোবাসতে চাই

কখনো বাসি নি ভালো; বাসলে তো সারাক্ষণ কুয়াশায় ঘোরে
থাকতাম পাখিদের মনে হতো লাল নীল সুর, খুব ভোরে
উঠে সূর্যে দেখতাম লাল রক্তজবা, ঘাসের সবুজে
আপাদমস্তক নগ্ন প’ড়ে থাকতাম দুই চোখ বুজে
তাকে খুঁজে খুঁজে হাঁটতাম পথে পথে কেঁপে কেঁপে
 নাম জ’পে জ’পে, কখনোও মেপে মেপে,
সাবধানে, পা ফেলতাম না রাস্তায়; দুর্ঘটনারত ট্রাক দেখে
 মালা ভেবে বুকের ওপরে তাকে আনতাম ডেকে।
 যদি ভালোবাসতাম, তাহলে কি দাড়ি কামাতাম? জুতো পায়ে
বেরোতাম পথে? চুল আঁচড়াতাম? পরতাম গায়ে
শীত গ্রীষ্মের শার্ট প্যান্ট জামা? তাহলে কি পাগল যুবক
 লিখতাম শুদ্ধ গদ্য? পাদটীকাসহ সন্দর্ভপুস্তক?
ভালোবাসলে কী ক’রে একটানা ঘুমোলাম এতোগুলো রাত,
যখন থাকার কথা জেগে, হৃৎপিণ্ডে হঠাৎ
কারো মুখ দেখে যখন কাঁপার কথা ভূমিকম্পে, তখন কী ক’রে
 ঘুমোলাম মধ্যরাতে, একটায়, দুটোয়, প্রহরে প্রহরে?
পাগল হই নি কখনো, কোনোদিন ভালোবাসি নাই,
আজ মনে হয় একটু পাগল হই, রাস্তায় জড়িয়ে ধ’রে চুমো খেয়ে
 বলি, ‘আমি ভালোবাসি, তোমাকেই চাই।’

*

গন্ধরাজ, যাও

গন্ধরাজ, যাও তার কাছে, ভরো তাকে অমল জ্যোৎস্নায়;
সুগন্ধে করো পূর্ণ, যেনো সে আবার ফিরে পায়
 শুদ্ধতা। সোনালি রোদ, যাও তার কাছে, তাকে
 দাও সুস্থতা। দোয়েল, যাও, তোমার নির্মল ডাকে
যেনো জেগে ওঠে সে তোমার মতোই নির্মল
 যাও মেঘ, অজস্র ধারায় ঢালো শ্রাবণের জল
তার দেহ ভ’রে, করো তাকে নদী, পলিমাটি,
 সবুজ বন্যফুলের মতো করো তাকে খাঁটি;
 চাঁদ, যাও, দাও তাকে তোমার পূর্ণিমা,
 যাক সে পেরিয়ে তার নষ্ট শরীরের সীমা।
যাও, শিশির, তোমাকে নিয়ে সে আজ উঠুক,
 গন্ধরাজ অন্ধকারে আজ সে আবার অম্লান ফুটুক।

*

ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে

এই শতকের শুরুতে রবার্ট ফ্রস্ট, নিঃসঙ্গ মার্কিন কবি, অশ্বে চ’ড়ে
 পৌঁছেছিলেন এক বনভূমির প্রান্তে; তখন দশ দিক ভ’রে
নেমে আসছিলো অন্ধকার। ছিলেন খুবই ক্লান্ত, দুই চোখে তাঁর
 জমছিলো ঘুম; তবু প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তিনি ঘুমিয়ে পড়ার
আগে যেতে চেয়েছিলেন মাইল মাইল পথ; ওই কবি শেষে
 পেরিয়েছিলেন বনভূমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে। বহু দূর দেশে,
 শতকের শেষ লগ্নে, আমি পৌঁছেছি আরেক বনভূমির প্রান্তে; আমাকে
 ঘিরেও নামছে ঘন অন্ধকার; নাম ধ’রে ঘুম আমাকেও ডাকে।
আমার অশ্ব নেই পায়ে হেঁটে আমি পেরিয়েছি পথ নিরবধি;
পা থেকে ঝরছে রক্ত চুঁইয়ে, ফিনকি দিয়ে, তবে শুধু যদি
রক্ত ঝরতো, তাহলেও সুস্থ থাকতাম, আমার দু-পায়ে রক্ত, বুকে
ঘৃণাবিষ; দূষিত আমার রক্ত পঙ্কিল ঘৃণায়। শরীর অসুখে
ভগ্ন; আমারও পাচ্ছে ঘুম, তবে ঘুমোনোর আগে মাইল মাইল যেতে
আমার ইচ্ছে করছে না; ভগ্ন জীর্ণ আমি ইচ্ছে করে মাথা পেতে
শুয়ে পড়ি পঙ্কে, কাদায়; আমি ভুগছি ঘৃণার কৃষ্ণতম জ্বরে,
 এক পা-ও না ফেলে এখনি আমার পথের ওপর
 ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে।

*

আমাদের ঠোঁট

প্রথম দেখার কথা আজো মনে পড়ে।
এসে ঢুকলে ঘরে, আর মহাজাগতিক সৌন্দর্যের ঝড়ে
 কেঁপে উঠলো নীলগ্রহ চোখের পল্লব, লাল টোল থেকে
ছড়িয়ে পড়লো জ্যোৎস্না, দুই ঠোঁট দেখে
মনে হলো সূর্যোদয় দেখছি বঙ্গোপসাগরে;
 লাল আভা উপচে পড়ছে দিগন্তের ছোট্ট কুঁড়েঘরে।
দু-একজন, কখনো কখনো, মাঝেমাঝে আসে;
 স্তব করে কেঁপেকেঁপে, লঘু হয়ে ভাসে
 আশ্বিনের কুয়াশার মতো। তুমিও তেমনি স্তবে
 কাঁপবে, ভেবেছিলাম নিজেকে মনে হবে
সার্থক; কিন্তু দেখি আমার ষাটটি সুপ্রসিদ্ধ বই
 ছিঁড়েফেড়ে ফেলছো প্রখর যুক্তিতে; আমি ডুবছি অথৈ
অন্ধকারে; কোন চিত্রকল্পে আছে ঢুকে
 প্রাগৈতিহাসিক ভ্রান্তি, দেখিয়ে দিচ্ছো, আমি একটু অসুখে
কাঁপতে থাকি, বই খুলে দেখাচ্ছো কোন কথাগুলো
ঝকঝকে, কিন্তু অসার, আমি শিমুলের তুলো
 হয়ে দিগ্বিদিক ছিঁড়ে ফেড়ে উড়ে যাচ্ছি আপাদমস্তক;
আক্রমণে লণ্ডভণ্ড আমার ষাটটি মোটামুটি প্রসিদ্ধ পুস্তক।
বাকশক্তিহীন, পর্যুদস্ত, আমি ভাবি, অমন ফাল্গুন
ঠোঁটে, লাল টোলে, কী ক’রে থাকতে পারে এমন আগুন?
 দু-ঘন্টায় বাতিল হয়ে যাই, মূর্খ, বহু কিছু শিখি,
ইচ্ছে হয় তিরিশ বছর ধ’রে আবার নতুন ক’রে বইগুলো লিখি।
তবুও স্বপ্নের মধ্যে আশ্চর্য বিকেল কেটে যায়;
 এক সময় দেখি জুলাইয়ের নিবিড় সন্ধ্যায়
আবছা অন্ধকারে পুব দিকে একটি স্থির শাদা চাঁদ ওঠে,
এবং আমরা বদ্ধ আলিঙ্গনে দুই জোড়া ঠোঁটে।

*

বুকে গেঁথে নিলাম ছুরিকা

তুমি এলে অস্বপ্নিত সৌন্দর্যের শিখা,
তখন বুঝি নি বুকে গেঁথে নিলাম ছুরিকা।
কেঁপে উঠলো মেঘমণ্ডল, সূর্য, জলস্থল,
 ছড়ালো সুন্দরবনে আশ্চর্য অনল।
 স্বপ্নাতুর হলো মাংস; বুকের জঙ্গলে
অজস্র বছর পর রক্তপদ্ম জ্বলে।
 স্বপ্নের তোড়ে ভাঙে মেঘনার তীর,
কুটো হয়ে ভেসে যায় খড়ের কুটির।
দিগন্ত দু-ফাঁক ক’রে তুমি এলে নেমে,
জড়ালাম আলিঙ্গনে, তীব্রতম প্রেমে।
তারপর থেকে শুধুই রক্তক্ষরণ,
 হৃৎপিণ্ড দীর্ণ ক’রে ঝরে সারাক্ষণ।
তীক্ষ্ণ এক ছুরি গাঁথা বুকের ভেতরে,
ফিনকি দিয়ে রক্তধারা নিরন্তর ঝরে।
ঠোঁটে ঠোঁট রেখে যেই জ্বেলে দিলে শিখা-
 তখন বুঝি নি বুকে গেঁথে নিয়েছি ছুরিকা।

*

রান্নাঘরে নারীবাদী

তুমি এসেছিলে লিসবন আর আমি দূর ঢাকা;
আমাদের দেখা হয়েছিলো গ্র্যান্টস হাউজের উষ্ণ রান্নাঘরে;
রাঁধছিলে তুমি পোর্ক ও পোটেটো; আমার শুঁটকি রান্না দেখে
চেয়ে রয়েছিলে দুই নীল চোখ বিস্ময়ে পুরো ভ’রে।

‘হাই’, তুমি বলেছিলে, ‘কোথা থেকে যেনো তুমি?’
 ‘বাঙলাদেশ; আর তুমি?’–বলেছিলে, ‘আমি পর্তুগাল।’
— ‘ব্যাঙলাদেশ?’ চিনতে পারো নি- ওটি সাগর না মরুভূমি;
লজ্জা তোমার লাল গণ্ডকে করে তুলেছিলো আরো লাল।

তারপর আমরা অনেক রেঁধেছি বুঝছি রান্নায়ও আছে সুখ।
তুমি খুব সুখে খেয়েছো শুঁটকি, ভর্তা, বিরিয়ানি, মাছ, ভাত,
আমিও খেয়েছি পোর্ক ও পোটেটো; স্বাদে ভ’রে গেছে মুখ;
 কথা ব’লে ব’লে বুঝতে পারি নি গভীর হয়েছে রাত।

‘নারীবাদী আমি’, বলেছিলে, ‘খুবই ঘৃণা করি প্রেম আর বিয়ে,
 প্রেম বাজে কথা; বিয়ে? ওহ্ গশ! খুবই নোংরা কাজ।’
‘প্রেম বেশ লাগে’, বলেছি আস্তে, ‘কখনো বিবাহ নিয়ে
ভাবি নি যদিও; মনে হয় বিবাহের কোনো দরকার নেই আজ।’

চুমো খেতে খেতে ঘুমিয়েছি আমরা; বহু রাত গেছে সুখে,
আমাদের দেহে বেজেছে অর্গ্যান, ড্রাম, ব্যাগপাইপ রাশিরাশি;
 একরাতে দেখি কী যেনো জমেছে তোমার সুনীল চোখে,
আধোঘুমে ব’লে উঠেছিলে, ‘প্রিয়, তোমাকে যে ভালোবাসি।’

কেঁপে উঠেছিলো বুক সেই রাতে; বেশি নয়, আট মাস পরে
বলেছিলে, ‘চলো বিয়ে করি, আমরা এখন বিয়ের ইচ্ছে ভারি।’
 চুমো থেকে আমি পিছলে পড়েছি, ফিরেছি নিজের ঘরে;
 ‘চলো বিয়ে করি, চলো বিয়ে করি’, প্রতিটি চুমোর পরে
এভাবেই, প্রিয়, একদিন হলো আমাদের চিরকাল ছাড়াছাড়ি।

*

বাবা ও মায়ের প্রতি

বাবা, ব্যর্থ ছিলেন আপনি আমার মতোই; সম্ভবত ১৯৯২ থেকে
 দেখি না আপনাকে, মনে যে পড়েন খুব, তাও নয়; কে কে
আর আপনাকে মনে করে? আপনার সন্তানেরা অতিশয়
 ব্যস্ত নানা কাজে, আপনাকে ভাবার মতো কোথায় সময়?
মা, তোমাকেও দেখছি না ক-মাস ধ’রে, ২০০৩-এর জুলাই
থেকে সম্ভবত ঠিক মনে নেই; তবে যখন কখনো যাই
 গ্রামে, বিশেষ যাই না, ঢুকি বিষণ্ণ দোতলার ঘরে,
 ডাকতে গিয়ে মনে পড়ে তুমি শুয়ে রয়েছো কবরে।
 বাবা ও তোমার পাশে একটু দাঁড়াই, কখনো প্রার্থনা
 করি না; বিশ্বাস নেই ওতে, তবে হই আনমনা
একটুকু, তারপর চ’লে আসি; কখনো হঠাৎ নিজ স্বরে
শুনি, বাবা, আপনার স্বর; একা ব’সে থাকি ঘরে,
 মনে হয় সন্ধ্যা নামছে, সুর ক’রে ডাকছেন নাম ধ’রে
 খেলা রেখে ফেরার জন্যে; মা, তোমাকে দেখি মাঝমাঝে
 দাঁড়িয়ে রয়েছে, পথ চেয়ে, একলা, হঠাৎ বুকে বাজে
 টুকরো মৃদু স্বর। খুব যে কষ্ট পাই বাবা আর তোমার অভাবে,
তা নয়; আমার পুত্রকন্যারা এভাবেই আমাকেও ভুলে যাবে।

*

বৃদ্ধদের মধ্যে

তিরিশ বছর দেখা নেই- এতো দিন? অথচ একদিন দেখা
 হতো প্রায় প্রতিদিন সকালে বিকেলে সেই বন্ধু ও বান্ধবীরা
সম্ভাব্য সূর্যাস্তের আগে ডেকেছে পার্টি; সঙ্গীহীন, একা,
জিন্সপরা যুবকের মতো আমি যাই; গিয়েই রক্ত, চোখ, শিরা
কেঁপে ওঠে; মনে হয় আমি এদের কাউকে চিনি না।
সিএসপি সুলেমান, দুইবার বউ ভাগিয়েছে অধস্তন দুই
 উপসচিবের, সাবদার ভাগিয়েছিলো নিজ মামীকেই,
 তারা দাড়ি রেখে বদলে গেছে আমি এককালে ‘তুই’
 ব’লে এদের ডেকেছি? কোথায় এখন তারা? কর্মে-কামে সেই
 সিদ্ধপুরুষেরা? তারা পঞ্চমবার পুণ্য হজ থেকে
ফিরেছে কদিন আগে; আমাদের স্বপ্নদেবী নিতম্বিনী রীনা
এখন মাংসের স্তূপ, অদ্ভুত হিজাব ও বোরখায় ঢেকে
 গুলশানে থেকে খোয়াব দেখছে জান্নাতের; যে-দিকে তাকাই
 রোগা, মাংস, জরা, ভগ্নগাল, দাড়ি; ক্যানাডায় পুত্রের সাফল্য ও কন্যার
বিবাহকাহিনী, বিসমিল্লা, ধর্মের গুণগান, জান্নাতের লোভ; ভয় পাই
আমি, যেনো মুখোমুখি হই এক সীমাহীন ক্লেদের বন্যার।
ফরিদার ঠোঁট ঝুলে গেছে, যার এভিন্যুর মতো প্রশস্ত লাল ঠোঁট দেখে
কেঁপেছি আমরা; এখন অদৃশ্য রেহানার পীনোন্নত পার্বত্য স্তন;
মোঃ জমিরালি তছবি হাতে কাঁপছে বারবার, পলাশির বস্তি ছেঁকে
এককালে বেশ্যাদের সঙ্গে যে প্রতিরাতে করতো রমণ।
আমিও কি এদের একজন? এতো ভগ্ন, জরাগ্রস্ত, বৃদ্ধ ও বাতুল?
এতো রুগ্ন? এমন অশ্লীল? এতো কুৎসিত? লাশের থেকেও সীমাহীন মৃত?
মনে পড়ে বেশ শাদা আমারও দুর্বিনীত অরাষ্ট্রিক ঢেউখেলা চুল,
তবু কেনো একটি তরুণীর ঠোঁট, গ্রীবা আমাকে বারবার করেছে বিস্মৃত?

*

উপহার

বুড়ো হয়ে গেছি বেশ, কিছুটা শিথিল; বুঝতে পারি নি তাই
তোমার একুশতম জন্মদিনে, তিলোত্তমা, কী নিয়ে যাই।
তুমি ঘাসফুল, স্বর্ণলতা, রোদ, পৌষের তুষের আগুন,
 কোকিলের ডাক, কৃষ্ণচূড়া, রক্তজবা, নদী, রঙিন ফাগুন।
 ঠিক হয় নি আমাকে ডাকা- বর্তমান- এমন রঙিন
 রাত্রে, যতোই বিখ্যাত, তবু আমি ভবিষ্যৎহীন।
 ব্যাংককের উপহার, ঝকঝকে দেহ নিয়ে এসেছে বন্ধুরা,
 জানে তোমার সোনার পাত্রে তীব্র গম ও আঙুরের সুরা
 তাদেরই পানীয়। বাজে ড্রাম নাচছে তারা উন্মত্ত দরবেশ,
 একটুকু ছোঁয়া, আলিঙ্গন, ও ঠোঁটের জন্য সম্পূর্ণ নিঃশেষ
 হ’তে তারা সবাই প্রস্তুত আজ রাতে; তারা দীপ্ত, সাফল্যমণ্ডিত,
এবং সাফল্য- অমরতা- চায় তোমাকে অন্তত একবার দ্বিখণ্ডিত
 ক’রে; তবুও, একুশবতী, অপরূপা, কেনো আমাকেই নিলে
 নিজ শয্যাকক্ষে; দুই ঠোঁটে একচাক মধু ভ’রে দিলে?
কী ক’রে জেনেছে তোমার একুশতম দেহ আর মন,
আনি নি কিছুই, শুধু ঠোঁটে ক’রে এনেছি একটি দীর্ঘ চুম্বন?

*

এগুলো কবিতা নয়

এগুলো কবিতা নয়, ১০,০০০ বা ১০ লক্ষ কিলোমিটার
 জুড়ে ছড়ানো খড়কুটো- স্বপ্ন ঘুমে-জাগরণে স্তব্ধ হাহাকার,
তোমাকে জড়িয়ে ধরা বাউল বাহুতে; লাল টোল, মুখ,
আঙুলের ছোঁয়া, একটু-ঘুমিয়ে-পড়া এক ফালি রক্তিম চিবুক,
 পানার্ত ওষ্ঠ, শিউলির বোঁটা, এগুলো একা জেগে থাকা,
 মধ্যরাতে, স্তনমণ্ডলিতে এলোমেলো ঝড় আর দুই ঠোঁট রাখা
ঘাসের যন্ত্রণা; দাবানলদগ্ধ, ছাই হওয়া, অরণ্যের কথা,
এগুলো জীবনের থেকেও বহু মাইল বিস্তৃত শূন্যতা।
এগুলো তোমার প্ল্যাটফর্ম জুতোর শব্দ, গ্রীবার কম্পন,
 জংঘার কোমল মাংস, চাঁদ-জানু, পদ্মলাল একমুঠো স্তন
 ও বৃত্তের ফুটে ওঠা, এগুলো তোমার ভাঙা জীর্ণ প্রতিধ্বনি,
একরাশ ছাই ও শূন্যতা থেকে খুঁজে আনা তুচ্ছ সোনামণি;
পাগল হাওয়ায় ঝ’রে পড়া, বৃষ্টিপাত, অপূর্ব ব্যর্থ সঙ্গম,
মৃত্যুর থেকেও ঠাণ্ডা ঘুম, শূন্যতার থেকে কিছু কম
এবং অনেক বেশি শূন্যতা; এগুলো অসুস্থ, কাঁপা, আঁকাবাঁকা
অক্ষরে তোমাকে প্রতিটি নিশ্বাসে বুকে ধ’রে রাখা।

*

যদি আর কাউকে

যদি আর কাউকে কখনো জড়িয়ে ধরো
সে যেনো হই আমি; যদি কোনো থরোথরো
ঠোঁটে রাখো ঠোঁট, সেই ঠোঁট যেনো হয়
আমার পাগল ঠোঁট; যদি কোনো হাত জয়
করে তোমার সোনালি দেহ, যেনো সেই হাত
হয় আমার দু-হাত; পুলকে শয্যায় কাটে রাত
যদি কারো সঙ্গে সে যেনো হই আমি; যদি বুকে
 দীর্ঘশ্বাস জমে, শুয়ে থাকো হঠাৎ অসুখে,
আমি যেনো হই সেই জ্বর, মাথা ধরা, যদি কেউ
সোনার খনিতে ঢোকে, আর শ্রাবণের ঢেউ
 হয়ে দোলায় তোমাকে, আমি যেনো হই সেই নদী;
পুলকে বিভোর হয়ে কাউকে কখনো বলো যদি,
 ‘প্রিয়, ভালোবাসি, তোমাকেই আমি দিবাযামি’,
সে যেনো আর কেউ নয়, হই শুধু আমি।

*

এর পর যেনো

এর পর যেনো তুমি খুব কষ্টে থাকো;
অন্ধ হয়ে যাও, যেদিকেই দুই চোখ রাখো
কিছুই দেখতে না পাও, তোমার চারদিকে
যেনো শূন্য হয় অম্লজান, ঝিলিকে ঝিলিকে
কেঁপে ওঠো, শ্বাস নিতে যেনো কষ্ট হয়,
তুষার, আগুন, দাবানল যেনো সকল সময়
 ঘিরে রাখে, বিষাক্ত শিংকেন, ব্রোট, ভাত,
জুপে, রামকেজে, জাফট; যেনো আসে রাত
 সুন্দরবনের সুন্দর বাঘের মতো; ঘুমহীন চোখে
আমাকেই শুধু দেখো তুমি শূন্য ওই বুকে।
তৃষ্ণায় শুকনো হয়ে খেতে গিয়ে জল
যেনো দেখো গ্লাশ ভ’রে জ্বলে দাবানল।
আমাকে নিশ্বাসে নিও, আমি অম্লজান,
তৃষ্ণা লাগলে দিনরাত গ্লাশ ভ’রে পান
 করো আমাকেই; ঘুম এলে সারারাত ধ’রে
ঘুম যেয়ো আমাকেই উষ্ণ শয্যা ক’রে;
 আমাকে জড়িয়ে ঘুম যেয়ো, ভোরবেলা যেই
 ঘুম ভাঙবে, বারান্দায় ফোটা দেখো আমাকেই।

*

বদলেয়ারের মতো

বদলেয়ার, আধুনিক কবিতার পিতা, উপাসক ছিলেন এক রূপসীর,
যাঁর রূপে দীপ্ত হতো রূপবতী প্যারিসের রাত। সেই দয়াবতী
দয়া করতেন সকলকেই তাঁর উজ্জ্বল সালঁতে ভিড়
জমতো কবি, দার্শনিক, শিল্পী, নানা প্রতিভার। সম্পদেও অতি
 ঋদ্ধ ছিলেন রূপসী, হৃদয়েও, ছিলেন শিল্পিত, এবং উদার।
 তাঁর সালঁতে সন্ধ্যায় পানপাত্র হাতে অনুপ্রাণিত হয়েছে অনেকে, যা এখন
মহৎ শিল্পকলা ব’লে গণ্য। ফ্রান্সের ভবিষ্যৎ মহাকবি বদলেয়ার
তখন যুবক, ক্লেদজ পুষ্পের স্তবে মগ্ন; বেশ্যালয়ে গিয়ে যখন তখন
খুঁজতেন নতুন কবিতা, সঙ্গে দেহ ভ’রে আনতেন সিফিলিস,
 গনোরিয়া, ধ্বজভঙ্গতা; রূপসীর সালয়ঁ, সন্ধ্যায়, গিয়ে তাঁর রূপে
পুড়ে লেখেন একগুচ্ছ প্রেমের কবিতা;- প্রেম আর বিষ
 ভরা উজ্জ্বল কবিতা প্রজ্জ্বলিত করে রূপসীকে। প্রতিভার স্তূপে
পরিপূর্ণ তাঁর সান্ধ্য সালঁয় তিনি দেখতে পান ফ্রান্সের ভাবীমহাকবি।
 রূপসীর বুক কেঁপে ওঠে কবিতায়, তাঁর মাংসে জাগে প্রেম, স্নেহ,
বুঝতে পারেন তাঁর সোনালি দেহের রূপে মুগ্ধ ফ্রান্সের রবি
 তাঁকে চান, সম্ভোগ করতে চান প্যারিসের তিলোত্তমা অপ্সরীর দেহ।
একরাতে রূপবতী বদলেয়ারকে নিজের কক্ষে নিয়ে ধীরেধীরে
নগ্ন হন; দেখা দেয় দুটি চন্দ্ৰস্তন, অগ্নিউরু, নাভি, জংঘা করেন চুম্বন;
 বদলেয়ার ভয় পান পরম সৌন্দর্য দেখে, তাঁর উপদংশগ্রস্ত শরীরে
 নামে জরা, নপুসংকতা, রূপসীর বাহুমুক্ত হয়ে করেন পলায়ন।
আমিও কেঁপেছি তোমার রূপে, ওষ্ঠে চেয়েছি স্তন; সারারাত সঙ্গম
 চেয়েছি; একদিন আমাকে তুমি দান করলে অনিন্দ্য শরীর,
নপুসংক নই, গনোরিয়া, উপদংশ নেই, তবু আমি ওই অসহ্য পরম
সৌন্দর্য দেখে ভয়ে হয়ে উঠলাম একমাত্র ক্লীব পৃথিবীর।

*

এটা যুদ্ধ নয়, কবিতা

যখন আমরা চুমো খাই, দুই জোড়া হাতে
জড়াই শরীর, কাঁপি ভূমিকম্পে, সাথে
কাঁপে দুইটি হৃদয়; দুই জোড়া ঠোঁটে
 সুন্দরবনের নামহীন যতো ফুল ফোটে।
তোমার বগলে রেশমের মতো লোমে
 জমে মুক্তো, আমি চোখ বুজে, ঘুমে,
পান করি। দেখা দেয় মনোরম জ্বর,
তোমার বুকের চন্দ্র, শুকতরা, কাঁপে থরথর;
রক্তজবার বনে প’ড়ে যায় সাড়া,
গোপন নিৰ্বরে ঝরে ভাইনের ধারা।
প্রস্তুত আমরা, ঢুকি স্বপ্নের ভেতর,
পদ্মানদী দুলে ওঠে আশ্বিনের ঝড়ে।
এটা যুদ্ধ নয়; বসন্তের কোমল বাতাস,
 শরীরে অর্গ্যান আর লিরিকের শ্বাস;
ধীর মাইন, শান্ত ঢেউ, অবিরাম, স্থির,
ঘুমের অধিক ঘুম, কোনো লাজুক কবির
গুপ্ত পান্ডুলিপি। এটা যুদ্ধ, হানাহানি নয়,
এতে নেই রক্তপাত- জয়, পরাজয়।
এটা নয় নাসার অস্ত্রশস্ত্র, সফট্‌ওয়ার,
 উদ্যত, স্বয়ংক্রিয়, যা দিয়ে বারবার
ধ্বংস করা যায় নীলগ্রহ, যুগল টাওয়ার,
এটা মৃদু বায়ু, পাপড়ি, পুষ্পের শৃঙ্গার।
এটা নয় ফ্রাংকরাইশ-ডয়েচলান্টের কাম-ব্যাকরণ,
 এটা স্বপ্ন, মাইনের ঢেউ, একটুকু ছোট্ট মরণ।
 এটা ছবি আঁকা, দুজনের দেহে লেখা দুজনের ছবি,
লিরিক, কবিতা, লিটার, যাতে দুজনেই কবি।

*

বন্ধু

আপনি নারী, বান্ধবী বলাই বাঙালির সামাজিক রীতি অনুসারে
 ঠিক হতো; আমরা বন্ধু, প্রেমিকট্ৰেমিক নই; সরষে ক্ষেতের ধারে
দাঁড়িয়ে পেতেন সুখ যখন ছিলেন বালিকা, ভরতেন গন্ধে, যেমন আমিও। জলে
সাঁতরিয়ে পেতেন প্রবল সুখ সারাদেহে, যদিও আপনার অত্যন্ত নিষিদ্ধ
ছিলো পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়া, নগ্ন সাঁতরানো; আমার জন্যে খুবই সিদ্ধ
ছিলো, আমি ন্যাংটো সাঁতার কেটেছি, আপনি পারেন নি। আমগাছে উঠে
পেতেন পরম সুখ আম পেড়ে, যদিও নিষেধ ছিলো; আপনিও ছুটে
যেতে চাইতেন মাঠে, উড়োতে চাইতেন ঘুড়ি; যদিও আপনাকে
 আটকে রাখতো ধার্মিক সমাজ, রাষ্ট্র; আমি ছিলাম স্বাধীন, এবং আমাকে
নিয়ে স্বপ্ন দেখতো সবাই; আপনাকে নিয়ে কেউ স্বপ্ন দেখতো না।
আপনি ছিলেন রাঙ, তামা, ছাই, খাদ, দস্তা; আমি অতি মূল্যবান সোনা।
 ক্লাশে প্রথম হতেন, সেটা তুচ্ছ, হাস্যকর, নিরর্থক, আমিও প্রথম হতাম,
 আমার গৌরব বাড়তো, আপনার কমতো, যদিও আমরা ছিলাম
একই দশকের; আপনাকে পেরোতে হয়েছে বহু ঝড়, অগ্নি, কালবৈশাখি,
 লুটিয়ে পড়েছেন ডাল থেকে ডানাভাঙা, বজ্রে পোড়া, এক পাখি,
ছিন্নভিন্ন, তবু অপ্রতিরোধ্য বিস্তীর্ণ আকাশে মেলেছেন ছেঁড়া পালকের ডানা,
যদিও আকাশ কতো বড়ো, নীল, আপনার ছিলো সম্পূর্ণ অজানা।
আমার আকাশ ছিলো, আপনার জন্যে ছিলো খাঁচা, ও খোয়াড়;
আকাশে উড়েছি আমি অবাধে, আপনার স্বপ্নগ্রস্ত ডানা ভেঙেছে বারবার,
তবু উড়েছেন একলা আকাশে; হয়েছেন নিজেই ঈগল,
 নিচে তুচ্ছ, খড়কুটো, জঞ্জাল, শুয়োরপাল, কেঁচো, প্রসারিত মল।
 দেখা হলো সুসময়ে যখন আমরা শূন্য, হাত খালি, তাই ভরা, চাই না কিছুই,
 সমস্ত চাওয়ার শেষ, এক অপূর্ব সময় আমাদের, অতীতের বিছানায় শুই;
 আপনার মুখে দাগ সময়শিল্পীর; আমি এক ক্লান্ত সাফল্যমণ্ডিত প্রাণী,
 হাঁটতে গিয়ে থামি, থামতে গিয়ে হাঁটি; শুধু এটুকুই জানি
নেই ভবিষ্যৎ, যদিও সফল; ঠোঁট নষ্ট, হৃৎপিণ্ড মৃত, শিশ্ন নপুংসক,
 দেখা হলো, আপনি বালিকা হয়ে উঠলেন, আমি ধানখেতে গ্রাম্য যুবক।
 সরষের সুগন্ধ চারদিকে, ঝাঁকেঝাঁকে পাখি, চৈত্রের আমের মুকুলে
দুলে ওঠে বাল্যকাল; কিশোরী আপনি আমার হাতে তুলে
দিলেন লুপ্ত বকুলের গন্ধ, পৌষের পূর্ণিমা, হিজলের ঢেউ, আশ্চর্য বেতুল,
জাম, সবুজ পেয়ারা, আমরোজ, কামরাঙ্গা, বন্য ধুতরার ফুল,
 ইলশের স্বাদ, দিঘি, মেঘ, নদী, ঢেউ, ঘাসফুল, গাব, শিমুলের মন,
কাঁঠালচাঁপার গন্ধ, ছড়ানো শিউলি, শাপলা, পাখিডাকা বিল ও কাঁঠালের বন।

*

কষ্ট পেয়ো না

আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না; আমি চমৎকার আছি।
থাকো উৎসবে, তোমাকে তারাই পাক কাছাকাছি
 যারা তোমার আপন; আমি কেউ নই, তোমার গোপন
 একান্ত স্বপ্ন; স্বপ্নের ভেতরে কেউ থাকে কতোক্ষণ?
তোমার রয়েছে বারিধারা, উত্তরা, সিলেট, বগুড়া,
চাইনিজ, সন্ধ্যায় সোনারগাঁও, তীব্র অনুরাগীদের সুরা;
আমি কেউ নই; আমি টেলিফোনে মিনিট কয়েক,
 তারপর স্তব্ধতা; তোমার চারদিকে সহস্র শতকে
ভক্ত, ভক্তি, স্তব; পার্টি, আরো পার্টি, আরো নিমন্ত্রণ,
 কতো হাত, তৃষ্ণার্ত ওষ্ঠ, বাহু, হয়তো ভ্রমণ
দুপুরে বিকেলে; ঘিরে আছে তোমাকে তোমার
 প্রিয় ও হৃদয়জনেরা; এমনকি তোমার ড্রাইভার।
আমি কেউ নই, এক নপুংসক, গুপ্ত, বিষণ্ণ প্রেমিক,
 যাকে তুমি দিয়েছিলে সব- দেহ, প্রেম, আন্তরিক
ওষ্ঠ, এখন ব্যস্ত তুমি আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না,
আমি একা বুনে যাচ্ছি কল্পনার অসম্ভব সোনা;
যখন উৎসবে থাকো ভুলে যেয়ো সম্পূর্ণ আমাকে,
একদিন আপাদমস্তক নীলগ্রহ দিয়েছিলে যাকে।
বেশ আছি, সুখে আছি; যদিও বিন্দু বিন্দু বিষ
জমে বুকে, শুনি ধ্বনি, বলেছিলে, ‘ইশ লিবে ডিশ।’

*

তরুণীরা

তারা ঠিক জানে আমার কিছুই নেই তবু আসে মাঝেমাঝে,
হয়তো কোথাও পোড় খেয়ে, পেইনকিলার নিতে; তাদের হৃদয়ে বাজে
হয়তো যন্ত্রণা; আমি জানতে চাই না; ভাসে, এসেই জড়িয়ে ধরে
অনেকেই, কেউ ডোবে আলিঙ্গনে, কেউ ওষ্ঠে, তাদের প্রচণ্ড ঠোঁট ভ’রে
মৌচাক; অনেকে গন্ধম মেলে দেয়, পাকা, কাঁচা, কম্পিত বোঁটায়
 চেপে ধরে বিহ্বল ওষ্ঠ, কাঁপে, গলে, ভাসে, ফোঁটায় ফোঁটায়
ঝরে মধু ঝর্না থেকে; কেউ আবার সুদূরে হাত রাখে, মুখে ভ’রে নেয়,
পান করে ঘন দুধ, প্রশিক্ষিত, চোখ বুজে; নরকে আমাকে দেয়
 স্বর্গের ভূমিকম্প; অনেকেই দূরযাত্রী, ফিজি থেকে হনুলুলু, সুদূর ভ্রমণ
চায়, আফ্রিকার বাঘিনীর মতো চায় ব্যাঘ্রের দৃঢ় দীর্ঘ আক্রমণ।
কেউ একবার এসেই হারিয়ে যায়, কেউ দু-বার তিনবার,
 চট্টগ্রাম, নিউইয়র্ক, কার্ডিফ, হেসে, শ্রীমঙ্গল, বারিধারা, ধানমণ্ডি, সাভার
 টেকনাফ থেকে; কেউ কাঁদে, কেউ মধ্যরাতে ফোন করে বিকেল বেলায়
 আসবে ব’লে; কিন্তু আসে না; হয়তো আকস্মিক মধুর খেলায়
মেতে থাকে অন্য কোনোখানে। কেনো আসবে এখানে?
তারা যতোই ব্যর্থ হোক, দুঃক্ষ পাক, এমআর করুক, তবে ঠিক জানে
আমি ভবিষ্যৎহীন; যতোই বিদ্যুৎ দিই, তবুও পারি না কিছু দিতে,
তারা চায় পেট ভ’রে পুত্রকন্যা, নাচতে চায় সংসারসঙ্গীতে।
 কেউ নম্বর দেয় গ্রামীণের, অ্যাকটেলের, টিঅ্যান্ডটির, কেউ চেপে রাখে
সব কিছু আমি জানতে চাই না, তারা, দয়াবতী, সবাই আমাকে
কিছু কিছু দেয়- স্বপ্ন, কল্পনা; কেউ ঢুকতেই একটি কবিতা ঢোকে সাথে;
যখন ঘুমের অভাব হয়, গড়াই শয্যায়, সেই ভয়ঙ্কর রাতে
 মনে পড়ে কারো মুখ, কারো ঠোঁট, কারো ফল, কারো মধুর শিৎকার;
 সবাইকেই ধন্যবাদ- দু-একজন হঠাৎ পংক্তি হয়ে ওঠে কবিতার।

*

তোমার অসুখগুলো

বহু অসুখ তোমার; মাথা ধরে প্রত্যেক সপ্তাহে
অন্তত তিনবার; এস্কেলেটরে উল্টে প’ড়ে পায়ে,
মেরুদণ্ডে ব্যথা পেয়ে একমাস থেকেছো শয্যায়;
 হাড়েও অসুখ, ডাক্তার বলেছে তোমার মজ্জায়
একটু অভাব বিশেষ বস্তুর; দুটি বৃক্কও দুর্বল,
হয়তো বদলাতে হবে; চোখে কষ্ট, অকস্মাৎ জল
দেখা দেয় চোখে; সামান্য গরমে দেহে লাল লাল
দাগ দেখা দেয়, এবং ঠাণ্ডায় চিবুক ও দুই গাল
 নীল হয়ে ওঠে; ঘুমোতে কষ্ট হয়, বটিকা প্রচুর
 খেয়ে শুতে যাও, আর ঘুম ভাঙে যখন দুপুর।
 হৃৎপিণ্ড ব্যথা করে, কখনো নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়,
 প্রচুর দুঃস্বপ্ন দেখো, ইঁদুর, বেড়ালকেও ভয়
পাও; স্তনেও অসুখ, ডান স্তনে এক ছোট্ট গোটা
দেখা দিচ্ছে, এবং শিথিল হচ্ছে বাঁ দিকের বোঁটা।
পাঁচটি চশমা লাগে, খেতে হয় ফলের পানীয়,
আপ্রিকোজে, গেমিজে, যদিও ভাতই প্রিয়।
তোমার অপূর্ব কণকচাঁপার সুগন্ধি শরীরে
অসুখের উৎসব, সমারোহ; অজস্র অসুখ ঘিরে
আছে তোমার সুন্দর দেহ; একটু বৃষ্টিতেই কাশো;
তবে তোমার প্রধান অসুখ- আমাকে ভালোবাসো।

*

নপুংসক

একজন বলে, তোমার অসুখ আছে, একটুও পারো না।
কী ক’রে পারবো? তুমি মনে করো এটা ব্লিটসক্রীক, লৌহ ও সোনা
দিয়ে প্রস্তুত আমার ট্যাংক; তুমি অসামান্য সৌন্দর্যমণ্ডিত,
তোমাকে দেখলেই আমি কামানের মতো হয়ে দ্বিখণ্ডিত
করবো তোমাকে। তোমার ঠোঁটের স্বাদে বগলের ঘামে
 যখন পাগল হই তুমি শুধু নিজেকে ছড়িয়ে দিয়ে কামে
প’ড়ে থাকো কাদামাটি। কখনোবা যুদ্ধে ওঠো মেতে,
মহাযুদ্ধ চাও, তুমি লড়াই শিখেছো, আর আমি ধানখেতে
প’ড়ে থাকি ব্যর্থ রাখালের মতো। আরেকজন বলে, তুমি গীতিময়
কবিতার মতো, ছন্দমিলে অনবদ্য, তোমাকে যেটুকু সময়
পাই তা-ই তো জীবন; তুমি কদমের গন্ধ, ইস্কুলের চৈত্রের বকুল,
আমাকে জাগিয়ে তোলো, নিজেকে মনে হয় নামহীন ফুল
সুন্দরবনের, কাশবন, সরষে ক্ষেত, চাঁদ, আশ্বিনের নদী,
বয়ে যাই ধীরেধীরে, ঘোলা জলে, ঘূর্ণিপাকে, ইলিশে পাঙ্গাশে নিরবধি
পরিপূর্ণ হয়ে উঠি; তোমার রাজাধিরাজ দৃঢ়, মহাকবি, ধীরস্থির,
 মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষরে লেখা কাব্য, মহাকাব্য হয়ে ওঠে আমার শরীর।
একজন বলে, তুমি তো পারো না, তুমি নপুংসক,
আরেকজন বলে, আমি তো রাখালি, তুমি ঘাসক্ষেতে রাখাল যুবক।

*

কষ্ট পেলে

কষ্ট পেলে আজকাল আর কষ্ট পাই না; মনে করি
 এটাই প্রাপ্য ছিলো- পেয়েছিও; তুমি আসবে বলেছিলে, তাই ঘড়ি
দেখি দু-একবার, তারপর দেখি না। পুরো একা ব’সে থাকি,
কিছু ভাবি ও ভাবি না; নিজেকেই সঙ্গী ক’রে রাখি।
 যখন চুম্বন করো, দাও মধু, মুহূর্তের জন্যে অমরতা,
তখনও বিষের কথা ভাবি, হয়তো কালকেই বিষের মত্ততা
বইবে শরীরে; তুমি একা নও, আরো কতো জন
এনেছিলো বকুলের গন্ধ, বিকেলের রোদ; তারা কোথায় এখন
 তাও জানি না, যদিও মনে পড়ে মাঝেমাঝে। হয়তোবা তারা
এখন সুগন্ধ, স্বপ্নহীন, রক্তশূন্য; শুকিয়েছে কবিতার ধারা
 তাদের নদীতে; হয়তো কেউ সিডনিতে, অসলোতে, বার্লিনে,
 মাইন নদীর তীরে, পঞ্চগড়, রংপুর, ধানমণ্ডি, সিঙ্গাপুর, জাপানে ও চীনে।
শুধু পাবো, এটা রীতি নয়; হারানোও প্রকৃতির রীতি,
 হারানোর পরও পাওয়া যায়, কোকিলের পর শালিখ ও দোয়েলের গীতি
শোনা যায়, ঘুম ভেঙে হঠাৎ স্বপ্নে কাঁপাকাঁপা বুকে সুখ লাগে,
 শূন্যতাও শূন্য নয়, অঘ্রাণে ঘাসের মতো দল মেলে জাগে
নতুন সবুজ। তুমি সরিয়ে নিয়েছো দেহ, ব্যাকুল হৃদয়,
সোনালি চিবুক, গ্রীবা, মধুময় ধ্বনির কম্পন, অনেকটা ক্ষয়
 হচ্ছি অত্যন্ত ভেতরে, কষ্ট পাচ্ছি, হয়তোবা অন্য কোনো সুখকর বুকে
 তুমি আজ পুলকিত; তোমার অভাবে কোনো প্রচণ্ড অসুখে
ভুগছি না; কিন্তু কি ভুগছি না? ভুলিনি তোমাকে, ভুলবো না; সুলতানা
তোমার শরীর, মুঘল কুমারী, অনেকের স্বপ্ন, দুষ্প্রাপ্য, জানা
 আছে বহু দিন, তুমিই বলেছো; তবু একটু সন্দেহ
জাগে, তুমি কোথায় এখন? কোথায় তোমার হৃৎপিণ্ড, আঙুরের দেহ?

*

বুকের ভেতরে

যদি জানতে আমার ধানক্ষেতে, আম আর বাঁশবনে
 কতোটা বইছে ঝড়, জমছে গরল; হৃৎপিণ্ডের খড়ে আর শনে
 কতোটা আগুন জ্বলছে দাউদাউ, কতোখানি ছাই
 জমছে রক্তের স্তূপে; উপড়ে পড়ছে কতো আম, জাম, জলপাই
গাছ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ছে কতো ঘরবাড়ি,
ইট কাঠ পাথরের নিচে প’ড়ে আছে মৃত, এলোমেলো, সারিসারি
 কতো লাশ, বিকলাঙ্গ শিশু; যদি জানতে কতো উচ্চ রক্তচাপে
 দেহের প্রত্যেক কণা, চোখ, হাত, গ্রহতারা কাঁপে;
 জীবনকে অতিশয় তুচ্ছ মনে হয়, ইচ্ছে করে লাশকাটা ঘরে
নামহীন প’ড়ে থাকি, যদি জানতে কতোখানি জ্বরে
গোলাপ শুকোয়, পৃথিবীকে মনে হয় একদলা
 থুতু, সত্যতাকে মনে হয় উপদংশ, গনোরিয়া, কুষ্ঠরোগে গলা
কুৎসিত ভিখিরি, তাহলে বিকেলের বহু আগে এসে,
জড়িয়ে ধরতে সেদিনের মতো ভালোবেসে।

*

কৃতজ্ঞতা

এখন দিচ্ছো না, কষ্ট পাচ্ছি; উগ্র দাবানল
জ্ব’লে উঠেছিলো, তা নেভাচ্ছি; ঠাণ্ডা জল
ঢালছি দাউদাউ বনে; রক্তে কলকল বিষ
 মধুর করছি; ভোরে দুটি দোয়েলের শিস
 শিশিরের মতো কাঁপে আঙিনার ঘাসে;
ভুলতে চাই, কুয়াশায় তবু মনে আসে
 একটি মুখ; এখন দিচ্ছো না, একদিন অতি
অভাবিত, লুফটহানসায় উড়ে, দয়াবতী,
 স্বপ্ন এসেছিলে; ছুঁয়েছিলে দশটি আঙুলে,
মাইন নদীর মতো, আর দুলে দুলে
 উঠেছিলে পদ্মা; দিয়েছিলে মিষ্ট আপফেল,
কির্শেন, হিমবেরেন; ভাইনট্রাউবেনের উদ্বেল
 রস খেতে; আমি মত্ত, তৃষ্ণার্ত, আত্মহারা,
খেয়েছি, গিলেছি ধীর ঘন জাফটের ধারা;
তুমি অভাবিত, আপাদমস্তক, ঝলকিত মণি,
কৃষককে দিয়েছিলে গুপ্ত হীরকের খনি।
মনে পড়ে- আজ মাংসে অতীতের ভিড়,
 দুই চোখে ভ’রে আছে সোনালি শরীর।
 সবই তোমার দান, চাই নি কখনো, শুভ্র চঞ্চলতা,
 যা দিয়েছিলে, তার জন্য জানাই কৃতজ্ঞতা।

*

সাঁকো

আমাদের বাড়ি থেকে একটু পশ্চিমে, বেঁকে আসা খালের ওপরে
একটি কাঠের সাঁকো ছিলো; সুন্দর, যদিও নড়োবড়ো, খ’সে প’ড়ে
গিয়েছিলো কয়েকটি কাঠ; আমাদের হাঁটার সময় কেঁপে
কেঁপে উঠতো ঢেউ হয়ে, ওটি পেরোনোর কালে সাবধানে মেপে
মেপে পা ফেলতাম, কখনো ছুটতাম। প্রত্যেক বিকেলে
আমি একবার গিয়ে দাঁড়াতাম সাঁকোর ওপর, একেকবার হেলে
 তাকাতাম নিচের জল ও মাটির দিকে; সাঁকো পার হয়ে যেতে
 ইচ্ছে করতো না, দাঁড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগতো, দূর ধানক্ষেতে
সবুজ ও সোনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, সন্ধ্যা হয়ে এলে
 ফিরতাম বাড়ির দিকে; মনে হতো কাকে যেনো ফেলে
যাচ্ছি, আমাকে ডাকছে সে, তার ডাক শুনতে শুনতে, আড়িয়ল বিলে
 সন্ধ্যা নামা দেখতে দেখতে এসে বসতাম পড়ার টেবিলে।
 ওই সাঁকো পার হয়ে বহু দিন গেছি বেশ দূরে; কখনো ভাগ্যকূলে,
কখনো কামারগাঁও, ফিরে এসেছি আবার; সব কিছু ভুলে
দাঁড়িয়ে থেকেছি তার ভাঙা থাম ধ’রে; মনে মনে
বলেছি অনেক কথা তার সঙ্গে, জ্যৈষ্ঠ আষাঢ়ের আশ্চর্য প্লাবনে
 যখন দুলতে থাকতো, তখনও দাঁড়িয়েছি গিয়ে
 সাঁকোর ওপর; দেখেছি প্রবল জল, ঘিরে, চারদিক দিয়ে
 বয়ে যাচ্ছে; একদিন ওই নড়োবড়ো সাঁকো পার হয়ে বহু দূরে
চ’লে যাই, ভুলে যাই তাকে; লন্ডন এডিনবরা ফার্থ নিউইয়র্ক ঘুরে
 বহু ব্রিজ দেখি; তারা আসামান্য, দীর্ঘ, শক্ত, বিস্ময়কর;
তবু আজ সন্ধ্যাবেলা একটি সাঁকো, নড়োবড়ো, কাঁপছে দেখি বুকের ভেতর।